আঠার
হিমগিরির সঙ্গে রাত কাটিয়ে পরের দিন ভোরে ফিরে এসে প্রথমেই গণার খোঁজ নেয় নওরঙ্গী। গণা এবং তার মাকে না পেয়ে একাই গলা ফাটিয়ে শোর তুলতে তুলতে দোসাদটোলা মাথায় তুলে ফেলে।
একটু পর গণার উধাও হবার খবরটা কীভাবে যেন রঘুনাথ সিংয়ের খামারবাড়ি পর্যন্ত রাষ্ট্র হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ হিমগিরি, রামলছমন এবং তাদের পহেলবানেরা দৌড়ে আসে। গোটা দোসাদটোলা ভয়ে সিটিয়ে যায়।
কিন্তু যার জন্য এত হস্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসা তাকে কোথায় পাবে হিমগিরিরা? গণা এতক্ষণে রঘুনাথ সিংয়ের তালুকের মধ্যে যে ভারতবর্ষ তার সীমানা ছাড়িয়ে খাস ধানবাদ না হলেও মাকে নিয়ে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
জনমদাসটাকে ধরেও আটকে রাখা গেল না। এ আপসোস হিমগিরিদের মরলেও যাবে না। ধরার পর গণাকে বেদম মার দেওয়া গেছে; এটুকুই যা সান্ত্বনা। কিন্তু আমৃত্যু যার বড়ে সরকারের জমি চষার কথা তাকে ঠেঙিয়ে হাতের সুখ করলে কতটুকু ক্ষতিপূরণ হয়?
প্রচণ্ড মার খাওয়ার পরও গণার এভাবে ভেগে যাবার দৃষ্টান্ত খুবই মারাত্মক। একটা লোক না থাকলে মালিকের স্বনাম এবং বেনামের হাজার হাজার একর জমি চষার ব্যাপারে কিছুই অসুবিধা হবে না। কিন্তু গণার দৃষ্টান্ত দোসাদটোলার অচ্ছুৎগুলোকে যদি সাহস আর উৎসাহ যোগায় তার ফলাফল হবে ভয়াবহ।
সরু গলার স্বর সাত পর্দা চড়ায় তুলে চেঁচাতে চেঁচাতে হিমগিরি বলে, ‘বল ভৈসের ছৌঁয়ারা, গণা কী করে এখান থেকে ভাগল? তার সিনায় এত সাহস হল কোত্থেকে?’
ভীরু কাঁপা গলায় গোটা দোসাদটোলাটা জানায়, ‘আমরা কিছু জানি না হুজৌর—’
‘একটা হারামজাদ একটা বুড়হীকে নিয়ে তো হাওয়ায় মিলিয়ে যায় নি। তোদের টোলার ভেতর দিয়েই হেঁটে হেঁটে গেছে। তোরা এতগুলো আদমী রয়েছিস এখানে; কেউ টের পেলি না! এ আমাকে বিশোয়াস করতে হবে?’
দোসাদটোলার বাসিন্দাদের তরফ থেকে আধবুড়ো গণেরি জানায়, সারাদিন তারা গতর চূরণ খাটে। সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরে বিস্তারায় লেটে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে মুর্দা বনে যায়। দুনিয়ায় তখন কে কী করছে, বিলকুল হুশ থাকে না হুজৌর। তাদের নিদের ভেতর কখন গণা আর সৌখী পালিয়ে গেছে, কেউ টের পায় নি।
গলা আরো তিন পর্দা চড়িয়ে সবার কানে তুরপুন চালিয়ে দেয় হিমগিরি, ‘জানবরের দল।’
গণেরি কিছু বলার জন্য হাঁ করতে যাচ্ছিল, আচমকা ওধার থেকে নওরঙ্গী ডাকে, ‘অ্যাই ধৰ্ম্মা—’
চমকে ধর্মা নওরঙ্গীর মুখের দিকে তাকায়, ‘কা?
‘কাল তুই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসে ছিলি। কারে, থা নহী?’
ধর্মার বুকের ভেতর শ্বাস আটকে যায়। নওরঙ্গী যে কোন দিকে যাচ্ছে, সে আগে থেকেই তার গন্ধ পায় যেন। কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে কিন্তু গলায় স্বর ফোটে না।
সাপিনীর মতো স্থির চোখে ধর্মাকে দেখতে দেখতে নওরঙ্গী ধারালো গলায় ফের বলে, ‘কা রে, গুংগা (বোবা) বন্ গৈল?’
অতি কষ্টে গলার ভেতরটা এবার সাফ করে নেয় ধর্মা, দুর্বল স্বারে কোনরকমে বলতে পারে, ‘তুমি কাল রাত্তিরে বয়েলগাড়িতে ওঠার পর আমি আর বসি নি। ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।’ ধর্মা টের পায়, এই সামান্য মিথ্যেটুকু বলতে তার বুকের ভেতর ভূমিকম্পের মতো কিছু একটা অনবরত যেন ঘটে চলেছে।
রাত্তিরে নওরঙ্গীর বয়েল গাড়িতে ওঠার কথাটা ভেল্কী দেখিয়ে ছাড়ে। একেবারে যাদুকা খেল যেন। বয়েল গাড়িতে চেপে রোজ রাত্তিরে এই ছমকী আওরতটা যে হিমগিরির কাছে যায়, এটা কোন গোপন ব্যাপার না। গারুদিয়া তালুকের তাবত আদমী তো বটেই, কুকুর-বেড়াল-ছুচো আর রাতচরা গিধেরাও তা জানে। এ একেবারে নিয়মিত এবং দৈনন্দিন ঘটনা। কিন্তু যে যত পারে জানুক, এমন কি স্বচক্ষে এক বামহন আর তার অচ্ছুৎ রাখনির কুকীর্তি দেখুক কিন্তু এই নিয়ে তাদের সামনে কথাবার্তা ঘাঁটাঘাঁটি চলবে না। এতে নাকি হিমগিরির সামাজিক মানমর্যাদা জাহান্নামে যায়। লোকটার মনস্তত্ত্ব অদ্ভুত।
হিমগিরি দ্রুত বলে ওঠে, ‘একটা জরুরী বাত তোরা শুনে রাখ; গণা কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক, পরশু হোক, ওর গলায় রশি দিয়ে ধরে নিয়ে আসব। এবার ওকে বাঁচিয়ে রাখা হবে না; জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হবে। গণার দেখাদেখি কেউ যদি বদ মতলব করে থাকিস তা হলে তোদের কপালে কী আছে আন্দাজ করে নে। হামনিকো বাতঠো কানমে ঘুষল?’
গোটা দোসাদটোলা তৎক্ষণাৎ ঘাড় হেলিয়ে জানিয়ে দিল—ঘুষেছে।
এবার হিমগিরি আকাশের দিকে আঙুল বাড়ায়। বলে, ‘দেখেছিস?’
অন্য দিন আলো ফুটতে না ফুটতেই রঘুনাথ সিংয়ের খামারবাড়ির দিকে বেরিয়ে পড়ে ভূমিদাসেরা। আজ গণা এবং সৌখী ভেগে পড়ায় এবং হিমগিরিরা দৌড়ে আসায় সময়ের দিকে কারো হুঁশ ছিল না। এদিকে কখন যেন রোদ উঠে গেছে। জষ্ঠি মাসের সকাল। রোদ উঠতে না উঠতেই ভাপ ছড়াতে শুরু করে।
আকাশের দিকে এক নজর তাকিয়েই হিমগিরির ইঙ্গিতটা বুঝে নেয় গণেরিরা। অর্থাৎ সূরয চড়ে গেছে, সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে এখনই জমিনে যাও। হুড়মুড় করে জনমদাসেরা দোসাদটোলার দিকে দৌড়ে যায়। নাকেমুখে মাড়ভাত্তা কিংবা বাসি পানিভাত্তা গুঁজে, পিঠে কালোয়া বেঁধে একটু পরেই তারা খামারবাড়িতে চলে আসে সেখান থেকে হাল বয়েল নিয়ে ক্ষেতির দিকে ছোটে।
যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে একবার খামারের পেছন দিকে তাকায় ধর্মা। সেখানে শুয়োরের খোঁয়াড়ের মতো যে ঘরগুলো গা জড়াজড়ি করে রয়েছে সেগুলো এখন ফাঁকা। তার মানে রামলছমন আর সে যে মরসুমী ওরাঁও আর মুণ্ডা কিষাণদের চাহাড়ের হাট থেকে নিয়ে এসেছিল তারা ক্ষেতিতে চলে গেছে।
এখানে আসার পর থেকে রোজই ধর্মাদের সঙ্গে সকালে ওরা বড়ে সরকারের জমিতে চলে যায়, সারা দিন কাজের পর ফেরেও একই সঙ্গে। আজ বেলা চড়তে দেখে তারা আর বসে থাকেনি।
.
ক্ষেতিতে আসার পর কারো নিশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। হাল বয়েল নিয়ে যে যার জমিতে নেমে পড়ে। চারদিক থেকে আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘উরা, উরা, হট্ হট্—’। আওয়াজের সঙ্গে লাঙলের শীষ রুক্ষ পাথুরে মাটির পেট চিরে চিরে ছুটতে থাকে।
একটানা অনেকক্ষণ লাঙল চালাবার পর ঘাড় তুলে একবার চার পাশে তাকায় ধৰ্মা। বাঁ দিকে যতদূর নজর যায়, আদিবাসী কিষাণরা মাটি চষে চলেছে।
ওদিকটায় কাল পর্যন্ত লাঙল পড়ে নি। খুব সম্ভব কাল রাতে হিমগিরি মরসুমী কিষাণদের না-চষা জমিতে লাঙল চালাতে বলে দিয়েছিল। হয়ত আজ ভোরে ক্ষেত চিনিয়ে দেবার জন্য কাউকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়েও থাকবে। ওরাঁও মুণ্ডাদের ঘামে ভেজা পিছল চামড়ায় জ্যৈষ্ঠের রোদ ঠিকরোতে থাকে।
ছোটবেলা থেকেই ধর্মা জানে, পাহাড় বা জঙ্গলের আদিবাসীদের কাজে কোন ফাঁকি নেই। এই যে মাটি চষা আর বীজ রোয়ার দায়িত্ব নিয়ে তারা এসেছে, এরপর আর ওদের পেছনে লেগে থাকতে হবে না, তাড়া লাগাবারও দরকার নেই। ঝড় উঠুক, বাঁড় (বন্যা) আসুক, রোদে পুড়ে সব ছারখার হয়ে যাক, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এখন আর কোনদিকে ওরা তাকাবে না।
হাইওয়ের ওপাশে সেই চিরকালের চেনা ছবি। দক্ষিণ কোয়েলের শুকনো মরা খাতের গা ঘেঁষে মিশিরলালজীর জমিতে অন্য দিনের মতো আজও ট্রাক্টর চলছে। ভট ভট আওয়াজ জষ্ঠি মাসের লু বাতাসে ভেসে ভেসে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর উড়ছে ঝাঁক ঝাঁক পরদেশী শুগা। বড় সড়কের পাশে টেলিগ্রাফের তারে বসে আছে ক্ষুদে ক্ষুদে চোটারা। তবে আজ একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ছে। তা হল পছিমা মেঘ। খুব একটা জমকালো নয়। টুকরা টুকরা, পেঁজা পেঁজা মেঘগুলো কোথাও দানা বাঁধছে না; আলস্যে গা ঢেলে দিয়ে পশ্চিম আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একটু থেমে ভুরুর ওপর হাতের আড়াল দিয়ে মেঘের গতিবিধি লক্ষ্য করে ধর্মা। লাঙল থামতে কুশীও থেমে গিয়েছিল। পেছন থেকে সে এবার ধর্মার পাশে গিয়ে দাড়ায়। বলে, ‘ঘটা (মেঘ)—’
ধর্মা ঘাড়টা সামান্য হেলায়, ‘হুঁ—’
পাশের ক্ষেত থেকে গণেরিও মেঘ দেখছিল। সে বলে, এই সালের পয়লা মেঘ। তবে ‘বারিষ’ নামতে দেরি আছে।’
‘কত দেরি গণেরিচাচা?’
‘আট দশ রোজ জরুর।’
‘এত্তে দের (দেরি)?’
গণেরি বুঝিয়ে দেয়। এ বছর মেঘের আনাগোনা সবে আজ থেকে শুরু হল। এত অল্প মেঘে তো বৃষ্টি হয় না। অঢেল মেঘ জমে জমে পছিমা আকাশ ‘কালা পাথর’ বনে যাবে। তবে না ‘বারিষ’ নামবে। কিন্তু সে সব একদিনে হয় না।’ গণেরি বলতে থাকে, ‘বারিষ না হলে কেউ আর বাঁচবে না। নদী-নহর, মানুষ জানবর, পাহাড়-জঙ্গল সব জ্বলে খতম হয়ে যাচ্ছে।’
ধর্মা বলে, ‘বারিষ দো-দশ রোজ বাদ শুরু হোক। মাথার ওপর মেঘটা থাকলেও আরাম। জেঠ মাহিনার রওদে জান যায়।’
গণেরি কি বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় হাইওয়ে থেকে চিৎকার ভেসে আসতে থাকে, ‘প্রতিভাজীকো—’
‘বোট দো—’
‘কৌন জিতেগী?’
‘প্রতিভা সহায়, আউর কৌন?’
চমকে ঘাড় ফিরিয়ে ধর্মারা হাইওয়ের দিকে তাকাল। লাল ধুলো উড়িয়ে একটা খোলা জীপ বিজুরি তালুকের দিকে চলেছে। দশ বারোটা জোয়ান ছোকরা গাদাগাদি করে সেটার ওপর দাঁড়িয়ে গলায় রক্ত তুলে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। জীপটার সামনের দিকে একটা লাল শালুর কাপড়ে একটা ঘোড়া আঁকা। তার তলায় কী সব যেন লেখা রয়েছে। অক্ষরপরিচয়হীন আনপড় জনমদাসেরা তা পড়তে পারে না। পারলে জানতো, সামনের চুনাওতে প্রতিভা সহায়কে জেতাবার জন্য ঘোড়ার চিহ্নে মোহর মারতে বলা হয়েছে।
দেখতে দেখতে জীপটা অনেক দূরে, লাল ধুলোয় আকাশ যেখানে ঝাপসা হয়ে আছে, একটা ফুটকির মতো মিলিয়ে যায়।
জোরে শ্বাস টেনে জ্যৈষ্ঠের খানিকটা তাতানো বাতাস ফুসফুসে ভরে নেয় গণেরি। বলে, ‘চুনাওর লড়াইতে তা হলে এবার আওরত নামল?’ এতদিন পর্যন্ত গারুদিয়া তালুকে যে নির্বাচনী যুদ্ধ হয়ে গেছে একজন মহিলাকে এবার নামতে দেখে গণেরি তা পুরুষে পুরুষে। অবাকই হয়েছে।
ধর্মা বলে, ‘পরতিভাজী কৌন চাচা?’
শ্বশুর গণেরি বলে, ‘বড় ঘরকা বহু।’ তারপর সে যা জানায় তা এইরকম। বিজুরি তালুকে দিয়ারা মনপখল গাঁয়ে তার সসুরাল। বাড়ি শুধু নামেই, ওখানে কেউ থাকে না। পুরনো আমলের বাড়িঘর ভেঙেচুরে ধসে যাচ্ছে। আগাছায় ঢেকে গেছে সব কিছু। পরতিভাজীদের কয়লা খাদান রয়েছে ঝরিয়াতে, কারখানা আছে রাঁচীতে। ওরা আজ যদি থাকে পাটনায়, কাল কলকাত্তায়, পরশু দিল্লীতে, নরশু বোম্বাইতে। বহোত বহোত পাইসা ওদের ঘরে।
হাঁ করে শুনতে থাকে ধর্মারা। শুধু ওরা দুজনই নয়, গণেরিদের কথা বলতে দেখে চারদিকের ক্ষেতগুলো থেকে আরো অনেকে উঠে এসে কখন তাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছিল, কারো খেয়াল হয় নি। এবার গণেরি সবাইকে তাড়া লাগায়, ‘যা যা, আপনা আপনা ক্ষেতিমে চলা যা—’
সবাই ফের ক্ষেতিতে নেমে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে ছাড়া ছাড়া আলগা আলগা মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা যখন খাড়া মাথার ওপর উঠে আসে সেই সময় কালোয়া খাওয়ার সময় হয়ে যায়। সবাই বয়েলগুলোর গলার রশি খুলে দিয়ে ঝোপঝাড় কি কোমরবাঁকা ত্রিভঙ্গ চেহারার সীসম গাছের ছায়া খুঁজে বসে পড়ে। খানিকক্ষণ জিরিয়ে গামছা কি ন্যাকড়ার গিঠ খুলে ভাত-সবজি-ডাল-নিমক-মিরচা বার করে খেতে শুরু করে।
একটা বাজেপোড়া তালগাছের গোড়ায় খেতে বসেছিল ধর্মা আর কুশী। আজ তাদের খাওয়ার আয়োজন সামান্যই। বাজরার রুটি, খানিকটা কালো কালো আস্ত কলাই সেদ্ধ, ভেরোয়া (ঢেড়স) ভাজা, নিমক, হরা মিরচি এবং খানিকটা করে তেঁতুল গোলা।
খেতে খেতে হঠাৎ কুশীর চোখে পড়ে, বা দিক থেকে হাইওয়ের ওপর দিয়ে সাইকেলে করে মাস্টারজী আসছেন। তাজ্জব বনবার মতো কোন দৃশ্য নয়। কয়েক সাল ধরে মাস্টারজীকে এভাবেই সাইকেলে করে রওদ-বারিষ মাথায় নিয়ে গারুদিয়া আর বিজুরি তালুকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে। পাঁচ সাত ‘মিল’ জায়গা জুড়ে ঘুরে ঘুরে তিনি তাঁর স্কুলের জন্য ছেলেমেয়ে জোটান।
কোন কোন দিন মাস্টারজী সটান হাইওয়ে ধরে বিজুরি তালুকের দিকে চলে যান। আজ কিন্তু গেলেন না। বাস-ইস্ট্যাণ্ডের কাছে ঝাঁকড়া পীপর গাছটার তলায় এসে নেমে পড়লেন। তারপর ক্ষেতিতে নেমে সাইকেলটা ঠেলে ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে ধর্মাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন।
কুশী বলে, ‘মাস্টারজী আসছে—’
ততক্ষণে ধর্মাও দেখতে পেয়েছিল। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘হামনিলোগ ইহা মাস্টারজী—আমরা এখানে—’
রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতির চারদিক থেকে নানা গলা শোনা যায়, ‘মাস্টারজী আয়া, মাস্টারজী আয়া—’
মাস্টারজীকে এ অঞ্চলের গরীব ভুখা অচ্ছুৎ মানুষেরা খুবই সম্ভ্রমের চোখে দেখে। তাঁকে যেমন ভালোও বাসে তেমনি শ্রদ্ধাও করে। সব চাইতে বড় কথা, আপনজন বলে ভাবে।
মাস্টারজী কাছে আসতেই এধার ওধার থেকে গণেরি, বুধেরি, মাধোলালরা উঠে আসে। তাঁকে নিয়ে কী করবে, কোথায় বসাবে, ভেবে উঠতে পারে না। ভীষণ ব্যস্তভাবে নিজের গামছাটা দশ বার ঝেড়ে জমিতে পেতে দেয় গণেরি। বলে, ‘বৈঠ মাস্টারজী, বৈঠ—’
মাস্টারজী গামছার ওপর বসেন না। সাইকেলটা সামনের সীসম গাছটার গায়ে দাঁড় করিয়ে আলের মরা ঘাসের ওপর বসে পড়েন। মোটা খদ্দরের ধুতির খুঁটে কপালের ঘাম মুছে সবাইকে দেখতে দেখতে সস্নেহে হাসেন। বলেন, ‘কী খবর তোদের? ভাল আছিস?’
ধর্মারা একসঙ্গে গলা মিলিয়ে জানায়, ‘হুঁ, রামজীকো কিরপা’
‘কালোয়া খাওয়া হয়ে গেল?’
‘হুঁ।’
গণেরিদের শরীর-স্বাস্থ্য ঘর-সংসার সম্পর্কে আরো কিছুটা খোঁজ খবর নিয়ে আসল কথায় আসেন মাস্টারজী, ‘তোদের মতলবটা কী, খোলসা করে বল্ তো!’
মাস্টারজীর কথায় যে ইঙ্গিতটা আছে, মোটামুটি আন্দাজ করতে পারে গণেরি। ফিকে হেসে ভয়ে ভয়ে শুধোয়, ‘কীসের মতলব?
‘ইস্কুলে ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছিস না কেন?’ সোজাসুজি প্রশ্নটা করে সেই পুরনো কথাটা আরেক বার নতুন করে মনে করিয়ে দেন মাস্টারজী। জমানা বদলে গেছে। গণেরিদের যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কামিয়া হয়ে পরের জমিতে বেগার দিতে দিতেই এই জনমটা বরবাদ করে ফেললি। ছেলেপুলেদের পেটে দু-চারটে কালির হরফ ঢোকাবার বন্দোবস্ত কর। তাদের আঁখ ফুটুক; নইলে তোদের মতোই তারাও পরের জমিনে হাল-বয়েল ঠেলে ঠেলেই খতম হয়ে যাবে। নিজেদের হক কোনদিনই বুঝে নিতে পারবে না।
গণেরি নিরুপায় হতাশ মুখে বলে, ‘কা করে মাস্টারজি! তুই আমাদের সবই জানিস। এই গরমের সময়টা ছেলেমেয়েগুলোকে পড়তে পাঠাই কী করে? দশ সাল আমাদের কুয়ো কাটানো হয় নি। টোলাতে এক বুঁদ পীনেকা পানি নেই। সূরয দেও উঠতে না উঠতে বালবাচ্চাদের পানি আনতে পাঠিয়ে দিই। শুখা নদী থেকে বালি খুঁড়ে পানি না আনলে সবাই ছাতি ফেটে মরবে! বারিষ নামুক, তখন ওদের পাঠাব।’
‘বারিষ শুরু হলে তো ধান রোয়ার জন্যে ওদের ক্ষেতিতে নিয়ে আসবি।’
কথাটা ঠিকই বলেছেন মাস্টারজী। আস্তে আস্তে খুবই দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ে গণেরি।
ক’সাল ধরেই মাস্টারজী দেখছেন গরমের সময় লাঙল দিয়ে ক্ষেতি তৈরি হয়ে যাবার পর যেই আকাশ থেকে বৃষ্টির দানা নামতে শুরু করে, ধান বোনাও চালু হয়ে যায়। ছোট ফালি জমিতে বীজ রুয়ে প্রথমে ধানচারা করে নেওয়া হয়। চারাগুলো বিঘৎ খানেক বড় হবার পর শেকড় সুদ্ধু তুলে এনে জমিতে লাইন ধরে ফাঁক ফাঁক করে লাগাবার পালা। এই সময়টা প্রচুর লোকজন দরকার। আদিবাসী মরসুমী কিষাণরা থাকা সত্ত্বেও সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে উঠে। অগত্যা মা-বাপেরা হাতে হাতে সাহায্যের জন্য ছেলেমেয়েদের ক্ষেতিতে টেনে আনে। না এনে উপায়ই বা কী? তারপর ধান রোয়া শেষ হতে না হতেই জোর বর্ষা নেমে যায়। দিনরাত তখন জল ঝরছে তো ঝরছেই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে রাস্তাঘাটের হাল বেজায় খারাপ হয়ে যায়। এই গারুদিয়া আর বিজুরি তালুকে পাক্কী আর ক’টা? পাটনা আর রাঁচিতে যাবার ঐ হাইওয়েটা বাদ দিলে সবই কাঁচা সড়ক। বর্ষার মরসুমে সেখানে হাঁটুভর থকথকে কাদা জমে থাকে। তখন কোশ হু-কোশ কাদা ঠেলে ইস্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠাতে কোন মা-বাপই রাজী না।
বর্ষার পর ছুটো মাস অবশ্য ভূমিদাসদের হাড়ে কিছুটা বাতাস লাগে। তখন ক্ষেতির কাজ পুরা বন্ধ। মাঠে মাঠে তখন ধানের শীষ লকলকিয়ে বাড়তে থাকে। সবুজ আবরণের ভেতর দুধ দ্রুত ঘন হয়। কিছুদিনের মধ্যেই মাইলের পর মাইল শস্যক্ষেত্রের রঙ একেবারে বদলে যাবে। যতদূর নজর চলবে, মাঠ জুড়ে শুধু অফুরন্ত সোনালী ধান যতদিন না ধান পাকছে, রঘুনাথ সিংয়ের খামার বাড়িতে গিয়ে গত সালের ধান-কলাই মুগ-মুসুর ইত্যাদি হরেক শস্য ঝেড়ে বেছে রোদে শুকিয়ে রাখতে হয় জনমদাসদের। এই সময়টা মাস্টারজীর ইস্কুলের কথা আচমকা মনে পড়ে যায় তাদের। সকাল হতে না হতেই দোসাদটোলার মা-বাপেরা ছেলেমেয়েদের ঘুম ভাঙিয়ে মাড়ভাত্তা খাইয়ে তাড়া দিয়ে দিয়ে ‘পাক্কী’র ওধারের কাঁচা সড়কে পৌঁছে দেয়। এখান থেকে বাচ্চাগুলো গারুদিয়া বাজারের পাশে মাস্টারজীর ইস্কুলে ঠিকই চলে যেতে পারবে। ছুটির পর মাস্টারজী নিজে সঙ্গে করে তাদের এই ‘পাক্কী’ পার করে দিয়ে যান। হাইওয়েতে দিনরাত উজানে ভাটিতে বাস-ট্রাক বেপরোয়া দৌড়োয়। বাচ্চাগুলোকে পার না করে দিলে গাড়ির তলায় চলে যাবার ভয়।
কিন্তু যাদের জন্ম ভূমিদাসদের ঘরে তাদের পক্ষে বছরের ক’টা দিনই বা পড়াশোনা সম্ভব? ধান যেই পাকলো, মাস্টারজীর ইস্কুল ফাঁকা করে ছেলেমেয়েরা মা-বাপের পিছু পিছু মাঠে গিয়ে নামল। ধান ওঠার পরও কাজের কি কামাই আছে? আবার লাঙলের ফলায় জমি তৈরি করে কলাই তিল তিসি মুগ মুসুর লাগাতে হবে। লাগাতে হবে আখ ভুট্টা বাজরা জনার! তখনও মা-বাপের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা ক্ষেতিতে আসবে। রবিশস্যের মরসুম ফুরোতে না ফুরোতেই ফের গরম শুরু হয়ে যাবে। এই ভাবেই ওদের জীবনে ঋতুর চাকায় বছর ঘুরে যায়। কাজেই ছেলেপুলের পেটে দু-চারটে কালির হরফ ঢোকাবার ফুরসত কোথায় ওদের?
মাস্টারঙ্গী বলেন, ‘বারিষ থামলে দো-চার রোজের জন্যে ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাবি। তারপর বাকী সাল ওরা আর ইস্কুলের মুখ দেখবে না। এভাবে কি পড়াশোনা হয়?’
কাচুমাচু মুখে হাত কচলাতে কচলাতে গণেরি বলে, ‘কা করে মাস্টারজী, কাম তো ওঠাতে হবে। কাম না ওঠালে বড়ে সরকার কি ছেড়ে দেবে?’ তারপর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের শুরু করে, ‘জনমভর আমরা খরিদীই হয়ে রইলাম।’
মাস্টারজী কোন কারণেই হতাশ হন না। মানুষ এবং জীবন সম্বন্ধে তিনি বড়ই আশাবাদী। বলেন, ‘এর মধ্যেই সময় করে নিতে হবে গণেরি। ছেলেমেয়েগুলাকে আনপড় মুরখ করে রাখা কোন কাজের কথা নয়।’
‘হুঁ।’
কথায় কথায় বেলা হেলতে শুরু করে। খানিক আগে যে পাতলা পাতলা মেঘ পছিমা বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল, দিগন্তের ওপারে কখন যেন সেগুলো উধাও হয়ে গেছে। জষ্ঠি মাসের সূরয খাড়া মাথার ওপর থেকে পশ্চিমের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে।
মাস্টারজী কী বলতে যাচ্ছিলেন, আচমকা হাইওয়ের দিক থেকে চিৎকার ভেসে আসে।
‘নেকীরাম শর্মাকো—’
‘বোট দো, বোট দো—’
‘উটকা পর—’
‘মোহর মারো, মোহর মারো—’
ঘাড় ঘুরিয়ে সবাই বড় সড়কের দিকে তাকায়। একটা টেম্পো বিজুরি তালুক থেকে গারুদিয়া বাজারের দিকে চলেছে। গাড়িটার সামনে উট আঁকা একটা লাল শালুর টুকরো আটকানো। বোঝা যায়, এবারের নির্বাচনে নেকীরামের প্রতীক হলো উট। টেম্পোটার পেছন দিকে আট দশটা ছোকরা নেকীরামকে ভোট দেবার জন্য অনবরত গলায় রক্ত তুলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে।
গাড়িটা লাল ধুলো উড়িয়ে ডান দিকের একটা বাকে অদৃশ্য হয়ে যায়।
যতক্ষণ নেকীরাম শর্মার ভোটের গাড়িটা দেখা যায়, তাকিয়ে ছিলেন মাস্টারজী। হাইওয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে এবার তিনি গণেরিকে শুধোন, ‘কৌন নেকীরাম রে? বড় ইস্কুলের পণ্ডিতজী?’
গণেরি বলে, ‘অয়সাই শুনা’
‘বামহন বলে বড় দেমাক না? ছুয়াছুত খুব মানে?’
‘শুনা অয়সা।’
‘পণ্ডিতজীও তা হলে চুনাওতে নেমে গেল?’
কী ভেবে গণেরি বলে, ‘জেনানাও চুনাওতে নেমেছে।’
একটু অবাক হয়ে মাস্টারজী জিজ্ঞেস করেন, ‘কৌন জেনানা?’
‘বড়ে ঘরকা বহু—পরতিভা সহায়। কয়লা খাদান আছে ওদের, কারখান্না ভি আছে। বহোত পাইসাবালী।’
মাস্টারজীর চমক লাগে। বলেন, ‘আচ্ছা—’
গণেরি বলে, ‘থোড়া আগে পরতিভাজীকো ভোটের গাড়ি বিজুরি তালুকের দিকে গেল।’
মাস্টারজী আপন মনে এবার বলেন, ‘ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট প্রতিভা সহায়, জমিমালিক রঘুনাথ সিং, বামহন নেকীরাম শর্মা—সবার ভোট চাই। গারুদিয়া-বিজুরিতে এবার চুনাওর পরব জমবে মনে হচ্ছে।’
গণেরি স্থির চোখে মাস্টারজীর দিকে তাকিয়ে ছিল। তাঁর কথাগুলোর গভীর মানে সে বুঝতে পারে না। শুধোয়, ‘কা বোলা মাস্টারজী?
‘ও কিছু না।’ প্রসঙ্গটা বদলে মাস্টারজী জিজ্ঞেস করেন, ‘আর কে কে ভোটে নামল জানিস?’
‘সুখন রবিদাস—’
‘বহোত তেজ ছোকরা। আউর?’
‘শুনেছি বিজুরির এক মুসলমান আদমীও নেমেছে।’
মাস্টারজী আবছা গলায় বিড় বিড় করতে থাকেন, ‘হিন্দু মুসলমান, জাতপাত, ইণ্ডাস্ট্রি, ল্যাণ্ড ওনারশিপ সব কুছ চুনাওকা ছত্রির তলায় এসে গেল। বহোত আচ্ছা—’
এই সময় দূর থেকে খ্যাসখেসে গলার চিৎকার শোনা যায়, ‘আরে উল্লু, গাধধে, পাঠঠে, হারামজাদকা ছোঁয়ারা গলার স্বরটা খুবই চেনা। চমকে সবাই দেখল, পুরনো লঝঝড় সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে ক্ষেতির পর ক্ষেতি পেরিয়ে রামলছমন আসছে। তার মুখের কামাই নেই। সমানে সে চেল্লাচ্ছে, ‘আসতে একটু দেরি করেছি, অমনি কাজে ফাঁকি! আসমানে আজ মেঘ দেখা দিয়েছে। দশ-পন্দর রোজের মধ্যে বারিষ নেমে যাবে। আভিতক ক্ষেতি চষা পুরা হলো না। হারামজাদকো বেটোয়া বিটিয়া, দয়া করে গতর তুলে জমিনে নামো। উল্লু, পাঠঠে, গাধে—’
মাস্টারজীর চারপাশে যারা ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা চোখের পাতা পড়তে না পড়তে হালবয়েল নিয়ে ক্ষেতিতে নেমে পড়ে। চারপাশ থেকে আওয়াজ উঠতে থাকে, ‘উরা হঠ, হঠ, উরা হঠ, হঠ—’
তার ভয়ে এতগুলো হট্টাকট্টা চেহারার দোসাদ-দুসাদিন সারাক্ষণ তটস্থ। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করে রামলছমন। চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ভূমিদাসদের মাটি চষা লক্ষ্য করে। তারপর হাতের সাইকেলটা একটা পরাস গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে মাস্টারজীর দিকে তাকায়, ‘কা মাস্টারজী, কা খবর?’
রামলছমনকে একেবারেই পছন্দ করেন না মাস্টারজী। খুবই নিস্পৃহ মুখে বলেন, ‘চলতা হ্যায়—’
‘তোমার ইস্কুল কেমন চলছে?’
‘ভাল না।’
‘এখানে?’
অর্থাৎ বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের জমিতে মাস্টারজী কী উদ্দেশ্যে এসেছেন, রামলছমন তা-ই জানতে চায়। মাস্টারজী এ প্রশ্নের উত্তর দেন না। কেননা আগেও অনেক বার এই ক্ষেতিতে রামলছমনের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং কম করে পঞ্চাশ বার এই একই প্রশ্ন করেছে সে। মাস্টারজীও একই উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু একই প্রশ্নের জবাব কত বার দেওয়া যায়! বিরক্ত মাস্টারজী এখন আর জবাব দেওয়াটা প্রয়োজন বোধ করেন না।
রামলছমন ট্যারা-বাঁকা পোকায় খাওয়া কালচে দাঁত বার করে বিশ্রী হাসে। বলে, ‘সমঝা। ইস্কুলের জন্যে ছেলেমেয়ে পাকড়াতে এসেছ।’
কথাটা ঠিকই বলেছে বগুলা ভকত। সে তো বটেই, গারুদিয়া এবং বিজুরি তালুকের তাবত মানুষ জানে মাস্টারজী সাইকেলে করে গাঁওয়ে গাঁওয়ে ক্ষেতিতে ক্ষেতিতে ঘুরে তাঁর স্কুলের জন্য ছাত্র ধরতে বেরোন। তিনি এবারও কিছু বলেন না।
রামলছমন মাস্টারজীর মুখের ওপর ঝুকে এবার শুধোয়, ‘মিলা?
ছাত্র পাওয়া গেল কিনা, রামলছমনের তা-ই জিজ্ঞাস্য। মাস্টারজী ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট বিরক্ত হলেও বাইরে তা ফুটে উঠতে দেন না।
গম্ভীর গলায় শুধু বলেন, ‘নেহী।’
উত্তরটা শুনে বেজায় খুশী রামলছমন। সবগুলো দাঁত একসঙ্গে বার করে এবার সে বলে, ‘ও আমি বহোত আগে থেকেই জানি। মাস্টার, এই জায়গাটা হলো পড়তি জমি। এখানে লেখাপড়ার চাষ হয় না। ইস্কুল খুলে গরমিনের পাইসাই বরবাদ। আর তুমিও এখানে ওখানে ঘুরে ছেলে মেয়ে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাচ্ছ। তার চেয়ে এক কাম কর—’
সন্দিগ্ধ চোখে মাস্টারজী তাকান, ‘কী কাম?
‘ইস্কুলের দুকান এখান চলবে না। এখান থেকে ইস্কুল উঠিয়ে ভালো জায়গায় নিয়ে বসাও। গাহেক মিলবে। না হলে পরেসানিই সার—’ উৎকৃষ্ট একটি রসিকতা করা হয়েছে ভেবে রামলছমন খুশিতে ডগমগ। হিক্কার মতো শব্দ করে করে সে হাসতে থাকে।
বিনা পয়সায় এরকম একটা দামী পরামর্শ পেয়েও মাস্টারজীকে আদৌ উৎসাহিত হতে দেখা যায় না। নিরানন্দ একটু হেসে তিনি উঠে পড়েন। একটি কথাও না বলে পাশের সীসম গাছটার গা থেকে নিজের সাইকেলটা নিয়ে বড় সড়কের দিকে চলতে শুরু করেন। মনে মনে সংকল্প দৃঢ় হতে থাকে। এই পড়তি জমিতেই লেখাপড়ার চাষ করে রামলছমনকে দেখিয়ে দেবেন।
মাস্টারজী চলে যাবার পর লম্বা লম্বা পা ফেলে বগুলা ভকত এ জমি থেকে ও জমিতে, ও জমি থেকে সে জমিতে চরকির মতো ঘুরতে থাকে। এভাবে ঘুরে ঘুরে কিছুক্ষণ সবার কাজ লক্ষ্য করে। তারপর যুবতী মেয়েদের পেছনে লেগে যায়। প্রথমেই তার চোখ পড়ে শনিচারীর ওপর। অন্য সব দিনের মতো মাধোলালের জমিতে গত সালের মরা গাছের শেকড় বেছে বেছে রাখছিল সে।
শনিচারীর পেটে ছ সাত মাসের বাচ্চা রয়েছে। সোজাসুজি সেদিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে খ্যা খ্যা করে হাসে রামলছমন। বলে, ‘কা রে শনচারী, পেটটার কী হাল করেছিস! তোর পেটের ছৌয়া কত বড় হল? তার হাসিতে দুনিয়ার সব বদবু মেশানো।
শনিচারী তার ছ সাত মাসের গর্ভ নিয়ে কী করবে, ভেবে পায় না। খাটো শাড়ির খুঁট টেনে সেটা ঢাকতে চেষ্টা করে কিন্তু শাড়ির বহর এতই ছোট যে কোমর আর বুক ঢাকার পর বাড়তি কিছু পাওয়া যায় না। দু হাতে পেটটা চাপা দিয়ে লজ্জায় সঙ্কোচে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পৃথিবী এই মুহূর্তে দু ভাগ হয়ে গেলে সে তার ভেতর ঢুকে যেত।
শনিচারীর এই জড়সড় সন্ত্রস্ত ভাবটা দেখতে দেখতে বেশ মজা পায় রামলছমন। চোখ নাচাতে নাচাতে সে বলে, ‘তোর ছৌয়াকে পেট থেকে মাটিতে কবে ফেলবি?’
শনিচারী এবারও উত্তর দেয় না। মুখ নীচু করে দাড়িয়ে থাকে। রামলছমন আবার কী বলতে যাচ্ছিল, ওধারের ক্ষেত থেকে গিধনী ডাকে, ‘এ বামহনিয়া, আমার এখানে এসো। শানচারী কবে ছৌয়া মাটিতে ফেলবে, আমি তোমাকে সমঝিয়ে দিচ্ছি।’
চমকে গিধনীর দিকে তাকায় রামলছমন। দুসাদটোলার এই একজনকেই সে যমের মতো ভয় পায়। ছুকরির জিভে চাকুর ধার। কিছুই তার মুখে আটকায় না। ক’দিন আগে এই বদ আওরতটা তার হাল খারাপ করে ছেড়ে দিয়েছিল। সন্দিগ্ধ ভীতু চোখে সে গিধনীকে দেখতে থাকে।
গিধনী হাত নেড়ে নেড়ে ডাকে, ‘আও আও হামনিকো দুলহন। আ যাও—’
বগুলা ভকত আর দাঁড়ায় না। ছুকরির মতলব ভাল নয়। মনে হচ্ছে সেদিনের মতো আজও নিশ্চয়ই কোন ফ্যাসাদে ফেলে দেবে। বজ্জাত আওরতের ত্রিসীমানায় থাকা ঠিক হবে না।
বকের মতো পা ফেলে ফেলে চোখের পলকে অনেক দূরে যেখানে আদিবাসী মরসুমী কিষাণরা জমি চষছে সোজা সেখানে চলে যায় রামলছমন।
ভূমিদাসরা নিশ্চিন্ত। আজ অন্তত বগুলা ভকতটা তাদের এদিকে আসবে না।
.
সন্ধ্যেবেলা বড়ে সরকারের খামারবাড়িতে হাল বয়েল জমা দেবার পর ধর্মা আর কুশী ছাড়া বাকী সবাই দোসাদটোলায় ফিরে গেল। আর ওরা দুজনে সোজা চলে এল সাবুই ঘাসের জঙ্গলে। চার দিন হয়ে গেল, বগেরি ধরার ফাঁদ পাতা হচ্ছে না। একটা দিন গেছে কোটরার পেছনে, একদিন চাহাঢ়ের হাটে কিষাণ আনতে। গণাকে যে দিন হিমগিরি পহেলবান দিয়ে পেটালো সেই দিনটাও বরবাদ হয়েছে। আরেকটা দিন শরীর খারাপ লাগছিল।
মোট চারটে দিন। চার দিনে ঠিকাদারদের কাছে বগেড়ি বেচে কমসে কম দশ বারোটা টাকা কামাই তো হতো। দশ বারোটা টাকা মানে নিজেদের মুক্তির দিকে অনেকখানি এগিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া বর্ষা নামলে বগেড়ি আর পাওয়া যাবে না। তল্লাট ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে তারা উধাও হয়ে যাবে। তার মানে পুরো বারিখের সময়টা কামাই প্রায় থাকবে না বললেই চলে। বেফায়দা চারদিনের রোজগার নষ্ট হয়ে গেল।
ফাঁদ টাদ পাতা হয়ে গেলে কুশী বলল, ‘এবার কী করবি?’
ধর্মা বলল, ‘কী আর করব, ঘরে ফিরব।’
‘অনেকদিন সফেদ গোয়ারিনদের কাছে যাই না। যাবি?’
গোয়ারদের চৌকাদ গাঁয়ের আলাদা একটা আকর্ষণ আছে ধর্মাদের কাছে। ওখানে গেলে সময়টা ভালই কাটে। সফেদ গোয়ারিন আর কালা গোয়ার, স্বামি-স্ত্রী দু’জনেই মানুষ বড় ভালো। ধর্মার ইচ্ছা হলো কুশীকে সঙ্গে করে চৌকাদে চলে যায়। পরে কী ভেবে বলল, ‘আজ থাক। কাল তো বগেড়ি নিয়ে ঠিকাদার বাবুদের কাছে যাব। তখন চৌকাদে যাওয়া যাবে।’
কুশী আর কিছু বলে না।
কিছুক্ষণ বাদে হাইওয়ে ঘুরে ওরা দোসাদটোলায় এসে রীতিমত অবাক হয়ে যায়। মহল্লার পশ্চিম দিকে যেখানে কুয়োটা রয়েছে সেখানে পাঁচ ছ’টা হ্যাজাক জ্বলছে। ওদিকের অনেকটা জায়গা রোশনাইতে ভরে গেছে। আর পুরো দোসাদটোলাটা ওখানে ভেঙে পড়েছে।
ধর্মা আর কুশী তাদের চার মা বাপকে নিজেদের ঘরে দেখতে গেল না। কুয়োর কাছে কেন এত রোশনাই, জানার জন্য খুবই কৌতূহল হতে থাকে দু’জনের। পায়ে পায়ে তারা এগিয়ে যায়।
কাছাকাছি আসতেই ধর্মাদের চোখে পড়ে, পুরনো কুয়োতে বালিকাটার কাজ চলছে। সেই সঙ্গে ঠিক পাশেই একটা নতুন কুয়ো ও কাটা হচ্ছে। কুয়োতে বসাবার জন্য পোড়া মাটির বিরাট বিরাট অগুনতি চাকা একধারে ডাঁই করে রাখা হয়েছে। বারো চোদ্দটা কুয়াকাটোয়া নতুন এবং পুরনো দুটো কুয়ো কাটতে কাটতে ঘেমে নেয়ে উঠছে।
ভিড়ের ভেতর খুঁজে খুঁজে গণেরিকে বার করে ধর্মা। জিজ্ঞেস করে, ‘কা বাত চাচা? একসাথ দো কুঁয়া?’
‘হুঁ—’ গণেরি আস্তে মাথা নাড়ে।
‘কুয়াকাটোয়ারা এল কখন?’
‘থোড়া আগে। বড়ে সরকার নিজে সঙ্গে করে দিয়ে গেছে!’
ধর্মার গলার স্বর কেঁপে যায়, ‘খুদ বড়ে সরকার!’ বলতে বলতে তার চোখ গোল হয়ে যায়।
‘হুঁ রে, হুঁ। খুদ এসে পুরানা কুঁয়ার বালি তুলতে আর নয়া কুঁয়া বানাতে হুকুম দিয়ে গেল।’
কুয়া কাটানোর এই ঘটনাটা দোসাদটোলার বাসিন্দাদের খুবই উত্তেজিত করে তুলেছে। হ্যাজাকের আলোয় তাদের চকচকে উজ্জ্বল মুখগুলো দেখলেই তা টের পাওয়া যায়। কারা যেন ওধার থেকে বলে উঠে, ‘বড়ে সরকারকা বহোত কিরপা।’
এধার থেকে আরো কয়েকজন বলে, ‘হামনিলোগনকো বহোত সৌভাগ—’
সৌভাগ্য তো নিশ্চয়ই। তাদের মতো অচ্ছুৎদের পাড়ায় বড়ে সরকারের পায়ের ধুলো পড়েছে। এমন উত্তেজক ঘটনা তার জন্মের পর থেকে বাইশ চব্বিশ সালের মধ্যে আর কখনও ঘটেছে কিনা, ধর্মা ভাবতে চেষ্টা করে। দশ বছর ধরে পুরনো কুয়োটা বালিতে বুজে এসেছিল। কতবার তারা বালি কাটাবার জন্য হিমগিরিনন্দনের কাছে আর্জি করেছে। কিন্তু কোন ফল হয় নি। অথচ বড়ে সরকার আজ শুধু পুরনো কুয়োর বালি সরাবার ব্যবস্থাই করেন নি; নিজে এসে নতুন কুয়ো কাটাবার হুকুমও দিয়ে গেছেন। এটা দোসাদদের চোদ্দ পুরুষের সৌভাগ্য না!
ধর্মা গণেরির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসায়, ‘বড়ে সরকার আচানক দুটো কুঁয়া কাটিয়ে দিচ্ছে কেন?’
চোখ কুঁচকে চাপা গলায় গণেরি বলে, ‘মুরুখ গাধ্ধে কাঁহাকা! শুনলি না সবাই বলছে, এটা বড়ে সরকারের কিরপা আর আমাদের বাপ, নানা, নানাকে বাপ, নানাকে বাপকে বাপ—সবার সৌভাগ।’
গলার স্বরটা কেমন যেন শোনায় গণেরির। একদৃষ্টে খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে ধর্মা, ‘নায় নায়–’
রুক্ষ গলায় এবার গণেরি বলে, ‘কী না?’
‘তুমি যা বলছ।’
অনেকটা সময় চুপ করে থাকে গণেরি। তারপর মুখটা ধর্মার কানের ভিতর গুজে দিয়ে বলে, ‘চুনাওকা তৌহার এসে গেল না। বোটমাঙোয়ারা এখন কত কী করে, দ্যাখ না।’
ধর্মা আর কিছু শুধোয় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুয়োকাটা দেখতে থাকে। চারপাশের লোকজন বড়ে সরকারের মহানুভবতা সম্পর্কে অনবরত বকে যায়। এত বড় একটা মহত্বের দৃষ্টান্ত দেখে তারা যেমন বিগলিত তেমনি কৃতার্থ।
একসময় কুয়োতলার ধার থেকে ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হতে থাকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোসাদটোলার বেশির ভাগ মানুষ রঘুনাথ সিংয়ের জমিতে হাল বয়েল ঠেলে এসেছে। আরেক দল গিয়েছিল দক্ষিণ কোয়েলের মরা শুখা খাতে বালি খুঁড়ে জল আনতে বা জঙ্গলে সুথনি আর মহুয়ার গোটা যোগাড় করতে। ফিরেই রঘুনাথ সিং এবং কুয়োকাটোয়াদের দেখে তারা একই সঙ্গে এতই উত্তেজিত অভিভূত আর অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ভুখ-তিয়াসের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। প্রথম দিকের সেই চমক এবং উত্তেজনা এখন খানিকটা থিতিয়ে আসায় সবাই টের পাচ্ছে পেটের ভেতর খিদেটা ক্ষ্যাপা জানবরের মতো দাপাদাপি করছে। ফলে একজন দু’জন করে সবাই ঘরে ফিরতে শুরু করেছে।
ধর্মা আর কুশীও তাদের চার মা-বাপকে ভিড়ের ভেতর থেকে খুঁজে বের করে বলে, ‘বহোত ভুখ লেগেছে। ঘরে চল্—’
দোসাদটোলার পুব দিকে কুশী এবং ধর্মাদের ঘর। কুয়োর পাড় থেকে ছ জনে সেদিকে হাঁটতে থাকে।
খানিকটা যাবার পর ডান দিকে ফাগুরামের ঘর। সেখান থেকে হারমোনিয়ামের বাজনার সঙ্গে গানের সুর ভেসে আসছে। চেনা গলা। গারুদিয়া-কোয়েল ফাগুরাম গানের কথা সুরে বসাবার জন্য গলা সাধছে।
থমকে দাড়িয়ে যায় ধৰ্মা। বছর কয়েক আগেও গানের দিকে দুর্দান্ত ঝোঁক ছিল তার। তখন ফাঁক পেলেই ফাগুরামের কাছে এসে বসত সে। ফাগুরাম তাকে নৌটঙ্কীর অনেক গান শিখিয়েছিল, পুরনো বেলো-ছেঁড়া হারমোনিয়ামে তালিম দিয়েছিল। তার খুবই আশা হয়েছিল, ধর্মাকে নিজের সাকরেদ করে তুলতে পারবে। কিন্তু ফাগুরাম আর ধর্মার জীবনের ধাঁচই আলাদা। পুরুষানুক্রমে ধর্মারা খরিদী কিষাণ আর ফাগুরাম হলো স্বাধীন মানুষ। ফাগুরামের যা মানায় ধর্মার মতো জনমদাসের তা কি কখনও শোভা পেতে পারে? সারাদিন বড়ে সরকারের জমিতে গতরচূরণ মেহনতের পর নিজেদের মুক্তির দাম যোগাড় করতে করতে কবে গানের শখ মুছে গেছে, মনেও নেই। চৰ্চা না থাকলে যা হয়, ফাগুরামের কাছে গান বাজনায় যেটুকু তালিম নিয়েছিল তা কবেই ভুলে গেছে। তবু কখনও কখনও গানের সুর ভেসে এলে সে কান খাড়া করে।
ফাগুরাম তাকে দেখতে পেয়েছিল। তবে অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারেনি। গান থামিয়ে সে শুধোয়, ‘কৌন রে?
ধর্মা সাড়া দেয়, ‘আমি ধম্মা ফাগগুচাচা’
‘বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? অন্দর আ যা—’
কুশীদের পাঠিয়ে দিয়ে ধর্মা ফাগুরামের ঘরে ঢোকে। ঢুকেই তাজ্জব বনে যায়। দোসাদটোলার সবার ঘরেই লাল কেরোসিনের ডিবিয়া জ্বলে কিন্তু ফাগুরামের এখানে ঝকঝকে কাচ বসানো নতুন দামী লণ্ঠন চোখে পড়ছে। যে হারমোনিয়ামটা সে বাজাচ্ছে সেটা আনকোরা নতুন। লণ্ঠনের আলোয় সেটার গা থেকে জেল্লা ঠিকরে বেরুচ্ছে। ধর্মা লক্ষ্য করে, ফাগুরামের পুরনো রঙওঠা রিডভাঙা হারমোনিয়ামটা একধারে পড়ে আছে। তার আরো নজরে পড়ে, ঘরের এককোণে রশিতে ক’টা নতুন কাপড় আর কুর্তা ঝুলছে, একজোড়া কাঁচা চামড়ার চকচকে নাগরাও আরেকটা কোণ আলো করে পড়ে আছে। তিন চার সালের ভেতর ফাগুরামকে নাঙ্গা পায়ে ছাড়া কখনও দ্যাখেনি ধর্মা। নতুন ধুতি নতুন জামা তো বেজায় তাজ্জবের কথা, সবসময় তার পরনে থাকত তালি-মারা সেলাই করা পুরনো ময়লা জামাকাপড়। কী এক জাদুতে সব বিলকুল বদলে গেছে।
ধর্মার মুখচোখের ভাব লক্ষ্য করছিল ফাগুরাম। গর্বিত হেসে সে বলতে থাকে, ‘ঐ যে নয়া ধোতিয়া, জামা, নয়া লালটিন (লণ্ঠন), হারমোনি—সব বড়ে সরকার দিয়েছে। একশো রুপাইয়া ভি। তা দিয়ে নাগরা কিনেছি, সিলভারকা কড়াইয়া কিনেছি, মাথায় দেবার তেল, নয়া কাকাই (চিরুনি)—অনেক জিনিস কিনেছি।’
ফাগুরাম এক নাগাড়ে যে সব জিনিসের নাম করল সে সব ধর্মার মতো জনমদাসের কাছে একান্তভাবেই স্বপ্নের বস্তু। ফাগুরামের কথার উত্তর না দিয়ে চকচকে চোখে সে ধুতি-নাগরা-লালটিন দেখতেই থাকে। দেখতে দেখতে তার মনে পড়ে যায়, সেদিন বড়ে সরকার ফাগুরামকে একটা নতুন হারমোনিয়াম দেবার কথা বলেছিলেন। চুনাওর সময় তাতে গান বাঁধতে সুবিধা হবে। কিন্তু হারমোনিয়াম, নয়া ধুতি, জামা, লালটিন ইত্যাদি দামী দামী জিনিস ছাড়াও নগদ একশো টাকা ফাগুরাম পেয়েছে জেনে এক ধরনের ঈর্ষা বোধ করতে থাকে ধৰ্মা।
ফাগুরাম ফের বলে, ‘সব কুছ বড়ে সরকারকা কিরপা। একটু থেমে বলে, ‘চুনাওর গানের জন্যে এত সব মেলে কে জানত। বড়ে সরকারকা কিরপাসে বহোত কুছ হো গৈল।’ রঘুনাথ সিংয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় গলার স্বর গাঢ় হয়ে আসে ফাগুরামের।
ধর্মা ভাবে, গানের তালিমটা বরাবর নিয়ে গেলে এই চুনাওর সময়টা কাজে লেগে যেত। ভাবে আর আপসোস হয়। পরক্ষণেই তার মনে হয়, এখন আর আক্ষেপ করে ফায়দা নেই। শুকনো গলায় সে বলে, ‘চুনাত্তর গান বেঁধে ফেলেছ?’
ফাগুরাম বলে, ‘পুরাটা হয়নি; থোড়া থোড়া হয়েছে। যা হয়েছে শুনবি নাকি?’
‘শোনাও না—’
ফাগুরাম ভাবে, এক কালের পুরনো সাকরেদ ধর্মাকে হাতের কাছে পেয়ে ভালই হয়েছে। বড়ে সরকার যে জন্য তাকে এত খাতির যত্ন করছেন, টাকা-পয়সা হারমোনিয়াম দিয়েছেন তা হল তার গান। তাকে বলা হয়েছে চুনাওর মীটিংয়ে মীটিংয়ে নতুন নতুন গান বেঁধে শোনাতে হবে। গানে এমন সব কথা থাকবে যাতে রঘুনাথসিংয়ের বিরুদ্ধে চুনাওতে যারা দাড়িয়েছে তাদের সম্বন্ধে শ্রোতাদের মন বিরূপ হয়ে ওঠে। রাতের পর রাত নৌটঙ্কীর গান গেয়ে আসর মাত করে দিলেও চুনাওর গান ফাগুরামের কাছে পুরোপুরি নতুন। যেটুকু সে বেঁধেছে সেই নমুনাটুকু কাউকে শোনাতে পারলে আন্দাজ পাওয়া যেত এই কিসিমের গান মীটিংয়ের শ্রোতারা পছন্দ করবে কিনা।
ঝড়ের বেগে গাঁটওলা সরু সরু মাংসহীন আঙুলগুলো হারমোনিয়ামের রিডের ওপর চালাতে চালাতে গান শুরু করে দেয় ফাগুরাম:
আপ সিং রঘুনাথ হ্যায়
ক্ষত্রিয়কুল প্রধান
ভোট দিজিয়ে সিংকো
হোগা সব কল্যাণ
বোল প্যারে বোল প্যারে
রঘুপতি রাঘব রাজারাম।
যাদুভরি গলা ফাগুরামের। গাম থামিয়ে সে শুধোয়, ‘কেমন লাগল ধম্মা?’
শুনতে শুনতে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল ধর্মা। খানিক আগের ঈর্ষার অনেকখানিই এখন আর নেই। বড়ে সরকার এমন গলার দাম দিয়ে ভালই করেছেন। ধর্মা বলে, আচ্ছা—’
‘লোকের পসন্দ, হবে?
.
ফাগুরাম খুশী হয়; হাল্কাভাবে হারমোনিয়াম বাজাতে থাকে। ধর্মা বলে, ‘থামলে কেন? বাকীটা গেয়ে ফেল ফাগু চাচা।’
ফাগুরাম জানায়, গানের বাকী অংশটা এখনও বানানো হয় নি। পরক্ষণেই কী মনে পড়ে যেতে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ‘তুই এখন ঘরে যা ধম্মা।’
এত খাতির করে গান শোনাতে শোনাতে আচমকা ফাগুরাম কেন যে তাকে চলে যেতে বলছে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ধৰ্মা।
ফাগুরাম ধর্মার মনোভাবটা টের পায়। এবার সে বুঝিয়ে বলে, ‘কাল গারুদিয়া বাজারে বড়ে সরকার চুনাওর মীটিন করবেন। সেখানে আমাকে পয়লা গাইতে হবে। রাতভর জেগে এখন বাকী গানটা বাঁধব, সুর চড়াব। তুই থাকলে গানা বানানো, সুর চড়ানো কিছুই হবে না। গুস্সা হোস না।’
এরপর আর গুস্সার প্রশ্ন ওঠে না। ধর্মা মানুষ হিসেবে যথেষ্টই বিবেচক। সে উঠে পড়ে।
ফাগুরাম বলে, ‘গানটা পুরা হলে তোকে পরে শুনিয়ে দেব।’
‘ঠিক হ্যায়।’ ফাগুরামের ঘর থেকে বারান্দা পেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে নামে ধৰ্মা।