পঁয়ত্রিশ
এক্সেলারেটর আরও দাবিয়ে দিল রানা। প্রচণ্ড শক্তিশালী টার্বো চার্জড় ইঞ্জিন। ঝোড়ো বেগে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে চলেছে সুবারু গাড়ি। পুরো দুই লেন ব্যবহার করে চুলের কাঁটার মত তীক্ষ্ণ বাঁক নিচ্ছে রানা। সামনেই পিচঢালা দীর্ঘ পথ। ডানে খাড়াভাবে নেমেছে পাহাড়ি খাদ। বামে উঠেছে পাথুরে দেয়াল। বেলফেগর ট্রাক চালাবার সময় এমন পথ দেখেছে রানা। অবশ্য, এখন চলেছে তার অন্তত তিন গুণ গতি তুলে।
মাথার ওপর কালো একটা ছায়া যেন হেলিকপ্টারটা। স্পিডোমিটার দেখল রানা, গাড়ির গতি এক শত সত্তর কিলোমিটার। সাঁই-সাঁই করে পিছনে পড়ছে কালো ফিতার মত রাস্তা। পেছনে পড়েছে কপ্টার। তবে মাত্র ক’সেকেণ্ড পর আবারও এগিয়ে এল ওটা।
‘সিটবেল্ট বেঁধে নাও,’ ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে বলল রানা।
ঠিক জায়গায় ক্লিপ আটকে নিল বেলা। বিপজ্জনক গতিতে ছুটে চলেছে গাড়ি। কাত হয়ে রানার ব্যাগ থেকে চোরাই পুলিশ রেডিয়ো নিল বেলা। স্ক্যান করল পুলিশ চ্যানেল। ভাবছে, শুনবে কর্তৃপক্ষের আলাপচারিতা। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল। ‘রেডিয়োতে কিছুই বলছে না। তারা ভাল করেই জানে, কান পেতে আছি আমরা।’
চুপ করে থাকল রানা।
এক শ’ নব্বুই কিলোমিটারে উঠল স্পিডোমিটারের কাঁটা। দু’ শ’ পেরিয়ে স্থির হলো সোয়া দুই শ’ কিলোমিটারে। আরও গতি দেয়ার সাধ্য নেই গাড়ির। ওপর থেকে আসছে হেলিকপ্টার। দেখতে না দেখতে গাড়ি পেরিয়ে গেল ওটা। আড়াআড়িভাবে ভাসতে ভাসতে নেমে এল রাস্তার কাছে। এগোতে দেবে না। নাকের কাছে হেলিকপ্টার দেখছে রানা। ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়েছে পাইলট। তীব্র বেগে রাস্তায় রানার লাগলে মুহূর্তে চুরমার হবে যান্ত্রিক ফড়িঙ। একই পরিণতি হবে গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হলেও। আগেই রানা বুঝেছে, এরপর কী করবে লোকটা।
থ্রটল টেনে রাস্তার ডানে টেইল রোটর রাখল সে। চলেছে আড়াআড়িভাবে। পাইলট ভাবছে, গতি কমিয়ে থামাবে গাড়িটা। তখন এয়ারক্রাফট থেকে নামবে সশস্ত্র জণ্ডারমি সদস্যরা। গ্রেফতার করবে কিডন্যাপারকে।
তাতে আপত্তি আছে রানার।
গতি হ্রাস না করে ডানে স্টিয়ারিং ঘোরাল ও। ঝড়ের বেগে পাশ কাটাল যান্ত্রিক ফড়িঙের সুপারস্ট্রাকচার। গাড়ি ও হেলিকপ্টারের মাঝে ব্যবধান থাকল মাত্র ছয় ইঞ্চি। পথের কিনারায় সরে ছুটছে গাড়ি। মুখ হাঁ করে পাশের খাড়া খাদ দেখছে বেলা। রানার হিসাবে কোনও ভুল হলে পাথুরে ব্যারিয়ারে লেগে ছিটকে পড়বে কয়েক শ’ ফুট নিচে। ফলাফল: নিশ্চিত মৃত্যু!
রোটরের দমকা হাওয়ায় থরথর করে কাঁপছে স্টিয়ারিং হুইল। তবে শক্ত হাতে ওটা ধরেছে রানা। হুইল বামে ঘুরিয়ে আবারও উঠে এল ঢালু রাস্তায়। চলেছে প্রচণ্ড গতি তুলে। আবার পিছু নিল হেলিকপ্টার। বেলার দিকে মনোযোগ নেই রানার। দু’হাতে সিট খামচে ধরেছে বেচারি। চোখ বন্ধ।
কানের কাছে রোটরের বিকট শব্দ। নতুন কৌশলে বামের ব্যারিয়ারের গায়ে গাড়িটাকে ফেলতে চাইছে পাইলট। বাধ্য হয়ে বামে সরতে হয়েছে রানাকে। পাথুরে দেয়ালে লেগে ঠাস্ শব্দে উড়ে গেল বামের উইং মিরর। টলমল করে উঠেছে গাড়ি। রানা ডানে সরছে দেখে কয়েক গজ ওপরে উঠল পাইলট। ফিরে এল মাথার ওপর। ভাবছে, আবারও রুদ্ধ করবে পথ। ডানে-বামে সরে উড়ন্ত হেলিকপ্টারের ওদিকটা দেখতে চাইছে রানা। বামে ছুটে আসছে দীর্ঘ বাঁক। গতি না কমিয়ে গোঁ ধরা মানুষের মত ছুটে চলল রানা। স্পিডোমিটারের কাঁটা দেখাচ্ছে এক শ’ নব্বুই কিলোমিটার। বাঁক পেরোতেই হঠাৎ সামনে পড়ল উঁচু রাস্তার দু’পাশে পাথুরে ব্যারিয়ার। পথ সোজা ঢুকেছে পাহাড়ি সুড়ঙ্গে। ওটার দিকে ছুটতে গিয়ে মৃদু হাসল রানা। বাঁক ঘুরে পাহাড়ি সুড়ঙ্গ দেখলে মুখ শুকিয়ে যাবে পাইলটের।
পলকের জন্যে রিয়ার ভিউ মিররে রানা দেখল, পাহাড় ও সুড়ঙ্গ দেখে তীরের মত ওপরে উঠছে পাইলট। ঝড়ের বেগে আঁকাবাঁকা টানেলে ঢুকল সুবারু। চারপাশে বাড়ি খাচ্ছে রোটরের বিকট ধুপধুপ আওয়াজ।
ক্ষণিক রেহাই পেলেও রানা জানে, সুড়ঙ্গ-মুখে হেলিকপ্টার রেখে অপেক্ষা করবে পাইলট। যান্ত্রিক ফড়িঙ থেকে নামবে সশস্ত্র জণ্ডারমি। তাদের অস্ত্রের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে ও।
উপায় নেই পালিয়ে যাওয়ার।
নাকি আছে কোনও পথ?
কড়া ব্রেক কষতেই নিচে নামল স্পিডোমিটারের কাঁটা। কর্কশ আওয়াজে চাকার রাবার পুড়িয়ে থেমে গেল গাড়ি।
‘এবার?’ জানতে চাইল বেলা।
‘নেমে পড়ব গাড়ি থেকে,’ বলল রানা। বন্ধ করল ইঞ্জিন। ইগনিশন থেকে চাবিটা নিয়ে দরজা খুলল।
সুড়ঙ্গের ওদিক থেকে হেডলাইট জ্বেলে আসছে এক গাড়ি। গতি অস্বাভাবিক বেশি। ওটার ছাত নিচু দেখে রানা বুঝল, জিনিসটা স্পোর্ট কার। সুবারু থেকে নেমে পেছনের দরজা খুলে ফ্যামাস রাইফেল নিল রানা। পথের মাঝে সরে গাড়িটার উইণ্ডশিল্ডের দিকে তাক করল মাযল। ভীষণ ঝাঁকি খেল হেডলাইট। কমে গেল ইঞ্জিনের গর্জন। বদলে শোনা গেল কড়া ব্রেকের বিশ্রী আওয়াজ। রানার থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে থামল স্পোর্টস্ কার। ওটা সাদা রঙের পিউজো আরসিযেড টু সিটার কনভার্টিবল। খোলা ছাত। গাড়ি এতই নতুন, ওর মনে হলো এইমাত্র শো-রুম থেকে আনা হয়েছে ওটাকে। ড্রাইভার রাগী চেহারার যুবক। মাথায় গল্ফ ক্যাপ। চোখে ডিযাইনার সানগ্লাস। অদ্ভুত বিপজ্জনক দৃশ্য দেখে চমকে গেছে সে।
‘গাড়ি থেকে বেরোও,’ তার বুকে মাযল তাক করল রানা।
‘কা-কা-কা-কা-কা-কেন?’ তুতলে উঠল যুবক।
‘আবারও কথা!’ ধমক দিল রানা। ‘আপাতত ওটা নিচ্ছি।’ গাড়ির পাশে সরল ও। এরই ভেতর সুবারু থেকে হোল্ডঅল ও ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়েছে বেলা।
‘আপনি এভাবে আমার গাড়ি নিতে পারেন না, তর্ক করতে চাইল চালক।
মাথা থেকে তার ক্যাপ কেড়ে নিয়ে নিজের মাথায় চাপিয়ে নিল রানা। ‘আবার বলে পারি না! খবরদার! একটা কথাও না!’
‘কিন্তু, ভাই….’
চোপ! আমি আবার কবে তোমার ভাই হলাম! গাড়ি থেকে বেরোও! ওদিকে পাবে একদল ভাল মানুষ।’ স্পোর্টস্ কারের দরজা খুলে খপ্ করে যুবকের বাহু ধরল রানা। একটানে বের করে আনল তাকে।
‘আপনি তো ডাকাতি করছেন!’
‘এতক্ষণে বুঝলে?’ যুবকের হাতে সুবারুর চাবি গুঁজে দিল রানা। ‘আপাতত এটাই চালাও। কথা বন্ধ, নইলে ভয়ানক রেগে যাব। …আর, হ্যাঁ, দাও দেখি তোমার সানগ্লাস!’ ছোঁ দিয়ে যুবকের চোখ থেকে নিয়ে নিজের নাকে ওটা বসিয়ে নিল রানা। হাত বাড়িয়ে দিতে ফ্যামাস রাইফেল নিল বেলা। নল তাক করেছে যুবকের বুকে। ব্যাগদুটো আরসিযেডের পেছনের সরু জায়গায় রাখল রানা। প্যাসেঞ্জার সিটে ভাঁজ করে রাখা একটা কোট। ইতালিয়ান সিল্কের। দাম হাজার ডলারের বেশি। ওটাও পরে কাজ লাগবে, ভাবল রানা। দেরি না করে চেপে বসল ড্রাইভিং সিটে। অ্যাক্সেলারেটর দাবাতেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। দ্রুত এসে প্যাসেঞ্জার সিটে চাপল বেলা। ব্যাগের ওপর রাখল রাইফেল। দরজা বন্ধ হতেই রওনা হলো রানা। পুলিশের চোরাই গাড়ির চাবি হাতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকল যুবক।
‘এটা একটু বেশি হয়ে গেল না?’ বলল বেলা। হু-হু হাওয়ায় উড়ছে ওর দীর্ঘ চুল।
‘আমি আসলে খুবই জঘন্য লোক!’ নিজের সম্পর্কে মতামত জানাল রানা।
মুচকি হেসে ফেলল বেলা। ‘আমি তোমাকে ঠিকই চিনেছি।’
ছত্রিশ
পাহাড়ি সুড়ঙ্গ থেকে সূর্যালোকে বেরিয়ে এল পিউজো আরসিযেড টু সিটার কনভার্টিবল। বড়জোর তিন বা পাঁচ মিনিট পাবে, বুঝে গেছে রানা। যুবক সুবারু নিয়ে সুড়ঙ্গের ওদিকে বেরোলেই গ্রেফতার হবে। পুলিশের বুঝতে সময় লাগবে না যে উড়ে গেছে তাদের পাখি। আসার সময় নিচের দিকে যাওয়া সরু এক রাস্তা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল, এবার বামের ওই পথে গাড়ি নিয়ে এগোল রানা। জানতে চাইল, ‘গুলির আওয়াজে ভয় পেয়েছ?’
‘ভয় পাওয়ার মত কিছু ঘটেনি,’ বলল বেলা।
‘দেখলাম চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছ।’
‘একদম মিথ্যে কথা।’ দূরে তাকাল মেয়েটা।
দু’কিলোমিটার পেরোবার পর দু’পাশ থেকে পথটাকে চেপে সরু করে আনল পাইনের ঘন জঙ্গল। পাতার কারণে তৈরি হয়েছে সবুজ সুড়ঙ্গ। আকাশ থেকে দেখবে না কেউ। আরও দুই কিলোমিটার যাওয়ার পর আরেকটা বাঁকে পৌঁছুল রানা। সামনে গ্রামাঞ্চলের দিকে গেছে সরু পিচঢালা পথ। কয়েক শ’ গজ পর পর ডানে ও বামে কাঁচামাটির রাস্তা। ওর মনে হলো না কেউ পিছু নিয়েছে। পেছনের রাস্তা বা আশপাশের আকাশ ফাঁকা। পরের কাঁচামাটির পথ পেরিয়ে থামল রানা। চাপা ঘড়ঘড় আওয়াজ ছাড়ছে ইঞ্জিন। পেট ভরা ব্যাগ নিজের দিকে টেনে চেইন খুলল ও।
‘এবার কী?’ জানতে চাইল বেলা।
‘কমিউনিকেশন ডিভাইস ট্র্যাক করবে, তাই ফেলে যাওয়া ভাল।’ এমনিতেই ছয়টা বাড়তি পিস্তল, টাকা ও সোনার বারের জন্যে যে-কোনও সময়ে ফেঁসে যাবে ক্যানভাসের ব্যাগের পেট। ব্যাগ হাতড়ে ওয়ালথার পিপিকে পিস্তলটা নিল রানা। রেখে দিল পকেটে। ড্যাশবোর্ডে একে একে রাখল পুলিশের রেডিয়ো ও মোবাইল ফোন। চেক করল রেডিয়ো। কোনও অ্যাক্টিভিটি নেই। একে একে উইণ্ডশিল্ডের ওপর দিয়ে সামনের রাস্তায় গিয়ে পড়ল ছয় রেডিয়ো। চুরমার হলো প্লাস্টিক ও সার্কিট বোর্ড। এবার মোবাইল ফোনের পালা। কয়েক সেকেণ্ড পর পথে পড়ে থাকল ভাঙাচোরা চারটে মোবাইল ফোনের আবর্জনা।
‘আমার মনে হয় পরিবেশবান্ধব উপায়ে ওগুলো বিদায় করা যেত,’ মন্তব্য করল বেলা।
পঞ্চম ফোন দূরে ছুঁড়বে রানা, এমনসময়, কর্কশ আওয়াজে বেজে উঠল ওটা। মৃদু বিস্ময় নিয়ে হাতের দিকে তাকাল ও।
‘দেখো কী বলে,’ অনুরোধ করল বেলা।
দ্বিধা করল রানা। পুলিশের ফোন। হয়তো কল করেছে লোকটার স্ত্রী। ঠিক সময়ে যেন বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরে। বা নষ্ট হয়েছে ওয়াশিং মেশিন। পেট খারাপ বেড়ালের। আবার অন্য কিছুও হতে পারে। কেউ হয়তো জানে মোবাইল ফোনটা এখন ওর কাছে। হয়তো জরুরি কিছু বলার আছে তার।
রিপ্লাই বাটন টিপে কানে মোবাইল ফোন ঠেকাল রানা। অপেক্ষা করছে কলারের কণ্ঠস্বরের জন্যে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করতে হলো ওকে।
‘বেশিক্ষণ চলবে না তোমার এই খেলা,’ বলল কমিশনার অ্যাল মার্লো। দুর্বল কণ্ঠে হতাশা। বোধহয় শুনেছে রেলওয়ে লাইনের সেই অস্বাভাবিক কাণ্ড।
‘খেলতে আপত্তি নেই,’ বলল রানা। ‘চাইলে আরও পুলিশ পাঠাতে পারো। তাদের আণ্ডারওয়্যার দেখতে মন্দ লাগবে না সাধারণ মানুষের।’
‘তুমি আসলে কামানের ছুটন্ত গোলা, রানা,’ নালিশের সুরে বলল মার্লো। ‘কঠিন করে তুলছ আমার কাজ। জরুরি সব ইশ্য বাদ দিয়ে অন্যদিকে মন দিতে হচ্ছে আমার লোকদের। এতে মস্তবড় ক্ষতি হতে পারে।’
ওই একই কথা তো আমিও তোমাকে বলতে পারি, ‘ বলল রানা। ‘খামোকা বাধা হয়ে উঠেছ আমার পথে।’
‘তো ধরে নিচ্ছি, তুমিও চাও এসব বন্ধ হোক? যে-কোনও সময়ে আরও খারাপ হয়ে উঠবে পরিস্থিতি।’
‘তুমি কি কোনও চুক্তি করতে চাও?’ জানতে চাইল রানা। ‘যৌক্তিক কথা বললে ভেবে দেখতে পারি।’
‘কী ধরনের যুক্তি তোমার পছন্দ, মার্লো?’
‘যেমন, তোমার প্রথম কাজ হওয়া উচিত এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইতকে ছেড়ে দেয়া। যা-খুশি কোরো না, রানা। কর্তৃপক্ষের কাছে মেয়েটা পৌঁছে গেলে আমার সাধ্যমত করব তোমার জন্যে। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত’ সরিয়ে রাখব পুলিশবাহিনীকে। সেসময়ের মধ্যে ইউরোপ ছেড়ে চলে যাবে তুমি।
‘শিকারি একদল হাউণ্ড সঙ্গে নিয়ে এক থেকে দশ গুনবে, আর তারপর চোখ মেলে বলবে, এবার ধরব তোকে, রানা- এতে আমি রাজি নই।’
‘ভাল করেই জানি, দশ গোনার আগেই উধাও হবে।’
কোথাও লুকিয়ে পড়লেও আইনের লম্বা হাত খুঁজবে আমাকে। কোথাও স্বস্তি পাব না। তা-ই না?’
মৃদু হাসল মার্লো। ‘কথাটা মিথ্যে নয়। তবে বুদ্ধিমান মানুষ আমার কথা শুনলে আত্মসমর্পণ করত। তোমাকে রাজি করাবার চেষ্টা করে দেখলাম। পরে দোষ দিতে পারবে না।’
‘তবে সমস্যা হচ্ছে, লুকিয়ে পড়ব বা পালিয়ে যাব, সেই ধাত কি আমার মধ্যে দেখেছ আগে?’ বলল রানা। ‘হাতে নিয়েছি জরুরি কাজ। সেটা শেষ না করে থামি কী করে?’
‘এসো একটা চুক্তি করি,’ বলল কমিশনার। ‘আমাদের ভেতর রয়েছে বড় একটা মিল। আমরা চাই ডেইটার গিসেলকে। ‘আমি চাই, নিয়ম মেনে আদালতে বিচার হোক তার। আর তুমি চাও তার জীবন নিতে। আর…’
‘ঠিক। কোনও সন্দেহ নেই,’ বলল রানা।
‘তাকে মুঠোয় পাওয়ার পর স্থির করব কী করা হবে। তার আগপর্যন্ত পাশাপাশি কাজ করতে পারি আমরা। সেক্ষেত্রে সাহায্য পাবে দক্ষ পুলিশবাহিনীর। নিজেদের ভেতর লড়ব না আমরা। কী, হতে পারে না চুক্তি?’
‘তার মানে, তুমি চাও কাছের পুলিশ স্টেশনে গিয়ে যেন আত্মসমর্পণ করি, তাই না? পরে আমাকে ছুটিয়ে নেবে সরকারি এজেন্টরা।’
‘অবশ্যই! ওটা হবে তোমার প্রথম পদক্ষেপ।’
‘চুক্তির এই শর্ত ভাল ঠেকছে না,’ বলল রানা, ‘আর তারপর আমাকে নিয়ে কী করা হবে?’
‘আনঅফিশিয়ালি ব্যবস্থা করব। আমাদের মিশন সফল হলে চলে যেতে পারবে এ দেশ ছেড়ে। অপরাধী হিসেবে নাম উঠবে না পুলিশের খাতায়।’
মৃদু হেসে মাথা নাড়ল রানা। ‘আসলে কী চাও, মার্লো? বুনো পশ্চিমের ডেপুটি শেরিফের মত আমার বুকে এঁটে দেবে টিনের তারা?’
‘তুমি আইনের পক্ষে কাজ করলে নানান সুবিধা পাবে,’ বলল মার্লো। ‘হয়তো জান না, সরকারের বহু উঁচু পর্যন্ত পৌঁছায় আমার হাত।’
‘তুমি এখনও বলনি কেন ডেইটার গিসেলকে খুঁজছ। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বড় কিছু। নইলে ডিজিএসআই নিজেদের এজেন্ট রাখত না তার দলের ভেতর। আসলে কী করেছিল সে? বাচ্চা কয়েকটা মেয়ের হাত থেকে কোকের ক্যান কেড়ে নেন তোমাদের প্রেসিডেন্ট, আর সেই ছবি তুলে ফেলেছিল?’
‘তুমি রাজি হলে ব্রিফ করা হবে। তোমার জন্যে তৈরি করা হবে উপযুক্ত পদ। পরামর্শদাতা বা এ ধরনের কিছু।’
‘আমি কাউকে পরামর্শ দিই না।’
‘তা হলে অন্য কোনও পদ পাবে।’
‘তুমি জান, পদের লোভ আমার নেই,’ বলল রানা। ‘তোমার লোকদের সঙ্গে কী করেছে গিসেল, সেটা নিয়েও আমার মাথা-ব্যথা নেই। আমি শুধু জানি, সে এবং তার দলের গুণ্ডারা খুন করেছে নিরীহ একদল সাধুকে। তারা ছিল আমার বন্ধু। কাজেই স্থির করেছি, এর প্রতিকার করব।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কমিশনার। ‘কিছু নিয়ম তো তোমাকে মানতে হবে, রানা। সঠিক নিয়ম মেনে না খেললে শত্রু হবে সবার।’
‘আমি চলি আমার নিজের আইন মেনে, মার্লো,’ বলল রানা, ‘সহায়তা চাইছ আমার কাছ থেকে? তা হলে সরিয়ে নাও পুলিশবাহিনী। একা খেলতে দাও। হয়তো ঠকবে না।’
‘তার মানে, অর্ধেক ইউরোপ তুমি চুরমার করবে, আর চুপ করে বসে থাকব আমরা?’
‘অর্ধেক ইউরোপের কথা কে বলল?’ হাসল রানা। ‘বড়জোর তিনভাগের একভাগ।’
‘তুমি জান, রানা, তুমি আসলে পাগল?’
‘তা হলে ভুলে যাও চুক্তির কথা,’ উইণ্ডশিল্ডের ওপর দিয়ে দূরে মোবাইল ফোন ছুঁড়ল রানা। ঠাস্ করে পড়ে চুরচুর হলো জিনিসটা।
‘আলাপ শেষ করার নতুন নিয়ম,’ বিড়বিড় করল বেলা। ‘চলো, যাওয়া যাক,’ গিয়ার ফেলে আরসিয়েড নিয়ে রওনা হলো রানা।
এঁকেবেঁকে নিচে গেছে দুই লেনের পথ। অনেকক্ষণ পর ছোট এক গ্রামে পৌঁছল ওরা। অ্যালপাইন শ্যালেগুলো পোস্ট কার্ডের ছবির মতই সুন্দর।
‘ওই যে, ডানে স্টপেজে বাস, আঙুল তুলে দেখাল বেলা।
চাপা গর্জন ছাড়ছে রুপোলি টুর বাসের ডিজেল ইঞ্জিন। বডির একপাশে সুইস এক ট্র্যাভেল কোম্পানির নাম। বাসের পেছনে গিয়ে গাড়ি রাখল রানা। নেমে পড়ল ওরা।
‘বাসে চাপবে ভাবছ?’ জানতে চাইল বেলা।
‘উপায় নেই,’ বলল রানা। লেদার জ্যাকেট নিয়ে ব্যাগে গুঁজল ও। পরে নিল ইতালিয়ান সিল্কের কোটটা। শুঁটকি যুবকের জন্যে তৈরি করেছে দরজি। কাঁধের কাছে সরু। তা ছাড়া, ভাল মানাচ্ছে না গল্ফ ক্যাপ ও সানগ্লাসের সঙ্গে। অবশ্য আপাতত ওগুলো থাকলে চট করে ওকে চিনবে না কেউ। চারপাশ দেখে নিয়ে হোল্ডঅলে ফ্যামাস রাইফেল রাখল রানা। চেইন টেনে দুই ব্যাগ কাঁধে তুলে উঠে পড়ল বাসে। পিছু নিয়েছে বেলা। হাতে সময় নেই। যখন-তখন স্টপেজ ছেড়ে যাবে বাস।
‘সীমান্তের দিকে যাচ্ছেন?’ ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘সোজা লোসানে,’ চওড়া হাসি দিল ড্রাইভার। ‘পৌঁছে যাব রাত আটটার আগেই।’
‘দুটো সিট হবে?’ মিষ্টি হাসল রানা।
‘দুটো কেন, দশটা দিতে পারব!’
সাঁইত্রিশ
রাত আটটায় ঘড়ঘড় আওয়াজে লোসানের প্রধান বাস স্টেশনে পৌঁছুল বাস। যাত্রীরা বিদায় নেবে সেজন্যে মাথা নিচু করে সিটে বসে থাকল রানা। একে একে সবাই নেমে যেতেই ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে বাস থেকে নামল ওরা। কোটি কোটি ধুলো কণা না থাকলেও লোসান আসলে প্যারিসের পাহাড়ি সংস্করণ।
‘প্রথম কাজ টাকা ভাঙিয়ে নেয়া,’ ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তায় বেরিয়ে বলল রানা। সুইট্যারল্যাণ্ডের মানুষের কাছে চার আনাও দাম নেই ইউরোর। ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রিত এক সংস্থা থেকে ড্রাগলর্ডের নোংরা ইউরোর বাণ্ডিল বদলে রানা নিল চকচকে সুইস ফ্র্যাঙ্কের বাণ্ডিল। নতুন কাগজ থেকে এখনও বেরোচ্ছে কালির সুবাস। মানি চেঞ্জার অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে থামল ওরা। প্রথম ট্যাক্সি পেতেই দেরি করল না ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে উঠে পড়তে। ওদের গাড়ি সবুজ ও কালো এক মার্সিডিয এস্টেট গাড়ি। বেশিরভাগ ইউরোপের দেশগুলোতে ট্যাক্সি হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় মার্সিডিয বেনকে।
‘কোথায় যাবেন?’ রিয়ার ভিউ মিররে চেয়ে বলল ড্রাইভার।
‘এখনও জানি না,’ বলল বেলা।
অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল ড্রাইভার ও রানা।
রানার উদ্দেশে বলল মেয়েটা, ‘জানি না যখন, নানাদিকে না গিয়ে উপায় নেই। আমি ছিলাম দলে নতুন। বেরোবার সুযোগ ছিল না। জানা নেই ওই বাড়ির নম্বর কত বা সড়কের নাম কী।’
ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে না তুমি মঠের কাছে যাও?’ প্রশ্ন করল রানা।
‘অন্ধকারে ড্রাইভ করেছে ব্যানওয়ার্ট,’ বলল বেলা। ড্রাইভারের দিকে ফিরল। ‘আপনি বরং আমাদেরকে নিয়ে যান ক্যাথেড্রালের দিকে।’
‘ক্যাথেড্রাল কেন?’ গাড়ি রওনা হতেই জানতে চাইল রানা।
‘জানালা দিয়ে দেখতাম একটা ক্যাথেড্রাল,’ বলল বেলা। ওই বাড়ি ওটা থেকে মাইলখানেক দূরে। একবার ওটার চুড়ো দেখলেই মনে হয় সব চিনব। আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো।’
মনে মনে হিসাব কষছে রানা। ক্যাথেড্রালের চারপাশের ছয় মাইলের মধ্যে থাকবে বাড়িটা। লোসানে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা তিন হাজার। অর্থাৎ ক্যাথেড্রালের চারপাশে রয়েছে কমবেশি নব্বুই হাজার মানুষ। কমবেশি চার হাজার বাড়ি।
সর্বনাশ!
বেলা জানে না কোনটা ছিল ওর সেফ হাউস!
বিংশ শতাব্দীর এক গথিক ক্যাথেড্রাল পিছনে পড়তেই মন দমে গেল রানার। শহরের পাহাড়ি এক অংশের আধুনিক সব বাড়িঘর পাশ কাটাচ্ছে ট্যাক্সি। দেয়াল ও বাগানে প্লাস্টিকের নানান জিনিসপত্র। লোসানে নেই প্যারিসের মত নটর-ড্যাম। জানালা দিয়ে চেয়ে আছে বেলা।
ওর ওপর ভরসা রাখতে হচ্ছে রানার। কিছুক্ষণ পর প্লেস ডে লা ক্যাথেড্রালে পৌঁছে জানতে চাইল ও, ‘কিছু বুঝলে?’
আশা নিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে চেয়ে আছে ড্রাইভার।
‘একমিনিট,’ গাড়ি থেকে নেমে গেল বেলা। থামল পথের বাঁকে। দেখছে বামে ও ডানে।
স্টিয়ারিঙের ওপর তবলা বাজাচ্ছে বিরক্ত ড্রাইভার। যে- কোনও সময়ে খেঁকিয়ে উঠবে, নষ্ট করা হচ্ছে তার সময়।
‘দিনে কত টাকা রোজগার করো?’ তার কাছে জানতে চাইল রানা।
সহজ উত্তর দিল ড্রাইভার। হয় মিথ্যুক, নইলে সত্যিই বড়লোক সুইটয়ারল্যাণ্ডের ড্রাইভাররা! অথবা বারো ঘণ্টা ড্রাইভ করলে কত পেত, সেই হিসেবই দিয়েছে সে।
ড্যামিকো কর্সিনির কাছ থেকে আদায়কৃত ইউরোর বদলে যে সুইস ফ্র্যাঙ্ক পেয়েছে, ওখান থেকে বেশকিছু টাকা ড্রাইভারের হাতে গুঁজে দিল রানা।
জুলজুল করে টাকাগুলো দেখল লোকটা।
‘বাকিটা পরে। অপেক্ষা করো।’ গাড়ি থেকে নেমে বেলার পিছু নিল রানা। পাহাড়ি পথে নেমে গেছে মেয়েটা। ওখান থেকে দেখা যাচ্ছে লোসান শহর। ঝাঁকে ঝাঁকে বাড়ির ছাত। হাজারো জানালা, এখানে-ওখানে চিমনি। চার্চের হলদে সব টাওয়ার’। কোবল পাথরের ছোট স্কয়্যার। একটু দূরে সরু এক সেতু। সাইন বোর্ডে লেখা: পন্ট বেসিয়েরেস।
গাড়িঘোড়ার চাপ কমতেই সেতুর ওদিকে গেল বেলা।
ওর পাশে গিয়ে থামল রানা।
দূরে দেখাল বেলা।
ওর আঙুল অনুসরণ করে তাকাল রানা।
লোহার রেলিঙে ভর দিল বেলা। চোখ কুঁচকে দেখছে চারপাশ। মুখে হতাশা। ঠোঁট চেপে বসল ঠোঁটে। তবে কয়েক মুহূর্ত পর বলল ও, ‘ওই ক্যাথেড্রালের দিকেই সেই বাড়ি।
উপায় নেই বলে ভরসা রাখতে হবে বেলার ওপর। দূরের সেই সাদা ক্যাথেড্রালের ওপর স্থির হলো রানার চোখ। বিড়বিড় করল, ‘ড্রাইভার হয়তো জানে কোন্ পথে যেতে হবে।’
ওই ক্যাথেড্রাল ভাল করেই চেনে ড্রাইভার। রানার কাছ থেকে আরও টাকা পাওয়ার আশ্বাস পেয়ে মহাখুশি। পন্ট বেসিয়েরেস সেতু পেরিয়ে শহরের ওদিকে চলল সে। পেছনে পড়ছে নানান রাস্তা, বুলেভার্ড, মার্কেট, ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ। জায়গায় জায়গায় ঝলমলে সাইনবোর্ড— ফার্সি কার্পেট, দামি গহনা, বুটিক, ইস্ সেন্ট লরেন্ট, লুই ভুইটন, শ্যানেল ও রোলেক্সের। তবে বেশিরভাগ ভবন জুড়ে একের পর এক ব্যাঙ্ক। সিটি কাউন্সিল বোধহয় শহরে নামিয়ে দিয়েছে ডেথ স্কোয়াড। রাস্তায় কেউ ময়লা বা আবর্জনা ফেললে রক্ষা নেই। সুইট্যারল্যাণ্ডের অন্যান্য শহরের মতই অতিরিক্ত পরিষ্কার লোসান। মাঝে মাঝে বাড়িঘরের মাঝের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল লেক জেনেভা। বিকেলের রোদে চকচক করছে সাগরের মত।
শহরকেন্দ্র পেরিয়ে সরু রাস্তা ধরে এগোল ট্যাক্সি। চারপাশে পুরনো আমলের শাটার দেয়া দালান। মাঝে জমি নেই। পেছন সিটে বসে সামনের দুই সিটের মাঝ দিয়ে চেয়ে আছে বেলা। মাঝে মাঝে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে ড্রাইভারকে। বামে, ডানে তারপর আবার বামে যেতে বলল। কিছুক্ষণ পর জানাল, ‘ব্যস, থামুন। এটাই সেই রাস্তা। সামনের বাঁক নিলেই সেই বাড়ি।’
বাড়ি থেকে আশি গজ দূরে থেমেছে ট্যাক্সি। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা ও বেলা। ড্রাইভারকে বলল রানা, ‘একটু দেরি হবে। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করুন।’
আপত্তি নেই ড্রাইভারের। গাড়িতে আছে রেডিয়ো, পকেটে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার। তাতেও সময় না কাটলে আছে খবরের কাগজ। তাকে বলেনি রানা, আগামী কয়েক মিনিটের ভেতর এ এলাকায় শুরু হতে পারে গোলাগুলি। হয়তো প্রথম সুযোগে ট্যাক্সি নিয়ে পালিয়ে যাবে ড্রাইভার!
মার্সিডিযের পেছন সিট থেকে ব্যাগ নিল রানা। হোল্ডঅল বইছে বেলা। একবার পরস্পরের দিকে দেখে নিয়ে বাঁকের দিকে চলল ওরা। রানা খেয়াল করল, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মেয়েটা। চোখে ভয় নেই। ‘ধন্যবাদ,’ নিচু গলায় বলল ও।
‘কীসের জন্যে?’ জানতে চাইল বেলা।
‘আমার পাশে থাকার জন্যে।
মিষ্টি হাসল মেয়েটা। ‘ভাল জিম্মি হওয়ার জন্যে?’
‘আমার জীবনে এত ভাল জিম্মি আর পাইনি,’ বলল রানা।
‘তার মানে আমাকে গুলি করতে হয়নি বলে তুমি খুশি?’
‘বাড়ির ভেতরে পা না রাখলেও পারো,’ বলল রানা। ‘যে- কোনও সময়ে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে বিপজ্জনক।’
‘বিপদের সময় সঙ্গিনী পাশে থাকবে, এটাই কি স্বাভাবিক নয়?’
জবাব দিল না রানা। নামছে সন্ধ্যার আঁধার। একটু দূরের এক বাড়িতে জ্বলে উঠেছে বাতি। রাস্তা ফাঁকা। ষাট গজ দূরে ডেইটার গিসেলের সেফ হাউস। জানালায় কোনও আলো নেই। সতর্ক থাকার জন্যে বাতি নিভিয়ে রাখতে পারে, অথবা ওই বাড়ি হয়তো খালি। সামনে দিয়ে ভেতরে ঢুকতে গেলে যে-কোনও মুহূর্তে কারও চোখে পড়বে ওরা।
‘এবার কী করবে ভাবছ?’ জানতে চাইল এলিস।
‘চোখ এড়িয়ে কাছে পৌছুব,’ বলল রানা। ‘এরপর খুঁজে নেব ভেতরে ঢোকার পথ। কেউ বাধা দিলে গোলাগুলি হবে। কপাল ভাল হলে হয়তো ওখানে পেয়ে যাব ডেইটার গিসেলকে। সেক্ষেত্রে তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনও যুক্তি দেখি না।
‘সবই খুব সহজ, তাই না?’ বিড়বিড় করল বেলা।
‘কাজটা কঠিন হবে,’ বলল রানা। ‘তুমি হলে কী করতে?’
‘জানি না,’ নিচু গলায় বলল বেলা। ‘খুব বেশি নীরব লাগছে চারপাশ। ব্যানওয়ার্টের নিসান ছাড়াও বাড়ির বাইরে থাকত অন্তত দুটো-তিনটে গাড়ি। তার একটা ছিল কালো রেঞ্জ রোভার। যেটাতে চেপে সীমান্তের কাছে গিয়েছিলাম। আরেকটা ছিল বাঁকা উইংওয়ালা সাদা বিএমডাব্লিউ। মালিক হেলমুট হাইনরাইনার। বাড়ির বাইরে তো একটা গাড়িও দেখছি না। হয়তো আছে পেছনের উঠানে।’
‘বাড়ির পেছনে উঠান আছে?’ জানতে চাইল রানা।
মৃদু মাথা দোলাল এলিস। দেখিয়ে দিল বামে দুই বাড়ির মাঝের সরু এক গলি। ‘চল্লিশ গজ গেলে বাড়ির পেছনের দিক।’
‘গলিতে ঢুকব,’ বলল রানা।
প্লাস্টারহীন ন্যাড়া: ইঁটের দেয়ালে নানান ছবি এঁকেছে কিশোর-তরুণরা। সরু গলি দিয়ে যেতে পারবে মাঝারি গাড়ি। বাড়ির পেছন উঠানে জন্মেছে ঘন ঝোপঝাড়। এখানে-ওখানে আবর্জনা ও ইঁটের খোয়া। একপাশে বড় চাকাওয়ালা ক’টা গার্বেজ বিন। বাড়িগুলোর পেছন উঠানের সীমানা হিসেবে রয়েছে পলকা এক বেড়া।
‘কোনও গাড়ি নেই,’ মন্তব্য করল বেলা।
‘সবাইকে না পেলেও হয়তো পাব দু’একজনকে,’ বলল রানা। ওর ইশারায় মাটিতে হোল্ডঅল নামাল বেলা। ওটার পাশে ব্যাগ রাখল রানা। হাঁটু গেড়ে বসে খুলল হোল্ডঅলের চেইন। ভেতর থেকে নিল ফ্যামাস রাইফেল ও ইশতিয়াকের কালাশনিকভ একে-৪৭। ‘জানো এগুলোর ব্যবহার?’ জানতে চাইল।
মাথা দোলাল বেলা। রানার হাত থেকে নিল একে-৪৭। দক্ষ হাতে ঠিক জায়গায় বসাল ফোল্ডিং স্টক। বের করে নিয়ে দেখল ম্যাগাযিন। ওটা ফুল লোডেড। রিসিভারে ম্যাগাযিন ভরে ক্লাঙ্ক আওয়াজে একটা গুলি পাঠাল চেম্বারে। অন করল সেফটি ক্যাচ।
‘আগে কোনও বাড়িতে রেইড দিয়েছ?’ জানতে চাইল রানা।
‘হ্যাঁ।’ আগের চেয়ে জোরে পড়ছে বেলার শ্বাস। রক্তে বইছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। ব্যাগ থেকে নিয়ে ওর হাতে একটা গ্লক পিস্তল দিল রানা। জিন্সের প্যান্টের ওয়েইস্টব্যাণ্ডে অস্ত্রটা গুঁজল মেয়েটা। নিজেও পিস্তল নিল রানা। ব্যাকআপ অস্ত্র হিসেবে বেল্টের নিচে রাখল ওয়ালথার পিপিকে। এবার অর্ধেক খালি ম্যাগাযিন রেখে নতুন একটা ভরল ফ্যামাস রাইফেলের রিসিভারে। চেম্বারে পাঠাল বুলেট।
ওরা তৈরি। দু’জনের চার অস্ত্রে রয়েছে ছিয়াশিটা বুলেট। এলিস বেলার দিকে তাকাল রানা। ‘এখনও পিছিয়ে যাওয়ার সময় আছে, বেলা। ভেবে দেখো।’
‘গু খা, ব্যাটা!’ বলেই ফিক করে হেসে ফেলল বেলা।
‘তোমার হাতের রান্না খেলে ওরকমই লাগবে মনে হয়,’ বলল রানা।
নাক বাঁকা করল এলিস। ‘এই মিশন শেষ হলেই দেখিয়ে দেব ফরাসি রান্না কাকে বলে! তোমার দাওয়াত থাকল।’
আটত্রিশ
পেছন দরজায় রানার কাঁধের ধাক্কা উড়িয়ে দিল পলকা তালা। বাড়িতে ঢোকার আগে সেফটি অফ করা রাইফেল কাঁধে এক- দুই-তিন করে সাত পর্যন্ত গুনল রানা। কোথাও বাজছে না কোনও অ্যালার্ম। বাড়ির ভেতর চেঁচিয়ে ওঠেনি কেউ। হলওয়ে থেকে এল না বারো গেজের ব্যারেল-কাটা বন্দুকের গুলি। থমথম করছে চারপাশ। হাঁটুর চাপে আরও খুলল দরজা। প্রায়ান্ধকার হলওয়েতে ঢুকল রানা। ওর এক পা পেছনে এলিস বেলা।
লম্বাটে টাউন হাউস প্রস্থে সরু হলেও গভীর। তেতলা। ওপরে চিলেকোঠা। প্রথমতলা খুঁজতে গিয়ে প্রতিটি বাতি জ্বেলে দিচ্ছে ওরা। দরজার কাছে পরস্পরকে কাভার দিচ্ছে। বেশিক্ষণ লাগল না পেছনের হল, লিভিং রুম, ডাইনিং রুম, কিচেন, ইউটিলিটি রুম, সামনের হল, ফাটল ধরা টাইসের শাওয়ার রুম দেখতে। একটা কল থেকে টুপটাপ পড়ছে পানি। প্রথমতলা ফাঁকা। রান্নার ঘ্রাণ নেই কিচেনে। বেসিনে নেই ক্রোকারি বা কাটলারি। বাতাসে নেই কফির সুবাস। রানা বুঝল, গত দু’এক দিনে এ বাড়িতে বাস করেনি কেউ। এবার সার্চ করতে হবে প্রতিটি ইঞ্চি, নইলে নিরাপদ বোধ করবে না ওরা।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছে রানা, রাইফেল প্রস্তুত। তর্জনী ট্রিগারের ওপর। সতর্ক হয়ে রয়েছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়। ওপরের সিঁড়ির ল্যান্ডিং থেকে উঁকি দিল না কোনও অস্ত্রের নল। দোতলার ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে হাতের ইশারা করল রানা। এবার বামে যাবে বেলা, ডানদিকে রানা।
নিঃশব্দে একটা একটা করে দরজা খুলে দেখছে ওরা। কেউ নেই। চাদরহীন সব বিছানা। ওয়ার্ডোব ও তাক খালি। ঘরগুলোতে সস্তা আসবাবপত্র। বেশিরভাগই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড বা জাঙ্ক ইয়ার্ড থেকে সংগ্রহ করা। ডেইটার গিসেল ধনী হলেও বিলাসের সুযোগ দেয়নি দলের বিশ্বস্ত সদস্যদেরকে।
দোতলা দেখা শেষে তৃতীয়তলা সার্চ করতে রানা ও বেলার লাগল বড়জোর পাঁচ মিনিট। ফাঁকা পড়ে আছে ফ্লোর। তিনটে বেডরুম, বড় এক গ্যালারি করা ল্যাণ্ডিং ছাড়া আর কিছুই নেই। এক এক করে প্রতিটা ঘর ঘুরে দেখল রানা।
দ্বিতীয় বেডরুম ব্যবহার করা হতো রিক্রিয়েশন রুম হিসেবে। আসবাবপত্র বলতে দু’রঙের সস্তা দুটো সোফা ও পাইন কাঠের তৈরি বড় টেবিল। চারপাশে কয়েকটা খটখটে চেয়ার। টেবিলে আমেরিকান রাইফেলম্যান পত্রিকা। পাশেই আধখাওয়া খাবারের দুটো প্যাকেট। প্লেটের বালাই নেই। টেবিলের সামনে গিয়ে থামল রানা। পড়ে আছে চারটে রুপালি রঙের অ্যালিউমিনিয়াম ট্রে। দুটো খালি হলেও অন্যদুটোর ভেতর রয়েছে খাবারের চারভাগের তিনভাগ। শুকিয়ে মুড়মুড়ে হয়ে উঠেছে নুডলস্। অন্য ট্রেতে কালো রঙের থকথকে সস। রানার মনে হলো ওগুলোর ভেতর রয়েছে মাংসের টুকরো। ফয়েল তুলে নাকের কাছে নিয়ে শুঁকল। জিনিসটাকে ওয়েস্টার সসে ভেজা মুরগির মাংস বলেই মনে হলো ওর। তর্জনীর ডগায় সামান্য তুলে ছোঁয়াল জিভে। অন্তত একদিন আগের বাসি ওটা। তৈরির সময় থেকেই ছিল অখাদ্য। গত চব্বিশ ঘণ্টায় প্রায় পচে গেছে।
টেবিলে মুচড়ে আছে সাদা কাগজের ব্যাগ। ওটায় করেই আনা হয়েছে খাবার। দু’হাতে ব্যাগটার কাগজ মসৃণ করল রানা। এবার পরিষ্কার দেখল কোন্ দোকান থেকে আনা হয়েছে জিনিসটা। একপাশে ঠিকানা।
প্রায় শেষ রানার রেইড দেয়ার কাজ। বেলা গেছে শেষ বেডরুম দেখতে। রানা উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠায়। ভেতরে ঢোকার আগেই বুঝল, ওখানেও থাকবে না কেউ। তবুও বাতি জ্বেলে দেখল চারপাশ। ঘরটা ছোট ফ্ল্যাটের মত করে সাজিয়ে নেয়া হয়েছিল। একপাশে বেডরুম ও কিচেন। আরেকদিকে লিভিং স্পেস ও টয়লেট। মনে হলো না গত কয়েক দিনে বাস করেছে কেউ।
‘ওরা চলে গেছে,’ সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং থেকে বলল বেলা। ‘এত কষ্ট করেও কোনও লাভ হলো না।’
‘ব্যানওয়ার্ট আর তুমি না ফেরায় সতর্ক হয়ে ওঠে,’ বলল রানা। গিয়ে থামল বেলার সামনে। মেঝের দিকে রাইফেলের মাঘল তাক করে অন করল সেফটি ক্যাচ।
‘যাহ্, এবার তো কিছুই করার নেই,’ হতাশা ঝরল বেলার কণ্ঠ থেকে।
‘তোমার রুম কোনটা ছিল?’ জানতে চাইল রানা।
‘তৃতীয়তলার সবচেয়ে ছোট বেডরুম। পাশের ঘরেই থাকত ব্যানওয়ার্ট।’
‘চিলেকোঠা ব্যবহার করত কে?’
‘রাতে কখনও রয়ে গেলে এখানেই থাকত ডেইটার গিসেল আর ডেইযি বাট্স্। তবে একেক বারে এক রাতের বেশি কখনও নয়।’
‘রিক্রিয়েশন রুমের ব্যাপারে বলো।’
‘সবাই জড় হলে ওই ঘর ব্যবহার করা হতো লিভিং রুম হিসেবে,’ বলল বেলা। ‘অথবা যখন গোপন মিটিং হতো। দলের বিশ্বস্তদের ডেকে নিত ডেইটার। ওখানে বসে মদ বা খাবার খেত হেলমুট হাইনরাইনার, রুপার্ট ওয়েনহেইম আর কয়েকজন মিলে।’
‘বেশি পছন্দ করত চাইনিয?’
‘পিত্যা,’ বলল বেলা। ‘কাছেই কোথাও আছে ফাস্ট ফুডের দোকান। ওখান থেকে ফিরতে বেশিক্ষণ লাগত না।’
‘খাবারের দোকানটা কত দূরে?’ জানতে চাইল রানা। ‘তোমার কি আবারও খিদে পেয়ে গেছে?’
‘না, তা নয়। চলো, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।’ বেলাকে সঙ্গে নিয়ে নেমে এসে রিক্রিয়েশন রুমে ঢুকল রানা।
নষ্ট খাবার দেখে নাক কুঁচকে ফেলল বেলা। ‘ইয়া! এই জিনিস খেতে হলে কুকুরের মত বেহায়া হতে হবে।’
কাগজের ব্যাগ দেখাল রানা। ‘সুপার এনজয়।’
‘এই জিনিস গছিয়ে আবার ওই নাম? আমার তো মনে হচ্ছে ব্যাটারা মানুষ মারবে!’
‘আশপাশ থেকে কেনা হয়নি,’ বলল রানা। ‘ঠিকানা আউচি এলাকার। জায়গাটা চেনার কথা ট্যাক্সি ড্রাইভারের। লোকটা এখনও অপেক্ষা করছে কি না কে জানে।’
‘শহরের একটা ডিসট্রিক্ট,’ বলল বেলা। ‘পুরনো বন্দর। কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে।’
বেলার দিকে তাকাল রানা। ‘তুমি না বলেছিলে এদিকটা চেনো না?’
‘ভুলে গেলে… আমি ইতিহাসের ছাত্রী? উনিশ শ’ বারো সালের অক্টোবর। লোসানের আউচিতে প্রথমবারের মত চুক্তি করল ইতালি ও অটোম্যান সাম্রাজ্য। ফলে শেষ হলো ইতালো-টার্কিশ যুদ্ধ।’ হাসল বেলা। ‘কী বুঝলে?’
‘সুপার এনজয়ের খাবার কিনতে কয়েক কিলোমিটার যাবে না কেউ,’ বলল রানা। ‘কাছেই আছে ভাল পিৎযার দোকান। তার মানে, যা ভেবেছি সেটাই ঠিক।’
‘কী ভেবেছ?’
‘এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় গেল?’ বলল রানা। ‘আমার ধারণা, কয়েকটা গাড়িতে দরকারি জিনিসপত্র তুলে সরে পড়েছে তারা। সেজন্যে হয়তো দিতে হয়েছে কয়েক ট্রিপ। বেশি দূরে কোথাও যাওয়ার কথা নয়। আবারও ড্রাইভ করে ফেরার সময় দু’জন এনেছে সুপার এনজয়ের খাবার। ঝটপট এখানে কাজ সেরে ফেরার আগে খেয়েছে ওই জিনিস। তবে ওদের খেতে ভাল লাগেনি। রুচি আছে।’
‘আরেকটা সেফ হাউসে সরে গেছে তারা?’
‘তুমি নিজেই তো বলেছ, টাকার অভাব নেই গিসেলের। নানাদিকে রেখেছে সেফ হাউস।’
‘আউচিতে গিয়ে খুঁজে দেখা যায়,’ বলল বেলা।
‘এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই,’ বলল রানা।
ঊনচল্লিশ
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সির কাছে ফিরে ওরা দেখল, নিজের সিটে এলিয়ে বসে আছে ড্রাইভার। মুখের ওপর খবরের কাগজ। প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু দুই কাস্টমার ফিরতেই চালু করল ইঞ্জিন। জ্বেলে নিল হেডলাইট। নিজেদের ব্যাগ ও হোল্ডঅল গাড়ির বুটে রাখল রানা। পেছন সিটে ওরা উঠতেই ড্রাইভারের কোলে মুচড়ে থাকা কাগজের ব্যাগ ফেলল বেলা।
‘চাইনি খাবেন?’ বলল লোকটা। ‘ওই রেস্তোরাঁর চেয়ে অনেক ভাল একটা চিনি।’
‘হয় আউচির সুপার এনজয়, নইলে কোথাও নয়,’ বলল রানা। ওখানেই চলুন।’ পেছনে হেলান দিয়ে বসল ও। বুজে ফেলল চোখ। বিশ মিনিট পর রাস্তার এক বাঁকে মার্সিডিয়ের গতি কমতেই আবারও খুলল চোখের পাতা
‘পৌঁছে গেছি,’ সন্তুষ্ট হয়ে বলল ড্রাইভার।
টেরেসওয়ালা সব বাড়ির মাঝে নানান রঙের বাতির আলোয় ঝলমল করছে সুপার এনজয় চাইনি রেস্তোরাঁ। ভাল ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটা। ‘গতি কমিয়ে রাস্তার শেষমাথায় যান,’ বলল রানা।
ধীর বেগে চলল ট্যাক্সি। বাম জানালা দিয়ে চেয়ে রইল রানা। ডানে চোখ রেখেছে বেলা। বাঁকের দু’দিকেই পার্ক করা গাড়ি। একটাও উইঙে মার খাওয়া সাদা বিএমডাব্লিউ নয়। নেই কালো রেঞ্জ রোভার। সামনে পড়ল তিনমাথা একটা মোড়।
‘এবার কোন্ দিকে?’ জানতে চাইল ট্যাক্সি ড্রাইভার।
মনে সন্দেহ থাকলে সোজা চলো, এই নিয়ম মেনে বলল রানা, ‘সোজা যান।’
আগের রাস্তার মতই এই স্ট্রিট। ডানে-বামে বাড়িগুলো দেখতে একইরকম। কোথাও নেই কালো রেঞ্জ রোভার বা সাদা বিএমডাব্লিউ গাড়ি।
‘যাহ্, ওদেরকে হারিয়ে ফেলেছি, হতাশ স্বরে বলল বেলা।
সামনে আরেকটা তিনমাথা মোড়ে পৌঁছে অধৈর্য সুরে বলল ড্রাইভার, ‘এবার কী?’
ওরা যেতে পারে ডানে, বামে বা সোজা সামনে।
‘বামে চলুন,’ বলল রানা।
‘বুঝে কোথাও যাচ্ছ?’ জানতে চাইল বেলা।
জবাব দিল না অনিশ্চিত রানা। পেটে কেমন এক অনুভূতি। তিক্ত মুখের ভেতর। পচা সসের জন্যে এমন হয়নি। টের পাচ্ছে ব্যর্থতার বাজে স্বাদ।
মোড়ে বামে বাঁক নিল ট্যাক্সি। হেডলাইট পড়ল টেরেসওয়ালা বাড়িগুলোর ওপর। সরু রাস্তার প্রথম থেকেই দু’পাশে সারি সারি পার্ক করা গাড়ি। ধীর গতিতে চলেছে ওরা। দু’পাশের বাড়িতে ধাক্কা দিয়ে ফিরছে মার্সিডিযের ডিজেল ইঞ্জিনের ধকধক আওয়াজ। কিছু বাড়ির সামনের জানালা খোলা। দেখা যাচ্ছে টিভি স্ক্রিন। হাঁটাচলা করছে কেউ কেউ। আবার কেউ বসে আছে লিভিং রুমে। একটা বাড়িতে পার্টি চলছে। জোরালো মিউযিক পৌঁছে গেছে রাস্তা পর্যন্ত।
না, নেই সাদা বিএমডাব্লিউ বা কালো রেঞ্জ রোভার। জানা নেই কোথায় লোকগুলোর সেফ হাউস।
ব্যর্থ হয়েছে ওরা। আপাতত আর কিছু করার নেই।
কিন্তু তখনই ট্যাক্সির পেছন জানালা দিয়ে বাইরে আঙুল তাক করল বেলা। জরুরি সুরে বলল, ‘ওই যে!’
বেলার দেখানো দিকে গেল রানার চোখ। একটু দূরে ডানের গাড়ির সারিতে মার খাওয়া উইং নিয়ে বসে আছে থ্রি সিরিজের সাদা একটা বিএমডাব্লিউ।
ওটার সামনের বাড়িতে কেউ আছে। টেনে দেয়া হয়েছে নিচতলার জানালার পর্দা। জ্বলছে বাতি।
‘পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে রাখুন,’ ড্রাইভারকে বলল রানা।
‘পার্ক করার জায়গা নেই,’ আপত্তি তুলল লোকটা।
‘তা হলে রাস্তার ওপরেই গাড়ি রাখবেন।’
পঞ্চাশ গজ যাওয়ার পর গাড়ি থামাল ড্রাইভার।
পরস্পরের দিকে তাকাল রানা ও বেলা।
‘রেডি?’ জানতে চাইল রানা।
‘হ্যাঁ, রেডি,’ বলল বেলা। ‘চলো, দেখা যাক কী হয়।’
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। মার্সিডিযের বুট খুলল রানা।
‘এবার বাড়ির পেছনে যাওয়ার উপায় নেই,’ বলল বেলা।
‘সদর দরজা দিয়েই ঢুকব,’ জানাল রানা। হোল্ডঅল থেকে বের করল ফ্যামাস রাইফেল ও একে-৪৭।
অস্ত্রের দিকে তাকাল বেলা। পরক্ষণে চোখ রাখল রানার চোখে। ‘তুমি কি পাগল? খোলা রাস্তায় রাইফেল হাতে বেরোব?’
‘অসুবিধে কী? সুইট্যারল্যাণ্ডে তো সবার কাছেই অস্ত্র থাকে।’ বুটের ঢাকনির জন্যে ওদেরকে দেখছে না ড্রাইভার। ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা নয়। বেলার হাতে একে-৪৭ ধরিয়ে দিয়ে বুটে ব্যাগ রাখল রানা। চেক করল রাইফেল। চেম্বারে ভরল বুলেট। অফ করল সেফটি ক্যাচ। বেল্টের পেছনে গুঁজে রেখেছে গ্লক ও ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল। গোলাগুলির জন্যে তৈরি।
‘তো চলো,’ বলল রানা। ভাবছে, হয়তো লাথি মেরে বাড়ির সদর দরজা ভেঙে ঢুকে দেখবে, ওই বাড়িতে বাস করে কোনও পরিবার। তখন? পার্কিং করা গাড়িটা হয়তো অন্য কোনও বাড়ির। জায়গা না পেয়ে এখানে রেখেছে। সেফ হাউসটা চার বাড়ি পরে। বাড়ির দরজার সামনে থেমে মন থেকে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলল রানা। প্রচণ্ড এক লাথি মেরে ফাটিয়ে দিল দরজার কাঠ। ঠাস্ আওয়াজে মনে হলো গুলি হয়েছে টু-টু বোরের পিস্তল থেকে।
খুলে গেছে কবাট। ঝড়ের বেগে হলওয়েতে ঢুকল রানা ও বেলা। সামনেই কার্পেট দিয়ে ঢাকা সরু এক সিঁড়ি গেছে ওপরে। বামে দরজা। বাতি জ্বলছে প্রথমতলায়। সঙ্কীর্ণ হলওয়ে পেরিয়ে তিন কদমে দরজার কাছে পৌঁছে গেল রানা। হ্যাণ্ডেলের ওপর পড়ল জোরালো লাথি। কট্টাস্ আওয়াজে লক ভেঙে খুলে গেল দরজা। উদ্যত পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকল রানা।
এই ঘর লিভিং রুম। এককোণে বাঁকা এক ল্যাম্প থেকে আসছে হলদে আলো। আগের সেফ হাউসের মতই আসবাবপত্র খুব সস্তা। ঘরের মাঝে কফি টেবিল। তার ওপর রাখা এক ক্যান স্টেলা আর্টোইস ও এক কপি গান অ্যাণ্ড অ্যামো পত্রিকা। চকচকে কাভারে নতুন বোল্ট অ্যাকশন ট্যাকটিকাল রাইফেলের ছবি। পত্রিকার আরেক পাশে স্মিথ অ্যাণ্ড ওয়েসন মিলিটারি অ্যাণ্ড পোলিস মডেল অটোমেটিক পিস্তল। অস্ত্রের নল তাক করা ঘরের দরজার দিকে।
অস্ত্রটা দেখেই রানা বুঝল, ঠিক বাড়িতেই এসেছে ওরা।
কফি টেবিলের তিন ফুট পেছনে কর্ডরয় কাপড় দিয়ে ঢাকা এক উইং চেয়ার। ওখানে বসে আছে এক লোক। বয়স পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ। মিলিটারি কায়দায় ছাঁটা লালচে চুল। চওড়া কাঁধ। পরনে স্লিভলেস টি-শার্ট। দেখা যাচ্ছে শিরা ওঠা পেশিবহুল দুই হাত। মুখের একদিক বিকৃত। গুলি লেগেছিল ওখানে। ক্ষতটা লালচে ও সাদা, যেন ঘন হয়ে উঠেছে মাকড়সার জাল। চোখ ও মুখের কোণে ভাঁজ। এক পলক দেখে তাকে জাত খুনি বলেই মনে হলো রানার।
হেলমুট হাইনরাইনার।
ডেইটার গিসেলের ডান হাত।
নিষ্ঠুর মার্সেনারি।
মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তা নয়। হেলান দিয়ে বসে আছে চেয়ারে। দৃষ্টি ফেলল রানার চোখে। নিচু করে নিল চোখ। যেন পাত্তা দিচ্ছে না রানার হাতের রাইফেল।
তার বুকে মাযল তাক করল রানা। ওর পেছনে সিঁড়িতে হালকা পদশব্দ। দৌড়ে ওপরে উঠছে বেলা।
‘কোনও চালাকি নয়,’ হাইনরাইনারকে সতর্ক করল রানা। ভাবছে, যে-কোনও সময়ে ওর ওপর ঝাঁপ দেবে সে। এক পা সামনে বাড়ল রানা। লোকটার বুকের দিক থেকে সরাচ্ছে না রাইফেলের মাযল। এত কম রেঞ্জে গুলি করলে চেয়ার ভেঙে দেয়ালে গিয়ে লাগবে মার্সেনারির মেরুদণ্ড। লোকটা অভিজ্ঞ সৈনিক। কোনও ঝুঁকি নিচ্ছে না রানা।
একতিল নড়ল না হাইনরাইনার। হাত বাড়াল না পিস্তলের দিকে। আরেক পা এগোল রানা। এবার ভালভাবে দেখল ম্লান, ধূসর চেহারাটা। লোকটার ভুরুতে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখে ফাঁকা দৃষ্টি।
মাতাল নাকি, ভাবল রানা। কফির টেবিলে লাথি মেরে পিস্তল ফেলল পাতলা কার্পেটের ওপর। ঠাস্ করে মেঝেতে পড়ল ক্যান ভরা স্টেলা। গড়িয়ে যাওয়ার সময় ওটার মুখ থেকে ঝরতে লাগল বিয়ার। লোকটা মাতাল হলে বহুক্ষণ থেকেই ড্রিঙ্ক করছে।
‘চেয়ার ছেড়ে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসো,’ নিৰ্দেশ দিল রানা। ‘মাথার ওপর রাখবে দুই হাত।’
তিলমাত্র নড়ল না হেলমুট হাইনরাইনার।
আরেক পা এগোল রানা। ঠাস্ করে লোকটার মাথার বামে নামল ওর রাইফেলের মাযল। এত জোরে মারেনি যে কোনও ক্ষতি হবে।
‘তোমাকে না বললাম…’ বলতে বলতে থেমে গেল রানা।
চেয়ার থেকে একপাশে এলিয়ে পড়ল লোকটা। শরীরে যেন হাড় বলতে কিছুই নেই। ধুপ করে মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে। নড়ছে না একদম।
রানা শুনল, ওপরতলায় টান দিয়ে ঘরের দরজা খুলছে বেলা। হাইনরাইনারের দিকে তাকাল ও। বুটের ডগা দিয়ে খোঁচা দিল নিথর দেহে। একটু আগে এত জোরে মাথায় বাড়ি দেয়নি যে অজ্ঞান হবে। তার মানে ভান করছে। রানা একটু অসতর্ক হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপর। হয়তো হাতে আছে ছোরা। লোকটার পেছনে চলে গেল রানা। রাইফেলের নল ঘাড়ের ওপর তাক করে সাবধানে পরখ করল পাস্। দুর্বলভাবে চলছে অনিয়মিত হৃৎপিণ্ড। লোকটা বোধহয় চলে যাচ্ছে কোমার ভেতর। হয়তো মৃত্যুপথযাত্রী।
এবার কী করবে ভাবতে শুরু করেছে রানা, এমন সময় ভীষণভাবে ঝাঁকি খেল লোকটা। ছটফট করছে জবাই করা মোরগের মত। ধনুকের মত বাঁকা হলো মেরুদণ্ড। দুই হাত যেন স্টিলের তার। টানটান হয়ে ছিঁড়ে পড়ছে প্রতিটি মাংসপেশি। আরও কয়েক সেকেণ্ড নানাদিকে ঝটকা দিল সে, তারপর শিথিল ও নির্জীব হয়ে গেল।
কী যেন হয়েছে; অভিনয় করছে না সে।
খুব সিরিয়াস কিছু।
সিঁড়ির ওপর থেকে চিন্তিত কণ্ঠে ডাকল বেলা, ‘রানা! জলদি এসে দেখে যাও!’
বোধহয় কোমায় চলে গেছে হাইনরাইনার। যেতে পারবে না কোথাও। লিভিং রুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠল রানা। ওপরে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে বেলা।
দোতলায় কাউকে পায়নি মেয়েটা, ভাবল রানা। ‘নিচে মাত্র একজন। তবে ঝামেলা করতে পারবে না।’
মাথা নাড়ল এলিস। ‘তা হলে বাড়িতে ওরা দু’জন। ওপরে রুপার্ট ওয়েনহেইম। করুণ হাল।’
সিঁড়ির ওপরের ল্যাণ্ডিঙে রানা পৌছুতেই পথ দেখাল বেলা। প্যাসেজওয়েতে জ্বলছে টিমটিমে আলো। একটা দরজার সামনে থামল মেয়েটা। দু’পাশের দেয়ালে ফুলের ছবিওয়ালা ওয়ালপেপার। বেলার পেছনে ঘরে ঢুকল রানা। আগের সেই সেফ হাউসের মতই ঘরে সস্তা আসবাবপত্র। ছাত্রাবাসের বেডরুমের মত হলেও এটা গণহত্যাকারীদের বাঙ্কহাউস। একপাশে চেয়ার, প্লাইউডের ওয়ার্ডোব ও সরু বেড। ওটার ওপর ধসে যাওয়া পুরনো ম্যাট্রেস।
বিছানায় পড়ে আছে একটা মৃতদেহ। সে যে বেঁচে নেই তা বুঝতে কাছে যেতে হলো না রানার। আগে কখনও দেখেনি এমন ভয়ানক বিকৃত লাশ। প্রস্রাব ও ঘামে ভিজে গেছে বিছানার চাদর ও ম্যাট্রেস। ভীষণ মুচড়ে আছে রুপার্ট ওয়েনহেইমের দেহ। মরেছে নরকের কষ্ট পেয়ে। রক্ত বেরোয়নি একফোঁটা। কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। অস্বাভাবিক কোনও কারণে মৃত্যু হয়েছে তার।
‘আমার মনে হয় না চাইনিয খাবার খেয়ে মরেছে,’ বলল রানা।
ফ্যাকাসে মুখে বলল বেলা, ‘অন্যজনের কী হাল?’
‘বেঁচে আছে। তবে আর বেশিক্ষণের জন্যে নয়।’
‘আমাদের কী করা উচিত?’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘কিছুই করার নেই। মরবে ব্যাটা। আজ হোক বা কাল, এমনই কিছু হতো। বাড়ি সার্চ করব। তাতে হয়তো জানব অন্যরা কোথায় গেছে। আর যদি জানতে পারি যে ফিরবে তারা, গোপনে বসে থাকব এখানে।’
কথাটা মাত্র শেষ করেছে রানা, এমন সময় একটু দূর থেকে এল সাইরেনের কর্কশ আওয়াজ। তিন লাফে এগিয়ে জানালা দিয়ে নিচে তাকাল ও। দু’দিক থেকে আসছে একসারি পুলিশের গাড়ি ও দুটো সোয়্যাট টিমের ভ্যান। বাড়ির দেয়ালে ক্যালেইডোস্কোপ তৈরি করেছে নীল আলো।
গাড়িগুলো থেমে যেতেই খুলে গেল দরজা। লাফিয়ে ভেতর থেকে বেরোল কালো ট্যাকটিকাল রেসপন্স পুলিশবাহিনীর পোশাক পরা সদস্যরা। প্রত্যেকের হাতে সাবমেশিন গান। ঘিরে ফেলল চারপাশ। তারা জানে কোথায় যেতে হবে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর নিচের হলওয়েতে বুটের আওয়াজ পেল রানা। কারা যেন ঝোড়ো বেগে উঠছে সিঁড়ি বেয়ে। কড়কড়-খ্যাসখ্যাস আওয়াজ তুলছে রেডিয়ো
ধমকে উঠল কয়েকজন, ‘পুলিশ! আত্মসমর্পণ করো!’
‘এবার কী?’ আগের চেয়েও ফ্যাকাসে হয়েছে বেলা। জানালা থেকে পিছিয়ে গেল রানা। হাত থেকে মেঝেতে ফেলল ফ্যামাস রাইফেল। বেল্ট থেকে নিয়ে মেঝেতে রাখল গ্লক ও ওয়ালথার পিপিকে পিস্তল। সোজা হয়ে মেয়েটার চোখে তাকাল রানা। ‘এবার একমাত্র কাজটাই করবে, এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইত। একটু আগে তুমি গ্রেপ্তার করেছ আমাকে।’