২৫
বিকেলবেলা তবরেজ এল হাউজবোটে।
আমিরের কাজ হয়ে গেছিল। তবরেজকে বুঝিয়ে দিল।
তবরেজ চলে যেতে বেগ বলল, “আমির, কালকের প্ল্যানে একটা চেঞ্জ হয়েছে। তোমাকে বলা হয় নি”।
আমির জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
বেগ বলল, “কাল থেকে আমাদের টিম স্প্লিট হয়ে যাবে। তুমি আর রজ্জাক তবরেজের সঙ্গে সেফ হাউজে চলে যাবে। আমরা পাঁচ দিন পর মিট করব”।
আমির কয়েক সেকেন্ড বেগের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওকে”।
বেগ বলল, “তোমার কোন আপত্তি নেই?”
আমির বলল, “আপনি সিনিয়র। আপনি যা বলবেন, মানতেই হবে”।
বেগ খুশি হল। বলল, “চল, আমরা ঘুরে আসি”।
কেউ আপত্তি করল না। আরিফের জ্বর কমে গেছিল। তার ঘুরতে ইচ্ছা করছি। দুর্বল শরীর সত্ত্বেও সে বেরোল।
শিকারা করে লেক রোডে পৌঁছে তারা দুটো অটো নিয়ে মুঘল গার্ডেনে গেল। অটো থেকে নেমে বেগ বলল, “তোমরা কিছু খাবে?”
পকোড়া ভাজা হচ্ছিল রাস্তার পাশে। আমির পকোড়া খেল। মুঘল গার্ডেনে ঢোকার পর আরিফ মুগ্ধ হল। এত সুন্দর বাগান। বেগ বলল, “শ্রীনগরে এলে আমি এখানে আসবই। আর এপ্রিলে টিউলিপ গার্ডেন”।
আরিফ বলল, “আপনি এখানে প্রায়ই আসেন”?
বেগ মৃদু হেসে বলল, “সে তো আসতেই হবে। এখানে না এলে হয়?”
অনেক বড় বাগান। সুন্দর করে কাটা ঘাস।
আয়েষা আরিফের পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “এখানে এসে ভাইজানের কথা মনে পড়ে গেল। ছোটবেলায় এসে খুব আনন্দ করেছিলাম দুজনে”।
থমকে গেল আয়েষা। আরিফ কী সান্ত্বনা দেবে বুঝতে পারল না। বেশ কিছু ট্যুরিস্ট আছে বাগানে। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ আড্ডা মারছে। ছোট ছোট কতগুলো বাচ্চা বাগানে দৌড়াদোড়ি করছে।
আরিফের হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল।
সে বাচ্চাদের মারবে? শিশুদের? হোক সে কাশ্মীরি, হোক সে ভারতীয়, যেই হোক, শিশু?
অসুস্থ বোধ করতে শুরু করল সে।
একটা বেঞ্চে বসল সে। একটা বাচ্চা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বায়না করছে কিছু একটা। ভাষাটা বুঝতে পারল না আরিফ। তার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আব্বু আম্মির সঙ্গে কোথাও গেলে খুব বায়না করত সে। নিজের দেশ থেকে এত দূরে বন্ধু বান্ধবহীন একটা পরিবেশ কান্না পেয়ে গেল তার। বেগ, আমিররা হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে গেছিল।
আয়েষা বলল, “লেকের ওপাশে আল্লাহর ঘর আরিফ। ওই সাদা মসজিদটা দেখা যাচ্ছে? আমাদের নবীজির মাথার চুলের একটা অংশ নাকি ওখানে আছে। তোমার শরীর খারাপ লাগছে?”
আরিফ মাথা নেড়ে না বলল। আয়েষা তার পাশে বসে বলল, “তুমি একটা ভয়াবহ মেন্টাল স্টেটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছো বুঝতে পারছি। আমিও যাচ্ছি। কিন্তু এই মুহূর্তে এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। এটাই উপায়”।
আরিফ চোখ বন্ধ করে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে স্মরণ করল।
আম্মি শিখিয়েছিল, যখনই কষ্ট হবে আল্লাহকে ডাকতে। চোখের কোণে জল এসে গেল তার।
আয়েষা ডাকল, “আরিফ”।
আরিফ বলল, “জি”।
আয়েষা বলল, “তোমার কি মাথা ধরেছে আবার? বেগ সাবকে বলে হাউজবোটে ফিরে যাবে?”
আরিফ বলল, “না না ঠিক আছে। তোমরা ঘুরে নাও। আমি বসছি। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছি বলে উইকনেস এসছে খানিকটা। ঠিক হয়ে যাবে”।
আয়েষা বলল, “তুমি ঠিক এই ধরণের কাজের জন্য উপযুক্ত না আরিফ। তোমাকে দেখলে মনে হয় তুমি হয়ত শায়ের হলে ভাল হতে”।
আরিফ হাসল, “আমরা কী করব, তা তো আমাদের হাতে নেই। আমরা প্রত্যেকেই কোন না কোন কাজে পৃথিবীতে এসেছি। অনেক কিছুই করা যেত। কিন্তু আপাতত সেগুলো না করে যে কাজের জন্য এসেছি, সেটাই করতে হবে”।
আয়েষা বলল, “এই দেশ আমার সব কেড়ে নিয়েছে আরিফ। আমি অনেক চেষ্টা করেও এই দেশের সম্পর্কে নরম হতে পারব না”।
আরিফ কিছু বলল না। আবার চোখ বন্ধ করে সর্বশক্তিমানকে ডাকতে শুরু করল।
২৬
রাত আটটা। তারা কিছুক্ষণ আগে ফিরেছে। আয়েষা তার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করছে।
আমির টিভি চালিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখছিল।
রজ্জাক বলল, “প্রিমিয়ার লীগ আছে। ওটা দেখতে পারো”।
আমির কানে দিল না।
রজ্জাক বলল, “হিন্দি সিনেমা ভাল লাগে?”
আমির মাথা নাড়ল, “দারুণ লাগে। আই লাভ অনুস্কা শর্মা”।
রজ্জাক বলল, “ওয়ে হোয়ে। তাহলে তো একবার মুম্বইও যেতে হচ্ছে জনাব”।
আমির বলল, “এনি ডে। জান দিয়ে দেব জানেমনের জন্য”।
রজ্জাক হেসে উঠল। আরিফও।
আরিফ ল্যাপটপ খুলে ক্যামেরা পোজিশন দেখছিল। আর্মি মার্চ করছে এখন লেক রোডে। দোকানগুলো সন্ধ্যের পরে বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার চারপাশে সাজানো চলছে। তোরণ বানানো হয়েছে বাঁশ দিয়ে। আনসারউদ্দিনকে অভিনন্দন জানানোর কথা লেখা আছে তোরণে।
অটো চলছে ইতস্তত। কয়েকটা গাড়িও। ভারতীয় সেনার গাড়ি পাঁচ মিনিট পর পর টহল দিচ্ছে।
রজ্জাক ল্যাপটপে উঁকি মেরে দেখে বলল, “পেশোয়ারের মুফতি বাজারে এক র এজেন্টকে মেরেছিলাম। এরকম ভিড় রাস্তায়। সাইলেন্সার দেওয়া রিভলভারে। পাকিস্তানে দশ বছর ধরে ঘাপটি মেরে ছিল। কাজুর ব্যবসা করত আর সব খবর দিল্লিতে পাঠিয়ে দিত। হঠাৎ করেই গুলি চালিয়েছিলাম। পাঁচ সাত হাত দূরে ছিল। কালকে সবটাই ডিপেন্ড করছে ধামাকাটা কত জোরে হবে তার ওপরে। মানুষ ঘাবড়ে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি না শুরু করলে আমি আনসারুদ্দিনকে শ্যুট করতে পারব না”।
আমির টিভি দেখতে দেখতেই বলল, “তোমাকে কাল যেতেও হবে না। আমাকে অস্ত্রটা দাও। সব একা করে চলে আসব”।
রজ্জাক বলল, “তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ভয় পাচ্ছি? ওসব আমি পাই না। আমি শুধু চাই ব্লাস্টের আওয়াজটা যেন গোটা দুনিয়া শুনতে পায়। আমার কাজটা তাহলে সহজ হয়ে যায়”।
আমির একটা আখরোট হাত দিয়ে ভেঙে মুখের ভিতর ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “জন্নত থেকেও শোনা যাবে। চিন্তা কোর না”।
রজ্জাক আরিফের দিকে তাকিয়ে হাসল, “তারপর আরিফ মিয়াঁ, পাকিস্তানে ফিরে কী করবে? আবার আগের কোম্পানিতে জয়েন করবে?”
আরিফ ম্লান হাসল, “জানি না কী করব”।
আমির বলল, “আমি মিরান সাহেবকে সাফ বলে দেব, এবারই শেষ, আর না, আমি আর কোন মিশনে যেতে চাই না। অনেক হল। আর্মি থেকেও এই জন্যই রিটায়ার করেছিলাম। কপাল এমন, সেই মিরান সাহেবের পাল্লায় পড়ে গেলাম”।
রজ্জাক বলল, “আমি অনেক দিন ধরেই মিরান সাহেবের পাল্লায় পড়ে আছি, তবে এই প্রথম দেশের বাইরে পাঠালেন। ফিরে গিয়ে বিয়ে করব। তারপর কাশ্মীর যখন পাকিস্তানের হিস্যা হয়ে যাবে, বউকে নিয়ে বেড়াতে আসব”।
আমির বলল, “বললাম তো, আর্মি যদি মনে করে কাশ্মীর দখল করতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না। এই সব ইন্টারন্যাশনাল ল, অ্যান্টি ওয়ার ল এত কিছু পাকিস্তান গভর্নমেন্টকে কে মানতে বলেছিল কে জানে”।
দরজায় নক হল। রজ্জাক গিয়ে দরজা খুলে দেখল বেগ দাঁড়িয়ে আছে। বেগ তার হাতের ফোন রজ্জাকের হাতে দিয়ে বলল, “মিরান সাব ফোন করেছেন। কথা বল। তোমার কথা হলে আরিফকে দিও”।
রজ্জাক শশব্যস্ত হয়ে ফোন ধরল। কিছুক্ষণ “জি স্যার, জি স্যার” বলে ফোনটা আরিফকে দিল। আরিফ ফোন ধরে সালাম দেওয়ার পর প্রত্যুত্তরে সালাম দিয়ে মিরান বলল, “কালকের দিনটা তোমার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন আরিফ। ইনশাল্লাহ তুমি সফল হবে”।
আরিফ বলল, “শুক্রিয়া স্যার”।
মিরান বলল, “কাল ফজরের নামাজ পড়বে”।
আরিফ বলল, “জি জনাব”।
মিরান বলল, “গোটা পাকিস্তান তোমার দিকে তাকিয়ে আছে আরিফ। আমরা জিতবই। নিশ্চয়ই জিতব। বেগ সাহেবের কথা শুনে চল। উনি অভিজ্ঞ মানুষ। অনেকবার শ্রীনগরে গেছেন। উনি ঠিক তোমাদের বের করে নিয়ে আসবেন, আমি জানি। চিন্তা কোরবে না। আমরা এখান থেকে যতটা পারি তোমাদের সাহায্য করব”।
আরিফ বলল, “জি জনাব”।
মিরান বলল, “আমিরকে দাও ফোনটা’।
আরিফ ফোনটা আমিরকে এগিয়ে দিল।
২৭
রাতে সবাই মিলে একসঙ্গে খেয়ে ঘুমাতে গেল তারা। আরিফের জ্বর আসে নি। তবে শরীর দুর্বল লাগছিল। বেগ তাকে বলল ঘুমিয়ে পড়তে।
আরিফ মাঝে শুল। তার দুপাশে রজ্জাক আর আমির।
আমির বলল, “আরিফ মিয়াঁ, কাল তুমি আলাদা হয়ে যাবে তাহলে?”
আরিফ বলল, “হ্যাঁ”।
রজ্জাক বলল, “জানি না আবার দেখা হবে নাকি আমাদের। কী আছে কাল, আল্লাই জানেন”।
আমির বলল, “জরুর দেখা হবে। কেন দেখা হবে না? আমি যা জিনিস বানিয়েছি, ওই জিনিস স্কুটি থেকেই যা কাজ করার করে দেবে”।
রজ্জাক কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা মাথাটা ইসলামাবাদে জমা দিয়ে রেখে এসেছি। এখন শুধু অর্ডার আসবে, আর রোবটের মত আমরা তা পালন করে যাব”।
আমির বলল, “আমাদের জন্য বেস্ট ডিসিশন তো ওরাই নেবেন। অহেতুক চিন্তা করছো কেন?”
রজ্জাক বলল, “কিছু না। এমনি মনে হল, বললাম। আনসারউদ্দিনের সঙ্গে পাকিস্তানের ভাল যোগাযোগ ছিল। অথচ তাকেই মারতে বলছেন মিরান সাব”।
আমির বলল, “এত ভেবো না। যা করতে বলা হয়েছে, করে যেখানে যেতে বলবে চলে যাব। ইন্ডিয়ান আর্মির কাশ্মীরে অবস্থা মোটেও ভাল না। ওরাও ভয়ে থাকে। ব্লাস্টটা ঠিক মত হতে দাও। ওরা অ্যাকশনে নামার বদলে দেখবে আরো ব্যাকফুটে চলে যাবে”।
রজ্জাক বলল, “আরিফ ভয় পাচ্ছো? তোমার এরকম এক্সপেরিয়েন্স নেই। ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক না”।
আরিফ বলল, “আমি কী করছি, কেন করছি কিছুই জানি না। করতে হচ্ছে বলে করছি। আমার চিন্তাশক্তি কাজ করছে না আজকাল”।
আমির বলল, “তাহলে তুমি মিরান সাহেবের কাজের জন্য উপযুক্ত লোক হবে। ওনার চিন্তাভাবনাওয়ালা লোক একেবারেই পছন্দ না। দেখো এই মিশনটা সাকসেসফুল করে দেশে ফিরলে উনি হয়ত তোমায় মিডল ইস্টেই পাঠিয়ে দিলেন। আয়েস করবে ওখানে”।
রজ্জাক বলল, “কোন আয়েস নেই। মিডল ইস্ট ভীষণ রক্ষণশীল জায়গা। আমি দু বছর ছিলাম, আমার থেকে ভাল আর কে জানে। তুমি চেষ্টা করবে ইউরোপের কোন কান্ট্রিতে যেতে। ইউ এস এ এখন আমাদের জন্য অনেক রকম ঝামেলা করে রেখেছে। ইউরোপে অত ঝামেলা হবে না। তবে আমি আর এসব কাজ করব না। এবার ফিরে গিয়ে বিয়ে করে নেব। অনেক হল মানুষ খুন”।
আমির বলল, “এত সোজা হলে কবে বেরিয়ে যাওয়া যেত মিয়াঁ! এত সোজা কিছুই না। তবে যাই বল, তুমি কিন্তু বার বার বিয়ের কথা বলছ। সত্যি করে বল তো মিয়াঁ, তোমার কি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে?”
রজ্জাক হেসে উঠে বলল, “ঘুমিয়ে পড়। কালকে অনেক কাজ আছে। এখন ফিজুল কী বাতে বলে লাভ নেই”।
আমির জোরে হেসে উঠল, “হো হো হো। তার মানে আছে। বিয়েতে আমাদের ডাকবে তো?”
রজ্জাক বলল, “ডাকব। কে কোথায় থাকবে কে জানে। চলে এসো”।
আমির বলল, “ওরা যেদিন অ্যাবটাবাদে লাদেনকে অ্যাটাক করে, ঠিক তার একদিন আগে আমি অ্যাবটাবাদ থেকে মুজফফরাবাদে ফিরি। আমাদের দেশের সর্বত্র আমেরিকান স্যাটেলাইটের নজর। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, আমেরিকা পাকিস্তানে ঢুকে অপারেশন করে চলে গেল, অথচ কেউ কোন প্রতিবাদ করল না? এর একটাই মানে হয়, পাকিস্তান ইনডাইরেক্টলি আমেরিকাকে লাদেনের কো অরডিনেটস দিয়ে দেয়”।
রজ্জাক বলল, “তুমি অ্যাবটাবাদে কী করছিলে?”
আমির বলল, “ওসামাকে যে বাড়িতে রাখা হয়েছিল, তার কাছের সেনা ছাউনিতে থাকতাম আমরা। দ্য ইনসিডেন্ট ওয়াজ ওপেন সিক্রেট। সবাই জানত ও বাড়িতে লাদেন আছে, কিন্তু কেউ মুখে কিছু বলত না। সে এক অদ্ভুত সিচুয়েশন। আমি ওখান থেকে পালিয়ে এসে বেঁচে গেছিলাম। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম ঘটনাটা শোনার পর। ওসামা ওয়াজ এ ট্রু রেবেল। লং লিভ ওসামা”।
রজ্জাক বলল, “লং লিভ ওসামা”।
২৮
অনেক রাত অবধি ঘুম এল না আরিফের। রজ্জাক আর আমিরকে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে দেখে সে অবাক হল। এত বড় একটা কাজ হবে আগামীকাল অথচ কোন হেল দোল নেই। এই জন্যই হয়ত এদের মিরান সাহেব এই কাজে নিয়েছেন। ঠান্ডা মাথার খুনী নাহলে এত বড় কাজ করা কারো পক্ষে সম্ভব না।
জোরে করে ঘুমাতে গিয়ে খুব বাজে একটা দুঃস্বপ্ন দেখল আরিফ। দেখল সে একটা কুয়োতে তলিয়ে যাচ্ছে, আব্বু আম্মি তাকে বাঁচাতে এসছে, অথচ কিছুতেই তাদের হাত ছুঁতে পারল না সে। অতলে তলিয়ে যেতে যেতে তার যেন দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। ঘুমের মধ্যেই আর্তনাদ করতে চাইলেও কিছুতেই শব্দ বেরোল না। অসহ্য অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভাঙল তার। ভোরের আলো জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। আরিফ দেখল সকাল সাতটা বাজে। রজ্জাক আর আমির তৈরী হয়ে নিয়েছে। সে উঠে বসল।
রজ্জাক বলল, “ফজরের নামাজ মিস করে গেলে?”
আরিফ লজ্জা পেল।
রজ্জাক বলল, “ঠিক আছে। তোমার তো ঘুমই হয় না। আল্লাহর কাজেই তো যাচ্ছো। উনি ঠিক মাফ করে দেবেন। আমরা রওনা দেব। আল্লাহ আমাদের জয়ী করুক ইনশাল্লাহ। তুমি ঠিক আছো তো?”
আরিফ ঘাড় নাড়ল।
রজ্জাক এসে আরিফকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে। নিজের খেয়াল রেখো”।
আমির হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছিল। মন দিয়ে প্রার্থনা সেরে উঠে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ফোনে যোগাযোগ থাকবে। দেখা হবে আবার আমাদের দেশে। রজ্জাকের বিয়েতে”।
রজ্জাক হেসে উঠে বলল, “মিয়াঁ আমার বিয়েটা ভোল নি দেখছি। ঠিক মনে রেখে দিয়েছো”।
আমির বলল, “ভুলে যাব কেন মিয়াঁ? তুমি হলে আমার পার্টনার। পার্টনারের বিয়ে কী ভুলতে পারি?”
রজ্জাক বলল, “প্রতিটা কঠিন দিনের আগে আমি কনসেন্ট্রেট করি। এখন এসব কথা বলে মনটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিও না। তোমার ডেটোনেটর কাজ করবে তো?”
আমির বলল, “টু হান্ড্রেড পারসেন্ট করবে। ওয়াসিম আক্রমের আউট সুইঙ্গার আর আমির মিয়াঁর বোম্ব সব সময় ওয়ার্ল্ড ক্লাস”।
রজ্জাক হেসে ফেলল।
আরিফ অবাক হয়ে যাচ্ছিল। এদের টেনশন হচ্ছে না? কোন অজানা কারণে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল তার।
রজ্জাক বলল, “বেগ সাব কি আসবেন না নাকি? আমরা ওকে ছাড়াই চলে যাব?”
আমির বলল, “আর আমাদের ম্যাডাম? দেখো দুজনে রাতে আবার কিছু করল নাকি”।
রসিকতাটা করে আমির হেসে ফেলল।
এবার আরিফ বুঝল আমির আসলে ঠান্ডা নেই এখন। টেনশন ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছে উলটোপালটা কথা বলে।
মাইকের শব্দ ভেসে আসছে লেক রোড থেকে। বিভিন্ন গান হচ্ছে।
আমির বলল, “তুমি আনসারউদ্দিনকে মারলে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ হবে না। এদিকে সারা বছর অ্যান্টি ইন্ডিয়ান কথা বলে পাকিস্তানের থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে, ওদিকে নিজের প্রোগ্রামে ইন্ডিয়ানদের দেশ প্রেমের গান চালিয়েছে। ফর্মার ইন্ডিয়ান প্রাইম মিনিস্টারের বার্থ ডে পালন করছে। ব্লাডি হিপোক্রিট”!
রজ্জাক বলল, “সেটা ইন্ডিয়ান আর্মির চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যও হতে পারে। তুমি অকারণ ওকে দোষ দিচ্ছো কেন?”
আমির বলল, “দোষ দিচ্ছি না। এই কাশ্মীরিদের জানো না তুমি। এরা কারো না। এট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে, ওরা নিজেদের জন্য আলাদা দেশের কথা ভাবে”।
রজ্জাক বলল, “যে যা পারে ভাবুক। নাও উই হ্যাভ টু কনসেনট্রেট অন আওয়ার মিশন। ভুলে যাও এসব কথা”।
আমির হঠাৎ করে বুক ডন দিল কয়েকটা। মেঝেতে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, “আমার আর তর সইছে না। ইচ্ছা করছে এখনই বেরিয়ে যাই। বেগ সাহেবকে ডাকি এবার”।
উঠল আমির।
সে বেরনোর আগেই বেগ তাদের ঘরে ঢুকল। বলল, “রজ্জাক, আমির, আমাদের দেশ পাকিস্তান তোমাদের জন্য আজ গর্বিত। দেশ এবং আমাদের ধর্মকে বাঁচানোর স্বার্থে তোমরা যেভাবে নিজেদের জীবন বাজি রেখে এগিয়ে এসেছো, তার জন্য স্বয়ং আল্লাহ তোমাদের আশীর্বাদ করছেন। তোমরা আর দেরী কোর না। লেক রোডে পৌঁছে কোন একটা দোকানে ব্রেকফাস্ট করে রাস্তায় নজর দিতে শুরু কর”। বেগ আমিরের মাথায় তাবিজ ছুঁইয়ে বিড় বিড় করে কিছু বলল।
রজ্জাকও মাথা এগোল। বেগ একই ভাবে রজ্জাকের মাথাতেও তাবিজ ছুঁইয়ে বিড় বিড় করে কিছু বলে গেল।
আয়েষা ঘরে ঢুকল। তার চোখ মুখ থমথমে। আরিফ দেখে বুঝল আয়েষার মধ্যেও তার মতই উৎকণ্ঠা কাজ করছে।
আমির বলল, “লেটস ডু ইট। কিন্তু মিশনে যাওয়ার আগে আমি আজ পাকিস্তানী জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বলব সবাইকে। এনিমি কান্ট্রিতে জাতীয় সঙ্গীতের মজাই আলাদা। আয়েষা, তুমি কি গাইবে? আজাদ কাশ্মীরের কোন জাতীয় সঙ্গীত ঠিক করে রাখো নি তোমরা?”
আমির হাসতে শুরু করল।
বেগ আমিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি গাও। আয়েষা জানে চুপ থেকেও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা যায়। শুরু কর”।
আরিফ বেসুরো গলায় “পাক সার জমিন” শুরু করল। রজ্জাক আর বেগ গলা মেলাল। আরিফও গাইল।
আয়েষা দাঁড়িয়ে রইল।
গান শেষ হলে বেগ বলল, “লেটস ডু ইট। দ্য মিশন ইজ অন নাও”
আমির সামরিক কায়দায় বেগকে স্যালুট করে বলল, “রাইট স্যার। অ্যালাউ আস টু লিভ”।
বেগ আমিরকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ইনশাল্লাহ আমরা জয়ী হবই। এগিয়ে যাও”।
পকেট থেকে ফোন বের করল বেগ। আমিরকে দিয়ে বলল, “ডু দ্য জব অ্যাজ পার মাই ইন্সট্রাকশান”।
আমির বলল, “কেন? ম্যাডামের কী হল?”
আয়েষা অন্য দিকে মুখ করল। আমির হাসতে শুরু করল অপ্রকৃতিস্থভাবে।
শিকারা এসে গেছিল।
আমির আর রজ্জাক রওনা হল। তারা তিনজন ওদের বোটের সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিল।
আরিফের হঠাৎই মনে হল, এ সব আসলে স্বপ্ন। নইলে এরকম একটা জায়গায়, এরকম স্বপ্নের মত পরিবেশে কেউ মানুষ মারার কথা ভাববে কেন?
বেগ বলল, “ল্যাপটপ অন কর আরিফ। লেটস স্টার্ট আওয়ার জব”।
আরিফ ল্যাপটপ অন করল।
রাস্তায় বাচ্চারা এবং তাদের বাবা মায়েরা এসে জড়ো হচ্ছে। আর্মিও আছে। তবে খুব একটা হেলদোল নেই কারো। বাচ্চাদের অনুষ্ঠান বলেই হয়ত।
বেগ তবরেজকে ফোন করল। আরিফ ল্যাপটপে জে এন্ড কে পুলিশের ওয়েব সাইট খুলল।
বেগ বলল, “হ্যালো তবরেজ, নাও ইটস ইওর টার্ন।”
ওপাশ থেকে তবরেজ কিছু বলল।
বেগ বলল, “প্ল্যানটা সামান্য চেঞ্জ হয়েছে। রজ্জাক আনসারউদ্দিনকে মারার সঙ্গে সঙ্গে তুমি রজ্জাক আর আমিরকে উড়িয়ে দেবে। ওকে?”
আরিফ ছিটকে গিয়ে বেগের দিকে তাকাল।
বেগ ফোনটা রেখে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হোয়াট?”
আরিফ আয়েষার দিকে তাকাল, “কী বলছেন উনি?”
আয়েষা বলল, “মিরান সাব বলেছেন বেগ স্যারের কথা শুনে চলতে”।
কথাটা বলে আয়েষা মাথা নিচু করে ফেলল।
বেগ বলল, “স্টার্ট ইওর জব লিটল সেইন্ট। ডোন্ট ওয়েস্ট ইওর টাইম”।
তীব্র মাথাব্যথাটা ফিরে এল আরিফের। সে বেগকে বলল, “ওদের কেন মারা হবে?”
বেগ হাসল, “টিম যত ছোট হবে, তত ভাল কাজ হবে”।
আরিফ বলল, “আপনি আমাকেও মেরে ফেলবেন?”
বেগ বলল, “দেশ যাকে চাইবে, তাকে দেশের জন্য সব কিছু ছাড়তে হবে। প্রয়োজন হলে মারতে হবে। প্রবলেম আছে?”
আরিফের মাথা কাজ করছিল না। সে আয়েষার দিকে তাকাল আবার। আয়েষা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সে আয়েষাকে বলল, “একটা প্যারাসিটামল দেবে?”
বেগ বিরক্ত গলায় বলল, “কিচ্ছু লাগবে না। কনসেনট্রেট অন ইওর জব”।
আরিফ বলল, “মাথা ধরে আছে। একটা ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে”।
আয়েষা তাকে প্য্যারাসিটামল দিল।
আরিফ মণিটরে দেখল তবরেজ পূর্ব নির্ধারিত পজিশনে স্কুটিটা রেখে তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গেল।
রজ্জাক আর আমির পৌঁছে গেছে। সকাল আটটা বাজে। প্রচুর বাচ্চা আসতে শুরু করছে। লেকরোডে লোক গিজগিজ করছে।
আরিফ উঠে বলল, “আমি টয়লেট থেকে আসছি”।
বেগ বিরক্ত গলায় বলল, “তাড়াতাড়ি”।
আরিফ বাথরুমে ঢুকে কমোডে বসল। তার মাথা কাজ করছে না। এই তো সকালেও রজ্জাক আর আমিরের সঙ্গে কথা হল, কিছুক্ষণ আগেও কথা হল, ওদের এত সহজে মেরে ফেলতে বলে দিল বেগ?
বমি হয়ে গেল আরিফের। মিনিট পাঁচেক বাথরুমে কাটানোর পর বেরোল ।
আয়েষা তাকে বলল, “এখন সুস্থ লাগছে?”
যন্ত্রণায় আরিফের মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
সে বেগের দিকে তাকিয়ে বলল, “আই জাস্ট টুক মাই ডিসিশন। আই কুইট। আমি এই কাজটা করতে পারব না”।
বেগ তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, “চুপ করে এখানে বস। ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া তুমি কী বলছ?”
আরিফ বলল, “জানি। আমি নীরিহ শিশুদের মারতে পারব না। আমির এবং রজ্জাকের গায়েও হাত দিতে দেব না। আপনি তবরেজকে বলুন আমির আর রজ্জাককে যেন কিছু না করে”।
বেগ কড়া গলায় বলল, “জাস্ট সিট হিয়ার, এন্ড লিসেন টু মাই অর্ডার”।
আরিফ আয়েষার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেশের মানুষের কথা ভেবে বাচ্চাদের মারতে হবে? এটা মেনে নিতে হবে? আমার না হয় দেশের লোক না আয়েষা, কিন্তু এরা তো কাশ্মীরি বাচ্চা! তুমি এটা কী করে করবে?”
বেগ এবার জোরে হেসে উঠল। বলল, “আমি জানতাম, এই জেনারেশনের ছেলেরা এরকমই হয়। দেশের জন্য এদের কোন রকম আবেগ কাজ করে না। ঠিক আছে। ওয়েট”।
বেগ ফোন বের করল। বলল, “মিরান সাব? আপনার ঘোড়া বিগড়েছে। ব্যবস্থা করুন”।
ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বেগ বলল, “এই নাও”।
আরিফ কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা নিল। মিরান সাহেব নরম গলায় বলল, “কী হয়েছে আরিফ?”
আরিফ বলল, “এই কাজটা বন্ধ করুন জনাব। প্লিজ। রজ্জাক আর আমিরকে কেন মারা হবে? ”
মিরান হেসে উঠল, “ইউ আর সো ইনোসেন্ট আরিফ। আচ্ছা একটা কাজ কর, বেগ সাবের গ্যালারিতে একটা ভিডিও আছে। দেখো।“
আরিফ ফোনটা কেটে বেগের হাতে দিয়ে বলল, “মিরান সাব বললেন আমাকে কী একটা ভিডিও দেখাতে। দেখান”।
বেগের যেন কিছু মনে পড়ল, এরকম মুখ করে বলল, “ও হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক। এই দেখো”।
ফোনে একটা ভিডিও বের করল বেগ। বিস্ফারিত চোখে আরিফ দেখল তার বাবা মা কে মেক আপ করানো হচ্ছে। মৃত সাজিয়ে শুটিং করা হয়েছে।
সে চেঁচিয়ে উঠল, “এর মানে?”
বেগ কাঁধ ঝাঁকাল, “আমাদের তোমাকে দরকার ছিল। আমরা জানতাম তুমি এরকম করবে। সিম্পল। তবে তুমি যদি এখনো আমাদের সহযোগিতা না কর, তাহলে যেটা আগে দেখেছিলে, সেটা করতে আমাদের এক সেকেন্ড লাগবে আরিফ। ওরা মিরানের কাস্টডিতেই আছে। নাও ইউ ডিসাইড, কী করবে”।
আরিফ বলল, “আমি আমার বাবা মার সঙ্গে কথা বলতে চাই”।
বেগ বলল, “ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম। সারাজীবন পড়ে আছে কথা বলার জন্য”।
আরিফ বলল, “আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমি ওদের সঙ্গে দেখা করতে চাই”।
বেগ বলল, “আমি বলছি তুমি এখানে এসে বস। নাও”।
আরিফ কয়েক সেকেন্ড বেগের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এসে চেয়ারে বসল। বেগ তার কাঁধ চাপড়ে বলল, “দ্যাটস লাইক এ গুড বয়”।
আমির আর রজ্জাক লেক রোডে ক্যামেরা পজিশনের কাছে হাঁটতে শুরু করেছে। স্বেচ্ছা সেবকরা বাচ্চাদের জড়ো করছে। আটটা পঁয়ত্রিশ বাজে।
কিছু কিছু বাচ্চা ভীষণ দুরন্ত। কেউ লাফাচ্ছে। কেউ দৌড়চ্ছে। কেউ কান্না জুড়েছে। আরিফ আয়েষার দিকে তাকাল। আয়েষা তার দিকে। আয়েষার চোখ ছলছল করছে।
আরিফ চোখ বন্ধ করল। আব্বুর কথা মনে পড়ছে খুব। অনেক কষ্টে কান্না আটকাল এ।
নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছা করছিল তার। ওরা যে তার পরিবারকে আটকে রেখে দিয়েছে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারল না সে? এত খেটে পড়াশুনা করে শেষে সে শিশুহত্যা করবে?
বেগ রজ্জাককে ফোন করছে ক্যামেরা দেখে। আরিফ দেখল ল্যাপটপের পাশে একটা পেপারওয়েট আছে।
সেটা তুলে নিয়ে সে সজোরে বেগের মাথায় মারল। বেগ শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল।
আয়েষা তার হাত জড়িয়ে ধরল, “কী করছো আরিফ?”
আরিফ বেগকে লাথি কষাল জোরে। বেগ ককিয়ে উঠল। আরিফ বলল, “আই অ্যাম নট ডুইং দিস আয়েষা। সরি”।
আয়েষা তার দিকে রিভলভর তাক করল। শক্ত গলায় বলল, “সরি আরিফ”।
আরিফ বলল, “ডু হোয়াটেভার ইউ ক্যান ডু। আমি এটা হতে দেব না”।
আরিফ ঘর ছেড়ে বেরোতে গেল।
আয়েষা গুলি করল। তার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল।
মেঝে থেকে বেগ চেঁচিয়ে উঠল, “স্টপ হিম। শ্যুট হিম আয়েষা।
নাও”।
আরিফ পিছন ফিরে আয়েষার দিকে তাকাল। আয়েষা তার দিকে তাকিয়ে আছে। আরিফ বলল, “আমার ধর্ম শিশুদের মারতে বলে না। আমার ধর্ম বলে না নিস্পাপ কাউকে মেরে কোন রকম জিহাদ হয়। আমাদের ধর্ম শিক্ষা দেয়, জিহাদ মানে নিজেদের ভেতরের কালোটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। আমার আব্বু আমাকে শিখিয়েছেন আয়েষা। আমি বেঁচে থাকতে কোন শিশুর কিছু হতে দেব না। তার থেকে তুমি আমাকে মেরে ফেল। কিন্তু জীবিত অবস্থায় কিছুতেও আমি এটা হতে দেব না”।
বেগ চেঁচিয়ে উঠল, “কী হল আয়েষা? শ্যুট হিম। আমি বলছি, মারো ওকে”।
আয়েষা একটু থমকাল। একবার আরিফ, আরেকবার বেগের দিকে তাকাল।
বেগ বলল, “শ্যুট হিম স্টুপিড গার্ল। হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর? গদ্দার হে ইয়ে লড়কা”।
আয়েষা চোখ বন্ধ করে আরিফের দিকে বন্দুক তাক করল।
আরিফ নড়তে পারছিল না। তার পা যেন হাউজবোটের মেঝেয়ে কেউ শক্ত কোন আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করল সে। এরকম মৃত্যু হবে সে কল্পনাও করে নি কোন দিন।
তবু শিশুহত্যার রক্তের দাগ হাতে লেগে থাকার চেয়ে এই মৃত্যু অনেক সম্মানজনক। আল্লাহকে ডাকতে শুরু করল আরিফ।
তিনবার গুলি চালানোর শব্দ শুনল আরিফ। হতভম্ব হয়ে চোখে খুলে দেখল বেগের কপালে তিনটে বুলেট গেঁথে দিয়েছে আয়েষা।
আয়েষা আরিফের দিকে তাকিয়ে হাসল, “স্পেশাল ট্রেনিং নিয়েছি ছ মাস ধরে। চাইলে প্রথমবারে তোমাকেই মারতে পারতাম। ভাগ্যিস সাইলেন্সার ছিল। নইলে এতক্ষণে সবাই জেনে যেত। যাই হোক, এবার কী করবে?”
আরিফ বেগের ফোনটা নিয়ে কানে দিল, “হ্যালো”।
কানেকশনটা কেটে গেছে। আরিফ বলল, “শিট”।
রজ্জাককে মণিটরে দেখা গেল। সে বারবার ফোন করতে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আয়েষা বলল, “লেটস গো আরিফ। উই হ্যাভ টু গো। নইলে সব শেষ হয়ে যাবে”।
দৌড়ে বেরোল তারা। একটা শিকারা যাচ্ছিল। আরিফ চিনতে পারল। আগের দিনের ছেলেগুলো যারা ফটো তুলবে বলে বায়না করছিল। আরিফ ডাকল, “জলদি, জলদি এদিকে এসো। প্লিজ”।
ছেলেগুলো শিকারা নিয়ে এসে খুশি গলায় বলল, “ফটো তুলবেন জনাব? এই তো বিবিজানভি আছেন সঙ্গে। দারুণ ড্রেস আছে।”
আরিফ লাফ দিয়ে শিকারায় উঠে আয়েষাকে বলল, “এসো। জলদি”।
আয়েষা আরিফের হাত ধরে শিকারায় উঠল”।
আরিফ বলল “যত তাড়াতাড়ি পারো আমাদের ওই স্টেজের ওখানে নিয়ে চল। জলদি”।
একটা ছেলে বলল, “কী হয়েছে?”
আরিফ রিভলভার বের করল পকেট থেকে, “যা বলছি কর”।
ছেলেদুটো ভয় পেয়ে জোরে দাঁড় বাইতে শুরু করল। আয়েষা বলল, “ভয়ের কিছু নেই। শুধু জলদি চল। প্লিজ”।
নরম রোদ স্পর্শ করছিল তাদের। অপূর্ব প্রকৃতি আর মাইকের শব্দের মধ্যে দুটো ছেলে প্রাণপণে শিকারা বইতে লাগল।
আয়েষা আরিফের হাত ধরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ আরিফ ফর রেসকিউইং মি”।
আরিফ উত্তর দিল না। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল।
ন’টা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি আছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, “জলদি”।
শিকারা জল কেটে এগিয়ে চলল পাড়ের দিকে। আটটা ছাপ্পান্নতে পাড়ে পৌঁছতেই আরিফ আয়েষাকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে শিকারা থেকে নেমে দৌড় শুরু করল।
রাস্তা ভর্তি বাচ্চা। তাদের ঠেলে এগনো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল। তবু তারা প্রাণপণে দৌড়ে স্কুটির কাছে গেল। আরিফের চোখ পড়ল আমিরের ওপর।
মিছিল শুরু হয়েছে। অসংখ্য বাচ্চা মিছিলে হাঁটতে শুরু করেছে। আমির পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিল আরিফ ছুটে গিয়ে আরিফকে জড়িয়ে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গিয়ে আরিফ আমিরকে বলল, “তুমি এখানে? এখানে কী করছো?”
আরিফ বলল, “বেগকে মেরে দিয়েছি”।
আমির মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ডু ইউ হ্যাভ এনি ফাকিং আইডিয়া, হোয়াট হ্যাভ ইউ ডান?”
আয়েষা আমিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “মিরান বলেছিল কাজ হলেই তোমাদের মেরে দিতে। আরিফ না থাকলে সেটাই করা হত”।
আমির বিস্মিত চোখে আয়েষার দিকে তাকাল। এতক্ষণে রজ্জাক দেখতে পেল তাদের। ছুটে এসে বলল, “কী হল?”
আমির রজ্জাককে বলল। রজ্জাক অবাক চোখে আরিফের দিকে তাকাল।
আমির বলল, “আমি আয়েষাকে বিশ্বাস করি না। দ্য মিশন মাস্ট গো অন”।
আরিফ বলল, “মিশন মাস্ট গো অন? এই বাচ্চাগুলোকে মারবে তুমি?
আমির কঠিন গলায় বলল, “আমি যে কাজের জন্য দেশ ছেড়ে এত দূর এসেছি, সে কাজ না করে কোথাও যাব না”।
আরিফ ঘড়ি দেখল। ন’টা বেজেছে। আরিফের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রজ্জাকের দিকে তাকাল।
আনসারউদ্দিন আসছে মিছিলে। হেঁটে হেঁটে। বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলাচ্ছে।
আমির রজ্জাককে বলল, “উই হ্যাভ টু ফিনিশ দ্য মিশন, দ্য ব্লাস্ট উইল হ্যাপেন। আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। মিরান স্যার আমাকে কালকেই বলে দিয়েছিলেন, যাই হোক না কেন, কাজটা শেষ করতেই হবে। আয়েষা ইন্ডিয়ান স্পাই হতেই পারে। তোমাকে ভুল বুঝিয়ে কাজটা করছে। এনিথিং ক্যান হ্যাপেন”।
আয়েষার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এল। সে বলল, “কী? আমি স্পাই?”
আমির বলল, “এনিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। তাই না আয়েষা? তুমি কিছুতেই এই মিশনটা মেনে নিতে পারছো না। তাই বেগ সাবকে মেরে এখন নতুন গল্প ফাঁদছো!”
মিছিলের ভিতর থেকে একজন কাশ্মীরি শিশু এসে আমির, রজ্জাক আর আরিফের হাতে একটা করে লাল গোলাপ দিল। আমির হতভম্ব হয়ে গোলাপটা দেখল কয়েক সেকেন্ড ধরে।
হঠাৎ একটা আর্তনাদ শুনে সবাই সে দিকে তাকাল। তবরেজ বন্দুক তাক করেছিল তাদের দিকে। রজ্জাক তবরেজকে গুলি করে আমিরকে বলল, “দ্যাট মিনস দে আর রাইট আমির। লেটস অ্যাবর্ট দ্য মিশন”।
আমির বিস্মিত চোখে গোলাপটা দেখল কয়েক সেকেন্ড। পরক্ষণে ডিটোনেটরটা লেকের জলে ছুঁড়ে মারল।
প্রথমে কারো চোখে পড়ে নি। শব্দও পায় নি কেউ। রজ্জাকের রিভলভারে সাইলেন্সার ছিল।
মাটিতে পড়ে থাকা তবরেজের শরীর থেকে রক্ত বইতে দেখে বাচ্চারা কাঁদতে শুরু করল। মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্কিত জনতা ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করল। আনসারউদ্দিনের নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে ঘিরে ধরল।
রজ্জাক বলল, “লেটস গো। সময় বেশি নেই। চল”।
রজ্জাক দৌড় শুরু করল। বলল, “ফলো মি”।
আরিফ কেমন হতভম্ব হয়ে গেছিল। আয়েষা আরিফের হাত ধরে টান দিল। ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল তারা।
কিছুটা যাওয়ার পর অটো পেল। অটোয় উঠে রজ্জাক বলল, “হজরত মসজিদ”।
লেক রোডে ততক্ষণে আর্মি নেমে গেছে।
২৯
দুপুর বারোটা। হজরত-ই-বাল মসজিদের সামনে বসে আছে তারা।
ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।
আমির বলল, “এতক্ষণে আই এস আই আমাদের ছবি র’কে পাঠিয়ে দিয়েছে না?”
আয়েষা বলল, “কেউ না কেউ মারতই আমাদের। কাজ হয়ে গেলেই মেরে ফেলত। এই জন্যই চারজন নতুন রিক্রুট। তবরেজ ব্লাস্ট করতে পারত না, তাই আমিরকে আনা। আমিরকে একা পাঠানো যাবে না, তাই টিম তৈরী করা। কাছের লোক তবরেজ আনসারউদ্দিনকে মারলে তবরেজকে আর্মি মেরে দিত। কিন্তু তবরেজ আই এস আইয়ের পুরনো লোক। তাই রজ্জাককে আনা। ফুটেজ মোছার জন্য আরিফকে আনা, আর গোটা মিশনটার বন্দুক আমার কাঁধে রাখা যাতে ধরা পড়লে মিডিয়ায় বলতে পারে কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাজ।”
রজ্জাক হাসল, “হ্যাঁ”।
আমির বলল, “ইটস আ ফেইলড মিশন। আর বাই দ্য ওয়ে, রজ্জাকের বিয়েটাও খাওয়া হল না”।
আরিফ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে বলল, “কিন্তু আমরা জন্নত যাব। কোন নকল জন্নত না, ধর্মগুরুদের সাজিয়ে দেওয়া জন্নতে না। সত্যিকারের জন্নতে”।
আমির বলল, “মিরান সাবকে আমি চিনি আরিফ। ওরা তোমার আব্বু আম্মিকে এবার মেরে ফেলবে”।
আরিফ মাথা নিচু করল। দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল তার।
সেনার কনভয়ের হুটারের শব্দ শোনা গেল।
আমির হাসল, “ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স ইজ গুড। ভেরি গুড”।
আরিফ বলল, “প্রার্থনা শুরু করি তাহলে?”
চারজন অস্ত্র সরিয়ে রেখে হাঁটু গেড়ে বসল রাস্তার উপরেই। মসজিদের দিকে মুখ করে প্রার্থনা শুরু করল।
ততক্ষণে এলাকা সেনার দখলে চলে গেছে…
***