১০
টিম মিটিং হচ্ছে।
আয়েষা কাশ্মীরের ম্যাপ প্রোজেক্টরে দেখিয়ে বলল, “আমরা কাল কাশ্মীর যাচ্ছি। কাশ্মীর মিনস আজাদ কাশ্মীর। মুজফফরাবাদে গিয়ে আমরা ওয়েট করব। পরশু গ্রীন সিগন্যাল পেলে উই শ্যাল এন্টার ইন্ডিয়া ফ্রম গুলমার্গ এরিয়া”।
আমির বলল, “গুলমার্গ? আর ইউ ক্রেজি? ওখানে সব থেকে বেশি ইন্ডিয়ান আর্মি থাকে”।
আয়েষা আমিরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “আমি যখন প্ল্যানটা করছি, তখন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে তাই না আমির? তুমি লিডার হলে তুমি যা বলবে, সেটা ফলো করতাম”।
আমির গম্ভীর হয়ে গেল।
আয়েষা বলল, “গুলমার্গ সাইট থেকে এন্ট্রি নেওয়া এখন সব থেকে সহজ হবে। ইন্ডিয়া এখন গুলমার্গ থেকে কিছু সেনা কমিয়ে কার্গিল সেক্টরে ট্রান্সফার করিয়েছে। এই ইনফরমেশনটা আমি কাল রাতে পেয়েছি। তখনই মিরান স্যারকে বলে গুলমার্গ গেটওয়ে ঠিক করেছি। আমাদের শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে। আর একটা কথা, ওখানে স্থানীয় কাশ্মীরিরাই আমাদের শেল্টার দেবে। এক্সকিউজ মি জেন্টলমেন”।
আয়েষা ঘর থেকে বেরোল।
আমির, রজ্জাক আর আরিফের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, “আই এস আই প্রোজেক্ট নাকি জেনানা লিড করবে! এদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে এ আওরাত”।
রজ্জাক বলল, “ঠিক আছে। স্টে কুল। ও যা প্ল্যানই করুক, লাস্ট ডিসিশন তো মিরানই নেবে। অত চিন্তা করছো কেন?”
আমির বলল, “চিন্তা করছি কারণ কাশ্মীরে ঢুকে যাওয়ার পর এর কথা শুনে আমাদের চলতে হবে। তখন আনাব শানাব ডিসিশন নেবে, আর আমাদের সমস্যায় …”
আমিরের কথা শেষ হবার আগেই আয়েষা রুমে ঢুকে বলল, “হ্যাঁ, তো যেটা বলছিলাম। আফটার এনটারিং কাশ্মীর, আমাদের ওখানে ওয়েট করতে হবে ফারদার ইন্সট্রাকশানের জন্য। তখন কী করতে হবে, সেটা তখন বলে দেব”।
আমির চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইল।
মিরান দরজা নক করে বলল, “মে আই কাম ইন”?
আয়েষা বলল, “শিওর জনাব”।
মিরান ঘরের ভিতর ঢুকে বলল, “কাল তোমরা মুজফফরাবাদে যাচ্ছো। সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। ইন্ডিয়ান পাসপোর্টসহ সব জরুরি ডকুমেন্ট ওখানেই দিয়ে দেওয়া হবে। আমার শুধু একটা কথাই বলার আমির, রজ্জাক আর আরিফ তোমাদের। প্লিজ রিলাই অন আয়েষা। ওর পোটেনশিয়াল আছে বলেই ওকে আমরা টিমটাকে লিড করতে বলছি। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড”।
আমির বলল, “সব বুঝলাম, কিন্তু আমরা হোয়াই গুলমার্গ?”
মিরান আমিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “বিকজ আয়েষা ডিসাইডেড। অ্যাম আই ক্লিয়ার? শোন আমির, আয়েষা কাশ্মীরের মেয়ে। গোটা জায়গাটাকে ও হাতের তালুর মত করে চেনে। তুমি যদি ওকে বিশ্বাস না কর, তাহলে সমস্যায় পড়বে। আর তুমি যদি মিশন থেকে বেরিয়ে যেতে চাও, বেরিয়ে যেতে পারো। সেক্ষেত্রে কী ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়া হবে সেটা আমরা ঠিক করব। দিস ইজ নট লস্কর অর হিজবুল, মাইন্ড ইট। দিস ইজ আই এস আই। আমরা কী করব, কেন করব, সেটা আমরা ঠিক করব”।
আমির বলল, “আমাদের এসকেপ প্ল্যান কী থাকবে? উনি তো কাশ্মীরি, উনি থেকে যাবেন, আমরা ফিরব কী করে?”
মিরান বলল, “আমি আছি তো। আমি না থাকলে আই এস আই তো আছে। আর কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান কন্ট্যাক্ট করা কি খুব কঠিন কাজ? এই মিশনটা কাশ্মীরে হবে। মিশন শেষে তোমরা ফিরে আসবে। অ্যান্ড ইফ আয়েষা ওয়ান্টস টু কাম ইন পাকিস্তান, শি ইজ অলওয়েজ ওয়েলকাম হিয়ার। আমি আয়েষাকে এই মিশনের নাম দেওয়ার প্রস্তাব করছি”।
আয়েষা বলল, “অপারেশন জন্নত ক্যায়সা হোগা স্যার?”
আমির বলল, “অপারেশন জন্নত? আমরা কী করতে যাচ্ছি জানতে পেরেছি?”
মিরান বলল, “আয়েষা জানে অপারেশনটা কোথায় হবে। বাকিটা ওকে জানানো হবে তোমরা পৌঁছলে। ও তখন তোমাদের জানিয়ে দেবে। দ্যাটস এ কুল নেম আয়েষা। গো অ্যাহেড”।
আমির চুপ করে গেল।
“বাই দ্য ওয়ে আয়েষা…”
মিরান আয়েষার দিকে তাকাল। আয়েষা বলল, “জি জনাব”।
মিরান বলল, “প্রাইম মিনিস্টার তোমাদের উইশ করেছেন। বেস্ট অফ লাক”।
আয়েষা হাসল, “শুক্রিয়া জনাব। বহত, বহত শুক্রিয়া”।
মিরান বলল, “বেস্ট অফ লাক টিম। উই উইল উইন ফর শিওর”।
মিরান ঘর থেকে বেরোলে আয়েষা বলল, “রজ্জাক, প্লিজ আরিফকে এবার আর্মস ট্রেনিংটা দিয়ে দাও। জাস্ট ফর সেলফ ডিফেন্স”।
রজ্জাক উঠল।
আরিফও।
আমির থমথমে মুখে বসে রইল।
১১
ভোর পাঁচটা। বেশ শীত আছে। একটা ছোট গাড়িতে তারা মুজফফরাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
আরিফ গাড়ির পিছনের সিটে মাঝে, তার একপাশে রজ্জাক আর একপাশে আয়েষা বসেছে।
সামনে আমির। রজ্জাকের কাছে গত রাতে রিভলভার চালানো শিখেছে আরিফ। অস্ত্রটা ধরতে তার শরীরটা কেঁপে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, এই একটা অস্ত্র তার বাড়ি ঘর, শৈশব, কৈশোর সব শেষ করে দিল। প্রথমদিকে হাত কাঁপছিল তার। ধীরে ধীরে আয়ত্তে এল। যদিও বুলস আই ভেদ করতে একবারও পারে নি। তবু রজ্জাক তার কাঁধ চাপড়ে দিয়েছে। বলেছে সে একজন “ফাস্ট লার্নার”।
পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গাড়ি চলেছে। ভোরের আলোয় প্রকৃতি অপূর্ব সুন্দর লাগছে। আরিফ মুগ্ধ হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
রজ্জাক গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
আয়েষা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভয় লাগছে আরিফ?”
আরিফ বলল, “সে সব অনুভূতি কাজ করছে না আমার”।
আয়েষা বলল, “স্বাভাবিক। বাট দে ডিজারভ ইট। আমরা ওদের ছেড়ে কথা বলব না”।
আমির বলল, “যদি আমরা ওদের বাগে পাই তো”। বলে হেসে উঠল। আয়েষা বলল, “আমির মিয়াঁ, তুমি একটু বেশি চিন্তা করছ বলে মনে হচ্ছে না?”
আমির বলল, “আল্লাহপাক জান দিয়েছেন। কোন জেনানার নির্বুদ্ধিতায় সেটা যেন না চলে যায়, আপাতত সেটাই প্রাথমিক লক্ষ্য জীবনে”।
আয়েষা চুপ করে গেল।
আমির ড্রাইভারকে বলল, “গান চালাও মিয়াঁ”।
ড্রাইভার গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে বলিউডের গান চালাল। আমির সে গানের সঙ্গে গলা মেলাতে লাগল। দু ঘন্টা পরে চেক পোস্টে পুলিশ গাড়ি আটকাল। ড্রাইভার আইডি দেখাতে সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্যালুট করে ছেড়ে দেওয়া হল।
রজ্জাক ঢুলতে ঢুলতে আরিফের গায়ের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল।
আরিফ রজ্জাককে তুলে বসিয়ে দিল আবার। রজ্জাক হেসে বলল, “সরি”।
আরিফ বলল, “ঠিক আছে। শুধু সোজা হয়ে ঘুমাও”।
রজ্জাক হেসে চোখ বন্ধ করল।
আরিফ রাতে ঘুমাতে পারে নি। যখনই চোখ বন্ধ করেছে, আব্বু আম্মির মুখদুটো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না এভাবে সব শেষ হয়ে গেল।
বুকের ভিতর এক অব্যক্ত হাহাকার সারারাত তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে।
গাড়িতে খানিকটা ক্লান্তিতেই চোখ বন্ধ হয়ে এল তার।
ঘুম ভাঙল একটা ঝাঁকুনিতে।
রাস্তা খুব খারাপ। গাড়ি নীলম ভ্যালি পার হচ্ছে। চারদিকে অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতি। আব্বু আম্মির সঙ্গে ঠিক হয়ে ছিল তারা কাশ্মীর ঘুরতে আসবে খুব তাড়াতাড়ি। সে কথা মনে পড়তে আরিফের চোখে জল চলে এল।
আয়েষা দেখল সেটা। আরিফের হাত ধরল, “আর ইউ ওকে?”
আরিফ খানিকটা অপ্রস্তুত হল। কী ঠান্ডা, নরম হাত। বলল, “জি, ঠিক আছি”।
আয়েষা আরিফের হাতে চাপ দিল একটু, “বেশি ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে”।
আরিফ বলল, “জি”।
অনেক কষ্টে কান্না সামলাল আরিফ। স্থানীয় কাশ্মীরিদের দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। আমির বলল, “দু মাস পরে এলাম। আবার আরেকটা মিশন”।
আরিফ বলল, “আরেকটা মিশন মানে? এর আগে কোন মিশনে এসেছিলে?”
আমির ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “নতুন ছেলে, কখনো কোন আর্মি ম্যানকে তাদের মিশনের ব্যাপারে জানতে চাইবে না। দিজ আর টপ সিক্রেট। তুমিও কোন দিন কাউকে বলবে না। ক্লিয়ার?”
আরিফ বলল, “ক্লিয়ার”।
আমির গাড়িতে চলা বলিউডি গানের সুরে শিস দিতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে তারা মুজফফরাবাদে প্রবেশ করল। একটা ছোট তালাবন্ধ বাড়িতে তাদের গাড়িটা নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
আয়েষা পকেট থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলল। বাড়িটা পরিষ্কার। আমির বলল, “আমি ঘুমোতে চললাম, রাতে ঘুম হয় নি। কোন দরকার হলে ডেকে নিও”।
আমির চলে গেল।
ডাইনিং টেবিলের ওপর টি ব্যাগ, ইলেক্ট্রিক কেটলি, চিনি সব সাজানো। আয়েষা বলল, “টি?”
আরিফ বলল, “আমি বানিয়ে দিচ্ছি”।
আয়েষা বলল, “থ্যাঙ্কিউ আরিফ”।
রজ্জাক সোফাতেই শুয়ে পড়ল।
তার ঘুম সম্পূর্ণ হয় নি বোঝা গেল।
১২
দুপুরে খেয়ে দেয়ে আয়েষা বলল, “আমি রেস্ট করছি। মিরান সাব বলেছেন আমান বলে একজন আসবে। তখন আমাকে ডেকে দিও”।
আরিফ ঘাড় নাড়ল।
রজ্জাক সোফাতেই ঘুমাচ্ছিল।
আমিরও আরেকটা ঘর দখল করে রেখেছে। আরিফ দেখল তার ফোন বাজছে। গতকাল থেকে একবারও তার ফোন বাজে নি। এখন দেখল একটা আন নোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।
ধরল সে, “হ্যালো”।
“হ্যালো আরিফ, আমি যায়ান বলছি”। ওপাশ থেকে যায়ানের গলা ভেসে এল।
আরিফ চারদিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “বল”।
যায়ান বলল, “আরে ভাই, তুমি কোথায় চলে গেলে? বাড়ি গেছো? অফিস আসছো না কেন?”
আরিফ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ রজ্জাক সোফা থেকে উঠে এসে তার ফোনটা নিয়ে অফ করে দিয়ে আরিফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ওরা তোমাকে বলতে ভুলে গেছে হয়ত, নো ফোন কলস। সিমটা ফেলে দাও”।
আরিফ চমকে গেছিল। রজ্জাক কেমন ক্ষিপ্রভাবে উঠে এল হঠাৎ করে। সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “সরি, আমি বুঝি নি। আমাকে মিরান সাহাবও কিছু বলেন নি এই ব্যাপারে”।
রজ্জাক বলল, “তুমি একেবারেই নতুন। ওর মাথায় আসে নি, বা বলতে ভুলে গেছে। লিভ ইট, কালকে যেগুলো শিখিয়েছিলাম, মনে আছে তো?”
আরিফ বলল, “হ্যাঁ”।
রজ্জাক বলল, “একটা জিনিস শিখাই নি। সব সময় খেয়াল রাখবে, শত্রুপক্ষের ওপর কোন দয়া নয়। যারা তোমার ঘর পুড়িয়েছে, তোমার কাজ হবে তাদের পোড়ানো, ক্লিয়ার”?
আরিফ বলল, “ক্লিয়ার”।
রজ্জাক আবার গিয়ে শুয়ে পড়ল।
আরিফ ফোনটার দিকে তাকাল। তার যায়ানের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল। যায়ানরা কত ভাল আছে। অফিস করছে, বিয়ে করবে্, সংসার করবে, আর তার সঙ্গেই এত সব কিছু হতে হল? মাঝে মাঝে তার ভয় হচ্ছে, পরক্ষণেই চোয়াল শক্ত করছে খানিকটা জোর করেই। ঠিকই তো, যারা তার আব্বু আম্মিকে মেরেছে, তাদের কেন ছেড়ে দেবে সে? ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
বিকেল পাঁচটার দিকে কলিং বেল বেজে উঠল। আরিফ দরজা খুলল।
একজন ছোট খাটো চেহারার লোক তার দিকে তাকিয়ে বলল, “মিরান স্যার পাঠিয়েছেন। খবর দিন ম্যামকে”।
আরিফ বলল, “আসুন ভিতরে”।
লোকটা চারদিক দেখে ঘরে ঢুকে বসল। রজ্জাক উঠে বসেছে। আরিফ আয়েষার ঘরের দরজা নক করল। আমিরেরও।
আয়েষা বলল, “সালাম ওয়ালাইকুম। আপনিই আমান?”
আমান বলল, “হ্যাঁ”।
ব্রিফকেসটা সোফায় তুলে সেটা খুলল আমান। ব্রিফকেসের ভিতর থেকে চারটে মানিব্যাগ বের করে বলল, “এগুলোর প্রত্যেকটাতে আপনাদের জন্য প্রয়োজনীয় ইন্ডিয়ান কারেন্সী, আর আপনাদের ইন্ডিয়ান আই কার্ড আছে। টাকার দরকার পড়বে। আপনাদের সবাইকেই ভারতীয় ব্যাঙ্কের একটা করে এটিএম কার্ড দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কার্ড ইউজ করবেন না। প্রয়োজন মানে খুবই প্রয়োজন। এটি এম মেশিনে সিসিটিভি বসানো থাকে। আশা করি বুঝতে পারছি কেন বললাম?”
সবাই মাথা নাড়ল।
আমির বলল , “আমরা কবে ঢুকছি?”
আমান বলল, “কাল ভোর চারটেয়। গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যাবে বর্ডারের কাছে। আমাদের কাজ হবে গুলমার্গে রোপওয়ে সাইডে গোলাগুলি শুরু করা। এর ফলে ওরা অনেকটা ডিস্ট্রাক্ট হয়ে যাবে। আপনারা সেই ফাঁকে পয়েন্ট ফোর থেকে কাশ্মীরে এন্ট্রি নেবেন। এখান থেকে কোন আর্মস বা কোন লাগেজ নিয়ে যে যাওয়া হবে না সেটা তো আপনারা জানেনই। ওপারে আপনাদের সব রকমের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একবারেই চিন্তার কিছু নেই। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”
আয়েষা বলল, “অনেক শুক্রিয়া আমান”।
আমির বলল, “এর মধ্যে মরে যাই যদি”?
আমান বলল, “পাকিস্তান আপনাকে মনে রাখবে জনাব”।
আমির বলল, “কারো মনে রাখার দরকার নেই আমাকে। শুধু বলুন বাঁচব তো?”
আমান বলল, “টু হান্ড্রেড পারসেন্ট জনাব। আমার ওয়াদা। অন্যথা হবে না। আমি এবার আসি। বেস্ট অফ লাক ফর টুমরো। বাই”।
যেমন ঝড়ের মত এসেছিল, তেমন ঝড়ের মত চলে গেল আমান।
আমির আয়েষার দিকে তাকাল, “তাহলে তোমার জেদই ঠিক থাকল”।
আয়েষা বলল, “বিলিভ মি আমির, আমি মরে গেলেও তোমাকে মরতে দেব না। খুশি?”
আমির বলল, “কী যে করছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এই এন্ট্রিটা সেফ হবে না”।
আয়েষা বলল, “হবে। চিন্তা করবেন না। কাল এই সময়ে আমরা শ্রীনগরে। নিশ্চিন্ত থাকো”।
আমির কাঁধ ঝাঁকাল, “ওকে। তাই হোক”।
আয়েষা আরিফের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কাছে ঘুমের ওষুধ আছে। আমার এখনো প্রয়োজন হয়। তুমি চাইলে তোমাকে দিতে পারি। খাবে?”
আরিফ মাথা নাড়ল, “নাহ। দরকার এই”।
রজ্জাক উঠে ফ্রিজ খুলল। একগাদা কোল্ড ড্রিংক্স ফ্রিজে।
আমির বলল, “আমাকে দিও”।
আয়েষাও বলল।
শুধু আরিফ চাইল না।
১৩
“ওসামাকে যেদিন অ্যাবটাবাদে মারল, সেদিন আমি মুজফফরাবাদেই ছিলাম”।
আমির বলল।
পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। মুজফফরাবাদ থেকে রাস্তা এখনও খারাপ হওয়া শুরু হয় নি।
আরিফ চুপ করে বসে আছে। ভোর তিনটেয় তুলে দিয়েছে তাদের আয়েষা। তৈরী হয়েছে সবাই। আই কার্ডের ব্যাগ ছাড়া কারো কাছে আর কিছু নেই। ড্রাইভার পাকিস্তানি আর্মির লোক। স্বল্পভাষী।
সারাদিন পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলবে। নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে তারা পৌঁছে মিরানকে ফোন করবে।
রজ্জাক বলল, “আর আমি ছিলাম লাহোরে”।
আমির বলল, “লাহোরে কী কাজ করছিলে”?
রজ্জাক হাসল, “ইজাজ খানকে মারতে গেছিলাম”।
আমির বলল, “ও আল্লা, ওই পলিটিশিয়ানকে তুমি মেরেছিলে? সেই দুশো মিটার দূরের বিল্ডিং থেকে? দ্যাট ফেমাস মার্ডার?”
“ইজাজ খান যে ইন্ডিয়ান স্পাই ছিল সেটা অনেক পরে জানা যায়। মিরান স্যার জানতেন অনেক আগে। হি জাস্ট অর্ডারড অ্যান্ড আই ডেলিভারড। অবশ্য তখন কন্ট্র্যাক্ট কিলার ছিলাম”, এমন স্বাভাবিক গলায় বলল রজ্জাক যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়।
আমির বলল, “আমার হিট লিস্টটাও মন্দ না। ইন্ডিয়ান আর্মির এক মেজরকে গলা কেটে মেরেছিলাম। বেচারা নাকি ভুল করে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়েছিল”।
জোরে হেসে উঠল আমির। পরক্ষনেই আয়েষার দিকে তাকিয়ে বলল, “অ্যান্ড ইউ ম্যাডাম। তোমার এরকম কোন অ্যাচিভমেন্ট?”
আয়েষা বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু নেই”।
আমির বলল, “বাহ। কিছু নেই। আর তুমি আমাদের লিডার হয়ে গেলে”।
আয়েষা ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার অ্যাচিভমেন্টটা এমন হবে, এত দিন কিছু না করার কষ্ট সুদে আসলে উঠে আসবে। ওকে?”
আমির ঘাড় ঘুরিয়ে আয়েষার দিকে তাকিয়ে ছিল। ঘাড় সোজা করে রাস্তায় নজর দিয়ে বলল, “দেখা যাবে। ফিলহাল আমাদের ঠিক ঠাক বর্ডার পার করে দিতে পারলেই অনেক মেহেরবানী হবে তোমার। ইন্ডিয়ান আর্মি আমাকে পেলে ছাড়বে না”।
রজ্জাক বলল, “দে ওন্ট স্পেয়ার এনি ট্রেসপাসারস। নট ওনলি ইউ ফ্রেন্ড”।
আমির বলল, “হু হু। তা তো ঠিকই। মাঝখান দিয়ে বেচারা আরিফ মিয়াঁ ফেঁসে গেল। দিব্যি করাচীতে হোয়াইট কলার জব করছিল। মিরান সাহাব কেন যে ওকে জুতে দিলেন আমাদের সঙ্গে, আল্লাই জানেন”।
আয়েষা বলল, “সব চিন্তাই তুমি করে দেবে। কেন আমাকে টিম লিডার করা হল, কেন আরিফকে আনা হল মিশনে। সব চিন্তাই তুমি করবে আমির? মিরান স্যারের জন্যও তো কিছু রাখো”।
আমির কাঁধ ঝাঁকাল, “জি হাঁ, জি হাঁ। তাই হোক। আমি বেশি ভেবে ফেলছি। দেশকে একটু বেশি ভালবাসি কি না। ওহ, তুমি কী করে বুঝবে, তুমি তো পাকিস্তানীই না”।
আয়েষা বলল, “পাকিস্তানীরাই শুধু দেশকে ভালবাসে বুঝি? আর যারা নিজের মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবনকে পণ করে লড়াই করে তারা কিছুই না?”
রজ্জাক বলল, “তোমরা থামো তো। আর আমির, প্লিজ। আমি ঘুমাতে চাই। আমাকে ঘুমাতে দাও। আজ রাতে কীসের মুখোমুখি হতে হবে, কিছুই জানি না। তাই প্লিজ স্পেয়ার মি”।
আয়েষা চুপ করে গেল।
আমির গজগজ করতে লাগল। আরিফ দেখল খাদের পাশ দিয়ে অপূর্ব সুন্দর এক খরস্রোতা নদী বয়ে চলেছে। আকাশ নীল। পাহাড়ে বরফ পড়া শুরু হয়েছে। প্রকৃতি এখানে অকৃপণ। তার মনে হল করাচীতে থাকলে এতক্ষণে সে টোস্ট তৈরী করে ডিমের অমলেট দিয়ে খেয়ে অফিসের জন্য দৌড়ত। সারাদিন ধরে অফিসের কাজ করে ফিরে বাড়িতে একবার ফোন করত।
আব্বু আম্মির মুখটা মনে পড়ে গেল আরিফের। কত আশা ছিল আব্বু আম্মির। তার করাচীর ফ্ল্যাটে দুজন চলে আসবে। ছেলের বিয়ে দেবে। নাতি নাতনি ঘরে লাফালাফি করবে।
অনেক কষ্টে চোখের জল সামলাল আরিফ। রজ্জাক ঘুমিয়ে পড়েছে। আয়েষা বলল, “ইন্ডিয়ায় আমাদের কোন ফ্রিডম অফ স্পিচ নেই জানো আরিফ। কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমরা যদি জল কিংবা বিদ্যুতের দাবীতে পথ অবরোধ করি, সঙ্গে সঙ্গে আর্মি এসে লাঠি চার্জ করে আমাদের তুলে নিয়ে যাবে। কাশ্মীরিদের ওরা মানুষ বলেই মনে করে না। উই নিড আ সেপারেট কান্ট্রি”।
আমির কথাটা শুনে জোরে হেসে বলল, “সেপারেট কান্ট্রি? আর মজা কোর না। কাশ্মীরিরা দেশ চালাতে জানে নাকি? এত মার খেয়েও তারা সেই ইন্ডিয়ার ওপরেই ডিপেন্ডেন্ট। কাশ্মীরকে আজাদ রাখতে পাকিস্তানকে সব সময় অ্যাক্টিভ থাকতে হবে। নইলে ইন্ডিয়া ঠিক আবার কাশ্মীরকে কবজা করে নেবে”।
আয়েষা বলল, “আমাদের কাউকে দরকার নেই। উই নো, হাউ টু রান এ কান্ট্রি”।
আমির বিদ্রুপের গলায় বলল, “তাই নাকি? তাহলে আমাদের ইনভলভ করা হচ্ছে কেন? নিজেরাই যা করার করে নাও”!
আয়েষা কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল।
১৪
সন্ধ্যে ছ’টা। তারা গুলমার্গ বর্ডারের কাছে পাকিস্তানি বেস ক্যাম্পে পৌঁছেছে।
পাকিস্তানী ক্যাম্পের কমান্ডার ইন চিফ হুসেন আনোয়ার আয়েষার কাছে এসে বলল, “আমরা ড্রোণ অ্যাক্টিভেট করে দিয়েছি। পয়েন্ট ফোরে এখনো ইন্ডিয়ান আর্মি আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রোপওয়ে লক্ষ্য করে ফায়ারিং শুরু করে দেব। এখন যুদ্ধ বিরতি চলছে। ওরা এক্সপেক্ট করবে না। পয়েন্ট ফোরে ওদের লোক কমে গেলেই আমরা আপনাদের পাঠিয়ে দেব”।
রজ্জাক বলল, “আপনাদের লোক থাকবে আমাদের সঙ্গে?”
হুসেন বলল, “থাকবে। আমরা বর্ডার পার করিয়ে দেব। চিন্তা করবেন না”।
আমির বলল, “আমাকে একটা লাইট মেশিনগান দেওয়া যায়?”
হুসেন আমিরের দিকে তাকিয়ে বলল, “না। কোন আর্মস দেওয়া যাবে না। মিরান সাহাব আপনাদের বলে নি?”
আয়েষা বলল, “বলেছেন। ঠিক আছে। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবেন। আমরা প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করছি”।
হুসেন চলে গেলে আয়েষা মিরান সাহেবকে ফোন করে রিপোর্ট করল।
প্রচন্ড শীত পড়া শুরু করেছে। তারা ভারি কিছু পরে নি। ভারি পোশাকে দৌড়তে অসুবিধে হবে। আমির আর রজ্জাক হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করতে বসল। আরিফ চোখ বন্ধ করল। সামনের সময় একেবারেই অনিশ্চিত। একই সঙ্গে তার মনে হল, কী আর হবে? নিজের আব্বু আম্মুকেই তো ওরে মেরে ফেলেছে। তার বেঁচে থেকেই বা কী হবে?
খানিকক্ষণ পরে ফায়ারিং এর শব্দ আসতে শুরু করল। এ পাশ থেকে ফায়ারিং শুরু হল। ওপাশ থেকেও প্রত্যুত্তর আসতে লাগল।
হুসেন এসে বলল, “চলুন। দ্য টাইম হ্যাজ কাম”।
চারজনকে তড়িৎগতিতে বেস ক্যাম্প থেকে বের করে একটা জিপে বসানো হল। গোলাগুলির শব্দের মধ্যে সে গাড়ি অন্ধকার ভেদ করে চলতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ পর একটা জায়গায় গাড়ি থামল।
হুসেন বলল, “সামনে একটা পাইন গাছের বন আছে। এখন ক্লিয়ার। দুটো বাঙ্কার ইন্ডিয়ান আর্মি ছিল। আমরা গোলাগুলি শুরু করেই ওদের সাফ করে দিয়েছি। বাকিরা রোপওয়ে পয়েন্টে আছে। আপনারা খানিকটা যাওয়ার পর দেখবেন একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। উৎরাই আছে অনেক খানি। দেখবেন পড়ে না যান। বন পেরিয়ে গেলে তারপর আর কোন চিন্তা নেই। বর্ডারের তার কেটে দেওয়া হয়েছে। গো, ফাস্ট। ম্যাক্সিমাম আধ ঘন্টার উইন্ডো পাবেন আপনারা। টর্চ দেওয়া হচ্ছে আপনাদের সঙ্গে, কিন্তু কোন ভাবেই টর্চ জ্বালাবেন না”।
তারা দৌড় শুরু করল অন্ধকার এবং গোলাগুলির শব্দের মধ্যে। আরিফের হাঁফ ধরছিল। আয়েষা তার হাত ধরল। আমির আর রজ্জাক অভ্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলল। পাহাড় থেকে নেমে চলা।
আরিফের মনে হল সে যেন খাদের মধ্যে এগিয়ে চলেছে। প্রবল গোলাগুলি শুরু হয়েছে কাছে পিঠে।
খানিকটা যেতেই চোখে পড়ল পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট বাঙ্কার। আয়েষা কৌতূহলবশত টর্চ জ্বালতেই দেখল দুজন ভারতীয় সেনা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তড়িঘড়ি টর্চ বন্ধ করে দিল আয়েষা।
হুসেনের কথাই ঠিক। বন পার হতেই একটা মারুতি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তারা উঠে পড়তেই সে গাড়ি স্টার্ট নিল।
আরিফের জোরে শ্বাস পড়ছিল।
আয়েষা আরিফের হাত শক্ত করে ধরে বলল, “উই হ্যাভ মেড ইট। ডোন্ট ওয়ারি”।
আমির রাগী গলায় বলল, “হুসেন সাব স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন টর্চ না জ্বালাতে। তুমি কেন জ্বালালে?”
আয়েষা বলল, “আই অ্যাম সরি। হাত পড়ে গেছে”।
আমির বলল, “হাত পড়ে গেছে? এতক্ষণে শিওর ওরা ট্র্যাক করে নিয়েছে আমাদের”।
ড্রাইভার বলল, “চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো। আপনাদের সহি সালামাত পৌঁছে দেব। আই কার্ড রেডি রাখুন। সামনে চেকিং আছে। আপনারা ইন্ডিয়ান ট্যুরিস্ট। গোলাগুলি দেখে পালাচ্ছেন। বুঝেছেন কী বলতে হবে?”
আমির বলল, “হ্যাঁ”।
সবাই পকেট থেকে আই কার্ড বের করতে শুরু করল।
চেক পোস্টে দুজন সি আর পি এফ ছিল। গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে কী হল?”
ড্রাইভার বলল, “স্যার বর্ডারে গোলাগুলি শুরু হয়েছে। ওরা ঘুরতে এসেছিলেন। গুলমার্গে হোটেলে ছিলেন। ফায়ারিং শুরু হতে ভয় পেয়ে বললেন শ্রীনগরে যাবেন”।
জওয়ান বলল, “আই কার্ড দাও সবার”।
ড্রাইভার আই কার্ড দিল। জওয়ান সেগুলো দেখে ফেরত দিয়ে বলল, “কাশ্মীর ঘুরতে এলে গোলাগুলি তো সইতেই হবে। দিল্লি থেকে এসেছেন দেখছি। যাই হোক, সাবধানে যাও”।
ড্রাইভার সালাম দিল।
গাড়ি চেক পোস্ট ছাড়ত্তে হাঁফ ছাড়ল আয়েষা। আমির বলল, “ইচ্ছা করছিল দুটোরই গলা কেটে ফেলে দি। ব্লাডি ইন্ডিয়ান্স”।
আয়েষা বলল, “তোমার এই গরম মিশনের জন্য রেখে দাও। আর আমি কিন্তু সহি সালামাত বর্ডার পার করিয়ে দিলাম। এখন তুমি কাশ্মীরে আছো। আশা করি আমার কথা শুনবে এবার”।
আমির চুপ করে গেল। আর কোন কথা বলল না। বোঝা গেল সে বেশ রেগে গেছে। গুলমার্গের পাহাড় থেকে নেমে গাড়িটা বেশ খানিকটা পথ গিয়ে রাস্তার পাশের এক পোশাকের দোকানে দাঁড়াল।
আয়েষা হাসি মুখে বলল, “কাম অন গাইজ। হাসান চাচার দোকানে এসে গেছি। আজ রাতে আমরা এখানে থাকছি”।