আঁধার রাতের কল্লোল
অন্যান্য মহকুমা শহরের সঙ্গে রামপুরহাটের একটু তফাত আছে। এমনিতে তেমন কিছু না। স্টেশন থেকে বেরোলে সেই রিকশার ভঁক-পঁক, টেম্পো আর অটোর কিলবিল। খোঁয়াড়ে বাসের গুঁতোগুঁতি। ছাদভরতি মাল ও মানুষ। বাস যখন শহরের মধ্যে দিয়ে যায়, বৈশিষ্ট্য বলতে তখনও কিছু চোখে পড়ে না।
স্টেশন এলাকা পেরিয়ে প্রথমে রেল-কোয়ার্টার্স, তারপর কোর্ট-কাছারি স্কুল আর কলেজ, অব্যবহৃত রবীন্দ্রসদন। দোচালা মিষ্টির দোকানের সামনে কেলেকুলো বেঞ্চি। পথের ধরে কলাপাতার ওপর শোয়ানো পেঁকো পুকুরের বোকা কাতলা, সামনে রুখুসুখু মেছুনী। সর্বত্র যা। সিনেমা হলের নাম ওয়েস্টার্ন টকিজ।
নতুনত্ব বলতে, বহরমপুরে রিলে সেন্টার খোলার পর, এদান্তি কিছু কিছু ছাদে বুস্টারসহ টিভির অ্যান্টেনা দেখা দিয়েছে, এই যা। এ-সবেরই মধ্যে দিয়ে ধুলোভরা সরু পথ জুড়ে দুমকাগামী গতরজব্দ বাস চলে হেলেদুলে। যেন, স্বাধীকারপ্রমত্ত ষাঁড়, কাশীর।
তবে, এহ বাহ্য। অন্তত, রামপুরহাটের ক্ষেত্রে। কেননা, শহরের পশ্চিমদিকে ছ-ফুঁকো নামক রেল-টানেল থেকে একবার বেরোলেই পরিবেশ আর আবহাওয়া সব যেন কেমন জাদুবলে হঠাৎ বিলকুল পালটে যায়। আরও পাঁচশ গজ এগিয়ে ব্রাহ্মণী নদীর খাল। এবং এই খাল-পোলটা পেরোলে রামপুরহাট—বৈশিষ্ট্য চোখে না পড়েই পারে না যে, সারা পশ্চিমবঙ্গে হয়ত এই একটিই শহর, যার শহরতলি বলে কিছু নেই। বা, থাকলে, তা একটি সুদীর্ঘ এবং ঝকঝকে, অম্লান চিত্র প্রদর্শনী!
৪০ মাইল দূরে সেই দুমকা পর্যন্ত ধুলোকাঁকরহীন, চিক্কণ, কুচকুচে কালো পিচের রাস্তা। আঁক-বাঁক নেই, অনর্গল, এক্কেবারে নাকবরাবর সোজা। রাস্তার দুধার দিয়ে টানা লালমাটির বর্ডার। আর, দুই দিকে— দুই দিগন্ত পর্যন্ত, যতদূর দু’-চোখ যায়— উঁচুনিচু, হাঁদা ল্যাটেরাইট, জমি শুধু। চাষবাস হয় না, তাই আল বলে কিছু চোখে পড়ে না কোথাও। যেজন্যে, গ্রামগুলিও দূর দিগন্তরেখায় সরে গেছে। শুধু শালবন মাঝে-মাঝে, টিলা। নিরবধি সময়, জোরালো হাওয়া আর অনুর্বর বাঁজা জমি। ক্বচিৎ, গির্জার রক্তিম মুণ্ডু দেখা যায়। ছানার জলের মতো নীল আকাশের গায়ে, এছাড়া কিছু, কোনো অ্যান্টেনা, কোথাও চোখে পড়ে না।
১০ মাইল দূরে প্রথম বাঁশের বেড়া— বিহার বাংলা বর্ডার। এরপর এক কিলোমিটার ভারতসরকারের জমি—নো ম্যানস ল্যান্ড। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এখানে এয়ারফোর্সের একটি ছোট স্ট্রিপ ছিল। এখানে বাস দাঁড়ায়। এখান থেকে শুরু বড়ো-বড়ো টিলার। সিঙ্গারসি পাহাড় দেখা যায়।
এখানেই, বিশেষত সকালেবেলায় ‘বিজয় ভারত’ বাসে উঠলে, কন্ডাক্টর-কাম-মালিক মিছরিলালজি বাসযাত্রীদের উদ্দেশ্যে এখনও হেঁকে ওঠেন, ‘জয় জয় বাবা অম্বিকা মহারাজ কী—’
বাঙালি-বিহারী-আদিবাসী নির্বিশেষে যাত্রীরা বলে ওঠেন, ‘জয়!’
অম্বিকা মহারাজ আজও এ-পথের দেবতা।
জায়গাটা নাম সুরুচুয়া। এরপর থেকে, না-ঘরকা না-ঘাটকা বলেই হয়ত, সামনে এক মাইল জুড়ে কাচপাহাড়ির ভারী জঙ্গল। যাত্রীরা যখন সামনের দিকে তাকিয়ে পথের দেবতার উদ্দেশে হাত জোড় করেন, তখন, সেদিকে তাকালে দেখা যায়, দূরে, ঘন জঙ্গলের মাথা ছাড়িয়ে সম্ভবত কোনো টিলার ওপর— না, কোনো মন্দির-চূড়া নয়— নয় কোনো ত্রিশূল— নীল আকাশের গায়ে একটি দুর্বোধ্য জ্যামিতিক চিহ্ন আঁকা রয়েছে; একটি সুউচ্চ অ্যান্টেনা।
কাচপাহাড়ির জঙ্গল-মহলের মাঝখানে ওই বিশাল অ্যান্টেনাটির প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৯ সালে। একটি পুঁচকে ১৪ ইঞ্চি টিভির—জন্যে, যদিও নির্ভেজাল ‘সোনি’।
আসলে, সবটাই ভিকি-র ভুল। কাচপাহাড়ি? ভিকি ভেবেছিল, সে আর কত ছোটো জায়গা হতে পারে? সান্টা ফে হোক, সান হোজে হোক, মডেরা হোক—হোয়াইট গেট হোক—আর কত ছোট হবে? সেই খুব ছোটবেলায় একবার যা ইন্ডিয়ায় এসেছিল। ছিল দিল্লি আর বম্বেতে। সে আর জানবে কী করে, যে, কলকাতাতেই টিভি এসেছে মাত্র কবছর আগে। আর খোদ রামপুরহাটে ইলেকট্রিক এসেছে স্বাধীনতার পর সে বেশ কিছু বছর গত হবার পরেই।
তবে, ৫ হোক, ১৪ হোক, ২০ ইঞ্চি হোক, অ্যান্টেনা ত একই।
তখনও বহরমপুরে কি আসানসোলে রিলে সেন্টারের কথা সরকারের মস্তিষ্কেও আসেনি। টানা সাতদিনের চেষ্টায় রামপুরহাট থেকে জিনিসপত্র আনিয়ে সে নিজের হাতে বুহু-বুস্টার লাঞ্ছিত ওই বিশাল অ্যান্টেনাটি বানিয়েছিল। জঙ্গল-মহলের মধ্যে একটি টিলার ওপর সেটি ফিট করে, খুব-কাছে-নয় পাথরকলের জেনারেটর থেকে তার টেনে টিভি চালু করতে লেগেছিল আরও সাতদিন। আর প্রথম যেদিন সন্ধেবেলায় টিভি চালু হল, সে একটা সেরিমোনি বটে।
পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে লোক এসেছিল। সকাল থেকেই তেলেভাজা, পাঁপড় আর শুকনো লাড্ডুর দোকান বসে গিয়েছিল। মায়, চুনি-ব্লাউজ আর বেলুনওয়ালাও বাদ যায়নি। লোক এসেছিল শিকরোপাড়া, মুর্গাডাঙা, হরিণধুকড়ি আর আদলপাহাড়ি থেকে। সুদূর আসানবনি ও মহুলপাহাড়ি থেকে লোক আসে গোরুর গাড়িতে চেপে। খবর নয় ত— শিমুলের তুলো—এখানে হাওয়ায় ওড়ে। অবাক কাণ্ড সত্যিই। কাচপাহাড়ির জঙ্গলের মধ্যে অম্বিকা মহারাজের আশ্রমে একটা টেবিলের ওপর টুল বসিয়ে এ-অঞ্চলের আদিবাসী মানুষ কিনা বিস্ময়বাক্সে সিনেমা দেখল—যা শহর রামপুরহাটের বাবুমানুষের দেখতে তখনও চার বছর বাকি। বস্তুত, রামপুরহাট কলেজ থেকে আমার বন্ধু অধ্যাপক তমোনাশ ভট্টাচার্যও ছিলেন সেদিনের সেই উদ্বোধন উৎসবে। সস্ত্রীক এবং সপুত্র। সেদিনটা থেকে গিয়েছিলেন।
মনে পড়ে ১৯৭৯ সালের ২৫ ডিসেম্বরের বড়োদিন। গেম-টিচার সন্তোষদা আর আমি সায়েন্স বিল্ডিং-এর পেছন দিয়ে শর্টকাটে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছি স্কুল-গেটের দিকে। ধূলিয়ান থেকে আজ বিকেলে ওঁর শ্যালক অরুণবাবুর আসার কথা। একটু আগে স্কুলের সামনে দুমকার শেষ বাস দাঁড়াবার শব্দ আমরা কোয়ার্টারে বসে শুনতে পেয়েছি। বিকেলবেলা। দূর থেকে আমরা দেখতে পেলাম, অরুণবাবু কোথা, তার বদলে বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ২৪-২৫ বছরের এক ফিটছয়েক সাহেব-বাচ্চা, (পরে জেনেছি, ১৮, ওদের, আমেরিকানদের, নাকি তখনই ২৪-২৫ দেখায়)। তার পরনে সাদা শর্টস, গায়ে নীল উইন্ড-চিটার, পিঠে স্লিপিং ব্যাগ। পায়ের কাছে একটি মাঝারি প্যাকিং বাক্স ও প্রকাণ্ড এক কিটস-ব্যাস পড়ে আছে। সে দাঁড়িয়ে আছে দুমকা রোডের ধারে। তার ঠিক পিছনে আমাদের কম্পাউন্ডের একমাত্র পান্থপাদপ গাছের পাতা কটি সবুজ চালচিত্রের মতো ছড়িয়ে আছে। সত্যি, দূর থেকে তাকে মনে হচ্ছিল বুঝি গ্রহান্তরের কোনো লাল-মানুষ। হঠাৎ কাচপাহাড়ির ভাঙা রানওয়েতে ফোর্সড ল্যান্ডিং করতে বাধ্য হয়েছে। সসার নামাবার মতো এর চেয়ে উপযুক্ত স্থান এ-অঞ্চলে আর কোথায়-বা। চিল-শকুন ত এখনও নামে।
‘হাই।’ দূর থেকে আমাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে সে হাসল। সহজেই চেনা যায়, প্রথম দর্শনেই ভালো লাগে, এমন মানুষ বিরল হয়ে আসছে। সে ছিল তেমনি একজন মানুষ। যখনই ইচ্ছে করি, তার সেই প্রথম দেখা সহাস্য, তরুণ দেবমূর্তি আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। পিছনে পান্থপাদপ।
অস্তরাগের আলোয় তাকে আরও লাল দেখাচ্ছে।
তার চোখে আকাশের দু-দুটি নীল তারা।
সে বলল, তার নাম ভিক্টর। আসছে ক্যালিফোর্নিনায় সাক্রামেন্টো থেকে। ডু উই নো সামবডি কলড আমবিকা চোন চাকারবোর্টি হু লিভস অ্যারাউন্ড হিয়ার—অ্যাট আ প্লেস কলড…কলড…সে জানতে চাইল। সে জায়গাটার নাম ভুলে গেছে এবং পুরো ঠিকানাটি হারিয়েছে।
‘এ-জায়গার নাম ত সুরুচুয়া।’
‘সুরোচোয়া। আ, দ্যাটস রাইট। বেঙ্গাল-বেহার বর্ডার?’
‘দ্যাটস রাইট।’
‘দেন দা প্লেস মাস্ট বি অ্যারাউন্ড হিয়ার।’ বলে সে দু-কাঁক ঝাঁকিয়ে স্রাগ করে বিজয়ীর হাসি হাসে।
‘আমবিকা? চোন?’ যদিও এমন সম্ভাবনার কথা দূরতম কল্পনাতেও আসে না, তবু, কী মনে হল আমার, তার অনুকরণেই নামটা উচ্চারণ করে আমি জানতে চাইলাম, ‘ইজ হি এ হারমিট?’
‘ইয়াপ। ইয়াপ।’ শরীর দুলিয়ে ছেলেটা বোধহয় ব্রেক-ডান্সের কোনো একটা মুভমেন্টই করে নিল! তীরে ওঠার আগে হাঁসের মতো গলাটা বাড়িয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল, ‘হি ইজ আ সাড়ু।’
বৃদ্ধ অম্বিকা মহারাজের খোঁজে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পরপার থেকে উড়ে এসেছে এই নীলচক্ষু, স্বর্ণকেশ তরুণ জুপিটার? এও বিশ্বাস করতে হবে? আমার একটা স্বভাব এই যে কোনো কিছু ঘটতে দেখলে আমি সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নিই। কিন্তু, এ যেন মানতে পারছি না কিছুতেই।
‘তাঁকে কেমন দেখতে বল ত?’
‘তা আমি বলতে পারব না। খুব ছোটবেলায় একবার মাত্র হার্ডওয়ারে দেখেছি।’
‘হরিদ্বার?’
‘নো, হার্ডওয়ারে।’ ভিক্টর আবার বলে।
হ্যাঁ, এরপর আর কোনো সংশয় রেখে লাভ নেই। পরনে রক্তাম্বর ও মাথায় জটাজূট, অম্বিকা মহারাজ হরিদ্বার থেকে স্কুলে এসে ওঠেন ১৯৭৪ সালে। তাঁকে স্কুল-মন্দিরে পুরোহিতের কাজ দেওয়া হয়।
ক্রমে তাঁর, বিশেষত কানের লতি ও নাকের পাটায়, গলিত-কুষ্ঠের লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর কাচপাহাড়ির জঙ্গলে তৈরি করলেন ওঁর নির্জন সাধনক্ষেত্র। ৭৬ থেকে সেখানে।
‘তা, তোমার’, শীতের দেবদারু-পাতার মতো ঘুরে-ঘুরে ঝরে পড়ছে আমার বিস্ময়, আমি জানতে চাইলাম, ‘অম্বিকা মহারাজের সঙ্গে কী দরকার?’
‘হি ইজ মাই আঙ্কল।’ ছেলেটা সগৌরবে জানাল। আবার!
আকাশের নীল তারার মতো ছলছলিয়ে উঠল তার চোখ। সে বলল, ‘মাই ড্যাডস ওন এল্ডার ব্রাদার। দা ওনলি ওয়ান অন টপ অফ দি প্ল্যানেট মাই ব্লাড উড রেকন অ্যাজ মাই ওন।’
‘দিস প্ল্যানেট’ শব্দ দুটি সে বিশেষ, জোর দিয়ে বলে। যেন, সত্যিই সে ‘দ্যাট প্ল্যানেটে’র মানুষ!
পূর্ণিমার রাতে এখানে সন্ধ্যার আঁধার হয় না। আলো থাকতে থাকতেই চাঁদ বনজঙ্গলের মাথায় উঠে পড়ে। তখন দিনের আর চাঁদের আলো মিশে এমন এক না-রুপোলি, না-সাদা কল্প-রঙ তৈরি হয় যা হয়ত স্বর্গেরই। স্যিলুয়েটে দুমকার পাহাড়। তার মাথায় এখনও কমলা-কোয়া আকারে সূর্য, তিন-চতুর্থাংশ পাহাড়ের পিছনে নেমে গেছে। দিগন্তে সাদা মেঘ রপবদল করতে করতে এখন রূপ নিয়েছে সোপানশ্রেণিসহ এক অলৌকিক দুর্গতোরণে। এক-একটি সূর্যাস্ত রশ্মির স্পর্শে ধাপগুলি একে একে রাঙা হয়ে উঠছে। পাথর কল থেকে ফেরা একদল সাঁওতালি মেয়ে খুনসুটি-রাগিণীতে গান গাইতে গাইতে পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে।
সেতমবে বিচড়ি তাসি-ইমে
রাচাড়ে হুড় তাসি-ইমে…
রোদ উঠেছে। ওগো, তোমার উঠোনে কাপড় শুকতে দাও। ওগো, উঠোনে ধান শুকতে দাও…
রাস্তা ছেড়ে তারা দল বেঁধে মাঠে নামে। সূর্যাস্ত ছেড়ে তাদের গানের সুর চন্দ্রোদয়ের পথে মিলিয়ে যায়।
‘আ। দেন, দিস ইজ দা হেভেন!’ ভিক্টর মুগ্ধ মনে বলে ওঠে।
বক্ষপট বিস্তৃততর করে ফুলিয়ে সে প্রশ্বাস নেয় ও বহু সময় বুকে আটকে রাখে।
‘হ্রীং’ আর ‘ক্রীং’ এই দুই বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে অম্বিকা মহারাজও এভাবে শুভ্র, কেশরাশিতে ভরা তাঁর বিশাল বুক ফুলিয়ে রাখতে পারেন, আমার মনে পড়ল।
তবে সে আরও বহুসময় ধরে। তান্ত্রিক সাধক। এ-জিনিস বহু সাধনার ফল। সহস্রপল ধরে এই ক্রিয়া দশ লক্ষবার করতে পারলে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে, উনি আমাকে বলেছিলেন (‘স্বর্গ-মর্ত-পাতাল কোত্থাও কেউ টেরটি পাবে না, বুঝলে বাবা?’— অম্বিকা মহারাজ)
‘আই লুক এগজ্যাক্টলি লাইক মাই আঙ্কল। ডোন্ট আই? লুক, অ্যাট দিস—জোড়া ভ্রূ দেখিয়ে সে কোলের শিশুর দেয়ালি-হাসি হাসে।
বলে, ‘হী অলসো উইয়ার্স দিস। ডাজন্ট হী?’
যেন ছদ্মবেশ, দুজনেরই। সে হাসতেই থাকে।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। জ্যোৎস্না এখানে এত প্রখর যে পথ চেনা দায় হয়ে ওঠে। সব একাকার হয়ে যায়।
এখন আর কাচপাহাড়ির জঙ্গলে ঢোকার প্রশ্ন ওঠে না। সে রাতটা ভিক্টর কাটাল আমাদের সঙ্গেই। সন্তোষদার বাড়িতে হ্যারিকেনের আলোয় ডিমের ঝোল দিয়ে মাধুরী বউদির হাতে-গড়া রুটি খেতে খেতে জানাল : সে ছাত্র। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন পড়ছে।
তার বাবা-মা গতবছর একসঙ্গে মোটর-দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
পৃথিবীতে জেঠু ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নেই। মা ছিলেন আইরিশ, মৃত পিতামাতার একমাত্র সন্তান। মা-র তরফে পিসে-মেসোরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে। যোগাযোগ নেই। ইন্ডিয়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন সকলকে চিঠি লিখে-লিখে হরিদ্বারের কাছে কনখলে বাবা কমলিবালার আশ্রমে সে জেঠুর খোঁজ পায়। চিঠি লিখে উত্তর না পেয়ে খ্রিসমাস-ব্রেকে নিজেই চলে এসেছে। হরিদ্বারে কমলিবালায় জেঠুর এক সতীর্থ সাধু ওকে কাচপাহাড়ির খবর ও পথ নির্দেশ দেন। বহুকষ্টে পথ চিনে সে এখানে পৌঁছেছে।
‘প্যাকিং বাক্সে কী এনেছ, ভিক্টর?’
আমি তখনো বিয়ে করি নি। সে রাতে পাশাপাশি তক্তপোশে শুয়ে আমি ওর কাছে জানতে চাই, ‘জেঠুর জন্যে কিছু নাকি?’
‘ইয়াপ। দ্যাটস রাইট। ইটস আ স্মল টিভি। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট।’
‘কাচপাহাড়িতে টিভি? হাঃ-হাঃ-হাঃ। পাগল ছেলে!’
‘হাসছ কেন? এখানে কোথাও জেনারেটর নেই?’
‘তা আছে। পাথর-কলগুলোয় থাকে। কিন্তু—’
‘কেন ওরা কানেকশান দেবে না? তোমরা সবাই ত টিভি দেখবে?’
‘তা হয়ত দিতে পারে। এখানে সবাই তোমার জেঠুকে শ্রদ্ধা করে।
কিন্তু, সবচেয়ে কাছাকাছি পাথর-কল থেকে তোমার জেঠু থাকেন অন্তত আধমাইল দূরে।’
‘দ্যাট, আই শ্যাল ফিক্স আপ। নো প্রবলেম। ডোন্ট ওয়রি।’ বলে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে থেকে দু-আঙুল বের করে সে আমাকে V-মুদ্রা দেখায়, ‘দিজ ইজ ভিকি। দে কল মী ভিক্টর।’
সত্যিই, দিন-পনের অক্লান্ত চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত অসাধ্যসাধন করল ভিকি। মাটিতে পোঁতা শিসল গাছের খোঁটা থেকে টানা কঠিন তার দিয়ে টানটান করে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে সে টিলার ওপর টাঙাল বিবিধ বুস্টারসহ এক বিশাল অ্যান্টেনা। পাথর-কল থেকে গাছগাছালির ডালপালায় বেঁধে মোটা ইনসুলেটর-দেওয়া তার টেনে নিয়ে গেল কাচপাহাড়ির জঙ্গলের মধ্যে। এই গ্রহের ওপর তার একমাত্র শোণিত-সম্পর্কের সাধনক্ষেত্রে সুদূর আমেরিকা থেকে বয়ে আনা পাণ্ডোরার বাক্সর মুখ সে খুলে তবে ছাড়ল।
তখন কে জানত, মাত্র ২ বছর যেতে না যেতেই ভূতচতুর্দশীর অন্ধকার রাতে তাকে এভাবে আবার কাচপাহাড়িতে ফিরে আসতে হবে! এবং, তাও এই অভিশপ্ত টিভিটার কারণেই।
অভিশপ্তই-বা বলি কী করে। ‘মন্ত্রসিদ্ধ’ বলতে বাধা কোথায়? কেননা, কাচপাহাড়িতে, তাঁর সাধনক্ষেত্রে, ঝুরি-নামা প্রাচীন অশ্বত্থের গুঁড়ির কাছে, মাটির বেদির ওপর, কালিকামূর্তির সঙ্গে রক্তসূত্রগাছি একটি বাঁধা ওই বৈদ্যুতিক যন্ত্রটি অথবা মাতৃমূর্তির উদ্দেশে আমি কতদিনই-না অম্বিকা মহারাজকে লাল কম্বলাসনে উত্তরমুখী বসে ধ্যান করতে দেখেছি। কখনও মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে উদাও কণ্ঠে
‘ওঁ নিত্যায়ৈ নমঃ। ওঁ ক্লিন্নায়ৈ নমঃ। ওঁ
মদদ্রমদয়ৈ নমঃ। ওঁ ফ্রেং ফ্রেং ক্রোং ক্রৌং
পশূন গৃহাণ ওঃ হং ফট স্বাহা…
একদিন দেখলাম, বেদির ওপর আঁকা, রহস্যময়, অনুন্মোচনীয় তান্ত্রিক যন্ত্র-চিহ্নের ওপর টিভিটা বসানো। তার সর্বাঙ্গে সিঁদুর ও রক্তজবার মালা। কালিকামূর্তির সামনে বসানো যেন চতুষ্কোণ ঘট একটি। মাটিতে ৭টি নির্জীব কাক পড়ে আছে। প্রত্যেকের পা লাল সুতো দিয়ে বাঁধা। হোমাগ্নি দাউদাউ জ্বলছে।
কাকগুলোকে দেখে বেশ বোঝা যায়, ওরাও জানে ওদের আহুতি দেওয়া হবে। টিভি-র পাশে কালো পাথরের দেবীমূর্তি। তারকাবিহীন শ্বেত চক্ষুদুটি ঝকঝক করছে। সামনে পোঁতা ত্রিশূল। তাতে লাগল কাপড় বাঁধা। ত্রিশূলের গোড়ায় একটি নরকপাল। তাতে মিলেমিশে থাকে গো, অশ্ব, মার্জার সারমেয় ও গর্দভ মূত্র—মহারাজের চেলা বটু সোরেন পরে পুলিশকে বলেছিল। সেদিন মহারাজের মন্ত্র ছিল :
‘দেবী মহাপিশাচিনী! ওঁ, হ্রীং, ক্রিং, শ্রীং, ক্লীং, হং হূ। বলিদানং দদাতি মে। গৃন্থতু। গৃন্থতু। গৃন্থতু। অ, র, ব, ফট, স্বাহা!
এত বলে দড়ি-বাঁধা প্রথম জ্যান্ত কাকটি ছুঁড়ে দিলে হোমাগ্নির মধ্যে। বলিদানের মন্ত্র। তা বলে দেবীমূর্তি ছেড়ে টিভি-পুজো! মহারাজা পাগল হয়ে গেছেন, সেইদিন প্রথম আমি বুঝতে পারলাম।
বলা নেই কওয়া নেই, ১৯৮১-র কালীপুজোর আগের দিন ভিকি এসে হাজির। চুলটুল উষ্কখুষ্ক। চোখের কোলে কালি। যেন কত রাত ঘুমায়নি।
তখন বিকেল ৪টে। বাস ত নেই এখন। এল কী করে। একজন মোটর সাইকেলে চেপে দুমকা যাচ্ছিল। হিচহাইক করে এসেছে, ভিকি বলল।
‘এ-সব কী শুনছি আঙ্কল!’ ভিকি জানতে চাইল, ‘পুলিশ নাকি আমার জেঠুকে অ্যারেস্ট করতে যাচ্ছে?’
‘ঠিকই শুনেছ।’ ওকে সত্যি কথা বলতে আমার বেশ কষ্টই হয়, ‘মানে আমিও তাই শুনেছি। তুমি কি সেইজন্যেই চলে এলে?’
‘আসব না?’ আগুনের নীল শিখায় দরদর করছে তার দুই চক্ষু, মুখচোখ লালে-লাল, সে বলল, ‘আঙ্কল টেলিগ্রাম করেছিল আমাকে। আই টুক দা ভেরি নেক্সট ফ্লাইট। শুনচি নাকি চারটে মার্ডার কেস ওঁর বিরুদ্ধে?’
‘হ্যাঁ।’ আমি শান্তভাবে বলি, ‘গত সপ্তাহে বটু সোরেনের খুনটা যদি উনিই করে থাকেন, তাহলে পাঁচটা।’
‘বাট আই ডোন্ট বিলিভ ইট!’ বুকে গোরিলার থাবড়া মেরে ভিকি বলল, ‘আমার আঙ্কল একজন সাধু। সে একটা পিঁপড়েও মারতে পারে না। সে করেছে পাঁচটা খুন। চালাকি!’
বললাম, ‘তুমি বাড়িতে এস। তোমাকে সব বলছি।’
‘নো-নো। আই মাস্ট মেক আ মুব টুওয়ার্ডস কাচপাহাড়ি। হিয়ার অ্যান্ড নাউ! আই মাস্ট সী মাই আঙ্কল ফার্স্ট। হাউ ইজ হী?’
‘উনি ত কদিন ধরে নিরুদ্দেশ।’
‘বাট হোয়ার ইজ হী?’
‘আমি কী করে জানব?’
‘কে জানবে? আই মাস্ট মীট হিম।’
‘জানবে পুলিশ। পুলিশই তাঁকে আজ সাতদিন ধরে পাচ্ছে না। তুমি কোথায় পাবে?’
‘দা পোলিশ কান্ট টাচ হিম।’ ওর গোড়ালি-ঢাকা সাদা ‘নিক’ জুতো দিয়ে, চলতে চলতে, মাটিতে লাথি মেরে ভিকি দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘আমি আগাম জামিনের কাগজপত্র কলকাতা থেকে তৈরি করে সঙ্গে এনেছি। রামপুরহাটের এস ডি পি ও মিঃ সাংমা সব দেখেছেন। উনি নিজে স্বীকার করেছেন, আমি যদি সিউড়ির সদর-কোর্টে কাল পিটিশনটা ফাইল করতে পারি—দে কান্ট ডু এনিথিং। বাট হোয়ার ইজ হী?’ সে স্কুলের সায়েন্স ও আর্টস বিল্ডিং, হস্টেল, অফিসঘর, কিচেন এমনকি ঊর্ধ্বপানে এ-অঞ্চলের দীর্ঘতম সেগুন গাছটার মাথাও চুলচেরা চোখে দেখতে থাকে, ‘আই নীড হিজ সিগনেচার।’
কিছুতেই, কিছুতেই ও আমাদের বাড়ি গেল না।
আজ ভূতচতুর্দশীর রাত। আগামীকাল কালীপুজো। কাচপাহাড়ি যেতে যেতে ঘনঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। যেখানে পূর্ণিমার আলোয় খবরের কাগজের হেডিং পড়া যায়, সেখানে আমবস্যার রাত কতদূর দুর্নিরীক্ষ্য, কালো হতে পারে তা অনুমেয়।
‘ওণ্ট ইউ মীট ইওর আন্টি?’
‘তুমি বিয়ে করেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘না। ভিকি বলল, ‘এখন না। চল, আগে জেঠুকে খুঁজে বের করি। হী হ্যাজ সেন্ট মী অ্যান এস-ও-এস।’
‘চল, অন্তত একটা টর্চ আনি বাড়ি থেকে?’
‘আই হ্যাভ ওয়ান। আই হ্যাভ ওয়ান।’ বলে মাটিতে কিটসব্যাগ নামিয়ে কাঁপা হাতে সে চেন টানে। একটা ছসেলের মস্ত ব্যাটারি বের করে জ্বেলে দেখে বলল, ‘ওককে। দিস ইজ ওয়ার্কিং।
আমাদের স্কুল কম্পাউন্ড বিশাল। প্রায় ৯০ বিঘের ওপর। এর মধ্যে ১০ বিঘের মতো জুড়ে স্কুল বাড়ি, মন্দির, মাস্টারমশাই ও স্টাফদের কোয়ার্টার, ছেলেদের হস্টেল, রান্নাবাড়ি, প্রাোয়র হল, জিমনাসিয়াম—মায় একটা স্কুলের নিজস্ব পোলট্রি— একটি গোশালাও এমনকি—বাড়িই প্রায় খান-পঞ্চাশ। ডিনামাইট দিয়ে ফাটিয়ে ১০-১২টি কুয়ো খোঁড়ার প্রয়াসের মধ্যে ৪ টি সফল হয়েছে। বাকি ৮০ বিঘে জুড়ে স্কুলের খেলার মাঠ ও জমি। ধান না হলেও, শাকসবজি ও রবিশস্য যথেষ্ট হয়। জমির প্রায় সবটাই স্থানীয় সাঁওতালদের দান। থিয়েটার বা নাচ-গানের প্রচলন নেই—নইলে সত্যানন্দ শিক্ষাপীঠকে অনায়সেই একটা মিনি শান্তিনিকেতন বলা যেত। বিহার থেকে আদিবাসী ছেলেরা এখানে পড়তে আসে।
স্কুলের বিরাট কম্পাউন্ড পেরিয়ে মাঠ ভেঙে আমরা সুরুচুয়ার চেকিং পোস্টে গিয়ে উঠলাম।
যেতে যেতে আমি ওকে যতদূর যা জানি, সংক্ষেপে বললাম। সেবারও কাচপাহাড়ি ছেড়ে যাবার মাসছয়েকের মধ্যেই সারসডাঙ্গার একটি কিশোরী সাঁওতাল মেয়ে নিখোঁজ হল। তার নাম সুশীলা হেমব্রম।
সুশীলা হারানো ছাগল খুঁজতে কাচপাহাড়ির জঙ্গলের মধ্যে ঢুকেছিল। ছাগল পাওয়া গেল। কিন্তু, সুশীলার খোঁজ আর পাওয়া গেল না। কাচপাহাড়ির টিলা থেকে একটা জলধারা বেরিয়ে এসে সুরুচুয়ার কাঁদড়ে (ডোবায়) এসে জমে। পরদিন ভোরে দেখা গেল কাঁদড়ের জল লাল। কিন্তু, তখন কেউ কিছু ভাবেনি। সেদিনটার তিথি ছিল, পরে মনে করে দেখা গেছে, অমাবস্যার চতুর্দশী।
‘সো হোয়াট?’ ভিকি বলল, ‘দ্যাট ডাজন্ট নেসেসারিলি ফিক্স মাই আঙ্কল অ্যাজ দা মার্ডারার।’
‘আরে, শোনো না তুমি আগে সবটা।’ আমি যেতে যেতে ওকে বলি, তিন মাস যেতে না যেতেই, আবার সেই অমাবস্যার রাতে, চতুর্দশী তিথিতে, ফরেস্ট গার্ড ভুটলের মেয়ে চম্পা নিরুদ্দেশ হল। সে ফিরছিল মলুটির মেয়েদের স্কুল থেকে, সাইকেলে চেপে। পথের ধারে সাইকেল আর বইখাতা পাওয়া গেল। কিন্তু এবারেও মেয়েটার খোঁজ পাওয়া গেল না।
এমন ঘটনা এখানে আগে ঘটেনি। তিন মাসের মধ্যে দু-দুটো মেয়ে নিখোঁজ, দুজনেই কিশোরী, আর তাও দুবারই অমাবস্যার চতুর্দশীতে? পুলিশে খবর দেওয়া হল।
কিন্তু, ভিকি আর শুনতে চায় না। ঘটনার গতি কোন দিকে যাচ্ছে টের পেয়ে সে বলল, ‘আই হ্যাভ সীন আওয়ার কনসাল জেনারেল ইন ক্যালকাটা। হী হ্যাজ অ্যাসিওর্ড মী দ্যাট হী উড কনট্যাক্ট দা হোম মিনিস্টার। আই অ্যাম আম্যারিকান সিটিজেন। হী ইজ মাই আঙ্কল। নান ক্যান টাচ হিম। আই শ্যাল মুভ হেভেন অ্যান্ড আর্থ টু সেভ হিম।’
বুঝলাম, বাকি দুটি মেয়ের কথা ওকে বলে আর লাভ নেই।
তাই উপসংহারে বলি, ‘অনলি লাস্ট উইক, বটু সোরেন হ্যাজ বিন মার্ডারড। হিজ বডি ওয়াজ ফাউন্ড মিউটিলেটেড বায় ও চপার।’ ‘বাট, নট বায় মাই আঙ্কল।’
‘কিন্তু, পুলিশের ধারণা তাই। মিঃ সাংমা নিজে আমাকে তাই বলেছেন। বটু সোরেন ছিল পুলিশের স্পাই। চেলা সাজিয়ে তাকে অম্বিকা মহারাজের আখড়ায় পুলিশই ঢুকিয়ে ছিল। টের পেয়ে, অম্বিকা মহারাজই তাকে খুন করেছে বলে পুলিশ মনে করে।’ আর এরপর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ।
‘অবশ্য, এত কথা লোকে এখনও জানে না।’ জানি, শুধু আমরা দু-একজন। লোক এখনও মহারাজকে আগের মতোই ভক্তি করে, ভিকিকে আশ্বস্ত করতে আমি বলি।
যেতে যেতে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এসেছে। আমরা দুমকা রোড ধরে চলেছি। দুদিকে কাচপাহাড়ির জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে।
রাস্তাটা এখন থেকে চড়াই। শপাঁচেক ফুটের মতো উঠে গিয়ে, ইংরেজি ‘U’ অক্ষরের মতো বেঁকে, আবার নিচে নেমে গেছে। বাঁকের মুখেই বাঁ-দিকের জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা। মহারাজের আখড়া সেখান থেকে মিনিট কুড়ির পায়ে-হাঁটা পথ।
ভিকির ছ-সেলের আমেরিকান টর্চ আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। কেউ কোত্থাও নেই। দূর মলুটিতে আজ থেকে ৭ দিন ভূতচতুর্দশীর মেলা। গেমস-টিচার সন্তোষদা মাধুরী বউদি আর মেয়ে হেনাকে নিয়ে মেলায় গেছেন। ওখান থেকে মাদলের শব্দ ভেসে আসছে। সত্যি, দূরত্ব অতিক্রম করার ব্যাপারে মাদলের জুড়ি নেই। লং ডিসট্যান্স রানার বলতে যদি কিছু বোঝায় তবে তা ওই সাঁওতাল পরগনার রাতের মাদল-শব্দ।
দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত শুধু অন্ধকার। শুধু আমারা দুজন। এ-পথের প্রতিটি নুড়ি, আমার চেনা, প্রতি ইঞ্চি জমি আমার মুখস্থ টর্চ রয়েছে। ‘আই হ্যাভ আ ওয়েপন’, ভিকি আমাকে অভয় দিয়েছে। মনে হয় রিভলবার। তবু আজ আমার গা ছমছম করে। আমার খুব ভয় করে। একটু পরেই আসবে সেই ইউ-টার্নের চড়াই, যার শুরুতে বটুর বডি সারারাত পড়েছিল। শেয়াল অথবা নেকড়ে। নেকড়ে টাইপ এক ধরনের বনবেড়াল এখানে যথেষ্ট। দেহের কয়েকটি অংশ পাওয়া যায়নি। তারা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে।
সেই জায়গাটার দিকে, বটুর নির্মম বিধিলিপির দিকে, আমি যত এগোই আমার ভয় তত বাড়ে। গতি শ্লথ হয়ে আসে। ‘প্লীজ ওয়াক স্টার পল্টুদা, উইলিউ!’ মিনতি-মাখা সুরে ভিকি আমাকে অনুরোধ করল।
মলুটির দিকে থেকে একটা জিপ আসছে মাঠের খানাখন্দ ভেঙে। জিপের টাল-মাটালের সঙ্গে হেডলাইটের তীব্র আলো স্বেচ্ছাচারী চাবুকের মতো উলটে-পালটে পড়ে তুলে নিচ্ছে অন্ধকারের চামড়া। একবার বোধহয় গাড্ডায় পড়েই কিছুক্ষণ শিবনেত্র হয়ে পড়ে রইল গাড়িটা। হেডলাইটের আলো আকাশের দিকে কতদূর উঠে গিয়ে ঠিক কোনখানটায় অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে, তা বোঝা অসম্ভব। ইঞ্জিন ফের স্টার্ট নিলে শব্দ শুনে বুঝি, রেঞ্জার নস্করবাবুর জিপ। উনি একই মলুটি গেছেন এবং ওঁর গাড়িতে সন্তোষদার সপরিবারে ফেরার কথা।
দুমকা রোডে সামনের দিকে উঠে পড়ে গাড়ি আমাদের দিকে এগিয়ে আসচে। আমরা তখন জঙ্গলে ঢোকার পায়ে-হাঁটা পথের সামনে পৌঁছেছি।
স্টার্ট বন্ধ করে ও হেডলাইট নিবিয়ে জিপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লেন নস্করবাবু। গাড়ির আলোয় আমাদের আগেই দেখতে পেয়েছেন।
‘ভিক্টর না?’
‘হ্যাঁ। ও একটু আগে পৌঁছেছে। আপনি একা যে। ওরা এল না?’
টর্চের আলোকছায়া এলাকায় নস্করবাবুর মুখ যতটা দেখা গেল, সেখানে ভয়ের বিচিত্র চলচ্ছবি।
‘হেনা মলুটির মেলা থেকে ডিসঅ্যাপিয়ার করেছে! আমি জানতাম আজও একটা চতুর্দশী। আজ কিছু হতে পারে। তাই নিজের মেয়েকে নিয়ে যাইনি। কিন্তু, হেনাকে আগলে রেখেছিলাম সর্বক্ষণ।
হঠাৎ কী যে হল নস্করদা হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন, ও-হো-হো-হো-হো। সব শালা ওই অম্বিকা-খুনের কাজ।’
‘ডীড হী সে আমবিকা!’
আমেরিকায় ভিক্টরদের বাড়িতে বাংলার কিছু কিছু চল ছিল।
কিন্তু, এতখানি বাংলা বোঝার এলেম নেই। ‘অম্বিকা’ শুনেই সে কৌতূহলী হয়ে পড়েছে।
‘হোয়াট হ্যাজ হ্যাপেনড উইথ মাই আঙ্কল? হ্যাজ হী সীন হিম!’
ওকে উত্তর দেবার প্রবৃত্তি সেই মুহূর্তে ছিল না। ও ত শুনে একটা কথাই বলবে। বাট, হী ইজ নট। বাট, হী হ্যাজ নট।
নস্করদার কাছে জানতে চাইলাম, ‘ওরা কোথায়?’
‘মাধুরী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। সন্তোষ নিয়ে আসছে। মলুটিতে মিঃ সাংমা সে-ই নিজে এলেন। এক কোম্পানি পুলিশও প্লেন ড্রেসে আগে থেকে ছিল। এস ডি পি ও ঠিকই ভেবিছিলেন যে আজ কিছু হতে পারে এবং হলে ব্যাটাকে হাতেনাতে ধরবেন। কিন্তু উনি যখন পৌঁছলেন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বোকা বেহারি কনস্টেবলগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে মেছো কুমির তখন মাছ নিয়ে জলে নেমে গেছে।’
একটানা এতক্ষণ দমবন্ধভাবে বলে বুক খালি করে নস্করদা একটা প্রশ্বাস ফেললেন।
‘তোমরা কী আশ্রমে যাচ্ছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘চল। আমিও যাব। সাংমা ওর ব্যাটেলিয়ন নিয়ে জঙ্গলের চারদিক দিয়ে ঢুকছে। ব্যাটা এ জঙ্গলেই লুকিয়ে আছেই। কোথাও। কে জানে আমার মণিমা’ আবার ফুঁপিয়ে উঠলেন নস্করদা, ‘এখনো বেঁচে আছে কিনা।’
সেদিন মেলার ঘটনার পরে বিশদভাবে জেনেছিলাম। বীরভূমের মতো বড়ো বড়ো গ্রাম পশ্চিমবঙ্গের আর কোনো জেলায় নেই। এমন গ্রামও নাকি আছে বীরভূমে, জনসংখ্যা যার লক্ষাধিক। মলুটি গ্রামটিও বেশ বড়োসড়ো।
গ্রামটি সীমান্ত-বিহারে পড়ে গেছে। কিন্তু পুরোপুরি বাঙালি অধ্যুষিত বলে, বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ গ্রন্থে মলুটি গ্রামের কথা অন্তর্ভুক্ত না করে পারেননি। পুরো একটি চ্যাপ্টার আছে মলুটি নিয়ে। সমরেশ বসু তাঁর ‘কোথায় পাব তারে’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মলুটির মেলায় নাকি মধ্যরাতের পর গণমৈথুন হয়। বিনয় ঘোষ যখন এদিকে আসেন, উঠেছিলেন আমাদের অতিথিশালায়। একদিন বেড়াতে বেড়াতে উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আসলে ফার্টিলিটি কাস্টের ব্যাপার, অ্যা। জমির উর্বরতা বাড়াতে, অ্যা, আগে কুমারী-বলির প্রথাও প্রচলিত ছিল।
আসলে যে-সব মেয়ে পুরুষের দোষে গর্ভবতী হতে পারত না, অ্যা, তাদের ফার্টাইল করাই ছিল এই বছরে-একদিন সারারাত মেলার উদ্দেশ্য। উপজাতিরা যাতে সংখ্যা কমে না যায় আর কী। অ্যা।’ (প্রয়াত, শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষের সঙ্গে যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরা ওঁর এই অ্যা-দোষের কথা জানেন।)
ইন ফ্যাক্ট স্ত্রী কণিকাকে গণমৈথুনের কথা তুলে আমি আজ সকালেই রসিকতা করে বলেছিলাম, ‘যাবে নাকি? দ্যাখো, ফার্টাইল হবার একটা বিরাট চান্স। একজন না-একজন ক্লিক করবেনই।’ শুনে কণি ‘ধ্যাৎ’ আর আমি ‘উঃ’ একসঙ্গে বলে উঠি যখন সে অকথ্যস্থানে আমাকে এক রামচিমটি কাটে। (বঙ্গসাহিত্যের শিক্ষক হয়েও স্ত্রীর সঙ্গে এবম্বিধ রসিকতা করার জন্য আমি শুধু পাঠকদের কাছে মাপ চাই। তবে পাঠিকারা কেউ দোষ ধরবেন না, তা জানি। কারণ, এর সঙ্গে পুরুষ-শাসিত নারীর হারানো স্বাধীনতার মৌলিক প্রশ্নটি জড়িত।)
তখন বেলা ১২টা। মলুটির মেলায় হঠাৎ গুঞ্জন : বাবা এসেছেন! বাবা এসেছেন!
তারপর সেই অনুমেয় দৃশ্য। এক দীর্ঘদেহী শ্মশ্রুজটাধারী রক্তাম্বরপরিহিত মানুষ হনহন করে এগিয়ে চলেছেন, আর, মোজেসকে যেমন বাইবেলে, জনসমুদ্র তাঁকে দু-ফাঁক হয়ে পথ করে দিচ্ছে। তাঁর পিছনে আসছে শত শত মানুষ। ওঁর পথের দুধারে দারুণ ধস্তাধস্তি। কে রইল, আর কে গেল সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই কারও। সবার চোখের সামনে দ্রষ্টব্য শুধু একজনই বাবা!
দেখলে, ভয় হয় সত্যিই। দশটা মানুষ নিয়ে যেন এক একটা মানুষ, বৃষস্কন্ধ। সাড়ে-ছফুট, আজানুলম্বিত বাহু, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, লক্ষ করে দেখলে বোঝা যায় তাতে কটি অস্থিখণ্ডও রয়েছে। মুখ ঘামে-সিঁদুরে মাখামাখি। দেখলে, দৈত্যাকার লাগে।
ভিড়ে দাঁড়িয়েছিল সন্তোষদা, মাধুরী বউদি আর হেনা। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন ওদের সামনে।
মাধুরী বউদির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। (‘ওঃহো, কী আগুন রে ভাই সে চোখে। মনে হচ্ছিল কপালকুণ্ডলার সেই ভয়ংকর কাপালিক যেন এখুনি মাধুরীকে বলবে— ‘মামনুসর।’— সন্তোষদা)
মেঘগম্ভীর স্বরে বাবা মাধুরী বউদিকে আদেশ করলেন— ‘খেতে দে!’
ব্যস, আর যাবে কোথা। ‘বাবা কথা বলেছেন’, ‘বাবা কথা বলেছেন’, ‘বাবা মৌনী ভেঙেছেন’, ‘বাবা খেতে চেয়েছেন’— মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ল সারা মেলা জুড়ে। (বলতে ভুলেছি, বাবা শেষ, ছমাস ধরে ছিলেন মৌনী।)
মানুষের হাতে-হাতে চলে আসতে লাগল মিষ্টির থালা, বিভিন্ন হোটেল আর দোকান দোকান থেকে ভাত-তরকারি।
প্রায় দশ-বারটি থালার সামনে বাবা বসে। এর-ওর থালা থেকে নিয়ে মাধুরী বাবাকে খাওয়াতে লাগল।
বাবা বললেন, ‘জল দে’।
জল খেয়ে হঠাৎ উঠে পড়ে বাবা হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন।
তখন আর বাবার সঙ্গে কেউ নেই। শত শত মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাবার প্রসাদ সংগ্রহের জন্যে। মাধুরী বউদি মুখ থুবড়ে পড়ে গেছেন।
ভিড় সরে গেলে দেখা গেল, হেনা নেই।
দূর থেকে মনে হয়েছিল, অম্বিকা মহারাজের আশ্রমে বুঝি আজ কোনো বড়সড় ধুনি জ্বলছে।
‘বাট নো!’ ভিক্টর অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, ‘ইটস ফায়ার!’
জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় মহারাজের আশ্রম। এখানে থেকে পুরোটা ঢালু পথ। আমরা সেইদিকে ছুটতে শুরু করলাম। সবার আগে টর্চ হাতে ভিকি। মনে হচ্ছিল, সে যে টর্চের আলোর আগে-আগেই ছুটে চলেছে। আমাদের অনেক আগে সে পৌঁছে গেল অকুস্থলে।’
‘অং-ক-লললল্!’
তার জঙ্গল-ফাটানো চিৎকার গাছের ডাল ছেড়ে পাখিরা ওড়াওড়ি শুরু করে দিল।
লম্বা শালগাছের খুঁটির ওপর অম্বিকা মহারাজের খড়ো চালের কাঠের ঘরটার চারিদিকে আগুন জ্বলছে। বাতাসে কেরোসিনের গন্ধ। নিঃসন্দেহে কেরোসিন ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আমরা প্রথমে দেখলাম রক্তাম্বর পরিহিত জটাজূটধারী এক অতিকায় পুরুষ— তাঁর চারিদিকে আগুন, কেন্দ্রস্থলে তিনি নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে। অগ্নিপরিধির মধ্যে সত্যিই তাঁকে স্বয়ং ব্রহ্ম মনে হচ্ছিল।
তারপর দেখতে দেখতে তার লাল কাপড়ে লাগে হলুদ আগুন। তিনি ছুটোছুটি শুরু করলেন।
এখন দাউদাউ করে জ্বলে যাচ্ছে। তাঁর সঙ্গে জ্বলে যাচ্ছে তার ধর্ম ও অধর্ম, পাপ এবং পুণ্য—ক্রোধ, অভিমান, মন্ত্র ও মৌন। তাঁর রোগ ও আরোগ্য জ্বলে যাচ্ছে।
ভূতচতুর্দশীর অন্ধকার রাতে, ডানা ঝটপট জঙ্গলে শেয়ার ও শূকরের ছুটোছুটির মধ্যে আগুন-আভায় উদ্ভাসিত শতশত পুলিশ ও মানুষের বিস্মিত, ভীত, এবং নিঃসন্দেহে সশ্রদ্ধ চোখের সামনে আগুনের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এক আরোগ্য-তন্ত্রী খুনে সন্ন্যাসী… পাঠক একবার কল্পনা করুন দৃশ্যটি!
তাঁর বুকের কাছে দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছেন, ওহো, টিভি-র সেটটা!
বুঝি, সেই আঁধার রাতের কল্লোলের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ভিক্টর আর একবার চিৎকার করে উঠল—
‘অং-ক-লললল্’
মনে হল, তিনি শুনতে পেয়েছেন।
স্পষ্ট দেখা গেল, জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে তিনি তাঁর মাংস-খসা ডান হাতটা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ভিক্টরের উদ্দেশে তুলে ধরেছেন।
কিংবা, সম্ভবত আগুন সেই মুহূর্তে এমন একটা অস্থি-সংকটকে ছুঁয়েছিল যে যাতে তাঁর হাতটা ওভাবেই উঠে যায়।
ওই তাঁর হাত থেকে সেটটা পড়ে যাচ্ছে জ্বলতে জ্বলতে।
তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।
তাঁর সঙ্গে হুমড়ি খেলে পড়ল জ্বলন্ত ঘরটা।
কলকাতার স্টোনম্যান আজ খবরের কাগজের প্রথম পাতায় রোজ হেডলাইন। স্টোনম্যানের দৌলতে ফুটপাথের ভিখারিরা জাতে উঠল। লালবাজার পাগলে-পাগলে ভরে গেল। স্টোনম্যান বি বি সি-র নিউজ হল। তাকে ধরতে এফ বি আই সাহায্যের হাত বাড়াল। টাইম ম্যাগাজিন নাকি কভার স্টোরি করছে?
অথচ, ১৯৭৯-৮১ জুড়ে বীরভূম-সান্তাল পরগনার সীমান্তে এতবড় মর্মান্তিক অতি-নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল সুদীর্ঘ দু-বছরের কাগজে একটি পঙক্তিও ছাপা হয়নি। ১৯৮১-র অক্টোবরের শেষের দিকে ‘রামপুরহাটে সাধুর আত্মহত্যা’ শীর্ষক ১২ লাইনের একটি খবর তৃতীয় সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাও ঘটনার দিনদশের পরে, বাস্তবিক মফস্বলের প্রতি কলকাতার এই অবহেলা ও বঞ্চনা, সমাজ-বিজ্ঞানের এটা একটা সম্পূর্ণ অধ্যায় হতে পারে। যাই হোক, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমি গোটা ব্যাপারটার সাক্ষী। তাই আমাকেই এতকাল পরে এই বিশেষ প্রতিবেদন লিখতে হল।
অগ্নিকাণ্ডের পরিদন সকালবেলায় ফরেস্ট বাংলোর বারান্দায় চা-আসরে বসে এস ডি পি ও মিঃ সাংমা আমাদের সামনে, যবনিকা তুলে, সম্পূর্ণ নেপথ্যকাহিনী উন্মোচন করেছিলেন।
দুমাস আগে শাগরেদ সেজে বটু সোরেন মহারাজের আখড়ায় ঢোকে। পুলিশ তার কাছেই নিয়মিত খবর পেত। মাত্র দিনকয়েকের সেবাদাসত্বই তাঁকে অম্বিকা মহারাজের পরম বিশ্বাসভাজন ও প্রিয়পাত্র করে তোলে। বস্তুত, মহারাজ তাঁকে অবিলম্বে সাধনসঙ্গী করে নেন।
এই রোমহর্ষক নাটকের উদ্বোধন হয় ভিক্টর প্রথমবার এসে টিভি প্রতিষ্ঠা করে চলে যাবার দিনকয়েকের মধ্যেই। একদিন, মধ্যরাতে কী এক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে মহারাজ মন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে গেলেন টিভি-র দিকে এবং থার্টিনথ চ্যানেলের বোতাম টিপলেন। অত্যন্ত জোরালো অ্যান্টেনা এবং আধুনিকতম প্রযুক্তিবিদ্যায় সজ্জিত হওয়ার দারুণ, নেপালের কোনো-এক ‘প্রায়ান্ধকার দোকান থেকে’ (ভিক্টর বলেছিল) কেনা ‘সোনি’র অন্তত এই সেটটিতে কিছুটা ভুতগ্রস্ততা ছিল গোড়া থেকেই, বিশেষ ওই ১৩নং চ্যানেল। ওটা টিপে এবং টিউনিং-এর চাকা ঘুরিয়ে ভিকি দু-তিনবার অজানা স্টেশন ধরতে পেরেছিল। যদিও কয়েক মুহূর্তের জন্য। একবার থাইল্যান্ড এসেছিল। রামায়ণ নৃত্যনাট্য হচ্ছিল তখন।
সে-রাতে টিউনিং-ও অ্যাডজাস্ট করতে হয়নি। মহারাজা জানতেন না, কী করে করে। সুইট টিপতেই অবিকল যা স্বপ্নে দেখেছিলেন…
১৪ ইঞ্চি পরদায় ভেসে উঠল সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের খেলার আদি অদৃশ্য শক্তি— বিশ্বপ্রসবিনী রাজরাজেশ্বরী মাতা ভরতারিণীর কামেশ্বরী মূর্তি। ঠিক যে-রকম বর্ণনা আছে কালিকা-পুরাণে, অক্ষরে অক্ষরে!
পাথরের সিংহাসনে রামধনুর সাতটি স্তর পরপর। তার ওপর সিংহ। সিংহের ওপর শব। শবের ওপর পদ্ম। তার ওপর দেবী স্বয়ং।
বটু সোরেন আমাদের স্কুল থেকে ফাইনাল পাশ করা ছেলে। সে নিখুঁত রিপোর্ট করত মিঃ সাংমার কাছে।
দেবী বলিদান প্রার্থনা করলেন। বললেন, ‘ওরে, তুই পাঁচটি কুমারী মেয়ের মুণ্ডু দিয়ে পঞ্চমুণ্ডির আসন কর।, তার ওপর বসে পঞ্চভূতশুদ্ধি সাধন কর। তোর কুষ্ঠ তা নইলে সারবে না।’
এরপর থেকে সাধনক্ষেত্রে দেবীমূর্তির পাশে রেখে শুরু হল ‘সোনি’র নিত্যপূজা। রক্তচন্দনে জবামালায় সাজিয়ে পঞ্চমুণ্ডের জল কুষিতে তুলে মহারাজ টিভি-র গায়ে নিক্ষেপ করছেন—এ দৃশ্য আমি নিজেও দেখেছি। মুখে উদাত্ত মন্ত্র—তারিণীং অভিষিজ্ঞামি। তারিণীং অভিষিজ্ঞামি। তারিণীং অভিষিজ্ঞামি। ওঁ, হ্রীং… ইত্যাদি কিন্তু সেই যে অন্তর্ধান করলেন, তরপর দেবী আর দেখা দিলেন না।
তারপর শুরু হল একের পর এক কুমারীর অন্তর্ধান।
‘মৃত বটু সোরেনের কাছে পাওয়া সূত্র ধরে’, মিঃ সাংমা বললেন, কাল রাতেই সাধনক্ষেত্রে মহারাজের আসনের নিচে মাটিতে পোঁতা চারজন কিশোরীর মুণ্ডু পাওয়া গেছে। তাদের দেহগুলি পাওয়া গেছে এয়ার-বেসের আমলের ডিনামাইট দিয়ে ফাটানো এক গভীর কুয়ো থেকে। একটি লাশ ফেলার পর, তার ওপর একস্তর করে মাটি ফেলা হয়েছে। বটুকে সাধনসঙ্গী জ্ঞানে তিনি ওদের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তাঁর মতে, ‘ওরা সব ভৈরবী প্রেরিত।’
জিপে ওঠার আগে মিঃ সাংমা নমস্কার করলেন জঙ্গলের মাথায় অ্যান্টেনাটার উদ্দেশে। কী ভেবে যে! বললেন, ‘লাক উড হ্যাভ ইট, তাই সন্তোষবাবু মেয়েকে ফিরে পেয়েছেন। ওঁর হয়েছিল ইনকিওরেবল লেপ্রসি অফ দ্য ওয়ার্স্ট কাইন্ড। ভূতসিদ্ধির জন্যে ওঁর ত দরকার ছিল মাত্র আর-একটি কুমারীর মুণ্ডু!’
পরিশিষ্ট
মর্গ থেকে এক তাল মাংস আর কিছু হাড়গোড় পাওয়া গিয়েছিল। হিন্দুমতে সৎকার ত হলই। আমাদের আশ্চর্য করে ভিকি বলল, ‘আমি শ্রাদ্ধ করব।’ শ্রাদ্ধশান্তি চুকতে ১১ দিন।
ভিকিকে রামপুরহাটে পোঁছে দেবার দিন। সেই ‘বিজয়ভারত’। সেই মিছরিলালজী টিলার ওপর দু-বছর আগে টাঙানো সেই বুস্টার-লাঞ্ছিত দুর্বোধ্য জ্যামিতিচিহ্ন নীল আকাশের গায়ে। শরতের শ্লথগতি গাভীন মেঘ।
‘জয় জয় অম্বিকা মহারাজ কী—’
‘জয়!’
সবার সঙ্গে হাত তুলে ভিকিও অ্যান্টেনার উদ্দেশ্যে নমস্কার করল। ওই সেই, কঠিন এবং নতুন মন্ত্রসিদ্ধ তন্ত্র-চিহ্ন যা অন্তরীক্ষ থেকে একদিন বিশ্বপ্রসবিনী ভবতারিণীর পবিত্র কামেশ্বরী মূর্তিকে পরদায় টেনে এনেছিল।
বাস খালি। ভোরের অবিরল চিত্র-প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে আমরা রামপুরহাটের দিকে চলেছি। কারও মুখে কথা নেই। এবার শীত বেশ তাড়াতাড়ি পড়বে, মনে হচ্ছে।
মিছরিলালজী কিছুতেই আমাদের টিকিট নিলেন না।
পাশে এসে বসে তিনি অম্বিকা মহারাজ সম্পর্কে এত অদ্ভুত গল্প শোনোলেন। ‘আমাদের’— কেননা, অনুবাদ করে লাইন-বাই-লাইন গল্পটি আমিও ভিকিকে বলি।
উনি মহারাজের সাধনক্ষেত্রে মাঝে মাঝে যেতেন। কাচপাহাড়ির টিলা থেকে যে সরু ঝরনাধারা নেমে এসেছে, একদিন দেখেন, তারই এক ইঞ্চি গভীর জলবিভাজিকার ওপর উপুর হয়ে শুয়ে উনি স্নান করছেন। আর মুখে বেরুচ্ছে এক অনির্বচনীয় আরাম মন্ত্র— আ, আ, আ…’
‘মহাত্মা, হাত জোড় করে হামি বললে, হিঁয়া পে হামি একঠো বানধ লাগিয়ে দিই? পানি জেয়াদা হোগা। অউর আপ ভি আরামসে এস্নান কিজিয়ে গা।’
অম্বিকা, মহারাজ তখনও মৌনী হননি। কামেশ্বরী ভৈরবীর নির্দেশ পাননি। তিনি উত্তরে তাঁকে এমন একটা কথা বলেছিলেন, মাহাত্ম্যে সন্ত তুলসীদাসজীও যার ধারে-কাছে আসে না, মিছরিলালজী মনে করেন।
‘সে কী রে বোকা।’ বাবা মিছরিলালজীকে বলেছিলেন হাসতে হাসতে, ‘যদি বাঁধ দিস, আর একটু না একটু স্রোত ত তবু কাঁদড়ে যাবে। বর্ষায় উপচে কাঁদড়ের জল যাবে নালায়। নালা যাবে নদীতে। নদী যাবে সমুদ্রকে ওর কষ্টের কথা ও বলবে। তখন সমুদ্র আমাকে ধমকাবে না?’
বাস ছুটে চলেছে রামপুরহাটের দিকে।
মিড-লং থেকে ফার-লং শটে হু-হু করে সরে যাচ্ছে কাচপাহাড়ির টিলা।
ওঁ হ্রীং। ওঁ ক্রীং। ওঁ হৃঁং। ওঁ হং।
ওঁ শ্রীং স্রীং।
ওঁ হ্রেং। ক্রেং। ফ্রেং।
ওঁ ফট স্বাহা।