পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

অষ্টম পর্ব— দেখা গেল পথ আছে

অষ্টম পর্ব— দেখা গেল পথ আছে

অফিসার ঠিক এই প্রশ্নটা আশা করেননি। খানিক আমার দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, “এ কথা তোমার মনে হল কেন?”

“দেখুন, সত্যি বলতে কেসটা শুরুতে আমি ধরতেই পারছিলাম না। তারিণী, প্রিয়নাথ, গণপতি, তৈমুর সব মিলিয়ে মিশিয়ে এমন জট পাকিয়েছে যে ছাড়ানো অসম্ভব। যখন আমি এক এক করে ছাড়াতে শুরু করলাম, তখনই একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল হল।”  

“কী সেটা?”

“গতকাল রাত থেকে আমি ঘুমাইনি। প্রায় সারারাত ভেবেছি কেসটা নিয়ে। দেবাশিসদার খুন। বিশ্বজিতের খুন। রমণপাষ্টি। হিলি। রামানুজ। সবাইকে নিয়ে। আর তাতেই খেয়াল করলাম কেসের বেশ কয়েকটা আসল দিক আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। ম্যাজিকে কী হয় জানেন তো? আসল ম্যাজিক চলে অন্য জায়গায়। দর্শকদের ধোঁকা দিয়ে অন্যদিকে মনোযোগ দিতে বলা হয়। এটাও সেরকম।”

“তাই নাকি? কীরকম?”  

“একেবারে শুরু থেকে শুরু করি। না হলে বোঝানো যাবে না। বছর তিনেক আগে আমি যখন প্রথম ডিটেকটিভের অফিসটা খুলে বসি, তখন বিজ্ঞাপন দেখে দেবাশিসদা আমায় ডাকেন। এমন একটা কেস দেন, যার কোনও মেরিট নেই। তাঁর যে স্ত্রী এমনিতেই তাঁর সঙ্গে থাকছিলেন না, তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড়ের। সেটা একেবারেই ধোঁকার টাঁটি। আসল উদ্দেশ্য উনি কথায় কথায় বলে ফেলেছিলেন। “আমি তারিণীচরণের প্রপৌত্র।” মজার ব্যাপার, গতকালই আমি জানতে পেরেছি, উনি আমার বাবাকে ও চিনতেন। শুধু চিনতেন না, বাবা মারা যাবার পর ওঁর বাড়িতে এক স্মরণসভাও হয়েছিল, যা আমি জানতামই না। তাহলে বাবাকে না ধরে সোজা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়া কেন? কারণ একটাই হতে পারে। দেবাশিসদার কোনও উদ্দেশ্য ছিল, যেটা বাবা জানতেন। ফলে বাবার থেকে সাহায্য পাবার আশা ছিল না। উনি বারবার আমাকে তারিণীর ডায়রির কথা জিজ্ঞাসা করতেন, জানতে চাইতেন সেটা কোথায় আছে? আমি বলতে পারিনি। কী ছিল তারিণীর ডায়রিতে? জানা নেই। এদিকে সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করে ক্লায়েন্ট হিসেবে যোগাযোগ করার আর-একটা কারণ দেখতে পাই। উনি বোধহয় বুঝেছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং করার পরেও আমার এই গোয়েন্দাগিরি বাড়ির লোকে ভালোভাবে নেয়নি। ফলে বাড়িতে ক্লায়েন্ট নিয়ে আলোচনার সুযোগ কম। এইভাবেই চলতে পারত, যদি না একদিন আচমকা দেবাশিসদা খুন হতেন। খুন হবার আগে উনি ঠিক কী করলেন? পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন না, নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেন না, শুধু আমায় একটা হোয়াটসঅ্যাপ করলেন। তাও চার লাইন কবিতা লিখে। এটা আপনার লজিক্যাল মনে হয়?”

“হয় না, তবে মানুষ ভয় পেয়ে গেলে প্যানিকে কী করে তার কোনও ঠিক নেই।”

“তা বটে।”  

“প্যানিকে মানুষ চিৎকার করে, পাগলামো করে, মাথা ঠোকে। ডায়রি পেন নিয়ে বসে কবিতা লেখে না।”

“তারপর এল কাটা অণ্ডকোশ। যেটা আপনার বাড়ি ফেলে আসা হয়েছিল। যেটা দেখে আপনি ভয় পেয়ে তাকেই লাইব্রেরি নিয়ে গেলেন।”

“হ্যাঁ, সেটা কী হয়েছে?”

“দেবাশিসদার বুকের কাটা দাগ আর সারা গায়ে ক্ষতচিহ্ন দেখে আমিই প্রথম আপনাকে লিং চি-র কথা বলি। দেবাশিসদা চিনেপাড়ায় যেতেন, তাই আমাদের সন্দেহ আরও প্রবল হয়। এমনকি কোনও চিনা দল গংসি- এর পিছনে আছে, সে বিশ্বাস আমাদের জন্মে যায়। এই গোটাটাই আমার ভুল। আমার ভাবনার ভুল। আমি নিজেও ভুল ভেবেছি, আপনাকেও ভাবিয়েছি। ফ্রিম্যাসনদের নিয়ে এত কিছু তো পড়েছেন। রমণপাষ্টি মানে জানেন?”  

“আরে! এটাই তো ছিল সেই বিশ্বজিতের কাছে দেওয়া চিরকুটে।”  

“হ্যাঁ। আমি অনেক খুঁজলাম কাল। প্রথমে পাইনি। তারপর ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’-র একটা ডিজিটাল ভার্সন খুঁজতে গিয়ে এটা পেলাম। পড়ে দেখুন। ছোট্ট ছোট্ট টীকায় কী লেখা আছে-

‘রমণগাষ্টি – ম্যাসনদিগের বর্গক্ষেত্র। বৃহৎ কোনও কার্যে লিপ্ত হইবার পূর্বে ম্যাসনগণ এই ছকক্রীড়ার মাধ্যমে আত্মবলিদান করিয়া থাকেন।” মানে পরিষ্কার। দেবাশিসদা নিজেই নিজের মৃত্যুকে স্টেজ করেছেন। ঠিক যেভাবে একজন সফল নাট্যকার করেন। আমরা সবাই তাঁর দেখানো পথে চলছি, তাঁর পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছি, তাঁর সাজানো ব্লু খুঁজে পেয়ে আনন্দে নেচে উঠছি। সোজা কথায় দেবাশিসদা আমাদের নিজের উদ্দেশ্যে ইউজ করছেন। এমনকি মৃত্যুর পরেও। শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। প্রায় তিন বছর ধরে উনি জাল বিছিয়েছেন। প্রমাণ চান? এই দেখুন”, বলে রামানুজের কাছ থেকে পাওয়া কাগজটা বাড়িয়ে ধরলাম অফিসারের সামনে।

“হ্যাঁ, এটা দেখেছি তো।”

“কাগজটা খেয়াল করুন। ঠিক যে কাগজে আমায় কবিতা লেখা হয়েছিল, সেই কাগজ। তবে আমায় লেখা কাগজের মতো এটা তাড়াহুড়ো করে ছেঁড়া না। একেবারে নিপুণভাবে ধৈর্য ধরে গোড়া থেকে কেটে নেওয়া, যাতে দেখেও না বোঝা যায় এই পাতা কোনও খাতা থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে।”

“তাতে কী হল?”  

“এবার ভালো করে দেখুন, এই কাগজের ঠিক উপরের কাগজে কিছু একটা লেখা হয়েছিল। এটায় তার ছাপ পড়েছে।”

এই ম্যাজিকটা আমি অফিসারের সামনেই দেখাব বলে ঠিক করেছিলাম। পকেট থেকে একটা কাঠপেনসিল বার করে খুব হালকা হাতে সেই ছাপের ওপরে বোলাতেই খুব চেনা চারটে লাইন সামনে এল—

“প্রিয়নাথের শেষ হাড় /তমুরের কাব্যগাথা/ গণপতির ভূতের বাক্স/তারিণীর ছেঁড়া খাতা”  

“এর মানে কী?”  

“মানে একটাই। যা ভাবছি, তাই ঠিক। এই কবিতা অনেক ভেবেই পাঠানো। তাড়াহুড়োতে না। এটা লিখে এমনভাবে ছেঁড়া হয়েছে যাতে মনে হয় দেবাশিসদার তাড়া ছিল। এটা লেখার বেরিয়েছে বললেন?”

পরেই তিনি বিশ্বজিতের নির্দেশটা লেখেন। ভালো কথা, বিশ্বজিতের পোস্টমর্টেমে কী যেন “ও হ্যাঁ। দিন পনেরো আগে মারা হয়েছে। কিন্তু ওখানে ফেলা হয়েছে সেদিন বা আগের দিন। বড়ি খুব সম্ভব কোনও বরফের চাঁইতে বা মর্গে রেখে দেওয়া হয়েছিল। ডিটেইল পরে পাব। তবে যেটা ইন্টারেস্টিং, ছুরি দিয়ে NO লেখা ছিল না। একটা ত্রিভুজ আর গোল। চারদিকে লেখা ছিল JAHBOULON আমরা ওই অন-টা উলটে নো দেখেছিলাম।”

.

২।

অনেক সময় মানুষ উটপাখি হয়ে যায়। চোখের সামনে প্রমাণ থাকলেও দেখতে চায় না। আমরাও জাবুলনকে যেন দেখেও দেখতে পাচ্ছিলাম না। বিশ্বজিতের এই খুনটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব দেখানো কেন এমন করছে এরা? নিজের উপরেই রাগ ধরছে। বেশ জোরেই বলে ফেললাম, “আপনি এবার সত্যিটা বলুন দেখি।”  

“মিথ্যে কথা কী বলেছি তোমায়?”

“মিথ্যে বলেননি। সত্য গোপন করেছেন। ঠিক একশো বছর আগে কলকাতায় যে ঘটনা ঘটেছিল, তার তিনজন সাক্ষী ছিল। তারিণীচরণ রায়, গণপতি চক্রবর্তী আর প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। গণপতি বিয়ে করেননি। লিভ টুগেদার করতেন সার্কাসের হিঙ্গনবালা ওরফে হরিমতীর সঙ্গে। সুতরাং গণপতির যা কিছু জানা ছিল সব তাঁর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। তাঁর কোনও উত্তরাধিকারীও নেই যার কাছে কোনও সূত্র থাকতে পারে। তারিণীর উত্তরাধিকারী আমি। দেবাশিসদা আমায় খুঁজে বার করেছেন ঠিক। আর থাকেন আপনি। যাকে দেবাশিসদা বিনে পয়সায় পড়াতেন, চ্যালা বলে ডাকতেন, বিয়েতে সাক্ষী করেছিলেন। আপনার পদবি মুখোপাধ্যায়… আর কিছু বলব?”

অমিতাভ মুখার্জির মুখে অদ্ভুত হাসি।

“কিছু জিনিস স্বীকার করতে নেই। বুঝে নিতে হয়। তুমি তো গোয়েন্দা। আমি সব বলে দেব কেন? তবে তোমার এটা বুঝতে এত সময় লাগল দেখে অবাক হচ্ছি।”  

“আর হ্যাঁ, আপনি আরও একটা মিথ্যে বলেছেন আমায়। আপনি আদৌ প্রিয়নাথের শেষ লেখাটা দেখেননি। যতটুকু শুনেছেন, দেবাশিসদার মুখে শুনেছেন। ভুল বললাম?”  

“এটা কেন বলছ?”  

“আমি খুব স্পেসিফিক্যালি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি ওই পাণ্ডুলিপি দেখেছেন কি না। আপনি বলেছিলেন দেখেছেন। তাতে কলকাতার এক জাদুকরের খুন নিয়ে কথা আছে। এদিকে ‘নীবারসপ্তক’ নামের ২০৬ নম্বর লেখা, যেটা প্রিয়নাথ লিখছিলেন, তার বেশ কিছু নোটস, কাটিং অরুণবাবুর ফাইলে আছে। সেখানে দেখি সম্পূর্ণ অন্য খবর। অন্য নোটস। বিশেষ করে অদ্ভুত কিছু দাঙ্গার, জাতিগত হানাহানির কথা আছে এতে। আমি নেটে চেক করেছি। কলকাতায় এই ধরনের দাঙ্গার সেই শুরু। প্রিয়নাথ এসব নিয়ে লেখেননি এটা হতেই পারে না। আমিও অবাক হচ্ছি, আপনাকে দেবাশিসদা কীভাবে বোকা বানিয়েছেন তা দেখে।”

“মানে?”

 “প্রিয়নাথের একটা লেখা চুরি করে আনেন দেবাশিসদা। ওতেই যদি সব থাকে তাহলে আপনাকে প্রয়োজন কোথায়? কোন জিনিস একমাত্র উত্তরাধীকারীর কাছেই থাকতে পারে? যার জন্য দেবাশিসদা আপনার খোঁজ করেছিলেন?”

“তাহলে খুলেই বলি। আমি এসব কিচ্ছু জানতাম না। বাবা ছোটোবেলায় মারা গেছেন। মামাবাড়িতে মানুষ। পৈতৃক বাড়িতে শরিকি সমস্যা। ঢুকতে পারি না। দেবাশিসদা আমায় পড়াতেন। আগেই তো বলেছি। ২০১২-তে গোপালচন্দ্রের ফাইলটা পেয়ে উনি উত্তেজিত হয়ে যান। বলেন যে করেই হোক, আমাকে শরিকি বাড়ির পজেশন নিতে হবে। মায়ের মুখে শুনেছিলাম প্রিয়নাথ দারোগা নাকি আমার কী সম্পর্কে প্রপিতামহ হন। একবার কথায় কথায় ওঁকে এটা বলেওছিলাম। তারপরেই উনি উঠে পড়ে লাগলেন। বললেন আর্কাইভে নাকি পুরোনো সব দলিল দস্তাবেজ থাকে। সেখান থেকে উনি আমার হক আদায় করে দেবেন। ওই পাণ্ডুলিপিতে নাকি প্রমাণ আছে।”  

“সে প্রমাণ আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?”

“না। এটা উনি দেখাতেন না। বলতেন সময় হয়নি। হলে সব আমাকেই দিয়ে দেবেন। আমিও ঘাঁটাতাম না।”

“বুঝতে পারছেন, কেন উনি চাইতেন আপনি ওই বাড়ির পজেশন নিন?”

“বুঝেছি। ভূতের বাক্স। দেবাশিসদা বলেছিলেন, লেখার একদম শেষে ছিল গণপতির ভূতের বাক্সের ভূতকে নাকি আয়ত্তে আনা গেছে। সেটার ধড় নাকি প্রিয়নাথের কবজায় রয়েছে।”

“আর মুন্ডু?”

“তারিণীর কাছে।”  

“বাহ। আর এটা আপনি এতদিন বলেননি? এই কি সেই গুপ্তধন, যার কথা দেবাশিসদা বলতেন?”

“তাই হবে হয়তো। আমি আসলে ব্যাপারটাকে খুব একটা পাত্তা দিইনি। অ্যাকাডেমিক খেয়াল ভাবতাম। উনি তো এটাও বলতেন, যদি সেটা খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনা যাবে।”

“প্রিয়নাথ ভূত নিয়ে ঠিক কী লিখেছেন? কোনও আইডিয়া আছে?”  

“স্পষ্ট কিছু না। তবে শুনেছি শুরুর দিকে প্রিয়নাথের লেখা যেমন অসামান্য বর্ণনাময়, শেষের দিকে কেমন যেন গুটিয়ে গেছে। অলংকারের ব্যবহার বেশি, সোজা কথাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লেখা, অনর্থক বাগাড়ম্বর। তবে ভূতের কাণ্ড নিয়ে নানা গল্প আছে। দেবাশিসদা সিরিয়াসলি বলতেন। আমার বিশ্বাস হত না। রূপকথার গল্পের মতো।”

“কীরকম?”

“সেই সময় কলকাতায় নাকি হঠাৎ হঠাৎ লোকজন পাগলের মতো আচরণ করতে আরম্ভ করেছিল। কোনও কারণ ছাড়াই কেউ ছাগল কাটতে গিয়ে ভাইয়ের গলা রামদা দিয়ে কেটে দিচ্ছে, খিদিরপুরে মুসলমান শ্রমিক হাসতে হাসতে হিন্দুর গলা টিপছে, বিদ্যুতের তার লাগাতে গিয়ে ইচ্ছে করে কাউকে মেরে ফেলা হচ্ছে— এমন সব। দুটো ব্যাপার অবশ্য খুব ইন্টারেস্টিং। এক, ঘটনার পরে কারও সে কথা মনে নেই আর দুই হাতের ছাপ নাকি বদলে যাচ্ছিল। তবে এসবের একটারও কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। হয়তো তাই এগুলো প্রিয়নাথ ছাপেননি। আষাঢ়ে গপ্পো আর কাকে বলে!”

আমি একটু চমকে উঠলাম। “আপনি আনন্দবাজারে কিছুদিন আগে এই খবরটা দেখেছেন? খিদিরপুরে হিজড়াদের খোলায় হয়েছিল? দেখুন, আমি মোবাইলে সেভ করে রেখেছি। বেশ ইন্টারেস্টিং।”

অফিসার “কই দেখি” বলে আমার হাত থেকে নিয়েই গম্ভীর হয়ে গেলেন। “এমনিতে তো ওপেন অ্যান্ড শার্ট কেস। কিন্তু…”  

“আপনি যে আষাঢ়ে গপ্পোগুলো বললেন তার সঙ্গে মিল পাচ্ছেন?” অফিসার উত্তর দিলেন না। শুধু উপরে নিচে মাথা নাড়লেন।

“আর-একটা তথ্য দিই? সেদিন জবানবন্দি নেবার সময় রামানুজ বলে ফেলেছিল, বিশ্বজিৎ নাকি এই খিদিরপুরের খোলাতেই যেত। তারিখটা দেখুন। রামানুজের সঙ্গে দেখা হবার কয়েকদিন আগে। মিলছে? রামানুজ যা বলছে, আমার ধারণা ও তার থেকে অনেক বেশি জানে। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে দেবাশিসদার ওই কাগজটা ও ইচ্ছে করেই আমাদের দিল। হয়তো দেবাশিসদার এমনই নির্দেশ ছিল। কে সত্যি কে মিথ্যে বলছে, আর কে সত্য গোপন করছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না। জাল কোথায় কীভাবে পাতা আছে জানে? ওকে জেরা করতে হবে। ছাড়লে চলবে না।”

“বুঝলাম। তবে এত কাণ্ড কীসের জন্য সেটাই তো বুঝছি না। আঁটুনি ফসকা গেরো হবে না তো?”

আমি জানতাম ঠিক এই প্রশ্নটাই আসবে। ব্যাগ থেকে টেমারলেনে মোড়া পালার বইটা বার করলাম। মলাট দেখে মুখার্জির চক্ষু চড়কগাছ। হেসে বললাম, “যা ভাবছেন তা নেই। তবে যা আছে দেবাশিসদা সেটারই খোঁজ করছিলেন সম্ভবত।”

পাতা ওলটাতে বাংলা পালা-টা দেখতে পেলেন মুখার্জি। মুখে একটু হতাশ ভাব। “ওহহ এটা। দেখেছি তো আগে।”

“হ্যাঁ দেখেছেন। আমিও দেখেছি। কিন্তু লক্ষ করিনি। শৈলচরণের লেখা শেষ রচনা। খুব সম্ভব এটার জন্যেই মরতে হয়েছিল তাঁকে। আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই যৌনগন্ধী এক পালা। রূপকথার। কিন্তু প্রথমবার লক্ষ করিনি। কাল দেখতে গিয়ে বইয়ের একেবারে শুরুতে এই বিজ্ঞাপন অংশে চোখ পড়ল। প্রায় দেখাই যায় না, কে যেন খুব হালকা হাতে পেনসিলে কিছু শব্দে দাগ দিয়েছে। শুধু শব্দগুলো পড়ুন”।

“সাবধান-ষড়-হত্যার-রাণী-জুবিলিতে। এর মানে কী?”

“উঁহুঁ! রিভার্স রিড। এগুলো উলটো করে পড়তে হয়। নাইট লিখেছেন।”

“জুবিলিতে রাণী হত্যার ষড়। সাবধান! জুবিলি কী?”

“সেটা আমিও জানতাম না। নেটে কাল খোঁজ করে পেলাম। মহারানি ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহণের ডায়মন্ড জুবিলি উপলক্ষ্যে ১৮৯৭ সালে বিরাট এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একটা ইংল্যান্ডে, অন্যটা এই দেশে। এমনকি সেই উপলক্ষ্যে স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়ার নাকি ভারতে আসার কথা ছিল। সেই প্রথমবার। শেষ অবধি কিছু একটা হয়। কী হয়, জানা নেই। আচমকা রানির ভারতে আসার প্ল্যান বাতিল হল। যদি এই লেখা সত্যি হয়, তবে তো বলতে হয় রানিকে খুনের এমন কোনও ষড়যন্ত্র হয়েছিল যা শেষ মুহূর্তে ধরা পড়ে যায়। কারণ এই লেখার সাল দেখুন। ঠিক তার আগের বছর।”  

“সেটা কি সেই ভূত দিয়ে?”  

“হতেই পারে। আর সেই ভূত এমন একটা কিছু, যা সাধারণের ধারণার বাইরে। যা মানুষকে নিমেষে পাগল করে দেয়। হাতের ছাপ বদলে দেয়। জন এফ কেনেডিকে যে মেরেছিল, সেই লি হার্ভে অসওয়াল্ড, বারবার বলেছিল তার খুনের ঘটনার কিচ্ছু মনে নেই। তার গত চব্বিশ ঘণ্টার স্মৃতি কে যেন মুছে দিয়েছে। ভুলে গেছেন? বিচারসভায় নিয়ে যাবার সময়ই তাকে খুন করা হয়। পাছে আরও কিছু সত্য বেরিয়ে আসে।”

“তুমি বলতে চাও এবারও তেমন কিছু হচ্ছে?” আমি গতকাল উর্ণার থেকে পাওয়া কাগজটা অফিসারের হাতে দিলাম। “এ কী! এ তো…”

“একদম তাই। আপনার চেনা চিহ্ন। কিন্তু তাড়াহুড়ো করা যাবে না। এরা অত্যন্ত হুঁশিয়ার জানান দিচ্ছে। আমাদের চেনাশোনার মধ্যে একমাত্র উর্ণার বাবা আছেন, যিনি হয়তো এদের আর বিপদজনক। এরা কিছু করতে চাইছে। রিচুয়ালিস্টিক খুনের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব সঙ্গে জড়িত এবং ভাগ্যক্রমে এখনও জীবিত। কিন্তু বাকি কারা আছে? তাদের কী কাজ? কিচ্ছু জানি না। আপাতদৃষ্টিতে এটা আর দশটা এনজিও-র মতোই। আইনি পথে এগোনো যাবে না। একেবারে গোপনে কাজ করতে হবে।”

“কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না। এখন তো রানি নেই। এখন এদের উদ্দেশ্য কী?”

“একটু আগে স্টিফেন নাইটের বইয়ের কথা বলছিলাম তো আপনাকে। ইংল্যান্ডের আসল চালক নাকি এখন এই ফ্রিম্যাসনরাই। ধরে নিন এই নতুন করে উঠে আসা জাবুলনরা ঠিক সেটাই চাইছে। প্রথমেই গোটা দেশে ঝামেলা বাধিয়ে দেবে। মানুষ মানুষকে মারবে পাগলের মতো। জাতিদাঙ্গা বাধবে। ভূতের প্রভাবে মানুষ আর মানুষ থাকবে না। তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পাবে। এসব আসলে ডেমো। নিজেদের জানান দেওয়া। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া। ভক্ত তৈরি করা। যারা দুর্বল তাদের অনেকেই কেউ ভয়ে, কেউ ভক্তিতে তাদের সমর্থন করবে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, ভূতের পরাক্রমের কথা জানতে পারলে দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দল এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আর সেই সুযোগে চলবে দরদাম। টাকার। ক্ষমতার দেশের আসল নিয়ন্ত্রণ এসে যাবে এদের হাতে। কিং না হয়েও কিং মেকার।”

“কী সাংঘাতিক! যা বলছ, তা যদি সত্যি হয়, তবে তো ভয়ানক ব্যাপার! কিন্তু এতদিন চুপ থেকে ঠিক এখনই কেন জেগে উঠল এঁরা?” অফিসারের মুখে কেমন একটা হতভম্ব ভাব।

আমিও কাল রাত জেগে ঠিক এটাই ভাবছিলাম। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কফি হাউসের সামনে গোপালের বলা কথাগুলো মনে পড়ল। আর এক মুহূর্তে সব কুয়াশা যেন সরে গেল চোখের সামনে থেকে। এডা তো সেমিফাইনাল। ফাইনাল হইব নেস্ট ইয়ার”

একটু হেসে বললাম, “এই বছরটা ভুলে গেলেন অফিসার মুখার্জি? ২০১৮। সবে পঞ্চায়েত ভোট শেষ হল। সামনের বছর ভারতের সবচেয়ে বড়ো উৎসব। লোকসভা নির্বাচন। সেই একশো বছর আগের জুবিলির মতো। এরা এতদিন শুধু চুপচাপ অপেক্ষা করছিল। এখনই তো এদের জেগে ওঠার পালা। উঠছেও হিলির ভূত কী জিনিস জানি না, কীভাবে তাকে জব্দ করব তাও জানা নেই। তবু আমি আমার মত এগোচ্ছি। আপনি বরং একটা কাজ করুন। আপনার দপ্তরে খোঁজ নিন আর কোথায় কোথায় এই ধরনের অদ্ভুত খুনোখুনি হচ্ছে। সব খবর পেপারে আসে না। দরকার হলে সেখানে গিয়ে সরজমিনে জিজ্ঞাসাবাদ করুন। আমি নিশ্চিত, কিছু না কিছু ক্লু পাওয়া যাবেই। তবে আবার বলছি। যা করবেন, গোপনে করবেন। আপনার দপ্তরেও যে এঁদের লোক বসে তার গ্যারান্টি কোথায়? দেরি করা যাবে না। হাতে একদম সময় নেই।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *