এক
এখন, জষ্ঠি মাসের এই বিকেলে গোটা আকাশ জুড়ে গলা কাঁসার রং ধরে আছে। পশ্চিম দিকের ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে সূর্যটা অনেকখানি নেমে গিয়েছিল। ঘণ্টা দেড়েকের ভেতর সন্ধ্যে হবার কথা। তবু এখনও রোদে ছুরির ধার।গরম বাতাস আগুনের ভাগ ছড়াতে ছড়াতে উল্টোপাল্টা ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে।
নিচে ছোটনাগপুরের চাষের ক্ষেত। জায়গাটার নাম গারুদিয়া। এখানে যেদিকে যতদূর চোখ যায়, চৌকো তেকোণা ছ-কোণা আট-কোণা, নানা মাপের নানা আকারের অগুণতি জমি। বহুকালের প্রাচীন আকাশের তলায় হাজার হাজার বছরের পুরনো সব শস্যক্ষেত্র পৃথিবীর গায়ে নানারকম জ্যামিতিক নকশা এঁকে পড়ে আছে।
চাষের ক্ষেতগুলোর একধারে হাইওয়ে। এই সড়ক দিয়ে একদিকে রাঁচী, আরেক দিকে পাটনার বাস যায়। গেল বছর বর্ষায় দক্ষিণ কোয়েলের বন্যায় হাইওয়ে ভেঙেচুরে গিয়েছিল। ঠিকাদাররা ভাঙা সড়কে মাটি ফেলেছে, তবে এখনও পীচ-টীচ পড়ে নি। বাস, ট্রাক, সাইকেল-রিকশা কিংবা বয়েল-গাড়ি অনবরত ছোটাছুটির ফলে বড় সড়কে সবসময় ঘন হয়ে ধুলো উড়ছে। ধুলোর চিকের আড়ালে ওদিকটা ঝাপসা। হাইওয়ের ওধারে দক্ষিণ কোয়েলের একটা রোগা সরু খাত এই জষ্ঠি মাসের রোদে শুকিয়ে ধু-ধু মরুভূমির মতো দেখায়।
অনেক দূরে আকাশ যেখানে শিরদাঁড়া বাঁকিয়ে মাটিতে নেমেছে সেখানে ছোটনাগপুরের একটা ছোটখাটো রেঞ্জ। এধারে ওধারে ট্যারাবাঁকা চেহারার কিছু কিছু সীসম গাছ, হঠাৎ হঠাৎ এক-আধটা ঢ্যাঙা তাল, ঝোপঝাড় কি আগাছার জঙ্গল ঝাঁ ঝাঁ রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুড়ছে।
একদিকে হাইওয়ে, আরেক দিকে ছোটনাগপুর রেঞ্জ—মাঝখানে এই গারুদিয়া তালুকের যাবতীয় জমিজমার মালিক একজন—রাজপুত ক্ষত্রিয় রঘুনাথ সিং। সড়কের ওধারে দক্ষিণ কোয়েলের পাড় ধরে যত চাষের জমি সে-সব মিশিরলালজীর। ঐ জায়গাটার নাম বিজুরি—বিজুরি তালুক।
এখন এই গারুদিয়া মৌজার সব জমিতে হাল-লাঙল চলছে। পুরো চৈত্র আর বৈশাখ মাস রোদে পুড়ে পুড়ে মাটি ফুটিফাটা হয়ে আছে। দু-আড়াই মাস এক কণা বৃষ্টি পড়ে নি। বৃষ্টি দূরের কথা, এদিকের আট-দশটা তালুক বা মৌজার তিন-চার লাখ মানুষ ছিটেফোটা মেঘও দেখে নি। ফলে মাটি এখন পাথরের চাঙড়া হয়ে আছে।
রাজপুত রঘুনাথ সিং-এর একটা ছ-কোণা ক্ষেতে এখন বয়েল-টানা লাঙল চালাচ্ছে ধৰ্মা বা ধম্মা। তাঁদের গাঁও-মহল্লার মানুষজন অবশ্য ধম্মাই ডাকে। এ ডাকটা খাতির বা স্নেহবশতঃ। সে একাই না, চারদিকের অন্য সব জমিতেও লাঙল ঠেলছে ধাওতাল, রামনাগিন, ঢোড়াইলাল, বুধেরি, এমনি আরো অনেকে। তাদের সঙ্গে শক্তসমর্থ মেয়েরাও জমিতে নেমেছে। লাঙলের ফলায় মাটি উপড়ে ফেলার পর তা থেকে কোদা (এক ধরনের আগাছা) কিংবা আগের সালের ফসলের শুকনো শেকড়-বাকড় বেছে একধারে জড়ো করে রাখছে।
রাজপুত রঘুনাথ সিং-এর তালুকে ধর্মা একজন বেগার খাটা ভূমিদাস। সে শুধু একাই না, তার ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে যারা এখন মাটি চষছে তারাও তা-ই। কিন্তু এই ভূমিদাসদের জীবন বা সমাজের ইতিহাস এখন না।
ধর্মার বয়েস তেইশ-চব্বিশ। গায়ের রং পোড়া তামার মতো। চৌকো মুখ, চওড়া মাংসল কাঁধ, পাথরের চাঙড়ার মতো বিশাল বুক, হাত দুটো কাঁধ থেকে জানু পর্যন্ত নেমে এসেছে, আঙুলগুলো মোটা মোটা এবং থ্যাবড়া, হাতের পাঞ্জা দুটো প্রকাণ্ড। তার কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল, মুখে খাপচা খাপচা পাতলা দাড়ি-গোঁফ। পরনে হাতকাটা লাল গেঞ্জি আর ডোরা-দেওয়া ইজের। ঘামে ময়লায় সেগুলো চিটচিটে। গলায় কালো কারে রুপো-বাঁধানো বাঘনখ ঝুলছে।
বাঁ হাতের শক্ত মুঠে চেপে লাঙলের ফলা যতটা সম্ভব মাটির গর্ভে ঢুকিয়ে বয়েল দুটোর পিঠে ছপটি হাঁকায় ধর্মা, আর থেকে থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘উর-র-র, উ-র-র, উর-র-রা—’
জষ্ঠি মাসে রোদের হল্কায় তেজী বয়েল দুটোর চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতে থাকে। তবু জন্তু দুটো প্রাণপণে লাঙল টানে। এদিকে লাঙলের ফালের ঘা লেগে পাথুরে মাটি থেকে আগুনের ফুলকি ছুটতে থাকে যেন।
যাই হোক না, মানুষ বা জন্তুর এখন রেহাই নেই। রঘুনাথ সিং দিন সাতেক আগে পাটনা গেছেন। তালুকের আর বাজার-গঞ্জের লোকজনরা বলাবলি করছিল, তিনি নাকি এবার এখানকার ‘এম্লে’ (এম-এল-এ) হবেন। সেই সব ব্যাপারেই দরকারী কাজে তাঁর পার্টনা যাওয়া। ধর্মারা শুনেছে তিনি এম্লে বনার ‘বাত পাক্কী’ করে ফিরে আসার পর চাষের জন্য পালামৌর কিছু ওঁরাও, সাঁওতাল আর অচ্ছুৎ ক্ষেতমজুব আনা হবে। ওরা ফুরনের কিষাণ। চাষের মরশুমে ফী বছরই ওদের আনা হয়। মরসুম ভর কাজ করে। শেষ হলেই ওদের বিদায় করা হয়। ফের ওরা আসবে সেই ফসল কাটার সময়। ক্ষেতিবাড়ি থেকে ধান, গেঁহু, বজরা, মুগ, মসুর, কলাই বা রবিচাষের ফসল কেটে রঘুনাথ সিংয়ের খামারে তুলে দিয়ে, ফিরে যাবে। কিন্তু যতদিন না রঘুনাথ সিং পাটনা থেকে ফিরছেন এবং ওঁরাও সাঁওতাল বা ভূমিহীন কিষাণরা আসছে ততদিন ধর্মাদের এবং তাদের লাঙল-টানা জন্তুগুলোর জিরেন নেই। রঘুনাথ সিং হুকুম দিয়ে গেছেন, আবাদের কাজ চষে ফেলতেই হবে। কেননা এ ক’দিনে অন্তত আধাআধি জমি আষাঢ়ে ‘বারিষ’ নামলে একদিনও দেরি করা হবে না; সঙ্গে সঙ্গে বীজ রোয়া শুরু করতে হবে।
লাঙল চালাতে চালাতে কোয়েলের শুকনো খাতের ওপারে তাকাল ধর্মা। শানানো রোদে চোখ দুটো সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকে যায় তার। তা ছাড়া সারা গা বেয়ে ঢলের মতো ঘাম ঝরছে। কপাল থেকে কয়েক ফোঁটা চোখের ওপর এসে পড়ে। হাতের পিঠে চোখ মুছে আবার তাকাল ধর্মা। মিশিরলালজীর তালুকেও লাঙল পড়েছে। তবে বয়েল-টানা লাঙল না, ‘মিশিনের’ লাঙল অর্থাৎ ট্রাকটর। গনগনে আকাশের তলায় ট্রাকটরের ভট ভট শব্দ আগুনের মতো লু-বাতাসে ভর করে খা-খা মাঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
রঘুনাথ সিংয়ের জমিনে চাষ-আবাদের হাল মান্ধাতা কি তার বাপ-ঠাকুরদার আমলের মতো। সেই বয়েল, সেই লাঙল। পুরানা জমানা এখানে হাজার বছর ধরে অনড়। আর কোয়েলের ওধারে মিশিরলালজীর জমিনে নয়া জমানা এসে গেছে। ওখানে পুরানা যুগের জন্তু অর্থাৎ বয়েল আর কামারের তৈরি লাঙল অচল। ক’বছর হল ওখানে চাষের কাজে ‘মিশিন’ চলছে।
ধর্মা ভাবল, মিশিরলালজীর মতো রঘুনাথ সিং যদি ‘মিশিনের’ লাঙল আনাতেন! কিন্তু কোনদিন আনাবেন বলে তো মনে হয় না। তাঁর কাছে মানুষ আর বয়েলের মতো জানোয়ারগুলোর বড় কষ্ট!
পাশের জমি থেকে হট্টাকাট্টা চেহারার আধবুড়ো গণেরি অন্য দিনের মতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে, ‘ন ঘটা (মেঘ), ন বারিষ (বৃষ্টি)। ধুপ আগ য্যায়সা (রোদ আগুনের মতো), মিটি পাখ বনী (মাটি পাথর হয়ে গেছে)। বহোত তখলিফ—’
ওধারের আরেকটা ক্ষেত থেকে ধাওতাল অভ্যাসবশে বলে উঠল, ‘জেঠ মাহিনা (জ্যৈষ্ঠ মাস) কব খতম হোগি মালুম ন পড়ি—’
আরেক জন বলল, ‘আকাশ থেকে যদি এরকম আগ গিরতে থাকে, আদমী নায় বাঁচেগা, নায় বাঁচেগা। সব মর যায়েগা।’
সবাই চারদিক থেকে সমস্বরে বলতে লাগল, ‘হাঁ। অব রামজী ভরোসা। হো রামজী তেরে কিরপা—’
জ্যৈষ্ঠ মাসে আগুনমাখা আকাশের তলায় যেদিন থেকে হাল-লাঙল পড়েছে সেদিন থেকেই মানুষগুলো রোজ এই কথাই বলে আসছে। জ্যৈষ্ঠ শেষ হয়ে কবে আষাঢ় পড়বে, কবে জলকণা-ভরা কালো মেঘে জাকাশ ছেয়ে যাবে, জ্বলন্ত মাঠ-ঘাট আর বাতাসের উত্তাপ জুড়িয়ে কবে এই পৃথিবী স্নিগ্ধ এবং শীতল হবে সেই দিনের আশায় ওরা উদ্গ্রীব হয়ে আছে।
ধর্মা আবছাভাবে চারপাশের মানুষের কথাবার্তা শুনছে। তাবে নিজে কিছু বলছে না। কোনদিনই সে কিছু বলে না। তার বাপ, ঠাকুরদা, ঠাকুরদার বাপ—তিন-চার পুরুষ ধরে ফী বছর তারা রঘুনাথ সিংদের এই জমি লাঙলের ফলায় চৌরস করে আসছে। শুধু কি তারাই, চারপাশের বুধেরি, গণেরি, ধাওতাল—এমনি সবাই পুরুষানু ক্রমে রঘুনাথ সিংয়ের জমি চষে আসছে। আকাশ থেকে রোদই ঝরুক কি আগুনই পড়ুক, জমি তাদের চষতে হবেই। পৃথিবীর মাটি ক্ষতবিক্ষত আর উথলপাথল করে বছরের পর বছর রঘুনাথ সিংদের জন্য ফসল ফলানো ছাড়া তাদের উপায় নেই। অহেতুক হা-হুতাশ করে কী হবে? তাদের জন্য যুগ-যুগান্ত ধরেই তো এই কষ্ট জমা হয়ে আছে।
ধর্মার জমিতে সে একলাই নেই। তাদের মহল্লার মেয়ে কুশীও রয়েছে।
ক’বছর ধরে ধর্মা মাঠে নামলেই কুশী তার লাঙলের পেছন পেছন ছুটতে থাকে। শুধু ক্ষেত চষার মরসুমেই না, বীজ রোয়া, নিড়ান দেওয়া, ফসল কাটা এবং পরে সেই ফসল রঘুনাথের গুদামে তোলা— সব কাজেই সারা বছর কুশী ধর্মার গায়ে ছায়ার মতো লেগে আছে। এখন এই জ্যৈষ্ঠ মাসে ধর্মার লাঙলের ফালে মাটির ছিলকা উঠে আসার পর সেগুলো থেকে শুকনো শেকড়-বাকড় আর আগাছা বেছে সাফ করে যাচ্ছে সে।
কুশীর বয়েস উনিশ-কুড়ি। মাজা কাঁসার মতো গায়ের রং। গোল মুখ, পুরু ঠোঁট, সাদা ঝকঝকে দাঁত, ভাসা ভাসা সরল নিষ্পাপ চোখ, মাথাভর্তি জট পাকানো ঝুপসি চুল। তার শক্ত গড়নের টান টান চেহারা সতেজ কোন গাছের কথা মনে পড়িয়ে দ্যায়।
কুশীর পরনে মোটা বনাতের হেটো রঙিন শাড়ি আর ইলদে রঙের খাটো জামা। ঘামে শাড়ি ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। হাতে তার কাসার কাংনা, নাকে ঝুটো পাথর বসানো চাঁদির নাকফুল।
জষ্ঠি মাসের বেলা যত লম্বাই হোক, অফুরন্ত তো নয়। ধীর চালে হলেও সূর্যটা আকাশের ঢাল বেয়ে একসময় আরো অনেকখানি নেমে যায়। পশ্চিম দিকটা এখন তাজা রক্তের মতো টকটকে লাল। রোদের তাতও বেশ কমে এসেছে। মাথার ওপর দিয়ে সবুজ রঙের এক ঝাঁক বুনো তোতা ডানায় বাতাস চিরে চিরে চেঁচাতে চেঁচাতে কোয়েলের শুকনো খাতটার দিকে উড়ে গেল।। অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাদের ট্টিহি ট্টিহি ডাক দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল।
সূর্য ডুববার ঠিক আগে আগে মাঠ থেকে ধর্মারা লাঙল তুলে ফেলে। আজও তুলতে যাবে, আচমকা পেছন থেকে কুশীর তীক্ষ্ণ গলা শোনা গেল, ‘হুই—দেখ দেখ—’ বলে হাইওয়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল।
ভুরুর ওপর হাত রেখে শেষ বেলার রোদ ঠেকাতে ঠেকাতে দূরে হাইওয়ের দিকে তাকায় ধর্মা। চারপাশের জমিতে যারা মাটি চষছিল তারাও কুশীর গলা শুনেছে। সেই লোকগুলোও চোখ আড়াল করে কুশীর আঙুল বরাবর হাইওয়ের দিকটা দেখতে লাগল।
বড় সড়কে এখন গাড়িঘোড়ার ভিড় নেই। গোটা কয়েক সাইকেল-রিকশা আর বয়েল-গাড়ি ঢিমে তালে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে। তবে লাল ধুলোর কুয়াশাটা মাথার ওপর অনড় হয়ে আছেই।
খুবই মামুলী দৃশ্য; আখছার চোখে পড়ে। এ আর দেখবার কী আছে? বিরক্ত গলায় ধর্মা গজগজিয়ে উঠল, ‘সাইকিল রিকস আউর বয়েলকা গাড্ডি কা দেখেগা?
কুশী সামনে এগিয়ে এল, ‘নায় নায়, উ দেখ—’
এবার চোখে পড়ল। হাইওয়েটা মাঠের মাঝখান দিয়ে অনেকদূরে যেখানে ধু-ধু হয়ে গেছে সেখানে কালো কালো দুটো ফুটকি দেখা যাচ্ছে। ফুটকি দুটো দ্রুত এদিকে ছুটে আসতে থাকে। নাঃ, কুশীর উনিশ বছরের তেজী চোখের জোর আছে। তিন মাইল তফাত থেকে ও সব দেখতে পায়। একেবারে বাজপাখির নজর।
কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগে কুশী আবার বলে ওঠে, ‘মালুম হোতা, বড়ে সরকারকা মোটরিয়া (মোটর)। সামমে (সামনে) জরুর মুনশীজী হোগা—’
কুশীর কথাই ঠিক। দেখতে দেখতে সেই চলন্ত কালো ফুটকি দুটো খানিকটা এগিয়ে এসে একটা পুরনো আমলের বড় বড় চাকাওলা হুডখোলা মোটর আর একটা হাড় বার-করা লঝঝড় সাইকেল হয়ে যায়। এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে—মোটরটার পেছনের সীটে গলায় যূঁই আর গোলাপের মালা ঝুলিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বসে আছেন বিশাল চেহারার মধ্যবয়সী বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং। তাঁর দু পাশে এবং ফ্রন্ট সীটে ঠাসাঠাসি করে রয়েছেন তাঁরই জনা কয়েক দিলক। দোস্ত—প্রাণের বন্ধু। রঘুনাথ সিংয়ের এইসব পেয়ারের বন্ধুবান্ধবের কথা পরে।
মোটরটার কয়েক গজ আগে আগে একটা সাইকেল চালিয়ে আসছে মুনশী আজীবচাঁদজী। এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরেছে সে, আরেক হাত দিয়ে একটা চোঙা মুখের কাছে ধরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে অনবরত কী যেন বলে যাচ্ছে। এতদূর থেকে তার কথা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
মুনশীজীর বয়েস ষাটের কাছাকাছি। রস-বার-করে-নেওয়া আখের ছিবড়ের মতো চেহারা, হাত-পা এবং আঙুল গাঁট পাকানো। ছুঁচলো মুখে মুড়োনো গোঁফ, চোখ দুটো দু আঙুল করে গর্তে ঢোকানো। লম্বা বাঁকানো নাকের ওপর নিকেলের গোল বাই-ফোকাল চশমা ঝুলছে। পরনে ধুতি, ধুতির তলায় শার্ট গুঁজে তার ওপর ধুসো কোট। জামার পকেটে সুতো-বাঁধা পকেট-ঘড়ি। মাথায় টুপি। তাকে দেখামাত্র ধূর্ত শেয়ালের কথা মনে পড়ে যায়। গারুদিয়া এবং আশেপাশের আট-দশটা তালুকের লোকজন জানে মুনশী আজীবচাঁদ রঘুনাথ সিংয়ের পা-চাটা কুকুর। সর্বক্ষণ তার একমাত্র কাজ হলো মালিক বড়ে সরকারের পায়ের তলায় বসে কুঁই কুঁই করে ল্যাজ নাড়া আর দুনিয়ার তাবৎ আদমীর পেছনে কারণে বা অকারণে লাগা। তার ভয়ে গারুদিয়া তালুকের সব মানুষ তটস্থ হয়ে থাকে।
আজই যে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং পাটনা থেকে ফিরে আসবেন, ধর্মারা জানত না। তবে মুনশীজী নিশ্চয়ই জানত।
হাইওয়েটা পশ্চিম দিকে আড়াই মাইল গেলে সড়কের ধার ঘেঁষে রেল স্টেশন। এ-জায়গার নামেই স্টেশনটার নাম, অর্থাৎ গারুদিয়া। ধর্মারা যখন রঘুনাথ সিংয়ের জমি চষছে, তখন কোন ফাঁকে মুনশীজী সামনের সড়ক ধরে বড়ে সরকারকে আনতে স্টেশনে গিয়েছিল, কেউ খেয়াল করেনি।
এক সময় মোটর আর সাইকেলটা কাছাকাছি এসে পড়ল। এবার মুনশীজীর কথাগুলো পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। গলার শিরাগুলো নারকেল দড়ির মতো ফুলিয়ে সে চিৎকার করে করে বলেছিল, ‘হট যা, হট যা—বড়ে সরকার আ রহা হ্যায়। হট যা, হট যা—’
রিকশা, বয়েল কি ভৈসা গাড়িগুলো সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে কিনারে সরে গিয়ে গিয়ে রাস্তা করে দিতে লাগল। রিকশাওলা, বয়েল গাড়িওলা, ভৈসা গাড়িওলা এবং যারা সড়কের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল তারা সবাই সসম্ভ্রমে রঘুনাথ সিংয়ের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ঝুকিয়ে ঝুকিয়ে জোড়হাতে বলতে লাগল, ‘নমস্তে মালিক-’ কিংবা ‘নমস্তে বড়ে সরকার—’
মুনশীজীর গলার স্বর ক্রমাগত চড়ছিলই, ‘আ রে হট যা, হট যা। এম্লে বড়ে সরকার যা রহা হ্যায়। হট যা রিকশাবালা, হট যা বয়েল গাড়িবালা, হট যা পায়দলবালা—’ চিৎকারের চোটে তার চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন।
প্রাচীন আকাশের তলায় আধ-চষা মাঠের মাঝখানে আঁকা গুহাযুগের আদিম কোন চিত্রের মতো চুপচাপ দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে যেতে থাকে ধর্মারা।
কিছুক্ষণ পর পুবদিকের একটা বাঁক ঘুরে ধুলোর ঝড় ওড়াতে ওড়াতে মুনশীজীর সাইকেল আর বড়ে সরকারের মোটরখানা অদৃশ্য হয়ে যায়।
তারপরও বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ দাড়িয়ে রইল ধর্মারা। হঠাৎ পাশের ক্ষেত থেকে বুধেরি বলে উঠল, ‘কা, বড়ে সরকার এম্লে হো গৈল?’
অন্য সবাই চারপাশের ক্ষেতগুলোতে বলাবলি করতে লাগল, ‘হো গৈল—কা?’
‘আ রে, নায় নায়’ আধবুড়ো গণেরি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আভি তক বড়ে সরকার এম্লে নায় বনি—’
সবাই গণেরির দিকে তাকাল, ‘কী করে বুঝলে চাচা?’
জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে বিপুল অভিজ্ঞতা গণেরির। এই পৃথিবীতে পঞ্চাশ-ষাট বছর বেঁচে আছে সে। বহুকালের পুরনো চোখ দিয়ে অনেক কিছু দেখেছে, বহুকালের পুরনো কান দিয়ে অনেক কিছু শুনেছে। এখানকার বেগারখাটা ভূমিদাসেরা তার যে কোন মতামতকে খুব দামী মনে করে।
গণেরি বলল, ‘এম্লে এ্যায়সা এ্যায়সা হওয়া যায় না। তার আগে চুনাও (নির্বাচন) হয় না? পাঁচ সাল আগে চুনাও হয়েছিল, মনে নেই? মোহর মেরে মেরে তোরা বাকসে (বাক্সে) ভোটের কাগজ ফেলে আসিস নি?’
সবার মনে পড়ে গেল। একসঙ্গে তারা বলে উঠল, ‘হাঁ হাঁ, আভি ইয়াদ পড়ি—’
বুধেরি বলল, ‘তাহলে এম্লে বনবার আগেই মুনশীজী বড়ে সরকারকে এম্লে বলছে কেন?’
গণেরি বলল, ‘ও হারামী একটা কুত্তা, দিন-রাত জিভ দিয়ে বড়ে সরকারের নাগরা সাফাই করছে। শালে এম্লে বলে বলে মালিককে খুশ করছে। ওর মুখে তিনবার থুক। এক, দো, তিন বলে পর পর তিন বার মাটিতে থুতু ফেলল। ঘেন্নায় তার মুখ কুঁচকে যাচ্ছে।
অন্য সকলে কথা বললেও ধর্মা চুপচাপই রয়েছে। ওরা যা বলাবলি করছে, সে-সবই তার জানা। ভোট না হলে যে এম্লে বনা যায় না, এ-কথা ছোটবেলা থেকেই সে শুনে আসছে। পাঁচ সাল আগে এখানে শেষ যে ভোট হয়ে গিয়েছিল, তখন তার বয়স ছিল কম। তাই ছাপানো কাগজে মোহর ‘ছাপ্পা’ মেরে বাক্সে ফেলা হয়নি। এবার অবশ্য তার ভোটের উমর হয়েছে। কিন্তু যাদের বয়েস অনেক, দুনিয়ায় বহুকাল ধরে টিকে আছে তাদের তো জানা উচিত, ভোট না হলে এম্লে বনা যায় না। বার বার ছাপানো কাগজে মোহর মেরে এলেও কেন যে তারা এম্লে বনার নিয়মকানুন ভুলে যায়, কে জানে। সে কিন্তু এই মুহূর্তে ভোট, এম্লে, বড়ে সরকার ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ কিছুই ভাবছিল না। অন্য একটা কারণে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল।
বড় সড়কের ওধারে কোয়েলের মরা খাত ধরে খানিকটা গেলে একটা সাবুই ঘাসের জঙ্গল। গরমকালের বিকেলে ওখানে ঝাঁকে ঝাঁকে বগেড়ি পাখি এসে পড়ে। আজকাল কুশী আর সে রোজই ওখানে বগেড়ি ধরার জন্য দশ-বারোটা করে ফাঁদ পেতে আসে। সড়ক কি ব্রিজ তৈরির ঠিকাদাররা বগেড়ির মাংস ভীষণ পছন্দ করে। অঢেল কাঁচা পয়সা ওদের হাতে। দামও দেয় ভাল। ডজন তিন সাড়ে তিন রুপাইয়া।
টাকার খুবই দরকার ধর্মার। কাল সন্ধোয় বাঁশের তৈরি যে ফান্দাগুলো তারা পেতে রেখে এসেছিল সেগুলোর ভেতর ক’টা বগেড়ি পড়েছে, জানার জন্য বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল সে। আচমকা ধর্মা অন্যদের তাড়া লাগাল, ‘সূরুয ডুবতে চলল। এবার লৌটবে (ফিরে যাবে) তো, না ক্ষেতিতে দাঁড়িয়ে থাকবে?’
অন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। বলল, ‘হঁ-হঁ, লৌটনা তো শুরুর—’
রোজ সকালে রঘুনাথ সিংয়ের খামার থেকে হাল-বয়েল নিয়ে মাঠে আসে ধর্মারা। সূর্য ডোবার আগে পশু এবং লাঙল সেখানে বুঝিয়ে দেবার পর নিজেদের ঘরে ফিরতে পারে।
.
একটু পরে দেখা গেল, হাল-বয়েলের মিছিল চলেছে বড় সড়কের দিকে। হাইওয়েতে এসে ধর্মা কুশীকে বলল, ‘তুই জঙ্গলে ফান্দাগুলোর কাছে যা। বয়েল আর লাঙল জমা দিয়ে আসছি।’
কুশী বলল, ‘তুরন্ত চলে আসিস!’
‘হাঁ।’
‘দের নায় করনা—’
‘নায়।’
কুশী আর দাঁড়াল না। হাইওয়ে থেকে নেমে দক্ষিণ কোয়েলের শুকনো খাতের ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল। যতদূর চোখ যায়, পড়ন্ত বেলার নির্জীব আলোয় লক্ষ কোটি ঝিকমিকে বালির দানা ছড়ানো দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতে একটি তামাটে চেহারার যুবতী ছাড়া আর কোন মানুষ নেই। এখন কুশী ছুটছে, ছুটছে আর ছুটছে।
পেছন দিকে দেখা যায়, বিজুরি তালুকের ট্রাকটরগুলোও ফিরে যাচ্ছে। আজকের মতো ওদেরও কাজ শেষ।
এদিকে সারাদিন পর ক্লান্ত পশু এবং তাদের সঙ্গী মানুষেরা ধুলো ওড়াতে ওড়াতে বড় সড়ক ধরে রঘুনাথ সিংয়ের খামারের দিকে এগিয়ে চলল।