৯
সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ৷ ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাস প্রায় ফাঁকাই হয়ে গেছে বলা যায়৷ বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বাড়িটা৷ শূন্য ক্লাসরুম, শূন্য অধ্যাপকদের কমনরুম, ব্যক্তিগত চেম্বার, বসার জায়গা৷ লম্বা বারান্দাও নিস্তব্ধ৷ দৈবাৎ কেউ যদি হেঁটে যায় তার জুতোর মশমশ শব্দ শোনা যায় করিডরের সারিবদ্ধ ঘরগুলোর ভিতর থেকে৷ যদিও সে ঘরগুলোর অধিকাংশই এসময় বন্ধ, দু-একটা ঘরের ভিতর শুধু আলো জ্বলছে৷ তার মধ্যে একটা ঘরের বাইরে নাম ঝুলছে—‘অ্যালান টিউরিং’৷ আর নামের নীচে লেখা তাঁর পদমর্যাদা, ডিগ্রিগুলো৷ কাজ সেরে বাইরে বেরোতে অ্যালানের প্রতিদিনই রাত আটটা বেজে যায়৷ ততক্ষণে নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ৷ অধ্যাপক, গবেষক, ছাত্র, কর্মচারীর দল যে যার বাড়ি, হোস্টেল বা ছাত্রাবাসে ফিরে যায়৷ এদিনও তার ব্যতিক্রম নয়৷ মাঝারি আকারের এ ঘরটা অ্যালানের ব্যক্তিগত চেম্বার৷ এখানে বসে অ্যালান পড়াশোনা করেন, অতিথি-অভ্যাগতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, বিশ্রামও নেন৷ হঠাৎ এ ঘরে ঢুকলে ঘরটাকে লাইব্রেরি রুম বলে ভুল হতে পারে৷ সার বেঁধে আলমারি সাজানো আছে এ ঘরে৷ বইয়ে ঠাসা সব আলমারি৷ তার কয়েকটার মধ্যে অবশ্য যন্ত্রপাতিও আছে৷ দু-সার আলমারির মাঝখানে দেওয়াল ঘেঁষে অ্যালানের বসার টেবিল৷ তার একপাশে অ্যালানের রিভলভিং চেয়ার আর মুখোমুখি মাত্র আর-একটা চেয়ার৷ লাল রেক্সিন মোড়া টেবিলটার মধ্যে অগোছালো ছাপ স্পষ্ট৷ ফাইলের স্তূপ, নানা ধরনের কাগজ-কলম-পেনসিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে৷ এমনকি কোনো ফাইলের গায়ে মিহি ধুলোর আস্তরণও জমা হয়েছে৷ এসব ব্যাপারে ঠিক আর পাঁচজন মানুষের মতো গোছানো, পরিপাটি নন অ্যালান৷ তা ছাড়া এই ছড়িয়ে থাকা জিনিসের মধ্যে থেকেই নাকি তাঁর প্রয়োজনীয় বই-কাগজ ইত্যাদি খুঁজে পান অ্যালান, আর সাজিয়ে রাখলে উলটোটা ঘটে৷ যে কারণে সহকর্মীদের তার টেবিল গুছিয়ে রাখতে বারণ করেছেন অ্যালান৷
মাথার ওপরের কড়ি-বরগার সিলিং থেকে শেডঅলা বাতি নেমে এসেছে টেবিলের ওপর৷ সেই আলোতেই টেবিলটা আলোকিত৷ টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি বসেছিলেন অ্যালান আর আর্নল্ড৷ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ানের চাকরি করে৷ অ্যালানের অধস্তন কর্মচারীও বলা যায়৷ বয়সে সে অ্যালানের থেকে কিছুটা ছোট৷ মেদহীন, কিন্তু পেশিবহুল পুরুষালি চেহারা৷ গোঁফের দু-প্রান্ত, আর চিবুকের দাড়ি ফরাসিদের মতো ছুঁচোলো৷ কাজের ক্ষেত্রে যদিও অ্যালানের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগ নেই টেকনিশিয়ান আর্নল্ডের, তবুও একই জায়গাতে চাকরির সূত্র ধরে উভয়ের পরিচিত হবার কারণে ইদানীং আর্নল্ড মাঝে মাঝে অ্যালানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে৷ বিশেষত ঠিক এই সময়তে, যখন দৈনন্দিন কোলাহল থেমে যায়, গবেষণাগারের অন্য সহকর্মীদের ছুটি দিয়ে বাড়ি ফেরার আগে অ্যালান যখন এ কক্ষে কিছুক্ষণের জন্য ফিরে আসেন, ঠিক তখন৷ ঠিক যেমন আজও এসেছে সে৷ ইদানীং অ্যালান যেন কেমন অদ্ভুত একটা আকর্ষণ অনুভব করছেন এই আর্নল্ড মুর নামের যুবকের প্রতি৷ অথচ আর্নল্ডের থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক এমন কিছু অ্যালানের জানার নেই, যা তিনি জানেন না৷ তবুও…৷ আর উলটোদিকের যুবকের কথা বলতে গেলে সে অ্যালানের নানা ব্যাপারে প্রবলভাবে আগ্রহী, নইলে সে বিনা কাজে অ্যালানের কাছে আসবে কেন? এ ব্যাপারটা অবশ্য আর্নল্ডের কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পারেন অ্যালান৷
নিভৃত কক্ষে বসে আলোচনা চলছিল দুজনের মধ্যে৷ আর্নল্ড বলল, ‘স্যর, আপনার কাজগুলোর মধ্যে আমার কাছে সবথেকে আকর্ষণীয় লাগে কিন্তু ওই এনিগমা কোড রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারটা৷ ওই সাংকেতিক বার্তা বা সাংকেতিক লিপি আপনি যন্ত্রের মাধ্যমে পাঠ করতে পেরেছিলেন বলেই তো হিটলার পরাজিত হয়েছিলেন! ভাবা যায়!’
মৃদু হেসে অ্যালান বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেকে তাই বলেন৷ এনিগমা কোড পাঠ করতে আমি সমর্থ হওয়াতেই আটলান্টিকে হিটলারের নৌবাহিনী বিধ্বস্ত হয়, যা ভবিষ্যতে হিটলারের পরাজয়ের কারণ হয়ে ওঠে৷’
আর্নল্ড বলল, ‘এই ক্রিপ্টোগ্রাফি, সাংকেতিক বার্তার ব্যাপারটা বরাবরই আমাকে আকর্ষণ করে৷’
অ্যালান হেসে বললেন, ‘সব ক্রিপ্টোগ্রাফি যে সাংকেতিক বার্তা, তা নয়৷ তবে তুমি যে এনিগমা কোড ধরনের সাংকেতিক বার্তার কথা বলতে চাইছ, তার উদ্ভব এবং ব্যবহার কিন্তু বেশ প্রাচীন৷’
আর্নল্ড জানতে চাইল, ‘প্রাচীন মানে কত প্রাচীন?’
অ্যালান জবাব দিলেন, ‘প্রাচীন মানে খ্রিস্টের জন্মেরও আগের ব্যাপার৷ কেউ বলেন এর উৎপত্তি ইন্ডিয়াতে, কেউ বলেন ইজিপ্টে৷ তবে প্রামাণ্য হিসাবে ‘সিজার কোড’-কেই ধরা হয়৷ রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার৷ তিনি রোমান বর্ণমালার নীচে নির্দিষ্ট ঘর ছেড়ে পর পর গাণিতিক সংখ্যা বসিয়ে ওই গাণিতিক সংখ্যা দিয়ে প্রথম সাংকেতিক বার্তা নির্মাণ করেন৷ পরবর্তীকালে নানা লোক তার আধুনিক রূপদান করেছেন, আরও কঠিনতম করে তুলেছেন, যাতে সহজে কেউ তা পাঠ না করতে পারে৷’
আর্নল্ড জানতে চাইল, ‘এ সম্বন্ধে কোনো বই আছে আপনার কাছে, যদি আমাকে দেন তবে পড়ার চেষ্টা করতাম৷’
অ্যালান নিজে জ্ঞানপিপাসু৷ কেউ যদি কোনো কিছু জানার চেষ্টা করে তবে অ্যালান সর্বতোভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেন তাকে৷ এমনও অনেক সময় হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপকের মুখে অ্যালান হয়তো শুনলেন যে তাঁর একটি বিশেষ বইয়ের প্রয়োজন, যা অ্যালানের বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়৷ হয়তো বা সাহিত্য বা দর্শনশাস্ত্রের বই৷ কিন্তু অ্যালান ব্যাপারটা জানতে পারলেই চেষ্টা করেন সে বই তাঁকে জোগাড় করে দেবার৷ আর্নল্ডের কথা শুনে একটু ভেবে নিয়ে অ্যালান বললেন, ‘হ্যাঁ, একটা বই আছে মনে হয়৷ ওই যে ওই আলমারিটার পিছনের আলমারিতে৷ পেলে নিয়ে যাও৷’
অ্যালানের কথা শুনে চেয়ার ছেড়ে বইটা খোঁজার জন্য আর্নল্ড চলে গেল আলমারির আড়ালে৷
ঘড়ি দেখলেন অ্যালান৷ আটটা বেজে গেছে৷ আর্নল্ড বইটা পেড়ে আনলেই এ ঘরের দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়বেন তিনি৷ কিন্তু মিনিট পাঁচেক পরও যখন আর্নল্ড আলমারির আড়াল থেকে বাইরে এল না, তখন তিনি নিজেই আর্নল্ডকে সাহায্য করার জন্য চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন৷ এগিয়ে গেলেন সেদিকে৷
দু-সারি আলমারির মাঝে ছোট্ট অপরিসর একটা জায়গা৷ আলোটাও খুব বেশি স্পষ্ট নয়৷ একটা আলমারির পাল্লা খুলে আর্নল্ড তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ অ্যালান তার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলমারির র্যাকের দিকে তাকাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ একটা মাদকতাময় মিষ্টি গন্ধ নাকে এল তাঁর৷ পারফিউমের গন্ধ৷ আর্নল্ডের শরীর থেকেই আসছে৷ গন্ধের উৎসস্থল মনে হয় আর্নল্ডের জামার কলারটা৷ মাথার চুল ছোটো করে ঘাড়ের অনেক ওপরে তুলে ছাঁটা আর্নল্ডের৷ ঢোলা শার্টটার কলার একটু নীচে নেমে যাবার ফলে তার ঘাড় আর কাঁধের পিছনের বেশ কিছুটা অংশ অনাবৃত হয়ে পড়েছে৷ অ্যালানের চোখ এরপর আটকে গেল আর্নল্ডের অনাবৃত ঘাড় আর কাঁধে৷ আর্নল্ডের শরীরের উন্মুক্ত সেই অংশ, আর পারফিউমের তীব্র গন্ধ যেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অ্যালানের অন্য সব চেতনাকে গ্রাস করল৷ অ্যালানের শরীরে জেগে উঠল অন্য এক অনুভূতি৷ অনেকটা যন্ত্রের মতোই এক-পা এগিয়ে এসে তাঁর নাকটা নামিয়ে আনলেন আর্নল্ডের ঘাড়ের কাছে৷ তারপর ধীরে ধীরে তাঁর নাক-ঠোঁট স্পর্শ করালেন আর্নল্ডের শুভ্র ঘাড়ে৷ অ্যালানের নিঃশ্বাসের গরম হলকাতে যুবক আর্নল্ডের শরীরটা যেন মৃদু কেঁপে উঠল৷ তারপর ধীরে ধীরে অ্যালানের দিকে মুখটা ফেরাল সে৷ তার চোখেও জেগে উঠেছে এক অদ্ভুত দৃষ্টি, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে এক রহস্যময় হাসি৷ যেন এমন কোনো মুহূর্তের প্রতীক্ষাতেই অ্যালানের কাছে ছুটে আসত সে৷ আর্নল্ডের শরীরটাও ঘুরে গেল অ্যালানের দিকে৷ আর্নল্ড উচ্চতায় অ্যালানের থেকে সামান্য বেশি৷ আর্নল্ডের গোঁফের নীচে পুরুষালি ঠোঁটটা নেমে এল নিখুঁতভাবে কামানো মুখমণ্ডলের ওপর, পাতলা ঠোঁটের ওপর৷ অ্যালানের হাত ততক্ষণে আর্নল্ডের বোতামের ফাঁক গলে তার বুক স্পর্শ করেছে৷ কী রোমশ পুরুষালি বুক আর্নল্ডের! ঠিক সেই মুহূর্তে বাতিটা হঠাৎ নিভে গেল৷ ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দাঁড়িয়ে অ্যালান আর আর্নল্ড৷ কোনো আদিম, অচেনা ভালোবাসা যেন এরপর তাদের দুজনের শরীর থেকে একটা একটা করে পোশাক খসিয়ে ফেলতে লাগল৷ আর্নল্ডের পেশিবহুল হাতের নিষ্পেষণে যৌন আনন্দে যেন পাগল হয়ে যেতে লাগলেন অ্যালান৷ নিজের সম্পূর্ণ শরীরটাকে আর্নল্ডের হাতে ছেড়ে দিলেন তিনি৷ অন্ধকারে নিস্তব্ধ ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্জন কক্ষে মিশে যেতে লাগল দুটো শরীর৷ ওঃ, কী তৃপ্তি!
কিন্তু হঠাৎই আবার আলো জ্বলে উঠল! কী ভয়ংকর উজ্জ্বল আলো! না, এটা ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যালানের ব্যক্তিগত সেই কক্ষ নয়৷ এটা কোর্টরুম৷ উজ্জ্বল আলোর নীচে বসে আছেন বিচারক, জুরি আর অন্য বেশ কিছু মানুষ৷ অ্যালানের বিচার শুরু হয়েছে৷ কাঠগড়া ধরে দাঁড়িয়ে আছেন অ্যালান৷ এখন তাঁর পরনে পোশাক থাকলেও সরকারি আইনজীবীদের একের পর এক প্রশ্নবাণে, বক্তব্যে অ্যালানের শরীরের পোশাক খুলে তাঁকে যেন নগ্নভাবে দাঁড় করানো হচ্ছে৷ আইনজীবী বলছেন, ‘ভাবতে পারেন, এই সেই ঘৃণ্য লোক! যে একজন পুরুষ হয়ে অপর একজন পুরুষের সঙ্গে দিনের পর দিন যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয়েছে, এক নিরীহ অধস্তন কর্মচারীকে বাধ্য করেছে তার সঙ্গে সমকামিতার সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য! এই ঘৃণ্য কাজ করার আগে তিনি একবারও বাইবেল- ঈশ্বর-সমাজের কথা ভাবলেন না? উনি যত বড়ই অঙ্কবিদ হন, পণ্ডিত হন, এই কদর্য কাজ করার আগে একবারও ভাবলেন না যে কেউ, কোনো সভ্য মানুষ তাঁকে সমর্থন করবেন না এ ব্যাপারে?’
কাঠগড়াতে দাঁড়িয়ে আছেন অ্যালান৷ কোনো কথা বলছেন না তিনি৷ প্রচণ্ড আলোতে চোখ ঝলসে যাচ্ছে তাঁর৷ কোর্টরুমের সব আলো যেন তাঁর মুখের ওপর এসে পড়েছে৷ পুড়ে যাচ্ছে তাঁর মুখ৷ পুড়ে যাচ্ছে…৷ একসময় তিনি বাধ্য হয়েই বলে উঠলেন, ‘দোহাই, আলোটা আমার মুখের ওপর থেকে সরাও, দোহাই তোমাদের! আমি আর সহ্য করতে পারছি না৷’
ঘুমটা ভেঙে গেল অ্যালানের৷ স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি৷ হ্যাঁ, একটা আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে৷ বেশ বেলা হয়েছে৷ গতরাতে শোবার আগে জানলার পর্দা টানা হয়নি৷ পাল্লাটাও বন্ধ করা হয়নি৷ বেশ বেলা হয়ে গেছে৷ সকালের আলো এসে পড়েছে অ্যালানের মুখে৷ ঘুম ভেঙে চোখ খুলে সত্যিই প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে গেছিল তাঁর৷ উঠে বসলেন অ্যালান৷ স্বপ্নের রেশ কাটতে আরও কিছুটা সময় লাগল তাঁর৷ তারপর খাট ছেড়ে নামলেন তিনি৷