চল্লিশ
‘মানে?’ অবাক চোখে রানাকে দেখল বেলা।
‘রাইফেল তাক করো আমার মাথায়, বোকা মেয়ে,’ বলল রানা। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মেঝেতে। দু’হাত মাথার ওপর।
দ্বিধা করল বেলা। তবে বুঝে গেল, এ ছাড়া উপায়ও নেই। রানার মাথার দিকে একে-৪৭ তাক করে বলল, ‘ওরা জানল কী করে যে আমরা এখানে?’
‘আমার সঙ্গে কথা বোলো না,’ বলল রানা।
পরক্ষণে প্যাসেজে পৌছুল সাবমেশিন গান হাতে সোয়্যাট অফিসাররা। দরজা খুলে ঝোড়ো বেগে ঢুকল ঘরে। রানার দিকে তাক করা হয়েছে অন্তত দশটা আগ্নেয়াস্ত্র।
চুপ করে বসে থাকল রানা। নিজেকে ডিজিএসআই এজেন্ট বলে পরিচয় দিচ্ছে বেলা। ওর কথা শেষ হতেই প্রশংসা করতে লাগল সোয়্যাট টিমের সিও। কাজের কাজ করেছে বেলা। এবার তারাই নেবে দায়িত্ব।
রানাকে মেঝেতে ফেলল দুই অফিসার। ওর হাতদুটো পিঠের কাছে নিয়ে কবজিতে আটকে দিল প্লাস্টিকের টাই। টু শব্দ করছে না রানা। সার্চ করছে ওকে। হাতছাড়া হলো সাধুর পিচ্চি বোতল। লোকগুলোর ভাব দেখে মনে হলো, ওটা যেন নাইট্রোগ্লিসারিন। মিনিটখানেক পর টান দিয়ে তুলে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো প্যাসেজে। সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নামল রানা। পাহারা দিয়ে ওকে বের করা হলো বাড়ি থেকে। চারপাশে পুলিশের গাড়ি থেকে বেরুচ্ছে নীল আলোর বন্যা। ট্যাক্সিটা দূরে দেখল রানা। ওটাকে ঘিরে ধরেছে একদল পুলিশ। গাড়ির বুট থেকে নিল রানার ব্যাগ ও হোল্ডঅল। টান দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তার ওপর উপুড় করা হলো ড্রাইভারকে। উল্টে যাওয়া কচ্ছপের মত হাত-পা ছুঁড়ছে সে। পিঠে তাক করা হয়েছে একগাদা আগ্নেয়াস্ত্র। তবে রানা জানে, দু’একঘণ্টা পর তাকে ছেড়ে দেবে পুলিশ। ওর নিজের কপাল হয়তো অত ভাল নয়। ভাবছে, এরা জানল কীভাবে কোথায় আছে ওরা!
একটু পর হয়তো জানবে কীভাবে ধরা পড়েছে।
ঘিরে ধরে পুলিশের কালো এক ভ্যানের দিকে রানাকে নিয়ে চলল ছয় অফিসার। গাড়ির পেছন দরজা খোলা। ভেতরটা যেন জানালাহীন স্টিলের খাঁচা। পিঠে ধাক্কা দিয়ে ওখানে তুলে দিল ওকে। এটা স্ট্যাণ্ডার্ড অ্যারেস্ট প্রোসিজার। খাঁচার বেঞ্চে বসে বাইরে তাকাল রানা। পুলিশদের চেহারা অতিরিক্ত গম্ভীর। ধমকে উঠছে রেডিয়োতে। এক অপরাধীকে গ্রেফতার করেছে বলে অত জরুরি ভাব কেন? না, এ ছাড়াও ঘটেছে খুব অস্বাভাবিক কিছু।
আশপাশে নেই বেলা।
ওকে সরিয়ে নিয়েছে পুলিশ অফিসাররা?
রানা দেখল, দূর থেকে ছুটে আসছে নামহীন এক প্যানেল ভ্যান। জ্বলজ্বল করছে ওটার হেডলাইট। নীল আলো বেরোচ্ছে রেডিয়েটর গ্রিলের ওদিক থেকে। সাইরেনের কর্কশ আওয়াজ। গাড়িটাকে বাধা দিল না কেউ। পথ থেকে সরে যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি। ভ্যানটা কালো নয়, সাদা রঙের। ব্রেক কষে থামল বাড়ির সামনে। সরসর করে খুলে গেল পাশের স্লাইডিং দরজা। নেমে এল চারজন লোক, হাতে অস্ত্র নেই। পরনে নভোচারীদের মত সাদা-রুপালি চকচকে পোশাক। নিউক্লিয়ার, কেমিকেল বা ব্যাকটেরিয়োলজিকাল দূষণ থেকে বাঁচতে ব্যবহার করা হয় ওই পোশাক। সাদা পোশাকে লেগে ছিটকে যাচ্ছে নীল আলো। লোকগুলোর মুখের হেলমেটে পুরু ভাইসর। ভারী গ্লাভস পরা হাতে কয়েক ধরনের ইকুইপমেন্টের কেস।
‘হ্যাযম্যাট টিম,’ বিড়বিড় করল রানা।
রেডিয়ো পেয়ে এসেছে, তা নয়। রওনা হয়েছে আগেই। হয়তো একটু দূরেই ছিল। হাজির হয়েছে নির্দেশ পেয়ে। ওরা এমন কিছু জানে, যেটা রানার জানা নেই।
এটা যুদ্ধ এলাকা নয়, অথচ সুইট্যারল্যাণ্ডের লেকের ধারের পাবলিক এলাকায় হাজির হয়েছে হ্যায়ম্যাট টিম।
তা হলে কি জারি করা হয়েছে মহাবিপদ সঙ্কেত?
পুলিশের গাড়ি সরতেই বাড়ির সামনে এসে থামল আরও তিনটে সাদা ভ্যান। এরই ভেতর সরে যেতে শুরু করেছে পুলিশ ও সোয়্যাট টিম। রাস্তা বেশি সরু বলে গাড়ি ঘোরাতে পারছে না তারা। নাকি সুরে কর্কশ আওয়াজ তুলছে ব্যাগ গিয়ার। দ্রুত পিছিয়ে চলেছে চাকা। পরের রাস্তায় পৌঁছেই ঘুরিয়ে নেয়া হচ্ছে গাড়ি। যেন এই এলাকায় পাওয়া গেছে এক মেগাটনের আণবিক বোমা। যে-কোনও সময়ে ফাটবে ওটা। তাই দেরি না করে পালিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো। এরই ভেতর ট্যাক্সি নিয়ে রাতের আঁধারে উধাও হয়েছে ড্রাইভার। সাদা ভ্যান থেকে নেমেছে চিকচিকে সাদা পোশাক পরা আরও আটজন লোক। তাদের একজন হাত তুলে ইশারা করল পুলিশদের দিকে। ভাইসরের ওদিক থেকে কী যেন বলছে সে।
ভীষণ ভয় পেয়েছে পুলিশ অফিসাররা। ছুটে গেল নিজেদের গাড়ির দিকে। আর কিছু দেখতে পেল না রানা। ধুম করে বন্ধ হলো ওর ভ্যানের পেছন দরজা। চারপাশে নামল ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাইরে দৌড়ে যাওয়ার শব্দ। ধুপ-ধাপ শব্দে বন্ধ হলো ক’টা গাড়ির দরজা। রানা টের পেল, দুলে উঠল মেঝে। হঠাৎ করেই রওনা হয়েছে ভ্যান। বেঞ্চে চুপ করে বসে থাকল ও। ভাবছে, দেখা যাক এবার কী ঘটে।
বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে কমল গতি। থামল ভ্যান। তারপর আবারও চলতে লাগল। ভ্যান বোধহয় চলেছে শহরের মাঝ দিয়ে। সামনেই কোথাও পুলিশ স্টেশন।
কিন্তু অনেকক্ষণ পেরোলেও আর থামল না ভ্যান। বাঁক নিল বহুবার। বেগ দেখে রানা ভাবল, শহর ছেড়ে যাচ্ছে ওরা। একটু পর পড়ল হাইওয়ে। গোঁ-গোঁ শব্দ করছে ইঞ্জিন। কড়কড় আওয়াজ তুলছে দ্রুত গতির চাকা। উল্টোদিকের বেঞ্চে পা ঠেকিয়ে চুপ করে বসে থাকল রানা। মৃদু দুলছে এদিক-ওদিক। ভাবছে, কোথায় নিয়ে চলেছে এরা?
পেরোল একঘণ্টারও বেশি।
দ্বিতীয় সেফ হাউসের কাছে কী দেখেছে, ভাবছে রানা। হয়তো গোটা এলাকা থেকে সবাইকে সরিয়ে নেবে হ্যাযম্যাট টিম। তা করবে গিসেলের ওই দুই লোকের কারণে। একজন মৃত। অন্যজন মরতে বসেছে। খুব গুরুতর কোনও ইনফেকশন হয়েছে তাদের। দেরি না করে কাজে নেমেছে ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম।
রানার মনে পড়ল মঠের সেই পাতাল ঘরের কথা।
ওখানে ছিল মৃত ও মৃতপ্রায় একদল মানুষ।
তা হলে কি তাদের মৃতদেহ থেকেই ইনফেকশন হয়েছে গিসেলের লোক দু’জনের?
এলিসের কথা মনে পড়ল রানার।
এবার কী হবে তার? সন্দেহ নেই সারারাত জেরা করবে বড় বড় অফিসাররা। জেনে নেবে মিশনের খুঁটিনাটি সব। কীভাবে ওই দল থেকে বেরিয়ে জিম্মি হয়েছিল, বাদ পড়বে না কিছুই। আশা করা যায়, নিজেকে ভালভাবেই রক্ষা করতে পারবে বেলা।
নিজেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় নেই রানা।
আসলে কিছুই তো করার নেই ওর।
এখন নিজেকে ছেড়ে দিতে হবে ভাগ্যের হাতে।
পেরোল আরও একঘণ্টা।
কবজি কেটে বসেছে প্লাস্টিকের কাফ। ল্যাকটিক অ্যাসিড জমেছে বলে ব্যথা করছে মাংসপেশি। দম নিয়ন্ত্রণ করে ব্যথার অনুভূতি থেকে মন সরিয়ে নিল রানা। রক্ষা পেল না চিন্তা- স্রোত থেকে। ভাবছে, মঠে প্রধান সাধুর সঙ্গে দাবা খেলার কথা। সেসময়ে তিনি যা বলেন, সব ঘুরে ঘুরে ফিরছে ওর মনে। সাধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারল না। জানা নেই বাকি জীবনেও বেরোতে পারবে কি না জেল থেকে। আরও কিছুক্ষণ পর দুশ্চিন্তামুক্ত হতে চাইল রানা। কিন্তু বেশ সময় লাগল মেডিটেশনের গভীর স্তরে যেতে। নিয়ন্ত্রিত হলো শ্বাস-প্রশ্বাস। শিথিল দেহে হেলান দিয়ে বসে থাকল দেয়ালে।
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল, সচেতন হলো গাড়ি থেমে যেতেই। কয়েক মুহূর্ত পর খুলে গেল পেছনের দরজা। ভেতরে ঢুকল উজ্জ্বল সাদা আলো। ধাঁধিয়ে গেল অন্ধকারে অভ্যস্ত চোখ। মিনিটখানেক পর খাঁচায় ঢুকল হ্যাযম্যাট সুট পরা দু’জন লোক। টান দিয়ে ভ্যান থেকে ওকে নামাল তারা। কাছেই অটোমেটিক অস্ত্র হাতে আরও ছয়জন। বিশাল এক পাতাল ঘরে থেমেছে ভ্যান। দূরে কংক্রিটের দেয়াল। একটু পর পর কংক্রিট পিলার। ছাত বেশ উঁচু। এইমাত্র প্রবেশ পথের জায়গায় নেমেছে হেভি ডিউটি স্টিলের শাটার। চারপাশে উজ্জ্বল সাদা হ্যালোজেন স্পটলাইট।
রানার পেছনে গেল হ্যাযম্যাট সুট পরা এক লোক। হাতে কাটার। কুটকুট করে কেটে দিল ওর কবজির টাই। ওকে ঘিরে ফেলল লোকগুলো, হাতে অস্ত্র। এস্কোর্ট করার ভঙ্গিতে মার্চ করে নিয়ে চলল এক ডোরওয়ের দিকে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে কবজি চলছে রানা। ঝাঁকিয়ে নিচ্ছে কাঁধ।
দরজার ওদিকে লিফটে রানাকে তুলে ষষ্ঠতলায় থামল লোকগুলো। হুইশ্ আওয়াজে দরজা খুলে যেতেই সামনে পড়ল চওড়া, দীর্ঘ করিডোর। ওর মনে হলো না এটা পুলিশ স্টেশন। ওকে বোধহয় এনেছে কোনও হাসপাতালে। অবশ্য আশপাশে নেই ডাক্তার, নার্স বা রোগী। বন্ধ প্রতিটি ঘরের দরজা।
‘কোথায় এনেছ?’ জানতে চাইল রানা।
জবাব দিল না কেউ।
এটা পাবলিক প্লেস নয় যে প্রবেশ অধিকার থাকবে সাধারণ মানুষের। মিলিটারি ফ্যাসিলিটি না হলেও সরকারি ভবন, ভাবল রানা। এত রাতেও এদের হাতে অস্ত্র। থমথম করছে চারপাশ।
করিডোর ধরে হেঁটে চলল ওরা। দেখা হলো হ্যাযম্যাট সুট পরা ক’জনের সঙ্গে। তাদের হাতে অস্ত্র নেই। সিকিউরিটি নয়, মেডিকেল পার্সোনেল, ভাবল রানা।
একটা দরজার সামনে থামল সবাই। দরজার ওপরে লেখা: ডিকনট্যামিনেশন।
একপাশের দেয়ালের প্যানেলে কি কোড দিল একজন। হাইড্রলিক্সের স্ আওয়াজে পিছলে খুলে গেল দরজা। পিঠে ধাক্কা খেয়ে ঘরে ঢুকল রানা। পেছনে আটকে গেল কবাট।
সাদা চারকোনা ঘরটা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে তিন বর্গ গজ। চারদেয়ালে টাইল্স্। দরজার জায়গাটা প্রায় চোখেই পড়ছে না। উল্টো দিকে আরেকটা দরজা। রোদের মত আলো আসছে চারপাশ থেকে। ঢালু হয়েছে মেঝে, মাঝে অগভীর ড্রেন। গোপন স্পিকারে ইংরেজিতে কড়া গলায় নির্দেশ দিল কেউ। চারদিকে তাকাল রানা। লোকটা বলছে জুতো, হাতঘড়ি ও গায়ের পোশাক খুলতে। স্পিকারের সঙ্গে বোধহয় রয়েছে গোপন ক্যামেরা। লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। আর্মি জীবনে এবং পরে গুপ্তচর হিসেবে বহুবার উলঙ্গ হতে হয়েছে ওকে। জুতো, মোজা, জ্যাকেট, শার্ট, জিন্সের প্যান্ট খুলল রানা। ডানে টাইল করা দেয়ালে দেখা দিল স্লাইডিং কমপার্টমেন্ট। আগের সেই কর্কশ কণ্ঠ বলল, ওটার ভেতর সব রেখে দিতে। নির্দেশ মেনে নিল রানা। ভাল করেই জানে, আপত্তি তুলে লাভ হবে না। ক্লিক আওয়াজে আটকে গেল কমপার্টমেণ্ট।
কয়েক সেকেণ্ড পর ছাতের হাজার হাজার ফুটো থেকে এল অস্বাভাবিক জোরে শীতল তরলের স্প্রে। ওটা এতই ঠাণ্ডা, ভীষণ চমকে গেল রানা। তবে ওটা পানি নয়, কোনও কেমিকেল। বরফের মত যেন কামড় বসাচ্ছে ওর ত্বকে। মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পর থামল হাজার কোটি কণাবৃষ্টি। ভিজে গিয়ে শীতে থরথর করে কাঁপছে রানা। এবার এল সাইক্লোনের জোর নিয়ে গরম হাওয়া। দশ সেকেণ্ডে খটখটে শুকনো হলো ও। এমন কী শুকিয়ে গেছে মাথার চুলও। আবার ক্লিক আওয়াজে খুলল আগের কমপার্টমেন্ট। এখন ওটার ভেতর ওর জিনিসপত্রগুলো নেই। সে জায়গায় রয়েছে হাসপাতালের রোব। ভেসে এল সেই কণ্ঠ, ও যেন পরে নেয় পোশাকটা। কমপার্টমেন্টে হাত ভরে রোব নিল রানা। পরিষ্কার সুতির ইস্ত্রি করা জিনিসটা নরম ও উষ্ণ। রোব পরে নিতেই গোড়ালির কাছে ঝুলতে লাগল শেষ প্রান্ত।
হিসহিস আওয়াজে খুলল উল্টোদিকের দরজা। নির্দেশ এল ওদিকে যেতে। ঠাণ্ডা স্প্রের সাদা বাথরুম থেকে বেরোতে পেরে খুশি রানা। ওর জন্যে অপেক্ষা করছে আরও চমক। দরজা পেরোতেই পেছনে বন্ধ হলো কবাট। রানা টের পেল, এসে পড়েছে হাসপাতালের অদ্ভুত উজ্জ্বল বাতির ঘরে। বাতাসে অ্যান্টিসেপটিক লোশনের গন্ধ। ঘরের মাঝে ধাতব বেড। পাশের টেবিলে সিল করা ব্যাগে খাবার পানির বোতল ও কাপ। একদিকে বেসিন। ছাত থেকে নেমেছে নাইলনের পর্দা। ওদিকে ছোট টয়লেট। সব ঝকঝকে, পরিষ্কার। ঘরের মেঝে ও তিন দিকের দেয়ালে চকচকে সাদা টাইল্স্। তবে চতুর্থ দেয়ালে টু-ওয়ে মিররের প্যানেল।
এখন থেকে প্রতিটি মুহূর্ত ওর ওপর চোখ রাখবে ওরা, বুঝে গেল রানা। সোজা গিয়ে কাঁচের প্যানেলে টোকা দিল ও। পুরু কাঁচ আর্মার প্লেটের মত। লোহার বেড এনে ব্যাটারিং র্যামের মত বাড়ি দিলেও কাজ হবে না। বেসিন তুলে আছড়ে ফেললেও ভাঙবে না ওই কাঁচ
‘অ্যাই, আমি কোথায়?’ গলা ছাড়ল রানা। ‘আমাকে আটকে রাখা হয়েছে কেন?’
জবাব দিল না কেউ।
কঠোর চোখে ভুরু কুঁচকে আয়নার দিকে তাকাল রানা। জানে, ওদিক থেকে চেয়ে আছে কেউ। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে ফিরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ল ও বিছানায়। ঠিক করেছে, বন্দি বাঘের মত পায়চারি করবে না, বা ভুলেও রাগবে না। ধীরে ধীরে নিতে লাগল দম। শিথিল করল সারাদেহের পেশি। একটু পর বুজে ফেলল চোখ।
ওদিকের ঘরে বোধহয় একাধিক গোপন দর্শক।
পরের চব্বিশ ঘণ্টায় এল না কেউ।
একচল্লিশ
রানা জানে, কোয়ারেনটাইন করা হয়েছে ওকে। রুপার্ট ওয়েনহেইম আর হেলমুট হাইনরাইনারের মত মরে ভূত হচ্ছে কি না, তা দেখছে আড়াল থেকে। বোধহয় একই হাল বেলারও। হয়তো পাশের ঘরেই আছে সে।
মোটামুটি সবই বুঝতে পেরেছে রানা, মহাবিরক্ত। কাটছে না সময়। সারাক্ষণ জ্বলছে বাতি। ঘড়ির অভাবে জানার উপায় নেই এখন কয়টা বাজে। মনে জাগছে হতাশা। বাইরে কোথাও রয়ে গেছে গিসেল। আর ও নিজে আটকা পড়েছে হাসপাতালে। কবে বেরোতে পারবে, তা-ও জানে না। মেজাজ খিঁচড়ে গেলেও চুপচাপ অপেক্ষা করছে। বারবার মন ফিরছে সাধুদের মঠে। অথবা, ভাবছে বেলার কথা। সংক্ষিপ্ত কয়েক দফায় ঘুমিয়ে নিয়েছে। পায়চারি করেছে ঘরে। কখনও সেরে নিয়েছে হালকা ব্যায়াম। ঘেমে গেলে মুখ-হাত ধুয়ে আবারও শুয়ে পড়েছে বিছানায়। টু-ওয়ে মিররের দিকে থেকেছে ওর পিঠ।
রানা ঘুমিয়ে আছে, একসময় ঘরে ঢুকল ক’জন ডাক্তার। তাদের পায়ের শব্দে জেগে গেল ও। পাশ ফিরতেই দেখল বেডের কাছে এসে থেমেছে তারা। সঙ্গে একজন নার্সও আছে। এখন কারও পরনে প্রোটেকটিভ সুট নেই।
‘হয়তো আপনারা কিছুই ভয় পান না, নইলে পরীক্ষায় পাশ করেছি,’ বলল রানা। ‘কোটা ঠিক?’
জবাব দিল না কেউ। কৌতূহলী চোখে দেখছে ওকে। মিনিটখানেক পর পরস্পরের দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকাল তারা। চলে গেল ঘর ছেড়ে। অবশ্য রয়ে গেছে নার্স। হাতে সিরিঞ্জ। রক্ত নিল রানার ধমনী থেকে।
‘আমাকে কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে?’ জানতে চাইল রানা।
নীরব থাকল নার্স।
‘আপনারা রোগীদের না খাইয়ে মেরে ফেলেন নাকি?’ চুপচাপ বিদায় নিল নার্স। ফিরল তিনঘণ্টা পর। এবার সঙ্গে ট্রে। ওটার ওপর কফি, ফ্রুট জুস, জাউ ভাতের মত কিছু আর একটা কলা।
তারও তিনঘণ্টা পর রানাকে দেয়া হলো নতুন এক সেট পোশাক। বের করে আনা হলো অবযার্ভেশন রুম থেকে।
ওর মনে হলো না এরা বিশ্বাস করছে ওকে।
সশস্ত্র এক গার্ড দূরত্ব বজায় রেখে নিয়ে চলল নতুন এক করিডোরে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর দাঁড় করিয়ে একটা দরজায় টোকা দিল সে। ‘স্যর, আমরা কি আসতে পারি?’
‘ইয়েস, কাম, কণ্ঠস্বর এল ওদিক থেকে।
দরজা খুলে রানাকে ইশারা করল গার্ড।
ঘরে বৃত্তাকার একটা অফিস টেবিলে বসে আছে দু’জন।
‘হ্যালো, রানা,’ বলল কমিশনার অ্যাল মার্লো। বিধ্বস্ত চেহারা। টাই খোলা। সুট কোঁচকানো। তার যে এমন হাল হতে পারে, কখনও ভাবেনি রানা। টেবিলে তার জন্যে জগ ভরা কফি। বাতাসে তার সুবাস। কমিশনারের পাশে মগ ভরা গাঢ় কালো কফি। ওই জিনিস ছুঁয়েও দেখেননি তার সঙ্গী। মাথা ভরা টাক। মইয়ের মত ঢ্যাঙা। পরনে কালো সুট। কৌতূহলী চোখে দেখছেন রানাকে।
রানার মন চাইল লাথি মেরে উল্টে ফেলে ওই টেবিল। তবে বুঝতে পারছে, উচিত হবে না কাজটা করা। কফির জগ থেকে আসছে দারুণ সুবাস। ভাল লাগবে এক মগ কফি পেলে। বাড়তি দুই চেয়ারের একটায় বসল রানা। বাড়তি কয়েকটা মগ দেখে ওখান থেকে নিল একটা। জগ থেকে কফি ঢালল মগের কানা পর্যন্ত। লোভীর মত মগে চুমুক দিল। কফিতে চিনি নেই। যথেষ্ট গরম। গুড!
‘জানি, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন,’ বলল কমিশনার মার্লো। ‘যেমন তুমি জানতে চাও কোথায় আছ, বা কেন তোমাকে ধরে এনে মেডিকেল টেস্ট করা হচ্ছে। আসলে এটা ছিল জরুরি। …সব শুরুর আগে খুশিমনে ধন্যবাদ দেব তোমাকে। তুমিই পথ দেখিয়ে আমাদেরকে চিনিয়ে দাও গিসেলের সেফ হাউসে।’ মৃদু হাসল সে। ‘তুমি কাজ করেছ আমার সেরা, বিশ্বস্ত এজেন্টের মত। যদিও বেতন নাওনি এক টাকাও।’
‘সাবধান, মার্লো, মুখ সামলে! হয়তো বিরক্ত হয়ে উঠব, ‘ বলল রানা। ‘মনে নেই আমি কামানের ছুটন্ত গোলা?’
‘ওই কথা বলার জন্যে আমি দুঃখিত,’ বলল মার্লো। ‘জানলে কী করে যে আমি কোথায় আছি?’
‘সহজ ছিল না কাজটা। আন্দাজ করেছি এরপর তুমি কী করবে।’
‘তাই? আমার জন্মই বৃথা।’
‘বারবার কষতে হয়েছে হিসেব,’ বলল মার্লো, ‘তা ছাড়া, জানতাম তুমি পছন্দ করো ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল। ওটা পেয়েছ ট্রেনে রেইড দেয়া এক পুলিশের কাছ থেকে।’ সন্তুষ্টচিত্তে হাসল মার্লো, ‘ওই পিস্তলের গ্রিপে ছিল জিপিএস ট্র্যাকিং ডিভাইস। গ্রিপ খুললেই পেয়ে যেতে।’
তুই গাধু, মনে মনে নিজেকে বলল রানা। দুনিয়ার হারামি লোক এই ব্যাটা কমিশনার মার্লো! জানতে চাইল, ‘আর ওই হেলিকপ্টার দিয়ে ধাওয়া? ওসবও নকল, তা-ই না?’
‘সহজেই পার পেয়ে গেলে সন্দেহ করতে,’ বলল মার্লো। ‘চেয়েছি, যেন ভাবো মুক্ত আছ নিজ যোগ্যতায়। পাইলটকে আগে থেকেই সব বলা ছিল। ফলে ঠিক সময়ে পিছিয়ে গেছে। তুমি ভাবলে ঠকিয়ে দিয়েছ তাকে। এদিকে আমরা ট্র্যাক করলাম তোমাকে। পৌঁছেও গেলে লোসানে। খুঁজে বের করলে গিসেলের লোকগুলোকে।’
‘পেয়েছি মাত্র দু’জনকে,’ বলল রানা।
‘তবে তোমার জন্যে জানতে পারলাম বহু কিছু। কপাল ভাল, আগেই তোমাকে গ্রেফতার করেনি এজেণ্ট বেলাইত।’
গম্ভীর রানা জগ থেকে নিল আরেক মগ কফি। টাকমাথার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়নি মার্লো। কাকের মত কুঁতকুঁতে কালো চোখে ওকে দেখছেন তিনি।
‘হয়তো ভাবছ এজেণ্ট বেলাইত কোথায়,’ বলল মার্লো ‘তোমার মতই চব্বিশ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে তাকেও। ফলাফল নেগেটিভ। তোমাদের সৌভাগ্য। অ্যাসেসমেন্টের জন্যে ধরে না আনলে হয়তো মেরে ফেলতে হতো।’
‘এবার বলো আমি কোথায়,’ বলল রানা, ‘যা বলছ, তার কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ঘড়িটা নিয়ে গেছে। জানা নেই এখন দিন না রাত।’
‘তোমাকে নতুন একটা দেয়া হবে,’ বলল মার্লো। হাতঘড়ি দেখল সে। ‘এখন বাজে রাত সাড়ে বারোটা। আমরা আছি ইন্টারপোল হেডকোয়ার্টার থেকে কয়েক মাইল দূরে সরকারি এক সায়েন্স ফ্যাসিলিটিতে। জায়গাটা গোপন নয়, তবে সাধারণ মানুষকে এখানে আসতে উৎসাহিত করা হয় না। আগেই বলেছি, কথা বলতে চাই সামনা-সামনি। একটা কথাও মিথ্যা বলিনি। ভাবছিলাম তোমার দেয়া সেই প্রস্তাব। পরে বুঝলাম, এই তদন্তে তুমি আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমার বসও একই কথা ভাবছেন। তোমার কারণেই গত চব্বিশ ঘণ্টা আগে জেনেছি, সত্যিই মানব-সভ্যতার বিরুদ্ধে ভয়ানক অপরাধে জড়িত ডেইটার গিসেল। বিষয়টি এতই বিপজ্জনক, মুখে বলে শেষ করা যাবে না। তাই আমার মনে হচ্ছে, জরুরি কিছু ব্যাপার তোমাকে জানিয়ে রাখা ভাল।’
‘বলো, আমার কান খোলা,’ বলল রানা।
‘তুমি বরং শোনো আমার কলিগের কাছ থেকে,’ বয়স্ক টাকমাথার দিকে ইশারা করল মার্লো। ‘পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, ইনি প্রসেফর অ্যামাকাস ব্যানিং।’
‘ইনি কী বিষয়ে প্রফেসর?’ জানতে চাইল রানা।
জবাব না দিয়ে বরফের মত ঠাণ্ডা হাসি দিলেন বৃদ্ধ।
‘বেশ কয়েকটা বিষয়ে,’ বলল মার্লো। ‘শুধু এটা বলব, তাঁর মত অভিজ্ঞতা ও মস্ত সব ডিগ্রি পৃথিবীর অন্য কারও নেই। তাঁর পেশা নিয়ে যত কম জানবে, ততই তোমার মঙ্গল। শুধু এটা জেনে নেয়াই যথেষ্ট যে, তিনি তাঁর সাবজেক্টে সেরা।’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চেয়ারে একটু নড়ে উঠলেন বৃদ্ধ। কঙ্কালের মত দুই হাতে চেপে ধরলেন নিজের হাঁটু। রানার মনে হলো, চরম এক লাথি খেয়ে ভীষণ ব্যথায় গাল কুঁচকে ফেলেছেন তিনি। কাকের কালো চোখে দেখছেন ওকে। অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর কড়কড়ে কণ্ঠে বললেন, ‘যা ঘটে গেছে, সেটাকে এককথায় বলতে পারি দৈব ঘটনা। অবশ্য শুরুর আগে আপনাকে জানিয়ে নেব এর ইতিহাস।’
চুপ হলেন প্রফেসর। যেন বুঝে নিচ্ছেন নিজের বক্তব্যের ওজন। কুঁতকুঁতে চোখে দেখছেন রানাকে। পুরো একমিনিট পর জানতে চাইলেন, ‘আপনি বায়োটেরোরিযম সম্পর্কে কতটা জানেন?’
বেয়াল্লিশ
হঠাৎ এ প্রশ্ন শুনে থমকে গেল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘শুনেছি, অনেকে মনে করেন ওটা টাইম বমের মতই বিপজ্জনক। যে-কোনও সময়ে ফাটবে। অন্যরা বলে, আজ পর্যন্ত সফল হয়নি ওদের কোনও হামলা।’
গম্ভীর চেহারায় মাথা দোলালেন ব্যানিং। ‘একইসঙ্গে সঠিক ওই দুই পক্ষ। এটা ঠিক, সঠিক সময়ে নজরদারী আর সৌভাগ্যের কারণে বারবার ঠেকিয়ে দেয়া গেছে বিপর্যয়। কিন্তু চিরকাল এভাবে চলবে না। নানাভাবে চেষ্টা করছে মানব- সভ্যতার শত্রুরা। যারা মনে করে বায়োটেরোরিযম খবরের কাগজের মিথ্যা বাঘ, তারা আছে বোকার স্বর্গে। বহু কাল ধরেই সমাজে বায়োলজিকাল হামলা করতে চাইছে নরপশুরা। বাতাসে, পানিতে বা অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে। প্রথমবারের মত হামলা হয় উনিশ শ’ বাহাত্তর সালে শিকাগো শহরে। ওই কাজ করে টেরর গ্রুপ রাইজ। তারা এক হাসপাতাল থেকে চুরি করে শহরের খাবারের পানিতে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল টাইফয়েড ভাইরাস। কুকীর্তিটা করে বসার আগেই ধরা পড়ে যায় তারা। এরপর হামলা হলো অরিগনে উনিশ শ’ চুরাশিতে। তারা খাবারে মিশিয়ে দিল সালমোনেলা। অসুস্থ হয়ে পড়ল অনেকে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে আবার শুরু করলেন প্রফেসার, ‘এরপর উনিশ শ’ তিরানব্বুই সালের জুলাই মাস। টোকিয়োর ক্যামেইডোর উঁচু এক বাড়ি থেকে তরল সাসপেনশনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে চাইল ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস- অর্থাৎ অ্যান্থ্রাক্স। কাজটা করেছিল ধর্মীয় সংগঠন আউম শিনক্রিও। মারা পড়ত হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু ভুল করে ধর্মান্ধ কুকুরগুলো ব্যবহার করল অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর স্ট্রেইন। এরপর দু’হাজার এক সালে চিঠির ভেতর করে ওয়াশিংটন ডিসি ও চিলির স্যান্টিয়াগোতে পাঠিয়ে দেয়া হলো অ্যানথ্রাক্স। কপাল ভাল, ধরা পড়ে গেল সেসব চিঠি। ক্ষতি হয়নি কারও। কিন্তু এরপর থেকে আরও সতর্ক হয়ে উঠল বায়োটেরোরিস্টরা। আমেরিকায় লেখাপড়া করেছিল পাকিস্তানি এক নিউরোসায়েন্টিস্ট আফিয়া সিদ্দিকি। দু’হাজার আট সালে নিউ ইয়র্কে ধরা পড়ল তার তৈরি বায়ো-ও অরফেয়ার মেটারিয়াল। বায়োটেরোরিযমের দায়ে ছিয়াশি বছরের সাজা হলো তার।’
‘বেগ্রামের ধূসর মহিলা,’ বলল রানা। ‘অনেকে বলে সিক্স-ফাইভ-ও প্রিযনার। সেসময়ে হাজার হাজার মানুষকে খুন করতে গিয়ে ধরা পড়ে একদল সাইকোপ্যাথ। তবে তাদের সবাই অপরাধী ছিল না। অনেকেরই সাজা হয়েছে অন্যায়ভাবে।’
কঙ্কালের মত শুকনো কাঁধ ঝাঁকালেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘আপনি এটা বলতে পারেন, নাইন/ইলেভেনের পর পর ওই ঘটনা ঘটলে কঠোর সাজা হয় পাকিস্তানি সেই মহিলার। আবার এ-ও ঠিক, সরাসরি আলকায়েদার সঙ্গে জড়িত ছিল সে। চেষ্টা করেছে হাইলি টক্সিক সাবস্ট্যান্স আমেরিকায় ছড়িয়ে দিতে। হালকাভাবে নেয়া যায় না এটাকে।’
‘বিজ্ঞানীরাই বা কেন এসব বাজে জিনিস তৈরি করে জমিয়ে রাখছেন?’ বলল রানা, ‘পরে ব্যবহার করবেন বলে?’
‘তাদেরকে দিয়ে করানো হচ্ছে,’ চিমসে হাসি হাসলেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘এতক্ষণ মূল বিষয়ে যাওয়ার জন্যে এই কথাগুলো না বললে চলত না।’ একটা সাদা খাম দেখালেন তিনি। ‘এবার জানবেন এক লোকের কথা।’
এনভেলপটা তুলে নিল রানা। ওটার মুখ খোলা। ভেতর থেকে নিল চকচকে, ছোট একটা ছবি। তোলা হয়েছে বহু দূর থেকে। একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দু’জন লোক। দেখা যাচ্ছে একজনের পিঠ। ছবিটা শীতকালে তোলা। দু’জনের পরনেই ভারী পোশাক। যার মুখ দেখা যাচ্ছে, সে পরেছে কালো রঙের কাশ্মিরী ওভারকোট। হাতে ট্যান লেদার গ্লাভ্স্। উঁচু কপালের ওদিকে ব্যাক ব্রাশ করা চুল। নম্বরের একাংশ দেখে রানা বুঝল গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সুইটয়ারল্যাণ্ডের।
‘এই লোকই ডেইটার গিসেল?’ টেবিলে ছবি রাখল রানা।
মৃদু মাথা দোলাল কমিশনার অ্যাল মার্লো।
‘গত কয়েক দশক ধরেই বাড়ছে বায়োটেরোরিযমের হুমকি,’ বললেন বিজ্ঞানী, ‘ধার্মিক ও অধার্মিক একদল মানুষ ধরে নিচ্ছে, শেষ হয়েছে মানব-সভ্যতার উন্নয়ন প্রক্রিয়া। এবার সামনে শুধু গাঢ় কালো অন্ধকার। যে-কোনও দিন পৃথিবীর বুকে নামবে ভয়ঙ্কর মহাবিপদ। আর তাই ঘটছে নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সুতরাং এখনই উচিত ভবিষ্যতের জন্যে তৈরি হওয়া। যেমন ধরুন সুপার স্টর্ম বা সোলার ম্যাগনেটিক ফ্লেয়ার। এ ধরনের বিপদ যে-কোনও সময়ে সভ্যতাকে ফিরিয়ে নিতে পারে অন্ধকার যুগে।’
চুপ হয়ে গেলেন প্রফেসর। জিভ দিয়ে চেটে নিলেন ঠোঁট। তাঁর সরু জিভ দেখে গিরগিটির কথা মনে পড়ল রানার। আবারও শুরু করলেন ভদ্রলোক, ‘অনেকে মনে করে, তাদের জীবনে বড় কোনও বিপর্যয় ঘটবে না। আবার অনেকে খুশি হবে পৃথিবী ধ্বংস হলে। এরা গর্ব করে বলবে- কী, বলেছিলাম না? আমার কথাই তো ঠিক হলো! নিজেরা মরবে, সেজন্যে কোনও আফসোস নেই।’ মৃদু হাসলেন বিজ্ঞানী। ‘মানসিক সমস্যা আছে বলে এদেরকে সিরিয়াসলি নিই না আমরা। কাপুরুষের মত এরা ভেবে নেয়: কী পেয়েছি এই জীবনে, ধ্বংস হোক না পৃথিবী! সত্যিই কোটি কোটি মানুষের সর্বনাশ হলেও কিছুই যায় আসবে না তাদের। তবে এরা বড় ধরনের বিপদ নয়। আসল সমস্যা তৈরি করে আরেকদল লোক। তারা চায় শেষ হোক মানব-সভ্যতা। আর সেজন্যে যা খুশি করতেও দ্বিধা নেই। আসলে ওই দলেরই লোক ডেইটার গিসেল। সে চাইছে ডেকে আনবে মহাবিপর্যয়। ‘
ভদ্রলোক থেমে যাওয়ায় নীরবতা নামল ঘরে।
কফি দিয়ে নিজের মগ ভরল মার্লো। ‘কয়েক বছর আগে প্রস্তুত দল বা পারাটি বলে একটা সংগঠন তৈরি করে গিসেল। সেসময়ে প্রথমে আমাদের রেইডারে ধরা পড়ে সে। জাল পেতে তাকে ধরার চেষ্টা করে ইন্টারপোলের অপারেটিভরা। তবে অতি চতুর ওই লোক ধরা দিল না, এড়িয়ে গেল সব ধরনের প্রলোভন।’
‘এজেণ্ট বেলাইতের কাছে খানিকটা শুনেছি,’ বলল রানা। ‘সে কি পৃথিবী ধ্বংস করতে আউম শিনক্রিওর মত কোনও ধর্মীয় সংগঠন তৈরি করেছে?’
মাথা নাড়ল কমিশনার। ‘আমরা জেনেছি সে নাস্তিক I ধর্মগুরু হওয়ার ইচ্ছে তার নেই।’
‘ডেইটার গিসেল দিনরাত স্বপ্ন দেখে, বর্তমান সভ্যতা শেষ করে নতুনভাবে শুরু করবে সব,’ বললেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘পারাটি দলের ওয়েবসাইট আছে ইন্টারনেটের অন্ধকার অংশে। ওখানে ঢুকতে ব্যবহার করতে হবে বিশেষ সফটওয়্যার। ওই সাইটে বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে বর্তমান জনসংখ্যাকে হ্রাস করা হবে। তারা চায় পৃথিবীতে থাকুক মাত্র দশ পার্সেন্ট মানুষ। কোনও সরকার থাকবে না। লেনদেন হবে না অর্থের। প্রয়োজন পড়বে না আইনের। গিসেল তার লেখায় বর্ণনা করেছে, একটা সময় আসবে, যখন মাত্র কয়েক মাসের ভেতর মরবে বেশিরভাগ মানুষ। গোটা পৃথিবী জুড়ে ঘটবে এটা। যারা বাঁচবে, সবাই পড়বে মহাবিপদে। নেতৃত্ব দেয়ার মত কেউ থাকবে না। আর তখন গিসেল পৃথিবী শাসন করবে তার অনুসারীদের নিয়ে। বিরোধীদের অবস্থা এতই খারাপ হবে, বাধা দিতে পারবে না তারা।’
‘নিজেকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর রাজা ভাবতে পছন্দ করে সে,’ বলল মার্লো। ‘তার বর্ণনা অনুযায়ী, বিপর্যয়পরবর্তী ওই জগতে তার ওপর কথা বলবে না কেউ। পারাটি দলের সদস্য-সদস্যা ছাড়া কাউকে গণ্য করা হবে না মানুষ হিসেবে। বছরের পর বছর ধরে ওই স্বপ্ন পুষে রেখেছে সে। কয়েক বছর আগে ব্যস্ত হয়ে উঠল পৃথিবী জুড়ে ধ্বংস ডেকে আনতে। চাই ক্ষমতা। আর সেজন্যেই পরে হামলা করেছে সাধুদের ওই আশ্রমে। এতে আরও সতর্ক হয়ে উঠেছি আমরা।’
‘তাকে বদ্ধ পাগল বলে মনে হচ্ছে আমার,’ বলল রানা।
‘বদ্ধ পাগল হলেও, ওর হাতে যা আছে, তা দিয়ে খুন করতে পারবে লাখ লাখ মানুষ,’ বলল মার্লো।
‘কী করে?’ কমিশনারের দিকে তাকাল রানা। পরস্পরের দিকে তাকাল মার্লো ও প্রফেসর ব্যানিং। যেন বুঝে নিল, সময় হয়েছে ক্লাসিফায়েড তথ্য দেয়ার।
প্রফেসরের দিকে চেয়ে মাথা দোলাল কমিশনার।
তেতাল্লিশ
রানার দিকে ফিরলেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘দু’হাজার পনেরো সালের মার্চের দুই তারিখ। দুনিয়ার মিডিয়া না জানলেও ইণ্টারপোল জেনে গেল, উত্তর কোরিয়ার পাহাড়ি এক জায়গায় গোপন এক মিলিটারি ফ্যাসিলিটিতে হামলা করেছে একদল মার্সেনারি। উদ্দেশ্য বায়োওয়েপন্স সরিয়ে নেয়া। পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স ধারণা করে, ওই ফ্যাসিলিটিতে ছিল ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস বা অ্যানথ্রাক্স। ওগুলো লেভেল ফোর এজেন্ট। অর্থাৎ, উপায় থাকবে না রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার। যেমন ইবোলা ভাইরাস, মারবার্গ ভাইরাস বা ক্রিমিয়্যান-কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার।’ চুপ হয়ে গেলেন প্রফেসর। বড় করে দম নিয়ে আবার বললেন, ‘আমরা জানলাম না কারা হামলা করেছিল।’
‘ডেইটার গিসেল,’ মন্তব্য করল রানা।
মাথা দোলাল কমিশনার মার্লো ও বিজ্ঞানী।
‘বলতে পারেন, একদল বদ্ধ উন্মাদের কাছ থেকে বেআইনি জিনিস চুরি করতে চেয়েছে আরেকদল উন্মাদ,’ বললেন প্রফেসর।
‘ওই একই কাজ করছে পাশ্চাত্য বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকার বিজ্ঞানীরা,’ বলল রানা।
‘কথা ঠিক,’ মেনে নিলেন ব্যানিং। ‘বাদ পড়েনি রাশা, ফ্রান্স বা চিন। গোপনে গবেষণা করছে দেশগুলো।’ যে সুরে কথা বলেছেন, রানার মনে হলো বিস্তারিত তথ্য আছে তাঁর পকেটে। ‘ডেইটার গিসেল মনে করেছিল অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক সহজে উত্তর কোরিয়ার ফ্যাসিলিটি থেকে ভাইরাস সরাতে পারবে সে। ওটা ছিল তার ভুল ধারণা। ব্যর্থ হয় ওই মিশন।’
‘গিসেল ভাবতেও পারেনি পাহাড়ি জঙ্গলে গার্ড দিয়ে রাখবে আমি তাদের সোনার ডিম,’ বলল মার্লো। ‘মারা পড়ল তার কয়েকজন অনুচর। অন্যরা হেলিকপ্টারে উঠে পালিয়ে গেল উপকূলে। ওখান থেকে লঞ্চে চেপে চলে যায় জাপানে। আমরা যখন বুঝলাম ওই দলের কয়েকজন ইউরোপিয়ান, ততক্ষণে দলের সবাইকে নিয়ে আত্মগোপন করেছে ডেইটার গিসেল।
‘এরপর পেরোল বেশ কয়েক মাস। পারাটি দলের কোনও অ্যাক্টিভিটি থাকল না। যদিও আমরা বুঝলাম, গিসেলের উদ্দেশ্য বায়োলজিকাল ওয়েপন্স চুরি করা। কাজেই চোখ-কান খোলা রাখলাম।’
ঘরে নীরবতা নামল।
চুপ করে আছে রানা।
একবার ব্যর্থ হয়েছে,’ বলল মার্লো। ‘টাকার অভাব নেই। নতুন করে তৈরি হতে থাকল গোপনে। এমন কী ওয়েবসাইট থেকেও হারিয়ে গেল তার দল। আর এখানেই ভুল করলাম আমরা। ধরে নিলাম, চরম হার মেনে লুকিয়ে পড়েছে সে। হয়তো আত্মহত্যা করেছে। বা অতিরিক্ত মদ্যপান করে মারা গেছে। এমনও হতে পারে, নিজ দলের কারও হাতে খুন হয়েছে। পেরিয়ে গেল কয়েকটা বছর। এরপর আবারও তাকে দেখা গেল সন্দেহজনক একদল লোকের সঙ্গে। এবার গোপনে খোঁজখবর নিল ফ্রেঞ্চ, ব্রিটিশ ও সুইস ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। কাজে সুবিধা হবে বলে শুরু হলো জয়েন্ট অপারেশন। পারাটি দলে ঢুকল আমাদের দু’জন এজেন্ট। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দুটো। প্রথমত, জানতে হবে কোথায় আছে ডেইটার গিসেল। দ্বিতীয়ত, আসলে কী করছে সে। প্রথম কাজে ব্যর্থ হলো এজেন্টরা। তবে তোমার মাধ্যমে জানা গেল, ডেইটার হামলা করেছে শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভোতে। আমরা জেনে গেলাম, হাল ছাড়েনি সে। এতগুলো মাস লুকিয়ে থেকে তৈরি করেছে নিখুঁত প্ল্যান। তার চাই মারণাস্ত্র তৈরির মত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া। ‘
‘আর এখন সেটা পেয়েছে সে,’ কমিশনার অ্যাল মার্লোর দিকে তাকালেন প্রফেসর।
জবাবে মৃদু মাথা দোলাল পুলিশ অফিসার।
রানার দিকে ফিরলেন প্রফেসর। ‘ওটা প্লেগ। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক মহামারী!’
নিষ্পলক চোখে রানার দিকে চেয়ে রইলেন তাঁরা
চুপ করে আছে রানা। হঠাৎ ভীষণ বিস্বাদ লাগল কফি। আস্তে করে হেলান দিল চেয়ারে।
‘কী ভাবছ, রানা?’ জানতে চাইল কমিশনার।
পুরো একমিনিট পর মুখ খুলল রানা, ‘সেফ হাউসে ছিল ডেইটার গিসেলের দু’জন। তাদের একজন কি মারা গেছে প্লেগে?’
‘মারা গেছে দু’জনই,’ বললেন প্রফেসর, ‘ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সবাইকে। তা করেছে স্পেশালাইড্ বায়োহ্যাযার্ড টিম। ওটা সবচেয়ে বিপজ্জনক স্ট্রেইন। ছড়িয়ে পড়লে রক্ষা নেই পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষের।’
‘চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর ইনফেকশন না হলে কখনও ওই রোগ হবে না,’ বলল রানা, ‘কাজেই আমাকে আর এজেন্ট বেলাইতকে রাখা হয়েছিল কোয়ারেনটাইন করে।
‘ঠিকই ধরেছ,’ বলল কমিশনার মার্লো।
‘কতক্ষণ বাঁচে প্লেগের জার্ম?’ বিজ্ঞানীর কাছে জানতে চাইল রানা।
‘প্লেগ আসলে ব্যাকটেরিয়াল ডিয্যি,’ বললেন প্রফেসর, ‘অ্যাকটিভ এজেন্টের নাম ব্যাকটেরিয়াম ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস। সংক্ষেপে ওয়াই পেস্টিস। ভাইরাসের মত নয়। কারও দেহে থাকতে হবে, এমন নয়। মাটিতে মিশে থাকতে পারে শত শত বছর। মোটেও হারিয়ে যায় না ভিরুলেন্স। সুযোগ পেলেই আবারও বিস্তার করে বংশ। এদিক থেকে বলতে পারেন, মরণ নেই তার জাতির।’
যা ভেবেছে, সেটাই সত্যি! গলা শুকিয়ে গেছে রানার। ‘আশ্রমে ছিল ওটার সোর্স, তাই না?’
মাথা দোলাল কমিশনার। অত্যন্ত গম্ভীর মুখ। ‘আমরা তা-ই ধারণা করছি।’
‘বেশ কিছু দিন ছিলাম ওখানে,’ বলল রানা, ‘কেউ বলেনি ওখানে ছিল প্লেগের জীবাণু।’ আশ্রমের নিচে কী দেখেছে, সংক্ষেপে বলল ও। বাদ পড়ল না প্রধান সাধুর কথা। জানাল, সেই সকালে মঠে যখন ফিরছে ও, তখনও ওখানে ছিল ডেইটার গিসেল এবং তার দলের লোক। খুন করছিল সাধুদেরকে। সংগ্রহ করেছে মহামারীর জীবাণু। ফেলে গিয়েছিল সোনার বার।
‘তোমার ব্যাগে একটা পেয়েছি,’ বলল মার্লো।
‘আশ্রমে নানা জায়গায় ছিল,’ বলল রানা। ‘যাতে পরে কেউ মনে করে, পাতাল ঘর থেকে গুপ্তধন সরিয়ে নেয়ার সময় পড়ে গেছে সোনার বার।’ মৃদু মাথা নাড়ল রানা। ‘ভাবতেও পারিনি চোখে ধুলো দেয়ার জন্যে করা হয়েছে কাজটা।’
‘অত্যন্ত ধনী ও বুদ্ধিমান লোক গিসেল,’ বললেন বিজ্ঞানী। ‘কে ভাববে, অপরাধের এলাকায় সোনা রেখে যাবে কেউ? অন্যদিকে সরিয়ে দিয়েছে সবার চোখ।’
‘ঠিকই বলেছেন,’ বলল রানা। ‘সোনার বার পেয়ে দ্বিতীয় বোমা কেন ব্যবহার করল, ভাবতে যাইনি। ওই বিস্ফোরণে আরেকটু হলে মারা পড়তাম। ডেইটার গিসেল চেয়েছে যেন পাতাল ঘরের খোঁজ না পায় কেউ। নিজের কাজে সে সফল।’ সিগারেটের কথা মনে পড়ল ওর। কালো সবরেইনি দেখে ধরে নিয়েছিল, নিস বা মার্সেইর রাশান মাফিয়ারা খুন করেছে সাধুদেরকে। প্রতিটি দিক হিসাব কষে সবার চোখ ভিন্ন দিকে নিয়ে গেছে ডেইটার গিসেল।
‘জরুরি আরও কিছু তথ্য দেব, যেগুলো আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে,’ বললেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘দু’হাজার বারো সালে শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভোর পাহাড়ি এলাকায় ইকোলজিকাল সার্ভে হয়েছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল, কী কারণে ওদিকে বেড়ে গেছে নেকড়ের সংখ্যা। নেকড়ে শিকার বন্ধের পর থেকেই খামারের গবাদি পশুর ওপর হামলা করছে ওগুলো। যাই হোক, ওই এক্সপিডিশনের সময় পাওয়া গেল অদ্ভুত এক জন্তু। ওটা ছিল বিকৃত দেহের একটা ইঁদুর। চোখ ছিল না ওটার।’
‘পাতাল ঘরে ওরকম দেখেছি,’ বলল রানা। ‘মনে হয়েছিল হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে ওখানেই আছে ওরা।’
‘ওই ইঁদুরের দেহ অ্যানালিসিস করে পাওয়া গেল প্লেগের অত্যন্ত আগ্রাসী ব্যাকটেরিয়াম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন প্রফেসর। ‘অসুস্থ হয়ে পড়েন সার্ভে টিমের প্রধান এবং তিনজন সদস্য। বাঁচতে পারেননি কেউ।’ শুকনো গলায় যোগ করলেন ব্যানিং, ‘বিষয়টি প্রকাশ পেল হাতে গোনা কয়েকটা সায়েন্টিফিক জার্নালে। মিডিয়ার কাছ থেকে গোপন করা হলো খবরটা। নইলে ক্ষতিগ্রস্ত হতো অ্যালপাইন টুরিযম ইণ্ডাস্ট্রি।’
‘তবে বাস্তবতা হচ্ছে, গোপন থাকল না কিছুই,’ বলল মার্লো। ‘উত্তর কোরিয়ায় ব্যর্থ হলেও প্লেগের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠল ডেইটার গিসেল।’
বেলার কথা মনে পড়ল রানার। কোনও বিষয়ে জানতে চাইলে টাকা ব্যয় করতে দ্বিধা করে না ডেইটার গিসেল। সে চায় ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিতে।
লোকটা সত্যিকারের রিসার্চার,’ বলল রানা, ‘নিশ্চয়ই সংগ্রহ করেছে ওই এলাকার নানান তথ্য। জেনে গিয়েছিল কোথা থেকে এসেছিল ওই ইঁদুর। ইন্টারনেটে ‘ইঁদুর’ বা ‘প্লেগ’ লিখে সার্চ করলেই পেয়েছে দরকারি তথ্য। এরপর খোঁজ নিতে গিয়ে একসময় বুঝে গেল, ইনফেকশনের সোর্স আশ্রমের নিচের পাতাল ঘর। নিশ্চয়ই পাহাড়ের কোনও ফাটল দিয়ে বেরিয়ে খোলা জায়গায় মারা পড়ে ইঁদুরটা।’
কীভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল নিরীহ এক সাধুকে, কী অভিশাপ দিয়েছিলেন তিনি, আর পরে মানুষ মরতে শুরু করলে কী ভয়াবহভাবে তাদেরকে আটকে দেয়া হয়েছিল পাতাল ঘরে- সংক্ষেপে কমিশনার মার্লো ও প্রফেসর ব্যানিংকে জানাল রানা। যোগ করল, ‘অভিশাপ বিশ্বাস করি না, তবে সাধু মারা গেছেন তেরো শত আটচল্লিশ সালে। কয়েক মাস পরেই শুরু হলো ভয়ঙ্কর প্লেগ। মৃতদেহ রাখল পাতাল ঘরে। বাদ পড়েনি জীবিত রোগীও। এমনিতেই শেকল দিয়ে বাঁধা ছিল হাত-পা। তার ওপর ওই ঘরের মাঝ দিয়ে তুলে দেয়া হলো দেয়াল। এরপর হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে ওখানে বাস করেছে ইঁদুরের পাল। শত শত বছর পর ওগুলোর একটা বেরিয়ে এলে দরকারি তথ্যটা পেয়ে গেল ডেইটার গিসেল। তা ছাড়া, তার অভাব নেই প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্টের।’
পেটে গুলি খেয়ে মারা যাচ্ছিল তরুণ সাধু জন পিয়েরে। ওর একটা কথা মনে পড়ল রানার। ভীষণ কষ্টে ছিল বেচারা। ফিসফিস করে বলেছিল: ‘ওরা ছিল সাদা ভূত…’
সাদা নয়, সাদা-রুপালি। গিসেলের দলের লোকের পরনে ছিল হ্যাযম্যাট সুট। পাতাল ঘরে মৃত মানুষ ও ইঁদুরের দেহ থেকে সংগ্রহ করেছে টক্সিক স্যাম্পল। বেলা বলেছে, অ্যাসল্ট ভেহিকেলে দেখেছে ডিমের মত সাদা কেস। পরে হ্যাম্যাট সুট, মুখোশ, জুতো এবং গ্লাভ্স্ পুড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় ওকে।
‘আশা করি বুঝেছ-আমরা কীসের বিরুদ্ধে লড়ছি,’ রানাকে বলল মার্লো, ‘ভয়ঙ্কর ইনফেকশাস প্যাথোজেন পড়েছে বদ্ধ এক উন্মাদের হাতে। ভাবছে, দুনিয়ার মালিক হবে সে। প্রথম সুযোগে আধুনিক যানবাহনের সুবিধা নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেবে মরণ জীবাণু। মাত্র কয়েক দিনে নানান দেশে মরতে শুরু করবে লাখ লাখ মানুষ।’
‘তার পরিকল্পনা সহজ,’ বললেন ব্যানিং, আধুনিক বায়োলজিকাল ওঅরফেয়ার এজেন্ট না পেলেও, খুঁজে নিয়েছে প্রাচীন আমলের মহাঅস্ত্র। ধরে নিতে পারেন, তার দলে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া প্রসেস করার মত কেমিস্ট বা বায়োলজিস্ট। এটাও ধরে নিতে হবে, আমরা যখন এসব নিয়ে আলাপ করছি, সেই একই মুহূর্তে নিজেদের জন্যে তৈরি করছে ভ্যাকসিন বা সিরাম। নিজেদেরকে রক্ষা করবে। তারপর চারপাশে ছড়িয়ে দেবে মৃত্যুবীজ।’
‘তার আগে হয়তো পাব সামান্য সময়,’ বলল মার্লো। ‘সময়টা কতটুকু, তা জানা নেই। গিসেলের হয়তো চেনা আছে প্রাইভেট কোনও ল্যাবোরেটরি। তবে ওটা কোথায়, আমরা জানতে পারিনি।’
‘হয়তো সাধারণ প্যাথোজেন, মনের আকাশে আশার ভেলা ভাসাতে চাইল রানা। নিজেই বুঝল, এমনি এমনি এত সিরিয়াস হয়ে ওঠেনি এরা।
শুকনো মুখে নিজ পায়ের দিকে চেয়ে রইল অ্যাল মার্লো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলেন প্রফেসর ব্যানিং। কয়েক মুহূর্ত পর ফিসফিস করলেন, ‘মিস্টার রানা, ওটা বিউবোনিক প্লেগ নয় যে রোগী বাঁচবে। নইলে আমার চেয়ে খুশি পৃথিবীতে কেউ হতো না।’
চুয়াল্লিশ
‘জিনিসটার নাম কী?’ জানতে চাইল রানা।
‘আমরা যার বিরুদ্ধে লড়ছি, সেটার নাম ব্ল্যাক ডেথ,’ ঢোক গিললেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘অনেকে ধারণা করে কালক্রমে ওটা হয়ে গেছে নিউমোনিক প্লেগ।’
‘আমি ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞ নই, একটু খোলাসা করে বলুন, অনুরোধের সুরে বলল রানা।
‘কয়েক শত বছর আগে মাত্র ক’দিনে ব্ল্যাক ডেথের সংক্রমণে ইউরোপে মারা পড়ে বিশ কোটি মানুষ,’ বললেন বিজ্ঞানী। ‘চোদ্দ শতাব্দীতে শহর দখল করতে টার্টার ক্যাটাপল্ট ব্যবহার করে কাফ্ফার প্রাচীরের ওদিকে ফেলা হয়েছিল বিউবোনিক প্লেগে মৃত লোকদের লাশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিযরা অসুস্থ মাছি পুরে সেই বোমা ফেলত মিত্রশক্তির সৈনিকদের ওপর। এর চেয়েও বড় এক্সপেরিমেন্ট করেছে সোভিয়েত রাশা। ওয়াই পেস্টিস দিয়ে তৈরি করে কোল্ড ওঅরে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র।’
‘আপনি বলছিলেন নিউমোনিক প্লেগের কথা,’ বলল রানা।
মাথা দোলালেন বিজ্ঞানী। ‘একই ব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট। ইয়েরসিনিয়া পেস্টিসের আত্মীয় সে। তবে নিউমোনিক টাইপ আরও বিপজ্জনক। ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। একজন থেকে সংক্রমিত হয় আরেকজনের ভেতর। মাত্র কয়েক দিনে ছড়িয়ে যায় লাখ লাখ বর্গ মাইল জুড়ে।’ কাঁধ ঝাঁকালেন ব্যানিং। ‘আর ওই একই জিনিস ছিল রুপার্ট ওয়েনহেইম ও হেলমুট হাইনরাইনারের দেহে। দখল করে নিয়েছিল ফুসফুস। ওই রোগে প্রথমে দেখা দেয় হালকা হাঁচি-কাশি, এরপর প্রচণ্ড জ্বর। হতে থাকে রক্তবমি। কয়েক ঘণ্টার ভেতর ভীষণ কষ্ট পেয়ে মারা যায় রোগী।’
চুপ করে আছে রানা।
‘তুমি সৌভাগ্যবান,’ বলল মার্লো। ‘মঠের সেই ঘর বা সেফ হাউসে পা রেখেও এখনও বেঁচে আছ। তবে পৃথিবীর শত শত কোটি মানুষ হয়তো মরবে করুণভাবে।’
‘আপনার বাঁচার আরেকটা কারণ, যে ওষুধ নিয়মিত খান, সেটা হয়তো রক্ষা করেছে আপনাকে,’ বললেন প্রফেসর ব্যানিং।
‘ওষুধ?’ ভুরু কুঁচকে গেল রানার।
‘সেফ হাউসে গ্রেফতার হওয়ার সময় ওটা তোমার কাছে ছিল,’ বলল মার্লো।
ওটা তো অতি সাধারণ এক টনিক, দিয়েছিলেন আশ্রমের প্রধান সাধু,’ বলল রানা।
‘প্রতিদিন কতটুকু করে খেতেন?’ জানতে চাইলেন ব্যানিং।
‘বড়জোর তিন বা চার ফোঁটা,’ বলল রানা, ‘এজেণ্ট বেলাইতকেও দিয়েছিলাম।’
‘দিয়েছিলেন কেন?’
‘যাতে সুস্থ থাকে জিম্মি।’
ওই পানির ভেতর কী আছে?’
‘জিজ্ঞেস করিনি প্রধান সাধুকে।’
‘ওটা অ্যানালাই করতে হবে,’ বললেন বিজ্ঞানী। ‘আগামী কয়েক ঘণ্টার ভেতর রিপোর্ট পাব,’ বলল অ্যাল মার্লো। ‘হয়তো ওটা থেকে বেরোবে জরুরি ডেটা।’
টনিকের বিষয়ে বিজ্ঞানী ও কমিশনার আগ্রহী হয়ে উঠেছেন দেখে জানতে চাইল রানা, ‘তার মানে আধুনিক কোনও ড্রাগ দিয়ে ঠেকাতে পারবেন না ব্ল্যাক ডেথ?’
চুপ করে থাকল কমিশনার মার্লো।
প্রফেসর ব্যানিং বললেন, ‘আগে নানান অসুখ সারাতে আমরা ব্যবহার করেছি অ্যান্টিবায়োটিক্স। তবে শেষ হয়েছে সেই স্বর্ণযুগ। দ্রুত বদলে যাচ্ছে জীবাণুরা। হয়ে উঠছে অনেক বেশি শক্তিশালী। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই আমরা সতর্ক করেছি: চিরকাল কাজ করবে না অ্যান্টিবায়োটিক্স। কাজেই দয়া করে টুকটাক রোগে ওই ওষুধ ব্যবহার করবেন না। নইলে দেহে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাবে জিনিসটা। তবে আমাদের কথা কানে নেয়নি কেউ। এখন একুশ শতাব্দীতে এসে দেখা যাচ্ছে, এমন কী গর্ভের সন্তান জন্ম নিচ্ছে নিউট্রাল ইমিউনিটি নিয়ে। প্রকৃতির নিয়মই এমন- ক্ষমতাকে কাজে লাগাও, নইলে হারিয়ে যাবে ওটা। এতকাল যারা বলে এসেছে ধ্বংস হবে পৃথিবী, এবার সময় হয়েছে তাদের বগল বাজিয়ে নেচে নেয়ার।’
নীরবতা নামল ঘরে।
চুপ করে নিজের হাত দেখছে কমিশনার অ্যাল মার্লো।
‘নিজেদের চোখের সামনে সব দেখছি,’ আবারও বললেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘গত পনেরো বছরে কাজ করেনি সত্তর ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক্স। ফলে মারা গেছে কোটি কোটি মানুষ। এক সময়ে প্রাণের ভয়ে হাসপাতালের ধারে-কাছে যাবে না কেউ। ওখানেই সবচেয়ে বেশি থাকবে ভয়ঙ্কর সব মাইক্রো- অর্গানিযম। দু’দিক থেকে বিপদে পড়েছে মানুষ। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন দুর্বল হয়ে গেছে, তেমনি জটিল হয়ে উঠেছে জীবাণুর মারণক্ষমতা। এমন কী বিজ্ঞানীরাও ভাবতে পারেননি, এত দ্রুত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে সাধারণ সব অণুজীব।’
‘এ বিষয়ে নিজেই ভয়ঙ্কর সব রিপোর্ট পড়েছি,’ সায় দিল অ্যাল মার্লো। ‘এমন কী বাঁচার জন্যে নিজের দেহে নতুন করে ডিএনএ তৈরি করছে মাইক্রোবরা। মুখ ফুটে ডাক্তারী পেশার কেউ বলছে না: আমরা আসলে আছি বারুদ ও গোলা ভরা কামানের মুখে।’
‘আর এই বিপদের সময় ব্ল্যাক ডেথের মত মহামারী এলে?’ মাথা নাড়লেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘প্রথম ধাক্কায় মরবে পৃথিবীর পঁচাত্তর ভাগ মানুষ!’
‘আপনারা বলেছেন নিজেদের জন্যে ভ্যাকসিন বা সিরাম তৈরি করছে ডেইটার গিসেল,’ বলল রানা। ‘ওই একই কাজ করতে পারে আমাদের বিজ্ঞানীরা।’
‘হয়তো,’ বললেন ব্যানিং। ‘তবে কেউ জানে না কবে সফল হবে গবেষণা। প্লেগের ভ্যাকসিন রয়ে গেছে তার প্রাথমিক পর্যায়ে। ওয়াই পেস্টিস স্যাম্পল থেকে তৈরি ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে ইঁদুরের ওপর। তাতে সফলতার মাত্রা খুবই কম। কাজেই নিশ্চয়তা নেই যে মানুষের দেহে তা কাজ করবে। একই কথা খাটে ডেইটার গিসেলের লোকদের বিষয়েও। এতক্ষণে হয়তো রোগে ভুগে মারা গেছে তারা। আর তাই কোথাও দেখা যাচ্ছে না তাদেরকে। আসলে সাধারণ মানুষকে ব্ল্যাক ডেথ থেকে রক্ষা করতে হলে চাই উপযুক্ত অ্যান্টিসিরাম। তেমন কিছু তৈরি করতে পারিনি আমরা। এ অবস্থায় ওই মরণ রোগ ছড়িয়ে পড়লে মাত্র কয়েক দিনে ইউরোপ থেকে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে মহামারী।’
‘মৃত্যুর আগে চিকিৎসা পেয়েছিল হেলমুট হাইনরাইনার?’ জানতে চাইল রানা।
গম্ভীর চেহারায় মাথা দোলালেন প্রফেসর ব্যানিং। ‘প্রয়োগ করা হয়েছে প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ। স্ট্রেপটোমাইসিন, ক্লোরোমাইসিন, টেট্রাসাইক্লিন, ডক্সি-সাইক্লিন, জেন্টামিসিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন- কাজ করেনি একটা ওষুধও। হাসতে হাসতে তাকে খুন করেছে ওই ব্যাকটেরিয়া। ধরে নিন, আমাদের হাতে আছে বাচ্চাদের গুলতি, আর ওটার আছে গোলা ভরা এক ডিভিশন যুদ্ধের ট্যাঙ্ক।’
‘হয়তো অনেক বেশি অসুস্থ ছিল, তাই ওষুধ কাজ করেনি,’ খড়কুটো ধরে ভেসে থাকতে চাইল কমিশনার অ্যাল মার্লো।
‘তা নয়,’ এক কথায় তাকে উড়িয়ে দিলেন বিজ্ঞানী। ‘ব্ল্যাক ডেথের বিরুদ্ধে আমাদের হাতে কোনও অস্ত্রই নেই। ‘
‘মহামারী একবার শুরু হলে রোগীদেরকে কোয়ারেন- টাইন করা হবে,’ বলল মার্লো
‘তাতে লাভ হবে না।’ চোখ বুজে ডানহাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুল দিয়ে নাকের গোড়া চেপে ধরলেন ব্যানিং।
‘হয়তো এরই ভেতর মারা গেছে ডেইটার গিসেল আর তার দলের সবাই,’ বলল কমিশনার। ‘একই কারণে মারা পড়েছে হেলমুট হাইনরাইনার আর রুপার্ট ওয়েনহেইম। সেক্ষেত্রে হয়তো ছড়িয়ে পড়বে না রোগটা। ‘
‘কিন্তু তা যদি না হয়?’ মাথা নাড়লেন প্রফেসর। ‘তা ছাড়া, মারা গেলেই বা কী? হয়তো মৃতদেহ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ব্ল্যাক ডেথের জীবাণু। সেক্ষেত্রে আমরা কী করব? কেউ জানে না কবে তৈরি হবে প্রয়োজনীয় ওষুধ।’
দেয়ালের দিকে চেয়ে রইল কমিশনার মার্লো।
‘মৃত্যুভয়ে পাগল হয়ে উঠবে কোটি কোটি মানুষ,’ বললেন ব্যানিং, ‘বাঁচার জন্যে ছুটে যাবে হাসপাতালে। রোগীদের দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়বে জীবাণু। প্রাণের ভয়ে পালাতে শুরু করবে সবাই। সড়ক পথ, নৌপথ, রেলপথ ভরে যাবে মানুষের ভিড়ে। কোনও দেশের সরকারের সাধ্য নেই ইমার্জেন্সি সার্ভিস দেবে। পথে-ঘাটে পড়ে থাকবে হাজার হাজার মৃতদেহ। ডাক্তারদের উপায় নেই চিকিৎসা দেয়ার। মাত্র কয়েক দিনে মরবে শত শত কোটি মানুষ। ওদিকে প্রতিটি শহরে শুরু হবে রায়ট ও ডাকাতি। শেষ পর্যন্ত যার যার কাজ ফেলে পালিয়ে যাবে মিলিটারি, পুলিশ ও মেডিকেল সার্ভিসের সবাই। সাধারণ মানুষের মতই দলে দলে মরবে তারা।’ মাথা নাড়লেন প্রফেসর। ‘মাত্র কয়েক মাস পর বন্ধ হবে মৃত্যুর এই মিছিল। শহরগুলো ততদিনে পরিত্যক্ত। বাজবে না কোনও সাইরেন। আকাশে থাকবে না কোনও হেলিকপ্টার। ফাঁকা পড়ে থাকবে এয়ারপোর্ট, রেলওয়ে স্টেশন, হাইওয়ে, নৌ-বন্দর। রাস্তায় মানুষের পচা লাশ খুবলে বেড়াবে শেয়াল-কুকুর। ওটাই হয়তো সত্যিকারের মহাপ্রলয়।’
কেন যেন রানার মনের পটে ভাসল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা দুর্ভিক্ষের চিত্র। খেতে না পেয়ে পথে-ঘাটে মরছে হাজার হাজার মানুষ। এক পলকে ও বুঝল, কালো- মৃত্যুর কবলে পড়লে কী ভয়াবহ পরিণতি হবে ওর ভালবাসার সবুজ ওই দেশটির!