অষ্টম পর্ব- হাল ভেঙে যে-নাবিক
এতক্ষণ কেবল শৈলর কতা মনে আসচিলো আর ফুফুরে২ কাঁদচিলাম। রাত পুরিয়েছে সে খপর পাই নি। শুনতে পেলুম গঙ্গায় চান কত্তে যাওয়া বুড়ী গিন্নিরা হাসচেন আর বৌ-ঝিদের মুণ্ডপাত কচ্চেন। কে এক বুড়ো হেঁড়ে গলায় “শিব ধন্য কাশী, শিব ধন্য কাশী” আউড়াতে আউড়াতে দ্রুত পায়ে চানে চলেচেন। দূরে গড়ের মাঠে দিনের পথম তোপ পড়লে। এতক্ষণে রাস্তায় গুরুচরণ ঘটিতোলা “কু-উ-উ-ও-র-র-ও-র-ঘ-টি-তো-ও-ও-লা” আওয়াজে বেড়িয়েছে। বাড়ির গিন্নিরা “অ্যাই ঘটি তোলা ইদিকে” বলে হাঁক পাচ্ছেন। ভারীরা বাঁকে করে বড় বড় কলসিতে জল এনে জলের ঘরের চৌবাচ্চায় ভরচেন। এদিকে ধোপদুরস্ত কাপড়, পরিষ্কার মেরজাই আর টুপি পরা দেশাইওয়ালা “লে দেশাই” বলে চিৎকার পাচ্ছেন। বাবুরা দুই পয়সায় এক বাক্স দেশাই খরিদ কচ্চেন। ওই টং টং আওয়াজে ট্রাম চলা শুরু হল। ওই সাবাং বেচতে মুসলমান ফিরিওয়ালা বেরুল। কলকেতা সহরে ওই সকাল হল।
.
কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করিনি। পড়ে গেছি। যে-কোনো থ্রিলারের চেয়ে চমকে দেওয়া সব ঘটনা। এখন বাইরে তাকিয়ে দেখি ভোরের আলো সবে ফুটছে। কলকাতার সকাল। তারিণীর ডায়রিতে এই সকালের কথা পড়েছি। খানিক আগেই। আমার খাট জুড়ে শীতালি পাখির মতো ছড়িয়ে আছে ধূসর কিছু পাতা। তারিণীচরণ রায়ের হারিয়ে যাওয়া ডায়রির পাতা। পাতা তো নয়, বোমা! সুকল্যাণ মিত্র আমাকে এই ডায়রি প্রথম পড়ার অনুমতি দিয়েছেন। তবু এখনও কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে গোটা ব্যাপারটা। একশো বছরের আগে ঘটে যাওয়া এক ষড়যন্ত্র, এক গুপ্ত সমিতি, মহারানি ভিক্টোরিয়া, প্রিয়নাথ, গণপতি, সব মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ভূত ব্যাপারটাই এমন আজব, এমন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া, প্রতিবার অসম্ভব মনে হচ্ছে। ছোটো থেকে আমাদের মধ্যে ফিকশন আর ননফিকশনের জগতের মধ্যে যে বিরাট খাড়া দেওয়ালটা তুলে দেওয়া হয়, তাতে সত্যিই একদিন যদি ফিকশনের কোনও চরিত্র আমাদের সামনে চলে আসে তবে আমরা চমকে উঠি। ভূত এমনই এক চরিত্র। এতকাল যে বইকে আমি নেহাত ভয়ের উপন্যাস হিসেবে জেনে এসেছি, আসলে সেটা সায়েন্স ফিকশন। ভুল বললাম। সায়েন্স রিয়েলিটি। আর সে রিয়েলিটি এতই শকিং যে মানতে পারছি না। চাইছি না।
তারিণীর ডায়রি কীভাবে তার কাছে ফিরে এল তা শুরুতেই ছোট্ট একটা চিরকুটে লেখা আছে। ১৯১১ সালের এক তারিখ। তলায় সই প্রি.ম.। তাতে লেখক জানাচ্ছেন, তিনি অসুস্থ। যে-কোনো দিন মারা যেতে পারেন। তাই তিনি যার যার সম্পত্তি তাকে ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন। এটা তাঁর জীবনের শেষ সঠিক সিদ্ধান্ত। যদি তাই হয়, তবে ভূতের মুন্ডু যেমন তারিণীর কাছে চলে এসেছে, ধড়ও চলে গেছিল গোপালচন্দ্রের কাছে। বাড়ির পজেশন নেবার সময় দেবাশিসদা গণপতির ভূতের বাক্স পেয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত। না পেলে এত ঘটনা ঘটত না। তারপর কী হল? আমার জায়গায় সাইগারসন সাহেব থাকলে কী অনুমান করতেন? কিংবা তারিণী? প্রথমেই যেটা হওয়া খুব সম্ভব, সেটা হল লোভ। প্রিয়নাথের শেষ হাড় “নীবারসপ্তক”-এ যে কেসের কথা লেখা, সেই একই কেস তারিণীর ডায়রিতে আছে। আরও বিস্তারিত। বরং প্রিয়নাথ, যতদূর জানি, অনেকদিন পরে লিখতে বসেছিলেন। তখন তারিণীর এই দিনলিপিতে ভরসা করাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু এই ডায়রিতে একেবারে শেষের পাতায় যে এন্ট্রি আছে, সেটাই আমাকে ভাবাচ্ছে। ১৯৫৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, কাঁপা হাতে লাল কালিতে লেখা একটা এন্ট্রি। পুরোনো কাগজে কালি চুষে নিয়ে থেবড়ে গেছে মাঝেমধ্যেই। হাতের লেখা তারিণীর, নিঃসন্দেহে। কিন্তু ভাষা একেবারে আধুনিক সাধুভাষা। ডায়রির ভাষা না। যেন কেউ কাউকে কোনও আদেশ করছে এমন ভাষা। লেখা রয়েছে-
এই অভিশপ্ত ডায়রিতে আবার লিখিতে হইবে ভাবি নাই। কিন্তু নিরুপায়। এই বৃদ্ধ বয়সে যে উপলব্ধি হইয়াছে, তাহা ওই যৌবনে না হওয়ায় উহা লিপিবদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। এখন বুঝিয়াছি ভূত আসলেই এক ভয়ঙ্কর আবিষ্কার, যাহা মানবজাতির কোন কল্যাণেই আসে নাই বা আসিতে পারে না। ইহা শুধুমাত্র মানবের লোভকে জাগ্রত করে, মোহাবিষ্ট করে, এক অলীক ভবিষ্যতের আশা দেখাইয়া তিলে তিলে উহাকে ধ্বংসের পথে লইয়া চলে। নীবার এক উদ্দেশ্য লইয়া গঠন করা হইয়াছিল। আমরা কেহই লখন ওরফে ল্যানসন ওরফে ম্যানুয়েলকে এই সংগঠনের সভ্য করিতে চাহি নাই। কিন্তু যাহার সুরক্ষাহেতু আমাদিগের এই প্রচেষ্টা, সেই দ্রিনা ওরফে অ্যালিসের লখনের প্রতি এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়াছি। সে লখনকে ত্যাগ করিতে রাজি নহে। লখনের এই গুণটি আছে। দুর্বলচিত্তের মানব উহার নিকট আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার করে। দ্রিনাও করিয়াছে। গণপতির বংশজ কেহ নাই। প্রিয়নাথের বংশধররা নীবার হইতে দূরে থাকিতে চাহে। টমসন সাহেব গত হইয়াছেন। তাহার কন্যা এক খৃষ্টানকে বিবাহ করিয়া সুখে আছে। নীবারে থাকিলেও তাহারা প্রায় গুরুত্বহীন। এই সুযোগে লখন ও তাঁহার পুত্র নীবারের সর্বেসর্বা হইয়াছে। এলাহাবাদ ও এডিনবরা ম্যাসনরির সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। শুধু তাহাই নহে, বিলাতে রাজপরিবারকে প্রচ্ছন্ন হুমকি (blackmaIl) দিয়া সে নিয়মিত অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টায় রহিয়াছে। আমি বুড়া হইয়াছি। আমার সাধ্য নাই উহাকে নিরস্ত করা। ইদানীং সে দলে সদস্য বাড়াইবার নিমিত্ত বহিরাগত কিছু অমিশুককে আনিয়া দলে ঢুকাইতে সচেষ্ট। আমার প্রাণ থাকিতে আমি তাহা হইতে দিব না। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর কি হইবে তাহা স্বয়ং ঈশ্বর জানেন। ডাক্তার গোপালচন্দ্র কিছুদিন হইল গত হইয়াছেন। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে আমাকে নিজের কক্ষে ডাকিয়া পাঠাইয়া তিনি যে ভয়ানক তথ্য আমায় দিয়েছেন তাহা না বলিয়া গেলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। তিনি যাহা বলিলেন তাহার চুম্বকসার এইরূপ-
ভূত অমিত ক্ষমতাশালী। কিন্তু ভূত কাহারও নির্দেশে চলে না। যে ব্যক্তির উপরে ভূতের প্রয়োগ হইবে, তিনি প্রায়শই ভূতের প্রভাবে যিনি প্রয়োগ করিয়াছেন তাঁহার নির্দেশ মানিয়া চলিবেন, ইহা ঠিক, কিন্তু এই রাসায়নিক অতীব ধূর্ত। মানবমনের হদিশ পাওয়াও দুষ্কর। তাই ভূতের প্রয়োগে মানব অন্যের বশবর্তী হইলেও কখনও কখনও ইহা অদ্ভুত এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায়। ফলতঃ আদেশ মানার পরিবর্তে ভূতের প্রভাবে মানুষ স্বয়ং আদেশকারীকেই আক্রমণ করিয়া বসে। ফলাফল মারাত্মক। আদেশকারীর ভয়াবহ মৃত্যু অবধি হইতে পারে। ডাক্তার গোপালচন্দ্র ইহা লইয়াই গবেষণা করিতেছিলেন। হয়তো ভূতের এই সমস্যাটি দূর করিতেও পারিতেন। কিন্তু তাঁহার গবেষণা সম্পূর্ণ হইবার পূর্বেই তাহাকে জাবুলন গবেষণাগার হইতে অপসারিত করে। ফলে আবিষ্কারটিতে এই ত্রুটি রইয়াই গিয়াছে।
মনে রাখিতে হইবে, ভূতের বিনাশ নাই। আজ হইতে শত সহস্র বৎসর পরেও এই ভয়াবহ রাসায়নিক তাহার ক্ষমতা হারাইবে না। ফলে আমি শুধু আমার সন্তানসন্ততিকে দৃঢ়ভাবে এই নির্দেশ দিয়া যাইতেছি যে, কোনদিন, কোন উপায়ে ভূতের নাগাল পাইলেও উহারা যেন ভূতের ফাঁদে পা না দেয়। ইহা আমাদিগের চরম বিনাশ ডাকিয়া আনিতে পারে।
.
নিচে তারিণীচরণ রায়ের সই। বাবা নির্ঘাত এটা পড়েছিলেন। আর পড়েছিলেন বলেই চিরকাল আমাকে নীবারের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। বাবার উপর আক্রমণ এই ডায়রির জন্যেই হয়েছিল সন্দেহ নেই। খুব যদি ভুল না করি তবে সে আক্রমণ দেবাশিসদার কীর্তি। তাও সফল না হয়ে উনি আমাকে ধরেন। প্রথম দিনই দেখতে চেয়েছিলেন ব্যান্ডেল চার্চ নিয়ে আমি কী জানি। যদি জানতাম আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমায় ধরিয়ে দিত। আমি জানতাম না। আর জানতাম না বলেই আরও ধন্দে পড়ে গেছিলেন দেবাশিসদা। সময় নিচ্ছিলেন। মাপছিলেন। আসল খোঁজ ছিল তারিণীর ডায়রির। ভেবেছিলেন সেখানে নিশ্চিতভাবে ভূত বানানোর ফর্মুলা লেখা আছে।
.
ব্যাগ থেকে কাল টেমারলেনের পিছনে লেখা ফর্মুলা বার করে দেখাতেই সুকল্যাণ মিত্র ডেকে নিয়েছিলেন ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের হেডকে। অনেকক্ষণ ধরে মন দিয়ে কাগজটা দেখলেন ভদ্রলোক। পাশের প্রিন্টার থেকে টেনে নিলেন একটা এ-ফোর শিট। পৃষ্ঠা ভরে উঠল কেমিক্যাল ফর্মুলায়। আর ভদ্রলোকের ফর্সা মুখ গম্ভীর হয়ে লাল হতে লাগল। অনেকবার কাটাকুটির পর ভদ্রলোক মাথা উঠিয়ে বললেন, “না স্যার। ইমপসিবল।”
“কী ইমপসিবল?”
“এই জিনিসটা ল্যাবে বানানো সম্ভব না। যদি…”
“যদি না কী?”
“এই দেখুন স্যার”, মলাটটা সামনে মেলে ধরলেন ভদ্রলোক, “এটা একটা মাল্টিস্টেপ রি-অ্যাকশান। মোট সাতটা স্টেপ। এদের মধ্যে তিনটে একেবারে ইঞ্জি। প্রাইমারিরি অ্যাকটেন্টগুলো ইজিলি অ্যাভেলেবল। সেগুলো মিশিয়ে প্রথমে বুনসেন বার্নারে গরম করতে হবে আধঘণ্টা, তারপর বাকি চারটে স্টেপ, তারপর রুম টেম্পারেচারে এনে আধঘন্টা রেখে শেষে দশ মিলিলিটার ইথানল মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। ফাইনাল সলিউশনের রং সবুজ। এটাও লেখা আছে।”
“ইথানল মানে তো…”
“ইথাইল অ্যালকোহল। যা থেকে মদ বানানো হয়। আগেকার সব ওষুধে দিত। নানা হোমিওপ্যাথিক ওষুধে এখনও থাকে। কিন্তু সেটা সমস্যা না। সমস্যা মাঝের এই চারটে স্টেপে। প্রাইমারিরি অ্যাকশান হয়ে যাবার পর যে চারটে রিঅ্যাকটেন্ট দেওয়া হচ্ছে, তাদের নাম বা ক্যারেকটার কোথাও কিছু লেখা নেই। এই দেখুন চারটে লাল তালার মতো ছবি। আর প্রতি তালার উপরে একটা করে লেটার লেখা। B, H, U আর T। এই কেমিক্যালগুলো কী কে জানে? হয়তো যে লিখেছিল সে ভেবেছিল এগুলো চেনা কিছু হবে। কিন্তু এগুলো না পেলে এই বিক্রিয়া ঘটানো যাবে না।”
“আর পেয়ে গেলে?”
“ক্লাস টুয়েলভের ছাত্রও বানিয়ে দেবে। মানে ধরুন ওই চারটে কেমিক্যাল হল তালা, আর এই ফর্মুলা হল চাবি। দুটো একসঙ্গে না পেলে কেউ কিছু করতে পারবে না।”
“ধরুন কেউ যদি শুধু কেমিক্যালগুলো পায়?” আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না।
“লাভ কী? ফর্মুলা না পেলে প্রথম স্টেপটাই তো করতে পারবে না। রিঅ্যাকশান শুরুই হবে না।”
“এ তো গেল রিঅ্যাকশান, বাকি গোটা দুই পাতা জুড়ে এত ফর্মুলা কী লেখা?” একটু হাসলেন ভদ্রলোক, “শুরুর দুটো উপাদানের একটা হোমোভ্যানিলিক অ্যাসিড। এককালে ল্যাবে খুব কষ্ট করে বানানো হত। সেটাই কীভাবে বানাতে হবে, তার পদ্ধতি লেখা। এখন যে-কোনো কেমিক্যাল সাপ্লায়ারকে বললেই এনে দেবে।”
“আর ওই চারটে নিয়ে কী লেখা আছে?”
“নাথিং।”
ফোনটা বাজছে। অমিতাভ মুখার্জি ফোন করেছেন। কিন্তু কেন? গতকাল ফেরার আগে সুকল্যাণ মিত্র একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, “ তুমি অমিতাভর সঙ্গে অ্যাসিস্ট করছ। করছ করো, কিন্তু সাবধানে। ও কিন্তু পুলিশের নর্ম খুব একটা মানে না। আইনও মেনে চলে না। পুলিশ বলে দুবার সাসপেন্ড হয়ে বেঁচে গেছে। কিন্তু তুমি একই কাজ করলে জেলের ঘানি টানবে। ও দেবাশিসের খুব কাছের লোক ছিল। দেবাশিসের খুনি ধরাকে ও পার্সোনাল ভেন্ডেটা হিসেবে ধরে নিয়েছে। ইমোশনালি এসব কাজ করলে একটু এদিক ওদিক হলেই বিপদে পড়বে। তুমিও সঙ্গে সঙ্গে ফেঁসে যাবে। এটা নাও।” বলে ছোট্ট একটা জিনিস হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আমার।
.
ফোন ধরলাম না। ফোন আবার বাজছে। এবার ধরতেই হল।
“কী করছ এখন? কোথায় আছ?”
“বাড়িতেই। কেন?”
“গ্রেট। আমি আসছি। তোমায় নিয়ে একটু চন্দননগর যেতে হবে।”
“কোথায়?”
“দেবাশিসদার বাড়ি। ওর বাড়িতে একটা গুপ্তঘরের সন্ধান পাওয়া গেছে। দশ মিনিটে আসছি। নিচে নেমে দাঁড়াও।”