আকাশের নিচে মানুষ – ১৬

ষোল

আকাশের কোথাও সূর্যটাকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন মুহ্‌ আন্ধেরা অর্থাৎ সন্ধ্যে নেমে এসেছে।

ধর্মা ডাইনে-বাঁয়ে কোনদিকে না গিয়ে সিধা দোসাদটোলায় ফিরে এল। এর মধ্যে জমির কাজ চুকিয়ে হাল-বয়েল রঘুনাথ সিংয়ের খামার বাড়িতে জমা দিয়ে ভূমিদাসেরা ফিরে এসেছে। ঘরে ঘরে মিট্টি তেলের ডিবিয়া জ্বলে উঠেছে।

নিজেদের ঘরে এসে ধর্মা খরগোসটা বারান্দায় রাখতেই তার মায়ের চোখ চকচকিয়ে উঠল। খুশিতে প্রায় চেঁচিয়েই ওঠে সে, ‘খেরাহা মেরে এনেছিস!’

‘হুঁ। জঙ্গলমে মিলল।’ বলে ঘাড় গুঁজে সুড়ঙ্গের মতো ছোট দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল ধৰ্মা। টাঙ্গিটা জায়গা মতো রেখে আবার বারান্দায় ফিরে এল। লক্ষ্য করল, বাপ শিউলাল কোথাও নেই। এমনটা ক্বচিৎ কখনও হয় কিনা সন্দেহ। সারাক্ষণ মা আর বাপ কাছাকাছিই থাকে। যখন খাদ্য আর জলের জন্য যায়, একসঙ্গেই যায়। ঘরে এসে চুল্‌হা ধরিয়ে মা রসুই করতে বসলে বাপ বাঁশের খুঁটিতে ঠেসান দিয়ে বসে থাকে। আজই শুধু ব্যতিক্রম। ধর্মা শুধোয়, ‘বাপ কঁহা?’

হঠাৎ যেন মনে পড়ে যায় ধর্মার মায়ের। সে ব্যস্তভাবে জানায় গণেরির ঘরের সামনে দোসাদটোলার পুরুষেরা গিয়ে জমা হয়েছে। গণেরি বলে গেছে, ধর্মা এলেই যেন তাকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ধর্মা শুধোয়, ‘কায়?’

তার মা বলে, ‘মালুম নহী। যা, তুরন্ত চলা যা—’

ধর্মার গলার আওয়াজ পেয়ে পাশের ঘর থেকে কুশী বেরিয়ে আসে। খরগোস দেখে সে-ও রীতিমত উত্তেজিত এবং খুশী হয়। কেননা মাংসের ভাগ তারাও পাবে। দু ঘরে যারই ভাল রান্নাবান্না হয় আরেক ঘর তার ভাগ পায়।

খরগোসটা কী করে পেল, সে সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে কুশী বলে, ‘টিরকে এসেছিল।’

ধর্মা জানায়, ‘দেখা হয়েছে’

‘কোটরার বাচ্চা দিয়েছিস?’

‘মিলল নায়।’

কথা বলতে বলতে ঘরের দাওয়া থেকে নীচে নামে ধর্মা।

কুশী বলে, ‘জঙ্গলে বেফায়দাই গেলি।’

‘হুঁ। একটা রোজ বরবাদ।’ বলে গণেরির ঘরের দিকে পা বাড়ায় ধর্মা।

পেছন থেকে কুশী বলে, ‘বগুলা ভকত ক্ষেতিতে গিয়েছিল। তুাহারকা বাত পুছল।’

‘কী বলেছিস তাকে?’

‘তুহারকে বুখার ভৈল।’

‘বগুলা ভকত কী বলল?’

‘কুছ নায়।’

ধর্মা চলার গতি বাড়িয়ে দেয় এবং দোসাদটোলার মাঝামাঝি গণেরির ঘরের কাছে এসে পড়ে।

গণেরির ঘরের সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে গোল হয়ে বসে আছে দোসাদটোলার তাবত মরদেরা। মধ্যিখানে একটা কেরোসিনের মশাল জ্বলছে। তাদের মধ্যে রঘুনাথ সিংয়ের খরিদী ভূমিদাসরা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে খারিজ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো। তা ছাড়া মাঙ্গীলাল ফাগুরামের মতো স্বাধীন মানুষও রয়েছে। জটলার একধারে রুক্ষ এবড়ো-খেবড়ো পাথরে কাটা মূর্তির মতো বসে আছে গণেরি। সে এই দোসাদ সমাজের মাতব্বর। হাওয়ায় মশালটা অল্প অল্প কাঁপছিল। তার আলো সবার মুখের ওপর দুলে দুলে যাচ্ছে।

গণেরিই প্রথম ধর্মাকে দেখতে পায়। সে ডাকে, ‘আয় ধৰ্মা, বৈঠ হিঁয়া—’ নিজের পাশের জায়গাটা দেখিয়ে দেয় সে।

বসতে বসতে ধর্মা শুধোয়, ‘কা হুয়া? ডেকেছ কেন গণেরিচাচা?’

‘জরুরী কথা আছে।’

‘কী?’

কেশে গলাটা সাফ করে নেয় গণেরি। তারপর গম্ভীর মুখে শুরু করে, ‘এই সাল বহোত খতারনাক খরা চলছে। এমন খরা বিশ-পঁচাশ সালের মধ্যে কেউ কখনও দ্যাখে নি। রওদের তেজে ক্ষেতি জমি ফেটে গেছে, নদী শুকিয়ে সিরেফ বালি। নায় পীনেকো পানি, নায় খানেকো দানা। আমাদের দোসাদটোলায় যারা বড়ে সরকারের ক্ষেতিতে মিট্টি চষতে যায় না, এই শুখায় এক দোঠো মাহিনা তাদের ভরসা হল জঙ্গলের মৌয়া ফল। লেকেন এহী সাল পাইসাবালা বড়ে আদমীদের লোকেরা এসে গাই বকরাদের খিলাবার জন্যে সেই ফল নিয়ে যাচ্ছে। এমন কি বড়ে সরকারের গাই বকরি চরানিরাও এদের মধ্যে আছে। রোজ যদি এভাবে মৌয়া নিয়ে যায় আমাদের মতো গরীব বাঁচবে না।’ একদমে কথাগুলো বলে একটু থামে গণেরি।

ধর্মা বুঝতে পারে দোসাদটোলার খারিজ মানুষগুলো গণেরির কাছে গাইবকরি চরানীদের মহুয়া নিয়ে যাবার কথা বলেছে। সেই কারণেই আজ এই জরুরী ‘মীটিন’। ‘মীটিন’ শব্দটা চুনাওর দৌলতে এ অঞ্চলের ছেলেবুড়ো, মেয়ে পুরুষ, অচ্ছুৎ, সবারই জানা। ভোটের বাবুরা দো-চার সাল বাদে বাদে এখানে ‘মীটিন’ বসায়। যাই হোক, ধর্মা বলে, ‘হামনি আজ নিজের আঁখে দেখেছি গাইবকরি চরানিরা মৌয়া নিয়ে যাচ্ছে। লেকেন এ ‘মীটিন’ কীসের জন্যে?’

গণেরি বলে, ‘তুই আসার আগে আমরা ঠিক করেছি সবাই বড়ে সরকারের কাছে যাব।’

‘কায়?’

‘জানবরদের জন্যে মৌয়া নেওয়াটা রুখতেই হবে। বড়ে সরকারের পা ধরে বলব, গরীবে মা-বাপ, আপনি আমাদের বাঁচান।’

ভিড়ের ভেতর থেকে নাথু বলে ওঠে, ‘মালিক কি শুনবে? তারও তো কত ভয়েস, গৈয়া, বকরি—’

গণেরি বলে, ‘শুনবে রে নাত্থুয়া, জরুর শুনবে। এহী সাল আমাদের কথা বড়ে সরকারকে শুনতেই হবে।’

ধর্মা অবাক হয়ে যায়, ‘কায়?’

‘এহী সাল চুনাও। আমাদের বোট পেতে হবে না মালিককে?’

ধর্মা এবং জটলার প্রতিটি মানুষ অভিজ্ঞ বহুদর্শী গণেরির কথায় চমৎকৃত হয়ে যায়। ঠিকই বলেছে গণেরি। এই ভোটের সময়টা রঘুনাথ সিং নিশ্চয়ই তাদের খুশী রাখবেন। নিজের হাতে তাদের মতো অচ্ছুৎ জনমদাসদের দামী উৎকৃষ্ট ভয়সা ঘিয়ের লাড্ডু যখন বেঁটে দিয়েছেন তখন মহুয়া ফলের আর্জিটাও মঞ্জুর করে দেবেন। আর তিনি বললে গারুদিয়া-বিজুরির অন্য পয়সাওলা আদমীরাও মহুয়ার ফলের জন্য জঙ্গলে লোক পাঠাবে না। চারদিকে এত নজর আছে বলেই না গণেরি তাদের মাতব্বর।

গণেরি ফের বলে, ‘আজ এখনই আমরা বড়ে সরকারের কোঠিতে যাব। তা হলে কাল থেকে গাই-বকরি চরানিদের জঙ্গলে যাওয়া রোখা যাবে।’

গণেরির কথায় কেউ কখনও ‘না’ বলে না। তা ছাড়া মহুয়া ফলের সঙ্গে দোসাদদের বাঁচা মরার ব্যাপার জড়িয়ে আছে। সবাই যখন উঠতে যাবে সেই সময় দূর থেকে রামলছমনের গলা শোনা গেল, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। হা রে ফাগুয়া—ফাগুরাম হো, টোলাতে আছিস?’

কখনও কোন কারণেই রঘুনাথ সিং বা তাঁর পা-চাটা কুত্তারা ফাগুরামের খোঁজ করে না। তার বাপ ভিগুরাম ছিল এক পুরুষের বেগার দেওয়া কিষাণ। ভিগুরাম মরল, সঙ্গে সঙ্গে তার ছেলেরও মুক্তি ঘটে গেল। বিশ তিরিশ সালের ভেতর রঘুনাথ সিংদের তরফ থেকে কেউ তাকে ডাকে নি। ফাগুরাম নামে যে একটা আদমী দোসাদটোলায় আছে, ভাবগতিক দেখে মনে হয়েছে, রঘুনাথ সিংরা সে খবরও রাখেন না। কিন্তু হঠাৎ এই রাত্রিবেলায় উচ্চবর্ণের বামহন রামলছমনকে তারই খোঁজে অচ্ছুৎদের পাড়ায় ঢুকতে দেখে সবাই হতবাক হয়ে যায়। শুধু ফাগুরামই ভয়ে ভয়ে সাড়া দেয়, ‘হাঁ হুজৌর—’ বলেই উঠে দাঁড়ায়। তার ভয়ের কারণটা এইরকম। নিজের অজান্তে সে কোন অপরাধ করে ফেলেছে কিনা, কে জানে। হয়ত সেই জন্যই এই তলব।

এর মধ্যে জটলাটার কাছে এসে পড়ে রামলছমন। ফাগুরামের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার সঙ্গে তোকে যেতে হবে ফাগুয়া—’

‘কঁহা হুজৌর?’ দম-আটকানো গলায় জানতে চায় ফাগুরাম।

‘বড়ে সরকারকে হাভেলিমে। মালিক তোকে নিয়ে যেতে বলেছেন। চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। চল্‌, জলদি কর—’

বড় সরকারের নাম শুনেই ফাগুরামের দুই পা বেজায় কাঁপতে শুরু করে। দাঁতে দাঁত লেগে যায় কেন। কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে প্রাণপণে; গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না।

গণেরি এবার আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। ভীত মুখে শুধোয়, ‘কুছ কসুর হুয়া ফাগুয়াকে হুজৌর?’

রামলছমন বলে, ‘কুছ নায়। চলে রামসীয়া জানকীয়া। বড়ে সরকার যানে বোলা, ব্যস। এর বেশি আমি কিছু জানি না। চল্‌ ফাগোয়া, চল্‌—’

রঘুনাথ সিংয়ের নামে দাঁতে দাঁত লেগে গিয়েছিল ফাগুরামের। এবারে শরীরের হাড্ডি আলগা হয়ে যাবার উপক্রম। সে গণেরির একটা হাত ধরে চাপা ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘ভেইয়া, তোমরাও হামনিকো সাথ চল—’ অর্থাৎ একা একা যেতে তার সাহস হচ্ছে না।

গণেরি বলে, ‘আমাদের তো মৌয়া ফলের জন্যে বড়ে সরকারের কাছে যেতেই হবে।’ জটলাটার দিকে চোখ বুলিয়ে তাড়া লাগায়, ‘উঠে পড় সবাই—’

রামলছমন বলে, ‘কা রে, পুরা দোসাদটোলা ফাগোয়ার সাথ যাবি নাকি?’

গণেরি জানায়, তারা আগে থেকেই বড়ে সরকারের হাভেলিতে যাওয়া ঠিক করে রেখেছে।

রামলছমন শুধোয়, ‘কী মতলব তোদের?’

‘বড়ে সরকারের কাছে জরুরী কাম আছে।’

রামলছমন আর কোন প্রশ্ন করে না। শুধু বলে, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। আর দেরি করিস না,’ বলেই পা বাড়িয়ে দেয়।

.

রামলছমনের পেছন পেছন হেঁটে দোসাদটোলার অচ্ছুতেরা যখন রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলিতে পৌঁছয় তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।

বাড়ির বিশাল কমপাউণ্ডে চার পাঁচটা বিজলী বাতি জ্বলছে। বাতিগুলোর এত তেজ যে একটা ‘সুই’ পর্যন্ত কুড়িয়ে নেওয়া যায়।

রঘুনাথ সিং চৌকো চৌকো পাথর বসানো বারান্দায় তাঁর নির্দিষ্ট ইজি চেয়ারটিতে আধশোয়ার মতো করে পড়ে আছেন। তাঁর তিন পা-চাটা কুত্তা—ডাগদরসাব, ভকিলসাব আর আর মুনশী আজীবচাঁদ কাছাকাছিই রয়েছে।

আচমকা রামলছমনের সঙ্গে দোসাদটোলার এতগুলো লোককে দেখে একটু অবাকই হন রঘুনাথ সিং। ভুরু টান করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর আস্তে আস্তে উঠে বসে রামলছমনকে বলেন, ‘তোমাকে বললাম ফাগুরামকে ডেকে আনতে। আর তুমি পুরা দোসাদটোলাটাকেই তুলে আনলে! বুদ্ধু, নালায়েক।’

রামলছমন ভয়ে ভয়ে বলে, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। আমি তো একা ফাগোয়াকে নিয়েই আসছিলাম। লেকেন ওরাও চলে এল। আপনার সাথ কী জরুরী বাত আছে।’

রঘুনাথ সিং গণোরিদের দিকে তাকিয়ে শুধোন, ‘কা বাত রে গণেরি?’

দোসাদটোলার তাবত মানুষ হাত জোড় করে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রঘুনাথ সিংকে সম্মান জানায়। তারপর সবার প্রতিনিধি হিসেবে গণেরিই খানিকটা এগিয়ে যায় এবং জোড়হাতেই মহুয়াফল সম্পর্কে তার আর্জি পেশ করে।

সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন রঘুনাথ সিং। কী ভেবে অন্যমনস্কের মতো বলেন, ‘ঠিক হ্যায়। গাই-বকরি চরানিরা মহুয়া আনতে যাবে না।’

দোসাদরা চমৎকৃত হয়ে যায়। গণেরি ভরসা দেওয়া সত্ত্বেও তাদের ভয় এবং সংশয় ছিল, মহুয়ার ব্যাপারে তাদের আর্জি বিলকুল না-মঞ্জুর হবে। কিন্তু উল্টোটাই ঘটল। সত্যিই দূরদর্শী মানুষ গণেরি; জগৎ জীবন এবং মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে তার জ্ঞান অঢেল। এই না হলে মাতব্বর! তার সম্বন্ধে গোটা দোসাদটোলার শ্রদ্ধা হঠাৎ দশগুণ বেড়ে যায়।

এই সময় গণেরির আরেকটা কথা মনে পড়ে যায়। সুযোগ বুঝে সে বলে, ‘হুজৌর আউর একগো বাত—’

‘কী?’

‘আমাদের কুয়াটা বিশ সাল কাটাই হয় নি; বালিতে বুজে এসেছে। পানিকা বহোত তখলিফ। হুজৌরের যদি ওটা কাটাবার হুকুম হয়—’

‘ঠিক ছ্যায়। হিমগিরিকে আমি বলে দেব।’

মহুয়ার ব্যাপারে গণেরির ওপর দোসাদদের যে শ্রদ্ধা দশগুণ বেড়েছিল, এক লাফে সেটা আরো বিশ পঁচিশ গুণ বেড়ে যায়।

চুনাওর সময় কাউকে চটাবেন না রঘুনাথ সিং; যে যা চাইবে কল্পতরু হয়ে তা বিতরণ করবেন। এটা বুঝে সুযোগটাকে পুরো কাজে লাগিয়েছে গণেরি। দোসাদটোলার কীসে হিত কীসে সুখ, সর্বক্ষণ এই সবই চিন্তা করে সে। এই জন্যই তো দোসাদরা তাকে মাথায় করে রাখে।

ওদিকে রঘুনাথ সিংয়ের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মুনশী আজীবচাঁদ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিৎকার করে এক কাণ্ডই বাধিয়ে দেয়, ‘এ দোসাদিয়া, মালিককো কিরপাসে মৌয়া পেলি, বালুকাটাই মঞ্জুর হল। রামরাজ আ গিয়া রে, রামরাজ আ গিয়া—’

কানের কাছে অনবরত এ জাতীয় ফেনানো চাটুকারিতা ভালই লাগে। তবু চোখেমুখে নকল বিরক্তি ফুটিয়ে রঘুনাথ সিং বলেন, ‘আ আজীবচাঁদ, চুপ হো বাবা—।’

মালিকের কোন কথায় থামতে হয়, কোন কথা এক কানে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বার করে দিতে হয়, সে তালিম পুরোপুরিই পেয়ে গেছে আজীবচাঁদ। গলার স্বর আরো তিন পর্দা চড়িয়ে সে চেঁচিয়ে যায়, ‘রামরাজ আ গিয়া রে, আ গিয়া রামরাজ—’

নিতান্তই হাল ছেড়ে দেবার মতো ভাব করে রঘুনাথ সিং বলেন, ‘হারামজাদটাকে নিয়ে আর পারা যায় না।’ বলেই গণেরির দিকে ফেরেন, ‘সব মঞ্জুর করে দিলাম। এবার তোরা যা। শুধু ফাগোয়া থাক। ওর সঙ্গে দরকার আছে।’

জোড়হাতে নুয়ে পড়তে পড়তে গণেরি বলে, ‘হুজুরের হুকুম হো যায় তো—’

‘কী?’

‘আমরা থেকে যাই। ফাগোয়ার কাম হয়ে গেলে একসাথ টোলায় লৌটব। অব হুজৌরকা কিরপা—’

‘ঠিক আছে। তোরা ওখানে গিয়ে বোস। ফাগোয়া খালি এখানে থাক।’ রঘুনাথ সিং কমপাউণ্ডের শেষ মাথায় ওয়েলার ঘোড়ার আস্তাবলের সামনেটা গণেরিদের দেখিয়ে দেন।

ফাগুরাম বারান্দার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। আর গণেরিরা দূরে গিয়ে ঘাসের জমিতে বসে পড়ে।

রঘুনাথ সিং এবার ফাগুরামের দিকে তাকান। স্নেহের আরকে গলা ভিজিয়ে বলেন, ‘তোর কথা সবার কাছে শুনি। আগে নৌটঙ্কীর দলে ছিলি?’

রামলছমন দোসাদটোলায় গিয়ে রঘুনাথ সিংয়ের এত্তেলা দেবার পর থেকে সেই যে হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছিল ফাগুরামের, এখানে আসার পরও সেটা থামে নি। তবে রঘুনাথ সিংয়ের গলার নরম স্বর তাকে খানিকটা সাহস দেয় যেন। ফাগুরাম বলে, ‘হুঁ হুজৌর।’

‘সবাই বলে তোর গলা নাকি বহোত মিঠি, যাদু-ভরি! তোর গান শুনলে লোকে ভুলতে পারে না। লেকেন—’

বড়ে সরকারের প্রশংসার কথায় ঘাড় নুয়ে হয়ে যায় ফাগুরামের। সে কিছু বলে না!

রঘুনাথ সিং ফের বলেন, ‘নৌটঙ্কীর দলে থাকতে তোর নাম হয়েছিল গারুদিয়াকা কোয়েল—না রে?’

মুখ না তুলেই মাথা নাড়ে ফাগুরাম! আবছা গলায় বলে, ‘জী হুজৌর। মানুষজন পেয়ার করে ঐ নাম দিয়েছিল।’

‘নৌটঙ্কীর দলে এখন তো আর তুই নেই?’

‘নায় হুজৌর। তিন সাল দল ছেড়ে দিয়েছি।’

‘বুকের দোষ হয়েছিল বলে?’

‘জী হুজৌর।’

‘এখন টিসনের কাছে বসে গান গেয়ে পাইসা কামাই করিস?’

ফাগুরাম অবাক হয়ে যায়। তার মতো নগণ্য, পোকার চাইতেও অধম একটা লোক সম্পর্কে রঘুনাথ সিংয়ের মতো বড়া আদমী কী করে এত খবর যোগাড় করেছেন, তিনিই জানেন। বলে, ‘জী হুজৌর।’

একটু চুপচাপ সে চুপচাপ। তারপর রঘুনাথ সিং বলেন, ‘শুনেছি তুই নাকি গান বাঁধতে পারিস।’

লাজুক মুখে ফাগুরাম বলে, ‘হুজৌরকা কিরপা। নৌটঙ্কীর দলে থাকতে গান বাঁধতে হত।’

‘বহোত আচ্ছা। শোন, কাল থেকে তোকে আর টিসনে গান গেয়ে ভিখ মাংতে হবে না।’

মুখ তুলে দু চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় ফাগুরাম, ‘হুজৌর ভিখ না মাংলে খাব কী? ভুখা মর যায়েগা বড়ে সরকার।’

‘ভুখা তোকে মরতে হবে না। এখন থেকে তোর পেটের ভার আমার।’

‘হুজৌরকা কিরপা।’

রঘুনাথ সিং একটু ভেবে বলেন, ‘তোকে শুধু একটা কাজ করতে হবে।’

বিনা কাজে নিতান্ত দয়াপরবশ এত সাল বাদে খোঁজখবর করে তার যাবতীয় দায় দায়িত্ব কাঁধে নেবেন, এতটা মহানুভব নিশ্চয়ই রঘুনাথ সিং নন। ফাগুরাম তাঁর আদেশের জন্য দম আটকানো মানুষের মতো অপেক্ষা করতে থাকে।

রঘুনাথ সিং বলেন, ‘চুনাও হচ্ছে, সে খবর জানিস?’

‘জানি হুজৌর।’ ফাগুরাম ঘাড় হেলিয়ে দেয়।

‘আমি এবার পয়লা চুনাওতে নেমেছি। আমি ছাড়া আছে আরো পাঁচজন। পাঁচজনের মধ্যে রয়েছে সুখন রবিদাস, প্রতিভা সহায়, নেকীরাম শর্মা আর আবু মালেক। পাঁচ নম্বর যে আছে তাকে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’ রঘুনাথ না থেমে সমানে বলে যেতে থাকেন, ‘ঐ চারজন আমার আঁখ থেকে নিদ ছুটিয়ে দিয়েছে। সুখন রবিদাস অচ্ছুৎ চামার। ও বিজুরি আর গারুদিয়া তালুকের জল- অচলদের ভোট টানতে চেষ্টা করবে। প্রতিভা সহায় পাটনাবালী, বহোত বড় ঘরকা বহু। ঝরিয়ার দিকে বিশটা কয়লাখাদান আর রাঁচীতে দশ পন্দরটা কারখানার মালিক ওরা। প্রতিভাজী কায়াথদের ভোট টানবে। গারুদিয়া তালুকের নেকীরাম শর্মা বামহনদের ভোট কব্জা করতে চাইবে। বিজুরী তালুকের মাস্টার আবু মালেক টানবে সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলমান ভোট। কা রে ফাগোয়া, সমঝা?’

ফাগুরাম নৌটঙ্কীর দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে বহু ঘাটের জল খেয়েছে। মানুষ সম্পর্কে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা। কেউ হাঁ করলে তার পেটের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পায়। ফাগুরাম বলে, ‘সমঝ গিয়া হুজৌর—’

‘কা সমঝা?’

‘বামহন, কায়াথ, মুসলমান আর অচ্ছুতিয়াদের বোট যদি ওরা টানতে পারে চুনাওতে আপনি জিততে পারবেন না। বিলকুল সব চৌপট হয়ে যাবে।’

রঘুনাথ সিং খুশী হলেন। তারিফের গলায় বললেন, ‘বুঝেছিস তা হলে। বহোত তেজ (চৌকশ) আদমী তুই। তোকে দিয়ে আমার কাজ হবে।’

ফাগুরাম বলে, ‘আমাকে কী করতে হবে মালিক?’

রঘুনাথ সিং এবার যা বলেন তা এইরকম। তিনি নেকীরাম শর্মা, প্রতিভা সহায়, আর মালেক আর সুখন রবিদাসের নানা গুপ্ত কেচ্ছা যোগাড় করে দেবেন। সেই সব মালমশলা দিয়ে ফাগুরামকে রসালো মজাদার গান বাঁধতে হবে এবং রঘুনাথ সিংয়ের লোকেরা যেখানে যেখানে তাঁর জন্য ‘ক্যামপিন’ (ক্যামপেন) করতে যাবে বা যেখানে যেখানে তাঁর ‘ভোটকা মীটিং’ হবে সেই সেই জায়গায় ফাগুরামকে ঐ গানগুলো গাইতে হবে।

করণীয় ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিয়ে রঘুনাথ সিং জিজ্ঞেস করেন, ‘পারবি তো?

‘আপনিকো কিরপায় (কৃপায়) পারব হুজৌর।’

‘তবে কাল থেকে লেগে যা’

‘আপনিকো যো হুকুম! লেকেন বাড় সরকার—’

‘কী?

‘আমার হরমুনিয়াটা (হারমোনিয়াম) বিলকুল বরবাদ হয়ে গেছে। বড়ে সরকারকা ইজ্জতকা সওয়াল। এটা নিয়ে চুনাওর গানা গাইতে বেরুলে লোকে আমার গায়ে থুক দেবে। বলবে মালিকের চুনাওতে এই হরমুনিয়া বার করেছিস! মালিকের ইজ্জত চৌপট করে দিলি। তোর—’

রঘুনাথ সিং হাত তুলে ফাগুরামকে থামিয়ে দিলেন। তিনি ওর মতলবটা টের পেয়ে গেছেন। চুনাওর মওকায় একটা ভালো হারমোনিয়াম বাগিয়ে নিতে চাইছে। অতিশয় ঝানু এবং তুখোড় লোক ফাগুরাম। চুনাওর মতো রাজসূয় ব্যাপারে একটা হারমোনিয়াম অতি তুচ্ছ জিনিস। ফাগুরামকে ডাকিয়ে পাঠাবার আগেই তিনি ওটার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। বললেন, ‘ঠিক হ্যায়। কালই হারমোনিয়াম পেয়ে যাবি।’

খুশিতে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল ফাগুরাম, ‘হরমুনিয়া হো গৈল রে, মালিককা কিরপাসে হরমুনিয়া হো গৈল—’

রঘুনাথ সিং একটু হাসলেন শুধু। তাঁর ঠিক পাশেই বসে ছিলেন বদ্রীবিলাস চৌবে। তিনি বলে উঠলেন, ‘হারমোনিয়াম পেয়ে যাবি। গানা কিন্তু আচ্ছা হওয়া চাই—’

ফাগুরাম বলে, ‘চিন্তা নায় করনা। এমন গানা বানাব যে পুরে গারুদিয়া আর বিজরীর সব আদমী মাতোয়ারা বন যায়েগা। ওহী চার আদমীর চুনাও যদি কাঁচাতে না পারি আমার নাম ফাগুরাম নৌটঙ্কীবালা নহী।’ বলে রঘুনাথ সিংয়ের দিকে তাকায়, ‘বহোত রাত হয়ে গেল। হুজৌরকো কিরপা হো যায় তো হামনিলোগ ঘর লোটে—’ বড়ে সরকারের মুখের ওপর ঘরে ফেরার কথা বলার সাহস অন্য দোসাদদের হতো না।

রঘুনাথ সিং যতক্ষণ মুখ ফুটে যাবার কথা না বলতেন ওরা চুপচাপ বসেই থাকত। কিন্তু ফাগুরামের আদতই আলাদা। সে পরিপূর্ণ স্বাধীন মানুষ বলেই হয়ত বলতে পারল।

রঘুনাথ সিং বললেন, ‘হাঁ, চলে যা।’

খানিকক্ষণ পর বড়ে সরকারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দোসাদটোলায় ফিরতে ফিরতে গণেরি ফাগুরামকে বলে, ‘আমার বড় চিন্তা হচ্ছে রে ফাগোয়া—’

একটা নতুন হারমোনিয়াম পাওয়ার খুশিতে একেবারে ডগমগ হয়ে ছিল ফাগুরাম। মুখ ফিরিয়ে সে বলে, ‘কা চিন্তা গণেরিচাচা?’

‘প্রতিভাজী বড়ে ঘরকা বহু। বহোত রুপাইয়া ওদের, বহোত পহেলবানও ওদের পোষা। সুখন আমাদের মতোই অচ্ছুৎ। দুই তালুকের সব অচ্ছুৎই ওকে মানে। নেকীরামজী আবু মালেক সাবের হাতেও রয়েছে অনেক লোক। বুঝে সমঝে গানা বাঁধবি, গাইবি।

‘ডরো মাত গণেরিচাচা। সব দিক আমি সামহাল দিয়ে নেব।’

‘সামহাল দিতে পারলেই ভালো। তবু বার বার বলে দিচ্ছি, বহোত হোঁশিয়ার।’

‘তোমার হোঁশিয়ারি আমার মনে থাকবে গণেরিচাচা—’

একসময় সবাই দোসাদটোলায় পৌঁছে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *