অপহৃত কল্পনা চাকমা – শাহীন আখতার
তদন্ত-সূত্র
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রায় ১১ দিন পর অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন কল্পনার ভাই কালিন্দিকুমার ও লালবিহারীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তারা ঢাকা এসেছিলেন বোনের উদ্ধারের দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলন করতে। তারও আগে পত্রিকা মারফত কল্পনা চাকমা অপহরণের খবর আমরা জানতে পেরেছিলাম। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচনোত্তর ফলাফল নিয়ে আমাদের উত্তাল আলোচনায় হঠাৎ হঠাৎ কল্পনা প্রসঙ্গটি এসে পড়তো। একজন মেয়েকে রাত দুপুরে তুলে নিয়ে গেল, দিনের পর দিন যাচ্ছে অথচ তার কোন হদিস নেই। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা অস্বস্তি অনুভব করছিলাম। সে সময় কালিন্দিকুমার চাকমা ওরফে কালীচরণ ও লালবিহারী চাকমা ওরফে ক্ষুদিরামের সঙ্গে দেখা। পাহাড়ের চাষবাস ফেলে তারা দুজন রাজধানীতে দুদিন ধরে হন্যে হয়ে বোন উদ্ধারের তদ্বির করছেন বটে, বিহ্বল ভাবটা তাদের তখনো কাটেনি। আমরা মানবাধিকার কর্মী তার নারী ইস্যুতে কাজ করি শুনে ভ্রাতৃদ্বয় এক কথায় আমাদের সাক্ষাৎকার দিতে রাজী হয়ে গেলেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় আমার সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী এডভোকেট খালেদা খাতুন।
আমার বোন কোথায়
কল্পনা চাকমা অপহৃত হয় ১১ জুন রাত ১টা নাগাদ। অপহরণকারীরা প্রথমে ক্ষুদিরামের চোখ বাঁধে। তারপর কালিন্দিকুমারের। কল্পনা চোখ বাঁধা ছিল কিনা তারা জানেন না, জানার কথাও নয়। জল তোলা, স্নান করার ঘাটে এসে চোখ বেঁধে বিলের দিকে তাদের তিন জনকে নিয়ে যাওয়া। কল্পনা হাঁটছিল বড় ভাই কালিন্দিকুমারের হাত আঁকড়ে ধরে। ক্ষুদিরাম গুলির নির্দেশ শুনে বিলের জলে ঝাঁপ দেন। বড় ভাই পরক্ষণে গুলির শব্দ শুনতে পান এবং ছোট ভাইকে মেরে ফেলেছে তাকেও মারবে ভেবে বোনের হাত ছেড়ে দৌড়ে পালান। তখন আরো একটা গুলির শব্দ হয়। তারপর কল্পনা ‘দাদা দাদা’ চিৎকার কালিন্দিকুমার শেষবারের মত শুনতে পেয়েছিলেন।
সেই রাতে মশাল জ্বেলে গ্রামবাসীদের নিয়ে কালিন্দিকুমার বোনকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। বিলের জলে ক্ষুদিরামের লুঙ্গি এবং গোলাগুলির থলে (ammunition pouch) তখন কেবল পাওয়া যায়। ক্ষুদিরাম সে রাতে বিল সাঁতরে বিবস্ত্র অবস্থায় পার্শ্ববর্তী লাম্বার বাড়িতে আশ্রয় নেন। আর খয়েরি রঙের গোলাগুলির থলেটি যথারীতি এজাহারের সময় থানায় জমা পড়ে। পরদিন অর্থাৎ ১২ জুন সকালে ক্ষুদিরাম প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান সম্রাটসুর চাকমার সঙ্গে কজইছড়ি সেনা ক্যাম্প কমান্ডারকে সনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ক্ষুদিরাম তাকে ‘আমার বোন কোথায়’ শুধোতেই তিনি গর্জে ওঠেন। এবং শালা মদ খাইছো, পাগল নাকি! শান্তি বাহিনী থেকে কবে ফিরেছো?’ বলে তাড়িয়ে দেন।
রাঙামাটির পথে
সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী, পাহাড়ী গণপরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ সমন্বয়ে আমাদের দলটি কল্পনা চাকমা অপহরণ সংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানে ২ জুলাই রাঙামাটি পৌঁছোয়। প্রথম গন্তব্য কর্ণফুলি সংলগ্ন ডিসি সাহেবের মনোরম বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। জেলা প্রশাসক শাহ আলম ভর সন্ধ্যায় বৃষ্টিভেজা অভ্যাগতদের অনতিবিলম্বে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর কল্পনা চাকমা অপহরণ সংক্রান্ত এফ আই আর-এর কপি পড়ে শোনালেন। কালিন্দিকুমার বর্ণিত বন্দুকধারী, টর্চ-অলা অপহরণকারীদের উল্লেখ এফ আই আর এর কোথাও নেই। ডিসি সাহেব জানালেন, বাঘাইছড়ি থানার টি এন ওকে দেয়া কালিন্দিকুমারের জনাববন্দীই এই এফ আই আর। তারপর বাঘাইছড়ির বন্যা পরিস্থিতি, বাঙালি-চাকমার মধ্যকার বর্তমান উত্তপ্ত সম্পর্ক নিয়ে তিনি কথা বললেন। কল্পনা চাকমাকে কি উদ্ধার করা যাবে, আমরা জানতে চাইলাম জেলা প্রশাসক বললেন ‘Law will take its own course।’ পুলিশ তদন্ত করছে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার ফোনে প্রায় প্রতিদিন কল্পনা চাকমা উদ্ধারের কাজ কতদূর এগিয়েছে, জানতে চান।
ডিসি সাহেবের বাসা ছেড়ে যখন রাস্তায় নামলাম তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা ৭টা। বাইরে ঘোর অন্ধকার ও টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এবার টিলাস্থিত পুলিশ সুপারের বাসভবন। পুলিশ সুপার মোঃ নুরুল আনোয়ার আমাদের খুঁটিনাটি প্রশ্নের জবাবে প্রতিবার ‘মামলা তদন্তাধীন’ বলে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে বিদ্যুৎ গেলো। তারপর প্রথম মোম এলো। পরে জেনারেটর। এই ফাঁকে আমরাও গুছিয়ে বসলাম। কল্পনার ভাই ক্ষুদিরাম ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী, তদন্তের স্বার্থে তার জবানবন্দী কি নেয়া হয়েছে? আমরা প্রশ্ন করলাম। পুলিশ সুপার জানালেন হয়েছে। আর ক্ষুদিরাম অপহরণকারীদের মধ্যে একজন ক্যাম্প কমান্ডার এবং দুজন ভিডিপি সদস্যকে যে চিনতে পেরেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে? মামলা তদন্তাধীন, তদন্তের স্বার্থে এতো ডিটেল বলা যাবে না, বলা যাবে না করেও এস পি সাহেব যা বললেন, আমাদের কেউ কেউ স্পষ্টভাবে, কেউ আবার আবছা আবছা বুঝলাম। অর্থাৎ তাদের তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। সে সময় আমরা জানতে পারি, কেবল মাত্র রাঙামাটি জেলায় ১৮০টি সেনা ক্যাম্প রয়েছে। একে পাহাড়ি এলাকা, তার ওপর যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় পুলিশ সুপারের পক্ষে একটি সেনা ক্যাম্পও ভিজিট করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি কল্পনা উদ্ধারে একশ ভাগ আশাবাদী।
এমন ঘুটঘুটে রহস্যাবৃত রাত! আশাবাদী না হলে যে এই অন্ধকারে এক পাও চলা যায় না। রাঙামাটি শহর জুড়ে লোডশেডিং। আমরা চলেছি। গন্তব্য রাঙামাটি সেনা প্রধান কার্যালয়। পথিমধ্যে পাহাড়ি সহযাত্রীরা বিদায় নিলেন। চারজন নারী এবং একজন পুরুষসহ মোট পাঁচজনের একটি নির্ভেজাল বাঙালি দল সেনা প্রধান কার্যালয়ের গেটে স্কুটার যোগে উপনীত হলাম। গেটে খানিক দাঁড়ানোর পর আমাদের মেহমানখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। মেহমানখানাটি আলোকিত প্রধান কার্যালয় থেকে অপেক্ষাকৃত নীচে এবং অন্ধাকারও। ঘন্টা খানেক অপেক্ষার পর কমান্ডার মেজর ডেকে পাঠালেন এবং বললেন কল্পনা বিষয়ে আমাদের কোন প্রশ্ন থাকলে যেন আই এস পি আর এর সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনে নিই। কেননা তারাই প্রেসের কাছে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্বকারী।
কল্পনার বাড়ী নিউ লাল্যাঘোনা
পরদিন ৩ জুলাই সকাল ৭টায় আমরা রাঙামাটি থেকে লঞ্চে চড়লাম। যাবো কল্পনার বাড়ী নিউ লাল্যাঘোনা গ্রাম। মাথার ওপর মেঘলা আকাশ, নীচে কাঁচালং নদী পাহাড়ি ঢলে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এবার ঢাকা থেকে যাত্রা করা বাঙালি পাহাড়ি মিলে গোটা দলটি সঙ্গে রয়েছে। লঞ্চ উজান ঠেলে অতি মন্থর গতিতে চলেছে। নদী তীরবর্তী গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ সৌম্য কান্তির পাহাড় দেখিয়ে একজন পাহাড়ি যাত্রী বললেন এর নাম রঙরাঙ পাহাড় অর্থাৎ কোলাহলের পাহাড়। রঙরাঙ পাহাড়সহ অন্যান্য পাহাড় চূড়ায় খানিক পর পর সেনা ছাউনি। একটি দুটি স্পিডবোট সেনা যাত্রীদের নিয়ে আমাদের পাশ কেটে জল উড়িয়ে দ্রুত চলে গেল। এক জায়গায় জলের ঘূর্ণিতে পড়ে পড়ে লঞ্চের স্টার্ট গেল বন্ধ হয়ে। লঞ্চের যাত্রী আসন ছেড়ে যাত্রীরা পাটাতলে বেরিয়ে এলেন। খানিকক্ষণ ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো লঞ্চটা পাহাড়ের পাদদেশে, নদীর চড়ায় ঢুসো চুসি করে স্টার্ট নেয়। তারপর মাইনীমুখের কাছে গিয়ে চড়ায় মুখ গুঁজে থেমে পড়ে। আমরা ইঞ্জিন নৌকোয় উঠে বসলাম। দূরছড়ি বাজারে এসে আবার নৌকো বদল। বাঙালি মাঝিরা এই অবেলায় কিছুতেই নিউ লাল্যাঘোনা, বাঘাইছড়ি যাবে না। অগত্যা আমরা চাকমা মাঝিদের নৌকোয় উঠলাম। এই প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় বিচ্ছিন্ন কিছু বাঙালি বসতি চোখে পড়লো। ডুবো এলাকার পাহাড় শিখরের সেনা ছাউনিগুলো যেন নীচে, আরো কাছাকাছি। তারা হাঁক ডাক ছেড়ে আমরা কারা, গন্তব্য কোথায় জানতে চাইলেন। বুঝলাম, স্পটের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। বিকেল সাড়ে ৪ টা নাগাদ আমাদের নৌকো কল্পনা চাকমার বাড়ির ঘাটে ভিড়লো।
কল্পনার ষাটোর্ধ্ব মা বাঁধুনি চাকমা বেরিয়ে এলেন। নিউ লাল্যাঘোনার গ্রামবাসীরা আঙ্গিনা জুড়ে ভিড় জমিয়েছেন। অথচ কোন কোলাহল নেই। এতোগুলি স্তব্ধ, বিহ্বল মুখ একসঙ্গে আর কোথাও দেখিনি। বাঁধুনি চাকমা মেয়ে অপহৃত হওয়ার সময়, ক্ষণ, ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। পাশে পুত্রবধু চারুবালা বসে। অপহরণকারীরা দুয়ারের দড়ি কেটে ঘরে ঢুকে পড়ার পর চারুবালা বাতি জ্বালাতে গেলে তারা তাকে ধমকে নিষেধ করেছিল। কল্পনার বড় ভাই কালিন্দিকুমার চাকমা মাঠের কাজ শেষে বাড়ী ফিরলেন। একি চেহারা হয়েছে তার, এর মধ্যে অসুখ বিসুখ করেছিল? কালিন্দিকুমার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। পাশে দাঁড়ানো একজন প্রতিবেশী জানান, কল্পনার ভাইয়েরা এখন চাপের মুখে আছে। ঢাকা থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে ফেরার পথে রাঙামাটিতে গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। কল্পনা অপহৃত হওয়ার পর তারা কেউ এখন আর ভয়ে রাতে বাড়ি থাকে না। ছোট ভাই ক্ষুদিরাম তখনও মাঠে কাজ করছিলেন। ভাইয়েরা কেউ লেখাপড়া করতে পারেননি। বাবা মারা গেছেন ছোট বেলায়। কল্পনাকে অনেক কষ্টে পড়াচ্ছিলেন তারা। বাঘাইছড়ি কলেজের বি এ ১ম বর্ষের ছাত্রী সে। বয়স ২৩। কেন সে অপহৃত হলো? কল্পনার একজন সহপাঠি মনে করেন, কল্পনা ক্যাম্প কমাডারের সঙ্গে চাকমা বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি করেছিল। প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে সে কল্পনাকে অপহরণ করেছে। নিউ লাল্যাঘোনার একজন তরুণের এ বিষয়ে অভিমত-কল্পনা খুব স্বাধীনচেতা মেয়ে ছিল। খুব সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল ওর। পাহাড়িদের জন্য নিজের জীবন দিতে পারে, কল্পনা এ রকম মেয়ে।
কল্পনাকে কখনো দেখিনি। কল্পনা এই, এরকম ছিল বলছে কেন ওরা? তারা কি মনে করে, কল্পনা আর ফিরবে না? একটি শোকার্ত গ্রাম পায়ে পায়ে হেঁটে এসে ঘাটে দাঁড়ালো। আমরা নৌকোয় উঠলাম। সামনে বন্যায় প্লাবিত বিল। এই বিল পথে কল্পনা অপহৃত হয়েছিল। তার পদচিহ্ন এখন জলের কোন গহীন তলায়।
আমরা বাঙালি
জল ডোবা জায়গাটার একপাশে বাঘাইছড়ি থানা সদর, অপর পাশে শিক্ষিত চাকমা অধ্যুষিত বাবুপাড়া। কল্পনা চাকমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমরা বাবুপাড়ায় নেমেছিলাম। সন্ধ্যা ৭টা। আমাদের এখন যেতে হবে থানা সদরে। টি এন ও ওসি আছেন ওখানে। ইঞ্জিন নৌকো স্টার্ট নিতেই বাঘাইছড়ি সদর উপকূলে প্রথমে একটি দুটি, চোখের পলকে অসংখ্য টর্চ আমাদের দিকে তাক করে জ্বলে উঠলো। কি মুশকিল! এতোদূর থেকে কি চ্যাঁচানো যায়। কিন্তু টর্চ তো নিভছে না। চাকমা মাঝিরা হাল ছেড়ে দিলেন। স্টার্ট বন্ধ। নৌকো দুলছে। লন্ঠন জ্বালানো হলো। আমরাও সঙ্গের টর্চ জ্বালালাম। ওদিক থেকে এক গুচ্ছ টর্চের আলো এগিয়ে আসছে। অগত্যা নৌকোর একমাত্র পুরুষ বাঙালি (পেশা সাংবাদিক) এগিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস বাঘাইছড়ি সদর ও বাবুপাড়ার মধ্যকার পায়ে চলার পথটি এখানো বানের জল ছাপিয়ে কিঞ্চিৎ ভেসে আছে! আমরা ঢাকা থেকে এসেছি, সাংবাদিক, আইনজীবী-বাঙালি পুরুষ জল কাদা ভেঙে এগিয়ে যেতে যেতে হাঁক দিলেন। আমরা, বাঙালি নারীরা টর্চ হাতে নৌকোর পাটাতনে দাঁড়ালাম। ওপার থেকে সাড়া এলো-আপনারা কি বাঙালি? তখন আমাদের আর পায়কে। হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা বাঙালি, বলতে বলতে কখন যেন নৌকো থেকে নেমে পড়েছি। জল কাদার ওপর দিয়ে সবাই এগোচ্ছি। এবার দুপারের বাঙালিরা মুখোমুখি। মধ্যিখানে বানের জল মহা কলরবে বয়ে চলেছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমাদের হাঁচি কাশি শুরু হয়ে গেল। তখন ওপার থেকে আবার ডাক এলো-আপনাদের সঙ্গে কি চাকমা আছে? কেবল বাঙালিরা চলে আসেন। তখন এপার থেকে চেঁচিয়ে বললাম-আমরা আসছি। নৌকোয় ফিরে এলাম। দুজন চাকমা (একজন নারী, অন্যজন পুরুষ) সহযাত্রীকে কি আবার বাবুপাড়ায় রেখে আসব? নৌকো ফিরতি পথ ধরা মাত্র ওপারের তারা যদি টর্চ ফেলে অন্য কিছু হাতে তুলে নেয়? মুখ দেখাদেখি তো হয়নি। আমরা যে বাঙালি তার প্রমাণ কি! সমাধান হিসেবে চাকমা সহযাত্রীদের জলে নামিয়ে (কাজটা যে কত অমানবিক, তখন মনে হয়নি) আমরা ওপারে যাবো, সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু মাঝিরা যে চাকমা? বেশী ভাবার সময় নেই। তাদের নিরাপত্তার ভার আমাদের নিতেই হবে। ওপারে নৌকো ভিড়লো। ঘাটে ভিডিপির সদস্যসহ ২৫/৩০ জন বাঙালি। আমাদের দেখামাত্র অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারের জন্য দু:খ প্রকাশ করলেন তারা। আমরা টি এন ও এবং ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাবো বললাম। তবে চাকমা মাঝিরাও আমাদের সঙ্গে যাবেন। নৌকোর ভার নিতে হবে নির্দিষ্ট কাউকে। তাই হলো।
বানের জল টি এন ও-র অফিস অব্দি ধাওয়া করেছে। জল কাদা ভেঙে প্রথম ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা। তিনি ব্যস্ত মানুষ। মারিশ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান এগিয়ে এলেন। এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ২৯ জুন বাঙালি মাঝিদের নিখোজ হওয়ার কথা উল্লেখ করলেন তিনি। আমরা বাবুপাড়া থেকে শুনে এসেছিলাম দশম শ্রেণীর ছাত্র রূপণ চাকমার গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিখোঁজ হওয়ার খবর। তার লাশ এখানো পাওয়া যায়নি। কল্পনা চাকমা উদ্ধারের দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণপরিষদ ২৮ জুন বাঘাইছড়িতে যে অবরোধ কর্মসূচী পালন করে, সেসময় এক পর্যায়ে বাঙালি ও চাকমাদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। রূপণ চাকমা তখন বাঘাইছড়ি বিডিআর ক্যাম্পের ২০০ গজের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়। এছাড়া সেদিন বাঘাইছড়ির অবরোধ কর্মসূচীতে যোগ দেয়ার জন্য আসার পথে নিখোঁজ হয় ৩ জন চাকমা ছেলে। চেয়ারম্যান আজিজুর রহামনের সঙ্গে কথাবার্তা চলাকালে ওসি শহীদুল্লাহ বিদায় নিতে ঘরে ঢুকলেন। কল্পনা চাকমা অপহরণ সংক্রান্ত পুলিশের তদন্তের ভার তার ওপর। সুতরাং আমাদের অনুরোধে ওসি সাহেবকে বসতেই হলো।
কল্পনার বড় ভাই কালিন্দিকুমার চাকমার জবানবন্দি নেয়ার পর এফ আই আর পড়ে শোনানো হয়নি বলে যে অভিযোগ আছে, আমরা তা শুরুতেই ওসি সাহেবের নিকট পেশ করলাম। তিনি বললেন, টিএনও সাহেব জনাববন্দি নিয়েছেন এবং অবশ্যই পড়ে শুনিয়েছেন। ‘তিনি পরহেজগার মানুষ, মিথ্যা বলেন না, অন্য দিক থেকে জানালেন চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান। কল্পনা অপহরণ সংক্রান্ত তথ্যানুসন্ধানের অগ্রগতি জানতে চাইলে ওসি সাহেব বলেন, তথ্যানুসন্ধানে সময় লাগবে। এটা একটা ক্লুলেস কেস। কিন্তু ইতিমধ্যে পাহাড়ী বাঙালিদের মধ্য যে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, আপনি কি মনে করেন, কল্পনা উদ্ধার না হলে এটা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে? আমাদের এই প্রশ্নের জবাবে ওসি শহীদুল্লাহ পাল্টা প্রশ্ন করেন কেন আপনারা মনে করেন কল্পনা উদ্ধার হবে না? এটি একটি sensational কেস। সাবধানে এগুতে হবে।’
আমরা টি এন ও র বাসার দিকে এগুতে থাকলাম। টি এন ও হাসান জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলে আমাদের তো মাথায় বাজ। তিনি জানালেন, কালিন্দিকুমার তার কাছে এসেই প্রথম জবানবন্দী দিয়েছিলেন। কিন্তু এই জবানবন্দী এফ আই আর হিসেবে রেকর্ড হয়নি। তার পকেটেই আছে। তিনি উঠে গিয়ে ভিতরের ঘর থেকে সেটি নিয়ে এলেন। কালিন্দিকুমার বর্ণিত বন্দুকধারী, টর্চ-অলা অপহরণকারীদের উল্লেখ আছে এই জবানবন্দীতে। অথচ এফ আই আর এ নেই। এবং তিনি যে কালিন্দিকুমারের জবানবন্দীটি লিপিবদ্ধ করার পর তাকে পড়ে শোনাননি, তা স্বীকার করলেন টি এন ও হাসান জাহাঙ্গীর আলম।
প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিপরীতমুখী নানান তথ্যে ভারাক্রান্ত আমরা ঘাটে এসে দাঁড়ালাম। পাশের চালাঘরে কয়েকজন মিলে জারি গান গাইছে। সত্যি মানুষের কি অসীম ক্ষমতা! এমন সশস্ত্র সংঘর্ষ পিষ্ট পরিবেশেও মানুষ গান করে। এসব দেখলে শুনলে মানবজাতির যে আরো উন্নতি হবে এ ব্যাপারে কোন সংশয় থাকে না।
এখানে রূপণেরা থাকে
পরদিন ৪ জুলাই সকালে বাঘাইছড়ির ঘাটে এসে দাঁড়ালাম। সামনে সেই কাচালং নদী। ইঞ্জিন নৌকোয় করে আমরা বাঘাইহাট যাবো। ওখান থেকে প্রথমে চাঁদের গাড়ী, পরে বাসে চড়ে পৌঁছবো খাগড়াছড়ি। সেদিনই ঢাকায় ফেরা। নৌকো খানিকটা চলার পর ঝগড়াবিল গাঁয়ে এসে থামলো। গায়ের স্কুল, মুদি-দোকান পেরিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরের চাতালে পৌঁছলাম। এই জনপদের নাম রূপকারী। কাপ্তাই বাঁধ তৈরির সময় সেখানকার রূপকারী গ্রাম থেকে উদ্বাস্তুরা এসে এখানে আবাস তৈরি করেন। তাদের ফেলে আসা, জলের তলায় হারিয়ে যাওয়া সেই গাঁয়ের স্মৃতি রক্ষার্থে এই এলাকার নামকরণ করেছেন তারা রূপকারী। কিশোর রূপণ চাকমা ছিল এ গাঁয়ের একজন উদ্বাস্তুর সন্তান।
আমাদের ঘিরে রূপকারীর বাসিন্দারা। রূপণের মা ইন্দ্রমুখী, বাবা হীরঙ্গ চাকমাও এসেছেন। অনেকের মধ্যে আছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী, মন্দিরের ভিক্ষু। বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর মনে অনেক দু:খ। তারা একবার ভিটেমাটি হারিয়েছেন। তাদের সোনার সন্তানেরা কেন এভাবে বারে বারে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা উঠতে যাবো, হঠাৎ রূপণের মা ইন্দ্রমুখী আমাদের একজনের পা জড়িয়ে ধরলেন, বাবা আমার সন্তান ফেরৎ চাই। তার গোর ফেরৎ চাই। আমি ধর্মমতে তার সৎকার করবো। গাঁয়ের মেয়েরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। রূপণের মৃত্যুতে ওরা কাঁদছে। রূপকারী জনপদ যেন অসহ্য শোকে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
আমরা রাঙামাটি থেকে খাগড়াছড়ি হয়ে তিনদিন পর ঢাকা ফিরছি কিন্তু কল্পনা চাকমা কোথায়? রাঙামাটির ডিসি গুজব শুনেছেন, কল্পনা রাঙামাটিতেই আছে। পাহাড়ি একজন কল্পনাকে স্পিডবোটে করে কজইছড়ি ক্যাম্প থেকে বাঘাইছড়ি ক্যাম্পে নিয়ে যেতে দেখেছেন। মারিশ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনে করেন, তারা নিজেরাও এ কাজ করতে পারে। কল্পনা উদ্ধারের কাজ এতোদিন ধরে এসব রটনার ভেতর কেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে? এ ওপর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে রেহাই পেলেও কল্পনা উদ্ধার ব্যতীত প্রশাসনের তো এ থেকে নিস্তার পাওয়ার কথা নয়।
ভোরের কাগজ : ১৭ জুলাই ১৯৯৬