দুই
অসীমার কাছেই শুনেছিলেন সরমা।
সেটা কোন সাল? যে সালে সুধন্য মারা যান, মিতা ধর্ষণ ও খুন হয়, অনন্তপুরে আগুন জ্বলে, মন্ত্রী বলে যান, সমাজবিরোধীকে রাজনীতিতে ঢুকতে দেব না?
উনিশশো আটাত্তর সাল ছিল, আটাত্তর। এই তো সে বছরই রতন ডাক্তারের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে প্রদীপ্ত ডাক্তারি প্র্যাকটিশ করতে করতে ‘প্রসূতিসদন’ প্রতিষ্ঠা করল।
অসীমাই জমিটা দিয়েছিল ভাইকে। সরমাকে বলেছিল, ছেলেপুলে নেই, সম্পত্তি নিয়ে কী করব? আমার বাড়িটা কল্যাণ সংঘকে দেব। জমিতে ও প্রসূতিসদন করুক।
অসীমার স্বামী অনেকটা জমি কিনেছিলেন। বহরমপুর তিনঘণ্টার বাসপথ, কে জানত অনন্তপুর হঠাৎ এমন কুলীন হবে, জমির দাম বাড়বে?
অসীমার সে সব জমি তো প্রদীপ্তই কেনে। দিদিকে বলেছিল, দেশ বেড়াও, আনন্দ করো। তীর্থে যাও। অসীমা সেই তীর্থভ্রমণে গিয়েই মারা যায়। প্রসূতিসদনের পাশে নার্সিং হোম, ওষুধের দোকান, প্যাথলজি ও এক্স—রে ক্লিনিক। টাউনের ওদিকটাই বাড়ছে।
আটাত্তর সালে তো ভবিষ্যত দেখতে পাননি সরমা। অসীমার হাত ধরে বলেছিলেন, রেবতী কী আমার কাছে থাকতে পারে না? বাড়ির একজন হয়ে?
—ওর জীবনের কোন কথাই তুমি জান না।
—অবশ্য, টাকা আমি ওকে কী বা দিতে পারব।
অসীমা নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, টাকা আমিও দিই না। রেবতী বছরে আট হাজার টাকার ধান বেচে সরমা, চার হাজার টাকার সরষে। ভাগ্য মেরেছে ওকে। নইলে ওর জেল খাটার কথা নয়।…. চমকে উঠলে?
—জল খাটবে কেন?
—তেজি মেয়ে। দেওরের গলায় কোপ দিয়েছিল। বলি তা হ’লে…
রেবতীর জ্যেঠা নরসিং দত্তের জমিজমা ছিল কুলডাঙায়। রেবতীকে ওই মানুষ করে, বিয়েও দেয় কুলডাঙায়। স্বামী ভাল, চাষবাস করে। ওদের একটা মেয়েও হয়। রেবতী অকালে বিধবা হল। তারপর ও জ্যাঠার দেওয়া নিজের জমি, নিজের ঘর নিয়েই থাকত। লোক দিয়ে চাষ করাত।
আজ ওর বয়স তিরিশই হবে। বিধবা হয়েছিল বিশ বছরে। ওর জ্ঞাতি দেওরের নজর পড়ল ওর ওপর। অমন বয়স। এক ঢাল চুলও ছিল। বাবা কত বললেন, সব বেচে দিয়ে টাউনে চলে আয়। রাজি হয়নি। কুলডাঙা থেকে নরসিংহ দত্ত নামটা মুছে যাবে? জেদি, তেজি, একরোখা মেয়ে। চরিত্র নিয়ে কেউ একটা কথা বলতে পারেনি।
এই দেওর কুমতবলবেই ঢুকেছিল। রেবতী ওর গলায় কোপ দেয়। তারপর মেয়েকে কাঁধে বসিয়ে, রক্তমাখা দা নিয়ে নিজেই থানায় যায়।
—খুব সাহস তো!
—রেবতী অসামান্য মেয়ে।
—তারপর?
অসীমা হেলান দিয়ে বসেন ইজিচেয়ারে। বলেন, বয়স হচ্ছে, বুঝতে পারি।
—তোমার আমার একই বয়স।
—তবু ভেঙে গেছি। তুমি শক্ত আছো, অসীমা বলে। সরমা বিষণ্ণ হাসেন।
—যাকে দেখার কেউ নেই, তাকে শক্তই থাকতে হয় অসীমা। তোমার তো আমার অবস্থা নয়। আর আমার অবস্থা যেন শত্রুরও না হয়।
—মিলনের পনেরো হল?
—হ্যাঁ। দশ বছর তফাৎ দু’জনের।
—মিলনের পড়াশোনার ক্ষতি হবে।
—সংগতি থাকলে হাতে পায়ে ধরে ওকে বিনোদপুরে রামকৃষ্ণ মিশনে দিতাম।
—তুমি তো পেনশান পাবে একটা। নয় চাকরি।
—দেখি! রেবতীর কথা বলো।
—বলি।
কেস হয়েছিল। যদিও রেবতী নিজেই আত্মসমর্পণ করে। রতনবাবু বহরমপুরের দুঁদে উকিল লাগিয়েছিলেন। ফলে রেবতীর মাত্র দু’বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আর ওর শ্বশুরবাড়ির গুষ্ঠি রেবতীর জমিজমা ঘরদোর নিতে পারেনি।
—আমাদের তো জমিজমা কুলডাঙাতেই। বাবা লোক রেখে সব সামলে রাখেন।
—ওর মেয়ে?
—অতসী আমার কাছে। নরসিং জ্যাঠা ভালবাসার সম্পর্কে আমারও জ্যাঠা। রেবতীর দায়িত্ব বাবাকেই দিয়েছিল জ্যাঠা। তাই আমার বাবা ওর কাকা, আমি ওর দিদি। এ সব গ্রাম সম্পর্ক কয়েক পুরুষের।
একেবারে পদ্মাপারের কথা বলে!
—ওদিকেও ঠাকুর্দার জমিদারী ছিল। নদীর ভাঙনে সব যেতে ওদের এনে বসবাস করান। মুখের ভাষা ছাড়বে কেন?
—জেল খাটতে হল।
—শুনে মন শিউরে উঠছে?
খুনী মেয়েমানুষ দেখেননি আগে। তবু শিউরে ওঠেননি সরমা। ইজ্জত রাখার জন্য খুন করেছিল রেবতী।
মিতার ইজ্জতও গেল। সে খুনও হল। রেবতীকে কেমন করে অপরাধী ভাববেন সরমা?
সরমা মাথা নাড়েন।
—না, শ্রদ্ধা হচ্ছে।
—জেলের পরই তীর্থ ঘুরে এল। মাথার চুল কাটল, কুলডাঙা যায় মাঝে মাঝে। তা ও তো থাকবে না সরমা। যাবে আসবে, আমার কাছেও আসে যায়। ওকেই জিজ্ঞেস করি।
রেবতী ঘরে ঢুকল।
—বেত্তান্ত শোনলেন?
—শুনলাম।
—কেমন বোঝলেন?
—তোমার মতো মেয়ে যদি ঘরে ঘরে হত, তাহলে কাজের কাজ হত।
—কী ক’মু? ইজ্জত লয় পুরুষ, কলঙ্ক হয় মাইয়ালোকের। আর জেলে যা দেখছি! বিচার হয় না। মাইয়া যদি নালিশ করে, তাগো আটক রাখে। আপনের পোলাও আজ নয় কাল খালাস পাইব, দেইখা নিয়েন।
সরমা শিউরে উঠে চোখ মুখ ঢাকলেন।
অসীমা বললেন, থাক রেবতী!
.
বকু সগৌরবে খালাস পায়নি।
অবনীবাবুও জান লড়িয়ে দেয়নি বকুর জন্যে, টাউনে জনমত এতই বিরুদ্ধ ছিল। অবনীবাবুর ওপর খুব ভরসা করেছিল বকু। তখন অবনীবাবু বলে পাঠায়, আমি কী করব? এমন করে গুছিয়ে নিলাম। ওর জন্যে সব ল্যাজেগোবরে হয়ে গেল। আমার ওপর ইনজাস্টিস হল সেটা দেখছে না?
অবনীর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি ডেভিড ধনুর্ধর দাশ, ‘মডেল’ নামে পরিচিত। কেন না তার কুঞ্চিত বাবরি চুল, ওপর পাটির দাঁতের স্বাভাবিক বেরিয়ে থাকা, বিশাল পাকানো গোঁফ, ইত্যকার কারণে তাঁকে মডেল করেই নাকি শারদীয়া মহিষাসুর বানানো হয় বলে টাউনে গল্প চালু আছে।
একদা সে খুবই খেপে যেত এবং কমলেশবাবুকে নালিশও করেছিল। কমলেশবাবু ওকে দীর্ঘকাল দেখছেন। ওর দাদাকে জানতেন।
তিনি বুঝিয়ে দিলেন, এ তো বিরাট সম্মান হে! মহিষাসুর যদি তোমাকে দেখে তৈরি করে, সেটা তো সম্মান।
অবনীবাবু তেতে বলেছিল, একেকবার একেক ফিলিমের মেয়ে স্টারের মুকের মডেলে দুগ্গার মুখ তৈরি হয়। তা অ্যাকটেসরা কি নালিশ করে? কমলেশবাবু রাজনীতি করে, সাচ্চা লোক, ঠিক বলেছে।
মডেলের বিশেষ ক্ষমতা বাহুবল এবং ওর মগজ এক মেশিন বিশেষ। আজকের সময় হলে ওর মগজে কম্প্যুটার বলা যেত। এখন আমরা কম্প্যুটার মগজ বিশিষ্ট শিশুর খবর কাগজে পড়ি। কিন্তু এ লাইনে অন্যতম পথিকৃৎ মডেলের নাম কেউ মনে রাখেনি। যা শোনে, তা ও কয়েকদিন বাদেও নির্ভুল বলতে পারে। অবনীবাবু দাবড়ে উঠল।
কী ভাবছো?
—এত ব্রেন নিয়ে চাশশো বিশ হয়ে থাকলাম! বাবা মাস্টার, দাদা, ভাই, বোনটা অবধি শিক্ষিত। লেখাপড়া শিখলে কাজে লাগত।
—বেন দিয়ে কিছু হয় না মডেল! শুধু ফাসটেশান! লেখাপড়া তো সবাই শিখছে। পাচ্ছে চাকরি? যাক গে, শোন যা বলি। বকুকে সব বলবে। আরও বলবে, তার জন্যে আমি ফাসটেশান। এত করে চল্লিশ বিঘে জমি ভেস করতে দিলাম! ভোটে টাকা দিলাম, গাড়ি দিলাম! যা ভেবেছিলাম, সব নষ্ট করে দিল বকু। পরের ইলেকশানে চানস নেব, সে আর হবে না। বকু আমার ডিম নষ্ট করল।
—যাগ গে, বলুন!
অবনীবাবু বলে যায়। সবার শেষে বলে, বকুর বাপ—মাকেও বলিহারি যাই! ছেলেকে বাঁচাবার জন্যে মা কোন চেষ্টা করল না। বাপটাও ছিল বেয়াড়া। বাড়িতে ভালবাসা পেলে ছেলেটা অমন হত?
সগ্যত লোকের নামে কিছু বলবেন না।
—বেশ! তবে শোন! দেখতে গেলাম। বললাম, ছেলের বিয়ে দিন! মা বলল, আসপদ্দা শোন! মা বলল, আপনার তো মেয়ে আছে। বকুর হাতে মেয়ে দিতে পারবেন? বলাটা আস্পদ্দা নয়?
—আস্পদ্দা কেন? বকুর হাতে মেয়ে দেবার চেয়ে মেয়েকে কোপ মেরে নিকেশ করা ভাল। আপনি বলছেন, আমি যাব। কিন্তু হাতে পেলে আমিই ওকে….
মডেল হাতের পেশী ফোলাল। বলল, রেপ করবে, খুন করবে, এ কি মাজাকি?
—আমারও তো সেই কথা। এখন ওকে মদত দেব, কোন ভরসায়? টাকার লসটা ভাবো তো? বাস! গুদাম! ও ভেবেছে কী?
—বহরমপুর যেতে যেতে পশশু।
—কাল যাও না।
—না, কাজ আছে।
দেখো!
—বড় মেয়েকে বেইজ্জত করল, তখন তো ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রোটেকশান দিলেন!
—ওদের পিটিয়েছিল কে? তুমি?
—আমি পিটিয়েছিল কে? তুমি?
—আমি ধরলে ওরা বাঁচত? দেখছিলাম …. দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।
—দেখছিলে!
—দেখার জিনিস, দেখব না? আপনার পেয়ারের বকু! সেদিন তো পায়ে পড়ছিল ওদের। ছোঃ।
—বকু এদিকে আমাকে সমানে খবর দিচ্ছে!
—আপনি ছাড়া ওর আপনজন কে?
—না, না, তোমরা আমার …. তোমরা আগে, বকু পরে। এ তুমি জেনে রেখো।
—ওসব বাতেলা ছাড়ুন দাদা। আমাদের সার্ভিস যখন নেবার তখন নিয়েছেন। এখন বকুকে তুলছেন।
—তোমাকে তো…..
—হিসেব করবেন। যা দিয়েছেন, তার দশগুণ পেয়েছেন। যাক গে! যেদিনে যাব বলে দেব।
.
বকুকে সবই বলে মডেল।
—দাদা তোমায় প্রোটেকশান দিতে আসবে না। এখন হাওয়া খুব খারাপ! দাদা হাত বাড়ালে টাউন তাকে শেষ করে দেবে। তোমার ঢোকাও বিপদ। দাদার পলিটিকসের বারোটা বাজিয়েছো তুমি।
—সরকারও ক্ষেপে আছে, নতুন এস. পি—ও। কাগজে যাচ্ছেতাই, সভা—মিছিল—মিটিং! তোমাকে শাস্তি দেবেই। মন্ত্রী এসেছিল, বিধানসভায় কথা উঠেছে। তোমাকে বাঁচাতে যাবে না দাদা।
—গুদাম জ্বলেছে, নতুন ‘রামেশ্বরী’ বাস জ্বলেছে, দাদার বাড়িতে বোমা পড়েছে, দাদার টাউনে থাকতে হলে তোমাকে উকিল দেয়াও সম্ভব নয়।
বকু হাত তোলে, কিছু বলতে যায়। কিন্তু মডেল পালটা হাত তোলে ও আঙুল বাঁকায়। বকু চুপ।
—দাদা বলেছে, এখন তোমার জেলখানাই ভাল। জেল খেটে বেরোও। গরমেন্টের এখন যেমন ট্যাঁ ফোঁ আছে, পরে এত থাকবে না। হাওয়া ঠাণ্ডা হবে, মানুষও ক্রমে ভুলে যাবে। তখন দাদা তোমায় দেখবে, ব্যস! যা যা বলেছিল সব বলে গেলাম।
বকু ফিশফিশ করে বলে, জামিন পাব না!
—জানি না।
—তুমি কিছু বলো!
—আমি? তোমার বিষয়ে? সিধে কথা বকু! আমি তোমায় হাতে পেলে জেল অবধি পৌঁছতে না।
—বুঝলাম।
—বোঝোনি, বোঝো।
—আমার জায়গায় পড়লে…..
—পড়তাম না। আমি বড়বোনকে টেনে নামাইনি, সে ঘটনা দেখে আমার বাপ বড় রাস্তায় সন্নেস হয়ে পড়ে যায়নি। আমি পনেরো বছরের বাচ্চার ইজ্জত নিয়ে তাকে খুন করিনি। আমার কীর্তি শুনে আমার বাপ মাথার শির ছিঁড়ে মরেনি। যা করেছি তা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে। জেনে রাখ হারামি, আদালত তোকে ছেড়ে দিলে আমি তোকে মারব।
মডেল বেরিয়ে যায়।
বিদেশ সরকার (বকু নিজে এফিডেভিট করে বিক্রম নাম বদলেছিল) ওরফে বকু বনাম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার মামলা আদালতে ওঠে ১৯৭৯ সালের গোড়ায়।
সব কিছুর পরেও অবনীবাবু বকুকে হাত ধুয়ে ফেলে দিতে পারছিলেন না। যাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে, সেই তরুণ প্রজন্মকে তিনি স্বপ্ন ফিরে দেবেন, প্রথম নির্বাচনের পর বাতাস তেমন ছিল না। যাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, তারা তাঁর দ্বারে প্রার্থী হয়ে আসবে এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না।
তবু বকুকে বুঝতে দেয়া দরকার যে অবনীবাবু তাকে ভোলেনি। একটি উকিল দেওয়া দরকার। সরকারি উকিল কী খেলা করবে, তা কে জানে।
কিন্তু উকিল দেবে কী করে?
না দিলেও নয়। মডেল যে সব কথা বলছে যেমন গলায় বলছে, তাতে তাকে কতটা হাতে রাখা যাবে, কতদিন হাতে রাখা যাবে?
হ্যাঁ, দিতে পারে বকুর মা।
সে রাজি হলে বলা যাবে, আমি নাচার। ছেলে যেমন হোক, মা যদি কেঁদে কেটে বলে যে দেখুন! ছেলের যেন ভয়ানক শাস্তি না হয় আমি দেখব না?
সরমার চাপা ঠোঁট, চোখে কঠিন তাচ্ছিল্য মনে পড়ল। তবু চেষ্টা করতে কষ্ট নেই।
যাবে কে?
মডেলকে পাঠানো যাবে না।
নিজে যাবে অপমান হতে?
রতনবাবুর মেয়ের কাছে যাবে? অবনীবাবু রোগেভোগে রতনবাবু, নয় প্রদীপ্ত ওদের কাছেই যায়। বড় মেয়ের ভালই বিয়ে দিয়েছিল, বিধবা হল। সেই যে খুনে মেয়েছেলেটা, সেও তো ও বাড়ির এক পুষ্যি। রতনবাবুর মেয়েই তাকে দিয়েছে বকুর মার কাছে।
না, বড়ই কানাকানি হবে। তার চেয়ে কথাটা চারিয়ে দিয়ে দেখা যাক।
এ সব ভেবেই অবনীবাবু রতনবাবুর বাড়ি যায়। কিন্তু কাকতালীয় যোগাযোগ, রতনবাবু সরমাকেই দেখছিলেন। অবনীবাবু বসে পড়ে এবং কথাটি পাড়ার সময় খোঁজে। সরমার মুখ দেখে মনেও হয় না অবনীবাবুকে চেনেন।
দরকারটা নিজের। তাই অবনীবাবু বলে, আপনি বকুর জন্যে উকিল দিতে চান? দেখব?
সরমা মুখ ফিরিয়ে বলেন, না!
কিন্তু…
সরমা বলেন আমি আপনার কাছে যাইনি। আপনি কেন আমাকে …. এ অবস্থায়….
—আসেন দিদি, আমার লগে আসেন।
রেবতী সরমাকে ভিতরে নিয়ে যায়। রতনবাবু শুকনো গলায় বলেন, তোমার কী হল?
—এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম…. তাতেই….
শরীর কিছু খারাপ নয় তো?
—না… তেমন কিছু নয়….
—তাহলে এসো আজকে। আজ রোগী অনেক। নদীর ওপার থেকে, এদিক থেকে.. একেক দিন…
লক্ষণীয় এই, তারপরেও অবনীবাবু উকিল দেবে ঠিক করেই বাড়ি ফেরে। রেবতী বলেছিল, মেয়েদের ইজ্জত নিলে আদালতে ‘ধর্ষণ’ প্রমাণ করা যায় না। ধর্ষণের আসামীর সাজাও হয় না।
বকুর জামিন হয়নি। সে নিজেও জামিন নিতে চায়নি।
সাইকেল রিকশা চালক বলেছিল, তার রিকশায় মিতা বসেছিল, বকুবাবু মটর সাইকেল চালিয়ে এসে রিকশায় ধাক্কা মারে বটতলার সামনে।
—তারপর কয়, তোর বরো বুনের ত্যাল বারছে। তরে দিয়া তগো ত্যাল ভাঙ্গুম!
মিতাকে হিঁচকে তুলে নেয় মটর সাইকেলে, গাড়ি ছোটায়। প্যাডলার পড়ে গিয়েছিল, উঠে প্রাণপণে রিকশা চালিয়ে পালায়।
সে কারো কাছে যায়নি? বলেনি?
না, বলেনি। বকুবাবুরে অরা ডরায়। হ্যায় আইসা জবরদস্তি টাকা তুলে পেডলার পিটায়। থানায় বইলা কিছু হয় না। হেয়ার লিগ্যাই অহনে পার্টি পেডলার ইউনিয়ান বানাইছে। অরা অবনীবাবুর ইউনিয়ানে আছিল, অহন নূতন ইউনাইনে যাইব।
সরকারি উকিলের মন্তব্য, রিপোর্ট করা উচিত ছিল, রিকশাচালক বোঝে না।
তয় কোলোনির হকল পেডলার জানে। ও জনায় জনায় কইছে হকলে জানে। এ কথাও অ কইত না, সাওস আছিল না। কিন্তু আদালতে ডাকছে, পার্থবাবু হকল লিখ্যা নিছে, না আইলেও বিপদ। যার নিজের রিকশা নাই, তেমুন পেডলারের সবেতেই বিপদ।
বকুই যে মিতাকে তুলে নিয়ে যায়, এ কথা বটতলার পান দোকানিও বলে।
মিতার দেহে কৌমার্য অটুট ছিল ধর্ষণাবধি, ডাক্তারের রিপোর্ট।
মিতা যে বাধা দিতে চেষ্টা করেছিল, নখে লেগে থাকা চামড়া ও মাংসে তার প্রমাণ মেলে।
‘বকু’ লেখা পদক ও চেনহার আরেকটি প্রমাণ।
‘ধর্ষণ’ বিষয়ে এখনও অপরাধ প্রমাণ ও অপরাধীর শাস্তি খুব গোলমেলে ব্যাপার। তবে মিতা শহরের সরকারি অফিসারের নাবালিকা মেয়ে, ধর্ষণের পর হত্যা ব্যাপারটি জনতাকে ক্রুদ্ধ করে বেশি।
মিতার দেহে ছেঁড়াফোঁড়া ব্লাউজ, অন্তর্বাস ছিল। দেহের নিম্নাঙ্গ অনাবৃত। কাপড়ের এক প্রান্ত ওর গলায় পেঁচিয়ে বাঁধা ছিল। এবং মাটিতে হেঁচড়ানোর দাগ দেখে বোঝা যায় ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
একজন ধর্ষণকারী, না একাধিক? মার্ডার না কালপেবল হমিসাইড অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার? অপরাধীকে সাহায্য করে অন্ধকার। উল্লেখিত মটর সাইকেল রাতের পর দেখা যায়নি। এখন প্রমাণিত, রোড কন্ট্রাকটর ভগবান দাসের ওয়ার্কসাইটের গুদামের পেছনে ওটা আছে। হেড কুলীর বক্তব্য ও দুশো টাকা দিয়ে ওটা বকুবাবুর কাছে কিনেছে।
সরকারি উকিল প্রাণপণ লড়ে যান। তারিখের পর তারিখ পড়ে।
তারপর ১৯৭৯ সালের শেষ দিকে বকুর নয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড হয় না। মিতার গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি ইত্যাদি পাওয়া যায়নি। বকুই খুন করেছে, না অন্য কেউ মিতাকে পড়ে থাকতে দেখে সেগুলো নেবার জন্যে….?
রায় বেরোলে পার্থরা খুশি হয় না। রীতা বলে, যা হয়েছে এতটাও আশা করিনি। রীতাই কলকাতা থেকে আসত বারবার। ওর বাবা শারীরিক কারণে একবারও আসতে পারেনি।
শেষদিন রায় বেরোলে রীতা পার্থকে বলে আর আসব না পার্থ।
—আমাদের ত্যাগ করবি?
—তা কখনও হয়? তবে এদিকে আর নয়।
—ন’বছর চাক্কি পিষুক!
রীতা বিষণ্ণ হেসে বলে, সরকারি উকিল দম দিয়ে জেরাই করল না! … ছেড়ে দে!… যা হয়েছে, তোদের জন্যই হয়েছে। আর ন’বছর জেল হয়েছে বলে আনন্দ করিস না। সাজার সময় তো কাটান যায়। কী নিয়মে কাটান যায় জানি না। যায়।
—হ্যাঁ, জানি।
—৩৭৫ আই. পি. সি. এদেশে ফালতু।
কেন রে?
—কখনও সাজা হয়? আমি কলকাতায় জাস্টিস করবী মিত্রের সঙ্গে অনেক কথা বলেছি। আসলে এ দেশে, মনের মধ্যে বসে আছে আদিম সংস্কার। পুলিশ, আদালত, সমাজ, সব আগেভাগে মনে মনে রায় দিয়ে বসে থাকে যে ধর্ষণ করা হল যাকে সে মেয়েই অপরাধী। নইলে সে কেন রেপড হল?
—আমি কিছু বলব না।
—জানি। বলতে পারছিস না যে মিতা বিপদ ডেকে এনেছিল। ওভাবে সিনেমা যাওয়াই ঠিক হয়নি ওর। সে তো আমরাও জানি। কিন্তু মিতার তো কোন পরিণত বুদ্ধিই ছিল না। বাড়িতে বলেও যেত না। বাবা ওকে কম বলেছে, নীতা কম সামলে চলত? আমি কম বুঝিয়েছি? আজ বলছি… কাউকে বলিস না…. আমার … খুব দুশ্চিন্তা ছিল! ওর লেখাপড়া হবে না…. বিয়ে দেওয়া অনৈতিক হবে… কে ওকে বিয়ে করবে, কেন বিয়ে করবে… সাজগোজ, সিনেমা দেখা, সিনেমার পত্রিকা পড়া, এ ছাড়া কিছুতে আগ্রহ নেই। বাবা কতদিন পারবে? আমি কতদিন পারব? মিতা… আমাকে… নিশ্চিন্ত….
রীতা কেঁদে ফেলে।
—এখন অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে!
—এই! চোখ মুছে ফেল। আজই ফিরবি না তো?
—না। জয়তীদি’র বাড়ি থাকব। ওঁরা খুব সহযোগিতা করেছেন।
—চল, চা খাবি চল।
—চল।
—কোর্টবাজার ছাড়িয়ে লালদিঘির দিকে হাঁটতে হাঁটতে পার্থ বলে, কিশোর কি চাকরি পেয়ে ভুলেই গেল আমাদের, না অন্য কিছু?
—কিচ্ছু না। এল আই সি তো! ট্রেনিঙে গেছে।
—বিয়েটা কবে হবে?
—ওর পোস্টিংটা হোক!
—ধর কলকাতায় হল না।
—যেখানেই হোক, কাজ একটা না একটা আমি করবই। নীতা হস্টেলে থাকবে, বাবা আমাদের কাছে।
—কিশোর পিছিয়ে যাবে না তো?
—সে ভয় করি না। আর এ সব কথা আমরা বারবার আলোচনা করেছি। বাবার পেনশান থাকবে…. আর যা পাবে তাতে নীতার একটা সম্বল।
—হ্যাঁ, তোদের জীবনটা সার্থক হোক।
—তুই কী করবি, রাজনীতি?
—সরাসরি না করলেও সমর্থনে তো থাকবই। ভেবে চিন্তেই ডিসিশান নিলাম।
—কী পাপবোধে অবসন্ন হয়ে আছিস?
—বকুকে খুঁজতে ওদের বাড়ি গিয়ে ও রকম পাগলামো না করলে হয়তো ওর বাবা…
—হ্যাঁ। সইতে পারলেন না।
—কী মহিমাময়ী মা। একবারও বললেন না পার্থ অন্যায় করেছে। বলেছেন, ও বকুকে খুঁজতে এসেছে, কোন দোষ করেনি।
—বকুর জন্যে নিজেদের অপরাধী ভাবেন তো!
—মহিলার কথা ভাবলে আমার…
—ওর উপকার করতে চাস?
—কী করব? কোন মুখে যাব?
—যাবি কেন! কলেজে পড়াচ্ছিস, ছেলেটাকে হস্টেলে সুবিধে করে দে, ও তো ভাল ছাত্র। ওখানে থাকলে পাপবোধেই শেষ হয়ে যাবে।
—তা করা যায়। যদি ওর মা করতে দেন…..
—নে, চা খাওয়া। তোদের সব সমস্যার সমাধান চিরকাল বাৎলে এলাম।
—তোর শক্তি আছে।
—গোড়া থেকেই থাকে না পার্থ। অবস্থায় পড়লে শক্ত হতেই হয়। নীতাকে মানুষ করতে পারলে….
—দেখ, তুই পারবি।
—টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, ভাইরাস জ্বর, তখন মিতা গেল না। আর এই মর্মান্তিক মৃত্যু! বাকি জীবন কি ওকে ভুলতে পারব? অনন্তপুরে আমি কোনদিন যাব না।
—যাস না। পরের স্টপ থেকে জীবন শুরু কর।
—জানি না…. কবে কী পারব… তুই কী করবি?
—বহরমপুরে মাস্টারি করব, যা করছি।
—দেবাশিস চলে গেছে সোনালিকে বিয়ে করে, তাই বিয়ে করবি না।
—কারো সঙ্গে মনের মিল খুঁজে পাই তো বিয়ে করব।
—তোদের বাড়িতে তো কেউ কারো বিয়ে দেয় না।
না। বাবা মা নিজেরা বিয়ে করেছিল। বিয়ে দেয়াতে বিশ্বাসই করে না। দিদি নিজে বিয়ে করল। দাদাও তাই। আমাকেও তাই করতে হবে।
—কী লাকি তুই!
—তোর বাড়িই বা কম লিবারাল না কি?
—বাবা… খুব সাধারণ মানুষ, কিন্তু বাধা দেয়নি কখনও। এম এ পড়তে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে গেলাম, বলেনি কিছু। খুশি হয়েছিল।
—চল দোকান এসে গেছে। কিশোরকে যোগাযোগ রাখতে বলিস।
—তোরা না এলে বিয়েই হবে না।
—বিয়ে দিতে দিতে গুনুদা না হয়ে যাই। লোকটা সারাজীবন এর—তার বিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, নিজের বিয়ে হল না।
—বড় ভাল লোক।
—গুনুদা না থাকলে সুধন্যবাবুর দাহ আমাকে করতে হত। আমি ওদের দিকে চাইতে পারছিলাম না…
—দেখা করিস একবার।
—অসীমাদিকে বলব যা বলার। ওঁর সামনে যেতে…..
—দেখ!
—একবারও পুলিশ খুনের ব্যাপারটা পারস্যু করল না…
—বেরোলে তো আবার…
—বাধা দিতে হবে। মানুষ তো সচেতন হচ্ছে। বামফ্রন্ট জেতায় একটা ইনপ্যাকট আছে না? মানুষ আশা করছে, দাবি জানাচ্ছে।
পার্থর গলায় বিশ্বাস ছিল, প্রত্যয়।