আঁধারে গোপন খেলা – ৪

ঘুম ভাঙল অ্যালানের৷ গত রাতে ইনজেকশন নিয়ে শুয়ে পড়ার পরই একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলেন তিনি৷ তারপর নানা দৃশ্য দেখতে দেখতে, যার কোনোটা হয়তো সত্যি আবার কোনোটা হয়তো কল্পনা, সেই হ্যালুসিনেশনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন৷ ঘুম ভাঙতেই তিনি অনুভব করলেন মাথাটা প্রচণ্ড ধরে আছে৷ ঘুলঘুলি দিয়ে আলো প্রবেশ করছে ঘরে৷ অর্থাৎ সকাল হয়ে গেছে৷ তাই দেখে বিছানায় উঠে বসার সময় তিনি অনুভব করলেন যে তাঁর হাত-পায়ের গাঁটগুলোতেও ব্যথা শুরু হয়েছে ইনজেকশনের প্রভাবে৷ এ ব্যথা আগামী তিনদিন যে আরও বাড়বে তা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানেন অ্যালান৷ তবে ঘোরের মতো ভাবটা আপাতত নেই৷ গতরাতে নৈশভোজ না করার জন্য একটু খিদেও যেন পাচ্ছে৷ বিছানা ছেড়ে নামলেন অ্যালান, আর নামার সময় হাঁটুর গাঁটে যন্ত্রণার জন্য মৃদু যন্ত্রণাসূচক শব্দ করে উঠলেন৷ এগিয়ে গিয়ে জানলার পাল্লা দুটো খুলে পর্দা সরাতেই একরাশ আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে৷ সকাল সাতটা বাজে৷ নির্মল প্রভাতী আলো ছড়িয়ে পড়েছে ছোট্ট জনপদ উইমস্লোর বুকে৷ পাখির ডাক ভেসে আসছে৷ অ্যালানের বর্তমান আবাসস্থল অনুচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা৷ তার ওপাশের রাস্তায় লোকচলাচল শুরু হয়ে গেছে৷ ঘোড়ার গাড়িতে ফুলের ঝুড়ি সাজিয়ে শহরের বাজারের দিকে চলেছে মাথায় হ্যাট আর লম্বা গাউন পরা চাষি রমণীরা৷ তাদের উচ্ছল কলহাস্য যেন অস্পষ্টভাবে অ্যালানের কানে এসে পৌঁছোচ্ছে৷ একদল সাইক্লিস্ট টিং টিং ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে চলে গেল অ্যালানের বাড়ির সামনে দিয়ে৷ এ তল্লাটের বাড়িগুলো ছোটোখাটো ছিমছাম হলেও বেশ সাজানো-গোছানো৷ ইটের তৈরি একতলা বা দোতলা বাড়ির প্রত্যেকটারই মাথায় পাথরের টালি বসানো ঢালু ছাদ৷ আর তার মাথার ওপর চিমনি বসানো৷ কোনো কোনো চিমনি থেকে সরু ফিতের মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেরিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে নীল আকাশের বুকে৷ অ্যালানের জানলার গরাদের একদম সামনে দিয়েই একটা ছোটো নীল রঙের পাখি সকালের ঝলমলে রোদে উড়ে গিয়ে বসল প্রাচীরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ওক গাছটার ডালে৷ পাখিটা জানলার এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল যে তার ডানার ঝাপটার মৃদু বাতাসও মনে হয় যেন মুখমণ্ডলে অনুভব করলেন জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যালান৷ পাখিটাকেও চিনতে পারলেন তিনি—রবিন৷

ভোরের আলো আর বাতাসের অদ্ভুত একটা গুণ থাকে৷ দুঃখ-অবসাদ-আশঙ্কাকে অনেকটাই যেন মুছে দিতে পারে সে৷ অ্যালানের ক্ষেত্রেও তেমনটাই যেন হল৷ বাইরের ঝলমলে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তাঁর অবসাদ ভাবটা যেন অনেকটাই কেটে গিয়ে একটু তরতাজা ভাব ফিরে এল৷ বেশ কিছুদিন হল এ বাড়ির বাইরে বেরোননি অ্যালান৷ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বাইরে থেকে কিছুটা ঘুরে আসবেন৷ শহরে যাবার অনুমতি না থাকলেও এই পল্লিগ্রামে হাঁটা-চলার অনুমতি আছে তাঁর৷ যদিও তাঁর সেই ঘুরে বেড়ানো সরকারি নজরদারিতেই হয়৷ সবেমাত্র একচল্লিশ বছর বয়স তাঁর৷ কিন্তু এই বয়সেই তিনি শারীরিক আর মানসিক চরম ভাবে জর্জরিত, বিধ্বস্ত গত ছ-মাসের পরিস্থিতির কারণে৷ হেঁটে এলে যদি একটু মানসিক অস্থিরতা দূর হয়, সেটাই বা কম কী?’ জানলা থেকে সরে এসে দরজা খুলে ঘন্টি বাজিয়ে পরিচারককে ডেকে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করতে বলে ওয়াশরুমে চলে গেলেন তিনি৷

আধঘণ্টার মধ্যেই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন অ্যালান৷ বাড়ির বাইরে রাস্তায় নেমে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা কাউকে দেখলেন না তিনি৷ কিন্তু তিনি নিশ্চিত যে, কিছুটা এগিয়ে পিছনে তাকালেই কাউকে দেখতে পাবেন তিনি৷ এক-একদিন এক-একজন লোক৷ একদিন অ্যালান থমকে দাঁড়িয়ে তেমনই একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, লোকটা কেন তাঁকে অনুসরণ করছে? প্রশ্ন শুনে লোকটা আমতা আমতা করে জবাব দিয়েছিল, সে নাকি পুলিশ বিভাগের কর্মী৷ অ্যালানের নিরাপত্তার জন্য সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হয়েছে৷ তবে অ্যালানের ধারণা এ লোকগুলো সাধারণ নিরাপত্তাকর্মী নয়৷ আসলে এরা গুপ্তচর৷ এদের মাধ্যমেই তাঁর গতিবিধির সংবাদ পৌঁছে যায় ব্রিটিশ ইন্টেলেজেন্সির বড় কর্তাদের কাছে, হয়তো বা তার ওপরের স্তরেও৷ তবে অ্যালানের পিছনের রাস্তায় অনেক লোক চললেও সেই জনতার ভিড়ের মধ্যে থেকেও এ লোকগুলোকে চিনতে অসুবিধা হয় না অ্যালানের৷ গণিতজ্ঞের চোখ ঠিক বুঝতে পারে লোকগুলো ঠিক পঞ্চাশ গজ তফাত থেকে অনুসরণ করে তাঁকে৷ কখনও দশ গজ তফাতের ফারাক হয় না৷

বাড়ির বাইরে বেরিয়ে রাস্তা ধরে ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন অ্যালান৷ একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালেন না ইচ্ছা করেই৷ যে লোকটা তাঁকে অনুসরণ করছে তাকে দেখতে পেলে হয়তো আবার মনটা তাঁর খারাপ হয়ে যাবে৷ নানা শঙ্কা, প্রশ্ন ঘিরে ধরবে তাঁকে৷ এই সুন্দর সকালটা কোনোভাবেই নষ্ট হোক তা চান না অ্যালান৷ খুব বেশি লোকচলাচল নেই রাস্তাতে৷ গাড়ি বলতে মাঝে মাঝে দু-একটা ঘোড়ার গাড়ি৷ চিৎকার-চেঁচামেচির তো কোনো প্রশ্নই নেই৷ রাস্তার দুপাশের অনুচ্চ ঢালে ফুটে আছে নানা রঙের ড্যাফোডিল আর লিলি৷ দুপাশ থেকে নানা রঙের গালিচা যেন এসে থেমেছে রাস্তার কিনারে৷ রঙিন চড়াই পাখির ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে সেই গালিচাগুলোর ওপরে৷ এসব দেখতে দেখতে একটার পর একটা বাঁক অতিক্রম করে কাছের পল্লিগ্রামের দিকে অ্যালান যত এগোতে লাগলেন, তাঁর মনের বিষণ্ণতা তত কেটে যেতে লাগল৷ গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎই রাস্তার পাশে দিকনির্দেশকারী একটা দণ্ডের মাথায় সাদা রঙের একটা কাঠের তিরচিহ্ন পোঁতা আছে দেখতে পেলেন তিনি৷ আর এরপরই একটা মৃদু কোলাহল কানে এল তাঁর৷ অ্যালান পৌঁছে গেলেন একটা ছোটো মাঠের পাশে৷ কাছেই এক জায়গাতে একটা ছোট শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে৷ কিছু স্থানীয় লোকজন রয়েছে সেখানে৷ সাধারণ চাষি বা শ্রমিক শ্রেণির মানুষ৷ আর রয়েছে কুড়ি-পঁচিশজন দশ-বারো বছর বয়সি ছেলে৷ তাদের বুকে আঁটা কাগজে নম্বর লেখা দেখে অ্যালান বুঝতে পারলেন, একটা দৌড় প্রতিযোগিতা হতে চলেছে এখানে৷ সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন অ্যালান৷ অঙ্কের মতো দৌড়ও যে তাঁর রক্তে মিশে আছে৷ বিশেষত ম্যারাথন বা লম্বা দূরত্বের দৌড়৷ ওয়ান্টান অ্যাথলিট ক্লাবের সদস্য ছিলেন অ্যালান৷ সে ক্লাবের হয়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমে বেশ কয়েকটা রেকর্ড সৃষ্টি করে পদকও জিতেছিলেন তিনি৷ শুধু পদক জেতার জন্যই নয়, অবসাদ কাটাবার জন্য মাইলের পর মাইল দৌড়োতেন অ্যালান, বিশেষত তাঁর গবেষণাসংক্রান্ত কাজের প্রচণ্ড মানসিক চাপের দিনগুলোতে৷ মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে দৌড় প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি দেখতে লাগলেন তিনি৷ হ্যাঁ, এখানে ম্যারাথন দৌড়েরই প্রস্তুতি চলছে৷ ছোট ছোট ছেলেগুলোকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা প্রত্যেকেই প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর৷ আনন্দমিশ্রিত উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে তাঁদের মুখে৷ সেই মুখগুলো দেখতে দেখতে নিজের বাল্যকালে ফিরে গেলেন অ্যালান৷ জীবনে প্রথম যেদিন তিনি এক লম্বা দৌড়ে সফল হয়েছিলেন, সে দিনটাতে৷ অ্যালানের নিজেরই আজ যেন রূপকথা বলে মনে হয় সে দিনটা৷ না, সেটা কোনো দৌড় প্রতিযোগিতা ছিল না, ছিল ডরমেট শেরবর্ন স্কুলে যাবার প্রথম দিন—

অ্যালানের তখন চোদ্দো বছর বয়স৷ মা সারা আগের দিনই তার নাম লিখিয়ে এসেছেন শেরবর্ন স্কুলে৷ স্কুলের অধ্যক্ষ মাকে বলে দিয়েছেন যে পরদিন থেকেই যেন তাঁর ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হয়৷ কারণ, ইতিমধ্যেই ক্লাসের পঠনপাঠন শুরু হয়ে গেছে৷ মায়ের কাছে খবরটা শুনে অ্যালানও বেশ উৎফুল্ল নতুন স্কুলে যাবে বলে৷ তবে অ্যালানদের বাড়ি থেকে তার নতুন স্কুল অনেকটা দূরে৷ চল্লিশ মাইল অর্থাৎ ষাট কিলোমিটার দূরত্ব৷ পরদিন অ্যালান যখন নতুন স্কুল ইউনিফর্ম গায়ে ব্যাগ নিয়ে স্কুল যাবার জন্য উৎসাহভরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামল, তখন সকাল সাতটা বাজে৷ কিন্তু বড় রাস্তায় পৌঁছে অ্যালান জানতে পারল কোনো বাস-ট্রেন এদিন চলবে না৷ ইংল্যান্ডে শিল্প ধর্মঘট শুরু হয়েছে৷ কিন্তু অ্যালানকে যে আজ স্কুলে যেতেই হবে৷ প্রথম দিন বলে কথা৷ অ্যালান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, যেভাবেই হোক সে যাবে৷ স্থানীয় এক দোকানির থেকে একটা সাইকেল নিয়ে সে প্রথমে রওনা হল ডরমেটের দিকে৷ কিন্তু মাইল দশেক এগোবার পরই পুরোনো সাইকেলের রিং গেল তুবড়ে৷ অগত্যা সাইকেলটা রাখার জন্য সে প্রবেশ করল রাস্তার পাশে এক সরাইখানাতে৷ সেখানে প্রাতরাশ করতে ঢুকেছিলেন এক সাংবাদিক৷ অ্যালানের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ও তার কথা শোনার পর তিনি অ্যালানকে বললেন, ‘এবার তুমি কী করবে? শেরবর্ন স্কুল আরও তিরিশ মাইল পথ! আমার সঙ্গে বাইক আছে৷ তোমার বাড়ির দিকেই যাব আমি৷ ইচ্ছে করলে তুমি মোটরবাইকে চেপে আজকের মতো বাড়ি ফিরে যেতে পারো৷’

কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে সদ্য কিশোর অ্যালান টিউরিং বলল, ‘এতটা পথ যখন এসেছি, তখন আর বাড়ি ফিরব না৷ ছুটতে আমার ভালো লাগে৷ দেখি দৌড়ে স্কুলে পৌঁছোতে পারি কি না!’

সত্যি সত্যি এরপর পায়ের জুতো খুলে ব্যাগে ভরে নিয়ে সেই সরাইখানা ছেড়ে খালি পায়ে তিরিশ মাইল দূরের শেরবর্ন স্কুলের উদ্দেশে ছোটা শুরু করল কিশোর অ্যালান! দুপাশে কত অজানা গ্রাম, ফাঁকা মাঠ, সোনালি গমের খেত, তার মধ্যে দিয়ে ছুটতে লাগল সে৷ স্কুলে পৌঁছোতেই হবে তাকে৷ মাথার ওপর সূর্যও তার সঙ্গে সঙ্গে এগোতে লাগল৷ ছোটার বিরাম নেই৷ অবশেষে দ্বিপ্রহরের কিছু পরে টানা পাঁচ ঘণ্টা দৌড়ে অ্যালান অবশেষে হাঁফাতে হাঁফাতে পৌঁছে গেল শেরবর্ন স্কুলের গেটে৷ স্কুলে তখন টিফিন টাইম চলছে৷ অধ্যক্ষের ঘরে ঢুকে অ্যালান তাঁকে সে কীভাবে স্কুলে পৌঁছেছে তা ব্যক্ত করতেই অধ্যক্ষ তাকে তিরস্কার করে বললেন, ‘তুমি মেধাবী হতে পারো, কিন্তু মিথ্যা কথাকে আমি প্রশ্রয় দিই না৷ পরদিন থেকে নির্দিষ্ট সময় স্কুলে না এলে ক্লাসে বসতে পারবে না৷ যাও এবার ক্লাসে গিয়ে বোসো৷’

অধ্যক্ষ অ্যালানের কথা বিশ্বাস করতে চাননি৷ করার কথাও নয়৷ তিরিশ মাইল দৌড়ে এসেছে এই বাচ্চা ছেলেটা! এও কি সম্ভব! কিন্তু পরদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত অ্যালানের খবরটা দেখে অধ্যক্ষের ভুল ভেঙে গেল৷ যে সাংবাদিকের সঙ্গে সরাইখানাতে অ্যালানের দেখা হয়েছিল, সেই সাংবাদিক কৌতূহলবশত ঘটনাটা কী ঘটে তা দেখার জন্য অ্যালানের পিছু পিছু মোটরবাইকে শেরবর্ন স্কুলে পৌঁছে গেছিলেন৷ অ্যালান নিজেও জানতে পারেনি ব্যাপারটা৷ আর সেই সাংবাদিকই সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন অ্যালানের অবিশ্বাস্য দৌড়ের কথা৷

মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে কৈশোরের সেই দৌড়টাই অ্যালানের চোখে ভেসে উঠল৷ ছুটে চলেছে অ্যালান৷ ছোটার যেন শেষ নেই৷ পথের দুপাশে কত অচেনা পল্লি, ফলের বাগান, গমের খেত, কত ধরনের নারী-পুরুষ! কখনও ইট বিছানো রাস্তা, কখনও মেঠো পথ, খালের ওপর কাঠের সাঁকো পেরিয়ে শেরবর্ন স্কুলের উদ্দেশে ছুটে চলেছে সে…৷

‘মার্জনা করবেন, আপনি কি এখানেই থাকেন?’—কণ্ঠস্বর শুনে চিন্তাজাল ছিন্ন হল অ্যালানের৷ বহু যুগ আগের থেকে আবার তিনি ফিরে এলেন বাস্তবের মাটিতে৷ একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে তাঁর সামনে৷ তার পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে স্থানীয় ফুলচাষি বলেই মনে হয় তাকে৷ এ তল্লাটে অ্যালানকে কেউ চেনে না৷ আর অ্যালানও চেনেন না কাউকে৷ প্রশ্নকর্তার কথা শুনে অ্যালান মৃদু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, মাইলখানেক তফাতে একটা বাড়িতে থাকি৷ কিছুদিন হল এখানে এসেছি৷’

জবাব শুনে লোকটা তার মাথার টুপি খুলে বিনীতভাবে জানতে চাইল, ‘আপত্তি না থাকলে দয়া করে আপনার নাম-পরিচয়টা একটু বলবেন?’

‘গণিতবিদ’ বা ‘ক্রিপ্টোবিশেষজ্ঞ’ বা ‘যুক্তিবিদ’—এ ধরনের কথার মানে হয়তো বুঝতে পারবে না লোকটা৷ অ্যালান তাই নিজের পরিচয়টাকে সহজ করার জন্য বললেন, ‘আমার নাম, অ্যালান টিউরিং৷ আমাকে একজন ইঞ্জিনিয়ার বলতে পারেন৷ যন্ত্রপাতি নিয়ে পড়াশোনা করি৷ একসময় ম্যারাথন দৌড়েও নামতাম৷ কিন্তু কেন বলুন তো?’

যে লোকটা কথা বলতে এসেছিল, সে অ্যালানের পরনে দামি পোশাক আর তাঁর চেহারা দেখে তাঁকে শিক্ষিত শহুরে মানুষ ভেবেই কথা বলতে এসেছিল৷ তার ওপর যখন সে শুনল যে অ্যালান একজন দৌড়বিদও, তখন সে উৎফুল্লভাবে বলল, ‘আমরা স্থানীয় ফুলচাষিরা বাচ্চা ছেলেদের দশ মাইল দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি৷ আমরা সাধারণ মানুষ৷ আপনার মতো বিশিষ্টজন যদি পতাকা নেড়ে দৌড় প্রতিযোগিতার সূচনা করেন তবে আমরা কৃতজ্ঞ থাকি৷’

হঠাৎ এই প্রস্তাবটা পেয়ে যেমন অ্যালান একটু অবাক হলেন, তেমনই তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বেশ খুশিও হলেন তিনি৷ তার মানে জীবনের টুকরো টুকরো আনন্দগুলো এখনও শেষ হয়ে যায়নি অ্যালানের জীবন থেকে৷ নইলে এই অপরিচিত লোকটাই বা হঠাৎ এসে তাঁকে ধরবে কেন ম্যারাথন রেসের পতাকা নাড়ার জন্য! অ্যালান একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘ঠিক আছে, চলুন!’

অ্যালানকে প্রথমে শামিয়ানাতে নিয়ে গেল লোকটা৷ হেপবার্ন নাম লোকটার৷ প্রতিযোগিতার আয়োজকদের কয়েকজনের সঙ্গে হেপবার্ন পরিচয়ও করিয়ে দিল অ্যালানের৷ তারা খুশি হল অ্যালানকে তাদের মধ্যে পেয়ে৷ এ লোকগুলো তেমন পড়াশোনা জানে না৷ শিক্ষিত অ্যালানকে তারা ফুলের স্তবক দিয়ে বরণ করল৷ কিছুক্ষণের মধ্যে ছোট ছোট ছেলের দল দৌড় শুরু করার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল মাঠের মাঝখানে চুনের দাগ দেওয়া জায়গাতে৷ তাদের দেখে অ্যালানের মনে হচ্ছিল, তিনিও গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন তাদের সঙ্গে দৌড়োবার জন্য! কিন্তু তা তো আর হবার নয়৷

ফ্ল্যাগ তুলে দেওয়া হল অ্যালানের হাতে৷ অ্যালান ফ্ল্যাগ নাড়াতেই ছুটতে শুরু করল ছেলের দল৷ অ্যালানের মনে হল তিনিই যেন ছুটতে শুরু করেছেন তাদের সঙ্গে৷ যতক্ষণ না ছেলের দল ছুটতে ছুটতে দূরে পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল, ততক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তালি দিতে থাকলেন অ্যালান৷

আয়োজকদের ইচ্ছা ছিল ম্যারাথন শেষ হলে ছেলেরা যখন আবার মাঠে ফিরে আসবে, তখন অ্যালানই তাদের হাতে পুরস্কারের ট্রফি তুলে দেন৷ সেইমতো অ্যালানকে প্রস্তাবও দিল তারা৷ কিন্তু তার জন্য অন্তত ঘণ্টা দুই অ্যালানকে থাকতে হবে এখানে৷ অ্যালানের শরীর ভালো নয়৷ হঠাৎ করে মাথার বা গাঁটের যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করলে শেষে বিপত্তি হবে৷ কাজেই সব দিক চিন্তা করে পূর্বনির্ধারিত জরুরি কাজ আছে বলে আর সেখানে থাকতে পারবেন না জানিয়ে আয়োজকদের থেকে প্রথমে মার্জনা চেয়ে নিলেন অ্যালান৷ তারপর পকেট হাতড়ে দুটো দশ পাউন্ডের নোট বার করে তাদের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘এ টাকাটা সব প্রতিযোগীদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন৷ বাচ্চা ছেলেদের জন্য এক ম্যারাথন রানারের সামান্য উপহার৷’—এ কথাগুলো বলে বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন তিনি৷

সামান্য একটা ঘটনা৷ কিন্তু এ ঘটনাটাই অ্যালানের অবসাদ অনেকটাই যেন কাটিয়ে দিল৷ বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ভাবতে লাগলেন, ‘সব অবসাদ, সব গ্লানি মুছে ফেলে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে হবে আমাকে৷ জীবনের ম্যারাথনে জিততেই হবে আমাকে৷ নতুন করে আবার কাজ শুরু করতে হবে৷’

কোয়ান্টাম ফিজিক্স নিয়ে যে গবেষণার কাজ তিনি শুরু করেছিলেন, তা অর্ধসমাপ্ত থেকে গেছে৷ সে কাজ পুনরায় চালু করার আবেদন জানিয়ে সরকারের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছেন অ্যালান৷ হয়তো বা আর ক’দিনের মধ্যে চিঠির জবাব এসে যাবে৷ সরকার আবার অনুমতি দেবেন সেই কাজের৷ অ্যালান যে এ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষক, চিন্তাবিদ, তা ব্রিটিশ সরকারও অস্বীকার করতে পারেন না৷ তাই হয়তো তাঁরা অনুমতি দেবেন৷ কোয়ান্টাম ফিজিক্স সংক্রান্ত সেই গবেষণার কথা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললেন ঘরমুখো অ্যালান৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *