কল্পনা চাকমার ডায়েরি, চিঠিপত্র ও ছবি
কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারের দাবি : রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও প্রতিরোধ
কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিক্রিয়া : বিভিন্ন লেখকদের লেখা

অপহৃত কল্পনা ও আজকের অবস্থা – মুক্তি নারায়ন

অপহৃত কল্পনা ও আজকের অবস্থা – মুক্তি নারায়ন

সাংগঠনিক দিক থেকে আমি আর কল্পনা একই মতাদর্শের অনুসারী হলেও একসাথে কাজ করার তেমন একটা সুযোগ হয়ে উঠেনি, বাঘাইছড়ির অন্যান্য নেতাদের সাথে যেমনটি হয়েছে। যার কারণে কল্পনাকে জানার তেমন একটা সুযোগ আমার হয়নি, যদিও কল্পনার সাথে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তবুও যতটুকু জানি এবং চিনি তার ভিত্তিতেই আজকের এ লেখার অবতারণা।

কল্পনা অত্যন্ত অমায়িক এবং মিতভাষী। সে জন্য সংগঠনে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। সংগঠনের কর্মীদের মধ্যে সময়ে সময়ে সামান্য যে সব ভুল বোঝাবোঝি হয়, সেগুলো মিটমাট হয় তারই দক্ষতার কারণে। কাজেই কল্পনা যে একজন দক্ষ কর্মী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কল্পনা শেষ সময় পর্যন্ত যে গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন তা তার কাজের মধ্য দিয়েই আমরা প্রমাণ পাই। বিজয়’দার নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত বৈঠকের দিন কল্পনাসহ এখানকার দু’চার জন কর্মী রাঙ্গামাটি উপস্থিত ছিলাম। বাঘাইছড়ি এসে বাবুপাড়ায় বৈঠক করে প্রচারণার জন্য এলাকা ভাগ করা হলো। কল্পনা বাঘাইছড়ি আর সারবোতলী এলাকায় প্রচারণায় নেমে গেলেন। যার যা দায়িত্ব সাধ্যমত পালন করা হলো। কল্পনা তার প্রচারণী এলাকায় খুব ভালো ভূমিকা রেখেছিলেন নিঃসন্দেহে। প্রচারণা শেষে আমরা সবাই নির্বাচনের দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

অবশেষে দুর্ভাগা সেই দিনটি আমাদের মাঝে উপস্থিত হলো। ১২ জুন সকাল ৯টা কি সাড়ে ৯টা নাগাদ আমাদের ভোট কেন্দ্রে খবর এল কল্পনা আর তার দু’ভাইকে রাত আনুমানিক ১টার দিকে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে লেঃ ফেরদৌস গুলি করে মেরে ফেলেছে এবং তাদের পাওয়া যাচ্ছেনা (খোঁজাখুঁজির পরও)। ঘন্টা খানেক পরে আরো খবর এলো যে দু’ভাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু কল্পনাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত আলোচনা করে কল্পনার গ্রাম লাল্যাঘোনার দিকে দু’জন কর্মী রওনা হল। পরে ২টার দিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমরাও রওনা দিলাম বাঘাইছড়ির দিকে।

থানা সদরে পৌঁছার কিছুক্ষণ পর কল্পনার নিখোঁজের খবর সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম। রাত আনুমানিক ১০টা নাগাদ একদিকে কল্পনাকে হারানোর শোক আর একদিকে পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে বাবুপাড়ার দিকে রওনা হলাম। নির্বাচনে পরাজয় আমাদের কাছে এত দুঃখের নয়। পরাজয় যে কারোর হতে পারতো, কিন্তু কল্পনার অপহরণ প্রিয়জন হারানোর মতই মর্মান্তিক, হৃদয় বিদারক। আমরা এধরণের ঘটনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কেন তাকে অপহরণ করা হলো? কি দোষ ছিলো তার? অন্যায় অনাচারের প্রতিবাদ করতো বলেই কি তাকে অপহরণ করা হলো? তার এই প্রতিবাদ করাটা কি অপরাধ? অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার তো সকলের রয়েছে।

কল্পনাকে অপহরণের পর একটি চক্র খুব তৎপর হয়ে উঠেছিলো সরকারের কাছ থেকে কিছু লুফে নেবার জন্য। তাদের মধ্যে জাতির কলংক সেনাবাহিনীর পা চাটা কুকুর সুবিনয় অন্যতম। কল্পনার প্রতিবাদী ভাষা সুবিনয়দের স্বার্থে আঘাত করতো, তা কারোর অজানা নয়। কল্পনা অপহরণের পরও যারা নির্বিকার থাকতে পারে তারা মনুষ্য সমাজে বাস করার যোগ্য কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাদের মা-বোনেরাও রক্ষা পাবে না “দেশ রক্ষক” নরপশুদের কাছে। তার প্রমাণ ‘৭১ এর ইতিহাস। ‘৭১-এ দালাল, রাজাকার ও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পাশবিক লালসার শিকার হয়ে সম্ভ্রম হারিয়েছেন নিরীহ সেজে থাকা অসংখ্য মা বোন। আমাদের জুম্ম নারীরাও যদি এতকিছুর পরও নির্বিকার থাকেন তাহলে তা হবে নীরেট বোকামী। কল্পনা অপহরণ যাদের মনে আঘাত লাগাতে পারেনি তাদের মা অথবা বোন অপহৃত হলে তাদের প্রতিক্রিয়া কি হতো তা আমার বোধগম্য নয়। কল্পনা অপহরণের পর যাদের দায়সারা প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল তাদের মতিগতিও এখন জনগণের কাছে পরিষ্কার। তারা এখন শুধু কল্পনা নয়, জুম্মদের অবিসংবাদিত নেতা প্রয়াত এম, এন লারমার আদর্শকেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তারা তাদের রঙীন স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এম, এন লারমার আদর্শকে গলা টিপে হত্যা করতে উদ্যত। তারা এক সময় জুম্ম ছাত্র সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের পক্ষে ছিল। আজ তারা শান্তির (?) মন্ত্র জপে ৫দফা সমর্থনের নাম করে আন্দোলনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আজ যারা ক্ষমতা আর স্বার্থের লোভে কল্পনাসহ অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আত্মত্যাগী ভাইবোনদের অস্বীকার আর অবহেলা করছে, তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ইতিহাস এই বিশ্বাসঘাতক বেঈমানদের কোনদিন ক্ষমা করবে না। জাতীয় বেঈমান, কুচক্রী আর সেনাবাহিনীর পোষ্যদের মনে রাখা দরকার, কল্পনার বোনেরা এখনো বেঁচে আছে, কল্পনার স্বপ্নগুলো এখনো হারিয়ে যায়নি। বাংলাদেশে আল-বদর, রাজাকারদের যে পরিণতি হয়েছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয় বেঈমানদেরও যে একই পরিণতি ঘটবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

সুবিধাবাদীদের চেহারা দেখলে হাসি পায়। তাদের কি বোধোদয় ঘটবে না? কল্পনা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন নিজের ইচ্ছায় এবং দেশ এবং জুম্ম জাতির স্বার্থে। কিন্তু সুবিধাবাদী সুযোগ সন্ধানী লম্পট গোষ্ঠী নেতা কর্মী সেজে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আন্দোলনে অংশগ্রহণের ভান করছে। তারা কি কল্পনার মহান আত্মত্যাগ থেকে কিছুই শিখতে পারলো না? তারা নিয়মিত মাসোহারা পাচ্ছে। মাসে মাসে টাকার তোড়া উড়ে আসছে, আর সেই টাকায় এখানে তথাকথিত দেশপ্রেমিক সাজছে। এদের ব্যাপারে সবাইকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। কথায় বলে চিহ্নিত শত্রুর চেয়ে বন্ধু বেশে অচেনা শত্ৰু অনেক বিপজ্জনক ও ভয়ংকর। এই সুযোগ সন্ধানী ধান্ধাবাজরা আজ যাদের গুণগান গাইছে এবং যাদের পদতলে লেজ নাড়ছে, কিছুদিন আগেও তারা তাদের সেই প্রভুদের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতো। যারা আজ প্রকৃত সংগ্রামীদের “হ্লে পেগর” ভয় দেখানোর স্পর্ধা দেখাচ্ছে, এরাই জগন্নাথ হলে থাকতে “লে পেগ” ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। অথচ নিয়তির কি পরিহাস, এদের মধ্যেই আজ সখ্যতা। তারাই সকলে মিলে আজ জাতীয় ঐক্যের কোরাস গাইছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, তাদের এই ঐক্য কার বিরুদ্ধে? তাদের এই ঐক্য যে সরকারের বিরুদ্ধে নয়, তা দিবালোকের মত সুস্পষ্ট। কারণ, এইসব ধান্ধাবাজরা একদিকে পাঁচ দফাকে সমর্থন করে বলে দাবী করে, আর অন্যদিকে সরকারী দল আওয়ামী লীগের লোভী কর্মী ও সমর্থক। তাহলে কি তাদের জাতীয় ঐক্যের মধ্যে আওয়ামী লীগও অন্তর্ভূক্ত? কাজেই তাদের ঐক্য যে সরকারের বিরুদ্ধে নয়, তাদের ঐক্যজোট যে আন্দোলনের পক্ষে নয়, তা খুব স্পষ্ট। তাহলে কি আমরা ধারণা করতে পারি যে, তাদের ঐ ঐক্য প্রকৃত দেশপ্রেমিক সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে? আরো সহজ কথায় বলতে গেলে, একজন উদীয়মান আপোষহীন (নীতিগতভাবে) আন্দোলনের প্রতীক নির্ভীক নেতার বিরুদ্ধে?

সুবিধাবাদী, সুযোগ সন্ধানী, ধান্ধাবাজদের সাথে প্রকৃত সংগ্রামী বন্ধুদের কখনো ঐক্য হতে পারে না। রতনে রতন চিনে, ভণ্ড চিনে ভণ্ডকে। ধান্ধাবাজদের এই ঐক্যে আমি ব্যক্তিগতভাবে ষড়যন্ত্রের আলামত দেখছি, জাতির অমংগলের কালোছায়া দেখতে পাচ্ছি। কেউ যদি জঘন্য ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের জন্য আন্দোলনের নামে এই সব পঁচাগলা রাজনৈতিক বেশ্যাদের সাথে দহরম মহরম করে, অথবা তাদের দিকে প্ৰকৃত সংগ্ৰামী বন্ধুদের বিরুদ্ধে ল্যাং মারা হয়, তাহলে জাতির জন্য তার পরিনাম কখনো শুভ হবে না। ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না।

কিছু দিন আগে সেই মসোহারা পাওয়া বৈঠক প্রক্রিয়ার জ্বরে’ আক্রান্ত তথাকথিত চার নেতা বাঘাইছড়ি আসে প্রলাপ বকতে। তাদের প্রলাপে বাঘাইছড়ির পাগলেরা পর্যন্ত হতবাক। বাঘাইছড়ির এ গ্রামে এসে তথাকথিত চার নেতার এক জন নারী লোভী লম্পট। সে নাকি মেয়েদের চাকুরী দিতে শুরু করেছে। বাঘাইছড়ি এসেও ঐ লম্পটটি তার বদ্ অভ্যাস ঢেকে রাখতে পারেনি। লোকজনের প্রশ্নের তোড়ে পড়ে তারা চুরি করতে ধরা পরা বিড়ালের মতো কাঁচুমাচু করে।

চাকুরী যেন তার পকেটের চকোলেট। যাকে ইচ্ছা তাকে দেবে। সে ভেবেছে তার পাগলামীতে বাঘাইছড়ির মেয়েরা হুড়োহুড়ি করবে। তার খেয়াল থাকা উচিত ছিলো বাঘাইছড়ি কল্পনার জন্মস্থান। বাঘাইছড়ির মেয়েদের চাকুরী এত মূখ্য নয়। তারা চায় ইজ্জ্বত আর জান মালের নিরাপত্তা। চায় মুক্ত গর্বিত জুম্ম জাতি হয়ে বেঁচে থাকতে সেই তথাকথিত চার নেতা অবশেষে কল্পনার গ্রাম লাল্যাঘোনায় চলে যায়। সেখানে তাদের প্রশ্ন করা হয়, “তোমরা কে? কি উদ্দেশ্যে ঘুরছো?” তারা এ প্রশ্নের সদূত্তর দিতে ব্যর্থ হয়। আমাদের প্রশ্ন ছিলো সত্যিকারের “৫দফার সমর্থক” হলে চুপি চুপি প্রচারণা কেন? প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা করতে দ্বিধা কোথায়? কোন প্রশ্নের ঠিকমত উত্তর দিতে না পারলে উপস্থিত একজন শিক্ষক ধমকের সুরে চড়া গলায় বলে উঠে “কে বলছে পত্রিকার কথা ভুল? কে বলছে বিবিসি’র ভাষ্য ঠিক নয়?” তখন চার কুচক্রীর একজন ঐ শিক্ষকের ধমকে পানি ছিটা খাওয়া বিড়ালের মতো একদম চুপসে যায়। পরে কাকুতি মিনতি করে “দাদা দাদা” “না না, আমরাতো আমরাতে…” বলতে বলতে আর কথা শেষ করতে পারেনি। তাদেরকে দুপুরে খাওয়ার জন্য বলা হলেও আর একদণ্ড থাকেনি।

এখন জুম্ম জনগণের সজাগ থাকার মুহূর্ত। পাঁচ দফার নাম নিয়ে অনেক লম্পট দেশপ্রেমিক সেজে সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নেবার ধান্ধায় রয়েছে। সে সব দেশপ্রেমিকদের কাছ থেকে দূরে থাকুন। এমন দেশপ্রেমিক গজিয়েছে, যে দেশপ্রেমিকরা ৮৩-সালে এম, এন, লারমাকেও হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। অভাগা জুম্মদের ধ্বংসের যত রকমের অপচেষ্টা চলুক এম, এন, লারমার চেতনায় কল্পনাসহ যারা আত্মত্যাগ করেছেন তা কখনো বৃথা যাবে না। যে কোন মূল্যে আমরা পাঁচ দফাকে তথা জুম্মোদের মুক্তির সনদ পূর্ণস্বায়ত্তশাসন দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাবো।

বাঘাইহাট বাজার, কাচালং, রাঙামাটি
স্বাধিকার : বুলেটিন নং—সাত, ২০ আগস্ট ‘৯৭

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *