পঞ্চান্ন
যা ভেবেছে ম্যাককুলাক, ঠিক তাই ঘটেছে তার ক্ষেত্রে। অ্যান্টিটক্সিনের কারণে মরার দশা তার। তবুও রয়ে গেছে মরা বাঁদরের লাশ সরাতে গিয়ে। কাজটা শেষ হতেই ভাবল, ল্যাবোরেটরি থেকে বেরিয়ে চলে যাবে নিজের কোয়ার্টারে। ভীষণ বমি আসছে তার। সেইসঙ্গে জ্বর। মাথাব্যথা যেন বাড়তি একটা চাপ। না, সত্যিই তার এখন চাই পূর্ণ বিশ্রাম।
এই বিপদে আবারও গিসেল হাজির হবে, ভাবতেও পারেনি সে। এইমাত্র কড়া ব্রেক কষে ল্যাবোরেটরির সামনের করিডোরে থেমেছে লোকটা। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল সে। এলোমেলো চুল। বিস্ফারিত দুই চোখ। নাকের কাছে সাদা পাউডার। ‘ওই ক্যানিস্টার!’ চেঁচিয়ে উঠল ডেইটার, ‘ওগুলো লাগবে!’
প্রধান গবেষণাগারের বাইরের ঘরে প্লাস্টিকের ক্রেটে ক্যানিস্টার রেখেছে ম্যাককুলাক। ডেইটার গিসেলকে দেখিয়ে দিল কোথায় পাবে জিনিসগুলো।
কিন্তু নিজে হাত না লাগিয়ে নির্দেশ দিল ডেইটার, ‘জলদি গাড়িতে তোলো! তুমি অসুস্থ নাকি? এখন সময় নেই অসুস্থ হওয়ার!’
‘কী হয়েছে, বস?’ কাঁপা গলায় জানতে চাইল বিজ্ঞানী। যে-কোনও সময়ে বমি করবে। ভূতের মত ফ্যাকাসে হয়েছে সে।
‘সরকারি এজেন্ট হামলা করেছে এই ফ্যাসিলিটিতে। এটা হাতে রাখো।’ ম্যাককুলাকের দিকে পিস্তলের বাঁট এগিয়ে দিল ডেইটার। ‘আমাকে রক্ষা করবে। আমরা চলে যাচ্ছি এখান থেকে। কেউ ঝামেলা করলে গুলি করবে।’
‘আমি তো বিজ্ঞানী, গোলাগুলি পারি না,’ পিস্তলের দিকে চেয়ে প্রতিবাদ করল ম্যাককুলাক।
রেগে গিয়ে তার নাকের কাছে নিজের নাক নিল ডেইটার। সাপের মত হিসহিস করল, ‘ভুলে যেয়ো না আমি তোমাদের নেতা। নিজের দায়িত্ব পালন করবে, গাধা; নইলে মুচড়ে ভেঙে দেব তোমার ম্যাচের কাঠির মত ঘাড়টা।’
আপত্তির উপায় নেই ম্যাককুলাকের। ক্যারিয়ারে ক্যানিস্টার রাখার পর, রওনা হলো ওরা। অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে বিজ্ঞানী। রেডিয়োতে দলের শেষ ক’জনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে ডেইটার। ‘ওয়াকেলেক? তোমার সঙ্গে রুটগার? মন দিয়ে শোনো আমার কথা। ফ্যাসিলিটির ভেতর ঢুকেছে সরকারি এজেন্ট। হাতে অস্ত্র তুলে নাও। হামলা করো তাদের ওপর। এটা একটা নির্দেশ।’
সাড়া দিল না ওয়াকেলেক।
বাধ্য হয়ে রেডিয়োর অন্য চ্যানেল ব্যবহার করল ডেইটার। ওটা ব্যবহার করে শুধু সে আর ডেইযি।
ওদিক থেকে যোগাযোগ করল না তার প্রেমিকা।
কোথায় গেল মেয়েটা!
শার্টের পকেটে হ্যাণ্ডসেট রাখল ডেইটার। চিৎকার করে গাল দিল গফ্ কার্টটাকে: ‘কুত্তার বাচ্চা, আরও জোরে চলতে পারিস না!’
.
‘অপ্রাকৃতিক পরিবেশ,’ বলল বেলা। ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই যে কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না লোকটাকে। কে জানে, কত দিন ধরে এখানে লুকিয়ে আছে!’
নিউক্লিয়ার বাঙ্কারের গভীরে ঢোকার পর গল্ফ কার্ট থেকে নেমে পড়েছে ওরা। চারদিকে নানান করিডোরের মোড়। এক এক করে ঘর সার্চ করতে করতে চলেছে দু’জন। এ ফ্যাসিলিটি কতটা বড় বা গভীর, জানা নেই রানার। তবে মনে হচ্ছে, মাটির ওপরে কোনও বাড়িঘর নেই। দূর থেকে আসছে ওগুলো বোধহয় জেনারেটর ও এয়ার চাপা গুঞ্জন।
কণ্ডিশনারের আওয়াজ।
রানার মনে হচ্ছে বিশাল ফ্যাসিলিটির ভেতরে রয়েছে আরও সশস্ত্র লোক। লাথি মেরে আরেকটা দরজা খুলে এমপিফাইভ হাতে ভেতরে ঢুকল রানা। এই ঘর যুদ্ধজাহাজের ডরমিটরির মত। কয়েক সারি বেড। কুঁচকে আছে চাদর। বাতাসে বাসি ঘামের বদ গন্ধ। পরের পাঁচটা ঘর একইরকম। এরপরের ঘরটা ক্যান্টিন। টেবিল ও চেয়ারের ওদিকে মেস লাউঞ্জ। ওখানে বড় আকারের একটা টিভি।
আবারও করিডোরে বেরোল রানা ও বেলা। করিডোর ও অসংখ্য ঘরের দরজার যেন শেষ নেই। কোথাও কোথাও বিলাসবহুল রিসেপশন এরিয়া। যে কেউ বলবে, যুরিখ, লণ্ডন, প্যারিস বা নিউ ইয়র্কের নামকরা কোনও কর্পোরেট হেডকোয়ার্টারের রিসেপশন রুম এসব। ওরা ঢুকল বিশাল এক ডাইনিং রুমে। ওয়ালনাট দিয়ে তৈরি টেবিল ও চেয়ার। মেঝেতে ফার্সি কার্পেট। চকচক করছে রুপালি প্লেট ও গ্লাস। একপাশে মার্বেলের ফায়ারপ্লেস। দেয়ালে নামকরা ক’জন চিত্রকরের তৈরি আসল তৈলচিত্র। নিউক্লিয়ার বিপর্যয় হলেও এখানে রয়ে যেত পুরনো আমলের শিল্প।
আরও এগিয়ে ওরা দেখল, প্রতিটি জায়গা বিলাসবহুল নয়। প্রকাণ্ড এক গুদাম এলাকায় ঢুকে মৃদু শিস দিল রানা। সারি সারি র্যাকে খাবার থেকে শুরু করে হাজারো ধরনের দরকারি জিনিসপত্র। এসবের তালিকা তৈরি করতেও একজন মানুষের লাগবে অন্তত একমাস।
‘কয়েক বছর ধরে জোগাড় করেছে,’ বিড়বিড় করল বেলা।
আরও কিছুক্ষণ হেঁটে ওরা পৌঁছল আর্মারিতে। সাজিয়ে রাখা হয়েছে হাজারো অস্ত্র। রানার মনে পড়ল সোভিয়েত আমলের এক অ্যাটমিক বাঙ্কারের কথা। ওটা বদলে নিয়েছিল ইউক্রেনিয়ান আর্মি। ভেতরে ছিল দশ হাজার কালাশনিকভ রাইফেল। দৃশ্যটা ছিল দেখার মত। কিন্তু তাদেরকে টেক্কা দিয়েছে ডেইটার গিসেল। নানাধরনের হালকা অস্ত্র জোগাড় করতে গিয়ে কত কোটি ডলার খরচ করেছে, তা সে-ই জানে। বাদ পড়েনি নানান দেশের মেশিন গান, শোল্ডার মাউন্টেড রকেট গ্রেনেড লঞ্চার, লং রেঞ্জ স্নাইপার রাইফেল। শেষের জিনিসটা দু’মাইল দূর থেকে ভেদ করবে মাঝারি ও ভারী আর্মার। রয়েছে চিন, রাশা ও আমেরিকার অ্যাসল্ট রাইফেল। আর্মারির ভেতর রয়েছে পৃথিবীর প্রত্যেক ধরনের সাবমেশিন গান, কমব্যাট শটগান ও পিস্তল। র্যাকের পর র্যাক চারপাশে। ঘরের মাঝেও। অস্ত্রগুলোর নল ছুঁই-ছুঁই করছে গম্বুজের মত উঁচু ছাত।
চারপাশ দেখতে দেখতে এগোতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল রানা। ঝুঁকে মেঝে থেকে তুলে নিল ছোট একটা শক্ত জিনিস। পায়ের নিচে পড়েছিল। নাইন মিলিমিটারের বুলেট। একদম নতুন। চকচক করছে। সম্প্রতি বের করা হয়েছে ক্রেট থেকে। চিন্তিত চেহারায় ওটা দেখল রানা।
আর ঝুঁকে বুলেটটা দেখেছে বলেই বেঁচে গেল। অনেকে এটাকে বলবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। হঠাৎ করেই শিরশির করে উঠেছে পিঠ। চরকির মত ঘুরেই রানা দেখল, এইমাত্র পনেরো গজ দূরের এক র্যাকের ওদিক থেকে বেরিয়ে এসেছে দু’জন সশস্ত্র লোক!
প্রায় একই সময়ে এমপিফাইভ তুলে গুলি করল রানা এবং ওই দু’জন। আগেই হ্যাঁচকা টানে বেলাকে একপাশে সরিয়ে দিয়েছে রানা। পেছনের উঁচু কয়েকটা ক্রেটের ওদিকে গিয়ে পড়েছে মেয়েটা। এক সেকেণ্ড আগে রানা ও বেলা যেখানে ছিল, তার পাশের র্যাকে লাগল একরাশ গুলি। অবশ্য আগেই মেঝেতে ঝাঁপ দিয়েছে রানা। ওর অস্ত্রের ম্যাগাযিনে রয়েছে প্রায় এক শ’টা গুলি। তবে শত্রুপক্ষের ম্যাগাযিনেও আছে ওই একই পরিমাণের বুলেট।
মুহূর্তে আমারি হয়ে উঠল খুবই বিপজ্জনক এলাকা।
ছাপ্পান্ন
দ্রুতগামী গল্ফ কার্ট প্রায় পৌঁছে গেছে করিডোরের শেষমাথায়। সামনেই একটি র্যাম্প। এবার কয়েক মিনিটের ভেতর ফ্যাসিলিটি ত্যাগ করে উধাও হবে ডেইটার গিসেল। আর কখনও ফিরবে না এখানে। সেজন্যে মনে কোনও কষ্টও নেই। তার এখানকার সব কাজ শেষ। সিটের পেছনের ক্যারিয়ারে নিরাপদে আছে প্লেগের ক্যানিস্টার ভরা ক্রেট। সাফল্যের ফল্গুধারা বইছে তার বুকে।
সরাসরি সামনে পড়বে হ্যাঙারে ওঠার র্যাম্প। ওটা পেরিয়ে ওপরের মেঝেতে পৌঁছুবে ডেইটার। কেউ বাধা দেয়ার আগেই উড়ে যাবে হেলিকপ্টার নিয়ে। এরই ভেতর পকেট থেকে রিমোট নিয়ে সিকিউরিটি কোড টিপতে শুরু করেছে সে।
ছয় নম্বর বাটন টিপবে, এমন সময় হঠাৎই ঘাড়ে টের পেল ইস্পাতের ঠাণ্ডা স্পর্শ। বরফের মত জমে গেল ডেইটার। বামহাত বাড়িয়ে গল্ফ কার্টের ইগনিশন থেকে চাবিটা খুলে নিল বুনযি ম্যাককুলাক। মোটর বন্ধ হতেই করিডোরে থমকে গেল ছোট্ট গাড়িটা। অ্যান্টিটক্সিনের প্রতিক্রিয়ায় দরদর করে ঘামছে ম্যাককুলাক। যে-কোনও সময় ডেইটারের গায়ে হড়হড় করে বমি করবে। কর্কশ, ‘দুর্বল স্বরে বলল, ‘আমি সরি, বস্। তবে আপনাকে কিছুতেই ওটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে দিতে পারি না। আমরা আবারও ফিরব ল্যাবোরেটরিতে। আগুনে পুড়িয়ে দেব ক্যানিস্টারের ব্যাকটেরিয়া।’
অস্ত্রের নল বড় ঠাণ্ডা লাগছে ডেইটারে ত্বকে। একবার ঢোক গিলে নরম সুরে বলল সে, ‘বুনযি, তুমি এসব কী বলছ? তুমি নিজেও তো আমার মতই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। আমার মতই তোমার নাম রয়ে যাবে ইতিহাসে।’
‘অনেক ভেবেছি,’ বলল ম্যাককুলাক। ‘আমরা ওই কাজ করলে সর্বনাশ হবে কোটি কোটি মানুষের।’ এবার দৃঢ় হলো তার কণ্ঠ: ‘এত মানুষের জীবন নিয়ে খেলার কোনও অধিকার আমাদের কারও নেই। আপনি পাগল হয়ে গেছেন। এখন থেকে আপনার দলে নেই আমি।’
‘কিন্তু, বুনযি…’
‘দয়া করে হাত থেকে রিমোট কন্ট্রোল ফেলুন, বস্।’
দ্বিধায় পড়ল ডেইটার। ভাবছে, কোনও উপায়ে কেড়ে নিতে পারবে কি না ম্যাককুলাকের অস্ত্র। কিন্তু খুব হালকা চাপেই গুলি বেরোয় বেরেটা থেকে। নড়তে গেলে হয়তো চাপ পড়বে ট্রিগারে। ফলে উড়ে যাবে তার অর্ধেক মাথা। বিরাট এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝেতে রিমোট ফেলল ডেইটার। তার দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে ম্যাককুলাক। লোকটা নেমে পড়ল গফ্ কার্ট থেকে। কয়েক পা গিয়ে রিমোটের দিকে গুলি করল সে। লাগল না গুলি। এবার পর পর তিনবার গুলি করে রিমোটটাকে চুরমার করল ম্যাককুলাক।
অস্ত্রের নল তার দিকে নেই দেখে সুযোগটা নিল ডেইটার গিসেল। গল্ফ কার্ট থেকে ঝাঁপ দিল অসুস্থ বিজ্ঞানীর ওপর। হালকা গড়নের লোক ম্যাককুলাক। তাকে বুকের নিচে নিয়ে মেঝেতে পড়ল ডেইটার। থাবা মেরে লোকটার হাত থেকে কেড়ে নিল বেরেটা। বামহাতে কঠিন দুটো ঘুষি মারল বিজ্ঞানীর গালে। ভেঙে গেছে লোকটার পুরু কাঁচের চশমা। ফাটা নাক ও ঠোঁট থেকে দরদর করে বেরোচ্ছে রক্ত। আরেকবার তার মুখে ঘুসি মারল ডেইটার। তারপর দুই হাতে চেপে ধরল লোকটার সরু গলা। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পর নেতিয়ে পড়ল ম্যাককুলাক। পরের দুই মিনিটে পৃথিবী ছাড়ল সে।
ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে ডেইটার। পিস্তল কুড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ভেঙেচুরে সর্বনাশ হয়েছে রিমোটের। ওই জিনিস ছিল মাত্র দুটো। এখন ফ্যাসিলিটি থেকে বেরোতে হলে জোগাড় করতে দ্বিতীয়টা। সেটা আছে সিলভিয়া রথচাইল্ড আর তার সঙ্গীর কাছে।
তাতে হাল ছাড়লে চলবে না। কোনও বাধা বা ক্ষতি মানবে না ডেইটার। পৃথিবীর বুকে কেউ নেই যে ঠেকাতে পারবে তাকে। ভবিষ্যতে স্বর্ণের অক্ষরে লেখা থাকবে তার নাম।
আবারও গলফ্ কার্টে উঠে ইউ টার্ন নিল ডেইটার। সোজা ফিরছে ফ্যাসিলিটির ভেতর। দূর থেকে শুনল একরাশ গুলির আওয়াজ। সেদিকেই চলেছে সে।
.
সাবমেশিন গানের গুলির তোড়ে অস্ত্রের র্যাকের পেছনে আশ্রয় নিয়েছে মাসুদ রানা। চারপাশে লেগে রঙিন ফুলকি ছিটকে দিচ্ছে গুলি। আগেও বহুবার মহাবিপদে পড়েও গোলাগুলির সময় মাথা ঠাণ্ডা রেখেছে রানা। এখনও তাই করছে। এক এক করে গুনছে মুহূর্ত। এরা যতই কোণঠাসা করুক, যে-কোনও সময়ে খালি হবে তাদের অস্ত্রের ম্যাগাযিন। রানার জানা আছে, এমপিফাইভের এক শ’ রাউণ্ডের ম্যাগাযিন খালি হতে সময় লাগে মাত্র ছয় দশমিক ছিষট্টি সেকেণ্ড।
সময়টা গুনছে রানা। আরও কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করল, তারপর শরীর গড়িয়ে বেরিয়ে এসে পাল্টা গুলি পাঠাল লোক দু’জনের দিকে। মেঝে চিবিয়ে বুলেট আসতে দেখে আর্মারির মাঝের একটা র্যাকের ওদিকে লুকিয়ে পড়ল তারা।
‘বেলা, তোমার কী হাল?’ জানতে চাইল রানা।
গুলির ক্রেটের পেছনে আছে বেলা। দেখা গেল না তাকে। অবশ্য দুই সেকেণ্ড পর একটা ক্রেটের ওদিক থেকে বেরোল একটা হাত। বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় আছে শত্রুরা। রানা বুঝল কী বোঝাতে চেয়েছে বেলা। র্যাকগুলোর মাঝের সরু বাঁকা পথে এগোবে মেয়েটা। প্রথম সুযোগে হামলা করবে একপাশ থেকে। ওটা ভাল বুদ্ধি বলেই মনে হলো ওর।
তবে তার আগে গোলাগুলি করে সরাতে হবে লোক দু’জনের মনোযোগ। প্রায় ফুরিয়ে আসা সাবমেশিন গান মেঝেতে ফেলে কাঁধ থেকে ফ্যামাস রাইফেল নিল রানা। সাবমেশিন গানের নাইন এমএম গুলি স্বল্প ক্ষমতার, তবে রাইফেলের হাই-ভেলোসিটি বুলেট ভেদ করবে শক্ত জিনিস। যে র্যাকের পেছনে আছে লোকদু’জন, সেদিকে গুলি পাঠাল রানা। একেকবারে গুলি করছে একটা করে। ব্যস্ত থাকুক তারা। ওদিকে আরেকদিক থেকে হামলা করবে বেলা। র্যাকে লেগে নানাদিকে ছিটকে উঠছে কাঠ ও লোহার আবর্জনা। বিস্ফোরিত হলো দেয়ালের কাছের কয়েকটা গুলির ক্রেট। রাইফেলের বিকট গর্জনে বদ্ধ জায়গায় ফাটতে চাইছে শ্রবণ ইন্দ্রিয়। পাঁচটা গুলির পর ঝনঝন করতে লাগল রানার কান। দশটার পর মনে হলো কালা হয়ে গেছে ও। ওদিক থেকে গুলি শুনে বুঝল, নতুন করে অস্ত্র রিলোড করেছে শত্রুপক্ষ। ডানের র্যাকের নিচ দিকে একটা ক্রেটের আড়ালে এক লোককে সরতে দেখল রানা। দেরি না করে ক্রেটের দিকে গুলি পাঠাল ও। ফ্যামাস রাইফেলের ন্যাটো ৫.৫৬ রাউণ্ড অনায়াসে ভেদ করল ক্রেট। ফেটে গেল কার্ডবোর্ডের বাক্স। চারপাশে ঝলসে উঠল নীলচে আগুন। ফ্যামাস রাইফেলের গুলির চেয়েও জোরালো শোনাল বিস্ফোরণের আওয়াজ। নানাদিকে ছিটকে গেল বাঁকাচোরা ধাতব টুকরো। করুণ এক আর্তনাদ শুনেছে রানা। মাঝের র্যাকের পেছনে বাক্সের ওদিকে ছিল লোকটা। টলমল করে বেরিয়ে এল খোলা জায়গায়। আগুন ধরে গেছে বামহাত ও মাথার ডানদিকে। রক্তে ভাসছে মুখ। দেরি না করে রাইফেল ঘুরিয়ে বিনা দ্বিধায় লোকটার বুকে গুলি করল রানা। একই সময়ে ঘরের বামদিক থেকে এল বেলার ফ্যামাস রাইফেলের গর্জন। র্যাকের পেছন থেকে বেরিয়ে একপাক ঘুরে সঙ্গীর পাশে পড়ল দ্বিতীয় লোকটা।
নানান র্যাকে ধরে গেছে আগুন। দেয়ালের ব্র্যাকেটে এক্সটিংগুইশার দেখে শিখার ওপর সাদা তরল স্প্রে করল রানা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিভল লকলকে আগুন। চারপাশে ছড়িয়ে গেল ধোঁয়া। যে বাক্স ফুটো হয়েছে, ওটা দেখল রানা। পোড়া কার্ডবোর্ডে লেখা: ক্যামপিং গ্যায।
‘ভেতরে ছিল হ্যাযার্ডায় মেটারিয়াল,’ মন্তব্য করল বেলা।
যে লোককে গুলি করেছে ও, তাকে দেখল রানা। ‘এটাও কি আত্মরক্ষার জন্যে?’
‘অস্ত্র তাক করেছিল তোমার দিকে।’
‘সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ।’
‘এরা ডেইটার গিসেলের পুরনো স্যাঙাত,’ বলল বেলা।
এখন পর্যন্ত মারা গেছে দশজন,’ বলল রানা।
মাথা দোলাল বেলা। ‘দলের অন্যরা বোধহয় ফ্যাসি-
লিটিতে পৌঁছায়নি। খুব বেশি লোক নেই এখানে।’
‘তবুও থাকে কেউ না কেউ,’ রানা ও বেলার পেছন থেকে বলল একজন। ‘মস্ত বড় ভুল করেছ এখানে এসে।
সাতান্ন
চরকির মত ঘুরল রানা ও বেলা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ডেইটার গিসেল। রানা বা বেলার অস্ত্রের নল নিচের দিকে তাক করা। ওই লোকের বামহাতে ধাতব ক্যানিস্টার। ওটাকে মোটা অ্যারোসল স্প্রে ক্যান বলে মনে হলো ওদের। ডানহাতে পিস্তল।
‘কুত্তীর বাচ্চি, তোকে আমি চিনি,’ বলল ডেইটার।
‘তুমি ভুল জানো, ডেইটার,’ বলল বেলা। ‘বাঁচতে চাইলে হাত থেকে অস্ত্র ফেলো।’
টিটকারির হাসি নিয়ে বেলাকে দেখল ডেইটার। কয়েক ডিগ্রি ঘুরিয়ে পিস্তলের নল তাক করল রানার দিকে। ‘তুমি আসলে কে?’
‘এমন একজন, যাকে বিরক্ত করা উচিত হয়নি তোমার,’ বলল রানা। ‘খুন করেছ সন্ন্যাসীদের সবাইকে। আর এই কারণে মরবে তুমি। বাঁচবে না তোমার দলের কেউ।’
‘ভাবছ আমাকে মেরে ফেলবে?’ হাসল ডেইটার।
‘ট্রিগার টিপলে তুমি নিজেও প্রাণে বাঁচবে না,’ বলল রানা। ‘ভাবছ এটা ঠেকাতে পারবে?’ ক্যানিস্টার উঁচু করে রানাকে দেখাল গিসেল, মুখে হাসি। হালকা হাতে ধরেছে জিনিসটা। মেঝের দিকে হাই-প্রেশার নযল। ‘এটা ফাটলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া।’
‘ফলে বড়জোর মরব আমরা তিনজন,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে মরবে না কোটি কোটি মানুষ।’
মাথা নাড়ল গিসেল। প্রসারিত হলো হাসি। ‘ভুল। মরবে মাত্র দু’জন। তোমাদের দেহে অ্যান্টিটক্সিন নেই।’
‘ব্যাকটেরিয়ার ওপর এত বিশ্বাস?’ বলল রানা। ‘তুমি নিজে তো মরবে গুলির আঘাতে।’
নড়ল না ডেইটার। সামান্য ফিকে হলো হাসি।
‘তোমাকে আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে না,’ বলল রানা, ‘প্যান্ট তো নষ্ট করেছ, বুঝেও গেছ, এবার মরবে। ক্যানিস্টার ফেললেও ঝাঁঝরা করে দেব। আসলে তোমার রেহাই নেই।’
কথা বলতে বলতে রাইফেলের পিস্তল গ্রিপের দিকে আঙুল সরাচ্ছে রানা। দ্বিধায় পড়েছে ডেইটার। খেয়াল নেই রানার আঙুল কোথায় চলেছে।
রানা ভাবছে, লোকটাকে গুলি করেই লাফ দিয়ে এগিয়ে ঠেকাবে ক্যানিস্টারের পতন।
হঠাৎ মুখ বিকৃত করল গিসেল। মনে মনে নিয়েছে চরম সিদ্ধান্ত। একই সময়ে রাইফেলের নল তুলে ট্রিগার টিপল রানা।
বুম!
সুড়ঙ্গ ও আমারি ভরে গেল বিকট শব্দে। তবে ওই গুলি রানার রাইফেল বা ডেইটারের পিস্তলের নয়। বেলাও ব্যবহার করেনি অস্ত্র। পেছনে প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে প্রায় উড়ে কয়েক ফুট এগোল রানা। হাত থেকে পড়ে গেছে রাইফেল। মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে দেখল উজ্জ্বল সাদা আলো। সব যেন স্লো মোশন ছায়াছবি। চেঁচাল বেলা। কর্কশ হাসল ডেইটার। অচেনা এক নারী কণ্ঠস্বর শুনল রানা।
গর্জে উঠল একটা পিস্তল।
নতুন কোনও ব্যথা পেল না রানা। আগেই বুঝেছে, গুরুতরভাবে আহত হয়েছে ও। চিত হয়ে দেখল ওর কাছে এসে থেমেছে কালো পোশাক পরা এক মহিলা। হাতে কমব্যাট শটগান। পেরেকের মত খোঁচা খোঁচা মেয়েটার সোনালি চুল। লিপস্টিকের কারণে রক্তের মত লাল দুই ঠোঁট। ধূসর চোখে প্রবল ঘৃণা।
এ-ই ডেইটার গিসেলের প্রেমিকা ডেইযি বাট্স্।
গিসেলের গুলিতে আহত হয়ে মেঝেতে পড়েছে বেলা। বুক বেয়ে দরদর করে পড়ছে তাজা রক্ত। ওর দিকে এগোতে চাইল রানা। তখনই টের পেল, কমব্যাট বন্দুকের গুলিতে ভেঙেছে ওর বাম কাঁধ ও বাহুর হাড়। চারপাশের মেঝেতে জমছে রক্তের অগভীর পুকুর।
কাছ থেকে আরেক গুলিতে রানাকে শেষ করতে কাঁধে বন্দুকের বাঁট তুলল ডেইযি বাস্। উড়িয়ে দেবে রানার মাথা। বাঁটে গাল ঠেকাল মেয়েটা। পিস্তল গ্রিপ ধরা আঙুল থেকে সরে গেল রক্ত। ট্রিগারে চেপে বসছে তর্জনী।
কিন্তু হঠাৎ কড়াৎ শব্দে গর্জে উঠল একটা রাইফেল। গলগল করে ডেইযির মুখ থেকে বেরোল রক্তের স্রোত। ডান কাঁধে ভর করে দ্বিতীয়বার গুলি করল বেলা। ছিন্নভিন্ন হলো সোনালি চুলের মেয়েটার কণ্ঠনালী। ধুপ করে মেঝেতে পড়ল সে।
একই সময়ে ডেইটার গিসেলকে দেখল রানা। প্রেমিকার করুণ পরিণতি দেখে খেপে গেছে সে। পিস্তল তুলল বেলাকে গুলি করতে। মাযল থেকে ছিটকে বেরোল কমলা আগুন। বুলেটের খোসা ছিটকে যেতেই কড়াৎ শব্দে ঠিক জায়গায় ফিরল পিস্তলের স্লাইড। গুলির কারণে ওপরে উঠেছে মাযল। আবারও গুলি লেগেছে বেলার বুকে। রক্তের ছিটা লেগে ভিজে গেছে মুখ। হাত থেকে পড়ে গেছে রাইফেল। একবার গুঙিয়ে উঠে হাঁচড়েপাঁচড়ে বেলার দিকে এগোতে চাইল রানা। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথায় হারিয়ে গেল ওর চেতনা।
.
ডেইটার গিসেল বুঝেছে, মারা পড়ছে তার প্রেমিকা। ছেঁড়া কণ্ঠনালী থেকে বেরোচ্ছে রক্ত ও ফ্যাকাসে লালচে সব ফেনা। কোটরের ভেতর উল্টে গেছে দুই চোখের মণি। কী যেন বলতে চাইলেও ডেইযির মুখ থেকে বেরোল একরাশ বুদ্বুদ।
প্রেমিকার দিকে ঝুঁকে গেল গিসেল। পিস্তলের নল ঠেকাল তার মাথার পাশে। টিপে দিল ট্রিগার। বিদায়, ডেইযি!
সোজা হয়ে সিলভিয়া ও তার সঙ্গীর রক্তাক্ত দেহ দেখল ডেইটার। ওই লোকের নাম জানে না সে। মারা গেছে বদমাশটা। এবার এক এক করে বড় সব শহরে প্লেগের ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে দেবে সে। আগামী কয়েক দিনের ভেতর মরবে কোটি কোটি মানুষ।
রানার পকেট সার্চ করে রক্তাক্ত রিমোটটা পেল ডেইটার। প্যান্টে মুছে নিল ওটা। ঘুরে বেরিয়ে এল করিডোরে। গল্ফ কার্ট নিয়ে আবারও ফিরতে হবে হ্যাঙারে।
এখানে শেষ তার সব কাজ। কেউ ঠেকাতে পারবে না তাকে। দরকার হলে পৃথিবীর বুকে সে হবে একমাত্র পুরুষ।
না, শেষ হয়নি তার কাজ। শুরু হয়েছে মাত্র।
.
খুলে গেল রানার ডান চোখ। দূর থেকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে যেন আসছে লণ্ঠনের মত টিমটিমে আলো। ধীরে ধীরে পিছু হটছে অন্ধকার। ওর মনে পড়ল কোথায় আছে। উঠে বসতে গিয়ে ককিয়ে উঠল ব্যথায়।
কিন্তু এখন ব্যথা নিয়ে ভাবার সময় নয়। হাঁটুর ওপর ভর করে উঠে বসল রানা। হাঁটু ছেঁচড়ে গিয়ে থামল বেলার পাশে। আহত ও মৃতদের রক্তে ভেসে গেছে মেঝে। সোনালি চুলের মহিলার মাথার পাশে বিশাল এক গর্ত।
রক্তে ভেজা বেলার ফ্যাকাসে মুখে হাত বোলাল রানা। ঘাড়ে আঙুল রেখে টের পেল, এখনও দুর্বলভাবে চলছে হৃৎপিণ্ড। বেশিক্ষণ হয়তো বাঁচবে না বেচারি।
নিজেও রানা প্রতি মুহূর্তে আরও দুর্বল হচ্ছে। ভীষণ শীত লাগছে। ঝাপসা হয়ে গেছে দৃষ্টি।
আর্মারি থেকে বেরিয়ে গেছে ডেইটার গিসেল।
প্লেগের ব্যাকটেরিয়া নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে লোকটা।
হ্যাঙারে পাবে হেলিকপ্টার।
চোখ পিটপিট করল রানা। উঠে দাঁড়াতেই টলমল করে উঠল দুই পা। কয়েক কদম যেতেই পিছলে গেল রক্তে ভেজা মেঝেতে। বাম কাঁধ ও বাহুতে গুরুতর জখম। হাত ঝুলছে ছেঁড়া লতার মত। ব্যথায় মনে হচ্ছে জ্ঞান না থাকলেই ভাল ছিল। ডানহাতে ধরে বামহাতটা বেল্টের ভেতর গুঁজল রানা। তিক্ত হেসে বিড়বিড় করল, ‘তুই না এর চেয়েও বেশি ব্যথা সহ্য করতে পারিস?’
একটু পর আবারও হারাবে চেতনা। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেবার হয়তো আর জ্ঞান ফিরবে না ওর। তাতে কিছুই যাবে আসবে না। এখন নিজেকে নিয়ে ভাবছে না রানা। বুঝে গেছে, শেষ হয়নি ওর কাজ!
কাছের র্যাকের সামনে গেল রানা। ওখান থেকে তুলে নিল ভারী অস্ত্রটা। একহাতে চালানো প্রায় অসম্ভব। রক্তে ভেজা হাতে ওটা চেপে ধরে গিসেলের পিছু নিল রানা।
আটান্ন
হ্যাঙারের শাটার খুলে যেতেই ভেতরে ঢুকেছে তাজা, মিষ্টি হাওয়া। বুক ভরে বাতাস নিয়ে মনটা ভাল হয়ে গেল ডেইটার গিসেলের। চারপাশের জঙ্গলে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা। কালচে নীল আকাশে চাঁদ। ফুটছে একটা-দুটো তারা। কী সুন্দর এই পৃথিবী। খুশিতে খলখল করে হাসল ডেইটার। আবারও ফিরল হেলিকপ্টারের পাশে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করল টারবাইন। আণ্ডারক্যারিজের গিয়ার চালু করল গিসেল। ধীর গতি তুলে শাটার পেরিয়ে চলে এল হ্যাঙারের বাইরে। ঘুরতে শুরু করেছে রোটর। প্রথমে বেগ থাকল খুব মন্থর। তারপর দ্রুত বাড়তে লাগল গতি। একটু পর এখান থেকে চলে যাচ্ছে ডেইটার। পরে হাজার হাজার বছর ধরে ইতিহাসের পাতায় থাকবে সে।
কন্ট্রোলের দিক থেকে ঘুরে ক্রেট দেখল ডেইটার। ওটার ভেতর ঠিকভাবে রাখা হয়েছে বারোটা ক্যানিস্টার। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। আবারও কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল ডেইটার। ভাবছে, যাচ্ছি পৃথিবী জয় করতে। দারুণ লাগছে মনটা।
প্রায় সম্পূর্ণ গতি পেয়েছে রোটর।
আরও ভাল লাগবে ভেবে পকেট থেকে কোকেনের ছোট্ট বোতল বের করল ডেইটার। ড্যাশবোর্ডের ওপর রাখল সামান্য কোকেন। আঙুল দিয়ে আঁকাবাঁকা রেখায় সাজিয়ে নিল ওগুলো। মুখ নিচু করে নাক দিয়ে ড্যাশবোর্ড থেকে টেনে নিল সাদা গুঁড়ো। আহ্, কী আনন্দ! বোধহয় আগে কখনও এত ফূর্তি আসেনি জীবনে!
কয়েক সেকেণ্ড পর চোখ মেলল সে।
হেলিকপ্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। রক্তাক্ত দেহে টলছে।
‘আবারও তুমি,’ বিড়বিড় করল ডেইটার গিসেল।
.
এক্স-সোভিয়েত রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড লঞ্চার অতিরিক্ত ভারী লাগছে রানার কাছে। ডান কাঁধে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। যে-কোনও সময়ে ওর শরীরের ভর নিতে পারবে না দুর্বল দুই পা। হেলিকপ্টারের রোটরের তুমুল হাওয়ায় মনে হচ্ছে, ঝড়ের ভেতর বাঁশ পাতার মত কাঁপছে ও পাহাড়ের চূড়ায়। চোখ পিটপিট করে বুঝতে চাইছে সব ঠিক দেখছে কি না। ডান কাঁধে লঞ্চার সরাসরি তাক করেছে চপারের ককপিট লক্ষ্য করে। ফ্লিপ-আপ সাইট দেখতে পাবে না ঝাপসা চোখে। এই রেঞ্জে লাগবেও না ওটা। চোখের কোণে দেখছে আবছা অন্ধকার।
হেলিকপ্টার থেকে সিমেন্টের চাতালে নামল ডেইটার গিসেল। বিস্মিত চোখে দেখছে রানাকে। ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসি। নাক ও ওপরের ঠোঁটে কিছু সাদা গুঁড়ো।
‘কোথাও যেতে পারবে না, ডেইটার, ‘ রোটরের আওয়াজের ওপর দিয়ে চেঁচাতে গিয়ে আরও দুর্বল বোধ করল রানা।
‘তুমি একটা গাধা!’ পাল্টা চিৎকার করল ডেইটার। পতপত করে উড়ছে তার শার্ট ও চুল। ‘রকেট মারলে চুরমার হবে ক্যানিস্টার। চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে ব্যাকটেরিয়া।’
ভীষণ কাঁপছে রানা। কী ঠাণ্ডা! রক্তে ভেজা শরীর যেন হিমবাহ। বুঝে গেল, ঠিকই বলেছে ডেইটার। কাছ থেকে আরপিজি ব্যবহার করলেও আগুনে পুড়বে না সব ব্যাকটেরিয়া। সন্ধ্যার হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়বে নানাদিকে 1 খামার, গ্রাম, শহর, অন্য দেশ…
‘ঠিকই বলেছ,’ অস্ফুট স্বরে বলল রানা। ‘ব্যবহার করা যাবে না আরপিজি।’
হাত সরিয়ে নিতেই কাঁধ থেকে খসে পড়ল রকেট লঞ্চার, মেঝেতে পড়ে ভোঁতা একটা আওয়াজ তুলল।
আবারও হাসল ডেইটার গিসেল।
রানার মনে হলো যে-কোনও সময়ে ভারসাম্য হারিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে যাবে ও। চারপাশ থেকে চেপে ধরছে অন্ধকার। সিধে থাকতে গিয়ে টলছে রানা। অনেক বেড়ে গেছে ব্যথার তীব্রতা। আগে কখনও এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি।
‘তা হলে অন্য কিছু লাগবে,’ ফিসফিস করে নিজেকে শোনাল রানা।
অন্যরকম হয়েছে গিসেলের চেহারার অভিব্যক্তি। এক পা পিছিয়ে গেল সে। তারপর আরেক পা। ফিরে যাচ্ছে হেলিকপ্টারের দিকে।
রানার মনে হলো স্বপ্নের ভেতর ওর ডানহাত চেপে ধরল কোমরের পেছনে পরিচিত জিনিসটা। ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল। হোলস্টার থেকে পিছলে বেরিয়ে এল ওটা। আবছা চোখে দেখল সামনে তাক হলো অস্ত্রটা।
গুলির আওয়াজটা প্রায় চাপা পড়ল রোটরের গর্জনের নিচে। সত্যিই গুলি হয়েছে কি না, শুনতে পায়নি রানা। তবে টের পেল হাতের তালুতে ঝাঁকি। হেলিকপ্টারের গায়ে ছিটকে লেগেছে ডেইটার গিসেলের মগজের একাংশ। হাঁটু ভেঙে মেঝেতে পড়ে গেল লোকটা। দুই চোখ আকাশের দিকে। গলগল করে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে রক্ত।
বিশাল এক টিলা থেকে যেন পড়ছে রানা। এক সেকেণ্ড পর হারিয়ে গেল অন্ধকারের ভেতর!
ঊনষাট
‘চলুন, রানা,’ মিষ্টি হাসল তরুণ সাধু জন পিয়েরে। ‘ওদিকে অনেক আলো।’
মালভূমির ওপর দিয়ে ছেলেটার পিছু নিল রানা। চারদিকে সবুজ ঘাস ও সূর্যমুখী ফুলের বাগান। ঝিরঝিরে বাতাসে দুলছে গাছপালা। চারপাশে কীসের এক সুবাস। দূরে বিশাল পাহাড়। নীল আকাশে নেই একফোঁটা মেঘ। জন পিয়েরের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে হাঁটার গতি বাড়াল রানা। ‘দাঁড়াও, জন!’
হঠাৎ দুলন্ত ফুলের ভেতর দেখল সামনে থেকে হেঁটে আসছে একদল সাধু। কাছে এসে রানার হাত ধরলেন প্রধান সাধু। নরম সুরে বললেন, ‘নিজ বাড়িতে ফেরো। আমরা খুব খুশি হব।’
‘এটাই কি স্বৰ্গ?’ জানতে চাইল রানা।
মৃদু হেসে সাধু হাত বোলালেন রানার কাঁধে। ওকে ঘিরে ধরেছেন বয়স্ক সাধুরা। তারপর হঠাৎ করেই বাতাসে মিলিয়ে গেলেন সবাই।
‘কোথায় গেল?’ বুকে খুব কষ্ট নিয়ে বলল রানা।
খুব চেনা কেউ বলল, ‘এই তো আমি এখানে।’ উষ্ণ হাতে ধরল রানার হাতের আঙুলগুলো।
কয়েকবার পিটপিট করে চোখ মেলল রানা। ‘বেলা?’
‘হ্যাঁ,’ মেয়েটার চোখে জল। ওটা যেন ফুলের বুকে ভোরের এক ফোঁটা শিশির কণা।
আবারও ঘুমিয়ে পড়ল রানা।
.
আরও পাঁচ দিন পর ভোরে হাসপাতালের বেডে সোজা হয়ে বসল দুর্ধর্ষ বিসিআই এজেন্ট। পাশের বেড়ে ঘুমিয়ে আছে বেলা। ঘরে ফুলদানীতে নানাধরনের ফুল। নিজের বালিশের পাশে চোখ পড়তেই নীল এক এনভেলপ দেখল রানা। ওটা নিয়ে ভেতর থেকে বের করল চিঠি। কাগজে চোখ বোলাতেই মৃদু হাসি ফুটল ওর মুখে।
বিসিআই চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটার সোহেল লিখেছে: প্রিয় ছোট্ট শালা,
গত পরশু দিন ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স চিফ মার্ভিন লংফেলো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেতেই তাঁর নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়েছে ফ্রান্স ও ইতালিতে কয়েকজন ব্রিটিশ এজেন্টকে। তাদের বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির অভিযোগ। এরাই হামলা করেছিল তোর ওপর। আশা করা যায় অন্তত বিশ বছর থাকবে জেলে।
কাজেই, শালা, এবার সুস্থ হয়ে সোজা দেশে ফিরে দুইবার চাইনি খাওয়াবি আমাদেরকে।
তোর বড় দুলাভাই,
সোহেল আহমেদ
রানা আন্দাজ করেছিল, অসুস্থ ওকে পাহারা দিতে বিসিআই থেকে কাউকে না কাউকে পাঠাবেন চিফ, মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। তবে রানার জানা নেই, গত বারো দিন ওর ঘরের বাইরের করিডোরে একেকবারে বারো ঘণ্টা করে দুই শিফটে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিয়েছে দু’জন বিসিআই এজেণ্ট।
হলদে জোব্বা পরা সোহেল ছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সলীল ছিল সাদা আলখেল্লা পরা হিন্দু সাধু। আজকে থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে ওদেরকে। এবার ছুটিতে যাবে ওরা।
নার্স ও ডাক্তাররা ছিল ওদের ওপর মহাবিরক্ত। কারণ পেছন পেছন গিয়ে রোগীর ঘরে উঁকি দিত ওরা। অথচ, কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেও কোনও লাভ হয়নি। এটা ঘটেছে বিসিআই থেকে ইন্টারপোলকে অনুরোধ করায়।
বেলার দিকে তাকাল রানা। এইমাত্র জেগেছে মেয়েটা। উঠে বসে দেখল রানাকে। নিচু গলায় বলল, ‘আমি তো ভেবেছি তোমাকে বুঝি হারিয়েই ফেলেছি।’
‘তুমিও তো ভয়ঙ্করভাবে আহত ছিলে,’ বলল রানা।
মাথা নাড়ল বেলা। ‘আমার জখম অতটা সিরিয়াস ছিল না। হাতের তাক খুব খারাপ গিসেলের। মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে গুলি। কিন্তু তোমারগুলো ছিল মারাত্মক।’
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল ওরা।
একটু পর আবারও ঘুমিয়ে পড়ল রানা।
আবার যখন ঘুম থেকে উঠল, বেলার কাছে শুনল, আরেকটু হলে বন্দুকের গুলি ভেদ করত ওর হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস। এ ছাড়া, ভেঙেছে বাম কাঁধ ও বাহুর হাড়। কপাল ভাল, ডেইযির বন্দুকে ছিল পাখি মারার সাত নম্বর ছররা। তবে সমস্যা করেছে রক্তশূন্যতা।
কয়েক দিন আগেও পাশের রুমে ছিল বেলা। তবে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ঠাঁই করে নিয়েছে রানার রুমে। বেলার নাম দিয়েছে নার্সরা, ‘কড়া পাহারাদারণী।’
‘আমরা এখানে এলাম কী করে?’ জানতে চাইল রানা। ‘সেজন্যে ধন্যবাদ দেব কমিশনার মার্লোকে,’ বলল বেলা। ‘বারবার বলেছিলেন যেন যোগাযোগ রাখি। কিন্তু তুমি তো মানা করে দিলে। তখন গোপনে তোমার বুটের একটা স্লটে রেখে দেন জিপিএস চিপ্স্। আমার বুটেও একই জিনিস ছিল।’
‘জানতাম কোথায় আছে জিনিসটা,’ বলল রানা।
‘একবার সার্চ করেই পেয়েছি। তবে রেখে দিয়েছি আগের জায়গায়।’
‘তুমি ডেইটার গিসেলকে শেষ করার মাত্র কয়েক মিনিটের ভেতর ওখানে পৌঁছে যায় পুলিশ হেলিকপ্টার,’ বলল বেলা। ‘স্পেশাল একটা টিম সরিয়ে ফেলেছে প্লেগের ক্যানিস্টার। সিল করে দেয়া হয়েছে গোটা ফ্যাসিলিটি।’
‘অ্যাল মার্লো সত্যিই বুদ্ধিমান,’ হাসল রানা। বুকে খিঁচ ধরতেই শুরু হলো ব্যথাদায়ক কাশি।
রানা স্বাভাবিক হওয়ার পর বলল বেলা, ‘নিজেই তাঁকে সব খুলে বলতে পারবে। তাঁর কাছে শুনেছি, ফ্রান্সের সরকার ও সাধারণ মানুষের তরফ থেকে তোমাকে পুরস্কার দিতে চান প্রেসিডেন্ট।’
‘তারপর প্রথম সুযোগেই আমাকে পুরে দেবে জেলে, বলল রানা।
মাথা নাড়ল বেলা। ‘মনে হয় না।’ নেমে এল নিজের বেড থেকে। বসল রানার পাশে। ঝুঁকে গেল। ওর ঠোঁট স্পর্শ করল রানার ঠোঁট।
রানা মাত্র সাড়া দেবে ভেবেছে, এমন সময় হনহন করে এসে ঘরে ঢুকল ইয়ামোটা, বদমেজাজী মহিলা এক নার্স।
খুকখুক করে কেশে উঠে সরে বসল রানা ও বেলা।