অপশক্তি – ৫

পাঁচ

পাঁচ দিন পর।

শেষরাতে বিছানা ছেড়ে মেঝেতে নেমে ব্যায়াম করছে রানা। আনমনে ভাবছে: কোন্ কৌশলে হারাচ্ছে সাধু? জিততে পারি না কেন দাবায়!

গত চার দিন হেরে ভূত হয়েছে রানা। প্রথমবারের পর থেকে বিশেষ নজর রেখেছে বোর্ডে। তাতে লাভ হয়নি। কোনও চুরি ধরা পড়েনি। প্রতিবার হারিয়ে দিয়ে মুচকি হাসেন অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড। মিষ্টি করে বলেন, ‘পরেরবার হয়তে। কপাল খুলবে?’

আশ্রমের সবাই বুঝেছে, দাবার পার্টনার পেয়ে খুব খুশি প্রধান সাধু। প্রার্থনার ফাঁকে ডেকে নেন রানাকে। আর তারপর মাত্র দশ বা পনেরো মিনিটে খতম করেন খেলা। প্রতিদিন তিন থেকে চারবার যুদ্ধে নেমে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে রানা।

‘আর কবে খুলবে কপাল?’ বিড়বিড় করল রানা। ‘আমার সব আত্মবিশ্বাস শেষ করে দিচ্ছে বুড়োটা!’

গোটা পঁচিশ বুকডন দিতেই টোকা পড়ল ঘরের দরজায়।

‘আসুন,’ উঠে বসল রানা।

ঘরে ঢুকলেন নব্য সাধুদের প্রধান ফ্রায়ার জিলেস 1 সরিয়ে ফেললেন হুড। দেখা গেল চক্চকে ন্যাড়া মাথা। বরাবরের মতই ফিসফিস করলেন, ‘একটা সাহায্যের জন্যে এসেছি, রানা।’

‘বলুন, আমার সাধ্যমত নিশ্চয়ই করব,’ বলল রানা।

সংক্ষেপে বলতে লাগলেন ফ্রায়ার জিলেস।

সমস্যাটা আশ্রমের বিয়ার বিষয়ক। মঠের নিচের সেলারে জমিয়ে রাখা হয় বিয়ার। তারপর সেগুলো ম্যাচিয়োর হলে তুলে আনা হয় ওপরে। কয়েকজন তরুণ সাধুর ওই কাজটার তদারক করেন ফ্রায়ার রোবি। এরপর আশ্রমের একমাত্র বাহন প্রাচীন এক ট্রাকে করে বিয়ার নেয়া হয় ব্রায়ানকন শহরে। ওই ট্রাকও চালান ফ্রায়ার রোবি। শহরে তাঁর কাছ থেকে বিয়ার সংগ্রহ করে এক হোলসেল এজেন্ট। বিক্রি করে ফ্রান্সের নানান এলাকায়। এ থেকে আশ্রমে আসে কিছু টাকা। তা ছাড়া, শত শত বছর বিয়ার তৈরির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের ব্যাপারটা তো আছেই।

ভুরু কুঁচকে গেল ফ্রায়ার জিলেসের। কিন্তু এখন সেসব বিয়ার সেলার থেকে তুলে শহরে নেয়ায় দেখা দিয়েছে সমস্যা। দু’দিন আগে সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে ডান পা মচকে গেছে ফ্রায়ার রোবির। আপাতত দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না তিনি। অথচ, আগামীকাল ভোরেই বিয়ার নিয়ে শহরের দিকে যাত্রা করার কথা। এখন রানা কি পারবে ফ্রায়ার রোবির বদলে ওসব নিয়ে শহরে যেতে?

খুশি মনেই রাজি হলো রানা। বুঝে গেল, গত ক’দিনে ওর ওপর বিশ্বাস এসে গেছে সাধুদের।

ফ্রায়ার . জিলেসের কথা অনুযায়ী, কাজটা প্রচণ্ড পরিশ্রমের। আশ্রমে নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি। সব চলে পুরনো নিয়মে। অর্থাৎ, লোহার বেড়ি পরা ওক কাঠের চল্লিশ গ্যালনের ভারী ব্যারেল ওপরে তুলতে লাগবে অন্তত আট থেকে নয় ঘণ্টা। কাজ শেষ হলে পরদিন সকালে ট্রাকে করে পৌঁছে দিতে হবে ব্রায়ানকন শহরে।

পঁচিশ মিনিট পর রানার সঙ্গে যোগ দিল তরুণ সাধুদের ছোট একটি দল। তাদের দু’জন যমজ। নাম ফ্রাঁসোয়া আর মার্ক। তৃতীয় তরুণের নাম পিয়োরট। একটু পর নিজের দল নিয়ে কাজে নেমে পড়ল রানা। আগে কখনও মঠের এত ভেতরে যায়নি। নিচে যাওয়ার আঁকাবাঁকা সরু সব করিডোরে জ্বলন্ত লণ্ঠন হাতে পথ দেখাল মার্ক। মৃদু কাঁপছে হলদেটে শিখা। দেয়ালে দেখা যাচ্ছে সবুজ শেওলা। ছায়াঘেরা করিডোরের দূর থেকে ফিরছে ওদের পদশব্দ। ভেজা দেয়ালে হাত রেখে রানা বুঝল, প্রাচীন আমলে সাধারণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পাহাড় খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে এসব সুড়ঙ্গ। করিডোর নিম্নমুখী দেখে রানার মনে হলো, ওরা নেমে চলেছে খনির ভেতর। এত নিচ থেকে কীভাবে বিয়ারের ব্যারেল অত ওপরে তুলবে, ভাবতে শুরু করেছে ও। অবশ্য একটু পর পুরু দড়ি ও শক্তপোক্ত পুলি দেখে বুঝল, গত পাঁচ শ’ বছর ওগুলো দিয়েই তোলা হয়েছে ব্যারেল। সে আমলের সেরা টেকনোলজি। মঠে বা অন্ধকার সেলারে নেই বিদ্যুতের সংযোগ। রানা ভাবল, সাধুরা বোধহয় ধরে নিয়েছে ঘুটঘুটে আঁধারে সহজে পৌঁছুতে পারবে ঈশ্বরের কাছে। কপাল ভাল যে পুলি ও দড়ি আছে, নইলে অন্ধকার খাড়া সব সিঁড়ি বেয়ে ব্যারেল তুলতে গিয়ে চ্যাপ্টা হয়ে মরত ওরা।

এবার নামতে হবে আসল কাজে। এক এক করে ব্যারেল তুলতে হবে ওপরে। তারপর সেগুলো নেবে আস্তাবলের কাছে। ওটার ভেতরেই আছে মঠ-প্রধানের সমবয়সী সেই বুড়ো ট্রাক। রানার জানা নেই বিয়ার বিক্রি করে কত টাকা পাবে আশ্রম।

পুরো চারঘণ্টা প্রচণ্ড খাটুনির পর সেলারের অর্ধেক ব্যারেল ওপরে তুলল ওরা। ততক্ষণে জিভ বেরিয়ে গেছে দুই যমজ সাধুর। সবাই কাহিল দেখে বিশ্রামের ঘোষণা দিল রানা। ঠিক হলো, আধঘণ্টা পর আবারও কাজে নামবে ওরা।

দুই যমজ শুয়ে পড়ল মেঝেতে। প্রার্থনায় বসল পিয়োরট।

বসে না থেকে জ্বলন্ত লণ্ঠন হাতে পাতাল করিডোর দেখতে বেরোল রানা। ভাবছে, হয়তো শত শত বছরে এখানে এসেছে মাত্র ক’জন মানুষ। কিছু করিডোর গেছে পাহাড়ের আরও গভীরে। ওর ভুল না হলে ওরা আছে মঠের সরাসরি দেড় শ’ ফুট নিচে। মেঝেতে জমেছে কয়েক শ’ বছরের পুরু ধুলো। একসময়ে শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে এসব করিডোর ব্যবহার করেছে প্রাচীন সাধুরা।

নানাদিকে সরু সব করিডোর। কোনও কোনওটার ছাত দুই থেকে আড়াই ফুট উঁচু। বাচ্চারা পারলেও ওসব সুড়ঙ্গে রানা ঢুকলে ওকে চলতে হবে হামাগুড়ি দিয়ে। আরও কয়েক মিনিট হাঁটার পর থামল রানা। ভাবছে, এবার ফেরা উচিত। এমন সময় দূরে দেখল অস্বাভাবিক সাদাটে আভা। এমন ফসফোরেসেন্ট আলো দেখেছে মধ্যপ্রাচ্যের পাহাড়ি গুহায়। আবারও পা বাড়াল করিডোরের গভীরে।

দশ গজ যাওয়ার পর গুহাটা প্রশস্ত হতে শুরু করল। ডান দিকের দেয়াল ঠিকই থাকল, কিন্তু বামদিকের দেয়ালটা সরে গেল দূরে। হঠাৎ রানা লক্ষ করল ডানের দেয়ালটা প্রাকৃতিক নয়, নির্মাণ করা হয়েছে। ভারি আশ্চর্য তো! অবাক হলো রানা: এখানে কে দেয়াল তৈরি করল, কেন? –

ফিরতে যাবে, এমন সময় আবারও চোখে পড়ল সেই অদ্ভুত সাদা আভাটা। বামের একটা সুড়ঙ্গ থেকে আসছে আলো। লণ্ঠন নিচু করে ধুলোয় দেখল একসারি স্যাণ্ডেলের ছাপ। মাথা নামিয়ে সঙ্কীর্ণ সুড়ঙ্গে ঢুকল রানা। তবে ছয় ফুট যাওয়ার পরেই বুঝল, ওই অদ্ভুত আলোও মানুষেরই তৈরি। একটু দূরে মেঝেতে কুঁজো হয়ে বসে আছে কেউ। হাতে আলোকিত খুদে এক স্ক্রিন।

রানা আরও কয়েক পা এগোতেই আঁৎকে উঠল কেউ। অফ করে দেয়া হলো স্ক্রিন।

লণ্ঠন নামিয়ে হলদেটে আলোয় রানা দেখল, ভীষণ চমকে গেছে ওর পরিচিত একটি মুখ।

‘জন?’

‘ওহ্, আপনি, রানা! ভীষণ ভয় পেয়েছি!’

সুড়ঙ্গে প্রতিধ্বনি তুলছে দু’জনের কণ্ঠস্বর।

‘এখানে কী করছ, জন?’ জানতে চাইল রানা। আগেই বুঝেছে, কী হবে উত্তর। জোব্বার ভেতর মুখ লুকাল তরুণ। ‘মোবাইল ফোন কোথায় পেলে? এটা না নিষিদ্ধ?’

লজ্জায় মাথা নিচু করল তরুণ। ‘ইয়ে… আপনি আবার… বলে দেবেন না তো?’

‘আমি কী বলব?’

‘আমার দাবা শেখার কথা?’

‘দাবা শিখছিলে? সত্যিই? দেখি?’

‘হ্যাঁ। একদিন হারাব আমাদের প্রধান সাধুকে! আপনি আবার বলে দেবেন না তো?’

জোব্বার পকেট থেকে ফোন বের করল জন। একটা বোতাম টিপতেই দেখা গেল দাবার কোর্ট।

হেসে মাথা নাড়ল রানা। ‘না, বলার মত কিছুই হয়নি। দেখি কতদূর শিখলে? এটা কে দিল?’

‘থিয়োডর দিয়েছে,’ বলল জন পিয়েরে। সে-ও তরুণ সাধু। তাকে খুব ভালভাবে চেনে না রানা।

গুটি সাজাবার ছক দেখে রানা টের পেল সিসিলিয়ান ডিফেন্স শিখছে ছেলেটা… নাইডর্ফ ভ্যারিয়েশন। ভেবেছে একদিন চমকে দেবে প্রধান সাধুকে। বেচারা জানে না কাকে টার্গেট করেছে!

সাদাসিধে জন পিয়েরের সহজ-সরল জীবনেও নিজের প্রভাব ফেলেছে আধুনিক টেকনোলজি। নরম সুরে বলল রানা, ‘ভয় পেয়ো না। আমি কাউকে কিছু বলব না। তবে আশা করি বাজে সব সাইটে গিয়ে নিজের মানসিক ক্ষতি করবে না। তা হলে মনে খুব কষ্ট পাবেন তোমাদের প্রধান সাধু অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড।’

লজ্জায় মুখ নিচু করল তরুণ।

‘তা হলে এটাই তোমার আস্তানা?’ মৃদু হাসল রানা। মাথা দোলাল জন। ‘আমি ছাড়া কেউ আসে না এখানে।’

‘বুঝলাম। কপাল ভাল যে আমার বদলে আসেননি তরুণ সাধুদের প্রধান। চলো, এবার ফেরা যাক। যে-কোনও সময়ে তোমাকে খুঁজবে কেউ।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও রানার পিছু নিল জন পিয়েরে।

সরু সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে ডানের চওড়া করিডোরের সামনে থামল রানা। দেখল চারপাশ। একটু দূরে করিডোর মিশে গেছে বিশাল এক কক্ষে। নিচু গলায় বলল ও, ‘ওই ঘর কীসের জন্যে?’

‘জানি না। হয়তো আগে জিনিসপত্র রাখত।’

ঘরে ঢুকে ধুলো ভরা একদিকের দেয়ালে হাত বোলাল রানা। এখানে-ওখানে মাকড়সার ঝুল। পাথরের বোল্ডার দিয়ে তৈরি দেয়ালের গায়ে গাঁইতি ও বাটালির দাগ। এগারো শতাব্দীতে যখন পবিত্র ভূমি দখল করতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়ছে খ্রিস্টান সেনাবাহিনী, সেসময়ে এখানে চুপচাপ পাহাড় কেটে এই মঠ তৈরি করেছেন নীরব সাধুরা। লণ্ঠনের আলোয় পাথুরে দেয়ালে ল্যাটিন লিপি খুঁজল রানা।

লিপি না পেলেও আছে অন্যকিছু।

একসময় এই গুপ্তকক্ষ ছিল বিশাল। পরে মাঝে তোলা হয়েছে ইঁটের দেয়াল। বোঝার উপায় নেই জায়গাটা কত বড়।

‘মাঝে কেন দেয়াল তুলেছিল?’ বিড়বিড় করল রানা।

আনমনে কাঁধ ঝাঁকাল পিয়েরে। মোবাইল ফোনের দিকে মন। জোব্বার ভেতর ওটা নাড়ছে ও।

ধুলোময় দেয়ালে হাত রাখল রানা। শত বছর আগের হলেও ঝুরঝুরে হয়নি আস্তর। মেঝেতে পড়ে থাকা গোল একটা বড় পাথর পেয়ে ওটা তুলে দেয়ালে ঠুকল রানা। আওয়াজটা ফাঁপা।

‘ওদিকে কিছু আছে,’ নিচু গলায় বলল রানা। গোটা কক্ষ ক্যাথেড্রালের মতই বড়।

পরে ধসে গেছে ওদিকের ছাত?

তাই তুলেছে এই দেয়াল?

হয়তো ওদিকে রয়েছে পাহাড়ের গভীরে যওয়ার সুড়ঙ্গ।

বিপদ হলে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যেত সাধুরা?

যাতে ঢুকতে না পারে শত্রু, তাই পরে তুলেছে দেয়াল? কি

ন্তু দুর্গের মত করে তৈরি করা হয়নি এই মঠ। চাইলে সহজেই সামনের চওড়া গেট ভেঙে ঢুকতে পারবে শত্রুপক্ষ।

তা হলে কী দরকার ছিল তাদের পাহাড়ি সুড়ঙ্গের?

রানার মনে হলো এটা বহুকাল আগের কোনও জটিল রহস্য। তবে বোকার মত দেয়ালের দিকে চেয়ে লাভ হবে না। এবার ফেরা উচিত। সেলার থেকে তুলতে হবে বাকি ব্যারেল। বোধহয় এরই ভেতর ওর জন্যে অপেক্ষা করছে অন্যরা।

বৃত্তাকার পাথরখণ্ড মেঝেতে ফেলল রানা। ভেবেছিল মেঝেতে ঠং আওয়াজ তুলবে ওটা। কিন্তু তা না করে ভোঁতা একটা শব্দ করল ওটা। মনে হলো ফেটে গেছে জিনিসটা।

ভুরু কুঁচকে গেল রানার। আগেও শুনেছে ওই ধরনের শব্দ।

লণ্ঠন নিচু করে পাথরটা আবার তুলল রানা। আরও কুঁচকে গেল ওর ভুরু।

পাথর নয়।

বহুকাল আগের ফাটা একটা মানব করোটি!

ছয়

শেষ বিকেলে প্রধান সাধু অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ডের ঘরে বৃদ্ধের মুখোমুখি বসেছে রানা। দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে গেছে ওর মুখ। মোমবাতির কাঁপা হলদেটে আলোয় গভীর মনোযোগ দিয়েছে দাবার বোর্ডে। দেয়ালে নৃত্যরত ছায়া যেন ভয়ঙ্কর রাক্ষুসী। গত ক’দিনে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়ে গেছেন সাধু রানার সঙ্গে। আজকাল পিতামহের মত রানার সঙ্গে মধুর হেসে, সস্নেহে কথা বলেন অলিভিয়ের। কিন্তু তাতে কী, প্রতিদিন মারাত্মক সব চাল দিয়ে ওর বারোটা বাজাতে একটুও কসুর করছেন না তিনি। এই মুহূর্তে নিজের রানিকে বাঁচাতে ব্যস্ত রানা। বিশপ ঘাড়ের কাছে এনে হুমকি দিচ্ছেন যুদ্ধবাজ সাধু। বিপদ বুঝে রানি পিছিয়ে নিল রানা। এতে তলিয়ে যাবে ওর নৌকা। যাক, কিছুই করার নেই। প্রতিপক্ষের সঙ্গে অলিভিয়ের গুটিগুলো বড়ই নিষ্ঠুর ও হিংস্র আচরণ করে।

‘আগামীকাল শহরে বিয়ার পৌঁছে দিচ্ছ বলে অনেক ধন্যবাদ, রানা,’ বলতে বলতে ওর নৌকাটা তুলে নিয়ে সেখানে নিজের হাতি বসালেন সাধু। সাধের নৌকা গেল বোর্ডের পাশে। ওখানে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রয়েছে রানার বেশিরভাগ গুটি।

বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনোকষ্ট ভুলতে চাইল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘ফাদার, আজ, অদ্ভুত একটা জিনিস দেখেছি। মঠের নিচে গোপন এক ঘর। বিশাল। ওখানে তুলে দেয়া হয়েছে ইঁটের দেয়াল।’

দাবার বোর্ড থেকে মুখ তুলে রানাকে দেখলেন সাধু। কয়েক মুহূর্ত পর নিচু করে নিলেন মুখ। নরম স্বরে জানতে চাইলেন, ‘বলো তো, রানা, কেন গিয়েছিলে ওখানে?’ নিস্পৃহ তাঁর চেহারা।

‘নানান করিডোরে ঘুরতে গিয়ে পৌঁছে যাই,’ বলল রানা। জন পিয়েরের কথা উচ্চারণও করল না। ‘ভাবছিলাম, আগে ওখানে কী ছিল। আপনি কি কিছু জানেন?’

‘প্রায় হাজার বছর হলো ওখানে কিছু রাখা হয় না,’ বললেন অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড।

‘আমারও তা-ই ধারণা,’ কয়েক ঘর পিছিয়ে রানি দিয়ে সাদা রাজার ওপর হামলা করতে চাইল রানা। ‘ওখানে পুরু ধুলো আর মাকড়সার জাল। এ ছাড়া পেয়েছি অস্বাভাবিক একটা জিনিস। মানুষ নিয়মিত ওখানে গেলে ওটা থাকত না।

সাধু জানতে চাইলেন না জিনিসটা কী।

রানা বুঝল: ও কী দেখেছে, তা তিনি জেনে গেছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল রানা, ‘বোধহয় এই মঠের আছে দীর্ঘ ইতিহাস।’

‘কথা ঠিক,’ দাবার বোর্ড থেকে চোখ তুললেন না সাধু।

‘নানাদিকে অসংখ্য সুড়ঙ্গ। কৌতূহল জাগে ওগুলো কোথায় গেছে। হয়তো নিচে আছে এমন সব ঘর, যেগুলো আপনারাও দেখেননি।

‘না, ছিল মাত্র একটাই ঘর,’ অস্বস্তি নিয়ে রানাকে দেখলেন সাধু। তুলে ঠিক জায়গায় রাখলেন সাদা ঘোড়া। তাতে রানার আক্রমণ তো নস্যাৎ হলোই, না পিছিয়ে উপায় থাকল না ওর। ‘আমি অনুরোধ করব, আর কখনও যাবে না ওদিকে।’

‘জায়গাটা বিপজ্জনক? ধসে পড়তে পারে, তাই তুলে দেয়া হয়েছিল দেয়াল?’

নীরবে রানাকে দেখলেন সাধু, তারপর প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘ওটা এমন জায়গা, যেটার কথা ভুলে যাওয়াই ভালো।

রানার মনে হলো, আরও কিছু জিজ্ঞেস করলে বিব্রত হবেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত পর বলল ও, ‘আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত।’

‘ওই ঘরের কথা তোমার জানার কথা নয়, বাছা, ‘ বললেন সন্ন্যাসী। ‘প্রতিটি জায়গার থাকে অতীত গোপন ইতিহাস। সেগুলো কখনও কখনও ভুলে যাওয়াই ভাল।’

একটু ঝুঁকে বসল রানা। ‘গোপন ইতিহাস?’

‘ওখানে হয়তো রয়েছে শত শত বছর আগের প্রেতাত্মা। তাদেরকে বিরক্ত না করাই মঙ্গল।’

‘ভূত বা প্রেতাত্মা আছে, তা বিশ্বাস করি না, ফাদার।’

‘তবুও তারা আছে,’ মৃদু হাসলেন সাধু। ‘যখন-তখন ক্ষতি করতে পারে। যেমন তোমার অতীত স্মৃতি। সেগুলো কিন্তু ঠিকই কষ্ট দেয় তোমাকে।

‘কিন্তু সেগুলো তো আর ভূত নয়, ফাদার।

‘তা ঠিক। তবে অতীতের লজ্জাজনক ঘটনা ঠিকই কষ্ট দেয় মানুষকে। স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চাইলে কখনও মেলে পরিত্রাণ।’

রানার মনে হলো, ওর জীবনের সব দুঃখের চেয়েও অনেক গভীর কোনও কষ্ট আছে ফাদার অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ডের মনে। সে বিষয় তুলে সাধুকে বিমর্ষ করে তুলেছে ও। বহুকাল আগে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছিল এ মঠে। তবে তা নিয়ে একটা কথাও বলবেন না সাধু। চোখে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা।

বোর্ডের দিকে চেয়ে বললেন তিনি, ‘চেক!’

চমকে উঠল রানা।

.

পরদিন ভোরের একটু আগে শুরু হলো ঝরঝর বৃষ্টি। ব্যায়াম শেষ করে জানালা দিয়ে দূরে তাকাল রানা। পাথুরে উঠানে ঠাস্-ঠাস্ শব্দে পড়ছে বরই সাইযের শীতল ফোঁটা। একটু

আগে সাধুর জোব্বা খুলে কালো জিন্সের প্যান্ট ও ডেনিম শার্ট পরেছে রানা। পায়ে গলিয়ে নিল বুট জোড়া। ফিতা বেঁধে সোজা হয়ে শার্টের ওপর চাপিয়ে নিল বাদামি চামড়ার জ্যাকেট। সবুজ ব্যাগ হাতে বেরোল ছোট্ট ঘর ছেড়ে। শুনেছে মঠের পাথুরে বাড়ির উঁচু দেয়ালের ওদিকের আস্তাবলে রয়েছে ট্রাক। ঘোড়াশালে ঢুকতেই শুনল, ওস্তাদ জাকির হোসেনের কায়দায় ছাতে তুমুল তবলার বোল তুলেছে খেপা বৃষ্টির ফোঁটা। কয়েক দিকের বড় ফুটো দিয়ে পড়ছে মোটা জলধারা। ভিজে গেছে মেঝের খড়। রানার উপস্থিতি টের পেয়ে বিরক্তি নিয়ে জেগে গেল এক বেড়াল। আপত্তির চোখে বেয়াদব লোকটাকে দেখে নিয়ে আরেক দিকে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

ট্রাকের পেছনদিক তাক করা দরজার দিকে। গতকাল হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছে বলে ট্রাকটা আর দেখতে আসেনি রানা। এবার ওটাকে ঘিরে দুই চক্কর কাটল। একটা লাথি দিল পেছনের চাকায়। টিউবের ভেতর বাতাস আছে। হয়তো ট্যাঙ্কেও কিছুটা রয়ে গেছে ছয় মাস আগের ডিজেল। পেট্রলের মত চট করে উবে যায় না ওই জিনিস। কেন যেন ওর মনে হলো, নাহ্, ভোগান্তি আছে আজ। রাস্তায় চলবে না এই প্রাচীন ট্রাক। কিংবা হঠাৎ মাঝরাস্তায় থেমে দাঁড়িয়ে গোঁ ধরবে, স্টার্টই নেবে না।

তবে মঠের মত অত পুরনো নয় ট্রাকটা। পেছনের কাঠের তক্তা ঘুণে ধরা। এখানে-ওখানে ফুটো। বয়সের ভারে গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়েছে সবুজ ট্রাকের। বহুবার সেলাই করা হয়েছে পেছনের ছেঁড়া ক্যানভাস। গাড়িটা উনিশ শ’ ছাব্বিশ সালের আট টনী লং-হুইল বেয সিত্রোঁ। বহুকাল

আগে কোম্পানির মালিক আদর করে নাম দিয়েছিলেন: বেলফেগর। ক্যাবে উঠে আনমনে ভাবল রানা: সাধুরা নিশ্চয়ই জানেন, তাঁদের এই একমাত্র বাহনটির নাম রাখা হয়েছে নরকের কুখ্যাত সাত রাজপুত্রের একজনের নামে? সে শয়তানের কাজই মানুষকে অলসতা ও ছলচাতুরী শিখিয়ে নষ্ট করা। কে জানে, এজন্যেই হয়তো ড্রাইভিং শিখতে আগ্রহী হয়নি সাধুরা!

জিনিসটা জাদুঘরে রাখা উচিত। নব্বই বছর আগের মিলিটারি হাফ-ট্রাকের ক্যাবের মতই ট্রাকের সামনে পেটা লোহার ড্যাশবোর্ড। ওটার বুক থেকে উঠেছে স্টিয়ারিং হুইল, যেটা প্রায় জাহাজের হুইলের সমান। কিন্তু ইগনিশনে প্রথমবার চাবি মুচড়ে দিতেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। বিরতি নেই ঘড়ঘড় শব্দের ভেতর। ভারী ক্লাচ চেপে দীর্ঘ গিয়ারস্টিক জায়গামত নিল রানা। ঠিকভাবে তেল দেয়া হয় গিয়ারবক্সে। বড় কোনও সমস্যা পেল না ও। বিড়বিড় করল, ‘চলো, দাদু, ঘুরে আসি। মাঝপথে আবার বেঁকে বোসো না, প্লিয!’

পিছিয়ে যেতেই ঘড়ঘড় আওয়াজে আস্তাবল থেকে বেরোল রঙ-চটা সবুজ দানব। বেশ ক’বার হুইল ঘুরিয়ে সামনে-পেছনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কাঠের গেটের দিকে ট্রাক তাক করল রানা। বৃষ্টির মধ্যে গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছে দুই সাধু। উইণ্ডস্ক্রিন ওয়াইপারের সুইচ খুঁজে নিয়ে চালু করল রানা। দুলতে দুলতে গেট পার হয়ে রাস্তায় উঠতেই পেছন থেকে হাত নাড়ল সাধুরা।

জবাবে হাত নাড়ল রানাও। বামে ঘুরিয়ে নিল ভারী স্টিয়ারিং হুইল। গ্যাস পেডালে চাপ দিয়ে চলল ব্রায়ানকন শহরের দিকে।

‘দাদু, এখন রইলাম শুধু তুমি আর আমি,’ ট্রাকের উদ্দেশে বিড়বিড় করল রানা, ‘আমাকে ডুবিয়ে কী লাভ হবে তোমার?’ ওর স্থির বিশ্বাস ভজকট কিছু একটা ঘটবেই।

কী ঘটবে জানলে ভুলেও মঠ ছেড়ে বেরোত না রানা।

সাত

সারারাত সতর্কতার সঙ্গে সুইটয়ারল্যাণ্ড থেকে আঁকাবাঁকা, জটিল পথে ইতালির আল্পসের দিকে চলেছে আর্টিকুলেটেড ভলভো লরি। ভোরের আলো ফুটতেই রন্দেভু পয়েন্টে পৌঁছে গেছে ড্রাইভার। অনেক হিসাব-নিকেশ করে স্থির হয়েছে, তারা দেখা করবে অ্যালপাইনের টরে পেলিস শহরের বাইরে উঁচু দুটো টিলার মাঝে পাথর ও ধুলো ভরা মালভূমিতে। মাত্র সাতচল্লিশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে টরিনো শহর। ওখান থেকে পনেরো কিলোমিটার গেলেই ইতালি ও ফ্রান্সের সীমান্ত। ডানে চূর্ণ নুড়িপাথরের ষাট ফুটি এক জায়গায় থামল বিশাল লরি। একটু দূরেই নির্জন রাস্তা। এত ভোরে হয়তো এদিকে আসবে না কেউ। নুড়ি ভরা জমির সামনে-পেছনে ফাঁকা জায়গা রেখে থেমেছে লরির ড্রাইভার। ডিজেল ইঞ্জিন বন্ধ করে সিটে হেলান দিল সে। ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে নিল কড়া কফি। কালো তরলে চুমুক দিয়ে অপেক্ষা করবে পরবর্তী নির্দেশের জন্যে।

তার নাম পোল ল্যাণ্ডেনবার্জার। কিছুক্ষণ পর রন্দেভুতে এসে পৌঁছল আরও তিনটে ভেহিকল। প্রতিটি কালো রঙের রেঞ্জ রোভার। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ধুলোয় ধূসরিত। লরি ও ওগুলোকে বাদ দিলে ফাঁকা পড়ে আছে সড়ক। লরির সামনে গিয়ে থামল তিন গাড়ি। জিপগাড়িগুলো থেকে নামল চারজন করে যাত্রী। সবমিলে এগারোজন পুরুষ ও এক যুবতী। মাঝের রেঞ্জ রোভার ড্রাইভ করে এনেছে মেয়েটা। অন্যদের চেয়ে বয়সে কম সে।

সামাজিক অনুষ্ঠানে আসেনি এরা। কাজেই তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে লরি থেকে নামল না পোল। অন্যদের ভেতরেও কোনও আলাপ হচ্ছে না। প্যাকেট থেকে নিয়ে সিগারেট জ্বালল ক’জন। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার ধারে। অন্যরা হেলান দিল গাড়ি বা লরির গায়ে। ভোরেই সূর্য বিলাতে শুরু করেছে উজ্জ্বল সোনালি রোদ। প্রায় সবার চোখে কালো সানগ্লাস। পরনে আরামদায়ক পোশাক: জিন্স ও টি-শার্ট। অবশ্য যুবতীর পরনে চামড়ার জ্যাকেট, প্যান্ট, পায়ে কমব্যাট বুট। মাথার চুল গুঁজে নিয়েছে বেসবল ক্যাপের ভেতর। কেন যেন তার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে না কেউ। হেলমুট হাইনরাইনার বা পাওলো গুয়েডিনেটির মতই একই কাজের জন্যে এখানে এসেছে সে। পনেরো সালে হেলমুট হাইনরাইনার বা পাওলো গুয়েডিনেটির সঙ্গে গিয়েছিল উত্তর কোরিয়ায় সেই বিপজ্জনক মিশনে। এখনও হাইনরাইনারের বাম গালে রয়ে গেছে বুলেটের বিশ্রী শুকনো ক্ষত। আরেকটু হলে মরতে বসেছিল সে। দলে অন্যরা নতুন। যেমন উইলিয়াম গান, ক্যাযিটি ওয়াকেলেক, ইংল্যাণ্ডের লোক পল হার্ভার্ট বা নতুন সদস্যা সিলভিয়া রথচাইল্ড। দলে সঞ্চালিত করা হচ্ছে নতুন রক্ত। তবে ভালভাবে খোঁজ না নিয়ে দলে ভিড়তে দেয়া হয় না কাউকে। মনে দ্বিধা এলে নেতা বাদ দিচ্ছে সন্দেহজনক যে কাউকে। এ ছাড়া উপায়ও নেই তার।

আঠারো মিনিট পর সবাই শুনল হেলিকপ্টারের রোটরের ধুব-ধুব আওয়াজ।

‘পৌঁছে গেছে,’ বলল হেলমুট হাইনরাইনার।

হাত থেকে সিগারেট ফেলল ধূমপায়ীরা। কেউ কেউ হাত বের করল পকেট থেকে। লরির ক্যাবে তাড়াহুড়ো করে কফি শেষ করল পোল ল্যাণ্ডে বার্জার।

হেলিকপ্টারটা বেল কোম্পানির চার শত ঊনত্রিশ- ডাব্লিউএলজি। নিচে অস্বাভাবিক ল্যাণ্ডিং গিয়ার। রাস্তায় নেমে গাড়ির মত এগোতেই সূর্যের সোনালি আলোয় মনে হলো কপ্টারটা সাদা বজ্র-ঝিলিক। রোটরের ঝড়ের মত প্রবল হাওয়ায় ক’পা পিছিয়ে গেল সবাই। চারদিকে উড়ছে ধুলো ও কাঁকর। মাথায় ক্যাপ চেপে ধরে চুল উড়ে যাওয়া ঠেকাল সিলভিয়া রথচাইল্ড। রাস্তা ছেড়ে ডানে সরল হেলিকপ্টার। ওদিকেই আর্টিকুলেটেড ভলভো লরি। আরও কমল রোটরের গতি। দলনেতাকে স্বাগত জানাতে জড় হলো সবাই।

ককপিট থেকে নামল হালকা দেহের ডেইটার গিসেল। পরনে নিভাঁজ পোশাক। সাদা শার্ট, আর্মানি জিন্স, চোখে এভিয়েটর রে-ব্যান। চল্লিশ বছর বয়সী লোকের তুলনায় যথেষ্ট ফিট সে। অন্যরা দেখল, রোটরের হাওয়ায় তার উঁচু কপালে উড়ছে পাকা কিছু ধূসর চুল।

কপ্টার থেকে নামল গিসেলের বহু বছরের প্রেমিকা ডেইযি বাস্‌। পরনে কালো কমব্যাট জ্যাকেট। সরু পায়ার কালো প্যান্ট। মাথার চুল এতই সোনালি, যে-কেউ ভাববে ওগুলো ধবধবে সাদা। ছাঁট দিয়েছে কদম ফুলের মত। চোখে হিংস্রতা, নীচতা ও নিষ্ঠুরতা। নতুনদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে: ভুলেও ঘাঁটাবে না ডেইযি বাকে। নিজে থেকে কথা তো বলবেই না, এমন কী চোখও রাখবে না তার ধূসর দুই চোখে। ডেইযি বাসের দিকে কেউ চাইলেও প্যাথোলজিকাল জেলাসিতে ভোগে ডেইটার গিসেল। ফলাফল: অবশ্যই মরতে হয় লোকটাকে।

সবার উদ্দেশে মাথা দুলিয়ে ডেইটার বুঝিয়ে দিল, দলের নেতা আসলে সে। ক’পা হেঁটে থামল লরির ক্যাবের পাশে। তার উদ্দেশে হাত নাড়ল পোল ল্যাণ্ডে বার্জার। বসের হাতের ইশারায় টিপে দিল ক্যাবের একটা সুইচ। খির-খির আওয়াজে নামতে লাগল লরির পেছন দরজা। ওটাকে পোক্ত করেছে শক্তিশালী দুটো হাইড্রলিক র‍্যাম। স্টিলের পাত মাটিতে নামতেই সবার চোখ গেল লরির ট্রেইলারের ভেতর।

র‍্যাম্প বেয়ে ট্রেইলারে হারিয়ে গেল হাইনরাইনার। স্টিলের মেঝেতে খট খট শব্দ তুলছে বুট জুতো। মিনিটখানেক পর বদ্ধ জায়গায় গর্জে উঠল একটা শক্তিশালী ইঞ্জিন। ডেইটার গিসেল ও অন্যরা দেখল, ধীরে ধীরে নেমে আসছে দেখার মত এক ভেহিকেল।

কয়েক লাখ ডলার ব্যয় করে চোরাই মার্কেট থেকে কিনেছে এটা ডেইটার। নাম দিয়েছে ব্যাট-মোবাইল। বিএটিটি অর্থাৎ ব্যালিস্টিক আর্মার্ড ট্যাকটিকাল ট্র্যান্সপোর্ট। দেখতে যেমন শক্তপোক্ত, তেমনি কাজের জিনিস। সোয়্যাট- টিম রেইডের জন্যে ম্যাসাচুসেটসের পিটবার্গে তৈরি করা হয়েছে লেনকো বিয়ারক্যাট। কালচে বডি, অনায়াসেই ঠেকিয়ে দেবে .৫০ ক্যালিবারের বুলেট বা ন্যাটোর আর্মার ভেদ করা ৭.৬২ রাউণ্ড। দু’দিকের দুই গানপোর্ট থেকে পাল্টা হামলা করতে পারবে তিনজন করে লোক। গিসেল ভেবেছে, দরকারে ছাতে সেট করে নেবে মেশিন গান টারেট। সে ব্যবস্থা আছে এ গাড়িতে। তবে রাস্তায় বেরোলে চোখে পড়বে সবার। তাই ঠিক করা হয়েছে, শুধু জরুরি মিশনে ব্যবহার হবে ওটা।

সত্যিকারের অ্যাসল্ট ভেহিকেল। নিচে ও চারপাশের আর্মার প্রায় অভেদ্য। কিছুই হবে না সাধারণ ল্যাণ্ড মাইন বিস্ফোরণে। বিপদ হলে ছয় লিটারের ভি৮ টার্বো-ডিজেল ইঞ্জিন ব্যবহার করে দ্রুত সরে যাবে ড্রাইভার। গাড়ির সামনে রয়েছে ব্রিচিং র‍্যাম। ভীষণ পুরু স্টিলের বাফার। আঠারো ইঞ্চি কংক্রিটের দেয়াল ভেঙে ঢোকা ওটার জন্যে সহজ কাজ। বাধ্য না হলে তার দলের কাউকে ঝুঁকির ভেতর ফেলে না গিসেল।

‘কী বুঝলে?’ প্রেমিকার দিকে তাকাল গিসেল।

কোমরে হাত রেখে মাথা দোলাল ডেইযি বাট্স্।

গাড়িতে রয়েছে পর্যাপ্ত অস্ত্র। এ ছাড়া আছে স্পেশালাইজ্ড কিছু ইকুইপমেণ্ট। বেআইনিভাবে এসব জোগাড় করতে গিয়ে খরচ করতে হয়েছে লাখখানেক ডলার। তাতে কিছুই যায় আসে না গিসেলের। টাকার অভাব নেই তার। মূল কথা উদ্দেশ্য পূরণ হওয়া। আজই হয়তো পাবে সারাজীবনের স্বপ্নের সেই জিনিস। আর সেটা পেলেই শুরু হবে ওর মিশনের দ্বিতীয় পর্যায়।

মাত্র ক’মাইল দূরেই ওই জিনিস। এমন নয় যে খুব কঠিন হবে এ মিশন। পনেরো সালের সেই রেইডের কথা মনে রেখেছে গিসেল। ওটা থেকে কঠিন শিক্ষা নিয়েছে সে। তা ছাড়া, এবারে আর বাধা দেয়ার মত কেউ নেই।

নিজেকে সত্যিকারের জিনিয়াস মনে হচ্ছে তার। প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছে। একটা একটা করে গিঁঠ দিয়েছে আলাদা সব সুতোয়। অন্য কেউ এভাবে তিলতিল করে এগোতে পারত না। আর সেজন্যেই নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে সে সামনে।

র‍্যাম্প থেকে নেমে এল বিয়ারক্যাট। সরে গেল লরি থেকে। লরির পেছনে এসে থামল হেলিকপ্টার। কালো রেঞ্জ রোভার থেকে ইকুইপমেন্ট নিয়ে কাজে নামল জেন্স রোভার্স ও মাইকেল ব্রেসলিন। স্পেশাল হাই-প্রেশার স্প্রে ছড়িয়ে দিতেই মুহূর্তে শীতল হলো একটু আগের উত্তপ্ত রোটর। বিশেষ রেঞ্চ ব্যবহার করে কয়েক মিনিটে খুলে নেয়া হলো হেলিকপ্টারের পাখা। এখন ট্রেইলারে ঢুকতে পারবে যান্ত্রিক ফড়িঙ। একপাশে রাখা হবে আলগা রোটর। অন্যরা মিশন থেকে ফেরা পর্যন্ত লরি পাহারা দেবে পোল ল্যাণ্ডেনবার্জার। তার যেন সমস্যা না হয়, সেজন্যে যথেষ্ট খাবার ও পানির ব্যবস্থা করেছে গিসেল। কেউ ঝামেলা করতে পারে, তাই হাতে দিয়েছে নাইন মিলিমিটারের পিস্তল ও কয়েকটি ম্যাগাযিন। দলের সবাই জানে, সবকিছু না বুঝে কাজে নামে না ডেইটার গিসেল। শান্ত চেহারাগুলো দেখে নিয়ে বলল সে, ‘তোমরা জানো, কী করতে হবে।’

মাথা দোলাল কয়েকজন।

বিয়ারক্যাট থেকে নেমে ঘোঁত শব্দে সায় দিল হেলমুট হাইনরাইনার।

কালো তিন রেঞ্জ রোভারের দিকে ইশারা করল ডেইটার গিসেল। ‘এবার চলো, দেখা যাক কী পাওয়া যায়!’

আট

সর্পিল পথে ট্রাক নিয়ে এগিয়ে চলেছে মাসুদ রানা। মাঝে মাঝে দু’পাশে পাহাড়ি বুনো ফুলের শোভা। কোথাও কোথাও হাজার হাজার ফুট নিচে গভীর খাদ। রানা এরই ভেতর বুঝে গেছে, ওর ট্রাকের স্টিয়ারিং হুইলটা আগের জন্মে ছিল তুখোড় রাজনীতিবিদ। যতই তাকে এদিক-ওদিক সরানোর চেষ্টা করা হোক, পারতপক্ষে নড়বে না সে। আর এ কথা বোঝার পর থেকে তীক্ষ্ণ বাঁক আসার আগেই গতি কমিয়ে নিচ্ছে রানা। ওদিকে ব্রেকটাও ঠিকভাবে কাজ করছে না। বর্ষণমুখর রাস্তায় পিছলে যেতে চাইছে ক্ষয়ে যাওয়া নেড়া চাকা। অতি ভারী বিয়ারের ব্যারেলের জন্যে এদিক-ওদিক দুলে সরে যেতে চাইছে সাসপেনশন। একটু জোরে বাঁক নিলে কাত হয়ে ধুম করে রাস্তায় আছাড় খাবে ট্রাক। তবে সাধুদের জন্যে কিছু করতে পারছে বলে রানা খুশি।

কয়েক মাইল যাওয়ার পর থেমে গেল বৃষ্টি। ছেঁড়া সব মেঘের মাঝে উঁকি দিল সূর্য। এতক্ষণ খটারখট্ আওয়াজে চলছিল ওয়াইপার। ওটার সুইচ বন্ধ করে দিল রানা। খুলে দিল জানালা। হু-হু করে এল পাহাড়ি শীতল হাওয়া। সন্ন্যাসীদের মঠে ছিল নিশ্চিন্ত জীবন। এখন চলেছে শহরের জটিলতার দিকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে রানার মনে। গভীর মনোযোগে ড্রাইভ করতে লাগল ও।

পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে সোনালি রোদে বিছিয়ে থাকা মনোমুগ্ধকর সব সবুজ উপত্যকা। মাত্র চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে গেল গন্তব্যের কাছে। কয়েকবার বাঁকা, ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে ঢুকে পড়ল ব্রায়ানকন শহরে। মন ফুরফুর করছে বলে বেলফেগর দানবটাকেও মন্দ লাগছে না এখন আর।

শহরে ঢুকে শার্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজ নিয়ে চোখ বোলাল রানা। ওটাতে রয়েছে পথের দিশা। পেছনে পড়ল ব্রায়ানকন শহরের ঐতিহাসিক এলাকা। ওদিকটা রোমান আমলের ব্রিগান-টিয়ামের মতই পুরনো। পরে দক্ষিণ-পশ্চিমে বেড়েছে আধুনিক শহর। কিছুক্ষণ পর মূল শহর এড়িয়ে পুব দিয়ে ছোট একটা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে ঢুকল রানা। ওর কপাল ভাল, রাস্তায় ভিড় নেই। নইলে বারবার প্রাচীন ক্লাচ টিপতে গিয়ে বারোটা বাজত জিনিসটার। তুষার নেই বলে এখন ভিড় নেই স্কিয়ারদের। শহর প্রায় ফাঁকা। রানা শুনেছে জনসংখ্যার তিনগুণ টুরিস্ট আসে এখানে। পাত্তা দেয় না প্রায় প্রতিদিনের তুষারঝড়।

গন্তব্যের দিকে যেতে যেতে একটা হাসপাতাল পেছনে ফেলল রানা। পিছনে পড়ল পার্ক। একটু দূরেই বিশাল এক সুপারমার্কেট। তারপর এল ছাড়া-ছাড়াভাবে তৈরি কয়েকটি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল দালান। পাশেই গাড়ি মেরামতের ছোট এক গ্যারাজ। আরও এগিয়ে রানা পেল সবুজ স্টিলের গেট। চারপাশে তারকাঁটার বেড়া। ভেতরে কংক্রিটের বিশাল উঠানে এক রেনও ট্রাক ও একটি রুপালি রঙের বিএমডাব্লিউ গাড়ি। গাড়ির ফোরে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাছা মোটা, বেঁটে হাতির মত এক লোক। ট্রাকের পাশেই চিকন তিন তরুণ। এই দলের কয়েক গজ দূরে ট্রাক থামাল রানা। হ্যাণ্ডব্রেক টেনে অফ করল ইগনিশন। থরথর করে কেঁপে উঠে নীরব হলো বেলফেগরের আত্মা।

ক্যাব থেকে নামতেই খর রোদে চোখ কুঁচকে গেল রানার। দেখল, দুলতে দুলতে আসছে বালিরঙা চুলের মোটা লোকটা। তার পেছনে দিগন্তে নীলচে পর্বত ও সবুজ টিলার কোলে সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় হীরার মত ঝলমল করছে শহরের ছোট সব সাদা বাড়ি ও শ্যালে।

মোটা লোকটাকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলল রানা, ‘আপনিই বোধহয় মোসিউ অ্যাব্রাহাম?’ ধরে নিয়েছে মঠের বিয়ার সংগ্রহ করতে তাকে পাঠানো হয়েছে ডিসট্রিবিউশন কোম্পানি থেকে।

‘বরাবর যে ফ্রায়ার আসেন, তাঁকে দেখছি না,’ রানাকে বলল লোকটা।

‘তাঁর বদলে এসেছি আমি,’ বলল রানা।

ওরা হাত মেলাবার পর বেলফেগরের পেছন থেকে বিয়ারের ব্যারেল নামাতে লাগল তিন তরুণ। তুলে দিচ্ছে রেনও ট্রাকে। এদিকে কয়েকটা কাগজ বনেটে বিছিয়ে দিল এসেলেট অ্যাব্রাহাম। কাগজপত্র সব ঠিক আছে দেখে নিয়ে সই করল রানা। ফিরিয়ে দিল ফর্মগুলো। চওড়া হাসি দিয়ে মোটা এক ফোল্ডারে সব রাখল অ্যাব্রাহাম। টান দিয়ে খুলল গাড়ির বুট। রানাকে বলল, ‘বেশ গরম, কী বলেন?’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ভাবছে, কয়েক পাউণ্ড ওজন কমে গেলেও এর কিছুই হবে না। গাড়ির পেছনের কুলার থেকে বরফের মত ঠাণ্ডা কয়েকটা ক্রোনেনবর্গ বিয়ার বের করল সে। একটা বাড়িয়ে দিল রানার দিকে।

আরেকবার মাথা নাড়ল রানা। ‘অতটা গরম লাগছে না।’ কিছুক্ষণ পর বেলফেগরের বিয়ারের সব ব্যারেল গেল রেনও ট্রাকের পিঠে। দেরি না করে রওনা হলো মালবাহী গাড়িটা। বিএমডাব্লিউতে চেপে পিছু নিল এসেলেট অ্যাব্রাহাম।

দায়িত্ব পালন হলো, এবার ফিরতে হবে সন্ন্যাসীদের মঠে। বেলফেগরের ক্যাবে উঠল রানা, তবে ইগনিশনে চাবি মোচড় দিতেই… কিছুই ঘটল না!

আবারও চেষ্টা করল রানা।

ফলাফল আগের মতই।

সেরেছে! ওকে পথে বসিয়ে দিয়েছে বেলফেগর দানব। হয় ফুরিয়ে গেছে ব্যাটারির পাওয়ার, নইলে ত্রুটি দেখা দিয়েছে পুরনো ট্রাকের ইলেকট্রিক তার বা আর কিছুতে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও ক্যাব থেকে নামল রানা। খুলল বনেট। ভেতরে ধুলো ও মোবিলে ভরা প্রাচীন সব তার। উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নেই বলে বোঝা যাবে না নষ্ট হয়েছে কী জিনিস।

তবুও হাল ছাড়ল না রানা। আগেই দেখেছে ক্যাবের পেছনে রয়েছে জং ধরা তোবড়ানো টুল লকার। ওটা দৈর্ঘ্যে চার ফুট, চওড়ায় দুই ফুট। ফ্ল্যাটবেডে উঠে লোহার বাক্সের সামনে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল রানা। দুই হাতের আট আঙুল দিয়ে খুলতে চাইল ডালা। কিন্তু পুরনো রঙ ও জঙে জ্যাম লেগে গেছে ওটার কবজা। প্রাণপণে টান দেয়ায় বিদঘুটে ক্যাচ-ক্রচ্ আওয়াজে খুলল ডালা। ভেতরে চেয়ে যে জিনিস দেখল রানা, মন থেকে উবে গেল ট্রাক মেরামতের আগ্রহ। বাক্সে রয়েছে রিমুভেবল একটা কম্পার্টমেন্ট। সেটার পেটে শুয়ে আছে বেশ কয়েকটা স্প্যানার। তবে ওর মনে হলো, গত পঞ্চাশ বছর ওগুলো ছিল কাদা ভরা কোনও নদীর নিচে। কোনও জ্যাক নেই নিচের কম্পার্টমেন্টে। টায়ার আয়ার্ন বা হুইল-নাট রেঞ্চও উধাও। দরকারি জিনিসপত্রের বদলে ওখানে রয়েছে গ্রিস মাখা একগাদা দড়ি ও একটা বোল্ট ক্রপার।

কাজে আসবে না এসব জঞ্জাল। পাহাড়ি মঠে টেকনোলজির প্রয়োজন নেই, কিন্তু সভ্য জগতে চাই মোবাইল ফোন। কিন্তু সেটা নেই রানার কাছে। পকেটে শুধু রয়ে গেছে মানিব্যাগ ও প্রধান সাধুর দেয়া সেই বোতল। আরেকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। আর তখনই মনে পড়ল, আসার পথে দেখেছে গাড়ি মেরামতির গ্যারাজ। দেরি না করে মেকানিক ডাকতে ফিরতি পথে রওনা হলো রানা।

মাত্র দশ মিনিটে পৌঁছে গেল গন্তব্যে। হেড মেকানিক হাসিখুশি মানুষ। রানা দু’চার কথায় পরিস্থিতি খুলে বলতেই মাথা দুলিয়ে সায় দিল সে। গায়ের ওভারঅলে কালো গ্রিস থাকলেও মনটা তার পরিষ্কার। পরের পাঁচ মিনিটের ভেতর বেলফেগরকে টেনে আনতে রওনা হলো সে টো ট্রাক নিয়ে। পাশেই প্যাসেঞ্জার সিটে রানা। একটু পর ট্রাকটা দেখে বিশাল চওড়া এক হাসি দিল মেকানিক। ভার দেখে মনে হলো বাবার জন্মেও এত পুরনো গাড়ি দেখেনি। কথাটা বোধহয় ঠিক, ভাবছে রানা। কিছুক্ষণ ইঞ্জিন ও ইলেকট্রিকাল তার ঘাঁটাঘাঁটি করে মাথা দোলাল লোকটা। ‘বুঝলাম। পুড়ে গেছে পুরো ইলেকট্রিকাল সিস্টেম।’

‘এখন কী করতে হবে?’ জানতে চাইল রানা।

‘আগে চলুন, ট্রাক নিয়ে গ্যারাজে যাই।’

একটু পর টো ট্রাকের লেজে বেলফেগরকে বেঁধে মেরামতির কারখানায় ফিরল রানা। গাড়ি থেকে নামতেই ওকে উঠানের একদিকের এক ধ্বংসস্তূপ দেখাল মেকানিক। ‘ওটাও বেলফেগর। ওটা থেকে পাব যন্ত্রপাতি আর দরকারি তার।’

রানার অভিজ্ঞতা বলছে, মেরামত হবে বেলফেগর। তবে তাতে লাগবে অন্তত আট থেকে বারো ঘণ্টা। অর্থাৎ, কপাল ভাল হলে আগামী ভোরের আগেই ফিরতে পারবে মঠে। সেটাই জানতে চাইল ও, ‘কতক্ষণ লাগবে মেরামতিতে?’

‘অন্তত বারো থেকে চোদ্দ ঘণ্টা,’ বলল হেড মেকানিক। মঠের সন্ন্যাসীদের, ফোন নেই, চাইলেও যোগাযোগ করতে পারবে না রানা। নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তায় পড়বেন তাঁরা। তবে সেটা খুব বেশি নয়। প্রার্থনায় বসে ভুলে যাবেন দুনিয়াদারির সব। তাঁরা একটি বিষয়ে সবাই একমত: সবই চলে স্রষ্টার আঙুলের ইশারায়। কাজেই উচিত নয় চিন্তা করা।

গ্যারাজের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে শহরের দিকে পা বাড়াল রানা। তিরিশ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেল মূল শহরে। প্রধান সাধুর দেয়া খুদে বোতলের তরলে কয়েক চুমুক দিলেও তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে ওর। খিদেও লেগেছে ভীষণ। ছোট্ট বোতল পকেটে রেখে মানিব্যাগ খুলে দেখল, যা ভেবেছে, তাই- সরানো হয়নি এক পেনিও। মানিব্যাগে যত ইউরো আছে তা দিয়ে অর্ধেক রেস্তোরাঁ কিনতে পারবে ও।

ব্রায়ানকন শহরটা সত্যিই দেখার মত। পুরনো অংশে রয়েছে দুর্গের মত সব দেয়াল। অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীর হামলা থেকে রক্ষা পেতেই এমন করেছিল শত বছর আগের মানুষ। ধূসর পাথরের সরু, আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে চলেছে রানা। ওর চোখ খুঁজছে বিসট্রো বা স্যাণ্ডউইচ বার। রাস্তাগুলো বেশ ব্যস্ত। চারপাশে প্রায় সবকিছুই রঙিন। মানুষের তৈরি আওয়াজও মেলা।

সঙ্কীর্ণ এক পথে বাঁক নিয়েই রানা দেখল, সামনের রাস্তার একাংশ দখল করে পেতে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি টেবিল ও চেয়ার। এ ধরনের সাধারণ বিসট্রোই খুঁজছিল রানা। ঠিক করেছে, চট্ করে খিদে ও তৃষ্ণা মিটিয়ে সোজা হাজির হবে ইশতিয়াক আহমেদ ফারুকের আস্তানায়। কিছুদিন আগেও কথা হয়েছে ওদের। বরাবরের মতই বলেছিল, এদিকে এলে যেন ঘুরে যায় তার ওখান থেকে। কিন্তু সময়ের অভাবে আর দেখা করেনি রানা। আজকে এসেছে সেই সুযোগ।

বিসট্রোর সামনের টেবিলগুলোয় ট্রে হাতে প্রজাপতির মত উড়ছে এক ওয়েটার। একটু দূরের টেবিলে বসেছেন পাকা চুলের ক’জন টুরিস্ট। পাশের টেবিলেই খবরের কাগজে নাক গুঁজে দিয়েছেন মধ্যবয়স্ক এক লোক। পরনে সুট ও টাই। রানার মনে হলো, এ লোক স্থানীয় ব্যবসায়ী অথবা ব্যাঙ্কার। আরেকটু দূরের টেবিলে হাতে হাত রেখে বসেছে দুই যুবক-যুবতী। যুবক ব্যায়ামপুষ্ট, ভারী গড়নের। পরনে পোলো শার্ট ও জিন্স। মেয়েটির পরনে লাল ও নীল ফুলে কারুকাজ করা সালোয়ার-কামিয। পায়ে সুন্দর নীল স্যাণ্ডেল। রানার দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে মেয়েটা।

সামান্য দূরেই খালি এক টেবিল। ওটার দিকে পা বাড়াল রানা। আপাতত কোনও কাজ নেই। ঠিক করেছে, রাত পর্যন্ত বন্ধুর ওখানে সময় কাটিয়ে ফিরবে গাড়ির গ্যারাজে। এরপর ট্রাক নিয়ে ফিরবে সন্ন্যাসীদের মঠে। ক্যাফে টেরেসের দিকে এগোতেই হঠাৎ চমকে থেমে গেল রানা। গলার কাছে উঠে এল হৃৎপিণ্ড। একটু আগে যে মেয়েটাকে দেখেছে, তার মুখের পাশে এখন একরাশ কালো চুল। কাঁধে ছোট্ট জন্মদাগ!

হতবাক হয়েছে রানা।

ওই মেয়ের দৈহিক গড়ন ওর খুব চেনা।

সোহানা!!!

কী করছে এখানে!

দ্বিতীয়বার তাকাল রানা।

ভুল হচ্ছে না ওর।

সোহানা জানেও না কত কাছে দাঁড়িয়ে আছে রানা। অজান্তেই ক’পা এগিয়ে প্রেয়সীর কাঁধে হাত রাখল ও। তাতে ভীষণ কঠোর হলো সঙ্গী যুবকের মুখ। চোখ সরু করে দেখছে রানাকে। কী যেন বলবে, তার আগেই মুখ খুলল রানা, ‘সোহানা, তুমি এখানে?’

নয়

আঙুলে সোহানার কাঁধের কোমল, উষ্ণ ত্বকের স্পর্শ। বুকে বহু কথা জমেছে রানার। কিন্তু বলা হলো না কিছুই।

অবাক হয়ে ঘুরে ওকে দেখল মেয়েটা। কথা বলতে বলতে ছেড়ে দিয়েছে সঙ্গীর হাত।

অনেক মিল এ মেয়ের সঙ্গে সোহানার। তবে অমিলও আছে মেলা। চোখ নীল। নাকে লাল তিলের মত দাগ। বয়সেও তিন থেকে চার বছর বেশি। চোখে অভিযোগের দৃষ্টি।

নিজেকে উজবুক মনে হলো রানার। আস্তে করে সরিয়ে নিল হাত। ‘সরি, প্লিয, মাফ করবেন, ম্যাডাম। ভেবেছি আপনি আমার পরিচিত কেউ।’

আগুনের তাপ আরও বাড়ল মেয়েটার চোখে। ‘ম্যাডাম নই, মাদমোয়াযেল।’ বিবাহিত বলায় যেন খেপেছে সে।

‘সত্যিই, ভুল হয়ে গেছে, সরি,’ আরও নরম সুরে বলল রানা। বুঝে গেল, জড়িয়ে গেছে ঝামেলায়।

খড়-খড় শব্দে পেছনে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়েছে বিশালদেহী শ্বেতাঙ্গ যুবক। দৈর্ঘ্যে রানার চেয়ে অন্তত পাঁচ ইঞ্চি বেশি। বুকটা রানার চেয়ে দ্বিগুণ চওড়া।

সঙ্গী ভীষণ খেপে গেছে দেখে খুশি মেয়েটা। সে যেন যুবতী হরিণী, দেখতে চাইছে দুই মর্দার ভেতর কে উপযুক্ত।

অন্যরাও দেখছে যুবক ও রানাকে। খবরের কাগজ নামিয়ে রাখল ব্যবসায়ী। কথা থামিয়ে চুপ হয়েছে পাকা চুলের টুরিস্টরা। দুশ্চিন্তা নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল তারা।

‘আগেই সরি বলেছি,’ বলল রানা। দাঁড়িয়ে থাকার ভেতর হুমকির লক্ষণ নেই। ‘দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন। আপনাদের জন্যে ড্রিঙ্ক পাঠাচ্ছি।’

‘আমার প্রেমিকার গায়ে হাত দিয়েছিস তুই!’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল যুবক। ‘সেজন্যে হাতটা ভাঙব তোর!’

‘পরিচিত আরেকজনকে ভেবেছিলাম,’ এক পা পিছিয়ে গেল রানা। ‘সেজন্যে আন্তরিক দুঃখিত।’

‘নিজেকে কী ভাবিস, কেলে কুকুর?’ গর্জে উঠল যুবক। ‘কোত্থেকে এসেছিস তুই?’

‘সন্ন্যাসীদের মঠ থেকে,’ বলল রানা। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে মুখ।

বাঁকা হাসল শ্বেতাঙ্গ যুবক। ‘জোকারি করছিস, না?’ প্রেমিকাকে পাশ কাটিয়ে রানার দিকে এল সে। পাকিয়ে ফেলেছে মুঠোদুটো।

‘বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়,’ শেষ চেষ্টা করল রানা। ‘ভুল করেছি। সেজন্যে ক্ষমাও চেয়েছি…’

তার জন্যে লড়বে দুই পুরুষ, সেটা বুঝতে পেরে খুশিতে চকচক করছে মেয়েটার দুই চোখ।

ঘুষি মারার দূরত্বে পৌঁছে গেল যুবক। ‘পিটিয়ে হাড় ভাঙব তোর, শুয়োরের বাচ্চা!’

বিদ্যুদ্গাতিতে রানার দিকে এল ঘুষি। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল রানা।

যুবক শক্তিশালী, তবে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়ে এগিয়ে এসেছে দুই পা।

‘মারামারি ঠিক নয়,’ বলল রানা। ‘সুন্দর বিকেলটা নষ্ট করে লাভ কী?’

আরও খেপল যুবক। ধরে নিল প্রেমিকার সামনে অপমান করা হয়েছে তাকে। এল দ্বিতীয় ঘুষি। ওটা আগের চেয়েও মারাত্মক।

ওই ঘুষি লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগেই রানা বলল, ‘তুমি যে বোকা পাঁঠা, সেটা জানো?’ ঝট্ করে সরিয়ে নিয়েছে মুখ। পাল্টা হামলা না করে খপ্ করে ধরল যুবকের বাহু। আরেকটু হলে নাক ফাটত ওর। মারামারি চাইছে না। তবে রক্তাক্ত এবং আহত হয়ে সন্ন্যাসীদের মঠে ফেরার ইচ্ছেও নেই। যুবকের পুরু বহুি মুচড়ে ধরে তারই পিঠের দিকে নিল রানা। পরক্ষণে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে মুখ থুবড়ে ফেলল লোকটাকে।

‘যথেষ্ট, এবার ক্ষান্ত দাও, বলল রানা। ‘এটা প্রমাণিত হয়েছে যে তুমি খুব সাহসী।’

কিন্তু মেঝেতে পড়ে থাকতে রাজি নয় এই হিরো। তার প্রেমিকার কাঁধ স্পর্শ করে ভুল করেছে রানা, কিন্তু তার চেয়েও বড় ভুল করল সে নিজে। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। মেঝেতে পড়ে ফেটে গেছে নাক। কুলকুল করে রক্ত পড়ছে। ভিজে গেছে পোলো শার্ট। ঘুষি মারবে বলে তুলল দু’হাত। কিন্তু ঝড়ের বেগে তার বুকের কাছে পৌছুল রানা। ওর ঘুষি লাগল যুবকের সোলার প্লেক্সাসে। মাঝারি ঘুষিই কাজ করল আরবী ঘোড়ার লাথির মত। হুড়মুড় করে পিছিয়ে চিত হয়ে একটা টেবিলে পড়ল যুবক। ঠাস্ আওয়াজে মাঝ থেকে ভাঙল টেবিলের টপ। ওটা নিয়ে মেঝেতে নামল যুবক। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ। দু’হাতে চেপে ধরেছে পেট। ফুঁপিয়ে উঠল মার খাওয়া বাচ্চার মত। এবার আর সাহস পেল না উঠতে। এদিকে বিসট্রো থেকে ছিটকে বেরোল সেই ওয়েটার। সঙ্গে আরও তিনচারজন। তাদের একজন চিৎকার করল, ‘পুলিশ ডাকো!’

‘পুলিশ লাগবে না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। নামিয়ে নিয়েছে দু’হাত। ‘ঝামেলার জন্যে দুঃখিত। আমি চলে যাচ্ছি।’ কৃষ্ণকেশী যুবতীকে একবার দেখে নিয়ে বিসট্রো থেকে বেরোতে পা বাড়াল রানা।

‘একমিনিট!’ পেছন থেকে ডাকল হতাশ মেয়েটা। ‘তোমার নাম কী?’

জবাব না দিয়ে পথের বাঁক ঘুরে বন্ধুর বাড়ির দিকে হেঁটে চলল রানা। বোকা বনে তিক্ত হয়ে গেছে ওর মন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *