আই. পি. সি. ৩৭৫ – ৬

ছয়

ওই ক’মাস বকু টাউনে পা রাখছিল। তাই মুখোশটা রাখার দরকার হয়েছিল।

মুখোশ টেনে ফেলে দিল। আর ও মুখোশ পরেনি।

না, বাড়িতে বাস করতে আসেনি আর। সরমার সঙ্গে দরকারও ফুরিয়ে গিয়েছিল। প্রসূতিসদন তো টাউনে, সে তো ঘাটপাড়ায় নয়। সেখানেই সরমার কর্মস্থান।

আর পেনশান আনতেও টাউনেই যেতে হত।

মেট্রন প্রায়ই হা—হুতাশ করতেন, তাঁর বোন ভগ্নীপতি মাটির মানুষ ছিল। কিন্তু তাদের দুই ছেলে জয় ও তিলক দুটোই জানোয়ার হয়ে গেছে।

—তোমার ছেলের দলে ভিড়েছে সরমাদি!

—আমার এই ছেলের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।

—এক বাড়িতে বাস তো করছো।

—সে বাড়ি তুলেছে, বাস করে না। কোন কোন দিন আসে! বাইরে গেট করেছে। ঢোকে আর বেরোয়। আমার দিকে আসে না।

মেট্রন নিশ্বাস ফেলল।

—কী বলব! বর্ডার থেকে মেয়ে এনেও পাচার করে, নানা কীর্তি করছে।

—পুলিশ ধরে না কেন?

—কী করে ধরবে? ওর পেছনে অবনীবাবু। আবার কলকাতা থেকে বীরু পাঠক আসছে রবি পাঠককে মদত দিতে। বকুর পেছনে সেই তো আসল লোক। ভোট আসছে, বকুর মদত চায়।

—সেই তো আমারও কথা, বহুকাল ধরে। বকুকে ওরা সমর্থন কেন করে, কেন ওর কাছে যায়। কেন, ওকে মেয়াদ না ফুরোতে বার করে আনল!

সরমার চোখ মুখ গনগন করছিল, চোখে কী যন্ত্রণা, যেন দগ্ধ হচ্ছেন, জ্বলে যাচ্ছেন।

মেট্রন নীরব।

—আজ অনেকদিন ধরে আমি এ প্রশ্নটা করি।

—আমাদের ভয় হয়। আপনার খোঁজে যদি এখানে কোনদিন….

—ডাক্তারবাবু কিছু বলেছেন?

—তিনি কি বলবার লোক?

—আমিই জিজ্ঞেস করব।

সরমা জিজ্ঞেস করেছিলেন।

অসীমার ভাই, একদা তাকে ”তুমি” বলতেন, সেভাবে বলেননি। সেভাবে তো বলেন না কথা। তিনি কর্মদাতা মনিব, সরমা কর্মী। এভাবেই কথা বলেন।

খুব সসংকোচে বলেছিলেন, আমি এখানে কাজ করছি বলে প্রসূতিসদনের কোন অসুবিধে হচ্ছে?

প্রদীপ্তর মুখ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল।

—বুঝলাম না। বসুন না।

—আমার ছেলের কথা তো জানেন! তার মা হয়ে এখানে কাজ করলে আপনার কোন অসুবিধা হলে… বলবেন, আমি তখনই….

—ছেড়ে দেবেন।

—হ্যাঁ ডাক্তারবাবু।

প্রদীপ্ত নিশ্বাস ফেলেছিল। বলেছিল, আপনার ছেলে এ টাউনেই আতঙ্ক একটা। আপনাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। বরঞ্চ আপনাকে ছাড়ালে আমার অসুবিধা হতে পারে।

—আমিই যদি ছেড়ে দিই?

—তাহলে আমরা আরও বিপন্ন হব। হয়তো আপনি আছেন বলে ঘাটপাড়ায় ওর জুলুম কম। হয়তো এই কারণে আমিও মাসে মাসে হাজার টাকা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছি।

—হাজার টাকা?

—হ্যাঁ… ভোটের সময় বেশি দিতে হয়। কিছু করার নেই। অন্য ডাক্তাররা বেশিই দেন। এটা তো এখানকার প্যাটার্ন।

—আপনারা পারেন না পুলিশকে বলে ওর জুলুম বন্ধ করতে?

—কী করে করব? পুলিশ আমাদের কথা শুনবে কেন?

প্রদীপ্ত তিক্ত গলায় বলেছিলেন, রাজনীতিক নানা রঙের নেতা লোকেরা ওর পিছনে। পুলিশ বা প্রশাসন নেতাদের চটাবে? খুন দেখলে বলবে আত্মহত্যা, মেয়ে তুলে নিয়ে গেলে কয়েকটা চুনোপুঁটিকে জেরা করে ছেড়ে দেবে। আমি প্রত্যাশাও করি না কিছু। ভাবাও ছেড়ে দিয়েছি।

—আমি কী বলব?

—কী আর বলবেন! বেঁধে মার তো আপনিই খাচ্ছেন। রেবতীদির মেয়ে আসে?

—আসত, আমি নিষেধ করেছি। বলেছি, এখানে দেখা করে যাবে আমার সঙ্গে।

—বাবা আর দিদি রেবতীদিকে আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তুলে গেছেন। তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল। রেবতীদি যা করেছে, মানিয়ে গেছে। অতসী ওর মায়ের মতোই জেদি। নিজের ভাল বোঝে না। আমরা ওপারের জমি বেচে দিচ্ছি, ও ওই জমি আর বাড়ি নিয়ে জেদ করে শত্রু ডেকে আনছে।

—আমি… ওকে বারবার বলি বেচে দিতে… ও চায়…

—হ্যাঁ, মায়ের নামে কিছু করবে। করবে তো করুক না, ওখানেই করতে হবে? জমি বাড়ী তো যাবেই, ও নিজেও…

—এত জমি কিনছে কে?

—আপনার ছেলে আছে, বীরু পাঠক আছে, লক্ষ্মণ জৈন আছে, কেনার লোক অনেক।

—ওদের কাছ থেকে…..?

—টাউনশিপ হেনতেন হবে না। হবে প্ল্যানলেস বাড়ির জঙ্গল। কেনার লোকের অভাব? বর্ডার পেরিয়ে লোক আসছে, সম্পত্তি করে রেখে যাচ্ছে। এতগুলো রাস্তা, এত যাতায়াতের সুবিধে, গঙ্গার পাড় ধরে জমি, ব্রিজ বা খেয়া পেরোলে টাউন, যে পারছে সে কিনছে।

—অতসীকে বলব।

—বলুন, শুনবে বলে মনে হয় না। আর আপনি যদি বছর দুয়েক আগে ছেড়ে দিতেন, তাহলে প্রশ্ন ছিল না। এখন ছাড়বেন না। কারণ বললাম তো। আমাদের বাগানটার ওপর খুব লোভ ওর, ছুতো পেলেই… আর আপনি বা বাড়িতে বসে কী করবেন? আপনি নিজেও আছেন জাঁতাকলে। আসুন!

সেদিন, কেন সেদিন সরমা প্রদীপ্তকে বলেননি, যে বকু অতসীকে বেইজ্জত করতে গিয়েছিল বলে সরমা তাকে বের করে দিয়েছেন? কেন বলেননি, অতসী অত্যন্ত বিপন্ন?

কী করে বলতেন? অতসীকে বলতে গেলেন মাসখানেক বাদে ও প্রসূতিসদনে এসেছিল, ও কানেই নিল না।

বললেন, বকুর কথাবার্তা আমার ভাল লাগছে না রে। মনে হচ্ছে কী জানি কি বিপদ হবে।

—ভয় পান?

—হ্যাঁ মা। তুমি যে আমার…

—না মাসিমা। আমার জিদ উঠছে। মা এমুন কইরা চইলা গেল…কুন বয়সে বিয়া, কুন বয়সে বিধবা…কারো দিকে চায় নাই। দেহসুখ ভাবে নাই। আহার ছাইরা দিল। তার সম্পত্তি নিব নিধিরাম আর বকুদা?

—রাখবি কি করে।

—মাইনষে সপন দেখে। আমি সপন দেখি, দ্যাশের আবাইগা মাইয়াগো লিগ্যা মায়ের নামে কিছু করলাম। এ কাজ আমি না করলে…

—ওখানে তোর আছে কে?

—বঙ্কিমদের দলে টানছি না?

—শত্রুপক্ষ কি চুপ করে থাকবে?

—অহন তো চুপ। দ্যাখেন অরা ডরাইতে চায়। ডর করি না দেইখা আরও চুপ। মারে দেইখা শিখছি।

—ওরা করবে সব? বিশ্বাস পাস?

—বঙ্কিমরা সব কইরা দিতে আছে। এবার ঘর উঠামু পাশ দিয়া, মায়ের নামে মহিলা আর শিশু হাসপাতাল হইব। নিধিরাম এরেতারে দিয়া শাসাইতেছে খুব। আমি ডরাই নাই।

—ভয় পেলে ভাল করতিস।

—থানায় লেখাইয়া আইছি যে আমার সম্পত্তির বেবস্থা আমি করতেয়াছি, দুষ্ট লোকে শাসায়।

—পুলিশের ভরসা করিস?

—না কইরা উপায়? বকুদা না কি আমাকে সিধা করব! ডরাইয়া বাচা যায় না মাসিমা।

অতসী চলে গিয়েছিল। বলেছিল, অহন জেদ উঠছে আমারও। অদের শিক্ষা দিয়া ছারুম।

রেবতী যদি সব বেচে দিয়ে যেত!

—চাইছিল। আমি দিই নাই।

সরমা কী করবেন? অতসী যদি এমন একরোখা হয়। বাস্তব পরিস্থিতি মানে না? অতসীর কথা ভাবলে বুক ফেটে যাচ্ছিল। তরুণ, সাহসী, পবিত্র মেয়ে। রেবতীর সময় আর ওর সময়, দুটোতে যে অনেক তফাৎ।

থানার নতুন বড়বাবু না কি খুবই ভাল। তার কাছে যাবেন? কোন অভিযোগ নিয়ে?

অসহ অসহ সরমার এই নির্জন একাকীত্বে কারাবাস।

* * *

বকুও তার দাপটে বুঝিয়ে দিচ্ছিল টাউনকে।

নির্বাচন তো আসেই নির্বাচনের নিয়মে, প্রস্তুতি চালাতে হয় অনেক আগে থেকে।

অনন্তপুর টাউন এখন চারদিকে হাত ছড়াচ্ছে, দানবশিশুর মতো দিনে দিনে অতিকায় হচ্ছে। যে জনস্রোত দেখেন বাজারে, পথে সর্বত্র, তাদের মুখও চেনেন না সরমা। অনেক কিছু জানবার চেষ্টাও না করে অন্ধকারে থেকে যান। কিন্তু সে অন্ধকারেও তীব্র হেডলাইট এসে পড়ে। আলো ফেলে বকু। শীর্ণ, ঋজু, শুভ্রবসনা সরমার রেখাজীর্ণ মুখ আলোর ফ্রেমে ধরা পড়ে। বকুর গলায় উল্লাস থাকে, যেন শিকার ধরে ফেলেছে, যে শিকার ব্যাধকে এড়িয়ে লুকোতে চায়।

সাইকেল রিকশা থেকে নেমে বাজারে যাবেন, বিকট শব্দে জিপ দাঁড়াল।

বকু বলে, ছি ছি, তুমি থলি হাতে বাজারে? তিলক যা যা, বাজার করে দিয়ে আয়। আমার মা বাজার টেনে নিয়ে যাবে?

সকলে চমকে তাকায়। সরমা নির্বাক। অত্যন্ত লোমশ ও ঝাঁকড়াচুলো এক যুবক লাফিয়ে নামে।

—ওকে দাও মা, তুমি চলে যাও। জিপে পৌঁছে দেব?

সরমা মাথা নাড়েন। বলতে পারেন না, চিরকাল একাই বাজার করছি।

—তিলক পৌঁছে দেবে। চলি মা। কাজ আছে।

সরমা জোর করে নিজেকে শাসন করেন, আত্মস্থ হন। তিলককে বলেন, দরকার নেই, সামান্যই বাজার।

তাঁর ও বকুর সম্পর্ক তো সবাই জানে। তবু তিলক বলে, সে কী হয় ম্যাডাম? বস তাহলে…

—না না, তুমি চলে যাও। আমার…সামান্যই বাজার।

তিলক পাশাপাশি হাঁটে। সরমা কোনমতে আলু কেনেন। বেগুন ও লাউ একফালি। তিলক বলতে থাকে, ঠকিও না, ঠকিও না ভাই, কার মা জানো তো?

সরমা কীভাবে বাড়ি ফিরেছিলেন জানেন না। বকু তাঁকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছে কেন?

তারপর থেকে বাজারে সরমার সংবর্ধনা অন্যরকম। তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিতে রিকশায় ঠেলাঠেলি।

.

মিলন বলল, দাদা শোধ নিচ্ছে মা!

—কিসের শোধ?

—ওই জানে।

প্রসূতিসদনে যান, যেখানে যান, মাঝে মাঝেই বকু জিপ থামায়।

—দেখুন রবিদা, আমার মা। সবাই শ্রদ্ধা করে জানেন?

অথবা, আশীর্বাদ করো মা, কাজে যাচ্ছি।

সরমা কোথায় যাবেন? কোথায় বকু নেই।

কত কী ঘটেছে, কত কী ঘটল! ”অনন্তপুর জনবাণী কে গলিয়ে দিত তাঁর জানলা দিয়ে। কে চাইত সরমাও জানুন। তিনি পড়ুন। এ কাগজ পড়বেন বলেই তো জানতেন যে কোথাও আছে প্রতিবাদী কণ্ঠ।

নালিখালের আবুল মণ্ডল তার কৃষিজমি বেচতে অস্বীকার করে। তার সদ্যবিবাহিতা মেয়েকে এই গ্রামস্থ স্বামীর ঘর থেকে অপহরণ করা হয়। ধর্ষিতা আমিনাকে উলঙ্গ অবস্থায় নদীর ধারে পাওয়া যায়। পুলিশের কাছে সে জবানবন্দি দেয় যে দোকান থেকে ফেরার সময়ে বিদেশ মিত্র, ওরফে বকু মিত্র বা ”বড়দা” এবং তার দুই সঙ্গী জিপ থামিয়ে তাকে… তদন্ত চলছে।

এমনি করেই বেরোয় কিশোরী রেবা দাসের অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ।

দুর্ঘটনার খবর বেরোত। অনন্তপুরে সে সময়ে পার্টিবাজি এক চূড়ান্ত নোংরামিতে পৌঁছেছে।

আবুল মণ্ডলের মেয়েকে আদালতে তোলা যায় নি। কেননা থানায় তার জবানবন্দীর কাগজই ছিল না।

আবুল মণ্ডল নাকি চীৎকার করে মাথা কুটে মরেছিল। কার কাছে যাবে আবুল? পুলিশের কাছে গেল, কী লাভ হল?

ওই কাগজেই যখন পড়লেন, আবুলের মেয়ে সাইদাকে নিহত অবস্থায় পাওয়া গেছে, আর পুলিশ আবুলকেই খুনী বলে ধরেছে, সরমা অবাক হন নি।

আবুল নাকি আদালতে বলেছিল, আমিই খুনী। আমি তাকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাই। পুলিশ কেস করতে বলি দারোগাকে। এ কথা যে বাপ বলে, সে বাপ তো মেয়েকে তখনি খুন করে বসে আছে। আর মেয়েও তো খুন হতে চাইছিল। আল্লা আমারে নাও, আমারে নাও বলে বাগানে—জঙ্গলে ঘুরত যে, সে খুন হতে চায় নি?

আবুলকে দিয়ে স্বীকার করানো গেল না, সে তখন গ্রামেই ছিল না। সে ঘরের শেষ সম্বল বলদটি বেচতে বেলডাঙা গিয়েছিল।

”আমি খুনী, আমার ফাঁসী দেন” বলে আবুল আবার মাথা কুটেছিল।

তারপর?

তারপর আবুল মণ্ডল, এমন কি ”অনন্তপুর জনবাণী’র পাতা থেকেও হারিয়ে গেল।

রেবা দাসের বাবা বুদ্ধি ধরে। সে লেখাপড়া জানত। সে বলে, রেপ কেস করতে পারে পুলিশ। মেয়ের মা, বাপ, ভাই কেউ পারে না। গরমেন কেস করলে তবে কেস হয়।

সুকেশ সরকার, যে না কি খবরগুলো লিখেছিল, সে ছুটে গিয়েছিল রেবার বাপের কাছে।

—চলুন, পুলিশকে চাপ দিয়ে কেস করাব।

নবনীমোহন দাস, মুড়ি—চিড়ে—বাতাসা দোকানী রাজী হয় নি।

—আপনি বলছ, ভালই বলছ, কিন্তু কেস করাব কাকে দিয়ে?

—পুলিশকে দিয়ে।

—ওঃ! পুলিশকে দিয়ে! পুলিশ যদি কিছু করত, তবে পিশাচগুলো সাহস পায় এত? ধরবে বা কেন? পেছনে ন্যাতারা আছে না?

—বকু বারবার এ ভাবে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে…

—কে বকু? কার নাম বলছ বাবু? আমি চিনি না, জানি না। বাতসা নেবে আপনি?

সুকেশ সরকার বাতাসা কিনেছিল কি না, তা সরমা জানেন না। তবে এটা সত্যি, যে সাইদা, রেখা, এদের কথা ভাবলেই মনে হত অতসীর কথা!

রেবা দাসের বাবা পুলিশের কাছে যেত কোন ভরসায়?

তাকে তো বাস করতে হবে মুচিখোলা গ্রামে, তার তো বউ ছেলে মেয়ে আছে।

ধর্ষণ ক্ষেত্রে অপরাধীর বিরুদ্ধে কেস করার অধিকার সরকারের। শুধু সরকারের?

ধর্ষিতার। তার আপনজনের, কারো কোন অধিকার নেই?

অতসীর কি হবে, অতসীর? সময়ের গা যখন এইডস সংক্রমণে পচে যাচ্ছে?

অতসীর কি হবে?

সরমাকে রামের মা বলেছিল, ক’টা মাইয়া এভাবে মইরা গেল, আমার বোনঝির ঘটনাও তো ওই।

—পুলিশ জানে?

—পুলিশ কী করবে? আপনারে পোলারে সবাই…

.

কিন্তু কোথায় সাহস পেয়েছিল পার্থদের সহপাঠী সুকেশ সরকার? শুনেছেন বটে ও ছাত্র—কংগ্রেস করত। কে ওকে ভরসা দিয়েছিল, তুমি লিখে যাও? সুকেশ তো রাজনীতি করত না।

মেট্রন বলেছিল, লিখবে না? বকুকে ছেড়ে দেবার বিরুদ্ধে ওই তো লেখে আগে। পরে না কলকাতার কাগজ লিখল? সুকেশের বউ কাজ করে, ও বাড়িভাড়ার টাকা পায়, কাগজ চালায়। পণ দেব না বলে জেদ ধরেছিল, তাতেই বোনের বিয়ে হল না। কী লাভ হল? বোন তো সেই ভেগেই গেল লাইট মিস্ত্রীর সঙ্গে? তবে হ্যাঁ, মিথ্যে খবর লেখে না।

—খবর ধরে নিলাম সত্যি। কিন্তু পুলিশ কিছু করে না কেন?

—দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না।

কিন্তু কেন?

”জনবাণী”র ওপরে লেখা থাকে নির্ভীক সংবাদপত্র। ছাপার ভুল থাকে, কৃষি সংবাদ, খেলাধুলার খবর। টাউনের আশপাশের মেলা ইত্যাদির খবর থাকে।

মাঝে মাঝে অত্যন্ত আবেগপূর্ণ উত্তপ্ত ভাষায় নারীধর্ষণ—নির‍্যাতন ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার খবর থাকে।

মিলন বলে, এসব তো বহরমপুরেও কাগজে বেরোয় মা, আমার যে কী অবস্থা!

—তুই আসিস কেন মিলন?

—তুমি আছো বলে।

—আমি আছি, বাধ্য হয়ে আছি। তোর তো কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সবাই জানে আমি কার মা। এ কলঙ্ক নিয়েই আমাকে চলতে হবে। তুই তো না এলেই পারিস।

—সবাই জানে আমি কার ভাই।

একজনের জন্যে কতজন জ্বলে মরবে, কতদিন?

—”জনবাণী” পড়ে খবর পাও?

—শুনি মাঝে মাঝে। কাগজটাও দিয়ে যায়।

—কোনদিন কী লিখে বসবে, মরবে। একবার ভাবেও না, মেয়ে বড় হয়েছে, কলেজে যায় বাসে চেপে।

—তোর জন্যেও ভয় হয়। কেন বা আসিস!

—লিলি তো আসতে দিতেই চায় না।

—ঠিকই করে। আমি বা কী লোহা না পাথরে তৈরি হয়ে এসেছি। মরি না।

—দাদা কোথা থেকে টাকা নিয়ে টাউনে এসে জমির কারবার শুরু করল তা জানো?

—ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে থাকবে। সৎপথের রোজগার কেমন হয় তা তো ও জানে না।

—বলতে পারো। বীরু পাঠকের হয়ে এক কাজই করত। দু’আড়াই লাখ নিয়ে কেটে পড়ে।

—বীরু পাঠক তো ওর সঙ্গে ঘোরে।

—ওই তো। তালে তাল দিচ্ছে, টাকাও তুলে নেবে। একবার রবি পাঠক জিতুক। বীরুবাবু আর অবনীবাবু দুজনেই তাল দিয়ে যাচ্ছে।

—ওকে বাঁচিয়েও যাচ্ছে।

—এখন তো রাজনীতি এরকমই।

—গুণ্ডা, মস্তান, খুনে নিয়ে?

—হ্যাঁ মা, এখন এ রকমই। ওদের এখানে টাউনেই দাদাকে দরকার। দাদা জমির ব্যবসা, ঠিকাদারি, বর্ডার কারবার করে যথেষ্ট প্রভাব করে ফেলেছে। তবে তা এখানেই। যাক না বহরমপুর, ঢুকতেও পারবে না। সেখানে অন্য ব্যাপার। আবার দাদার তো কলকাতায় কোন কানেকশান নেই, ওদের আছে। দাদারও ওদেরকে দরকার। যাক গে, তুমি কি উইল করেছো?

—করব এবার। ভাল মনে করেছিস।

—উইল থাকলেও, দাদা জুড়ে বসলে আমি কিছু পাব না। ও যদি আমাকে একটা ন্যায্য টাকা ধরে দিত, আমি আর ভাগ চাইতাম না।

—আমি জানি না।

—তুমিও সম্পর্কটা কাটিয়ে দিলে একেবারে। না কি?

—সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয় মিলন, আর বলিস না।

—তোমার অবস্থাই সবচেয়ে…

সকলের চোখে যে ভয় ও ঘৃণার পাত্র, তার মা হয়ে একটি ছোট টাউনে বাস করবার দুঃসহ যন্ত্রণা মিলন কী বুঝবে। সরমা বললেন, খেয়ে নে। আমার সকালে ডিউটি। কাল রাখি আসবে না, ওর ছেলের অসুখ।

—একেবারে একা থাকা..

সরমা শুকনো, তীব্র গলায় বললেন, চোর বা ডাকাত, বকুর বাড়ি ঢুকবে না। সে ভয় নেই! কিন্তু ঘর পড়ে থাকলেও রাতে এখানে বাস করবে না কেউ, কোন কাজের লোক নয়। একা থাকা? একাই তো থাকি। মেশিনের মতো হয়ে গেছি মিলন, আর ভাবি না ভাবতে ভুলে গেছি।

—অসুখ বিসুখও তো হতে পারে।

—হয় কোথায়? তোর বাবা…নরম মানুষ ছিল…আঘাত সইতে পারল না। আমি তো পাথর। পাথর কি ক্ষয় হয়? যা, হাত মুখ ধুয়ে আয়।

.

এরপরেই সহসা গ্যারেজ হস্তান্তরিত হয়ে যায় বকুর নামে। প্রদীপ্তদের যে বৃহৎ আমবাগানের ওপর বকুর লোভ ছিল, সেটি বকুই কিনে নেয়।

কী শর্তে, কী টাকায়, কী চাপে পড়ে, তা জানতে পান না সরমা। তবে এটা বোঝেন, যে অত্যল্প দামে কোহিতুর, সাদৌল্লা, আনারসা, ভবানীচৌরসের যে আমবাগান জেলার গর্ব ছিল; সেটি প্রদীপ্ত স্বেচ্ছায় বিক্রি করেনি।

বারো হাজার টাকায় বাগান বিক্রি হল, আর—

প্রদীপ্তর রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে যায়। ওর বউ ওকে নিয়ে গাড়িতে চলে যায় কলকাতা। সেখানে দু’মাস থেকে প্রদীপ্ত ফিরে আসে শীর্ণ আর গম্ভীর হয়ে।

সরমা মাথা নিচু করে বোবা হয়ে কাজ করেন। কাজের স্বাভাবিক ছন্দ ধরে রাখার মধ্যেও কৃত্রিমতা এসে যায়। যন্ত্রের মত কাজের কথা বলে যান।

—সাত নম্বর বেডে ডাকছিল রাখি!

—এই ওষুধগুলো আঠারো নম্বর বেডের জন্য।

—দু’নম্বর কেবিনকে রাতে শুধু সুপ দেবেন।

—টাকাটা জমা করে নিন বাদলবাবু, শিপ্রার দিদির জন্যে দিয়ে গেল।

—লিনেনের আলমারির তালা পালটাতে হবে। এ মাসেও তিনটে তোয়ালে কম দেখছি।

খাতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় করে তুলেছিলেন সরমা। বিশেষ প্রদীপ্তর অনুপস্থিতির সময়ে!

মেট্রন আর ক্যাশিয়ার বাদলবাবু বলতে বাধ্য হলেন, সরমা যেভাবে নিজের কাজের বাইরে সবদিকে নজর রেখে চলেছেন, তা দেখা যায় না।

মেট্রন বললেন, আপনাকে ইনক্রিমেন্ট দেয়া উচিত।

—না!

সরমা আর্তনাদ করেছিলেন। কিছু চান না তিনি। তাঁর এই প্রাণ দিয়ে কাজ করার পেছনে কথা তো একটাই। বকু এক অপমানজনক অবস্থায় ফেলে প্রদীপ্তকে বাগান বেচতে বাধ্য করেছে। সরমার এ আচরণ, তিনি বকুর মা বলে নিরন্তর প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। প্রায়শ্চিত্ত!

কিন্তু কতদিন এভাবে পারবেন, কতদিন?

ওই প্রাচীন বাগান হস্তান্তর নিয়ে ”জনবাণী” লিখতে শুরু করল। জমি, বিশেষ কৃষিজমি দিয়ে ফাটকাবাজি, রাজনীতিক নেতা, সরকারি অফিসার ও জনৈক সমাজবিরোধীর জোট বাঁধার কথা।

তার পরে পরেই বেরোল ”জনৈক সমাজবিরোধীর বিষয়ে বিশেষ সংবাদ”, যাতে মিতা ধর্ষণ ও হত্যা, কয়েক বছর আগে অন্য গ্যারেজ মালিক লালচাঁদ রাই হত্যা, বীরু পাঠকের সঙ্গে এক দুষ্কৃতীর অশুভ যোগাযোগের কথা, সবই বেরোয়। টাউনের আশপাশে নারী অপহরণ, বিক্রি, ধর্ষণ ও হত্যার তালিকা বেরোল। ”পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা কেন” তার বিশ্লেষণও বেরোল। সরমা বুঝলেন এবার কিছু হবে।

সুকেশের প্রেসে বোমা ফেলা ও সুকেশের মেয়েকে বাসস্টপ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া এক সন্ধ্যাতেই ঘটে।

সে মেয়ে নিখোঁজ থাকল একদিন, দু’দিন, তিনদিন। তারপর পাওয়া গেলে ব্রিজের নিচে তার ধর্ষিত ও নিহত শরীর।

টাউনের মনে শ্যাওলা জমেছিল। প্রতিবাদ করতে ভুলে গিয়েছিল মানুষ। মানুষ শিখেছিল, চোখ খোলা রেখেই কিছু না দেখতে।

কান খোলা রেখেও কিছুই না বলতে।

মুখ থাকতেও কিছুই না বলতে।

প্রদীপ্তদের বাগান এভাবে বিক্রি হতে পারে, কিন্তু শহরে কেউ ভুলেও সেকথা আলোচনা করবে না।

বস্তি পুড়তে পারে, মানুষ উচ্ছেদ হতে পারে,—সেটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এ শহর উদযাপন করে রবীন্দ্রমেলা। একাঙ্ক নাটক উৎসব। মে—দিবস উদযাপন। নেলসন ম্যান্ডেলাকে অভিনন্দন জানিয়ে পোস্টার লাগাতে পারে।

কিন্তু উদিতা, একটি ছোট মেয়ের নগ্ন শরীর যেন এ শহরের এসব হিপোক্রিসির আবরণ খানিক খুলে দিল।

বহুদিন বাদে এ শহরে এ ঘটনা নিয়ে গোলমাল শুরু হল।

সুকেশের মেয়ে উদিতা সরকারের ধর্ষণ ও হত্যা থেকে যেন টাউন হঠাৎ বুঝল, নারীঘটিত অপরাধ খুব বেড়েছে।

রবি পাঠক এক ডেপুটেশন নিয়ে গেল থানায়।

মহিলা এম.এল.এ. চলে এলেন সরেজমিন তদন্তের ওপর জোর দিতে।

.

জেলার অন্যান্য কাগজেও লেখালেখি শুরু হল। উদিতা যদিও ”বকু গুণ্ডা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বাঁচাও বাঁচাও” বলে চেঁচিয়েছিল, অনেকে শুনেছিল, সে কথা কেউ বলল না।

একদা সুধন্যবাবু থানায় গিয়েছিলেন। সরমা ঠিক করলেন, এবার তিনি যাবেন। থানায় যাবেন। একা? একাই তো হয়ে গেছেন বহুকাল। কবে সুধন্য ছিলেন, ছেলেরা ছোট ছিল। সন্ধ্যায় ওদের পড়াতে বসতেন সরমা। তখন তাঁর জীবনে নিয়মিত বৃষ্টি ঝরত, খরা ছিল না কোথাও। তারপর বকুর বন্য, উদ্দাম, হিংস্র ও কামুক হয়ে ওঠা, সুধন্যর হৃৎপিণ্ড ও চেতনায় রক্তপাত, সরমার অপার গ্লানি, মিলনের চোর হয়ে থাকা, খরার কাল শুরু। বাড়তে বাড়তে খরার তাপ সুধন্যকে নিল, সরমাকে নগ্ন ও অসহায় করে দিল দুনিয়ার সামনে। অতসী এল বৃষ্টির আশ্বাস নিয়ে। দিনে দিনে, বছরে বছরে, ঝরঝরে বৃষ্টিতে সরমার জীবন আবার সিক্ত, শ্যামল, স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। বকু এক প্রচণ্ড দাবানলের মতো এসে সব স্নিগ্ধতা মুছে নিয়ে গেছে। আবার বিশাল মরুপথে যাত্রা, এবার একেবারে নিঃশেষে একা।

থানায় একাই যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাজারতলার মাঠে জনসমাগম, সরু পথ, রিকশা চলছে, উঠে দাঁড়ালেন দোকানের দাওয়ায়। হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান। দাওয়ায় দাঁড়িয়েছিলেন কমলেশবাবু।

আরও বয়ঃজীর্ণ, রোগা, চশমার পিছনের চোখের দৃষ্টি অবোধ্য, মুখে অনেক রেখা। এই কমলেশবাবু অবিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য, স্থানীয় নেতা, ষাটের দশকে খাদ্য আন্দোলনে মিছিল নিয়ে কলকাতা গিয়েছিলেন। চেনা যায় না।

—মিলনের মা নয়?

—হ্যাঁ আপনি এখানে দাঁড়িয়ে।

—আমি তো এখন পথপার্শ্বের জনতা। দাঁড়িয়ে দেখি। আমাকে কেউ দেখে না আমি অন্যদের দেখি। আমি এখন বরবাদ। তা…আপনি কি মিটিংয়ে এসেছেন?

—কিসের মিটিং? আমি থানায় যাব।

—কেন? এমন সময়ে…একা একা…

—থানায় যাব। বলব বকুকে ধরুন। শাস্তি দিন…মানুষের ক্ষতি করবে বলে পাগলা কুকুর মেরে ফেলেন…ওকে কেন ছেড়ে রেখেছেন? পুলিশ কত নির্দোষকেও মারে, দোষীকে ছেড়ে রেখেছে কেন?

—আস্তে মিলনের মা, আস্তে। মিটিং দেখুন।

—কিসের মিটিং?

—আইনশৃঙ্খলার অবনতি, উদিতা সরকার ধর্ষণ ও হত্যা, প্রতি মাসে সাত—সাতটা নারী—ধর্ষণ, কখনও ধর্ষণের পর হত্যা। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা,—প্রতিবাদ জানাতে এবং প্রতিকার দাবি করে মিটিং। ওই দেখুন, প্রধান বক্তা রবি পাঠক, মায়া ঘোষ ঢুকল। দেখুন সঙ্গে কে?

খোলা ম্যাটাডোরে লাল ব্যানারে লেখা, নারী ধর্ষণকারী ঘাতকদের শাস্তি চাই। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে পরশু দিন বন্ধ পালন করুন।

ব্যানারে পিঠ রেখে দাঁড়িয়ে স্বয়ং বকু। রবি পাঠক ও মায়া ঘোষ বসে আছে।

—দেখলেন?

সরমা মুখে হাত চাপা দেন।

—চলে যান, বাড়ি চলে যান, ওরা থানা থেকেই আসছে। এখানে থাকবেন না। এরপরেও থানা যাবেন?

—কার কাছে যাবেন? শহরে কি মানুষ আছে? সব কেনাবেচা হয়ে গেছে এখন। এ এক বিশাল মাংসের বাজার। কসাইদের কাছে যাবেন? যাবেন না।

—আপনি…

—দেখে যাই। এখন শুধু দেখি। ছানি পড়েছে তো, তাই সব স্পষ্ট দেখি।

কি, যাবেন থানায়?

সরমা মাথা নাড়লেন। কী আশ্চর্য অবাস্তব সব। কী আশ্চর্য রকম অবাস্তব! সরমা নেমে আসেন। পথ ধরে বাড়ির দিকে চলেন। মাইকে বকুর গলা, বন্ধুগণ! এই টাউনে এবং আশেপাশে নারী নির‍্যাতন ও হত্যার ঘটনা চলছে, তবে চলবে না…আমরা…

পথচারী ও প্যাডলার মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছে কেউ কেউ।

সরমা কী করবেন? পুলিশের কাছে গিয়ে কী লাভ?

সেদিন সুধন্য ফিরে আসেন, আজ সরমাও ফিরে আসছেন। কোন দেশে, কোন সমাজে বাস করছেন সরমা?

একটা কী যেন গোলমাল। সরমা থমকে দাঁড়াল।

ভীষণ, ভীষণ দর্শন একটা লোক। ঝাঁকড়া কোঁকড়া চুল কাঁচাপাকা, বেঁটে, চৌকো ও বলিষ্ঠ। কুচকুচে কালো রং, গোঁপ পাকানো, ওপর পাটির দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। সে ঠেলছে দু’চার—জনকে চেঁচাচ্ছে ফ্যাঁসফেঁসে গলায়।

—আমি ছাড়ব না। আমি যাব। বকুকে আমি…

ছেড়ে দে তোরা…ওকে মেরে আমি ফাঁসি যাব…সুকেশের মেয়েকে ও…

মডেলদা! মডেলদা!

—আমি যাব।

একটি ক্রুদ্ধ রণরঙ্গিনী মেয়ে এগিয়ে যায়।

—কার কাছে যাবে বাবা! অবনীবাবুর কাছে?

—এই, এই বীণা!

—বাপকে নিয়ে যা। তুই চুপ কর।

—আরে, তোরা ভয় পাস, আমি ভয় পাই না। বাবা! বাড়ি চলো।

মডেল বলে, বাড়ি যাব?

—হ্যাঁ, বাড়ি যাবে। এখানে কাদের সঙ্গে কথা বলছো?

—বীণা, মাইরি বলছি…

—যা যা, সবাইকে চেনা আছে। বাড়ি চলো বাবা। টর্চ কোথায়?

—বাড়ি যাব!

—হ্যাঁ, মা বসে আছে।

—চল, তাই চল।

—করতে পারবে না কিছু যখন, তখন চেঁচিয়ে দম নষ্ট করো কেন? তখন তো …যাক গে।

—আমি ওকে একদিন…

—আপনি…এখানে কেন?

পরিশীলিত কণ্ঠ, গলায় উদ্বেগ।

—পার্থ!

—আপনি বাড়ি যাচ্ছেন?

—হ্যাঁ।

—চলুন, খানিক এগিয়ে দিই।

হাঁটতে থাকেন সরমা। দু’পাশ দিয়ে টাউনও চলেছে, কিন্তু সবাই অচেনা, অন্য জগৎ।

—কোথায় যাচ্ছিলেন?

—থানায়। গেলে বলতাম, বকুকে ধরুন…মারুন…কত নির্দোষকে মারেন…ওকে…

—যাননি তো?

—না, পথে…কমলেশবাবু…মিটিং দেখলাম…ওকেও দেখলাম…

—যাবেন না থানায়।

—এ টাউনে সবাই কি মরে গেল?

—না। পরশুর বনধ কেটে যাক, আমরা মিটিং করব, থানা ঘেরাও করব, কলকাতার কাগজের লোক আনব, বকুকে নিয়ে নির্বাচন জেতা বন্ধ করব রবি পাঠকের।

—আমি যাব মিটিংয়ে, আমি বলব।

—তারপর এখানে ফিরবেন, জীবন বিপন্ন হবে, হয় তো মিলনেরও। আমার ধারণা বকু সাইকোপ্যাথ। এ রকম কেস পাওয়া যায়, মেয়েদের সম্মান লুঠে তাদের খুন করে। যাবেন না। ও বিকারগ্রস্ত। আপনার আর মিলনের ওপর রাগও আছে।

—ওই লোকটি কে? চেঁচাচ্ছিল?

পার্থ ঈষৎ হাসে।

—নাম ধনুর্ধারী। তবে টাউন বলে ওর মডেলে দুর্গাপূজোর মহিষাসুর তৈরি হয়। নাম এখন মডেল। অবনীর লোক, সমাজ—বিরোধী ছিল, তবে তিন—চার বছর বসে গেছে। পুলিশ ওর ছেলেকে মারল, ওকে শাসাল…বর্ডার থেকে জামা প্যান্টের কাপড় আনে, বেচে। জামাইকে ক্যাসেটের দোকান করে দিয়েছে, ওই মেয়ে ওর। এসে গেছেন প্রায়, চলে যান।

—অনেকদিন বাদে দেখলাম…ভাল থেকো।

—চলি!

সরমা দরজা খুলে ঢুকে বসে পড়েছিলেন বারান্দায়। তারপর মাথায় জল ঢেলে স্নান করে অনেকটা জল খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুম আসেনি।

 * * *

আজ যেমন আসছে না আসবে না। কে নিয়ে গেল তাঁর ঘুম?

অতসী নিয়ে গেছে।

অতসীর বিপন্ন আর্তনাদে সরমা রক্তমাংসের মানুষ হয়ে গেছেন।

নইলে তিনি তো মেশিন হয়ে গিয়েছিলেন। আশ্চর্য যান্ত্রিকতায় কাজ করতেন, খেতেন, ঘুমোতেন। ভাবতেন, এর পরেও বাঁচবো কেন? মেশিনও ক্ষয় হয়, জীর্ণ হয়। আমি তেমনি করে শেষ হব একদিন।

কাল রাত অবধি ঘুমিয়েছেন।

আজ ঘুম নেই, অতসী ঘুম নিয়ে গেছে।

সেবার দীর্ঘকাল বাদে টাউনের মানুষ নড়ে বসেছিল। মিতা হত্যার পর যেমন, তেমন ক্ষেপে দোষীকে ধরার জন্যে ছুটে বেড়ায়নি। মিতার দিদি রীতার বন্ধু ছিল পার্থরা। তখন হাওয়া ছিল অন্য রকম। নব নির্বাচিত সরকার আসার ফলে মানুষের মধ্যে একটা জাগরণ এসেছিল।

সেদিনও বকুর প্রকৃত বিচার ও শাস্তি হয়নি।

এতকাল বাদে হাওয়া ঘুরে গেছে।

সুকেশের মেয়ের বন্ধুরা ও বান্ধবীরা অন্য মানসিকতার। মানুষও পালটে যাচ্ছে। মেট্রনই বললেন, সব মেয়ের তো এমন পরিণতি হয় না। যাদের হয়, জানবেন তারাও গঙ্গাজলে ধোয়া নয়।

সরমা নির্বাক থাকলেন।

—আপনার কী মনে হয়? মেয়েটা…

—যে মেয়ে ধর্ষণ হয়, সে নিজেও খারাপ, এ আমি বিশ্বাস করি না। যদি খারাপও হয়, তার ইজ্জত নেবে?

—অ, কাগজ পড়েন খুব? মেয়েদের স্বাধীনতা?

—পড়ি।

মেট্রন কেন, মেয়েদের ব্যাপারে সবসময়ে মেয়েরা কেন নির্দয় হয়? মিতা হত্যার পর থেকে কত, কত ধর্ষণ, ধর্ষণ ও হত্যার কথা পড়লেন। অপরাধীদের কঠোর শাস্তি হয় এ খবর তো কখনও পড়েননি।

অতসী বলত, উকিলবাবুর কাছে শুনি তো! কিছুই হয় না অগো। কেসই হয় না, কেস উঠলেও আসামি কয়, কিয়ের জোরে করছি? অ আমারে ডাইকা নিচ্ছে। এই তো! আর মাসিমা, আদালত বলেন, পুলিশ বলেন, সমাজ বলেন, বেবাক মনে করে মাইয়াটাই মন্দ। ইজ্জত লইলে সে মাইয়ার আর উদ্ধার নাই।

তবু তো সংগঠিত প্রতিবাদ হয়।

”জনবাণী”, নীরব থাকলেও জেলার অন্যান্য কাগজ তো লিখল? কলকাতার কাগজেও সংক্ষিপ্ত খবর বেরোল। টাউনে মেয়েদের সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করল, প্রতিকার চাইল।

সেদিনের মিটিঙের ব্যাপারও মুখে মুখে ফিরল। ফলে রবি পাঠকের দাঁড়াবার ব্যাপার বাতিল হয়ে গেল। পুলিশ ইনসপেক্টর সাসপেনডেড হলেন। তদন্ত শুরু হ’ল।

কলকাতা থেকে এলেন এ জেলা থেকে নির্বাচিত মন্ত্রী।

তিনি মিতার সময়েও এসেছিলেন।

বললেন, নারী ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিরোধে সমাজের শুভকামী নর—নারীকেই এগোতে হবে।

এ কথা সেবারও বলেছিলেন।

বললেন, পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তায় সমাজবিরোধীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে।

এ কথাও সেবার বলেছিলেন।

এ সময়ে হঠাৎ শোনা গেল বকু টাউনে নেই। সে কলকাতা গেছে।

জনমত যেমন হয়। জাগ্রত হল, জাগ্রত থাকল, অতঃপর বিশ্রাম করতে গেল।

কমলেশবাবু বললেন, এই জনমতের কোন দাম নাই। যত অনাচার, তার নিরসন করবে কে? না অনাচারী।

সে অনাচারীর মদত দেয় কে? না রাজনীতিক নেতারা। এই নেতারা কে?

কেউ কোন আন্দোলন করেনি, দল করতে এসে ক্ষমতায় বসেছে।

কোন জনতা সামিল হল? এক বোবা—কালা—কানা জনতা। বকু যেয়ে মিটিং করে, জনতা শোনে। এদের জনমতের দাম কি?

কমলেশবাবুর শ্রোতা এখন মডেল। কেননা মডেলই তাঁর কাছে এসে বসে।

মডেল বলল, রেখে দিন ও সব কথা। ঘেন্না ধরে গেল।

আর অতসী প্রসূতিসদনে এসে বলল, মায়ের নামে মহিলা—শিশু সদন উদ্বোধন করবে সাক্ষাৎ এম. এল. এ মায়া ঘোষ। কয়, তুমি চালাইবা কী কইরা? সমাজকল্যাণ দপ্তররে দিয়া দেও, অরা দায়িত্ব নিব। আমি কইলাম, মানে ওনারে কই নাই, ভাবলাম, মিশনরে দিয়া দিলে অরা ওখানে মাইয়াগো, শিশুগো, চিকিৎসার কাম করতে পারে। ডাক্তার বসলে গ্রামের লোকেরও উপকার।

—বলেছিস মিশনকে?

—আপনেরে না কইয়া বলতে পারি?

—সেই ভাল অতসী। একটা প্রতিষ্ঠান চালানো কি সহজ কথা?

—টাকাও দিয়া দিমু। অরা তো ভাল কাজই করে।

—সব দিয়া দিবি?

—আমারে অরাই ত শিখাইয়া নার্স বানাইল। যে কাজ শিখছি, মাসিমা, আর উপাস করব না।

—নিজের একটা থাকার জায়গা?

—নিজেই কইরা নিমু। আমি ত কোয়াটারও পাইতেয়াছি। পাইলে আপনেরে নিয়া যামু।

—তাই নিয়ে যাস। এ কাজটা হোক আগে।

—আজ ডাক্তার মামারে বইলা যাই।

প্রদীপ্ত ও তার স্ত্রীকে বলে বড় আনন্দ করে চলে গিয়েছিল অতসী।

এবার ওই সদন উদ্বোধন হবে। সরমা ভেবেছিলেন, এখন আর কেউ দখল করতে পারবে না অতসীর মায়ের বাড়ি। অতসীর স্বপ্ন ভেঙে দিতে পারবে না।

ভেবেছিলেন?

তারপর, তারপর আজ সন্ধ্যায় অতসী তাঁকে ডাকল।

সরমা উঠলেন, জানলার পর্দা টানলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *