পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

অষ্টম পরিচ্ছেদ— দুঃস্বপ্ন

অষ্টম পরিচ্ছেদ— দুঃস্বপ্ন

৩ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৫, রাত ১১.৫০

ইংল্যান্ডের বার্নমাউথের ছোট্ট বাগানবাড়িটায় সন্ধে না হতেই খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই শুয়েপড়ে। ইদানীং বাড়ির মালিক অসুস্থ হয়ে পড়ায় কারও আর রাত জাগা হয় না। মালিক আগেই অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু দিন পনেরো সেটা বেড়েছে। লন্ডন থাকাকালীন এক ভোরে বেরিয়ে কাউকে না জানিয়ে কোথাও একটা গেছিলেন তিনি। ফেরার পরে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। মুখের হাসি মুছে গেছে, একা থাকেন, কী যেন বিড়বিড় করেন সারাক্ষণ। স্ত্রী ফ্যানি বহুবার জিজ্ঞাসা করেছেন, “কী হয়েছে লুই? আমায় খুলে বলো।” উত্তর আসেনি। স্পষ্টতই এড়িয়ে গেছেন নানা অছিলায়। তবে ফ্যানি একটা কথা বুঝেছেন। ভয়ানক কোনও একটা অভিজ্ঞতায় লুইয়ের অন্তরাত্মা অবধি শিহরিত হয়ে গেছে। কথায় কথায় রেগে যাচ্ছেন। জিনিসপত্র ছুড়েছুড়ে ফেলছেন, আবার পরক্ষণেই চাকরদের বলছেন সদরের দরজা ভালো করে আটকে দিতে, যাতে কেউ ঢুকতে না পারে। নিজের হাতে টেনে দিচ্ছেন জানলার ভারী পর্দা। মাঝে মাঝে সেখান থেকেই উঁকি মেরে কীসব যেন দেখার চেষ্টা করছেন। ফ্যানিকে তো একদিন নিজের ঘর থেকে তাড়িয়েই দিলেন, “চলে যা ডাইনি! তোর জন্যেই আজ আমার এই অবস্থা”, আবার পরদিনই হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইছেন। এই লুইকে ফ্যানি চেনেন না। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকেই ধুম জ্বর এল লুইয়ের। সেই ভয়ানক জ্বরের ঘোরেই কথা বলে চলেছেন, “দিনগুলো সব রাত হয়ে গেছে, রাতগুলো দিন। এ এক অদ্ভুত রাত, যেখানে সব বিড়ালের রং ধূসর আর সব ভালোর রং কালো…” কিছুই বুঝতে পারতেন না ফ্যানি। ভাবতেন সব সেরে যাবে একদিন।

তিন তারিখ প্রায় মাঝরাতে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল লুইয়ের আর্তনাদে। ভয়ংকর বীভৎস কিছু দেখলে মানুষ যেমন মরণ আর্তনাদ করে, তেমনি। পাশের ঘর থেকেই দৌড়ে এলেন ফ্যানি। লুই তখনও অচেতন, কিন্তু কোনও এক দুঃস্বপ্ন দেখে গোঙাচ্ছেন। পাশে ঢাকা লণ্ঠনটা উসকে দিয়ে লুইয়ের দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগলেন তাঁর স্ত্রী। একবার, দুইবার, বারবার।

সারা গায়ে ঠান্ডা ঘাম, মাথার চুল অবধি ভিজে গেছে, ধড়মড়িয়ে লাল চোখে জেগে উঠলেন লুই। উঠেই বেশ চটে গেলেন ফ্যানির উপরে। “ডাকলে কেন আমাকে? আমি অসামান্য একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।” বলেই আবার পাশ ফিরে ঘুমোতে লাগলেন লুই। বোধহয় আবার স্বপ্নটা দেখার জন্য। সারারাত পাশে জেগে বসে রইলেন ফ্যানি।

পরদিন খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে চলে এলেন। তাঁর স্বামী। এমনটা সচরাচর ঘটে না। কিন্তু এসেও টেবিলে বসে থাকা বাকিদের সঙ্গে একটাও কথা বললেন না। যেন একমনে কী একটা ভাবছেন আর নাটকের সংলাপের মতো একের পর এক সংলাপ বলে চলেছেন। পাশেই ছিল সৎ ছেলে। লয়েড। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে তোমার?” ততক্ষণে লুইয়ের খাওয়া শেষ। তিনি টেবিলের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি আমার ঘরে যাচ্ছি। একটা লেখা মাথায় এসেছে। যতক্ষণ না দরজা খুলব কেউ আমায় ডাকবে না, ডিস্টার্ব করবে না, এমনকি বাড়িতে আগুন লেগে গেলেও না।” বলে যেতে যেতে অদ্ভুত একটা কথা বললেন, “ওরা অবাস্তব কাহিনি চায়, তাই তো? আমি এবার ওদের বাস্তবটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দেব।”

তিন দিন, তিন রাত ঘর থেকে বেরোলেন না লুই। ফ্যানি দরজার সামনে খাবার রেখে আসতেন, লুই সময়মতো খেয়ে নিতেন। চতুর্থ দিনের দিন, ফ্যানির ডাক পড়ল লুইয়ের ঘরে। ফ্যানি জানতেন এই ডাক আসবে। যে-কোনো লেখা লিখে লুই তাঁকে না দেখিয়ে ছাপতে দেন না। ঘরে ঢুকে ফ্যানির চক্ষু চড়কগাছ। গোটা ঘরে দোমড়ানো সাদা পাতা ছড়িয়ে আছে মৃত সৈনিকের মতো। খাটের উপরে মুখের ভিতর থার্মোমিটার আর হাতে প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া পেনসিল নিয়ে বসে আছেন লুই। তাঁর সারা মুখ মড়ারমতো সাদা। সামনে বিরাট মোটা একটা কাগজের পাণ্ডুলিপি।

ম্লান হেসে ফ্যানিকে বললেন, “তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। এই তিনদিনে প্রায় চৌষট্টি হাজার শব্দ লিখেছি। দিনে কুড়ি হাজারের বেশি। বল এবার তোমার কোর্টে।”

পাণ্ডুলিপি ফ্যানির দিকে এগিয়ে দিলেন লুই। বইয়ের নাম দেখেই চমকে উঠলেন ফ্যানি। নামভূমিকায় যিনি, তিনি তো সবার পরিচিত, সম্মাননীয় এক ডাক্তার! প্রথম পাতাতেই বড়োবড়ো করে লেখা, “The Curious Case of Dr Elly Henky Jr. and Hewed Raddy।” এরপর যখন পড়তে শুরু করলেন, ফ্যানির হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল ভয়ে। এ কী শুনছেন তিনি? এও সম্ভব! আর যদি সত্যিই সম্ভব হয়, তবে এই লেখা প্রকাশ পেলে কেউ রেহাই পাবে না। কেউ না। যে ব্রাদারহুডের কথা লুই লিখেছেন, তাঁদের গোপনতম তথ্য, নিগূঢ় ব্রহ্মাস্ত্রের কথা প্রকাশ পাক নিশ্চয়ই তাঁরা চাইবেন না। আর তাই শুধু লুই না, এদের ক্রোধের আগুনে দগ্ধ হবেন ফ্যানি, এমনকি তাঁর আগের পক্ষের ছেলে লয়েড-ও। কিন্তু লয়েডের কী দোষ। ও বেচারা তো কিছুই জানে না এসবের। ফ্যানির দুই চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। প্রথমে খেয়াল করেননি লুই। চোখ পড়তেই থেমে গেলেন।

“কী হয়েছে ফ্যানি?”

ফ্যানি প্রথমে কিছু বলছিলেন না। শুধু পাশাপাশি মাথা নাড়লেন। কিছু হয়নি।

লুই অত বোকা না যে ফ্যানির কথা সরাসরি বিশ্বাস করে নেবেন। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকলেন, জোর করলেন। অবশেষে ধরা গলায় ফ্যানি জানালেন, “কী বই লিখছ তুমি? জানো এই বই প্রকাশ পেলে কী হতে পারে? যাদের কথা লিখেছ, তারা কেউ আমাদের ছেড়ে দেবে ভেবেছ? ওদের ক্ষমতা অনেক। বরং তুমিই ছাপোষা লেখক। তোমায় কেউ বিশ্বাস করবে না। মাঝখান থেকে আমরা সবাই বিপদে পড়ব।”

“কিন্তু”, গলা কাঁপতে থাকে লুইয়ের, “এত বড়ো একটা ঘটনা জেনে ও চুপ করে বসে থাকব? আর ওরাই তো বলেছে আমায় এটা নিয়ে লিখতে।”

“কিন্তু সত্যিটা লিখতে বলেছে কি? তুমিই তো বললে, বলেছে রূপকথার মতো করে লিখতে। তেমন করেই লেখো। আসল নাম ঠিকানা দেবার দরকারটাই বা কী? আর তোমার গোটা লেখা ওই ওষুধটা নিয়ে। তুমি বরং গল্পের অভিমুখ ঘুরিয়ে দাও। মানুষের যে দুটো সত্তা, ভালো আর খারাপ–সেটাকে নিয়ে লেখো। তাহলে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।”

বলতে বলতে লুইয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই থেমে গেলেন ফ্যানি। সেখানে আষাঢ়ের মেঘের মতো অন্ধকার, হাত কাঁপছে, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত লয়ে। বিকৃত ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন লুই, “বেরিয়ে যাও। এখুনি বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে।” আর একটাও কথা না বলে ফ্যানি নেমে এলেন নিচে। গুম হয়ে ফায়ারপ্লেসের ধারে বসে রইলেন খানিক। আধঘণ্টাও গেল না। ঝড়ের বেগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন লুই। হাতে পাণ্ডুলিপির তাড়া।

“তুমি ঠিক বলেছ। আমাকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে”, বলে ফ্যানি কিছু বোঝার আগেই গোটা পাণ্ডুলিপি ছুড়ে দিলেন ফায়ারপ্লেসে। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল গোটা পাণ্ডুলিপিটাই। চেষ্টা করেও ফ্যানি একটা টুকরো অবধি বাঁচাতে পারলেন না।

তারপর কয়েকদিন ভূতগ্রস্তের মত কাটল লুইয়ের। কিছু লিখছেন না। শুধু কাগজে হিজিবিজি কাটছেন। নাম লিখছেন। নাম কাটছেন। আবার নতুন নাম লিখছেন। একই নামের অক্ষরকে এদিক ওদিক করে নতুন নাম বানাচ্ছেন। অবশেষে এলি হেনকি জুনিয়ার আর হিউড রাডির নামের পছন্দসই অ্যানাগ্রাম বানানো গেল। ফরাসি ভাষায় পারদর্শী লুইয়ের মনে হল এর চেয়ে ভালো কিছু হয় না। এই নামের ফরাসি মানে “JekIll” বা “I kIll”, আমি খুন করি। তারপর এক হপ্তায় মাত্র পঁচিশ হাজার শব্দের যে নভেলাটি তিনি বড়দিনের জন্য লিখলেন, সেটা পড়ে ফ্যানির আপত্তির কিছু রইল না। বড়দিনের পরপরেই বাজারে লংম্যানস, গ্রিনঅ্যান্ড কোং থেকে প্রকাশ পেল নতুন বই, “The Strange Case of Dr. Jekyll and Mr. Hyde, WrItten by Robert LouIs Stevenson।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *