আই. পি. সি. ৩৭৫ – ১

এক

সরমা দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ উঠোনের দরজায় ঘা পড়ল।

—দরজা খোলেন মাসিমা, দরজা খোলেন, আমারে বাঁচান, দরজা খোলেন!

সরমা দরজা খুলতে যাচ্ছিলেন, মিলন দৌড়ে এসে মার হাত ধরল।

—কী করছো?

—কে ডাকছে, অতসী না?

—না, না, চলে এসো।

—মাসীমা! অরা আমার ইজ্জত লইব, দরজা খোলেন, না না, অমন কাজ কইরো না। ছারো, ছাইরা দেও,

বকুদা গো…!

চিৎকারটা হঠাৎ কেটে যায়। পায়ের শব্দ, অনেক পায়ের শব্দ গলি দিয়ে চলে যাচ্ছে। কে গর্জে ওঠে চাপা গলায়, কে বলে, ইজ্জত দেখাচ্ছে!

সরমা বসে পড়েন।

—সর্বনাশ হয়ে গেল মিলন…. অতসীর সর্বনাশ হয়ে গেল।

মিলন, তাঁর ছোট ছেলে মিলন, ঠিক তাঁর বড় ছেলে বকুর গলায় গর্জে ওঠে, সন্ধেবেলা দরজা খুলছো? মেয়েছেলে এভাবে ডেকে দরজা খুলিয়েছে তারপর ডাকাত ঢুকেছে জানো না? গত মাসেই তো….

—কিন্তু, কিন্তু ও ‘বকুদা’ বলল কেন?

—জানি না। চলে এসো ঘরে।

—মিলন, ও অতসী।

—আমি চিনলাম না গলা?

সরমা শান্ত হন, সংবিৎ ফিরে পান, আঁচল টেনে নেন গায়ে।

—তুমি চেনোনি, কেন না তুমি এখানে থাকো না। সাত বছর ধরে কাজ করছো। খুব কমই আসো এখানে।

ভয় পেয়েছে বলেই মিলন হঠাৎ রুক্ষ হয়ে ওঠে।

—কে আসবে। কেন আসবে! প্রতি মাসে ডাকাতি, খুন পলিটিকস নিয়ে মারামারি, অনন্তপুরের কোন ইজ্জত আছে না কি? দাদার নামে আতঙ্ক… তুমি বলেই পড়ে আছো।

—পালিয়ে যাব? এই বয়সে?

—পড়ে আছো তো বড় ছেলের জন্যে। আমি তো এখানে কেন, জেলাতেই থাকতে চাই না। যে একখানা নাম তোমার বড় ছেলের। খুব চেষ্টা করছি চলে যেতে। আমি কি বহরমপুরেই থাকব না কি?

—কোথায় যাবে?

—কলকাতা, কলকাতা। লিলির দাদার সঙ্গে ব্যবসা করব। বউ কলকাতায়, ছেলে কলকাতায়, আমি একটা মেসে…

কলকাতা তবু সেফ। মফঃস্বলের শহরগুলো…

সরমা, ছেলে কি বলবে তা বলে দিতে পারেন। মফঃস্বলে জীবন খুব বিপন্ন। সর্বত্র সমাজবিরোধী। কলকাতা এখন সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। জেলার তুলনায় কলকাতা নিরাপদ। কলকাতার তুলনায় ব্যাঙ্গালোর। ব্যাঙ্গালোরের তুলনায় লন্ডন। মিলনের বুদ্ধি এই রকমই।

সরমা ছোটছেলের দিকে তাকান।

—কথা বাড়িয়ে লাভ নেই মিলন… চলো, খেতে দিই।

—তুমি কি দাদার জন্যে বসে থাকবে?

কেন, কেন মিলন দাদার কথা তুলে মাকে এমন করে বিদ্ধ কর? আত্মজ বকুও। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ তো নেই সরমার। মিলন তা জানে, তবু বলে।

—তার জন্যে অনেককাল বসে থাকি না। সে বাড়িতে আসে না, এলেও আলাদা চাবি আছে, ওর ঘরেই চলে যায়। বাড়িতে আসেও কম, খায় না তো বহুকাল…

…. তবু তার জন্যে তুমি এখানে…

সরমা শ্রান্ত গলায় বলেন, চাকরি একটা করি। তোমার বাবার পেনশানটাও পাই … তার টানে পড়ে থাকি না।

—চাকরি করার দরকার কী?

—নিজের জন্যে। সে তুমি বুঝবে না। লিলি চাকরি করে কেন? তুমি তো অনেক টাকা পাও!

মিলন অবাক হয়ে যায়। লিলি ওর কাছে এমন অনন্য এক মেয়ে, যে লিলির সঙ্গে কারো তুলনা চলে এ মিলন ভাবতেই পারে না। মা যে কী!

শিশুকে বোঝাবার মতো ধীর গলায় ও বলে, মা! লিলি একটা নামকরা বড় ফার্মে রিসেপশানিস্ট। আমার সঙ্গে আলাপ হয় যখন, তখনি ও তিন হাজার টাকা পেত।

—আর আমি একজন ডাক্তারের প্রসূতিসদনের আপিসে বসি, মাইনে পাই চারশো!

—সে কথা নয় মা… সে তো লিলিও তোমার খুব প্রশংসা করে, নিজের মাকে কত বলে, তুমি শুধু দোকানে যাও! হাবিজাবি কেনো আর টিভি দেখো,—দেখো তো আমার শাশুড়িকে। এখনো কি চমৎকার কাজ করছেন, একেবারে স্বাবলম্বী।

সরমা লিলিকে জীবনে বার তিনেক দেখেছেন। লিলির মা, ওষুধ দোকানমালিক লিলির দাদা, এদের একবারও দেখেননি।

কাজ করা মানে স্বাধীনতা। কাজ করেন বলে তাঁকে ছেলেদের ওপর নির্ভর করতে হয় না। মিলন তা বুঝবে না। ওর কাছে লিলির কাজটা ‘কাজ’, কেননা তাতে টাকা অনেক। সরমার কাজটা সম্ভবত ‘অকাজ’।

মনের ভেতরের মনটা মরে গেছে বলেই জানতেন। যেদিন বকু বাসস্ট্যান্ডে গ্যারেজ মালিক লালু সাহাকে খুন করল এবং প্রমাণাভাবে খালাস হয়ে সগর্বে ঘুরে বেড়াতে থাকল, সেদিনই সরমার মনটা নিঃশেষে মরে যায়। বকু নিশ্চয় একজন সমাজবিরোধী।

সে ভাড়া খাটে দাম নিয়ে। ভাড়াটে গুণ্ডা সে, ভাড়াটে খুনী।

অথচ তার কাছেই আসে সবাই। বেশ একজন মাননীয় লোকের কাছে আসছে। অনন্তপুর টাউনের সমাজে বকুর সঙ্গে শত্রুতা করে কেউ টিকতে পারে না। অনন্তপুরে বকু ”বকু বাবু”।

এখানেই তো সরমার মনে যত প্রশ্ন। বকু সমাজবিরোধী। সমাজের শত্রু সে। কিন্তু অনন্তপুরের সমাজে বকু একজন অত্যন্ত দরকারী লোক।

কেন?

কেন তাকে নেতারা মান্য করে? বাপের বয়সী নেতারা বকুর ঘাড়ে হাত রেখে হাঁটে? বকুর দুর্গাপুজো এ টাউনে বিখ্যাত। পয়লা জানুয়ারি বকুর ক্লাবে বিশাল ধুমধাম ফাংশান হয়।

সমাজবিরোধীকে নেতাদের এত দরকার?

সমাজবিরোধীকে পুলিশ এত খাতির করে?

এ টাউনে সরমার মত সুরক্ষিত কেউ নয়। বকুর মা তিনি!

এ সব কথা ভাবেন যখন …. মিলনকে কি বলবেন। এখানে তুই খুব নিরাপদ মিলন। কি এখানে, কি বহরমপুরে বকুর ভাই খুব নিরাপদ।

কেননা ”বকু” একটি আতঙ্কের নাম।

—কী ভাবছো, মা?

—কিছু না। খেতে আয়। ভোরের বাস ধরবি। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়।

সরমা আর মিলন এক টেবিলেই বসেন।

খেতে খেতে মিলন বলে, একা থাকো, ভয় করে না? সরমা ক্ষীণ হাসেন।

—বকুর মা—হওয়া এ টাউনে খুব নিরাপদ মিলন। আমার কিছু হবে না।

—আমার। আমার কি ইচ্ছে করে না, লিলিদের নিয়ে ঘুরে যাই? কিন্তু দাদা এমন একটা নাম করেছে … আমারই ওকে ভয় করে।

—না। বলতে হবে না, বুঝি।

—খবর তো বহরমপুরেও যায়। এর চেয়ে বিয়ে টিয়ে করে… টাকাও তো করেছে।

সরমার মনে হয়, কোন মেয়ের যেন বকুর মত স্বামী না হয়।

তিনি বলেন, রুটিটা নতুন গুড় দিয়ে খা।

—হ্যাঁ….. কী যে হল তখন …. কে ডাকল…

—ডাকল অতসী। এখন ভেবে লাভ নেই। সকালেই জানা যাবে।

—ওরা তো সেই কুলডাঙায় আছে।

সেখানেই।

—বহুকাল দেখি না।

—আমি দেখি, আমার কাছে আসে।

—তোমাকেই বা ডাকবে কেন?

—অনেক কাল ধরে আমাকেই তো ডাকে। আমার কাছে ছিল। আমিই ওকে প্যারামেডিক্যাল পড়তে পাঠাই। আমার কাছে থেকেছে মাঝে মাঝে।

—ওদের জমি নিয়ে তো মামলা চলছিল। মামলায় কী হল?

—জিতেছে, জমি দখল নেয়ার জন্যে ছুটছিল। ওর কথা থাক, আমার ভাল লাগছে না।

—এখন আর আসে?

—তত সময় পায় না।

—না এলেই ভাল। ওর রেপুটেশান তো…

সরমা বলেন, ওগুলো রটনা। যা জানিস না তুই … ভাসা ভাসা শুনে … ও রেবতীর মেয়ে!

—যাক গে, আমার আর কী! এমনি জিজ্ঞেস করা!

সরমা বলেন, ও রেবতীর মেয়ে শুনেও তুই…. সে সময়ে রেবতী না থাকলে তোর আর আমার কি হত? অনেক উপকার পেয়েছিস মিলন…

মিলন যেন হতবাক। আসলে মিলন তো অন্য প্রজন্মের ছেলে! উপকার পেলেই তা মনে রাখবে তা মিলন জানে না।

সরমা কি মিলনকে কিছুই শেখাতে পারেননি? কাদের জন্যে সরমা এমন করে লড়াই করলেন?

ভাল কথা, লিলির দাদা আরেকটা ওষুধের দোকান করছেন, আমি পার্টনার হব।

—বললি তো তখন।

—টাকা এখন ওষুধের দোকানে…. বছর খানেকের মধ্যে কলকাতায় ফ্ল্যাট না করি তো… এ বাড়ির দাম এখন কত?

—জানি না। আমি মরে গেলে তোমরা বাড়ি বেচে দিও। তখন দাম জানতে পারবে।

—দাদার সঙ্গে আমি কোন ডিলিংসে যাব না। টাকা তো অনেক করেছে, আমাকে আমার শেয়ার বলে যা দেবে, ক্যাশ চাইব।

—আমাকে শোনাচ্ছিস কেন?

—মা! তোমার সঙ্গে তো দাদা কথা বলে…..তুমি একটা সময়ে যদি বলে রাখো…

সরমা মুখ তুলে তাকাল। মিলনের চোখে কি প্রত্যাশা। মিলন নিরীহ, ভাল ছাত্র ছিল, ভাল কাজ করে। বিয়ে করেছে, বউ ছেলেকে ভালবাসে, বউকে ভয় পায় খুব। এ বাড়ির ভাগ না হলেও ওর চলে যায়। কিন্তু ভাগের টাকাটা ও চায়। আজকাল সবাই চায়, টাকা চায়।

—আমার সঙ্গে ওর কথা হয় কখন, যে বলব? আচ্ছা মিলন! তোর বাবা বাড়িটা করলেন, কত আশা ছিল তোরা থাকবি। বাড়িটা রাখা যায়, এমন কথা তোর মনে হয় না? বেচে দেবার কথাই ভাবিস।

—দাদার মনে হয়?

—বকু তো আমার হিসেবের বাইরে।

—দাদার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয় মা। তুমি আলাদা। তুমি যতদিন থাকবে, আমি টাকা পাঠাব। আসব, যাব। তবে ভয় তো দাদাকে। আর বাইরে পরিচয় দিতেও লজ্জা করে। লিলিকে নিয়ে এলাম সকালে, সেদিনই দাদা বাস দাঁড় করিয়ে একটা মেয়েকে নামিয়ে…. পরদিন ভোরে আমাকে পালাতে হয়েছিল মা।

—জানি। তোর পালাবার জায়গা আছে … তুই পালাতে পারিস। আমার জায়গা নেই। বেঁধে মার খাই।

—তুমি চলে আসতেই পারো। আমি তো বলেছি…

—হ্যাঁ, মনে আছে।

—তোমার জন্যেই ছুটে ছুটে আসা….

—তাও জানি। চল হাত ধুয়ে নে।

মিলন হাত ধোয়। রান্নাঘরটা বন্ধই থাকে এখন, বন্ধ থাকে দোতলার ঘর ও ছাত। বারান্দার কোণেই রান্না করেন সরমা। বাড়ি খুব বড় নয়, তবু মনে হয় কত বড়। তাঁর বাড়িতে রাতে কেউ থাকবে না। কোন কাজের লোক।

বকুর বাড়িতে থাকবে কে? কোন ভরসায়? সরমা কি জানতেন, মেয়েদের বিষয়ে ওর এমন হিংস্র লোভ জন্মাবে? মেয়েদের বেইজ্জত করে ও এমন আনন্দ পাবে?

জানতেন না।

অতসীর একদিনের চাপা আর্তনাদ ও মিনতি মনে থাকবে। না বকুদা। তোমাকে আমি ‘দাদা’ বলেছি।

সে অনেকদিন আগে। সরমা যেন বাঘিনী হয়ে গিয়েছিলেন।

বকুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন, অতসীকে টেনে এনেছিলেন নিজের ঘরে। বকুকে বলেছিলেন, বেরিয়ে যা তুই এ বাড়ি থেকে।

উত্তরে বকু বলেছিল, তোমার বাড়ি? টাকা নিয়েছো, টাকা দাও চলে যাচ্ছি।

—কিসের টাকা?

—কেন, নতুন ঘর তুললে। দোকান ঘর করলে। সে সময়ে অনেক টাকা নিয়েছো।

—টাকা দিইনি?

—যা দিয়েছো, তার চেয়ে বেশি নিয়েছো।

—দেব, বাড়ি বেচে তোর ধার শোধ করব।

বকু হঠাৎ মুখ ঢেকে মুখোশ পরে নিয়েছিল। অন্যরকম গলায় বলেছিল কেন ঝামেলা করছো? অতসী…. অতসীর সঙ্গে আমি ঠাট্টা করেছিলাম!

সরমা দরজা বন্ধ করে দেন। অতসীকে বলেন, সকালেই তোকে পৌঁছে দিয়ে আসব। এ বাড়িতে আসিস না আর দরকার হলে প্রসূতিসদনে যাস।

—হ মাসিমা, তাই যামু।

পরদিন অতসী চলে যায়। অতসীকে কাছে পেয়ে সরমা বড় স্বস্তি, বড় শান্তি পেয়েছিলেন। রাখতে পারলেন না। সারাজীবন খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছেন আর সে খড়কুটো ভেসে গেছে।

এখন একজন প্রৌঢ়া ঠিকে লোক সকালে কাজ করে দিয়ে যায়। সরমা বাকি কাজ নিজেই সেরে নেন।

মিলন হাত মুখ ধোয়। দাঁত মাজে। লিলির শাসন বড়ই কড়া, কোন রকম নড়চড় হবে না। তবু ভাল। মিলন শান্তিতে আছে। লিলির কাছে আত্মসমর্পণেই ওর শান্তি।

—চল শুবি চল।

দরজা বন্ধ করেন সরমা। নিজের ঘরে ঢোকেন। একা শোবার ঘরে পালঙ্কটা খুবই বড়। স্বামী রাত জেগে বই পড়তেন। হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর, অতসী যখন এসে থাকত তখন এখানেই ঘুমোত। সরমার ইচ্ছে ছিল, ক্রমে ক্রমে অতসী এখানেই থাকবে। এখান থেকেই কাজ করতে যাবে। বিয়ে হলেও যাবে—আসবে। কিন্তু তা হতে দিল কোথায়?

মিলন বোঝে না, ওর পালাবার জায়গা আছে। সরমা কোথায় পালাবেন?

বকু আর মিলন যেন দুই মেরুর মানুষ; স্বামীর ছবির দিকে তাকান সরমা। কেন ওরা ওই রকম, কেন বকু বাড়ির টাকা চুরি করত? স্কুল ছেড়েছিল। কেন? ব্যায়াম করত, খেয়ে খেয়ে স্বাস্থ্য ও শক্তি বাড়িয়েছিল। আঠারো বছর বয়স থেকেই সাইকেলের চেন হাতে জড়িয়ে মস্তানি করে বেড়াত।

পুলিশ তুলে নিয়ে যেত।

বাবা ছাড়িয়ে আনতেন।

চেষ্টা কি কম করেছেন? মোটর গ্যারেজে কাজ শিখতে দিয়েছেন, বলেছেন, হাতের কাজ করা খুব ভাল। তাতেও মানুষ খেটে খেয়ে বাঁচতে পারে।

বকু মোটর পার্টস বেচে দিয়ে টাউন ছাড়ে।

সে সময়েই অবনীবাবু বকুকে ফিরিয়ে আনে টাউনে। বলে, সুধন্যবাবু! বকু একটা তরুণ ছেলে। ওদের এ সব দামালপনা হল ফাসটেশানের কারণে।

—কিসের ফ্রাসট্রেশান সার? আমি একটা চাকরি করি, যে ভাবে হক, গ্রামের সম্পত্তি বেচে এ বাড়িটা করেছি … ছেলেদের পড়াশোনা, খাওয়া—পরা, কোন কষ্ট রাখিনি। এমন নয় যে ওকে সংসার চালাতে হয়।

অবনীবাবু তখন কংরেস রাজনীতি করে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অনন্তপুরের যে কোন অবদান ছিল এ কথা কেউই জানত না। অবনীবাবু যে রাজনীতি করত তাও কেউ জানত না। কিন্তু স্বাধীনতার সময় থেকেই অবনীবাবু রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে। স্বাধীনতার বয়স তখন একত্রিশ, অবনীবাবু তখন তিনটে নির্বাচন পার করেছে। সে নির্বাচনে দাঁড়ায় না, নির্বাচন জেতায়।

অবনীবাবু ‘র—ফলা’ যুক্ত শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। বকুর বাবার কথা শুনে সে ঈষৎ হাসল।

—কিসের ফাসটেশান? দেখুন অল্প বয়সে সকলেরই মনে কোন না কোন ডিম থাকে।

—ডিম?

—স্বপ্ন, স্বপ্ন! আমার আপনার ডিম ছিল বিটিশকে তাড়াব। আমার বাবার ডিম ছিল আমাকে উকিল বানাবেন। মানুষের ডিম থাকে।

—বকু কি বলেছে কিছু?

—ওদের বলতে হয় না। ওদের মুখ দেখেই বোঝা যায়।

হঠাৎ অবনীবাবু জনসভায় বক্তৃতা করার ঢঙে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর এত বছর কাটল! যুবকদের চারদিকে শুধু হতাশা আর হতাশা! শিক্ষকরা আদর্শচ্যুত। নেতারা উদাসীন! যুবকদের মনের স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে! অথচ যুবশক্তি এখন আসল শক্তি। ওদের কাজে লাগাতে হবে।

সুধন্যবাবু হাত তুলেছিলেন।

—কাজে লাগাবেন? বকুকে?

—ওদের সকলকে।

—কী কাজে লাগাবেন?

রাজনীতিতে জয়েন করুক। টেম্পোরারি হলে হবে না, প্রাণমন দিতে হবে। নেতাজি বলেছিলেন, রক্ত দাও, আমি ফিডাম এনে দেব। আমি বলি, আমাকে মদত দাও, আমি তোমাদের ডিম ফিরিয়ে এনে দেব।

—তা দিন। বকুকে…. আপনি যদি …. বড় ছেলে … ও যদি সংসারের কথা না ভাবে……

—ভাববেন না।

—কিন্তু গ্যারেজমালিক যে কেস করেছে?

—লালচাঁদ তো? ও আমাদের দলে আছে, ওসব আমি ঠিক করে নেব।

—পুলিশ শুনবে?

—পুলিশকে বোঝাতে হবে। যুবকদের সামান্য অপরাধে কড়া শাস্তি দিও না। তাদের একটা চানস দাও! সে আমি বুঝব।

—বেশ! আমি চলি।

—এখন বাড়িতে কোনও মুখ করবেন না।

—কে ওকে মুখ করে? আমি করি না, ওর মা তো কথাই বলে কম। আর চেঁচিয়ে কথা বলা তার স্বভাবেই নেই। মিলন একেবারেই অন্যরকম।

—জানি জানি, ফাস্ট হয় ক্লাসে। আচ্ছো আপনি আসুন তবে।

সুধন্যবাবু বাড়ি এসে সরমাকে বলেছিলেন, মিলন ছোট, ওর স্বপ্নও অনেক। ওর কথাই ভাবো।

—অবনীবাবু কেন ডেকেছিল?

—সে বকুর ঠিকা নিল। মানুষ ঠিকাদারি করে না? অবনীবাবু ছেলেদের ঠিকা নিচ্ছে।

—বকুকে দিয়ে ভোটের কাজ করাবে?

—যা হয় করাবে। আমি ভাবতে পারি না আর। কেন, কী কারণে বকু আমাকে এমন কষ্ট দিচ্ছে! আমাদের বংশে কেউ এমন ছিল না। তোমার বা কী দোষ, ভেবে পাই না। কর্মফল? কোন কর্মের ফল এটা? কবে কাজে ঢুকেছি। গ্রামের জমিজমা, বাড়ি পুকুর বেঁচে ছেলেদের টাউনে পড়াব বলে টাউনে বাড়ি করেছি। জীবনে বিলাসিতা করিনি. …. কী দেখলে বকু জন্ম থেকে। কী হল তার।

সরমা বলেছিলেন, ভেবো না। যা হবার তা হবে।

—থাকত তেমন আত্মীয় কেউ, পাঠিয়ে দিতাম দূরে।

”দূরে” বলতে সুধন্য আর সরমা বুঝতেন কলকাতা, বম্বে, দিল্লি, পাটনা। অনন্তপুরে তখন সবচেয়ে দেশ—বেড়ানো লোক ছিল রতন ডাক্তারের ছোট মেয়ে ও জামাই। জামাই রেলে চাকরি করত, পাশ পেত। তাই সপরিবারে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। গল্প করত, একবার কন্যাকুমারিকা দেখে আসব, আর রামেশ্বর সেতুবন্ধ। তাহলেই ভারতভ্রমণ পুরো হয়ে যাবে।

সেই রতনবাবুর ছেলেও ডাক্তার। তার স্থাপিত প্রসূতিসদনেই সরমা কাজ করেন।

যা ছিল দূর, তা এখন কাছে।

অনন্তপুরেই কত জনের ছেলে বা মেয়ে এখন লন্ডনে বা আমেরিকায় বা জার্মানিতে থাকে। রতনবাবুর ছেলে প্রদীপ্ত তো ভাইয়ের কাছে কয়েকবার গেল আমেরিকা। আর সরমার যা যা কাছে ছিল, সবই দূরে চলে গেল।

সবচেয়ে অতর্কিতে, বিনা নোটিশে চলে যান সুধন্য। তিরিশ বছর বিবাহিত জীবন তাঁদের। একবারই সুধন্য সরমাকে ছেড়ে থেকেছিলেন।

যখন বাবা—মার পিণ্ড দিতে গয়া যান পাঁচ দিনের জন্যে। নইলে কখনও ছেড়ে থাকেননি সরমাকে।

বড় শান্ত মানুষ ছিলেন, বড় অল্পে পরিতৃপ্ত।

আগে কাজ করতেন ছগনলাল জৈনদের এস্টেট আপিসে। তারপর জমিদারি ব্যবস্থা চলে গেল। ছগনলাল’জৈনরা অনন্তপুরে বাসের ব্যবসা খুললেন, সরকারি কন্ট্রাকটর হলেন, জৈন অ্যানড জৈন আপিসেই থেকে গেলেন সুধন্যবাবু। ছগনলাল জৈনই ওঁকে ঢুকিয়ে দেন ফুড সপ্লাই আপিসে। তখন লোক ঢোকাবার ক্ষমতা ওঁর ছিল। কংরেস দলের ভোটে টাকা ঢালতেন। বিকল্প শাসন চালাতেন।

সরকারি কাজ বছর পনেরো করতে করতেই সুধন্যকে বুড়ো করে দেয় বকু।

বকু ও তার সঙ্গীরা অবনীবাবুর বলে বলীয়ান। বাজার থেকে, দোকান থেকে তোলা ওঠাত।

ওয়াগন থেকে মাল সরাত।

নির্বাচনের সময় গ্রাম থেকে লরি বোঝাই লোক আনত। সর্বদাই ওর পকেটে পয়সা থাকত। টাউনে ঘুরত প্রথমে সাইকেলে, পরে মোটর সাইকেলে, চোখে কালো চশমা পরে।

ফুড সাপ্লাই গুদাম করার ঠিকাদারি যখন অবনীবাবু পেল ছগনবাবুকে টপকে, বকু হয়ে গেল সুপারভাইজার। ওই গুদাম সে সময়ে একটা ভয়ের জায়গা হয়ে ওঠে। ওপার বাংলা থেকে মেয়ে নিয়ে এসে এ শহরে গণিকাপট্টি খোলার কৃতিত্বও বকুর। মেয়েদের ওরা গুদামেও আনত।

এমন কত কাজে বকু পথিকৃৎ। এখন খুন, জখম, মস্তানি, মেয়েদের মাংস নিয়ে কেনাবেচা তো চারদিকে। এ ঢাউনে এ সব কাজে পথ দেখাল বকু।

সুধন্যবাবু যেদিন শুনলেন, পোস্ট মাস্টারের মেয়েকে রাস্তায় টানাটানি করেছে বকু, সেদিন তিনি থানায় ছুটে গিয়েছিলেন!

—আপনারা কী করেন? টাউনে মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে এমন কাণ্ড? গ্রেপ্তার করুন দোষীকে।

—আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন।

—হব না? আমার ছেলে এতে জড়িত!

—বকুবাবু তো সিনেমা দেখছিলেন।

—কিসের সিনেমা দেখছিল। অন্য ছেলেরাই তো একে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। ওরা বকুকে দেখেনি? এই কিশোর, পার্থ টাউনের ভাল ছেলে এরা মিথ্যে বলবে?

—আপনি বাড়ি যান।

বকু এ সময়ে ‘কে, কে রংবাজি করছে?’ বলে মঞ্চে ঢুকেছিল এবং বাবাকে দেখে বলেছিল, তুমি এখানে কী করছো? যাও, বাড়ি যাও।

—পাপিষ্ঠ! তুই ক্ষমা চা মেয়েটার কাছে, পা ধর। বকু বলেছিল, কাকে কী বলছো? মেয়েছেলে যদি ওখানে তার লাভারকে মিট করতে যায়, সে বেলেল্লাপনা সওয়া যায়? তোমরা কেন এসেছো ভাই? কেটে যাও, সরে পড়ো। টাউনের ভাল ছেলে তোমরা!

মেয়েটি কাঁপতে শুরু করেছিল। বলেছিল, আমি কোন রিপোর্ট লেখাতে চাই না, আমি বাড়ি যাব।

দারোগা বললেন, এই তো সুবুদ্ধির কথা। এ সব নিয়ে যত কচলাবেন তত তিতো হবে।

পথিক বলল, রীতা! উঠে আয়। এতে লাভ হবে না কিছু।

মাঝখান থেকে—

বকু বলল, ঠিক বলেছিস পথিক।

—তোর সঙ্গে কথা বলছি? বকু, চুপ কর।

কিশোর কিছু বলে না, চেয়ে থাকে। ভ্রূ কুঁচকে, গভীর অভিনিবেশে।

সুধন্যর বুকে শ্মশানের বাতাস বয়ে যায়। এরা তো এক সময়ের ছেলে, মোটামুটি এক বয়সীও। সুধন্যর ছেলে মেয়েদের বেইজ্জত করে, এরা তাকে বাঁচায়। কিন্তু অবাক হয়ে শোনে যে তিনিই বলেছেন, করুক, রীতা নালিশ করুক। আমি সাক্ষী দেব।

দারোগা বলেন, অ্যাকট ইওর এজ মশাই। আপনি জানেন কিছু? ছিলেন ওখানে? ৩৫৪ ধারা প্রমাণ করতে পারবে রীতা? আইনের বোঝেন কিছু?

বকু বলে, বাড়ি যাও, বাড়ি যাও। বুড়ো হয়েছো, বাড়ি গিয়ে হরিনাম করো গে।

—ক্ষমতা থাকলে আমি—ই … সুধন্য আপন মনে বলে যান নিজেকেই আমরা জানতাম, ছেলেমেয়েকে সম্মান করতে হয় … সে কারো মেয়ে, কারো বোন… আমি পাপ করেছিলাম কিছু। ও….

মাথা টলে যায় ওঁর।

পথিক বলে, উঠুন মেসোমশাই। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাই। কিশোর, রীতাকে বাড়ি নিয়ে যা।

—চল, তাই চল।

বকু চেয়ার টেনে দারোগার দিকে ঝুঁকে বসে।

—লিখিয়েছে কিছু?

—আপনি যান বকুবাবু। আমার কাজ আছে।

—আরে, আমার যে কথা আছে!

বেরিয়ে এসে ওরা সাইকেল রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে থাকে।

সুধন্যবাবু মাথা নাড়তে থাকেন, নাড়তে থাকেন। বিড়বিড় করে বলেন, যুবকরাও নড়ে না। তারা এক হলে কি বকুদের এত দর্প বাড়ে।

কিশোর ক্রুদ্ধ হেসে বলে, যুবকরা ওদের ঠেকাতে একত্র হলে পুলিশ তাদের ধরে মেসোমশায়।

—পারত, তারা পারত। আমার ক্ষমতা থাকলে আমি বকুকে মেরে জেলে যেতাম … ভয় পাই। ওর দেহে শক্তি বেশি, আর মন বলতে কিছু নেই…

কিশোর বলে, পার্থ তুই রীতাকে নিয়ে যা। আমার মনে হচ্ছে ওঁর শরীর ভাল নেই…

হঠাৎ অনন্তপুরে বাজারের বাস স্ট্যান্ডে দোকানে আলো, দোকানে রেডিওতে ‘জয়মালা’ প্রোগ্রামে ”ও দুনিয়াকে রাখওয়ালে” বাজছে, সাইকেল ও সাইকেল রিকশা চলেছে, এমন মঞ্চে সুধন্যবাবু মাটিতে বসে পড়েন রীতার পা ধরে।

হাহাকার করে বলেন, পাপী শাস্তি পেল না। ওই পাপের জন্মদাতা আমি! তুই আমাকে লাথি মার মা, তুই আমাকে শাস্তি দে, শাস্তি দে….

সুধন্যবাবু খোয়ো—ওঠা বেমেরামতি রাস্তায় মাথা ঠুকতে থাকেন।

লোকজন ভিড় করে, সরে যায়। টাউনের প্রচার ব্যবস্থা খুব পাকা। একঘণ্টার মধ্যেই সবাই জেনে গেছে যে রীতাকে বকু টানাটানি করছিল, কিশোর ও পথিক তাকে উদ্ধার করে ও থানায় নিয়ে যায়। বকুর বাবাও সেখানে গিয়েছিলেন।

দৃশ্যটি নাটকীয় সন্দেহ নেই। লাঞ্ছিতা মেয়েটিকে তাঁরই গায়ে লাথি মারতে বলছেন বকুরই বাবা। পাপ যে করেছে সে পাপীকে শাস্তি দিতে পারো না যখন, পাপীর জন্মদাতাকে লাথি মারো, লাথি মারো…

কিন্তু দর্শকরা এটাও জানে যে ঘটনার নেপথ্যনায়ক বকু; ‘বকু’ নামের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছুতে থাকা বিপজ্জনক। দর্শকরা সরে যেতে থাকে।

পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে আসেন কমলেশবাবু, জরুরি অবস্থায় জেল খেটে বেরিয়েছেন, অনন্তপুরে তিনশো ভোটে আর এস পি—র কাছে পরাজিত হয়েছে, প্রবীণ, রাশভারি মানুষ।

—কী, কী হয়েছে! সরে যান সবাই।

কিশোর ওঁকে দ্রুত কী বলে নিচু গলায়। তিনি বলেন, তুমি রীতাকে নিয়ে যাও। রিকশা ডাকো, সুধন্যকে ডাক্তারখানায় নাও। এঃ! লোকটা ছেলের কারণে মুখ নিচু করে চলে, খুব সজ্জন!

রীতা নিচু হয়ে সুধন্যবাবুর হাত ধরে।

—উঠুন, উঠুন আপনি … রক্ত পড়ছে কপাল থেকে … উঠুন! আপনি কিছু করেননি…. উঠুন!

পার্থ ও কমলেশ সুধন্যকে ডাক্তারখানায় নেয়। রক্তটা বেশিই পড়ছে একটু।

কিশোর রীতাকে নিয়েও রিকশায় ওঠে। আস্তে বলে, আমি তোমাকে ক্লাবে যেতে বলেই ভুল করেছি।

—আমিও ভুল করেছি। আসলে অফিসে ছুটি তো পাই না। ভাবলাম… মাসখানেক দেখা হয় না।

—এখন আর এখানে থেকো না রীতা। ভোরের ট্রেনেই ফিরে যাও। এখানে থাকা আর ঠিক হবে না।

—ভীষণ কথা ছড়াবে কিশোর টাউনে। বাবা বদলি হয়ে গেছে! কিন্তু লোক না এলে যেতে পারছে না। নীতা আর মিতা এখানেই পড়ছে।

কিশোর বলল, ভেবো না। পরীক্ষা দিয়েছি, কাজটা পাবই। কাজ পেলে বিয়ে করতাম, এ মাসেই রেজেস্ট্রি করে নেব।

—নীতা আর মিতাকে একটু দেখো!

—আমি কাজ পেলে ওদের শান্তিনিকেতনেই পাঠাব। দুজনের রোজগার, পারব না?

—দেখা যাক। দু’জনকে হস্টেলে দিলে খরচ আছে।

—বাবাও কিছু দেবে নিশ্চয়। নীতার জন্যে ভাবি না। শক্ত মেয়ে, সাবধানে চলতে জানে। মিতার জন্যে ভাবনা হয়। শরীর বেড়েছে, মন অপরিণত, স্বভাবটাও হয়েছে গায়ে পড়া।

—ওদের বুঝিয়ে বলে যেও।

—বলব। সর্বদাই বলি।

—বকুর মতো ছেলেদের মন তো সহজ পথে চলে না। ও তোমাকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। থানায় ওর বাবা ও সব কথা বললেন….

রীতা বলল, আমরা সবাই কাপুরুষ হয়ে গেছি খুব। ওর বাবা তো অন্যায় বলেননি কিছু…. এ কথা তো সত্যি যে যুবকরাও সত্যি করে এগিয়ে আসে না। যদি আসত, তাহলে বকুরা ভয় পেত।

কিশোর ক্লিষ্ট হেসে বলে, হ্যাঁ। স্বাধীনতার ফলে আমাদের নৈতিকতার বোধও ভেঙে গেছে। সামনে অন্যায় দেখলে পাশ কাটিয়ে যাই, মেয়েদের অপমান করতে দেখলে চুপ করে থাকি।

রীতা বলে, আমার ওপর ওর রাগ থাকল। সে রাগটা নীতাদের ওপর গিয়ে পড়লে…

—এ সব ভেবেও তো চুপ করে যেতে হয়। তবে শহর ছেড়ে যাবার আগে ওকে আমি শিক্ষা দিয়ে যাব।

—তোমার দিদি জামাইবাবু এখানে থাকে না?

—জামাইবাবু তো অবনীবাবুর ডান হাত। সাব ঠিকাদার, চোর একটা। আমি তো যাই না। দিদি কী করে বিয়েটা মেনে নিল? দোজবরে লোকটা। ছেলে মেয়ে আছে….

—মেনে নিতে হয় কিশোর। তোমার দিদির বিয়ে হচ্ছিল না, স্কুলের ক্লার্ক, চাকরি করে বিয়ের টাকা জমাত। দোজবরে হক, যা হক, টাউনে বাড়ি আছে, নদীর ওপারে ধানজমি আছে, সচ্ছল সংসার, অনুগত স্বামী …. সতীশের মেয়ে তো মামাবাড়ি থাকে।

—হ্যাঁ, দিদি চিরকালই মোটা সুখের কথা ভেবেছে। তাই পেয়েছে, সবাই জানে আমার সঙ্গে জামাইবাবুর বনে না। তাই আমি বকুকে মারলে, বকু দিদিদের কিছু বলবে না।

—নীতা আর মিতার কথা ভেবেও তুমি তোমার রাগ সামলে রেখো।

—রাখব।

—মা যদি থাকত। তাহলে অনেক ভরসা পেত বাবা। কী করে জানা যাবে ক্যানসার? ডাক্তাররাই ধরতে পারেনি।

—ক্যানসার তো সর্বত্র।

—শহরে খুব ক্যানসার হচ্ছে?

—শহরে, গ্রামে, সর্বত্র। ক্যানসার ধরেছে সমাজদেহে। নইলে এত নোংরা হয়ে যায় সব?

—বকু? ওকে কবে থেকে দেখেছি! ও কী করে…

রীতা কেঁদে ফেলে এতক্ষণে।

—আমার… নিজেকে…. এমন… অশুচি…. লাগছে….

রিকশা দাঁড়ায়। কিশোর রীতার হাত ধরে নামায়, ভাড়া দেয়।

রীতার বাবা যেহেতু অনন্তপুরে পোস্টমাস্টার, ওঁর বাড়িটা সেকেলে বাংলার অর্ধেক অংশে। বাকি অর্ধেকে পোস্টাফিস। পোস্টাফিসের জন্য নতুন বাড়ি উঠেছে। এই পুরনো বাড়ি নাকি ভাঙা হবে।

—চোখ মোছো রীতা।

—সুধন্যবাবু আমার পায়ে…

—কী যন্ত্রণা পাচ্ছেন উনি। তাই ভাবো!

.

—যন্ত্রণা, যন্ত্রণা, ভীষণ যন্ত্রণা সরমা?

—কোথায় যন্ত্রণা?

—দেহে নয়। মনে…

কমলেশবাবু বললেন, পার্থ! ওঁকে শুইয়ে দাও, এতটা উত্তেজনার পর…

সরমা সুধন্যবাবুকে ভেতরে নিয়ে যান। কমলেশবাবু বলেন, আমি গেলাম।

—আমিও যাব।

সরমা এসে দাঁড়ালেন।

—কী হয়েছে, বলে যাও পার্থ।

অপ্রতিভ পার্থ বলে, কাল বলব এসে। আজ একটু তাড়াও আছে। ডাক্তার দেখেছে…ওঁর প্রেসার কিন্তু বেশি।

—মাথা ফেটে গেছে?

—না… হঠাৎ মাথা ঘুরে …. আজ আসি।

—যাক। খুব উপকার করলে বাবা।

—আপনি ওঁর কাছে যান।

সরমা দরজা বন্ধ করে স্বামীর কাছে এসে বসেছিলেন। বিচলিত হয়ে চেঁচামেচি তিনি কোনদিন করেন না। আজও মনে আছে, সুধন্য চোখ বুজে শুয়েছিলেন।

—এখন একটু ভাল বোধ করছো?

—ভাল?

সুধন্যর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। হতাশ, শূন্য গলায় বলেছিলেন, কাল কী হবে সরমা? কেমন করে মুখ দেখাব শহরে?

—কী হয়েছে?

—পোস্টমাস্টারের মেয়ে রীতাকে ওই গুদামঘরে নিয়ে তুলেছিল বকু। ভাবতে পারো? পার্থ….. কিশোর…… ওরা এসে পড়ল বলে….

—রীতা কে?

বুদ্ধিমতী ভাল মেয়ে রীতা! কলকাতায় টেলিফোন অফিসে কাজ করে। কিশোরের সঙ্গে ভালবাসা ওর। কিশোরও ভাল ছাত্র ছিল। এম এস সি পাশ করে কী সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে, পাশ করবে, কাজও পাবে। কিশোর আর পার্থ এ শহরের ভাল ছেলে। পার্থ তো বহরমপুর কলেজে কাজও পেয়েছে, আসছে মাসে জয়েন করবে।

টাউনের…. ভদ্রলোকের মেয়েদের…. আমি দারোগাকে বললাম, ওকে ধরুন! দারোগা… দারোগা বলল, কী বলব? বকুকে নির্দোষ বলল!

—বকু কি… রীতাকে…

—না… ইজ্জত নিতে পারেনি। এরা ছিল… কিন্তু এরপর? কেমন করে পথ দিয়ে হাঁটব, কাজে যাব, বলতে পার? মিলন বা পড়তে যাবে কী করে?

—তুমি ওষুধ খেয়েছো, ঘুমোও।

—ঘুম আসবে?

একটু কিছু খাও খেলেই ঘুম আসবে।

—খাব না।

সরমা শক্ত গলায় বলেছিলেন, হ্যাঁ, খাবে। খেয়ে ঘুমোবে। একটা অমানুষের জন্যে বাড়িতে আর সবাই কি মুখ লুকিয়ে থাকবে? উপোষ করে মরবে?

—দরজা বন্ধ করো, বকু যদি আসে! সে শুনলে…

—এলে আমি দেখব।

দেখতে হয়নি সরমাকে। বকু সে রাত্রে ফেরেনি। সকালেও ফেরেনি।

বেলা আটটা নাগাদ খবর এসেছিল, মিলন খবর এনেছিল।

—মা! কী হয়েছে শুনেছো?

—কী হয়েছে?

—দাদা… দাদা আর নেপালকে মেরেছে কারা যেন গুদাম ঘরের কাছে।

—মেরেছে?

হ্যাঁ হ্যাঁ, হাত ভেঙে দিয়েছে, এলোপাথাড়ি পিটেছে, ওদের হাসপাতালে নিয়ে গেছে মা! আর অবনীবাবু বলছে, এ নিশ্চয় পার্থদার কাজ।

সরমা নির্বাক।

—আমি হাসপাতালে যাব মা?

—না।

সরমা গর্জে উঠেছিলেন।

—তুমি তোমার কাজ করবে, পড়তে যাবে। বাবার আপিসে বলে যাবে যে বাবা আজ যাবে না, কয়েকদিনই যাবে না, প্রেসার বেড়েছে খুব।

সুধন্য উঠে এসেছিলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিলেন, মেরেছে? পার্থ বকুকে মেরেছে?

—হ্যাঁ বাবা।

—যাক, তা হলে কিছু ভরসা আছে! ছেলেরা সবাই অমানুষ হয়ে যায়নি। খুব ভাল, খুব ভাল!

বেশ কিছুদিন অনন্তপুর গরম হয়ে থাকল। বকুর খবরের জন্যে সরমার মন ব্যাকুল হত। ভাবতে চেষ্টা করতেন, এবার বকু বদলে যাবে।

সুধন্যবাবু শুধু বলতেন, ওই ছেলে কেন এমন হল বলতে পারো? মেয়েদের ইজ্জত নেয়, …. কোন বংশের ছেলে সে? কিছুই মনে রাখল না? শুনেছি, অনেক পাপের ফলে এমন কুলাঙ্গার জন্মায়…..

—তুমি শান্ত হও।

—কেমন করে?

মিলনের কথা, আমার কথা তো ভাববে….

—তোমার কথাই ভাবি।

—যাক, ঘুমাও একটু।

—ঘুম তো হয় না!

সরমার বুকে পাষাণ চেপে বসত। বকুর কথা ভাবলে শিউরে উঠতেন অথচ তার কথা মনে হত বারবার।

অবনীবাবু একদিন সুধন্যবাবুকে দেখতে এলেন। বসলেন, ঘরদোর দেখলেন।

—না, বাড়ি খারাপ নয়, তবে পুরনো ফ্যাশানের।

যেন বকুকে নিয়ে কোন ঘটনা ঘটেনি। যেন বাড়ির দরদাম করতে এসেছেন।

একটু বা বিস্মিত। সুধন্যবাবুর মত সামান্য মানুষ এমন বাসযোগ্য বাড়ি বানাল কি করে?

—এ হে হে, এত চওড়া বারান্দা? আরেকটা ঘর হয়ে যেত।

—ওই আর কি…

—তা, বকুর তো বেরোবার সময় হল।

—কবে বেরোবে?

সুধন্যবাবুর গলা নেমে গেল, চোখ অসহায়।

—হাসপাতাল তো টিটমেন করে ছেড়ে দিত। কিন্তু বকু বাড়ি আসবে…. আমার সঙ্গে একটা, যাকে বলে মিসান্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে আছে… আমার কথাতেই ওখেনে…

—এখানে নয়।

অবনীবাবু জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ হাসি হাসলেন।

—আপনি ও বুঝবেন না…. একটা ফলস কমপেনের ওপর… ছেলেটার ডিম সব নষ্ট হয়ে গেল….

সুধন্যবাবু বললেন, ডিম? স্বপ্ন? মেয়েটার ইজ্জত নেবে, সেই স্বপ্ন ছিল তার? একে আপনি স্বপ্ন বলবেন?

সরমা নিবিষ্ট চোখে অবনীবাবুকে দেখছিলেন।

—আ হা হা, বকু যদি গিলটি হবে, তাহলে ওই মেয়ে কি সোনা? টাউন ছেড়ে ভাগল কেন? ছোঁড়াও তো ভেগেছে।

—আমি শুনতে চাই না।

—নরম হোন। ফরগিভনেস ইজ হেভেনলি। আর… ছেলে তো আপনার দুটো। এ বাড়িতে তার দাবিও আছে।

—কিসের দাবি? বাড়ি ওদের মায়ের। আপনি, আপনি ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন কেন?

—আরে, ওরা হল ইউথ। আমরা হলাম… যাকে বলে…. আমি হলাম ডিমার… স্বপ্ন দেখি। এসব ছেলে পুলে…. ফাসটেশান… ওকে বিয়ে দিন।

সরমা এগিয়ে এলেন। স্বামীকে বললেন, তুমি একটি কথাও বলবে না।

অবনীবাবুকে বললেন, বিয়ে দেব বকুর?

অবনীবাবু বললেন, তাই দিন। দেখবেন, বকু ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

তারপর মধুর স্মৃতিতে মগ্ন হয়ে সস্নেহ হাসলেন, আমিও দামাল ছিলাম তো। বাবা কুড়ি না হতে গোয়ালে ঢোকালেন। আমিও বাঁধা পড়লাম।

—আপনাদের জমিদার ঘরে ও সব সাজে। বকুর লেখাপড়া কী, রোজগার কী, স্বভাব কী, যে ওকে মেয়ে দেবে?

—দেবে, দেবে। মেয়ে আছে!

—কে?

—সে আমি ঘটিয়ে দেব। পোস্টমাস্টারের কি একটা মেয়ে?

সরমা মাথা নাড়লেন।

—আমার ছেলে যদি পাত্র হিসেবে আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, আপনি দিতেন?

অবনীবাবু দেঁতো এবং ঠাণ্ডা হাসি হাসলেন।

—বিয়ে হয় সমানে সমানে। যাক গে! বকু বাড়ি এলে যদি এমন অশান্তি হয় …. থাকুক, আমার ব্যবস্থাতেই থাকুক।

সরমা আস্তে বললেন, আমি … আমি তাকে পেটে ধরেছি…. সে আমার ছেলে! ভাল হক… এই চেয়েছি।

—সে তা বলে না।

—আপনি. …. আপনি টাউনে ধনীমানী লোক … আপনি কেন বকুকে, ওদের বয়সি ছেলেদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন? কেন সব অন্যায়কে ঢাকছেন? চলে যাবেন না, সত্যি কথা বলুন!

অবনীবাবু তাকালেন সরমার দিকে। ওঁর গলা এখন খুব ঠাণ্ডা।

—আমার দরকার ওদেরকে।

সরমা ফিসফিস করে বললেন, দরকার ফুরিয়ে গেলে?

—তখনকার কথা তখন।

.

সময়টা অদ্ভুত ছিল।

১৯৭৭—এর নির্বাচনের পর দেড় বছর কেটেছে। সরমা জানতেন না, অবনীবাবু কত তাড়াতাড়ি ভোল পালটে নতুন সরকার সমর্থক হবে। জানতেন না রাজনীতিকদের দরকার হবে সমাজবিরোধীদের আর সমাজবিরোধীদের দরকার হবে রাজনীতিকদের।

জানতেন না, কেন না অনন্তপুর এ সবের সঙ্গে অপরিচিত ছিল। অবনীবাবুই এ টাউনে সমাজবিরোধীদের তৈরি করে। মাথায় তোলে।

‘তখনকার কথা তখন’ মানে কী?

ব্যবহার করে বকুকে ফেলে দেবে? পুরনো, বরবাদ জুতো বা ছাতার মতো?

বকুর জন্যে উদ্বেগ হয়েছিল কিছুক্ষণ।

তারপর মনে হয়েছিল, ‘পোস্টমাস্টারের কি একটা মেয়ে?’ বলল কেন? কী জন্যে বলল? পোস্টমাস্টারের তো তিনটি মেয়ে। রীতা কলকাতায় চাকরি করছে। মিতা উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে, খেলাধুলায় ভাল। সাঁতারে ভাল, ঝকঝকে মেয়ে। সাজগোজ করে না। বাজে আড্ডা মারে না, মায়ের অকালমৃত্যুর পর সংসার ওই দেখে।

নীতা ক্লাস টেনে পড়ছে। অসম্ভব বাড়ন্ত চেহারা, খুব ঝোঁক সাজগোজের। সিনেমা দেখার, রেস্টুরেন্টে খাওয়ার। বুদ্ধিও কম। পড়াশোনাতেও খারাপ।

—কী করবেন?

—পোস্টমাস্টারকে বলবেন, ‘আমার ছেলে বকু হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছে, মেয়েকে সাবধান করুন, সাবধানে রাখুন?’

কেমন করে বলবেন?

কাকে বলবেন? পার্থকে? পথিককে? কী বলবেন?

সুধন্যবাবুকে ছেড়ে যাবেন বা কী করে? ভীষণ, ভীষণ উৎকণ্ঠায় সে রাত কেটেছিল।

সুধন্যবাবু বুঝেছিলেন।

রাতে সেদিন বললেন, একটু সুজির পায়েস করবে? আর দু’খানা রুটি। নয় বেশি করেই করো। মিলনও খাবে। তুমিও খাও।

—খেতে ইচ্ছে করছে?

—খুব?

—নিশ্চয় করে দেব।

মিলন বাড়ির ভাবগতিক দেখে চুপ করে থাকত, মাথা গুঁজে খেত। বাপের কাছে বসত, হঠাৎ যেন বড্ড বড় হয়ে গিয়েছিল ছোট বয়সেই।

সরমা বললেন, মিলন! একটু সুজি আন বাবা। একটা দুধের কৌটো।

খেতে বসে মিলন বলেছিল, আজ নেমতন্ন, মা?

—হ্যাঁ রে। ভাল করে খা।

—মা! একদিন লুচি আর ছোলার ডাল করবে?

—নিশ্চয় করব। তোর বাবা ভাল হলে মন্দিরে পুজো পাঠাব, লুচি ভোগ দেব, সব করব।

সুধন্যবাবু বলেছিলেন, আর মিলন ফার্স্ট ডিভিশানে পাশ করলে আমি ওকে ঘড়ি দেব।

বেশ সহজভাবে খাওয়াদাওয়া হল। বাসন কোসন তুলে সরমা শুতে গেলেন। সুধন্যবাবু বললেন, শুয়ে পড়ি আজ। ক’দিন তো গেল! সরকারী চাকরি বলে চাকরি যায় না। নইলে এমন কামাই…

—এত বছরে একদিন কামাই হবে না?

—ভাবছি আমিও চাকরি করব। ম্যাট্রিক পাশ। ঘরে বসে থাকব কেন?

—দূর। স্বামী স্ত্রী দুজনে বাইরে কাজ করব?

—অনেকেই করছে। পার্থ বহরমপুর কলেজে পড়াবে, আর ও যাকে বিয়ে করবে সেই অনিন্দিতা তো বহরমপুর গার্লস কলেজেই ঢুকেছে।

—লেখাপড়াই সব সরমা!

—সত্যিই তাই।

—মিলনকে নিয়ে দুঃখ ভোলো।

সরমা নীরব।

—সব কি আর হয়?

—আর না, ঘুমোও।

—বাড়ি কিন্তু তোমার।

—জানি।

—এটাই তোমার সম্বল।

—তুমিই তো আছো।

—হ্যাঁ…. আছি… ঘুমোও।

সরমা আলো নেভালেন, শুলেন, কিন্তু ঘুম তো আসে না। সুধন্যবাবুর প্রেসার এভাবে বেড়ে যাবে, রাস্তায় ঘুরে পড়বেন, কবে ভেবে ছিলেন?

সেদিন রক্ত দেখে ভয় পেয়েছিলেন। ডাক্তার বললেন, রক্ত পড়ল বলে বেঁচে গেলেন। ব্রেন হেমারেজ হলে…..

সরকারি আপিস এখন, চাকরি যাবে না, সেটা সহকর্মীরা দেখছে। কিন্তু সুধন্যবাবু উঠবেন কবে?

—টাউনের বাড়ি বেচে দিয়ে, কুলডাঙার দিকে সস্তায় বাড়ি করে নিলে … মিলনকেও সারগাছি রামকৃষ্ণ হস্টেলে রাখা যায়….।

সুধন্যবাবু ঘুমিয়ে পড়েছেন।

সেই ভাল, সেই ভাল। সরমা যেন ভেসে যাচ্ছিলেন বর্ষায় ভরা গঙ্গার স্রোতে। ভাসতে ভাসতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ যেন পায়ের নিচে মাটি পেলেন। কুলডাঙাতে বাড়ি তো কম খরচেই করা যাবে। সুধন্যবাবু না হয় বাসেই যাওয়া আসা করবেন। মিলন হস্টেলে থাকবে। সেখানে ‘বকু’ শুনে চমকে উঠতে হবে না।

সরমা সকালেই সুধন্যবাবুকে বলবেন কথাটা।

কিন্তু রাতের পর কেমন সকাল এসেছিল?

ভোরবেলাই দরজায় ধাক্কা, পার্থ চেঁচাচ্ছে, বকু! বকু! বকু!

আমরা জানি তুই লুকিয়ে আছিস!

সরমা দরজা খুলে দিলেন।

ক্রুদ্ধ, বন্য, বর্বর গলা পার্থর। সঙ্গে অনেক লোক।

—বকু কোথায়?

—বাড়িতে আসেনি।

—আমরা দেখব।

সরমা সরে দাঁড়ালেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে নিথর, মুখে আঁচল। মিলন ভয়ার্ত চোখে তাকাচ্ছে।

—বাবার কাছে যা!

ওরা ওপরে উঠে যাচ্ছে, ঘর দেখছে, ছাত। পার্থ চেঁচিয়ে চলেছে, বেরিয়ে আয় বকু! তোকে খুন করে আমি ফাঁসি যাব! বেরিয়ে আয়!

সুধন্যবাবু কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসেন। সরমা দৌড়ে গিয়ে ওঁকে ধরেন।

পার্থরা নেমে আসছে।

—কী… কী হয়েছে পার্থ?

পার্থ ঘুরে দাঁড়ায়। ওর চোখ মুখ এমন হিংস্র, ক্রুদ্ধ, নির্দয়।

—মিতা, পোস্টমাস্টারের ছোট মেয়ে … সোনালীতে সিনেমা দেখে ফিরছিল। বকু ওকে তুলে নিয়ে গেছে কাল রাত সাড়ে ন’টায়।

—তার…পর….?

—আজ নদীর পাড়ে মিতার লাশ পাওয়া গেছে। রেপ করে খুন করে গেছে তাকে।

—ধর্ষণ … খুন….?

—হ্যাঁ, আপনার ছেলে। চল তোরা, ওই অবনীবাবু সরিয়ে দিয়েছে। আজ ছাড়ব না… সব জ্বালিয়ে দেব। থানাতে লাশ যাবে।

ওরা বেরিয়ে যায়।

সুধন্যবাবু চেঁচাতে যান, গলা আটকে যায়। তারপরই মাটিতে ভেঙেচুরে ঢলে পড়েন। অনেকটা বমি করে অজ্ঞান হয়ে যান।

মিলন চেঁচিয়ে ওঠে, বাবা!

—আপিসের সত্যবাবুকে ডাক মিলন, বাবাকে তুলতে হবে খাটে। বল, ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনতে।

—বাবা নড়ছে না, মা!

—যা, যা! দাঁড়াস না।

মিলন চলে যায়। উদভ্রান্ত এক কিশোর পথ ধরে ছুটে যায়, সত্য কাকা! সত্য কাকা!—ওর চিৎকার কিছুক্ষণ শোনা যায়।

আবার সব নিঃশব্দ। সকালে মধ্য রাতের নৈঃশব্দ্য। সরমার কোলে সুধন্যবাবুর মাথা। সরমা আঁচলে সযত্নে বমি মোছান। সুধন্যবাবুর শরীর আবার কেঁপে ওঠে। আবারও বমি। সরমা মুখ মোছান।

গয়লা ঢোকে পা টিপে টিপে। ভয় পাচ্ছে? এ বাড়িতে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে? মিতার কথা নিশ্চয় শহরের এদিক থেকে ওদিক অবধি সবাই জেনে গেছে।

—মা!

সরমা মুখ তুলে তাকান। গয়লার চোখে করুণা, উদ্বেগ। ও নাড়ে, মাথা নাড়ে।

—এক ঘটি জল আর গামছাটা দেবে শরণ?

বাবুজি… ছি ছি ছি … ছোট খোকা কোথায়?

—আমি তো ওঁকে তুলতে পারব না। মিলন সত্যবাবুকে ডাকতে গেছে।

শরণ দুধের ঘটিটা রান্নাঘরে রাখে, জোরে শেকল দেয়। তারপর বলে, আমি তুলে দিচ্ছি ঘরে।

—তুমি পারবে?

—পারব।

শরণ সুধন্যবাবুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়।

সরমা তাড়াতাড়ি আলনা থেকে একটা কাপড় টেনে নিয়ে বমির ওপর ফেলে দেন। বলেন, সাবধানে শরণ, পা সামলে!

বাসি বিছানাতেই শোয়াতে হয়। মশারি টেনে খুলে ফেলেন সরমা, জানলা খুলে দেন। গামছা ভিজিয়ে সুধন্যবাবুর মুখ, কপাল গা মোছাতে থাকেন।

—বাতাস করেন, বাতাস করেন মা! বাবু ঘেমে যাচ্ছেন।

সরমা বাতাস করেন, আর ঝুঁকে পড়ে বলতে থাকেন, শোনো। মিলন সত্যবাবুকে ডাকতে গেছে! সত্যবাবু ডাক্তার আনবে! শোনো! মিলন….

সত্যবাবু, ডাক্তারবাবু, কমলেশবাবু। কমলেশবাবু বলতে বলতে ঢোকেন, পার্থ এ কী করল? ইশশ! সেদিনই পথের মধ্যে… আমি প্রেসারটা দেখাতে এসেছিলাম ডাক্তারের বাড়ি….

ডাক্তার বলেন, টর্চ আছে?

মিলন টর্চ দেয়….

চোখ দেখেন। নাড়ী দেখেন। তারপর বলেন, মাথায় যন্ত্রণার কথা বলেছিলেন কি?

সরমা মাথা নাড়েন।

—ঘুম হচ্ছিল?

—না… সেদিন থেকেই ….

—হাসপাতালে নিতে হবে।

—কী হয়েছে?

ডাক্তার কাঁধ ঝাঁকাল। তরুণ ডাক্তার, টাউনে এসেছেন বছরখানেক। অনন্তপুরে ডাক্তারদের পয়সা খুব।

—মানে… মনে হচ্ছে মাসিভ সেরিব্রাল হেমারেজ। বাড়িতে কিছুই হওয়া সম্ভব নয়।

কমলেশবাবু বলেন, হাসপাতালে যাবে কী করে? হাসপাতালে তো অ্যাম্বুলেনস নেই।

সরমা বলেন, রিকশায়।

—না না, ঝাঁকি লাগবে।

—তবে?

সত্যবাবু বলেন, গোপালবাবুর গাড়িটা দেখি, সে তো ভাড়া দেয়?

সরমা লাজলজ্জা ভুলে বলেন, তাই করুন, তাই করুন….

—মিলন যে বড্ড ছোট….

কমলেশবাবু বলেন, ওঁর বা বয়স কী!

—পঞ্চাশ হয়নি….

সরমা স্বামীর দিকে চেয়ে থাকেন। স্বপ্ন ছিল অনেক সুধন্যবাবুর … অনেক স্বপ্ন … মামাবাড়িতে অবহেলা অনাদরে মানুষ সরমার বিয়ে হচ্ছিল না। সুধন্যবাবু বিয়ে করে নিজের পরিবারে অপ্রিয় হয়ে যান। দেশের ঘরবাড়ি জমিজমা বেচে অনন্তপুরে বাড়ি করলেন, উৎসাহ দিয়ে সরমাকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করালেন। সর্বদা বলতেন, পাড়াগাঁয়ে বড় হলে মন বড় সংকীর্ণ হয়। ছেলেরা টাউনে পড়বে সরমা, সুযোগ সুবিধা কত!

সুধন্যবাবুর কাছে আধাগ্রাম—আধাশহর অনন্তপুর ছিল মস্ত টাউন। বহরমপুর, কৃষ্ণনগর ছিল বিগ টাউন। কলকাতা ছিল মেট্রোপলিস।

স্বপ্ন ছিল অনেক…. বাইরের দিকে দুটো ঘর তুলে নেবেন ক্রমে ক্রমে… টাউন ডেভেলপ করবে, দেখো সরমা, জমি—জায়গার দাম বাড়বে… চোখ পড়ে বাইরে তুলসী মঞ্চের ওপর। সুধন্যবাবু নিজের হাতে করেছিলেন মঞ্চটা। তুলসীর বাতাস খুব ভাল।

সত্যবাবু গাড়ি আনেন। বলেন, মানুষ অবস্থা বিচার করে না… আরে পঁচিশ টাকা চেয়ে বসলি, মানুষের অবস্থার সুযোগ নিতে আছে? বৌঠান, আপনি যাবেন?

—যাব, মিলনও যাবে।

—চলুন তবে।

—আপনারা গাড়িতে যান, আমি নয় রিকশায়… টাকা পয়সার ব্যবস্থা…

কমলেশবাবু বলে, না! মিলন বাড়ি বন্ধ করে যাক, আমি দাঁড়াচ্ছি। আপনি যান… বউমা! নিরীহ মানুষই যত কষ্ট পায়… কিন্তু পার্থ এ কী করল! এখানে…

সরমা মাথা নাড়েন। পার্থ কোন অন্যায় করেনি। বকুকে খুঁজতে এসেছিল। বকু! তাঁর বড় ছেলে। তাঁর গর্ভজাত সন্তান। পঁচিশ বছরের ছেলে বাপ—মার ভরসা হতে পারত। পার্থ দোষ করেনি।

দোষী সুধন্যবাবু, দোষী তিনি।

তাঁদের সন্তান সমাজদেহে একটা ক্যানসার।

অথচ জ্ঞানত সরমা ছেলেদের কোন প্রশ্রয় দেননি, আদর দিয়ে বাঁদর করেননি।

হাসপাতালের একদিকে জনতার জটলা, ভিড়। সরমা তাকান না। ওরা মিতাকে এনেছে। নিশ্চয় ময়না হবে।

সকলের মাথা ওঁদের দিকে ঘুরে যায়।

আস্তে আস্তে জনতার গলা নেমে আসে।

কে বলে, কার পাপের শাস্তি কে পায় দেখ!

পার্থর ক্লান্ত গলা, চুপ কর হিমু।

হাসপাতালে সুধন্যবাবু। সরমা ও মিলন বাইরে বেঞ্চে।

আপিসের আরও কে কে আসে। সত্যবাবু এগিয়ে আসেন, আপনারা বাড়ি যান বৌঠান। স্নান করে কিছু খেয়ে টেয়ে আসুন।

—উনি?

—মাথার ভেতরে, মানে ব্রেনে হেমারেজ তো…. আমরা আছি তো। আপনারা ঘুরে আসুন।

—টাকা লাগবে তো!

—পরে। পরে হবে। এখন যান। বাড়িতে থাকবে এমন কেউ আছে?

—কে থাকবে?

—যাক গে, যান।

সরমা বলেন, চল মিলন। যাবার সময়ে রামের মাকে ডেকে নিয়ে যাবি। ঘর দোরটা…

মিলন উঠে দাঁড়ায়। বাড়িতে বাবা নয়, মা’র কথাই চলে চিরকাল। মায়ের ওপর অপার ভরসা মিলনের। দশ বছরের বড় দাদার সঙ্গে ওর কোন আদানপ্রদান নেই কোনদিন।

রামের মা বলল, আপনের লগে যাইত্যাছি, কিন্তু আর কাম করতে পারতাম না মা!

—আজ ঘরদোরটা সেরে দিয়ে যাও।

—পোলা নিষেধ করত্যাছে। আপনে বা কী করবেন, বাবুর মতো মাইনষের কপালে এমুন শাস্তি… হা রে ভগবানের বিচার! কার দোষে কারে শাস্তি দিলা!

হ্যায় কী করছিল?

তালা খুলে ঢোকেন সরমা। রামের মা বলে, আপনে ছান করেন, পোলারে দেন, নিজে মুখে দেন! আমি দুধ জ্বাল দিয়া দিত্যাছি।

বাসি বিছানা তোলে রামের মা। ঘরদোর মুক্ত করে। কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয়। সরমা মিলনকে বলেন, দুধ পাউরুটি খা মিলন।

—ওপরে যাচ্ছো কেন?

—ঘর বন্ধ করব। তুই জানালাগুলো বন্ধ করে দে।

যন্ত্রের মতো পরপর কাজ করে যান সরমা। কত বয়স হয়েছিল মিতার? পনেরো না তার কম? শুনেছিলেন, ওই মেয়ে বুদ্ধিতে খাটো, দেহে বাড়ন্ত। রীতা তো ভাল ছাত্রী, কলকাতায় কাজও করছে। মেজ মেয়েটি না কি খুব ভাল খেলাধুলোয়, ব্যায়ামে। ওদের মা তো গেলেন অকালে ক্যানসারে।

কাউকে চেনেন না সরমা। পোস্টমাস্টারকে একদিন বাজারে দেখেছেন মাত্র। সরমা দোকান বাজার করেন, সংসার দেখেন, মিলনকে চোখে চোখে রাখেন। ওঁর চেনাশোনার পরিধিও ছোট।

টাউনের সুপরিচিত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার রতনবাবুর প্রথম পক্ষের মেয়ে অসীমা ছাড়া বন্ধু বলতে কেউ নেই। অসীমা অকালে বিধবা, তাঁর সঙ্গেই প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দেয়। টাউনে স্বামীর তৈরি নিজের বাড়িতেই ‘কল্যাণ সংঘ’ করেছে। মেয়েদের সেলাই শেখায়। পুজোর মণ্ডপে প্রতি বছর মেয়েদের তৈরি খাবারের দোকান দেয়। সরমা এক সময়ে ‘কল্যাণ সংঘে’ যেতেন। আর যান না বকু বড় হবার পর।

দরজা বন্ধ করে সরমা দেয়ালে গাঁথা ছোট সিন্দুক খেলেন। টাকা শ’তিনেক। এতে কী হবে? তাঁর গয়না অবশ্য আছে। মামা—মামি দেখতে পারতেন না। দিদিমা মায়ের ষোল ভরি সোনা দিয়েছিলেন সরমাকে। নিজের কানের মুক্তো ফল। সুধন্যর কাকিমা সোনা বাঁধানো লোহা আর একটি সরু চেন দেন। সুধন্যর মায়ের গয়না সরমা পাননি। সোনা বেচতে হলে বেচবেন।

সুধন্য ভাল হয়ে উঠুন। কিছু করতে হবে না সুধন্যকে। সব সরমা করবেন।

এ বাড়ি বেচবেন।

কুলডাঙায় বাড়ি করবেন।

মিলন আর সুধন্য আর সুরমা।

—মা, চলো।

—চল।

—তুমি কিছু খেলে না?

—একটু দুধ খাই।

বাড়ি বন্ধ করে তালা দেন দরজায়।

—মা… দাদা যদি আসে?

—আমি আছি, ভাবিস না।

তারপর হাসপাতাল। প্রতীক্ষা, প্রতীক্ষা, প্রতীক্ষা। রাত শেষ হয় হয়, নার্স দৌড়ে এল।

—তোমার বাবা?

—হ্যাঁ….

—এস… জল দাও।

সরমা মিলনের হাত ধরে নিয়ে গেলেন।

সুধন্যর জ্ঞানও আসেনি, চোখও খোলেননি। সকালে সেই আপিসের লোকেদেরই খবর দিতে হল।

আর ঘণ্টাখানেক বাদে পার্থ মিলনকে নিয়ে এল। মিলনকে বলল, বাবাকে বাড়ি নিয়ে যাবে?

সরমা ওর দিকে তাকালেন।

দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। পার্থ মাথা নামিয়ে বলল, আমার…. মাথার ঠিক ছিল না…

তারপর যেন সেন্টিমেন্টকে প্রশ্রয় দিতে চায় না, এ ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নরম, ক্ষমাপ্রার্থী গলাতেই বলল, বাড়ি নিয়ে যাবেন?

সরমা মাথা হেলালেন। বাড়ি থাকতে হাসপাতাল থেকেই শ্মশান কেন?

আমরা নিয়ে আসছি। আপনি চলুন।

—মিলন ছুঁয়ে থাকুক।

—ঠিক আছে, মিলন আমাদের সঙ্গে যাবে। আপনি .. দাঁড়ান, একটু দেখি।

বাইরে চলে যায় ও। কাকে কী বলে। বলে, খবর দিয়ে এলাম… তা এমন বিপদের সময়ে…

—এই তো এসে পড়েছি।

অসীমা? এখানে?

সরমার মাথা আর কাজ করছে না।

অসীমা বলে, পার্থ ছুটতে ছুটতে গেল বলে জানলুম… তা ওঠো সরমা, বাড়ি চলো।

—উনি?

—ওরা নিয়ে আসবে। চলো। ইশশ। এভাবে… মিলনের বাবা…

অসীমার সঙ্গে বাড়ী এসেছিলেন। আগের দিন সকালে উঠেছেন। চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। কিন্তু সরমা তখনও ভেঙে পড়েননি। কী যেন তাঁকে চালাচ্ছিল। ভীষণ কড়া হাতে চালাচ্ছিল। মিলনের মুখ? তাঁর গভীর একাকীত্ব? কী?

সব জায়গার মতো অনন্তপুরেও মড়া পোড়াবার একজন থাকে, অন্তত অনেক কাল ছিল, গুনু দত্ত। ছেলেমেয়েদের ব্যায়াম করাত, ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে মড়া পোড়াতে যেত। গুনু দত্তই সুধন্যবাবুকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করল।

বাড়ি। পাটভাঙা জামা ও ধুতি, চশমা। মিলনকে নিয়ে ওরাই গেল। যাবার সময়ে সরমা বললেন, মিলন সব করবে।

—হ্যাঁ, সে আমি দেখব।

তখন তো সরমা জানেন না যে বকু পালিয়েছে কেষ্টনগর। কেষ্টনগর থেকে কলকাতা। অসীমাই শ্মশানযাত্রীদের জন্য নিমপাতা, আগুন, মিষ্টি, সব ব্যবস্থা করলেন। অসীমা বললেন, একেবারে একা!

—কে থাকবে আর?……

—আজ নয় থাকলাম, কাল…

—না না। তুমি চলে যেও।

রামের মা এসে পড়ে। সে কাঁদতে কাঁদতে ঢোকে এবং ভগবানের একচোখো বিচারকে অনেক গালাগালি দেয়। গয়লা, মুদি, সাইকেল রিকশা চালক, কতজন এসে দাঁড়ায় ও রামের মা অতীব যোগ্যতার সঙ্গে তাদের সঙ্গে পাবলিক রিলেশন করে যায়।

—পোলায় তো কইয়াই খালাস? আমি কই, বাবুর মতো মায়ের মতো মানুষ হয় না কি? ভাইগ্য দোষে অমুন পোলা হইছে। আগে তো আছিল না… কী বা হইল… বাবুর কথা কী মিষ্টি! মা ভিন্ন ডাকে না, এট্টা ফরমাজ করে না….

পরে সরমা শুনেছিলেন, সুধন্যবাবুর চিতা নিভতে না নিভতে অনেক, অনেক লোক মিতার মৃতদেহ বয়ে এনেছিল।

পরদিন অসীমা, চুল ছাঁটা, বলিষ্ঠ চেহারার একজন মেয়েকে নিয়ে আসেন। বয়স বছর তিরিশ হবে। অত্যন্ত শক্ত মজবুত হাত পা। পরনে সেমিজ ও কাপড়। ধারালো চোখ, কালো মুখে কালো ভুরু, ঠোঁট পাতলা, সর্বদা টিপে থাকে। পরে, হাসলে দেখেছিলেন দাঁত ঝকঝকে।

—রেবতী। ওর কথা পরে বলব। এখন ও তোমার কাছে থাকুক।

—কী করবে?

খাবে, থাকবে বাড়ি পাহারা দেবে। নরসিং লেঠেলের নাম শুনেছো?

—শুনেছি বোধ হয়।

—বিখ্যাত লেঠেল ছিল। রেবতী ওর ভাইঝি। জ্যাঠার কাছে মালকোঁচা মেরে লাঠি শিখেছিল। নরসিং কাকার কাছে এক সময়ে গুনুদারাও লাঠি শিখত। শোন সরমা, পরে কথা হবে। তোমার আর মিলনের একা থাকাটা আমার ভাল লাগছে না। রেবতী থাকুক, পাহারা দেবে। রেবতী, তোমাকে তো সব বলেছি।

—হ, শুনছি সব।

—তোমাদের স্বজাতি, কায়স্থ।

—আর জাত, অসীমা!

—আমি চলি। রেবতী ওর মতো ফুটিয়ে নেবে। তোমাদের তো হবিষ্যি চলছে এখন। কাজ কবে?

—ও—ই, এগারো দিনে।

এর মধ্যে বকু আসবে কি না, এই চিন্তায় সরমা দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলেন, যদিও বকুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিল না।

মনে মনে ভাবছিলেন, থানায় ডায়েরি করবেন।

রেবতী ওঁর কাছে মেঝেতে বসে সুপুরি কুচোচ্ছিল। মিলনও মেজেতে বসেছিল।

—এত সুপুরি কি হবে মাসী?

জীবনেও মা—বাবা ছাড়া কাছে পায়নি কাউকে। তাছাড়া সেদিন থেকে আজও মিলনের স্বভাব, ও নিজে কিছুর মধ্যে যায় না। অন্যে দায়িত্ব নিক, ও আজ্ঞা পালন করে চলবে। প্রথম জীবনে মা (দাদাকেও পায়নি এবং এক বাড়িতে থেকেও); এক ছোট্ট ইনটারভ্যাল রেবতী মাসি; তারপর ওর শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুবর্গ ; তারপর থেকে লিলি।

—রেবতীর ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্য, কর্মক্ষমতা দেখে মিলন আশ্বস্ত। ওর দরকার শক্ত থাম। যাতে হেলান দেবে।

—এত সুপুরি?

—কামের দিন মানুষজন আইব। পান দিতে লাগব। লও, সইরা বও। কামের দিন তক সাবধানে থাকবা। তোমার হাতে অন্নজল লইব বইলা তিনিও হুতাশে আছে। তুমি তারে মুক্তি দিবা। ইশশ! কী বা বয়েস!

সরমার মনে হল, সুধন্যও তো যেতেন না। বাঁচার কত ইচ্ছে না ছিল। বকু, বকুই পিতৃঘাতী। হায়! এ হত্যাও তো হত্যা। সরমা কী করবেন?

—লন, আপনারা দুধ খই খাইয়া নেন।

—তুমি রোজ রোজ মিষ্টি আনচো কেন?

—অসীমা দিদি দিয়া গেছে আমার কাছে।

—দরকার বা কী?

—দেহে শক্তি না রাখলে পারবেন কী কইরা। নিজেরে নিজে না দ্যাখলে কেও দ্যাখে না রে মা! এক্কেরে খাটি কথা! মিলন আছে না?

—হ্যাঁ …. খাই…..

—অহন আপনের উপর

মিলন খেয়ে শুয়ে পড়ে। প্রতিটি দরজা জানালা বন্ধ কি না আবার দেখে নেয় রেবতী। নিজে রুটি তরকারি খায়। তারপর রান্নাঘরে তালা দিয়ে ঘরে এসে নিজের বিছানা পাতে। মশারি টাঙাতে টাঙাতে বলে, মিলন ঘুমাইছে?

—হ্যাঁ, ও তো শুলেই ঘুম।

আপনেও চক্ষু বোজেন। চিন্তা করবেন না। আপনের বরো পোলা টাউনে ঢুকব না।

সরমা নির্বাক।

—অহন ঢুকলে পাবলিক কাইটা ফালাইব।

সত্যি বলছো?

—হ দিদি।

সরমা মনে মনে বলেন, তাই ফেলুক। সুধন্য মরে যাবেন, মিতা মরে যাবে, মিতার বাবা আর বোনরা বাকি জীবন জ্বলবেন, সে কেন বেঁচে থাকবে? মরে যাক, সরমা শোক করবেন। চলে যাক দূরে কোথাও, সরমা জানবেন তাঁর একটা ছেলে, যার নাম মিলন।

কিন্তু ঘুম আসে না। বকু কেন এমন হল? … কেন?

.

অনন্তপুরে পরপর অনেক ঘটনা ঘটে যায়।

মিতার হাতে ‘বকু’ লেখা রুপোর তাবিজ সহ চেন হার ছিল, নখে ছিল চামড়া ও মাংস। বকুর অপরাধ এড়াবার কোন উপায় ছিল না।

বকু ধরা পড়ছে না এই আক্রোশে মানুষ ফুঁসছিল। অবনীবাবুকে ঘেরাও করেও কোন উত্তর মেলেনি। হঠাৎ একদিন, সুধন্যবাবুর শ্রাদ্ধের আগেই, অবনীবাবুর গুদামঘর জ্বলে যায়।

জ্বলে যায় তাঁর গ্যারেজ ঘর।

অবনীবাবুর বাড়িতে বোম পড়ে।

কমলেশবাবুর নেতৃত্বে এক বিশাল জনতা মিটিং করে ও থানা ঘেরাও করে ও. সি—কে চব্বিশ ঘণ্টা টেবিলে বসিয়ে রাখে।

অনন্তপুর—কাটোয়া লাইনে অবনীবাবুর বাস লুঠ হয়, জ্বলে যায়।

বকুর সাগরেদদের চোলাই ঠেক জ্বলে যায়। সাগররেদরা নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যায়।

এস. পি—র কাছে ডেপুটেশনে যায় শহরবাসী। আর কে জানে কার কলকাঠি নাড়ার ফলে সর্বাধিক বিক্রিত বাংলা দৈনিকে অনন্তপুর নামক আধাশহরে রাজনীতিক ও সমাজবিরোধীর অশুভ আঁতাত বিষয়ে নিজস্ব সংবাদ বেরোয়। তাতে বালিকা ধর্ষণ ও হত্যা খুবই হাইলাইটেড হয়। বকুর কীর্তিকলাপ, তার আদর্শনিষ্ঠা, সমাজসেবী স্বাধীনতা সংগ্রামী পিতার পুত্রের কীর্তি শ্রবণে তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগের খবরও বেরোয়।

ফলে যে তুফান ওঠে তা সামলানো কঠিন হয়। নির্বাচিত সদস্য ও বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী এর তদন্ত, অপরাধী গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তি দাবি করেন। তিনি অনন্তপুর চলে আসেন এবং জনসভায় ঘোষণা করেন, জনগণের সরকার রাজনীতিতে সমাজবিরোধীর অনুপ্রবেশ সহ্য করবে না, করবে না।

.

অবনীবাবুর সঙ্গে তিনি কথাই বলেন না এবং ও. সি—কে বলেন, আপনি পাবলিকের সারভেন্ট। আপনার মতো অফিসাররাই আমাদের ইমেজ নষ্ট করছে চক্রান্ত করে।

ও. সি. সাসপেন্ড হয়।

নতুন ও. সি. আসে।

এত কিছুর পর বকু কলকাতায় গ্রেপ্তার হয় ও বহরমপুর জেলে আনীত হয়।

জেলের মধ্যেই অন্য কয়েদীরা বা কেউ বা কাহারা বকুকে নির্মল আনন্দে মারে। এ সব খবর সরমার কাছে সবই পৌঁছয়, পরের ঘটনা আগে বা আগের ঘটনা পরে।

মিলন ও তাঁর মধ্যে কোন কথা ব্যতীতই একটা বোঝাপড়া হয়ে যায়, উনি বলেন না ‘বকু’। মিলনও বলে না ‘দাদা’। অথচ এ বাড়িতে সেও ছিল একদিন।

এখনকার বকু ছিল?

অন্য কোন বকু ছিল?

সুধন্য চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন। পরের পরিণতি কি তিনি সইতে পারতেন?

রেবতী একদিন বলে, নূতন পোস্টমাস্টার আইল না তবুও পোস্টমাস্টারবাবু চইলা গেল।

—চলে গেলেন মানে?

—কলকাতায় অগো কে আছে, গেল! মাইয়া লইয়া গেল, বাবু আর কামও করব না।

সরমা নির্বাক।

—বরো মাইয়া কলকাতায় কাম করে… এই আর কি!

—হ্যাঁ। পরিবারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

—তাগো অবশ্য রেহাই নাই। কেস যহন চলব, অগো আইতে হইব।

—ভাবতে পারি না রেবতী, ওদের কথা…

—আমি তা আশ্চজ্য মানছি আপনাগো দেইখা। কী বংশে কী পোলা … হয়, এমুন হয়….

—কেসে… কিছু… হবে?

রেবতী ঈষৎ হাসল।

—এই কেসে কুন—অ—দিন কিছু হয় নাই। হইবও না। মাইয়া মরে, কলঙ্ক হয়, আসামী ছাড়া পায়!

—যদি কোথাও চলে যেতে পারতাম….

—দিদি, তো কয় আপনাগো নাই কেউ….

না, কেউ নেই।

রেবতী কোন অতীত স্মৃতিতে অবগাহন করে। অনেক দূরে চলে যায়। তারপর ফিরে এসে নিশ্বাস ফেলে বলে, আপনজন কি আপনজন হয় সগলার ভাইগ্যে। আপন থ’নে পর ভালো, পর থ’নে বন ভালো—কথায় আছে, সে কি মিছা?

যাবেন কোথায়? কোথাও কেউ নেই তাঁর। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কতকাল সম্পর্ক নেই। তারাও না কি দেশের বসবাস তুলে দিয়ে রানাঘাট লাইনে পায়রাডাঙা গেছে, আর ভাগীরথীর ভাঙনে দেশঘরও গেছে। সরমার মামাবাড়ি তো তখনি কোন সম্পর্ক রাখেনি বিয়ের পর। শুনেছিলেন এক মামাত বোনের বিয়ে হয়েছে বেলডাঙায়, সেও শোনা কথা।

—রেবতী, তুমি থাকবে তো?

—থাকার কথা তো দিদি বলে নাই। আর, আপনের বিপদের সময়, দিদি থুইয়া গেল, আমার কথা আপনে জানেনও না।

—কী কথা?

—দিদির কাছে শোনবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *