আঁধারে গোপন খেলা – ৭

‘মরকম? মরকম? দেখো ছেলের দল আমাকে আবার মারতে আসছে! কোথায় তুমি?’ বিড়বিড় করে বলছিলেন তিনি৷

‘উঠে পড়ুন স্যার, উঠে পড়ুন৷ ডিনারের সময় হয়ে গেছে! খাবেন না?’ পরিচারকের মৃদু ঝাঁকুনিতে বিছানাতে উঠে বসলেন অ্যালান৷ তারপর পরিচারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ও স্টুয়ার্ট তুমি! আমি ভাবলাম বুঝি মরকম!’ অতি ধীরে ধীরে ক্লান্তভাবে কথাগুলো বললেন তিনি৷

মরকম কে তা জানা নেই স্টুয়ার্টের৷ দু-দিন আগে সকালে বাইরে বেরিয়েছিলেন অ্যালান৷ তাঁকে দেখে স্টুয়ার্টের মনে হয়েছিল যে বেশ খুশি মনেই বাড়ি ফিরেছিলেন অ্যালান৷ দাবার বোর্ড নিয়ে খেলতেও বসেছিলেন৷ কিন্তু তারপর থেকেই প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অ্যালান৷ এ দু-দিন বলতে গেলে তিনি শুয়েই ছিলেন৷ প্রায় ঘোরের মধ্যেই কাটিয়েছেন৷ মাঝে মাঝে ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে নানা কথা বলেছেন, আবার কখনও বা শরীরের যন্ত্রণাতে বা কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে কঁকিয়ে উঠেছেন৷ অ্যালানের এ ব্যাপারটা অবশ্য স্টুয়ার্টের কাছে নতুন নয়৷ সরকারি চিকিৎসক এসে তাঁকে ইঞ্জেকশন দেবার পর এ ব্যাপারটা যে ঘটে তা জানে স্টুয়ার্ট৷ তবে এ-বারের অসুস্থতাটা যেন একটু বেশি বলে মনে হচ্ছে পরিচারকের৷ অ্যালানকে সে বলল, ‘রাত দশটা বাজে৷ উঠে পড়ুন স্যার৷ ডিনারটা সেরে নিন৷ নইলে শরীর আরও দুর্বল লাগবে৷’

বিছানা ছেড়ে নামলেন অ্যালান৷ মাথার যন্ত্রণা এই মুহূর্তে না থাকলেও গাঁটের যন্ত্রণা অত্যন্ত প্রবল৷ ‘চারদিন হতে চলল তবু যন্ত্রণা কমছে না কেন? ডাক্তার কি তবে হরমোন ইঞ্জেকশনের সঙ্গে অন্য কিছু মিশিয়ে শরীরে প্রবেশ করিয়েছেন?’—এ কথাটা মনে মনে একবার ভাবলেন অ্যালান৷ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অ্যালান চললেন ওয়াশরুমের দিকে৷

গরম জলে অত রাতেই স্নান সারলেন তিনি৷ সারাদিন আজ বিছানা ছেড়ে ওঠেননি তিনি৷ স্নান সারার পর তাঁর ক্লান্ত অবসন্ন ভাবটা অনেকখানি যেন কেটে গেল৷ একটু খিদেও যেন পেল৷ পোশাক পাল্টে তিনি যখন পাশের ডাইনিং রুমে উপস্থিত হলেন, ততক্ষণে টেবিলে ডিনার সাজিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল পরিচারক৷ ডিনার সারতে বসলেন অ্যালান৷ স্যুপের বাটি থেকে চামচ দিয়ে স্যুপ মুখে দিয়ে তিনি পরিচারককে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার কোনো চিঠি এসেছে? নীল খামওলা সরকারি মোহরের ছাপওলা চিঠি?’

স্টুয়ার্ট জবাব দিল, ‘না স্যার, আসেনি৷’

অ্যালান বললেন, ‘আসার কথা৷ আসবে৷ চিঠিটা এলে, আমি যদি সেসময় ঘুমিয়েও থাকি, তাও আমাকে ডেকে তখনই চিঠিটা দেবে৷ খুবই জরুরি চিঠি৷’

স্টুয়ার্ট জবাব দিল, ‘আচ্ছা স্যার৷’

অ্যালান আর-কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে ডিনার শেষ করে ফিরে এলেন ঘরে৷ শরীরে কিছুটা বলও যেন তাঁর ফিরে এল৷ একটা চেয়ার টেনে আনলেন তিনি জানলার কাছে৷ পর্দা সরিয়ে, জানলার কাচের পাল্লা খুলে তিনি চেয়ারে বসলেন৷

বাইরে নিস্তব্ধ পৃথিবী৷ বিয়ার পাবগুলো এতক্ষণে নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে৷ হই-হুল্লোড় সেরে পরদিন আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরে গেছে তরুণ-তরুণীর দল৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই, অ্যালানের বাড়ির সামনের রাস্তাটা শূন্য৷ আকাশের দিকে তাকালেন অ্যালান৷ মেঘমুক্ত আকাশে উজ্জ্বল তারাভরা রাত৷ কেউ যেন একরাশ হীরককুচি ছড়িয়ে রেখেছে আকাশের বুকে৷ সেদিকে তাকিয়ে মনটা একটু ভালো হয়ে গেল অ্যালানের৷ সেদিকে তাকিয়ে অ্যালানের প্রথম মনে পড়ল মরকমের কথা৷ গ্রীষ্মের কত রাত অ্যালান আর মরকম পাশাপাশি ঘাসের ওপর শুয়ে এমনই তারাভরা রাতের দিকে তাকিয়ে কাটিয়েছেন! শেরবর্ন স্কুলে পড়ার দিনগুলোতে অ্যালানকে মরকম শুধু যে গণিতের উচ্চতর শাখা, সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তাই নয়, গ্রহ-নক্ষত্র সম্বন্ধে অদ্ভুত ফলিত জ্ঞান ছিল তার৷ কোনটা ‘গ্রেট বিয়ার’ বা সপ্তর্ষিমণ্ডল, কোনটা মেনেসা তারামণ্ডল, এ সব কিছু অ্যালানকে চিনতে শিখিয়েছিল সে৷ সারাদিন পড়াশোনার ক্লান্তির শেষে কখনও কখনও অ্যালানকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠত অ্যালানকে আকাশ চেনাবার জন্য৷ তখন অ্যালান আর মরকম পরস্পরের বাড়ি যাতায়াত আর রাত্রিবাসও শুরু করেছে৷ অ্যালান তার জ্ঞান দেখে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘এসব তারা তুমি চিনলে কীভাবে? পাঠ্যবইতে এসব লেখা থাকলেও আমাদের ইস্কুলে তো তারা চেনাবার ক্লাস হয় না!’

মরকম জবাব দিয়েছিল, ‘বলতে পারো নিজের আগ্রহতেই শিখেছি৷ রাতের পর রাত জেগে বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে আকাশের তারা চিনেছি৷ যখন পারতাম না তখন বাবার শরণাপন্ন হতাম৷ তিনি চিনিয়ে দিতেন৷ আসলে আকাশ আর তারা চেনার ব্যাপারটা অনেকটা হয়তো আমাদের রক্তের মধ্যেই মিশে আছে বংশানুক্রমে৷ তুমি তো জানোই, আমার পূর্বপুরুষরা একসময় নাবিক ছিলেন৷ সেসময় তো দিকনির্ণয়ের জন্য যন্ত্রপাতির তেমন প্রচলন ছিল না৷ দিকচিহ্নহীন উত্তাল সমুদ্রে রাতের আকাশে নক্ষত্র দেখেই দিক নির্ণয় করতেন নাবিকরা৷ তাঁরা অধিকাংশই কিন্তু নিরক্ষর ছিলেন, অথচ তাঁদের কী আশ্চর্য জ্ঞান ছিল আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র চেনার ব্যাপারে৷ হয়তো বা তাঁদেরই দক্ষতা কিঞ্চিৎ লাভ করেছি আমি৷’

হ্যাঁ, ক্রিস্টোফার মরকমই শেরবর্ন স্কুলের আতঙ্কের দিনগুলোকে পরিণত করেছিল সোনালি দিনে৷ মরকম হয়ে উঠেছিল অ্যালানের রক্ষাকর্তা, অভিভাবক, শিক্ষক ও সর্বোপরি একান্ত বন্ধু—ভালোবাসার মানুষ৷ মা, সারা টিউরিং-এর পর অ্যালান যদি কাউকে ভালোবেসে থাকে, সে হল ক্রিস্টোফার মরকম৷ যে বয়সে মরকমের সঙ্গে অ্যালানের যোগাযোগ, সে বয়সটা অ্যালানের জীবনে কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণ৷ যৌনতা বিকশিত হতে শুরু করে, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোলাগা ভালোবাসা শুরু হয়৷ যা আসলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণই৷ অ্যালান কিন্তু মেয়েদের প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করেননি কোনোদিন৷ অ্যালানের নিজের চেহারা বেশ নরম, কমনীয়৷ চলতি কথায় লোকে যাকে বলে ‘মেয়েলি ভাব’৷ সেসময় অ্যালানের শরীরে, কথা বলায়, হাঁটাচলাতে সে ভাবটা একটু বেশি পরিমাণেই ছিল৷ যে কারণে শেরবর্ন স্কুলে প্রাথমিক অবস্থায় মার্টিন আর তার অনুচরদের বিদ্রুপ আর অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল অ্যালানকে৷ আর অ্যালানের তথাকথিত মেয়েলি ভাবের জন্যই সম্ভবত সমবয়সি মেয়েরা অ্যালানের প্রতি তেমন কোনো আকর্ষণ, বলা ভালো যৌন আকর্ষণ অনুভব করেনি৷ অ্যালানকে তারা এড়িয়েই চলেছে৷ অ্যালানের জীবনে নারী বলতে শুধুই তার মা, সারা টিউরিং৷ মাতা-পুত্রের মধ্যে যেমন স্নেহ-ভালোবাসার স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকে, ঠিক তেমনই সম্পর্ক ছিল তাদের দুজনের মধ্যে৷ তবে মরকম ছিল অ্যালানের সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের৷ ঈর্ষণীয় পুরুষালি চেহারা ছিল তার৷ একদিকে সে যেমন ছিল অসম্ভব মেধাবী আর স্নেহপরায়ণ, তেমনই তার মধ্যে একটা নায়কোচিত শক্তসমর্থ ব্যাপার ছিল৷ মরকমের সঙ্গে অ্যালানের যেদিন প্রথম আলাপ, মার্টিনের দলের হাত থেকে অ্যালানকে উদ্ধার করে তার হাত ধরে মরকম যেদিন তাকে মাটি থেকে টেনে তুলেছিল, সেদিন সেই হাতের স্পর্শে অ্যালান জীবনে প্রথম যেন অন্য ধরনের অনুভূতি লাভ করেছিল৷ সে অনুভূতি কি অতি সূক্ষ্ম যৌন অনুভূতির আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনো রূপ ছিল? মরকমই কি প্রথম পুরুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল? যৌনভাবে একজন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হতে শিখিয়েছিল পুরুষ অ্যালানকে?—এ প্রশ্ন অ্যালানের মনে আজও উঁকি দেয়৷ উত্তরটা অ্যালানের নিজের কাছেও ধোঁয়াশার মতো৷ হয়তো ‘হ্যাঁ’, হয়তো ‘না’৷ তবে এ কথা সত্যি যে মরকমের প্রতিটা স্পর্শ যেন এক অদ্ভুত ভালোলাগার জন্ম দিত অ্যালানের শরীরে৷ যে কটা দিন মরকম আর অ্যালান একসঙ্গে এ পৃথিবীতে ছিল, সে ক’দিন মরকমের প্রতি এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে আবিষ্ট হয়েছিল কিশোর অ্যালান৷

তবে অ্যালানের মা কি তাদের দুজনের ব্যাপারে কিছু সন্দেহ করেছিলেন? সতর্ক হবার চেষ্টা করেছিলেন ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে? অ্যালানকে তিনি মরকমের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে মুখে কিছু না বললেও অ্যালান বুঝতে পারত শেষের দিকে তিনি যেন মরকমকে বিশেষ পছন্দ করতেন না৷ তিনি চাইতেন না যে মরকমের বাড়িতে অ্যালান রাত্রিবাস করুক৷ এর পিছনে তাঁর কি কোনো আশঙ্কা কাজ করত? মরকমের সান্নিধ্য, স্কুল, পড়াশোনার বাইরে কোনো ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ ছিল না অ্যালানের৷ মা, সারাও ব্যাপারটা জানতেন৷ তবুও আঠেরো বছরে পদার্পণ করার আগেই সারা কেন অ্যালানকে জোর করে নিয়ে গেছিলেন সেই বিশেষ ধরনের নৈশভোজে? যে নৈশভোজে অভিভাবকরা সদ্য যৌবনে পদার্পণকারী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উপস্থিত হয় বিশেষ কারণে! উপস্থিত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে যদি কারো কাউকে ভালো লাগে, তবে তাদের অভিভাবক-অভিভাবিকারা ভবিষ্যতে তাদের বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা সেরে রাখেন৷ তবে অ্যালানকে সেখানে পছন্দ করেনি অ্যালানের সমবয়সি কোনো মেয়ে, আর অ্যালানও তাদের কারো প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করেনি৷ বলরুমে ঝাড়বাতির আলোর নীচে রংচঙে পোশাক পরা কিশোরী-তরুণীর দল যখন অ্যালানের সামনে একঝাঁক উজ্জ্বল প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল, অ্যালানের মন ছিল তখন তাদের থেকে অনেক দূরে৷ তখন সে ভাবছিল মরকমের কথা—মরকম এখানে থাকলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই তাকে ছেঁকে ধরত নারীর দল৷ তার মতো সুঠাম শক্তপোক্ত পুরুষকেই তো নারীরা মনে মনে কামনা করে৷ শুধু নারীরা কেন, অ্যালানের মতো কিছু পুরুষও হয়তো মনে মনে কামনা করে মরকমকে৷ সে এখন কী করছে? নিজের ঘরে পাঠে নিমগ্ন? নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দেখছে, ভাবছে অ্যালানের কথা? বলরুমের একপাশে দাঁড়িয়ে অ্যালান সেদিন এ কথাগুলোই ভেবেছিল৷ নৈশভোজের আসর থেকে হতাশভাবে ছেলেকে নিয়ে বাড়িমুখো হয়েছিলেন সারা টিউরিং৷

তবে এরপর অবশ্য সারাকে নিজেই দুশ্চিন্তামুক্ত করে দিয়েছিল ক্রিস্টোফার মরকম, তার নিজের ব্যাপারে৷ হঠাৎই একদিন প্রবল জ্বর এল মরকমের৷ একদিন, দু-দিন, তিনদিন৷ কিছুতেই জ্বর ছাড়ে না তার৷ পরীক্ষায় ধরা পড়ল মরকম ‘বোভাইন টিউবারকিউলোসিস’ আক্রান্ত৷ সেই শেষের ক-দিন অ্যালান আর মরকম দুজনের জীবনেই করুণতম দিন ছিল৷ ‘টিউবারকিউলোসিস’ রোগ মানেই মৃত্যুর পরোয়ানা, আর এ রোগ অত্যন্ত ছোঁয়াচে৷ এ রোগ সম্বন্ধে সেসময় এ ধারণাই পোষণ করত লন্ডনের মানুষ৷ কারো এ রোগ হলে তার ধারে-কাছে পরিবারের লোকও ঘেঁষত না মৃত্যুভয়ে৷ কিন্তু সেই প্রথম মায়ের নিষেধও অগ্রাহ্য করেছিল অ্যালান৷ রোজ সকাল হলেই অ্যালান সমস্ত বাধা-নিষেধ অগ্রাহ্য করে মরকমের বাড়ি ছুটে যেত৷ মরকমের সেই ছোট্ট ঘরটাতে তার খাটের পাশে চেয়ার ঠেলে নিয়ে বসে থাকত সে, যতক্ষণ না সন্ধ্যা নামে৷ মরকম বিছানাতে পড়লেও প্রথম দিকে কথা বলতে পারত সে৷ অ্যালানকে তার পাশে অমনভাবে ঠায় বসে থাকতে দেখে মরকম নিজেই কখনও বা অ্যালানকে বলত যে, ‘এবার তুমি বাড়ি ফিরে গিয়ে পড়তে বসো৷ আর কয়েক মাস বাদেই যে পরীক্ষা৷ ক্লাসে তোমাকে প্রথম হতেই হবে৷ আমার হয়তো এবার দেওয়া হবে না৷’ মরকমের কথা শুনে অ্যালান হেসে বলত, ‘সিলেবাস তো কবেই শেষ করেছি তা তুমি নিজেই জানো৷ আর আমার প্রথম হবার ব্যাপারে তোমার তো সন্দেহ থাকার কথা নয়৷ আর তুমিও সুস্থ হয়ে উঠবে৷ নিশ্চয়ই পরীক্ষা দেবে৷’

অ্যালানের কথা শুনে বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠত মরকমের ঠোঁটে৷ আর তা দেখে অ্যালান তার মনে সাহস যোগাবার জন্য বলত, ‘আমার মনে হচ্ছে আর ক-দিনের মধ্যেই খাট ছেড়ে নামবে তুমি৷ তবে আমরা কিন্তু প্রথমে বই নিয়ে অঙ্ক করতে বসব না৷ রাতে মাঠে যাব৷ ওই যে তুমি আমাকে নতুন একটা তারা চেনাবে বলেছিলে, সেটা চেনাতে হবে৷’ এ কথাটা শুনে মুহূর্তের জন্য আশার আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত মরকমের চোখ৷ দুর্বল কণ্ঠে সে বলত, ‘হ্যাঁ, দেখাব৷ পশ্চিম আকাশে ওটা দেখা যায়৷’

সেই নতুন তারা কিন্তু আর দেখা হয়নি, চেনা হয়নি অ্যালানের৷ এরপর বিছানা থেকে ওঠা তো দূরের কথা, মরকমের কথাও বন্ধ হয়ে গেছিল৷ অসহায় দৃষ্টি নিয়ে সে চেয়ে থাকত অ্যালানের দিকে৷ শেষ দু-তিনদিন কোনো হুঁশ ছিল না মরকমের৷ তারপর একদিন সকালে অ্যালান, মরকমের বাড়ি পৌঁছে দেখল মরকম নিশ্চলভাবে শুয়ে আছে৷ তার যে ডানহাতটা একদিন অ্যালানকে মাটি থেকে টেনে দাঁড় করিয়েছিল, সেই হাতটা আজ শীর্ণভাবে খাটের থেকে মাটির দিকে ঝুলছে৷ সে হাত আর কোনোদিন অ্যালানের হাত আঁকড়ে ধরবে না৷

জানলার পাশে বসে তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে অ্যালান ভাবতে লাগল মরকমের কথা৷ শেরবর্ন স্কুলের সেই দিনগুলোর কথা৷ যে দিনগুলো আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, যেমন আর কোনোদিন ফিরবে না ক্রিস্টোফার মরকম৷ তবে সেসব দিনের কথা কোনোদিন ভোলেনি অ্যালান৷ আজ সে নিঃসঙ্গ বলে মরকমের কথা তার মনে পড়ছে এমনটা নয়৷ ব্লেচলি পার্কের সাইফার স্কুলে এনিগমা রহস্য উন্মোচনের জন্য চূড়ান্ত পরিশ্রমের দিনগুলোতে অথবা টিউরিং মেশিনের সফলতা লাভের দিনেও সে ভোলেনি মরকমকে৷ অ্যালান ‘যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব’ প্রমাণ করার পর অ্যালানের সহকর্মীরা কেউ কেউ বলতেন যে অ্যালানের নোবেল প্রাইজ পাওয়াটা কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা৷ তাঁদের এ বক্তব্যের যে কিছুটা সারবত্তা আছে তা অ্যালান নিজেও মানেন৷ অ্যালান মনে মনে ভেবে রেখেছেন যে সত্যিই যদি তিনি কোনোদিন নোবেল প্রাইজ পান, তবে তিনি সে পুরস্কার উৎসর্গ করবেন তাঁর ভালোবাসা—ক্রিস্টোফার মরকমের স্মৃতির উদ্দেশে৷

আকাশের দিকে চেয়ে মরকমের কথা ভাবতে ভাবতে পশ্চিম আকাশে এক উজ্জ্বল তারা হঠাৎ চোখে পড়ল অ্যালানের৷ ওটাই কি তবে সেই তারা, যা মরকমের চেনানো হল না অ্যালানকে? নাকি মরকম নিজেই ওই তারা? ছেলেবেলাতে অ্যালান তাঁর মার মুখে কোনো একটা রূপকথার গল্পে শুনেছিলেন মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে ফোটে৷ যদিও বিজ্ঞানের সঙ্গে তারা হওয়ার গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে কথাটা মনে পড়ে কেন জানি ভালো লাগল অ্যালানের৷ তারাটার দিকে তাকিয়ে মরকমের উদ্দেশে মনে মনে তিনি বললেন, ‘হয়তো বা তুমি ওই তারাই হবে!’

ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল একসময়৷ গির্জার ঘড়িতে রাত বারোটার ঘণ্টা বাজল৷ জানলা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন অ্যালান৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *