সাত
আজকের রাতই কি বড় বেশি লম্বা? না এখনও ভোর হবার সময় হয়নি?
বাইরের দরজায় ধড়াম করে শব্দ হল। কে যেন দরজার গায়ে আছাড় খেয়ে পড়ল।
অতসী? অতসী এল?
চাপা, বিকৃত গলা কারও।
”মা” বলে কে ডাকল? ”মা” ডাক এত লম্বা হবে কেন? ”মা” বলল, না ”মাসিমা” বলল? সরমা আঁচল গুছিয়ে দৌড়ে গিয়ে বারান্দায় আলো জ্বেলে দরজা খুললেন।
বকু আছড়ে পড়ল ধপাস করে। রক্ত, রক্ত, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর মুখ, গা, শরীর। গায়ের গেঞ্জি ও পাঞ্জাবি ছেঁড়া ঝুলছে। বাঁ হাতে চোখ ঢেকে আছে, রক্ত।
সরমা মুখে আঁচল গুঁজলেন।
—ঘরে…ঘরে যাব…
—তোমার…কী হয়েছে?
বকু বিদ্ধ শূকরের মতো চেঁচিয়ে ওঠে, আমার…আমার চোখ…আঙুল ঢুকিয়ে খিমচে নিল…চোখ…খুনে…খুনে…মাগী…
—তোয়ালে…তোয়ালে…রক্ত…
—অতসী?
সরমা শুনতে পান তিনি বলছেন, ঘরে চলো।
—দেখতে পাচ্ছি না…মাথায় আধলা ইট বসিয়ে দিল…
সরমার গলা বলে—ঘরে চলো।
—আমার ঘরে না।
বকুর গলায় আতঙ্ক রাস্তার ওপার ওপারে…কেউ এলে আমাকে…
—ভিতরেই চলো।
বকু নিজেকে টেনে হেঁচড়ে এনে কোনমতে বারান্দায় ওঠে। গলায় কবচ নেই, আঙুলে আঙুলে আংটি। বারান্দায় উঠেই পড়ে যায় ধপাস করে।
মিলন চোখ কচলাতে কচলাতে নেমে আসে।
—কী হয়েছে মা?
তারপর নির্বাক হয়ে যায়।
—ওকে ঘরে তোল।
মিলন ও সরমা ওকে ঘরে নিয়ে মাদুরে শোয়ান। মিলন আতঙ্কিত।
—কিন্তু এ যে…ভীষণ ব্লিডিং হচ্ছে।
বকু জড়িয়ে জড়িয়ে বলে, ডাক্তার ডাকো।
—ক’টা বাজে মিলন?
—দুটো পনেরো। তুমি…তুমি কিছু করো না মা?
—কী করব?
—নার্সিংহোমে কী করে?
—ওটা প্রসূতিসদন মিলন…বাচ্চাদের ডেলিভারি ও চিকিৎসা হয়…সেও রোগের চিকিৎসা হয়…এমারজেন্সি কেস নয়। আমিও ডাক্তার নই।
সরমা আলমারি খোলেন, তাঁর ধোয়া কাপড় বের করেন। বলেন, জল আন এক বালতি।
কাপড় বালতির জলে ডোবান, চেপেন, রক্ত মুছতে থাকেন।
—মাথার দিকে মা! মাথায় আঘাত…
—কী রকম চোট জানি না। যদি ক্ষতি হয়?
—রক্ত তো পড়ছেই। ইশ, মাথা থেকেও…
সরমা মিলনের দিকে সরোষে তাকান। মিলন কী ভেবেছিল? ওর দাদা একতরফা মেরে যাবে, অথচ অক্ষত, অটুট থেকে চলে যাবে?
আরেকটা কাপড় বের করেন।
মিলন মাথাটা সামান্য তোলে। কাপড় দিয়ে পরতে পরতে জড়িয়ে দেন মাথা ও চোখ। অসীম শক্তিতে কপাল ও চোখ থেকে টেনে নামান বকুর হাত।
বাঁ চোখের কোটর থেকে উছলে আসে রক্ত। মিলন বেরিয়ে যায়, বমি করে।
—কী করছো? দেখতে পাচ্ছি না কেন? ডাক্তার…
—রাত তিনটেও বাজেনি বকু।
—কাউকে…বলো না…আমি…এখানে…
—না। বলব না…
বকুর গলা অবসন্ন হয়ে আসে, আমিও ওকে… শেষ করে দিয়েছি…খতম।
—সে কোথায়?
এ সময়েও বকু ধূর্ত হাসতে চেষ্টা করে।
—বলব…তুমি তো…
সরমার হাতের কাছে বালতির জল লাল। হাতের কাপড় লাল? মুছতে মুছতে দেখতে পান, গলা ও মুখ নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত। অতসী এত শক্তি কোথা থেকে পেয়েছিল। মাথায় রগ থেকে রক্ত ঝরছে।
—ডাক্তার…হাসপাতাল…টাকা…আমি…দেব! জল!
—আনছি..
জল আনেন সরমা, কিন্তু বকু জ্ঞান হারায়।
নিশ্বাস ফেলেন সরমা। জল দেবেন কাকে?
মিলন দরজা ধরে দাঁড়ায়।
—আমি দেখতে পারব না মা।
—দেখো না।
—ডাক্তার কোথাও পাবে না?
—আমি জানিও না টাউনের কিছু।
সরমা, যেন তৃতীয় কোন ব্যক্তির কথা বলছেন এ ভাবে বলেন, হাসপাতালে নিতে পারো, নেবে কিসে?
—অ্যাম্বুলেন্স নেই?
—তুমি তো খবর রাখো না। এখনও নেই।
—লোকে রুগি হাসপাতালে নেয় কিসে?
—সাইকেল রিকশা, কারোও গাড়ি পেলে তাতে, ভ্যান রিকশা, খাটুলি কাঁধে বয়ে। গরুর গাড়িতে।
—ইশশ…মানুষ কী করে…
—এখানে থাকে? আমরা তো থাকি।
—অবনীবাবু…রবি পাঠক…
—যেতে চাও, যাও না। তোমার দাদার জন্যে তারা গাড়ি নিয়ে ছুটে আসবে? জানি না।
—কী…হল, কী করে হল…
সরমা নিষ্প্রাণ গলায় বলেন, তোমাকে বলাও বৃথা মিলন।
অবসন্ন, অবসন্ন সরমা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। চোখ বোজেন।
—সন্ধ্যেবেলা আমি ঠিকই শুনেছিলাম।
—কী ”ঠিক” শুনেছিলে?
—কত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছো, তাই অবশ্য স্বাভাবিক। নিজের আর নিজেরটা ছাড়া কবে বা কার কথা ভেবেছো? সন্ধ্যেবেলা অতসীই ডেকেছিল।
—অতসী!
—হ্যাঁ, অতসী। তোমার দাদা তাকে মেরেছে, সেও তোমার দাদাকে…
অতসী, তোকে বকু কোথায় নিয়েছিল টেনে? কত দূরে?
—অতসী এই কাণ্ড করেছে?
—নিশ্চয়।
—দাদা বলল?
—সেই বলল।
—খুনে মায়ের খুনে মেয়ে…ইশশ।
সরমার ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি ফুটে ওঠে।
—পোস্টমাস্টারের মেয়ে মিতা, সুকেশের মেয়ে উদিতা, এরা খুনী মায়ের খুনী মেয়ে ছিল না মিলন। মিতা আর উদিতার মাঝামাঝি সময়ে আর কে কে মরেছে জানি না। যাক গে, তখন যদি তোমার নিষেধ না শুনে বেরিয়ে যাই…
—কোথায় যেতে?
—অতসীকে ডাকতে ডাকতে যেতাম, ও নিশ্চয় সাড়া দিত।
—কিন্তু দাদা…
—দাদার জন্যে কষ্ট হচ্ছে?
—মা…তুমি এ সময়ও…
—আমি তো ডাক্তার আনতে পারব না। তুমিই যাও না।
—রামকে ডাকব?
—ও পাড়ায় তোমার দাদা খুব জনপ্রিয় নয় মিলন। যেতে চাও, যেতে পারো। আমি যাব কি করে?
—তুমি বলবে তো!
—চিরদিন যে যা বলবে, তাই করবে? নিজে পার না কিছু?
—কলকাতা হলে…
—এটা কলকাতা নয়।
—দাদা যদি সেরে ওঠে, যদি জানে আমরা কিছু করিনি…
—বকু আমাদের দুজনকেই মারত, তাই ভাল হত?
অতসী, তোর জন্যে আমি কিছু করতে পারলাম না। বকুকে শাস্তিও তুই—ই দিয়ে গেছিস।
—সকাল হচ্ছে বোধহয় মা।
—এখনই?
না, তিনটে বেজেছে, দু’মিনিট বাকি। সময় থেমে গেল আজ? এতক্ষণ এত কিছু হয়ে গেল, এতটুকু সময় লেগেছে? সকাল কখন হবে, সকাল? যদিও এরপর আর কোনদিন কোনও সূর্যোদয় আলো এনে দেবে না সরমাকে, শুধু অন্ধকারই থাকবে।
মিলন বিমূঢ়ের মতো চেয়ে আছে?
—চারটেয় তবু ফর্সা হবে।
—হলে কী করবে?
—দাদাকে…হাসপাতালে…
সরমা মাথা নাড়ল।
—আমি পারব না মিলন। এই বয়সে…রিকশা পাব না…দৌড়ে দৌড়ে যাব…আমি পারব না। তুমি পারো তো যাও, তোমার যদি প্রাণ ব্যাকুল হয়।
—আমি কাকে চিনি এখানে?
—জানি না, আমি আর পারব না।
—আজ না ফিরলে…আমার ওদিকে…
সরমা নির্বাক।
—রক্তে তো ভিজে যাচ্ছে সব এখনোও। অবশ্য…কমে এসেছে।
—জানি না।
মিলন খুব বিপর্যস্ত। কোনদিন কোন সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি…ঝামেলা এড়িয়ে চলা ওর স্বভাবে ঢুকে গেছে। আর সুরমা দীর্ঘকাল হাঁটছেন মরুভূমি ধরে। মিলন আশা করে আজও মা ঝামেলা সামলে দেবে। খুব, খুব প্রত্যাশী চোখে ও চেয়ে আছে।
সরমা মাথা নাড়েন।
—মা, কাপড়টা ছাড়ো।
—যেতে চাইলে চলে যাও মিলন।
—ছি ছি মা! আমি কি অমানুষ? তোমাকে এর মধ্যে ফেলে…
সরমা ক্ষীণ হাসেন।
—মা, চা করব?
—করতে পারবে?
—কেন পারব না? চা করি, রান্নাও চালিয়ে নিতে পারি…
—করো তবে।
মিলন চা করতে যায়। বকু খুবই নিথর। সহসা মনে খেলে যায় বিদ্যুৎ ঝিলিক। বকুর হাতটা তুলে নেন সরমা। না নাড়ী ধীরে চলছে, চলছে। হাত নামিয়ে রাখেন সরমা। নাড়ী দেখতে জানেন না, ব্যান্ডেজ বাঁধেননি দীর্ঘকাল। অবিরাম রক্তপাত বন্ধ করতে হলে কী করতে হয়? অবিরাম—রক্তপাত—অবিরাম—
চমকিত সরমা হাতের দিকে তাকান। মেঝেতে রক্ত হয়েছে, চাপ বাঁধছে, ক্ষীণ ধারায় নামছে…
—বাইরে এসো মা। ও ঘরে আমি…যত ঝামেলা এড়িয়ে চলি, ততই…
সরমা ওঠেন। আলমারির আয়নায় আরেক সরমা। রক্তে ভেজা কাপড়, রাত জেগে চোখ লাল। আলনা থেকে জামা সায়া কাপড় নেন, গামছা। কাল অবধি কী নিয়মে বাঁধা ছিল জীবন। আর আজ?
বাথরুমে চলে যান, কাপড় ছাড়েন। জল ঢালেন গায়ে। ঘষে ঘষে রক্ত তোলেন। জল ঢেলে রক্ত তোলেন, মাথা ও গা মোছেন। অতসী ওঁর পিঠে সাবান দিয়ে দিত। বকুর বিষয়ে কোন স্মৃতি মনে আসছে না, শুধু অতসীর চিৎকার শুনতে পাচ্ছেন, সরমা কি স্বাভাবিক মানুষ নন? বকু মানে শৈশব থেকে কৈশোরের বকু। ও ঘরে যে শুয়ে আছে সে কোন বকু? সরমা কী করবেন? বেরিয়ে আসেন।
মিলন চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
—এখন জল ঢাললে গায়ে?
—চা দাও মিলন।
চা খান। বলেন, এখানেই বসি। তুমি জামাকাপড় পালটে নাও মিলন।
—দাদা যে কী জীবন বেছে নিয়েছিল!
—চা খাও।
—কোনদিন শান্তি দিল না কাউকে। নিজেও…
মাথা নাড়েন সরমা। মৃদু গলায় বলেন, শান্তি তো ও চায়নি। কী যে চেয়েছিল। ছোটবেলার পর…কেন এমন হয়ে গেল…জানি না।
দুজনে চুপ করে বসে থাকেন।
থাকতে, থাকতে থাকতে থাকতে এক সময় পাঁচটা বাজে। সরমা উঠে দাঁড়ান।
মিলন দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছে।
ভেজানো দরজা খুলে ঢোকেন। বকু এখনও নিথর, যেন বেশি নিথর।
—মা, দাদা কি…
সরমা জবাব দেন না।
—আমি হাসপাতালে যাচ্ছি, তুমি কোথায় যাচ্ছো মা?
সরমা ক্ষিপ্র পায়ে বারান্দা থেকে নেমে বেরিয়ে যান দরজা খুলে।
মিলনের ”মা” ডাক শুনতে পান না।