দশ
জষ্ঠি মাসের বেলা বেশ চড়ে গেছে। আর খানিকটা পরেই সূর্যটা খাড়া মাথার ওপর উঠে আসবে। গরম লু-বাতাস চারদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে যেন। গাছপালা বা মানুষের ছায়া দ্রুত ছোট হয়ে আসছে।
ঝলসানো মাঠের মাঝখানে পূর্বপুরুষদের মতোই লাঙল ঠেলে চলেছে ধর্মা। তার পেছন পেছন ঊর্ধ্বশ্বাসে অন্যদিনের মতোই দৌড়ুতে দৌড়ুতে কোদো বেছে চলেছে কুশী।
ওধারে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের পাশে বিজুরি তালুকে অন্য সব দিনের মতো ট্রাক্টর চলছে। হাইওয়ের ওপর বাস-লরি-সাইকেল রিকশার স্রোতে কামাই নেই। যে কোন দিনের মতোই গারুদিয়ার এই অঞ্চলটায় সেই একই চিত্র। হাল চষতে চষতে আজ একটা তফাত শুধু চোখে পড়েছে। হাইওয়ে দিয়ে একটা জীপে করে ক’টা ছোকরা গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে খানিকক্ষণ আগে বিজুরির দিকে চলে গেছে, ‘রঘুনাথ সিংকো—’
‘বোট দো—’
কালই পাটনা থেকে চুনাওর টিকিট নিয়ে ফিরেছেন রঘুনাথ সিং। আর আজই তাঁর লোকজনেরা ভোট মাঙার জন্যে দিগ্বিদিক চষে বেড়াতে শুরু করেছে।
বহুদর্শী আধবুড়ো গণেরি ওধারের একটা ক্ষেত্র থেকে শুধু বলেছে, ‘বোটকা খেল চালু হো গৈল—’
…
দুপুরের ঠিক আগে একটা লঝঝড় সাইকেলে চেপে ঝক্কর ঝাঁই ঝক্কর ঝাঁই শব্দ করতে করতে এল রামলছমন। আগেই জানানো হয়েছে, আজীবচাঁদ যেমন রঘুনাথ সিংয়ের পা-চাটা কুত্তা, এই রামলছমন তেমনি বড়ে সরকারের খামারবাড়ির সর্বেসর্বা হিমগিরি-নন্দনের পা-চাটা কুত্তা।
রামলছমনের কাজ হল, রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতিতে ক্ষেতিতে ঘুরে জনমদাসদের কাজের তদারকি করা। সোজা কথায় কে কোথায় ফাঁকি মারছে, কে আড্ডা দিচ্ছে, কে গা ঢিলে দিয়ে কাজে গাফিলতি করছে, এ সব দিকে নজর রাখা এবং দরকারমতো হিমগিরিকে খবরগুলো জানিয়ে দেওয়া। লোকটার গিদ্ধড়ের চোখ—সে চোখে ধুলো ছিটিয়ে কিছু করার উপায় নেই।
কাল রামলছমন ক্ষেতিতে আসে নি। আজ নিশ্চয়ই তার শোধ তুলে ছাড়বে। ধর্মারা ভয়ে বুকের ভেতর শ্বাস আটকে লাঙল ঠেলে যেতে থাকে। লোকটা যে কথায়বার্তায় বা ব্যবহারে মারাত্মক ধরনের, তা নয়। কিন্তু হিমগিরির কাছে গিয়ে কখন কী লাগিয়ে বসবে তার ঠিকঠিকানা নেই। তার ফলাফল বেশির ভাগ সময় বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
সাইকেলটা মাঠের একধারে একটা কোমরবাঁকা সীসম গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে ‘রামসীয়া’র গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসে রামলছমন, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া—’ প্রায় সারাদিনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই একটাই পদ সে গেয়ে থাকে। হিমগিরির যেমন ‘কানমে ঘুষল’, রামলছমনের তেমনি ‘চলে বনবাস রামসীয়া—’। এগুলো তার ধরতাই বুলি।
রামসীতা জনকীয়ার গান গাইলে কী হবে, রামলছমনের নজরটা সর্বক্ষণ ভাগাড়ের দিকে। ভূমিদাসদের কাজকর্মের ওপর নজর তো সে রাখেই, তা ছাড়া তার চোখ চরকির মতো ছুঁক ছুঁক করে অচ্ছুৎদের ডাঁটো যুবতী মেয়েদের দিকেই বেশি ঘুরতে থাকে। শুধু ভূমিদাসদের মেয়েই না, যে কোন ঢঙ্গিলা যুবতী ছুকরি দেখলেই রামলছমন চনমনিয়ে ওঠে। ‘চলে বনবাস রামসীয়া জনকীয়া—’ গাইতে গাইতে তার গা ঘেঁষে গিয়ে দাড়ায় সে। এই স্বভাবের জন্য গারুদিয়া এবং বিজুরি তালুকের লোকজনেরা তাকে বলে ‘বগুলা ভকত’ বা বকধার্মিক। আর ভূমিদাসরা বগুলা ভকত তো বলেই, তা ছাড়া আরো বলে ‘চুহা’। সেটা হিমগিরির কাছে অনবরত তাদের নামে রামলছমন লাগায় বলে। ও যা লোক, অচ্ছুৎদের পান থেকে চুনটা একবার খসলে আর উপায় নেই। সেটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে হিমগিরির কানে গুজগুজিয়ে তুলে দ্যায়।
দূর থেকে রামলছমনকে দেখামাত্র সবাই সতর্ক হয়ে গেল। চাপা গলায় আধবুড়ো গণেরি বলে, ‘হোঁশিয়ার—’
অন্যরা অস্পষ্ট স্বরে বলাবলি করে, ‘চুহাকে বচ্চে আ গৈল—’
যুবতী মেয়েদের মধ্যে দুর্দান্ত বেপরোয়া এবং ডাকাবুকো যারা তারা বলে, ‘আ গৈল গারুদিয়াকে নাগরিয়া বগুলা ভকত—’
গানের সেই পদটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার গাইতে গাইতে পরনের কাপড় লিকলিকে উরু পর্যন্ত গুটিয়ে এ ক্ষেত থেকে ও ক্ষেতে চরকিপাক দিতে থাকে রামলছমন। ঘুরতে ঘুরতে সে চলে আসে আধবুড়ো ধানপতের ছ’কোণা জমিতে। তার বয়সী অনেকেই আছে ভূমিদাসদের মধ্যে। কিন্তু ধানপত কমজোরি দুবলা মানুষ; গেল সাল চীচকের ব্যায়রামে খুবই কাবু হয়ে পড়েছিল। সেই থেকে শরীর ভেঙে পড়েছে। লাঙল ঠেলতে ঠেলতে এ বছর যেভাবে সে ধুঁকছে তাতে বেশিদিন আর তাকে খোরাকি দিয়ে রঘুনাথ সিং রাখবেন বলে মনে হয় না। খুব শীগগিরই সে খারিজ হল বলে।
রামলছমনকে দেখে গায়ের সবটুকু শক্তি হাতের মুঠে জড়ো করে ধানপত পাথরের মতো নীরেট মাটিতে প্রাণপণে লাঙলের শীষ ঢোকাতে থাকে। পরিশ্রমে এবং কষ্টে হাত আর গলার শির দড়ির মতো পাকিয়ে ওঠে তার; ঘোলাটে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে। পোড়া তামাটে রঙের গা বেয়ে স্রোতের মতো গল গল করে ঘাম ছুটতে থাকে।
কতটা জমি চষা হয়েছে, চোখ কুঁচকে দেখতে দেখতে রামলছমন বলে, ‘ক্যা রে বুড়হা, আধি রোজ কাম করে এইটুকু জমিন চষেছিস!’ সত্যি সত্যিই বেশি চষতে পারে নি ধানপত। অবশ্য বেশি চষলেও রামলছমন এই এক কথা প্রতিটি জমিতে ঘুরে ঘুরে বলবেই। এটা ওর কথার মাত্রা বা মুদ্রাদোষ, যাই বলা যাক না।
ধানপত উত্তর না দিয়ে লাঙল ঠেলতে থাকে। ঠিকমত জমি চৌরস করতে না পারলে তার ফলাফল কী দাঁড়াবে, সে জানে। নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুবই ভীত হয়ে পড়েছে ধানপত।
রামলছমন ফের বলে, ‘হারামজাদ অচ্ছুৎ ভৈস! চলে বনবাস রামসীয়া জনকীয়া—’ কথার ফাঁকে এক পদ গেয়েই আবার শুরু করে, ‘ধান্দেবাজ ফাঁকিবাজ নিকম্মা উল্লু কাঁহিকা! আধি রোজে এই কাম! বিনা কামে খোরাকি মারার মতলব! অ্যায়সা অ্যায়সা পেটের দানা মেলে! চলে বনবাস রামসীয়া জানকিয়া—’
ওধারের ক্ষেত থেকে আধবুড়ো গণেরি হাতজোড় করে এগিয়ে আসে। দোসাদটুলির সে মাতব্বর মানুষ। সবার বিপদে আপদে একেবারে বুক দিয়ে পড়ে। ধানপতের হয়ে সে কাকুতি মিনতি করতে থাকে, ‘ধানপতিয়া দুবলা আদমী; পিছলা সাল ভারী বুখার ভৈল। বামহন দেওতা, গুসসা দায় হোনা। বহোত রওদ (রোদ)—’
গণেরির দিকে ফিরে খেঁকিয়ে ওঠে রামলছমন, ‘বহোত রওদ! শালেলোগদের মাখ্খনের তবিয়ত, রোদে গলে যাবে! চলে রামসীয়া জানকীয়া—বারিষ নামার আগে পুরা জমিন চষা না হলে সব হারামজাদের খোরাকি বিলকুল বন্ধ্—’
গণেরি বলে, ‘হো জায়গা দেওতা, জরুর হো জায়েগা। গুস্সা নায় হোনা—’
রামলছমন বলে, ‘কথায় কাম হবে না। চষা না হলে সবার বুকে শুখা চানা ফেলে রগড়ানো হবে।’ বলেই সামনের দিকের জমিতে তাকায়। সেখানে লাঙল দিচ্ছে বুধেরি। তার একটা পা সামান্য ছোট। রামলছমন চেল্লায়, ‘অ্যাই বুধেরি, ল্যাংড়া বকরা (ছাগল), তোর জমিনের আধাআধিতেই তো আঁচড় পড়ে নি।’
বুধেরি ভয়ে ভয়ে হাতজোড় করে বলল, ‘বারিষকো মুহূমেই (শুরুতেই) হো যায়েগা হুজৌর—’
‘দেখেগা।’
শুধু ধানপত বা বুধেরিকেই না, আরো কয়েকজনকে ধমকধামক দিল রামলছমন, তর্জন গর্জন করল। বোঝা যায়, যাদের ওপর সে বেশি হম্বিটম্বি করেছে তাদের যথেষ্ট দুর্ভোগ আছে। ক্ষেতি থেকে সোজা খামারবাড়িতে গিয়ে হিমগিরির কাছে তাদের নামে লাগাবে রামলছমন। ফলে খোরাকি বাবদ যে মাড়োয়া গেঁহু মকাই বা সামান্য গুমো আতপ মেলে তার থেকে কিছু কাটা যেতে পারে। হিমগিরি আর রামলছমন আংরেজি করে বলে ‘ফাইন’ বা জরিমানা। রামলছমনের চুকলির জন্য ফী সপ্তাহে কাউকে না কাউকে ‘ফাইন’ দিতে হয়।
রামলছমন এবার আলাদাভাবে কাউকে না, তাবত খরিদী ভূমিদাসের উদ্দেশ্যেই গলায় অনেকখানি আবেগ ঢেলে বলে, ‘কাম কর। থোড়া পেয়ারসে লাঙল চালা। বড়ে সরকার মালিক তোদের জন্যে এত করছেন, খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখছেন। নিমকহারামী না করে তাঁর জন্যে তোরা কিছু কর। কতবার তোদের বলেছি, মালিকের জন্যে করলে ‘পুণ’ (পুণ্য) হয়—’
ক্ষেতে ক্ষেতে ভূমিদাসেরা বয়েলের ল্যাজ মোচড়াতে মোচড়াতে চেঁচাতে থাকে, ‘উররা–উরর–উরর–’
বুধেরির ক্ষেতে দাঁড়িয়ে রামলছমন শকুনের চোখ দিয়ে চারদিক দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে আর ‘রামসীয়া, জানকীয়া’ গাইতে গাইতে খানিকক্ষণ পর ধর্মার জমিতে চলে আসে। ধর্মার পেছন পেছন দৌড়ুতে দৌড়ুতে যথারীতি আগাছা বাছছিল কুশী; কখনও বা একটু থেমে ঝুঁকে মাটি ভেঙে ঝুরঝুরে করে দিচ্ছে।
আলের ওপর দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ ধর্মা এবং কুশীর কাজ দ্যাখে রামলছমন। কিন্তু না, হাজার চেষ্টা করেও কোথাও এতটুকু খুঁত বার করতে পারে না সে। তাতে মনে মনে কিছুটা ক্ষেপে যায়। কী ভেবে সে ডাকে ‘এ ধম্মা—’
ধর্মা লাঙল ঠেলতে ঠেলতেই ঘাড় ফেলায়। বলে, ‘ক্যা দেওতা?’
‘কাল রাতে বাজারে কালালীর কাছে তোকে আর কোশীকে দেখলাম না?’
ধর্মা তটস্থ হয়ে উঠে। ঢোক গিলে বলে, ‘উধরি গৈয়া থা (গিয়েছিলাম)।’
রামলছমন শুধোয়, ‘আমাকে দেখে তুরন্ত ভেগে পড়লি যে তোরা?’
ধর্মা ভাবে, সত্যি গিধের চোখ জানবরটার। কুশী আর সে যে তাকে দেখে দারুখানার রাস্তা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে এসেছিল, সেটা তা হলে রামলছমনের নজর এড়ায় নি। তার চোখে ধুলো দেওয়া খুবই মুশকিল। শ্বাসটানার মতো শব্দ করে সে বলে, ‘নায় দেওতা, নায়। আপহিকো নায় দেখা হামনি—’
‘ঝুটফুস—’
‘নায় দেওতা, নায়—’
এ ব্যাপারে আর জল ঘোলা করে না রামলছমন। সরু মরকুটে বাঁশের মতো পা ফেলে ফেলে কাছে এসে কুশীর গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। কুশী চলতে শুরু করলে, সে-ও চলতে থাকে। কুশী থামলে সে-ও থামে।
এই ভয়টাই করা হয়েছিল। যুবতী ছুকরি দেখলে বিশ হাত তফাতে আলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, তেমন ধাতই নয় রামলছমনের। এ ব্যাপারটা নিত্য নৈমিত্তিক। জমিতে এসে চাষ- টাষ নিয়ে খানিকক্ষণ একথা সেকথা বলার পর মেয়েদের গায়ের সঙ্গে আঠার মতো সেঁটে যায় বগুলা ভকতটা।
রামলছমন গ্যাদগেদিয়ে একটু হাসে। তারপর দ্রুত ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া’ কলিটা গেয়ে বলে, ‘কী গতর করেছিস কোশিয়া! ক্যা গদরাই জওয়ানি। ফিলমকা (ফিল্মের) হিরোইন য্যায়সা। হোয় হোয়, চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া—’ গারুদিয়া আর বিজুরি তালুকে বর্ষাকাল বাদে সারা বছর তাঁবু খাটিয়ে যে টেম্পোরারি সিনেমা হল বসানো হয় সেখানে গিয়ে প্রচুর হিন্দী ছবি দ্যাখে রামলছমন। যে ছবিই আসুক সে দেখবেই। ‘রামসীয়া জানকীয়া’র সঙ্গে তার কথায় ‘ফিলমকা’ হিরো-হিরোইনেরা এসে যায়।
লোভের বদবু মাখানো রামলছমনের গোল গোল ছোট ছোট চোখ কুশীর বুক কোমর এবং কোমরের তলার দিকে অনবরত ছোটাছুটি করতে থাকে। আর মাঠের কোদো বাছতে বাছতে দম আটকে আসে কুশীর, শরীর কুঁকড়ে যেতে থাকে। কেননা খাটো হেটো শাড়ি আর জামায় তার পুষ্ট সতেজ শরীর পুরোপুরি ঢাকা পড়ে নি। আগাছা বাছার ফাঁকে ফাঁকে একবার বুকে হাত চাপা দেয় কুশী, একবার শাড়ির খুঁট টেনে কোমরের কাছের ফাঁকা জায়গাটা ঢাকতে চেষ্টা করে।
কুশীকে দেখতে দেখতে কুর্তার পকেট থেকে কৌটো বার করে রামলছমন। সেটার ভেতর থেকে বেরোয় চুন এবং তামাকপাতা। হাতের পাতায় ডলে ডলে খৈনি বানিয়ে প্রথমে নিজের ঠোঁটের ফাঁকে খানিকটা ঢুকিয়ে দ্যায়। তারপর কুশীকে বলে, ‘লে—’
কুশী খৈনি যে খায় না তা নয়। কিন্তু রামলছমনের কাছ থেকে নেশার এই উপহার নেবার ফলাফল কতদূর যেতে পারে সে সম্বন্ধে তার মোটামুটি ধারণা আছে। দূর থেকে শুধু শরীর দেখার দাম হিসাবে খৈনি দেবার মতো শৌখিন লোক রামলছমন নয়। কিছু নিলে এই বগুলা ভকত তার দশগুণ উশুল করে নেবে অন্যভাবে। কুশী একটা হাত নেড়ে কাচুমাচু মুখে বলে, ‘নায় দেওতা, নায়—’
‘লে না—’ রামলছমন একরকম জোরই করতে থাকে।
‘নায় নায়—’
‘ঠিক হ্যায়—’ অগত্যা বাকী খৈনিটুকুও দাঁতের গোড়ায় পুরে পিচিক করে থুতু ফেলে রামলছমন ফের বলে, ‘চলে বনবাস রামসীয়া জানকীয়া। ক্যা বদন, ক্যা আঁখ, ক্যা সিনা রে তোর কোশিয়া! বামহন-কায়াথ-রাজপুতদের ঘরে অ্যায়সা মেলে না।’
নিজের শরীরটা নিয়ে কী করবে, কোথায় লুকোবে, ভেবে পায় না কুশী। করুণ মুখে সে বলতে থাকে, ‘নায় নায় দেওতা, অ্যায়সা নায় বোলো—’
রামলছমন আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, হাল বয়েল চালাতে চালাতে হঠাৎ থমকে ঘুরে দাঁড়ায় ধর্মা। এতক্ষণ একটা কথাও বলে নি সে। এবার বলে, ‘বামহন দেওতা, এক বাত—’
‘কী?’
‘কুশী জমিন সাফ করতে না পারলে বারিষ নামের আগে কাম পুরা হবে না। অব আপহিকো কিরপা।’ বলে রামলছমনের মুখের দিকে তাকায় ধর্মা। বগুলা ভকত যেভাবে কুশীর পেছনে লেগেছে তাতে তাকে ঠেকানো দরকার। কিন্তু ও যা ধূর্ত শয়তান আদমী তাতে কাজের দোহাই ছাড়া অন্য কোনভাবেই আটকানো যাবে না। রামলছমনের রকমসকম দেখে ভেতরে ভেতরে ভয়ানক রেগে যাচ্ছিল ধর্মা। ইচ্ছা হচ্ছিল দৌড়ে ঘর থেকে একটা টাঙ্গি বার করে এনে চুহাটার ঘাড়ে কোপ ঝেড়ে দ্যায়। শালে শয়তানের বাচ্চাটা কেন কুশীর পেছনে লেগেছে, সে বোঝে। কিন্তু টাঙ্গি ঝেড়ে ফায়দাও যে নেই, তাও সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হয়। তার আর কুশীর জীবন স্রেফ খতরা হয়ে যাবে। তার চাইতে কৌশলে ওকে যতটা তফাতে হটিয়ে রাখা যায়।
গোল গোল স্থির চোখে কিছুক্ষণ ধর্মাকে দ্যাখে রামলছমন। পিচিক করে আরেক বার থুতু ফেলে। থেমে থেমে বলে, ‘এ ছোকরিরা তুহারকা দুলহানিয়া হোগী—নায়?’ তারপর উত্তরের জন্য না দাড়িয়ে ‘চলে বনবাস—’ গাইতে গাইতে ডান দিকের চারটি ক্ষেত পেরিয়ে গিধনীর কাছে চলে এল।
গিধনী মাধোলালের জমিতে তার লাঙলের পেছনে দৌড়ে দৌড়েমাটি সাফ করে। রামলছমনকে দেখে বুক চিতিয়ে চোখ কুঁচকে সে বলে, ‘আও আও বামইনিয়া, হামনিকো প্যারা দুলহন—’ দোসাদটুলির এই একটা মেয়ে যার মুখে কিছুই আটকায় না। কাউকে রেয়াত করে কথা বলা তার ধাতে নেই। বিশেষ করে রামলছমনকে সে আদপেই পরোয়া করে না। যে নিজের মান-সম্মান রাখতে জানে না তাকে কে রেয়াত করবে?
রামলছমন ট্যারাবাঁকা কালচে দাঁত বার করে শিয়ালের মতো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘তু বহোত হারামী ছোকরিয়া—’
গিধনি বলে, ‘তা হলে আমার গায়ে গা ঘষতে রোজ রোজ আসো কেন রে বামহনিয়া?’
রামলছমন উত্তর দ্যায় না; আরেক দফা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। হাসিটায় নোংরা থকথকে ক্বাথ মেশানো যেন।
গিধনি আবার বলে, ‘ক্যা মাংতা হামনিকো পাস? কী চাও?’
রামলছমন হাসতে হাসতেই চোখ টেপে। তারপর তড়িঘড়ি করে বলে, ‘বুঝিস না। জওয়ান আদমী জওয়ানী ছোকরির কাছে কেন ঘোরে?’
দ্রুত এক পলক মধ্যবয়সী গিধটাকে দেখে নেয় গিধনি। তারপর বলে, ‘তুম জওয়ান ছোকরে—’
‘তব ক্যা বুড়হা? উমর (বয়স) তিশ সাল পুরা হয় নি; গেল বছর গর্মীতে আধা শির সফেদ হয়ে গেল। আগর—’
‘এক কাম করোগে বামহনিয়া?’
‘কা?’
‘আমাকে সাদি করবে?
অন্য দিন রামলছমনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নোংরা অশ্লীল ঠাট্টা করে গিধনি। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অচ্ছুৎ দোসাদের ঘরের মেয়ে হয়ে কিনা সে রামলছমনকে সাদি করতে বলার মতো হঠকারিতা দেখায়! বগুলা ভকত যত খারাপ যত গন্ধী লোকই হোক না, বামহন তো—দুনিয়ার সেরা জাত। কী করে যে গিধনির সিনায় এত সাহস হয়, কে জানে। গোটা গারুদিয়া তালুকটাই যেন কিছুক্ষণের জন্য একেবারে বাজ পড়ার পরের অবস্থার মতো স্তব্ধ হয়ে যায়।
এদিকে হাসতে হাসতে থমকে গিয়েছিল রামলছমন। মুখ আলগা হলেও গিধনির মুখে আগে আর কখনও এমন কথা শোনে নি। রাগে রামলছমনের মুখচোখ এবং কানের লতি গনগনে আগুনের মতো হয়ে উঠতে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে, ‘বদ আওরত! রাণ্ডী কাঁহিকা—’ বলেই ঘাড়টা বাঁই বাঁই করে ডাইনে এবং বাঁয়ে ঘোরাতে থাকে।
প্রথমটা চারধারের জমিতে খরিদী কিষাণরা ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে মজা পেয়ে তারা দাঁত বার করে হাসতে শুরু করেছে। রামলছমনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ধাঁ করে মুণ্ডু ঘুরিয়ে আবার বয়েলের ল্যাজ মোচড়াতে মোচড়াতে চেঁচাতে থাকে, ‘উরর—উরর—উররা—’
এদিকে গিধনি রামলছমনকে বলে, ‘সাদি না করে মধু পীতে (খেতে) চাও? তা হলে রাতকো ঘরের দুরাজ (দরজা) খুলে রাখব। চলে এসো—’
উচ্চবর্ণের লোকেরা, বিশেষ করে মালিক বড়ে সরকার এবং হিমগিরি বা রামলছমনের মতো তাঁর প্রবল দাপটওলা নৌকরেরা পুরুষানুক্রমে খরিদী কিষাণদের ঘরের যুবতী মেয়েদের ভোগদখল করে আসছে। সূর্যোদয় সূর্যাস্তের মতো এটা স্বাভাবিক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু তা নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কেউ ঠাট্টা করবে, মজা করবে সেটা খুবই অসম্মানজনক।
গিধনির কথায় চারপাশ থেকে হাসির শব্দ ওঠে। একসঙ্গে অনেক আতসবাজী ফাটলে যেরকম হয় সেরকম শব্দ। জষ্ঠি মাসের তাতানো বাতাসে ভর করে সেই আওয়াজ ফাঁকা মাঠের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে।
রামলছমন ক্ষিপ্তের মতো হাত-পা ছুঁড়ে এধার-ওধার দেখতে দেখতে চিৎকার করতে থাকে, ‘কৌন হাসতা, কৌন রে বান্দরকে বাচ্চা—’
কেউ উত্তর দেয় না। নিপাট ভালমানুষের মতো মুখ করে ঘাড় গুঁজে সবাই ফের জমি চষতে থাকে।
গিধনির দিকে ফিরে রামলছমন আবার বলে, ‘হারামী আওরত কাঁহিকা। তুহারকে হালচাল বদ, জবান বদ, তোর সারা গায়ে বদবু (খারাপ গন্ধ)—’
‘তা হলে বদবু শুকবার জন্য আসো কেন রে বামহনিয়া? বগুলা ভকত, তোমাকে কে অচ্ছুৎদের মেয়ের কাছে আসতে বলে!’
রামলছমন গলার স্বর শেষ পর্দায় তুলে এবার চেঁচাতে থাকে, ‘তোকে আমি সিধা করে ছেড়ে দেব রাণ্ডী— ‘
আজ যেন গিধনির ওপর জিন বা সাঁখরেল (ভূত বা শাঁকচুন্নী) ভর করেছে। দু হাত নেড়ে তাচ্ছিল্যের একটা ভঙ্গি করে সে। তারপর নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে করতে বলে, ‘আরে যা যা বামহনিয়া, তোর মতো সিধা করনেবালা আমি বহোত দেখেছি। যা যা, তুহারকে মুহ্মে থুক—’ বলে তার মুখে ঠিক না, জমিতে গুনে গুনে সাতবার থুতু ফেলে গিধনি।
গিধনির মা-বাপ এবং ওপর দিকের চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে খিস্তি খেউড় করতে করতে রামলছমন বকের মতো পা ফেলে ফেলে তার সেই সাইকেলটায় গিয়ে ওঠে। তারপর ক্ষেতের পাশের শক্ত পাথুরে রাস্তার ওপর দিয়ে ঝক্কর ঝাঁই, ঝক্কর ঝাঁই আওয়াজ তুলতে তুলতে হাইওয়ের দিকে চলে যায়।
বড় সড়ক বা হাইওয়ের বাঁকে রামলছমনের সাইকেল অদৃশ্য হয়ে যাবার পর চারদিকের ক্ষেত থেকে সবাই উঠে এসে গিধনিকে ঘিরে ধরে, ‘তোর জন্যে ঐ বামহনিয়া চুহাটা আমাদের সবার পেট (খোরাকী বা রোজগার) কাটার ব্যবস্থা করবে। বিলকুল ভুখা থাকতে হবে ক’রোজ।’
গিধনি বোঝাতে চেষ্টা করে, ‘কসুর করেছি আমি। পেট যদি কাটে আমারটা কাটবে। তোমাদের কেন কাটবে? কভি নায়—’
‘চুহাটার কথায় আমরা হাসলাম যে। হারামজাদ বগুলা ভকত গুসসা হো গৈল। শোধ না তুলে কি আমাদের ছাড়বে ঐ বামহনিয়া গিধটা জানিস না ও কিত্তে বড়ে (কত বড়) খাতারনাক আদমী—’
গিধনি হাত নাড়তে নাড়তে বলে, ‘ডরো মাত। আমি সব ঠিক করে দেব।’
মাধোলাল গলার শির ফুলিয়ে চেঁচায়, ‘কী ঠিক করবি তুই, কী ঠিক করবি? মর গিয়া হামনিলোগ, জরুর মর গিয়া—’ কোন ব্যাপারে জোর দিতে হলে বা উত্তেজিত হয়ে উঠলে একটা কথা দু’বার করে বলে সে।
গিধনি বলে, ‘আরে নায় নায়। বগুলা ভকতের কথায় যদি খোরাকি কাটা যায় আমি সিধা বড়ে সরকারের মকানে চলে যাব। বলব, গলতি আমার। খোরাকি কাটতে হলে আমারটা কাটো।’
এতক্ষণ অভিজ্ঞ জ্ঞানী গণেরি একটা কথাও বলে নি। চুপচাপ সবার চিৎকার চেঁচামেচি আর গিধনির কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার সামনের দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলে, ‘তোরা ডরাস না; এখন খোরাকির মাড়োয়া কি গেঁহু কাটা যাবে না।’ গণেরির বলার ভঙ্গিটি ধীর কিন্তু অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময়।
সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘কায় কায়?’ গণেরির কথায় তারা রীতিমত অবাকই হয়েছে।
গণেরি বুঝিয়ে দেয়, ‘চুনাও আ গৈল নায়? বড়ে সরকার হামনিলোগকো মিঠাইয়া খিলাইল। ভোট মাংনেকো টেইনমে (টাইমে) খোরাকি নায় কাটেগা।’ গণেরি বহুদর্শী মানুষ। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বিপুল। এই ভূমিদাসদের মধ্যে যে কোন বিষয়ে তার জ্ঞান সব চাইতে বেশি। আগেও অনেক বার দেখা গেছে সে যা বলে তার ষোল আনাই ঘটে যায়। অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে সে বুঝেছে এই নির্বাচনের সময় বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং তাঁর ভোটদাতাদের চটাবেন না—তা তারা তাঁর জমির খরিদী ভূমিদাসই হোক, জল-অচল অচ্ছুৎই হোক আর ভিখমাঙোয়া গরীব মানুষই হোক।
গণেরির কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে আবার সবাই চাষের কাজে নামে; এখন আর তাদের কোনরকম দুর্ভাবনা নেই।
সন্ধের আগে আগে সূর্য ডোবার মুখটায় রঘুনাথ সিংয়ের ভূমিদাস এবং অবোধ বয়েলের পাল যখন খামারবাড়িতে ফিরছে সেই সময় সবার চোখে পড়ে ভোটের সেই গাড়িটা বিজুরি তালুকের দিক থেকে ফিরে আসছে।
‘রঘুনাথ সিংকো—’
‘বোট (ভোট) দো।
‘রঘুনাথ সিং—’
‘বোট দো।’
জীপটা তাদের পাশ কাটিয়ে একসময় বাকের আড়ালে হারিয়ে যায়।
গণেরি যে সত্যি সত্যিই অত্যন্ত জ্ঞানী এবং দূরদর্শী, খামারবাড়িতে এসে তা টের পাওয়া যায়। ধর্মাদের এক দানা খোরাকিও কাটা গেল না।