১
বাড়িটাতে আজ বিশেষ উত্তেজনার ভাব৷ কিছু পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছে বাড়িটার বাইরে, অবাঞ্ছিত মানুষ ও সাংবাদিকদের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ রোধ করার জন্য৷ আসলে কদিন ধরে লন্ডন শহরের এই বাড়ির ভিতরে এক বিশেষ আদালত বসছে৷ মানুষের দৃষ্টি যাতে এ বিচারপ্রক্রিয়ার ওপর না পড়ে, তাই আদালত ভবনে এই বিচারপ্রক্রিয়া না করে ব্রিটিশ সরকার এই নির্দিষ্ট বিচারটাকে সরিয়ে এনেছিলেন লন্ডন শহরের এক প্রান্তের এই বাড়িতে৷ সরকারের এই গোপনীয়তার চেষ্টার কারণ, যে বিষয় নিয়ে বিচার চলছে এবং এই মামলাতে যিনি অভিযুক্ত—দুই-ই সরকারের কাছে বিশেষ স্পর্শকাতর বিষয়৷ এক সপ্তাহ ধরে বিচারপ্রক্রিয়া চলেছে৷ আজ মামলার রায়দান করবেন বিচারক৷ তবে সরকারি পক্ষের গোপনীয়তা রক্ষার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে৷ সাংবাদিকরা কোথা থেকে সবকিছুর খবর পায় কে জানে! তারা শেষ পর্যন্ত জেনে গেছে ব্যাপারটা৷ সকাল থেকেই তারা ভিড় জমিয়েছে বাড়িটার প্রবেশ তোরণের সামনে৷ আর তাদের সঙ্গে স্থানীয় উৎসাহী কিছু জনতাও৷
সরকারি আধিকারিক আর এই বিচার-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই কম্পাউন্ডের ভিতর৷ মাঝে মাঝে সরকারি গাড়িগুলো এসে থামছে কম্পাউন্ডের প্রধান ফটকের সামনে৷ যেখানে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা গাড়ির ভিতর উঁকি দিয়ে আগে নিশ্চিত হচ্ছেন ভিতরে বসে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের পরিচয় সম্পর্কে৷ তারপর খুলে দেওয়া হচ্ছে লোহার ফটক৷ গাড়ি কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে সোজা চলে যাচ্ছে পোর্টিকোর নীচে৷ গাড়ির আরোহীরা সেখানে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে প্রবেশ করছেন৷ বেলা দশটা বাজতে আর আধঘণ্টা বাকি৷ ঠিক দশটাতে আদালত বসবে৷ বিচারকের গাড়িটা যে ইতিমধ্যে বাড়িতে প্রবেশ করেছে, তা একটা গাড়িকে ঘিরে পুলিশকর্মীদের ঘটা দেখে বুঝতে পেরেছে সাংবাদিকরা৷ কিন্তু ‘তিনি’, অর্থাৎ এই মামলায় যিনি অভিযুক্ত তিনি কি এসে গেছেন, নাকি আসবেন?—এ নিয়ে জল্পনা চলছে সাংবাদিকদের মধ্যে৷ আসলে যিনি অভিযুক্ত তিনি সরকারের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও তাঁর মুখ সাংবাদিকদের কাছে বিশেষ পরিচিত নয়৷ একজন গণিতবিদের মুখ আর কজনের কাছে পরিচিত হতে পারে?
বেলা ঠিক পৌনে দশটা৷ কাচ তোলা কালো রঙের একটা ব্রুহাম গাড়ি এসে দাঁড়াল ফটকের সামনে৷ কিছুটা তফাত থেকে সাংবাদিকদের মনে হল চালক ও একজন ব্যক্তিই বসে আছে গাড়ির ভিতর৷ আর এ গাড়ির ভিতর বসে থাকা ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েই পুলিশকর্মীদের মধ্যে বিশেষ চঞ্চলতা দেখা দিল৷ আর সেটা খেয়াল করে কে যেন একজন বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, উনি হতে পারেন৷’
সাংবাদিকরা সেটাই অনুমান করে গাড়িটার দিকে এগোতে যাচ্ছিল, কিন্তু তারা গাড়ির কাছে পৌঁছোবার আগেই পুলিশকর্মীরা অতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গেট খুলে গাড়িটাকে ঘিরে ধরে কম্পাউন্ডের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিল৷ সাংবাদিকরা এ ব্যাপারটা দেখে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল, ‘হ্যাঁ, তিনিই এলেন৷’
উপস্থিত সাংবাদিক আর জনতার মুখের ওপর এরপর লোহার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল৷
পুলিশকর্মীদের ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়ে গাড়িটা গিয়ে থামল পোর্টিকোর ঠিক নীচে৷ দরজা খুলে চালকের পিছনের আসন থেকে নামলেন অভিযুক্ত৷ মাঝারি আকৃতির গড়ন৷ নিখুঁতভাবে কামানো মুখে কেমন যেন একটা মায়াবী ভাব আছে৷ একই সঙ্গে তাঁর চোখ দুটোতে কেমন যেন বিষণ্ণতা৷ সদ্য চল্লিশ অতিক্রম করেছেন, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হয় তাঁর বয়স আরও কম—আটাশ-তিরিশ হবে৷ হ্যাঁ, ইনিই অ্যালান টিউরিং৷ গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ অ্যালান৷ এই বয়সেই যাঁর নাম জানেন আইনস্টাইনের মতো পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী, যাঁকে চেনেন এ দেশের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, এমনকি বিশ্বত্রাস হিটলারও নাকি এই ব্রিটিশ যুবকের নাম জেনেছিলেন৷ হ্যাঁ, এই অ্যালানই এই মামলার একমাত্র আসামি৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর৷ এবং তা প্রমাণিতও হয়ে গেছে৷ এখন তাঁকে বিচারক কী শাস্তিদান করেন সেটাই দেখার৷ অন্য কারও বিরুদ্ধে এ অভিযোগ থাকলে পুলিশ হয়তো তখনই তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরত৷ তবে লোকটার নাম অ্যালান টিউরিং বলেই পুলিশ বা প্রশাসন কাজটা করেনি৷ শুধু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নথিভুক্ত হবার পর সরকারি গবেষণাগার এবং অ্যালানের বর্তমান কর্মস্থল ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যালানের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ আর অ্যালানের সরকারি পরিচিতিপত্র আর পাসপোর্ট নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে তারা৷ আসলে ব্রিটিশ সরকার চেয়েছেন যে আদালতে অ্যালানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবার পরই তাঁরা আদালতের নির্দেশমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন৷ যাতে লন্ডনের অভিজাত মহল এবং পণ্ডিত মহলের কাছে এমন কোনো বার্তা না যায় যে, অ্যালান কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার৷
গাড়ি থেকে নেমে অ্যালান প্রবেশ করলেন বাড়ির ভিতর৷ কয়েকজন পুলিশকর্মী তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল বিচারকক্ষে৷ মাঝারি আকৃতির একটা হলঘর৷ সেটাকেই বিচারকক্ষের রূপ দান করা হয়েছে৷ ঘরটার একপাশে বেদির মতো একটা উঁচু জায়গাতে বিচারকের বসার আসন, টেবিল৷ তার গায়ে একটা পতাকা-দণ্ডে ইউনিয়ন জ্যাক৷ বিচারকের আসনের মাথার ওপর ফ্রেমে বাঁধানো রাজা ষষ্ঠ জর্জের ছবি৷ বিচারকের বেদির কিছুটা নীচে একপাশে জুরি আর অন্যপাশে আদালতকর্মীদের বসার টেবিল আর কাঠগড়া বা উইটনেস বক্স৷ আর তারপর বেদির সামনে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দেওয়ালের শেষ মাথা পর্যন্ত সার সার বসার আসন৷ কোনো আদালত কক্ষ ঠিক যেমন হয় ঠিক তেমনই রূপদান করা হয়েছে এ কক্ষকে৷
দর্শক আসনগুলো পরিপূর্ণ৷ তবে যাঁরা এ কক্ষে উপস্থিত আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই সরকারের প্রশাসনিক বিভাগ—পুলিশ বিভাগ বা সামরিক বিভাগের লোকজন বা মামলার সাক্ষী৷ আর অ্যাডভোকেট বা কৌঁসুলিরা তো আছেনই৷
চাপা স্বরে নানা আলোচনা চলছিল লোকগুলোর মধ্যে৷ একটা মৃদু গুনগুন শব্দ৷ ভারী দরজা ঠেলে এক পুলিশ অফিসার অ্যালানকে নিয়ে প্রবেশ করতেই সে শব্দ থেমে গেল৷ সবাই তাকাল অ্যালানের দিকে৷ অ্যালান কারও দিকে তাকালেন না৷ অফিসার তাঁকে নিয়ে গিয়ে বসালেন কাঠগড়ার কাছাকাছি অ্যালানের জন্য নির্দিষ্ট বসার জায়গাতে৷ গত কয়েক দিন মামলা চলার সময় এই আসনেই বসেছেন অ্যালান৷ তিনি চেয়ারে বসতেই উকিলদের জন্য নির্দিষ্ট বেঞ্চ ছেড়ে একজন উকিল এসে দাঁড়ালেন অ্যালানের সামনে৷ অ্যালান নিজে কোনো উকিল নিয়োগ করেননি৷ ইচ্ছা হলে অ্যালান হয়তো লন্ডন শহরের সেরা কৌঁসুলিদের নিয়োগ করতে পারতেন তাঁর হয়ে ওকালতি করার জন্য৷ কিন্তু তাঁর ওপর অভিযোগটা ওঠামাত্রই অ্যালান এত ব্যথিত ও হতাশ হয়ে পড়েছেন যে তিনি ও পথে হাঁটেননি৷ মানুষ অন্যের সফলতাতে এত ঈর্ষান্বিত হতে পারে, পরশ্রীকাতর হতে পারে, সর্বোপরি এত হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, তা এ ঘটনা না ঘটলে কোনোদিন জানতে পারতেন না অ্যালান৷ হ্যাঁ, তাঁর সহকর্মীরাই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন সরকারের কাছে, এ মামলা চলাকালীন তাঁরা সাক্ষ্যও দিয়েছেন অ্যালানের বিরুদ্ধে৷ পরিচিত সব মুখ৷ আর সহকর্মীদের এ ব্যাপারটাই অ্যালানকে এত হতাশ করেছে, ব্যথিত করেছে যে অ্যালান মামলার ব্যাপারটাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন৷ যেন, যা হবার তা হোক৷ এ কারণেই আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো উকিল নিয়োগ করেননি তিনি৷ তবে সভ্য বিচার-ব্যবস্থার পীঠস্থান বলা যায় ইংল্যান্ডকেই৷ যে কারণে পৃথিবীর বহুদেশ ব্রিটিশ বিচার-ব্যবস্থাকেই অনুসরণ করে থাকে৷ এই বিচারব্যবস্থাতে অভিযুক্তকেও আইনি সুযোগ গ্রহণ বা সুরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়৷ যে কারণে অভিযুক্ত তার পক্ষে কোনো আইনজীবীকে নিয়োগ করতে না পারলে বা না করলেও সরকারি তরফে একজন সরকারি আইনজীবীকে নিয়োগ করা হয় অভিযুক্তের পক্ষ অবলম্বন করার জন্য৷ অ্যালান অবশ্য এ ব্যাপারে তাঁর আপত্তি জানাননি এই কারণে যে, সরকার তাঁর জন্য যে আইনজীবী নিয়োগ করেছেন, তিনি বয়সে নিতান্তই তরুণ৷ তাঁর অভিজ্ঞতা ও অর্থ উভয়েরই প্রয়োজন৷ অ্যালান তাঁর নিয়োগ সম্বন্ধে আপত্তি জানালে তিনি এ দুইয়ের থেকেই বঞ্চিত হতেন৷ এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও অ্যালান মাথায় রেখেছিলেন কথাটা৷
যে আইনজীবী অ্যালানের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তিনি অ্যালানের পক্ষ নেওয়া সেই সরকারি আইনজীবী৷ অ্যালানের সামনে একটু ঝুঁকে সেই আইনজীবী তাঁকে সুপ্রভাত জানিয়ে চাপাস্বরে বললেন, ‘স্যার আপনার শরীর ঠিক আছে তো? তাহলে বলুন! এই অজুহাতে আমি মামলার রায়দান এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেবার জন্য আবেদন করতে পারি৷’
অ্যালান নবাগত এই আইনজ্ঞের কথা শুনে বিষণ্ণ হেসে জবাব দিলেন, ‘শরীর ঠিকই আছে৷ মনটা শুধু ভালো নেই৷ আর রায়দান পিছিয়েই বা কী হবে? অযথা আরও কিছুদিন বাড়তি উৎকণ্ঠাতে কাটাতে হবে আমাকে৷ যা হবার তা আজকেই হোক৷ আমার আর এ জায়গাতে যাওয়া-আসা করতে ভালো লাগছে না৷’— কথাগুলো ধীরে ধীরে থেমে থেমে বললেন অ্যালান৷
অ্যালানের বক্তব্য শুনে যুবক কৌঁসুলি মৃদু চুপ করে থেকে তাঁর তারুণ্যের আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘তবে আপনার শাস্তির পরিমাণ যাতে কম করা যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব আমি৷ আমার ওপর ভরসা রাখুন, নিশ্চয়ই কিছু একটা করতে পারব আমি৷’
আশ্বাসবাণী শুনে আবারও মৃদু হাসলেন অ্যালান৷ একেই হয়তো বলে আইনজীবীর পেশা৷ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা লড়ে যাবার চেষ্টা করে তার মক্কেলের জন্য৷ হয়তো বা ভবিষ্যতে এই যুবক একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী হবেন৷
অ্যালানকে কথাগুলো বলে সেই তরুণ আইনজীবী আবার নিজের জায়গাতে ফিরে গিয়ে তাঁর আসন গ্রহণ করলেন৷ দশটা বাজতে আর মিনিট পাঁচেক বাকি৷ ঠিক দশটাতে আদালতের কাজ শুরু হবে৷
মাথা নীচু করে বসলেন অ্যালান৷ যেমনভাবে রোজ তিনি বসে থাকেন৷ আদালত কক্ষে চাপাস্বরে আবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে৷ কিন্তু সেই গুঞ্জনধ্বনি যেন অ্যালানের কানে প্রবেশ করছে না৷ গত কয়েকদিন ধরেই একজনের কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ছে তাঁর৷ যাঁর কথা অ্যালানের মনে পড়ছে, তিনি ‘সারা টিউরিং’৷—অ্যালানের মা৷ এই অবিশ্বাসের পৃথিবীতে আজ অ্যালানের একমাত্র বিশ্বাসের, ভালোবাসার মানুষ৷ যিনি নিজের সবকিছু উজাড় করে অ্যালানকে মানুষ করেছেন৷ অ্যালানের প্রতি তাঁর আত্মত্যাগ সীমাহীন৷ অ্যালানকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলার জন্যই তিনি তাঁর সব সুখভোগ ত্যাগ করে ইন্ডিয়া ছেড়ে আবার এ দেশে ফিরে এসেছিলেন৷
কাজের চাপে বেশ কয়েকমাস মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতে পারেননি অ্যালান৷ মা এখন কী করছেন! বাড়ির সেই একচিলতে বারান্দাতে একলা বসে, সকালের রোদ্দুর গায়ে মেখে কি অ্যালানের জন্য নতুন কোনো উলের সোয়েটার বুনছেন, নাকি ওভেনে কোনো নতুন ধরনের কেক বানিয়ে রাখছেন ছেলে বাড়ি ফিরলে তাকে খাওয়াবেন বলে? অ্যালানের যতটুকু ধারণা তাতে অ্যালানের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা, এই মামলার কথা এখনও তাঁর কানে পৌঁছোয়নি৷ কিন্তু কাল হয়তো খবরটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে৷ ব্যাপারটা তিনি জানতে পারবেন৷ তখন, কী প্রতিক্রিয়া হবে তাঁর? ছেলের প্রতি তীব্র ঘৃণা, নাকি গভীর সমবেদনা? অ্যালান ঠিক অনুমান করতে পারছেন না সেটা৷ মাথা নীচু করে মা সারার কথা ভাবতে লাগলেন অ্যালান৷
কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দশটা৷ ‘গড সেভ দ্য কিং’ সংগীতধ্বনির সঙ্গে এজলাসে প্রবেশ করলেন বিচারক৷ সবাই উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন বিচারককে৷ প্রৌঢ় বিচারপতি তাঁর আসন গ্রহণ করলেন৷ আজ আর তাঁর বিশেষ তেমন কোনো বাদানুবাদ শোনার ব্যাপার নেই৷ তাঁর কাজ অভিযুক্তের শাস্তি ঘোষণা করা এবং সেই শাস্তির ব্যাপারে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা অভিযোগকারী, এক্ষেত্রে সরকার পক্ষের কোনো বক্তব্য থাকলে শোনা৷ বিচারপতি প্রথমে জুরিদের সঙ্গে মৃদুস্বরে কী যেন কথাবার্তা বললেন৷ তারপর এক আদালতকর্মী হাঁক দিল অ্যালান টিউরিং-এর নাম ধরে৷ অ্যালান তাঁর আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালেন কাঠগড়াতে৷
রায়দানের আগে বিচারক একবার তাকালেন অ্যালানের মুখের দিকে৷ হয়তো বা তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন যে অ্যালানের মুখমণ্ডলে কোনো অনুশোচনার ছাপ ধরা দিচ্ছে কি না৷ কিন্তু দোষী ব্যক্তির মুখমণ্ডলে একটা অদ্ভুত নির্লিপ্তি ছাড়া তেমন কিছু অভিব্যক্তি ধরা দিল না বিচারকের চোখে৷ অতএব তাঁর রায় পাঠ করতে শুরু করলেন বিচারক—
‘অ্যালান ম্যাথিসন টিউরিং, পিতা জুলিয়ান ম্যাথিসন টিউরিং, ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের আনীত অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে৷ জুরি মহোদয়গণও সম্মিলিতভাবে এই ব্যক্তির অপরাধ সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়েছেন এই আদালতে উপস্থিত সাক্ষ্যপ্রমাণের দ্বারা৷ মিস্টার অ্যালান টিউরিং যে অপরাধ করেছেন, তা এ দেশের আইন, ধর্ম বা সমাজের চোখে এক ঘৃণ্য অপরাধ৷ তাই এই আদালত অ্যালান টিউরিংকে তাঁর…. অপরাধের জন্য প্রচলিত বিচারব্যবস্থার…. ধারা অনুসারে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের শাস্তি দান করছেন…
এরপর সামান্য আরও কয়েকটি কথা বলে সংক্ষিপ্ত রায়দান পর্ব শেষ করলেন বিচারক৷
আদালত কক্ষে এবার নিস্তব্ধতা নেমে এল৷ সবাই তাকাল অ্যালান টিউরিং-এর দিকে, বিচারকের রায় শোনার পর এই হাই প্রোফাইল অপরাধীর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য৷ হ্যাঁ, অ্যালান এখন দণ্ডাদেশ পাওয়া অপরাধী৷ আদালত এই মর্মেই রায় ঘোষণা করেছে৷
বিচারক এরপর অ্যালানকে প্রশ্ন করলেন, ‘মিস্টার টিউরিং, এই আদালত যে রায় ঘোষণা করলেন, সে সম্পর্কে আপনার কিছু বলার আছে?’
অ্যালান কোনো জবাব দিলেন না, মাথা নীচু করে নিশ্চুপ ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি৷ তা দেখে বিচারপতি আবারও তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘অ্যালান, আপনাকে বলছি৷ আদালতের রায় নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে?’
অ্যালান এবারও নিশ্চুপ৷ তাঁর দৃষ্টি কাঠগড়ার সামনে মাটির ওপর বিছানো লাল কার্পেটের ওপর নিবদ্ধ৷
বিচারকের প্রশ্নে অ্যালান কোনো সাড়া না দেওয়াতে একটা মৃদু গুঞ্জন শুরু হল৷
এবার কিন্তু উঠে দাঁড়ালেন অ্যালানের পক্ষ নেওয়া সেই তরুণ আইনজীবী৷ বিচারকের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘মি লর্ড, মিস্টার অ্যালান টিউরিং এই মুহূর্তে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত৷ কোনো কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে তিনি নেই৷ আপনি যদি অনুমতি দেন, তবে এই রায় নিয়ে তাঁর পক্ষ অবলম্বন করে আমি আদালতের সামনে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই৷ দয়া করে আমাকে সে সুযোগ দেওয়া হোক৷’
তরুণ আইনজীবীর আবেদনে সরকারি পক্ষের আইনজীবীরা আপত্তি না তোলায় বিচারপতি একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে৷ ওঁর হয়ে আপনিই বলুন৷ আদালত অনুমতি দিচ্ছেন৷’
তরুণ আইনজীবী এরপর বলতে শুরু করলেন, ‘মি লর্ড, প্রথমেই বলি, মিস্টার অ্যালান টিউরিং-এর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ সম্বন্ধে আমার কোনো বক্তব্য নেই৷ মিস্টার টিউরিং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আদালতে দাঁড়িয়ে কখনও অস্বীকার করেননি বা তাঁর অপরাধ গোপন করার চেষ্টা করেননি, যা অন্য অপরাধীরা প্রায় সবসময় করে থাকে৷ আদালতে শুনানি চলার সময় তিনি সরকারি আইনজীবীদের এবং জুরি মহোদয়দের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে গেছেন, নচেৎ এই মামলার যে এত দ্রুত নিষ্পত্তি হত না, তা আমরা সবাই জানি৷ মিস্টার টিউরিং এ কাজটা করে গেছেন, তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হলে তিনি কঠিন শাস্তি পাবেন, তাঁর কারাদণ্ড হবে, তা জেনেও৷ কারণ তিনি বিচার-ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল৷’
এরপর একটু থেমে আবেগঘন কণ্ঠে সেই তরুণ আইনব্যবসায়ী বলতে লাগলেন, ‘ইয়োর অনার, এ কথা ঠিকই, এক ঘৃণ্য অপরাধ করেছেন মিস্টার টিউরিং৷ এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমি নিজেও ব্যাপারটাকে সমর্থন করি না৷ কিন্তু আসামির কাঠগড়াতে দণ্ডাদেশ পেয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার অপরাধই শুধু নয়, আসুন, তাঁর অতীতটাকেও আমরা একবার স্মরণ করি৷ হ্যাঁ, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাই কিছুদিন আগে গণিত, বিজ্ঞান, আর তাঁর অসাধারণ বৌদ্ধিক ভাবনার জন্য দু-দুটি ঈর্ষণীয় সরকারি খেতাব লাভ করেন৷ যার একটি হল, ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এমপায়ার’৷ আর অপরটি হল ‘ফেলো অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি’৷ এ ছাড়া গণিতশাস্ত্র ও কম্পিউটার শাস্ত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের নানা পুরস্কার তিনি তো পেয়েইছেন…
হ্যাঁ৷ ইনিই সেই অ্যালান টিউরিং, যিনি বলেছিলেন, যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা, বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন এক প্রশ্ন, ‘লেট আস কনসিডার দ্য কোশ্চেন, ক্যান মেশিন থিংক?’ যন্ত্র কি চিন্তা করতে পারে? হ্যাঁ, তিনি ব্যাপারটা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন৷ যা সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীতে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে ব্রিটিশরাই যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাও আর-একবার প্রমাণ করেছে৷
শুধু কি তাই? আজ আদালতে কারাদণ্ডের হুকুম শোনা এই ব্যক্তির সম্বন্ধেই আমাদের দেশের মাননীয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মিস্টার চার্চিল একদিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে আটলান্টিক সাগরে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সাফল্যের আসল কারিগর হলেন গণিতবিদ অ্যালান টিউরিং৷ তিনি হিটলারের সেনানায়কদের সাংকেতিক রেডিয়ো বার্তার মর্ম উদ্ধার করে ব্রিটিশ বাহিনীর ও মিত্রশক্তির জয় নিশ্চিত করেন৷ যার ফলে অন্তত দু-বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায় এবং এক কোটি মানুষের জীবনহানি কম হয়৷’ হ্যাঁ, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই সেই মানুষ, যিনি অন্তত এক কোটি মানুষের প্রাণরক্ষা করেছিলেন…৷’
বিচারক এবার আইনজীবীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শাস্তির ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী, তা এবার স্পষ্ট করুন৷’
তরুণ আইনজীবী বললেন, ‘হ্যাঁ, সেটা এবার বলছি৷ বিচার চলাকালীন সরকারপক্ষের আইনজীবীরা একটা কথা বার বার বলেছেন৷ কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এই জঘন্য অপরাধ কোনোদিন করতে পারেন না৷ হ্যাঁ, আমিও মনে করি মিস্টার টিউরিং মানসিকভাবে অসুস্থ৷ অত্যধিক মানসিক চাপ মিস্টার টিউরিং-এর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটিয়েছে৷ তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন৷ তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে দেশকে, সমাজকে আরও অনেক কিছু দিতে পারবেন৷ তাই সরকারি আইনজীবী ও আদালতের কাছে আমার আবেদন, অপরাধী সম্পর্কে কারাবাসের বিকল্প কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না তা নিয়ে ভাবা হোক৷ কারাদণ্ড ভোগ করলেই যে অ্যালান মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, যেটা সম্ভব তাঁর চিকিৎসা করলে৷’—এই বলে বসে পড়লেন তিনি৷ বিচারক আইন মোতাবেক শাস্তি ঘোষণা করলেও তিনি শিক্ষিত মানুষ ও অ্যালানের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল৷ হয়তো বা তিনি তাঁর গাম্ভীর্যের আড়ালে অ্যালানকে রক্ষা করার কোনো সুযোগ খুঁজছিলেন৷ তাই তিনি সরকারপক্ষের আইনজীবীকে বললেন, ‘এ ক্ষেত্রে আপনাদের মতামত কী?’
সরকারি আইনজীবী বললেন, ‘আমার মত প্রকাশের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় দেওয়া হোক৷’
আইনজীবীর সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে বিচারপতি এক ঘণ্টার জন্য আদালত মুলতুবি করলেন৷
এক ঘণ্টা পর যখন বিচারপতি নিজের চেয়ারে বসলেন, তখন সরকারপক্ষের আইনজীবী জানালেন, ‘সরকারের বক্তব্য সরকারি তত্ত্বাবধানে সরকার অপরাধীর চিকিৎসা করবে৷ অপরাধী যদি এ ব্যাপারে সরকারকে অসহযোগিতা করে, অথবা চিকিৎসা নিতে না চায়, তবে তাকে জেলে পাঠানো হবে৷’
বিচারক এরপর অপরাধীর কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী করবেন আপনি? চিকিৎসা করাবেন নাকি জেলে যাবেন?’
অ্যালান মনে করেন না তিনি যা করেছেন তা অপরাধ, তিনি মানসিক ব্যাধির শিকার৷ কিন্তু তাঁর যে এখনও অনেক কাজ বাকি৷ জেলে গেলে সেসব কাজ আর কোনোদিন হবে না৷ অগত্যা অসহায় অ্যালান বললেন, ‘সরকারের প্রস্তাবে আমি রাজি৷’