উনিশ
পরের দিন সকালে খামারবাড়িতে হাল বয়েল নেবার জন্য আসতেই হিমগিরি ধর্মাদের জানায়, ‘আজ তুরন্ত ক্ষেতির কাম চুকিয়ে ফেলবি। সূরয ডুববার অনেক আগে হাল বয়েল এখানে জমা দিয়ে বসে থাকবি। এখান থেকে মুনশীজী তোদের এক জায়গায় নিয়ে যাবে। কানমে ঘুষল্—’
সবাই সমস্বরে জানায়, ‘হুঁ হুজৌর—’
ধর্মার আচমকা মনে পড়ে, অনেকদিন পর কাল বগেড়ির জন্য সাবুই ঘাসের জঙ্গলে ফাঁদ পেতে রেখে এসেছে। খামারবাড়িতে মুনশী আজীবচাঁদের জন্য কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানা নেই। তারপর মুনশীজী কোথায় নিয়ে আরো কতটা সময় আটকে রাখবে তারও ঠিক নেই। রাত বেশি হয়ে গেলে বগেড়ি নিয়ে ঠিকাদারদের কাছে যাওয়া যাবে না। কয়েকটা টাকার যে আশা ছিল তা পুরোপুরি বরবাদ।
ভয়ে ভয়ে ধর্মা শুধোয়, ‘হুজৌর, মুনশীজী আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?’
হিমগিরিনন্দন সরু গলায় খেঁকিয়ে ওঠে, ‘গেলেই দেখতে পাবি। সুরয চড়ে যাচ্ছে। আতী ক্ষেতিতে চলে যা।’
আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না ধর্মার। এই সকালবেলাতেই হঠাৎ তার মাথায় খুন চড়ে যায়। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, কভী নায়, কভী নায়। সূর্য ডোবার আগে হাল-বয়েল জমা দিয়ে মুনশীজীর জন্য সে কিছুতেই বসে থাকবে না। কিন্তু যা ইচ্ছে করে তা কি আর মুখ ফুটে বলা যায়! বিরক্ত অসন্তুষ্ট ধর্মা রাগে ঘাড় গোঁজ করে রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতিতে এসে জমি চষতে শুরু করে দেয়।
অন্য সব দিনের সঙ্গে আজকের কোন তফাত নেই। দুপুর পর্যন্ত একটানা লাঙল ঠেলা, দুপুরে কালোয়া খেয়ে খানিকক্ষণ জিরিয়ে ফের ক্ষেতিতে নেমে পড়া—সব কিছু একই নিয়মে ঘটে যায়। এর মধ্যে হাইওয়ে দিয়ে বড়ে সরকারের ভোটের গাড়ি আর নেকীরাম শর্মার ঘোড়ায়-টানা টাঙ্গা ‘বোট দো’ ‘বোট দো’ করতে করতে বিজুরি তালুকের দিকে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। বড়ে সরকার আর প্রতিভা সহায়ের মতো নেকীরামের জীপ নেই। অগত্যা টাঙ্গায় করেই কয়েকটা ছোকরা তার জন্য ভোট চাইতে বেরিয়েছে।
কাল তবু আকাশে অল্প স্বল্প টুকরা টাকরা মেঘ ভেসে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল। আজ তার ছিটেফোঁটাও নেই। গলা কাঁসার মতো গনগনে আকাশ থেকে জেঠ মাহিনার ঝাঁ ঝাঁ রোদ নেমে আসছে।
বিকেল হতে না হতেই দেখা গেল, লঝঝড় সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে বগুলা ভকত এসে হাজির। অন্য দিন বিদঘুটে টেরাবাঁকা চেহারার সীসম বা পরাস গাছের গায়ে সাইকেলটা ঠেসান দিয়ে রেখে রামলছমন ক্ষেতিতে ক্ষেতিতে ঘুরে সবার কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর বকের মত ঠ্যাং ফেলে ফেলে যুবতী দুসাদিনদের পেছন পেছন ছোঁক ছোঁক করতে থাকে। আজ কিন্তু সাইকেলটা ধরে থেকেই ভীষণ ব্যস্তভাবে চেঁচাতে লাগল, ‘এ গণেরি, এ ধম্মা, এ মাধো আজ আর কাম করতে হবে না। হাল-বয়েল নিয়ে তুরন্ত আমার সাথ চল্—’
শুধু ধর্মাদেরই না, তাড়া দিয়ে দিয়ে মরসুমী আদিবাসী কিষাণগুলোরও কাজ বন্ধ করে দেয় রামলছমন। তারপর সবাইকে নিয়ে সোজা খামারবাড়িতে চলে আসে।
সূর্য ডোবার আগে জমি চষা থামালে বড়ে সরকারের পা-চাটা কুত্তারা যেখানে ক্ষেপে ওঠে, সেখানে আজ কী এমন হল যে কাজ বন্ধ করিয়ে বগুলা ভকত তাদের ডেকে নিয়ে এল!
বড় সড়ক দিয়ে আসতে আসতে গণেরি জিজ্ঞেস করে, ‘কা দেওতা, আজ সূরয ডোবার আগেই কাম বন্ধ করে দিলে কেন?’
রামলছমন দাঁত বার করে বলে, ‘তোদেরই তো দিন এখন গিদ্ধড়েরা। ভোটের পরব এসেছে। পাওকা জুত্তি এবার মাথায় চড়বে।’
ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না। গণেরি বিমূঢ়ের মতো শুধোয়, ‘কা মতলব দেওতা?’
‘চল না, গেলেই বুঝতে পারবি।’
খামারবাড়িতে এসে ধর্মারা দেখতে পায়, শুধু তারাই না, দোসাদটোলার বাতিল বুড়োবুড়ি বাচ্চা-কাচ্চারা গাদা মেরে বসে আছে। দোসাদরা ছাড়াও গারুদিয়া তালুকের দূর দূর গাঁ থেকেও এনে জড়ো করা হয়েছে আরো চার পাঁচ হাজার লোককে। খামারবাড়ির সামনের দিকের রাস্তায় কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ষাট সত্তরটা বয়েল এবং ভৈসা গাড়ি।
এত লোকজন, এত গাড়ি দেখে ধর্মারা তাজ্জব। গণেরি, বুধেরি, ধর্মা অর্থাৎ জমিন থেকে যারা যারা রামলছমনের সঙ্গে এসেছে চাপা নিচু গলায় দোসাদটোলার বাতিল বুড়োবুড়িদের শুধোয়, ‘কা রে, তোরা এখানে?’
বুড়োবুড়িরা জানায়, হিমগিরি লোক পাঠিয়ে তাদের ডাকিয়ে এনেছে।
‘কায়?
‘কা জানে—’
অন্য গাঁয়ের মানুষজনকে জিজ্ঞেস করেও একই উত্তর পাওয়া যায়। তাদেরও লোক পাঠিয়ে ডেকে আনা হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে এতগুলো লোক যোগাড় করা হয়েছে, কেউ জানে না। শুধু বলা হয়েছে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের তলব। তাতেই সুড় সুড় করে সবাই ‘এক মিল’ ‘দো মিল’ ‘তিন মিল’ কি তারও বেশি রাস্তা জেঠ মাহিনার তেজী সূরয মাথায় নিয়ে গৈয়া কি ভৈসা গাড়িতে চেপে চলে এসেছে।
আচমকা হিমগিরিনন্দন তুরপুন চালানো সরু গলায় ধর্মাদের উদ্দেশে চেঁচাতে থাকে, ‘তুরন্ত সবাই হালবয়েল জমা দিয়ে ভৈসা আর বয়েল গাড়িতে গিয়ে ওঠ।’ বলে সামনের গাড়িগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয়।
কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা যায়, শুধু ধর্মাদেরই না, তাড়া দিয়ে দিয়ে হিমগিরি এবং রামলছমন অন্য সবাইকেও গাড়িগুলোতে তুলে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে ষাট সত্তরটা গাড়ি লাল ধুলো উড়িয়ে মিছিল করে চলতে শুরু করে।
এদিকে জ্যৈষ্ঠের সূর্য ডুবে গেছে। গারুদিয়া তালুকের ওপর আবছা অন্ধকার নামতে শুরু করেছে। এতক্ষণ উল্টোপাল্টা বাতাস গরম ভাপ ছড়াচ্ছিল। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক আস্তে আস্তে জুড়িয়ে যাচ্ছে।
একসময় গাড়িগুলো গারুদিয়া বাজারের পশ্চিম দিকের খোলা মাঠে এসে পড়ে। এধারে ওধারে তাকিয়ে ধর্মারা বেজায় হকচকিয়ে যায়। মাঠ জুড়ে যতদূর চোখ যায় অগুনতি মানুষ আগে থেকেই এসে বসে আছে। তা দশ পন্দর হাজার তো নিশ্চয়ই। লোকজনের ফাঁকে ফাঁকে বাঁশের খুঁটি পুঁতে পুঁতে বিজলি বাতি আর লাউড স্পীকারের চোঙ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। চারদিকে শুধু রোশনি আউর রোশনি।
সামনের দিকে লাল সালুর কাপড় দিয়ে মোড়া বিরাট উঁচু মঞ্চ। সেখানে প্রচুর চেয়ার টেবল সাজানো রয়েছে। একদিকে রয়েছে সাদা ফরাস পাতা। গোটা মঞ্চটা এখন একেবারে ফাঁকা।
একটা বয়েল গাড়িতে ধর্মার পাশে বসে ছিল গণেরি। বলে , ‘অব সমঝ গৈল—’
ধর্মা শুধোয়, ‘কা গণেরিচাচা?
‘বড়ে সরকারকা চুনাওকা ‘মীটিন’ হোগা ইধরি। উসি লিয়ে হামনিলোগনকো ইধরি লেকে আয়া—’
‘হুঁ?’
‘হুঁ’
সকালবেলা হিমগিরি তাড়াতাড়ি ক্ষেতির কাজ চুকিয়ে আজ ধর্মাদের চলে আসতে বলেছিল। তাতেও তর সয়নি। দুপুরের তেজ পড়তে না পড়তেই রামলছমনকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এতক্ষণে বোঝা যায়, কেন সূর্যাস্তের আগেই তাদের ক্ষেতি থেকে উঠিয়ে এত খাতির করে গাড়িতে চাপিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
গণেরি চাপা নীচু গলায় বলে, ‘হামনিলোগনকে। বহোত সৌভাগ—’
গণেরির গলার স্বরে এমন কিছু রয়েছে যাতে ধর্মা ঘাড় ফেরায়, ‘কায় চাচা?’
‘আরে মুরুখ গাধধে, গাড়িতে চড়িয়ে মীটিনে নিয়ে এল, আমাদের সৌভাগ না?’
ধর্মা কী বলতে যাচ্ছিল, বলা হয় না। এই সময় কোত্থেকে মাটি ফুঁড়ে মুনশী আজীবচাঁদ, ঠিকাদার অযোধ্যাপ্রসাদ আর কয়েকটা ছোকরা উঠে আসে যেন। জমি চষতে চষতে এই ছোকরাগুলোকে বড়ে সরকারের ভোটের গাড়িতে করে পাক্কী দিয়ে অনেকবার বিজুরি তালুকে যাতায়াত করতে দেখেছে ধর্মারা।
মুনশী আজীবচাঁদ চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘রুখ যা, রুখ যা—’
কাতার দিয়ে বয়েল আর ভৈলা গাড়িগুলো মাঠের একধারে দাঁড়িয়ে যায়। আজীবচাঁদ এবং অযোধ্যাপ্রসাদরা সবগুলো গাড়ির কাছে ছোটাছুটি করতে করতে সওয়ারীদের উদ্দেশ্যে চেঁচাতে থাকে, ‘উতারকে আ, উতারকে আ—’ এর মধ্যে অযোধ্যাপ্রসাদের উৎসাহই সব চাইতে বেশি। বোঝা যায়, এত সব গৈয়া ও ভৈসা গাড়ির ব্যবস্থা সে-ই করেছে।
হুড়মুড় করে গাড়িগুলো থেকে লোকজন নেমে পড়ে।
মাঠের যেখানটায় আগে থেকেই কয়েক হাজার মানুষ বসে পড়েছে সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে আযোধ্যাপ্রসাদরা বলতে থাকে, ‘উধার যাকে বৈঠ। ধীরেসে— ধীরেসে। বড়ে সরকার আভ ভি আ যায়েগা। উসকা বাদ মীটিন চালু হোগা—’
গাড়ি থেকে নেমে ধর্মারা মাঠের ভিড়ে মিশে যায়। মীটিং কখন শুরু হবে তার ঠিকঠিকানা নেই। ধর্মা এবং তার সঙ্গী সাথীরা আগে থেকে যারা এসে বসে আছে তাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। কথায় কথায় জানা যায়, আজ ভোর থেকেই বড়ে সরকারের লোকেরা বয়েল আর ভৈলা গাড়ি পাঠিয়ে তাদের আনিয়ে নিয়েছে। সেরেফ মীটিনকা লিয়ে।
রাত একটু বাড়লে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং তাঁর পা-চাটা কুত্তাদের নিয়ে দামী টমটম চালিয়ে মীটিংয়ের মাঠে চলে আসেন এবং টমটম থেকে নেমে সোজা মঞ্চে গিয়ে ওঠেন। কা তাজ্জবকি বাত, বড়ে সরকারদের পেছন পেছন ফাগুরামকেও দেখা যায়। তার গলায় রঘুনাথ সিংয়ের দেওয়া সেই নতুন ঝকমকে দামী হারমোনিয়ামটা। পরনে নতুন ধুতি কুর্তা পাগড়ী, পায়ে কাঁচা চামড়ার নাগরা। ভোল একেবারে পাল্টে গেছে ফাগুয়ার। সে গিয়ে ফরাসে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়ে। বোঝা যায়, চুনাওর এই মীটিংয়ে বড়ে সরকার কিছু গানবাজনার ব্যবস্থা করেছেন।
বড়ে সরকার এবং তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গীরা মঞ্চের চেয়ারগুলো দখল করে বসে। অযোধ্যাপ্রসাদ ও কয়েকটা ছোকরাও তাঁদের সঙ্গে ওপরে উঠেছিল। তারা গলা ফাটিয়ে মাইকে শ্লোগান দিতে শুরু করে।
‘রঘুনাথ সিংকো—’
‘বোট দো।’
‘রঘুনাথ সিংকো—’
‘বোট দো।’
‘রঘুনাথ সিং এম্লে হোনেসে কা মিলি?’
‘রামরাজ রামরাজ।’
‘হাঁথীমার্কা কাগজ পর—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
লাউডস্পীকারে এইসব কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ে। সারা মাঠ গমগম করতে থাকে।
একসময় শ্লোগান শেষ হয়। মীটিং-এর পরিবেশটা মোটামুটি তৈরি হয়ে যায়। বড়ে সরকারের প্যারা দোস্ত মহকুমার বড় ভকিল গিরধরলালজী ছোকরাদের হাতের ইসারায় সরিয়ে দিয়ে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ান। বলেন, ‘ভাইলোগ আউর বহিনো, আপনারা সবাই জানেন বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংজী এবার গারুদিয়া আউর বিজুরি তালুক থেকে চুনাওতে নেমেছেন। এ আমাদের সবার বহোত বহোত সৌভাগের কথা। ভগোয়ানের দয়ায় আউর রঘুনাথজীর কিরপায় দুই তালুকের হর আদমীর দুখ, কষ্ট, অভাব—বিলকুল সব চলে যাবে। এখানকার সব আদমীর মুখে হাসি ফুটবে। ভুখা-নাঙ্গা কাউকে থাকতে হবে না। তব্ হাঁ, এ সব চাইলে একটা কথা মনে রাখতে হবে। চুনাওতে যাতে বড়ে সরকার জিততে পারেন তার ব্যওস্থা করা দরকার। ভেইয়া আউর বহিনরা, সেই ব্যওস্থা রয়েছে আপনাদের হাতে। আজাদীর পর থেকে আপনারা কতবার চুনাও দেখলেন, কত লোককে এম-এল-এ বানালেন, এম-পী বানালেন। মগর কিছু হল কী? কিচ্ছু হয় নি। চুনাও আসে, চুনাও যায়। আজাদীর আগে আপনারা যেখানে ছিলেন ঠিক সেখানেই পড়ে আছেন। আপনাদের দুখ দেখে বড়ে সরকার মনমে বহোত দুখ পান। তাঁকে অনেক বলে কয়ে হাতে-পায়ে ধরে এবার আমরা চুনাতে নামিয়েছি। হাতীমার্কা কাগজে মোহর মেরে তাঁকে জেতান। মনে রাখবেন, বড়ে সরকার জিতলে গারুদিয়া আউর বিজুরি ভালুকে জরুর রামরাজ নেমে আসবে।’ বলেই হাতের ইসারায় সেই ছোকরাগুলোকে ডেকে শ্লোগান দিতে বলেন গিরধরলালজী।
মঞ্চের পেছন থেকে ছোকরাগুলো মাইকের কাছে এসে আবার শ্লোগান দিতে থাকে।
‘হাঁথীমার্কা কাগজ পর—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
‘রঘুনাথ সিং জিতনেসে কা মিলি—’
‘রামরাজ, রামরাজ ‘
দ্বিতীয় প্রস্থ শ্লোগানের পর গিরধরলাল ফের বলেন, ভেইয়া আর বহিনরা, আপনারা সবাই শুনেছেন, এবার চুনাওতে রঘুনাথজী ছাড়া আর যারা নেমেছেন তারা হল প্রতিভা সহায়, নেকীরাম শর্মা, সুখন রবিদাস আউর আবু মালেক। মনে রাখবেন দুখ-কষ্ট-অভাব, এ সবের হাত থেকে বাঁচতে হলে রঘুনাথজীকে ভোট দিতেই হবে। মনে রাখবেন হাতীমার্কা কাগজে মোহর মারতে হবে। বলেই আকাশের দিকে হাত তুলে গিরধরলাল চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘রঘুনাথ সিং—’
সেই ছোকরাগুলোকে আগে থেকেই শেখানো ছিল। তারা একসঙ্গে হাত ছুঁড়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘যুগ যুগ জীও— ‘
‘রঘুনাথ সিং—’
‘যুগ যুগ জীও।’
‘বাঁচনা হ্যায় তো—’
‘হাঁথীমে মোহর।’
‘বঁচনা হ্যায় তো—’
‘হাঁথীমে মোহর।’
মীটিং সরগরম করে বড় উকিল গিরধরলাল বলেন, ‘ভেইয়া আউর বহিনরা, এবার বড়ে সরকারের মুখ থেকে আপনারা কিছু শুনুন—বলেই নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে গিয়ে বসে পড়েন।
রঘুনাথ সিং তাঁর বিপুল শরীর নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে মাইকের সামনে এসে দাড়ান। তাঁর চেহারার যা বছর তাতে ‘হাতী’র প্রতীকটি বড়ই মানানসই হয়েছে। মাইকের ডাঁটিটা ধরে তিনি বলেন, ‘ভাইরা আর বহিনরা, আমি আগে কিছু বলব না। আমার বলার আগে থোড়াকুছ গানাবাজনা হবে। গারুদিয়ার কোয়েল ফাগুরামকে তো আপনারা চেনেন।’
কয়েক হাজার শ্রোতা সমস্বরে চিৎকার করে জানাল, ‘হুঁ-হুঁ, সরকার। ও নৌটঙ্কীবালা—’
‘হা—নৌটঙ্কীবালা। ওর গলার আওয়াজ বঢ়ী মিঠি। ফাগুরাম ক’টা গান বেঁধেছে। আগে সেই গানগুলো শুনে নিন।’ বলে ফাগুরামের দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিত করেন।
সঙ্গে সঙ্গে দু হাতের দশ আঙুল চালিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতে শুরু করে ফাগুরাম। তার সামনেও একটা মাইক রয়েছে।
ফাগুরাম নৌটঙ্কীবালার নাম জানে না, বিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে এমন লোক নেই। নেহাত কয়েক সাল ফাগুরামের খারাপ সময় যাচ্ছে। বুকের দোষ হওয়াতে এখন আর নৌটঙ্কীর আসরে গাইতে পারে না। তবে আগে যারা একবার তার গান শুনেছে, এখনও ভুলতে পারেনি। গারুদিয়া বাজারের গায়ে এই চুনাওর মীটিংয়ের কয়েক হাজার শ্রোতা চনমনিয়ে উঠে পিঠ খাড়া করে বসে।
একসময় বাজনা থামিয়ে ফাগুরাম বলে, ‘বড়ে ভকীলজীর মুহমে আপনারা শুনেছেন, এহী সাল চুনাওতে নেকীরাম শর্মা, পরতিভা সহায়, সুখন রবিদাস, আবু মালেক নেমেছে। আমি এদের নিয়ে গানা বেঁধেছি। সিরিফ মালেকসাব বাদ। মালেক সাবের গানা পরে বেঁধে সবাইকে শোনাব।’ বলেই ফের হারমোনিয়ামে ঝড় তুলে বাজাতে শুরু করে। ‘আ আ’ করে সুরটাকে গলায় বসিয়ে গানও ধরে:
বোল প্যারে বোল প্যারে
রঘুপতি রাঘব রাজারাম—
শর্মাজীকো দেখিয়ে
ভুল ধরমকা জ্ঞেয়ান।
চারো হাতসে সুদ মাঙতা,
সুদমেই পুরা ধেয়ান।
ভোট মাঙনে আয়ে হে
হোতে সব হয়রান।
বোল প্যারে বোল প্যারে ……..
গানের সঙ্গে সঙ্গে সেই ছোকরাগুলো মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে তালে তালে দু হাতে তালি বাজাতে লাগল। তেজী বিজলী আলোয় দেখা যাচ্ছে বড়ে সরকার মুখ টিপে টিপে হাসছেন। তাঁর সঙ্গীদের মুখেও হাসি। বোঝা যায়, ফাগুরামের গান শুনে তাঁরা পরিতৃপ্ত।
শ্রোতারাও খুব হাসছিল। গণেরির পাশে বসে হেসে হেসে গড়িয়ে পড়তে থাকে ধর্মা। সে বলে, ‘ফাগগুচাচা বহোত আচ্ছাই গান বেঁধেছে। কা মজাদার!’
এখানে বলে নেওয়া দরকার, নেকীরাম শর্মা স্কুলে পড়ালেও তার গোপন সুদের ব্যবসা আছে। এ অঞ্চলের বিখ্যাত সুদখোর সে। তার কাছ থেকে ‘করজ’ নিলে ফী মাসে টাকায় আট আনা সুদ। গারুদিয়ার কত লোকের রক্ত চুষে চুষে সে যে ছিবড়ে করে দিয়েছে তার হিসেব নেই।
ফাগুরাম এবার তার দু নম্বর গান শুরু করে।
কায়াথকুলকি পরতিভা
হ্যায় নখরোকি খান
ভোট মাঙনে আয়ী হ্যায়
হাঁসে সকল জাহান।
পরতিভাকে ভোট দেনেসে
হো যায়গা বাজরাজ (বাজা মেয়ে মানুষের রাজত্ব)।
বোল সখী বোল সখী
ক্যায়সে মিলে রামরাজ।
হাততালির তোড় এবার বেড়ে যায়। মঞ্চের সেই ছোকরাগুলোই না, শ্রোতাদের মধ্যেও সংক্রামক ব্যায়রামের মতো তা ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
পয়সাওলা বড়ে ঘরকা বহু আঁটকুড়ো প্রতিভা সহায়কে এবারকার চুনাওয়ে ভোট মাঙবার জন্য দু-চারটে গাঁওয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। তাঁর সাজগোজ ঠাটঠমকই অন্যরকম। ফাগুরাম তাঁর চালচলনকে খোঁচা দিয়ে এই গান বেঁধেছে।
ভিড়ের ভেতর আর সবার সঙ্গে প্রাণভরে হেসেই যাচ্ছে ধর্মা। ফাগুরাম এবার তিসরী নম্বর গান শুরু করে;
চুনাওরাজমে দেখিয়ে
হ্যায় আচরজকে (আশ্চর্য) খান
চোরচামারকি জাত হ্যায়
সুখন দাস মহান।
বোল প্যারে বোল প্যারে
রঘুপতি রাঘব রাজারাম।
জাতপাতের দারুণ কড়াকড়ি এখানে। নিজে অচ্ছুৎ ভূমিদাসদের বংশধর হয়েও রঘুনাথ সিংয়ের জন্য আরেক অচ্ছুৎকে নিয়ে গান বানিয়েছে ফাগুরাম হাজার হাজার অচ্ছুৎ, ভূখানাঙ্গা জনমদাস, মরসুমী কিষাণ, নিভূম ক্ষেতমজুর এই গানের ভেতর কী আছে, তলিয়ে বোঝে না। বুঝবার শক্তিও নেই। গানটার বাইরের দিকে যে গাঁজানো মোটা রসের মজা আছে তাতেই তারা খুশী। তারা হাসতেই থাকে।
চার নম্বর গানটা ধরার আগে হারমোনিয়াম থামিয়ে মাইকের কাছে মুখ এনে ফাগুরাম বলতে থাকে, ‘শর্মাজী, পরতিভাজী আউর সুখন দাস ক্যায়সা আদমী, আপনারা জানেন। তবু আরেক বার মনে করিয়ে দিলাম। এইসব আদমী চুনাওতে জিতে এম্লে বনলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আভি শুনিয়ে—’ বলে রঘুনাথ সিংয়ের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে গান ধরে ফাগুরাম:
আপ রঘুনাথ সিং হ্যায়
ছত্রিয়কুল প্রধান
ভোট দীজিয়ে সরকারকো
হোগা সব কল্যাণ
বোল প্যারে বোল প্যারে
রঘুপতি রাঘব রাজারাম।….
গান থামার পর সেই ছোকরাগুলো ফের হাতী চিহ্নে মোহর মেরে রঘুনাথ সিংকে চুনাওতে জেতাবার জন্য শ্লোগান দিতে থাকে।
শ্লোগানের পর রঘুনাথ সিং ফের মাইকের সামনে দাঁড়ান। আবার বলতে শুরু করেন, ‘ভাইয়া আউর বহিনরা, আপনারা গিরধরলালজীর কথা শুনেছেন, ফাগুরামের গান শুনেছেন। শুনে প্রতিভা সহায়, নেকীরাম শর্মা, সুখন রবিদাস—এরা কীরকম আদমী, জরুর বুঝতে পেরেছেন। নেকীরাম বামহন হয়েও সুদখোর, যে তার কাছ থেকে করজ নেয় সে তার খুন চোষে। সুখন দাস অচ্ছুৎ, সে জন্য আমি তাকে ঘেন্না করি না, তার নামে উচা জাতের লোকেদের মতো তিনবার ‘থুক’ দিই না। তবে ও জানে কী? বোঝে কী? এম-এল-এ হওয়া কি সোজা ব্যাপার? ছেঁড়া জুত্তি কি রামচন্দরজীর সিংহাসনে উঠতে পারে? আর ঐ প্রতিভা সহায়? বড়ে ঘরকা বহু। মোটরিয়া ছাড়া এক কদম ফেলতে পারে না। হাজার রুপাইয়ার কমে শাড়ি পরে না। শহরবালী পাইসাবালী ঔরতের শখ হয়েছে চুনাওতে নামবে। লেকেন ও ভুখানাঙ্গা গরীব গাঁওবালা ভারতবাসীর দুঃখকষ্ট কী জানে! এর আগে ক’রোজ ও গাঁওমে এসে থেকেছে! কোনটা ধানগাছ, কোনটা গেহুঁ গাছ, ও ফারাক করতে পারবে? ও ঔরত কভ্ভী সড়কের চায় দুকানে বসে কিষাণদের সঙ্গে চায় খেয়েছে; কভ্ভী গাঁওকা ক্ষেতিসে নহরকা বগলমে টাট্টী কী? ও আপনাদের কেউ নয়, ওর সঙ্গে আপনাদের কোঈ সম্পর্ক নেহী। একটা কথা শুধু বলে রাখি, আমিই একমাত্র আপনাদের লোক—আপনা আদমী। জনম থেকে আপনাদের পাশাপাশি এই গাঁওমেই আছি। আপনাদের ছেড়ে কোনদিন শহরে চলে যাই নি। আমি জানি আপনা-পরায় চিনে নিতে ভুল করবেন না আপনারা। আমার কথা খতম। ভাইরা আউর বহিনরা, সবাইকে পরণাম। কেউ পায়দল চলে যাবেন না। আপনাদের জন্যে গাড়ি মজুদ রয়েছে। আপনাদের সবাইকে ঘরে পৌঁছে দেবে। পরণাম, পরণাম—’
রঘুনাথ সিং মাইকের কাছ থেকে সরে যান। সেই ছোকরারা আরেক বার গলার শিরা ছিঁড়ে শ্লোগান দিতে থাকে।
‘রঘুনাথ সিংকো—’
‘বোট দো।’
‘হাঁতী মার্কামে—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো।’
মধ্যরাতের কিছু আগে আগে গৈয়াগাড়িতে ফিরে আসছিল ধর্মা। তার পাশাপাশি বসে আছে আধবুড়ো গণেরি। সামনে পেছনে আরো শ’খানেক গাড়ি চলেছে। দিগন্ত জুড়ে এক শো গাড়ির ছশো চাকায় অনবরত ক্যাঁচকোঁচ শব্দ হতে থাকে।
গোটা রাস্তাটা এখন সরগরম। চাকার আওয়াজ তো আছেই। তা ছাড়া প্রতিটি গাড়িতেই রঘুনাথ সিংয়ের এই ‘চুনাওকা মীটিন’ নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা চলছে।
ক’দিন আগেই পূর্ণিমা গেছে। আকাশের মাঝখানে রুপোর প্রকাণ্ড কটোরার মতো গোল চাঁদ তখন চোখে পড়ত। এখন চাঁদটার বারো আনা ক্ষয়ে ক্ষয়ে সিকিভাগে এসে দাঁড়িয়েছে।
রাস্তার দু’ধারে অবারিত শস্যক্ষেত্র। দূরে দূরে ঝাপসা দু-একটা দেহাত ঘুমে অসাড় হয়ে আছে। চারপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে লক্ষ কোটি জোনাকি উড়ছে।
ধর্মা হঠাৎ ডেকে ওঠে, ‘চাচা’
দুই হাঁটুর ফাঁকে থুতনি গুঁজে বসে ছিল গণেরি। মুখ তুলে সে বলে, ‘কা?’
‘ফাগগু চাচা বহোত আচ্ছা গাইল আজ। গানগুলোও আচ্ছাই বেঁধেছে। না গণেরি চাচা?’
গম্ভীর গলায় গণেরি বলে, ‘তা বেঁধেছে।’
‘লেকেন আমি ভাবছি অন্য কথা।’
‘কী?’
‘ফাগগুটার জান চৌপট না হয়ে যায়।’
ধর্মাকে এবার চিস্তিত দেখায়। ভীতু গলায় সে শুধোয়, ‘কায় চাচা?’
গণেরি এবার যা বলে তা এই রকম। যাদের খোঁচা দিয়ে ফাগুরাম এই সব গান বেঁধেছে তারাও পাইসাওলা বড়া আদমী। এই গান শুনে নিশ্চয়ই তারা খুশী হবে না। ফাগুরাম বাড়াবাড়ি করলে তার বিপদ ঘটে যেতে পারে।
ধর্মার আচমকা মনে পড়ে যায়, খানিকক্ষণ আগে চুনাওর মীটিংয়ে ফাগুরামের গান শুনে সবাই যখন হেসে গড়িয়ে পড়ছিল, গণেরি তখন থমথমে মুখে চুপচাপ বসে ছিল। তা ছাড়া সেদিন বড়ে সরকার যখন ফাগুরামকে ডাকিয়ে প্রতিভা সহায়, নেকীরাম শর্মাদের নামে গান লেখার দায়িত্ব দেন তখনও তার দুশ্চিন্তার কথা বলেছে গণেরি।
চুনাওর এই সব গানের মধ্যে শুধু হাসি আর মজাই নেই, মারাত্মক বিপদও রয়েছে। ফাগুরামের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হঠাৎ অস্থির হয়ে ওঠে ধর্মা।
একসময় কয়েকটা গৈয়াগাড়ি দোসাদটোলায় পৌঁছে যায়। বাকীগুলো গারুদিয়া তালুকের নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।