আঁধারে গোপন খেলা – ৮

এদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কিছুটা সুস্থবোধ করলেন অ্যালান৷ গাঁটের যন্ত্রণাটা একটু কম৷ ওষুধের প্রভাবটা সম্ভবত কাটতে চলেছে৷ তবে ধকলটা এবার যেন একটু বেশিই হল৷ তিনি ঠিক করলেন আজ একটু পড়াশোনা করবেন৷ অবসাদের কারণে বেশ কয়েকমাস পড়াশোনা তেমন হয়ে উঠছে না৷ গবেষণার অনুমতিপত্র নিশ্চয়ই এর মধ্যে চলে আসবে৷ নতুনভাবে আবার কাজ শুরু করার জন্য প্রস্তুত হওয়া প্রয়োজন৷ তিনি ঠিক করলেন সারাদিন তিনি পড়াশোনা নিয়েই থাকবেন৷

সেইমতো তিনি বিছানা ছেড়ে উঠেই স্নান সেরে নিলেন৷ ব্রেকফাস্টের টেবিলে খেতে বসে পরিচারককে বললেন, তিনি লাইব্রেরি রুমে থাকবেন৷ অযথা লাঞ্চের জন্য তাঁকে যেন বিরক্ত না করা হয়, খিদে পেলে তিনি নিজেই খাবার দেবার জন্য বলবেন৷ তবে হ্যাঁ, সরকারি কোনো লোক যদি চিঠি নিয়ে আসে, তবে যেন তৎক্ষণাৎ তাঁকে খবর দেওয়া হয়৷ পরিচারককে এ কথা জানিয়ে প্রাতরাশ সাঙ্গ করে লাইব্রেরি রুমে গিয়ে ঢুকলেন অ্যালান৷ ছোটো একটা ঘর৷ বইপত্রে ঠাসা৷ ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল আর চেয়ার৷

অ্যালান যখন এ বাড়িতে আসেন তখন তাঁর নিজের বাড়ির লাইব্রেরির সামান্য অংশই এখানে আনতে পেরেছিলেন সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে৷ তাতেই এই ছোট ঘরটা এমনভাবে ভরে গেছে যে ঘরের একটা মাত্র জানলাও বইয়ের র‌্যাকের আড়ালে ঢাকা পড়েছে৷ র‌্যাক থেকে একটা মোটা বই নামিয়ে এনে চেয়ারে বসলেন অ্যালান৷ টেবিলে বইটা রেখে সেটা খুলতেই প্রথম পাতাতে একটা সরকারি সিলমোহর চোখে পড়ল৷ তাতে লেখা ‘পাশ’ এবং তার সঙ্গে সরকারি আধিকারিকের স্বাক্ষর৷ এই লাইব্রেরিতে যত বই আছে, তার সবকটাতেই এই সিলমোহর আছে৷ অর্থাৎ এই বইগুলো অ্যালানের পাঠের উপযুক্ত৷ সরকারি আধিকারিকরা আগে দেখে নিয়েছেন এই বইগুলোর মধ্যে কোথাও যৌনতা বিষয়ক কোনো লেখা, বলা ভালো সমকামিতা নিয়ে কোনো লেখা আছে কি না৷ তারপর বইগুলো এ বাড়িতে আনার ছাড়পত্র মিলেছে৷ সিলমোহরটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলেন অ্যালান৷ বইগুলো এ বাড়িতে পৌঁছোবার আগে সরকারি দপ্তরে পাঠাতে হয়েছিল৷ এমন যদি হয়ে থাকে যে যিনি ছাড়পত্র দিয়েছেন, তিনি বা তাঁর কোনো কর্মচারী বইতে ছাপ মারার আগে এ বইটার প্রতিটা পাতা পড়েছেন, তবে সেই কাজ নিশ্চয়ই অত্যন্ত ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে৷ উচ্চতর গণিতবিদ্যা সংক্রান্ত এই মোটা বইটার কোনো অর্থ না বুঝেই যদি পাতার পর পাতা সমকামিতার গন্ধ খোঁজার জন্য পড়তে হয়, তবে তার থেকে বিড়ম্বনার ঘটনা আর কী হতে পারে?—এ কথাটা ভেবেই মনে মনে হাসলেন অ্যালান৷ কিন্তু তারপরই তাঁর মনে সেই পুরোনো প্রশ্নের উদয় হল৷ সে প্রশ্ন—‘যন্ত্র ভাবতে পারে কি না?’—এ প্রশ্নের চেয়েও অ্যালানের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, রাষ্ট্র কি মানুষের যৌন ভাবনা নির্ধারণ করার অধিকারী? কারো যৌন ভাবনা বা ধারণা, সমাজের প্রচলিত যৌন ভাবনার সঙ্গে না মিললেই কি সে অপরাধী? সে মানসিক বিকারগ্রস্ত? অসুস্থ? অ্যালানের মতো নিশ্চয়ই পৃথিবীতে এমন আরও পুরুষ আছেন, যাঁরা পুরুষের প্রতি যৌনভাবে আকৃষ্ট, এমন অনেক নারী আছেন যাঁরা নারীর প্রতি আকৃষ্ট, তবে তাঁরা সবাই কি মানসিকভাবে অসুস্থ, অপরাধী? ঠিক যেমন অ্যালান আজ অপরাধী! মানুষের ভালোলাগার ওপর তো নিজের কোনো হাত থাকে না৷ যেমন কৈশোর থেকেই অ্যালানকে বেশি আকৃষ্ট করত পুরুষেরা৷ মরকমের মতো সুঠাম চেহারার পুরুষেরা, পরবর্তীকালে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ান আর্নল্ড মুরের মতো সুঠাম পুরুষেরা৷ কোনো নারী তাদের মতো কোনোদিন আকৃষ্ট করতে পারেনি অ্যালানকে৷ আগ্রহ জন্মাতে পারেনি তাঁর মনে৷ আর্নল্ড এখন কোথায়? সে কি এখনও বিশ্ববিদ্যালয়েই চাকরি করছে? অ্যালান তাকে শেষবারের জন্য দেখেছিলেন আদালতে৷ সরকারি কৌঁসুলি যখন বিচারকের সামনে আর্নল্ডকে দেখিয়ে বলছিল—‘এই সেই আর্নল্ড৷ যার ওপর প্রায়শই জঘন্য অত্যাচার চালাতেন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অভিযুক্ত৷’ তখন তা শুনে আর্নল্ড মাথা নীচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল৷ যদিও ব্যাপারটা সত্যি নয়৷ উভয়ের সম্মতিতে, ভালোবাসায় যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন তাঁরা৷ তবে আর্নল্ডের ওপর কোনো রাগ নেই অ্যালানের৷ আর্নল্ড সামান্য টেকনিশিয়ান, নিশ্চয়ই সে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল৷ আর সে যদি তার সম্মতির ব্যাপারটা স্বীকারও করত, তবে অ্যালানের কোনো লাভ হত না৷ সেক্ষেত্রেও অ্যালানকে শাস্তির মুখে পড়তে হত৷

অ্যালান বুঝতে পারলেন, বইয়ের পাতায় সিলমোহরটার দিকে তাকিয়ে তাঁর মন আবার বিক্ষিপ্ত হতে শুরু করেছে৷ হয়তো বা আবার অবসাদ নেমে আসবে তাঁর মনে৷ তাই তিনি এরপর প্রথম পাতাটা উল্টে বইটা পড়তে শুরু করলেন৷

তন্ময় হয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে ছিলেন অ্যালান৷ বেলা দশটা নাগাদ ঘরের দরজাতে টোকা পড়ল৷ অ্যালান একটু বিরক্তভাবে সেদিকে তাকিয়ে ‘ইয়েস’ বলতেই, পরিচারক দরজার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, ‘একজন সরকারি ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন৷’

সরকারি ভদ্রলোক! তবে কি সেই চিঠির জবাব এসেছে? নাকি অন্য কিছু? বই বন্ধ করে অ্যালান বললেন, ‘নিয়ে এসো তাঁকে৷’

কিছুক্ষণের মধ্যে যিনি অ্যালানের ঘরে ঢুকলেন, তাঁকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন অ্যালান৷ আরে, এ যে তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহকারী, চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু, গোলেমবাক! তাঁকেই কি সরকারি তরফে পাঠানো হয়েছে? মনের উচ্ছ্বাস গোপন করে অ্যালান প্রথমে পরিচারককে নিজের কাজে চলে যেতে বললেন৷ আর তারপর সে চলে যাওয়া মাত্রই জড়িয়ে ধরলেন গোলেমবাককে৷

বেশ অনেকটা সময় আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় রইলেন দুই পুরোনো বন্ধু৷ দীর্ঘদিন পর তাঁদের সাক্ষাৎ হল৷ এরপর অ্যালান তাঁকে বললেন, ‘সরকার তোমাকে আমার কাছে পাঠাল?’

গোলেমবাক কাঁধ নাচিয়ে বললেন, ‘ধুস, সরকার তোমার কাছে আমাকে পাঠাবে কেন? আমি তো আর সরকারি চাকরি করি না৷ দাবার ইনস্টিটিউট খুলেছি৷ ভালোই রোজগার৷’

অ্যালান বললেন, ‘তার মানে! তোমার গায়ের কোটটাতে তো সরকারি মোনোগ্রাম আঁকা, আর পরিচারকও তো বলল যে…৷’

অ্যালানকে থামিয়ে দিয়ে গোলেমবাক বললেন, ‘গায়ের কোটটা একটা সরকারি অনুষ্ঠানে উপহার পেয়েছি৷ আর যে গাড়িতে এসেছি সেটাও আমার এক বন্ধুর সরকারি গাড়ি৷ সেজন্যই তো গেটকিপার বিশ্বাস করল আমার কথা৷ তাকে মিথ্যা বলেছি৷ তবুও সে অনুমতিপত্র দেখতে চাইছিল৷ তখন তাকে আমি এমনভাবে বললাম যে, আমার অনুমতিপত্র নিয়ে ঘোরার প্রয়োজন হয় না, সে যে আমার মুখ দেখে কেন চিনতে পারছে না সেটাই আশ্চর্য, আমি যদি ফিরে যাই তবে তার চাকরি যাবে, তখন সে প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল৷ আমাকে বাড়ির ভিতর ঢুকতে দিল৷’ কথা শেষ করে হাসলেন গোলেমবাক৷ তারপর পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে দেশলাই দিয়ে ধরালেন৷ গোলেমবাক বরাবর এরকমই মজাদার, সাহসী মানুষ৷ অ্যালানের সহকারী হিসাবে যখন তিনি কাজ করতেন, তখন অন্য সহকর্মীরা গোলেমবাকের সম্বন্ধে সতর্ক থাকতেন, পাছে গোলেমবাক কোনোভাবে মজা করে তাঁদের নাস্তানাবুদ না করেন সেজন্য৷ একবার তো তিনি স্টেথোস্কোপ নিয়ে ডাক্তার সেজে এক তরুণীর বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন তার বাবার হূদযন্ত্রের চিকিৎসার জন্য৷ রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে প্রেসক্রিপশন হিসাবে তিনি কন্যার হাতে যেটা তুলে দিয়ে এসেছিলেন, সেটা সেই তরুণীর প্রেমিকের প্রেমপত্র৷ হতভাগ্য সেই তরুণ তার প্রেমিকার পিতার পিস্তলের ভয়ে কিছুতেই প্রেমিকার বাড়িমুখো হতে পারছিল না৷ অগত্যা সে শরণাপন্ন হয়েছিল গোলেমবাকের৷ আর তার কার্যোদ্ধার করে দিয়েছিলেন তিনি৷ এমন অনেক মজাদার কাহিনি আছে গোলেমবাককে নিয়ে৷ আবার এই গোলেমবাকই প্রচণ্ড পরিশ্রমী, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দক্ষ, দাবার বোর্ডে নিমেষে মাত করে দিতে পারেন প্রতিপক্ষকে৷ অ্যালান আবারও বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন, ‘কিন্তু আমি যে এখানে আছি সে খোঁজ তুমি পেলে কীভাবে?’ গোলেমবাক বললেন, ‘আমার একটু ফুলের শখ আছে৷ বাড়িতে একটা বাগান করছি৷ বন্ধুর গাড়ি নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় এখানে এসেছিলাম ফুলের বীজ সংগ্রহ করতে৷ কাজ মিটতে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে এক ফুলচাষির বাড়িতে রাতে রয়ে গেলাম৷ সেখানেই নানা কথার মধ্যে জানতে পারলাম ‘অ্যালান টিউরিং’ নামের এক শহুরে ইঞ্জিনিয়ার নাকি বাচ্চাদের ম্যারাথন রেসের উদ্বোধন করেছেন এবং অর্থমূল্য পুরস্কারও দিয়েছেন৷ তোমার চেহারার বিবরণও মিলে গেল তাদের কথায়৷ ব্যস, আমি বুঝে ফেললাম, এই অ্যালান টিউরিং তুমিই৷ আর আজ সকাল থেকে খোঁজ শুরু করলাম চারপাশে৷ তবে বাড়িটা খুঁজে পেতে অবশ্য বিশেষ কষ্ট হয়নি৷ ছোট জায়গা৷ আর তোমার বাড়ির গেটেই একমাত্র সরকারি উর্দি পরা দারোয়ান আছে৷ বুঝলাম এ বাড়িতে যিনি বাস করেন তিনি হয় সরকারি কর্তাব্যক্তি, নাহয় সরকারি অতিথি৷ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, ‘হ্যাঁ, এ বাড়ির মালিকের নাম অ্যালান টিউরিং৷ ব্যস, তারপর দারোয়ানকে ভড়কে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে কতক্ষণ? তুমি কেমন আছ জানতে এলাম আমি৷’ গোলেমবাকের কথা শুনে বিষণ্ণ হেসে অ্যালান বললেন, ‘হ্যাঁ, সরকারি অতিথিই বটে! খাচ্ছি-দাচ্ছি দিব্যি আছি৷’ গোলেমবাক জানতে চাইলেন, ‘এ বাড়িতে কে কে থাকো তোমরা?’

অ্যালান জবাব দিলেন, ‘আমি, একজন পরিচারক, একজন রান্নার লোক আর গেটম্যান৷ শেষ তিনজন লোকের অবশ্য এক সপ্তাহ অন্তর পরিবর্তন ঘটে৷ নতুন লোক আসে৷ আর হ্যাঁ, আমি বাড়ির বাইরে বেরোলেই একজন পুলিশকর্মী আমাকে অনুসরণ করে৷ সেটা আমার নিরাপত্তার স্বার্থে, নাকি আমি যাতে কোথাও পালাতে না পারি, সে কারণটা ঠিক আমার জানা নেই৷’

এ কথা বলার পর অ্যালান বললেন, ‘তোমার হাতে কিছুটা সময় আছে? তবে চলো আমার বেডরুমে গিয়ে বসি? এ ঘরে তো একটা চেয়ার ছাড়া বসার জায়গা নেই৷’

গোলেমবাক বললেন, ‘আমার হাতে সময়ের অভাব নেই৷ কিন্তু বেশিক্ষণ এখানে থাকা উচিত হবে না৷ যদি কেউ এসে পড়ে? ঠিক আছে চলো যাই৷ একঘণ্টা কথা বলা যেতেই পারে৷’

গোলেমবাককে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোতে এগোতে অ্যালান বললেন, ‘সাধারণত কেউ এ বাড়িতে আসে না, একমাত্র ডাক্তার ছাড়া৷ সে আজ আসবে না৷ আমার পরিচিতজনরা হয়তো আমাকে আজ ঘেন্না করেন, অথবা সরকারি কোপে পড়ার ভয়,বা সরকারি অনুমতি না পাবার কারণে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন না৷ এমনকি আমার মা-ও নন৷’—এ কথা বলে নিজের শয়নকক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন অ্যালান৷

গোলেমবাক তাঁর আসন গ্রহণ করার আগে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন৷ হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ল দেওয়ালের গায়ে রাখা দাবার বোর্ডটার ওপর৷ রাজহাঁস যেমন জল দেখলে উৎফুল্ল হয়, তেমনই দাবার বোর্ডটা দেখে গোলেমবাক বললেন, ‘তুমি এখনও দাবা খেলো? মনে আছে আমরা কেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা খেলতাম একসময়?’

অ্যালান বললেন, ‘না, খেলার জন্য তো সঙ্গী লাগে৷ ক-দিন আগে একবার তোমার কথা মনে পড়েছিল৷ বোর্ডটা নামিয়ে খেলতে বসেছিলাম৷ কিন্তু পারলাম না অসুস্থতার কারণে৷’

কথাটা শুনে গোলেমবাক একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘চলো তবে এক বোর্ড খেলা যাক৷’

প্রস্তাবটা লুফে নিয়ে অ্যালান বললেন, ‘হ্যাঁ, চলো খেলতে খেলতে কথা বলি৷’

দাবার বোর্ডটা খাটে নামিয়ে এনে ঘুঁটি সাজিয়ে খেলতে বসলেন দুই বন্ধু৷ প্রথমে চাল দিলেন অ্যালান-ই৷ তারপর তিনি বললেন, ‘মনে হচ্ছে আমি যেন ব্লেচলি পার্কে ফিরে গেছি! সেসব দিন আর কোনোদিন কি ফিরবে?’

গোলেমবাক চাল দিয়ে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, সোনাঝরা দিন ছিল সেসব৷ কত কঠিন পরিশ্রমের দিন৷ কিন্তু তার মধ্যেও তোমার নেতৃত্বে কত উৎসাহ, আনন্দ নিয়ে কাজ করতাম আমরা৷ একটাই লক্ষ্য, যেভাবেই হোক ভাঙতে হবে এলিগমা কোড৷’

খেলতে খেলতে নানা কথা শুরু হল দুই বন্ধুর মধ্যে৷ পুরোনো দিনের নানা গল্প৷ ঘড়ির কাঁটা এগোতে লাগল খেলার সঙ্গে সঙ্গে৷ একসময় অ্যালান হঠাৎ গোলেমবাককে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা লন্ডনের মানুষ আমাকে ঠিক কী চোখে দ্যাখে বলো তো?’

গোলেমবাক একটা মোক্ষম চাল দিয়ে বললেন, ‘‘যে যাই মনে করুক না কেন, আমি মনে রেখেছি সেই অ্যালান টিউরিংকে, যাঁকে ব্রিটিশ সরকার ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার’ খেতাব দেবার পর নৈশভোজের অনুষ্ঠানে সমর নায়ক মার্শাল মন্টেগোমারি সকলের সামনে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, এই সেই গণিতবিদ, ক্রিপ্টোবিশেষজ্ঞ অ্যালান টিউরিং, যাঁর জন্য আমরা হিটলারের জেনারেলদের প্রাতরাশের মেনু পর্যন্ত জেনে যেতাম৷’’

কথাটা শুনে অ্যালান বিষণ্ণভাবে বললেন, ‘ওসব ঘটনা এখন অতীত৷ তবু আমি জানতে চাই লন্ডনের শিক্ষিত সমাজ আমার ঘটনাটা নিয়ে কী ভাবেন?’

গোলামবেক বললেন, ‘লন্ডনের সমাজ বরাবরই রক্ষণশীল৷ প্রচলিত ভাবনার বাইরে তারা কথা বলে না৷ সমাজ বা বাইবেল যে ঘটনাকে সমর্থন করে না সেটাকে তারা অপরাধ বলেই ভাবে৷ তোমার সম্পর্কে আমি যতটুকু শুনেছি তাতে সেই অংশের মানুষ সরকারি সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনো ভুল দেখছেন না৷ হ্যাঁ, একটা ক্ষুদ্র অংশের মানুষ আছেন, যাঁরা বলেন তুমি আসলে সরকারের এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের শিকার৷ এমনকি আমি তাদের কয়েকজনকে গোপনে এও আলোচনা করতে শুনেছি যে….৷’

—এ পর্যন্ত বলে কথাটা অ্যালানকে জানানো উচিত হবে কি না বুঝতে না পেরে থেমে গেলেন গোলেমবাক৷

অ্যালান ব্যাপারটা খেয়াল করে বললেন, ‘থামলে কেন? বলো আমার সম্বন্ধে কী বলেন তাঁরা?’

প্রশ্ন শুনে গোলেমবাক ইতস্তত করে বললেন, ‘দেখো পুরো ব্যাপারটাই শোনা কথা৷ সত্যি-মিথ্যা আমার জানা নেই৷ তাই ও কথাটা থাক৷ শুনলে তুমি কষ্ট পেতে পারো৷’

গোলেমবাকের কথা শুনে অ্যালানের জানার আগ্রহ যেন আরও প্রবল হয়ে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘গোপন কোরো না, বলে ফেলো৷ তোমার সঙ্গে আমার আর কখনও দেখা হবে কি না জানি না৷ হয়তো বা আমার কোনোদিন কথাটা জানাই হবে না৷ আমার সম্পর্কে সব কথা আমার জেনে রাখা দরকার৷ বিশেষ করে আমাকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের কথা৷’

অ্যালান কথাটা বলার জন্য চাপাচাপি করাতে গোলেমবাক যে কথাটা বললেন তা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলেন অ্যালান৷

গোলেমবাক বললেন, ‘তাঁরা মনে করেন ব্রিটিশ সরকার তোমার চিকিৎসার নামে তোমাকে মানসিক, শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দিতে চান৷ হয়তো বা খুনও৷ যাকে বলে স্লো পয়জনিং৷ সেজন্যই সরকার তোমাকে সমকামিতার অপরাধে জেলে না পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর নামে নিজেদের হেফাজতে রেখেছেন, লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেছেন, যাতে তাঁদের কাজটা করতে সুবিধা হয়৷’

কথাটা শুনে একটু চুপ করে থেকে প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে অ্যালান বললেন, ‘তাঁদের এ অনুমানের কারণ কী? এ ভাবনার তো কোনো ভিত্তি থাকতে হবে৷ আমি তো সরকারের কোনো বিরুদ্ধাচারণ করিনি?’

গোলেমবাক বললেন, ‘তুমি আন্তর্জাতিক রাজনীতির কোনো খবর রাখো?’

অ্যালান বললেন, ‘দ্যাখো, রাজনীতি নিয়ে আমি কোনোদিনই তেমন আগ্রহী ছিলাম না৷ ব্লেচলি পার্কে আমি যোগ দিয়েছিলাম ওখানকার কাজটা একজন গণিতবিদ, ক্রিপ্টো- বিশেষজ্ঞ হিসাবে আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল বলে৷ সে কাজ মেটার পর আমি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করি৷ খবরের কাগজে রাজনীতি সম্পর্কিত কোনো খবর প্রকাশ পেলে হয়তো আলগোছে কখনও-সখনও চোখ বোলাতাম তাতে৷ ব্যস এ পর্যন্তই৷ আর এখন তো খবরের কাগজ পড়তেই দেওয়া হয় না আমাকে৷ টেলিফোন তো নেই-ই৷’

গোলেমবাক বললেন, ‘আমি যতটুকু খবর রাখি বলছি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর থেকেই আমরা এবং আমাদের মিত্রদেশরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে নেমে পড়েছে৷ হয়তো এটাই স্বাভাবিক ছিল৷ হিটলার ও মুসোলিনির ভয়ে শুধু দেশগুলো জোট বেঁধেছিল, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে তো তারা জোট বাঁধেনি৷ বিশেষত এখন তীব্র রেষারেষি শুরু হয়েছে দুই বৃহৎ শক্তিধর দেশ আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে৷ একদিকে স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোকে রুশিকরণ বা কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তন করার কাজে নেমেছে, অন্যদিকে আমেরিকানরা অর্থনৈতিকভাবে শাসন করতে চাইছে আমেরিকা, ইউরোপ, এমনকি এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশকে৷ সামরিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার ক্ষেত্রেও পরস্পরকে টেক্কা দেবার লড়াইতে নেমেছে এই দুই দেশ৷ যা ভবিষ্যতে হয়তো কোনোদিন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও ডেকে আনাতে পারে৷ ব্রিটেন এখনও এই দু-পক্ষের কাউকে সমর্থন না করলেও তাকেও হয়তো একদিন কোনো পক্ষ নিতে হবে৷’—এই বলে একটু থামলেন গোলেমবাক৷

‘কিন্তু এসবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?’ জানতে চাইলেন অ্যালান৷

গোলেমবাক বললেন, ‘এ কথা আমাদের মানতেই হবে যে আমরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দিক থেকে বর্তমানে তাদের থেকে কিছুটা পিছিয়ে৷ আমাদের দেশের চেয়ে উন্নত গবেষণার সুযোগও আমেরিকা আর রাশিয়াতে প্রচুর৷ আর এ ব্যাপারটাকে কাজে লাগিয়ে ওই দুই দেশ সারা পৃথিবী থেকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক নিজের দেশে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, তাদের সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তিবৃদ্ধির জন্য৷ কে বলতে পারে হয়তো তুমি একদিন উন্নত গবেষণার সুযোগ লাভের আশাতে ওসব দেশে চলে গেলে, তারপর সেখানেই রয়ে গেলে? এনিগমা কোডের রহস্য উৎঘাটনের পর একদা মিত্রশক্তির সব দেশের সামরিক বিভাগ তোমার নাম জানে৷ ওই দুই দেশের যে-কোনো দেশ তোমাকে পেলে লুফে নেবে৷ তারপর সেই দেশ হয়তো একদিন তোমার আবিষ্কারকে ব্যবহার করবে ব্রিটেনের বিরুদ্ধেই৷ আমাদের দেশের অবশ্য বেশি ভয় কমিউনিস্ট রাশিয়াকে নিয়ে৷ তারা নাকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানী সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েছে! তুমি যদি অসুস্থ হয়ে থাকো অথবা এ পৃথিবীতে না থাকো, তাহলে নিশ্চয়ই ব্রিটিশ সরকার একটা চিন্তা থেকে মুক্ত হয়৷ এবার নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ যে কিছু মানুষ কেন তোমার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন?’

গোলেমবাকের কথা শুনে বিস্মিত অ্যালানের হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল৷ তিনি সমকামিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হবার মাসখানেক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পেত্রোভিচ নামে এক বিজ্ঞানী ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যালানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন৷ তাঁর সঙ্গে অ্যালানের সৌজন্যমূলক আলোচনাও হয়েছিল৷ ওই পেত্রোভিচ নামের লোকটি অ্যালানকে তাঁর দেশের ক্রেমলিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান সম্পর্কে বক্তৃতা করতে যাবার জন্য আমন্ত্রণও জানিয়ে গেছিলেন৷ ব্যস, এ পর্যন্তই৷ অ্যালান তাঁকে কথা দেননি সেখানে যাবেন বলে৷ ওই রাশিয়ান বিজ্ঞানীর তাঁদের দেশে অ্যালানকে আমন্ত্রণ করার পিছনে অন্য কোনো মতলব ছিল কি না, তা অবশ্য অ্যালানের জানা নেই৷

কেমন যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা কিছুক্ষণের জন্য বিরাজ করতে লাগল সেই ঘরে৷ ব্যাপারটা কাটিয়ে ওঠার জন্য গোলেমবাক এরপর বললেন, ‘হয়তো এসব কথার কোনো ভিত্তিই নেই৷ ছাড়ো এসব, চাল দাও৷ আমাকে তো আবার ফিরতে হবে৷ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে৷’

তাঁর কথা শুনে অ্যালানও নিজের ভাবনাকে সংযত করে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, দিই৷ হ্যাঁ, এখন এসব ভেবে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না৷’—এ কথাগুলো বলে চাল দিলেন অ্যালান৷

কিন্তু তারপরেই তিনি বুঝতে পারলেন তিনি ভুল চাল দিয়েছেন৷ একটা চালেই এবার কিস্তিমাত করে দেবেন অপর পক্ষ৷ গোলেমবাক দাবার বোর্ডটার দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন৷ তারপর বরাবর যেটা করে থাকেন সেটাই করলেন৷ দাবার বোর্ডটাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে দক্ষ চালে সেই মুহূর্তের জন্য বিপদ থেকে নিজেকে এবং অ্যালানকে মুক্ত করলেন৷

নিঃশব্দে খেলা চলতে থাকল৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল৷ জীবনে এই প্রথমবার গোলেমবাককে কিস্তিমাত করলেন অ্যালান৷ ব্যাপারটাতে অ্যালান প্রচণ্ড বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি কি ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাকে জিতিয়ে দিলে গোলেমবাক? তুমি তো কোনোদিন হারো না!’

গোলেমবাক বললেন, ‘আসলে জীবনে এই প্রথমবার দাবার বোর্ডে মনোসংযোগ হারালাম আমি৷ ভুল চাল দিয়ে ফেললাম, হেরে গেলাম৷ কিছু ভুল এমন আছে তা করে ফেললে তুমি যত বড় খেলোয়াড় হও না কেন তোমাকে হারতে হবে৷’

গোলেমবাকের দিকে তাকিয়ে অ্যালান বললেন, ‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক৷ এক-একসময় মনে হয় আমার জীবনটা যদি দাবার বোর্ডের মতো হত৷ বিপদের সময় গোলেমবাকের মতো কেউ যদি বোর্ডটা ঘুরিয়ে দিত…’

গোলেমবাক বললেন, ‘‘আমাদের প্রত্যেকের জীবনও এক-একটা দাবার বোর্ড৷ কিন্তু জীবনের দাবা খেলাতে আমাদের প্রতিপক্ষের নাম ‘সময়’৷ সে বড় নির্মম, নিষ্ঠুর৷ কাউকে সে জিততে দিতে চায় না, নিজে জিততে চায়৷’’

এবার আর দেরি করা যাবে না৷ ফেরা দরকার গোলেমবাকের৷ খাট থেকে নেমে দাঁড়ালেন তিনি৷ অ্যালানও নেমে দাঁড়ালেন৷ অ্যালানের হাত ধরে গোলেমবাক ছোট দুটো শব্দ উচ্চারণ করলেন, ‘ভালো থেকো৷’

দরজা খুলে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে গেলেন গোলেমবাক৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *