৫
ইসলামাবাদে হোটেল পেতে অসুবিধা হল না আরিফের। রাওয়ালপিন্ডির ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটাই তাকে একটা ছোট্ট সুন্দর হোটেলে নিয়ে গেলেন। পৌঁছতে সন্ধ্যে সাতটা বাজল। বাজারের মধ্যে হোটেল। গমগম করছে চারদিক।
আরিফ কিছু খেয়ে একটা বড় শপিং মলে ঢুকল।
ঝা চকচকে শপিং মল। এদিক সেদিক ঘুরে তার মনে পড়ল তার একটা জুতো কেনা দরকার। সে একটা দোকানে ঢুকে জুতো কিনল। মলের ফুড কোর্টে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কোল্ড ড্রিংক্স খেল।
আরও বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক করে হোটেলে রাতের দিকে পৌঁছতে দেখল ইউনুস স্যার ফোন করছেন।
ধরল সে, “সালাম স্যার”।
“পৌঁছেছো তো সহি সালামাত?”
ইউনুস স্যার জানতে চাইলেন।
আরিফ হাসল, “জি জনাব। হোটেলেই আছি এখন,কাল সকালের দিকে বেরিয়ে ঠিকানাটা ঠিক খুঁজে নেব”।
ইউনুস স্যার বললেন, “ভাল করে ট্রেনিং কর আরিফ,আমাদের অফিসের অনেক নওজোয়ানের মধ্যে থেকে তোমাকে পছন্দ করা হয়েছে মানে তোমার মধ্যে পোটেনশিয়াল আছে বলেই করা হয়েছে,নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?”
আরিফ বলল, “অনেক শুক্রিয়া জনাব। আই শ্যাল ট্রাই মাই বেস্ট”।
ইউনুস বললেন, “ইউ শুড,ট্রেনিং ভাল হলে কিন্তু অ্যাব্রোডেও পাঠানো হয়,জানো তো?”
আরিফ বলল, “জি জনাব,ইন্টারভিউয়ের সময় সেরকম শুনেছিলাম। আপনাকে অনেক শুক্রিয়া”।
ইউনুস বললেন, “সাবধানে থাকো। বি ইন্টেলিজেন্ট। বি ব্রেভ। বাই। গুড নাইট”।
ফোনটা রেখে আরিফ ঠোঁট ওলটাল। ব্রেভ হবার কী আছে?
অদ্ভুত কথা!
সে রাতে আর কিছু খেল না।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কোল্ড ড্রিংক্সেই পেট ভরে গেছিল।
ঘুমিয়ে পড়ল সে।
রাতে খুব ভাল ঘুম হল। অপরিচিত জায়গায় ঘুমাতে তার কোন কালেই কোন সমস্যা হয় না। এক ঘুমে রাত কাবার হয়ে গেল। ভোরে উঠে স্নান সেরে নিল সে।
ব্যাগ গুছিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিওয়ালাকে মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই ঠিকানায় যেতে হবে জনাব। কত দূর এখান থেকে?”
বুড়ো ট্যাক্সিওয়ালা তার দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে ঠিকানাটা দেখে বলল, “ঘন্টাখানেক লাগবে। উঠে বসুন”।
আরিফ ট্যাক্সিতে উঠল।
ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “আপনি ব্যবসা করেন?”
আরিফ অবাক হয়ে বলল, “না। কেন বলুন তো?”
ট্যাক্সিওয়ালা বলল, “ঠিকানা তো খুরশিদ মার্কেটের। ওখানে ড্রাই ফ্রুটের পাইকারি বাজার আছে। তাই ভাবলাম”।
আরিফ হাসল, “না জনাব আমি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করি। ওই ঠিকানায় আমার ট্রেনিং আছে”।
ট্যাক্সিওয়ালা বলল, “ট্রেনিং?খুরশিদ মার্কেটে কীসের ট্রেনিং হয়?”
আরিফ বলল, “সেটা তো গিয়ে জানা যাবে জনাব। আমি তো কিছুই চিনি না”।
ট্যাক্সিওয়ালা বুঝদারের মত মাথা নাড়ল।
ইসলামাবাদ বেশ সাজানো গোছানো শহর। করাচীর মত গিজগিজে না। প্ল্যান করে তৈরী করা । আরিফের বেশ ভাল লাগছিল।
একটা ঘিঞ্জি বাজার মত জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ট্যাক্সিওয়ালা বলল, “নিন জনাব। আপনার খুরশিদ মার্কেট এসে গেছে”। আরিফ অবাক হল,চারদিকে গিজগিজ করছে দোকান। এটা দেখে কোন অফিস পাড়া বলেই মনে হচ্ছে না।
অল্টার টেকনোলজি,১৩ মাহমুদ রোড।
মোবাইলে ঠিকানাটা দেখে আরিফ এগোল।
রাস্তায় যেসব লোক ছিল,তারা প্রথমে মাহমুদ রোড চিনতেই পারল না। পাঁচ ছ জনকে জিজ্ঞেস করার পরে অবশেষে একজন দেখালো।
একটা সরু ঘিঞ্জি গলি। গলিতে ঢুকে খানিকটা এগনোর পর একটা ছোট্ট দোকান দেখতে পেল।
দর্জির দোকান। একজন বৃদ্ধ লোক বসে কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটছে।
আরিফ অবাক চোখে সেটা দেখে বুঝল কোন ভুল হয়েছে।
ইউনুস স্যারকে ফোন করল। ফোন রিং হয়ে গেল। ইউনুস স্যার ফোন ধরলেন না।
কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে আরিফ বৃদ্ধ দরজিকেই জিজ্ঞেস করল, “চাচা,এখানে অল্টার টেকনোলজির অফিস কোথায় আছে?”
বৃদ্ধ সেলাই থামিয়ে ফেজ টুপি খুলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আবার সেলাই করতে শুরু করল।
আরিফ আরেকবার ইউনুস স্যারকে ফোন করল।
ফোন এবার সুইচ অফ বলল।
অবাক হয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে আরিফ বৃদ্ধর দোকানের পাশে একটা মশলার দোকানে এক লোক বসে ছিল,তাকে জিজ্ঞেস করল, “জনাব,এখানে অল্টার টেকনোলজির অফিস কোথায় বলতে পারবেন?”
সে লোক তার দিকে তাকিয়ে থেকে বৃদ্ধ দর্জির দিকে দেখিয়ে বলল, “চাচাই জানে”।
আরিফ বৃদ্ধকে আবার জিজ্ঞেস করল, “চাচা”…
বৃদ্ধ বলল, “দোকানের ভিতরে ঢুকে একটা সিড়ি আছে। সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাও”।
আরিফ অবাক হল। কিন্তু বৃদ্ধের কথা অমান্য করল না। বৃদ্ধকে পাশ কাটিয়ে দোকানের ভিতরে ঢুকল।
খুব কম পাওয়ারের একটা বাল্বের আলোয় বাস্তবিকই একটা সিড়ি চোখে পড়ল।
আরিফ সিড়ি দিয়ে নামল। বেশ খানিকটা নামার পর একটা দরজা দেখল,ইতস্তত করে দরজা ধাক্কাল সে।
ধাক্কানোর সঙ্গে সঙ্গে এক যুবক দরজা খুলে দিল।
ছোট্ট একটা অফিস। দশ বারোটা কম্পিউটার আছে। সবাই চুপ চাপ বসে কাজ করছে। এসি চলছে।
তাদের করাচীর অফিসের সঙ্গে এই অফিসটাকে আরিফ মেলাতে পারল না।
করাচীর জিন্না রোডের ওপরে অত বড় অফিস যাদের তাদের কেন এই রকম জায়গায় ট্রেনিং করতে পাঠানো হবে?ছেলেটা তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “বলুন”।
আরিফ বলল, “আমি ট্রেনিঙের জন্য এসেছি”।
ছেলেটা বলল, “আরিফ?ইউনুস পাঠিয়েছেন?”
আরিফ ঘাড় নাড়ল।
ছেলেটা একটা চেয়ার এনে দিয়ে বলল, “বসুন”।
আরিফ চেয়ারে বসল।
ছেলেটা একটা কম্পিউটারে বসে পড়ল আবার।
আরিফ চুপ করে বসে থাকল।
কয়েক মিনিট পর দর্জিচাচা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ফলো মি”।
আরিফ চাচার মুখে ইংরেজি শুনে আরও অবাক হয়ে গেল।
চাচা তাকে নিয়ে একটা ছোট ঘরে প্রবেশ করল।
বলল, “বস”।
আরিফ বসল।
চাচা পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “দেখো”।
আরিফ কিছু না বুঝেই মোবাইলটা হাতে নিল,মোবাইকে একটা ছবি ছিল,দেখেই তার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল।
সে লাফিয়ে উঠে বলল, “একী?”
চাচা বলল, “তোমার আম্মি আব্বু,বালোচের ইন্ডিয়া সাপোরটেড বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে আজ একটু আগে শহীদ হয়েছেন.ওরা এসেছিল মুখে কালো কাপড় দিয়ে,তোমাদের গোটা গ্রাম শেষ করে দিয়ে গেছে ওরা”।
আরিফ মেঝেতে বসে পড়ল।
পরক্ষণেই ফোন বের করে বাড়িতে ফোন করল। আম্মি আব্বু দুজনের ফোনই সুইচড অফ বলছে।
সে দু হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল। চাচা চুপ করে চেয়ারে বসে থাকল।
কয়েক মিনিট পরে সামলে উঠে সে চাচাকে বলল, “আপনি কী করে জানলেন?এত দূরে এখানে খবরই বা এল কী করে?আর আমি এই অফিসে কী করছি?”
চাচা এবার উঠে এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আল্লাহ খবর দেন তার অনুসরণকারীদের। আমার জানার ছিল,আমি জানতে পেরেছি। ওরা আমাদের দেশটাকে শেষ করে দিচ্ছে। আমরা প্রতিশোধ নেব না আরিফ মিয়াঁ?”
আরিফের দু চোখ বেয়ে আবার জলের ধারা গড়াতে শুরু করল। সে আর উত্তর দিতে পারল না।
৬
আরিফকে একজন এসে একটা থালায় কাজু আর আখরোট দিয়ে গেল।
আরিফের মাথা কাজ করছিল না। চাচা তাকে মেঝে থেকে তুলে চেয়ারে বসিয়েছে।
নিজেকে সামলাতে আধঘন্টা লাগল তার।
এই পুরোটা সময় চাচা আরিফের সামনে বসে ছিল।
তার কান্না থামলে আরিফ বলল, “আমাকে আজকেই বাড়ি যেতে হবে। আপনি পারলে আমাদের অফিসে জানিয়ে দেবেন। আব্বু আম্মিকে আমি শেষ দেখা দেখতে চাই”।
চাচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “তোমাদের গ্রাম এখন বিদ্রোহীদের দখলে। ওখানে যাওয়া মানে নিজের মৃত্যু ডেকে আনা। একজনকেও ছাড়ছে না ওরা। দেখা মাত্র গুলি করছে। আমাদের সেনাও ওখানে ঢুকতে পারে নি”।
আরিফ বলল, “তাহলে আমি কী করব?”
চাচা বলল, “বদলা নিতে চাও না? বাবা মার খুনীকে মারতে চাও না?”
আরিফ কিছু সময় মাথা নিচু করে বসে থেকে বলল, “চাই”।
চাচা বলল, “প্রতিবছর বালুচিস্তানের প্রতিটা অঞ্চলে এই সব টেরোরিস্টরা একটার পর একটা গ্রামে হামলা করে। মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটায়। এমনি এমনি হয় বলে তোমার মনে হয়? এদের পিছনে আছে ইন্ডিয়ানদের হাত। একইভাবে ওরা আমাদের ভাইদের ওপর অত্যাচার করে চলেছে কাশ্মীরে। আমাদের মানুষেরা মার খেয়ে মরছে ওখানেও। আমরা যদি ওদের শাস্তি না দিতে পারি, তাহলে আয়নায় নিজের মুখ দেখা উচিত না আমাদের”।
আরিফ বলল, “আমি ইউনুস স্যারের সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি জানিনা আমি এখানে কী করে এলাম, এত বড় একটা ঘটনা ঘটল আমার সঙ্গে, আমার অফিসে ইনফর্ম করা উচিত”।
চাচা হেসে বলল, “বেশ। কথা বল’।
ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করল চাচা। তার দিকে রিসিভার এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও কথা বল”।
আরিফের ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। সে কোন রকমে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা ধরতে পারল।
ওপাশ থেকে ইউনুস স্যারের গলা ভেসে এল, “হ্যালো”।
আরিফ বলল, “স্যার আমি আরিফ বলছি”।
ইউনুস স্যার বললেন, “তুমি পৌঁছে গেছো?”
আরিফ কেঁদে ফেলল, “স্যার, আমার আম্মি আব্বু…”
ইউনুস স্যার বললেন, “জানি। তোমাদের গ্রাম এখন বালুচ জঙ্গীদের দখলে”।
আরিফ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “স্যার, আমার কি এখানেই ট্রেনিং ছিল? অ্যাড্রেসটা ভুল ছিল না তো?”
ইউনুস স্যার বললেন, “একদম ঠিক অ্যাড্রেসে পাঠিয়েছি তোমায়। চাচা যা বলেন, সেভাবে চল, অনেক উন্নতি করবে। বেস্ট অফ লাক”।
ফোনটা কেটে গেল।
আরিফ চাচার দিকে ক্লান্ত মুখে তাকিয়ে বলল, “ট্রেনিং কবে শুরু হবে আমার?”
চাচা বলল, “আজ, এখন থেকে”।
চাচা উঠে দেওয়াল আলমারীটাকে গায়ের জোরে ঠেলল। সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াল সরে গিয়ে সেখানে একটা কাঁচের দরজা এসে গেল। আরিফ দেখল একটা বিরাট ঘরে অসংখ্য লোক কাজ করছে। চাচা বলল, “দরজা পেরিয়ে চলে যাও”।
আরিফ স্খলিত পায়ে কাঁচের দরজাটা ঠেলল।
দরজা খুলে গেল। আরিফ দরজা পেরিয়ে ঘরটায় প্রবেশ করা মাত্র চাচা আলমারীটা আগের জায়গায় নিয়ে গেল।
চমকে পিছন ফিরল আরিফ। দেওয়াল আবার আগের মত হয়ে গেছে। কিন্তু এ যেন আশ্চর্য এক জায়গা। ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে দরজির দোকান পেরিয়ে সে বড় একটা ঘরে চলে এসেছে, যে ঘরে নাকি প্রবেশ করতে হয় কোন এক আলমারি সরিয়ে। প্রবল শোকের মধ্যেও আরিফের অবাক লাগছিল। এরকম জায়গা থাকতে পারে ইসলামাবাদে, এটাই তো কোন দিন কল্পনাই করে নি সে।
একজন মধ্যবয়সী লোক যেন মাটি ফুঁড়ে তার সামনে এসে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “ওয়েলকাম টু আই এস আই”।
আরিফ আই এস আই শুনে অবাক হয়ে হাঁ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল।
৭
“আরিফ আহমেদ খান। গ্রাম আজমানাবাদ। বালুচিস্তান। ওয়েস্ট পাকিস্তান।
ফাদার উসমান খান। মাদার আমিনা খান। রাইট”?
মধ্যবয়স্ক লোকটি তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।
আরিফ বলল, “রাইট। আমার সম্পর্কে এত কিছু জানলেন কী করে?”
লোকটা তার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি মিরান জাফর। ইউ ক্যান কল মি মিরান”।
আরিফ মিরানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা এত কিছু জানলেন আমার সম্পর্কে আর আমাদের গ্রামটাকে বাঁচাতে পারলেন না? আর আমিই বা কেন এখানে এলাম?”
মিরান তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক আরিফ। সমস্যাটা হল ওয়েস্ট বালুচিস্তানে আমাদের ফুল কন্ট্রোল নেই এই মুহূর্তে। ইন্ডিয়া আমাদের টেরোরিজম গ্রুপগুলোকে সাপোর্ট দিচ্ছে। তোমাকে যখন আমরা আমাদের কাজের জন্য পিক করেছিলাম, তখনও জানতাম না এই অ্যাটাকটা হবে। ওরা একেবারে অতর্কিতে আজ সকালে তোমাদের গ্রামটাকে আক্রমণ করেছে। আমাদের কিছু করার ছিল না। এটা সম্পূর্ণভাবে কাকতালীয় যে তুমি আজ এখানে এলে আর আজই ঘটনাটা ঘটল”।
আরিফ বলল, “মানে? আমাকে পিক করেছেন মানে? কবে পিক করলেন, কেন পিক করলেন? আমি কেন আপনাদের হয়ে কাজ করব?”
মিরান রাগল না। বলল, “যেদিন করাচীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলে সেদিনই আমরা পিক করেছি তোমাকে। ওখানে অনেকেই ছিল, কিন্তু আমাদের তোমাকে দরকার। উই নিড ইউ ইন কাশ্মীর আরিফ”।
আরিফ বুঝল না। বলল, “কাশ্মীর? মানে?”
মিরান হাসল, “ব্রেকফাস্ট করে নাও। তারপর বুঝিয়ে বলছি”।
আরিফ বলল, “আমার পক্ষে এখন কিছু খাওয়া সম্ভব না স্যার। আর এই মুহূর্তে আমি একেবারেই বিধ্বস্ত। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি বাড়ি যেতে চাই”।
মিরান বলল, “তোমাকে মঈনুদ্দিন বলে নি, তোমাদের এলাকা এখন পুরোপুরি বালোচ টেরোরিস্টদের দখলে?”
আরিফ মাথা নিচু করল।
মিরান বলল, “আমাদের দেশটাকে ওরা বিভিন্ন ভাবে কন্সপিরেসি করে শেষ করে দিচ্ছে, সর্বত্র আমাদের পাকিস্তানী সেনারা পিছিয়ে পড়ছে, দিনের পর দিন আমাদের মা বোনেদের কাশ্মীরে ইন্ডিয়ান আর্মি রেপ করছে, ভাইদের বিনা বাক্যে কুকুরের মত গুলি করে মারছে, তোমার নিজের আম্মি আব্বু, যারা তোমাকে এত কষ্ট করে এত আদর করে বড় করলেন, তাদের প্রতি তোমার কোন কর্তব্য নেই? তোমার প্রতিশোধ নেওয়ার কোন ইচ্ছা জাগছে না”।
আরিফ দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বলল, “আমার এই সকালটাকেই বিশ্বাস হচ্ছে না স্যার। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না আমার ফ্যামিলির ওপর দিয়ে এতবড় ডিজাস্টার হয়ে গেছে। যে গ্রামে আমি জন্মেছি, যে গ্রামে আমি বড় হয়েছি, সেখানে আজ এই অবস্থা… আমার বাবা মা…”
আরিফ কেঁদে ফেলল।
মিরান আরিফের কাঁধ চাপড়ে ল্যাপটপটা আরিফের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “কিছুক্ষণ আগে তোমাদের গ্রাম থেকে এই ছবিগুলো পেয়েছি ইউজিং ড্রোণ ক্যামেরা। জাস্ট ওয়াচ”।
আরিফ দেখল বেশ কয়েকটা বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়ার ছবি দেখল। জঙ্গীরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে বন্দুক নিয়ে উল্লাস করছে। আরিফ বলল, “প্লিজ আর দেখাবেন না। এত রক্ত আমি আর দেখতে পারছি না”।
মিরান বলল, “স্বাভাবিক। কোন সুস্থ মানুষ এই দৃশ্য দেখতে ভয় পাবে। কিন্তু আমাদের ভয় পেলে চলবে না। উই হ্যাভ ডিউটিজ টু ডু। রিভেঞ্জেস টু টেক। ওদের এত সহজে ছেড়ে দেব আমরা? এটা হতে পারে?”
আরিফ রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমাদের গ্রামে সেনা পাঠাবেন? আমাকে আর্মস দিন। আমিও যেতে চাই”।
মিরান হেসে আরিফের পিঠে হাত দিয়ে বলল, “এই তো, স্ফুলিঙ্গটা এসেছে। দ্যাটস দ্য স্পিরিট। হ্যাঁ, আরিফ, তোমাকে আর্মস দেওয়া হবে। কিন্তু তোমার গ্রামে যাওয়ার জন্য না। তোমাকে একটা আরো কঠিন মিশনে পাঠাবো আমরা। দেশের কাজে পাঠাব। তোমাকে শ্রীনগর যেতে হবে”।
আরিফ বলল, “সে তো ইন্ডিয়ায়। কী করে যাব?”
মিরান বলল, “সে দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দাও। আপাতত একটা কথা বল, আর ইউ রেডি”?
আরিফ বলল, “আপনি শিওর আমি কাজটা পারব?”
মিরান বলল, “টু হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর এই কাজটা তুমিই পারবে”।
আরিফ বলল, “কী করতে হবে আমাকে?”
মিরান খুশি হল। বলল, “লেটস হ্যাভ ব্রেকফাস্ট টুগেদার। তারপর সব জানাচ্ছি”।
৮
“নিজের ধর্মের মানুষের কথা কখনও ভেবেছো আরিফ?তারা একেকটা দেশে কত কষ্ট করে বেঁচে থাকছে,সেটা জানলে তোমার রক্ত গরম হয় না?”
আরিফকে খেতে দেওয়া হয়েছে। বাখরখানি। আরিফের গলা শুকিয়ে আসছিল। একটু খেয়েই রেখে দিয়েছে সে।
মিরানের প্রশ্নটা শুনে সে বলল, “খারাপ লাগে ঠিকই কিন্তু এর বেশি কোন দিন ভেবে দেখিনি”।
মিরান কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “আমাদের দেশের এটাই সমস্যা। সবাইকে দেশের কাজে ইন্সপায়ার করার দরকার পড়ে। আমরা জেনেও না জানার ভাব করে বসে থাকি। এই মুহূর্তে ভারতের হাত থেকে কাশ্মীরের আজাদি পাওয়াটা আমাদের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। দিনের পর দিন আমরা তোমাকে হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ করেছি,তুমি পাও নি?”
হঠাৎ করে তার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল মিরান।
আরিফ বলল, “হ্যাঁ,বিভিন্ন ভিডিও এসেছে আননোন নাম্বার থেকে,আমি আননোন নাম্বার দেখে সেগুলো আর খুলি নি”।
মিরান মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে,দেখো নি বেশ করেছো,তুমি হোটেলে চেক আউট করে এসেছো?”
আরিফ বলল, “না জনাব”।
মিরান বলল, “ওকে। আমি লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার রুমে যা আছে,সব নিয়ে চলে আসবে। তুমি আজ থেকে আমাদের সঙ্গে থাকবে।”
আরিফ বলল, “আমাকে কাশ্মীরে পাঠানো হবে কবে?”
মিরান হেসে বলল, “অধৈর্য হতে হবে না,ঠিক পাঠাবো তোমাকে”।
আরিফ বলল, “কী করতে হবে আমাকে?”
মিরান বলল, “ওরা তোমার ঘর জ্বালিয়েছে,গ্রাম জ্বালিয়েছে,বাবা মাকে নিষ্ঠুর ভাবে খুন করেছে। তোমার কী মনে হয়,আমাদের ইন্ডিয়াতে কী করা উচিত?”
আরিফ উত্তর দিতে পারল না। মিরানের দিকে তাকিয়ে থাকল।
মিরান বলল, “তোমাকে জানাব আমরা কী করব। আপাতত রেস্ট কর। একটা ছোট অপারেশন করতে একটা ছোট টিম যাবে। এই স্কোয়াডে তোমাকে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেই পাঠানো হবে। তবে তোমাকে সেলফ ডিফেন্স তো করতে হবে। তার জন্য রিভলভার আর লাইট মেশিনগান চালানো শিখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি”।
আরিফ মিরানের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “আমাকে একটা কথা বলবেন?”
মিরান বলল, “কী?”
আরিফ বলল, “এটা কি সুইসাইড মিশন?”
মিরান বলল, “ঠিক নেই। কেন?নিজের ধর্মের জন্য নিজের কুরবানী দিতে তোমার আপত্তি আছে?”
আরিফ মাথা নিচু করে বলল, “আমি জানি না,আমি পারব না কি”।
মিরান বলল, “দেন ইউ হ্যাভ টু ট্রাই টু সারভাইভ। তুমি যদি পারো,ফিরে এসো। আমি সে ব্যবস্থা করে দেব”।
আরিফ চুপ করে রইল।
মিরান বলল, “আওয়ার নেশন নিডস ইউ আরিফ। এটা কোন টেরোরিস্ট অরগানাইজেশন না। আই এস আই আমাদের দেশের সংস্থা। আমাদের গর্ব। বি প্রাউড টু বি এ পার্ট অফ ইট”।
আরিফ বলল, “আমার আব্বু আম্মি বেঁচে থাকলে আমি অত ভাবতাম না জনাব। আমার মাথা কাজ করছে না ছবিগুলো দেখার পর থেকে”।
মিরান বলল, “তাহলে সেটাকে তোমার উইকনেস না বানিয়ে স্ট্রেংথ বানাও। যারা তোমার নিজের লোকেদের মেরেছে,তাদের শেষ করে দেওয়ার শপথ নাও,ইউ হ্যাভ টু ডু ইট”।
আরিফ বলল, “ওকে। আই শ্যাল ডু ইট”।
মিরান খুশি হল, “দ্যাটস লাইক এ গুড পাকিস্তানী,লেটস মিট ইওর পার্টনারস”।
মিরান ইন্টারকমের ফোন তুলে বলল, “লেট দেম কাম”।
তিনজন মিরানের চেম্বারে ঢুকল।
একজন লম্বা মত ফর্সা। মিরান পরিচয় করাল, “মিট রজ্জাক,হি ইজ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট শার্প শ্যুটারস ইন পাকিস্তান”।
একজন ছটফটে ছোটখাটো মানুষ। মিরান বলল, “হি ইজ আমির,হি ওয়াজ এ লেফটেনান্ট ইন পাকিস্তান আর্মি,এন্ড লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট”…
মিরান তৃতীয় জনকে দেখাল, “শি ইজ আয়েষা,ফ্রম লাহোর। ইওর টিম লিডার। আয়েষা,সে হাই টু আরিফ”।
আয়েষা আরিফকে দেখে হাসল, “হ্যালো আরিফ”।
আরিফ হাসতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।
৯
“কিছুক্ষণ আগে মঈনুদ্দিন চাচার থেকে তোমার ঘটনাটা শুনলাম আরিফ। আই অ্যাম ভেরি সরি ফর ইউ। আমার নাম আয়েষা মির্জা”।
মিরান আয়েষাকে নির্দেশ দিয়েছে আরিফের দেখভাল করার। আয়েষা আরিফকে নিয়ে একটা ঘরে এসে বসেছে। ছোট ঘর। একটা টেবিলে ল্যাপটপ খোলা। আরিফকে চেয়ারে বসানো হয়েছে। আরিফের মেয়েদের সামনে একটা জড়তা আসে। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না,আই এস আই ইন্ডিয়াতে মিশনে যাবে,তার টিম লিডার হবে একজন মেয়ে।
আয়েষা সুন্দরী,জিন্স আর টি শার্ট পরে আছে।
আয়েষা আরিফের প্রশ্নটা যেন বুঝল। সে বলল, “আমি বর্ন এন্ড ব্রট আপ ইন দিল্লি। আমি একজন কাশ্মীরি মেয়ে। এই মিশনে আমার এক্সপেরিয়েন্স কাজে লাগবে। তোমরা কেউই কাশ্মীরকে চেনো না আমার মত,আমি যতটা ভাল করে চিনি,কাশ্মীরকে কেউ সেভাবে চেনে না”।
আরিফ বলল, “তুমি পাকিস্তানে এলে কী করে?”
আয়েষা বলল, “আমার ভাই ইন্ডিয়ান ফৌজের এগেইন্সটে একটা অহিংস মুভমেন্টে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। ওরা আমার ভাইকে মাঝরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গুলি করে মারে। আমি তখন দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করি। আমাকে কলেজ থেকেও বিনা কারণে বের করে দেওয়া হয়। হিন্দুত্ববাদীরা আমার মুখে কালি মাখিয়ে দেয়। আই ডিন্ট হ্যাভ এনি আদার চয়েস”।
আয়েষা মাথা নিচু করল।
আরিফ বলল, “সরি টু হিয়ার দ্যাট”।
আয়েষা বলল, “এখন আর সরি বলার সময় না আরিফ। লেট দেম পে বাই দেয়ার ওন কয়েন। শেষ করে দিতে হবে ওদের”।
আরিফ বলল, “আমাকে কী করতে হবে?”
আয়েষা বলল, “আমাদের ইন্ডিয়ান আইডেন্টিটি তৈরী করা হচ্ছে। কালকের মধ্যে হয়ে যাবে। পরশু দিন উই আর গোয়িং টু এন্টার ইন্ডিয়া”।
আরিফ বলল, “পরশু?”
আয়েষা বলল, “ইয়েস। আজ রাতেই জানিয়ে দিচ্ছি আমরা কী করে ইন্ডিয়ায় এন্ট্রি নেব”।
আরিফ বলল, “ওকে”।
আয়েষা বলল, “টেক রেস্ট। ইউ নিড টু টেক রেস্ট। আমি বুঝতে পারছি”।
আরিফ বলল, “আই জাস্ট নিড মাই পেরেন্টস। আমি আর কিছু চাই না”।
আয়েষা বলল, “মন শক্ত কর আরিফ। আমাদের প্রতিশোধ নিতেই হবে। এত সহজে ওদের আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। বার বার ওরা জিতে যাবে,এটা আমরা অ্যালাউ করব?বল?”
আরিফ বলল, “আমার একটা প্রশ্নই বার বার মাথার মধ্যে আসছে। আমার আব্বু আম্মি,আমার চাচা,এরা সবাই খুব নিরীহ মানুষ। কোন দিন কারো ক্ষতি করে নি। এদের মেরে এরা কী প্রমাণ করতে চায়?”
আয়েষা বলল, “ওরা আমাদের হারাতে চায়। সবখানে ওরা আমাদের হারাতে চায়। আমরা কাশ্মীরিরা পাকিস্তান সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ,তারা আমাদের কথা ভেবেছে। আমি পাকিস্তান সরকারকে এই সাহায্যের পরিবর্তে আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই”।
আরিফ বলল, “পাকিস্তান সরকার নিজের ঘর বাঁচাতে পারছে না,আমাদের গ্রাম বালুচ দস্যুরা দখল করে নিচ্ছে। কেন কিছু করতে পারছে না?”
আয়েষা বলল, “গিভ দেম সাম টাইম আরিফ। তারাও মানুষ। তুমি দেখবে,এই সব গদ্দারদের পাকিস্তান আর্মি কুকুরের মত মেরে তাড়াবে। শুধু একটু সময় দাও তাদের। আমাদের দেশের একাংশও ইন্ডিয়ানদের হেল্প করছে। তাদের আগে আইডেন্টিফাই করি। দেখবে তারপরে আর কোন অসুবিধা হবে না”।
আরিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একটা দিনে আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আমাকে যে এখানে বসে থাকতে হবে আজ, চব্বিশ ঘন্টা আগেও ভাবতে পারি নি”।
আয়েষা বলল, “আল্লাহপাক যা চান,আমাদের দিয়ে তাই করিয়ে নিচ্ছেন আরিফ। আমরা তার একজন অনুসরণকারী আর আজ্ঞাবহনকারী চাকর ছাড়া কিছুই নই। আমিও কোন দিন ভাবতে পারি নি পাকিস্তান আমাদের মত কাশ্মীরিদের দু হাতে বরণ করে নেবে। আমাদের জিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করবে। সবাই তো আমাদেরই বরাবর দোষ দিয়ে যায়,আমাদের দমন করে যায়,কিন্তু ইন্ডিয়ানরা কখনো আম কাশ্মীরিদের ব্যাপারে ভাবে নি। তারা আমাদের মানুষ বলেই মনে করে নি। আমরা কেন ছেড়ে দেব?আমরা উত্তর দেবই তাদের। ছাড়ব না”।
আরিফ বলল, “আমাকে একটু একা থাকতে দেবে প্লিজ?আমি অন্য কিছু ভাবতে পারছি না”।
আয়েষা মাথা নাড়ল, “ওকে আরিফ। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। টেক ইওর টাইম”।
আয়েষা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আরিফ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।