অয়েল পেন্টিং

অয়েল পেন্টিং

চৌরঙ্গির মোড়ে যখন পৌঁছল অরণ্য, বিকেল গড়াচ্ছে সন্ধের দিকে। আকাশ দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই। ঘন কালো রাশিরাশি মেঘ দিনের শেষ আলোর সবটুকু চেটেপুটে খেয়ে এখন স্ট্র্যাটেজিক টাইমআউট নিয়েছে! এক রাউন্ড হয়ে গেছে। আবার হয়তো শুরু হবে বৃষ্টির নতুন তাণ্ডব। শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। চৌরঙ্গি মোড়ের ইতিউতি জলে ডোবা। রাস্তা আর ফুটপাত আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। ফুটপাত ঘেঁষে সাবধানে পা বাড়াল অরণ্য। আজ অফিস থেকে একটু আগেই বেরিয়েছে সে। লিটল রাসেল স্ট্রিটে তার অফিস। সেখান থেকে হেঁটে চৌরঙ্গি যেতে মিনিট পনেরোর বেশি লাগে না। অরণ্যর লেগে গেল প্রায় ঘণ্টাখানেক।

কলকাতায় বর্ষা ঢুকে গেছে। বিনা নোটিশে যখন-তখন ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে কয়েক পশলা। বেরনোর মুখে অরণ্যর অফিসের সিনিয়র অ্যাকাউন্টেন্ট সন্তোষদা হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘বুঝলে অরণ্য, এসব লোকাল বৃষ্টি। রাসেল স্ট্রিটে ঝমঝমিয়ে পড়ছে। থিয়েটার রোড দেখবে, শুকনো খটখটে!’

অফিস থেকে বেরিয়ে চৌরঙ্গির দিকে হাঁটা লাগাতেই অরণ্য দেখল কালো পর্দায় ঢেকে গেছে আকাশ। কয়েক পলের মধ্যে যেভাবে হুড়মুড়িয়ে নামল বৃষ্টি, তাকে সন্তোষদার ‘লোকাল’ বলে মনে হয়নি। ন্যাশনাল বা ইন্টারন্যাশনালও হতে পারে! একটা চায়ের দোকানের এক কোণে কোনওরকমে গুটিসেটে মেরে বসে থাকতে থাকতে অরণ্যের মনে হয়েছিল, সঙ্গে ছাতা থাকলেও এই বৃষ্টি আটকাত না।

বৃষ্টি সামলে চৌরঙ্গি মোড়ে এসে গ্লোসাইন দেখে কিউরিও শপটা চিনতে পারল অরণ্য। হ্যাঁ, এই এই দোকানটার কথাই বলেছিল সতীশ। ফিন ডোর ঠেলে দোকানের ভিতরে ঢুকল সে। ক্যাশ কাউন্টারে এক মাঝবয়সী অবাঙালি ভদ্রলোক। তাকে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আইয়ে স্যার। কহিয়ে, ক্যায়া দিখায়ুঁ আপকো?’

অরণ্য বলল, ‘অয়েল পেন্টিং মিলেগা?’

‘হাঁ স্যার, কিঁউ নেহি’ বলেই ভদ্রলোক হাঁক দিলেন, ‘সামসুদ্দিনভাই…’।

দোকানটা বেশ বড়। প্রচুর কালেকশন। পুরোনো জিনিসের সম্ভার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল অরণ্যর। বাবরের আমলের গড়গড়া। আকবরের সময়কার তরোয়াল। হরিণের শিং দিয়ে তৈরি নানারকম ছড়ি। বাদশাহি আংটি, ব্রেসলেট। হাতির দাঁতের ফ্লাওয়ার ভাস। বেলজিয়ান গ্লাসের মিনে করা আয়না। হরেকরকমের মুখোশ। ভেলভেটের নকশাদার গয়নার বাক্স। দেড়-দুশো বছরের পুরোনো সব জিনিস। মন দিয়ে দেখছিল অরণ্য। এমন সময় সত্তরোর্ধ্ব এক প্রবীণ তাকে ডাকলেন, ‘ইধর আইয়ে সাব।’

স্টকরুমের সামনে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াতে চবনবাহার, কিমাম আর এলাচের গন্ধ ভেসে এল অরণ্যর নাকে। ইনিই তাহলে সামসুদ্দিন। দুধসাদা পাঠানি কুর্তা পরেছেন বৃদ্ধ। চোখে যত্ন করে পরা সুরমা রহস্যময় করে তুলেছে। ডান গালে মটরের দানার মতো একটা আঁচিল। ছুঁচলো দাড়ি। গা থেকে ভেসে আসছে মৃদু অথচ আচ্ছন্ন করা আতরের গন্ধ।

সামসুদ্দিন আয়েশ করে পান চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করলেন, ‘হাইট ক্যায়সা হোবে সাব? কোথা রাখবেন? ড্রয়িংরুম কে লিয়ে? ইয়া, বেডরুম?’

অরণ্য বুঝল, এরা খদ্দেরের মন মতো জিনিসই দেওয়ার চেষ্টা করে।

‘পাঁচ ফিটের মতো হাইট। ড্রইংরুমে রাখব। তবে সিনারি গোছের কিছু চাইছি না। একটু অন্যরকম।’ জবাব দিয়ে অরণ্য মোবাইলের ফটো গ্যালারি খুলে ড্রইংরুমের ছবি দেখাল সামসুদ্দিনকে।

বৃদ্ধ মিষ্টি হেসে বললেন, ‘সিক্সটিন বাই টু ভোওয়ানিপুর? আগরওয়ালসাব কি লর্ড হাউস?’ একটু থেমে ফের বলেন, ‘হাঁ, ইসকে লিয়ে একটা খাস অয়েল পেন্টিং দিখাতে পারব আপনাকে!’

ছবি দেখেই বৃদ্ধ চিনে গেছেন বাংলোটা! সতীশ বলেছিল এই কিউরিও শপ থেকে একটা সময় আগরওয়ালসাহেবের বাংলোতে নিয়মিত জিনিসপত্র যেত। তাই লর্ড বাংলো খুব ভালো করেই চেনেন সামসুদ্দিনের মতো পুরোনো কর্মচারিরা।

স্টকরুমে ঢুকে গেলেন সামসুদ্দিন। সাদা সিল্কের কাপড়ে মোড়া প্রায় পাঁচফুট লম্বা একটা পেন্টিং নিয়ে বেরিয়ে এলেন। পেন্টিংয়ের কভারটা খুলতে খুলতে সামসুদ্দিন বলেন, ‘সাব, একদম খাস চিজ আছে। পসন্দ হোবে আপনার।’

পেন্টিংটা দেখে মন ভরে গেল অরণ্যর। ছবিটা একটা ব্রিটিশ বাচ্চার। মাথা ভর্তি সোনালি চুল। দুষ্টুমিভরা নীল চোখ। গোলাপি গাল। লালচে ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লাল। অদ্ভুত হাসি মাখা মুখ। মাথাটা ইষৎ বাঁ দিকে হেলানো। গলায় ফিনফিনে সোনার চেন। নীল রংয়ের একটা তোয়ালে জামা পরে। হলুদ রংয়ের হাফপ্যান্টের ওপর। বাচ্চাটার দু’হাতে দুটো সোনালি বল। লাল রংয়ের কাশ্মিরী কার্পেটের উপর বসে বাচ্চাটা। ছবিটায় পিছনের দিকে দেখা যাচ্ছে মেটে রংয়ের কাঠের বেবিকট। কিছু খেলনাও রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পেন্টিংয়ের তলায় দেখল সোনালি রংয়ে লেখা, সেভেনথ মার্চ, এইট্টিন এইট্টি টু। তলায় আর্টিস্টের সই, অল্টার টমাস।

‘সাব, একশো পঁয়তিস সাল পুরানা হ্যায় ইয়ে পেন্টিং। অল্টার টমাস সাব নে বানায়া থা। উস জামানে কি জানিমানি পেন্টার হুয়া করতে থে। সির্ফ দো ম্যাহেনে কে লিয়ে আয়ে থে কলকাত্তা। তব হি ইয়ে পেন্টিং বানায়া গয়া থা।’

এতক্ষণ কিউরিও শপে ছিল বলে অরণ্য বুঝতে পারেনি, আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তবে একটু ঢিমেতালে। তুলোর মতো নরম বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন আদর করে দিচ্ছে। ট্যাক্সি ধরে ভবানীপুরে ফিরতে ফিরতে চুপচুপে ভিজে যাওয়া শহরটাকে অন্যরকম লাগছিল। কলকাতা তার কাছে নতুন। অরণ্যর পদবী সিনহা হলেও আসলে সে প্রবাসী বাঙালি। জন্ম ও বড় হওয়া মুম্বইয়ে। কলকাতায় এই প্রথম আসা। গারমেন্টস টেকনলজি নিয়ে বার্লিন ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি কোর্স করার পর দেশ-বিদেশের অনেকগুলো কোম্পানি অফার ছিল। কলকাতা বোধহয় টানছিল অরণ্যকে। ‘আগরওয়াল গারমেন্টস’এর চাকরিটা ও নিয়ে নেয়। ঋতুজা আর ডোডোকে নিয়ে তিনদিন হল কলকাতায় এসেছে। আগরওয়ালসাহেবের ভবানীপুরের বাংলোই আপাতত ওর ঠিকানা।

বাংলোটা এক কথায় অসাধারণ। ব্যস্ততম শহরের হৃদয়ে যে এমন এক টুকরো দ্বীপ থাকতে পারে, অরণ্য ভাবেইনি। বাংলোটার নাম লর্ড হাউস। বিশাল গেট পেরিয়ে সেখানে পা দিয়ে মন ভরে গিয়েছিল অরণ্যর। কেয়ারটেকার সতীশ জানত তারা আসবে। লর্ড বাংলোর সামনে তারা নামতেই হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলেছিল, ‘ওয়েলকাম স্যার, ওয়েলকাম ম্যাডাম।’

মেন গেট পেরিয়ে মোরাম ঢালা রাস্তা। দু’ধারে গোলাপ আর মরসুমি ফুলের বাগান। বাংলোর দরজায় পৌঁছে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল ওরা। কালচে সোনালি রংয়ের মেহগনি কাঠের আর্কগেট। দেড়শো বছরেরও বেশি পুরোনো বাংলোটাকে যেন ঘিরে রয়েছে ইতিহাসের পরিখা।

ঋতুজা উপচে পড়া খুশি নিয়ে বলেছিল, ‘অরণ্য, এমন বাংলোতে কখনও যে থাকব, ভাবিনি। স্বপ্ন দেখছি না তো?’

দোতলা বাংলোর নিচেতলায় ড্রয়িংরুম, কিচেন, গেস্টরুম। ওপরতলায় দুটো বেডরুম। সতীশ একেএকে সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। লর্ড বাংলো রোমান-গথিক স্টাইলে বানানো। সেই সময়কার কলকাতার ইংরেজ স্থাপত্যের সঙ্গে মিল রেখে এটাকে বানানো হয়েছিল। উডেন ফ্লোর, ফায়ার প্লেস ঝকঝক করছে। ক্যাবিনেট, সাইডবোর্ড, ডাইনিং টেবল, বুককেস সব অ্যান্টিক। লর্ড বাংলোর মতো। লংকেস ক্লকটাও এখনও টিকটিক করে জানাচ্ছে সময়!

সতীশের বয়স প্রায় পঞ্চাশ। তিরিশ বছর কেয়ারটেকারের কাজ করছে এই বাংলোতে। ওর কাছেই শুনেছিল এই লর্ড বাংলোর ইতিহাস। ১৮৬০ সাল নাগাদ এই বাংলো তৈরি হয় পার্ক স্ট্রিট থেকে খানিক দূরে, ভবানীপুরে। সে সময় কলকাতা সারা ভারতের রাজধানী। বাংলার লেফ্টন্যান্ট গভর্নর ছিলেন সিসিল বিডন। তাঁরই এক আত্মীয় আসেন লন্ডন থেকে। যিনি ছিলেন আর্কিটেক্ট। ভবানীপুরে তাঁরই তত্ত্ববধানে তৈরি হয় লর্ড বাংলো। তবে তখন এটা ছিল বাগানবাড়ি। পদস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীরা এখানে পার্টি করতেন। বিকেল থেকে শুরু হত খানাপিনা। চলত রাতভোর। ১৮৮০ নাগাদ এই বাংলো কিনে নেন উইলিয়াম গডফ্রে। পদস্থ ইংরেজ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী গডফ্রেসাহেবের সম্পর্ক ছিল খুব ভালো। কিন্তু কলকাতায় তাঁর মন টিকল না। তাঁর আটমাসের বাচ্চা উইল ম্যালেরিয়ায় মারা যাওয়ার পর আর থাকতে চাননি। স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যান লন্ডনে।

লর্ড বাংলো আবার চলে যায় ব্রিটিশ সরকারের হাতে। বাগানবাড়ির মতোই পড়েছিল দীর্ঘদিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগে এই বাংলো কেনেন কেশরিলাল আগরওয়াল। যিনি অরণ্যর বস সুরতলাল আগরওয়ালের বাবা। পরিবার নিয়ে মাসখানেক তিনিও ছিলেন এখানে। তারপর আলিপুরে অন্য একটি বাংলো কিনে চলে যান। তারপর থেকে লর্ড বাংলোই অফিসের গেস্টহাউস। সেভাবে এখানে কেউ যে থাকে, তা নয়। অফিসের কেউ কেউ এসে ওঠেন এখানে। কিছুদিন আগে চেন্নাই অফিস থেকে ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন মূর্তিনারায়ণ। দিন পনেরো পর তিনিও চলে যান হায়দরাবাদের অফিসের দায়িত্ব নিয়ে।

ফায়ারপ্লেস এখন আর ব্যবহার হয় না। তার সামনে রাখা কালচে কাঠের তেকোণা টেবলের উপর রাখা বহু পুরোনো একটা ক্যান্ডল স্ট্যান্ড দেখছিল ঋতুজা। ফায়ারপ্লেসের ডানদিকের দেওয়ালে কালো বর্ডারের মতো দাগ। অনেকদিন দেওয়ালে কোনও ছবি ঝোলানো থাকলে যেমন হয়। ঋতুজা জানতে চেয়েছিল, ‘এখানে কি আগে কোনও পেন্টিং ছিল?’

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। পুরোনো অনেক জিনিসই টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ওটা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই বাতিল করা হয়েছে।’ সতীশ জবাব দিয়েছিল।

অরণ্যর দিকে তাকিয়ে ঋতুজা বলেছিল, ‘এখানে একটা অয়েল পেন্টিং লাগালে দেওয়ালটা আরও খুলে যাবে।’ সতীশই তখন খোঁজ দিয়েছিল ওই কিউরিও শপটার।

আগের রাতে বৃষ্টিবাদলার জন্য আর পেন্টিংটা দিয়ে যেতে পারেনি কিউরিও শপের ডেলিভারি বয়রা। সকালে দিয়ে গেল। ফায়ারপ্লেসের ডানদিকের দেওয়ালে পেন্টিংটা লাগাতেই ঘরের চেহারাটা পাল্টে গেছে। ঋতুজাও ছবিটা দেখে মুগ্ধ। সবচেয়ে খুশি যেন ডোডো। ও যেন নতুন বন্ধু পেয়েছে! মাত্র সাতমাস বয়স। এখনও হাঁটতে শেখেনি ডোডো। হামাগুড়ি দেয়। ঋতুজা কোল থেকে নামিয়ে দিতেই হামা দিয়ে চলে গেল ছবিটার সামনে। হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছে ছবির বাচ্চাটার দিকে। খিলখিল করে হাসছে আর নানারকম আওয়াজ করে যেন কথা বলছে ছবির বাচ্চাটার সঙ্গে। বন্ধুর সঙ্গে খেলায় মেতে উঠেছে ডোডো।

অফিসে ঢোকার পর কাজের চাপে আর মাথা তুলতে পারেনি অরণ্য। ‘আগরওয়াল গারমেন্টস’ বিদেশে প্রচুর মাল রপ্তানি করে। এই সেকশনটাই আপাতত দেখতে হচ্ছে তাকে। বিস্তর কাজ। কাল আবার ফ্যাক্টরি সুপারভাইজ করতে যেতে হবে। যাবতীয় হোমওয়ার্ক সেরে রাখছিল অরণ্য। প্রাইভেট সেক্টরে টিফিনটাইম বলে কিছু হয় না। যে যার মতো কাজের ফাঁকে লাঞ্চ বা টিফিন করে নেয়। ছোট একটা প্যান্ট্রি আছে। স্যান্ডুইচ আর আমেরিকানো আনিয়ে নিয়েছিল সে। কখন যে সন্ধে পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি অরণ্য। ঋতুজার ফোনে ঘোর ভাঙল তার। দুটো রিং হওয়ার পর ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই ঋতুজার ভয় পাওয়া গলা শুনতে পেল অরণ্য।

‘অরণ্য, অরণ্য, ছবিটায় কিছু একটা আছে! ওটা, ওটা গোলমেলে…’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ঋতুজা।

অরণ্যও ঘাবড়ে গেল। ছবিতে আবার কি গোলমাল থাকতে পারে? নিজেও বুঝতে পারছে না। বলল, ‘কী হয়েছে? মাথা ঠান্ডা করে বলো।’

‘বিকেল থেকে বৃষ্টি পড়ছে। কাজের মেয়েটা চলে গেছে আগেই। সন্ধে নাগাদ সতীশও চলে গেল। সারাদিন ডোডো ঘুমোয়নি। ভেবেছিলাম, সন্ধের পর ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু ও ছবিটাকে ছেড়ে নড়তে চাইল না। ডোডোকে অয়েল পেন্টিংয়ের সামনে বসিয়ে কিচেনে ডিনার বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ কারেন্টটা চলে গেল। হাতড়ে হাতড়ে মোমবাতি খুঁজছি, তখনই দুটো বাচ্চার গলা শুনতে পেলাম। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। প্রথমে ভাবলাম ভুল শুনেছি। কান পেতে শুনলাম। নাহ, ভুল নয়! দুটো বাচ্চার গলা ভেসে আসছে! একটা ডোডোর। আর একটা কার? তাড়াতাড়ি মোমবাতি জ্বালালাম। যে অচেনা বাচ্চার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম এতক্ষণ, সেটা থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। দ্রুত বেরিয়ে এসে দেখি, ডোডোর হাতে একটা সোনালি বল। প্রথমে কিছু মনে হয়নি। ভাবলাম, আশেপাশে বোধহয় কোথাও পড়েছিল হয়তো। ও তুলে নিয়েছে। হঠাৎই খেয়াল পড়ল, একইরকম বল পেন্টিংয়ের বাচ্চাটার হাতে দেখেছি না!’

ঋতুজার গলা কাঁপছে। ফোনের এপারেও যেন ওর হার্টবিট শুনতে পাচ্ছে অরণ্য। হাঁপাতে হাঁপাতে ঋতুজা বলল, ‘দেখলাম, ছবির বাচ্চাটার হাতে একটাই বল! আর, আর…’ ঋতুজার গলা বুজে আসছে। ঢোঁক গিলে সে বলল, ‘আর দেখলাম, বাচ্চাটা তাকিয়ে রয়েছে আমারই দিকে! জানো, মিঠে হাসিটা ছিল না ওর। তার বদলে ছবিটার মুখে যেন একরাশ বিরক্তি। যেন আমার আসাটা পছন্দ হচ্ছে না ওর! মোমবাতির আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, নীল নয়, ওর চোখ দুটো লাল। কারেন্টটা এল তখন। নিমেষে পাল্টে গেল সব কিছু। অবাক হয়ে দেখলাম, ছবির বাচ্চাটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে। দুটো সোনালি বলই ওর হাতে। ডোডোর হাত শূন্য।’

ঋতুজার কথা শুনে অরণ্য থমকে গেল। ওই সুন্দর, নির্মল ছবিটা কি… ভুল হয়নি তো ঋতুজার? এ আবার হয় নাকি? না-না, ও ভুলই দেখেছে।

অরণ্য মোলায়েম হেসে বলল, ‘ঋতু, তুমি ভুল শুনেছো। বৃষ্টির আওয়াজ অনেক সময় এমন সাউন্ড এফেক্ট তৈরি করে, মনে হয় কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। নতুন জায়গা, তার উপর একদম ফাঁকা। আমরাও এমন জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত নই। ভুল শোনাটা অস্বাভাবিক নয়।’

‘আর ঋতু’, অরণ্য আবার বলল, ‘ছবির বাচ্চাটার হাত থেকে একটা বল ডোডোর হাতে যাবে কি করে? হয় নাকি!’

ঋতুজা এখন অনেক স্বাভাবিক। ফিরে পেয়েছে নিজের বোধ, বুদ্ধি। ‘কিন্তু আমি যে…’, আর একবার বলার চেষ্টা করল ঋতুজা।

‘না-না ঋতু, তুমি ভুলই দেখেছো।’ অরণ্যর মোলায়েম গলা শুনে ঋতুজা আনমনে বলল, ‘কে জানে। তাই হবে হয়তো।’

অরণ্য আর দেরি করল না। মুখে যতই বলুক, ঋতুজা সত্যি ভয় পেয়েছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা দরকার। হাতের কাজ দ্রুত শেষ করতে লাগল সে।

লর্ড হাউসে ঢুকে অরণ্য দেখল, সব স্বাভাবিক। অয়েল পেন্টিংটার মধ্যে কোনও পার্থক্য চোখে পড়ল না তার। ছবির বাচ্চাটা যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে। নাহ্, ঋতুজা ভুলই দেখেছে। ঋতুজার ভয় পাওয়া মুখটা নেই ঠিকই, কিন্তু মনে খচখচানি থেকে গেছে। কী যেন ভেবে চলেছে সে।

ডিনার করতে করতে ঋতুজা বলল, ‘অরি, আমি এতটা ভুল দেখলাম?’

‘আমরা এমন অনেক কিছু ভুল দেখি, শুনি। পরে তলিয়ে ভাবলে দেখবে, বাস্তবে সেটা হতে পারে না। এক ধরনের হ্যালুসিনেশন বলতে পারো। জার্মানিতে থাকাকালীন ড. হোবার্ট লো-র একটা বই পড়েছিলাম। নির্জনতা মানুষকে অনেক কিছু ভাবায়। বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই। তোমার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। ভবানীপুর জনবহুল জায়গায় হলেও এই বাংলোটা ভীষণ নিরিবিলি। তার উপর বৃষ্টিবাদলার দিন।’ নরম হেসে অরণ্য বলল, ‘ঋতু, তুমি ভুলই দেখেছো।’

খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে ঋতুজা বলল, ‘তাই হবে, ভুলই দেখেছি।’ পরক্ষণেই হাসতে হাসতে বলল, ‘তুমি আবার সতীশকে কিছু বলো না যেন। কী ভাববে বলো তো!’ অরণ্যও হেসে ফেলল।

ব্রেকফাস্টের পর বাগানটা ঘুরে দেখছিল অরণ্য। কতরকম যে গাছ রয়েছে এই বাগানে, তার ঠিক নেই। গোলাপই নানান কিসমের। মিষ্টি গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাগানময়। ভোররাতের বৃষ্টিধোয়া বাগানে গাঢ় সবুজ রং ধরেছে। সকালের নরম রোদ পিছলে পড়ছে গাছগুলোয়। বাগানের মাঝে শ্বেতপাথরের ফোয়ারাটার রূপ আরও খুলে গেছে। বেশ পুরোনো জিনিস। তবু ঠিকঠাক রয়েছে।

অরণ্য দেখল, পরাণ এসে গেছে। মালির কাজ করে এখানে। প্রতিটা গাছ থেকে ছিঁড়ে নিচ্ছে হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা। খুপরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গোলাপ গাছের গোড়ার মাটি নরম করে দিচ্ছে। যাতে বৃষ্টির জল না দাঁড়ায়। কয়েক দিন ধরেই পরাণকে দেখছে অর‍ণ্য। গ্রামের মানুষের যেমন সাধারণ চেহারা হয়, তেমনই। রোদে পুড়ে যাওয়া তামাটে মুখ। বয়স পঞ্চাশের আশেপাশে। গায়ে ময়লা হাফশার্ট। ফুলপ্যান্টটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে কাজ করছে। সকাল সকাল পরাণ চলে আসে কাজে। বিকেলে ফিরে যায় গ্রামে। সতীশের কাছে শুনেছে, পরাণ আসে সুন্দবনের কাছে কুলতুলি গ্রাম থেকে।

পরাণের কাছে গিয়ে অরণ্য জিজ্ঞেস করল, ‘কত দিন কাজ করছো এখানে?’

‘তা বছর সাতেক হবে বটে বাবু।’

পরাণ কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু একটা চাপা অস্থিরতা যেন ওর মধ্যে কাজ করছে। সে বারবার তাকাচ্ছে বাংলোর দিকে। অরণ্যর মনে হল, পরাণ যেন কিছু বলতে চায়। সে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবে পরাণ?’

‘না বাবু, মানে…’ যেন কিছু বলতে গিয়েও বলে উঠতে পারছে না পরাণ।

হাতের কাজ থামিয়ে পরাণ বলল, ‘বাবু ওই যে ছবিখান, ওটা… ওটা…’ একটু দম নিল পরাণ। অরণ্য অবাক হল। সে বলে উঠল, ‘কোন ছবিটা পরাণ?’

‘যে ছবিখান খরিদ করে আনসেন, ওটা ভালো নয় বাবু। ওটারে বিদায় করেন।’

‘কী বলছো, পরাণ!’ হেসে ফেলল অরণ্য।

‘মিছে কতা লয় বাবু। ছবিটায় অপদেবতা আসে।’

‘বাবু, বছর দশ আগের কতা। তখন মনচন্দানি ছায়েবের বাংলোতে কাম করি। একদিন ছায়েব একখান ছবি লয়ে আইলেন। কয়েক দিনের মধ্যে ছায়েবের দশ মাসের বাচ্চাটা মারা গেল বাবু। চোক্ষের সামনে ওই ঘটনা দেখসি। কী ফুটফুটে সিলো বাচ্চাটা। বাবু, ওই সেই ছবিখান। যেটা আপনি আনসেন। বাবু, ওটারে বিদায় করুন।’

পরাণ খুব উত্তেজিত হয়ে গেছে। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ। সে দু’হাত জোড় করে অনুরোধ করছে। অরণ্য চুপ করে গেল। গ্রামের লোকজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করে। কারও অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে ভাবে ভৌতিক কাণ্ড। মনচন্দানির দশ মাসের বাচ্চাটা ছেলেটা হয়তো হঠাৎ কোনও অসুখে মারা গেছিল। সেটা ঘটেছিল পেন্টিংটা কেনার পরই। গ্রাম্য পরাণ সেটার সঙ্গে ছবির যোগ দেখতে পেয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, পেন্টিংটাতে ভূত আছে। অরণ্য এইসব বুজরুকিতে কান দেয় না কোনওদিন।

অরণ্য কথা বাড়াল না। ঋতুজা আগের রাতে ছবিটার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে। ঋতুজা না হয় এই পরিবেশে নতুন। এত বড় বাংলোতে একা থাকলে মানুষ এমন কিছু দেখে যার বাস্তবের কোনও মিল নেই। কিন্তু পরাণের উপর বিরক্তই হল। মুখে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি সতীশের কাছে খোঁজ নেব। তুমি কাজ করো।’

দূর থেকে সতীশকে আসতে দেখল অরণ্য। কাছে আসতেই তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা সতীশ, মনচন্দানি বলে কাউকে চেনো।’

‘চিনি স্যর। শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তি। থাকেন নিউ আলিপুরে। কিন্তু কেন স্যর?’

‘পরাণ বলছিল, যে পেন্টিংটা আমি কিনে এনেছি, সেটা নাকি মনচন্দানির বাংলোতে সে এর আগে দেখেছে। পেন্টিংটা কেনার কয়েক দিনের মধ্যে মনচন্দানির দশ মাসের বাচ্চা মারা যায়!’

সতীশ হেসে ফেলল। বলল, ‘গ্রামের লোকেদের নিয়ে এই হল মুশকিল। কুসংস্কারে ভরা মন নিয়ে সব ঘটনাকে দেখে। এরকম আবার হয় নাকি! স্যর, আপনি প্লিজ রাগ করবেন না। আমি কথা বলছি পরাণের সঙ্গে।’

একটু থেমে সতীশ ফের বলল, ‘স্যর, আজ দুপুরের পর চলে যাব। মেয়েটাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। ক’দিন ধরে জ্বর। কিছুতেই কমছে না।’

অর‍ণ্য অনুমতি দিয়ে ফিরে এল বাংলোতে। আজ অরণ্যকে তাড়াতাড়ি অফিস যেতে হবে। কোম্পানির নতুন প্রোডাক্ট নিয়ে বসের সঙ্গে মিটিং। দুপুরের পর সোনারপুর যাবে। ফ্যাক্টরি সুপারভাইজ করতে। ফিরতে ফিরতে রাত হবে। কিন্তু পরাণের কথাগুলো মনটাকে খিঁচড়ে দিয়েছে।

ড্রয়িংরুমে ঢুকে অরণ্য দেখল, ডোডো ছবির বাচ্চাটার সঙ্গে খেলা করছে। আধোআধো ভাষায় কী যেন বলছে। হাসছে খিলখিল করে। দেখতে দেখতে অরণ্যর ভাবছিল, এত সুন্দর ছবিটাতে ভূত আছে! এরাও পারে বটে! নিজের মনেই হেসে ফেলল অরণ্য। ঋতুজার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করল না। বললে আরও ভয় পেয়ে যাবে। দ্রুত তৈরি হয়ে অফিস রওনা দিল অরণ্য।

ফ্যাক্টরি থেকে বেরোতে বেরোতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল অরণ্যর। সেই সকাল থেকে চলছে মিটিংয়ের পর মিটিং। বসের সঙ্গে মিটিং। ফ্যাক্টরি সুপারভাইজ। তারপর ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের সঙ্গে মিটিং। কম সময়ে প্রোডাকশন কী ভাবে বাড়ানো যায়, খতিয়ে দেখেছে অরণ্যের নেতৃত্বে পাঁচজনের একটা টিম। হাইটেকনলজি মেশিন এসেছে জার্মানি থেকে। তার ইন্সস্টলেশন নিয়ে ভিডিও কনফারেন্স। এক মিনিটও ফুরসত পায়নি অরণ্য। সব মিটিয়ে যখন অফিসের গাড়িতে ভবানীপুরের দিকে রওনা দিল, তখন সন্ধে নেমেছে। ক্লান্তিতে অবসন্ন লাগছে অরণ্যর। বিকেল পর থেকে আবার বৃষ্টিটা শুরু হয়েছে। মোবাইলটা অনেকক্ষণ সুইচঅফ ছিল অরণ্যর। অন করতেই দেখল, ঋতুজার অনেকগুলো মিসডকল অ্যালার্ট। সঙ্গেসঙ্গে ডায়াল করল ঋতুজার নম্বর। কিছুক্ষণ বেজে কেটে গেল। নিশ্চয় ডোডোকে নিয়ে ব্যস্ত। যা বিচ্ছু হয়েছে ছেলেটা! ওকে নিয়ে হিমশিম খায় ঋতু। ডোডো আসার পর পূর্ণতা পেয়েছে তাদের দাম্পত্য। যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে।

ঋতুজার ফোনে আবার ডায়াল করল অরণ্য। দুটো রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ করল ঋতুজা। ‘তুমি ফোন করেছিলে? আমি অফিসের মিটিংয়ে…’

কথা পুরো করতে পারল না অরণ্য। ফোনের ওপারে কারা কথা বলছে? দুটো বাচ্চার হাসি শুনতে পেল সে। দূর থেকে ভেসে আসছে চার্চের সাতটা বাজার ঘণ্টা। মিষ্টি গলায় ইংরেজিতে গান করছে কেউ। মেয়েলি কন্ঠস্বর। ঋতুজার নয়। অচেনা কেউ। সেই গান ছাপিয়ে ফিসফিস করে কে যেন কচিগলায় ডাকছে থেমে থেমে, ‘ডোডোওওও…ডোডোওওও?, ডোডোওওও… ডোডোওওও!’

ডোডোর হাসি শুনতে পেল অরণ্য। কে ডাকছে ওকে? ‘ঋতু…’ ঢোক গিলে কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল অরণ্য। তার সমস্ত বোধ, বুদ্ধি, বিচার হারিয়ে ফেলেছে অরণ্য। এসি গাড়িতে বসেও কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে অরণ্য। হাতের কাঁপুনি টের পাচ্ছে সে। ফোনের ওপার থেকে অরণ্য শুনতে পেল, কে যেন খুব ভালোবেসে ডোডোকে কাছে টানছে, ‘ডোডোওওও… ডোডোওওও, ডোডোওওও… ডোডোওওও! কাম হানিইই, কাআআম!’

যে ডাকছে, তার গলাটাও শিশুর মতো। আধোগলায় সেই ডাক। অরণ্য ফোনটা কাটার চেষ্টা করল। পারছে না। কিছুতেই ডিসকানেক্ট করা যাচ্ছে না কলটা। দুটো বাচ্চার খিলখিল হাসির শব্দ আছড়ে পড়ছে ওপার থেকে। যেন দুটো বাচ্চা খেলায় মশগুল। ঠিক তখনই ফোনটা কেটে গেল। আবার ঋতুজার নম্বর ডায়াল করল অরণ্য। আনঅ্যাভেলেবল বলছে। আবার, আবার, আবার…। পাগলের মতো ডায়াল করে যাচ্ছে অরণ্য।

লর্ড হাউসের সামনে গাড়িটা দাঁড়াতেই এক লাফে নেমে পড়ল অরণ্য। অঝোরে পড়ছে বৃষ্টি। সে সব ভুলে দৌড়তে শুরু করে বাংলোর দিকে। অরণ্য বুঝল, পুরো বাংলোটা অন্ধকার। কারেন্ট নেই। দরজার সামনে এসে মোবাইল টর্চটা অন করল অরণ্য। দরজা ভিতর থেকে লক করা নেই। হাতের চাপে সেটা খুলে যেতেই সে স্পষ্ট শুনতে পেল, দুটো বাচ্চার হাসি। ড্রইংরুমের দিক থেকে আসছে। সে কি সত্যি দুটো বাচ্চার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। ভালো করে কান পাতল অর‍ণ্য। হ্যাঁ, দুটো বাচ্চাই। একটা ডোডো। আর একটা বাচ্চা তবে কে? টর্চ জ্বালিয়ে কয়েক পা এগোল অরণ্য। হালকা আলোয় দেখল, ডোডো বসে রয়েছে ড্রইংরুমের মেঝের ওপর। আলো পড়ায় সে মুখ তুলে তাকিয়েছে অরণ্যর দিকে। অরণ্য দেখল, ডোডোর মাথাটা ঈষৎ হেলানো বাঁ দিকে। ঠোঁটের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। গলায় একটা পাতলা সোনার চেন। তার ঠিক পিছনে দেখা যাচ্ছে একটা বেবিকট। ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে কিছু খেলনা। পুরো ড্রইংরুমটাই যেন হুবহু ছবির ক্যানভাসে বদলে গেছে! ডোডোর হাতে দুটো সোনালি বল। তার ঠিক পিছনে বসে আছে একটা ব্রিটিশ বাচ্চা। সেই ছবির বাচ্চাটা! পেন্টিংয়ের আট মাসের শিশুর চোখে নীলচে আগুন। প্রচণ্ড আতঙ্কে অরণ্যর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। যাবতীয় শক্তি জড়ো করে কোনওরকমে অরণ্য চিৎকার করে উঠল, ‘ডোডো…!’

দপ করে জ্বলে উঠল ড্রয়িংরুমের সেন্ট্রাল ঝাড়বাতিটা। অবাক হয়ে অরণ্য দেখল, ডোডো একই রকমভাবে বসে রয়েছে মেঝে। অরণ্যকে দেখে বাড়িয়ে দিয়েছে তার দুটো হাত। ডোডোর হাতে কোনও বল নেই! অয়েল পেন্টিংটার দিকে চোখ গেল তার। যেমন ছিল তেমনই আছে! আগের মতো বাচ্চাটা বসে রয়েছে একশো পঁয়ত্রিশ বছরের পুরোনো ছবিতেই!

অরণ্য দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল ডোডোকে। সে দেখল, কিচেনের দরজার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে ঋতুজা। জলের ছিটে দিয়ে তার জ্ঞান ফেরাতেই সে আতঙ্কের চোখে আঙুল তুলে দেখাল ছবির দিকে। জড়িয়ে ধরল ডোডোকে। কাঁপা গলায় বলল, ‘ভূত! ভূত আছে অরি, ওই ছবিটাতে।’ হারিয়ে যাওয়া গলায় ঋতুজা বলে চলেছে, ‘ছবির বাচ্চাটাই ডোডোর সঙ্গে খেলা করছিল। অরি, আমি ভুল দেখিনি। বিশ্বাস করো, ভুল দেখিনি!’

অর‍ণ্য খুব ভালো করে জানে, ঋতুজা ভুল দেখেনি। সে নিজেও একটু আগে এগুলোই দেখেছে। ডোডো আর ঋতুজাকে জড়িয়ে ধরে অরণ্য বলল, ‘ছবিটাকে এখনই বিদেয় করব। কাল সকালেই চলে যাব এই বাংলো ছেড়ে।’

সতীশকে ফোন করল অরণ্য। সে ধরতেই বলল, ‘সতীশ এখনই বাংলোতে এসো। ভীষণ বিপদ। দেরি করো না, প্লিজ।’

‘কী হয়েছে স্যর?’ উদ্বেগ নিয়ে বলল সতীশ। সে জানে, অরণ্যর কোনও সমস্যা হলে চাকরি হারাতে হতে পারে তাকে।

অরণ্য বলল, ‘পরাণ ভুল বলেনি। ছবিটাতে কিছু একটা আছে। শুধু ঋতুজা নয়, আমিও দেখেছি।’

ঋতুজা আর ডোডোকে নিয়ে সে এখন বসে রয়েছে ডাইনিং টেবলে। সামনের দেওয়ালে ঝুলছে পেন্টিংটা। সেন্ট্রাল ঝাড়বাতিটা অদ্ভূত আলোআঁধারি বলয় তৈরি করেছে ড্রইংরুমের দেওয়ালে। ছবির বাচ্চার কোনও পরিবর্তন আর দেখা যায়নি। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে অরণ্য যা দেখেছে, তা মিথ্যে নয়। অরণ্যরও সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। যেন হারিয়ে ফেলেছে তার সব কথা। তাকে এক হাতে আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছে ঋতুজা। বুকের কাছে ডোডো।

সতীশ যখন এসে পৌঁছল, তখন আটটা বাজছে লংকেস ঘড়িতে। সতীশকে দেখে প্রাণ ফিরে পেল অরণ্য।

সতীশ বলল, ‘স্যর, পরাণের সঙ্গে আমিও পরে কথা বলেছি। ওর কথা শুনে মনে হয়েছিল, গ্রাম্য লোক। কুসংস্কারে ভরা। কী দেখতে কী দেখেছে। সারাদিন ব্যাপারটা মাথায় ঘুরছিল। মেয়েটাকে সন্ধেয় ডাক্তার দেখানোর পর ভাবলাম, নিউআলিপুর খুব দূরে নয়। একবার ঘুরেই আসি। ওখানে গিয়ে শুনলাম মনচন্দানিসাহেব কলকাতায় নেই। ওঁর বাড়ির সিকিউরিটির গার্ডকে আমি চিনি। সেও দীর্ঘদিন কাজ করছে সেখানে। তার কাছে জানলাম, পরাণের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এই পেন্টিংটা একটা নিলাম থেকে কিনেছিলেন মনচন্দানিসাহেব। তিনদিনের মাথায় তাঁর আটমাসের বাচ্চাটা মারা যায়। মনচন্দানিসাহেবের বাচ্চাটাও নাকি পেন্টিংটার সামনে সারাক্ষণ বসে থাকত। ওই ঘটনার পর ছবিটাকে বিদায় করা হয়। অনেকবছর পর সেই ছবি আপনি কিনে এনেছেন কিউরিও শপ থেকে। ওরাও বোধহয় জানে না, ছবিটা ভূতুড়ে। আপনি ফোন না করলে আমিই করতাম। দেরি করবেন না স্যর, চলুন পেন্টিংটা এখুনি ফেরত দিয়ে আসি।’

সতীশ নিজেই দেওয়াল থেকে নামাল ছবিটা। দ্রুত মুড়ে ফেলল সাদা সিল্কের কাপড়ে। তার উপর চাপিয়ে দিল পলিথিন পেপার। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। ট্যাক্সি ডেকে তার মাথাতেই বেঁধে দিল ছবিটা। সতীশকে ঋতুজা আর ডোডোর সঙ্গে রেখে অর‍ণ্য একাই রওনা দিল চৌরঙ্গির দিকে।

কিউরিও শপটা তখন বন্ধ হওয়ার মুখে। ক্যাশ মিলিয়ে নিচ্ছেন মালিক। উদভ্রান্ত অরণ্যকে হুড়মুড় করে কিউরিও শপে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। কোনও ভনিতা না করেই অরণ্য বলল, ‘এই ছবিটা ফেরৎ দিতে এসেছি।’

শপের মালিক বিরক্ত হয়েছেন। তবু বললেন, ‘কিঁউ স্যর? কুছ খারাবি হ্যায় ক্যায়া?’

অরণ্য ভেঙে বলল না। যেভাবে হোক ফিরিয়ে দিতে হবে পেন্টিংটা। ওরা না নিতে চাইলে চৌরঙ্গির ফুটপাতেই ফেলে রেখে যাবে। আর্তি নিয়ে অরণ্য বলল, ‘আমার বাচ্চাটা এই ছবিটা পছন্দ করছে না। টাকা দিতে হবে না। ছবিটা ফেরৎ নিন, প্লিজ।’

কিউরিও শপের মালিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অরণ্যর দিকে। তারপর বললেন, ‘পেন্টিং কা দাম আপকো ওয়াপস মিল জায়েগা।’ তারপর গম্ভীরগলায় ডাক দিলেন, ‘সামসুদ্দিনভাই?’

স্টকরুম থেকে বেরিয়ে এলেন সেই সামসুদ্দিন। কিউরিও শপের মালিক বললেন, ‘সামসুদ্দিনভাই পেন্টিং চেক করকে স্টোররুম মে রখ্ দিজিয়ে।’ অরণ্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপকা প্যায়সা লে লিজিয়ে স্যর।’

অরণ্য এগিয়ে গেল ক্যাশ কাউন্টারের দিকে। সামসুদ্দিন তখন খুলে ফেলেছেন পলিথিন পেপার, সাদা সিল্কের কাপড়টাও। ক্যাশ কাউন্টার থেকে টাকা নিচ্ছিল অরণ্য। সামসুদ্দিনের ডাকে পিছন ফিরল সে।

বুড়ো সামসুদ্দিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অরণ্যর দিকে। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে তাকে বলল, ‘লেকিন সাব, ইয়ে পেন্টিং তো হামনে দিয়া নেহি।’

‘কী বলছেন কী?’ উত্তেজিত পায়ে অরণ্য এগিয়ে গেল সামসুদ্দিনের দিকে। রেগে গিয়ে বলল, ‘এই ছবিটাই তো নিয়ে গেলাম। ভুলে গেছেন নাকি?’

অরণ্যর সামনে ছবিটা চুলে ধরেছে সামসুদ্দিন। প্রবল বিস্ময়ে সে থতমত খেয়ে গেল। অরণ্য অবাক হয়ে দেখল, পেন্টিংয়ে সব ঠিকঠাক আছে। ঠিক আগের মতোই। ছবির বাচ্চাটার চোখে মোহময়ী হাসি। ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ছে লাল। মাথাটা বাঁদিকে ইষৎ হেলান। গলায় সোনার চেন। নীল রংয়ের স্লিভলেস জামা। হলুদ রংয়ের হাফপ্যান্ট। বাচ্চাটার হাতে দুটো সোনালি বল। লাল রংয়ের কাশ্মিরী কার্পেটের উপর বসে আছে সে। ছবিটায় পিছনের দিকে দেখা যাচ্ছে মেটে রংয়ের কাঠের বেবিকট। ছড়িয়েছিটিয়ে কিছু খেলনা। প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে অর‍ণ্য দেখল, ছবির বাচ্চাটার মাথায় একরাশ কালোচুল। অরণ্য ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। কোথায় সেই ব্রিটিশ বাচ্চাটা। তার বদলে এই ওয়েল পেন্টিংয়ের ফ্রেমে তারই ছেলে ডোডো!

কাঁপা হাতে মোবাইল বের করে ঋতুজার ফোনে ডায়াল করল অরণ্য। আনঅ্যাভেলেবল। সতীশের ফোনও সাড়া দিচ্ছে না। ভয়ে, আতঙ্কে ভবানীপুরের দিকে দৌড়তে শুরু করল অরণ্য। দৌড়তে দৌড়তেই সে শুনতে পেল, দুটো বাচ্চার খিলখিল করে হাসি। আধোগলায় কে যেন ডাকছে, ‘ডোডোওওও…’!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *