অ্যালবাট্রস – ১

এক

—প্লীজ, মিস ব্যানার্জী, স্টপ টরচারিং ইওরসেলফ। আপনি ছদ্মবেশে কোথাও যাননি, সন্ধ্যার পরে নিজের রুমেই ছিলেন। প্লীজ, বিলিভ মি, দিস ইজ হোয়াট হ্যাপেনড…

—এক্সকিউজ মি ডক্টর মজুমদার, আপনি আমার কথাটাই বিশ্বাস করুন, বিকজ আই অ্যাম দি ওনলি পার্সন হু নোজ এগজ্যাক্টলি হোয়াট হ্যাপেনড দ্যাট ইভনিং…আর কেউ জানে না… কে—উ—না। কেউ ছিল না সেখানে, শুধু আমি আর পদ্মিনীমাসি… কেবল আমরা দুজন…

—ওকে, ওকে, মিস ব্যানার্জি, লেটস টক অ্যাবাউট সামথিং এলস, অন্য বিষয়ে কথা বলি বরং, ওটা থাক, ওটা বড্ড ডিপ্রেসিং বিষয়…বরং আপনার ছোটবেলার কথা একটু বলুন শুনি—হোয়্যার ডিড ইউ গ্রোআপ?

— ছোটোবেলা? আমি তো চন্দননগরের মেয়ে। মফঃস্বলে বড়ো হয়েছি, গঙ্গার ধারেই বাড়ি ছিল আমাদের। ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটেছি, বাগান ছিল, পেয়ারাগাছে, আমগাছে চড়েছি। মার সঙ্গে সংসারের কাজকর্মও করেছি, সাইকেল চড়ে স্কুলে গেছি—মিশনারি স্কুলে পড়তাম—রেডিও শুনেছি—টিভি দেখেছি—গান শুনেছি— যেমনভাবে মফঃস্বলে ছোটরা বড়ো হয়।…

—আপনারা ক’ভাই বোন?

—আমরা তিনজন। আমরা দুই বোন, আর দাদা।

—বাবা কী করেন?

—তখন তো ভালোই চাকরি করতেন, কলকাতার একটা বিদেশি ফার্মে, সারা সপ্তাহ কলকাতায়, উইকএন্ডে বাড়ি আসতেন, প্রত্যেকের জন্য কিছু না কিছু উপহার নিয়ে—আমরা বাবার পথ চেয়ে থাকতাম…।

—তারপর?

—তারপর একদিন আর এলেন না। হি স্টপড কামিং হোম। হি লেফট আস। অ্যাবানডনড আস। যেমন হয়ে থাকে। আ উওম্যান গট হোলড অফ হিম। নাথিং নিউ।

—আই অ্যাম সরি, মিস ব্যানার্জি। লেটস ড্রপ দ্যাট ট্রপিক। তারপর, আপনি কলকাতায় এলেন কবে?

.

না, এভাবে চলতে পারে না।

চোখ খুলে শুয়ে আছি, অথচ মনের মধ্যে ঘুম। জানালাটা বন্ধ, তবু আলো আসছে। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো এসে দেয়ালের ওপরে ডিজাইন বানাচ্ছে। খড়খড়ি নয়, আলোটা আসছে ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে—এ বাড়ির ঘুলঘুলিতে ডিজাইন করা সিমেন্টের গ্রিল বসানো আছে। আলোটা মরা আলো। দিন শেষের আলো। এই আলোটা খাটে শুলেই চোখের সামনে এসে নাচানাচি শুরু করে দেয়। ঘুলঘুলি দিয়ে ঘরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। ইনফিলট্রেট করে। ইনফিলট্রেশন। ‘অনুপ্রবেশ!’ কথাটা বেশ লাগে। লুকিয়ে চুরিয়ে ঢুকে পড়া। পদ্মিনীমাসিও অনুপ্রবেশই করেছে আমার মধ্যে। আমার জীবনের মধ্যে। আমার বাঁচা—মরার মধ্যে। আমার সব চিন্তাভাবনা, আমার স্বপ্ন—কল্পনা, সর্বত্র। কোথাও আর এতটুকু ফাঁক নেই যেখানে পদ্মিনীমাসি ওই অধরা আলোর মতো নাচানাচি করছে না। পদ্মিনীমাসির বগলকাটা ব্লাউজের তলা থেকে উপচে পড়া শরীরের মতো উপচে পড়ছে ওর যত ভাঙাচোরা ভাবনাচিন্তাগুলো, আমার নিয়মিত নিয়ন্ত্রিত মনের ভেতর থেকে। আমি দিব্য দেখতে পাছি। এতে আমার কোনও হাত নেই।

তুড়ুক তুড়ুক করে আলো লাফাচ্ছে। দেয়ালের সাদা গায়ে আলো ঘুরপাক খাচ্ছে। ক্যালাইডোস্কোপ? দূর, ক্যালাইডোস্কোপ কেন হবে? তা নাই যদি হবে, আলোর ডিজাইনগুলো বদলে যাচ্ছে কেন তবে? ঘুলঘুলির গ্রিলের ডিজাইন তো বদলাচ্ছে না। তবে, এই যে আলোর বিচিত্র ঘূর্ণি, এই যে সুদৃশ্য স্লাইড—শো চলেছে, এর মানে কী?

এটা কেমন করে হচ্ছে? এটা কার কাজ? এবং এটা কেন করা হচ্ছে? আমার ঘরেই বা কেন? আমাকে সেটা জানতে হবে। জানতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না।

খাটে শুয়ে শুয়ে আলোর নাচ দেখছি। নাচ? না নাচন? আলোর নাচন। নাচে আলো নাচে রে ভাই আমার প্রাণের কাছে। প্রাণের খুব কাছাকাছি চলেছে আলোর নাচন। দেয়ালে এখনই অন্ধকার একটু একটু করে নামবে। বাইরে পাখির ডাক, কূজন, কলকাকলি শোনা যাচ্ছে। তার মানে সন্ধে হচ্ছে। সন্ধের পর এই আলোগুলো কেউ বদলে দিয়ে যায়।

পদ্মিনীমাসি বলত ছোটবেলায় ওদের পথে গ্যাসলাইট ছিল। একটা লম্বামতো লোক কাঁধে মই নিয়ে ঘুরে বেড়াত, আর একটা একটা করে গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দিত। তখন মাসিরা বাড়ি ফিরত, পাড়ায় খেলা শেষ। সন্ধ্যা, অফিশিয়ালি ডিক্লেয়ারড।

এই দেয়ালের আলোর নাচনটা পালটে যায় রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো জ্বলে উঠলেই। আমি গ্যাসলাইট দেখিনি তবে এই বৈদ্যুতিক বাতিও কিছু কম রহস্যময় নয়। পদ্মিনীমাসি বলত গ্যাসলাইটের আলোয় আবছা আলো—আঁধার তৈরি হত, আরও যেন গা ছমছমে, আর শীতকালে তো কথাই নেই! উনুনের ধোঁয়ার জালের সঙ্গে ঐ গ্যাসবাতির আলো জুড়ে আচ্ছন্ন করে ফেলত গোটা পাড়াটাকে। সবই কেমন ঢেকে যেত রহস্যে—আকাশেও কুয়াশা, তারাগুলোকে ঢেকে রাখতো মানুষের চোখের নাগাল এড়িয়ে। আর তখনই ঐ ছায়া ছায়া আঁধারে পদ্মিনীমাসির সঙ্গে পাড়ার ছেলেরা ক্লাবের মাঠে দেয়ালটার ওপাশে। যেখানে ঝোপঝাড়। মানকচুর ঝোপ, দুটো বুনোকুল গাছ আর একটা কামিনীফুলের ঝাড় ছিল, সেইখানে গিয়ে ঐসব কীর্তিকলাপ করত। পদ্মিনীমাসি বলত। ছি ছি, পিউ, তুই কী রে? এত বয়েস হল, এখনও এসব মজা করতে শিখিসনি?

—ওরে বাবা, পদ্মিনীমাসি আমার ওসব শিখে কাজ নেই!

পদ্মিনীমাসির লজ্জাশরম বলে কিছু ছিল না। আশ্চর্য মেয়েমানুষ সত্যি। কী যে না বলতে পারে। কী যে না করতে পারে। ওর মুখে কিছুই আটকায় না! ছিঃ! শুনতে শুনতেই সারা গা ঘেমে যেত আমার। সন্ধে হলে ক্লাবের মাঠে গিয়ে পাড়ার বড় ছেলেদের সঙ্গে পদ্মিনীমাসি ছোটবেলাতে যা যা করত, স—ব আমাকে বলা চাই। কত কতদিন আগেকার কথা সে সব। অথচ পদ্মিনীমাসি কিছুই ভোলেনি, সব ডিটেইলস মনে আছে এখনও। ভোলাদা কেমন করে কী করেছিল, আর মণ্টুদা কেমন করে কী করেছিল। আমি যত বলি মাসি আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে, আজ থাক, কাল অফিসে তাড়াতাড়ি পৌঁছুতে হবে। মাসি ততই ফিসফিস করে বলে যাবে। কোনখানে কত সুখ, সেই ছোটবেলা থেকেই সব জেনে গেছে পদ্মিনীমাসি, সব শিখে গেছে। ওর যে মা ছিল না। বাবা আপনমনে ঘুরে বেড়াত পার্টির কাজ নিয়ে। ঠাকুমা বুড়ি মানুষ অত সামাল দিতে পারত না নাতনীকে।

পদ্মিনীমাসি ছিল সারা পাড়ার মক্ষিরানী।

—আচ্ছা পিউ, তোর ঠিকঠাক বয়েস কত হল বল দিকি?

—তোমার বয়েস তো আমি জিজ্ঞেস করিনি পদ্মিনীমাসি। তুমি কেন আমারটা জানতে চাইছো?

—তুই কি ভার্জিন? এখনও শুসনি কারুর সঙ্গে?

লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল আমার, রাগেও।

দূর! কী সব কথা! কিন্তু মুখে বলি—

—তোমার তা দিয়ে কী হবে, পদ্মিনীমাসি?

—আমার আর কীই বা হবে! তোমাকেই জীবনে একটু গাইডেন্স দিতে পারতাম এই আর কি। সারাজীবনে তো শুধু লেখাপড়াই করলে, লক্ষ্মীমেয়েটি হয়ে রইলে। না করলে প্রেমপ্রণয়, না করলে কোনও এক্সাইটিং অ্যাডভেনচার।

—কখনও করব না তো বলিনি?

—আর কবে করবে সোনামণি?

—হোয়েন ইউ উইল স্টার্ট লিভিং মাই ডার্লিং চাইলড? গেট আপ অ্যান্ড গেট গোয়িং।

—ইউ হ্যাভ আ গরজাস বডি—পদ্মিনীমাসির চোখগুলো চকচক করত,—লুক অ্যাট ইওরসেলফ ইন দ্য মিরর এভরিডে, আন্ড লাভ ইওরসেলফ আ লিটল বিট মোর। কী সুন্দর ফিগার রে, তোর কী সরু কোমর, কী অপূর্ব পাছা—সাহেব—মেমগুলো যাতা—ওরা পাছার মর্ম জানে না, আসল বাহারটিই বোঝে না মেয়েদের ঊরু নিতম্বের—ঐ যে টুইসি, ওটা একটা ফিগার হলো? দুদিক চ্যাপ্টা?

আমার ফিগারটা এখনও পর্যন্ত বলতে নেই, বেশ ভালোই রেখেছি, কী বল?

পদ্মিনীমাসি কথা বলতে বলতে উঠে পড়ত—বড় লম্বা আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াত।

সুন্দরী ঠিকই। বয়েস হয়েছে। তবু সুন্দরী।

ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখত, পদ্মিনীমাসি। নানারকম ভঙ্গি করত, ‘বিভঙ্গ’ বলাই ঠিক, মডেলরা যেমন করে র‍্যাম্পে দাঁড়ায়, যেমন করে হাঁটে, যেইভাবে হাঁটাচলা করত আয়নার সামনে। নিজেই নিজের বুকের মাপ নিত, লজ্জার বালাই নেই, যেন ফল কিনতে গেছে বাজারে—

তারপর বলত, পিউ, এদিকে আয়, একটা জিনিস তোকে শেখাই—

আমি বরং যাই টিভিরুমে গিয়ে বসি।

—কেন কেন, যাবি কেন, আরে, তুই থাকলে আমার কিছু অসুবিধে নেই—অনেস্টলি…এটা শেখা জরুরি…

.

পদ্মিনীমাসির অসুবিধা ছিল না, কিন্তু আমার তো ছিল।

পদ্মিনীমাসির এই অসঙ্কোচ বেহায়াপনা আমার সহ্য করতে কষ্ট হতো। আমি উঠে বাইরে চলে যেতাম।

প্রথম প্রথম পদ্মিনীমাসিকে দেখে আমার মনে হতো যেন কোনও অন্য গ্রহের প্রাণী। যেমন সাজগোজ, তেমনি আচরণ। তেমনি কথাবার্তা। সবই অতি উচ্চগ্রামে বাঁধা, সবই অতি স্থূল।

পদ্মিনীমাসিকে মিসেস মিত্র ডাকেন ‘প্যাডি’ বলে। ওর সব বন্ধুবান্ধবীর কাছেই উনি প্যাডি। যদি নামটি ছোট করে বলতেই হয় তবে ‘প্যাডি’ কেন, ‘মিনি’ কেন নয়, এটাও আমার কাছে রহস্য থেকে গেছে, একটা আনসলভড পাজল।

পদ্মিনীমাসি সংক্রান্ত আরও অনেক বিষয়বস্তুর মতোই।

.

—সারারাত্রি উনি এত কী বলতেন আপনার কাছে?

—আমার কাছে? ওঁর জীবনের যত কথা, অভিজ্ঞতার গল্পগুলো সব করতেন আর কি—

—জীবনের যত কথা? তার মানে? কীরকম অভিজ্ঞতা?

—মানে, ছোটবেলা—বড় হওয়া—বিবাহিত জীবন—কাজকর্ম—বন্ধুবান্ধব—এইরকম —সুখদুঃখের কথা—

—কী ধরনের কাজকর্ম?

—এই যা যা করেছে আর কি। ও তো অনেক ধরনের কাজ করেছে? হ্যামবার্গার বিক্রি, আর্টিস্টের ন্যুড মডেল হওয়া থেকে দোকানে মেয়েদের ব্র্যান্ড নেম আন্ডারওয়্যার বিক্রি, এভন কসমেটিক্স সেলসগার্ল, দোকান দেওয়া, ব্যবসা, বাচ্চাদের ক্রেশে কাজ। টোরোন্টোয় ওর নিজের দোকান ছিল। বিজনেস ছিল—ক্যানাডায় দোকানও ছিল। হোটেলের রিসেপশনিস্ট; অ্যাড কোম্পানিতে মডেলিং, কমার্শিয়াল ফার্মে পাবলিক রিলেশনের কাজ, ফিল্মের নায়িকাদের সেক্রেটারি, কী না করেছে পদ্মিনীমাসি? তা ছাড়া ও খুব ঘোড়া বুঝতো।

—ঘোড়া? ওঁর ঘোড়া ছিল বুঝি?

—ঘোড়া ছিল না। কিন্তু রেসের মাঠে খুব প্রতিপত্তি ছিল। কবে কোন ঘোড়া জিতবে, কীসব অঙ্ক কষে ঠিক ঠিক বাতলে দিতে পারত। ঘোড়াদের ঠিকুজি—কুলুজি জানত। কোন ঘোড়ার বাবা কে, মা কে, ঠাকুর্দা কে—কে কবে কোন রেসে জিতেছিল, কাদের এগেনস্টে, সব কিছু ওর জানা ছিল। বইপত্তর ছিল। ইদানীং সেকেন্ডহ্যান্ড ল্যাপটপ কিনেছিল। ইন্টারনেটে খবর সংগ্রহ করবে বলে। ওটাই ওর উপার্জনের ‘সোর্স’ ছিল বলে মনে হয়।

—খুব ইন্টারেস্টিং মহিলা তো?

—হ্যাঁ। খুব ইন্টারেস্টিং।

—ওঁর বন্ধু—বান্ধব কেমন ছিল?

—ছিল, সারাদিন ফোন আসত। এককালে প্রচুর বয়ফ্রেন্ড ছিল ওর।

—বয়ফ্রেন্ডদের গল্প করতেন? না রেসের ঘোড়ার গল্প?

—রেসের ঘোড়ার গল্প আমার কাছে খুব একটা করত না। ফোনে যখন বলত শুনতাম। ওটা ওর কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট—রেসের ব্যাপার নিয়ে আমাকে তেমন কিছুই বলত না। আমি তো বুঝি না।

—তবে আপনাকে কী বলতেন। সারারাত্রি ধরে?

—ঐ তো, আপনিই তো বললেন। বয়ফ্রেন্ডদের গল্প।

—প্রেজেন্ট বয়ফ্রেন্ডদের কথা, না পাস্ট?

—পাস্ট—প্রেজেন্ট দু’রকমই। তবে পাস্ট—টাই তো বেশি দীর্ঘ, সেই গল্পটাই বেশি বেশি। চারবার তো বিয়েই করেছিল—তা ছাড়া, বহু এক্সপিরিয়েন্স—

—আপনার শুনতে ভালো লাগত?

—প্রথম প্রথম ভালোই লাগত। অন্যরকম জীবন ত? আমরা মফঃস্বলে বড় হয়েছি একরকমভাবে—গাছপালা, নদী, আকাশ, বই, গান, পরিবার—পড়শি, সবকিছু মিলিয়ে একটা নিজস্ব পরিচিত জগৎ ছিল আমাদের। সেটা পদ্মিনীমাসির আন্তর্জাতিক জগৎটা থেকে একেবারেই আলাদা তো? ওর তো কথায় কথায়, প্যারিস, লন্ডন, হংকং, ব্যাংকক, লস এঞ্জেলেস, লাস ভেগাস—অন্য একটা অনেক বড় একেবারে অচেনা পৃথিবী—ভালো লাগবে না? মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।

কিন্তু পদ্মিনী সিং তো বাঙালি মেয়েই—উনি কোথাকার? কলকাতার? না মফঃস্বলের?

.

মিসেস মিত্রের এই গেস্ট হাউসে আমি যখন এলাম তখন কেবল একটা ডাবলরুমে একটি সিটই খালি ছিল। এক : বাড়িটির সিকিওরিটি সিস্টেম ভাল, একা মেয়ের থাকার পক্ষে সেটা জরুরি। দুই : বাড়িটা থেকে সোজাসুজি আমার অফিসের জন্য মেট্রো ধরা যায়। তিন : মিসেস মিত্রকে আমার খুব ভালো লাগল। এবং চার—চারনম্বরটাই এক হওয়া উচিত ছিল। খরচটা আমার পার্সের উপযুক্ত। ভদ্রপাড়ায়, ভদ্রমহিলার পরিবারে, ফোন, টিভি, ফ্রিজের ব্যবহার ও ব্রেকফাস্ট, ডিনারসমেত এ.সি. রুম। সবচেয়ে চমৎকার কথা এসির জন্য গরমকালে একটা আলাদা সারচার্জ দিতে হবে, সারাবছর ধরে অতিরিক্ত কড়ি গুনতে হবে না। ছ’মাস ভাড়া কম, অক্টোবর টু মার্চ। আর এ.সি. না চালালে, সারচার্জটা দিতে হবে না। অত্যন্ত সৎ ও ভদ্র বন্দোবস্ত। অবশ্য দু’জনের মত চাই! ডবলরুম মানে বেশ বড়সড় ঘরে দুটি সিংগেল খাট, দুটি পড়ার টেবিল—চেয়ার, দুটি টেবিলল্যাম্প এবং দুটি আলমারি। তার একটিতে লম্বা আয়না আঁটা। আলাদা ড্রেসিং টেবিল নেই। বাথরুম অ্যাটাচড, তাতেও বেশ বড়সড় একটা আয়না আছে। গিজার আছে। ভারি পছন্দ হয়ে গেল আমার মিসেস মিত্রের গেস্ট হাউস। ঘরের দেওয়ালের হালকা পিচ রঙটার সঙ্গে ম্যাচ করে দরজা জানলার পর্দা, বেডকভার, টেবিলক্লথ—মহিলার রুচি সুন্দর। এমনকী বাথরুমেও কমোডের সঙ্গে ম্যাচ করে বেসিনের রঙ পিচ। দেওয়াল সাদা টালির। তোয়ালে আমাদের তাই দু’ সেট করে—একজনের পীচ, অন্যজনের সাদা। যাতে এর সঙ্গে ওরটা গুলিয়ে না যায়। এ সবই খুব যত্ন করে মিসেস মিত্র আমাকে বুঝিয়ে বলে দিয়েছিলেন প্রথম দিনেই। একমাত্র অপছন্দ হয়েছিল দেওয়ালের ছবিগুলো। কাঁচা কাঁচা অয়েলপেন্টিং।

—কী সব হাবিজাবি ছবি বাঁধিয়ে রেখেছেন কড়ারঙের ফলফুলের ছবি। একটা আল্পস শিখরে ছবিওলা ক্যালেন্ডার আছে, সেটা বরং সুন্দর। ওটা বোধহয় সুইৎজারল্যান্ড। জানি না কোনওদিনও সশরীরে যাওয়া হবে কি না। পদ্মিনীমাসি ওখানেও গিয়েছে। অনেক গল্প আছে ওর সুইৎজারল্যানডের রোমান্সের। যখন ঘরটা নিলাম, তখনই পদ্মিনীমাসি সেখানে অধিষ্ঠিতা, কিন্তু ওই সময়টায় দিল্লি গিয়েছিল কোনও কাজে। আমি ঢুকে ছিলাম খালি ঘরে, একটা আলমারির মাথায় শুধু সুটকেস ছিল একটা। এখনও ঘরটা খালি। আয়না, আলমারির মাথায় সুটকেসটাও পুলিশ নিয়ে গেছে।

 ব্রেকফাস্ট খাবার নিয়ম এখানে দু’রকম। ইচ্ছে করলে ঘরেও নিয়ে আসা যায়। তবে তোমাকে নিজে রান্নাঘরে গিয়ে ট্রে নিয়ে আসতে হবে। আবার খাওয়ার শেষে ট্রে রান্নাঘরে রেখে আসতে হবে। এবং টেবিল বা মেঝে নোংরা করলে পরিষ্কার করতে হবে। আর খাবার টেবিলে গিয়ে বসলে, মিসেস মিত্র ওখানে তোমাকে সার্ভ করবেন। আমার সেটাই পছন্দ। হাউসকোট পরেই গিয়ে বসা অ্যালাউড। অ্যালাউ না করে উপায় নেই কেন না মিসেস মিত্র নিজে দিবারাত্র হাউসকোটের মধ্যেই জীবনযাপন করেন। একটু স্থূলাঙ্গী। কিন্তু সুন্দরী, চুলে হেনা, ঠোঁটে লিপস্টিক, ভুরু প্লাক করা, দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে—ছেলেটি বিদেশেই সংসার পেতেছে। মেয়েরা আসাযাওয়া করে। স্বামী মারা গেছেন রিটায়ার করবার দিন সকালবেলায়। তাঁর সেদিন ফেয়ারওয়েল মিটিং ছিল অফিসে— সেটাই কনডোলেন্স মিটিঙে পরিণত হয়েছিল। মিসেস মিত্র সেই মর্মান্তিক ঘটনাটি ভুলতে পারেন না—নানা কথার মধ্যে এই কথাটি ঘুরে ফিরে এসে পড়ে।

”সারা জীবন পরিশ্রম করলেন, একটি দিনের জন্যও অবসর উপভোগ করতে পারলেন না। ছুটি কাকে বলে। অবসর যাপন কাকে বলে। ভগবান ওকে সেটা বুঝতেই দিলেন না—আমাদের কতরকম প্ল্যান ছিল। এই যে অ্যাটলাসটা দেখছ, এই গ্লোবটা, এসবই পৃথিবী দেখতে বেরুবার জন্যে। তো উনি তো আকাশ থেকে সবই দেখে নিচ্ছেন। আমারই যাওয়া হল না। ওঁর কাজ থামল, আমার কাজ শুরু হল।”—

শেষপর্যন্ত স্বামীর জন্য দুঃখপ্রকাশ এইখানে এসে থামত। ফেয়ারওয়েল মিটিঙে মিস্টার মিত্রকে উপহার দেবার জন্য যা কিছু কেনা হয়েছিল, সে সবই অফিস—কলিগরা মিসেস মিত্রকে দিয়ে যায়। এই চমৎকার দেওয়ালজোড়া অ্যাটলাস, এই আলোজ্বালা গ্লোব—এ সব তাঁরই শখের জিনিস। প্ল্যান ছিল রিটায়ারমেন্টের পরেই স্বামী—স্ত্রীতে মিলে রাউন্ড—দ্য—ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বেরুবেন, শরীর বিকল হয়ে পড়বার আগেভাগেই। পৃথিবীর নানান জায়গায় মিস্টার মিত্রের নানান প্রিয়জন পরিচিতজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। প্ল্যান হয়েছিল সকলের সঙ্গে দেখা করে করে বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে বেড়ানোর। তারপর ছেলের কাছে ক’দিন গিয়ে থাকা। ছেলে তখনও ছাত্র। ফেরার সময়ে আবার আধখান পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে দেখতে দেখতে ঘরে ফেরা। আর দু’মাস বাদেই ট্যুরটা শুরু হচ্ছিল। রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট যাবতীয় গুছিয়ে নিতে মাস দুয়েক লেগে যাবে—তারপরেই দে—ছুট।

—সে সব তো কিছুই আর হল না। তখন মেয়েরাই বুদ্ধি দিলে, ”এতবড় ফ্ল্যাট খালি রেখে কী করবে মা? বাড়ি খাঁ খাঁ করবে। বাবা নেই, তোমারও আর কাজ নেই কোনও—বরং কয়েকজন পেয়িং গেস্ট রাখো। উপার্জনও হবে, তোমার সময়টাও ব্যস্ত থাকবে তাদের দেখভাল করা নিয়ে। কত আর টিভি দেখবে। ফেমিনা পড়বে?”

বড় মেয়েটি থাকে দুর্গাপুরে। ছোট ব্যাঙ্গালোরে। কিন্তু মার খোঁজখবর করে, যাওয়া—আসা করে দু’জনেই। দুর্গাপুরে বড়জামাই সরকারি চাকরি করে, মেয়েও স্কুলটিচার। ছোট মেয়ে— জামাই দুজনই ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করে। আই. টি. এক্সপার্ট তারা। কিন্তু স্বামীটি বোধহয় অতটা ব্রাইট নয়। স্ত্রীই বেশি মাইনে পায়। কিন্তু দু’জনে ভাব—ভালোবাসা খুব। অন্তত মিসেস মিত্র তাই বলেন। তাই হোক বাবা, তাই হোক। ভালো থাকুক।

স্বামী—স্ত্রী এক প্রফেশনে থাকলেই নানা সংঘাত তৈরি হয়, আর স্ত্রী যদি বেশি উন্নতি করে, তবে তো কথাই নেই। মিসেস মিত্র যাই বলুন, আমি মনে মনে একটু সন্দিহান। ছোট মেয়েটি বারকয়েক এসেছে ইতিমধ্যে, জামাই তো এল না একবারও? অবশ্য মেয়ে আসে মিটিংয়ে, সেমিনারে। জামাই যদি অতটা উন্নতি না করে থাকে, নেমন্তন্নই বা পাবে কেন?

এসব অবশ্য আমার মস্তিষ্কজাত নয়। পদ্মিনীমাসিরই মন্তব্য এগুলো।

পদ্মিনীমাসি নিজেই নাকি এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল, ওর প্রেমিক ওকে ভীষণ হিংসে করত। তাই তো পদ্মিনীমাসি তার প্রফেশনই বদলে ফেলল—এক্কেবারে অন্য জগতে চলে এল যেখানে প্রেমিকের সঙ্গে সংঘাত হবে না। পদ্মিনীমাসির মতে, বয়ফ্রেন্ডদের সর্বদা অন্য ক্ষেত্র থেকে বেছে নিতে হয়। বয়ফ্রেন্ডরা বেশিদিন নিজের বিষয়ে নিজের থেকে বেশি সাকসেসফুল মেয়ের প্রেমে পড়ে থাকতে পারে না—হিংসেয় নীল হয়ে শত্রুতা শুরু করে দেয়। কিংবা স্রেফ পালায়। অন্যত্র, দুর্বলতর মেয়ে খুঁজে নেয় নিশ্চিন্তে। প্রেম করবার জন্য। যেখানে সে নিজে সুপিরিয়র ফিল করবে।

ঋত্বিকের সঙ্গে আমার এ সব সমস্যা নেই। আমাদের সমস্যাটা পদ্মিনীমাসিকে বললেই নির্ঘাত একটা ব্যাখ্যা মিলত। কিন্তু পদ্মিনীমাসিকে আমি কিছুই বলি না। পদ্মিনীমাসি একটানা কথা কইত। আর আমি একটানা শুনে যেতাম। যেন রেডিও শুনছি। তা তো এফ. এমে ইন্টার—অ্যাক্ট করা যায়, ফোন লাইন থাকে, পদ্মিনীমাসি যখন কথা কইত, তার মধ্যে কোনও ইন্টার—অ্যাকশনের ফাঁক থাকত না, একটানা নিজের মনে, কিন্তু আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ চুম্বকের মতো আঁকড়ে রেখে পদ্মিনীমাসি কথা কয়ে যেত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্রোতের মধ্যে ভাসিয়ে নিয়ে যেত আমার জাগ্রত চেতনাকে।

.

যখন ঘরটা নিলাম, তখন মিসেস মিত্র কিন্তু এ কথাটা বলেননি। বলেছিলেন একজন মাঝবয়েসী ভদ্রমহিলা আছেন, আমার রুমমেট। জানলার ধারের খাটটা তাঁর। আয়নাওলা আলমারিটাও তাঁর। মহিলা অনেক বছর ইয়োরোপ—আমেরিকায় ছিলেন। এখন ফিরেছেন। এখানে জমি—বাড়ি—ফ্ল্যাট একটা কিছুর খোঁজ করছেন। কলকাতায়, না দিল্লিতে, না ব্যাঙ্গালোরে কোথায় ফ্ল্যাট কিনবেন, সেটা স্থির করতে পারছেন না। তবে বম্বে নয়, চেন্নাই নয়, এটা স্থির। ঐ শহর দুটো ওঁর অপছন্দ। একটা বড্ডই ইমপারসোনাল সিটি—আরেকটা বড্ড ওলড ফ্যাশনড।

আর তিনি নিজে কেমন?

—”প্যাডি?” মিসেস মিত্র হেসে উঠেছিলেন।

—”তুমি নিজেই দেখবে।”

মিসেস মিত্রকে বেশ লাগে আমার। বেশ মা—মা, একটা পনিটেল ঝুঁটি বেঁধে, লিপস্টিক পরে, পায়ে হাইহিল চটি আর পরনে হাউসকোট—সারাদিন গিন্নিপনা করছেন। আরও গেস্ট আছে তাঁর।

একটা কাপল আছে। ছাপোষা হিন্দু বাঙালি স্বামীর রূপসী কাশ্মীরী মুসলিম বউ (তাদের নাকি আসলে বিয়ে হয়নি), দুজনেই ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করে। আরেকজন স্মার্ট, সুপুরুষ ভদ্রলোক আছেন—রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার, দক্ষিণ ভারতীয়। তিনি দক্ষিণ ভারতে ফিরে না গিয়ে, অথবা কোনও দক্ষিণী গেস্ট হাউসে না গিয়ে, এখানে থাকেন কেন, জানি না। তাঁর দুবেলার খাদ্য আসে সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব থেকে। ব্রেকফাস্ট করেন ঘরে। মিসেস মিত্র গোকুলকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যেকের খুব যত্নআত্তি করেন, অতিথি সৎকারে ত্রুটি নেই তাঁর।

পদ্মিনীমাসির নানান খামখেয়ালিপনাকে তিনি প্রশ্রয় দেন, মিস্টার সুব্রহ্মনিয়মের হুইস্কি সোডাবরফের সাপ্লাই (স্ট্রিক্টলি আফটার সানডাউন, ইনফ্যাক্ট ওনলি আফটার সিক্স থার্টি!) দেন সযত্নে, গোকুলের মারফত, পদ্মিনীমাসিরও তিনটে জিন অ্যান্ড টনিক মিসেস মিত্র অ্যালাউ করেন, কেমন করে জানি না চার নম্বরটার ব্যবস্থা করতে চাইলেই, ম্যাজিকের মতো ডিনার চলে আসে ঘরে। মিসেস মিত্রকে আমার বেশ লাগে। পদ্মিনীমাসির মতে মিস্টার সুব্রহ্মনিয়মের সঙ্গে মিসেস মিত্রের প্রচণ্ড একটা অ্যাফেয়ার ছিল অল্প বয়সে এবং সেই কারণেই তিনি বিয়ে করেননি, সেই কারণেই তিনি দেশে না গিয়ে বুড়ো বয়সে এখানে এসে আছেন, এবং সেই কারণেই মিসেস মিত্রের ছেলেটি বিদেশেই চাকরি নিয়ে ফিরে চলে গিয়েছে এবং এসবের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পদ্মিনীমাসি বলে যে ওঁদের দু’জনের ঘর দুটোর মাঝখানে একটা গোপন দরজা আছে, যেটা দেখা যায় না, কেন না দরজাটা আছে ওয়াড্রোবের মধ্যে। রাতের বেলায় মিসেস মিত্র নিজের ঘর থেকে প্রত্যহ মিস্টার সুব্রহ্মনিয়মের ঘরে চলে যান। তাই তো উনি এখনও এত সুন্দরী—এত ফিট—এত হাসিখুশি।

এত কর্মঠ, এত অ্যাট্রাকটিভ।

—”বিকজ দে হ্যাভ ইট! সেক্স, ইট ইজ দি এসেন্স অফ আওয়ার বিইং—না করলেই তো শুকিয়ে—মুকিয়ে বুড়ুটে মেরে যায় মানুষে—কি মেয়েছেলে, কি ব্যাটাছেলে, ওইটি ছেড়েছো কি মরেছ!—লাইফ রিজেনারেটস ইটসেলফ ইন দ্যাট অ্যাক্ট, বুঝেছ গাধা মেয়ে? ডু ইট! বলে না, ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার‍্যা’ (ওসব পুত্র—টুত্র কিছু না, ঐ শুক্রটি যেই পতিত হবে তোমার শরীরে, তক্ষুণি জেল্লা খুলে যাবে। বুঝেছ? বলে না, ‘বিয়ের জল গায়ে পড়েচে’? ‘বিয়ের জলটা’ আর কিছুই নয়, সুইটিপাই— সেমেন সেমেন, ওটাই মেয়েদের নারীত্বে পালিশ জাগায়, শরীরটা শক্তপোক্ত রাখে, জরায়ুটাকে যথাস্থানে ধরে রাখে, শরীরে যৌবনের রসকষগুলো বইয়ে টেনশন কমায়, মনটা ভালো রাখে—মানুষকে অ্যাট্রাকটিভ রাখে, নিয়মিত সেক্সের চর্চা রাখাটা জেনারেল হেলথের পক্ষে খুব জরুরি। খুব উপকারী। বোথ ফর ইওর মেন্টাল হেলথ, অ্যান্ড ফর ইওর বডি—ইট কিপস ইউ টুগেদার—কিপস ইউ হ্যাপি।”

.

—আপনি, পদ্মিনী সিং—কে ‘মাসি’ ডাকতেন কেন? সকলেই তাকে ‘প্যাডি’ ডাকত যখন।

—আমি যেদিন ওকে মিট করলাম মনে হল ও আমার বয়সী হবে, মাসি ডাকটা আপনি এসে গেছিল। মফস্বলী অভ্যেস। ও বলল আমাকে পৃথিবীতে কেউ কখনও মাসি ডাকেনি। বড়জোর আন্টি—তুমিই প্রথম। আমাকে ‘প্যাডি’ বলে ডাকে সবাই।

আমি বললাম, ‘প্যাডি’ খুব বিশ্রী শুনতে। পদ্মিনী এত সুন্দর নাম—আমি পদ্মিনীমাসি বলব। ও বলল ঠিক আছে—উই’ল টার্ন আ নিউ পেজ—তোমার সঙ্গে সঙ্গেই পদ্মিনীমাসির জন্ম হল—ওয়ান জেনারেশন আপ—

—আপনার কি ওকে মা—মাসির মতো লাগত?

—প্রথম প্রথম লাগত, তারপর বদলাতে থাকল, দিদির মতো, বন্ধুর মতো, সমবয়সীর মতো, পদ্মিনীমাসিকে আমার মাঝে মাঝেই সমবয়সীর মতো লাগত—ও যেসব কথাবার্তা বলত—যেভাবে বলত—আমাকে যেভাবে ট্রিট করত—ঠাট্টাইয়ার্কি মারত যেসব—তাতে ওকে মা—মাসির পর‍্যায়ে ফেলা যেত না—

—আপনি কি ওঁকে পছন্দ করতেন?

—পার্ডন?

—আপনি কি ওঁকে পছন্দ করতেন?

—কি জানি। বোধহয় করতাম। আবার করতামও না।

—কেন পছন্দ করতেন?

খুব অ্যাট্রাক্টিভ। সুন্দরী।

—দেখতে সুন্দর? বাস?

—কেবল সেই কারণে?

—না, স্বভাবটাও চার্মিং, হাসিখুশি। ঠাট্টা—তামাশা করতে পারে— শুধুই সেইজন্য?

—শুধু তাই নয়, মানুষটি স্নেহপরায়ণ। আমাকে খুব স্নেহ করত পদ্মিনীমাসি।

—কী করে বুঝলেন?

—এটা বোঝা যাবে না? কি আশ্চর্য!

—তাহলে আপনি ওঁকে পছন্দ করতেন, কেননা উনি আপনাকে পছন্দ করতেন। এই তো?

—অনেকটা তাই, বলতে পারেন।

—তাহলে ওঁকে অপছন্দ করবার ব্যাপারটা কেন এল? উনিও কি আপনাকে অপছন্দ করেছিলেন ইদানীং?

—না না, বরং তার বিপরীত। পদ্মিনীমাসির মনের মতো হয়েই তো আমার যত যন্ত্রণা হয়েছিল। সারারাত কথা কইত, আমাকে ঘুমুতেই দিন না। সকালে উঠে অসম্ভব ক্লান্ত লাগত। ওর না হয় মোর অর লেস রিটায়ার্ড লাইফ, কিন্তু আমার তো অফিস আছে? ও বুঝতে চাইত না। এখনও সেইটেই…

প্রথম প্রথম পদ্মিনীমাসির কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি দপ দপ করতাম ভেতরে ভেতরে। ভয়ানক রাগ হতো পদ্মিনীমাসির ওপরে। এ সব কথা আমাকে বলার মানে কী? এ সব কথা আমাকে বলে ওর লাভ কী? ও তো জানে, ও নিশ্চয় বোঝে।

—রোজ উঠেই অফিস দৌড়ই, শুধু যেদিন ঋত্বিকের সঙ্গে দেখা করি সেদিন দেরি হয়। নইলে বিকেলেই ফিরে আসি। এসে টিভি দেখি। কিংবা ওয়াকম্যান, বই নিয়ে শুতে চেষ্টা করি। বই পড়তে চেষ্টা করা মানেই পদ্মিনীমাসির কথকতা শ্রবণ। পদ্মিনীমাসি সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে ঘরেই থাকে। তারপরে জিন অ্যান্ড টনিক। আর কথা। একটানা কথা! নিজের কথা, নিজের জীবনের কথা, নিজের প্রেম—জীবনের কথা। শুধু নিজেরই নয়, অন্য অন্য আরও অনেকেরই প্রেম—কাহিনী শুনতে হয় আমাকে। পদ্মিনীমাসির তো ওটাই কেবল কথা বলার বিষয়। না ‘কেবল’ বলব না, ওটাই ওর ‘প্রধান’ বক্তব্য। ফ্রয়েডের মতো।

.

সম্প্রতি কী একটা পত্রিকায় পড়ছিলাম বিদেশে একটা নাটক খুব নাম করেছে, নারীবাদী নাটক—”ভ্যাজাইনা মনোলগস”, তার বিষয়বস্তু কী তা আমার জানা নেই, কিন্তু পদ্মিনীমাসির একটানা কথাগুলিকে যদি ”ভ্যাজাইনা মনোলগস” নামে দেওয়া যেত, খুব একটা ভুল হত না। ঐ নাম দেওয়া যেত পদ্মিনীমাসির পুরো অস্তিত্বটাকেই। শুনতে শুনতে আমার মাঝে মাঝে ওঁকে বিরাট একটা যোনির মত মনে হয়। ঐ যে বিশাল যোনির মধ্যে বসানো হয় বিরাট শিবলিঙ্গ—গৌরীপট না কী যেন তার নাম—পদ্মিনীমাসি নিজেই যেন তাই। বিশাল এক গৌরীপট। শ্বেতপাথরে তৈরি। আর তার মধ্যে, বিদ্ধ হয়ে আছে চোরকাঁটার বনের মতো, যাদবদের শরবনের মতো অজস্র, নানা সাইজের, নানা বর্ণের লিঙ্গসকল। সেই বিপুল গৌরীপটের ঠোঁট আছে, সেখান থেকে অনর্গল যান্ত্রিক বাক্য নির্গত হচ্ছে—কলের গানের মতো—প্রতিটা লিঙ্গের বায়োডাটা, প্রতিটা লিঙ্গের কর্মতৎপরতার, অথবা অকর্মণ্যতার কাহিনী। শুনতে শুনতে গোটা আমিটা যেন শ্রবণেন্দ্রিয় হয়ে যাই—আমার চোখ, ঠোঁট, কান, গলা, বুকের ভেতর পর্যন্ত, সমস্ত শরীর, সম্পূর্ণ অস্তিত্বই কান হয়ে ওই শব্দ আকর্ণ শ্রবণ করতে থাকে—শব্দগুলো, কথাগুলো যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে, ধুলো হয়ে, রেণু রেণু ধুলো হয়ে চোখ—কান—গলা—বুক সব বুজিয়ে দিচ্ছে— ধুলোয় ধুলোয় বুজে যাচ্ছে সব। শুনতে শুনতে একসময়ে মনে হয় আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না, আমার সর্বাঙ্গ ছিল শ্রবণবিধুর, এমন বধিরতা গ্রাস করেছে আমাকে, পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো ঝিমিয়ে পড়েছি আর নিতে পারছি না, মনে হচ্ছে চেঁচিয়ে উঠি চিৎকার করে উঠে বলি ”চুপ!” কিন্তু মুখে শব্দ ফোটে না, দুঃস্বপ্নের সময়ে যেমন স্বরনালী স্তব্ধ থাকে, পা চলে না, আমারও তেমন কণ্ঠরোধ হতো—পদ্মিনীমাসির কথা শুনতে শুনতে। একটা প্রবল উদ্বেল, গোপন ধারণা সর্বাঙ্গে বাজতে শুরু করত। অথচ ঘরে যে পদ্মিনীমাসি আছে, সেটাও মনের কোণে ঠিক খেয়াল থাকত। প্রবল অস্বস্তিতে ছটফট করতে করতে পদ্মিনীমাসির ওপরে রেগে উঠে ঘুমিয়ে পড়তাম।

.

আজ ঘরে কেউ নেই।

যা খুশি করা যেতেই পারে।

এখন নিঃসীম প্রিভেসি। ঘর অন্ধকার ছিল সর্বাঙ্গে সেই বাজনাটা আর বাজছে না। দেওয়ালের চলমান আলোগুলো বড্ড ডিসটার্ব করছে। ওগুলো কে বা কারা পাঠাচ্ছে?

এবং কেন? কী উদ্দেশ্যে?

আগে সেটা জানা দরকার।

জানা খুবই দরকার—ওগুলো তো শুধু আলো নয়, ওরা সংকেত—আলোর সংকেত—কিসের সংকেত?

 কে কাকে সংকেত পাঠাচ্ছে?

ওগুলো কি আমার জন্যেই?

নাকি পদ্মিনীমাসির প্রেমিকদের কারিকুরি?

এ ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নেওয়া খুব জরুরি। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাচ্ছে আলোগুলোর মধ্যে আছে অশ্লীল ইঙ্গিত—গা গুলিয়ে উঠছে।

বীভৎস। বিবমিষা—নাঃ!

এভাবে চলতে পারে না।

একটা বিহিত করা দরকার—মে বি আই নীড হেলপ—আমাকে জানতেই হবে কেন এমন হচ্ছে।

এসবের পেছনে কে? বা কারা?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *