অপশক্তি – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

বিজ্ঞানী অ্যামাকাস ব্যানিং চুপ হয়ে যাওয়ায় ঘরে নেমেছে থমথমে নীরবতা। সেটা ভাঙল কমিশনার মার্লো, ‘ডেইটার গিসেল বেরিয়ে আসবে নিজেদের আস্তানা ছেড়ে। জীবিত মানুষগুলোকে জড় করে গড়বে নতুন এক পৃথিবী।’

‘সত্যিই মহামারী হলে মারা পড়বে শত শত কোটি মানুষ,’ বললেন প্রফেসর। ‘ওটা তার সুখস্বপ্ন।’

আবারও চুপ হয়ে গেল সবাই।

দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত পেরোবার পর বলল রানা, ‘আপনারা কী চান? আমাকে কেন ডেকেছেন এই মিটিঙে?’

‘আমরা চাইছি তুমি আগের মতই খুঁজবে গিসেলকে, ‘ বলল কমিশনার মার্লো। ‘তবে এবার প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহায্য পাবে আমাদের তরফ থেকে। বাধা দেবে না কেউ।’

‘তাই?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘যা খুশি করতে পারি?’

‘তাতে থাকবে মাত্র একটা শর্ত।’

‘সেটা কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমরা চাই তোমার সঙ্গে থাকুক একজন অ্যান্টি- টেরোরিস্ট এজেন্ট। সম্প্রতি পদোন্নতি হয়েছে তার। এমন কেউ, যে ভাল করেই চেনে ডেইটারকে। আশা করি এতে বাড়তি সুবিধে পাবে তুমি।’

যে-কোনও সময়ে দ্রুত সরে যেতে হবে,’ আপত্তির সুরে বলল রানা। ‘সবসময় যে নিয়ম মেনে চলব, তা-ও নয়। প্রতিটা পদে ধীর করে দেবে আমাকে সরকারি লোক।’

মৃদু হাসল মার্লো। ‘সবসময় নিয়ম মেনে চলবে না ওই এজেন্ট। সেটা আগেই প্রমাণ করেছে সে। তোমার মতই হাইলি ট্ৰেইণ্ড। তাকে ধরে নিতে পারবে পার্টনার হিসেবে। টপ ক্লাসের আর্মড্ ও আনআর্মড কমব্যাট জানে। একমাত্র ‘এজেন্ট, যে কিনা ব্যক্তিগতভাবে চেনে ডেইটার গিসেলকে। আমার মনে হয় তুমি ভরসা রাখতে পারবে স্পেশাল এজেন্ট বেলাইতের ওপর।’

খুলে গেল ঘরের দরজা। ভেতরে ঢুকল এলিস বেলা। মনে হলো না রানাকে চেনে। পুরনো বাইকার জ্যাকেট ও ফেডেড জিন্সের বদলে পরনে কালচে সুট। প্রথমবারের মত রানা বুঝল, মেয়েটা সত্যিই দারুণ রূপসী। যেন সদ্য ফোটা তাজা গোলাপ!

মৃদু হাসি ফুটল বেলার ঠোঁটে।

‘প্রমোশনের জন্যে কংগ্র্যাচুলেশন্স, স্পেশাল এজেন্ট,’ গম্ভীর চেহারায় বলল রানা। ‘বোধহয় মস্তবড় কোনও মাছ ধরেছেন।’

‘তা তো বটেই,’ বলল বেলা।

‘ভাবছেন, এখন থেকে কাজ করব মিলেমিশে, তাই না?’

‘আমরা এবার দু’জন কিডন্যাপার আর জিম্মি থাকছি না।’

‘আপনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্যে আমি দুঃখিত।’

‘না, ঠিক আছে,’ বলল বেলা। ‘আমি কিছু মনে করিনি।’ কমিশনার মার্লো কিছু আঁচ করলেও তার চেহারায় সন্দেহের কোনও ছাপ নেই। ক্লান্ত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত একজন মানুষ। হাই তুলে বলল, ‘রাত বাজে তিনটা। এবার বিদায় নেব ডক্টর ব্যানিং আর আমি। তোমাদের জন্যে ব্যবস্থা করে দেয়া হবে গাড়ির।’

‘প্রথমে কোথায় যাব আমরা?’ জানতে চাইল রানা।

‘লিওনের ক্রাউন প্লাযা হোটেলে। অতিথিদের আপ্যায়নের জন্যে ওটা ব্যবহার করে ইন্টারপোল। আশা করি ওখানে কোনও অসুবিধে হবে না তোমার।

‘সংক্ষিপ্ত সময় ওখানে থাকছি,’ বলল রানা।

‘তোমার যা লাগবে, আমাকে জানিয়ে দিলে সকালে পেয়ে যাবে সব,’ বলল কমিশনার।

‘খুব বেশি কিছু লাগবে না, জবাব দিল রানা। ‘নতুন একটা ঘড়ি। ওমেগা সি-মাস্টার অটোমেটিক। স্টিলের ব্যাক। ডায়াল নীল। ঠিক যে জিনিস গার্বেজে ফেলেছে তোমাদের মেডিকোরা।’

‘তুমি চাইলে রোলেক্স সাবমেরিনার নিতে পার,’ নির্দ্বিধায় বলল মার্লো, ‘টাকা দেবে ফ্রান্সের করদাতারা।’

‘লাগবে না,’ মানা করে দিল রানা। ‘এ ছাড়া লাগবে ভাল একটা গাড়ি। যেটা বড়সড় আর শক্তপোক্ত।

‘আমার মনে পড়ছে ব্রায়ানকনের এক লোকের কথা,’ বলল মার্লো, ‘নামটা বোধহয় ইশতিয়াক আহমেদ ফারুক। কেন যেন মনে হয়েছে সে তোমার বন্ধু। তার ছিল একটা এইচওয়ান হামার। ঠিক তেমন গাড়ি পেলে চলবে তোমার?’

চুপ থাকল রানা।

‘হামারটা এখন আছে পুলিশের গ্যারাজে। আমার ধারণা ওটা ফেরত পাওয়ার জন্যে মুখিয়ে নেই মোসিউ আহমেদ। আমি একবার ফোন দিলেই পুলিশের লোক এসে দিয়ে যাবে।’

‘তা হলে ওটাই হোটেলে পাঠাও,’ বলল রানা, ‘আর ভুলবে না ফ্যামাস রাইফেলের কথা। বাদ দেবে না ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল। তবে ভেতরে যেন জিপিএস ট্র্যাকিং চিপ্‌স্‌ না থাকে।’

‘ধরে নাও সব পেয়ে গেছ,’ বলল মার্লো। ‘আশা করি হোটেলে আবার গোলাগুলি করবে না।’

সরাসরি কমিশনারের চোখে তাকাল রানা। ‘আগেই তো জানো, কাজ করব আমার নিয়মে। প্রয়োজনে তছনছ করে দেব তোমার হোটেল।’

ঠাট্টা বুঝতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল অ্যাল মার্লোর। মৃদু হাসল। ‘তোমার সঙ্গে আবারও কাজ করতে পেরে আমি খুশি, রানা। আশা করি শুয়োরটাকে ঠেকাতে পারব আমরা।’

অতি আশাবাদী নয় নীরব রানা। এমন কোনও সূত্র নেই যেটা অনুসরণ করবে। সেটাই বলল, ‘প্রথম থেকে শুরু করতে হবে সব। প্রতিটি দিক নিয়ে ভাবতে হবে। লাগবে এমন কোনও জরুরি তথ্য, যেটা আমাদেরকে নেবে গিসেলের আস্তানায়।’

‘তুমি যে-কোনও বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পার,’ বলল মার্লো। ‘জবাব দেয়ার চেষ্টা করব।’

‘ডেইটার গিসেলের জীবিত কোনও আত্মীয় আছে?’

‘না,’ মাথা নাড়ল কমিশনার। ‘গত দেড় বছর আগে মারা গেছে তার মা। এর এক বছর আগে বাবা। একজন গেছে লিউকেমিয়ায়। আরেকজন হার্ট অ্যাটাকে। একজনের বয়স হয়েছিল বাষট্টি। অন্যজনের সত্তর। ভাই-বোন নেই গিসেলের। স্ত্রী বা সন্তানও নেই।’

‘তার ব্যবসার কী হলো?’

‘বারো সালে চার শ’ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিয়েছে এক ইতালিয়ান কোম্পানির কাছে।’

‘ডেন্টিস্ট, জেনেভায় তার অফিস আছে?’ জানতে চাইল রানা। ‘নিজেই হয়তো অফিসে তৈরি করেছে ল্যাবোরেটরি।’

বেশ ক’বছর আগেই প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছে,’ বলল মার্লো, ‘ওই দালানে এখন আছে কসমেটিক প্লাস্টিক সার্জারি হসপিটাল। ওটা চালান ইরানিয়ান ডক্টর খামের তামের। আমাদের এজেন্ট জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাওয়ায় ভীষণ ভয় পেয়েছেন তিনি। ভেবেছিলেন ওরা ট্যাক্স অডিটর।

‘ডেইটার গিসেলের পরিচিত মানুষগুলোর তালিকা চাই,’ বলল রানা। ‘শুরু কোরো ডেইযি বাকে দিয়ে। কোথাও না কোথাও থাকবে দুর্বল কোনও লিঙ্ক। ওটা ধরতে পারলে আমরা পৌঁছে যেতে পারব গিসেলের কাছে।’

‘এসব ভেবে আগেই প্রতিটি দিকে তদন্ত করা হয়েছে, বলল বেলা।

‘ভাল,’ বলল বিরক্ত রানা। ‘সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, কোনও ধরনের সূত্র পাব না আমরা। তা হলে পথ চলার জন্যে থাকল শুধু বিকৃত দুটো লাশ।’

‘না, আরও কিছু আছে,’ বলল বেলা। ঘুরে তাকাল অ্যাল মার্লোর দিকে। ‘স্যর, আপনি কি বলেছেন ভিকি অন্যাথের কথা?’

‘এখনই বলতে যাচ্ছিলাম,’ বলল মার্লো।

‘কে সে?’ জানতে চাইল রানা।

‘ভিকি অন্যাথ ডেইটার গিসেলের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী,’ বলল কমিশনার, ‘জন্মেছে উনিশ শ’ ছিয়াশি সালে ড্রেসডেন শহরে। বেশ ক’বছর জামান আর্মিতে ছিল কমাণ্ডো বাহিনীতে। ঝড়ের মত বলতে পারে ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজি। যখন চাকরি করত, সেসময়েই বোধহয় জুটে যায় পারাটি দলে। চোদ্দ সালে ছেড়ে দেয় চাকরি। বোধহয় গিসেলের সঙ্গে গিয়েছিল উত্তর কোরিয়ার মিশনে। পারাটি দলের জন্যে সংগ্রহ করত অবৈধ অস্ত্র। আমাদের ধারণা, তার মাধ্যমেই প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেছে গিসেল। কিন্তু ষোলো সালের এপ্রিল মাসে দুই অস্ত্র ব্যবসায়ী খুন হয় অন্যাথের হাতে। প্রমাণ পেয়ে যাওয়ার তিন মাস পর সুইট্যারল্যাণ্ডে গ্রেফতার হয় সে। এ ছাড়া, তার বিরুদ্ধে ছিল লোসানে তেরো বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণের মামলা।’

কথাটা শুনে কঠোর হলো রানার চেহারা।

‘প্রমাণের অভাব হয়নি,’ বলল মার্লো। ‘তাকে দেয়া হয় পনেরো বছরের সাজা। পাঠিয়ে দেয়া হয় লো-সিকিউরিটি প্রিযন অল্টডর্ফ-এ। তবে আমার মনে হয়, সহঅপরাধীদের ওপর হামলার কারণে আগামী কিছু দিনের ভেতর তাকে পাঠানো হবে অন্য কোনও কারাগারে।

‘অল্টডর্ফে তার সঙ্গে দেখা করেছে কেউ?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা দোলাল কমিশনার। ‘সুইস ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস থেকে পাঠানো হয়েছে দু’জন এজেন্টকে। ওরা অবশ্য ওটাকে বলে ইন্টারভিউ। সুইসদের সহজ কারাগার ব্যবস্থায় ভুলেও ইন্টারোগেশন শব্দটা ব্যবহার করা হয় না।’

‘তার ফলে কী জানা গেল?’ জিজ্ঞেস করার আগেই উত্তর জেনে গেছে রানা।

‘বুঝতেই পারছ, লোক হিসেবে মার্বেলের মতই শক্ত ভিকি অন্যাথ। তার পেট থেকে কিছুই বের করা যায়নি। কোনও কথাই বলেনি সে।’

‘আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই,’ বলল রানা। ‘তোমার নিজের পদ্ধতি ব্যবহার করে?’

‘ওটা কাজে আসতে পারে।’

মাথা নাড়ল কমিশনার মার্লো। ‘আসলে সে উপায় নেই, রানা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভেতর নানান সুবিধা দিতে পারব। তবে সুইট্যারল্যাণ্ডে নয়। ওখানে সামান্য উল্টাপাল্টা করলেই পড়বে চরম বিপদে। বন্দির বিষয়ে খুব সহনশীল তারা। ধরে নাও তোমার সঙ্গে কথা বলবে না ওই লোক। সুযোগ নেই জেরার। সুইস কর্তৃপক্ষ মনে করে, ভাল ব্যবহার দিয়ে শুধরে নেবে অপরাধীদেরকে। বন্দিদের জন্যে নেই কোনও শাস্তি। তাদেরও আছে ছুটির দিন। পাহাড়ে, পার্কে বা ঘাসের মাঠে ঘুরে বেড়ায় ঘোড়ায় চেপে। এভাবেই নাকি ভয়ঙ্কর সব অপরাধী একদিন হয়ে উঠবে দায়িত্ববান নাগরিক!’

‘কী জানি, সত্যিই হয়তো তাই!’ উদাস চেহারায় বলল এলিস।

বড় করে শ্বাস ফেলল রানা। ‘ঠিক আছে, হাসিমুখে মিষ্টি সুরে ভিকি অন্যাথকে জিজ্ঞেস করব, ‘বলো তো, বাবা অনাথ, এখন কোথায় আছে তোমার প্রিয় বন্ধু ডেইটার গিসেল?’

.

কমিশনার অ্যাল মার্লো ও প্রফেসর অ্যামাকাস ব্যানিং ঘর ছেড়ে যেতেই ভেতরে ঢুকল কালো সুট পরা অন্তত বিশজন সিকিউরিটি পার্সোনেল। রানা ও বেলাকে পথ দেখিয়ে নামিয়ে আনল নিচতলায়। ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে নিচু ছাতের দীর্ঘ এক কালো সিত্রোঁ ডিএসফাইভ। স্মোকড্ উইণ্ডো ওটার। ড্রাইভার চালিত ওই জিনিস স্বয়ং ব্যবহার করেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। গ্যারাজের দরজা খুলে যেতেই রানা দেখল, রাতটা বৃষ্টি ভেজা। গাড়ির সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসল সশস্ত্র এক এজেন্ট। রানা ও বেলাকে পেছনের সিটে বসতে বলল দ্বিতীয়জন। গাড়িতে উঠে রানা আন্দাজ করল, দ্বিতীয় লোকটার কোটের ভেতর সাবমেশিন গান। হয় স্করপিয়ন, নয়তো মাইক্রো উযি। গাড়ি থেকে সরে রেডিয়োতে কী যেন বলল সে। রওনা হলো ড্রাইভার। বেরিয়ে এল গোপন সায়েন্স ফ্যাসিলিটি ছেড়ে। সামনেই দিনের মত আলোকিত চেকপয়েন্ট। জানালা নিচু করে গার্ডদের কী যেন বলল এজেন্ট। হাতের ইশারা করে পিছিয়ে গেল গার্ডরা। খুলে গেল স্টিলের তারের উঁচু, চওড়া গেট। নীরব, নিঝুম রাতে ছিটকে বেরোল কালো গাড়ি। ক্রমেই বাড়ছে চলার বেগ।

‘আমি খুশি তুমি সুস্থ,’ নিচু গলায় বলল বেলা।

‘আমিও খুশি, যে তুমি ভাল আছ,’ জবাবে বলল রানা। অন্ধকারে দেখল মেয়েটার চোখে ও ঠোঁটে হাসি। আলতো করে ওর হাত ধরল বেলা। চুপ করে বসে থাকল ওরা।

কিছুক্ষণ পর হোটেলে পৌঁছুল কালো গাড়ি। ইন্টারপোলের নির্দেশ রয়েছে বলে ডেস্কে থামতে হলো না ওদেরকে। সরাসরি লিফটে চড়ে উঠে এল ডাবল সুইটের দরজার সামনে। প্রকাণ্ড ঘরের আসবাবপত্র রীতিমত বিলাসবহুল। রাস্তার পাশের ওই সস্তা মোটেলের সঙ্গে তুলনা চলে না এই হোটেলের সুইটের। মৃদু আলোকিত। মাঝে লাউঞ্জ ও ডাইনিং রুম, দু’দিকে দুটো বেডরুম। ডাইনিং টেবিলে নানান ফলে ভরা কারুকাজ করা কাঁচের বাউল। কয়েকটা ফুলদানী থেকে আসছে ফুলের সুবাস। লাউঞ্জের আরেক পাশে গিয়ে বেডরুমে উঁকি দিল রানা। ভেতরে ডাবল বেড। একপাশে বাথরুম। একটু দূরে চওড়া ফ্রেঞ্চ উইণ্ডোর সামনে মেঝেতে পার্শিয়ান কার্পেট। ওদিকে বোধহয় বারান্দা। বেডের পাশে ক্যানভাস ও চামড়া দিয়ে তৈরি ব্যাগ। চেইন টেনে ওটা খুলল রানা। ভেতরে মেয়েদের পোশাক। পরিপাটিভাবে ভাঁজ করা ব্লাউস, লেস দেয়া আণ্ডারওয়্যার, হালকা নীল সিল্কের নাইট গাউন। শেষ জিনিসটা প্রায় ঝাঁকিজালের মত। ওটা পরলে আর কিছুই বাকি থাকবে না দেখতে। ব্যাগে চেইন টেনে উঠে দাঁড়াল রানা। এই ঘর বেলার।

ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিল রানা। ওই একই সময়ে উল্টো দিকের ঘর থেকে বেরোল বেলা। মৃদু হেসে বলল,

‘এই রুমটা তোমার। ভেতরে দেখলাম বিতিকিচ্ছি সেই সবুজ ব্যাগ।’

লাউঞ্জে মুখোমুখি হলো রানা ও বেলা। কেমন যেন অস্বস্তির ভেতর পড়ে গেছে। ওদের মনে হলো, ওরা যেন পরস্পরকে পছন্দ করে এমন দুই কিশোর-কিশোরী।

‘অনেক রাত,’ কয়েক মুহূর্ত পর বলল বেলা। ‘আমাদের বোধহয় শুয়ে পড়া উচিত। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।’

বিন্দুমাত্র ক্লান্ত নয় রানা। যখন কোয়ারেনটাইন-এ ছিল, সেঁটে ঘুমিয়ে নিয়েছে। আপাতত জাগতে পারবে প্রায় চার দিন। ‘তা হলে সকালে দেখা হবে,’ বলল রানা।

একতিল নড়ল না ওরা। নিজের বেডরুমে যাওয়ার আগ্রহ নেই কারও। কী এক আকর্ষণে আটকা পড়েছে দু’জন।

আরও কিছুক্ষণ পর বেলা বলল, ‘ঠিক আছে, শুভরাত্রি।’

‘শুভরাত্রি, বেলা।’

থম মেরে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল ওরা।

পেরিয়ে গেল দীর্ঘ মুহূর্ত। তারপর ভুরু উঁচু করে হাসল বেলা। ‘বলো তো, ওরা আমাদেরকে এই সুইটে পাঠাল কেন?’

‘যাতে পরস্পরকে ভাল করে চিনে নিতে পারি,’ বলল রানা।

‘নাকি প্রেমের সুযোগ করে দিতে?’

‘ঘটনা যা-ই হোক, আমি অখুশি নই।’

‘তাই?’

‘এবার গিয়ে শুয়ে পড়ো,’ বলল রানা। ‘কাল থেকে শুরু হবে টানা খাটুনি।’

‘কিন্তু ঘুম যে আসছে না,’ বলল বেলা।

চুপ করে আছে রানা।

‘মিনিবার-এ ওয়াইন অথবা ব্র্যাণ্ডি পাব,’ বলল বেলা। ‘নেবে দু’একটা ড্রিঙ্ক?’

সুইটের মৃদু হলদে আলোয় চকচক করছে মেয়েটার চুল। ঝিকিয়ে উঠছে দুই চোখের মণি। ঠোঁটে রহস্যময়, অদ্ভুত এক টুকরো হাসি। এগোল আরও এক পা। গ্রীবা কাত করে দেখল রানাকে। অস্ফুট স্বরে বলল, ‘কী, রানা?’

সামনে বাড়ল রানা। ওর নিষ্ঠুর ঠোঁট নামল বেলার ভেজা, অধীর ঠোঁটে। কয়েক মুহূর্ত পর মেয়েটাকে তুলে নিজের ঘরের দিকে চলল বিসিআই এজেন্ট।

ছেচল্লিশ

শুভ্র বরফ ও উঁচু পাহাড়ে ভরা সুইট্যারল্যাণ্ড।

অল্টডর্ফ প্রিয়নে ঢুকলে চট্ করে কেউ বুঝবে না, সাধারণ এক রাস্তার ধারে স্বাভাবিক সব বাড়িঘর ও অফিসের মাঝে এটা সত্যিই একটা রাষ্ট্রীয় কারাগার। অবশ্য ভারী লোহার প্রবেশদ্বার ও ভবনের দোতলার পুরু শিক দেয়া জানালা দেখলে মেনে নিতে হবে বাস্তবতা। ছাতে কয়েল করা রেযার ওয়াইয়ার চকচক করছে সকালের রোদে।

কারাগারের প্রধান প্রবেশদ্বারে রানা ও বেলা থামতেই কাজ করল’ রিমোট মেকানিযম, ট্র্যাকে সরসর করে সরে গেল দরজা। একটু আগে লিওন থেকে হেলিকপ্টারে চেপে এখানে পৌঁছেছে ওরা। এখন বাজে সকাল নয়টা চব্বিশ মিনিট ওদের জন্যে অপেক্ষা করছেন কারা-কর্তৃপক্ষ।

গতরাতের সেই সুট বেলার এখনও নিভাঁজ। আজকে আরও সুন্দরী দেখাচ্ছে ওকে। রানার পরনে নতুন জিন্স প্যান্ট ও কালো জ্যাকেট। ওদের সঙ্গে কোনও পাস বা আইডি নেই। তার প্রয়োজনও পড়বে না। ওরা ইন্টারপোল থেকে এসেছে জানলে খুলবে ইউরোপের যে-কোনও বন্ধ দুয়ার।

গেটের কাছে অপেক্ষা করছেন এক মহিলা। ফ্রেঞ্চ ভাষায় তাঁকে নিজেদের পরিচয় দিল বেলা, ‘ইনি মেজর রানা, ইন্টারপোলের অ্যাটাশে। আর আমি স্পেশাল এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইত। আমরা এসেছি আপনাদের কয়েদি ভিকি অন্যাথের সঙ্গে দেখা করতে।’

ওদের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলেন মহিলা। নিজ নাম বললেন হান্না বাথ। বেশ দীর্ঘকায়া তিনি। খোঁপা করেছেন, পাকা কিছু চুল রুপালি সুতোর মত। নরম সুরে বললেন, ‘আমার সঙ্গে আসুন।’

কয়েদি কথাটা শুনে মহিলা আহত হয়েছেন কি না, বুঝতে পারল না রানা। নিবাসী বলা বোধহয় ভাল ছিল।

আগে কোনও কারাগারে দু’কবাটের দরজা দেখেনি রানা। এবার দেখল। ওদেরকে ভবনের ভেতরে নিয়ে গেলেন মহিলা।

‘ফ্রাউ বাথ, করিডোরের দেয়াল সব গোলাপি কেন?’ জানতে চাইল রানা। বাচ্চা মেয়েদের ঘরে এ ধরনের রঙ ব্যবহার করা হয়। এখানে অবশ্য ফ্যাকাসে লালচে খেলনা ঘোড়া বা পুতুল নেই।

‘কালার সাইকোলজি স্টাডি থেকে জানা গেছে, ওই রঙ- কমিয়ে দেয় মানুষের হিংস্রতা,’ বললেন ফ্রাউ বাথ। ‘মনটা হয়ে ওঠে শান্ত।’

‘ও,’ মেনে নিল রানা। ‘আর এসব বন্দি… নিবাসীরা জেলখানার ভেতর যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে?’

‘অবশ্যই,’ বরফের মত ঠাণ্ডা হাসি দিলেন মহিলা। ‘ঠিক আছে, এবার সাক্ষাৎ করবেন গভর্নরের সঙ্গে। তিনি আপনাদের সঙ্গে দু’চারটে কথা বলতে চান।’

নিয়ন বাতির ফ্যাকাসে লাল এক করিডোর ধরে ওদেরকে নিয়ে চলেছেন মহিলা। একটা দরজার সামনে থেমে কবাটে মৃদু টোকা দিলেন। ভেতর থেকে সাড়া দিলেন কেউ। দরজা খুলে রানা ও বেলাকে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলেন ফ্রাউ বাথ। আরামদায়ক আসবাবপত্রে সাজানো ঘরটা বড়। নানাদিকে টবে গাছ। ওগুলো ফ্যাকাসে লাল নয়, এটা ভেবে বেশ ভাল লাগল রানার।

‘ম্যাক্স বাউম্যান,’ সুইস-জার্মান সুরে নিজের নাম বলে চেয়ার ছাড়লেন গভর্নর। ছোটখাটো মানুষ তিনি। চোখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। কুঁচকে গেছে ভুরু ও কপাল। তাঁর ইশারায় চেয়ারে বসল রানা ও বেলা। নিজ চেয়ারে বসে ইংরেজিতে জানালেন তিনি, ‘আমিই অল্টডর্ফ কাউন্টি জেলের গভর্নর ম্যাক্স বাউম্যান।’ সাধারণ দু’চার কথায় রানা ও বেলাকে সহজ করে নিলেন তিনি। তারপর বললেন কেন তিনি এত চিন্তিত। গতকাল এই জেলে ঘটে গেছে ন্যক্কারজনক এক ঘটনা। বরাবরের মতই প্রতি সপ্তাহে ভিকি অন্যাথকে দেখতে আসেন মহিলা সোশিওথেরাপিস্ট। কিন্তু তিনি এখন আছেন হাসপাতালে। তাঁর বাম কলার বোন ভেঙেছে অন্যাথ। শুধু তাই নয়, আর কখনও ডান কানের অর্ধেক ফেরত পাবেন না তিনি। ওটা এক কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে গিলে ফেলেছে হতচ্ছাড়া!

‘বলতে খারাপ লাগছে, আগেও এধরনের কাজ করেছে ‘সে,’ নার্ভাস সুরে বললেন গভর্নর বাউম্যান। ‘সবমিলে পাঁচবার। এর আগের বার প্রায় অন্ধ করে দিয়েছিল এক নিবাসীর দুই চোখ। তার আগে ভেঙেছে তার প্রতিটা দাঁত। পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠেছে, বাধ্য হয়ে আমরা তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আরও নিরাপদ ফ্যাসিলিটিতে। আশা করি রেজেন্সডর্ফে এমন করতে পারবে না সে।’

‘মনে হচ্ছে, চারপাশের দেয়াল লালচে করে খুব একটা কাজ হচ্ছে না,’ নরম সুরে বলল রানা।

চট্ করে ওকে দেখল বেলা। আবার ফিরল গভর্নরের দিকে। ‘তা হলে কি আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না তার?’

‘তা হবে, তবে নিরাপত্তা আছে এমন রুমে, ‘বললেন গভর্নর, ‘চাই না আপনাদের ক্ষতি হোক। আরেকটা কথা, বেশি সময় নেবেন না। আজ বারোটায় তাকে রেজেন্সডর্ফে পাঠিয়ে দিচ্ছি আমরা।’

‘আমরা তাকে মাত্র দু’চারটে প্রশ্ন করব,’ বলল রানা। ‘তাতে বেশি সময় লাগবে না।’

‘আপনারা সহযোগিতা করছেন বলে ধন্যবাদ,’ স্বস্তির ছাপ ফিরল গভর্নরের চোখে-মুখে।

এই লোক আলকাট্রাযের গভর্নর হলে স্রেফ উন্মাদ হয়ে যেত, ভাবল রানা।

দশ মিনিট পর ইন্টারভিউ রুমে পৌঁছে প্লাস্টিকের দুটো চেয়ারে বসল ওরা। সামনে সাদা প্লাইউডের টেবিল। অ্যাল মার্লোর কথা মনে রেখে ইন্টারোগেট কথাটা উচ্চারণও করেনি রানা। ঘরে অ্যান্টিসেপটিক লোশনের কড়া গন্ধ। ঘরের মাঝে প্লাস্টিকের এক চেয়ারে মুখোমুখি বসেছে ভিকি অন্যাথ। তবে দু’পক্ষের মাঝে পুরু দেয়ালের গায়ে পার্সপেক্স সিকিউরিটি জানালা। অন্যাথের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কারাগারের দুই রক্ষী। সতর্ক চোখ রেখেছে বন্দির ওপর। লোকটা কপাল দিয়ে গুঁতো মেরে কাঁচ ভাঙার মত তেড়িবেড়ি কিছু করলে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা।

খুব শান্ত মনে হলো ভিকি অন্যাথকে। মনেই হয় না চৌত্রিশ বছর বয়স। কোঁচকানো গালের চামড়া। চোখের নিচে ঘন কালি। মণিদুটো ক্ষুধার্ত হাঙরের মত। খুব ছোট করে ছাঁটা চুল। পরনে জিন্স ও টি-শার্ট। সুইস কর্তৃপক্ষ বোধহয় ধরে নিয়েছে ইউনিফর্ম পরলে মন দমে যাবে কয়েদির।

ধীর স্বরে কথা শুরু করল এলিস বেলা। ‘হের, অন্যাথ, আমি জানি আপনি ভাল ইংরেজি জানেন। তাই আশা করছি ইন্টারভিউয়ের সময় কথা বলবেন ওই ভাষায়। এতে আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’

জবাব দিল না ভিকি অন্যাথ। হাঙরের মত ক্ষুধার্ত চোখে দেখছে বেলাকে। যেন ভাবছে, আগে ছিঁড়ে নেবে শরীরের ঠিক কোন্ অংশটা!

চুপচাপ তাকে দেখছে রানা।

‘ঠিক আছে, হের অন্যাথ, আমার নাম স্পেশাল এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইত,’ বলল বেলা। ‘আমি এখানে এসেছি ফ্রেঞ্চ জেনারেল ডিরেকটোরেট অভ হোমল্যাণ্ড সিকিউরিটির তরফ থেকে। আমরা জানতে চাই, এখন ঠিক কোথায় আছে আপনার বন্ধু ডেইটার গিসেল।’

বাঁকা হাসল অন্যাথ। চোখে ফাঁকা দৃষ্টি। ‘আপনার পাশের লোকটা কে?’

কড়া চোখে একবার রানাকে দেখল বেলা। নরম সুরে বলল, ‘এটা খুব জরুরি, যেন আমরা খুঁজে পাই ডেইটার গিসেলকে। সেজন্যেই এখানে এসেছি আপনার সাহায্য পাওয়ার জন্যে।’

টু শব্দ করল না অন্যাথ। চেয়ে আছে চুপচাপ। উষ্ণ পাথরের ওপর আয়েস করে শোয়া গিরগিটি যেন।

‘জানি, কী ভাবছেন, অন্যাথ,’ প্রসঙ্গ পাল্টে নিল বেলা। ‘আমি কি আপনাকে ভিকি বলে ডাকতে পারি? সবাই তো গোয়েন্দা বা টিকটিকি অপছন্দ করে, তাই না? তবে এমন ভাববেন না। ডেইটার গিসেলের বিরুদ্ধে একটা তথ্যও আমি আপনার কাছে চাইব না। ধরে নিতে পারেন, আসলে তারই উপকার করছেন আপনি। আমাদের হাতে যে ধরনের প্রমাণ রয়েছে, তাতে মহাবিপদে পড়বে সে। আপনি পারেন তাকে বিপদ থেকে সরিয়ে নিতে। তারই ভালর জন্যে আমরা চাইছি আলাপ করতে।’

নিচু গলায় নিষ্কম্প সুরে কথা বলেছে বেলা। মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না রানা। ও নিজে আরেকটু হলেই বিশ্বাস করে ফেলত কথাগুলো। সরল চেহারা নিয়ে বসে আছে বেলা। তবে ভিকি অন্যাথের চোখদুটো যেন মৃত কুমিরের। রানা বুঝে গেল, ওই লোকের থুতনির নিচে লোডেড পিস্তলের নল ঠেসে ধরতে না পারলে, ওই পেট থেকে একটা কথাও বেরোবে না। মুহূর্তের জন্যে তৃপ্তির ছাপ পড়ল অন্যাথের দুই চোখে। যেন ভাবছে সে, যা করছ, চালিয়ে যাও, ডেইটার গিসেল! আমি আছি তোমার সাথে!

‘আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী,’ আরও নরম সুরে বলল বেলা, ‘তাতে উপকার হবে আপনার বন্ধুর। আপনি নিশ্চয়ই চান তার ভাল হোক?’

রানার মন চাইল বলতে: ‘আরে, কুত্তার বাচ্চা, হারামজাদা, মুখ খোল, তা হলে কমিয়ে দেব পাঁচ বছরের সাজা!’

কিন্তু সে উপায় নেই ওর। মনে পড়ল অন্য পদ্ধতি। ভাল হতো বলতে পারলে, ‘বল, শালা, কোথায় আছে ডেইটার গিসেল! নইলে একটা একটা করে ভাঙব তোর মেরুদণ্ডের গিঠ!’

অবশ্য ঘরের জানালা ভেঙে ওদিকে গিয়ে দুই গার্ডকে কাবু করে ভিকি অন্যাথের মুখ খোলানো আপাতত ওর কম্ম নয়।

তিলতিল করে চলল ইন্টারভিউ। একটা কথাও বলল না ভিকি অন্যাথ। নানান মিষ্টি কথা বলে তার মন ভেজাতে চাইল বেলা। ওর কাজে যে খুঁত বা দক্ষতার অভাব আছে, তা মনে হলো না রানার। নানাদিকে সরে আলাপ করতে চাইছে বেলা। তবে পঁচিশ মিনিট পর বুঝে গেল, পাথরের মন গলিয়ে দেয়া সম্ভব হলেও এই লোকেরটা নয়। আর একটা কথাও বলেনি সে। দুই গার্ড সরিয়ে নিয়ে গেল তাকে।

ইন্টারভিউ রুম থেকে বেরিয়ে এল রানা ও বেলা। কারাগার থেকে বেরিয়ে অফিশিয়াল গাড়ির দিকে চলল ওরা। বিড়বিড় করল বেলা, ‘গাধাটা চাঁদের নোংরা কোনও পাথর!’ রাগে লালচে হয়ে গেছে দুই গাল। খেপে গিয়ে বলল, ‘কই, রানা, তুমি নিজে তো একটা কথাও বললে না!’

চুপ করে থাকল রানা।

‘সরি, তোমার ওপর রাগ ঝেড়ে দেয়া অন্যায়,’ ওর বাহু ধরে এগোল মেয়েটা। অখুশি মুখে ফুটল ম্লান হাসি। ‘দোষ তো আর তোমার নয়! নিজের ব্যর্থতা কেন চাপিয়ে দেব অন্যের ঘাড়ে? কুকুরটা একটা কথাও বলল না!’

থমকে দাঁড়িয়ে বেলার মুখোমুখি হলো রানা। স্পর্শ করল ওর বাহু। ‘সাধ্যমত করেছ। নিজের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ো না। কাজটাই ছিল অসম্ভব। এর চেয়ে সুইসাইড মিশনে গেলেও বেশি সম্ভাবনা থাকে বাঁচার।’

নিজের সুডৌল, পায়ের দিকে তাকাল বেলা। ‘তুমি বোধহয় সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে এ কথা বলেছ।’

‘মোটেও না,’ বলল রানা। ‘সে মুখ খুললে খুবই অবাক হতাম। ভিকি অন্যাথ প্রথম থেকেই জানে, কী করবে ডেইটার গিসেল। ও তো আর গাধা নয়। দলনেতার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছে। এসবে সম্পূর্ণ সায় আছে তার। সুইস ইন্টেলিজেন্সের লোকদের কারণে জেনে গেছে, কী করছে তার নেতা। এ-ও ধরে নিয়েছে, কোনও না কোনও উপায়ে কারাগার থেকে তাকে বের করবে গিসেল। আর সেজন্যেই আরও সতর্ক সে। অপেক্ষা করছে মুক্তির জন্যে।’

ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল বেলা। ‘তুমি আগেই এসব জানতে? তা হলে এখানে এলে কেন?’

‘না এসে উপায় ছিল না,’ বলল রানা। ‘আমি আরও নিশ্চিত হয়েছি গভর্নরের কথা শুনে। ফ্যাকাসে দেয়ালের করিডোর থেকে বের করে ভিকি অন্যাথকে নেয়া হবে অন্য জেলখানায়।’

‘আমিও তা শুনেছি, তবে তাতে কী?’ বলল বেলা। ‘আমরা তো আর তার মুখ খোলাতে পারব না।’

বেলার হাত ধরে গাড়ির দিকে চলল রানা। দূরে সোজা হয়ে বসল সরকারি কালো ডিএসফাইভ গাড়ির ড্রাইভার।

নিচু গলায় বিসিআই এজেণ্ট বলল, ‘কে বলল? এই কারাগার তো আর গুয়ান্টানামো বে-র জেলখানা নয়।’

‘তাতে কী?’

‘যেখানে গুরুতর অপরাধীর থাকে ছুটির দিন, সে দেশে কেন এক জেল থেকে অন্য জেলে সরাবার সময় দেয়া হবে একগাদা গার্ড?’ যুক্তি দিল রানা। ‘সাধারণ প্রিযন সার্ভিস ভ্যানে থাকবে বন্দির সঙ্গে ড্রাইভার আর বড়জোর একজন গার্ড। পথে হাইজ্যাক হতে পারে ওই ভ্যান। কাজটা সারতে দু’জনের বেশি লাগবে না।’

গাড়ির দরজার হ্যাণ্ডেলে হাত রেখে থামল বেলা। ‘সর্বনাশ! তা হলে তুমি ভাবছ অন্যাথকে ছুটিয়ে নেবে ডেইটার গিসেল?’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘সহজই হবে। আগেও বহুবার এমন হয়েছে। ব্রিটেনে প্রাইভেট সিকিউরিটি ফার্মের গার্ডদের কাছ থেকে দলের লোককে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে অপরাধী দল।’

‘ডেইটার গিসেল আর ডেইযি বাস,’ বিড়বিড় করল বেলা। ‘এবার বুঝতে পেরেছি! হায়, যিশু! ভাবছ, কাজটা করবে ওরা দিন-দুপুরে?’

‘করলে ঠেকাবে কে?’ বলল রানা। ‘ড্রাইভার বা গার্ড?’

‘ঠিকই বলেছ, রানা!’ মাথা দোলাল বেলা। ‘ওদের তো তেমন প্রস্তুতিও লাগবে না! গভর্নর বলেছেন দুপুর বারোটায় অন্য জেলখানার দিকে যাবে ভিকি অন্যাথের ভ্যান।

নতুন হাতঘড়ি দেখল রানা। এটাতে আঁচড়ের দাগ নেই। বেলার চোখে তাকাল বিসিআই এজেন্ট। ‘সময় মাত্র দু’ঘণ্টা। কল দাও কমিশনার অ্যাল মার্লোকে। সে যেন পাঠিয়ে দেয় এম্মেন এয়ার বেসে হামার। খুব দূরে নয় ওই এয়ার বেস। গাড়িতে থাকবে দরকারি সবকিছু। হাতে খুব বেশি সময় পাব না আমরা।’

পকেট থেকে ফোন নিয়ে কল দিল বেলা। ‘কথা শেষ করে তারপর কী করব?’

গাড়ির দরজা খুলল রানা। ‘আগে চাই ভরপেট ব্রেকফাস্ট।’

সাতচল্লিশ

সকাল এগারোটা আটান্ন মিনিট।

কারাগারের গেট পেরিয়ে প্রিযনার ভ্যান রাস্তায় বেরোতেই মনে মনে হাঁফ ছাড়লেন অল্টডর্ফ কাউন্টি জেল গভর্নর ও তাঁর কর্মচারীরা। খুশির হাসি চেপে রেখেছে গার্ডরা। সত্যিই বিদায় নিয়েছে হতচ্ছাড়া কয়েদি ভিকি অন্যাথ। দু’ঘণ্টা পর পৌঁছুবে দূরের জেলখানা রেজেন্সডর্ফে। ওখানে কঠোর আইনের শাসন। বাকি কয়েক বছর ওখানেই থাকবে পশুর মত লোকটা।

চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার, পাশেই গার্ড। দুই জেলের মাঝে কোথাও থামবে না ভ্যান। প্রয়োজন নেই বলে দেয়া হয়নি বাড়তি গার্ড। অল্টডফ শহরের নীরব পথ পেরিয়ে দক্ষিণ-পুবে সিডরফারস্ট্রাস ধরে ব্যাহহফস্ট্রাসের দিকে চলেছে ড্রাইভার। কিছুক্ষণ পর পৌছুবে যুরিখ ও রেজেন্সডর্ফের দিকে যাওয়া উত্তরমুখী এ-ফোর মোটর-ওয়েতে।

কিন্তু ওই পর্যন্ত আর যেতে পারল না প্রিযনার ভ্যান।

পরে পুলিশের কাছে সাক্ষ্য দিল ভীত একদল মানুষ, কীভাবে ভ্যান থামিয়ে অপরাধীকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে দুই হাইজ্যাকার। সাক্ষীদের ভেতর নিখুঁত বর্ণনা দিল পাইকারি ওয়াইন বিক্রেতা ব্রিটিশ নাগরিক গ্রেগ জনসন। মাত্র অল্টডর্ফ শহরের কাছে পৌঁছেছে, এমন সময় তার জাগুয়ার গাড়িটাকে রাস্তার কিনারায় চাপিয়ে দিল কালো এক মার্সিডিয সেলুন গাড়ি। ভয় পেয়ে থামল জনসন। ফলে বাধ্য হয়ে কড়া ব্ৰেক কষে থেমে গেল অন্তত বারোটা গাড়ি। রাস্তার বুকে তৈরি হলো জটলা।

ওদিকে চল্লিশ গজ গিয়ে স্কিড করে আড়াআড়িভাবে থামল কালো মার্সিডিয। আটকে দিয়েছে সাদা রঙের এক ভ্যানের পথ। গ্রেগ জনসনের মনে হলো ভ্যানটা স্বাভাবিকের চেয়ে ভারী। পেছনে পুরু কাঁচের জানালার ফ্রেম রিইনফোর্সড্। ভ্যান যখন থেমে গেল, জনসনের মনে হলো ওটা বোধহয় অপরাধী বহনের গাড়ি। তখনই ভীষণ কেঁপে গেল তার বুক। বুঝে গেল চোখের সামনে ঘটছে অস্বাভাবিক কিছু। প্রাণপণে হর্ন বাজাচ্ছিল দশ-বারোজন ড্রাইভার, কিন্তু পরের ঘটনা দেখে চুপ হয়ে গেল সবাই।

খুলে গেছে কালো মার্সিডিযের দু’দিকের দুই দরজা। রাস্তায় নেমে এল দু’জন। পরনে কালো জ্যাকেট। মুখে স্কি মাস্ক। একজনের উচ্চতা ছয় ফুট মত। অন্যজন মাঝারি আকারের। হালকা-পাতলা। সে মহিলাও হতে পারে। দ্রুত প্রিযনার ভ্যানের দু’দিকে গেল তারা। লম্বা লোকটার হাতে পিস্তল। ওটা তাক করল ভ্যানের উইণ্ডশিল্ডের দিকে। তার সঙ্গিনীর হাতে হাতুড়ি। ওটা দিয়ে ড্রাইভারের জানালা ভাঙল সে। হাত ভেতরে ভরে বাটন টিপে হ্যাঁচকা টানে খুলল দরজা।

অস্ত্রের মুখে ড্রাইভারকে বাধ্য করা হলো রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়তে। একই হাল হলো তার পাশে বসা গার্ডের। অস্ত্র হাতে তাদের দু’জনকে আটকে রাখল লম্বা লোকটা। ওদিকে ভ্যানের ভেতর ঢুকে পড়েছে তার সঙ্গিনী। বেরিয়ে এল কয়েক মুহূর্ত পর। সোজা গিয়ে খুলল পেছনের দরজার তালা। হাট হয়ে গেল দুই কবাট।

গ্রেগ জনসন যে অ্যাংগেল থেকে দেখেছে, তাতে পরে কী ঘটল, পুরোপুরি বুঝতে পারেনি সে। ওই একই কথা বলেছে অন্যান্য সাক্ষী। তবে এটা ঠিক, ভ্যানের ভেতরে যে লোক ছিল, তার পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট ও টি-শার্ট। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ। ছোট করে ছাঁটা চুল। তাকে জোর করে কালো মার্সিডিয গাড়ির দিকে নিয়ে গেল সশস্ত্র দু’জন। একটু পর নিজেরাও চেপে বসল গাড়িতে, তারপর তুমুল বেগে চলে গেল তারা।

আগে কখনও কাউকে হাইজ্যাক করতে দেখেনি সাক্ষীরা। বাকি জীবনেও হয়তো আর দেখবে না। খুব দ্রুত পেশাদারী দক্ষতার সঙ্গে কাজ সেরে চলে গেছে ওই দু’জন।

কিছুক্ষণ পর পুলিশ স্টেশনে নেয়া হলো সাক্ষীদেরকে। সব জেনে নেয়ার পর ছেড়েও দেয়া হলো। পুলিশ এখনও জানে না অল্টডর্ফ জেলখানা থেকে বেরোবার একটু পরেই কে বা কারা কিডন্যাপ করেছে নৃশংস খুনি ভিকি অন্যাথকে।

পলাতক অপরাধীকে ধরার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল পুলিশ বাহিনী। আশা করা হলো, বেশিক্ষণ লাগবে না ভিকি অন্যাথকে গ্রেফতার করতে। এই ধরা পড়ল বলে!

আটচল্লিশ

মুখোশ খুলতেই একরাশ চুল ছড়িয়ে পড়ল এলিস বেলার মুখের দুইপাশে। নিচু গলায় বলল ও, ‘এখনও ভাবতে পারছি না, আমরাই করেছি ওই কিডন্যাপিং!’

সাঁই-সাঁই চলেছে চোরাই মার্সিডিয। এরই ভেতর মুখোশ খুলে পেছন সিটে প্লাস্টিকের নকল এয়ারস কোল্ট .৪৫ রেপ্লিকা পিস্তলের পাশে রেখেছে মাসুদ রানা। অস্ত্রটা আসলে খেলনা বলেই ড্রাইভার ও গার্ডকে ভয় দেখাতে গিয়ে বদমেজাজ দেখাতে হয়েছে ওর। ‘এ ছাড়া উপায়ও ছিল না।’

‘ধরা পড়লে নিজেরাই যাব জেলে,’ বলল বেলা।

‘আগে ধরুক তো,’ বলল রানা।

‘ধরতে পারলে বারোটা বাজিয়ে দেবে সুইস কর্তৃপক্ষ।’

সামনে বড় মোড়। বামে বাঁক নিল রানা। কিছুটা গিয়ে পড়ল ডানের রাস্তায়, তারপর বাঁক নিল আবারও বামে। ‘বোধহয় গাড়ির বুটে হাঁসফাঁস করছে বেচারা অনাথ বালক।’

‘তাকে নিয়ে গিয়ে কী করব আমরা?’ জানতে চাইল বেলা।

‘হুমকি দেব ব্যাটাকে। সব না বললে এ বছরে আর উপহার পাবে না স্যান্টা ক্লযের কাছ থেকে।’

‘তুমি সত্যিই মনে করো ওই লোক জানে ডেইটার গিসেল কোথায় আছে?’

‘এটা তো বলতেই পারি, আমাদের চেয়ে বেশি জানে,’ বলল রানা। ‘কথা বলে ব্যাটার চোখ।’

‘ওর তো কুমিরের মত চোখ। দৃষ্টি ঘোলাটে।’

‘সেই ঘোলাটে চোখে অনেক কথা,’ বলল রানা। ‘এ ধরনের ব্যাপারগুলো ভবিষ্যতে খেয়াল করলে সবই বুঝবে।’

‘নোংরা মনের সাইকোপ্যাথ,’ বলল বেলা। ‘শিশু ধর্ষক! ওর অন্তর বলে কিছুই নেই। একটা কথাও বলবে না। দেখো।’

‘বলবে বহু কথা,’ নিশ্চয়তা দিল রানা।

‘হয়তো তার আগেই ধরা পড়ব এই চোরাই গাড়ি নিয়ে।’

‘এই গাড়ি চোরাই হতে পারে, তবে নম্বর প্লেট নিয়েছি অল্টডর্ফ স্যালভেজ ইয়ার্ডের ভাঙা এক বিএমডাব্লিউ গাড়ি থেকে,’ বলল রানা। ‘এই নম্বর প্লেট খুঁজছে না পুলিশ।’

‘এটা-সেটা চুরি করছ, সেজন্যে মনে কোনও পাপ বোধ হচ্ছে না তোমার?’

‘বড় ধরনের পাপ তো নয়,’ বলল রানা। ‘পরে ফেরত পেয়ে যাবে এই গাড়ির মালিক। যদি গুঁতো মেরে ভেঙেও ফেলি, ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির দালালের ঘাড় চেপে ধরবে ওই লোক। তুমি শুধু মনের ভেতর এটুকু রাখো, আমরা মহৎ কাজে নেমেছি।’

‘তবুও মনে হচ্ছে, গাড়ির মালিকের জন্যে একটা চিরকুট রেখে আসতে পারতে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেলা।

‘সত্যি, ভুলই করেছি,’ হাসল রানা। ‘চিরকুটে লিখে দেয়া উচিত ছিল: আপনি এইমাত্র অংশ নিলেন জাতীয় নিরাপত্তামূলক কাজে। খুশি থাকুন!’ বেলাকে দেখে নিল রানা। ‘অত মন খারাপ কোরো না। এম্মেন এয়ার বেসে গিয়ে হামার পেয়ে গেলেই এটা রেখে যাব।’

‘তারপর কী করব আমরা?’

‘খুঁজে নেব পরিত্যক্ত পুরনো কোনও ফ্যাক্টরি দালান, ওয়্যারহাউস বা খামারবাড়ি।’

‘আগেই সব ভেবে রেখেছ,’ নালিশের সুরে বলল বেলা। ‘কিন্তু একটা কথা ভাবছ না: জার্মান কমাণ্ডো ফোর্সের প্রাক্তন সৈনিকের পেট থেকে কিছু বের করা একেবারেই অসম্ভব?’

‘আমিও তো কমাণ্ডো, বলল রানা। ‘ওর কাছে ভাল মানুষের মত জানতে চাইব, কোথায় আছে ডেইটার গিসেল। অন্যাথ মুখ না খুললে বাধ্য হয়েই ঘি তুলব আঙুল বাঁকা করে।’

একবার না-সূচক মাথা নাড়ল বেলা।

‘দেখবে সবই জানাবে,’ বলল রানা।

নীরবতা নামল দু’জনের মাঝে।

অল্টডর্ফ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে লুসার্ন। পথের বেশিরভাগ অংশ মোটর-ওয়ে। লুসার্নের সামান্য দূরেই এম্মেন শহর। কাছেই মিলিটারফ্লাজপ্ল্যাট এম্মেন। দুপুর দুটোয় ওখানে পৌঁছুল রানা ও বেলা। মিলিটারি এয়ার বেস, সহজে ওখানে নামে না সাধারণ বিমান। আগে থেকে না জানিয়ে রাখলে ভেতরে ঢুকতে পারে না কেউ। অবশ্য ইন্টারপোলের

বড়কর্তাদের অনুরোধে আজ রানা ও বেলার জন্যে খুলে গেল চওড়া গেট। প্রশ্ন করা হলো না কোনও। কিছুটা যাওয়ার পর সবুজ এক প্রিফ্যাব দালানের ভেতরে এইচওয়ান হামার গাড়িটা পেয়ে গেল ওরা। ইগনিশনে চাবি। দুপুরের আগেই ফ্রেঞ্চ এক মিলিটারি এয়ারবাস ট্র্যান্সস্পোর্ট বিমানে চেপে পৌঁছে গেছে গাড়িটা।

কথা রেখেছে কমিশনার অ্যাল মার্লো। হামারের সিটের পেছনে পাশাপাশি হেভি ডিউটি দুটো ন্যাটো ইণ্ড্য কিটব্যাগ। একটার ভেতরে প্লাস্টিকের যিপলক পাউচ। তাতে যথেষ্টর চেয়েও বেশি ইউরো ব্যাঙ্ক নোট ও সুইস ফ্র্যাঙ্ক। এ ছাড়া আছে নতুন ফোন ও রেডিয়ো। ব্যাগে আরও আছে রাবারের হ্যাণ্ডেলওয়ালা এসওজি ট্যাকটিকাল নাইফ। কালো ফলা ক্ষুরের মত ধারালো। আরও আছে অ্যালিউমিনিয়াম দিয়ে তৈরি একটা পুলিশ হ্যাণ্ডকাফ। নীরবে যেন কমিশনার মনে করিয়ে দিচ্ছে রানাকে, আশা করি আমরা জীবিত পাব ডেইটার গিসেলকে। দ্বিতীয় ব্যাগ বেশি ভারী। ভেতরে তেল দিয়ে পরিষ্কার করা চকচকে নতুন যুগের ফ্যামাস রাইফেল ও শত শত বুলেট। এ ছাড়া রয়েছে ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল। এবার বোধহয় ভেতরে নেই জিপিএস ট্র্যাকার। পিস্তলের জন্যে রয়েছে পাঁচটা লোডেড ম্যাগাযিন। প্রতিটির ভেতর আটটা ঝিলিক দেয়া নতুন .৩৮ ক্যালিবারের ফুল মেটাল জ্যাকেট বুলেট। অস্ত্র ও গুলি দেখে রানার মনে হলো, ডেইটার গিসেল বাঁচল না মরল, তাতে কচুও যায় আসে না কমিশনারের।

পিস্তল কক করে কোমরের পেছনে রেখে দিল রানা। ব্যাগের চেইন টেনে চলে গেল সামনের কাউন্টারে। ওখানে বসে আছে এক সার্জেন্ট। হামার বুঝে নেয়ার জন্যে একটা ফর্মে সই করল রানা। কাজটা শেষ হতেই আবার গিয়ে উঠল জিপে। চাবি মুচড়ে দিতেই গর্জে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। ফিউয়েল গেজ দেখল ও। ট্যাঙ্ক পুরোপুরি ভরা। হামার ড্রাইভ করে এয়ার বেস থেকে বেরিয়ে এল রানা। পেছনে মার্সিডিয নিয়ে এল বেলা।

এক কিলোমিটার পেরোবার পর এয়ার বেসের ওয়াইয়ার বেড়ার পাশে রাস্তার ধারে থামল ওরা। হামার থেকে নেমে চোরাই গাড়ির বুট খুলল রানা। ভিকি অন্যাথ বোধহয় প্রথমে ভেবেছিল তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে উদ্ধার করার জন্যে। এবং তা করেছে ডেইটার গিসেল। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুটের ভেতর গরমে সিদ্ধ হয়ে মন দমে গেছে তার।

রানাকে দেখেই ঘেউ করে উঠল লোকটা, ‘ধরে নাও তুমি লাশ, শুয়োরের বাচ্চা!’

তার হাতে হ্যাণ্ডকাফ আটকে দিয়ে টেনে গাড়ি থেকে নামাল রানা। ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে গেল হামারের পাশে। ‘সহজে মরতে চাইলে নিজের মাথায় গুলি করো! খুন হওয়ার আগে বুঝবে ভিকি অন্যাথ কী মাল! শুনতে পেয়েছ আমার কথা, হারামজাদার বাচ্চা?’

‘তুমি কিন্তু এখন আর ফ্যাকাসে লাল করিডোরে নেই, ‘ নরম সুরে বলল রানা। অন্যাথ জবাব দেয়ার আগেই তার মাথার পাশে নামল ওয়ালথার পিপিকের নলের জোরালো এক খটাশ্। ভেজা তোয়ালের মত রাস্তায় নেতিয়ে পড়ল লোকটা। তার দুই কবজি ও গোড়ালি ডাক টেপ দিয়ে ভাল করে মুড়িয়ে নিল রানা। বাদ পড়ল না গলার নিচের পুরো দেহ। রেশম পোকার হাল হয়েছে ভিকি অন্যাথের। তার মুখে চার ইঞ্চি টেপ আটকে দিল রানা। লোকটাকে তুলে দিল হামারের সিটের পেছনে। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। মার্সিডিয থেকে সরিয়ে ফেলল দরকারি সবকিছু। ভাল করে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে দিল ভেতরের অংশ। এখন আর থাকবে না আঙুলের ছাপ।

কাজ শেষে আবারও হামারে উঠল ওরা। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে বেলা বলল, ‘এবার দেখা যাক কী করো।’

‘টেপের অভাব নেই,’ হুঁশিয়ারি জারি করল রানা। ‘তুমিও বেশি কথা বললে…’

‘শেষে হয়তো বাধ্য হব তোমাকে গ্রেফতার করতে, পাল্টা হুমকি দিল বেলা।

‘এবার পরের কাজ, ওটা কঠিন,’ হামার নিয়ে রওনা হয়ে গেল রানা।

‘দেখো, আমি বলছি, একটা কথাও বলবে না,’ মাথা নাড়ল বেলা। গম্ভীর হয়ে গেছে ওর চেহারা।

‘আসলে মুখ না খুলে উপায় নেই বেচারা অনাথের,’ জানাল রানা।

আরেকবার মাথা নাড়ল বেলা। ‘দেখো, সত্যি হবে আমার কথা।’

ঊনপঞ্চাশ

প্রকাণ্ড মিলিটারি ফোর-হুইল-ড্রাইভ নিয়ে শহর বা গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়া মোটেও স্বস্তিকর নয়। তার ওপর, গাড়ির ভেতরে রয়েছে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রচুর গুলি। এ ছাড়া, রানা হাইজ্যাক করেছে প্রমাণিত এক অপরাধীকে। পুলিশ একবার ওকে ধরতে পারলে বাকি জীবনে বেরোতে পারবে না জেল থেকে। বিপদের সম্ভাবনা কমাতেই রানা চলেছে সুইস উরির ক্যান্টন এলাকার দিকে। ওটা এক হাজার বর্গ মাইলেরও বেশি পাহাড়ি অঞ্চল। পাঁচভাগ জায়গায় পাইনের জঙ্গল। প্রতি মাইলে জনসংখ্যা বড়জোর দু’জন। একের পর এক সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে দু’পাশে নীল জলের লেক পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে রানা। দূরে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে লেকের বুকে অলস ভঙ্গিতে ভাসছে প্যাডল স্টিমার। একবার পাহাড়ের বহু ওপরে উঠছে রাস্তা, আবারও নেমে যাচ্ছে বহু নিচে। চারপাশে এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি চূড়া। কোথাও কোথাও রাস্তাটাকে চেপে ধরেছে গাছের সারি। জায়গায় জায়গায় সবুজ সুড়ঙ্গের মত। প্রায় বিকেল হতে চলেছে। ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছে রানা। এরই ভেতর বেশ ক’বার ভেবেছে, ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ওয়্যারহাউস, ফ্যাক্টরি বা খামারবাড়ি মোটেও পরিত্যক্ত নয়। যে কাজে নেমেছে, ওর চাই নিরাপদ বাড়ি। সেটা হতে হবে রাস্তা থেকে বেশ অনেকটা দূরে।

হঠাৎ ছোট এক শহরের কিনারায় পৌঁছে বিড়বিড় করল রানা, ‘দুশালা!’

মফস্বল শহর। ছোট ছিমছাম সব বাড়ি। একপাশে গাছের সারির ভেতর কারুকাজ করা হলদে গির্জা। পেছনের স্কয়্যারের ফ্ল্যাগপোলে ঝুলছে বিশাল এক ষাঁড়ের করোটি। ওটা দেখিয়ে দিচ্ছে ওখানে আছে আর্মির অফিস। পাশের কাঠের পোক্ত খুঁটিতে তিনটে তীর। সামনে তিনটা সরু রাস্তা দেখাচ্ছে। একটা র‍্যাথাউস, টাউন হল; আরেকটা ব্যাহহফ বা রেল স্টেশন; অন্যটা আর্যটেযেনট্রাম বা হাসপাতাল।

হামার নিয়ে এগিয়ে চলেছে রানা। তবে কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর জংলা এলাকায় পরিত্যক্ত এক কটেজ দেখল বেলা। ডানে গাছপালা ও ঝোপঝাড়। বামে কয়েক শ’ গজ দূরে আঁকাবাঁকা রাস্তা।

‘থামো,’ বলল বেলা।

ব্রেক কষে থেমে পিছিয়ে গেল রানা। দেখেছে কটেজ। একবার মাথা দোলাল। রাস্তা থেকে নেমে মাটির রাস্তা ধরে চলল হামার। থামল ওরা পুরনো ওই বাড়ির সামনে। প্রায় ধসে গেছে ঢালু ছাত। জানালার ফ্রেম থাকলেও কবাট নিয়ে গেছে কেউ। দরজার সামনে জন্মেছে ঝোপঝাড়। উঠানে প্রাচীন এক সিমকা গাড়ি। বাকি জীবনেও চালু হবে না। এটা পরিষ্কার, এই বাড়িতে বাস করে না কেউ।

বাড়ির সামনে থেমে হামারের ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। হালকা লাথি মেরে খুলল গাড়ির দরজা। নেমে পড়ল মাটিতে। গাড়ির পেছন দরজা খুলে বাঘের মত খপ্ করে ধরল ভিকি অন্যাথকে। জেগে আছে সে। হাঁসফাঁস করছে। ভয়ানক সব গালি দিচ্ছে, কিন্তু টেপের কারণে বোঝা যাচ্ছে না কিছু। ফুলিয়ে ফেলেছে লাল দুই গাল। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নিজেকে ছোটাতে। ফলে কপালে ফুটেছে কয়েকটা নীল রগ। এসওজি নাইফ ব্যবহার করে তার গোড়ালির টেপ কাটল রানা। হিঁচড়ে নামাল তাকে মাটিতে। পায়ে ঝিঁঝির কারণে টলছে লোকটা। ঘাড় ধরে তাকে পরিত্যক্ত কটেজের দিকে নিয়ে চলল রানা।

‘কী করবে ভাবছ?’ ঠোঁট কামড়ে ধরল বেলা। অনিশ্চিত চোখে দেখছে রানাকে।

‘আমার বদলে উইলিয়াম টেল থাকলে ব্যাটাকে গাছের সামনে দাঁড় করিয়ে, ওর মাথায় আপেল রেখে তীর মেরে টার্গেট প্র্যাকটিস করত,’ বলল রানা। ‘এবার ওকে একটু নরম করে নেব।’

‘কিন্তু তোমার সঙ্গে তো আর তীরধনুক নেই,’ আপত্তির সুরে বলল বেলা।

‘এটা আমার জীবনের লজ্জাজনক এক অধ্যায়,’ বলল রানা। লাথি মেরে খুলল কটেজের দরজা। ওপরের দেয়াল থেকে ঝরঝর করে মেঝেতে ঝরল শুকনো রঙ। বাড়ির ভেতরে ইঁদুরের পায়খানার বাজে গন্ধ। পানিতে পচে যাওয়া দেয়াল থেকে খসে পড়ছে চল্টা। একটু দূরে ভেতরে যাওয়ার আরেক দরজা পেয়ে আবছা আলোর ঘরটাতে অন্যাথকে নিল রানা। আসবাবপত্র বলতে মেঝেতে প্রাচীন আমলের দুটো চেয়ার। ফাটল ধরা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে আসছে বাইরের আলো।

একটা চেয়ারের দিকে ভিকি অন্যাথকে ঠেলল রানা। বসিয়ে দিল ওটার ওপর। ব্যাক রেস্টের পেছনে রয়ে গেছে লোকটার হ্যাণ্ডকাফ পরা দু’হাত। বেলার দিকে টেপ ছুঁড়ল রানা। ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলের নল তাক করেছে বন্দির মাথায়। চেয়ারের পায়ার সঙ্গে টেপ দিয়ে অন্যাথের দুই গোড়ালি আটকে দিল বেলা। টেপ ব্যবহার করে চেয়ারে ভাল করে বাঁধল তার বুক ও কোমর।

অন্য চেয়ারে বসে অন্যাথের মুখোমুখি হলো রানা, হাতে পিস্তল। নলটা তাক করেছে সরাসরি বন্দির বুকে। ঝুঁকে বাম হাতে চড়চড় করে খুলল অন্যাথের মুখের টেপ। নরম সুরে বলল, ‘আমরা এবার কথা বলতে পারি। কী বলো?’

ক্ষুধার্ত হাঙরের দৃষ্টিতে রানাকে দেখল অন্যাথ। ‘তুমি জানোও না কখন খুন হয়ে গেছ!’

‘আগেও এসব বোলচাল শুনেছি বহুবার,’ বলল রানা। ‘তার চেয়ে বলো, কোথায় তোমার বন্ধু ডেইটার গিসেল। মুখ না খুললে পরিত্যক্ত এই বাড়িতে গভীর রাতে তোমাকে খেয়ে নেবে ইঁদুর। বুঝতে পেরেছ আমার কথা?’

‘তুমি চাও ডেইটার গিসেলকে,’ বলল অন্যাথ

‘বাহ্, তুমি তো চট্ করে সব বুঝতে পারো,’ বলল রানা। ‘একেই বলে পারাটি দলের সদস্য!’

বিশ্রী হাসল ভিকি অন্যাথ। ‘তোমরা এত কষ্ট করলে, কারণ তোমরা আসলে জানো না সে কোথায়। তা-ই না?’

‘আজ হোক বা কাল, তাকে পারই,’ বলল বেলা।

বাঁকা চোখে ওকে দেখল ভিকি অন্যাথ। ঠোঁটে টিটকারির হাসি। যেন মনে মনে বলছে, ‘কিছুই করতে পারবি না তোরা! তোদের চেয়ে ঢের চালাক গিসেল! এবার মরবি তোরা!’

লোকটার কপালে ওয়ালথারের নল ঠেকাল রানা। সহজ সুরে বলল, ‘যা বলার জলদি, অন্যাথ!’

কথাটা পাত্তা দিল না জার্মান লোকটা। ঠোঁটে মুচকি হাসি। দেখছে আস্ত দুই গাধাকে। তার নিজের হাতে রয়ে গেছে সেরা তাস। ‘বাদামি কুত্তার বাচ্চা, পারলে গুলি কর্! তাতে কিছুই হবে না! পরে তোরা বুঝবি কী করেছে গিসেল!’

‘আমরা জানি সে কী করতে চায়,’ বলল বেলা। ‘ভুলেও ভেবো না সফল হবে।’

‘তাই নাকি? তো কীভাবে তাকে ঠেকাবি তোরা? ভাবছিস চুপ করে বসে থাকবে ডেইটার গিসেল? তোরা জানিসও না সে কী ধরনের মানুষ।’

‘আমরা তোমার কাছ থেকে সাহায্য চাইছি,’ বলল বেলা। ‘তুমি নিশ্চয়ই চাও না মারা পড়ক কোটি কোটি মানুষ?’

কাঁধ ঝাঁকাল অন্যাথ। ‘তাদের কী হবে তাতে আমার কী?’ আবছা আলোর ঘরে নামল থমথমে নীরবতা। ইঁদুরের পায়খানার গন্ধে কুঁচকে আসতে চাইছে নাক। হাতের পিস্তলটা দেখছে রানা। সামান্য কাত করে ধরল। নরম সুরে বলল, ‘পিস্তলটা দেখে ভয় লাগছে না তোমার, ভিকি?’

‘আগেও আমার দিকে বহুবার ও-জিনিস তাক করা হয়েছে,’ বলল লোকটা। ‘তারা ছিল তোর চেয়ে অনেক বেশি শক্ত। তবুও বেঁচে আছি।’

‘পিস্তলের আসলে এটাই সমস্যা,’ অস্ত্রটার নল নামিয়ে নিল রানা। হাঁটুর কাছে রেখে ক্লিক আওয়াজে অন করল সেফটি ক্যাচ। ‘এ জিনিস দেখলে হয় ভয় পাবে কেউ, নইলে একেবারেই না। ওই দুই পর্যায়ের মাঝে কিছুই নেই। আমি এখন তোমার পায়ে গুলি করলে তুমি চলে যাবে শকের ভেতর। এত দ্রুত বেরোবে রক্ত, শেষে অসুস্থ হয়ে পড়বে। কিন্তু তা হলে আমার তো চলবে না। ‘

‘ভয় দেখাবার চেষ্টা করে কোনও লাভ হবে না,’ বলল অন্যাথ।

‘তোমার মুখ খুলতে যে পিস্তল লাগবে, তেমনও নয়,’ বলল রানা। ‘কথা তুমি ঠিকই বলবে। তবে সেজন্যে তোমাকে দিতে হবে সামান্য ব্যথা। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

তৃপ্ত হাসি আরও চওড়া হলো অন্যাথের। ‘ভাবছিস ক্ষতি করে দিবি, তাই না, গাধার বাচ্চা?’

‘এবার বুঝলাম তুমি সত্যিই খুব টাফ,’ বলল রানা। ‘আপত্তি নেই ব্যথা পেতে। আর্মিতে ইন্টারোগেশন ট্রেইনিং- এর ভেতর দিয়ে গেছ, তাই ভাবছ সবই সহ্য করতে পারবে।’ তিক্ত হাসল অন্যাথ। হাঙুরে চোখে দেখছে রানাকে।

‘আমিও গেছি ওই ট্রেইনিং-এর ভেতর দিয়ে,’ বলল রানা। ‘মোটেও ভাল লাগেনি। তবে ওটা থেকে পেয়েছি জরুরি শিক্ষা। তুমি ভাল করেই জানো, কেমন হয় মানুষের শরীর। খুব দুর্বল। প্রচণ্ড নির্যাতন হলে এক পর্যায়ে ভেঙে পড়ে মানসিক প্রতিরোধ। এমন কী ভিকি অন্যাথও পারবে না মুখ বন্ধ রাখতে। কাজেই বলছি, নিজেকে সুপার হিউম্যান না ভেবে বলো যা জানতে চাইছি।’

‘কে তুই, শুয়োরের বাচ্চা?’ খেঁকিয়ে উঠল অন্যাথ।

‘মানুষের সহ্যের সীমা কোন্ পর্যন্ত, সেটা জানে এমন এক লোক আমি,’ বলল রানা। ‘বিশ্বাস করো, আমি কাজে নামলে চুরমার হবে তোমার সমস্ত গর্ব। কাজ শেষে বিন্দুমাত্র খারাপ ও লাগবে না আমার। ঠিক যেমন তোমার খারাপ লাগেনি তেরো বছরের বাচ্চা মেয়েটাকে ধর্ষণ করতে।’

চুপ করে থাকল ভিকি অন্যাথ।

ঘুরে রানাকে দেখল বেলা। হাত রাখল বিসিআই এজেন্টের কাঁধে। অন্যাথকে নরম সুরে বলল, ‘প্লিয, মেনে নাও ওর কথাটা। তুমি কেন পক্ষ নেবে ডেইটার গিসেলের? সে তো তোমার বন্ধু নয়। আজ ইচ্ছে করলে তোমাকে মুক্ত করতে পারত। তা করেনি। আর পরে যদি সে প্লেগের জীবাণু ছড়িয়ে দেয়, তুমি নিজেও তো মরবে ওটার কারণে।’

কী যেন ভাবছে অন্যাথ। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল সে। ‘অন্য কারও মগজে বাজে চিন্তা ঢোকা গিয়ে, হারামি কুত্তী! ভেবেছিস আমি দুধের শিশু?’

‘শেষ সুযোগ পেলে,’ বলল রানা। ‘ডেইটার এখন কোথায়?’

মাথা নেড়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকল ভিকি অন্যাথ। সরাসরি তাকাল ঘরের অন্ধকার কোণে।

রানার দিকে তাকাল বেলা। যেন নীরবে বলছে, একটা কথাও বলবে না এই লোক।

তিলতিল করে পেরোচ্ছে সময়। কেউ জানে না কখন নিরীহ কোটি কোটি মানুষের জীবনে নরক ডেকে আনবে ডেইটার গিসেল।

‘জীবিত কেউ হঠাৎ উধাও হতে পারে না,’ বলল রানা। ‘তবে তোমার ক্ষেত্রে তেমনই হবে, অন্যাথ। ভাল চাইলে জবাব দাও: কোথায় লুকিয়ে আছে ডেইটার গিসেল?’

ঘুরে রানাকে দেখল অন্যাথ। খুশিতে চকচক করছে চোখের মণি। ‘সে আছে এমন এক জায়গায়, যেখানে যেতে পারবে না কেউ। আর ওখানে গেলে আগেই জানবে সে। এক মাইলের ভেতর তোদেরকে দেখলে আত্মগোপন করবে গিসেল। দরকার হলে ওখানে থাকবে বছরের পর বছর।’

‘আমি অপেক্ষা করব,’ বলল রানা। ‘শেয়ালের গর্ত থেকে সে মাথা বের করলেই ধরব। আর সেজন্যে তুমি বলে দেবে ঠিক কোথায় অপেক্ষা করতে হবে আমাকে।’

‘তুই শালা আসলে দুনিয়ার সেরা চুতিয়া গাধা। কারও সাধ্যি নেই যে ওকে ঠেকায়। সারাজীবন এটাই চেয়েছে গিসেল।’

‘সকাল থেকেই অনেক ধৈর্য ধরেছি,’ বলল রানা। ‘বারবার ভেবেছি, একসময়ে অধৈর্য হয়ে উঠব। আর তখন এক এক করে ভাঙব তোমার হাড়। …এরপর কিন্তু একটাও প্রশ্ন করব না। শেষবারের মত জানতে চাইছি, ডেইটার গিসেল কোথায়?’

ঘাড় কাত করে অন্যদিকে তাকাল অন্যাথ। ‘তুই শালা আসলে সত্যিকারের মাদারচোত!’

‘না, তোমাকে দেখছি ছেড়ে দিতে হবে,’ গালি খেয়ে লালচে হয়ে গেছে রানার মুখ।

জিতে গিয়ে খুশিতে চকচক করছে অন্যাথের দুই চোখ। উঠে দাঁড়াল রানা। বেল্টে গুঁজল ওয়ালথার পিস্তল। পকেট থেকে নিল হ্যাণ্ডকাফের চাবি। অবাক চোখে ওকে দেখছে বেলা। ভিকি অন্যাথের চেয়ারের পেছনে গেল রানা। চাবি দিয়ে খুলল দুই কাফ। মেঝেতে পড়ে ঠং আওয়াজ তুলল অ্যালিউমিনিয়ামের হাতকড়া।

চেয়ারের পাশে ঝুলছে জার্মান লোকটার দুই হাত। খুশি, মুক্তি পাবে একটু পর। মাংসপেশির আড়ষ্টতা কাটাতে গিয়ে ঝাঁকিয়ে নিল কাঁধ।

বেলার দিকে তাকাল রানা। ‘বাইরে তাজা হাওয়া। ঘুরে এসো। এখানে ইঁদুরের পায়খানার বাজে গন্ধ।’

‘না, আমি ঠিক আছি,’ ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল বেলা।

‘বেশ,’ বলল রানা। খপ্ করে অন্যাথের বাম হাতটা মুচড়ে ধরে পিঠের দিকে নিয়ে নিচে হ্যাঁচকা টান দিল ও। প্রচণ্ড চাপ পড়তেই ক্লচাক্‌ আওয়াজে কাঠির মত ছিঁড়ল কার্টিলেজ। তীব্র ব্যথায় কেঁউ করে উঠল অন্যাথ।

আতঙ্কিত ও হতবাক বেলার দিকে চেয়ে নেই রানা। ‘ভুলে গেলে, ভিকি, মানুষের দেহে এক শত ষাটটা জয়েন্ট। তবে আমাদের হাতে এত সময় নেই যে একটা একটা ভাঙব। জরুরি কয়েকটা জয়েন্ট নিয়েই কাজ করব। কবজি, গোড়ালি, কনুইয়ের হাড় ও হাঁটু দিয়েই আপাতত শুরু করা যাক। সেগুলোর পর আছে কোমর ও দুই কাঁধ। এরপর মেরুদণ্ডের ভার্টেব্রা। কোন্‌টা আগে ভাঙব, সেটা বলে দেবে তুমি। কাজেই ভাল চাইলে চটপট বলো কোথায় আছে গিসেল।’

কপাল ও ঘাড়ের রগ ফুলে গেছে ভিকি অন্যাথের। ভয়াবহ যন্ত্রণায় বিস্ফারিত হয়েছে দুই চোখ। ডানহাতে ধরেছে ভাঙা কবজি।

‘মানুষকে চমকে দিতে ভালবাসো তুমি,’ বলল রানা। ‘তাতে আমারও আপত্তি নেই।’ ভিকি অন্যাথ সরে যাওয়ার আগেই চেয়ারের ডানে সরল রানা। চেপে ধরল লোকটার ডান কবজি। অন্য হাতে পেছন থেকে খামচে ধরেছে অন্যাথের বাইসেপ। প্রচণ্ড টানে হাত উল্টো দিকে নিয়ে একই সময়ে হাড়ের ওপর হাঁটু নামাল রানা।

করুণ আর্তনাদ ছাড়ল অন্যাথ। সেই চিৎকার ছাপিয়ে শোনা গেল হাড় ভাঙার মড়াৎ আওয়াজ। রানার হাতে তুলতুল করছে লোকটার শিথিল হাত। ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জয়েন্টের ওপরে মাংসপেশি ও সিনিউয়ের সঙ্গে যুক্ত উলনা ও নিচের রেডিয়াস। হাত ভাল করতে লাগবে একাধিক অপারেশন। জখম সেরে উঠতে লাগবে কয়েক মাস। আসলটা ফেলে হয়তো বসাতে হবে কনুইয়ের নকল জয়েন্ট। রানা সরে যেতেই দুই হাত পড়ে থাকল অন্যাথের কোলে। ছটফট করছে লোকটা। একবার মাথা নাড়ছে এদিক, আবার ওদিক। শ্বাস ফেলছে ফোঁস ফোঁস করে। দাঁত দিয়ে কামড়ে কেটে ফেলেছে ঠোঁট। থুতনি বেয়ে নামছে ফেনা ভরা লালা।

‘রানা…’ আপত্তির সুরে শুরু করেছিল বেলা…

‘তুমি চাইলে ব্যথা এড়িয়ে যেতে পারো,’ বেলার দিকে না চেয়ে ভিকি অন্যাথকে বলল রানা।

‘ম… ম… মর, কুকুরের বাচ্চা!’ দাঁতে দাঁত পিষল লোকটা।

তার সাহসের প্রশংসা না করে পারল না রানা। পাথরের মতই দৃঢ় এর মনোবল। এক পলক তাকে দেখল রানা, তারপর লাথি মেরে তার নিচ থেকে সরিয়ে দিল চেয়ার। কাত হয়ে মেঝেতে পড়েছে ভিকি অন্যাথ। পাশে দাঁড়িয়ে এসওজি ট্যাকটিকাল ছোরা বের করল রানা। ঝুঁকে কাটল চেয়ারের পায়ার সঙ্গে অন্যাথের ডান গোড়ালির টেপ। ওপর থেকে ফেলতেই খট আওয়াজে মেঝেতে গাঁথল ছোরার ডগা। ভীষণ ব্যথায় দুই পা ছুঁড়ছে অন্যাথ। তার গোড়ালি ও কাফ মাসলের পাশে তিরতির করে কাঁপছে ছোরাটা। ওটা তুলে নিল রানা। ‘এর পরেরবার ছোরা গাঁথবে মাংসে।’

‘রানা, প্লিয, এভাবে কিছুই জানব না আমরা,’ অনুরোধের সুরে বলল বেলা।

‘শুনলে এজেণ্ট বেলাইতের কথা, ভিকি?’ বলল রানা। ‘ও চাইছে যেন তোমাকে আর কষ্ট না দিই। তোমার বন্ধুরা কিন্তু দয়া করেনি আমার বন্ধুদের প্রতি।’ অন্যাথের ডান গোড়ালি ধরে মোচড় দিতে শুরু করল রানা। কেন্নোর মত গুটিয়ে যেতে চাইল লোকটা। বুকের দিকে টেনে নিতে চাইছে পা। কিন্তু শক্ত হাতে গোড়ালি ধরে মোচড় দিল রানা। যে-কোনও সময়ে ভাঙবে হাড়। ‘তবে তোমার বন্ধু আর আমার বন্ধুদের ভেতর অনেক তফাত,’ বলল রানা। ‘আমার যে খুব ভাল লাগছে এসব করতে, তা নয়। কিন্তু তোমার বন্ধুদের মনে হয়েছিল ব্যথা ও মৃত্যু ডেকে আনলে ভাল লাগবে তাদের। এমন কী তোমার মত শিশু-ধর্ষকের চেয়েও অনেক নিচু শ্রেণীর লোক তারা। আর তাদের মত একদল নরপশুর জন্যে কেন এত কষ্ট সহ্য করবে তুমি? তাই আবারও জানতে চাইছি, কোথায় আছে ডেইটার গিসেল। এখনও সময় আছে, ডাক্তাররা সুস্থ করে তুলতে পারবে তোমাকে। এরপর কিন্তু…’ এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল রানা।

লোকটা ঘাড় ত্যাড়ামি, করবে, সেজন্যে তৈরি রানা। এরপর দেবে আরও বেশি যন্ত্রণা। আসলে একবার সীমা পেরিয়ে গেলে উপায় থাকে না থেমে যাওয়ার। হয়তো বাকি জীবন খচখচ করবে ওর মন।

পেরিয়ে গেল আরও দুটো সেকেণ্ড। তারপর পাঁচ সেকেণ্ড। ‘কী? বলবে?’

টু শব্দ করল না ভিকি অন্যাথ।

কিন্তু সহ্যের মাত্রা আছে যে-কোনও মানুষের। রানা একপা এগোতেই হাউমাউ করে উঠল সে, ‘বলছি! বলছি!!’

ভিকি অন্যাথ মুখ খুলতেই চাপা স্বস্তির শ্বাস ফেলল রানা। পশুটার কপাল ও গাল থেকে ঝরছে ঘামের ফোঁটা। তীব্র ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ফুঁপিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। দিতে লাগল জরুরি তথ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *