আকাশের নিচে মানুষ – ১২

বারো

টিরকে সেদিন একজোড়া কোট্‌রার বাচ্চা (এক ধরনের হরিণ, ছাগলের যতো দেখতে, ইংরেজিতে বলে barking deer) যোগাড় করে দেবার কথা বলে গিয়েছিল। ধর্মা ভেবেছিল পরের দিনই ক্ষেতির কাজে ডুব মেরে জঙ্গলে যাবে। কিন্তু যাওয়া হয় নি। অবশ্য টিরকের কাছ থেকে দিন তিনেক সময় নেওয়া আছে।

দু’দিন পর সে দেখল, এখন জঙ্গলে না গেলেই নয়। হাতে আর একটা দিন মোটে রয়েছে। এক দিনে কোট্‌রার ছানা জোটানো যাবে কিনা সে সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত নয় ধর্মা, তবু চেষ্টা করে দেখতে হবে। সে ঠিক করল, পরের দিন ভোর হলেই মাঠকুড়ানি, জঙ্গলকুড়ানিদের সঙ্গে সে দক্ষিণ কোয়েলের শুখা খাতের দিকে বেরিয়ে পড়বে।

কিন্তু শেষ দিনেও যাওয়া হল না। তার কারণ, আগের দিন ক্ষেতির কাজের পর খামারবাড়িতে হাল-বয়েল জমা দিতে এসে সে শুনল, পরের দিন তাকে রামলছমনের সঙ্গে চার মাইল তফাতে চাহাঢ়ের হাটে যেতে হবে। ফী বছর চাষ-আবাদের মরসুমে আদিবাসী ওরাওঁ, মুণ্ডা, সাঁওতাল আর চেরোরা ওখানে কাজের আশায় এসে বসে থাকে। জমিজমার মালিকরা দরকারমতো তাদের ভেতর থেকে বেছে বেছে লোক নিয়ে যায়। পুরো চাষের সময়টা পেটভাতায় তারা জমিতে খাটবে। যাবার সময় মাথাপিছু মজুরি বাবদ কিছু পয়সা আর কিলোকয়েক করে মকাই বা জনার বা গুমো আতপ দেওয়া হবে তাদের। আবার ওরা আসবে সেই ফসল কাটার মরসুমে। দ্বিতীয় দফায় এসে ফসল খামারবাড়িতে তুলে রবিশস্যের কাজ চুকিয়ে ফিরে যাবে। বছরের পর বছর আবহমান কাল এই নিয়মেই চলছে।

চাহাঢ়ের হাটে রামলছমনের সঙ্গে ধর্মাকে যে যেতে হবে, তার কারণটা হল এই। রামলছমন মুণ্ডা আর ওরাওঁ টোরাওঁদের ভেতর থেকে ক্ষেতমজুর বেছে দিয়ে সাইকেলে চলে আসবে। আর ধর্মা তাদের সঙ্গে করে রাস্তা দেখিয়ে আনবে। ভূমিদাসদের মধ্য থেকে একেক বছর একেক জনকে রামলছমনের সঙ্গে পাঠানো হয় আদিবাসী মজুর আনতে। এবার ধর্মার পালা।

তুরপুন চালানোর মতো সরু গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হিমগিরিনন্দন বলেছে, ‘কাল সবেরা হবার আগে আন্ধেরা থাকতে থাকতে ‘পাক্কী’তে (হাইওয়ে) বাস ইস্টাণ্ডে গিয়ে বড়া পীপর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকবি। রামলছমন ওখানে গিয়ে তোকে সাথে করে নিয়ে যাবে। কানমে ঘুষল?’ বলেই ভয়সা দুধের বোতল বার করে গলায় ঢেলে দিয়েছে। খাওয়া হলে ধুতির খুঁটে ঠোঁট মুছে একটা পান মুখে পুরে চিবোতে শুরু করে দিয়েছে।

চাহাঢ়ে যাওয়া মানেই জঙ্গলে যাওয়া হবে না। জঙ্গল থেকে কোট্‌রার বাচ্চা ধরে আনতে পারলে টিরকের কাছ থেকে বিশটা টাকা পাওয়ার আশা পুরোপুরি চৌপট। কিন্তু হিমগিরির মুখের ওপর ‘না’ বলে দেবার হিম্মত ধর্মার মতো ভূমিদাসদের সিনায় থাকে না। ঘাড় নুইয়ে সে বলেছে, ‘হাঁ হুজৌর—’

হিমগিরি এবার বলেছে, ‘চাহাঢ় থেকে ফিরে আসার পর কাল আর ক্ষেতির কাম করতে হবে না তোকে। বাকী রোজ বিলকুল ছুট্টি—সমঝা?’

অর্থাৎ এতটা রাস্তা যাতায়াতের জন্য ধর্মাকে যে ধকল পোয়াতে হবে সেই বাবদে ছুটি না হয় দেওয়া হল কিন্তু তাতে বিশটা টাকা ক্ষতির কতটা পূরণ হবে, সে পুরোপুরি বুঝতে পারে না। তবু মাথা নাড়িয়ে কৃতার্থ ভঙ্গিতে বলেছে, ‘হুঁ দেওতা—’

‘চাহাঢ়ের হাটে নাস্তা আর একবেলার খোরাকিও পেয়ে যাবি।’

ফী বছরই দেখা গেছে, চাহাঢ়ে যারা মুণ্ডা ওরাওঁ জাতীয় মরসুমী কিষাণ আনতে যায় তাদের ওখানকার দোকানে নাস্তা আর দুপুরের কালোয়া খাইয়ে দেওয়া হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই এই নাস্তা এবং কালোয়াটা ভালই দেন বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং। রীতিমতো একটা ভাতকা ভোজই বলা চলে। শিকার অর্থাৎ মাংস, ডাল, ভাজি, আচার, হরা মিরচি, পেঁয়াজ দিয়ে এরকম উৎকৃষ্ট ‘ভোজন’ জীবনে ক’দিন করেছে, অচ্ছুৎ ভূমিদাসরা গুনে বলে দিতে পারে।

কালোয়ার লোভও ধর্মাকে তেমন চাঙ্গা করে তুলতে পারে না। বিশ রুপাইয়া যে বহোত বড় ব্যাপার। তবু মুখে চোখে হাসি ফুটিয়ে তাকে বলতে হয়েছে, ‘হাঁ হুজৌর—’

.

পরের দিন ভোর হতে না হতেই এক পেট মাড়ভাত্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে ধৰ্মা। আজ ক্ষেতে গিয়ে কুশীকে গণেরি বা অন্য কারো পেছন পেছন দৌড়ে কোদো বাছতে হবে বা বড় বড় শক্ত মাটির ডেলা পিটিয়ে গুঁড়ো করতে হবে।

হাইওয়ের বাসস্ট্যাণ্ডে প্রকাণ্ড পীপর গাছের তলায় ধর্মা যখন এসে পৌঁছয় তখনও আকাশে অগুনতি তারা ফুটে আছে। এখানে গোটা তিনেক যে দোকান রয়েছে তার মধ্যে চায়ের দোকানটা ছাড়া আর কোনটাই খোলে নি। ‘পাক্কী’তে এখন গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় নেই। ফাঁকা রাস্তায় অন্ধকারে ক্বচিৎ এক-আধটা দূর পাল্লার বাস চোখে পড়ে।

এখনও রাত ঝিম ঝিম করছে। পীপর গাছের মাথায় বাদুড়েরা ডানা ঝাপটায়। কামার পাখিরা (এক ধরনের পেঁচা) থেকে থেকে অদ্ভুত আওয়াজ করে ডাকতে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি উড়ছে রাস্তায়, ঝোপেঝাড়ে এবং ওধারের আদিগন্ত শস্যক্ষেত্রে। আর আছে লাখ বেলাখ মশা। ধর্মার চামড়ায় অনবরত সুই (ছুঁচ) ফোটাতে থাকে তারা।

যতক্ষণ না রামলছমন আসছে, এখানে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে হবে ধর্মাকে। অবশ্য ওপাশের চায়ের দোকানের সামনে চেরা বাঁশের বেঞ্চিটা এখন বিলকুল ফাঁকা; খদ্দের-টদ্দের একজনও নেই। সকালে রোদ উঠলে চারদিক যখন আলো হয়ে যাবে সেই সময় এই চায়কা দুকান গাহেকে ভরে উঠবে। তখন থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ওখানে ভনভনে মাছির মতো ভিড়।

বাঁশের ফাঁকা বেঞ্চিটায় বসলে কারো কোন ক্ষতি হবার কারণ নেই কিন্তু ধর্মার পক্ষে ওখানে বসা সম্ভব না। কেননা সে জল-অচল অচ্ছুৎ ভূমিদাস আর দোকানটা হল উচ্চবর্ণ এক কায়াথের। সে ওখানে বসলে মেরে হাড় ঢিলে করে দেবে।

কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, খেয়াল নেই। হঠাৎ একসময় পাটনার দিক থেকে দূর পাল্লার একটা বাস এসে পীপর গাছের তলায় দাঁড়িয়েই আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগায়।

বাস থেকে একটা লোকই নেমেছে। প্রথমটা অন্ধকারে খেয়াল করে নি ধর্মা। কখন রামলছমন আসবে সেই জন্য সে প্রায় দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে।

লোকটা তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। বলে, ‘কৌন—ধম্মা?’

ধর্মা চমকে তার দিকে তাকায় কিন্তু তৎক্ষণাৎ চিনতে পারে না। শেষ রাতে পাটনার দিক থেকে আসা বাসটা থেকে কেউ নেমে তার নাম ধরে ডাকবে, একটু আগেও ভাবতে পারে নি ধর্মা। তার ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে এখন রামলছমন ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। তাই চমকটা থিতিয়ে যেতে খানিক সময় লাগে।

অবাক চোখে তবু তাকিয়েই থাকে ধর্মা। বিড়বিড়িয়ে বলে, ‘আপ—আপ—’

লোকটা আরো কাছে এসে ধর্মার কাঁধে হাত রাখে। বলে, ‘নায় পয়চানা হামনিকো? আমাকে চিনতে পারছিস না নালায়েক?’

‘নায়—’ আস্তে মাথা নাড়ে ধর্মা।

‘হামনি গণা—’

বিস্ময়টা আচমকা কয়েক গুণ বেড়ে যায় ধর্মার। এই কি বুড়ি সৌখীর বেটোয়া (ছেলে) তার আজন্মের চেনা গণেশ বা গণা? এর পরনে এখন বিলাইতী ফুর পান্‌ট (ফুল প্যান্ট), বিলাইতী কুর্তা, পায়ে জুতিয়া, হাতে ঘড়ি, গলায় রঙ বেরঙের রেশমী রুমাল বাঁধা, মাথার চুল কাকাই দিয়ে বাহার করে আঁচড়ানো। এক হাতে চামড়ার দামী বাকস্ (স্যুটকেশ)। দেখেও বিশ্বাস হয় না দামী পোশাক-পরা শহুরে এই চমকদার ছোকরাটাই গণা! পা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত বদলে গেছে সে। অথচ বছরখানেক আগেও এই গণা তাদের সঙ্গে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতিতে মাটি চষত, ফসল রুইত, ধান-গেঁহু-তিল-তিসি পাকলে কাটতে যেত। সারা দিন মাঠে মাঠে ঘুরে তার রুখা কর্কশ চামড়া থেকে খই উড়তে থাকত, খরায় পুড়ে বারিষে ভিজে শীতে কুঁকড়ে হাত-পা ফেটে যেত, সারা শরীরে ছিল ভুখ আর কষ্টের ছাপ।

এক বছর আগে যেদিন গণা দোসাদটোলা থেকে ভেগে যায় সেদিন থেকেই মনে মনে একই সঙ্গে তাকে শ্রদ্ধা এবং ঈর্ষা করে আসছে ধর্মা। অচ্ছুৎ ভূমিদাসের ঘৃণ্য জীবন থেকে নিজের হাতে মুক্তি জুটিয়ে নেবার জন্য শ্রদ্ধা, আর ধর্মা নিজে তা না পেরে পরাধীন ক্রীতদাসের মতো দিন কাটাচ্ছে বলে ঈর্ষা।

এই মুহূর্তে অন্ধকারে স্বাধীন মানুষটাকে বড় মহিমান্বিত মনে হয় ধর্মার। কোন দিন যে গণা তার সঙ্গে মাঠে নেমে হাল-বয়েল চালাত, রঘুনাথ সিংয়ের খামারবাড়িতে ফসল কেটে নিয়ে যেত—সে সব যেন কোন মিথ্যে স্বপ্নের মতো। নিজের মাথাটা আপনা থেকেই যেন গণার পায়ের দিকে নুয়ে পড়তে থাকে ধর্মার। আস্তে করে সে বলে, ‘আপ কিধরসে (কোত্থেকে)—’

তাকে থামিয়ে দিয়ে গণা বলে, ‘আপ আপ করছিস কেন? তু করে বল।’

যদিও গণা ছিল তার আজন্মের সঙ্গী, সমবয়সী, ক’দিন আগেও একই সঙ্গে দোসাদটোলায় ক্রীতদাসের জীবন কাটিয়েছে তবু তাকে ‘তুই’ বলতে সাহস হয় না। অনেক জোরাজুরির পর শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজী হতে হয়। সে জিজ্ঞেস করে, ‘এত্তা রোজ তুই কোথায় ছিলি গণা? তুই চলে যাবার পর মহল্লার সবাই আমরা কত ভেবেছি।’

গণা তামাসা করে বলে, ‘জরুর ভেবেছিলি আমি মরে ফৌত হয়ে গেছি।’

‘আরে নায় নায়—’

গণা ফের বলে, ‘এখান থেকে পয়লা রাঁচী ভেগেছিলাম। উঁহাসে পটনা, পটনাসে ফরবিসগঞ্জ। ঘুমতে ঘুমতে (ঘুরতে ঘুরতে) ধানবাদ চলে গেলাম। এখন ওখানেই থাকি।’

ধর্মা জিজ্ঞেস করে, ‘কী করিস ওখানে?’

‘ফেক্টরিমে কাম করতা। তিন শ রুপাইয়া তলব।’

একসঙ্গে তিন শ টাকা ধর্মার চোদ্দ পুরুষে কেউ কখনও চোখে দ্যাখে নি এবং এ নিয়ে তার পরিষ্কার কোন ধারণাও নেই। সে বলে, ‘বহোত রুপাইয়া—নায়?’

গণা গম্ভীর চালে হাসে; কিছু বলে না।

ধর্মা ফের শুধোয়, ‘ফেক্টরি কা চীজ?’

‘কারখান্না। ‘মিসিনে’ (মেসিনে) বহোত কুছ ওখানে বানানো হয়।’

ধর্মা কতটুকু বোঝে সে-ই জানে। জিজ্ঞেস করে, ‘এখন তুই কোত্থেকে এলি?’

গণা জানায়, ‘ধানবাদসে। চায় খাবি? চল্‌ ঐ দুকানটায় যাই—’

চা খুবই পছন্দ করে ধর্মা কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়ে যায় উচ্চবর্ণের কায়াথ দোকানদার জেনেশুনে তাদের মতো অচ্ছুৎদের গেলাসে চা দেবে না। তার উৎসাহ ঝিমিয়ে আসে। গণাকে নিজের মনোভাব জানিয়ে দেয় সে।

গণা বলে, ‘ঘাবড়াস না, আমার কাছে পিলাস্টিকের গিলাস আছে।’ চামড়ার বাক্স খুলে চটপট দুটো রঙিন গেলাস বার করে দোকান থেকে চা কিনে ফের পীপর গাছের তলায় ফিরে আসে সে।

চা খেতে খেতে গণা বলে, ‘এত্তে রোজ বাদ কেন এলাম জানিস?’

‘কায়?’ তরিবত করে চা খেতে খেতে ধর্মা মুখ তোলে।

‘মাকে এবার নিয়ে যাব। কোম্পানিকা কোয়াটার মিলা। এত মাইনে পাই আর আমার মা ভিখমাঙনী হয়ে ঘুরে বেড়াবে তা হয় না।’

হঠাৎ ধর্মার মনে পড়ে, বুড়ী সৌখীর মুখে এই কথাটাই ক’দিন আগে সে শুনেছে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা ব্যাপার ভেবে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ধর্মা বলে, ‘তুই যে আসবি নওরঙ্গী টের পেয়ে গেছে। অন্ধেরা থাকতে থাকতে মহল্লায় গিয়ে তোর মাকে নিয়ে ভেগে যা। বহোত হোঁশিয়ারিসে যাবি।’ বহুদিন পর গণাকে দেখে, তার চালচলন এবং পোশাক-টোশাকের বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করে তার এত চমক লেগেছিল যে নওরঙ্গীর কথাটা আগে মনে পড়ে নি। তা ছাড়া এখনই রামলছমন এসে পড়বে।

‘নওরঙ্গী কৌন?’

‘ওহী ছমকী রাণ্ডী আওরত—ভুলা গৈল?’

‘আগে বড়ে সরকারের রাখনী ছিল? উসি বাদ হিমগিরিকা?’

‘হাঁ। জরুর ও রাণ্ডী তোর কথা হিমগিরির কানে তুলে দিয়েছে। করজের রুপাইয়া শোধ না করে তুই ভেগে গিয়েছিলি। তোকে পেলে হিমগিরি খতম করে দেবে।’

‘অত সোজা না। দেশে পুলিশ আছে, কানুন আছে। যা খুশি করা যায় না।’

পাটনা ফরবেশগঞ্জ ধানবাদ ইত্যাদি ভারী ভারী টৌনে ঘুরে এই এক বছরে নিশ্চয়ই অনেক কিছু দেখেছে গণা, অনেক কিছু জেনেছে। হয়ত সে যা বলছে তা-ই ঠিক। তবু আজন্মের সহজাত ভয়ের সংস্কার ঘুচতে চায় না। ধর্মার বুকের ভেতর শ্বাস আটকে আসতে থাকে। চোঁ চোঁ করে গরম চা শেষ করে গেলাসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা নে; পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে পারলাম না। যা, চলে যা। তোকে দেখলেই মহল্লার লোকজন শোর তুলে দেবে। সাথ সাথ খবর হিমগিরিকো পাস পৌঁছ যায়েগা। চুপকে চুপকে মহল্লায় ঢুকবি। মাকে নিয়ে সড়কে উঠবি না; মাঠ দিয়ে দিয়ে চলে যাবি। কেউ যেন দেখতে না পায়।’

‘তু বহোত ডর গিয়া। এত্তে রোজ বাদ তোকে দেখলাম। দু-চারটে বাতচিত করি।’

গণার দুঃসাহস তার সম্পর্কে ধর্মাকে আরো শ্রদ্ধান্বিত করে তোলে। তবু ভীতভাবে সে বলে, ‘নায় নায়। আভি রামলছমন চলা আয়েগা। তোকে দেখলে মুসিবত হয়ে যাবে।’

‘ঠিক হ্যায়। তুই যখন বলছিস তখন যাই।’ কয়েক পা এগিয়ে কী ভেবে আবার ফিরে আসে গণা। বলে, ‘গারুদিয়ায় আমাদের মতো অচ্ছুৎদের জীওন হল জানবরের জীওন। চুহা কি কুত্তার মতো বেঁচে না থেকে আমার কাছে চল। ফেক্টরিতে নৌকরি জুটিয়ে দেব। বিলকুল বঁচ (বেঁচে) যায়েগা।’

ভারী টৌনে থেকে থেকে শুধু চেহারা পোশাকে না, কথাবার্তাতেও ‘জেল্লা’ লেগে গেছে গণার। সত্যিই তো এখানে পশুর জীবন তাদের—অসহনীয় এবং গ্লানিকর। এই আলোবাতাসহীন নরক থেকে বেরিয়ে যাবার কথা বলছে গণা। বলছে সে নিজের হাতে তার জন্য স্বাধীন সম্মানজনক জীবনের দরজা খুলে দেবে। ধর্মার বুকের ভেতর রক্ত ছলকাতে থাকে; লোভে চোখ চকচকিয়ে ওঠে। অসীম আগ্রহে গণার দুটো হাত ধরে সে বলে, ‘সচমুচ এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবি তো?’

‘সচমুচ। আমার ঠিকানা মনে করে রাখ। ঊষা ইঞ্জিনার কোম্পানি; বয়লট ডিবিজান (বয়লার ডিভিসন)। ধানবাদ টিশনকা বগলমে বহোত ভারী ফেক্টরি। গেটে গিয়ে বয়লট ডিবিজন বলবি। আমাকে ডেকে দেবে।’

গণার ঠিকানা বার বার বিড় বিড় করে আওড়াতে থাকে ধর্মা।

গণা আর দাঁড়ায় না। ধর্মার রক্তে স্বাধীনতার প্রাণবাণ একটি বীজ বুনে দিয়ে হাইওয়ে ধরে এগিয়ে যেতে থাকে।

.

পাক্কীর দূর বাঁকে গণা অদৃশ্য হয়ে যাবার পর আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ধর্মা। অন্ধকার যখন দ্রুত ফিকে হয়ে আসতে থাকে, পুবদিকের আকাশ যখন ফর্সা হয়ে যায় সেই সময় পুরনো লঝঝড় সাইকেলে ঝক্কর ঝাঁই ঝক্কর ঝাঁই আওয়াজ তুলে রামলছমন এসে পড়ে। গাড়িটা না থামিয়েই চোখের তারা ধারাল করে পীপর গাছের তলায় তাকায়। ডাকে, ‘ধম্মা হো, আ গিয়া তু?’

ধর্মা তৎক্ষণাৎ সাড়া দেয়, ‘হুঁ—’

‘হামনিকো পিছা আ যা—’

অর্থাৎ চাহাঢ়ের হাট পর্যন্ত পাক্কা পাঁচ মাইল সড়ক রামলছমনের সাইকেলের পিছু পিছু এখন দৌড়ে যেতে হবে ধর্মাকে। সাইকেলটার পেছনে ক্যারিয়ার লাগানো আছে। ইচ্ছা করলে ধর্মাকে সেখানে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু উঁচু জাতের রামলছমন এই ভোরবেলা অচ্ছুৎ ভূমিদাসকে বয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের নরকে যাবার রাস্তা সাফ করতে পারে না।

.

চাহাঢ়ের হাটে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেশ রোদ উঠে গেল। পনের দিন পর পর এখানে হাট বসে। তিরিশ চল্লিশ মাইলের ভেতর এত বড় আর এত জমজমাট হাট আর নেই।

এর মধ্যেই হাটের চালাগুলোর তলায় কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। চারদিক থেকে বয়েল কি ভৈসা গাড়িতে করে আরো অনেক দোকানদার এখনও আসছে। পায়ে হেঁটে আসছে গাদা গাদা দেহাতী মানুষ।

রামলছমন হাটের মাঝখানে ঢুকল না। এক ধারে গৈয়া (গরু) হাটার পাশ ঘেঁষে সার সার পরাস কড়াইয়া আর চিলাম গাছ। পরাস এবং কড়াইয়া গাছগুলোতে সেই চৈত্র মাস থেকে গনগনে লাল রঙের থোকা থোকা ফুল ফুটতে শুরু করেছিল। এখনও গাছগুলো ফুল ফুটিয়েই যাচ্ছে।

পরাস কড়াইয়ার তলায় রোদ এবং ছায়া মেশানো জায়গাটায় অনেকগুলো মুণ্ডা ওরাওঁ চেরো আর সাঁওতাল মেয়ে পুরুষ তাদের কাচ্চাবাচ্চা সমেত বসে আছে।

ফী বছর চাষবাসের সময় আদিবাসীরা এভাবে চাহাঢ়ের হাটের একধারে এইসব গাছের তলায় গা জড়াজড়ি করে বসে থাকে। চারধার থেকে জমির মালিক বা তাদের লোকজনরা এসে এখান থেকে ক্ষেতমজুর বাছাবাছি করে নিয়ে যায়।

এতকাল হিমগিরিনন্দন স্বয়ং ক্ষেতমজুর নেবার জন্য চাহাঢ়ের হাটে আসত। ইদানীং বছর দুই তিন রামলছমন আসছে। তবে ধর্মা এই প্রথম এল।

পাঁচ মাইল পাক্কীতে সাইকেল চালিয়ে আসার দরুন জিভ বেরিয়ে গিয়েছিল রামলছমনের। সাইকেলটা একটা চিলাম গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে ওরাওঁ মুণ্ডাদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে খানিকটা দূরে গিয়ে সে বসে এবং বাছরির (বাছুরের) মতো জিভ বার করে হাঁপাতে থাকে। ধর্মাও একটা কড়াইয়া গাছের তলায় বসে হাঁপায়।

খানিকটা ধাতস্থ হবার পর উঠে দাঁড়ায় রামলছমন। বলে, ‘আমি আগে চায়-পানি খেয়ে আসি। বহোত ভুখ ভি লাগ গিয়া। আমি এলে তুই খেতে যাবি। ততক্ষণ সাইকেলের ওপর নজর রাখ। আর ওরাওঁ মুণ্ডাগুলোর ভেতর কাকে কাকে ক্ষেতির কামে নিবি দেখে রাখ্‌। দুব্‌লা কমজোরি আদমী চলবে না। সমঝা?’

ধর্মা ঘাড় কাত করে, ‘হুঁ।’

রামলছমন এগিয়ে গিয়ে হাটের থিকথিকে ভিড়ে মিশে যায়।

কড়াইয়া গাছের ছায়ায় বসে বসে এক অচ্ছুৎ ভূমিদাস একদল ভূমিহীন আদিবাসী ক্ষেতমজুরের দিকে তাকায়। জষ্ঠি মাসের বেলা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এ সময় চড়তি সূরযের ভয়ানক তেজ।

ধর্মা লক্ষ্য করল, এখনও অন্য ক্ষেতমালিক বা তাদের লোকজনেরা আদিবাসী কিষাণ নিতে আসে নি। তবে দুটো লোক ওরাওঁ-মুণ্ডাদের গা ঘেঁষে ওধারের পরাস গাছটার তলায় বসে আছে। লোক দুটো পাহাড় জঙ্গলের আদিবাসী না; মনে হয় টৌনের (শহরের) লোক। পরনে ফুর পান্ট (ফুল প্যান্ট), ভালো কামিজ, পায়ে জুতো। তারা হাত নেড়ে নেড়ে বোঝাচ্ছিল, ‘লোকের জমিনে কাজ করে ক’টা পাইসা আর পাবি? এক দো মাহিনা বাদ তো ভাগিয়েই দেবে। আমাদের সাথে চল। রোজ এক এক আদমী পাঁচ সাত রুপাইয়া মজুরি পাবি, খোরাকি পাবি, চার মাহিনা বাদ বাদ নয়া কাপড়া মিলবে, কামিজ ভি। আওরতরা শাড়ি পাবি, চোলিয়া পাবি—’ একটু থেমে ফের শুরু করে, ‘এক-দো মাহিনার পর কেউ তোদের ভাগাবে না; সালভর (বছর ভর) কামাই (রোজগার) করতে পারবি। পেটের জন্যে, কাপড়ের জন্যে কোন চিন্তা থাকবে না। বিলকুল গিরান্টি (গ্যারান্টি)।’

বছরভর যাদের পায়ে পায়ে দুর্ভিক্ষ ঘুরতে থাকে, সারা গা ঢাকার মতো যথেষ্ট আচ্ছাদন যাদের নেই, তেমন একদল সরল নিষ্পাপ ক্ষুধার্ত আদিবাসী মেয়েপুরুষের চোখ লোভে চকচক করতে থাকে। কানে শোনার পরও তাদের বোধহয় সম্পূর্ণ বিশ্বাস হয় না। একজন মধ্য বয়সী মুণ্ডা বলে ওঠে, ‘ঝুটফুস (মিথ্যে কথা)।’

লোকদুটো প্রাণপণে হাত নেড়ে বলতে থাকে, ‘নায় নায়, বিলকুল সচ। তোদের জাতের বহোত আদমী পাইসা কামাতে আমাদের সাথ গেছে।’

‘হুঁ, শুনা। রোজ পাঁচ সাত রুপাইয়া মিলেগা?’

‘জরুর।’

‘নয়া কাপড়া ভি?’

‘হাঁ।’

‘কোথায় যেতে হবে তোদের সাথ?’

‘আসাম, আগরতলা—’

‘বহোত দূর?’

‘নায় নায়, নজদিগ। হাজারিবাগসে থোড়া দূর—’

এ অঞ্চলের লোক হাজারিবাগের নামটা জানে। মধ্যবয়সী মুণ্ডা কিছুক্ষণ কী চিন্তা করে। তারপর বলে, ‘টিরেনের ডিব্বায় চড়ে যেতে হয়?’

লোকদুটো মাথা নাড়ে, ‘হাঁ। তা হলে আর বসে থেকে কী হবে। আমাদের সাথ চল। নে নে, উঠে পড়। দুকানে গিয়ে চায়-পানি, নিমকিন, বুনিয়া (বোঁদে), সমোসা খাইয়ে দিচ্ছি। টিসনে গিয়ে ভাতকা ভোজ লাগিয়ে দেব। ওঠ ওঠ—’

দূরে বসে ওদের কথাবার্তা শুনছিল ধর্মা। আগেই সে কার কাছে যেন শুনেছে, খুব সম্ভব মাস্টারজীর কাছেই—আড়কাঠিরা মুণ্ডা ওরাওঁ আর সাঁওতালদের দূর দেশে নিয়ে যায়।

কিন্তু ভালো ভালো দামী দামী খাবার এবং নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের প্রলোভন সত্ত্বেও উঠে পড়ে না আদিবাসীরা। প্রবীণ মুণ্ডা নিজেদের ভাষায় স্বজাতের লোকজনের সঙ্গে কী সব পরামর্শ করে। সাঁওতাল এবং ওরাওঁদের মধ্যে যারা বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ তারাও উঠে এসে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকে। বোঝা যায়, অজানা জায়গায় যাবে কিনা সে জন্য তারা মন ঠিক করতে পারছে না। কিন্তু টাকাপয়সা আর দু’বেলা ভরপেট খাওয়ার ব্যাপারটা রয়েছে। সেটা এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আড়কাঠি দুটো তাড়া লাগাতে থাকে, ‘কী হল রে, জলদি উঠে পড়। ধুপ (রোদ) চড়ে যাচ্ছে—’ তাদের ব্যস্ততার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, ক্ষেতমালিকের লোকেরা এসে গেলে আদিবাসীদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ হবে না। ভালো হোক, মন্দ হোক, পুরুষানুক্রমে জমির মালিকদের তারা চেনে। তাদের কাছ থেকে কতটুকু কী পেতে পারে সে সম্বন্ধে এই আদিবাসীদের স্পষ্ট ধারণা আছে। হাজার লোভ দেখানো সত্ত্বেও দূরে অজানা জায়গায় যেতে এরা ভয় পায়।

আড়কাঠিদের তাড়াতেও লোকগুলো ওঠে না। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ চালাতেই থাকে।

এইসময় রামলছমন চা এবং নাস্তা খেয়ে ফিরে আসে। এসেই শুধোয়, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। আদমী পসন্দ করে রেখেছিস?’

আদিবাসী এবং আড়কাঠিদের কথা শুনতে শুনতে এ ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ধর্মার। সে বেজায় ভয় পেয়ে যায় এবং বুকের ভেতর দম আটকে তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘কসুর হো গিয়া দেওতা। আভি পসন্দ কর লেতা—’

প্রচুর সুখাদ্যের তলায় চনচনে খিদেটা চাপা পড়ার দরুনই হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক রাগ যতটা চড়া উচিত ঠিক ততটা চড়ে না রামলছমনের। সে বলে, ‘ভইস কাঁহিকা! তুহারকা ফাইন হো গিয়া—নাস্তা বন্ধ্‌। এক দফে দুফারমে কালোয়া মিলেগা—’

সকালে ভালো নাস্তার আশা ছিল। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয়ানক মন খারাপ হয়ে যায় ধর্মার। পাক্কী ধরে পাঁচ মাইল দৌড়ে আসার জন্য খিদেটাও পেয়েছে মারাত্মক। কিন্তু কিছু করার নেই আর। দুপুর পর্যন্ত পেটে ভুখ নিয়ে তাকে থাকতে হবে।

বিষণ্ন মুখে ধর্মা আদিবাসীদের দিকে এগিয়ে যায়। রামলছমনও হাত দশেক দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছু পিছু এগুতে থাকে।

রামলছমন আর সে যে ক্ষেতমালিকের লোক তা বোধ হয় আগে টের পায় নি আড়কাঠি দুটো। তারা ভীষণ ব্যস্তভাবে উঠে পড়ে এবং খানিকটা দূরে অন্য একটা চিলাম গাছের তলায় গিয়ে বসে।

এইসব আড়কাঠিরা ক্ষেতমালিকদের ভয় পায়। তার কারণ অস্থায়ী কিষাণ ছাড়া মালিকদের চাষ আবাদের খুবই অসুবিধা। অথচ বেশ কিছুকাল ধরে এই মরসুমী কিষাণদের ফুসলে সুদূর আসাম বা ত্রিপুরায় চা-বাগান কিংবা ইটখোলায় কাজে নিয়ে যাচ্ছে আড়কাঠিরা। ফলে জমি মালিকের লোকেরা এদের ওপর ক্ষিপ্ত। ক’বছর বেশ কয়েকজন আড়কাঠি মালিকদের লোকের হাতে বেদম মার খেয়েছে। স্বার্থে চোট লাগলে যা হয় আর কি।

দূর থেকেই রামলছমন আদিবাসীদের শুধোয়, ‘কি রে, গারুদিয়ায় গিয়ে ক্ষেতের কাজ করবি তো?’ এটা বলার জন্যই বলা। সে জানে ক্ষেতের কাজ না করে ওদের গতি নেই।

রামলছমনকে ওরাওঁ মুণ্ডাদের অনেকেই চেনে। কেননা ক’বছর ধরে সে মরসুমী কিষাণ নিতে আসছে। আড়কাঠিদের কথা ভুলে গিয়ে এই মুহূর্তে ওরা বলে, ‘হ্যাঁ। সেই জন্যেই তো বসে আছি হুজৌর।’

কী করে ক্ষেতমজুর বেছে নিতে হয় সে সম্বন্ধে নিজস্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাদের দোসাদটোলার আধবুড়ো গণেরি এবং মাধোলালের কাছে এ ব্যাপারে অনেক শুনেছে ধর্মা। আদিবাসীদের কাছে এসে একটা ওরাওঁকে সে বলে, ‘ওঠ—’

ওরাওঁটা উঠে দাঁড়ায়। ধর্মা তার আগাপাশতলা এক নজর দেখে নিয়ে বলে, ‘যা, ওধারে গিয়ে দাড়া—’ লোকটাকে তার পছন্দ হয়েছে।

ওরাওঁটা ডান দিকে পা বাড়িয়েছিল, রামলছমন পেছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আরে উল্লু, একবার আঁখে দেখেই পসন্দ্‌ করে ফেললি? চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। ভালো করে টিপে টিপে হাত দ্যাখ, পা দ্যাখ, পিঠ দ্যাখ, সিনা দ্যাখ—অ্যায়সা অ্যায়সা কিষাণ পসন্দ করা যায়!’

অগত্যা রামলছমনের হুকুম অনুযায়ী লোকটার গা টিপে দেখতে হয়। 

রামলছমন ফের বলে, ‘কী মালুম হল, জানবরটার গায়ে তাকত আছে?’

ধর্মার একটা কথায় ওরাওঁটা নাকচ হয়ে যেতে পারে, আবার মাসখানেক মাস দেড়েকের জন্য দু’বেলা পেটের চিন্তা ঘুচতেও পারে। যখন তার শারীরিক শক্তি সামর্থ্যের পরীক্ষা চলছে সেইসময় করুণ চোখে সে ধর্মার দিকে তাকায়। মুখে কিছু না বললেও, চাউনি দেখে টের পাওয়া যায়—ধর্মা যেন তাকে বাতিল করে না দেয়।

ধর্মা বলে, ‘আছে হুজৌর।’

ধর্মার কথায় ভরসা করলেও রামলছমন ওরাওঁটাকে শুধোয়, ‘দু’বেলা পাটনাই বয়েলের লাঙল টানতে পারবি তো?’

‘পারব হুজৌর।’

‘ঠিক হ্যায়। ওধারে গিয়ে গাছের নিচে বসে থাক।’ বলে ধর্মার দিকে তাকায়, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া, এবার দুসরা আদমী—’

পুরুষদের বেলায় হাত-পা টিপে পরখ করে নিলেও মেয়েদের গায়ে হাত দেয় না ধৰ্মা। কিন্তু রামলছমনের একান্ত ইচ্ছা পুরুষদের মতো মেয়েদেরও যাচিয়ে বাজিয়ে নেওয়া হোক। সে জন্য ধর্মাকে ধমক ধামকও দিতে থাকে, ‘গায়ে হাত দিলে কি ফোস্কা পড়ে যাবে। রাজা মহারাজার ঘরবালী সব! চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। লাগা হাত কুত্তীদের গায়ে।’ পারলে কাপড় খুলিয়ে শারীরিক শক্তি যাচাই করিয়ে নেয় সে।

ধর্মা কুঁকড়ে যেতে থাকে। ভয়ানক কাঁচুমাচু মুখে সে বলে, ‘নায় নায় হুজৌর। এ আওরত হ্যায়—’

প্রচুর চেঁচামেচি করেও কোন মেয়ের গায়ে ধর্মাকে হাত দেওয়াতে পারে না রামলছমন। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ব্যাপারটা তাকে মেনে নিতে হয়।

কিষাণ বাছতে বাছতে বকরি কি গো-হাটের কথা মনে পড়ে যায় ধর্মার। যেভাবে মানুষ টিপেটুপে বকরি বা ছাগরি বা গাই-বয়েলের শাঁস দেখে নেয় সেইভাবে এই মনুষ্যসন্তানদের বেছে নিতে হচ্ছে। বড় খারাপ লাগে তার।

বাছাবাছি করে মেয়েপুরুষ মিলিয়ে মোট চল্লিশ জনকে একধারে জড়ো করল ধর্মা আর রামলছমন। এ ছাড়া বারো চোদ্দটা বাচ্চাও রয়েছে মেয়েগুলোর সঙ্গে। বাচ্চাগুলো গুনতির মধ্যে নয়; ওরা পুরোপুরি হিসেবের বাইরে। বাপ-মা গতর খাটিয়ে মজুরি আর খোরাকি পাবে কিন্তু বাচ্চাদের জন্য কিচ্ছু না। যাদের বাচ্চা, খাওয়াবার দায় তাদেরই। এই নিয়মই বছরের পর বছর চলে আসছে। তবু রামলছমন কথাটা আরেক বার মনে করিয়ে দেয়, ‘তোদের আন্ডা-বাচ্চার জন্যে কিন্তু কিছু মিলবে না।’

আদিবাসীরা মাথা নাড়ে, ‘জানতা হ্যায় হুজৌর—’

‘পরে আবার ঝামেলা বাধাস না।’

‘নায় নায়।’

এবার শিশুগুলোকে বাদ দিয়ে অন্যদের মাথা গুনে গুনে প্রত্যেককে একটি করে টাকা দেয় রামলছমন। বলে, ‘এক রুপাইয়া ‘ইডভান্স’ দিলাম। যা, খেয়ে আয়। খাওয়া হলে এখানে লৌটবি। সমঝা?’

‘হাঁ হুজৌর—’ একটা করে টাকা হাতে পেয়ে আদিবাসী মানুষগুলো ভীষণ খুশী। তারা ছাতু বা মকাই টকাই কেনার জন্য দোকানের খোঁজে চলে যায়।

এই সময় চাহাঢ়ের হাটের আরেক দিক থেকে বহু মানুষের চিৎকার ভেসে আসে।

‘সুখন রবিদাসকো—’

‘বোট দো, বোট দো—’

‘সুখন রবিদাসকো—’

‘বোট দো, বোট দো—’

চেঁচাতে চেঁচাতে লোকগুলো এদিকে চলে আসে। সব মিলিয়ে তিরিশ চল্লিশ জন। তাদের মাঝখানে সাতাশ আটাশ বছরের, মাঝারি মাপের, পেটানো চেহারার হাসিমুখ সুখন রবিদাসকে দেখা যায়। পরনে মোটা সুতোর খাটো ধুতি আর মোটা কাপড়ের কামিজ, পায়ে সস্তা খেলো স্যান্ডেল। সর্বক্ষণ তার মুখে হাসি লেগেই থাকে।

গারুদিয়া আর বিজুরি তালুকের বাইরেও অনেক দূর পর্যন্ত চামারদের এই ছেলেটাকে বহু লোক চেনে এবং খাতির টাতিরও করে। সুখন ‘পড়িলিখী’ আদমী; পাটনায় গিয়ে কয়েক সাল ‘কালেজে’ পড়েছে। তা ছাড়া বহোত তেজীও। বামহন, কায়াথ, ভকীল, ডাগদর, সরকারী অফসর—সবার মুখের ওপর ঠাঁই ঠাঁই কথা বলতে পারে। আংরেজি বলে জলের মতো। উঁচু জাতের লোকেদের সঙ্গে নানা ব্যাপারে তর্কাতর্কি করার জন্য অনেক বার মারধরও খেয়েছে। একবার এমন মার খেয়েছিল যে পুরা দু দিন বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিল।

সুখনকে অনেক কাল ধরেই চেনে ধর্মা। ওদের বাড়িও গারুদিয়া মৌজায়—চামারটোলায়। চামারটোলাটা যদুবংশী ছত্রিদের অর্থাৎ গোয়ালাদের গাঁ চৌকাদের পশ্চিম ধারে। যাই হোক অচ্ছুৎ হয়েও সুখন বামহন কায়াথদের পরোয়া করে না। এই সব নানা কারণে তাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করে ধর্মা। জল-অচল অচ্ছুৎ হলেও একটি আদমী বটে সুখন রবিদাস; বহোত তেজ আদমী। বহোত উঁচা শির।

রামলছমনও সুখনের ভোটের দলটাকে লক্ষ্য করছিল। ক্রমশঃ তার ভুরু দুটো কুঁচকে যাচ্ছে আর মুখে তাচ্ছিল্য বিরক্তি আর প্রচণ্ড রাগ ফুটে উঠছে। সে বলে, ‘আচ্ছা, অচ্ছুৎ চুহার বাচ্চাটা তা হলে চুনাওতে নেমেছে! বোট মাঙতে বেরিয়েছে! হাঁথীর সাথ চুহা লড়তে এসেছে! এক লাথ খেয়ে যে চ্যাপ্টা হয়ে যাবি হারামজাদের ছৌয়া (ছেলে)।’ এখানে যার সম্বন্ধে হাতীর উপমা দেওয়া হল তিনি রঘুনাথ সিং।

রামলছমনের কথাগুলো পুরোপুরি কানে ঢোকে না ধর্মার। দু চোখে শ্রদ্ধা এবং বিস্ময় নিয়ে সুখনের দিকে তাকিয়েই থাকে। যতদূর মনে আছে, সুখন রবিদাস এই প্রথম চুনাওতে নামল। অন্যমনস্কের মতো রামলছমনকে সে শুধোয়, ‘সুখন রবিদাস কি বড়ে সরকারের সাথ চুনাওতে লড়বে?’

রামলছমন বড় বড় গজালের মতো কালচে দাঁত বার করে খিঁচিয়ে ওঠে, ‘হাঁ রে উল্লু, হাঁ। চুহাকা বাচ্চাটার পাখনা গজিয়েছে। মরেগা, জরুর ফৌত হো যায়েগা। কাঁহা বড়ে সরকার, কাঁহা ও চামারকে ছৌয়া!’

সুখন রবিদাস তার চুনাওর দল নিয়ে ধর্মাদের সামনে দিয়ে উত্তর দিকে থিকথিকে ভিড়ের ভেতর মিশে যায়। সেদিকে তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে তাকিয়ে থাকে রামলছমন।

বেলা আরো বেড়ে গেছে। চড়তি সূরয আকাশের ঢালু পাড় বেয়ে বেয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। ধর্মা হঠাৎ টের পায় সেই গনগনে খিদেটা পেটের ভেতরটা যেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।

রামলছমন সুখনদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ধর্মাকে বলে, ‘ওরাওঁ মুণ্ডাগুলো ফিরে এলে আর দেরি করব না; গারুদিয়ায় ফিরে যাব।’

খিদের কথাটা ‘বলব না বলব না’ করেও শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলে ধর্মা, ‘হুজৌর দেওতা, বহোত ভুখ লাগি।’

রামলছমন চেঁচিয়ে উঠে, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া! হারামজাদ তুহারকো আভি ‘ফাইন’ কর দিয়া—নাস্তা বন্ধ! ভুল গিয়া?’ বলতে বলতেই তার মনে পড়ে যায়, ক’দিন আগে বড়ে সরকার নিজের হাতে অচ্ছুৎ দোসাদদের ভৈসা ঘিয়ে তৈরি দামী লাড্ডুয়া বেঁটে দিয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই চুনাও। এখন ছোট বড় চামার-দোসাদ-গঞ্জু-ধোবি-তাতমা-ধাঙড় কাউকেই চটানো ঠিক না। চুনাওর দিক থেকে এরা কেউ মানুষ না; একটা করে ভোট। দেশে বামুন কায়াথ আর কত? এইসব গরীব জল-অচল মানুষই তো গুনতিতে বেশি। এরা সবাই ক্ষেপে গেলে মতদান রঘুনাথ সিংয়ের বিরুদ্ধে চলে যাবে। সাধে কি আর বড়ে সরকার ভুখা, আধা-নাঙ্গা, জানবর য্যায়সা অচ্ছুৎগুলোকে আর তাবত গারুদিয়া তালুকের দেহাতী মানুষগুলোকে মিঠাইয়া বিলোন! মাথাটা ভীষণ সাফ তাঁর।

সরকার এই এক ‘মিশিন’ বার করেছে—চুনাওকা মিশিন। ভোট হল এই মিশিনের তেল। বেশি লোকের ভোট যে পাবে মিশিন তার পক্ষেই চালু থাকবে। তাই জলচল হোক, জল-অচল হোক, লিখিপড়ী হোক আর আনপড়ই হোক—চুনাওতে জেতার জন্য সবাইকেই খাতির করতে হয়, তোয়াজ করতে হয়। চুনাওর মরসুম পার হলে মাথার ওপর থেকে নামিয়ে এদের উপযুক্ত জায়গায় ঝেড়ে ফেলা হবে। অর্থাৎ বড়ে সরকারের নাগরার তলায় তখন আবার এরা ফিরে যাবে।

এসব কথা এই মুহূর্তে রামলছমনের মনে পড়বার কথা ছিল না; সুখন রবিদাসের ভোটের দলটাকে দেখে হঠাৎ মনে পড়ে যায়। যার ভোট আছে, এমন কোন লোককেই এখন চটানো ঠিক নয়। সে তাড়াতাড়ি ফের বলে ওঠে, ‘ফাইন মাপ কর দিয়া। এই নে, এক রুপাইয়া নাস্তার জন্যে, দো রুপাইয়া কালোয়ার জন্যে। তুরন্ত খেয়ে আয়।’

নগদ তিনটে টাকা পাওয়া আর আকাশের তিনটে তারা হাতে পাওয়া ধর্মার কাছে একই ব্যাপার। খুশি এবং উত্তেজনায় তার বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড লাফাতে থাকে। আর সেই অবস্থাতেই হাটের দিকে দৌড়য় ধর্মা। কিছুক্ষণ পর পুরাপাক্কা দু’টাকা খরচা করে রহেড় ডাল, বেইগন আর বদির তরকারি, শিকার এবং পুদিনার আচার দিকে ভাতকা ভোজ খেয়ে পরাস আর কড়াইয়া গাছগুলোর তলায় ফিরে আসে। নাস্তার একটা টাকা তার হাতেই থেকে যায়। এটাই তার মস্ত লাভ। এই টাকাটা খরচ না করে সে জমিয়ে রাখবে ভবিষ্যতের জন্য।

এদিকে ওরাওঁ এবং মুণ্ডারাও খেয়েদেয়ে ফিরে এসেছে। রামলছমন আর দেরি করতে চাইল না। তাড়া দিয়ে বলে, ‘পেট ঠাণ্ডা করেছিস। এবার চল সব—’

ওরাওঁরা তৎক্ষণাৎ রাজী, ‘হুঁ-হুঁ—’

ধর্মারা যে চল্লিশ জনকে বেছে নিয়েছে তারা ছাড়াও পরাস গাছগুলোর তলায় আরো অনেক আদিবাসী বসে ছিল। চারপাশের অন্য ক্ষেতমালিক বা তাদের লোকজনেরা ঐ সব ঝড়তিপড়তি ওরাওঁ মুণ্ডাদের ঝাড়াই বাছাই করে নিচ্ছে। ধর্মা যখন খেতে গিয়েছিল সেই ফাঁকে অন্য ক্ষেত মালিকরা এখানে হানা দিয়েছে।

আদিবাসীদের সঙ্গে করে এক সময় ধর্মারা রওনা হয়ে যায়। তার আগেই মেয়েরা তাদের বাচ্চাগুলোকে পিঠের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে। আগে আগে লঝঝড় সাইকেলে ঝক্কর ঝাঁই ঝক্কর ঝাঁই আওয়াজ তুলতে তুলতে পাক্কী ধরে গারুদিয়ার দিকে এগুতে থাকে রামলছমন। পেছনে বাকী সবাই।

চড়তি সূরয খাড়া মাথার ওপর উঠে এসে এখন গনগনে আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই জষ্ঠি মাসের দুপুরে রোদের ভাপ মারাত্মক হলেও হাওয়া দিচ্ছে প্রচুর। উল্টোপাল্টা তেজী হাওয়া উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে আড়াআড়ি ছুটে চলেছে।

মাতব্বর গোছের সেই আধবুড়ো মুণ্ডাটার পাশাপাশি হাঁটছিল ধর্মা। খানিকক্ষণ আগে আড়কাঠি দুটো কড়াইয়া গাছের তলায় এরই গা ঘেঁষে বসে আসাম বা ত্রিপুরা কোথায় যেন নিয়ে যাবার জন্য অনবরত ফুসলে যাচ্ছিল।

হাঁটতে হাঁটতে মাঝবয়সী মুণ্ডার সঙ্গে নানারকম গল্প হতে থাকে। কথায় কথায় ধর্মা জানতে পারে, ওদের গাঁও এখান থেকে কম করে পনের বিশ ক্রোশ উত্তরে। সালভরই তাদের বড় কষ্ট। বিশেষ করে এই শুখা গরমের সময়টা।

রোদে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এক দানা খাদ্য কোথাও নেই, দশ হাত বালি খুঁড়লে তবে হয়ত এক লোটা খাবার জল মেলে।

মুণ্ডাটা যা বলে যায় তা এইরকম। এখন চাষের মরসুম বলে তাদের মতো কিছু শক্তসমর্থ তাকতওলা মানুষকে জমির মালিকেরা কাজের জন্য ডাকে। বাদবাকীদের যে কী হাল, ভাবা যায় না। কাজ নেই, খাদ্য নেই, পাইসা নেই। একমাত্র ভরসা হল মহুয়ার ফল আর সুথনি। টৌনের লোকেরা এসে মাঝে মাঝে তাদের অনেককে কাজের আর ভরপেট খাওয়ার লোভ দেখিয়ে বহু দূরের কোন অজানা দেশে নিয়ে যায়।

ধর্মার মতো ভূমিদাসদের সঙ্গে এই ভূমিহীন আদিবাসী ক্ষেত-মজুরদের তফাৎ সামান্যই। জীবনযাত্রা প্রায় একই ধাঁচের। তফাতের মধ্যে এরা মোটামুটি স্বাধীন আর ধর্মারা বাপ-নানার করজের শেকলে পুরুষানুক্রমে বাঁধা হয়ে আছে। তবু খানিকটা কৌতূহল দেখায় ধর্মা। জিজ্ঞেস করে, ‘টৌনের লোকেরা তোদের জাতের আদমীদের কোথায় নিয়ে যায়?’

মুণ্ডাটা হাত নেড়ে বলে, ‘মালুম নহী।’

‘যারা বাইরে যায়, ফিরে এসে কী বলে? খেতে পায়? পাইসা পায়?’

‘মালুম নহী।’

‘কায়?’

‘যারা বাইরে গেছে তাদের কেউ এখনও ফেরে নি। পিছা সাল গাঁও ধামুদা থেকে শ আদমী গেল। তার আগের সাল গোলগোলি, পাট্টন, চৌহট—এই সব গাঁও থেকে গেল দেড় শ আদমী; কোই নহী লোটা।’

‘বেঁচে আছে তো?’

‘মালুম নহী—’

এরপর চুপচাপ। পাশ দিয়ে দূর পাল্লার বাস গরম বাতাস চিরে ক্ষ্যাপা জানবরের মতো অনবরত ছুটে যায়, সাইকেল-রিকশা যায়, ভৈসী আর গৈয়া গাড়ি যায়। আর এক ভূমিদাস মুক্ত আকাশের তলা দিয়ে একদল ভূমিহীন মানুষকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।

রামলছমন ধর্মার কাঁধে মরসুমী ক্ষেতমজুরদের দায়িত্ব চাপিয়ে জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন আর তাকে দেখা যায় না।

মাইলখানেক যাবার পর চাহাঢ় হাটের সেই আড়কাঠি দুটো দৌড়ুতে দৌড়ুতে এসে তাদের ধরে ফেলে। খুব সম্ভব তারা পেছন পেছন আসছিল। রামলছমনকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে এখন এগিয়ে এসেছে। ক্ষেত মালিকের লোক রামলছমন তাদের দেখলে গোলমাল বাধিয়ে দেবে। তাই এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে সুযোগ বুঝে এগিয়ে আসা।

ধর্মা যে মধ্যবয়সী মুণ্ডাটার সঙ্গে কথা বলছিল, তার গা ঘেঁষে চলতে চলতে আড়কাঠিদের একজন জিজ্ঞেস করে, ‘তোরা কোথায় যাচ্ছিস?’

মুণ্ডাটা জানায়, ‘গারুদিয়া তালুকে।’

‘কার জমি চষতে যাচ্ছিস?’

‘মালুম নহী। ইসকো পুছো—’ বলে মধ্যবয়সী মুণ্ডা ধর্মাকে দেখিয়ে দেয়।

আড়কাঠিরা চাহাঢ় হাটের একধারে খানিকক্ষণ আগে কড়াইয়া গাছের তলায় ধর্মাকে দেখেছে। ক্ষেতমালিকের লোকের সঙ্গে এলেও চেহারা এবং জামাকাপড়ের হাল দেখে তারা টের পেয়ে গেছে, ধৰ্মা তুচ্ছ কিষাণ বা ঐ জাতীয় কিছু; তাকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। তারা জানতে চায়, গারুদিয়ার কার জমিনে আদিবাসীদের লাগানো হবে।

ধর্মা বলে, ‘বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের।’

আড়কাঠিরা আর দাঁড়ায় না, নতুন কোন প্রশ্নও করে না। ঘুরে চাহাঢ়ের হাটের দিকে ফিরে যেতে থাকে।

সামান্য এই খবরটার জন্য জেঠ মাহিনার এই ঝলসানো রোদে এতটা রাস্তা কেন যে ওরা দৌড়ে এসে আবার ফিরে যাচ্ছে, জানবার ইচ্ছা হয় ধর্মার। সাতপাঁচ ভেবে শেষ পর্যন্ত আর কথাটা জিজ্ঞেস করা হয় না।

.

রাস্তায় মাঝে মাঝে জিরিয়ে শেষ পর্যন্ত গারুদিয়ায় রঘুনাথ সিংয়ের খামারবাড়িতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। এর মধ্যে গণেরি মাধোলাল কুশীরা হাল-বয়েল জমা দিয়ে দোসাদটোলায় ফিরে গেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *