আঁধারে গোপন খেলা – ৬

তাঁদের ছোট বাড়িটার জানলার ঠিক কয়েক হাত তফাতেই সেই উইলো গাছটা৷ নিস্তব্ধ রাতে মোম জ্যোৎস্না যেন চুঁইয়ে পড়ছে তার গা বেয়ে৷ কাচের জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ ঘরের ভিতর ফায়ারপ্লেসের আগুনটা কেমন যেন একটা নীলচে আলো ছড়াচ্ছে৷ ডিনার অনেকক্ষণ হয়ে গেছে৷ মা সারার গায়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে অ্যালান৷ ঘুম আসছে না তার৷ জানলার কাচ ভেদ করে আলো এসে পড়েছে অ্যালানের মুখে৷ বড় মায়াবী সেই মুখ৷ অ্যালানের মুখমণ্ডলে, চেহারাতেও একটা মেয়েলি ছাঁদ আছে৷ এ জন্য তার সমবয়সি ছেলেরা অনেকসময় তাকে বিদ্রুপ করে৷ অ্যালান কারও সঙ্গে ঠিকভাবে মিশতে পারে না কেবল মা ছাড়া৷ সবসময় কী যেন ভেবে চলে অ্যালান! যত অ্যালানের বয়স বাড়ছে তত তার এই অন্তর্মুখী প্রবণতা যেন বেড়ে চলেছে৷ ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন সারা৷ গির্জার ঘড়িতে মধ্যরাতের ঘণ্টা বাজল৷ ছেলেকে তখনও তাকিয়ে থাকতে দেখে মা বললেন, ‘কি রে, ঘুমোবি না? কাল সকালে উঠে তো আবার স্কুলে যেতে হবে৷’

‘ঘুম আসছে না৷’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল অ্যালান৷

‘কেন ঘুম আসছে না? স্কুলে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?’—জানতে চাইলেন সারা৷ বেশ কয়েকমাস হয়ে গেল ছেলেকে ডরমেটের শেরবর্ন স্কুলে ভরতি করেছেন সারা৷ বাড়ির থেকে বেশ অনেকটা দূর হলেও এই স্কুলটা লন্ডনে অন্যতম সেরা স্কুল বলে বিবেচিত হয়৷

দুটো প্রশ্নের জবাবই এড়িয়ে গিয়ে অ্যালান বলল, ‘তুমি বরং আমাকে ইন্ডিয়ার গল্প বলো, রাজা-রানির গল্প বলো৷ সেই মন্দিরের গল্প বলো, যেখানে দেবতাদের হাত নেই৷ রথে করে ঘোরে যারা….৷’

সারা তাঁর জীবনের বেশ অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ওড়িশা রাজ্যের গঞ্জামের ছত্তরপুরে৷ অ্যালান সেখানেই গর্ভে এসেছিল সারার৷ তারপর তিনি সন্তানের জন্ম দেবার জন্য ইংল্যান্ডে চলে আসেন৷ স্বামী জুলিয়াসের অবশ্য এখনও যাওয়া-আসা আছে ইন্ডিয়াতে৷ ছোটবেলা থেকেই ইন্ডিয়ার নানা গল্প শুনিয়ে অ্যালানকে ঘুম পাড়াতেন সারা৷ তার মধ্যে একটা হল পুরীর মন্দিরের গল্প৷ সেই গল্পই শুনতে চাইল অ্যালান৷

ছেলের কথা শুনে মা হেসে বললেন, ‘পনেরো বছর বয়স হয়ে গেল তোমার৷ এখনও ওসব গল্প শোনার নেশা গেল না!’

কিশোর অ্যালান পাশ ফিরে তার মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলো তুমি৷ আমার এখনও ওসব গল্প শুনতে ভালো লাগে৷’ অ্যালান যেন আজও বড় হয়নি, আট বছরের অ্যালানই আছে৷ অ্যালানের অনুভূতি স্পর্শ করল সারাকে৷ ছেলের চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে সারা ছেলেকে বলতে শুরু করলেন ছোট অ্যালানকে ঘুম পাড়াবার জন্য ইতিপূর্বে বহুবার বলা সেই গল্প—‘সমুদ্রের তীরে রয়েছে সেই অদ্ভুত নগরী—পুরী৷ আমাদের লন্ডনের থেকেও অনেক প্রাচীন সেই নগর৷ আর তার চেয়েও প্রাচীন নাকি সেখানকার মন্দির! হিন্দু গড শ্রীজগন্নাথের মন্দির৷ সে নগরীতে একজন রাজা আছেন বটে, কিন্তু আসল রাজা হলেন সেই জগন্নাথ৷ রাজার মতোই, বলা যেতে পারে তাঁর থেকেও বেশি দাস-দাসী-পরিচারকেরা সেবা করে তাঁকে৷ লোকে বলে যে মন্দিরে যত ধনরত্ন সোনা আছে, তার কণামাত্র সম্পদ আমাদের বাকিংহাম প্যালেসেও নেই৷ পুরীর মন্দিরে হিন্দু ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের লোকের প্রবেশাধিকার নেই৷ তবে আমি যখন সে নগরীতে গেছিলাম তখন সৌভাগ্যক্রমে উৎসবের দিন ছিল৷ ইন্ডিয়ার নানা প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু সমবেত হয় সে উৎসবে৷ বিরাট প্রাসাদের মতো রথে মন্দিরের বাইরে বার করা হয় দেবতাকে৷ তাঁর সঙ্গে থাকেন দেবতার ভাই ও বোন৷ তাঁরাও দেবতা৷ কাঠের তৈরি দেবমূর্তিগুলোর প্রত্যেকের পরনেই সোনার সুতোয় বোনা পোশাক আর অলংকার! মুকুটে যে কত ধরনের হিরা-জহরত আছে, তার হিসাব নেই৷ তার এক-একটা দিয়ে হয়তো লন্ডন শহরের সব প্রাসাদ কিনে নেওয়া যাবে৷ তবে তিনটে মূর্তিই বড় অদ্ভুত৷ কনুই থেকে তাদের হাত নেই৷ জাহাজের কাছির থেকেও মোটা কাছি টেনে হাজারে হাজারে মানুষ বিগ্রহের প্রাসাদের মতো রথকে টেনে নিয়ে যায়৷ রথ যে পথে যায়, সে পথে রথের আগে আগে সোনার ঝাঁটা দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করেন স্বয়ং পুরী নগরীর রাজা৷ লক্ষ লক্ষ মানুষের চিৎকার, জয়ধ্বনি আর বাজনার শব্দ নগরী অতিক্রম করে বহু দূর থেকে শোনা যায়! কত মানুষ! কত ধরনের তাদের পোশাক, অলংকার, ভাষা…৷’

গল্প বলে চলেন সারা৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেই অজানা দেশের সেই ছবি যেন ধরা দিত তার চোখে৷ মাকে অ্যালান বলতে পারছে না, নতুন ইস্কুলে তার প্রতি তার সহপাঠীদের আচরণ ক্রমশই যেন অসহনীয় হয়ে উঠছে৷ যা কিশোর অ্যালানের মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে৷ অনেক রাত পর্যন্ত অ্যালানের ঘুম না-আসার এটাও একটা কারণ৷ কিন্তু মায়ের মুখে গল্প শুনতে শুনতে আর মাথায় স্নেহ স্পর্শ অনুভব করতে করতে একসময় অ্যালানের মন থেকে তিক্ত চিন্তাগুলো দূর হয়ে যেতে লাগল৷ গল্প শুনতে শুনতে একসময় অ্যালান ঘুমিয়ে পড়ল৷

পরদিন সকালে উঠে অ্যালান ভাবল সে আজ স্কুলে যাবে না৷ যে অ্যালান প্রথম দিন স্কুলে যাবার জন্য তিরিশ মাইল পথ ছুটে গেছিল, সেই অ্যালানেরই স্কুলে যেতে ইচ্ছা করছে না৷ ভয় লাগছে তার৷ না, পড়া না-পারার ভয় নয়৷ ইতিমধ্যে যতগুলো ক্লাস টেস্ট হয়েছে, তার সবেতেই প্রথম হয়েছে অ্যালান৷ বছর শেষ হতে এখনও বেশ কয়েকমাস দেরি৷ কিন্তু তার মধ্যেই আস্ত বইগুলো বেশ কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে তার৷ উঁচু ক্লাসের গণিত বই লাইব্রেরি থেকে নিয়ে অঙ্ক কষতে শুরু করেছে অ্যালান৷ এবং তা শিক্ষক মহাশয়দের সাহায্য ছাড়াই৷ পড়া না-পারার ব্যাপারে অ্যালানের ভয় নেই৷ তার ভয়ের জায়গা অন্য৷ অ্যালান শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল, ‘আজকের দিনটা অন্তত দেখা যাক৷’ তেমন হলে বাড়ি ফিরে এসে মাকে সে বলবে নতুন বছরে তাকে অন্য স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করতে৷

নির্দিষ্ট সময়েই প্রতিদিনের মতো স্কুল গেটে পৌঁছে গেল অ্যালান৷ তবে প্রথমে সে ভিতরে প্রবেশ করল না৷ প্রবেশতোরণের একটা থামের আড়ালে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল, যতক্ষণ না প্রার্থনা সংগীতের ঘণ্টা বাজে৷ আর সেই শব্দ হতেই সে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল প্রেয়ার লাইনের একদম শেষ মাথাতে৷ তারপর প্রার্থনা সংগীত শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একছুটে ক্লাসরুমের ভিতর৷ ক্লাসরুমের ভিতর অবশ্য বেশি আতঙ্কের অবকাশ নেই৷ টিফিনের আগে পর পর চারটে ক্লাস৷ একটা ক্লাস শেষ হতেই পরের শিক্ষক ক্লাস নেবার জন্য ঢুকে পড়েন৷ তবুও তারই মধ্যে দুটো ঘটনা ঘটল৷ পদার্থবিদ্যার শিক্ষকের প্রশ্নের জবাবে পড়া বলছিল অ্যালান৷ না, ভুল উত্তর নয়, তবে তার স্বভাবসুলভ ভাবে একটু তুতলিয়ে, থেমে থেমে৷ ঠিক সেই সময় ছাত্রদের মধ্যে থেকে কে যেন একবার অ্যালানের উদ্দেশে ‘ব্যা ব্যা’ করে ডেকে উঠল৷ সঙ্গে সঙ্গে চাপা হাসির রোল উঠল ক্লাসে৷ শিক্ষকমশাই তা দেখে হাতের বেতটা দিয়ে টেবিলের ওপর চড়াম করে বাড়ি দিতেই থেমে গেছিল সেই শব্দ৷ আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হল তৃতীয় পিরিয়ডে৷ অ্যালান যখন খাতায় একমনে নোট নিচ্ছিল, তখন একটা চকের টুকরো কোথা থেকে যেন উড়ে এসে মট করে ভাঙল অ্যালানের মাথায়৷ যদিও তাতে অ্যালানের তেমন লাগেনি, তবে এ দুটো ঘটনাই অ্যালানকে বুঝিয়ে দিল, এ দিনটাও তার ভালো কাটবে না৷ সে যেমন আশঙ্কা করেছিল তেমনই ঘটতে চলেছে৷ তাই বাঁচার একটা উপায় মনে মনে ভেবে রাখল অ্যালান৷ টিফিন পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজতেই শিক্ষক যখন ক্লাস থেকে বেরোচ্ছেন, তখন তাঁর গায়ের সঙ্গে একদম লেপটে ক্লাস থেকে বেরোল অ্যালান৷ অন্য ক্লাসের ছাত্ররাও তখন ক্লাস থেকে বেরোচ্ছে৷ তাদের ভিড়ে মিশে লম্বা অলিন্দটা আগে অতিক্রম করল অ্যালান৷ তারপর মাঠে নেমে সোজা স্কুলবাড়িটার পিছন দিকে ছুট দিল৷ সেদিকে সচরাচর কেউ যায় না৷ বড় বড় গাছ আর আগাছা ঘেরা সে জায়গা৷ আর তার শেষ প্রান্তে পুরোনো একটা বাড়ি আছে৷ পরিত্যক্ত বাড়িটা৷ একসময় সেটা আবাসিক শিক্ষকদের বাসস্থান ছিল৷

ঝোপজঙ্গল ভেঙে একছুটে বাড়িটার কাছে পৌঁছে গেল অ্যালান৷ ব্যস, এবার সে অনেকটা নিশ্চিন্ত৷ টিফিন শেষ হবার ঘণ্টা বাজলেই সে একছুটে ক্লাসে গিয়ে ঢুকবে৷ একটা ওক গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসল অ্যালান৷ চারপাশ কেমন নিস্তব্ধ, শান্ত৷ শুধু ইস্কুলবাড়ির উলটোদিক থেকে ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো ছাত্রদের মৃদু কোলাহল ভেসে আসছে৷ অ্যালান অবশ্য কোনোদিনই ছাত্রদের খেলায় যোগ দেয় না৷ এসময়টা ক্লাসে বা বারান্দার থামের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নিজের মনোজগতেই বিচরণ করত সে৷ কিন্তু কিছুদিন ধরে সেই একলা থাকাটা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না৷ ‘তবে আপাতত এখন আধঘণ্টার জন্য একটু শান্তি৷’—গাছের ছায়ায় বসে মনে মনে ভাবল অ্যালান৷

কিন্তু অ্যালানের শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হল না৷ নেকড়ে যেমন নিরীহ খরগোশের সন্ধান পেয়ে যায়, ঠিক তেমনই যেন কীভাবে অ্যালানের সন্ধান পেয়ে গেল তারা৷ অ্যালানেরই সহপাঠী একদল ছেলে—হ্যারি, গুচ, পিটার, জন্টি আর তাদের পান্ডা মার্টিন৷ মাটি ফুঁড়ে যেন অ্যালানের চারপাশে তারা সব উদয় হল৷ যারা তাকে উত্ত্যক্ত করবে বলে অ্যালান এখানে এসে লুকিয়ে ছিল৷ অ্যালানকে দেখে এক জান্তব আনন্দ যেন ফুটে উঠল তাদের চোখে-মুখে৷ প্রথমে তারা একযোগে তালি দিয়ে বলতে শুরু করল, ‘ব্যা, ব্যা, ব্ল্যাকশিপ, হ্যাভ ইউ এনি উল?’

‘ব্যা, ব্যা’ শব্দ দুটোর ওপর বেশ জোর দিয়েই পরিচিত ছড়ার এই লাইনটা বলতে শুরু করল তারা৷ এর পিছনে একটা কারণ আছে৷ মাঝে মাঝেই কথা আটকে যায় অ্যালানের৷ আর এই ত্রুটির কারণে একদিন ক্লাসে সে ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে কয়েকবার ‘ব্যা, ব্যা’ শব্দ করেছিল৷ আর তারপর থেকেই ছেলের দল এভাবেই তাকে উত্ত্যক্ত করে৷ কখনও ‘ব্যা’ ‘ব্যা’ করে ছাগলের ডাক ডেকে, বা এই ছড়া কেটে৷

গাছের গুঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে ভীত অ্যালান৷ সে কী করবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না৷ এতগুলো ছেলের ফাঁক গলে ছুটে পালানো অসম্ভব৷ আবার চিৎকার করলেও তার গলার শব্দ স্কুলের ভিতর পৌঁছোবে না৷ একসময় তালি থামাল ছেলেগুলো৷ তারাও এবার বুঝতে পারল, তাদের শিকার ফাঁদে পড়েছে৷ তাকে নিয়ে তারা এবার যা খুশি করতে পারে৷ কেউ বাধা দেবার নেই, কারও চোখে পড়ার ব্যাপার নেই৷ তাই দলনেতা মার্টিন দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘আজ দেখব এটা সত্যি ছেলে নাকি মেয়ে? এই কেউ হাত দিয়ে দেখ তো শার্টের ভিতর, ওর বুকটা মেয়েদের মতো নাকি? নইলে ও এমন মেয়েদের মতো চলে কেন?’

মার্টিনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই গুচ আর জন্টি, অ্যালানের কাছে এসে দাঁড়াল৷ আর অ্যালান কিছু বুঝে ওঠার আগেই জন্টি ঝুঁকে পড়ে অ্যালানের শার্টের ভিতর দিয়ে সোজা তার বুকের ভিতর হাত চালিয়ে খিমচোতে শুরু করল৷ লাগছে অ্যালানের৷ যন্ত্রণায়, আতঙ্কে কাঁপছে সে৷ মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না তার৷ এতদিন এই ছেলেগুলো যাই করুক, তার গায়ে হাত দেয়নি৷ আজ তাকে বাগে পেয়ে অসভ্যতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে—যাচ্ছে এরা!

অ্যালানের অবস্থা দেখে অশ্লীলভাবে হাসছে মার্টিন আর তার সঙ্গীরা৷ বেশ কিছুক্ষণ ধরে অ্যালানের বুক খামচাবার পর জন্টি তার সর্দারের উদ্দেশে বলল, ‘না, ওর বুকটা এখনও ছেলেদের মতোই আছে৷’

তা শুনে মার্টিন খিকখিক করে হেসে বলল, ‘হয়তো বুক পরে বড় হবে৷ অনেক মেয়েদের অমন দেরিতে বড় হয়৷ আসলে দেখতে হবে ওর ট্রাউজারের ভিতর আমাদের ছেলেদের মতো লম্বা জিনিসটা আছে কি না? খুলে ফেল ওটা৷’

কথাটা শোনামাত্রই উঠে দাঁড়াল অ্যালান, ছেলেগুলোকে বাধা দেবার একটা শেষ চেষ্টা করার জন্য৷ অন্য তিনজন ছেলেও এবার এগিয়ে এল অ্যালানের কাছে৷ অ্যালান এমনিতেই কোমল প্রকৃতির ছেলে৷ জীবনে মারপিট দাঙ্গাহাঙ্গামা সে কোনোদিন করেনি৷ কাজেই মৃদু একটু ধস্তাধস্তি হল মাত্র৷ তারপর অ্যালানকে চ্যাংদোলা করে ছেলের দল নিয়ে চলল গাছের ছায়া থেকে বেশ কয়েক হাত তফাতে, যাতে অ্যালানের ট্রাউজারের নীচে কী জিনিস আছে তা সূর্যালোকে ভালোভাবে দেখা যায় সেজন্য৷

উন্মুক্ত স্থানে ঘাসের ওপর চিত করে শোয়ানো হল অ্যালানকে৷ গুচ শক্ত করে চেপে আছে অ্যালানের হাত, আর জন্টি, পিটার এ দুজন চেপে ধরল তার পা দুটো৷ মার্টিন এসে দাঁড়াল তাদের সামনে৷ তারপর হ্যারিকে নির্দেশ দিল, অ্যালানের ট্রাউজার আর অন্তর্বাস কোমর থেকে নীচে নামিয়ে ফেলার জন্য৷ কাজটা করার জন্য হ্যারি অ্যালানের শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়তে গেল…

আর এরপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ হ্যারি, অ্যালানের শরীর স্পর্শ করার আগেই পিছনে একটা প্রচণ্ড লাথি খেয়ে অ্যালানের শরীরের ওপর দিয়ে যেন উড়ে গিয়ে পড়ল গাছের গুঁড়ির নীচে৷ আর এর পরক্ষণেই মার্টিনের মুখের ওপর পড়ল প্রচণ্ড একটা ঘুসি৷ মার্টিন গড়াগড়ি দিতে লাগল মাটিতে৷ আর শেষ লাথিটা পড়ল জন্টির ঘাড়ে৷ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল সে!

মুহূর্তের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটল৷ সেখানে আবির্ভাব হয়েছে অন্য একজনের৷ কাণ্ডটা ঘটিয়েছে সেই৷ আর প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে তাকে দেখামাত্রই ছেলেগুলো মাটি ছেড়ে উঠে পালাবার জন্য যে যেদিকে পারে ছুটতে শুরু করল৷ পালের গোদা মার্টিনও উঠে পড়ে পালাতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু সে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই আগন্তুক খপ করে ধরে ফেলল তার চুলের ঝুঁটি৷ তারপর মার্টিনের গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, ‘বল, আর কোনোদিন ওর পিছনে লাগবি?’

মার্টিনের সব তেজ তখন উধাও৷ চিঁ চিঁ করে সে বলে উঠল, ‘না, লাগব না৷’

মার্টিনের কথা শুনে আগন্তুক তার চুলের মুঠিটা জোরে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আরও জোরে বল! আর লাগবি ওর পিছনে?’

আতঙ্কে কঁকিয়ে উঠে মার্টিন জোরে বলে উঠল, ‘না, আর কোনোদিন লাগব না ওর পিছনে৷ কোনোদিন আর লাগব না৷ এবার আমাকে ছেড়ে দাও৷’

আগন্তুক শেষবারের মতো তার ঝুঁটিটা একবার নেড়ে দিয়ে এক ধাক্কাতে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবারের মতো ছেড়ে দিলাম৷ ফের যদি ওর পিছনে তোরা কেউ লাগিস, তবে ঘণ্টাঘরের দড়ি থেকে তাকে ঝুলিয়ে দেব৷ যা পালা!’

অ্যালানের রক্ষাকর্তা মার্টিনকে ছেড়ে দেওয়া মাত্র মার্টিন ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ছুটল সে জায়গা ছেড়ে পালাবার জন্য৷

নবাগত ছেলেটা এরপর এগিয়ে এল অ্যালানের দিকে৷ অ্যালান তখন হতভম্বের মতো উঠে বসেছে৷ যে ছেলেটা মার্টিনের দলবলকে বেদম মার মারল তার পরনেও স্কুলেরই ইউনিফর্ম৷ তবে সে অ্যালান আর মার্টিনদের দলবলের থেকে বয়সে একটু বড়ই হবে৷ আর তার চেহারাটাও বেশ শক্তপোক্ত পুরুষালি৷ অ্যালানের মতো নরম নয়৷ অ্যালানের উদ্দেশে সে তার শক্ত হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওঠো৷ ওই গাছের নীচে গিয়ে বসি৷ ভয় নেই, ওরা আর আসবে না৷ আর কোনোদিন তোমাকে কিছু বলা বা করার সাহস দেখাবে না৷’

নতুন ছেলেটার হাত ধরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়াল অ্যালান৷ তারপর গায়ের ধুলো ঝেড়ে তার সঙ্গে গিয়ে গাছের গুঁড়ির গায়ে হেলান দিয়ে বসল৷

প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার পর অ্যালান তাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কে? ভাগ্যিস তুমি এলে! নইলে যে কী বিপদে পড়েছিলাম!’

ছেলেটা বলল, আমার নাম, ক্রিস্টোফার মরকম৷ তোমার চেয়ে ওপরের ক্লাসে পড়ি৷ এখানে সিগার খেতে এসেছিলাম৷ তারপর তোমাদের ব্যাপারটা চোখে পড়ল৷’—এই বলে পকেট থেকে একটা আধপোড়া সিগার আর দেশলাইয়ের বাক্স বার করল মরকম৷

‘তুমি স্কুলে সিগার খাও!’ বিস্মিতভাবে বলে উঠল অ্যালান৷

মরকম হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, খাই৷ স্কুলে স্যারেরা জানতে পারলে তাড়িয়ে দেবে৷ তাই এখানে লুকিয়ে খেতে আসি৷ আমি রাত জেগে পড়াশোনা করি৷ একজন আমাকে বলেছিল যে সিগার টানলে ঘুম চলে যায়৷ সেটা করতে গিয়ে এখন নেশা ধরে গেছে৷’

অ্যালান এবার বলল, ‘আমার নাম অ্যালান টিউরিং৷ নয় মাস হল এই নতুন স্কুলে ভরতি হয়েছি৷’

সিগার জ্বালিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে মরকম বলল, ‘ও, তুমিই সেই টিউরিং৷ যে দৌড়ে স্কুলে এসেছিল! খবরের কাগজে পড়েছি৷’

অ্যালান মৃদু লজ্জিতভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই সেই৷’

মরকম জানতে চাইল, ‘কী পড়তে ভালো লাগে তোমার?’

অ্যালান জবাব দিল, ‘অঙ্ক৷ তোমার কী ভালো লাগে?’

মরকম বলল, ‘আমারও প্রিয় বিষয় অঙ্ক৷ তবে তার মধ্যে জ্যোতির্বিদ্যা, সংখ্যাতত্ত্ব, এসব বেশি প্রিয়৷ এ ব্যাপারে তোমার জানা আছে? আমি কিছু কিছু জানি৷’

অ্যালান বলল, ‘না, জানি না৷ তুমি জানালে তোমার কাছে শিখব৷’

মরকম বলল, ‘নিশ্চয়ই জানাব৷’

কথা চলতে লাগল৷ তারপর একসময় ঘণ্টা পড়ার সময় হল৷ ফেরার পথ ধরল তারা দুজন৷ অ্যালানের মনের কোণে তখনও কিছুটা ভয় লুকিয়ে আছে৷ সে বলল, ‘মার্টিনের দলবল সত্যি আর কিছু বলবে না তো?’

মরকম তার পিঠ চাপড়ে বলল, ‘না বলবে না৷ ওরা চেনে আমাকে৷ আমার পূর্বপুরুষরা একসময় জলদস্যু ছিলেন৷ এ কথাটা ইস্কুলের অনেকেই জানে৷ তা ছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি আমি মারপিটও করতে পারি, সেটাও ওরা জানে৷ পিটিয়েওছি অনেককে৷ দেখলে না, ওরা অতজন, তবু কেমন লড়লাম৷ তুমি নিশ্চিন্তে থাকো৷ কাল টিফিনের সময় আবার এখানে এসো৷ জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলব৷’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *