পঞ্চাশ
পরিত্যক্ত কটেজ থেকে বেরিয়ে ফিরতি পথ ধরেছে রানা ও বেলা। খুব চুপচাপ হয়ে গেছে বেলা। কিছুক্ষণ পর হামারের ইঞ্জিনের শব্দের ওপর দিয়ে বলল, ‘ভয়ঙ্কর নির্যাতন করেছ।’
মাথা দোলাল রানা। ‘তা ঠিক।’ মাটির পথ ছেড়ে উঠে গেল পাকা রাস্তায়। চলেছে ছোট্ট শহরের দিকে।
পুরো একমিনিট দূরে চেয়ে রইল বেলা। কী যেন ভাবছে। একটু পর চোখে প্রশ্ন নিয়ে দেখল রানাকে। ‘আর কোনও উপায় ছিল না, তাই না?’
‘না, ছিল না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।
‘আমরা আসলে খুব খারাপ মানুষ, তাই না, রানা?’
‘হয়তো,’ বলল রানা, ‘তবে কোটি কোটি অসহায়, নিরীহ মানুষকে বাঁচাতে চাওয়ার ভেতর লজ্জার কিছু দেখি না।’
‘তা ঠিক,’ বিড়বিড় করল বেলা। ‘বুঝতে পেরেছি, ঠিকই করেছ।’
ছোট্ট শহরে পৌঁছে গির্জা পাশ কাটাল ওরা। স্কয়্যারের একপাশে ফ্ল্যাগপোল। দিক নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতালের সরু পথে এগোল রানা। দু’পাশে সারি সারি গাছ। একটু দূরেই সাদা কটেজের মত হাসপাতাল। সামনে ও দু’দিকে সবুজ ঘাসের লন। ছেঁটে রাখা হয়েছে হেজ ঝোপের বেড়া। পার্কিং লটে হামার রেখে নেমে পড়ল রানা। ‘একমিনিট পর ফিরছি।’
গাড়ির পেছন দরজা খুলে অচেতন অন্যাথের শিথিল দেহ কাঁধে তুলে নিল ও। কয়েক গজ গিয়ে তাকে নামিয়ে দিল ঘাসের ভেতর। একটু দূরেই হাসপাতালের সদর দরজা।
গাড়িতে ফিরল রানা। অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে দিতেই গর্জে উঠে ছুটল হামার। রিয়ার ভিউ মিররে ওরা দেখল, এইমাত্র হাসপাতালের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে দুই মেল নার্স। ভিকি অন্যাথকে বাগানে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গেল তারা। অজ্ঞান রোগীর কপালে মার্কার পেন দিয়ে লেখা : বিপজ্জনক! জেল পলাতক আসামী!
অন্যাথকে ভয় পাবে না দুই মেল নার্স। ভাঙা দু’হাত নিয়ে কোথাও পালাতে পারবে না গিসেলের অনুচর। শহর থেকে বেরোবার সময় কমিশনার মার্লোকে কল করে রানা জানিয়ে দিল, পলাতক ভিকি অন্যাথকে কোথায় পাবে সুইস পুলিশ।
কোথায় চলেছে, কমিশনারকে কিছুই বলেনি রানা। স্কয়্যারে পৌঁছে হাইওয়ের দিকে রওনা হয়ে নিচু গলায় বলল, ‘এবার গিসেলের সঙ্গে ব্যক্তিগত বোঝাপড়া আছে আমার।’
.
বহু কিলোমিটার দূরে সুইস গ্রামাঞ্চলে পাতাল ফ্যাসিলিটিতে সাদা টাইল করা করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে ডেইটার গিসেল। বামের দরজা খুলে ঢুকল ল্যাবোরেটরিতে। জেনারেটর চব্বিশ ঘণ্টা শক্তি জুগিয়ে চলেছে নিয়ন বাতিগুলোকে। ল্যাবোরেটরির এদিকটা আউটার চেম্বার। পরতে হবে না হ্যাযম্যাট সুট। পুরু কাঁচের ওদিকে ম্যাক্সিমাম- কণ্টেইনমেণ্ট ইনার চেম্বারে ঢুকতে হলে ব্যবহার করতে হবে এয়ারলক। ফ্যাসিলিটির ভেতর দিন-রাতের হিসাব থাকে না বলে দেয়ালে বড় একটা ঘড়ি। এ ছাড়া আসবাবপত্র বলতে আর কিছুই নেই।
কাঁচের ওদিকে বিএসএল-৪ পযিটিভ প্রেশার প্রটেকটিভ সুট পরে নিজ কাজে ব্যস্ত বিজ্ঞানী বুনযি ম্যাককুলাক। আগে স্টকহোমে চাকরি করত ইউরোপিয়ান সেন্টারে ডিযিয কন্ট্রোল ল্যাবোরেটরিতে। কয়েক বছর হলো যোগ দিয়েছে পারাটি দলে। এ মুহূর্তে সুটের ভেতর অক্সিজেন পাচ্ছে প্লাস্টিকের হোসের মাধ্যমে। সাপের মত জিনিসটা বেশ দীর্ঘ। ঘরের যে- কোনও দিকে হেঁটে বেড়াতে পারবে ম্যাককুলাক। পিপিপিএস সুটের ভাইসরের পেছনে আছে মাইক, ওটার কারণে কথা বলতে পারবে যে-কারও সঙ্গে। কাঁচের দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে কী যেন পরীক্ষা করছে সে। সামনে এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত স্টেইনলেস স্টিলের লম্বা বেঞ্চ। ওটার ওপর রাখা নানান ইকুইপমেন্ট। লাখ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে ওগুলোর জন্যে। তবে বেশিরভাগ যন্ত্র চেনে না ডেইটার গিসেল। যেগুলো চেনে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইনকিউবেটর, ভ্যাকসিন বাথ, বিশাল ভ্যাকিউম পাম্প, সেন্ট্রিফিউজ, কমপিউটারের সঙ্গে যুক্ত এক মাইক্রোস্কোপ, র্যাক ভরা জার, পেট্রি বিন ও নানান যন্ত্রপাতি। ডেইটারের আগ্রহ নেই ওগুলোর প্রতি। তার চাই সঠিক ফলাফল বা সফলতা। আর সেটা পাচ্ছে না বলেই রেগে আছে সে। পেরিয়ে গেছে কয়েকটা দিন, এখনও ভাল রেয়াল্ট দেখাতে পারেনি বুনযি ম্যাককুলাক।
কাঁচে টোকা দিল ডেইটার গিসেল। ফোঁস ফোঁস আওয়াজে চলছে অক্সিজেন, তাই শুনতে পায়নি বিজ্ঞানী। আরও জোরে টোকা মারল গিসেল। এবার চমকে গেছে চাঁদের অভিযাত্রীদের মত পোশাক পরা বিজ্ঞানী। ঝট্ করে ঘুরে তাকাল। যেন হেডলাইটের আলোয় চমকে যাওয়া খরগোশ।
‘আপনি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন, আউটার চেম্বারের স্পিকারের জন্যে যান্ত্রিক শোনাল তার কণ্ঠ। ভাইসরের পেছনে ঝাপসা চশমার কাঁচ। ভেবেছিল আপাতত দেখা হবে না বসের সঙ্গে।
‘আমাদের কাজ কতটা এগোল?’ আমাদের কথাটার ওপর জোর দিয়েছে ডেইটার গিসেল।
‘সামান্য এগোতে পেরেছি। তবে আরও সময় লাগবে।’
‘বেশ কয়েকটা দিন তো গেল, বলল গিসেল। ‘আপনি তো বলেছিলেন দু’তিন দিনেই কাজ শেষ হবে।’
‘অনেকটা এগোতে পেরেছি,’ বলল ম্যাককুলাক। খুব সতর্ক। কোনওভাবেই প্রকাশ করবে না নিজের বিরক্তি। নইলে হয়তো প্রাণ দিতে হবে বেঘোরে। স্টকহোমে ইসিডিসিতে কাজ করার সময় বড়জোর জলবসন্ত নিয়ে কাজ করেছে সে। ট্যাকটিকালি ওটা ছিল বায়োসেফটির লেভেল থ্রি। চিকিৎসা করা যাবে এমন রোগ। কিন্তু ব্ল্যাক ডেথ একদম অন্যকিছু। সুটে পিনের সমান ফুটো হলেই সে শেষ। সেক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ হবে যন্ত্রণা কমানোর জন্যে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করা। কাজ করতে করতে সর্বক্ষণ ঘামছে সে। এখানে-ওখানে চুলকে উঠছে শরীর। টয়লেটে যাওয়াও মহা ঝামেলা। আগে ডিকনট্যামিনেটেড না হয়ে কোথাও যেতে পারে না সে। কয়েক ঘণ্টা হলো শুকিয়ে গেছে গলা। শেষ কখন পেটে কিছু দিয়েছে, সেটাও মনে নেই।
কিন্তু ঘাড়ের ওপর আরবি জিনের মতই বসে আছে ডেইটার গিসেল। তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
‘এত সময় লাগছে কেন?’ জানতে চাইল গিসেল। ‘কঠিন সব কাজ তো আগেই শেষ। আপনি শুধু ব্যাকটেরিয়াটা নিয়ে…’
‘স্যর, এই এক্সপেরিমেন্ট কিন্তু সায়েন্সের প্রথম বর্ষের জিনিস নয়,’ নরম গলায় বোঝাতে চাইল ম্যাককুলাক। ‘প্রথমে রসদ থেকে নিয়েছি আসল ব্যাকটেরিয়া। তারপর সেটাকে বদলে নিয়েছি এয়ারোসলিসাইড ফর্মে। সে কাজ এখন শেষ।’ কাঁচের কেবিনেটে একসারি অ্যালিউমিনিয়ামের ক্যানিস্টার দেখাল বিজ্ঞানী। সব মিলিয়ে বারোটা। আপাতত ওই কয়টা চেয়েছে ডেইটার গিসেল। পৃথিবীর বড় কয়েকটা শহরে ছড়িয়ে দেবে ব্যাকটেরিয়া। এবার বাকি রয়েছে সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা।
ক্যানিস্টারগুলো দেখে হাসল গিসেল। ওগুলো প্রতিটি আট ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের। আকারে বড়জোর ককটেইল শেকারের মত। দেখলে কেউ বুঝবে না ভেতরে রয়েছে মৃত্যুবীজ। ওই জিনিস কোটি কোটি মানুষকে শেষ করবে, ভাবতে গিয়ে নিজেরও অবাক লাগছে গিসেলের।
‘চট্ করে ছড়িয়ে দিতে পারবেন,’ নার্ভাস সুরে বলল বুনযি ম্যাককুলাক। ‘ক্যাপ খুলে নযল টিপলেই হাই-প্রেশারের কারণে ছিটকে বেরোবে ওই জিনিস। বড়জোর এক সেকেণ্ড লাগবে কনসার্ট হল, সিনেমা হল, ট্রেন বা জাহাজে ছড়িয়ে যেতে।’
‘ঠিকমত কাজ করবে তো?’
‘এক শ’ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারব,’ বলল ম্যাককুলাক। পাশের ঘরের ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছে। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর মারা গেছে ষোলোটা বাঁদর ও খাঁচা ভরা ত্রিশটা সাদা ইঁদুর। তার আগে প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছে ওগুলো। মৃত্যুগুলো দ্বিতীয়বার ভাবিয়ে তুলেছে বুনযি ম্যাককুলাককে। ‘বাঁদরগুলোর ওপর আরও দ্রুত কাজ করেছে অ্যারোসলাইড্ স্ট্রেইন। পরে মরেছে ইঁদুর। ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে গেলে প্রথম ঘণ্টায় দেখা গেছে রোগের প্রাথমিক উপসর্গ।’
‘কতক্ষণ বাঁচে রোগী?’
‘সবচেয়ে কম বেঁচেছে বাঁদর পাঁচ ঘণ্টা সাতাশ মিনিট। মানুষের মরতে লাগবে সাত বা আট ঘণ্টা মত।’
ওয়েপনাইড্ প্লেগের বিষয়ে কমপিউটার বা বইয়ে যা পেয়েছে, সবই পড়েছে গিসেল। সায়েন্টিফিক লিটারেচারে ব্ল্যাক ডেথের মত কোনও অস্ত্রের কথা কখনও পায়নি। ‘তা হলে তো বেশিক্ষণ লাগবে না কাজে নামতে।’
‘ভীষণ হিংস্র ব্যাকটেরিয়া,’ সায় দিল ম্যাককুলাক। কত কোটি মানুষ মরবে ভাবতে গিয়ে সুটের ভেতর আবারও ঘেমে গেল। কাজে সামান্য ভুল হলে নিজেও খুন হবে সে।
‘অ্যান্টিটক্সিনের কী হাল? তৈরি হবে কখন?’ অধৈর্য হয়ে উঠছে ডেইটার গিসেল। নিজেরা নিরাপদ হলে, তারপর ছড়িয়ে দেবে ব্ল্যাক ডেথের ব্যাকটেরিয়া।
ভাইসরের ওদিকে গাল ফুলিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল ম্যাককুলাক। খসখস আওয়াজ তুলল কোঁচকানো সুট। ‘সাধ্যমত করছি, বস। কাজ খুব জটিল। ইয়েরসিনিয়া পেস্টিসের ক্রোমোযমে আছে চেনা দশটা টক্সিন-অ্যান্টিটক্সিন মডিউল। তার দুটোর ভেতর রয়েছে পাঁচটা পিএ পরিবার। আরইএলইবি, এইচআইজিবিএ, এইচআইসিএবি, পিএইচডি/ডক আর এমকিউএসআরএ…
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি। সহজ কথায় বলুন।’
‘সহজ কথায় বিষয়টি খুব জটিল। সামান্য ভুল হলেও চলবে না। ভয়ের কথা, তাজা ব্যাকটেরিয়া নিজেদের দেহে ইঞ্জেক্ট করলে মরব মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভেতর। সফল হলেও সবার দেহেই ভ্যাকসিন কাজ করবে, তা-ও নয়। পাঁচ বা সাত পার্সেন্ট সম্ভাবনা আছে নিজেরাই শেষ হব আমরা।’
‘এই ঝুঁকিটা তো নিতেই হবে,’ বিষয়টাকে পাত্তা না দিয়ে হাতের ইশারা করল ডেইটার গিসেল।
‘ভ্যাকসিন নেয়ার পর রোগীর মনে হবে মরে যাওয়াই ভাল,’ বলল ম্যাককুলাক। ‘কয়েক ঘণ্টা থাকবে মাথা-ব্যথা ও জ্বর।’
‘তাতে সমস্যা নেই। কাজটা কখন শেষ হবে?’
‘আমি খুব ক্লান্ত। না ঘুমিয়ে আরও জেগে থাকলে যে- কোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটবে।’
‘কাজ শেষ হলেই ঘুমাতে পারবেন,’ বলল ডেইটার।
‘ভ্যাকসিন তৈরিতে হয়তো লাগবে আরও বারো ঘণ্টা,’ ক্লান্ত সুরে বলল বিজ্ঞানী। ‘এরপর প্রয়োগ করতে হবে জন্তুগুলোর ওপর।
মৃদু মাথা নাড়ল ডেইটার গিসেল। চোখে অদ্ভুত অশুভ এক আলো। ওটা আগেও দেখেছে ম্যাককুলাক। ঢোক গিলল সে। ‘ঠিক আছে, আমাকে দিন আরও ছয় ঘণ্টা।’
‘আপনাকে দেব তিন ঘণ্টা,’ বলল ডেইটার। ‘এর ভেতর কাজ শেষ করুন।’ দেয়াল ঘড়ি দেখাল। পরক্ষণে আঙুল তাক করল নিজের কপালে। ‘এরপর মগজে পাবেন আস্ত একটা বুলেট।’ অলস পায়ে আউটার চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।
একান্ন
ভিকি অন্যাথের বক্তব্য মনে গেঁথে নিয়েছে রানা ও বেলা।
পশ্চিমে ছুটে চলেছে হামার। কয়েক ঘণ্টা পর পেছনে পড়ল জেনেভা শহর। উত্তরদিকে ছবির মত সুন্দর ঢেউ খেলানো সবুজ সব টিলা।
গ্রামের সরু পথেও গতি হ্রাস করছে না রানা।
বিকেল পাঁচটায় পাহাড়ের ওদিকে মুখ লুকাতে চাইল সুয্যি মামা। সোনালি আলো ছড়িয়ে দিল ফসলের মাঠে। মাঝে মাঝে গাঢ় সবুজ রঙের পাইনের ছোটখাটো জঙ্গল। কোথাও কোথাও সাদা বেড়ার ওদিকে নিশ্চিন্তে ঘাস চিবুচ্ছে পালে পালে গরু। গলার কাউবেল থেকে উঠছে টুং-টাং আওয়াজ। দূরে দূরে একটা-দুটো খামারবাড়ি। মনে হওয়ার কারণ নেই ওগুলোর একটাতে বাস করে একদল টেরোরিস্ট।
বারবার কু ডাকছে রানার মন।
ডাহা মিথ্যা বলেনি তো ভিকি অন্যাথ?
সেন্টার কন্সোলে রাখা ম্যাপে তর্জনী রাখল বেলা। ‘যে- কোনও সময়ে পৌঁছে যাব।’
আরও দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর সামনে পড়ল অর্গানিক ডেয়ারি ফার্ম। ভাল বর্ণনা দিয়েছে অন্যাথ। একগাদা গরু চরছে মাঠে। রাস্তা থেকে নেমে আড়াআড়িভাবে এগোল রানা। একটু পর দেখল খামারবাড়ি ও আশপাশে ছোটখাটো ক’টা দালান। চারদিকে বৃত্তাকার উঠান। দিগন্তে পাহাড়ে মিশেছে ঘাসের মাঠ। দূরে ফসলের মাঠে কাজ করছে লাল ট্র্যাক্টর নিয়ে এক লোক।
একবার মাথা নাড়ল বেলা। ‘কে বলবে এখানে আছে টেরোরিস্ট গ্রুপ! চারপাশ যেন ক্যালেণ্ডারের ছবি!’
‘তুমি ভেবেছিলে এখানে থাকবে দুর্গ, রেযার ওয়াইয়ার আর মেশিনগান সহ একদল লোক?’ জানতে চাইল রানা।
‘তা হলে অন্তত বুঝতাম এখানে ডেইটার গিসেল আছে।’
‘আছে, তাতে হয়তো ভুল নেই,’ বলল রানা।
‘তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে নিজেই বিশ্বাস করছ না।’
‘বিশ্বাস না করে উপায় নেই আমার,’ বলল রানা।
কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে আরও কিছু দূর যাওয়ার পর ওরা পেল মাঠে ঢোকার সাইড গেট। পশ্চিমে ওদিকেই সবুজ মাঝারি জঙ্গল। খামারবাড়ি থেকে কেউ দেখছে না, এটা ধরে নিয়ে গেট পেরিয়ে গেল রানা। এবড়োখেবড়ো পথে নাচতে নাচতে চলেছে হামার। পেছনে ফেলে যাচ্ছে চাকার চওড়া নকশা করা চিহ্ন। জঙ্গলের খুব কাছে পৌঁছে গেল ওরা। কয়েকটা গাছের আড়ালে গাড়ি রেখে ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। ‘সামনেই আছে জায়গাটা।’
‘চলো, যাওয়া যাক,’ বলল বেলা।
‘দরকারি সব গুছিয়ে নাও,’ বলল রানা। ‘হেঁটে যেতে হবে।’
হামারের পেছন থেকে কিটব্যাগ নিয়ে ইকুইপমেন্ট বের করল রানা। প্যান্টের পকেটে রাখল গুলিতে ভরা তিনটে ম্যাগাযিন। চতুর্থ ম্যাগাযিন ভরল রাইফেলের রিসিভারে। বোল্ট টানতেই তেল দিয়ে পরিষ্কার করা চেম্বারে ঢুকল গুলি। থ্রি ওয়ে ফায়ার সিলেক্টরটা সিঙ্গল শট-এ নিল রানা। আপাতত ফুল অটোমেটিক ফায়ার বাদ। তিনটে করে গুলি খরচ হলেও বড় দ্রুত ফুরিয়ে যায় ম্যাগাযিন। ঠিক সময়ে বুলেট না পেলে মহাবিপদ। তা ছাড়া, ও জানে না লড়তে হবে কতজনের বিরুদ্ধে। হয়তো নিরাপত্তার জন্যে চারপাশে পঞ্চাশজনকে রেখেছে গিসেল। আবার ভিকি অন্যাথ মিথ্যা বললে এখানে হয়তো কোনও ফ্যাসিলিটিই নেই। সেক্ষেত্রে আবারও প্রথম থেকে খুঁজতে হবে লোকটাকে।
পিস্তল চেক করে পকেটে ওটার কয়েকটা ম্যাগাযিন পুরল রানা। বেল্টে খাপ ঝুলিয়ে ওটার ভেতর ভরল এসওজি ছোরা। বেলাকে দিল রেডিয়ো, অন্যটা নিল নিজে। হ্যাণ্ডকাফ নিল না। আর যা-ই করুক, গিসেলকে গ্রেফতার করবে না ও। বেলার কাছে জানতে চাইল, ‘তুমি তৈরি?’
‘হ্যাঁ, রেডি,’ কাঁধে ফ্যামাস রাইফেলের স্লিং ঝুলিয়ে নিল বেলা। চট্ করে এক পা এগিয়ে চুমু দিল রানার ঠোঁটে। কয়েক মুহূর্ত পর মুখ পিছিয়ে নিয়ে বলল, ‘ভাগ্য ভাল হোক, এই কামনায়।’
জঙ্গলে গাছের মাঝ দিয়ে এগোল ওরা। এখনও উজ্জ্বল আলো বিলাচ্ছে সূর্য। দূরের পাহাড় থেকে আসছে তাজা হাওয়া। ঘাসের মাঠে চরছে শত শত গরু। দূরে পশ্চিমে পাইনের ঘন জটলা। অন্যাথ বর্ণনা দিয়েছে ওটার। তার কথা ঠিক হলে ওদিকেই আছে ডেইটার গিসেলের আস্তানা।
পনেরো মিনিট মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে জঙ্গুলে জায়গাটায় পৌঁছুল ওরা। একটু দূরে চারণভূমির কাঠের সাদা বেড়া। মাঠে কয়েকটা গরু কৌতূহলী চোখে দেখছে ওদেরকে। তবে তাজা ঘাসের আকর্ষণে ঘণ্টি বাজিয়ে দূরে সরে গেল।
বেড়ার কাছে থেমে চারপাশ দেখল রানা। আড়ালে পড়েছে খামারবাড়ি ও ছোট সব দালান। কৌতূহলী চোখে ওকে দেখছে বেলা। ঘন জঙ্গল যেন গাঢ় সবুজ কোনও দুর্গ। নিচু গলায় বলল ফ্রেঞ্চ এজেন্ট, ‘আশা করি ওদিকেই হাইডআউট।’
কালচে ছায়া ফেলেছে সারি সারি গাছ। তার মাঝ দিয়ে হেঁটে চলল রানা ও বেলা। শেওলায় ভরা মাটি স্পঞ্জের মত নরম। মৃদুমন্দ হাওয়ায় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলছে উঁচু সব গাছের কাণ্ড। বেশিক্ষণ হাঁটতে হলো না ওদেরকে। পঞ্চাশ গজ যাওয়ার পর হাত তুলে ফিসফিস করল রানা, ‘থামো।’
ঝোপঝাড়ের ওদিকে কংক্রিট ভিত্তির ওপর দূরে দূরে ধাতব খুঁটি। সেগুলোকে জড়িয়ে পথরুদ্ধ করেছে উঁচু ওয়াইয়ার মেশ বেড়া। সাবধানে এগিয়ে বেড়ার ওদিকটা দেখল রানা। প্রায় সিকি মাইল পর্যন্ত গেছে বেড়া। চারটে করে খুঁটির পর একটা করে স্টিলের ফ্রেমের মেশ গেট। প্যাডলক দিয়ে বন্ধ। দশ একর বৃত্তাকার জমির মাঝখানে জঙ্গল পরিষ্কার করে তৈরি করেছে বিশাল এক চারকোনা হ্যাঙার।
এসওজি ছোরা বের করে তারের ওপর ওটার ফলা ঠেকাল রানা। বিদ্যুতের ফুলকি উঠল না। সহজেই টপকে যেতে পারবে। খাপে ছোরা রেখে গাছের নিচে বেলার পাশে ফিরল ও।
রানার মতই বেড়ার দিকে চেয়ে আছে বেলা। কালো কাঠ ও সাদা জানালা দিয়ে তৈরি হ্যাঙারটা আকারে প্রায় ফুটবল মাঠের সমান। স্টিলের বিশাল গেটের সামনে থেমেছে পাকা রাস্তা। ‘ভাল বর্ণনা দিয়েছে অন্যাথ,’ মন্তব্য করল বেলা। নীরবে যেন রানাকে বলছে, চলো, যাওয়া যাক।
বেড়া ও জঙ্গলে চোখ বুলিয়ে আবারও হ্যাঙারটা দেখল রানা। ঠিক করেছে, অন্ধকারে টপকে যাবে তারের বেড়া। নিচু গলায় বলল, ‘আগে রাত নামুক। তারপর ভেতরে ঢুকব।’
‘ভেতরে ঢুকবে কীভাবে?’ জানতে চাইল বেলা।
শুকনো হাসল রানা। ‘কোনও না কোনও পথ বেরোবে।’
পিছিয়ে গাছের ছায়ায় বসল ওরা। চোখ রাখল চারপাশে।
তবে ওরা জানে না, ওদেরকে দেখে ফেলেছে কেউ।
বায়ান্ন
‘বুনযি ম্যাককুলাক!’ দড়াম করে ল্যাবোরেটরির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ডেইটার গিসেল, হাতে নাইন মিলিমিটার বেরেটা পিস্তল। ওটা দিয়ে খুন করেছে ব্রিটিশ গুপ্তচর পল হার্ভার্ট ওরফে রন হাওয়ার্ডকে। এবার ঠিক করেছে ওটা দিয়ে খতম করবে বুনযি ম্যাককুলাককে। ওই লোকের বদলে ডেকে আনবে নতুন বিজ্ঞানী। কোটি টাকাও তার জন্যে কোনও ব্যাপার নয়।
ল্যাবোরেটরির ইনার কণ্টেইনমেন্ট এরিয়ায় কেউ নেই। হারামজাদা ম্যাককুলাক গেল কোথায়? ‘শুয়োর,’ বিড়বিড় করল ডেইটার গিসেল। বেরেটার স্লাইড টেনে অফ করল সেফটি ক্যাচ। বেরিয়ে এল ল্যাবোরেটরি থেকে।
বেশি দূরে নেই ম্যাককুলাক। পরের ঘরেই তাকে পেল ডেইটার। এখানে রাখা হয় পরীক্ষার জন্যে জন্তু-জানোয়ার। এখনও পিপিপিএস সুট পরে আছে আমেরিকান লোকটা। খাঁচার ভেতর দেখছে সাদা-কালো এক বাঁদরকে। বসে আছে ওটা। ডানহাতে একটুকরো আপেল। ডেইটারকে দেখে খাবার মেঝেতে ফেলে খাঁচার শিক চেপে ধরল বাঁদরটা। শুরু করেছে কর্কশ ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ। বিস্মিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল ম্যাককুলাক। প্রচণ্ড টেনশন, ক্লান্তি ও ঘুমের অভাবে ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। ডেইটারের হাতে পিস্তল দেখে বিস্ফারিত হলো তার দুই চোখ।
‘মানুষের বিশ্বাস খুব দামি, ম্যাককুলাক,’ বলল ডেইটার, ‘বিশেষ করে আমার মত মানুষের। তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে কাজ শেষ করবে ঠিক সময়ে। এখন তোমার সব সময় শেষ।
‘হায়, যিশু!’ আঁৎকে উঠল ম্যাককুলাক। ‘প্রটেকশন ছাড়া ঢুকেছেন কেন?’ মাথা নাড়ল সে। ‘ওই বাঁদর তো ইনফেক্টেড!’
এক পা পিছিয়ে গেল ডেইটার গিসেল। পকেট থেকে রুমাল নিয়ে চেপে ধরল নাক-মুখ। খাঁচার পাশের টেবিলে সাদা একটা বোতল ও কয়েকটা ডিসপোযেবল সিরিঞ্জ। ‘ভেতরে কি ওই জিনিস নাকি?’
‘অ্যান্টিটক্সিন,’ বলল ম্যাককুলাক। ‘সময়ের আগেই কাজ শেষ করেছি। নব্বুই মিনিট আগে ড্রাগটা দিয়েছি এই বাঁদরকে। ওই একই সময়ে ওর শরীরে ইঞ্জেক্ট করেছি জীবিত ব্যাকটেরিয়া।’
খাঁচার ভেতর উন্মাদের মত চেঁচামেচি করছে বাঁদর। এরা প্রায় মানুষের মত দেখতে, তাই চিরকাল অপছন্দ করেছে ডেইটার। বাঁদরের দিকে পিস্তলের নল তাক করল সে। ‘মুখ বন্ধ করাও ওটার!’
‘উপায় নেই, বস।’
‘ওটা কি অসুস্থ?’
‘আপনাকে দেখে ভয় পেয়েছে,’ বলল ম্যাককুলাক। ‘অসুখের সিম্পটম বলে মনে হচ্ছে না।’
খুশির স্রোত বয়ে গেল ডেইটারের হৃৎপিণ্ডে। ‘তা হলে তো কাজ করছে অ্যান্টিটক্সিন! এরই ভেতর পেরিয়ে গেছে নব্বুই মিনিট। তুমি বলেছিলে সিম্পটম দেখা দেয় একঘণ্টার ভেতর।’
‘সাধারণত। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে যথেষ্ট সময় নয় নব্বুই মিনিট।’
কয়েক সেকেণ্ড কী যেন ভাবল ডেইটার। সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগল না। তার শিরার ভেতর বইছে আগুনের হলকা। জিতে গেছে সে। এবার আর অপেক্ষা করার কোনও মানেই হয় না! ‘যথেষ্ট দেখা হয়েছে।’ খপ্ করে বোতল ও কয়েকটা সিরিঞ্জ নিল সে। ‘এই বোতলের ভেতর সবার জন্যে যথেষ্ট আছে?’
‘দিতে পারবেন কম করে হলেও এক শ’জনকে,’ বলল ম্যাককুলাক। ‘কিন্তু…’
তার বুকে পিস্তল তাক করল ডেইটার। ‘তা হলে এবার সুট খোলো।’
‘কেন!’
বিজ্ঞানীর ফোলা পোশাকের দিকে নল তাক করল ডেইটার। টিপে দিল ট্রিগার। বদ্ধ ল্যাবোরেটরির ভেতর বিকট আওয়াজ তুলল গুলি। ফুটো হয়েছে পিপিপিএস সুট। বগলের নিচে নরম মেটারিয়াল ভেদ করে বুলেট লেগেছে পেছনের একটা কমপিউটারের স্ক্রিনে। আরও জোরে চিৎকার করতে লাগল বাঁদরটা। দুই হাতে ঝাঁকি দিচ্ছে খাঁচার শিক। পিস্তলের নল ঘুরিয়ে আবারও গুলি করল ডেইটার। ছিটকে গিয়ে খাঁচার পেছনের শিকে পড়ল রক্তাক্ত বাঁদর। মৃত।
‘খোলো তোমার সুট,’ আবারও ম্যাককুলাককে নির্দেশ দিল ডেইটার। ‘এমনিতেই ওটার আর কোনও মূল্য নেই।’
ফুটো হয়ে যাওয়া সুটের অংশটা একহাতে চেপে ধরল বুনযি ম্যাককুলাক। ঘুরে দেখল মরা বাঁদরটাকে। কয়েক সেকেণ্ড পর গলার কাছে হাত নিয়ে খুলে ফেলল হেডগিয়ার। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে। কাঁপছে থরথর করে। মিনিটখানেক লাগল সুট খুলতে। মনে মনে গালি দিল: ‘কুত্তার বাচ্চা, তুই বেরিয়ে এসেছিস তোর বাবার পেছনের ফুটো দিয়ে!’
এক এক করে অ্যান্টিটক্সিনের বোতল ও সিরিঞ্জ তার দিকে ছুঁড়ল ডেইটার। বিজ্ঞানী ওগুলো লুফে নেয়ায় বলল, ‘ভাবছ কাজ করবে?
‘আমার সাধ্যমত করেছি। কোথাও কোনও ভুল হওয়ার কথা নয়।’
‘তা হলে এক ডোয নাও। পরীক্ষা হয়ে যাক।’
ভয়ে কাঁপছে ম্যাককুলাক। তরল ওষুধ সিরিঞ্জে ভরে বাহুতে ইনজেক্ট করল সে। ভীষণভাবে কুঁচকে ফেলেছে দুই গাল।
‘গুড,’ বলল ডেইটার, ‘এবার আমাকে দাও।’ প্যাকেট থেকে নতুন নিডল নিয়ে তরল ভরল সে। দেরি হলো না নিজের বাহুতে ইনজেক্ট করতে। হতবাক হয়ে তাকে দেখছে ম্যাককুলাক।
‘তুমি ভাল দেখিয়েছ,’ হাসল ডেইটার। ভাবটা এমন, অবাধ্য ছাত্রের কাজে শিক্ষক খুশি। ‘ইতিহাসে লেখা থাকবে তোমার নাম। ভুলবে না কেউ।’
ল্যাবোরেটরি থেকে করিডোরে বেরিয়ে তার মনে পড়ল আমেরিকান বিজ্ঞানীর কথা। অ্যান্টিটক্সিনের কারণে একটু পর শুরু হবে বমি-বমি ভাব, জ্বর ও মাথা-ব্যথা। করিডোরে বাঁক নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অফিসের দিকে চলল সে। ভাল করেই জানে, কোন্ জিনিস দূর করবে সাইড এফেক্ট। যে লোক ভবিষ্যতে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ, তার তো চলে না দুর্বলতা প্রকাশ করা। বিশেষ করে ডেইযির সামনে।
ডেইটার গিসেলের অফিস প্রকাণ্ড। মেঝেতে পুরু ইরানি কার্পেট। চেয়ারগুলো দামি চামড়া দিয়ে মোড়া। ওক কাঠের টেবিলের ওদিকে গিয়ে নিজের সুইভেল চেয়ারে বসল সে। সামনের দেয়ালে সারি সারি সিকিউরিটি মনিটর। সামনে আধুনিক কন্ট্রোল প্যানেল। বাঙ্কার ও বাইরের হাই-ডেফিনিশন ইমেজ ফুটছে মনিটরে। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছে। তবে আপাতত সেদিকে মন না দিয়ে টেবিলের ওপর অ্যান্টিটক্সিন ও নিডলগুলো রাখল সে। ডানদিকের ড্রয়ার টেনে খুলে ওখান থেকে নিল প্লাস্টিকের একটা স্যাচেল। ওটার ভেতর রয়েছে কোকেন, একটা ক্রেডিট কার্ড ও খাটো একটা স্ট্র। টেবিলে মিহি সাদা পাউডার ফেলে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে সরু তিনটে লাইন তৈরি করল সে। তিনবারে নাকে টেনে নিল সাদা গুঁড়ো। সোজা হয়ে বসতেই হাত থেকে পড়ে গেল স্ট্র।
চোখের সামনে নানা রঙের আলো দেখছে ডেইটার। খুশির বুদ্বুদ উঠছে মনে। কী তৃপ্তি! পিয়ানোর কিবোর্ডের চেয়েও চওড়া হাসি ফুটল ঠোঁটে। এমনিতেই এখন মনে হচ্ছে সে হয়ে গেছে পৃথিবীর রাজা। আর ভবিষ্যতে সত্যিই তা-ই হবে। কারও সাধ্য নেই যে…
ঠিক তখনই গিসেলের চোখে পড়ল একটা সিকিউরিটি মনিটরের দৃশ্য। ওখানে ঘটছে অত্যন্ত অস্বাভাবিক ব্যাপার।
বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে হ্যাঙারের দিকে চেয়ে আছে দু’জন। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। জানেও না গাছের ওপর থেকে তাদেরকে দেখছে গোপন ক্যামেরা। ওই দু’জনের কাছে আছে আগ্নেয়াস্ত্র। লোকটার চুল কালো। বয়স সাতাশ কি আটাশ। শক্তপোক্ত, ব্যায়ামপুষ্ট দেহ। আগে তাকে দেখেনি ডেইটার। তবে মেয়েটাকে ভাল করেই চেনে। যদিও এখন ঠিক মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছে।
ও, হ্যাঁ, সিলভিয়া রথচাইল্ড!
জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মত খেপে গেল ডেইটার। মগজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে কোকেন। কুত্তীর বাচ্চি, বিশ্বাসঘাতিনী!
প্রায় দু’মিনিট মনিটর দেখল গিসেল। সরে গেল তারা গাছের নিচে। দেখা যাচ্ছে মনিটরের কোণে। আলাপ করছে নিজেদের ভেতর। কেন সার্ভেইল্যান্স সিস্টেমে মাইক্রোফোন রাখেনি, তা ভাবতে গিয়ে মন খারাপ হলো ডেইটারের। এরা ঢুকতে চায় ফ্যাসিলিটির ভেতর। মনে হচ্ছে আর কেউ নেই দলে। কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে গিয়ে ডেইটার নাড়ল ছোট একটা লিভার। জিনিসটা জয়স্টিকের মত। কয়েক ইঞ্চি সরে গেল গোপন ক্যামেরার লেন্স। আবারও মনিটরের মাঝে হাজির হয়েছে কপোত-কপোতী। নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র করছে কুকুরগুলো।
পকেট থেকে রেডিয়ো হ্যাণ্ডসেট নিয়ে ধমকে উঠল ডেইটার গিসেল, ‘দু’জন ঢুকেছে এ এলাকায়, গুয়েডিনেটি! পেরিমিটার গেট আঠারো! এক লোক, সঙ্গে হারামজাদি সিলভিয়া রথচাইল্ড! আমি বুঝে গেছি কী চায়! থামাতে হবে তাদেরকে! চারজনকে সঙ্গে নিয়ে খতম করো কুকুরদুটোকে! প্লেটে করে কুত্তীর মাথা নিয়ে আসবে আমার কাছে! সেজন্যে সময় পাচ্ছ বড়জোর দশ মিনিট! ওভার অ্যাণ্ড আউট!’
তেপ্পান্ন
চমকিত গুয়োডিনেটির হাত থেকে মেঝেতে পড়েছে রেডিয়ো। ওটা না তুলেই দৌড়ে গিয়ে রিক্রিয়েশন রুমে ঢুকল সে। সোফা ও আর্মচেয়ারে শুয়ে-বসে প্রলয়ের ওপর তৈরি নামকরা এক সিনেমা পঞ্চাশ ইঞ্চি প্যানাসনিক টিভিতে দেখছে পোল ল্যাণ্ডেনবার্জার, মাইকেল ব্রেসলিন, জেন্স রোভার্স আর জার্গেন বোনো।
‘অন্যরা কোথায়?’ দরজার কাছে থেমে জিজ্ঞেস করল গুয়েডিনেটি।
সোফায় শুয়ে আছে ল্যাণ্ডে বার্জার, মাথা উঁচু করে তাকাল সে। ‘ওয়াকেলেক হাগতে গেছে।ল্যাবোরেটরিতে ম্যাককুলাক। শেষবার অ্যামিনেমকে দেখেছি জিমে। আর ডেইযি কোথায় কে জানে! কেন, কী হয়েছে?’
‘হ্যাঙারের কাছে শত্রু!’ জানাল গুয়েডিনেটি, ‘এসো! বেরোতে হবে! সঙ্গে নেবে যার যার অস্ত্র।’ জোরে দু’বার হাততালি দিল সে। ‘জলদি! ব্রেসলিন, দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসো এমপিফাইভ। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা, বোনো। যা খুশি করবে সিলভিয়াকে নিয়ে। পরে অবশ্য ছেমড়ির মাথাটা ছিঁড়ে প্লেটে সাজিয়ে দিয়ে আসতে হবে বসকে!’
মাত্র কয়েক মিনিটে তৈরি হলো গিসেলের দুর্ধর্ষ পাঁচজন অনুচর। করিডোরের মাঝ দিয়ে ছুটে চলল তিনটে ইলেকট্রিক বাগি। আজই সকালে নতুন করে ছয় ডিজিটের বাঙ্কার এন্ট্রি/একটি কোড আবারও পাল্টে দিয়েছে তাদের বস।
ঝামেলা কাকে বলে!
পাতাল করিডোরে গফ্ কার্ট রেখে হেঁটে হ্যাঙারের মেঝেতে উঠল তারা। নতুন করে রিমোট কন্ট্রোল টিপে বাঙ্কারের প্রবেশপথ বন্ধ করল গুয়েডিনেটি। এবার যন্ত্রটা তাক করল স্টিলের শাটারের দিকে। এক সেকেণ্ড পর সবুজ হলো বাটন। ঝাঁকি খেল স্টিলের কেবল। ইলেকট্রিক মোটরের খির- খির আওয়াজ তুলে ওপরে উঠছে শাটার। মাত্র কয়েক ফুট উঠতেই হ্যাঙার থেকে বেরোল তারা। পেছনে আবারও শাটার বন্ধ করল দলনেতা গুয়েডিনেটি।
পেরিমিটার গেট আঠারোর দিকে সরাসরি না গিয়ে ঘাসজমি পার হয়ে দূরের এক গেটের সামনে থামল তারা। প্যাডলক খুলে সবাইকে নিয়ে জঙ্গলে বেরোল গুয়োডিনেটি। অনুপ্রবেশকারীরা রয়েছে প্রায় সিকি মাইল দূরে। বস বলে দিয়েছেন সময় মাত্র দশ মিনিট। এরই ভেতর ওরা খরচ করে ফেলেছে ছয় মিনিট। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছুটে চলল পাঁচ খুনি।
কাঁধ থেকে নামিয়ে হেকলার অ্যাণ্ড কক এমপি- ফাইভএসডি সাবমেশিন গান হাতে নিল গুয়েডিনেটি। অস্ত্রটার নলে রয়েছে পেটমোটা সাইলেন্সার। গুলির সময় প্রায় কোনও আওয়াজই করে না। স্পেশালাইড্ মিলিটারি অস্ত্রটা জোগাড় করেছে পারাটি দলের পুরনো বন্ধু ভিকি অন্যাথ। দলের অন্যদের হাতেও একই সারমেশিন গান। নলের ওপরে ইওটেক রেড ডট অপটিক্স। সি-ম্যাগাযিনে পুরো এক শ’টা গুলি। ছোটখাটো যুদ্ধের জন্যে যথেষ্ট। হালকা চালে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ছুটছে গুয়েডিনেটির দলের সবাই। স্পঞ্জের মত শেওলার কারণে প্রায় কোনও আওয়াজ তুলছে না বুট। মাত্র তিন মিনিটে পেরিমিটার গেট আঠারোর কাছে পৌঁছল তারা।.. চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল পাঁচজন।
মাইকেল ব্রেসলিন হেলিকপ্টার মেকানিক হলেও চাকরি করেছে ইউএস আর্মিতে কমাণ্ডো হিসেবে। গর্ব করে বলে, পৌঁছে যেতে পারে জীবিত যে-কোনও জন্তুর একফুটের ভেতর। ডানে-বামে দেখতে দেখতে ছুটছে সে। চোখের সঙ্গে ঘুরছে এইচ অ্যাণ্ড কে সাবমেশিন গানের নল। একবার টার্গেট পেলেই দেরি হবে না লোকটাকে খতম করতে। বামে পনেরো গজ দূরে এগোচ্ছে পোল ল্যাণ্ডে বার্জার। সত্যিকারের ভাল ড্রাইভার। জঙ্গলে লড়তে হবে শুনে অস্বস্তির ভেতর পড়েছে সে। ল্যাণ্ডেনবার্জারের বামে ছড়িয়ে পড়ে গাছের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে পাওলো গুয়েডিনেটি, জার্গেন বোনো ও জেন্স রোভার্স। দরকার হলে পুরো জঙ্গলে চিরুনি চালাবে তারা।
বেড়ার কাছে প্রথম যেখানে দেখা গেছে ওই দু’জনকে, সেখানে পৌঁছে নিচু সুরে শিস বাজাল জেন্স রোভার্স। নাহ্, আশপাশে নেই কেউ। বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছেন বস। অথবা চেয়েছেন দলের ওপরের পর্যায়ের সবাই ফিট থাকুক। সিনেমা দেখে লাভ কী? তাই এই ড্রিল। কথাটা ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলল রোভার্স।
কিন্তু ঠিক তখনই কী যেন লাগল ঘাড়ের পেছনে। চোখে অত্যুজ্জ্বল আলো দেখল সে। জানেও না কখন পড়েছে মাটিতে। তার জানার কথা নয়, প্রায় একই সময়ে স্টিলের একটা ফলা ঘ্যাচ করে ঢুকেছে পাঁজরের ফাঁক দিয়ে। মাত্র দুই সেকেণ্ড হুঁশ থাকল তার। তারপর বিদায় নিল পৃথিবী থেকে।
চোখের কোণে নড়াচড়া দেখেছে জার্গেন বোনো। ভুরু কুঁচকে ঘুরল বামে। কয়েক সেকেণ্ড আগে ওখানে ছিল জেন্স রোভার্স। আগ্নেয়াস্ত্রের নল ওদিকে তাক করল সে। কিন্তু কিছুই নড়ছে না কোথাও। নিজের কোর্স পাল্টে নব্বুই ডিগ্রি ধরে বেড়ার দিকে চলল সে। এমপিফাইভের ট্রিগারে রয়েছে তর্জনীর ছয় পাউণ্ড চাপ। গুলি বেরোবে আরও চার পাউণ্ড ওজন চাপিয়ে দিলে। সাপের মত এঁকেবেঁকে গাছের মাঝ দিয়ে এগোল সে।
কিন্তু জেন্স রোভার্স যেখানে ছিল, তার দশ ফুটের ভেতর পৌঁছেও কিছুই দেখল না জার্গেন বোনো। এগিয়ে গেল আরও কয়েক ফুট। রোভার্স গাধাটা গেল কোথায়? গাছের গোড়ায় পানি দেয়ার সময় নয় এটা! মুখ হাঁ করেও নীরব থাকল বোনো। আপাতত আওয়াজ করা চলবে না।.
এবার সত্যিই চিরকালের জন্যে চুপ হলো জার্গেন বোনো। মাত্র চার সেকেণ্ড পেয়েছিল। সেসময়ে চিৎকার করে দলের সবাইকে সতর্ক করতে পারত। কিন্তু পেছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরেছে ঘাড়। ভীষণ চাপে আটকা পড়েছে কণ্ঠনালী। পাদুটো ছটফট করছে বোনোর। মুহূর্তে তাকে টেনে নেয়া হলো শেওলা ভরা ঝোপের ভেতর। শ্বাসরুদ্ধ হয়েছে তার। একই সময়ে ডান থেকে বামে ভীষণ ঝটকা খেল ঘাড়। কোথায় যেন ভেঙে গেল কিছু। পরমুহূর্তে জার্গেন বোনোর চোখ থেকে হারিয়ে গেল সব আলো।
মৃতদেহটা ছেড়ে কয়েক পা সরে গেল রানা। গাছের সারির ভেতর ছায়ার মত অপেক্ষা করছে এলিস বেলা। তার দিকে জার্গেন বোনোর এমপিফাইভ ছুঁড়ল রানা। নীরবে খপ্ করে ওটা নিল মেয়েটা। হাতের ইশারা করে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় একবার হাতঘড়ি দেখাল রানা। পরক্ষণে পাঁচটা আঙুল।
জবাবে মাথা দোলাল বেলা। আড়াআড়িভাবে সরে গেল পথ থেকে। তার বামে সরে বেড়ার দিকে চলল রানা। ওদিকে সামনের লোকটা। মনে মনে রানা গুনল পাঁচ সেকেণ্ড, এরপর বিশ গজ দূর থেকে এল চাপা গুলির আওয়াজ। প্রথম লোকটার এমপিফাইভ হাতে এজন্যেই অপেক্ষা করছিল রানা। হেকলার অ্যাণ্ড কক ওর কাছে ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলের চেয়েও চেনা। জঙ্গলে, রণাঙ্গনে, তুষারের ভেতর বা পানির নিচেও ওই জিনিস ব্যবহার করেছে।
কাঁচা শুটারের পক্ষেও এত কাছ থেকে এই অস্ত্র দিয়ে শত্রুকে গুলি করে মিস করা কঠিন। তবে, রানা তো শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ছে না। খুন করছে একদল পশুকে। রয়ে গেছে তিনটে জানোয়ার। তবে তারা জানে না কী ঘটছে আশপাশে। এগোতে গিয়ে বারবার নানাদিকে ঘোরাচ্ছে অস্ত্রের নল। যে- কোনও সময়ে ঘাবড়ে গিয়ে মরবে নিজেদেরই ক্রসফায়ারে। এমপিফাইভএসডির সাইলেন্সারটা সত্যিই অতুলনীয়। রানা জানে, প্রতি সেকেণ্ডে বেরনো পনেরোটা নাইন মিলিমিটার প্যারাবেলাম গুলি সামান্য ওপরে তুলতে চাইবে মাযল। মাত্র সাত সেকেণ্ডে তামার জ্যাকেট পরা এক শ’ পাঁচটা গুলি বিধবে ঝোপঝাড়, ডালপালা বা জীবিত কারও দেহে।
নৃশংসভাবে খুন হয়েছে শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভোর নিরীহ সাধুরা। গিসেলকে ঠেকাতে না পারলে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভোগ করে মরবে কোটি কোটি মানুষ। কাজেই খুন করতে গিয়ে সামান্যতম দুঃখবোধ থাকল না রানার মনে। পাঁচ সেকেণ্ডে বুকে-পেটে একরাশ গুলি খেয়ে মরল ব্রেসলিন আর ল্যাণ্ডে বার্জার।
মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ভঙ্গি দেখেই রানা টের পেল মারা পড়েনি গুয়েডিনেটি। তার কাছে গিয়ে দেখল বুকে গুলি খেয়ে মাটিতে পড়ে শেওলার ভেতর মুখ চেপে পাদুটো ঝটকা দিচ্ছে সে। তার পাশে থামল রানা। গুয়েডিনেটির হাতে এখনও সাবমেশিন গান। ঝুঁকে খাপ থেকে সিওজি ছোরাটা নিল রানা। খুনির কানের পেছনে নরম অংশ ভেদ করে মগজে ঢুকল ফলা। থামল লোকটার দু’পায়ের ছটফটানি।
লাশের শার্টের আস্তিনে ফলা পরিষ্কার করল রানা। বেল্টের খাপে রাখল ছোরা। সরে গিয়ে ভাবল, কমল শত্রু। তবে ওর আসলে চাই ডেইটার গিসেলকে।
একটু দূরেই বেলা। এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে জঙ্গল থেকে। কাঁধে রাইফেল, হাতে সাবমেশিন গান। ওটার নলের গরম সাইলেন্সার থেকে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কেমন যেন বুনো লাগছে মেয়েটাকে।
‘ঠিক আছ?’ জানতে চাইল রানা।
ফ্যাকাসে মুখে মাথা দোলাল বেলা। ‘হ্যাঁ, ঠিক আছি।’
কয়েক মুহূর্ত ওকে দেখল রানা। বুঝে গেল, ভয় পেয়ে বসে পড়বে, সেই মানুষই নয় বেলা।
‘এতক্ষণে ওরা জেনে গেছে আমরা ভেতরে ঢুকতে চাই,’ বলল ফ্রেঞ্চ এজেণ্ট।
‘আমারও তা-ই ধারণা,’ বলল রানা।
ছড়িয়ে থাকা লাশ দেখল বেলা। চোখে বিষণ্ণতা। রানাকে দেখে নিয়ে বারকয়েক মাথা নাড়ল। ‘এই কাজ আগেও করেছ।’
হয়তো বেশি চাপ পড়েছে বেলার মনে।
কোনও জবাব দিল না রানা।
‘মনটা ভাল লাগছে না, বলল বেলা। ‘আগেও খুন করেছি। তবে সেটা ছিল আত্মরক্ষা। কিন্তু এটা একদম অন্য কিছু।’
চুপ করে থাকল রানা। কখনও কখনও খুন না করে উপায় থাকে না। তবুও খচখচ্ করে মন। সাবমেশিন গানে নতুন ম্যাগাযিন ভরল ও। এক এক করে সার্চ করতে লাগল লাশ। প্রথমজনের কাছে কিছু না পেলেও দ্বিতীয়জনের পকেটে পেল চিউইং গাম, এক প্যাকেট সিগারেট, খুচরো কয়েন ও একটা বিক লাইটার। তৃতীয়জনকে চিত করে দেখল, এ-ও শ্বেতাঙ্গ। বয়স পঁয়ত্রিশ মত। বাদামি চুল। চেহারায় রুক্ষতা। লোকটার প্যান্টের পকেটে রানা পেল ছোট একটা রিমোট কন্ট্রোল হ্যাণ্ডসেট। ওটা তৈরি অতি বড়লোক কারও জন্যে। গায়ে কোম্পানির নাম লেখা নেই। দু’সারি বাটনের কি-প্যাড। নিচে লাল ও সবুজ দুটো বাটন। জিনিসটা কীসের, বুঝল না রানা।
তৃতীয় লাশের বুকে শিথিলভাবে পড়ে আছে ডানহাতটা। ওটা সরিয়ে বুকের পকেট ঘাঁটতে চাইল রানা। মাটিতে পড়ল লাশের মুঠো করা হাত। কী যেন আছে ভেতরে। মুঠো খুলে দেখল রানা, তালুতে কালিতে লেখা রয়েছে ছয়টা সংখ্যা।
আরেকবার ডিজিটগুলো দেখার পর রিমোট কন্ট্রোলে চোখ বোলাল রানা। চট্ করে বুঝে গেছে, ওটা কী। বারবার ফোন বা রিমোট কন্ট্রোলের কোড বদলে নেয়ার অভ্যাস আছে গিসেলের। বিশেষ করে সিকিউরিটি নম্বরগুলো। সেজন্যেই হ্যাঙার খোলার কোড পাল্টে নিয়েছে সে। আর সেটা দেখছে রানা মৃতদেহের ডানহাতের তালুতে!
হয়তো কাগজ না পেয়ে হাতে লিখেছে লোকটা। সাধারণ ভুল। তবে এজন্যে বাড়তি সুবিধা পাবে ওরা। আসলে খুব নিরাপদ সিস্টেমেও রয়ে যায় কোনও না কোনও দুর্বলতা।
‘আমরা বোধহয় জেনে গেছি কীভাবে ঢুকতে হবে ভেতরে,’ বেলাকে বলল রানা।
চুয়ান্ন
হ্যাঙারের স্টিলের শাটার অনড়। আর্মার ভেদ করা রকেট ব্যবহার করলে হয়তো উড়িয়ে দেয়া যাবে ওটা। অবশ্য সঠিক কোড খুলে দেবে শাটার।
‘এবার দেখা যাক,’ শাটারের দিকে রিমোট তাক করে লাল বাটনে চাপ দিল রানা।
তাতে ঘটল না কিছুই। এবার চাপ দিল সবুজ বাটনে। শাটারের ওদিক থেকে এল মৃদু ক্লিক আওয়াজ। পরক্ষণে চালু হলো ইলেকট্রিক মোটর। ওপরে উঠছে শাটার। সহজেই হয়তো ভেতরে ঢুকতে পারবে রানা ও বেলা। কিন্তু ওদিকে কী আছে, কে জানে!
শাটার আরও খানিক ওঠার পর অস্ত্র হাতে একপাশ দিয়ে হ্যাঙারে ঢুকল ওরা। গুলি এল না ওদের দিকে। বিশাল হ্যাঙারে কোথাও কোনও নড়াচড়া নেই। জায়গাটা প্রকাণ্ড গুহার মত।
‘এটা অটো মিউযিয়াম নাকি,’ বিড়বিড় করল বেলা।
লাল মেঝে। দূরের কোণে ডেইটারের বেল ৪২৯ চপার। আণ্ডারক্যারিজের নিচে চাকা। উল্টোদিকের দেয়ালের কাছে ভলভো আর্টিকুলেটেড লরি ও ট্রেইলার। উজ্জ্বল আলোয় ঝিকমিক করছে দামি সব মোটর সাইকেল। একদিকে তিনটে কালো রেঞ্জ রোভার জিপগাড়ি। পাশে দারুণ এক স্পোর্টস কার। দেখলে যে কেউ ভাববে, ওটা এসেছে কল্পকাহিনীর কোনও সিনেমার দৃশ্য থেকে। অন্যদিকে ভারী চেহারার লেনকো বিয়ারক্যাট অ্যাসল্ট ট্রাক। ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রানা। দৃঢ় হলো চোয়াল। স্পর্শ করে দেখল গাড়িটার ব্যাটারিং র্যাম। এখনও রিভেট হেডে মঠের কবাটের টুকরো। একটা চল্টা হাতে নিয়ে দেখল রানা।
‘ভেতরে কেউ নেই,’ চারপাশে চোখ বোলাল বেলা। ‘অন্যরা কোথায়? আর ওই লোকগুলোই বা বেরোল কোথা থেকে?’
পায়ের নিচের মেঝে দেখাল রানা। ‘এসেছে পাতাল থেকে। নিচের ফ্যাসিলিটির ভেতর পাব ডেইটার গিসেলকে।’
‘তার মানে সে আছে মাটির নিচে?’
‘তাই তো বলেছে ভিকি অন্যাথ।’
‘বলেছে বটে। তবে ওর কথা বিশ্বাস করিনি। এখন মনে হচ্ছে হাজির হয়েছি অদ্ভুত এক জায়গায়। আরেকবার চারপাশ দেখল বেলা। ‘আমি তো কিছুই দেখছি না। কোনও ট্র্যাপ ডোর চোখে পড়েছে তোমার?’
জবাব না দিয়ে রিমোট কন্ট্রোলের কি-প্যাডে ছয় ডিজিটের সংখ্যা টিপল রানা। সবুজ বাটন খুলে দিয়েছে শাটার। আশা করা যায় অন্যকিছু করবে লাল বাটন। ওই বাটন টিপল রানা।
কিছুই ঘটল না।
কে জানে, হয়তো কোনও কাজে লাগবে না লাল বাটন। খুলে গেছে রিমোটের ভেতর কোনও তার।
ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল বেলা। মুখ খুলবে, তখনই ওদের পায়ের নিচে সরতে লাগল পঞ্চাশ টন ওজনের মেঝের স্ল্যাব। একটু দূর থেকে এল হাইড্রলিকের হুইশ্ আওয়াজ। গোপনে কাজ করছে কয়েকটি গিয়ার। বাতাস সরে যাওয়ার আওয়াজে ভরে গেল চারপাশ। শক্তিশালী কোনও মেকানিযম কাঁপিয়ে দিল চারদিকের দেয়াল। চমকে গেছে রানা ও বেলা। হ্যাঙারের মেঝেতে তৈরি হচ্ছে বিশাল এক গহ্বর। দৈর্ঘ্যে ওটা বিশ গজ, চওড়ায় পাঁচ গজ। ধীরে ধীরে মেঝে হয়ে উঠছে প্রকাণ্ড এক র্যাম্প। ওদিকে পাতাল করিডোর। পুরো ঘটনা ঘটতে লাগল মাত্র পনেরো সেকেণ্ড। নিচের মেঝেতে র্যাম্প বসে যেতেই চাপা ভারী শব্দে আবারও কেঁপে উঠল গোটা দালান।
‘তার মানে পাতাল ফ্যাসিলিটি,’ বিড়বিড় করল বেলা।
‘গোপনে তৈরি, সায় দিল রানা।
ডেইটার গিসেল এই জিনিস তৈরি করল কী করে?’
‘হয়তো কিনে নিয়েছে। টাকার তো অভাব নেই।’
‘অকল্পনীয়!’
‘কেন যেন মনে হচ্ছে, এটা বিশাল ফ্যাসিলিটি,’ বলল রানা। র্যাম্পের কাছে কয়েকটা গল্ফ কার্ট। ইগনিশনে ঝুলছে চাবি। এসব গাড়িতে চেপে এসে হ্যাঙার থেকে বেরিয়ে গেছে ওই পাঁচজন খুনি। প্রতিটি গাড়ির রয়েছে দুটো করে সিট। চকচকে ক্রোম রিম, সঙ্গে ফোলা চাকা। স্টাইলিশ জিনিস।
একটা গল্ফ কার্টের পেছনের ক্যারিয়ারে ওর রাইফেল ও সাবমেশিন গান রাখল রানা। চেপে বসল ড্রাইভিং সিটে। মেঝের প্যাডেলে চাপ দিতেই নীরবে চালু হলো ইলেকট্রিক মোটর। ইউ টার্ন নিয়ে বেলার জন্যে অপেক্ষা করল রানা। সন্দেহ নিয়ে পাতাল করিডোর দেখছে মেয়েটা। ছাতে সারি সারি জ্বলছে নিয়ন বাতি। চারপাশ অতিরিক্ত নীরব।
‘মনে হচ্ছে ওটা নরকের প্রবেশদ্বার,’ বলল বেলা। ‘তো চলো, গিয়ে যোগ দিই গিসেলের সঙ্গে, বলল রানা।
.
পাতাল অফিসে বসে মনিটরে সবই দেখছে ডেইটার গিসেল। প্রথমে খুন হলো তার পাঁচজন দুর্ধর্ষ অনুচর। এত সতর্ক হয়েও কোনও লাভ হলো না। অচেনা ওই লোককে নিয়ে হ্যাঙারে এসে ঢুকল সিলভিয়া কুত্তী। আর এখন গিসেলেরই কেনা গল্ফ কার্টে চেপে এত সাধের ফ্যাসিলিটির সুড়ঙ্গের মাঝ দিয়ে এগিয়ে আসছে দুই হারামি।
।সত্যিই ভয় পেয়েছে গিসেল। মনে উঁকি দিয়েছে ভয়ঙ্কর এক চিন্তা। কে ওই সিলভিয়া রথচাইল্ড? আসল নাম যে নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। নাম ভাঁড়িয়ে গোপনে তার দলে ঢুকে পড়েছিল পল হার্ভার্ট। সেক্ষেত্রে এরা কি পুলিশবাহিনীর সদস্য? সরকারি গুপ্তচর? তা হলে ফ্যাসিলিটি দখল করতে হাজির হবে আরও অনেকে। হয়তো এরই ভেতর অফিস থেকে রওনা হয়ে গেছে তারা।
টেবিল থেকে অ্যান্টিটক্সিন ও সিরিঞ্জ নিল গিসেল। কারও হাতে ওষুধটা পড়ার আগেই সরিয়ে ফেলতে হবে। দৌড়ে অফিস থেকে বেরোল সে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ল: ‘ডেইযি! তুমি কোথায়!’ নিজেই জানে, এত বড় ফ্যাসিলিটির ভেতর চিৎকার করে কাউকে ডেকে নেয়া প্রায় অসম্ভব।
কোথায় আছে মেয়েটা?
‘ডেইযি!’ ভয় ও কোকেনের প্রতিক্রিয়ায় ভীষণ অস্থির লাগছে গিসেলের। ডেইযি অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয় ওর জন্যে। এখন জরুরি অ্যান্টিটক্সিন সরিয়ে ফেলা। ঘুরে উল্টো দিকের করিডোর ধরে ছুটতে লাগল সে। একটু দূরেই সবচেয়ে কাছের গল্ফ কার্ট স্টেশন। নিউক্লিয়ার বাঙ্কারের নানা জায়গায় আছে ওই জিনিস। ডিজেল জেনারেটর সর্বক্ষণ বিদ্যুৎ দিচ্ছে বলে চার্জড় থাকে কার্টের ব্যাটারি। চার্জিং বে-তে পৌছুতে গিয়ে হতক্লান্ত হলো ডেইটার। প্রথম কার্টের পাওয়ার কেবল খুলে চেপে বসল ড্রাইভিং সিটে। ডান পায়ে মেঝেতে চেপে ধরল প্যাডেল। দ্রুত বেগে রওনা হলো গলফ কার্ট।
ডেইটার গিসেল চলেছে ল্যাবোরেটরির দিকে।