অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী
সামান্য বিদ্যা যথাযথ পর্যায়ে পড়ে না বলে তা অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়। যথার্থ জ্ঞান না থাকায় সামান্য বিদ্যা অর্জনকারীর মনে বিদ্যার অহঙ্কার জন্মে। ইংরেজিতে বলা হয়—A little learning is a dangerous thing. চীনদেশের দার্শনিক কনফুসিয়াস (খ্রি. পূ. ৫৫১-৪৯৭ অব্দ) বলেছেন— Learning Without thought is meaningless; thought without learning is dangerous. সুতরাং অল্পবিদ্যা আসল বিদ্যার পর্যায়ভুক্ত নয় বলে সেই বিদ্যার অধিকারী যে চিন্তা এবং কাজ করে তা ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিকর বলে এই প্রবাদের প্রয়োগ হয়।
সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়-
বিদ্যয়া পূজ্যতে লোকে বিদ্যয়া সুখমশুতে।
বিদ্যা শুভকরী কিন্তু স্বল্পা বিদ্যা ভয়ঙ্করী।।
বিদ্যা দ্বারা লোকে সম্মান লাভ করে, বিদ্যা দ্বারা লোকে সুখ ভোগ করে, বিদ্যা অতিশয় শুভকরী; কিন্তু স্বল্প বিদ্যা অতীব ভয়ানক।
অল্পবিদ্যা যে ভয়ঙ্কর সে বিষয়ে বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে আমাদের দেশে। দু’একটি গল্প এরকম—
এক লোকের নাতি জ্বরে ভুগছে। ডাক্তারের কাছ থেকে বোতলে ওষুধ নিয়ে এলেন বৃদ্ধ। আগেকার দিনে ডাক্তারের দোকানে বিভিন্ন রকম ওষুধ মিলিয়ে তরল আকারে মিক্চার তৈরি করে শিশিতে পুরে দেয়া হতো। শিশি নিয়ে যেতে হতো ডাক্তারখানায়। শিশির গায়ে ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট বা কম্পাউন্ডার সাহেব কাগজ কেটে দাগ তৈরি করে লাগিয়ে দিতেন এবং কতক্ষণ পর পর কোন্ নিয়মে খেতে হবে তা লিখে দিতেন। তো নাতির ওষুধের শিশিতে লেখা ছিল—’সেবনের পূর্বে ভালো করিয়া ঝাঁকাইয়া লইবেন।’ অর্থাৎ ওষুধকে ঠিকমতো ঝাঁকিয়ে তারপর খেতে হবে।
ওষুধ খাওয়াবার সময় উপস্থিত। বৃদ্ধ তার নাতিকে ওষুধ খাওয়াতে প্রস্তুত। জ্বরে কাতর নাতিকে তুলে নিয়ে তিনি ঝাঁকাতে লাগলেন। অসহায় শিশু কান্না জুড়ে দিলেও বৃদ্ধের ভ্রূক্ষেপ নেই। অবশেষে মরণাপন্ন হয়ে বেহুঁশ হলো নাতি। মৃতপ্রায় শিশুকে বাঁচাতে সবাই এগিয়ে এসে বৃদ্ধকে গালাগালি দিল। বৃদ্ধের সামান্য লেখাপড়া ছিল, কিন্তু যথার্থ জ্ঞান ছিল না বলে সে কিছুতেই হার মানছিল না। তার মনে দেমাক্ ছিল যে, সে ঠিক কাজটিই করছে। সে শিশির গায়ের লেখা পড়ে সবাইকে দেখিয়ে জানাতে লাগলো যে, সে ভুল করেনি, কারণ তার বিদ্যা কম নয়।
দ্বিতীয় গল্প এরকম—
এক গ্রামে বাস করতো এক হাতুড়ে কবিরাজ। তার হাতযশ এবং চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান খুব বেশি বলে সে খুব অহঙ্কারী ছিল। আসলে সে চিকিৎসা বিষয়ে লেখাপড়া করেনি। শুধু কিছু বচন মুখস্থ ছিল তার। সে বচন টোটকা চিকিৎসা-সম্পর্কিত। একবার সেই কবিরাজের কাছে এলো চোখের রোগী। কবিরাজের মুখস্থ ছিলো-নেত্ররোগে সমুৎপন্নে কৰ্ণো ছিত্ত্বা কটিং দহেৎ। অর্থাৎ চক্ষুরোগ হলে দুই কান ছিদ্র করে কটি বা কোমর পোড়াতে হবে।
আসলে পূর্বোক্ত বিষয় ছিল অশ্বচিকিৎসার ব্যবস্থা। কিন্তু কবিরাজ অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো রোগীর চক্ষুচিকিৎসায় ঐ ব্যবস্থা প্রয়োগ করে বিপর্যয় সৃষ্টি করলো। ফলাফল ভয়ঙ্কর।
তৃতীয় গল্প নিম্নরূপ—
এক গ্রামে এক স্বল্পবিদ্যা জানা বামুনের বাস। টোল বা গুরুগৃহে সে শিক্ষা লাভ করেনি। কিন্তু নানা জায়গা থেকে সংস্কৃত বচন ও শাস্ত্রকথা সংগ্রহ করে সে মুখস্থ রাখে। সেসব বচন মাঝে মাঝে উচ্চারণ করে সে তার বিদ্যার পরিচয় দিতো। নিরক্ষর গ্রামবাসী তাকে নানা ধর্মীয় কাজে ডেকে ব্যবস্থা নিতো এবং পূজা-অর্চনায় পুরোহিত হিসেবে মান্য করতো। ঐ গ্রামে সে রীতিমতো ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ।
একদিন ঐ ভট্টাচার্য বামুন একটি সংস্কৃত শ্লোকে দেখলেন যে, জল ছাড়া তেলে ভাজা জিনিস, পায়েস, দই ও ছাতু—এসব শূদ্রের ঘরে তৈরি হলেও ব্রাহ্মণ তা খেতে পারে। এখানে পায়েস অর্থ দুধ জ্বাল করে বানানো ক্ষীর; দুধ ও চালের তৈরি পরমান্ন নয়। ভট্টাচার্য মহাশয় ব্যবস্থা করলো যে, ব্রাহ্মণেরা শূদ্রের ঘরে পরমান্ন খেতে পারবে। ব্যস্! আর যায় কোথা? পাশের গ্রামের ব্রাহ্মণেরা ঐ ভট্টাচার্যকে পতিত ও একঘরে করলো। শূদ্রের অন্ন খেয়ে বিশাল অন্যায় করায় তার এই শাস্তি। ক্ষীর ও পরমান্নের পার্থক্য না বুঝে বামুনগিরি করায় তার পক্ষে ক্ষতি হয়ে গেল বেশ।
আসলে দর্শনশাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য উপাধি পেয়ে থাকেন। আমাদের দেশে ভট্টাচার্য-বংশের সন্তান হলেই ভট্টাচার্য বলে পরিচয় দেয়, তার দর্শনশাস্ত্রে জ্ঞান থাক বা না থাক। ব্রাহ্মণের মূর্খ সন্তান ভট্টাচার্য হতে পারে না এবং ব্রাহ্মণ বলেও পরিচয় দিতে পারে না—এই হচ্ছে মূল শাস্ত্রীয় বিধান। তাই ভট্টাচার্য নামধারী কোনো মূর্খকে বলা হয় বিদ্যাশূন্য ভট্টাচার্য। আবার তাদের বিদ্যা অল্প বলে সে বিদ্যার প্রয়োগ সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ভয়ানকভাবে।