অ্যালবাট্রস – ৩

তিন

পূতিগন্ধময় শব্দটার মানে এতদিনে টের পেলাম। ঠিক যেন রাস্তার পাশের খোলা ড্রেনের মধ্যে পড়ে গিয়েছি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত নর্দমার পাঁকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, মুখখানা দেখাই যাচ্ছে না, কাপড়চোপড় সব ভিজে ভারী—ছোটবেলায় একবার দোলের সময়ে কাদার মধ্যে ফেলে বাঁদুরে রং মাখিয়ে দিয়েছিল ও—পাড়ার বড় বড় ছেলেরা এসে, সেইরকম লাগছে—কেবল রং নয়, পাঁক, খোলা নর্দমার ময়লা ফিলথ…। আমি স্নান করতে চাই—সুগন্ধী সাবান মেখে স্নান করে পরিচ্ছন্ন হতে চাই—চন্দননগরে যেরকম ঝুপুস করে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়তাম, সেরকম ঝাঁপাতে ইচ্ছে করছে—এত ময়লা, এত পাঁক, এত দুর্গন্ধ এর মধ্যে টেঁকা যায় না—আমি ঘর বদল করতে চাই—অথচ সেটা এখন সম্ভব হচ্ছে না, অন্য কোথাও উঠে যেতে হয়—উঠে যাওয়া, অন্য ঘর পাওয়াও তো সোজা নয়।—তাছাড়া এখানে দু’মাসের টাকা জমা আছে, অন্যত্র ঘর ঠিক করলে দু’মাস আগে বলতে হবে—টাকাটা ফেরত হয় না। কিন্তু এই নোংরামি আমার আর শরীরে সহ্য হচ্ছে না—আমি মুক্তি পেতে চাই—যে কোনও উপায়ে মুক্তি। আমি পরিচ্ছন্ন হতে চাই—মনে মনে দিদিমার সেই মন্ত্রটা বলি, ”যঃ স্মরেৎ পুণ্ডরীকাক্ষং স বাহ্যাভ্যন্তরৌ শুচিঃ”—ওটা বলে বলে নিজেকে পরিষ্কার করে রাখতে চেষ্টা করি—ভেতরে ভেতরে স্নান করার মতন—কিন্তু আমি মরে যাচ্ছি—মনে মনে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি—অশুচিতার মধ্যে আমূল ডুবে রয়েছি।

—কী চমৎকার চাঁদের আলো আসছে পিউ, দ্যাখো একবার না লাসভেগাসে, লাসভেগাসে বিশাল বিশাল সব হোটেল আছে, হোটেলের ভেতরে যে কী নেই?—একটা হোটেলের ভেতরই ওরা ‘ভেনিস’ বানিয়েছে, ক্যানাল গণ্ডোলা, সব—আরেকটা হোটেলের মধ্যে ‘প্যারিস’ বানিয়েছে। ছাতাওলা কাফে, রেস্তোরাঁ, ফ্রেঞ্চ কুইজিন—এমনকী আইফেল টাওয়ার—ভাবতে পারবে না, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না, এমনকী, ‘লাক্সর’ বলে হোটেলটার চেহারাও পিরামিডের মতো, ভেতরে টুটানখামোনের টুম্ব—এর নকলটা বানিয়ে রেখেছে।

—আবার ‘নিউইয়র্ক—নিউইয়র্ক’ বলেও একটা আছে ঠিক ম্যানহাটনের মত—কিন্তু আমি যেখানে সেটার নাম ‘দ্য গোল্ডেন নাগেট’, খুব পুরনো হোটেল—ওয়ান অফ দি আর্লিয়েস্ট—লাসভেগাস তো খুব পুরনো নয়, বছর চল্লিশেক বয়েস বড় জোর—ওই গোল্ডেন নাগেটেই আলাপ হলো জে—য়ের সঙ্গে। বিগ জো, লাসভেগাসের খুব জবরদস্ত মাল—বিশাল এক জুয়াড়ি, যা ছোঁয় তাই সোনা হয়ে যায়। এই আমার মতোই—সেই বিগ জে—য়ের সঙ্গে এক রাত্রে প্রচুর ড্রিংক করে বিশ হাজার ডলার বাজী ধরেছিলাম—শনিবার রাত তিনটার সময় কাসিনোতে যখন হলভর্তি লোক, পুরোদমে জুয়াখেলা চলছে বড় লাউঞ্জে— সেইখানে সক্কলের মধ্যিখানে গায়ে একটাও সুতো না রেখে সিরিয়াস মুখে জুয়ো খেলতে শুরু করেছিলাম—বিবস্ত্র মেয়েদের নাচ তো ওখানে সবাই দেখেছে, কিন্তু বিবস্ত্রা জুয়াড়ীর এমন মারকাটারি খেলা তো কেউ দেখেনি?—জে—য়ের সঙ্গে বিশহাজার ডলার তো জিতলামই—তাছাড়া সেই রাত্রেই আমার ভাগ্যে জ্যাকপট জুটে গিয়েছিল—রোজগার তো জীবনে কম করিনি? রাখতে পারলাম কই? জে আমাকে সেই নগ্ন অবস্থায় সোজা পাঁজাকোলা করে তুলে ধরে বাইরে নিয়ে চলে গেল চুমু খেতে খেতে—এক্কেবারে খোলা আকাশের নীচে—চাঁদের সেখানে দফারফা—লাসভেগাসে তো রাতের বেলায় দিনের আলো করে রেখেছে—জ্যোৎস্না দেখাই যায় না—জে নিয়ে গেল হোটেলের পেছনদিকে, সুইমিং পুলের পাশে—যেখানে শহরের আলো নেই—আছে উপছে পড়া জ্যোৎস্না…মরুভূমির জ্যোৎস্না যে কী জিনিস—পিউ—সুইমিং পুলের পাশে,… জে আমাকে, ঘাসের ওপরে…কী রে পিউ? ঘুমোলি নাকি? পিউ?

—নাঃ! শুনছি। তবে এবারে ঘুমোব। আজ ঐ পর্যন্তই থাক। কাল হবে। কেমন?

—আরে, এখনও তো শুরুই হয়নি কিছু! ওখানে সারা রাত্রি যে অরজিটা হোলো—জলের মধ্যে।

—আমি শুনব না মাসি…।

—জাস্ট লিসেন টু দিস ওয়ান—হোয়াট জে ডিড টু মি…

—আমি শুনতে চাই না। উঠে যাব? এত রাতে টিভিরুমে গিয়ে বসে থাকব? প্লিজ ঘুমোও। আমাকে ঘুমোতে দাও।

—আর—রে? শোন না—উই জাস্ট ওয়েন্ট ওয়াইল্ড দ্যাট নাইট, ওঃ ইট ওয়াজ গ্রেট—ওই মরুভূমির রাত্রে—কী হল শুনলে তোর…

—প্লিইইজ!! স্টপ ইট!—আই নিড স্লিপ! কাল প্রচুর কাজ আছে পদ্মিনীমাসি, আমি শুনতে চাই না। গুডনাইট!

—রোজই তোর এক কথা—

—রোজই যে ঘুম পায়। সারাদিন কাজের পরে—

—এসব তো শুনে শরীর মন চাঙ্গা হয়ে ওঠার কথা

—সকলের শরীর মন তো একরকম হয় না—

—মনটা আলাদা হতে পারে, কিন্তু সুইট হার্ট শরীরের স্বভাব একই—

—না, এক নয়, তোমার শরীরের স্বভাব আলাদা—

.

মক্ষিকা ব্রণমিচ্ছন্তি।

এত বড় পৃথিবীটাতে কি পদ্মিনীমাসির জীবনে কোনও মন ভালো করা গন্ধ ঘটে না? পদ্মিনীমাসি খুব হাসাতে পারে। কিন্তু সেই হাসিরও উৎস ওই ডার্টি জোকস। শরীর। শুধু শরীর। কোথা থেকে যোগাড় করে এত অন্তহীন কু—কথা?

ঋত্বিক বলে, ফ্রাস্ট্রেটেড মহিলা—গল্পগুলো পর্ণোগ্রাফির বই পড়ে পড়ে শিখে রেখেছে। তোমাকে বোকা পেয়ে ঝাড়ছে।

অসম্ভব, এখানে থাকা অসম্ভব। আমি পাগল হয়ে যাব এখানে—এই পরিবেশ থেকে আমাকে পালাতেই হবে, সুস্থ পরিবেশে। পালাবই বা কোথায়? ঋত্বিকের সঙ্গেও একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে আমার। যদিও ঋত্বিক সেটা টের পাচ্ছে না, ওর আচরণে কোনও পার্থক্য হয়নি—আমি নিজের ভেতরে ভেতরে দূরত্বটা বুঝতে পারছি—ঋত্বিক কিছুই বুঝছে না—অহংকার করে এমিলির গল্পটা রোজই তুলছে—যেহেতু আর কাউকে বলা চলবে না—এমিলি প্রমিস করিয়ে নিয়েছে জগতের দ্বিতীয় কাউকে বলা বারণ—কিন্তু আমি, ঋত্বিকের মতে, জগতের মধ্যে পড়ি না—আমি ঋত্বিকের মধ্যেই পড়ি—ওর নিজের মধ্যে ও যা জানে, আমার সবটাই জানার কথা—ও নাকি এমিলিকেও বলেছে—’আমার গার্লফ্রেন্ডকে শুধু বলব, ওকে না বলে তো আমি থাকতেই পারব না। আমার জীবনটা তো ওরও।’ সে তো বুঝলাম, খুব ভালো কথা, এটাই তো আমারও ধারণা ছিল এতদিন—

কিন্তু ঋত্বিকও যে ভেতরে ভেতরে অবিকল পদ্মিনীমাসির মতই হয়ে যাচ্ছে—হয়ে গিয়েছে—সেটা তো এতদিন আমি বুঝতে পারিনি—এই এমিলি ঘটনা সেটাই স্পষ্ট করে দিল—বুঝিয়ে দিল আমরা পরস্পরের থেকে কতদূরে আছি—ওরা একপারে, আমি অন্যপারে—পদ্মিনীমাসির সঙ্গে ঋত্বিকও এখন পাঁকভর্তি জমিতে। যতক্ষণ আমি ওদের সঙ্গে আছি, আমিও পাঁকের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি—আমাকে সরে আসতেই হবে—আমি মিশনারি স্কুলের মেয়ে, আমাদের সিস্টাররা শিখিয়ে দিয়েছেন পাপপুণ্যের হিসেব—আমি সতীত্বের মূল্য জানি—পদ্মিনীমাসির কাছে যেটার কোনও দামই নেই—এখন দেখছি ঋত্বিকের কাছেও না—অথচ এতদিন ভেবেছিলাম। ঋত্বিক বুঝি আমারই মতো—আমার অভিন্ন।

কিন্তু তেমন আর রইলাম কোথায়? সবকিছু তো পাল্টে গেল।

গা গুলিয়ে উঠছে। ‘সেক্স’ এই শব্দটা, কিংবা তার প্রসঙ্গমাত্রও মনে এলেই গা গুলিয়ে উঠছে। বমি আসছে আমার। যদিও, ঋত্বিক যাই করে থাক, দোষটা কার তা সত্যিই আমি জানি না। দোষ অ্যাট অল আছে কি না কারুর। সেটাও বলতে পারি না। এতে দোষ ধরার পাটই নেই—নো কোয়েশ্চেন অফ ব্লেমিং এনিবডি, অন্তত ঋত্বিক তো তাই বলছে।

দোষটা পেলে কোথায়?

নো ওয়ান হ্যাজ সিনড। নো ওয়ান হ্যাজ বিং রং—ড! নো ওয়ান হ্যাজ লায়েড টু এনিওয়ান। নো ওয়ান হ্যাজ চিটেড এনিওয়ান। তোমার প্রবলেমটা কিসের? আমি তো তোমার প্রতি টোটালি ডিভোটেড। টোটালি লয়্যাল। টোটালি অনেস্ট। তুমিও তাই। এখানে পাপপুণ্যের আবার কী হলো?

তোমার কাছে আমার কিছুই গোপন নেই। আমার কাছেও তোমারও কিছু গোপন নেই। তাহলে? তবে আমাদের সমস্যা কিসের?

ওদের কলিগ ঐ মেমটা বিলেত থেকে এসেই তো যত গোল বাধালো। এমনও যে ঘটে এ সংসারে কে ভেবেছিল। ওদিকে সতীপুজো, সতীব্রত, সতীমন্দির হচ্ছে রাজস্থানে—আর এদিকে পদ্মিনীমাসির দলবল কী কাণ্ডটাই না করে বেড়াচ্ছে। ঐ—এমিলি? কী অদ্ভুত মেয়ে। অফিসে এতগুলি লোক থাকতে ঋত্বিককেই ধরে পড়ল?—”আমার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। সামনের হপ্তায় আমার ফিয়াঁসে আসছে। আমরা একসঙ্গে গোয়াতে বেড়াতে যাচ্ছি—তার আগেই খুব জরুরি একটা কাজ আছে—আমার মান বাঁচাও, ডু মি আ ফেভার! তুমি ভদ্র, তুমি সৎ, তোমাকে বিশ্বাস করতে পারা যায়। শুধু একটিবার! জাস্ট ওয়ান্স—প্লিজ হেলপ মি—এই ঊনত্রিশ বছর বয়সেও আমি ভার্জিন রয়েছি, এটা দেখলে আমার বর কী ভাববে? সে খুব স্মাট, তার অনেক কিছু এক্সপিরিয়েন্স আছে। আমার তেমন কিছুই নেই, কড়া ক্যাথলিক আপব্রিঙ্গিং ছিল—আমি মুখ দেখাতে (মুখ?) দেখাতে পারব না, আমার ভার্জিনিটি শেষে যদি ওকেই ভাঙতে হয়—ভেঙে দে বাবা, আমার মানটা রাখ—যা চাইবি তাই দেব। একটা বড় শিভ্যাস রিগালের বোতল দেব! ন্যাপোলিয়ন ব্র্যান্ডি দেব!”

ঋত্বিক তো সেই শুনে হ্যাংলার মতন গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়ে কষ্ট করে তার কৌমার্য হরণ করে তাকে উদ্ধার করে দিয়ে হইস্কির ব্র্যান্ডির বোতল নিয়ে বীরগর্বে ফিরে এসেছে। আমাকে আবার আনন্দ করে বোতলগুলো দেখিয়ে সেই গল্প বলেছে। ছিঃ ছি, ছি। যেমন ও, তেমনি ওর সেই মেম কলিগ! ওরা কি পাগল, না কি রে বাবা? এমনও হয় নাকি? সাহেব বর ভারি দুঃখ পাবে স্ত্রী যদি ভার্জিন হয়? ভাববে, মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব আনঅ্যাট্রাকটিভ, তাই এতকাল কোনও পুরুষ মানুষ তাকে চায়নি। সময়টা কীরকম? সতী হলে লজ্জা? এত উল্টোপুরাণ!

আর দ্বিতীয় কারণও আছে একটা। শুনলে রক্ত মাথায় চড়ে যায়। কী? না—ওই ভার্জিনিটি পরিত্যাগ করার মূহূর্তটি নাকি বড়ই যন্ত্রণাদায়ক—স্বামীর সঙ্গে মিলনের প্রথম মুর্হূতটি মধুময় হোক, স্মৃতিসুখকর হোক—এটাও তিনি চান।

অতএব যন্ত্রণার অনুষঙ্গটা বাদ দিতে প্রথমবারের অভিজ্ঞতাটা হয়ে যাক দূর—পর অচেনা কারুর সঙ্গে, যার সঙ্গে প্রেম নেই। পুনর্বার যার সঙ্গে যোগাযোগের দরকারও ভবিষ্যতেও হবে না। এবং যে ব্ল্যাকমেইল করবে না। সৎ, ভদ্র, নীরোগ। দেখেশুনে সে বেছে নিয়েছে কাকে? না ঋত্বিককে। সুবোধ বালক। সেই সাপ জ্যান্ত গোটা দুই আন তো? ঋত্বিকই সেই সৎ, ভদ্র, আজেবাজে লোক। ফেকলু মেশিন। কিন্তু ঋত্বিক তুই কেন ব্যবহৃত হতে গেলি? তোর লজ্জা করল না। অপমানিত লাগল না? তুই তো জানিস ঋত্বিক আমি দিন গুনছি। তুই তো নিজেও ছিলি ভার্জিন—ওর ভার্জিনিটি তুই হরণ করলি, নাকি তোরই ভার্জিনটি ওই মেয়েটা কেড়ে নিল?

ধরো যদি কোনও অভাগা পুরুষ এসে আমাকে পায়ে ধরে ওই একই অনুরোধ করত, আর আমিও দয়াময়ী হয়ে সেটা কৃপা করে রক্ষা করতে যেতাম? তুমি কীরকম ভাবতে আমাকে?—তাহলে আমার বেলায় একরকম আর তোমার বেলায় অন্যরকম—এমনটা নিশ্চয়ই হওয়া উচিত নয় ঋত্বিক?

এর ফলাফলও খুব গোলমেলে হতে পারে?

তোরই ভাষায় বলছি, তুই বাড় খেয়ে ক্ষুদিরাম হতে গেছিলি ঋত্বিক। এটাতে শহিদ হোসনি।

দেওয়ালে এরকম আলো ছিল না সেদিন, তখনও গ্রীষ্মকাল, ঘুলঘুলি, জানলা, সবকিছু বন্ধ, সব ফাঁক সিলমোহর করে দিয়ে এ.সি. চালু করা হয়েছিল। অন্ধকার ঘরে, শুধু খুব নিচুতে নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছিল, দেয়ালের কাঁচের কুলঙ্গির মধ্যে। অন্ধকার যৎসামান্য হালকা ছিল সেই আলোটুকু ঘিরে। আর পদ্মিনীমাসি কথা বলছিল। ওর ছোটবেলার কথা। পদ্মিনীমাসির মেসোমশাইয়ের কথা।

পদ্মিনীমাসিকে তার ঠাকুমা মাঝে মাঝে মামাবাড়িতে পাঠাত। দিদিমার কাছে বেড়াতে যেতে পদ্মিনীমাসিও ভালোবাসত। দিদিমার কাছে বেড়াতে যেতে আমিও তো ভালোবাসতাম। যতদিন দিদিমা ছিলেন, দিদিমা আমাকে আহ্লাদ দিতেন মায়ের চেয়ে বেশি। দিদিমা আমাদের আদর করতেন। বোনকে, আমাকে, পদ্মিনীমাসির সঙ্গে শুধু এখানেই আমার মিল। ওর দিদিমাও খুব আদর করতেন ওকে। ওর তো মা ছিল না।

.

”মা—মরা মেয়ে ছিলাম তো, দিদিমা সবসময়ে বলত মামিদের, ‘ভালো করে খাওয়াবি মেয়েটাকে, মা—হারা শিশু’—তা মামীরা অযত্ন করত বলব না। কিন্তু শাশুড়ির চোখের মণিকে বৌরা কখনও বেশি পছন্দ করে না। তায় মামারাও তো খুব আদর দিত, মামাবাড়ির আদর যাকে বলে! মেসোমশাই ছিল ঘরজামাই। ছোটমাসির বর। ছোটমেয়েটি দাদুর এতই আদরের, তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে প্রাণে সয়নি, ঘরজামাই করে রেখেছিলেন জামাইকে। ছোটমাসির দুই ছেলেমেয়ে, আমার চেয়ে ছোট দুজনেই। ছেলেটা টুকাই, আমার কাছাকাছি, আর বুলান অনেক বাচ্চা। টুকাই আর আমি একসঙ্গে ঘুরতাম, খেলতাম, দুষ্টুমি করতাম। মামাতো দাদাদিদিরা সব অনেক বড় বড়। ছোটমাসি মানুষটা সাদা সরল ভালোমানুষ। আমার মায়ের সঙ্গে শুনেছি খুব ভাব ছিল। মায়েরা দুজনে পিঠোপিঠি বোন। মামাদের চেয়ে অনেক ছোট।”

পদ্মিনীমাসি চোখ বুজে একটু ভেবে নিল—”মামারা লোক মন্দ ছিল না, কিন্তু মেসোমশাই—একদিন আমাকে আড়ালে ডেকে বলল, ”শোন পদ্ম—তোকে একটা কথা বলি। তোর তো বিয়ে—থা দিতে হবে, তার আগে বড় হবার মন্তর তোকে শিখিয়ে দিই, মন্তরটা কিন্তু একদম গোপন রাখবি, কাউকে বলবি না, মাসিকেও না। এমনকী টুকাইকেও না।”

পারবি তো গোপন রাখতে? তবেই কিন্তু শেখাব, নতুবা নয়। আমি মহোৎসাহে বলেছিলাম, ”হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব পারব।”

—”তাহলে আজ দুপুরবেলায় সবাই যখন ঘুমোবে, টুকাইও ঘুমিয়ে পড়বে, তখন চুপি চুপি চিলেকুঠুরিতে চলে যাবি।”

এমনিতেই দুপুরবেলা ছাদে যাই ‘আচার পাহারা দিচ্ছি’ বলে আচার খেতে। আজও গেলুম। মেসোও এল একটু বাদে। আমাকে নিয়ে চিলেকুঠুরিতে ঢুকে দোরটাতে শিকলি তুলে দিল। তারপর তো বুঝতেই পারছিস—তখন আমার দশা।—নেবার মত কিছুই ছিল না, তবু কী পেল কে জানে?

খানিক পরে মেসো আমাকে ছেড়ে দিল। বলল, ”কী রে ভালো না? কারুকে বলবি না কিন্তু।”

বড় হবার মন্ত্রটা আমি সত্যি শিখে গেলাম। সারাজীবন কাজেও লেগেছে।

আস্তে আস্তে নেশা ধরে যাচ্ছিল—এমনি সময়ে আমার বাড়ি ফিরে যাবার সময় এসে গেল। মেসোর মন্তর ততদিনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। এও বুঝে গেছি যে এটা কাউকেই বলতে নেই।

তারপর আমি বড় হয়ে গেলাম। দিদিমা মারা যাবার পরে ঠাকুমা আর আমাকে অত মামাবাড়িতে পাঠাত না।

এরপরেই পদ্মিনীমাসি ভুরু তুলে নিচু গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল—”তোর এরকম মেসোটেসো কেউ ছিল না?”

—”নাঃ, আমার মেসোমশাইরা খুব ভালো।”

—”আমার মেসোও তো ভালই। দারুণ ট্রেনিং দিয়ে দিয়েছিল। সেইজন্যেই তো পাড়ার দাদারা এত মেয়ে থাকতে আমাকেই পাঁচিলের ধারে ডেকে নিয়ে যেত, আমাকেই ক্যাডবেরি দিত।”

সেই ক্যাডবেরির কথা ভেবে ঘেন্নায় লজ্জায় আমি ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠতাম আর পদ্মিনীমাসি নিজে নিজেই হেসে উঠে একটা সিগারেট ধরাতো।

.

একেবারেই আলাদা। তবু ওই মেমসাহেবের ঋত্বিকের সাহায্য নিয়ে নিজেকে স্বামীর জন্য প্রস্তুত করার ঘটনাটায়, আমার পদ্মিনীমাসির মেসোর গল্পটা মনে পড়ে গিয়েছিল।

যদিও জানি মূলত দুটোতে কোনও মিল নেই, তবু আমার মনে মনে কীভাবে যেন একটার সঙ্গে আরেকটার সুতো জড়িয়ে গিয়েছিল। জানি একটা স্পষ্টত অন্যায় অপরাধ, চাইল্ড অ্যাবিউজ, ক্রিমিন্যাল কেস, পুলিশে দিলে মেসোর মস্ত শাস্তি হবার কথা। অন্যটা ন্যায়—অন্যায়ের হিসেবের বাইরে। কোনও ক্রাইমের প্রশ্নই নেই, দুজন কনসেন্টিং অ্যাডাল্টের মধ্যে মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ব্যাপার। কন্ট্রাক্টের ব্যাপার। অথচ আমার মনে হয়েছিল, ঋত্বিকও একভাবে অ্যাবিউজড হয়েছে। পরোপকারের উদ্দেশ্যে না অন্য লোভে পড়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিয়েছে, পদ্মিনীমাসি যেমন দিয়েছিল। আমি বিশ্বাস করি না যে শুধু দামি স্কচের লোভে ঋত্বিক অনিচ্ছায় কিছু করবে—একটি তরুণী স্বর্ণকেশী বিদেশিনীর শরীরের প্রতি কৌতূহল কি আসলে কাজ করেনি এর মধ্যে? বাল্যকালের সেই ঘটনার পরে পদ্মিনীমাসির তো স্বভাবটাই পাল্টে গেছে, যা বুঝছি। তারপর থেকে পদ্মিনীমাসিকে তো মাঠেঘাটে—হাটেবাজারে, ট্রামেবাসে—ট্রেনে—প্লেনে সর্বত্র সক্কলেই যথেষ্ট abuse করেছে, করে চলেছে, পদ্মিনমাসির কথাগুলো যদি সত্য হয়—আর ও নিজে প্রত্যেকটা ঘটনাকেই পজিটিভ সেকসুয়াল প্লেজার বলে উপভোগ করেছে। কোনওটাকেই অন্যায় ভাবেনি, বলপ্রয়োগ বা সুযোগ নেওয়া বলে মনে করেনি। উল্টে ভেবেছে সে নিজেই প্রত্যেকটা পুরুষকে abuse না হোক use করেছে, ফর হার ঔন প্লেজার। গল্পগুলো শুনে আমার কিন্তু মোটেই তা মনে হয়নি। পদ্মিনীমাসি যাই বলুক। এমিলিকে দেখে এখন ধারণাটা পাল্টাচ্ছে। মেয়েরাও দিব্যি দেখছি ছেলেদের ব্যবহার করে, used sanitary travel-এর মতো ফেলে দিচ্ছে। ঋত্বিকও এমনই একজন ব্যবহৃত পুরুষ। পদ্মিনীমাসি যেমন ব্যবহৃতা নারী।

এই ধরনের অভিজ্ঞতার ফল অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে, একটা আড়াল ভেঙে দেয় তো! পদ্মিনীমাসির যে এই পুরুষ—বাতিক, এই যে দেহসুখ সর্বস্ব জীবন—মনন, আমার মনে হয় এর জন্য সবচেয়ে দায়ী ওর বাল্যকালের মেসোর সঙ্গে সেই এক্সপিরিয়েন্স। আমরা কতটুকু বুঝব তার যন্ত্রণা। এখন ঋত্বিকের জীবনে যেটা ঘটল, কতদূর বিধ্বংসী হতে পারে তার প্রতিক্রিয়া? তাতে ওরও যদি পদ্মিনীমাসির মত নেশা ধরে যায়? যে কোনও মেয়ে ইশারায় ডাকলেই ও যদি সাড়া দেয়? এই কাজটা তো দেহজীবীর কাজই হল। তাই না? কে জানে ঋত্বিকের ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষতি হয়ে গেল, মূল্যবোধে কতটা চিড় ধরল ওর? এসব ঘটনা ফাঁকা যায় না, জীবনে ছাপ ফেলে যায়। পদ্মিনীমাসির তো সারাটা জীবনই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে—ঋত্বিকেরও যে হবে না তার গ্যারান্টি কী?

পদ্মিনীমাসি যে এমনভাবে যা খুশি তাই করে বেড়ায়, এবং সগর্বে বলে বেড়ায় যে করে বেড়াচ্ছে, গোটা ব্যাপারটার ভেতরে অদ্ভুত একটা আকুলতা, একটা অস্থিরতা আছে, তার খানিকটা আমি বুঝতে পারি। আবার পারিও না। পদ্মিনীমাসি এত গুছিয়ে গল্প করে, ওর কোন কথাটা সত্যি, কোনটা যে মিথ্যে, তাও বুঝতে পারি না। পদ্মিনীমাসিকেই বুঝতে পারি না আমি। কখনও গুচ্ছের টাকা খরচ করে রাজ্যের দামি দামি খাবার কিনে আনে বাইরে থেকে, মিসেস মিত্রকে খাওয়ায়, আমাকেও খাওয়ায়—আবার মাসের পর মাস মিসেস মিত্রর টাকা দেয় না—আমার কাছে একশো টাকা, পঞ্চাশ টাকা ধার করে ট্যাক্সিভাড়া মেটায়।

ইয়েস, ডক্টর মজুমদার, বিলিভ মি, আই নো পদ্মিনীমাসি ডিড দিস টু মি। শি টুক আওয়ে ঋত্বিক ফ্রম মি। শি ড্রোভ ক্রেজি। ঋত্বিকের মাথা খারাপ করে দিয়েছিল ও।

—শুনুন। শান্ত হোন। অল ইজ নট লস্ট। ওকে ফেরানো যাবে।

—ফোন ধরছে না।

—রাইট আ লেটার টু হিম। এক্সপ্লেইনিং ইট অল।

—ঋত্বিক কি পদ্মিনী সিং—কে চিনত?

—হ্যাঁ, আমার কাছে কত গল্প শুনেছে। মিটও করেছে।

—তবে ভাবনা নেই। হি উইল বিলিভ ইউ। হি উইল আনডারস্ট্যান্ড। রিল্যাক্স। মিস ব্যানার্জি, আপনি একটু রিল্যাক্স করুন—ঋত্বিক ফিরবে।

আমি বলছি, ওটা টেমপোরারি উইথড্রয়াল। আপনি পদ্মিনী সিংয়ের যাবতীয় অ্যাডভাইস ভুলে যান।

—কেমন করে ভুলব? পদ্মিনীমাসি তো এখনও রোজ রাত্রে এসে কথা কইছে। শি ভিজিটস মি এভ্রি নাইট। অ্যান্ড ড্রাইভস মি ক্রেজি উইথ হার ফিলথিনেস—

—ইয়েস, আই নো, বাট ইট উইল স্টপ নাও।

উনি আর আসবেন না। ইউ টেল হার টু গো আওয়ে। আপনি ওঁকে বলুন আর কোনওদিন না আসতে। বলুন, আপনি ওঁর গল্প শুনবেন না। বলুন ওঁর উপদেশ আপনার পছন্দ হয় না। বলুন, নেভার টু কাম ব্যাক। আস্ক হার টু ফাইন্ড হার পিস ইন হেভেন। টেল হার ইউ ডু নট ওয়ান্ট টু সি হার এগেইন। মেক ইট ভেরি ক্লিয়ার।

—শি হ্যাজ ফাউন্ড হার পিস ইন ডেথ। শি টোলড মি। ও আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। আই কু’ডন্ট স্ট্যান্ড ইট এনি মোর। সারাক্ষণ শুধু ডার্টি স্টোরিজ—ডার্টি জোকস—আমাকে বই পড়তে দিত না—আমাকে গান শুনতে দিত না—ভাবনাচিন্তা করতে দিত না, ওকে না মারলে, আমিই মরে যাচ্ছিলাম—আমাকে কেউ বিশ্বাস করছে না—কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন ডক্টর মজুমদার—রোজই আমি মনে মনে ভাবতাম, কীভাবে ওর কফিতে বিষটা মিশিয়ে দেব। সেই নীল পাথর বসানো ছোট রূপোর কৌটায় ওর প্রচণ্ড কড়া ঘুমের ওষুধ থাকতো, আমি তো সেটাই—আমি সেইটাই—

—কাম ডাউন মিস ব্যানার্জি…

সারাক্ষণ শি ইউজড টু থিংক অফ কিলিং হারসেলফ—কখনও বলত সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দেবে, কখনও বলত মেট্রোর সামনে লাফাবে। কখনও বলত বটানিক্সের বুড়ো বটগাছটা থেকে গলায় দড়ি দেবে—কখনও বলত বিষ খাবে—বেঁচে সুখ ছিল না ওর। অথচ মরবার মতো মনের জোর ছিল না। আটঘাট বেঁধেও মরতে পারছিল না—তাই আমিই ওকে মুক্তি দিলাম—শি ওয়ান্টেড ইট, আই হেল্পড হার আউট—ঋত্বিককে কথাটা বললাম, ও বিশ্বাস করল না। মিসেস মিত্রকে বললাম, মিসেস মিত্র তো আপনার কাছেই আমাকে নিয়ে এলেন।

ওরা দুজনেই বলছে—এটা আমার মনের ভুল—

—মিস ব্যানার্জি, ইট হ্যাভ এভরি রিজন টু গেট কনফিউজড। আপনার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন মিসেস সিং উইথ হার রিলেন্টলেস সেক্স টকস—দিস ইজ আ কাইন্ড অফ অ্যাবিউজ—ইউ ওয়্যার ভার্বালি অ্যাবিউজড—কন্টিনুয়াসলি, ফর টু ইয়ারস—দ্যাটস অ্যান ইনরমাস স্ট্রেন অন ইওর নার্ভস—আপনার তো কনফিউশন হতেই পারে! ট্রাই টু গেট আউট অফ ইট, ইউ মাস্ট ট্রাই—একটু সচেতনভাবে চিন্তা করুন, চেষ্টা করুন ব্যাপারটা বুঝতে—যুক্তি দিয়ে বুঝতে, সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ সর্বদা যে ফিজিক্যাল হয় তা কিন্তু নয়, হোয়াট মিসেস সিং ওয়াজ ডুইং টু ইউ, ওয়াজ আ ফর্ম অফ সেকসুয়াল অ্যাবিউজ—শি ওয়াজ ডুইং ইট উইথ ওয়ার্ডস—ভার্বালি ওভার—পাওয়ারিং ইউ—রেপিং ইয়োর মাইনড—আপনার তো ওর ওপরে রাগ হতেই পারে। অ্যাবিউজের ভিকটিমদের প্রায়ই অ্যাবিউজারদের প্রতি একটা লাভ—হেট ফিলিং থাকে। আপনি একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন তো, কেন পদ্মিনী সিং—কে আপনি খুন করতে চাইবেন?

—কেননা, ও আমার ঘর ভেঙেছে। দুবার দুবার। আমার বাবাকে নিয়ে পালিয়েছিল, যখন আমি স্কুলে পড়ি। আবার আমার ফিয়াসেঁকে সিডিউস করেছে—ওর সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশন পাতিয়েছে—ওকে আমার কাছে থেকে সরিয়ে দিয়েছে—ডক্টর মজুমদার, ঋত্বিককেও নষ্ট করে দিয়েছে পদ্মিনীমাসি—শি ডিজার্ভস টু ডাই—শি হ্যাজ নো রাইট টু লিভ। আমাদের এতজনের জীবন নষ্ট করে আমরা তিন ভাইবোনই ঘরছাড়া, মা একদম বদলে গেছেন—ঐ পদ্মিনীমাসির জন্যে—ঋত্বিকও বদলে যাচ্ছে—

—কাম, কাম, মিস ব্যানার্জি, অত উত্তেজিত হবেন না। আপনার মায়ের কথা জানি না কিন্তু ঋত্বিককে আপনার কাছ থেকে কেউ সরায়নি—অ্যাকচুয়ালি ইটস হি হু ব্রট ইউ টু মি। হি হ্যাড টকড টু মি ওভার দ্য ফোন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *