আঁকার খাতা
সবে ভোরের আলো ফুটেছে। সারারাত ধরে ছুটে চলেছে ট্রেনটা। থ্রি-টায়ার কুপেটাতে অন্য সহযাত্রীরা কম্বল মুড়ি দিয়ে এখনও শুয়ে আছে। নীলাভর অবশ্য ঘুম ভেঙে গেছে অনেক আগেই। নামতে হবে তাকে। জানলার বাইরে তাকিয়ে ছিল নীলাভ। ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে বাইরের পৃথিবীতে। যতদূর চোখ যায় ফাঁকা জমি। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে ছোটো ছোটো টিলা, কোথাও কোথাও একলা দাঁড়িয়ে থাকা কোনো গাছ। এ-ট্রেন মধুপুর যাবে। নীলাভ অবশ্য মধুপুর যাবে না। তার আগে একটা ছোটো হল্ট স্টেশনে নামবে। কর্ডলাইন ধরে একটু ঘুরপথে মধুপুর যায় এ-ট্রেন। এ-লাইনেরই সেই হল্ট স্টেশনটা। যে-জায়গাতে নীলাভ যাচ্ছে সে-জায়গাতে এর আগে সে কোনোদিন যায়নি। হয়তো কোনোদিন যেতও না, যদি না সেদিন পরিতোষের কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনত।
নীলাভ একজন ইলাসট্রেটর। ছবি আঁকিয়ে। বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকায় ছবি আঁকার কাজ করে। ফি-হপ্তায় প্রতি শনিবার বইপাড়া অর্থাৎ কলেজ স্ট্রিটে এক প্রকাশকের ঘরে নীলাভ-পরিতোষের মতো কয়েকজন ছবি আঁকিয়ে আড্ডা জমায়। সেখানেই মাসখানেক আগে আড্ডার মধ্যে হঠাৎই পরিতোষ বলেছিল, ‘ক-দিন আগে মধুপুর গেছিলাম একটা আর্ট এক্সিবিশনে। ফেরার পথে সিগনাল না পেয়ে শিমুলপুর নামে একটা ছোটো হল্ট স্টেশনে গাড়ি থেমে ছিল। ট্রেনে মধুপুরের এক বাঙালি ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে চা খেতে নেমেছিলাম। আমি যে একজন ইলাসট্রেটর সে পরিচয় দিয়েছিলাম ভদ্রলোককে। চা খেতে খেতে সেই ভদ্রলোক দূরে একটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ‘আপনি তো ইলাসট্রেটর। ওই যে দূরে বাড়িটা দেখছেন ওই বাড়িটাতে একজন ইলাসট্রেটর থাকতেন। কলকাতার নানা বড়ো বড়ো কাগজে, বইপত্রে ছবি আঁকতেন ভদ্রলোক। অবধূত চাকী নাম ছিল ভদ্রলোকের।’
একথা বলার পর পরিতোষ বলেছিল, ‘তুমি নিশ্চয়ই অবধূত চাকীর নাম শুনেছ, কাজ দেখেছ— আমরা যখন ছোটো ছিলাম, কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে প্রায় সব কাগজেই, বিশেষত শিশু-কিশোর পত্রিকায় ওঁর ইলাসট্রেশন থাকতো। যদিও ওই ‘অবধূত চাকী’ নামটা নাকি আসলে ছিল ছদ্মনাম। আসল নাম জানা নেই।’
পরিতোষের কথা শুনে নীলাভ প্রায় লাফিয়ে উঠে বলেছিল, ‘দেখব না কেন, বলতে গেলে ওঁর কাজ দেখেই আমার মনে ছবি আঁকার ইচ্ছা জাগে। পেন ড্রয়িং করতেন। কী বলিষ্ঠ কলমের আঁচড় ছিল! নৈসর্গিক দৃশ্য হোক, বা ছুটন্ত ঘোড়া, তাঁর হাতে সব কিছু যেন জীবন্ত হয়ে উঠত। ছোটোবেলায় ওঁর ছবিগুলো কপি করার চেষ্টা করতাম। আমার আঁকাতেও তাঁর আঁকার প্রভাব আছে। ভাবশিষ্যও বলতে পারো। তবে দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে তাঁর আঁকা দেখে আঁকা শিখলেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ ঘটেনি, এমনকী তাঁর ছবিও দেখিনি কোনোদিন। অনেককে জিজ্ঞেস করেও তাঁর বাড়ির ঠিকানা জানতে পারিনি। এই প্রথম তোমার মুখ থেকে তাঁর বাড়ির খবরটা শুনলাম। ওঁর ছবিগুলো নিয়ে আমার একটা অ্যালবাম প্রকাশ করার বহুদিনের ইচ্ছা। ব্যাপারটা অনেকটা গুরুদক্ষিণাও বলতে পারো। তা তোমার সেই সহযাত্রী ভদ্রলোক আর কিছু বলেছিলেন অবধূত চাকী বা ওই বাড়িটার সম্বন্ধে?’
এ-প্রশ্ন শুনে পরিতোষ জবাব দিল, ‘ভদ্রলোক বলেছিলেন অবধূত নাকি একাই থাকতেন বাড়িটাতে। বছর দশেক আগে রেল লাইনে আত্মহত্যা করেন। বর্তমানে একজন কেয়ারটেকার গোছের লোক থাকে বাড়িটাতে। তুমি তো মাঝে মাঝেই একা একা এদিকে সেদিকে বেরিয়ে পড়। একবার গিয়ে দেখে আসতে পার বাড়িটা। ভদ্রলোককে আর দেখার সুযোগ না পেলেও তাঁর কোনো ইলাসট্রেশন বা ফোটোগ্রাফ পেয়ে যেতে পার। ভবিষ্যতে সে সব জিনিস তোমার কাজে আসতে পারে’।
পরিতোষের কাছে কথাগুলো শোনার পর নীলাভ সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে পুজোর সংখ্যার ইলাসট্রেশনের কাজগুলো মিটে যাবার পর সে দেখে আসবে অবধূত চাকীর বাড়িটা। যার ফলশ্রুতি তার এই ট্রেন যাত্রা। গতকাল রাতে কলকাতা থেকে নীলাভ উঠে বসেছে মধুপুরগামী এই ট্রেনে।
জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় ঘড়ি দেখে নীলাভ অনুমান করল হল্ট স্টেশনটা আর বেশি দূরে নয়। অন্তত টাইমটেবিলে তাই লেখা আছে। নীলাভর ঠিক উলটোদিকে লোয়ার বার্থে শুয়ে থাকা একটা লোক চাদরের আড়াল থেকে মুখ বার করে মাথাটা একটু তুলে জানলার দিকে তাকাল। তাই দেখে নীলাভ লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘শিমুলপুর হল্ট আর কত সময় লাগবে বলতে পারেন?’
লোকটা প্রশ্ন শুনে জানলার বাইরে ভালো করে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘সামনেই আসছে। ওর আর একটা নাম আছে—আত্মহত্যা হল্ট। আমরা এদিককার লোকরা এ স্টেশনটাকে ও-নামেই ডাকি।’
নীলাভ বিস্মিত ভাবে জানতে চাইল, ‘তার মানে?’
লোকটা জবাব দিল, ‘ফাঁকা স্টেশন তো। অনেকেই হল্ট স্টেশনটাকে আত্মহত্যার জন্য বেছে নেয়। এমন ঘটনা বেশ কয়েকটা ঘটেছে ওখানে। তাই ওই নাম হয়ে গেছে স্টেশনটার।’ কথাগুলো বলে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল লোকটা।
তার কথা শুনে নীলাভর মনে পড়ে গেল পরিতোষের জানানো কথাটা—অবধূত চাকীও আত্মহত্যা করেছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের গতি কমে এল। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নীলাভ এগোল দরজার দিকে।
।।২।।
নীলাভ নেমে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। অন্য কোনো লোক গাড়ি থেকে নামল না। প্ল্যাটফর্মে পা রেখেই স্টেশনের এক প্রান্তে বিরাট এক শিমুলগাছ নীলাভর নজরে পড়ল। ‘হয়তো-বা ওই গাছটার জন্যই এ-জায়গার নাম শিমুলপুর’। মনে মনে ভাবল নীলাভ। ঠিক সেই সময় উলটো দিক থেকে একটা গাড়ি এসে থামল প্ল্যাটফর্মের অন্যপাশে। দু-জন মাত্র লোক নামল সে ট্রেন থেকে। ভোরবেলা সারাদিনে একবার মাত্র একই সময় আপ-ডাউন দুটো গাড়ি একই সময় ওখানে এসে থামে। বেশ কয়েক জোড়া এক্সপ্রেস ট্রেন এ-লাইনে চললেও তারা এখানে থামে না। দুটো ট্রেনই আধ মিনিটের জন্য প্ল্যাটফর্মে থেমে পর পর হুইসেল বাজিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল। ফিরতি ট্রেনটা পরদিন এ-সময় এখান থেকেই ধরবে নীলাভ। আজ রাতে মাথা গোঁজার মতো একটা আস্তানা খোঁজার দরকার নীলাভর। অন্য ট্রেন থেকে যে দু-জন লোক নামল তাদের দেখে নীলাভর স্থানীয় মানুষ বলেই মনে হল। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে নীলাভর দিকেই আসছিল তারা। নীলাভ তাদের উদ্দেশে বলল, ‘এখানে কাছাকাছি কি থাকার জন্য কোনো হোটেল বা ধর্মশালা আছে?’
প্রশ্ন শুনে একজন মৃদু থমকে দাঁড়িয়ে জবাব দিল, ‘না নেই।’ তারপর নীলাভর প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগোল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্ল্যাটফর্মে একলা দাঁড়িয়ে রইল নীলাভ। একজনও লোক নেই প্ল্যাটফর্মে বা তার বাইরে। এমনকী কোনো চেকার বা রেলকর্মচারীও নয়। টিকিট কাউন্টারের মতো একটা ঘর আছে বটে, তবে সেটা বাইরে থেকে তালা বন্ধ। ভালো করে প্ল্যাটফর্মের বাইরে তাকাতেই বেশ কিছুটা দূরে একটা বাড়ি চোখে পড়ল নীলাভর। সামনেই দুর্গাপূজা। রেল লাইনের গায়ে আর দু-পাশের অনাবাদি জমিতে জায়গায় জায়গায় কাশফুলের ঝাড়। তার মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ এগিয়েছে বাড়িটার দিকে। আরও একটা শিমুল গাছ আছে সেদিকে। নিশ্চয়ই অবধূত চাকীর সেই বাড়িটা হবে! কারণ, পরিতোষও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বাড়িটা দেখতে পেয়েছিল। ও-বাড়িটা ছাড়া অন্য কোনো ঘরবাড়িও চোখে পড়ছে না। তবে আগে ওখানেই যাওয়া যাক— একথা ভেবে নিয়ে নীলাভ প্ল্যাটফর্মের ঢাল বেয়ে নেমে বাড়িটার দিকে যাবার পথ ধরল, বেশ কয়েকটা বাঁক নিয়ে পায়ে চলা পথটা বাড়িটার দিকে। কিছুটা এগোবার পর একটা ছোটো নালা চোখে পড়ল একটা বাঁক পেরিয়ে। তিরতির করে জল বইছে তাতে। মাত্র হাত দশেক চওড়া হবে সেটা। বাঁশের একটা সাঁকো রয়েছে তার ওপর। একদিক থেকে এসে অন্য দিকে কাশের বনের আড়ালে হারিয়ে গেছে সেটা। আরও কিছুটা এগিয়ে অন্য একটা বাঁকের মুখে শিমুল গাছের কাছে উপস্থিত হল নীলাভ। সেখান থেকে বাড়িটা খুব কাছেই। নীলাভ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল সেটা আসলে বাড়ির পিছন দিক। পথটা গিয়ে বাড়িটার সামনে দু-ভাগে ভাগ হয়েছে। একটা পথ গিয়ে থেমেছে বাড়ির পিছন দিকে একটা দরজার সামনে, আর অন্যপথটা বাড়িটাকে বেড় দিয়ে সম্ভবত তার সদর দরজাতে পৌঁছেছে। নীলাভ ঠিকই অনুমান করেছিল। বাড়িটার কাছে গিয়ে সে দ্বিতীয় পথটা ধরে পৌঁছে গেল বাড়িটার সামনের অংশে। বেশ বড়ো পুরোনো লাল ইটের তৈরি চওড়া দেওয়ালের একটা বাড়ি। সামনে থামওলা টানা বারান্দায় বড়ো বড়ো দরজা-জানলা, যদিও সেগুলো বর্তমানে বন্ধ। একসময় মধুপুর বা তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে হাওয়া বদলের জন্য এমন বাড়ি বানিয়ে রাখতেন পয়সাওয়ালা বাঙালিরা। হয়তো-বা তেমনই কেউ সত্তর বা একশো বছর আগে বানিয়েছিল এ-বাড়িটা। নীলাভর এমনই মনে হল।
বাড়িটার সামনে কাউকে না পেয়ে নীলাভ একটু ইতস্তত করে বারান্দায় উঠে এল। টানা বারান্দার একপাশে বেশ কয়েকটা তালা বন্ধ ঘর। মাথার ওপর কড়িবরগা থেকে গোলা পায়রার ডাক শোনা যাচ্ছে। বারান্দায় উঠেও কাউকে না দেখতে পেয়ে নীলাভ হাঁক দিল, ‘বাড়িতে কেউ আছেন?’
বার কয়েক হাঁক দেবার পর বারান্দার শেষ প্রান্তের একটা দরজা খুলে গেল। একটা লোক সেই ঘর থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল নীলাভর সামনে।
বছর পঞ্চাশেক বয়স হবে লোকটার। মাঝারি গড়ন, মাথায় কদমছাঁট চুল। পরনে ধুতি আর ফতুয়া। খালি পা। লোকটা সম্ভবত স্থানীয় দেহাতি মানুষ হবে। নীলাভকে দেখে মৃদু বিস্মিতভাবে সে প্রশ্ন করল, ‘কী চাই?’ প্রশ্নটা সে বাংলাতেই করল।
নীলাভ জবাব দিল, ‘আমি কলকাতা থেকে আসছি। আচ্ছা এটা কি অবধূত চাকীর বাড়ি? যিনি ছবি আঁকতেন?’
লোকটা উত্তর দিল ‘হ্যাঁ, তাঁরই বাড়ি। তবে তিনি তো আর নেই। আপনি?’
নীলাভ বলল, ‘বলছি। কিন্তু আপনার পরিচয়টা যদি বলেন?’
লোকটা জবাব দিল, ‘আমার নাম মিছরিলাল। একসময় বাবু, মানে আপনাদের অবধূত চাকীর দেখাশোনা করতাম। তিনি মারা যাবার পর এ-বাড়িটার দেখাশোনা করি। বাবু তো বিয়ে করেননি। মরার আগে আমার নামে এ বাড়িটার কাগজ করে দিয়ে গেছিলেন।’
কথাটা শুনে নীলাভ বলল, ‘তবে আপনিই এখন এ-বাড়ির মালিক? এ-বাড়িতেই থাকেন?’
লোকটা বলল, ‘তা বলতে পারেন। তবে আমি রাতে এখানে থাকি না। দু-মাইল দূরে আমার গ্রাম। সেখানে থাকি। আপনি কেন এখানে এসেছেন বলুন?’
নীলাভ এবার বলল, ‘আসলে আমি ওঁর আঁকার ভক্ত। ছেলেবেলা থেকে ওঁর আঁকা দেখে ছবি আঁকা শিখেছি। এখানে ওঁর বাড়ি আছে জেনে ছুটে এসেছি। এ-বাড়িটা বলতে গেলে আমার কাছে তীর্থস্থানের মতো।’
‘ও আপনিও ছবি আঁকেন।’ কথাটা বলার পর কেমন যেন একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল লোকটার মুখে।’
নীলাভ বলল, ‘হ্যাঁ, আঁকি। আচ্ছা, এ-বাড়িতে নিশ্চয়ই ওঁর আঁকা ছবি আছে? আমাকে দেখাবেন সেগুলো?
প্রশ্ন শুনে মিছরিলাল কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর জবাব দিল, ‘না, তাঁর কোনো ছবি নেই এ-বাড়িতে।’
কথাটা শুনে নীলাভ আরও বিস্মিত ভাবে বলল, ‘নেই কেন?’
লোকটা জবাব দিল, ‘কলকাতা থেকে পাকাপাকি ভাবে এ-বাড়িতে চলে আসার পর তিনি আর কোনো ছবি আঁকেননি। আগের আঁকা যেসব ছবি এ-বাড়িতে ছিল সেসব তিনি পুড়িয়ে দেন।’
কথাটা শুনে নীলাভ আরও বিস্মিতভাবে বলল, ‘তাই নাকি! পুড়িয়ে দেন কেন?
মিছরিলাল প্রশ্নটা শুনে যেন মৃদু রুষ্টভাবেই বলল, ‘ওসব কথা আজ আর জেনে কাজ নেই। আর কিছু বলবেন?’
নীলাভ মৃদু বিমর্ষ ভাবে বলল, ‘ওঁর কোনো ফোটোগ্রাফ আছে এ-বাড়িতে? আপনি তো ওঁর দেখাশোনা করতেন। যদি ওঁর সম্বন্ধে কিছু বলেন আমাকে?’
মিছরিলাল বলল, ‘না, বাবুর কোনো ফোটোগ্রাফও নেই এ-বাড়িতে। কোনোদিন ছিলও না। বাবু ভালো লোক ছিলেন। আর কিছু বলার নেই।’
মিছরিলালের কথা ও বাচনভঙ্গি দেখে নীলাভ বুঝতে পারল, লোকটা এ-ব্যাপারে তার সঙ্গে বাক্যালাপ করতে চায় না। নীলাভ বেশ আশাহত হল তার ব্যবহারে। তবু সে অবধূত চাকীর সম্বন্ধে শেষ প্রশ্নটা করল, ‘ওঁর আসল নাম কী ছিল যদি বলেন?’
মিছরিলাল এবারও তাকে নিরাশ করে বলল, ‘সে নাম আমি জানি না। এবার আপনি ফিরে যান।’
এরপর আর এ-বাড়িতে থাকা যায় না। আশাভঙ্গ হয়েছে নীলাভর। কলকাতা থেকে এতদূর ছুটে আসাটাই বলতে গেলে ব্যর্থ হল তার। শুধু বাড়িটাতেই যা পা রাখতে পারল সে। তবে আজ আর তার কলকাতায় ফেরার উপায় নেই। রাতে মাথা গোঁজার জন্য একটা আস্তানার দরকার। তাই লোকটাকে সে বলল, ‘আচ্ছা, এখানে কোনো হোটেল, ধর্মশালা বা মাথা গোঁজার জন্য কোনো ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে? কাল ভোরের আগে তো আমার ট্রেন নেই। এ-বাড়িটা দেখার জন্য আর অবধূত চাকীর সম্বন্ধে জানার জন্যই কলকাতা থেকে ছুটে এসেছিলাম আমি। এ-জায়গা বা এখানে কাউকে চিনি না আমি।’
লোকটা বলল, ‘না, এখানে কোনো হোটেল বা ধর্মশালা নেই। আমি যেখানে থাকি সে-গ্রাম এখান থেকে তিন মাইল দূর। সেখানেও কেউ ঘর ভাড়া দেয় না। প্ল্যাটফর্মে চলে যান। ভাগ্য ভালো থাকলে সিগনাল না পেয়ে কোনো গাড়ি থামলে সে গাড়িতে উঠে মধুপুর চলে যাবেন। নইলে কাল ভোরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
কিন্তু এভাবে কী ভাগ্যের জন্য অপেক্ষা করে প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা যায়? মহা সমস্যায় পড়ল নীলাভ। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে মিছরিলালকে বলল, ‘আচ্ছা এ-বাড়িতে একটা ঘরে থাকা যায় না? খাট বিছানার দরকার নেই। একটা ঘর পেলেই হল রাত কাটাবার জন্য।’
মিছরিলাল বলল, ‘না, হবে না।’
নীলাভ পকেট থেকে চট করে দুটো একশো টাকার নোট বার করে বলল, ‘দেখো-না, যদি কিছু ব্যবস্থা করা যায়? একটা রাতের তো ব্যাপার মাত্র। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই তোমার চোর-ডাকাত মনে হচ্ছে না?
নীলাভর বাড়িয়ে দেওয়া একশো টাকার নোট দুটোর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মিছরিলালের মুখের ভাব যেন নরম হয়ে গেল। সে বলল, ‘না, চোর-ডাকাত মনে হচ্ছে না। তাছাড়া এ-বাড়িতে চুরি ডাকাতি করার মতো কিছু নেই। শেষ সময় বাবুর আয় ছিল না। বাড়ির জিনিসপত্র বেচেই তিনি খেতেন। কিন্তু আমি তো বিকেল হলেই ফিরে যাই। আপনি একলা এ-বাড়িতে…’
যদি মিছরিলালের মন আবার কঠিন হয়ে যায় তাই মিছরিলালকে আর কথা শেষ না করতে দিয়ে নোট দুটো তার হাতে গুঁজে দিয়ে নীলাভ বলল, ‘না, একলা থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। কোন ঘরে থাকব বলো?’
মিছরিলাল একটু দোনোমনো করে শেষ পর্যন্ত বলল, ‘ঠিক আছে আসুন। আমি যে-ঘরে এসে থাকি, সেই ঘরেই থাকবেন।’
বারান্দা দিয়ে একটু এগিয়ে নীলাভকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকল মিছরিলাল। আসবাব বলতে ঘরের মাঝখানে একটা তক্তপোশ রাখা আছে। আর ঘরের কোণে রাখা আছে একটা কুঁজো আর গ্লাস। খোলা জানলা দিয়ে বাইরের জমিতে কাশবন দেখা যাচ্ছে। নীলাভর ব্যাগে চাদর, মোমবাতি, বেশ কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট আছে। একটা রাত নীলাভর এখানে থাকতে বিশেষ সমস্যা হবে না। মিছরিলাল তাকে ঢুকিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল।
।। ৩।।
বিকাল পর্যন্ত সময়ের কিছুটা সময় ঘুমিয়ে আর কিছুটা সময় একটা গল্পের বই পড়ে কাটিয়ে দিল নীলাভ। বিকালবেলা সূর্যের তেজ কমলে নীলাভর মনে হল বাইরে থেকে একবার ঘুরে আসা যাক। ঘরের বাইরে বারান্দায় বেরোতে নীলাভ দেখতে পেল মিছরিলাল দাঁড়িয়ে আছে। নীলাভকে দেখে বলল, ‘আমি এখন ফিরে যাব।’
বারান্দা থেকে একসঙ্গেই বাড়ির বাইরে নেমে এল তারা দু-জন। মিছরিলাল অন্যদিকে চলে যেতে গিয়েও একটু থমকে দাঁড়িয়ে প্রথমে বলল, ‘সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসবেন। আর রাতে ঘরের বাইরে বেরোবেন না।’
নীলভ বলল ‘কেন? এখানে চোর-ডাকাতের উপদ্রব আছে নাকি?’
মিছরিলাল বলল, ‘তা নেই। তবে….’
‘তবে কী? ভূতপ্রেতের ভয়? আমার কিন্তু ও-সবে বিশ্বাস নেই।’ মৃদু হেসে বলল নীলাভ।
কথাটা শুনে কয়েক মুহূর্ত নীলাভর দিকে তাকিয়ে রইল মিছরিলাল। তারপর ধীরে ধীরে এগোল তার গ্রামে ফেরার জন্য। নীলাভ এগোল তার উলটো দিকে যেদিকে রেলস্টেশন আছে সেদিকে। যদি কোনো লোকজনের দেখা মেলে সেই আশায়।
প্ল্যাটফর্মে উঠে এল নীলাভ। কিন্তু একই রকম জনশূন্য রেলস্টেশন। একটা লোকও নেই কোথাও। তবে দিনশেষের আলোতে বেশ সুন্দর লাগছে চারপাশ। দিগন্তবিস্তৃত কাশের বন রাঙা হয়ে উঠেছে বিদায়ি সূর্যের আভাতে। মৃদু বাতাসে তাদের মাথাগুলো দুলছে। রেল লাইনের মাথার ওপর বিদ্যুতের তারে দোল খাচ্ছে ফিঙের ঝাঁক। এঁকে-বেঁকে এক সময় ছোটো হতে হতে হারিয়ে গেছে দু-পাশের রেললাইন। নির্জন প্ল্যাটফর্মে একটা বেঞ্চে এসে বসল নীলাভ। তার মনে হল, হয়তো বা এ-রকম বিকেলে এখানেই এসে বসতেন অবধূত। এখানে বসেই হয়তো তিনি তাঁর ছবির কথা ভাবতেন। বাড়িটাতে তাঁর কোনো ছবি না পেলেও বাড়িটা তো দেখা হল নীলাভর। সেটাই-বা কম কী। পরদিন ভোরে বাড়িটা ছাড়ার সময় মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় বাড়িটার একটা ছবি তুলে রাখতে হবে। মনে মনে নানা কথা ভাবতে লাগল নীলাভ।
বেশ কিছুক্ষণ বেঞ্চে বসে থাকার পর নীলাভ খেয়াল করল সূর্য প্রায় ডুবে গেছে, আলো মরে যেতে শুরু করেছে, এবার ফিরতে হবে তাকে। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফেরার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছে নীলাভ, ঠিক সেই সময় তার চোখে পড়ল প্ল্যাটফর্মের যেদিকে শিমুলগাছটা আছে সেদিক থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে আসছে একজন লোক।
লোকটা এগিয়ে এসে নীলাভর সামনে থমকে দাঁড়াল। তার পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। গৌরবর্ণ গোলগাল চেহারা। বয়স মনে হয় ষাট পেরিয়ে গেছে। মাথার চুলে পাক ধরেছে। লোকটা প্রথমে হিন্দিতে জানতে চাইল, ‘ট্রেন ধরতে এসেছেন নাকি? এখন তো কোনো ট্রেন নেই?’
নীলাভ হিন্দিতে জবাব দিল, ‘না, এখানে এক জায়গাতে আছি। জানি এখন ট্রেন নেই। বিকালবেলা একটু বেড়াতে এসেছি প্ল্যাটফর্মে।’
নীলাভর অপটু হিন্দি আর তার মধ্যে বাঙালি টান দেখেই সম্ভবত লোকটা বুঝতে পারল, নীলাভ বাঙালি। আগন্তুক মৃদু হেসে বলল, ‘বাঙালি মনে হচ্ছে? আরে আমিও তো বাঙালি।’
তার কথা শুনে নীলাভ হেসে ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ, বাঙালি। কলকাতা থেকে আজই এসেছি। আবার কাল ভোরের ট্রেনেই ফিরে যাব।’
লোকটা এবার হাত জোড় করে নীলাভকে নমস্কার করে বলল, ‘আমার নাম অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। স্থানীয় লোক। এখানেই থাকি। তা আপনি কোথায় এসেছেন এখানে?’
নীলাভ প্রতিনমস্কার জানিয়ে বলল, ‘আমার নাম নীলাভ বাগচি। ইলাস্ট্রেটর, মানে বই পত্রপত্রিকায় ছবি আঁকার কাজ করি। এখানে অবধূত চাকী নামে এক বিখ্যাত শিল্পীর বাড়ি আছে। ও বাড়িটা দেখতে এসেছি। রাতটুকু ওখানেই থাকব।’
কথাটা শুনে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি এটাই অনুমান করেছিলাম যে আপনি ওখানেই এসেছেন—অবধূতবাবুর বাড়ি।’
নীলাভ বলল, ‘আপনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল?’
ভদ্রলোক হেসে বললেন ‘হ্যাঁ, বিলক্ষণ ছিল।’
কথাটা শুনে নীলাভ আগ্রহী হয়ে বলল, ‘তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানাবেন আমাকে। তাঁকে কোনোদিন না দেখলেও বলতে গেলে তিনি আমার শিক্ষাগুরু ছিলেন। পত্রপত্রিকায় ছাপা তার আঁকা দেখেই বলতে পারেন ছবি আঁকা শিখেছি।’
অনিকেতবাবু বললেন, ‘কী আর বলব। ভালো মানুষ ছিলেন, ভালো ছবি আঁকতেন। শেষজীবনে আঁকা ছেড়ে দিয়েছিলেন।’
নীলাভ বললেন, ‘আর কিছু? তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য?’
ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘শেষজীবনে অবসাদে ভুগছিলেন। আত্মহত্যা করেন। তবে মৃত মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমি আলোচনা করি না।’
নীলাভ বলল, ‘ও আচ্ছা। জানেন অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম এখানে। যদি তাঁর কোনো ছবিটবি দেখা যায়। কিন্তু তা দেখতে পেলাম না। শুনলাম ওঁর সব আঁকা উনি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।’
অনিকেতবাবু প্রথমে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।’ তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তবে ওর শেষ আঁকার খাতাটা কিন্তু ও-বাড়িতে আছে। কিছু ছবিও আছে তাতে।’
কথাটা শুনেই নীলাভ বিস্মিতভাবে বলল, ‘তাই নাকি? কিন্তু ওবাড়িতে মিছরিলাল বলে যে লোকটা থাকে সে কিছু বলল না তো আমাকে?’
অনিকেতবাবু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, খাতাটা আছে। মিছরিলাল খুব ভালোবাসত অবধূতবাবুকে। ওই খাতাটাই তার কাছে অবধূতবাবুর শেষ স্মৃতি। খাতাটা পাছে কেউ হাতিয়ে নেয় বা খাতাটার যদি কোনো ক্ষতি হয়, সে জন্য ও খাতাটা কাউকে দেখাতে চায় না।’
কথাটা শুনে নীলাভ আফসোসের স্বরে বলল, ‘ইস, ছবিগুলো যদি একবার দেখা যেত!’
ভদ্রলোক কয়েকমুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে নীলাভর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি ছবির খাতাটা সত্যিই দেখতে চান। তবে সে ব্যবস্থা আমি করতে পারি।’
নীলাভ বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই দেখতে চাই। আপনি ব্যবস্থা করবেন?’
অনিকেতবাবু বললেন, ‘তাঁর আঁকা দেখার জন্য যখন আপনি এতদূর ছুটে এসেছেন তখন সেই সাহায্য আমি করব। ও-বাড়ির কোন ঘরে কোথায় খাতাটা রাখা আছে আমি জানি। আপনি বাড়ি ফিরে যান। রাতে আমি ও বাড়ি যাচ্ছি। জেগে থাকবেন।’
কথাটা শুনে নীলাভ বলল, ‘আমি যে কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব তা জানি না।’
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘আগে ছবিগুলো দেখুন তারপর ধন্যবাদ দেবেন। আমি এখন আসি। রাতে দেখা হবে।’
এই বলে ভদ্রলোক প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। নীলাভও এরপর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগোল বাড়িটাতে ফেরার জন্য। সে যখন ঘরটাতে ফিরে এল ঠিক তখনই বাইরে ঝুপ করে অন্ধকার নামল।
।।৪।।
ঘরে ঢুকে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসল নীলাভ। এক সময় বাইরে ধীরে ধীরে অন্ধকার কেটে গিয়ে চাঁদ উঠতে শুরু করল। অনিকেতবাবুর জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল নীলাভ। সময় এগিয়ে চলল, সাতটা—আটটা। কিন্তু ভদ্রলোকের দেখা নেই। বাইরে গোল চাঁদ ধীরে ধীরে মাথার ওপর উঠতে লাগল। রাত ন-টা যখন বাজল তখন নীলাভর মনে হতে লাগল হয়তো ভদ্রলোক আর না-ও আসতে পারেন। হয়তো তিনি নীলাভকে বাইরের লোক দেখে মশকরা করেছেন, অথবা কোনো কাজে আটকে পড়েছেন। একটা দোলাচলের মধ্যে তবু নীলাভ তাঁর অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু আরও ঘণ্টা দুয়েক সময় যখন অতিক্রান্ত হল, তখন নীলাভ অনুমান করল ভদ্রলোক আর আসছেন না। পরদিন কাক ভোরে তাকে ট্রেন ধরতে হবে। কাজেই কিছু খেয়ে শুয়ে পড়াই ভালো। নীলাভ ধীরে সুস্থে সঙ্গে আনা এক প্যাকেট বিস্কুট আর মিষ্টি খেল। রাতে ঘুমোবার আগে রোজ মিনিট দশেক পায়চারি করার অভ্যাস তার। ঘরটা বেশ বড়ো। ঘরের মধ্যেই হাঁটার কাজটা সেরে নিল সে। তারপর যখন সে জল খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে যাচ্ছে ঠিক তখনই দরজাতে টোকা দেবার শব্দ হল। বাইরে থেকে একটা গলা শোনা গেল, ‘নীলাভবাবু, জেগে আছেন? আমি এসেছি।’
নীলাভ দরজা খুলতেই দেখতে পেল অনিকেতবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। নীলাভকে দেখে তিনি বললেন, ‘আমার আসতে দেরি হয়ে গেল। তবে ভালোই হল, বাইরে জ্যোৎস্না ফুটে গেছে। নইলে খাতাটা দেখাবার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। আপনি তৈরি তো? তবে চলুন সে-ঘরে যাই?’
নীলাভ তাঁর কথার জবাবে হেসে বলল, ‘এত দেরি দেখে আমি ভেবেছিলাম আপনি আর আসছেন না। কোনো কারণে আটকে গেছেন। হ্যাঁ চলুন।’
এই বলে নীলাভ ঘর থেকে মোমবাতিটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ভদ্রলোক তাকে নিয়ে দরজা খুলে পাশের একটা ঘরে ঢুকলেন। তারপর সেই ঘরটা থেকে অন্য দরজা দিয়ে এলেন অন্য একটা ঘরে। দ্বিতীয় ঘরটাতে মুহূর্তের জন্য থামলেন তিনি। অন্য ঘর। দেওয়ালের এক কোণে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানে দেওয়ালে কোনো কালো দাগ দেখতে পাচ্ছেন? আগুন লাগানোর দাগ। এটাই ছিল তাঁর আঁকার ঘর। ওই জায়গাতেই তিনি আগুন জ্বেলে তাঁর সব আঁকা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।’
কথাটা শুনে সেদিকে তাকিয়ে আফসোসে মাথা নাড়ল নীলাভ। লোকটা কথাটা বলে আর অবশ্য সেই ঘরে দাঁড়ালেন না। এগোলেন অন্য ঘরের দিকে। পরপর বেশ কয়েকটা ঘর অতিক্রম করলেন ভদ্রলোক। কোনো ঘরেই কোনো আসবাবপত্র নেই। ভদ্রলোক যেভাবে একটার পর একটা দরজা দিয়ে ঘরগুলো অতিক্রম করলেন তাতে নীলাভ বুঝতে পারল যে এ-বাড়ির সব কিছুই ভদ্রলোক চেনেন। অবশেষে ভদ্রলোক নীলাভকে নিয়ে একটা ঘরে এসে দাঁড়ালেন। এ-ঘরেই প্রথম একটা আসবাব চোখে পড়ল তার—কাঠের বড়ো একটা আলমারি। ঘরে অন্য একটা জানলা ও দরজাও আছে। অনিকেতবাবু বললেন, ‘দাঁড়ান আগে জানলাটা খুলি। বাতিটা দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখুন।’
তার কথামতো বাতিটা নীলাভ সেখানে রাখল। ভদ্রলোক জানলাটা খুলতেই বাইরে থেকে চাঁদের আলো এসে ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। বাইরে তাকিয়ে নীলাভ বুঝতে পারল বাড়ির পিছনদিকের সে ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছে। জানলা খোলার পর ভদ্রলোক আলমারির কাছে গিয়ে তার পাল্লাটা খুললেন। নীলাভ দেখল তার তাকগুলো সব শূন্য। ভদ্রলোক এরপর তার পায়ের পাতার ওপর ভর করে একটু লম্বা হয়ে হাত বাড়িয়ে সব থেকে ওপরের তাক হাতড়ে অবশেষে একটা খাতা বার করে আনলেন। খাতাটার আকৃতি দেখেই অনিকেত বুঝতে পারল সেটা একটা ড্রইং-বুক বা আঁকার খাতা। নিশ্চয়ই ওটা অবধূত চাকীর আঁকার খাতা।
খাতাটার মলাটের ওপর থেকে ধুলো ঝেড়ে সেটা নিয়ে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। নীলাভও তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। খাতাটা তার হাতে তুলে দেবার আগে ভদ্রলোক বললেন, ‘মোট পাঁচটা ছবি আছে খাতাটাতে। তবে আমি যেভাবে বলব সেভাবে খাতার পাতা উলটে ছবিগুলো দেখবেন। তবে ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। প্রথমে প্রথম ছবিটা দেখুন।’
খাতাটা হাতে নিয়ে কেমন যেন একটা রোমাঞ্চ অনুভব করল নীলাভ। অবধূত চাকীর নিজের হাতে আঁকা ছবি বলে কথা!
খাতার প্রথম পাতাটা খুলল নীলাভ। চাঁদনী রাতে একটা ল্যান্ডস্কেপের ছবি। আরে এই তো ছবির নীচে এককোণে অবধূত চাকির নামের আদ্যক্ষর। ‘এ’ আর ‘সি’ লেখা। যেমন থাকত অবধূত চাকীর আঁকা ছবিগুলোতে। জ্যোৎস্নার আলো বিধৌত চরাচর, কাশের বন, তার পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে হারিয়ে যাওয়া রাস্তা কালির আঁচড়ে জীবন্ত করে তুলেছিলেন শিল্পী। চাঁদটা এত সুন্দর যেন সে সত্যি খাতার ভিতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে। তন্ময়ভাবে খাতাটার দিকে তাকিয়ে রইল নীলাভ। এমন সময় অনিকেতবাবু বললেন, ‘একবার জানলার বাইরে তাকান।’
নীলাভ তাকাল। তারপর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে গেল বিস্ময়ে। বাইরের দৃশ্যটাই যেন ক্যামেরাতে তোলা ফোটোগ্রাফের মতো নিখুঁতভাবে ধরা আছে খাতাটাতে। একই কাশের বন, তার মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা রাস্তার প্রতিটা বাঁক, এমনকি এই মুহূর্তে চাঁদের অবস্থানটাও হুবহু একই রকম! যেন এই মুহূর্তে ওখানে দাঁড়িয়েই ছবিটা এঁকেছেন শিল্পী। নীলাভ বলল, ‘অবিশ্বাস্য।’
অনিকেতবাবু বললেন, ‘এরপরের ছবিগুলো বোঝার জন্য আমাদের বাইরে যেতে হবে।’
ঘরের পিছনের দরজাটা খুলে রাস্তায় নামলেন ভদ্রলোক। নীলাভ খাতাটা নিয়ে তাকে অনুসরণ করল।
।।৫।।
কিছুটা পথ হেঁটে তারা এসে দাঁড়াল বাড়িটার কাছাকাছি যে শিমুলগাছটা আছে তার নীচে। ভদ্রলোকের নির্দেশে দ্বিতীয় পাতাটা খুলল নীলাভ। এবারও বিস্ময়ের সীমা রইল না তার। যেন এখনই আঁকা হল ছবিটা। সেখানে দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে বাড়িটা আর একটু এগিয়ে সাঁকোটা যেমন ভাবে দেখা যাচ্ছে, খাতাতেও হুবহু যেন তেমনই আঁকা। এমনকী বাড়ির পিছনের দরজাটা যে খোলা তাও ছবিটাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে! ভদ্রলোক তাকে কেন বাইরে আনলেন, তা এবার বুঝতে পারল অনিকেত। শিমুল গাছের তলা ছেড়ে তারা এরপর এগোল সামনের দিকে। তারা এসে এরপর থামল সাঁকোটার ওপর।
তৃতীয় পাতার ছবির সাথে এ জায়গারও হুবহু মিল। বাড়িটা অনেক দূরে সরে গেছে। রেল লাইনের দিকটা কিছুটা চোখে পড়ছে এবার। অনিকেতবাবু বললেন, ‘চাঁদের অবস্থানটা খেয়াল করুন। আমাদের এগোবার কারণে আমাদের কাছে চাঁদের অেবস্থান যেমন বদলাচ্ছে, ছবিতেও তেমনই বদলাচ্ছে চাঁদের অবস্থান।’
নীলাভ বুঝতে পারল ভদ্রলোকের কথাগুলো একশো শতাংশ সত্যি! কিন্তু এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে কেউ যদি ছবিটা না আঁকে তবে তা কীভাবে সম্ভব?
অনিকেতবাবু যেন মৃদু হাসলেন। ছবির অন্য পাতা দুটো দেখার আকর্ষণে নীলাভ আবার অনুসরণ করল তাঁকে।
নীলাভরা এরপর যে জায়গায় এসে দাঁড়াল সেখান থেকে প্ল্যাটফর্ম আর রেললাইন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনেক পিছনে দেখা যাচ্ছে ফেলে আসা বাড়িটা। চতুর্থ ছবিটাতে তেমনই আঁকা আছে। যেন সময়ের সাথে সাথে খাতার পাতায় ছবি এঁকে চলেছে কেউ! নীলাভর বিস্ময়ের সীমা নেই বুঝতে পেরে অনিকেতবাবু এবার স্পষ্ট হেসে বললেন, ‘এ-খাতার শেষ ছবিটাই আসল ছবি। সেটা দেখলে বুঝতে পারবেন ছবি কতটা জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে! কতবড়ো শিল্পী ছিলেন অবধূত!’ এই বলে তিনি এগোলেন রেললাইনের দিকে। শেষ ছবিটা দেখার অমোঘ আকর্ষণে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর পিছনে হাঁটতে লাগল নীলাভ।
রেললাইনে উঠে এল তারা। অনিকেতবাবু বেশ কিছুটা দূরে রেললাইনের গায়ে একটা ইলেকট্রিক পোস্ট দেখিয়ে বললেন, ‘রেললাইনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা ওই পোস্টের সামনে গিয়ে লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খাতাটা খুলবেন। তিনি যে কতবড়ো শিল্পী ছিলেন তবে তা বুঝতে পারবেন। আর এই শিল্পীকেই এক সময় অন্যের ছবি চুরি করার, কপি করার জন্য অপমান করেছিল একদল লোক। অবধূত চাকীর কারও ছবি কপি করার প্রয়োজন হতো না।’
নীলাভ বিস্মিত হয়ে গেল ভদ্রলোকের শেষ কথাগুলো শুনে। তিনি এরপর বললেন, ‘যান, ও-জায়গাতে গিয়ে শেষ ছবিটা দেখে আসুন। রেললাইনের পাথরের ওপর দিয়ে আমার হাঁটতে অসুবিধা হয়, নইলে সঙ্গে যেতাম।’ নীলাভর মধ্যে একটা তীব্র আকর্ষণ অনুভব হচ্ছে শেষ ছবিটা দেখার জন্য। কী আছে সেই ছবিতে? ভদ্রলোকের কথা মতো নীলাভ খাতাটা নিয়ে এগোল রেললাইনের মধ্যে দিয়ে।
নির্দিষ্ট জায়গাতে গিয়ে নীলাভ দুটো লাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে খাতাটা খুলল। তার সামনে দিয়ে যে ভাবে রেললাইনটা চলে গেছে সেভাবেই খাতায় আঁকা হয়েছে। যেন এ জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবিটা আঁকা হয়েছে। ছবিতে আঁকা আছে দূর থেকে একটা ট্রেন যেন সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। রেল লাইনে ছড়িয়ে পড়ছে তার আলো। কয়েকমুহূর্ত সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর নীলাভর মনে হতে লাগল ছবির ট্রেনটা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তার আলো যেন ক্রমশ বড়ো উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে। আলোয় ভরে উঠেছে খাতাটা। ট্রেনটা যেন খাতা ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চলেছে। আর এরপরই রেলগাড়ির প্রচণ্ড ঝমঝম শব্দ শুনে চমকে উঠে সামনে তাকাতেই নীলাভ দেখতে পেল তার সামনে এসে পড়েছে একটা ট্রেন। হাত কুড়ি মতন ব্যবধান। ট্রেনের উজ্জ্বল আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। আর পরমুহূর্তই এক ঝটকায় তার হাত টেনে কেউ তাকে লাইনের বাইরে ছিটকে ফেলল। মুহূর্তর জন্য মৃত্যুকে ফাঁকি দিল নীলাভ। নীলাভর সামনে দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে মৃত্যু—মাঝরাতের একটা এক্সপ্রেস ট্রেন!
যে-হাতটা নীলাভকে মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচাল সেই হাতটাই আবার নীলাভকে টেনে দাঁড় করাল। মিছরিলালের হাত। মিছরিলাল দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। মৃত্যুর মুখ থেকে সদ্য ফিরে আসা নীলাভ হতভম্ভ।
নীলাভদের সামনে দিয়ে ট্রেনটা দ্রুত গতিতে সরে যাবার পরই নীলাভ দেখতে পেল লাইনের ঠিক ওপাশে দাঁড়িয়ে আছেন অনিকেতবাবু। নীলাভকে জীবন্ত দেখে তার চোখে মুখে যেন ফুটে উঠেছে বিস্ময়মিশ্রিত ঘৃণার ভাব। রেললাইনের পাশেই পড়েছিল সেই আঁকার খাতাটা। মিছরিলাল সেটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিতেই রেল লাইনের ওপাশ থেকে ভদ্রলোক বললেন, ‘মিছরিলাল, খাতাটা ফেরত দাও।’
মিছরিলাল জবাব দিল, ‘না, এ খাতা আমি আর দেব না বাবু। প্রতিশোধ নেওয়া তো অনেক হলো। আর এ-কাজ আমি করতে দেব না আপনাকে।’
অনিকেতবাবু এবার কাতর স্বরে বলে উঠলেন, ‘না, খাতাটা আমাকে দাও। তুমি জান না এই শহুরে ভদ্রলোকগুলো আমাকে কত অপমান অসম্মান করেছে…’
উলটো দিক থেকেও একটা এক্সপ্রেস ট্রেন আসছে। তার আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছে রেললাইন। লাইনের দু-পাশে দাঁড়ানো নীলাভ, মিছরিলাল আর অনিকেতবাবুকে দেখতে পেয়েই মনে হয় ঘন ঘন হুইসেল বাজাচ্ছে ট্রেনের চালক।
অনিকেতবাবুর কথার জবাবে মিছরিলাল বলে উঠল, ‘আমি সব জানি বাবু। তার জন্য দুঃখও কম নয়। কিন্তু আর নয়।’ এই বলে এক অদ্ভুত কাণ্ড করল মিছরিলাল। দু-হাতে আঁকার খাতাটা সে ছিঁড়তে শুরু করল। আর তাই দেখে করুণ আর্তনাদ করে উঠলেন অনিকেতবাবু, তারপর রেললাইনে উঠে পাগলের মতো ছুটতে শুরু করলেন দানবের মতো ছুটে আসা ট্রেনটার দিকে। ট্রেনটা এসে পড়ল ভদ্রলোকের ওপর। ভয়ংকর দৃশ্যটা না দেখার জন্য শেষ মুহূর্তে চোখ বুজে ফেলেছিল নীলাভ। ভদ্রলোকের শেষ আর্তনাদ যেন একবার শুনতে পেল নীলাভ। তারপর ট্রেন ঝমঝমানি আর হুইসেলের শব্দে ঢাকা পড়ে গেল সব কিছু। ট্রেনটা বেশ দূরে চলে যাবার পর চোখ মেলল নীলাভ। তার পাশে দাঁড়িয়ে মিছরিলাল। তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে ছেঁড়া খাতার টুকরোগুলো। নীলাভ ভয় ভয় চোখে তাকাল কিছুটা দূরে যেখানে অনিকেতবাবুর ছিন্নভিন্ন দেহটা পড়ে থাকার কথা সে জায়গাতে। কিন্তু সেখানে লাইন বা তার আশেপাশে কিছু পড়ে নেই। তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই সম্ভবত মিছরিলাল বলল, ‘না, ওখানে কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। তবে ঠিক ওই জায়গাতেই বাবু একদিন আত্মহত্যা করেছিলেন।’
নীলাভ বলল, ‘তার মানে?’
মিছরিলাল বলল, ‘আমার সঙ্গে আপনি এবার বাড়িটাতে ফিরে চলুন। সেখানে গিয়ে সব বলছি আপনাকে।’ নীলাভর মাথার ভিতর যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব কিছু। মিছরিলালের পিছনে টলতে টলতে সে এগোল বাড়িটার দিকে।
বাড়ি ফিরে সেই পিছনের ঘরটাতেই বসল তারা। বড়ো মোমটা তখনও জ্বলছে। ঘরটাতে ঢুকে ধাতস্থ হতে বেশ অনেকটা সময় নিল নীলাভ। মিছরিলাল বাড়ির ভিতরে কোথা থেকে যেন জল এনে খাওয়াল নীলাভকে।
মোমবাতির আলোতে বিষণ্ণ মিছরিলালের মুখ। একসময় সে বলতে লাগল তার কথা। টুকরো টুকরো কথা। দীর্ঘক্ষণ থেমে থেমে, আপনি তো জানেন বড়ো শিল্পী ছিলেন বাবু। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে। কিন্তু সেটাই কাল হল। ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ল একদল শিল্পী। তাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যাঁদের বাবু ছবি আঁকা শিখিয়েছিলেন, নানা কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। বাবুর বিরুদ্ধে গোপনে শলা করল তারা। বাবু একবার একটা ছবি এঁকেছিলেন। তারা প্রচার করল সেটা নাকি এক বিখ্যাত শিল্পীর ছবি চুরি করে আঁকা। বাবু সেই শিল্পীর ছবি কোনোদিন দেখেননি। হয়তো বা কোনো কারণে দুই শিল্পীর ভাবনা মিলে গেছিল। কিন্তু বাবুর কথা কেউ বিশ্বাস করল না। কোন কাগজে নাকি লেখা হল বাবু চুরি করে আঁকেন। লজ্জায়, অপমানে, ঘৃণায় বাবু ছবি আঁকা ছেড়ে দিলেন। নিজের সব ছবি নষ্ট করে দিলেন। তাঁর প্রচণ্ড একটা আক্রোশ জন্মে গেল শহুরে মানুষ, বিশেষত যাঁরা ছবি আঁকেন তাদের প্রতি…
আত্মহত্যা করার আগে শেষ ওই খাতাটায় ছবি এঁকে ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি কতবড়ো শিল্পী ছিলাম তা এই খাতাটা ভবিষ্যতে বুঝিয়ে দেবে।’ এই বলে অদ্ভুত হাসি হেসে ছিলেন তিনি। শেষ ছবিটা আঁকার পরদিনই তিনি রেললাইনে আত্মহত্যা করেন। তাঁর কথা সেদিন বুঝতে পারিনি, পরে বুঝেছিলাম। এই খাতাটাই অনেককে টেনে নিয়ে গেছে মৃত্যুর দিকে। লোকে ভাবে ব্যাপারটা আত্মহত্যা, কিন্তু আসলে ব্যাপারটা তা নয়…
‘আমি গরিব মানুষ। আপনি টাকাটা দেখাতে আমি লোভে পড়ে গেছিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে একটা কু-ডাক দিচ্ছিল। তাই মাঝরাতে আবার বাড়িতে ফিরে এসেছিলাম। দেখলাম আপনি নেই। কী ঘটতে পারে তা অনুমান করে আমি ঘুরপথে পৌঁছে গেছিলাম রেললাইনের ধারে, যেখানে ঘটনাগুলো ঘটে। ভাগ্যিস গেছিলাম সেখানে…’
নীলাভ বলল, ‘তবে ওই অনিকেতবাবু…।’
মিছরিলাল জবাব দিল, ‘উনিই বাবু।’
নীলাভ এবার খেয়াল করল—অনিকেত চট্টোপাধ্যায় আর অবধূত চাকী তাদের নামের আদ্যক্ষর একই। ‘এ’ আর ‘সি’। সে জন্যই নিশ্চয়ই আদ্যক্ষরে মিল থাকা ছদ্মনাম নিয়েছিলেন তিনি। ছবির নীচে স্বাক্ষর করতেন ‘এ সি’ লিখে। মিছরিলাল বলল, ‘ঘটনাগুলো ঘটার পর কিন্তু খাতাটা আবার এই আলমারির তাকে ফিরে আসত। কতবার ভেবেছি খাতাটা নষ্ট করে দেব কিন্তু পারিনি। বাবুর শেষ আঁকা, শেষ স্মৃতি। কিন্তু এবার করলাম। নইলে এ-খাতা আরও অনেক মানুষকে টেনে নিয়ে যেত রেল লাইনে। প্রতিহিংসা বড়ো ভয়ংকর। তা যুক্তি মানে না…’
নীলাভ নিশ্চুপ। মোমবাতিটা এবার শেষ হয়ে এসেছে। নিভে যাবার আগে আলোর শিখাটা কাঁপছে। সেই আলো এসে পড়েছে মিছরিলালের মুখে। তার চোখে জল। হাতের পাতার উলটো দিক দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে মিছরিলাল বলল, ‘খাতাটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমার ধারণা বাবু আর আসবেন না। সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। একটু পর ভোরের আলো ফুটবে। আপনাকে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ধরার জন্য আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।’
—