আই. পি. সি. ৩৭৫ – ৩

তিন

সরমা এ সব কথা অসীমার কাছে শুনেছেন। অসীমা মানুষটা এমনই, যে তাঁর কাছে যে কোন বয়সের মানুষ অনায়াসে বলতে পারে মনের কথা। কতজনের যে একান্ত আপনজন অসীমা, ভাবাই যায় না। পার্থ ওঁকেই সব বলেছিল।

বকুর ন’বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে জেনে সরমা অসীমাকে বলছিলেন, হয়তো শুধরে যাবে, হয়তো বুঝবে। বুঝলে ওরই ভাল।

—দেখো!

—বাপের মৃত্যুর জন্যও তো ওই দায়ী।

—সে কি তা মনে করে?

—জানি না অসীমা। ওকে আমি চিনিই না। বিক্রম নাম রাখল বাবা, ক’বছর আগে গিয়ে পালটে এল। ‘ভদ্র বংশ! কী ঘরের ছেলে’ এ সব বলত বাবাকে বললে ওঃ মস্ত বংশ! রাজা না জমিদার ছিলে তোমরা? কত রুক্ষ কথা না বলেছে!

—একটা কথা বলব?

—বলো?

—যে সময়টা পাচ্ছো, কাজে লাগাও।

—কী করব?

মিলনের বাবার রোজগারটা চলে গেল। আপিস থেকে কী পাও দেখো? নিজে কোনও কাজ নাও। মিলনকে মানুষ করো।

—আপিসে কাজ পেলেও পেতে পেতে অনেক সময় লাগবে। আর সত্যি বলছি, ওখানে অনেক বেটাছেলের মধ্যে বসে কাজ করব, সবাই জানে কার মা! ভাবতে গেলে এখন….

—সত্যবাবুকে ধরো, টাকাপয়সা আদায় করো।

—সে চেষ্টা করছি।

—কাজ…. কাজ…. আচ্ছা, বলব তোমাকে। মিলন যদি বড় হত…

—মাত্রই পনেরো। লেখাপড়ায় ভাল কিন্তু দাদার জন্যে মন ভেঙে গেছে, মুখ লুকিয়ে বেড়ায়। ওর ক্লাসের ছেলেরা আগে কত এসেছে, এখন কতদিন এ বাড়ি আসে না।

ওকে পাস করার পর সরিয়ে দাও।

—কোথায়? কোনও জায়গা আছে?

—বহরমপুরে পড়াও হস্টেলে রেখে।

—কী করে?

—পার্থ দেখবে, চেষ্টা করবে, সাহায্য করবে। ও তোমার সামনে আসতে…

—কেন সংকোচ বোধ করে? ও না বললেও আসতই খবর। যখনই শুনতেন, তখনই ওঁর ও অবস্থা হত।

সরমারই কি হয়নি? কিন্তু নিজের যন্ত্রণা চাপতে হয়েছিল স্বামীকে দেখে।

—পার্থ ভাবে ও দায়ী।

—ভাবতে নিষেধ কোরো। আমি অন্তর থেকে বলছি সে দায়ী নয়। সেই তোমাকে এনে দেয় অমন বিপদে, মিলনের বাবাকে হাসপাতাল থেকে…. আমার উচিত তাকে ধন্যবাদ দেওয়া, যাব কোন মুখে? টাউনে তেমন বেরোতাম না, যেটুকু যেতাম সে পথ বকু বন্ধ করে দিল।

—এটাই তো ভুল করছো সরমা! তোমাদের কেউ দোষী মনে করে না। তুমি মাথা উঁচু করে বেরোতে পারো যখন দরকার।

—অমন ছেলের জন্ম দেওয়া পাপ নয়?

—রোজ কত শিশু জন্মাচ্ছে। সে বড় হয়ে কেমন দাঁড়াবে, কে বলতে পারে? সন্তানের পরিণাম বিষয়ে বাপ—মার হাত থাকে অনেক সময়ে। তবে তোমাদের বিষয়ে সে কথা কেউ মনে করে না। আজ না হোক, কাল তোমাকে বেরোতেই হবে। রেবতী তো বসে থাকবে না।

—রেবতী চলে যাবে?

—রেবতীর মেয়েকে নিয়ে ওর যত চিন্তা। আমার কাছে আছে অন্নদাসুন্দরী স্কুলে ভর্তিও করেছি। তবু মেয়ের কাছে থাকে ক’দিন, দেশে যায় জমিজমা দেখতে। আর কী করে জানো?

—কী করে?

—এখন ও ধরে নিয়েছে, ইহকালের নয়, পরকালের কথা ভাববে। গুরুপাড়া মঠে দীক্ষা নেবে, সেখানে থেকে মঠের কাজকর্ম করবে।

ওর মেয়ে?

—মেয়ের জন্যেও মাসে একশো টাকা দেয়, আমাকেও নিতে হয়। ওর আত্মসম্মান আছে, আর বললাম তো ওর অর্থাভাব নেই। মেয়েকে ও লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবার মত স্বাবলম্বী করতে চায়; একই সঙ্গে, মেয়ের মায়ায় জড়াতে চায় না। রেবতী একটা আশ্চর্য মেয়ে। লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেলে ও দেখিয়ে দিত।

সরমার মনে হল। সবচেয়ে আশ্চর্য ওর স্বাধীন থাকার চেষ্টা। রেবতীর মত মন ক’জনের থাকে?

সেদিন কি সরমা জানতেন যে অতসী আসবে তার কাছে। তাঁর জীবন সুধায় ভরে দেবে?

অসীমার কথা শুনেছিলেন।

বুঝেছিলেন এই ন’বছর সময়কে কাজে লাগাতে হবে। নইলে ভেসে যাবেন।

অসীমাকে বলেছিলেন, দেখি কী করতে পারি?

রেবতী বলেছিল, আমি আইতে যাইতে খবর নিমু দিদি, কথা দিত্যাছি। অহন আমারে ছাইরা দেন। এট্টা কথা শোনেন।

—বলো রেবতী।

—আপনের বারির পিছনের জমি বেইচা দেন, টাকা লইয়া সামনের পাচিলের গা দিয়া দোকানঘর তুইলা ভারা বসান। মাইনষের সাহায্যও পাইবেন, ভারা বা কুন না পঞ্চাশ—পচাত্তর পাইবেন?

—এখানে দোকান করবে কে?

—কয়েন কী, আপনাগো পারায় এট্টা মুদি দোকান নাই, এট্টা পানের দোকান নাই। ছুটতে হয় রাস্তার মোরে, দোকান দিলে চলব। চলেন, আজ আমার লগে বাজার চলেন।

—আমি?

—কাল নয় পরশু থনে যাইতে অইব না? নিজে করবেন না পোলার পরাল্যাখা নষ্ট করবেন? চলেন! আমিও জেল থিক্যা বারাইয়া পরথম যহন হাটে বারাই আমারও ডর ধরছিল। ঝাইরা ফালাই। আর ডরাই নাই। পাপ অ করি নাই, ডর অ করি নাই। আপনি বা কী পাপ করছেন? যে করছে, হ্যায় শাস্তি পাইছে।

সরমা বুঝেছিলেন, রেবতী সত্যি কথাই বলল। বেরোবেন না। দোকানবাজার করবেন না। মুখ লুকিয়ে কতদিন থাকবেন? খুব খুব কৃতজ্ঞ হয়েছিল মন।

—হ্যাঁ রেবতী, চলো।

—মন দিয়া পাকসাক কইরেন। মিলনের অহন বারের বয়স। মাছও কিনেন, নয় অরে পাক কইরা দিবেন। আপনার রামের মারেও কইছি। অহন হে কাম করব।

—রেবতী। বয়সে ছোট না হলে প্রণাম করতাম।

—থোঁন ফালাইয়া ও কথা। কে কারে দ্যাহে দিদি! নিজে নিজেরে দ্যাহেন। আমি আবাইগা, আপনে তো জলে ভাসতেয়াছেন! সাতরাইয়া ডাঙায় ওঠেন। মিলনের বাপ যা থুইয়া গেলেন, রক্ষা করেন! চলেন।

রেবতী নিয়ে গিয়েছিল।

—নেন, দরদাম দেখেন, বাইছা নিবেন। এহানে আলু নিয়েন দিদি! চিনা মানুষ। চলেন, লাউ কুমড়া বাইগন নিবেন কার থনে, দেখাই।

—উনি বাজার করতেন।

—নাই তিনি। পাপ জগৎ ছাইরা বৈকুণ্ঠে গিছেন। আপনের প্যাটের খিদা তো লইয়া যান নাই! দ্যাখেন, এহানে চিরা—গুর—চিনি—বাতসা নিয়েন। দাদা গো! দিদিরে দেইখা দিও সওদা।

এভাবেই পথে বেরোবার দীক্ষা হয়।

ক’দিন বাদে সরমা নিজেই গেলেন বাজারে। মিলনের জন্যে ডিম কিনছেন, কে বলল, ও ডিম নেবেন না।

পার্থ!

—ওঁকে টাটকা ডিম দাও, আমার মাসিমা।

—হ্যাঁ দাদা। দিচ্ছি।

—চলুন, থলিটা আমাকে দিন। পার্থ সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে চলে। হাতলে থলি ঝোলায়।

—তোমার বাজার?

—সে তো শুধু কাঁচালঙ্কা। পৌঁছে দিই আপনাকে, কিনে নেব। বাজারে যত কাঁচালঙ্কা আসে, আমার মা তার অর্ধেক খায়। কী ঝাল খেতে পারে।

—তোমার মা তো স্কুল করেছেন। গানের স্কুল।

—বাবা মা দু’জনেই।

—বেশ নাম করেছে স্কুলটা।

—হ্যাঁ, ছেলে মেয়ে তো আসে। মিলন বাজারে আসে না বুঝি?

—কখন আসবে? সকালে কোচিং ক্লাসে যায়, এসেই স্কুলে যায়। বিকেলে সত্যবাবুর ছেলের সময় হলে অঙ্কটা দেখিয়ে নেয়… শনি—রবি বইয়ে মুখ গুঁজে….

—খেলতে যায় না?

—এখন আর….

—আজ আমার অফ ডে, বিকেলে আসব। ওকে থাকতে বলবেন।

—বলব।

—নিন। বাড়ি এসে গেছে।

সরমা ওর দিকে তাকান। বলেন, পার্থ! তুমি একটু খবর নিও, এসো। কেমন?

—নিশ্চয় আসব। আপনাকে মাসীমা বললাম…… অসীমাদি’কে দিদি বলি…

—তোমার যা খুশি, ডেকো।

—আপনিও যে কোন দরকারে মিলনকে পাঠাবেন আমার কাছে। বাস স্ট্যান্ডের সামনেই আমাদের ক্লাব, ‘সংস্কৃতি চক্র।’

—নিশ্চয় পাঠাব।

—আপিসে গিয়েছিলেন?

—সত্যবাবুরাই দেখছেন।

—যান তো আমি বুধবার নিয়ে যেতে পারি, অফ—ডে থাকে।

—বলব পার্থ। এসো … চা খাবে?

—বিকেলে খাব।

পার্থ চলে যায়। সরমাকে খুব হালকা করে রেখে যায়।

বিকেলে পার্থ এসেছিল। মিলনকে বলেছিল, তুমি খেলতে যাবে। ঘরে বসে থাকবে কেন?

—ছেলেরা ….. ছেলেরা …..

—তোমার সঙ্গে খেলে না?

—অনেক টিটকারি দেয়….

—দিক। তবুও যাবে। বলবে, আমি তো কিছু করিনি। না গেলে তোমারই ক্ষতি, বুঝেছো? এখন বাড়িতে পুরুষ বলতে তুমি। বড় হয়ে যাও, মিলন।

—যাব….. পার্থদা!

খুব বুঝিয়েছিল পার্থ। দাদা যা করেছে সেটা ঘৃণ্য অপরাধ। তুমি তো অপরাধ করনি। এ ভাবে চোরের মত পালিয়ে বেড়াবে না। পুরুষ মানুষ, শক্ত হও। তোমার মাকে দেখ। জীবন বড় কঠিন মিলন। পালিয়ে বাঁচা যায় না।

—স্কুলে কোন সাবজেক্টে সাহায্য দরকার? শুনলাম অঙ্ক দেখাতে যাও?

—মোটামুটি পঁচাত্তর থেকে আশি পাই সব সাবজেক্টে। অঙ্কটা আরও ভাল হলে নম্বর উঠবে।

—আমি অত পেতাম না। মাধ্যমিকটা পাস করো। তারপর দেখব বহরমপুর হস্টেলে থাকবে, কে এন কলেজে পড়বে, ব্যবস্থা করে দেব।

—সে যে অনেক খরচ….

—হয়ে যাবে। তুমি দাঁড়ালে তোমার মা’র কত সাহায্য হবে ভাবো তো?

—হ্যাঁ….

—আর মিলন….

—কী?

—সেদিন … আমার মাথার ঠিক ছিল না ভাই। আমি এখনও নিজেকে…

পার্থ মাথা নিচু করে।

মিলন ফিসফিস করে বলে, মা বলেছেন… আপনার… কোন দোষ হয়নি… ও খবর জানলেই … বাবা…।

মিলন কেঁদে ফেলে।

—আমার বাবা মা খুব ভাল পার্থদা! খুব ভাল…

—নিশ্চয়। এ কথা টাউনসুদ্ধ সবাই জানে। সবাই বলে। যাকগে, আজ চা খেতে পারি।

সরমা চা নিয়ে আসেন, দুটি বিস্কুট। মিলন চোখ মুছে পার্থর দিকে তাকায়।

—আমি….. স্টার পেলে স্কলারশিপ পাব না?

—নিশ্চয় পাবে। পাঁচ বছর বাদে দেখবে পড়াশোনা খতম করে ফেলেছো। সাত বছরে এম এ।

মিলন আস্তে বলে, এম এস সি।

আর ভাবেননি সরমা।

এটাও খুব আশ্চর্য, যে মিলন পালিয়ে পালিয়েই বাঁচল, আজও তাই বাঁচছে।

মাধ্যমিক পাস করে সেই যে গেল বহরমপুরে পড়তে, কোনদিন ভাবল না, বাড়িটা মা রক্ষা করবে কি করে। বাজারহাট করতে তো বলতেন না সরমা।

কোনদিন বললে বলত, ওই তো। আলু আর ডাল আছে। চালিয়ে নাও না।

সমস্যা দেখলেই ও সরে যেত কারো আড়ালে। একদা সরমা, কিছুদিন রেবতী, কিছুকাল পার্থ। আবার সরমা!

যে পার্থ ওর এত উপকার করেছিল, তার সঙ্গে দেখাও করে না। তারপরে তো লিলিকে বিয়ে করল।

লিলি বলে, তাই মিলন রাতে আর সকালে দু’বার দাঁত মাজে।

লিলি বলে, তাই মিলন ঠোঁট টিপে ভাত খেতে শিখেছে।

মিলন হল একেবারে প্যাসিভ মানুষ। অন্যে চালালে তবে ও চলতে পারে।

অথচ ”মা” বলে মিলনই আসে। বাড়িতে তারও অংশ আছে, সেটা ও ভোলে না।

মিলনকে যদি বলা যায়, তুমি একটি স্বার্থপর মানুষ,—মিলন অবাকও হবে, আঘাতও পাবে।

বেচারি মিলন! তাঁর ভালমানুষ, ব্যক্তিত্বহীন ছেলে! আজ রাতে কী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে!

ও জানেও না অতসীর গলা সরমার ঘুম কেড়ে নিয়ে গেছে। সরমা শুধু ভাবছেন কখন রাত কাটবে, কখন ছুটে বেরোবেন!

.

আপিস থেকে তেরো হাজার টাকা পান সরমা। পিছনের দু’কাঠা বেচেন চৌদ্দ হাজারে।

অসীমার বাবাই ক্রেতা জোগাড় করে দেন। বলেন, টাকা ফিকস ডিপোজিটে রাখো, সুদ পাবে। দোকান করার মধ্যে যেও না। কাটোয়া—আজিমগঞ্জ—ওদিকে খাগড়াঘাট স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে, ফারাক্কা ব্যারেজও হবে। অনন্তপুরে জায়গা—জমির দাম বাড়বে। কলেজ হচ্ছে, মেয়েদের কলেজও হবে। এতগুলো রোড জংশন টাউন, জায়গা ছেড়ো না মা! পরে বুঝবে আমার কথা কত দামি। পেনশান তো পাবে যা হোক!

—হ্যাঁ, তিনশোর কাছে।

একাশিতে মিলন স্টার পেয়ে মাধ্যমিক পাস করে। সত্যিই বহরমপুরে পড়তে চলে যায়।

আর মিলন পিছন ফিরে তাকায়নি। বি এস সি পাস করেই ও মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ নিয়ে কলকাতা চলে যায়। ওষুধ কোম্পানির কাজের সূত্রেই লিলির দাদার সঙ্গে আলাপ। তারপর মাঝারি ওষুধ কোম্পানি থেকে মস্ত কোম্পানিতে ঢুকল মিলন। লিলি মুখে যাই বলুক, আজ ১৯৯২ সালে মিলনের বয়স যদি ঊনত্রিশ হয়, লিলির বয়স অন্তত ছত্রিশ—সাঁইত্রিশ হবে। মিলনকে কেন কর্মরত, ইংরিজিতে তুখোড়, অমন একটি মেয়ের দাদা, মা সবাই ‘ক্যাচ’ ঠাওরালেন, তা সরমা জানেন না। লিলির সম্পর্কে কানাঘুষো যা শুনেছেন, তা কানেও নেননি। শুনে কি করতেন? মিলন যে লিলিকে বিয়ে করে ধন্য হয়ে গেছে, সেটা তো দেখতে পাচ্ছিলেন। শুধু মনে হয়েছিল, মিলনের তখনই চাকরি নেওয়ার পেছনে কারণ একটাই।

ও পালাতে চাইছিল। বকুর বা বিদেশবাবুর বা মিস্টার সরকারের বহুজনের ‘দাদা’—র ছায়া থেকে পালাতে চাইছিল।

বকুর প্রত্যাবর্তন সম্ভাবনাতেই ও ঘাবড়ে যায়।

মিলন দীর্ঘকাল মাকে দুশো টাকা পাঠিয়ে যায়। সরমা ‘না’ বলেন, ও শোনে না। একদা মা’র অনুগত ছিল, এখন লিলির অনুগত হয়ে ও সুখী হয়েছে। থাকুক, সুখে থাকুক, শান্তি পাক।

যখন আসে, কোন সমস্যায় প্রবেশ করতে চায় না। সরমাও আশা করে না।

কিন্তু মিলন মাধ্যমিক পাস করার সঙ্গে সঙ্গে সরমাও ‘প্রসূতিসদন—এ কাজ পেয়ে যান। খাতা লেখা কাজ। দুশোয় ঢুকেছিলেন, আজ তার চারশোয় থেমে আছে, তা থাকুক। তবু কাজ তো! কাজ করে তাঁর নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরে এল।

আর… মিলন যখন বহরমপুরে গেল, সরমার সময় যখন কাটে না, তখন একদিন রেবতী এসে হাজির।

—দিদি! সাহায্য চাই।

—কী করব বলো রেবতী?

—আমার মাইয়া…..অতসী!

—কী হল তার?

—হয় নাই কিছু। কিন্তু থাকে তো ডাক্তার দিদির কাছে! (বাবা ডাক্তার, ভাই ডাক্তার, তাই অসীমা ডাক্তার দিদি।) তিনি অহন যাইব গিয়া কুনখানে য্যান? দক্ষিণ ভারত! সে কুন দেশ?

—মাদ্রাজ যাচ্ছে?

—না, অনেক ঘুরব। হেই যে রাম সেতু বানছিল, হেই যে বিবেকানন্দ সাগরে ঝাপাইয়া সাগর পারাইছিল, দ্যাশে দ্যাশে ঘুরব চার মাস!

—অতসীকে আমার কাছে?

—দিদি যেমুন, ভাই বউ কই তেমুন না। দিদি কয়, রেবতী, আইয়া থাক তুই চারমাস। আমি ভাগ্না, ভাগ্না বউয়ের লগে ঘুরুম অনেক! তা কয়েন তো? এই জমিজমা সামলাই, এই মঠে দৌড়াই। মঠে অহনে আমার উপর ডিউটি অনেক! মঠের বৈকালী, আরতি, হকল দেখি! মচ্ছব লাগলে পাক সাক দেখি। মিছা কমু না, আনন্দও পাই। অহন আমি অগো বাড়ি…. সব টেবুলে খায়…. মাছ মাংসের ম্যাল্লোছ কারখানা….. আমি পারুম না।

—অতসীকে রেখে যাও।

—দিদিও তাই কইছে। মাইয়ার পরালিখায় খুব মাথা! ডাক্তার দাদা কয়, নয় ক্লাস পাস করলেই নার্সিং পরার বেবস্থা কইরা দিবে।

—পাস করে কলেজে পড়বে না?

—না দিদি! নার্স কামে টাকা ভাল। দাদার ওখানে কাম করব। আজকাল লিখিপরি চাকুইরা মাইয়া বিয়া দিতে শিক্ষিত বর জুটে গো! হকলই তো কইলাম।

—কী পড়ছে এখন?

—ছিকছে উঠব। আশ্চাজ্জ মাথা! কুনোটায় ফেল নাই।

—বয়স কত?

এগারো হইব। দ্যাশের লোকের তো একটাই কথা। বিয়া দাও, জামাই আনো। ক্যান? অহন বিয়া। তিন বছরে পোলার মা! ধান সিদ্ধ করো, ভাত রানবো, পোলা বিয়াও, অরা তো টাউনের গতিক বুঝে না। মাইয়ারা কাম করে। বিয়াও করে, ফকফকা কাপড় পইরা কামে যায়, সংসারিও দেখে, আমি তো কই খুব ভাল আছে তারা। নাও কও!

—আমি তো এখনি রাজি। তবে, ওদের বাড়ি অনেক আরাম … এখানে…

—এহানে ভাল থাকব! তয়, খরচ নিবে।

—দেবেই তুমি?

—নিশ্চয়। কাছে রাখি নাই, কিন্তু এটা জানি মনে জানে যে মা তার লিগ্যা সব করছে, পরেও করব। শুধু এট্টা কথা দিদি!

—বলো?

—তোমার হেই পোলা আইয়া পরলে মাইয়ারে তহনি সরাইবা।

—এখন তো আসবে না। ততদিনে ও নার্সিং পড়তে চলে যায় তো ভাল। না রেবতী, সে এখানে আসবে না, কিন্তু এলে অতসীকে রাখব না এখানে। আমার নিজের দায়িত্ব নেই?

—নিশ্চিন্ত করলা দিদি!

—তুমি যা করেছো…

—হকলই গুরু করায়। তিনি সুতার পাকে জগৎ ঘুরায় তো! তোমার বিপদ আমারে টাইনা ফালাইল!

—অসীমা সে সময়ে….

—তানারেও টাইনা আনছিল। আজ আমারে এহানে আনল। মঠে কী সুন্দর গায় দিদি—

 এ জগৎ রে মন! সদ্গুরুর কারখানা!

 মানুষ যত সুতায় বাঁধা

 তাঁর হাতে লাটাইখানা

 রে মন! সদ্গুরুর কারখানা!

 তীর্থে তীর্থে ঘুইরা মরো

 তাঁরে কেন না দর্শন করো

 যাবে মোহভ্রান্তি পাবে শান্তি

 তিনি ভিন্ন আর কিছু নাই

 রে মন!

 সদ্গুরুর কারখানা!

সত্যই কথা! একশৎ বৎসর আগে গুরুপাড়ায় প্রকাশ! আবার একশৎ বৎসর পরে গুরুপাড়ায় অপ্রকাশ! ম্যাল্লোছ যখন জমিদার! সেই নাম লইল, গেরুয়া পরল, জমি জিরাত, সম্পত্তি দিয়া মঠরে দাড় করাইল। দুর্গাষ্টমীতে প্রকাশ দিবসে যে মেলা লাগে!

—শুনেছি। তোমার মেয়েকে বড় করে দিয়ে তবে যেতে….

—তাঁর ইচ্ছা! সুতার টান, চইলা গেলাম!

—রোগা হয়ে গেছো!

—এক লক্ষ একবার মালা ঘুরাই, একাহারে খাই! দেহ তো তিনি দিছে। তিনি লইব দিদি!

—অতসীকে নিয়ে এসো।

অতসী এল।

এগারো বছরের মেয়ে। চোখে ধানক্ষেতের শ্যামলিমা। মুখটি রেবতীর মতো কাটা কাটা। যেন কালো পাথরের কোন দেবীর বালিকা মূর্তি। তেলে জলে চকচকে চামড়া। একরাশ চুল অনেক উঁচুতে তুলে দু’বেণী বাঁধা। পরনের ফ্রক অসীমার কল্যাণসংঘে তৈরি, স্কুল ইউনিফর্মের মতো কলার দেওয়া।

—দেখেন, মাইয়া দেখেন!

—তোমার সঙ্গে এত মিল!

—হ, মায়ের অভিশাপ হকলটি পাইছে। স্বাস্থ্য! চুলের রাশ! তবে হ্যাঁ, ঘরের কামকার্য জানে, সাজনগোজনের মন নাই। যা অতসী! মাসিমারে পরণাম কর।

অতসী গম্ভীর মুখে জুতো মোজা খুলে এগিয়ে এসে সরমা ও রেবতীকে প্রণাম করল।

সরমা ওকে কাছে টেনে নিলেন।

—আমি কে, বল তো?

—মাসিমা।

—আমার কাছে থাকবি তো?

—থাকুম।

—মায়ের জন্যে মন খারাপ করবি না? অতসী সবেগে মাথা নাড়ল।

—অর বেছনাও আনছি।

—কিসের বিছানা? ও আমার কাছে শোবে।

রেবতী বড় নিশ্চিন্ত মনে চলে গিয়েছিল। আর অতসী ওঁকে, উনি অতসীকে আঁকড়ে ধরলেন। রামের মা বলত, কুন গাছের বাকল কুন গাছে লাগল, এ যে দেখি সেই বিত্তান্ত। ক্যান বা মায়ায় জরান মা? হেই তো যাইবই। বুকে চাকু মাইরা যাইব।

সে কথাই কি সত্যি হল?

অতসীর আর্তনাদ বুকে ছুরিই তো মেরেছে। মায়াবী, মায়াবী মেয়ে।

—আপনের লগে শুমু, গায়ে যদি পা লাগে পাপ তো হইব নিঘাথ। তহন?

—কী হবে বল তো?

—ঘুমের কালে দোষ লাগে না মাসিমা।

ভোরে উঠত, চটপট বিছানা তুলে ফেলত। ছুটে চলে যেত রান্নাঘরে। চা করত, দুধ জ্বাল দিত।

—তুই কি এইসব করতে এসেছিস?

—ক্যান, কাম করলে পরা হয় না বুঝি?

সরমার ঘরটিই আশ্রয় করেছিল। ঘরের এক কোণে যে টেবিল ঘরের শোভা হয়ে বিরাজ করত, তাতে বইখাতা, পেনসিল রাখত। আলনার নিচে ওর টিনের বাক্স।

নিজের জামা টামা নিজে কাচত। রবিবার সরমার জামা, সায়া, কাপড়, সাবানে কেচে দিত।

আর পড়ত চওড়া জানলায় বসে, কপাটে হেলান দিয়ে। বলত, মাসিমা। পরা ধরেন ত!

অতসীকে নিয়ে পড়তে বসা, সেও একটা কাজ হল!

—বাবাঃ। বাচলাম য্যান। ওহানে ভাল তো বাসে সবাই, পরা ধরবে, সময় নাই কারো। হকলডি মানুষ ব্যস্ত। আর মামীমা কথায়, কথায় জল দিয়া যা। চা দিয়া যা! সময়ই দিত না।

—ওখানেও কাজ করতিস?

—হ’ করছি। তা তো করতেই লাগত। দাদু আমারে ডাক্তারখানায় ডাইকা পরা ধরত। কইত, তর মা খুব কষ্ট করছে। তুই পইরা শুইনা নিজ পায়ে দাড়াইবি।

—তোরও নার্স হবার ইচ্ছে?

—খুব। মামা কয় ওই কাম শিখলে উপার্জন অনেক। আমি জ্বর দেখতে পারি। মাথায় বরফ দিতে পারি, মামা কয়, আমার হইব।

—নিশ্চয় হবে। তবে রেজাল্ট ভাল হওয়া চাই অতসী। নয় তো মা তোকে…..

—ক্লাসে ফাস। সেকেন হই।

কী ঝরঝরে মেয়ে! নিজে ভাত বেড়ে খেয়ে চলে যেত স্কুলে। আর বিকেলে এসেও ভাতই খেত। ওর জন্যে মাছ আনতে শুরু করেন সরমা। স্কুলে যাবার সময় মাছ হয়ে উঠত না, বিকেলে এসে মাছ—ভাত খেত।

পাতে মাছ দেখে বলেছিল, আমি মাছ না হইলেও খাইতে পারি।

—মাছ হলে?

—ভাল খাই।

খাওয়ার পর বলেছিল, অগো বাড়িতে খাওনদাওন তো মামীমার হাতে। ডাক্তার মাসি এ সব দেখে না কিছু। তার খাবার ঘরে পৌঁছায়।

—এত কাজ করে।

—মামীমা ভাত দিত না বিকালে। কইত পাউরুটি খা। ভাতের মতো কী আছে, কয়েন?

—ও বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না?

—যামু। ডাক্তার মাসি ঘুইরা আসুক।

—মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করে না।?

—মায়ের কাছে থাকিই নাই।

—এখানে থাকতে ভাল লাগে?

—খুব।

মিলন যখন ছুটিতে বাড়ি এল, ওকে দেখে অবাক।

—এ কে, মা?

—রেবতীর মেয়ে অতসী।

—এখানে থাকে?

—অসীমাদের বাড়ি ছিল। এখন….

—ওকে কাজের জন্যে রেখেছো?

—ছি ছি ছি! ওর মা খরচ দিয়ে রেখেছে। স্কুলে পড়ে। লেখাপড়ায় ভাল। আমারও আর একলা লাগে না অত।

অতসী টিপ করে মিলনকে প্রণাম করেছিল।

—নানা…. এ কী।

—ক্যান? আপনে ত দাদা হইলেন। পরণাম করব না কেন? মাসিমা, দাদা চা খায় ত?

—হ্যাঁ, ওর জন্যেও কর।

—রেবতীমাসি আসে?

—মাঝে মাঝে আসে।

রেবতী আসত। ওর বাগানের তরকারি, গাছের নারকেল আনত, শীতকালে খেজুরে গুড়।

—মাইয়া খুব বশ হইছে তোমার।

—তোমার মেয়ে যে লক্ষ্মী।

—অহন যা ভাইবা থুইছি, তা যদি হয়…

—হবে রেবতী।

—ল’ অতসী। ও বাড়ি ঘুইরা যাই।

—ছুটি তো ওরও, দেশে নিয়ে যাবে?

—না না। মাইনষের হিংসার অন্ত আছে? আমি মরলাম না। লজ্জায় দেশঘর ছারলাম না, মাইয়া টাউনে পড়তেয়াছে, জমিজমাও ভাইসা যায় নাই, মাইনষে হিংসা করে। দ্যাশে লইলেই কইব, ল’ রেবতী মাইয়ার বিয়া দে! তারা আর কী বোঝে?

রেবতী বলেছিল, নারকেল ভাইঙা আন অতসী, কুরাইয়া দেই।

—থাক রেবতী, একটু বোস।

—নেন, কুরানি দেন। আপনে কন, দ্যাশের কথা! দ্যাশ কি তেমুন আছে? শুধু হিংসা আর হিংসা। অতসীরে না কি বাবু বানাইতেছি! মাইয়া বুঝি হাকিম হইব! এমুন সব কথা কয় যে গা জইলা যায়।

—তোমারও ছেড়ে থাকা…

—না দিদি। আমি অরে দূরে রাইখা মানুষ করতেয়াছি অনেক ভাইবা। রেবতী নিশ্বাস ফেলেছিল।

—জ্যাঠা নামের ডাকের মানুষ আছিল, পালছিল, বিয়া দিছিল, সইত্য। কিন্তু চার ক্লাসের পর লিখিপড়ি শিখি নাই। অসীমাদিদি কও, তুমি কও, অনেক মাইয়া দেখি। লিখিপড়ির জোরে পায়ে দাড়াইত্যাছে। আমিও ঠিক করছিলাম, মাইয়া নিজের জোরে দাড়াক। দেহ, আর জমিজমা থাকব। টাকাও কি থাকব না? কিন্তু লিখিপড়ি না হইলে বাচাইতে পারব না কিছু। আমি নির্মমতা নয়, ভাইবা শুইনা এই বলি।

—তা সত্যি।

.

—আমারে যারা সাহায্য হইছে, দিদির বাপ অহনে বুড়া। দিনকালও তেমুন নাই। অর কালে দিন মন্দই হইব। অ জানুক আমারে দাড়ইতে হইব। আপনেও দেখবেন অরে, বেশি আদর দিয়েন না।

—বুঝলাম।

—কই রে অতসী?

—এই যে।

—চল মা! এইবার ঘুইরা আসি। মাসিমার কাজকাম করিস তো?

সরমা বললেন, সব করে।

—কই! করতে গ্যালেই আপনে….

—যা করিস সেই যথেষ্ট।

মায়ের হাত ধরে অতসী চলে গেল।

.

আর রেবতীর স্বপ্ন সরমার মনেও সঞ্চারিত হয়ে যায়, হয়ে যায়। রেবতী অতসীকে সবল, আত্মনির্ভরশীল করতে চায়। ওকে উপার্জনক্ষম করতে চায়। তাই হোক, তাই হোক!

শুধু কিছুটা সময় চান সরমা। মিলন দাঁড়াল, অতসী দাঁড়াক, ক’বছর সময় পাবেন?

বকু মিতাকে খুন করে জেলে গেছে।

‘বকু’ নামের কালো ছায়ার হাতে সরমারও তো দীর্ঘকাল কারাবাসই চলছে।

সে জামিন পায়নি।

তিনি ক’বছর জামিন পেয়েছেন জানেন না।

কিন্তু মরে তো যাননি। নিজে কাজ করছেন, কাজে কী মুক্তি। মিলন কলেজে পড়ছে বহরমপুরে থেকে, পথ পেয়েছে। কতজনের কত সাহায্য পেলেন! বকু বাইরে থাকলে কে সম্পর্ক রাখত তাঁর সঙ্গে?

জীবন এত জটিল কেন? সন্তান কেন মায়ের কাছে ভয়ের কারণ হবে? সন্তান কারাগারে, তাতে মা কেন স্বস্তি পাবে?

সরমা কি খুব নিষ্ঠুর, খুব মমতাহীন?

রেবতী আর অতসীর কথা ভাবতে ভাবতে সরমার চোখে বকুর জন্যে জল এল। সে কি বুঝবে না, কত বড় একটা সুযোগ পেল? অনুশোচনায় পুড়বে না? ভাল হয়ে বাঁচবে না? হয়তো সরমার এত নীরব থাকাটা ভাল হচ্ছে না।

চিঠি লিখবেন কাকে, কোথায়?

বহরমপুরে আছে, না অন্য কোন জেলে?

লিখবেন, বহরমপুর জেলেই লিখবেন। কে জানে, সে চিঠি বকুর হাতে পৌঁছবে কিনা।

ভাবতে ভাবতে সরমা সন্ধ্যা দেন, শাঁখে ফুঁ দেন। তারপর হাত জোড় করে মনে মনে বলেন, সে মানুষ হোক। এমন কাজ করেও বেঁচে গেল যখন, তখন তা বুঝে অনুতপ্ত হোক। আর কিছু চায় না সরমা। এমন অবাঞ্ছিত, সকলের ভয়ের পাত্র হয়ে যেন সে না থাকে।

—মা! কী ভাবছো?

—কিছু না মিলন। খাবি কিছু?

—না মা, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব আজ। কাল ভোরে যাব বাদলের বাড়ি। কোশ্চেন আনব কয়েকটা।

—বেরোচ্ছিস?

—পার্থদা একটা বই দেবেন বলেছেন।

—ঘুরে আয়।

—তোমার অ্যাসিস্টেন্ট কোথায়?

—রেবতীর সঙ্গে অসীমাদের বাড়ি গেছে।

—মা!

—কী?

—রেবতী মাসি জেল খেটেছিল তুমি জানো?

—জানি।

—তারপরেও…. ও তো ক্রিমিনাল মা!

—জেলে গেলেই সবাই ক্রিমিনাল হয়?

—খুন করেছিল…

—খুন করেছিল….

—সে অনেক কাহিনী মিলন…. ইজ্জত রাখার জন্যে রেবতী….

—না… তবে একই রক্তে জন্ম তো মেয়েটার…..

—লেখাপড়া শিখছিস না তুই? যাদের বংশে কেউ কোন অপরাধ করেনি, তাদের বংশেও তো … থাক মিলন!

মিলন কী বলতে গিয়েও বলে না।

—ও সব ভাবিস না। সেদিন রেবতী এসে হাল না ধরলে আমরা কী বিপদে পড়তাম সেটা মনে করিস বাবা। ওর কাছে আমরা তো কৃতজ্ঞ।

—সে তো নিশ্চয় মা। আমি ঘুরে আসি।

মিলন চলে যায়।

সরমা বোঝেন ওর মনে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই গেল। যে যেমন হয়। মিলন শান্ত, নিস্তরঙ্গ, ওর বাবার মতো।

সরমাও তো তাই ছিলেন।

শান্ত আজও আছেন, ধৈর্য আজও আছে! পরিস্থিতির জন্যে তাঁকে জীবনের অন্য রূপ চিনতে হচ্ছে।

আরও কঠিন হতে হচ্ছে।

মেয়েকে নিয়ে ফিরে এসে রেবতী রাতটা থেকে গেল। বলল, দাদারে কইলাম, যতটুকু পরলে নার্সিং শিখাইতে পারেন, ততটুকুই পরুক। মিলন তো বিদ্বান হইব। অর নামে আমি মানসিক করছি।

সত্যি?

—নিশ্চয়। এমুন পোলা। এমুন কথাবাত্তা! অ ভাল কইরা পাস করলে আমি সর্বমঙ্গলা মন্দিরে অন্নভোগ দিমু। খুব জাগ্রত ঠাকুর!

সরমা কেমন করে বলবেন, রেবতীর বিষয়ে মিলনের মনে এখন ঘোর অবিশ্বাস?

—অহনও ফিরে নাই?

—তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে। কাল ভোরে এক বন্ধুর বাড়ি যাবে।

—পার্থ দাদাও অর সুখ্যাত করে।

—দেখ, তোমাদের আশীর্বাদ!

—সদাসর্বদা মনে জাগাইয়া থুই। গুরুরে বলি, সরমাদিদির মতো আবাগী বিশ্বসংসারে নাই। তারে দেইখ ঠাকুর, সে বড় কষ্ট করত্যাছে।

—এসো, খেয়ে নাও কিছু।

—কিসের খাওয়া? খই বাতসা লইয়া আইছি। জপ সারুম, মুখে দিয়া জল খাইয়া শুইয়া যামু।

—দেহ ভেঙে পড়বে।

—বরো ছায়া মায়ায় পালছিল জ্যাঠা। পরে তো আগুন দিয়া হাঁটত্যাছি। এ কারণেও মাইয়ারে বুক ফাটলেও মুখে মিষ্ট বলি না। অরে তো জানতে হইব জীবনে কষ্টই বেশি, সুখ কম।

—কী হয় রেবতী? ছেলেদের…. আবদার দিইনি কখনও। অন্যায় দেখলে শাসন করেছি…

—হ দিদি। সইত্য। অহন মিলন দারাইলে তুমি মাটি পাইবা।

—প্রদীপ্ত ওকে নার্সিং শেখাবে?

—বেবস্থা করবে। সে ফাঁকা কথা কয় না। কথাই কয় কম, যা কয় সেইমত কাম করে। অনেক দিন দেখতেয়াছি ত! অর ভাইরাও অমুনই।

—খুব ভাল পরিবার।

—বেবাগ মানুষ ভাল। তবে বুড়াবাবুর বউ ভাগ্য নাই। পরথমজন। অসীমাদিদিরে থুইয়া মইরা গেল। শালীরেই বিয়া করল তিনি। ইনিও তিনপোলা, এক মাইয়া রাইখা মইরা গেল। অসীমাদিদির কপালও পুড়ল কুন বা বয়সে। বর পোলা ডাক্তার, মেজ জনা বুঝি ইঞ্জিনিয়ার হইব, ছোটটাও কী পড়তেয়াছে।

—ছোট মেয়ের বর তো ভাল।

—খুব ভাল। রেলে অপিচার। বউ লইয়া বেরায় দেশে দেশে। বেবাক ভাল! তবে বরো বউদি কই, তেমুন মনের মানুষ না।

—সব কি হয়? এখন ছেলে মানুষ… শিখে যাবে।

—দাদা দিদিরে মাথায় রাইখা চলে।

—খুব ভক্তি করে।

—অগো বংশ, জমিদার বংশ.. লিখি পরি বংশ… অগো ঘরে ভাল হয়। আমার বংশে লিখিপড়ির দাম ছিল না… আমারেও চাষীবাসি দেইখাই দিছিল বিয়া। আমি ত দিদিগো ঘরে আইতাম, থাকতাম, তাতেই হুতাশ ছিল যে মাইয়ারে মানুষ করুম। লও, খাইয়া শুইয়া পরো।

—তুমিও হাতমুখ ধুয়ে নাও। অসীমা ফিরেছে?

—না। দেরি অইব। তিনি থাকব না বইলাই মাইয়া লইয়া আইলাম।

—আমি বড় বেঁচে গেছি।

—যদি দারাইতে পারে, অতসীও তোমারে দেখব। মাইয়া ছিল না, পাইলা!

—হ্যাঁ রেবতী…

মেয়ে ছিল না, মেয়ের মমতা বোঝেননি। অতসী তো তাঁকে ভুলিয়ে দেয় অনেক দুঃখ।

—অহন আপনি কাম করেন, না খাইলে দেহ টেকব? খান, ভাত হাতে চিন্তা করেন কেন?

—ইস! মাথায় সাবান দিয়া দেই। কী আঠা পড়ছে চুলে!

—প্রসূতিসদনে কাজ! জামা কাপড় সাদা চাই। মাসি কাচতে পারে না। আমি কাইচা দিমু।

—পূজায় মেলা লাগছে, দেখবেন না? চলেন, ঘুইরা আসি। যান না ক্যান?

অতসী, অতসী, কবে থেকে আমি সকলের জন্যে করে আসছি। আমার কোন শৈশব ছিল না। মামা—মামীর সংসারে এত হেলাফেলায় মানুষ, যে ছোটবেলায় খেলাধুলো জানি না। স্কুলে যেতাম, সেও দিনের পর দিন ভাত না খেয়ে। বিয়ের আগে নতুন কাপড়জামা গায়ে ওঠেনি।

বিয়ে হয়েছিল, স্বামী আর দু’ছেলের সংসার। কাজকর্ম, দায়িত্ব সবই তো আমার ছিল।

কথায় বলে, আশার দোরে, ভূত খাটে। তা ছেলেরা মানুষ হবে, এই আশায় ভূতগত খাটতেন স্বামী, খাটতাম আমি। স্বামী গেলেন, বড় ছেলে এরকম, আমি যেন সেই পথিক যাকে ঝড় তাড়া করেছে। যে গাছের নিচে দাঁড়াতে যায়, সেটাই উপড়ে পড়ে।

কোনও আশা, কোনও আকাঙ্ক্ষা ছিল না আর।

তবু মিলন আছে, তাকে যত তাড়াতাড়ি পারি দাঁড় করাব বলে এত চেষ্টা।

অতসী, তুই মনে করিয়ে দিলি আমার একটু যত্ন দরকার, আমার কোনও সাধ আহ্লাদ আছে।

আজ, এত বছর বাদে সরমা সেদিনের সরমাকে দেখতে পাচ্ছেন।

খেয়েদেয়ে, ঘরে ঘরে তালা দিয়ে সেই সরমা ধবধবে কাপড়জামা পরে সাইকেল রিকশায় অতসীকে নিয়ে স্কুলে যান। নামিয়ে দেন। প্রসূতিসদনে চলে যান। তিনি গেলে লক্ষ্মীদি রোজ বলেন, আজ দশটা বেজে দু’মিনিট হল গো!

লক্ষ্মীটি কটকট করে কথা শোনাতেন, কিন্তু সময়ে অসময়ে উনিই দেখতেন।

সেই সরমার মন পড়ে থাকত দরজার দিকে। বিকেলে অতসী এসে পড়ত।

—আইয়া পড়ছি মাসিমা।

—বোস একটু।

ঘাড় নেড়ে অতসী ব্যাগ থেকে বই নিয়ে পড়ত মন দিয়ে! স্কুলের বন্ধু জয়া ওকে গল্পের বই দিত।

লক্ষ্মীদি বলতেন, রেবতীর মেয়ে যে এমন হবে তা কে জানত? হক, মানুষ হক। আবার দু’জনে বাড়ি ফিরতেন। রামের মা এসে পড়ত। অতসী ভাত খেত কুড়িয়ে বাড়িয়ে, তারপর মাঠে একটু খেলতে যেত। সন্ধ্যা দেখতে না দেখতে এসে যেত।

সেই সরমা এতটুকু উনোনে রাঁধতেন, রান্নাঘরের কোণে বসেই অতসী দুলে দুলে পড়ত।

মাঝে মাঝে বলত, পরুম না। হইয়া গেছে পরা। সকালে অঙ্ক কইরা নিমু।

—এখন কী করা হবে?

—আপনে গল্প বলবেন, আমি শোনব।

—কোন গল্পটা বলব?

—ক্যান, সেই যে বলতেন টাউনে বাঘ আইছিল? সেই গল্প বলেন!

—সে কত আগে। তখন সব ঝোপঝাড়… মাঠ…

—সিনেমা আছিল?

—একটা। এখন তো দুটো। তুই সিনেমা দেখেছিস?

—মায়ে ‘রানি রাসমণি’ দেখাইছিল।

—চল, ঘরে যাই।

মাঝে মাঝে বলত, চুল বাঁইধা দেন তো।

—আমার বাঁধা তোর পছন্দ হবে?

—হইব, হইব।

মাঝে মাঝে বারান্দায় চকে ঘর এঁকে একাই এক্কা—দোক্কা খেলত লাফিয়ে লাফিয়ে।

ঝড় হলে এত এত আম কুড়িয়ে আনত।

—আমি কাইটা দিমু, আপনে আচার করেন। আর সরমার গায়ে ঘেঁষে রাতে কত কথা যে বলত।

—বৃষ্টি হইব না। হইত যদি মাইনষে ব্যাঙের বিয়া দিত।

—ব্যাঙের বিয়ে দিলে বৃষ্টি হয়?

—হয়। মাসীমার ঝি গুরুদাসী কইছে।

—বৃষ্টি হলে তো সব ভেসে যায়।

—তাতে কী? যখনকার যা, হওয়াই লাগে। মাসীমা! খুব নাকি বান আইছিল অনেক আগে?

—সে তো ক’বছর আগে।

না, না, অনেক আগে। তহন নদী দিয়া সোনাভরা ঘড়া ভাইসা গিছিল, তাই উঠাইয়া একজন রাজা হইয়া যায়।

—তুই গল্পটা বল।

—অনে—ক দিন আগে, এক আষাঢ় মাসে….

কথা বলতে বলতে অতসী হঠাৎ ঘুমিয়ে যেত।

অন্ধকারে সেই সরমা অতসীর গায়ে হাত বোলাতেন। মাঝে মাঝে বলতেন। তুই ভাল থাক, নিজের পায়ে দাঁড়া…

সেই সরমার খোঁজ নিয়ে যেত পার্থ। বলত, খুব ভাল হয়েছে। একটা মেয়ে পেয়েছেন।

বলত, কাজ করছেন, বেরোচ্ছেন, এতে আমারও খুব ভাল লাগছে। আর মিলনও মন দিয়ে পড়ছে। কলেজে সুনাম হয়েছে।

—সে তো তোমার জন্যেই।

—না, না, আমি আর কী করেছি।

আজ সরমা বোঝেন, যে ক’বছর বকু জেলে ছিল, সেই ক’বছর তিনি ছিলেন জেলের বাইরে।

ওই ক’বছরই তো জীবনের শেষ সুসময়। বকু যে আবার বেরোতে পারে, এখানেই ফিরে আসতে পারে, সে সম্ভাবনার কথা যেন ইচ্ছে করেই ভুলে থাকছিলেন!

ভুলের স্বর্গে বাস করে যে, সে নির্বোধ। জীবন তাকে ক্ষমা করে না। তাকে দাম দিতে হয়। আজ কেন, অনেকদিন ধরেই তো সরমা দাম দিয়ে চলেছেন। তবু বোধহয় দাম দেয়া বাকি ছিল। নিঃশেষে সব দাম চুকিয়ে নিয়ে গেল সন্ধ্যা ও রাতের মধ্যবর্তী সময়টা।

যখন অতসীর গলা শুনলেন। অতসী তাঁকে ডাকল। তিনি দরজা খুললেন না।

মিলন ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। অতসীর গলার আর্ত চীৎকার ওকে বিচলিত করেনি। কেননা মিলন ভুলে গেছে সব।

রেবতীর বিষয়ে এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই মনে।

অতসীকে ও মনেই রাখেনি।

দাদা একটা আতঙ্ক, তাই এখানে আসে কম। যখনি আসে, তখনি বাড়ির শেয়ার যে ওরও প্রাপ্য সে কথাটা বলতে ভোলে না।

দাদার ভাই হয়ে পালানো যায়। দাদা যদি আতঙ্ক হয়, সে আতঙ্কের গ্রাসে মা কত বছর তিলে তিলে মরছে, তা মিলন ভাবে না।

ভাবতে গেলে সরমার…..

অসীমা বলতেন, দুঃখ পাও? দুঃখ পেয়ে কি করবে সরমা? মানুষ ভুলে যায়, ভুলে যেতে হয়। সব সময়ে অতীতকে মনে করলে মানুষ বাঁচতে পারে না। মিলন খুবই অন্যরকম। ভেবে কি করবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *