আইভি সোম হত্যামামলা (১৯৭৮) – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

আইভি সোম হত্যামামলা (১৯৭৮)

একটি পোস্টমর্টেম

বাক্স রহস্য

রানিকুঠির বাজার ছাড়িয়ে পোল পার হয়ে, বাঁশদ্রোণির দিকে অনেকটা ভিতরে গেলে একটি মাটির গির্জা পড়ে। গির্জার পাশ দিয়ে সোজা চলে গেলে বোড়াল গ্রাম। (সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র সুটিং হয়েছিল বলে গ্রামটির নাম আজ অপরিচিত নয়।) গির্জা থেকে মাইল-দেড়েক বোড়ালের দিকে গেলে একটি কালভার্ট। তার নিচে দিয়ে বর্ষার জল ছোট নদীর মতো বয়ে চলেছে।

১৯৬৮ সালের ১৭ আগস্ট শেষরাতে কালভার্টের নিচে একটি টিনের কালো ট্রাঙ্ক দেখতে পায় রতনতনু ভক্ত নামে স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস থ্রি-র একটি ছেলে। সারারাত পেটের যন্ত্রণার পর, শেষরাতে, মার সঙ্গে প্রাতঃকৃত্যের প্রয়োজনে সে তাদের বাড়ি সংলগ্ন খাল-ধারে গিয়েছিল। শৌচকার্যের জন্যে জলে নেমে কালভার্টের নিচে সে ট্রাঙ্কটি দেখতে পায়। সে উঠে এসে তার মাকে বলে।

খবর পেয়ে বাবা শ্রীকাশীকান্ত ভক্ত (৪৯), ওই স্কুলের শিক্ষক, সেখানে আসেন। তিনি দেখেন, ট্রাঙ্কটি সদ্যই কেনা হয়েছে এবং আঙটায় পিতলের তালা, সেটিও ঝকঝক করছে। ভালো রকম কিছু প্রাপ্তির আশায় তাঁরা তিনজনে খুবই ভারী ট্রাঙ্কটি কোনোক্রমে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তখন সবে আলো ফুটছে। অত ভোরে তাঁদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়নি। বাড়িও খালের ধারেই।

তালা ভেঙে আধ ইঞ্চি ফাঁক করেই কাশীবাবু ডালাটা নামিয়ে দেন। তারপর সোজা ছুটে যান স্থানীয় এম এল এ-র বাড়িতে।

ট্রাঙ্কের ভেতর মোচড়ানো-দোমড়ানো অবস্থায় এক যুবতীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার জিভটি প্রায় বিঘৎখানেক বেরিয়ে, দাঁতের চাপে কেটে ঝুলে আছে খানিকটা। মাথাটি কয়লা ভাঙা কিছু ভারী জিনিস দিয়ে (মুখের রক্ত-মাংসের সঙ্গে কয়লার গুঁড়া দেখে তাই অনুমান করা হয়) এমনভাবে থেঁতো করা যে চেনবার উপায় নেই। ট্রাঙ্কের নিচে তোয়ালে মোড়া একটি ছোট কপিকল ও খানিকটা প্লাস্টিকের দড়ি পাওয়া যায়।

লালবাজার স্পেশাল ব্রঞ্চের (মার্ডার) তরুণ ইনস্পেক্টর কে পি (কামাখ্যাপ্রসাদ) সেন তদন্তের ভার পান। পোস্টমর্টেম ও আটোপসি রিপোর্ট এলে দেখা যায়, যুবতীর বয়স ২৫ এবং গলায় ফাঁস দিয়ে তাকে খুন করা হয়েছে। তার ডান কাঁধে একটি জন্ম-জড়ুল ছিল। এবং তাকে ১৬ আগস্ট কোনো এক সময় খুন করা হয়।

ট্রাঙ্কে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বলতে কিছু পাওয়া যায়নি। এক সপরিবারে কাশীকান্তবাবুর ছাড়া। কিন্তু পুলিশ তাঁদের আদৌ সন্দেহ করেনি।

প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ

কালভার্টের পাশে একটি লাইব্রেরি ফ্রেমের চশমা পাওয়া যায়। চশমাটি আনকোরা নতুন। একটি কাচে +১০ ও অন্যটিতে +৮ পাওয়ার। ডাঁটিতে চশমার ব্র্যান্ডে নাম দেখে বউবাজারের দোকান থেকে দোকানে খোঁজখুঁজি করে, গত ৬ মাসের মধ্যে ওই পাওয়ারের ১৩টি চশমা করিয়েছেন এমন ১৩ জনের নাম ও ঠিকানা মেলে। তাঁদের মধ্যে একজন গলফ ক্লাব রোড়ের শখের পক্ষী-বিশারদ ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রীসাধন চক্রবর্তী।

চশমাটি তাঁরই বলে দেখামাত্র তিনি স্বীকার করে নেন ও ‘দেখি দেখি’ বলে তখুনি চশমাটি পরেন। (‘এ আপনি কোথায় পেলেন?’— রেকর্ড।) কামাখ্যাবাবু টিপে-টাপে দেখলেন অধ্যাপকের মুখে বেশ ফিট করেছে চশমাটি। তাঁরই বটে। শাদা পোশাকে কামাখ্যাবাবু তখন তাঁকে তাঁর আইডেনটিটি কার্ড দেখান। এবং অনুমতি নিয়ে চশমাটি তাঁর কাছে রেখে দেন। (‘না-না, এতে আপত্তির কী আছে?’)

সাধনবাবুর নতুন চশমা হয়েছে (‘স্ত্রীর পছন্দ’)। এবার ছোট ছোট গোলাকার কাচের চশমা করিয়েছেন, এবার স্টিল ফ্রেমের। আরও কিছু প্রশ্নোত্তরের পর কামাখ্যাবাবু তাঁকে লালবাজারে আসতে বলেন। (‘আমি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে এসেছি’— কামাখ্যাবাবু। ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আই উইশ ভেরি মাচ টু হেলপ ইউ আউট ইয়ং ম্যান, টু ড্রাইভ দা লাস্ট গ্রেন অফ ডাউট ফ্রম ইওর মাইন্ড।’— সাধনবাবু।)

জিজ্ঞাসাবাদের সময় সাধনবাবুর স্ত্রী বাসনাদেবী বলেন, ১৪ আগস্ট বিকেলবেলা বায়নাকুলার নিয়ে পাখি দেখতে সাধনবাবু ওদিকে গিয়েছিলেন। ওই দিকে লুপ্তপ্রায় জাতের দু-দুটি পক্ষী-দম্পতি দেখা গেছে, এই শুনে। (‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওই কালভার্টে আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলাম’— সাধনবাবু।) চশমাটি উনি তবে ওখানেই ফেলে আসেন। (‘যা ভুলো মন’— বাসনাদেবী।)

খুবই বিশ্বাসযোগ্য কথা। পাখি বিষয়ে সাধনবাবুর একটি নির্ভরযোগ্য বই আছে। বস্তুত, তখন, একটি দৈনিকপত্রে ‘ওপার বাংলার পাখি’ নামে তিনি একটি নিয়মিত কলামও লিখেছেন।

সাধনবাবু নামকরা লোক। একজন উপমন্ত্রীর সহপাঠী বন্ধু। বন্ধুবান্ধবদের কেউ সেক্রেটারি, কেউ স্টিল অথরিটির জেনারেল ম্যানেজার, একজন চিলির রাষ্ট্রদূত। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়লে যা হয় আর কি। লালবাজারে সসম্ভ্রমেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এট-সেটা, এলোমেলো, অবাস্তব সব প্রশ্ন—দুঁদে পুলিশ অফিসাররা প্রথমেই যেভাবে বিভ্রান্ত করে দেন। তারপর এক সময় কামাখ্যাবাবু ড্রয়ার খুলে সাধনবাবুর চশমাটি টেবিলের ওপর রাখেন।

‘আপনি কত তারিখে ওদিকে গিয়েছিলেন বললেন?’

‘১৪ আগস্ট।’

‘বিকেলবেলা।’

‘আ-হ্যাঁ।’

‘কী কী পাখি দেখলেন?’

‘ইন্টারেস্টিং বলতে ওই শা-বুলবুল যা দু-একটি আর হ্যাঁ, বেশ কয়েকটা ক্রশ ব্রিড নতুন জাতের টুনটুনি।’

এবার টেপটা চালিয়ে দিলেন ইনসপেক্টর সেন। টেপ ঘুরে যাচ্ছে। দুজনেই চুপ। যেন, তাঁর আর-কোনো প্রশ্ন নেই। সেন হঠাৎ জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু সেদিন, বিশেষ করে বিকেলবেলা ত মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।’

ঘূর্ণমান টেপ থেকে সাধনবাবু চোখ তুললেন না।

‘এই দেখুন আপনার চশমা, আর এই দেখুন’, একটা ফোটোগ্রাফ, টেবিলে রেখে ‘আপনার চশমার ছবি পেয়েই ছবি তোলান হয়। এই যে’, ছবি উলটে, ‘ফোটোগ্রাফারের সই, ডেট আর সময়।’

ছবি দেখার জন্যে সাধনবাবু একটু মুখ তুললে ইনসপেক্টর সেন এতক্ষণে হেসে বলেন, ‘চশমাতে একফোঁটা বৃষ্টির দাগও ছিল না।’

অধ্যাপক চক্রবর্তীকে আর বাড়ি ফিরতে দেওয়া হয়নি। সেদিনই ভোররাতে তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী বাসনা চক্রবর্তীকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

খুনের মোটিভ

জামিনের অযোগ্য বিবেচনা করে আদালতের নির্দেশে মোট ৬ মাস জেলে থাকাকালীন তদন্ত-কার্য সমাধা হয়। সরকারি উকিল আলিপুর কোর্টে দুদিন ধরে প্রাথমি তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেন। চক্রবর্তী দম্পতিকে দায়রায় সোর্পদ করা হয়।

বিখ্যাত ক্রিমিনাল প্র্যাকটিশনার শ্রী এম এল বাসু ও তাঁর দুজন সহকর্মী আসামী পক্ষে দাঁড়ান এবং সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করে অ্যাডভোকেট প্যানেলের প্রধান শ্রীকেশব হালদার স্বয়ং। সেশন কোর্টে দুবছর ধরে মামলা চলাকালীন ৮৮ জন সাক্ষ্য দেন, ২৯টি ‘একজিবিট’ আদালতে পেশ করা হয়। সাক্ষী-সাবুদের জেরা করার সময় বহু অজানা তথ্য উদঘাটিত হয়।

সেশন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের তিনজন বিচারপতির তিনটি রায় পড়ে, বলা যেতে পারে ‘অধ্যয়ন’ করে, আমার সেশন জাজের রায়টিই সবচেয়ে মূল্যবান বলে মনে হয়েছে যদিও এটিই ছিল সংক্ষিপ্ততম, মাত্র ২২ পৃষ্ঠার। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল যথাক্রমে ১০৩ ও ৭৫ পৃষ্ঠার, যদিও রায় দুটি পাঠ করতে উভয় বিচারপতির প্রায় একই সময় লেগেছিল—অর্থাৎ সারাদিন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন বেশ তোতলা।

যাই হোক, তিনজন বিচারপতিই খুনের ‘মোটিভ’ সম্পর্কে তিনরকম মতামতও দিয়েছিলেন এবং তিনজনেই স্বীকার করেন পুলিশ-প্রদত্ত মোটিভ আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। (‘সেক্স ম্যানিয়াক’।) খুনের মোটিভ সম্পর্কে সেশন কোর্টের বিচারপতি হিজ অনার জে এন বসাকই কিছুটা বুঝেছিলেন বলে আমার মনে হযেছে। (‘আমি জীবনে রায় দেবার আগে এবং পরেও একটি খুনের মোটিভ নিয়ে কখনও এমন দিনের পর দিন চিন্তাভাবনা করিনি।’)

আবহসঙ্গীত

আইভি হত্যা মামলার (১৯৬৮) প্রধান আসামী অধ্যাপক শ্রীসাধন চক্রবর্তী ৫০ দশকের গোড়ায়, তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। (সাধন ক্লাসে আসত সরস্বতীর মুটের মতো দু-কাঁধে অন্তত ১০ খানা মোটা মোটা লাইব্রেরির বই নিয়ে, মনে হত দেবী বুঝি ওর পিছনে পিছনে ক্লাসে ঢুকবেন। তখনই তার চোখে খুব মোটা কাচের চশমা, একটু কুঁজো, স্কলাররা যেমন হয়। অ্যাড্রেসড না হলে সে কারও সঙ্গে কথা বলত না : সাক্ষী শ্রীবীরেন্দ্রলাল ব্রহ্ম : কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং ইনসপেক্টর।) আসামীর বাবা হরিপ্রসাদ চক্রবর্তী ছিলেন খুলনার জেলা স্কুলের শিক্ষক। পার্টিশনের পর দমদমের দেবীনিবাস রোডে মামাশ্বশুরের বাড়িতে সপরিবারে ওঠেন। খুব তাড়াতাড়ি দমদমের মতিঝিল স্কুলে চাকরি পেয়ে প্রাইভেট রোডের কলোনিতে চলে যান।

এম-এ পড়ার সময়েই অমিয় সেনের মেয়ে বাসনার সঙ্গে তাঁর লাইব্রেরিতে আলাপ। গোয়ালিনী-টাইপের গোলগাল, বাসনাকে দেখতে মোটেই ভালো ছিল না, লেখাপড়াতেও তথৈবচ, যে জন্য ‘ইসলামিক হিস্ট্রি’ ছাড়া সে আর-কিছুতে চান্স পায়নি। মাতৃহারা, একমাত্র সন্তান এই অচল আধুলিটিকে পসারহীন কিন্তু ফাঁটবাজ দূরদর্শী ব্যারিস্টার সেরা প্রজাপতি অফিস বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চালাবার প্রয়াস করেন। সেশনে মামলা চলাকালীন, বালিগঞ্জের কমলা গার্লস স্কুলের সহপাঠিনী মৃদুলা সাহাকে (তখন তিন সন্তানের জননী) সাক্ষ্য দিতে রাঁচি থেকে আনা হলে তিনি বলেন :

মৃদুলা : মাসিমা মারা যাবার পর ফ্ল্যাট একদম খালি থাকত। স্কুল পালিয়ে প্রায়ই আমরা সারা দুপুর ওদের ফ্ল্যাটে কাটিয়েছি।

প্রশ্ন : বেডরুমে?

উত্তর : হ্যাঁ।

প্রশ্ন : দরজা বন্ধ করে।

উত্তর : হ্যাঁ।

প্রশ্ন : এক বিছানায়।

উত্তর : হ্যাঁ। বাসনা হত সেলিম আর আমি আনারকলি। মেসোমশাইয়ের নাম আমরা দিয়েছিলাম ‘আকবর’।

৫৯-এ ব্যারিস্টার সেন হঠাৎ জুতো পরতে পরতে স্ট্রোকে মারা গেলে, প্রায় কপর্দকহীনা কুরূপা কিন্তু ‘তবু আকর্ষণীয়া’ বাসনা সেনকে বিয়ে করে সাধনধন ক্ষীরোদ মার্কেটের ওপর শ্বশুরের ফ্ল্যাটে ওঠেন। গলফ ক্লাবের ফ্ল্যাটে মাত্র তিন-চারজনের বেশি তখনও গৃহপ্রবেশ করেননি। কলেজ কো-অপারেটিভের বাড়ি, কলকাতায় তখন ‘ওন ইওর ওন ফ্ল্যাট’ সিস্টেম সবে চালু হয়েছে। প্রতিবেশী ফ্ল্যাট-মালিকরা সকলেই অধ্যাপক। প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় ওঁরা ছিলেন ‘বিচিত্র দম্পতি’। রাতে ‘প্রতিদিন দুজনে মদ্যপান করতেন।’ সকালের দিকে শোনা যেত ভাঙচুরের প্রবল শব্দ। শ্রীমতী সেন মর্নিং কলেজে পড়ান। ১২টা নাগাদ তিনি যখন ফেরেন, স্বামী কলেজে চলে গেছেন। তাঁকে বে-আইনিভাবে সংগৃহীত একটি মূল্যবান দু-টুকরো কোনারক-ভাস্কর্য রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ফ্ল্যাটে যেতে দেখা গেছে, যা তাঁর স্বামী কাচের জানালার মধ্য দিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দেন। এই ভাঙচুর করাটা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। পুলিশ তাঁদের স্টোররুমে ঢুকে ছেঁড়া শাড়ি, শায়া ও ব্রেসিয়ার, ছেঁড়া শেকসপিয়র (অখণ্ড) সহ বহু মূল্যবান বই, ছুরি দিয়ে শত ছিন্ন করে কাটা ‘এ গার্ল উইথ এ হর্স টেল’ (পিকাসো : কপি) ও একটি যামিনী রায় (মা ও ছেলে : কপি)—বাঁকুড়ার ঘোড়া ও পুরুলিয়ার মুখোশ ইত্যাদি পায়—সবই টুকরো টুকরো। অথচ প্রতি সন্ধ্যায় স্বামী-স্ত্রীকে মুখোমুখি বেতের চেয়ারে বারান্দায় দেখা যেত টানা ২-৩ ঘণ্টা : মদ্যপান করছেন।

ডায়েরির ছেঁড়া পাতা

চাবি দেওয়া ড্রয়ারে সাধনবাবুর একটি ডায়েরি পাওয়া যায়। এন্ট্রি ১৯৬৭ সালের গোড়া থেকে।

‘২১-২-৬৭। না, আইভির বুকের প্যাচটা জন্ম-জড়ুল। আজ আইভিকে স্পেশালিস্ট দেখালাম। ক-দিন আগে আইভির সঙ্গে ব্ল্যাকবার্ন লেনের তা-ফা-হসুন-এ সারাদুপুর’। (এখন হোটেল কুঙ্গা : লেখক।) আইভি বলল, ‘দেখুন স্যার, আমার বাবা নেই, বলার মতো কেউ নেই। তাই আপনাকে বলছি। আমার চামড়ায় একটা লালরঙের প্যাচ দেখা গেছে। আপনি কি কোনো স্পেশালিস্টকে চেনেন?’

আমি : স্কিন স্পেশালিস্ট?

আইভ : না। অসুখটা… অসুখটার নাম ‘L’ দিয়ে।

—লিউকোডারমা?

—না স্যার।

—লিউকোমিয়া?

—না। ‘এল’ দিয়ে আর একট অসুখ বলুন, লেপ…

—রোসি?!

আমি আঁতকে উঠলাম।

—কোথায়?

সে আপনাকে দেখানো যাবে না।

—কোথায়?

—বুকে।

‘লজ্জা করতে হবে না আইভি। যদি সত্যিই বাবার মতো মনে করো’ অসীম পিতৃস্নেহ থেকে আমি তাকে বলেছিলাম, ‘তবে দেখাও। আমিও ত কিছুটা বুঝব।’

‘আইভি প্রথম বোতামটা খুলল। তারপর আর কিছুতেই পারে না। আমি উঠে গিয়ে বাকি দুটি খুললাম। সত্যিই, বাম স্তনের ওপর হালকা লালচে প্যাচ একটা, বিঘৎ খানেক, ঠিক একটা নৌকোর মতো। হঠাৎ বানের সময় মোহনা দিয়ে ঢোকা দুটি জলস্তম্ভের আকার নিল তার স্তনদুটি, আমি দেখলাম, তরঙ্গের মাথায় টলমলে একটি লাল নৌকা। ধ্বংস হবার আগে আমি মাথা নিচু করে সেই জল-তোড়ের মধ্যে ঝাঁপ দিলাম। মুহূর্তে আমাদের পিতাপুত্রীর সম্পর্ক বদলে গেল।’

‘৬-৫-৬৭। গলিতে টিউবওয়েল বসছে। ভারার উপর আজ বিকেলবেলা দেখলাম একটা দুধরাজ বসে। দুখরাজের এত্ত লম্বা ল্যাজ আমি আগে দেখিনি। তা ৮ ইঞ্চি ত হবেই। পেট আর গলা ছাই-রঙা, নিচের দিকটা লালে-বেগুনিতে। সরু থেকে মোটা ছাইরঙা ল্যাজের ওপর আড়াআড়িভাবে কালো পট্টি চার-পাঁচটা। দুধরাজ না সিবিয়া?’

‘১৮-৯-৬৭। আজ মহরমের ছুটি। আজ সকালে বাসনার সঙ্গে ঝগড়া নয়, মারামারি। বাসনা ভেবেছে কী? রবীন্দ্রভারতীর ভাইসচ্যান্সেলর পদের জন্যে আমাকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তদ্বির করতে যেতে বলেছে। যুক্তফ্রন্ট সরকার হয়েছে; যখন পার্টি ভাগ হয়নি সে ছিল আমার কমরেড, তা বলে রমেনের কাছে তদ্বির করতে—ছিঃ! আসলে বাসনা চায় গাড়িটা। কিন্তু, আমি আরও রেসপেক্টেবল হতে চাই না। রেসপেক্টিবিলিটি ইজ আ প্রিজন!’…

‘চোপ! আর একটা কথা বলেছ কি—’ বলে দুহাতে টেপ রেকর্ডারটা (টেলিফাঙ্কেন) তুলে আমি আছড়ে ভাঙার ইঙ্গিত করলাম। কথা বলল না বাসনা, কিন্তু তার চেয়েও যা বেশি, দেখি-না-মুরোদ-কত চোখে দাঁড়িয়ে রইল। এত স্পর্ধা! আমি আছাড় মারলাম না। কিন্তু, তার চেয়েও যা বেশি, হাত দুটো রেকর্ডার থেকে খুলে নিলাম। খান-খান হয়ে ভেঙে গেল আমার প্রাণধিক জিনিশটা।

অন্যান্য কয়েকটি এন্ট্রি—

‘২৮-১০-৬৭। আইভির কাছে ৭ দিন ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর করিয়ে পুজোয় বাসনার সঙ্গে চাইবাসা ঘুরে এলাম। (১৯।১০ থেকে ২৬।১০)। ২৪ আর ২৫ গভীর জঙ্গলের মধ্যে টিলার ওপর বরাইবুরুর বাঙলোয়। নিচে কারো নদী। ওপারেও জঙ্গল। ভালো লাগল না। সন্ধেবেলা দেখি একটা ময়ূরী এসে বারান্দায় পায়চারি করছে। আইভির কথা মনে পড়ল। যদি আইভি থাকত বাসনার বদলে? তাহলে হয়ত অনেক বেশি শরীর হত। আইভি হয়ত, হয়ত কেন নিশ্চয়ই, ন্যাংটো হয়ে আমার সঙ্গে স্নান করতে রাজি হত ওই কারো নদীর ঝকমকে জলে। কিন্তু, তাহলেও কিছু হত না। ৭ দিনের প্যাগানিজমে মুক্তি নেই।’

ভালো লাগল না। অথচ, আসার সময় সে কী ছটপটানি! যেন বরবাদ হয়ে যাবে জীবন, অরণ্যে-বাঙলোয় কদিন না কাটালে। কিছুই ত হল না। কিছুই ত হয় না। হোয়ার ইজ দ্য মাইন্ড? মন সহযোগিতা না করলে কিছু হবার নয়।’

‘১০-২-৬৮। কাল ছিল আমাদের বিবাহ বিচ্ছেদ না-করার দশম বার্ষিকী। শুতে যাবার আগে বাসনাকে বললাম, ‘কেমন মজা দেখলে বাসনা?’ বাসনা বলল, ‘কীসের মজা?’ আমি বললাম, ‘এই যে, দশ-দশটা বছর কেটে গেল আমাদের বিবাহিত জীবনের, অথচ ভালোবাসার কোনো দরকারই হল না।’

‘৫-৮-৬৮। আইভি ভালবাসতে পারে। সে আমাকে ভালোবাসে। আইভি আমাকে সত্যিই ‘সব’ দিয়েছে। তবু আমার ঝুলি খালি কেন? তবু ‘আমি’ কিছু পাইনি।’ কেননা আইভির ভালোবাসা আমাকে ভালোবাসার আরও-বাইরে ছুঁড়ে দিয়েছে।

আইভি একটা সরকারি ফ্ল্যাট পেয়েছে। হস্টেল ছেড়ে সে সেখানে উঠে যেতে চায়। নিয়ে যেতে চাইছে আমাকে। ভালোবাসা পেলে মানুষ ‘সব পেয়েছি’-কে পায়। কিন্তু, আমি ত কিছুই পেলাম না! বাসনার কাছে যা পাইনি তা আইভির কাছে পেতে গিয়ে আমি দেখছি এ ত কিছুই-না, আমার আরোগ্যের ওষুধ ত ‘এ’ নয়। ভালোবাসা ‘ভালো’, গ্রহণ করার মত মনটা আমার কই? নেই। কিন্তু আইভির সঙ্গে এতদূর এসে, কৌমার্যসহ তার শরীর, সর্বস্ব লুণ্ঠন করে, এ-কথা ত তাকে আজ বলা যায় না। পৃথিবীর কোন মেয়েমানুষ এটা বুঝতে চাইবে না যে নারীর-প্রেমের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সব উৎস শুকিয়ে গেছে।’

‘৮-৮-৬৮। The best relation between a man and a woman is that of the murderer and the murdered. Who said that? Dostoievsky’s Krilov or Durenmat’s Herr M.?’

‘৬-৮-৬৮। আমাদের রোজকার কোটা এক-পাঁইট রামের শিশিটা অনেকক্ষণ ফুরিয়ে’ গেছে। টেবিলে পাশাপাশি দুটি শূন্য গ্লাস। বাসনার হাত দুটি ধরে আমি তাকে বললাম, ‘বাসনা, তোমাকে ছেড়ে নতুন ‘ভালো’-র সন্ধানে আমি যেতে চাই না। তুমি আমাকে বাঁচাও।’

ডায়েরির শেষ এন্ট্রি—

‘১২-৮-৬৮। আসবে বলেছে। দুপুরে। আগের দিন আমরা যাব। দুটি বোরখা ও ক. (কপিকল?— লেখক।) জোগাড় হয়েছে।

জাস্টিস বসাক তাঁর রায়ে এক জায়গায় অবজার্ভ করেছেন, ‘ভালোবাসা গ্রহণ করার মতো মন আর না থাকলেও, বেদনা ও দুঃখকে গ্রহণ করার মতো মন আসামীর ছিল। সে দাঁড়িয়ে ছিল সীমারেখায়। দু-নম্বর আসামী বাসনা চক্রবর্তীর দ্বারা প্ররোচিত না হলে সে হয়ত আইভি সোমকে খুন করতে না।’ যথার্থ!

নায়িকার প্রবেশ ও প্রস্থান

ডায়মন্ড হারবারে গঙ্গার ধারে একটি নির্জন দোতলা হোটেল। নাম ‘মোহিনী’। তখন ডায়মন্ড হারবারে কাজ-কর্মে ছাড়া কেউ যেত না, অন্তত ফুর্তি করতে। ‘সাগরিকা’ হবার কিছুকাল পরে হোটেলটি উঠে যায়। এখন নার্সিংহোম হয়েছে।

অনেক খোঁজ খবর নিয়ে, ওই হোটেলে সাধনধন ১৬ আগস্ট, সোমবার, দুপুরবেলায় ১নং ঘরে আইভিকে আসতে বলেন। (‘সেলিম আখতার নামে বুক করব। এক সঙ্গে যাওয়া ঠিক হবে না। অবশ্যই বোরখা পরে আসবে। আফটার-অল, তুমি আমার ছাত্রী’ : হাত চিঠি।) আগের দিন, ১৫ আগস্ট বিকেলবেলা, শেরোয়ানি-পাঞ্জাবি পরা সেলিম আকতার ও তাঁর স্ত্রী (বোরখা পরিহিতা) মোহিনী হোটেলের এক নম্বর ঘরে আসেন। সঙ্গে ছিল একটি কালোরঙের ট্রাঙ্ক। পরদিন দুপুরবেলা বোরখা পরে আইভি যখন রিকশা থেকে নামে, হোটেলের ম্যানেজার তখন ঘুমুচ্ছিলেন। এবং কুক বলরাম ছাড়া তাকে কেউ দেখেনি। সে ভেবেছিল, সাহেবের বউ-ই বোধহয় কোথাও থেকে ঘুরে-টুরে এলেন। ১ নং ঘর সেই দেখিয়ে দিয়েছিল।

আইভি এলে, দরজা বন্ধ করে, সাধনধন তাকে একটি সুন্দর হাউসকোট উপহার দেন (নিউ মার্কেটের ‘মঞ্জু-লা’র সেলসম্যান হায়দর আলি সেটি ও ক্রেতা সাধনবাবুকে শনাক্ত করে) এবং বাথরুম থেকে পরে আসতে বলেন। হাউস কোটে বেল্টটি লাগান ছিল না। বাথরুম থেকে একেবারে স্নান-টান করে শুধু হাউস কোট পরে বেরিয়ে আইভি বেল্টটি চায়। অধ্যাপক চক্রবর্তী বেল্টটি নিজের হাতে তার কোমরে লাগিয়ে দিতে গিয়ে, না লাগিয়ে, যেন বরমাল্য পরিয়ে দিচ্ছেন, এমনভাবে (ধরা যেতে পারে সাদরে ও সহাস্যে) তার গলায় পরিয়ে দেন ও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। চুম্বন করতে করতে তিনি তাকে নিয়ে যান গঙ্গার দিকে দেওয়াল-জোড়া কাচের জানালার ধারে। লিনটেল জুড়ে ভারী পরদার ধারে অন্ধকারে ঝুলছিল একটি প্লাসটিকের দড়ি, তার ডগায় আঙটা। আইভির গলায় পরানো বেল্টের হুকটা তিনি আঙটায় লাগিয়ে দেন। পরদার পিছনে অধ্যাপক পত্নী আধ ঘণ্টা ঘরে ঘামছিলেন। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তিনি দড়ি ধরে ঝুলে পড়েন। আইভি ‘টু’ শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি। তারপর দুজনে মিলে দড়ি ধরে অনেকটা উঁচুতে টেনে তোলেন এবং আইভিকে অনেকক্ষণ শূন্যে ঝুলিয়ে রাখেন।

তার জিভ বেরিয়ে আসে। পায়ের পাতা লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ে। কপিকলটি লিনটেলের পিছনে ফিট করা হয়েছিল।

‘খুন যখন হয়, তখন খুনীর কাছে পৃথিবীটা দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে থাকে খুন, অন্যদিকে বাকি পৃথিবী’—জাস্টিস জে এন বসাক তাঁর রায়ে এক জায়গায় লেখেন। এরপর বাকিটা খুনের নিয়মেই ঘটে যায়। এবং সে সম্পর্কে বিস্তৃত কিছু না বলাই ভালো। সাধনবাবু একটি আন্ডারওয়্যার পরে মুখ থেঁতো করার কাজটি করেন। (‘আমি বাথরুমে পালিয়ে যাই’— বাসনা চক্রবর্তী।) এ-জন্য ব্যবহৃত থান ইটটি ছিল হোটেলের রান্নাঘরের সামনে কয়লার স্তূপে বেড়া দেবার জন্যে ইটগুলির একটি, পরে সেটি খাপে খাপে মিলে যায়। হোটেলের জানালার ধারে ঝোপের মধ্যে যে তোয়ালে দিয়ে মোড়া অবস্থায় ইটটি পাওয়া যায়, সেটিও হোটেলের বলে শনাক্ত হয়। থান ইটে লেগে-থাকা রক্ত ও মাংসকুচি, বলা বাহুল্য, ছিল আইভি সোমের।

হোটেল থেকে রিকশায় ডায়মন্ড হারবার স্টেশন। ভারী কালো ট্রাঙ্কটি রিকশাঅলার সাহায্য নিয়ে তোলার সময় কুক বলরামের সন্দেহ হয়েছিল। (‘মুই তখনি সন্দেহ করিলা কি টাঙ্কো এত্তা ভারী হইলা কেমতি’— বলরাম)। শিয়ালদহ থেকে ট্যাক্সি করে। সোজা বাঁশদ্রোণি ছাড়িয়ে গড়িয়ার পথে কালভার্ট পর্যন্ত। তখন রাত এগারটা। মাঠের মধ্যে একটা দোতলা আলোজ্বলা বাড়ি। ‘ওই বাড়ি’ বলে সাধনবাবু ট্যাক্সি থামান এবং ট্রাঙ্ক নামিয়ে ও সেকালে ১০ টাকা বখশিশ দিয়ে ড্রাইভারকে চলে যেতে বলেন। ‘ভজা’ ‘ভজা’ বলে বাড়িটির উদ্দেশে তিনি চাকরকে ডাকেন। ড্রাইভার বাঁকেবিহারী বর্মনের তাই সন্দেহ হয়নি।

খানিকটা পায়ে হেঁটে, কিছুটা রিকশায় সাধনবাবু বাঁশদ্রোণি বাজারে ফেরেন। সেখানে থেকে ট্যাক্সিতে গলফ ক্লাব রোডে।

মানুষ খুন করে কেন?

মানুষের মানুষ খুন করার মতো স্টুপিড কাজ আর হয় না। পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে একটি করে খুন হয়। প্রায় সবগুলিই হঠাৎ উত্তেজনার বশে, শতকরা ৯৫ ভাগ। পৃথিবীর প্রায় সব খুনই এক : স্টুপিড! এবং এইসব খুন নিয়ে এমনকি, কিছু লেখাও গর্হিত, অমানবিক কাজ। ‘কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু খুন হয়’, জাস্টিস বসাক তাঁর রায়ে যেমন বলেছিলেন, ‘যার মোটিভ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা, সমাজের মঙ্গলের জন্য ঠিক ততটাই জরুরি, আনাটমি জানার জন্য যতটা জরুরি বিজ্ঞানীর মড়াকাটা। এইসব খুনীদের আমাদের মতো মানবতাবাদী ফাঁসুড়েরা (‘humanist executioners’) ফাঁসি না দিলে, নিঃসন্দেহে এরা আর একটি খুন করত না। আইভি সোমের হত্যাকারী আসামী সাধনধন চক্রবর্তী পৃথিবীর সেই স্বল্প-সংখ্যক খুনীদের একজন।’ বস্তুত, সেশান জাজ জাস্টিস জে এন বসাকের রায়টি প্রথমেই না পড়তে পেলে এই খুন সম্পর্কে তথা এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ হত না।

রায়টি মাত্র ২২ পৃষ্টার হলেও, এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের নায়ককে জাস্টিস বসাক চমৎকার বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর মতে, ‘আসামী একালের মূল্যবোধহারা সমস্ত সর্বস্বান্ত মানুষের প্রতিনিধি। গবিবের মেধাবী ছেলে, বিয়ে হল চালিয়াত ব্যারিস্টারের মেয়ের সঙ্গে। বাবা-মা, ভাই, আইবুড়ো বোন, দুঃস্থ আত্মীয়স্বজন সকলকে ছেড়ে সে ফ্ল্যাটে উঠে এল। কেন? না, সে ভালোবাসবে। সে, ভালোবাসা পাবে। ১০ বছরের দাম্পত্যে তার বাঁজা স্ত্রী একের-পর-এক জন্ম দিয়ে গেল ফ্ল্যাট-ফ্রিজ ও টেলিফোন—শেষে একটি গাড়ির জন্ম দেবে বলে মন্ত্রীর কাছে তাকে পাঠাতে চাইল। ঠিক এই সময় এল কন্যা-সমা আইভি। সে কিছুই চাইল না। শুধু সর্বস্ব খুইয়ে তাকে ভালোবাসল। কিন্তু আসামী দেখল, সে ভালোবাসার ‘বাইরে’। এই ‘বাইরে’ শব্দটি প্রয়োগ করতে গিয়ে আমি এখানে আলবের কামুদ ‘দা আইটসাইডার’ গ্রন্থটিকে সাক্ষ্য দেবার জন্য ডাকি। আসামী তার ডায়েরিতে ডস্টইয়েভস্কির কিরিলোভ (দ্য ডেভিলস) ডুরেনমাটের হের এম-এর (দ্য প্লেগ) উল্লেখ করেছে। কিন্তু আমার মনে হয় ‘দা আউটসাইডার’-এর নায়ক মারসোর সঙ্গেই তার মেলে বেশি। সে হয়ত বইটি পড়েনি। … তবু, মারসোর তুলনায় অন্তত, কিছুটা ‘ভিতরে’ সে ছিল। অন্তত হত্যার পূর্বে তার এক বছরের ডায়েরি পড়ে তাই মনে হয়। তার অন্তত কিছুটা দুঃখ ও কিছু বেদনাবোধ অবশিষ্ট ছিল। সে পাখি ভালোবাসত। বরাইবুরু যাবার জন্যে সে ‘ছটফট’ করত। তার জীবনে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে আইভি সোম এসেই তাকে সব মূল্যবোধের ‘বাইরে’ ঠেলে দিল। তার মৃত্যুদণ্ড আইভিই ঘোষণা করে গেছে। …

‘গত দেড় বছর ধরে দিনের পর দিন কাঠগড়ায় এসে সে দাঁড়িয়েছে। আমি তার শূন্য, সর্বরিক্ত চাহনি লক্ষ করেছি। প্রায় কোনো প্রশ্নেরই সে জবাব দেয়নি। এবং যেটুকু দিয়েছে, তা কত নিরাসক্তভাবে!

[অ্যাডভোকেট জেনারেল : আপনার আন্ডারউয়্যারে ১৮টি রক্তবিন্দু পাওয়া গেছে যা নিহত আইভি সোমের।

আসামী : নিরুত্তর।

অ্যা জে : এই থান ইটে নিহতের রক্তমাংস পাওয়া গেছে।

আসামী (আনমনে) : হ্যাঁ, ওটা দিয়েই আমি তার মুখটা থেঁতো করি।

অ্যা জে : (বিচারকের প্রতি) ইওর অনার, অ্যাটেমপ্ট টু কনসিল এভিডেন্স।

(আসামীর প্রতি) : কেন?

আসামী : নিরুত্তর।

অ্যা জে : (চিৎকার করে) আই সে, হোয়াই? হোয়াই ওয়াজ দা আইডিয়া?

আসামী : আমি তাকে খুন করেছি।

অ্যা জে : আপনি একা নন।

আসামী : হ্যাঁ আমি একা।]

১৮ পাতায় এসে দণ্ডদানের ঠিক প্রাক্কালে জাস্টিস বসাকের ভাষা স্পষ্টতা হারিয়ে ফেলে। দু-লাইনের ফাঁকগুলি পড়ে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে। তাঁর রায়ের শেষ কটি প্যারাগ্রাফে ছিল এইরকম—

‘আমি মানুষের ভালোবাসায়, মানুষকে ভালোবাসায় বিশ্বাস করি। আমি বিশ্বাস করি, যদি ভালোবাসার, কোথাও কোনো মানুষের মনে, মৃত্যু হয়, তা সাময়িক। ভালোবাসা আরও অব্যর্থ শক্তিতে তারই মনে আবার বেঁচে উঠবে। যারা খুন করে, হ্যাঁ, আমি তাদের ঘৃণা করি।

‘আসামী বাসনা চক্রবর্তীর অপরাধ সম্পর্কে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু, আমার মনে একটা সংশয় থেকেই গেলই যে আসামী সাধনধন চক্রবর্তী তারই প্রেম-ভিখারিণী আইভি সোমকে কি সত্যিই খুন করেছিল, না, এটা, তার পক্ষে, একজন আউটসাইডার হিসাবে, ছিল আত্মহত্যা? যদি শেষোক্তটি সত্য হয়, তবে ঈশ্বর জানেন, সকল আত্মহত্যাকারী মানুষের কাছে যা পায়, সেই সহানুভূতি ও করুণা আমার কাছেও সে পেতে পারত। …

‘তবু, এটাই সত্যি যে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে আসামি সাধনধন ও বাসনা চক্রবর্তী পূর্বপরিকল্পনামতো ঠান্ডা মাথায় খুনই করেছে। কেইন খুন করেছিল অ্যাবেলকে। কেউ খুন করলে সমাজে থাকার অধিকার তার আর থাকে না। কেইন পালিয়েছিল মরুভূমিতে। সেখানে মরে ছিল। আমাকেও তাই মৃত্যুদণ্ডই দিতে হবে।

‘আমি, ৩৪ উপধারাসহ পঠিতব্য ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুসারে আসামী সাধনধন ও বাসনা চক্রবর্তীকে মৃত্যু পর্যন্ত দড়িতে ঝুলিয়ে রেখে ফাঁসির আদেশ দিচ্ছি। আসামী সাধনধন চক্রবর্তীর মৃত্যু-পর আত্মার জন্য আমি সেই সঙ্গে ঈশ্বরের কাছে অগ্রিম শান্তি কামনা জানাই।’

২২ পৃষ্ঠাব্যপী রায়ের এখানেই শেষ। রাষ্ট্রপতির কাছে সাধন চক্রবর্তীর পিতা অশীতিপর শ্রীহরিপ্রসাদ চক্রবর্তীর ক্ষমা-আবেদন নামঞ্জুর হবার পর ১৯৭২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্সি জেলে, ভোর রাত্রে, সাধনধন ও বাসনা চক্রবর্তীর আধ ঘণ্টা আগে পরে ফাঁসি হয়। ফাঁসির মঞ্চের দিকে যাবার সময় সাধনধনের কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু, বাসনা চক্রবর্তী ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁকে নাকি অঞ্জান অবস্থাতেই ফাঁসি দেওয়া হয়।

গল্পটি কল্পনাপ্রসূত

১৯৮৭

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *