অষ্টম পর্ব— সোনালি সিংহের গান

অষ্টম পর্ব— সোনালি সিংহের গান

১৭৯৯ সালে নির্মাণ শুরু হয়ে ১৮০৩ সালে কলকাতায় তৈরি হয় পেল্লায় রাজভবন। তৈরির বরাত পেয়েছিলেন চার্লস ওয়েট নামের এক স্থপতি। লেগেছিল তখনকার দিনেই আশি হাজার পাউন্ড, আসবাবে আঠেরো হাজার পাউন্ড আর রাস্তা ইত্যাদিতে তিন হাজার পাউন্ড। এক লাটভবন বানাতেই কোম্পানির ফৌত হবার দশা। তবে হ্যাঁ, লোকে যখন যায়, দেখে বলে জিনিসের মতো জিনিস একখানা। মাথায় পতপত করে উড়ছে ইউনিয়ান জ্যাক, সামনে বন্দুকধারী উর্দিপরা সান্ত্রি, ব্যাপারই আলাদা। আজকে তো নিউ ইয়ার ডে-তে গোটা রাজভবন সাজানো হয়েছে কতরকম রংবেরঙের ফুলে। আজ দুপুরে মহাভোজ। ভোজের মেনুর মধ্যে একটা প্রধান জিনিস হল ‘বোরস্ হেড’ বা শুয়োরের মাথা, যা রোজমেরি, বে-লিফ আপেল আর অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাজিয়েগুছিয়ে পরিবেশন করা হয়। নানারকম খাদ্য পানীয় থরে থরে টেবিলে রাখা। আছে টার্কি, ডাক রোস্ট, প্লাম, পুডিং, যত রাজ্যের জিনিস দিয়ে তৈরি বিরাট পাই, ট্যাঞ্জারিন, লেবু, খেজুর, বাদাম, কিসমিস, চকোলেট, আরও কত কী!! বড়োলাট আজকের দিনে নিজে অতিথিদের আপ্যায়ন করেন। রাজভবনে ঢুকতে একটু সমস্যা হয়েছিল। সাইগারসনকে নিয়ে আপত্তি না থাকলেও প্রিয়নাথ, বিশেষ করে তারিণীকে নিয়ে দ্বাররক্ষীরা আপত্তি করছিল। তাও তো তারিণী আজকে সাহেবি পোশাক পরে এসেছে। টমসন সাহেব বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের রাজি করলেন। সাইগারসন পথে তাঁকে সব খুলে বলেছেন। প্রথমে টমসন রাজি হননি, পরে সাইগারসন তাঁকে বোঝান, তিনি এমন কিছু করবেন না যাতে বড়োলাট অসন্তুষ্ট হন। গোটা কেসের ঘটনাও টমসন সাহেবকে জানাতে হয়েছে। অগত্যা তিনি রাজি হয়েছেন।

লাটভবনে পৌঁছে তারিণীরা দ্যাখে পার্টি শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পানীয়র গেলাস হাতে নিয়ে ঘুরছেন সাহেব মেমসাহেবরা। তারিণী আর প্রিয়নাথকে দেখে তাঁদের কয়েকজন অবাক হলেন, কয়েকজন ভুরু কোঁচকালেন বোঝা গেল। বিরাট বড়ো হলঘরের এক কোণে বড়োলাট ল্যান্সডাউন দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে সবাইকে আপ্যায়ন করছেন। টমসন সাহেব সাইগারসনকে নিয়ে সোজা সেদিক পানে রওনা হলেন। পিছন পিছন তারিণী আর প্রিয়নাথ। প্রিয়নাথ ঠিকই শুনেছিল। বড়োলাট এই দিন হ্যান্ডশেকের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয়দের কায়দায় আলিঙ্গনও করেন। তবে সেটা অবশ্যই ইউরোপীয়দের। তাদের কপালে করমর্দনও জুটবে কি না সন্দেহ। প্রথমেই টমসন করমর্দন করে আলিঙ্গন করলেন। বড়োলাট হেসে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালেন। টমসন এবার সাইগারসনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। প্রিয়নাথ দেখল, আলাপ করানোর পর বড়োলাটের কানের কাছে মুখ নিয়ে টমসন সাহেব কী যেন বললেন। শুধু “এঁর দাদা…” টুকু শোনা গেল। বড়োলাটের মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। সাইগারসনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম…” “ভুল শুনেছিলেন” বলে সাইগারসন এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন। এবার আলিঙ্গনের পালা। আলিঙ্গন করতে করতে বড়োলাট বললেন, “তারপর বলুন, আপনার কী সেবা করতে পারি?”

“কিচ্ছু না, শুধু পলের রক্ত পরিবর্তনে দুর্ঘটনা ঘটায় কার্টার আর রিচার্ডকে কেন মরতে হল, সেটা বললেই চলবে।”

ঘরে বাজ পড়লেও বুঝি বড়োলাট অনেক কম চমকাতেন। প্রিয়নাথ দেখল রাগ, অবিশ্বাস, আতঙ্ক সবকিছু একসঙ্গে তাঁর মুখে খেলা করছে। প্রথমে মনে হল এক্ষুনি তিনি তাদের তাড়িয়ে দেবেন। তারপর কোনওক্রমে নিজেকে সামলে বললেন, “এসব আপনি কী বলছেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”

সাইগারসন খুব নরম গলায় বললেন, “হুজুর, আমি জানি, যে ব্যক্তিগত শোক আপনার ওপর দিয়ে গেছে তার তুলনা নেই। কিন্তু আপনি তো আমার পরিচয় পেলেন। সত্যের একবারে গোড়া অবধি না পৌঁছে আমার শান্তি নেই। আপনি দয়া করে বলুন, ঠিক কী হয়েছিল। সঠিক উত্তর আপনি ছাড়া কারও কাছে নেই।”

বড়োলাট খানিক থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তারপর টমসন আর সাইগারসনকে ডেকে বললেন, “আসুন আমার সঙ্গে। আমি জানতাম একদিন এই দিনটা আসতে চলেছে, তবে এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা ভাবিনি।” টমসন রওনা দিলেও সাইগারসন গেলেন না। “পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি পুলিশ অফিসার প্রিয়নাথ মুখার্জি, টমসন সাহেবের অধস্তন। আর উনি এক আশ্চর্য মানুষ। প্রাইভেট ডিটেকটিভ তারিণীচরণ রায়। আজকে আমি যা জেনেছি, তা এঁদের সাহায্য ছাড়া জানা সম্ভব ছিল না। আমি যা জানি, এঁরাও তাই জানেন। আমি এঁদেরকেও সঙ্গে নেবার অনুমতি চাইছি।”

বড়োলাট মুখে কিছু বললেন না। শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। হলঘরের পাশেই লাইব্রেরি ঘর। থরে থরে বই সাজানো তাতে। ঢুকে নিজের হাতে মোটা মেহগনি কাঠের দরজা বন্ধ করে দিলেন বড়োলাট। এগিয়ে গেলেন মাঝে রাখা টেবিলের দিকে। টেবিলে ছড়ানো বেশ কিছু বই, পাখির ছবি। নিজে বসলেন। ওঁদেরও বসতে বললেন। প্রিয়নাথ আর তারিণী তবু দাঁড়িয়েই রইল।

—বলুন কী জানতে চান? তবে তাঁর আগে আমাকে একটা কথা দিতে হবে আপনাদের চারজনকে। আপনাদের জীবদ্দশায় বা আমাদের কারও জীবদ্দশায় এ কাহিনি যেন দিনের আলো না দ্যাখে। রাজি? কারণ এর অন্যথা হলে আমি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব, আর সেটা কারও জন্য ভালো হবে না।

সবাই কথা দিল।

—এই ঘটনার কোনও বিবরণ কেউ লিখে রেখেছেন?

তারিণী স্বীকার করল সে ডায়রিতে লিখেছে। বড়োলাট আদেশ দিলেন টমসন যেন সত্বর সেই ডায়রির পাতাগুলো নিজের দখলে এনে নষ্ট করে দেন। টমসন রাজি হলেন। এবার বড়োলাট তাকালেন সাইগারসনের দিকে। তিনি প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, বললেন,

“গত ১২ ডিসেম্বর, আপনার ভাই পলের অপারেশনের সময় অতিরিক্ত ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ আর রক্তমোক্ষণে সে মারা যায়। এমন দুর্ঘটনা হতেই পারে। তবু এই দোষে কার্টার আর রিচার্ডকে মরতে হল কেন?”

দুঃখের একটা হাসি ফুটে উঠল বড়োলাটের মুখে, “আপনি কিছুই জানেন না ডিটেকটিভ। আপনি জানেন কত আদরের ভাই ছিল আমার পল? বাপ মা নেই। আমার চেয়ে ঢের ছোটো। আমিই বাবার মতো মানুষ করেছিলাম। ওর গায়ে একটা আঘাত লাগুক, তার চেয়ে নিজে সে আঘাত পিঠ পেতে নিতাম। বুদ্ধিমান, হাসিখুশি, ভালো ক্রিকেট খেলে, দারুণ গান করে। পলকে দেখতাম আর আমার গর্ব হত। আদর্শ ইংরেজ বলতে যা বোঝায় তাই। কিন্তু সুখ সইল না ওর কপালে। ওর মায়ের বংশে পাগলামো ছিল। সেটা উত্তরাধিকার সূত্রে পেল। দেখতে দেখতে ভাইটা আমার কেমন বদলে গেল। কথা শোনে না। কিছু বলতে গেলে মারতে আসে। ডাক্তার মার্টিনকে দেখালাম। উনিই বললেন ভবানীপুরে ভরতি করতে। খুব একটা লাভ হল না। শেষে শুনলাম ওর মাথার খুলি নাকি ফুটো করে দেবে। তখন আর রাখিনি ওকে। বাড়িতেই নিয়ে এসেছিলাম।”

“রক্ত পরিবর্তনের কথা জানলেন কীভাবে?” সাইগারসন বললেন।

“একদিন কথায় কথায় ডাক্তার মার্টিন বলে ফেলেছিলেন। আসলে রিচার্ডকে উনি আগে থেকেই চিনতেন। ওঁর অ্যাপোথেকারিতে কাজ করেই রিচার্ড বড়ো হয়েছে। এটাও বলেছিলেন এটা নিষিদ্ধ উপায়। আমি প্রথমে রাজি ছিলাম না। কিন্তু আমার স্ত্রী জানতে পেরে বারবার আমাকে অনুরোধ করতে থাকে, শেষে আমিও রাজি হয়ে যাই। পলকে ও নিজের ছেলেই মানত।”

“তারপর?” আবার ধরিয়ে দেন সাইগারসন।

খানিক চুপ থেকে শুরু করলেন বড়োলাট ল্যান্সডাউন, “রিচার্ডের নিজের স্বার্থ ছিল। ও মনেপ্রাণে চাইছিল বেডলামের চিফ সার্জেন হতে। কিন্তু বয়স কম। একমাত্র আমার সুপারিশে কাজ হতে পারত। আর তাই ও কার্টারের ম্যাজিক দলের সঙ্গে এ দেশে চলে আসে পলকে সারাতে। প্রথমে ডালান্ডা হাউসের কিছু পাগলের ওপর পরীক্ষা করা হয়। কয়েকজন মারা যায়, কিন্তু কয়েকজন সেরেও ওঠে। মার্টিন নিজে আমায় বলেন, এ চিকিৎসায় সুফল পাবার সম্ভাবনা প্রচুর। আমার স্ত্রীর জোরাজুরিতে আমি শেষ অবধি রাজি হলাম।

যেমন ভেবেছিলাম, তেমন হল না। ১২ তারিখ সারাদিন কোনও কাজ করতে পারিনি। অপেক্ষায়। কী হয় কী হয় ভাব! সন্ধেবেলা রিচার্ড এল। সঙ্গে কার্টার। রিচার্ড জানাল অপারেশানে একটু ভুল হয়েছে। পল মারা গেছে। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। তাও সেটা বুঝতে দিলাম না। বললাম, পলের দেহ এখন কোথায়? রিচার্ড জানাল ও নাকি বাধ্য হয়ে গোটা দেহ ছিন্নভিন্ন করে চিনা পাড়ায় ফেলে আসার ব্যবস্থা করেছে। না হলে নাকি সবাই জেনে যাবে ও বেআইনি অপারেশান করে। ভেবে দেখুন, যে ভাইয়ের মাথায় সামান্য ফুটো অবধি আমি সহ্য করতে পারিনি, তার দেহ এমনভাবে ছিঁড়েখুঁড়ে…”

বড়োলাট খানিক চুপ করলেন। চোখের কোলে জল টলটল করছে। লাইব্রেরি নিস্তব্ধ। শুধু বাইরে থেকে মাতাল সাহেবদের উল্লাসের শব্দটুকু শোনা যাচ্ছে। বড়োলাট আবার শুরু করলেন, “রিচার্ডের হাড়ে হাড়ে ছিল শয়তানি। ও বুঝেছিল, এই ঘটনার পরে ওর আর বেডলামের প্রধানের পদ পাওয়া হবে না। তাই ও এসে সরাসরি আমায় ব্ল্যাকমেল করল। বলল, আমাকে ওর সুপারিশপত্র লিখে দিতে হবে। না হলে ও সবাইকে জানিয়ে দেবে আমি ওকে দিয়ে আমার ভাইয়ের রক্ত পরিবর্তনের কাজ করিয়েছি। এতে ওর থেকে আমার ক্ষতি বেশি।”

“আপনিই বা রাজি হবেন কেন?” প্রিয়নাথ মুখ খুলল।

“ওর কাছে প্রমাণ ছিল। পলের যৌনাঙ্গ, যেটার হদিশ অনেক খুঁজেও পুলিশ করতে পারেনি। আমাকে মানতেই হল। কিন্তু আমিও হেনরি ফিসমরিস ল্যান্সডাউন, প্রধানমন্ত্রী লর্ড সেলবার্নের নাতি। আমায় ধমকাবে ওই বস্তির ছোকরা? ঠিক করলাম কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলব। কার্টারকে লাটভবনে ডেকে পাঠালাম।”

তারিণী ফিসফিস করে প্রিয়নাথকে বলল, “স্যার, এটা তাহলে সেই দিন, যেদিন নবীন মান্না হোটেলে এসেছিলেন।”

প্রিয়নাথ কিছু বলল না। শুধু ওপরে নিচে ঘাড় নাড়ল।

“কার্টার নিজে হ্যালিডেকে পছন্দ করত না। কিন্তু ওর মা বেডলামে ভরতি। তাই কিছু বলতেও পারছে না। সব বলল আমাকে। আমি ওকে অফার দিলাম, ও একটা ম্যাজিক শো অ্যারেঞ্জ করুক, সেখানে সবার চোখের সামনে হ্যালিডেকে মরতে হবে। শার্লির দায়িত্ব আমি নেব। ও পলের সঙ্গে যা করেছে, আর তারপরেও যে ব্ল্যাকমেল করে চলেছে, ওকে বাঁচতে দেওয়া যেত না। শনিবারের শো-তে তাই স্পেশাল হিসেবে ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক রাখা হয়। ঠিক হয়, ম্যাজিকে আমাদের দুজন লোক সাহায্য করবে, যেটা কার্টার জানবে, হ্যালিডে না। ম্যাজিকের একটা অংশে হ্যালিডে বেরিয়ে আসবে, তার জায়গায় একই পোশাকে দড়ি নিয়ে রাখহরি ভিতরে ঢুকবে। হ্যালিডে চলে যাবে সোজা সদর দরজায়। ম্যাজিক শেষে ক্লাইম্যাক্সে সে ঢুকবে দরজা খুলে। সেটাই হয়নি। আমার লোক ছিল। হ্যালিডে বেরোনো মাত্র তাকে টুঁটি টিপে খুন করে। শুধু করেই না, দেহটাকে নগ্ন করে পাতলা পাটাতনে রেখে দেয় যাতে সেটা ভেঙে পড়ে হলভরা লোক হ্যালিডেকে দ্যাখে। আমার ভাইয়ের সঙ্গে ও যা করেছে, তাতে এটুকু করাই যায়।”

সবাই চুপ। প্রথম কথা বললেন সাইগারসন। “সেদিন আপনি নিজে কার্টারের হাতে একটা কাগজ গুঁজে দেন। কেন?”

“কার্টারকে আমি কথা দিয়েছিলাম প্রতিশোধ আমার সামনেই হবে। আমি নিজে উপস্থিত থাকব। তখনই ও জানায়, আমি যদি শেষ মুহূর্তে মত বদল করি তাহলে যেন ওকে জানাই। মৃত্যু পরোয়ানাটা আমি নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলাম। তাও এক চিনা চিহ্নে। চিহ্নটা আমাকে কার্টারই শিখিয়েছিল।”

“আর তিনটে প্রশ্ন। এক, হ্যালিডেকে কে খুন করল? দুই, রাখহরিকে কেন খুন করা হল? আর শেষ প্রশ্ন, কার্টার তো আপনার সব কথা মেনে চলেছিল, তাকে খুন করালেন কেন?”

“হ্যালিডেকে খুন করেছে ভাড়াটে খুনি। আমি তার নাম জানি না। জানার প্রয়োজনও নেই। ডাঃ মার্টিন ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে দ্বিগুণ পেনশন দিয়ে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছি। রাখহরিকে খুন করা হয়নি, শুধু মাথার সামনেটা ফুটো করে ঘিলুর একটু অংশ চেঁছে নেওয়া হয়েছে, যাতে ও কোনও উত্তেজনা আর দেখাতে না পারে। ওকে ডালান্ডা হাউসে নিয়ে রাখা হয়েছে। ওর উপরে পরীক্ষা হবে।”

“হ্যালিডেকে কে খুন করেছে বোধহয় বুঝতে পারছি”, সাইগারসন বলল।

“কে?”

“হ্যালিডের গলায় আঙুলের দাগ স্পষ্ট। মঞ্চের পিছনের অন্ধকারে পিছন থেকে কেউ হ্যালিডের গলা টিপে ধরেছিল। আমি দেখেছি। নটা আঙুলের দাগ আছে…”

“লখন!” প্রিয়নাথ অজান্তেই বলে উঠল।

“হলে অবাক হব না। তাহলে হুজুর, শেষ প্রশ্নটা? কার্টারকে কেন মরতে হল?”

“সে কী! কার্টার তো আত্মহত্যা করেছে, আপনারা জানেন না? আমি তো তাই জানি”, দেখেই বোঝা গেল বড়োলাটও অবাক হয়েছেন।

“আপনি একটু ভুল জানেন হুজুর। কার্টারের বন্দুক ছিল ডান হাতে। ও বাঁহাতি। আমি ওকে সেদিন গ্রিনরুমে পৌঁছে দেবার পর ও ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর কেউ একটা এসেছিল। যে তার বিশ্বস্ত। তাকে কার্টার দরজা খুলে দিয়েছিল। সেই এসে কার্টারকে খুন করে।”

“কিন্তু আমি তো এ বিষয়ে কিচ্ছু জানি না! আমি তো ভাবতাম কার্টার আত্মহত্যা করেছে!” বড়োলাট বললেন।

“তাহলে একটাই সিদ্ধান্তে আসা যায়, সে রাতে কার জন্য কার্টার দরজা খুলেছিলেন, সেটা আর কোনও দিনও জানা যাবে না।”

“আমার জন্য।” পাশ থেকে গলা খাঁকরে বললেন টমসন।

চার জোড়া চোখ তাঁর দিকে নিবদ্ধ। কী বলছেন তিনি?

খুব ধীর গলায় টমসন বলতে থাকেন, “এই গোটা কেসে একটা জিনিসের কথা বারবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সেটা যে কী বস্তু, তা কেউ দেখেনি, আমি দেখেছি।”

“কী সেটা?”

“কার্টারের লেখা সেই চিঠি, যেটা স্টেটসম্যান অফিসের ডাকবাক্সে ফেলে আসা হয়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কে এই কাজ করেছে, সেটা বার করতে পারিনি। আপনারা কেউ জানেন?”

সবার আগে পাশাপাশি মাথা নাড়ল তারিণী। তারপর বাকি দুজন। নবীন মান্নাকে কথা দিয়েছে তাঁর নাম কেউ জানবে না।

“যাক, তাহলে ধরে নিতে হবে কার্টার নিজেই গেছিল ফেলতে। সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ তাতে যা লেখা ছিল সেটা।”

“কী ছিল তাতে?”

পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বার করে দেখালেন টমসন। “এই সেই চিঠি। দেখুন এতে কী লেখা আছে।” সবাই দেখল চিঠিতে লেখা, “The dead body of Governor General’s cousin brother is supposed to be found Near Teritti Bazar, China town. Detailed information may be given on the basis of payment. Please contact Carter the Magician. Sharp.”

স্টেটসম্যান খবরটা ছাপে, কিন্তু এই শেষ অংশটা বাদে। কিন্তু সম্পাদক আমার বন্ধু বলে চিঠিটা আমাকে দেখান। আমি আবার ইঁদুরের গন্ধ পাই। বুঝতে পারি কার্টার কম শয়তান না। টাকার লোভে সব করতে পারে। বড়োলাট আমায় সব খুলে বলেন। ফলে বুঝলাম এর সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। হ্যালিডের ছিল ক্ষমতার লোভ আর কার্টারের টাকার। টাকার বদলে আজ নয় কাল ও যদি সব কথা বলে দেয়, তবে মহান ইংরেজ শাসনের ভিত কেঁপে যাবে। আমি কাউকে কিচ্ছু জানালাম না। ঠিক করলাম কার্টার বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছে। সেদিন কার্টার অসুস্থ হয়ে গ্রিনরুমে গেল। মঞ্চে হইচই। কপাল ভালো ইনস্পেক্টর জেনারেল হেনরি নিজেই আমায় বললেন মঞ্চের পিছনে গিয়ে সহযোগীদের একত্র করতে। আমি সবার অজান্তে কার্টারের গ্রিনরুমের সামনে এসে দরজায় টোকা দিলাম। কার্টার জিজ্ঞেস করল, কে? নাম বলতে দরজা খুলে দিল। টেবিলেই ডুয়েলের পিস্তলটা রাখা ছিল। একটা গুলি মঞ্চে ব্যবহার করেছিল। জানতাম আর-একটা গুলি পিস্তলের ভিতরেই থাকবে… নিজের পুলিশি রিভলভারটা আর ব্যবহার করতে হল না। জানতাম না ও বাঁহাতি। ভাবলাম পারফেক্ট ক্রাইম। কেউ ধরতে পারবে না। এখন বড়োলাট বাহাদুর যদি আমায় দোষী বলেন, তবে যে শাস্তি দেবেন, মাথা পেতে নেব।”

সাইগারসন লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। “অদ্ভুত খেলায় মেতেছিল এরা দুজন। লোভের খেলায়। যে খেলায় প্রাণ বাজি রেখে খেলতে হয়। খেলা শুরু হলে কারও রেহাই নেই…”

তারিণী এতক্ষণে মুখ খুলল। একটাই কথা বলল সে। অনেকদিন আগে গণপতির মুখে শোনা। “সূর্যতামসী।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *