আই. পি. সি. ৩৭৫ – ৪

চার

ভুলে যায়। ভুলে যাওয়াটা বোধহয় নিয়ম।

মিতার কেসের পর পোস্টমাস্টাররা চলে গেলেন। সরমা শুনেছেন, তিনি রীতা আর কিশোরের কাছে থাকেন। নীতা খেলাধুলো করত, বি. এস. সি. পাশ করল, রেলে চাকরি পেয়ে গেছে।

তখন যারা ছোট ছিল, তারা বড় হয়ে গেল। মিতার স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এল মানুষের মনে। তখনকার অনেক পরিবার টাউন ছেড়ে চলে গেল ; আবার নতুন নতুন মানুষ এসে শূন্যস্থান পূর্ণ করল।

অনেক, অনেক নতুন বাড়ি উঠেছে। মানুষ এখন মাইনে পায় বেশি, কলেজে বা আপিসে বা ব্যাঙ্কে লোন নিয়ে বাড়িও করে ফেলে।

করবে নাই বা কেন? মহকুমা সদর হিসেবে ভাল টাউন। চার পাঁচটা বড় বড় খেলার মাঠ আছে। তরুণ সংঘ ক্লাব থেকে ভাল ভাল ফুটবলার বেরিয়েছে। আর চিত্রাভিনেত্রী সুমনার পরিচয়ে সবসময়ে দাবী করা হয় ও এই টাউনের মেয়ে। যদিও সুমনার বাবা এ শহরে মাত্র তিন বছর কাজ করেছেন।

এ শহরের পাশে আছে বহতা নদী। হাইওয়ে তো সর্বদা ব্যস্ত থাকে। উত্তরবঙ্গগামী কত বাস। কত বাস! হাওড়া লাইনের ট্রেন ধরা খুব সহজ এখন।

এততেও অনন্তপুর প্রচণ্ড গুরুত্ব পায়নি।

শহরকে প্রকৃত গুরুত্ব দিলেন যোগপ্রেমানন্দ। তিনি একজন অতিমানব, দেবতার অংশ। চেহারায় জেল্লা, বসন ভূষণ, সবই টি. ভি.—র বিজ্ঞাপনের মত। চেহারা দেখলে মনে হয় কবির বেদী কোন সন্ন্যাসী সেজেছে। অথচ ওঁর বয়স না কি একশো পঁচিশ।

একশো বছর আগে বিকানীর থেকে পঁচিশ বছরের যে যুবক যথারীতি হিমালয় গমন করেন। তিনি একদা হরিদ্বারে চলে এলেন যোগাসনে আসীন অবস্থায়। গঙ্গাবক্ষে ভাসতে ভাসতে।

হরিদ্বারেই বসে গিয়েছিলেন। কিন্তু অনন্তপুরের বিখ্যাত জৈন পরিবারের এক প্রৌঢ়, যিনি দিল্লীতে বিশাল ব্যবসা ফেঁদেছিলেন, ভালই ছিলেন, তাঁকে সহসা সস্ত্রীক শান্তির সন্ধানে হরিদ্বার যেতে হয়।

কারণ তাঁর পুত্রবধূ চন্দা। চন্দাকে পুড়িয়ে মারার অপরাধে তার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি সকলে ধরা পড়ে, অহেতুক প্রচার পায় ঘটনাটি, ঢি ঢি পড়ে যায় দিল্লীতে, এবং শ্বশুরের ব্যবসা চোট খায়।

চন্দা জনৈক মন্ত্রীর আত্মীয়া, যে মন্ত্রী অতীব প্রভাবশালী। শ্রীযুক্ত ও শ্রীযুক্তা জৈন তীর্থে তীর্থে ঘুরতে থাকেন।

যোগপ্রেমানন্দকে তিনিই ”আবিষ্কার” করেন। সাশ্রু নয়নে বলেন, সব লপসাইডেড গ্রোথ হয়ে যাচ্ছে প্রভু। একদিকে পশ্চিম ও উত্তর ভারত দপদপিয়ে বাড়ছে শুধু ধর্মানুগত্যের জন্যে। ওদিকে পশ্চিমবঙ্গ দেখ। গডলেস দেশ। একটা কিছু করো।

—এর জন্য চাই ত্যাগ।

—আমি তো আমার সর্বস্ব…

—তোমার জনসংযোগ কি রকম?

—হয়ে যাবে প্রভু।

হয়ে যায়, সবই হয়ে যায় এখন, মনে যদি বিশ্বাস থাকে, বিশ্বাসে শুধু বস্তু নয়, ধর্মাচার্যের কৃপাও মেলে।

যোগপ্রেমানন্দ এবং জৈন দম্পতি তিন মাস বাদে দিল্লীতে উপস্থিত হন। জৈন বলেন, আমার ওপর ছেড়ে দিন সব।

সাধুমহারাজ বলেন, সব মনে রেখো।

—রেখেছি।

মধ্যবর্তী তিন মাস সময়ে দুজনে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। দুজনেই বুঝেছেন, এ যুগে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে একেবারে ব্যবসায়ীর মত। প্রোমোটার চাই, টাকা খাটাবার লোক চাই, জনসংযোগ অফিসার চাই, চাই ধনী ভক্তকুল।

দিল্লী ব্যবসা বা রাজনীতি বা ধর্মের পক্ষে উর্বর ক্ষেত্র।

দিল্লীতে সাধু বা সাধ্বী, মহাপ্রাণ ও মহাপ্রাণা, জ্যোতিষী, গণক, ম্যাজিক দ্বারা রোগ আরোগ্য ইত্যাদি ইত্যাদির সমাজে যোগপ্রেমানন্দ যে ফিট করে গেলেন, এ শ্রীযুক্ত জৈনের অবদান। ব্যবসা নয়, দোরে দোরে ঘুষ দিতে হল না। ক্যাবিনেট ও অন্যান্য দলের মানুষরাও ভিড় করলেন। প্রেমানন্দ আশ্রমের প্রাণপুরুষ বললেন, মাটি, মাটির দখল নাও।

বললেন, বাংলার মহিমা অস্ত গেছে। কিন্তু সূর্য তো পুব আকাশেই ওঠে। বাংলার মাটি থেকেই উদিত হবে প্রকৃত ধর্মচেতনা।

দিল্লী থেকে পাটনা, ক্রমে তাঁর নাম ছড়াল। এখন বিদেশে তাঁর ভক্ত অনেক, অনাবাসী ভারতীয় আছে, আছে সেখানকার অধিবাসীরা।

অখ্যাত অনন্তপুরে নদীর ওপারে এঁর বিশাল আশ্রম ও অতিথি—আবাস প্রতিষ্ঠা সুরেশ জৈনের কীর্তি। প্রেমযোগানন্দ সেখানে বছরে চারবার আসেন। তাঁর মূর্তি পূজা পায়। ক্যাসেট তাঁর কণ্ঠ শোনায়।

সরমা দেখতে যাননি। কিন্তু প্রদীপ্তর বৌ দেখতে গিয়ে অভিভূত হয়ে ফিরে এল।

—কি আশ্চর্য জায়গা, স্বর্গ বললেও হয়।

—শুনেছি তো খুব দেখার মত জায়গা।

—বই এনেছি পড়ে দেখুন।

—ইংরিজি বই, সায়েবদের লেখা?

—না না, এ তো প্রেমযোগ ট্রাস্টের বই।

—বাঙালী ভক্তও অনেক?

—অনেক। সাতদিন ধ্যানমন্দিরে ধ্যান করলে, থাকলে সাত বছর বয়স কমে যায়। কি ব্যবস্থা! হট্টগোল নেই, নোংরা নয়, আলো ঝলমল করছে, বিশাল ফুলবাগান। বসে থাকলেও শান্তি।

বসে থাকলে শান্তি যে পাবার সে পায়।

সরমা কেমন করে তেমন শান্তির ছোঁয়া পাবেন?

প্রদীপ্তর বউ যে কি বলে!

—আমার কপালে নেই দিদি।

—কেন?

—ও তো বিশ্বাসই করে না। বলে, বাড়িতে দুর্গোৎসব হচ্ছে, ঘরে বিগ্রহ আছেন, ও সব ফ্যাশানেবল গুরুতে আমার বিশ্বাস নেই।

—অসীমা গিয়েছে?

—না না, কেউ না। আমার বাবা মা গেলেন, আমিও ঘুরে এলাম।

.

প্রেমযোগানন্দ নিয়ে ক্ষ্যাপামি কয়েক বছর চলল। কত ধানক্ষেত বিক্রি হল, আশ্রমের জমি হয়ে গেল, তার ঠিকঠিকানা নেই।

সরমা একদিনও যাননি।

অসীমা বললেন, যেতে ইচ্ছে হয় সরমা?

—না, কি হবে গিয়ে।

রেবতী বলে গেল, দেইখা আইলাম দিদি। ও বরলোকের জায়গা। আমার মত চাষীবাসীর লিগ্যা গুরুপাড়ার মঠই ভাল।

সরমা গেলেন না, অসীমা গেল না, কিন্তু অনন্তপুর প্রেমযোগাশ্রম নাম করতে থাকল। এপারে নয়, ওপারে একটা অন্যরকম মানুষের ভিড় হয়। বড় বড় গাড়ি আসে আর ঢুকে যায়। লাভের মধ্যে ওখানে একটা বাস স্টপ হল। অসীমা ঠোঁট উলটে বললেন, ভীমরতি ধরেছে মানুষের। যুবো যুবো ছেলে মেয়েও ভক্ত হচ্ছে।

পার্থ কলকাতার কোনো কলেজে সুযোগ পেয়ে চলে যাচ্ছে। যাবার আগে বলে গেল, একদিকে বাংলাদেশ থেকে মৌলবী আসছে, নতুন নতুন মসজিদ উঠছে। এখানে এক ঢঙের মন্দির হল। দেখলেন, পুজোপাট, কবচমাদুলি, নতুন নতুন ঠাকুরদেবতা কি রকম বাড়ছে এখন। আশ্চর্য!

—আশ্চর্য কেন?

—আশ্চর্য অথবা দুঃখের বিষয়। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায়। রাজনীতির বোধচেতনা এখন উধাও। যুক্তিহীন, অন্ধ বিশ্বাস এ ভাবে বাড়বে?

—তাই তো বাড়ছে পার্থ।

—দুঃসময় এটা। এ দুঃসময় কি কাটবে?

সরমা ভাবলো, দুঃসময় তো অনেককাল শুরু হয়েছে। নইলে বকুদের এমন করে আশ্রয় দেয় অনন্তবাবুরা?

কয়েকটা বছর তো নিঃশ্বাস নেবার সময় পেয়েছিলেন, তখন কি জানেন, এরপর জীবনটা নিষ্প্রদীপ হয়ে যাবে, থেকেই যাবে অন্ধকারে?

মিলন বি. এস—সি এত ভালভাবে পাশ করল যে, কলেজও আশা করল ও এম. এস—সি পড়বে, রিসার্চ করবে।

মিলন সে কথা ভাবলই না!

মিলন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি নিল।

সরমা বললেন, এ কি করলি?

—অত পড়ে কি হবে?

—কলেজে পড়াতে পারতিস আরো পড়লে।

—এমন চাকরি পেয়ে ছেড়ে দেব? তা ছাড়া, আমি দূরে যেতে চাই। অন্য কোথাও…. ফোর্থ ইয়ারে একবার শুনেছিলাম ওরা ছেড়ে দিতে পারে। শুনে আমি কলেজ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলাম।

হ্যাঁ। মিলন ওই রকমই।

পালিয়ে বাঁচতে চায়।

—আমার কথা ভেবেছিস?

—আমি, আমি যদি দাঁড়াই মা, তোমাকে নিয়ে যাব সেখানে। এখন তো মাত্র ন’শো আশি পাব। তোমাকে আমি টাকা পাঠাব মা।

ভীষণ, ভীষণ আঘাত পান সরমা। কিন্তু মিলনের কথা তো মিথ্যে নয়। বকুর ছায়াতে সে বাঁচবে কী করে? বকু একটি এমন নাম, যার সংস্পর্শে এলেই সব নষ্ট হয়ে যায়।

—তুমি একলা হয়ে যাবে…. কিন্তু অতসী তো আসবে, আসেও তো।

—আমার কথা ছেড়ে দে। না… রাগ করে বলছি না মিলন!

সরমা চেষ্টা করেই হাসেন।

—আমার তো বড় বন্ধন এই বাড়ি… তোর বাবার স্মৃতি… এমন নয় যে কোনও জায়গা আছে গিয়ে দাঁড়াব।

—আমি দাঁড়ালেই তোমাকে নিয়ে যাব মা!

—আগে দাঁড়া! মাইনে তো ভালই।

—শুনতে ভাল। আজকাল টাকার দাম কী? এক টাকায় কী কেনা যায়? টাকার কোন দাম আছে?

—কলকাতায় চাকরি।

—হ্যাঁ…. একটা ট্রেনিংয়ে পাঠাবে বম্বেতে, যদি মনে করে। লাইনটা ভাল। কতজন ওপরে উঠে গেছে। বহরমপুর বড় জায়গা তো, সব জানা যায়। এ টাউনে কিছুই নেই। ওখানে ক্লাব, খেলাধুলো, বইমেলা, কলেজে ডিবেট, সেমিনার, সে অন্য পরিবেশ। এত বদ্ধ জলা নয়। বাবা যে কেন এখানে…

—সময়ে সব বদলে যায় মিলন। গ্রামে থাকবেন না বলে এখানে বাড়ি করলেন। আমাদের কাছে এটাই টাউন। টাউনের পরিবেশে ছেলেরা বড় হবে! নইলে যে জমিজায়গা ছিল!

—বাবা ফার্মিং করতে পারতেন! চাষবাসে নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করে পানজাবে সব ফার্মিং করছে!

—আগে অত কথা কেউ জানত না। সামান্যেই খুশি থাকত। তোর বাবা তো সাবেককেলে মানুষ ছিলেন! যাকগে, যাবার আগে মন্দিরে পুজো দেব। অসীমাদের বলে আসব কালই। জামাকাপড়, সুটকেস, সব তো লাগবে।

—তা লাগবে।

—দেব। টাকা তুলে দেব।

—আমার জন্যে ফিকস ডিপোজিট ভাঙবে?

—যা হয় করব।

—টাকা আমি তোমায় দিয়ে দেব মা!

—বেশ তো। দিস! পার্থ… জানে….?

—জানে, বলেছি।

সরমা হাজার টাকা ভেঙেছিলেন। সব টাকাই তো মেচিওর করবে, বাড়বে, আবার ফিকস ডিপোজিট করবেন এভাবে রেখেছিলেন। কিছু টাকার সুদ সেভিংসে জমা পড়ে। তা থেকেই ভাঙলেন। ব্যাঙ্কের টাকায় হাত দিতে চান না সরমা, কিন্তু বাড়ি মেরামত করতে হয়। পুজোর আগে কিছু তুলতে হয়। এ ভাবেই গুনে গুনে চালান।

মিলন ছ’শো টাকা নিয়েছিল।

সে টাকা সে ফেরত ঠিকই দিয়ে দেয়। কিন্তু সরমাকে নিয়ে যাবে, সে কথা রাখতে পারেনি মিলন। সে জন্যে মিলনকে অনেকে স্বার্থপর বলে।

সরমা বলেন না।

গ্রাম থেকে অনন্তপুরে, এ টাউন ছেড়ে বহরমপুর, সে শহর ছেড়ে কলকাতা….টাউন ছাড়ার পরই ওর জীবনও অন্যরকম হয়ে গেল!

থাক, সুখে থাকুক। ওরা নিজেদের নিয়ে ভালই থাকে। লিলিকে সরমা কাছেও পান না, আশাও করেন না। পুত্রবধূর সঙ্গে তো সম্পর্ক হয় বছরে একবার।

পুজোর আগে মিলন মাকে দামি কাপড় দিয়ে যায়। বলে, লিলি কিনেছে মা!

বিজয়ার পর লিলির একটা পোস্টকার্ড পান। সরমাও আশীর্বাদ জানিয়ে চিঠি দেন।

ওরা স্বার্থপর, না স্বার্থপর নয়, সে বিচার সরমা করতেও যান না।

নিঃস্বার্থ ও দরদী হলেই কি আসতে পারত?

মিলনের দাদা যখন বকু?

দেয়ালে সুধন্যর ছবিটার দিকে তাকালেন সরমা। সুধন্যর বয়স সেই আটচল্লিশেই আটকে আছে।

সুরমার বয়স বাষট্টি হয়ে গেল।

পঁচিশ বছরে বকু জেলে যায়। এখন ওর বয়স ঊনচল্লিশ।

বাবার মৃত্যুকালে মিলনের পনেরো।

আজ ওর বয়স ঊনত্রিশ।

একা সরমার জীবনে এমন দুঃসহ ভার কেন?

অতসীর জীবনটাও যদি পরিপূর্ণ হতে পারত, সরমার একটা যাবার জায়গা হত। সব বেচে দিয়ে যাকে যা দেবার দিয়ে টাকা নিয়ে ওর কাছেই চলে যেতেন।

তাই যাবেন। তাই যাবেন, কোলে তুলে নেবেন ওকে। বলবেন, আমি আছি মা। আমি তোর কাছে আছি।

যদি সুযোগ পান।

অতসীও তো এক লক্ষ্যে এগোচ্ছিল।

চুরাশি সালে নাইন থেকে টেনে উঠল। রেবতীকে কথা দিয়েছিলেন সরমা। ওকে নিয়ে গেলেন প্রদীপ্তর কাছে।

—দিদি! ম্যাট্রিক পাস করলে তো সরকারি নার্সিংই পড়তে পারে।

—সে হয় না। ও তো বর্ণহিন্দু। তপশীলী বা আদিবাসী নয়। যদি চানস না পায়? তুমি তো বলেছিলে….

—জুনিয়ার নার্সিংই শেখাও ওকে। নার্সিংহোমে হাতেকলমে কাজ শিখুক।

সুরমা বোঝাতে পারছিলেন না কেন তাঁর এত উদ্বেগ। সময় যে কমে আসছে। বকু যদি এসে পড়ে? তখন অতসী কি করবে?

রেবতী একলক্ষ্যে অর্জুনের মত অতসীকে স্বাবলম্বী করতে চাইছে। অতসীকে দাঁড় করাতে হবে। সে উদ্বেগ তো সরমারও।

প্রদীপ্ত বলল, বড় চিন্তা হচ্ছে?

—হ্যাঁ। ওকে তো খুব তাড়াতাড়ি পায়ে দাঁড়াতে হবে!

—ঠিক আছে, ঠিক আছে।

অসীমা বলেছিলেন, তোর ভরসাতেই রেবতী ওকে রেখে গেছে।

—জানি। আমি ব্যবস্থা করছি। কেষ্টনগরের কাছে একটা মিশন হাসপাতালে প্রাকটিকাল নার্সিং শিখুক। পড়বে, হাতে—কলমে কাজ করবে। তিন বছর শিখুক, আমার নার্সিংহোমে নিয়ে নেব। ওখানে ওরা খুব কড়া নজরে রাখে মেয়েদের। কাজও শেখায়। একটি মেয়েও বসে নেই আজ। আর এখানে তো…. অতসী ক্রমে হেড নার্সই হয়ে যাবে।

—খুব ভাল হবে!

—কেষ্টনগরে আমি জানিয়ে দেব। কলকাতায় মিশনের হেডমাস্টার। কলকাতার মিশন তো খুব চেনা আমার। কিন্তু ওকে পৌঁছে দেবে কে?

সরমা বললেন, আমি নিয়ে যাব।

অতসীর ছোট ট্রাঙ্ক গুছিয়ে দিলেন। ওর মা যে টাকা দিত তার অর্ধেক তো জমাতেন। টাকা দিলেন। বললেন, খিদে পায়, কিনে খাবি। সবাই মেয়ে, কোন অসুবিধে হবে না।

—আপনে ভাল থাকবেন কিন্তু….

—থাকব।

—ছুটি পাইলেই চইলা আসুম।

—সে তো আসবিই। শোন, চলেই তো যাবি! মার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি চল। তখনি কিন্তু যেতে পারেননি! যাবার সময় হল দু’বছর বাদে।

—চলেন। সে অহন বাড়িতে আইছে। কুলডাঙায়।

অতসী বড় হয়ে গেছে। রেবতীর কথামতো আজও ওর সাজগোজে মন নেই। সুঠাম স্বাস্থ্য, অনেক তৈলাক্ত চুলে যান টান বেণী। জামার হাতা প্রায় কনুই অবধি, ঝুলও লম্বা। পেট বা পিঠ দেখা যায় না। হাসপাতালে তো সাদা থান, সাদা জামা, কোমরে সাদা বেলট মাথায় সাদা ক্যাপ পরে। নিজের সম্পর্কে খুব সচেতন। ওর সঙ্গে ঠাট্টা মশকরা সম্ভব নয়।

সরমা বলেছিলেন, হাত, কান, সব ন্যাড়া করে রাখিস! আমার কাছে এলে তো পরতে পারিস।

—ইচ্ছাই চইলা গিছে মাসিমা।

—একটা টিপ পরলে কী সুন্দর দেখায়?

—পুরুষ পিছে লাগবে। আপনাগো সময় চইলা গিছে। অহন মাইয়ালোকের… হাসপাতালে কত কি দেখি মাসিমা! আপনে ভাবতে পারবেন না। শুধু পয়সায় লিগ্যা স্বামী তার পরিবারে বাঘের মুখে ঠেইলা পাঠায়! একটা মাইয়ার ইজ্জত লয় তিনজন! মাইয়ারে মায়েবাপেও খেদায়। হাসপাতালে আনছিল তারে, বাঁইচা উঠল, বিষ খাইছিল। শুধু কান্দে আর কয়, বাঁচাইলেন ক্যান? আমি যামু কোথা?

সরমা নিশ্বাস ফেলেন।

—মায়ে ঠিক কামই করছিল।

—তুই শুনেছিস?

—হ, মায়েই কইছে।

—তোর মার মতো হয় ক’জন?

—মাইয়ারা ছুরি ছোরা ধরতে শিখলে কিছু বাচতে পারত।

—তুই যেখানে আছিস, সে জায়গা তো ভাল?

—খুব ভাল।

—পরে দেখিস, বিয়েও ভাল হবে তোর।

—কে জানে! আজকাল বিয়ের আগে টাকা হাঁকে, টাকা নাই ত বিয়া নাই।

—যাক গে, সে সব পরের কথা।

—হ মাসিমা। নিজের পায়ে দাড়াই, কর্তব্য তো কিছুই করি নাই। মায়ের কিছু করতে হইব না…. সে আমি জাইনা রাখছি।

—এ কথা বললি কেন?

—তার দেহে আছেই বা কী! মরলেও সে ওই গুরুপাড়াতেই মরব। সেখানে শ্মশানে জায়গা কিন্যা থুছে।

—জানি। ও সব ভেবো না মা। তুমি পায়ে দাঁড়িয়েছো, কারো ভরসা করো না, এটা জানলেই মা অনেক শান্তি পাবে। একদিকে তাকিয়ে আছে কতকাল!

—আপনে আমার কাছে মায়ের থিক্যা বেশি ছারা কম নয়। আপনারে কাছে রাখুম, স্যাবা করুম, তা হইলে বাচি। আর কিছু চাই না… ন্যান, দারাইলেন ক্যান?

—ফল কিনে নিই… তোর মা তো দোকানের মিষ্টি খাবে না।

—ফল বা কী খায়! একেক বছর একেক ফল গুরুর চরণে দেয়। দ্যাখেন, ভাতও দিয়া থুছে কিনা! আমি তো কই। অন্নজলটাও দিয়া দাও!

বাসে ব্রিজ পেরোলেন, ওপারে নেমে রিকশা নেন।

অতসী বলে, নদী পারাইতাম কবে, ভুইলা গিছি। আগে তো আছিল নৌকা।

—কতটা দূর?

—ধরেন এক কিলোমিটার। আগে আছিল তিন মাইল পথ! হাইটা আইতে হইত। অহন পথরে, ঘাটরে, দোকান, বাজার!

প্যাডলার বলল, কুলডাঙায় যাইবেন কুনবারি?

—নরসিংহ পারা।

—অহন এহানেও জমির দাম বাড়ত্যাছে।

—জানি, চলেন।

সরমা আগে বোঝেননি কুলডাঙা কত বড় জায়গা। পাড়ার পর পাড়া, দোকানপাটও আছে। বেশ বড় একটা মাঠ। কোন মন্দিরের চূড়া চোখে পড়ে। অতসী অস্ফুটে বলে, এত মানুষজন আছিল না। রেবতীর বাড়ি দেখে উনি অবাক হয়ে যান। টিনের চালের পাকা বাড়ি, পাঁচিল ঘেরা।

—বাড়ির সামনে ওই যে টিউব কল, আর মাথায় পাকা ছাওনি দেখেন, মা তার জ্যাঠার নামে দান করছে। যত ঘরবাড়ি, সকল জমি মা’গো আছিল। পাঁচ জাত বসত করাইছিল মায়ের জ্যাঠা! তাতেই নরসিংপারা নাম হইছে। শুনি পঞ্চায়েত থিক্যা নাম দিবে নরসিংহপুর।

—এত গাছগাছালি!

—চলেন, দ্যাখেন।

—জোরে জোরে পাঁচিলের দরজায় ঘা দেয় অতসী।

… দরজা খোলো মা, কারে লইয়া আসছি দ্যাখো।

রেবতী আতিপাতি দরজা খোলে। বলে, এমুন খবরবার্তা না দিয়া… এ কী? সপন তো দেখি না। সরমা দিদি আইতে পারলা?

—মা কি দরজায় কথা কইয়া বিদায় দিবা?

—ল’ অতসী, বরো মুখ হইছে তোর। আসো দিদি, আসো! গোপাইলা গেল কই? আসো দিদি, ঘরে আসো।

দরজার পর অনেকটা জমিতে ফুলবাগান। জবার গাছই কতগুলো। কলাঝাড় বেশ ঘন। অপরাজিতা লতিয়ে উঠেছে পেয়ারা গাছে।

চওড়া বারান্দা, তারপর ঘর। চৌকি, আলমারি, টেবিল, দুটো চেয়ার।

—দারাও, জল আইনা দেই। হাতমুখ ধোও।

—না, মাসিমারে আমি কলপারে লইয়া যাই। বারি দেখাই।

ঘরের পর অন্দরেও বারান্দা। বারান্দার কোলে আরেকটি ঘর। শেকল তোলা।

—মায়ে ওই ঘরে থাকে।

—বড় ঘরে কে থাকে?

—এই গোপাইলা। সুবল, গোপাল, অদের বাপের লগে মায়ের জমি চাষ করে। ডাক্তার মাসির বাপ, বুড়া দাদুর বেবস্থাই চলত্যাছে। সুবল বিয়া করছে, অহন গোপাল তার ভাগ্না নিয়া ওই ঘরে থাকে। ভাগ্না পড়তেয়াছে, ওই টেবুলে পড়ে।

স্নানের পাকা ঘর, মেঝেতে টিউবওয়েল।

—সব ব্যবস্থা করেছে।

—হ তা করছে। মাসিগো বারি যাইত, থাকত, চালচলনে অন্যরকম চিরকাল। গায়ে জামা, পরনে সায়া পরত, অহনও পরে। দারান, গামছা আনি। আমার তো সবই আছে এখানে। আসাই হয় না, এই যা।

হাত মুখ ধুয়ে ঘরে আসেন ওঁরা। রেবতী বলে, রাতে তো থাকবা না দিদি?

—কেমন করে থাকব বাড়ি ফেলে?

—কও ক্যান, সেই টানেই তো বার বার আসি অহন। টান গিয়াও যায় না। অতসীর হাতে সর্ব—সমর্পণ কইরা ছুটি নিমু।

—আমি এহানে থাকুম না।

—বারি কী করবি?

—তোমার নামে ইসকুল দিমু মাইয়াগো।

—গোপাইলা আইছে, ডাক দেহি?

—থাক মা, বকাবকি কইরা কাম নাই। অদের ভরসার বাস।

—ক্যান বকুম না? হাতি খন্দেও পরে নাই, বানরের লাথ খাইব ক্যান?

রেবতী চোখ বুজে নিজেকে স্থির করে ও সম্পূর্ণ শান্ত গলায় বলে, অরে এই টাকাটা দে। মন্টুর দোকান হইতে কাচা সন্দেশ আনব।

—এত টাকার সন্দেশ কেন রেবতী?

—তোমরা খাইবা, লইয়া যাইবা। গছের ফল ছারা ত দিতেও পারুম না কিছু।

অতসী বলে, মায়ের তিনটা গাই আছিল।

—হঃ করছিলাম সব। জিদের বশে করছিলাম। অহন কত বছর হয়, নাইরকেল বাগান বেচলাম, গাই গরু বেচলাম। বারি বাসের যুগ্য কইয়া নিলাম। হকলই অতসীর। অতসীর আঠারো হইছে, অরে নিয়া হকল ওর নামে কইরা দিমু।

গোপাল নামে একটি আঠার—উনিশ বছরের ছেলে মিষ্টির বাক্স এনে অতসীকে দেয়। রেবতী বলে, দেখ গোপাইল্যা! আমার দিদি হয়।

—অতসী দিদি কইছে সে কথা, পিসি।

—ল, মাইন্য দে। এমন মাইনষের পায়ের ধূলাও আশীর্বাদ। অরে আশীর্বাদ করো দিদি! গোপাইল্যা ছাওয়াল ভাল। অদের হাতেই সব। যত্ন কইরা রাখে। এট্টা বকনা দিছি, অর্ধেক ধান দেই। ডাল কলাই যা করে অরাই নেয়। ঘর তুইলা দিছিলাম, তা তার বাপের চেষ্টায় রক্ষা পাইছে। তিন বিঘা জমি লিখ্যা দিলাম, অর দাদা বিয়া বসল। শউরের কুমন্ত্রণায় বাপরে দিয়া সেই জমি বেচাইল। তিন বিঘা পনেরো হাজার। শোনছে কেউ? অহন বিশ পচিশ হাজার বিঘার দর? ভাবলে…

—মা। যা দিয়া দিছ, তা লইয়া ভাইব না। তয় মায়ের দুঃখ গোপাইল্যা। টাকা দিয়া তরা কাম করলি না কুনো। হকলটি রেডিও, টেপরেকর্ডার, খাওনদাওন আর সুবইলার সাইকেল কিন্যা উরাইয়া দিলি।

—দাদার শউর হাওলাত নিল।

—হ হ, নিধিরামের ভাই বলরামের হাওলাৎ! সে টাকা জলে গিছে। যা গোপাইল্যা, কামে যা!

গোপাল চলে যায়। খুবই জোয়ান, বেঁটেখাটো, পরনে জয় বাংলার প্যান্ট ও গেঞ্জি। তবে মুখ চোখের ভাব সরল, বোকা বোকা।

রেবতী নিঃশ্বাস ফেলে। বলে, অগো তরে আমিও কম করি না। অদের ভরসাতেই সব ছাইড়া রাখি। তর, এহানে হকলই বেচতে অইব। বলরাম আর কৎজন অহনে জমি কও, মাইয়া কও, গরু কও, হকল বেচনের দালালি করে। ভাইগ্য! যে নিধিরাম পাকা গরু চোর, জালিয়াতির আসামি, সেই অহনে পঞ্চায়েত সদস্য! অরা অহনে নানা কালা কারবারে লামছে। যাউক গা! আমি চোখ বুজলে অতসীরে আসতেও হইব না। ভুজঙ্গ উকিল টাউনে বইসাই বেইচা দিব।

—ইস! তোমার নামে ইস্কুল দিব।

—পারবি না। জবরদখল কইরা বইসা গেলে উঠাইতে পারবি না। রতনবাবুদের কাছারিবাড়ি, ময়রাজানে আমবাগান, হকলই জবরদখল হইয়া গেল না? অহন জমির ফাটকা চলত্যাছে। কাচা টাকার লোভে চাষি জমি বেইচা হাহাকার করত্যাছে। সুবইলার বাপ যা করল!

অতসী মুচকি হেসে বলল, তার নাম কি গো মা? সে না ডাকসম্বন্ধে ভাই?

—দূর মুখপুরি। সে নাম আমি বলতে পারি?

—পতিতপাবন! আমার বাবার নাম, জানেন মাসি? তাতেই মা…..

সরমা ঈষৎ হেসে বললেন, মিলনের বাবার নাম আমি তো দরকারে বলি। অবশ্য তেমন দরকার হলে….

—মাসিমা! জিগান না মারে বাবা কি বইলা ডাকত!

রেবতী হেসে ফেলে।

—দুজনাই পোলাপান। আমি ক্ষীরমুরকি খাইতে বরো ভালবাসতাম। তা হে জনা আমারে অ আমার মুরকি গো! বইলা ক্ষ্যাপাইছে।

নিশ্বাস ফেলে রেবতী—কুন—অ কষ্ট দেয় নাই। আমারে কত যত্ন করছে। অতসী হইতে কত আনন্দ করছে। ভাল লোকটাই থাকল না গো দিদি!

অতসী বলে, থাক ও সব কথা, মা!

—তর নামে বেবাগটি রাইখা যাই। বিয়ার লাইগা শিক্ষিৎ পোলা আইসা লাইন দিব। চাকুইরা মাইয়া, এত সম্পত্তি!

—বিয়ার আগে কিছু খাইতে দিবা কি না ভাব।

—যা, আমার চৈকির নিচে পিফা আছে, কলা আছে, সব গাছের! লইয়া আয় কাইটা। মাসিরে দে, নিজেও খা।

—তোমার বাড়ি বড় সুন্দর রেবতী।

—ক’দিন থাকলে গুরুপাড়া লইয়া যাইতাম।

—সেখানে শ্মশানে জমি কিনেছো?

—হ দিদি! জমি কিনছি। রান্নাশাল, পাকা দালান বারি বানাইয়া দিছি। মাইয়ারা নিত্য ভোগ রান্ধে, ঘরখান বরোসরো হইলে তাগো আরাম। আমি ছারা কারেও এমুন বারি আইসা থাকতে দেয় তারা? আমি কই, মাইয়ার সম্পত্তি, দেখভালন আমার। তা এটুক আমি করব। কয় না কিছু। আমারে মাইন্য দেয়।

অতসী পাথরের থালায় পেঁপে, কলা, সন্দেশ নিয়ে আসে। কাঁসার রেকাবি এগিয়ে ধরে, দেন আমাদের তুইলা দেন।

রেবতী বলে, আল্লাইদা মাইয়া!

—মাসিমা না থাকলে অতসী পাইতা?

—ল’, থাল হাতে ও কথা বলতে নাই।

—রেবতী তুমি!

—দিনে একপাকে হবিষ্য। রাতে খই, কলা, দুধ।

—সে কী মা? রাতে না তুমি বাতাস খাইতা? ছি ছি, পাপ হইব।

—না লো! অহন খাই। মহারাজ খুব বকছে। বলছে দেহ শুকাইয়া লাভ নাই কুনো।

—বাঁচলাম।

—চশমাও লইছি। পুথি পড়তে চক্ষে দেই।

ওঁদের ফেরার সময় হয়। রেবতী বলে, আজ মিষ্টিটা লইয়া যা। টানতে কষ্ট, নয় ডাটা, লঙ্কা, লাউ, কলা দিতাম।

—দাও না, রিকশাতেই তো যামু।

—দেই তবে।

মস্ত এক থলিতে সব নিয়ে আসে রেবতী। বলে, দিদির বাজার করতে লাগব না দু’দিন।

—মা! চিঠি যেমুন দেও দিও।

—তুইও দিস।

ছিপছিপে, শুভ্রবসনা রেবতী দাঁড়িয়ে থাকে দরজায়, যতক্ষণ না রিকশা মোড় নেয়।

অতসী বলে, সত্যই সুবইলা বরো বেইমানি করল। মায়ে অগো ঘর, বৎসরের ধান, কলাই, বেবাগ দেয়, আজও দিত্যাছে। অর শ্বশুরের মতলব, সে বারি আর বাগান লেখাইয়া লও। অতসী পাইব ক্যান?

—বেচেই দিক। শত্রুতা করে সম্পত্তি রাখা যায় না।

অতসী ঘাড় নাড়ল। বলল, আমিও মায়ের মাইয়া। সে যহন এত কষ্ট করছে, আমি তার নাম জাগাইয়া যামু। অরা কয়, মাইয়ার বিয়া হইব না। সহ্য হয় না মাসিমা, এমুন ব্যবহার… মায়ে বইলা অগো রাখছে। আমি হইলে বেবাগ তারাইতাম। ওই সুবইলার অসুখ কম করছে মা?

ওই একটা দিন বড় ভাল কেটেছিল সরমার। ভগবান দিয়েছিল একটি সুন্দর, সমুজ্জ্বল শান্তির দিন! ভগবান আছেন? আজ সরমা ভেবে পান না কিছু।

ওই দিনটি তাঁর শেষ পাওনা ছিল এত দীর্ঘ পথ হাঁটার পর?

তাই হবে, তাই হবে, নইলে অতসী ফিরে যাবে দু’দিন বাদে। সরমা রান্নাবান্না সেরে ওর সঙ্গে গল্প করছেন, পার্থ কেন অসময়ে এসে দাঁড়াল?

কেন বলল, বকু ছাড়া পেয়ে গেছে শুনলাম।

ঘড়ির কাঁটা থেমে গিয়েছিল সরমার হৃৎপিণ্ডও বুঝি এক নিমেষ থমকে দাঁড়িয়েছিল, মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল, গলা শুকনো।

—ছাড়া পেয়ে গেল? কিন্তু…

—অবনীবাবু যোগাযোগ রেখেছিল… কলকাতায় ছিল বকু… কলকাতাতেই কেসটা রি—ওপন করায়…. এসব আইনের মারপ্যাঁচ বুঝি না…. এখন শুনছি, ওর শাস্তিটাই বেআইনী হয়েছে। যথেষ্ট প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে ছিল না, হেন তেন…

—কিন্তু…. কেস তো পুলিশ করেছিল…

—আপিল করিয়ে টরিয়ে …আমি এসব বুঝিও না তেমন। আপনাকে বলে গেলাম।

—সে…. এখানে আসছে?

—তাও জানি না। আচ্ছা চলি। মাঝে মাঝে আপনার খবর নিতাম, প্রসূতিসদনে খবর নেব। ও এলে… ওখানে আসা….

সরমার চোখে অন্ধকার নেমেছিল। আবার, আবার তাঁর কারাবাস শুরু হবে?

—টাউনে সে সময়ে ওর ওপর সবাই তো…

—কয়েকটা বছর গড়িয়ে গেছে। টাউনে সে সময়ে যারা ছিল, সবাই নেই। আর রাজনীতিও তো দিন দিন নোংরা থেকে নোংরা হচ্ছে। লুম্পেন, গুণ্ডা ঢুকে পড়েছে সর্বত্র। বর্ডার জেলা, নানা রকম ক্রাইম হচ্ছে এখন…. সবই বদলে গেছে। জানি না… বুঝি না… চলি তবে। অবনীবাবুকে খুব উল্লসিত দেখলাম…. মনে হ’ল আপনিই একা জানেন না। চলি।

সে কথাও সত্যি। মানুষ, মূল্যবোধ এক রকম থাকছে না। ডাকাতি, ধর্ষণ, কোন কেসে আসামী ধরা পড়ে না। রাজনীতিক আর সমাজবিরোধী আজ পরস্পরের সঙ্গে গাঁঠছড়ায় বাঁধা।

সাধারণ মানুষের জীবনও নিয়ন্ত্রণ করে সমাজবিরোধীরাই।

হতাশ মানুষ এখন দেবদৈবে ভরসা খোঁজে। কিন্তু দেবদৈবের বা কি ক্ষমতা আছে?

গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে চেয়েছিলেন সুধন্য। আজ শহরের কালো ছায়া গ্রামকেও গ্রাস করেছে। সরমা, রেবতী, এদের মত মানুষেরা এ সমাজে একেবারে অপ্রয়োজনীয়।

সরমা দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে পড়েছিলেন। অতসী সব শুনছিল এতক্ষণ। ও এগিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

তারপর বলল, চলেন, খাইয়া লই।

—অতসী!

—কানবেন না, কানবেন না। ইশশ …. নিজের পোলা ঘরে আইবে, মারে কানতে হয়! কানবেন না, অমঙ্গল হয় মাসিমা….

সরমা চোখ মোছেন। কান্নাভেজা রুদ্ধপ্রায় গলায় বলেন, সবই আমার অদৃষ্ট!

—নেন, ওঠেন।

—চল, খাবি চল?

—খাইয়া চইলা যাই মাসিমা? বাস পামু এখন।

—না মা, তুমি যাবে কেন? কাল যেও ধীরে আস্তে। তোমার ক্ষতি করবে কে?

—মায়ে বলছিল….

—আমার মনে আছে। কাল যেও।

—আপনারে রাইখা যাইতে আমার….

—কাঁদে না অতসী, কাঁদে না। কাঁদলে কাঁদার শেষ নেই মা। কেঁদে জুড়োব তেমন কপাল করে আমিও আসিনি, তুইও আসিসনি।

—আমার উপর দিয়া ত কিছুই যায় নাই। মা জানলাম না, আপনে বাচাইয়া রাখছেন এতকাল…. আপনেরে ভগবান কেন এমুন শাস্তি দিত্যাছে? আপনের কথাই ভাবলে…

সেদিন রাতে অতসী হঠাৎ বলেছিল মাসিমা! শাস্তি ত দাদাও কম পায় নাই… দ্যাখেন হয়তো দাদায় সুবুদ্ধি হইয়া ঘরে আসব। আপনের দুশ্চিন্তা থাকব না আর! এক পোলা এত ভাল..

সরমা নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।

—ঘুমো অতসী!

অতসী তাঁর মনের কথাই বলেছে। যে ছেলে ভাল, সে তো টাকা পাঠিয়েই কর্তব্য সারে। আসতেই পারে না। আর বকু? এত বছর ধরে তো এক প্রার্থনাই জানিয়ে যান সরমা, সে যেন ভাল হয়ে যায়। যেখানে থাকুক, মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচে। নরকের প্রেতের জীবন যেন ত্যাগ করে।

এ প্রার্থনা যে করেন, তাও তো নীরবে। এ কী ভাগ্য তাঁর, এ কী নিয়তি?

দগ্ধ, জীর্ণ জীবনে অতসী একমাত্র সান্ত্বনার প্রলেপ। মনে মনে গভীর আবেগে বলেন, তোর ভাল হক অতসী, তুই ভাল থাক। তোর মায়ের স্বপ্ন পূর্ণ হক। আমিও শান্তি পাব। চোখে দেখি না দেখি—কাছে পাই বা না পাই—ভাল আছিস জেনে শান্তি পাব।

অতসী ঘুম ঘুম চোখে বলেছিল, কাপর ইস্ত্রি করতে দিছি, আইনা নিবেন।

—নেব, তুই ঘুমো।

অতসী ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সরমার গায়ে হাত রেখে। আপনের গায়ে হাত রাখলে বরো ভরসা পাই। ভয়ভীত চইলা যায় মাসীমা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *