সতের
মহল্লায় ঢুকবার মুখে একটা ঝাঁকড়ামাথা কড়াইয়া গাছ। দূর থেকেই ধর্মাদের চোখে পড়েছিল গাছটার তলায় একটা ছইওলা বয়েলগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেটার পাটাতনের নিচে একটা লণ্ঠন ঝুলছে বলেই অনেক তফাত থেকে গাড়িটা নজরে পড়েছিল।
অবশ্য দোসাদটোলার যে কেউ চোখ বুজেও বলে দিতে পারত সন্ধ্যের পর ওখানে একটা বয়েল গাড়ি ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে না। কেননা ক’বছর ধরে রাত একটু গাঢ় হলে গাড়িটা ওখানে এসে দাঁড়ায়। আজ বরং একটু দেরিই হয়ে গেছে।
বয়েলগাড়িটা পাঠায় হিমগিরিনন্দন। দোসাদটোলার সবাই জানে সূরয ডুবে যাবার পর চান্দা উঠতে না উঠতেই সাজতে বসে নওরঙ্গী। তারপর রাত একটু গাঢ় হলে কড়াইয়া গাছের তলায় হিমগিরির বয়েল গাড়ি এসে দাঁড়ালেই সে সেটায় গিয়ে ওঠে। আর ওঠামাত্র গাড়িটা ক্যাচোর কোচর আওয়াজ তুলে খামারবাড়ির দিকে চলতে শুরু করে।
বড়ে সরকারের একজন উৎকৃষ্ট পা-চাটা কুকুরের রাখনি বলে দোসাদটোলার কেউ নওরঙ্গীর মুখের ওপর কিছু বলতে সাহস করে না। কিন্তু সবাই তাকে ঘেন্না করে; আড়ালে যা-তা বলে।
বয়েল গাড়িটার ছায়া মাড়ানোও যেন পাপ, এভাবে খানিকটা তফাত দিয়ে দোসাদটোলায় ঢুকতে থাকে ধর্মারা। যেতে যেতে চাপা হিংস্র গলায় কে যেন বলে ওঠে, ‘রাণ্ডী ঔরত—’
বুধেরি বলে, ‘সন্ধ্যেবেলা গণাটাকে কী মারই না খাওয়ালো! হারামী ছমকী কুত্তী—’
রঘুনাথ সিং আচমকা ফাগুরামকে ডেকে পাঠানোর জন্য দোসাদপাড়ায় যে ভয় এবং আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল তার তলায় গণার বেধড়ক মারধোরের ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। বুধেরির কথায় আবার সেটা সবার মনে পড়ে যায়। গণেরি থুতু ফেলে বলে, ‘সব ঐ শাঁখরেলটার (শাঁকচুন্নী) জন্যে।’
চাঁদের আলোয় দেখা যায়, দোসাদদের চোখগুলো জ্বলছে। নওরঙ্গী সম্পর্কে তাদের মনের গুহায়িত ঘৃণা এবং বিদ্বেষ আচমকা বহুগুণ বেড়ে যায়।
কেউ আর কোন কথা বলে না; দাঁতে দাঁত চেপে একে একে দোসাদটোলায় ঢুকে পড়তে থাকে।
আরো কিছুক্ষণ বাদে গোটা মহল্লাটার খাওয়া দাওয়া চুকে যায়। ঘরে ঘরে মিট্টিতেলের ডিবিয়াগুলো আর দেখা যায় না। সারাদিন ‘গতর চূরণ’ খাটুনির পর দোসাদরা বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়েছে।
ধর্মা কিন্তু শুয়ে পড়েনি। দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের ওপর দিয়ে তিন মাইল পথ ভেঙে সে জঙ্গলে গেছে, সারাদিন নিঝুম বনভূমিতে ঘুরে কোটরা হরিণের খোঁজ করেছে। তারপর আবার তিন মাইল ভেঙে ফিরে আসা, ফাগুরামের সঙ্গে বড়ে সরকারের কোঠিতে য’তায়াত—সব মিলিয়ে তার শরীরেও কিছু আর নেই। তবু বিড়ি ধরিয়ে বারান্দার খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে বসে সে। পহেলবানদের হাতে বেদম মার খাবার পর গণার কী হাল হয়েছে একটা দেখা দরকার। তার বচপনের দোস্ত গণা। গণার জন্য খুবই কষ্ট অনুভব করতে থাকে ধর্মা।
সে যে বসে বসে বিড়ি ফুঁকে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে, তার কারণ একটাই। ধর্মা নজর রেখেছে এখনও নওরঙ্গী বয়েল গাড়িটায় গিয়ে ওঠেনি। রাণ্ডীটা কেন যে আজ এত দেরি করছে রামজী জানে। সে না যাওয়া পর্যন্ত গণাদের ঘরে যেতে সাহস হয় না ধর্মার। কেননা, ঔরতটা যদি তাকে গণার কাছে যেতে দেখে, বলা যায় না এই নিয়ে হিমগিরির কাছে কী লাগিয়ে বসবে। মাঝখান থেকে তার জানটি চৌপট হয়ে যাবে। যতক্ষণ না নওরঙ্গী দোসাদটোলা ছেড়ে যাচ্ছে, একটার পর একটা বিড়ি ফুঁকে যাবে ধর্মা।
হাতের বিড়ির আগুন যখন সুতোর কাছাকাছি চলে এসেছে সেইসময় ঠুন ঠুন করে চাঁদির পৈড়ীর (মল) আওয়াজ কানে আসে ধর্মার। ঘাড় ফিরিয়ে সে দেখে কুয়োর ওধার থেকে নওরঙ্গী আসছে। বুকের ভেতর অফুরন্ত ঘৃণা এবং বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও চাঁদের আলোয় মাঝবয়সী ডাঁটো চেহারার রাখনি ঐরতটাকে পরীর মতো মনে হয় ধর্মার। সেজেছেও সে মারাত্মক।
কাছাকাছি এসে নওরঙ্গী থমকে দাঁড়িয়ে যায়। বলে, ‘এখন ঘুমোস নি?’
‘নায়—’ ধৰ্মা মাথা নাড়ে।
‘জেগে আছিস কেন?’
‘নিন্দ, আসছে না।’
‘শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।’
বলে আর দাঁড়ায় না নওরঙ্গী। রুপোর পৈড়ীতে ফের ঠুন ঠুন মিঠা আওয়াজ তুলে কড়াইয়া গাছের তলায় সেই বয়েলগাড়িটায় গিয়ে ওঠে।
একটু পর গাড়িটা ক্যাচর কোঁচর শব্দ করে চলতে থাকে। আর ধর্মা তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ে। তারপর এই নিশুতি রাতে দোসাদটোলার শেষ মাথায় গণাদের ঘরে এসে সে অবাক হয়ে যায়। একটা ডিবিয়া জ্বেলে সৌখী এবং গণা তাদের মালপত্র বাঁধাছাদা করছে। মালপত্র আর কি, কলাই-করা দু-চারটে বাটি, অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো দুটো থালা, পেতলের লোটা, কিছু হাঁড়িকুড়ি, সৌখীন দু-তিনটি ছেঁড়া ময়লা চিটচিটে কাপড়, ইত্যাদি।
গণই এত রাতে ধর্মাকে দেখে গণারা চমকে যায়। তারপর গণাই তাকে, ‘আয়, ভেতরে আয়—’
ধৰ্মা শুধোয়, ‘কা হৈল? জিনিসপত্র বাঁধছিস যে?’
‘চলা যায়েগা।’
‘তোকে না বড়ে সরকারের পহেলবানেরা এত মারল! ‘
সৌখী ভয়ে ভয়ে বলে, ‘আমিও তো গণাকে কেত্তে বার বুঝিয়েছি। ওরা একবার তোকে মেরে গেছে। আবার যদি করজ না শুধে ভাগিস, খতম করে দেবে।’
গণা রেগে যায়, ‘এত সোজা না!’ একটু থেমে বলে, ‘তিন পুরুখ ধরে ওহী রাজপুতের ক্ষেতিতে আমরা বেগার দিয়ে গেছি। তাতেও কি করজের পানশো (পাঁচ শো) রুপাইয়া শোধ হয় নি? জান গেলেও আমি আর বেগার দেব না। কভী নেহী।’
ধর্মা হঠাৎ নিরানন্দ বোধ করে। সে যদি গণার মতো ওভাবে বলতে পারত! কিন্তু তার যে হাজারটা পিছুটান। বুড়ো মা-বাপ তো রয়েছেই, তার ওপর আছে কুশী এবং তার মা-বাপ। গণা অবশ্য বলেছে, তার জন্য ওদের কারখানায় একটা নৌকরি জুটিয়ে দেবে। কিন্তু ধর্মা ভীরু, দুর্বল। গণার মতো অত সাহস তার সিনায় নেই। পাঁচ-পাঁচটা মানুষের দায়িত্ব নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঝাঁপ দিতে তার বুক কাঁপে।
গণা ফের বলে, ‘তোরাও আর বেগার দিস না ধর্মা। আগেও তোকে বলেছি, এখনও ফের বলছি নৌকরি তোকে একটা জুটিয়ে দেবই। ঐ হারামী রঘুনাথ রাজপুত আর তার পোষা কুত্তাদের মুখে তিন লাথ মেরে এখান থেকে ভেগে যা।’
এ জাতীয় কথা গণার মতো মুক্ত মানুষের মুখেই মানায়। ধর্মা বুঝতে পারে, যে একবার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে. তাকে আর কোন ভাবেই দোসাদটোলার এই ঘৃণ্য পরাধীন জীবনের সুড়ঙ্গে ঢোকানো যাবে না। ধর্মা বলে, ‘তোর কথা আমার মনে থাকবে গণা।’
বাঁধাছাদা হয়ে গিয়েছিল। গণা শুধোয়, ‘তুই তো ওদিক থেকে এলি। এই রাণ্ডীটাকে দেখলি? জানবর আওরতটা এতক্ষণ ওর ঘরে বসে আমার ওপর নজর রাখছিল। এখন আর ওটার সাড়াশব্দ পাচ্ছি না।’
জানবর আওরত আর রাণ্ডী যে কে, বুঝতে অসুবিধা হয় না ধর্মার। কেন যে নওরঙ্গী আজ এত দেরি করে হিমগিরির কাছে গেল তাও টের পাওয়া যায়। ধর্মা বলে, ‘নওরঙ্গী রাণ্ডীটা এইমাত্র হিমগিরির বয়েল গাড়িতে উঠে চলে গেল।’
গণা বলে, ‘আমারও মনে হল ছমকী আওরতটা ঘরে নেই। তখন ডিবিয়া ধরিয়ে মায়ের বর্তন-উর্তন কাপড়া-উপড়া বাঁধতে বসেছি। ওটাকে একবার যদি ধানবাদ বাজারে পাই—’ একটা মারাত্মক ইঙ্গিত দিয়ে সে থেমে যায়।
ধর্মা চুপ করে থাকে।
গণা ভারী ভারী মালগুলো ঘাড়ে এবং হাতে ঝুলিয়ে নেয়। সৌখীকেও ছোটখাটো হাল্কা পুটলি-পাঁটলা নিতে বলে। তারপর ফু দিয়ে ডিবিয়াটা নিভিয়ে সেটা একটা ঝোলায় পুরতে পুরতে বলে, ‘চলি রে ধম্মা—’
কাল বেধড়ক মারের জের এখনও কাটে নি। গণা ভাল করে হাঁটতে পারছিল না। কোন রকমে পা টেনে টেনে সে এগিয়ে যেতে থাকে। তার পাশাপাশি ধর্মাও হাঁটে, পেছনে সৌথী।
একটু পর ধর্মাদের ঘর ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় গিয়ে নামে গণা আর সৌখী। ধর্মা আর এগোয় না। ঘাড় ফিরিয়ে গণা আরেক বার বলে, ‘যাই রে ধর্মা।’
ধর্মা ঘাড় হেলিয়ে দেয়, ‘হুঁ—’
বুড়ী মাকে নিয়ে জ্যোৎস্না-ধোয়া কাঁকুরে মাঠের ওপর দিয়ে স্বাধীন জীবনের দিকে এগিয়ে যায় গণা। আর দোসাদটোলার সুড়ঙ্গের মুখে এক পরাধীন জনমদাস স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরে হঠাৎ একটা অসহ্য কষ্ট টের পায় সে।