আঁধারে গোপন খেলা – ৫

অ্যালান নিজের ঘরে ফিরে এলেন৷ অনেক দিন পর মনটা আজ তাঁর ভালো লাগছে৷ ঘরে ঢুকে হ্যাটটা খুলে স্ট্যান্ডে রেখে ওভারকোট খুলতে খুলতে দাবার বোর্ডটার দিকে নজর গেল তাঁর৷ এ বাড়িতে আসার পর থেকে বোর্ডটা একইভাবে ওখানে রাখা আছে৷ আর তার পাশে চেরিকাঠের নকশা করা ঘুঁটির বাক্সটাও৷ ম্যারাথন দৌড়ের মতো ছেলেবেলা থেকে দাবা খেলারও তীব্র নেশা ছিল অ্যালানের৷ মা-ই তাকে এ বোর্ডটাতে হাতে ধরে দাবা খেলা শিখিয়েছিলেন, অ্যালানের যখন বছর দশেক বয়স তখন৷ তিনি বলতেন দাবা খেললে নাকি মনোসংযোগ, একাগ্রতা বাড়ে৷ মস্তিষ্কের ব্যায়াম হয়৷ অ্যালানও এ কথাটা বিশ্বাস করেন৷

পোশাক পরিবর্তন করে দাবার বোর্ড আর ঘুঁটির বাক্সটা এনে বিছানায় বসে বোর্ডের ওপর ঘুঁটি সাজাতে শুরু করলেন অ্যালান৷ তিনি একলা যতবারই এ বোর্ডটা নিয়ে বসেন, ততবারই প্রথমে মা সারার কথা মনে পড়ে অ্যালানের৷ সেই প্রথম দিন, যেদিন একটা সাদা লেসের গাউন পরে সারা তাঁর ছেলেকে দাবা খেলা শেখাতে বসেছিলেন৷ কিছুক্ষণ আগেই পেস্ট্রি বানাচ্ছিলেন মা৷ জামার হাতায় কীভাবে যেন চকোলেট লেগে গেছিল৷ চকোলেটের মৃদু মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছিল মা-র গা থেকে৷ আজও এই বোর্ডটা নিয়ে বসলে বহুদিন পরও যেন সেই চকোলেট ক্রিমের গন্ধ নাকে এসে লাগে অ্যালানের৷ এদিনও তার ব্যতিক্রম হল না৷

ঘুঁটি সাজাবার পর প্রথম চালটা দিয়ে টিউরিং-এর মনে পড়ে গেল আরও দুজনের কথা৷ কর্নেল হিড ওভলেন আর গোলেমবেক৷ দুজনেই একসময় অ্যালানের সহকারী ছিলেন৷ ওভলেন তখনই দাবাতে ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন, আর গোলেমবেক ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন পরবর্তীকালে৷ অ্যালানের গবেষণাকক্ষে সবসময় একটা দাবার বোর্ড রাখা থাকত৷ ব্লেচলি পার্কে এনিগমা কোড ভাঙার মতো দুরূহ গবেষণার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ বর্ষাকাল আর প্রবল শীতে তুষারপাতের দিনগুলোতে যখন মানসিক ক্লান্তি কাটাবার জন্য বাইরে বেরিয়ে দৌড়োনোর সুযোগ থাকত না, তখন মনকে চাঙ্গা করার জন্য সহকর্মীদের সঙ্গে দাবা খেলতেন অ্যালান৷ বিশেষত সহকারী গোলেমবেকের সঙ্গে৷ অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন দাবাড়ু ছিলেন এই গোলেমবেক৷ অ্যালান তাঁকে কোনোদিন হারাতে পারেননি৷ গোলেমবেক জানতেন যে যে-কোনো পরিস্থিতিতেই তাঁকে জিততে হবে এবং তিনি অ্যালানকে হারাবেনই৷ আর সেই আত্মবিশ্বাস থেকে এক অদ্ভুত কাজ করতেন তিনি৷ খেলতে খেলতে অ্যালান যখন প্রথমবার হারতে বসতেন, ঠিক সেই সময় দাবার বোর্ডটাকে ঘুঁটিসমেত ঘুরিয়ে দিতেন তিনি৷ অর্থাৎ অ্যালানের প্রতিকূল অবস্থাটা নিজের দিকে টেনে নিতেন, এবং সেই অবস্থাতেও শেষ পর্যন্ত গোলেমবেক-ই জিততেন৷

দাবার বোর্ডে গোলেমবেকের হস্ত সঞ্চালন দেখতে লাগত অনেকটা যন্ত্রের মতো৷ দাবার বোর্ডের সমান্তরালে প্রথমে নেমে আসত হাতটা৷ আঙুলগুলো কেমন যেন যান্ত্রিকভাবে খুলে আবার ঘুঁটি স্পর্শ করে স্থানান্তরিত করত তাকে৷ আর সেই হাতের দিকে তাকিয়ে গোলেমবেকের কাঠ কাঠ হস্ত সঞ্চালন দেখে তাকে যেন কেমন যন্ত্রমানব বলে মনে হত অ্যালানের৷ ‘কিন্তু যন্ত্র কি ভাবতে পারে? দাবার চাল দিতে পারে?’ হয়তো বা গোলেমবেকের ওই হাতটা দেখেই নিজের অবচেতনে প্রথম এ প্রশ্নের উদয় হয়েছিল অ্যালানের মনে৷ যা পরবর্তীকালে সচেতনভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিল অ্যালানের মনে৷ অ্যালান কাজ শুরু করেছিলেন ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ নিয়ে৷

ইতিপূর্বে অবশ্য এ নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি৷ অনেক বৈজ্ঞানিকই মনে করতেন ব্যাপারটা একেবারেই অসম্ভব৷ উলফগ্যাং ভন কেম্পেলেন ‘দ্য টার্ক’ নামের একটা যন্ত্র বানিয়ে দাবি করেছিলেন যে সেই যন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে দাবা খেলতে পারে৷ অর্থাৎ তাঁর যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে! জনসমক্ষে লোকজনকে মানুষের সঙ্গে যন্ত্রের খেলা দেখিয়ে চমকেও দিয়েছিলেন৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিজ্ঞানী বা গণিতবিদের মধ্যে পার্থক্য হল, কোনো ঘটনা বা আবিষ্কার তার বৈজ্ঞানিক বা গাণিতিক ব্যাখ্যা ছাড়া তাঁরা বিশ্বাস করেন না৷ উলফগ্যাং তাঁর যন্ত্রের কার্যকারিতা জনসমক্ষে প্রমাণ করলেও কিছুতেই তার ব্যাখ্যা দিতে চাননি৷ কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য সেই যান্ত্রিক দাবাড়ুর আসল রহস্য ফাঁস হয়ে গেছিল৷ প্রতারক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিলেন ভুঁইফোড় বিজ্ঞানী উলফগ্যাং৷ আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো ব্যাপারই ছিল না তাঁর যন্ত্রে৷ তাঁর যন্ত্রের ক্যাবিনেটের আড়ালে বসে থাকত বামনাকৃতির এক দাবাড়ু৷ আসলে দাবার চালটা সে-ই দিত৷ আর বাইরে থেকে দেখলে মনে হত যে যন্ত্র যেন তার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তায় চাল দিচ্ছে!

আর এ ঘটনার পর থেকেই যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা কৃত্রিম দাবাড়ুর প্রসঙ্গ উঠলেই সবাই উল্লেখ করত সেই টার্ক মেশিনের কথা৷ যা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করা একজন মানুষের মনোবল, মনোসংযোগ নষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট৷ অনেক বৈজ্ঞানিক, যন্ত্রবিদই হাসাহাসি করতেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে৷ কাজটা তাই সহজ ছিল না অ্যালানের পক্ষেও৷ সন্দেহ আর বিদ্রুপের বাতাবরণ ঘিরে ছিল চারপাশে৷

দাবায় একলা চাল দিতে দিতে অ্যালান ভাবতে লাগলেন ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অসম্ভব পরিশ্রম কিন্তু উদ্দীপনাভরা দিনগুলোর কথা৷ কঠিন এক চ্যালেঞ্জ তখন অ্যালানের সামনে৷ তাঁর বিশ্বাসকে প্রমাণ করতে হবে জনসমক্ষে৷ তারপর একদিন সত্যিই সে দিন এল, যেদিন অ্যালান পৃথিবীর কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন—‘‘আই প্রোপোজ টু কনসিডার দ্য কোশ্চেন, ‘ক্যান মেশিন থিংক’?’’

শুধু তাই নয়, এর কিছুদিনের মধ্যে তিনি আরও এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন মানুষের কাছে—কেবলমাত্র বৃদ্ধি নয়, এমন কোনো যন্ত্র কি সম্ভব, যা খেলায় ভালো ফল করতে পারে? অ্যালান প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ‘পারে৷’ সে পরীক্ষা পৃথিবীর কাছে বিখ্যাত হয়ে গেছে ‘টিউরিং পরীক্ষা’ নামে৷

‘হয়তো বা এ পরীক্ষার জন্যই ভবিষ্যতের মানুষ অন্তত মনে রাখবে আমার নামটুকু৷’—ভাবলেন অ্যালান৷ ‘ক্যান মেশিন থিংক?’, যন্ত্র কী ভাবতে পারে? বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে চাল দিতে থাকলেন অ্যালান৷ কিন্তু একসময় আবার তাঁর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হল৷ ভার হয়ে আসতে লাগল মাথা৷ চোখের সামনে থেকে যেন মুছে যেতে লাগল দাবার বোর্ড৷ উঃ, কী যন্ত্রণা! প্রচণ্ড যন্ত্রণা! মাথার ভিতর স্নায়ুতন্ত্রগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে! পুড়ে যাচ্ছে! বিছানাতে টলে পড়লেন অ্যালান৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *