অপশক্তি – ৩০

ত্রিশ

চুক্তি শেষে রেস্তোরাঁ ছেড়ে গাড়িতে চেপেছে রানা ও বেলা।

‘আবারও বলছি, ঘুমিয়ে নেবে,’ বলল ফ্রেঞ্চ এজেন্ট।

রওনা হয়ে গেল ওরা।

‘গাড়িতেই ঘুমাতে পারব,’ জানাল রানা।

পিকআপ ড্রাইভ করছে এলিস। ফিরে পেয়েছে ওর গ্লক। মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘মোটেলে উঠলে অসুবিধে কী? আমাদের তো বিশ্রাম চাই! ওখানে আরামদায়ক বিছানা পাব।’

‘পরে বলবে পটাতে চেয়েছি, সেটা বড় কারণ,’ উদাস হয়ে বলল রানা।

‘মনে হচ্ছে সত্যিকারের ভদ্রলোক!’ হাসল এলিস।

যখন-তখন পুলিশ হাজির হবে সে ভয়ে জেগে থাকল বাঙালি ভদ্রলোক। কিন্তু আধঘণ্টা পর ঝিমুতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বেলার কাঁধে মাথা রেখে। সেই ঘুম ভাঙল ঝাঁকি খেয়ে।

থেমে গেছে পিকআপ ট্রাক। সোজা হয়ে রানা দেখল, রাস্তার পাশে ওরা থেমেছে একটা মোটেলের পার্কিং লটে।

‘জায়গাটা ভালই মনে হচ্ছে,’ মন্তব্য করল বেলা।

পাঁচ মিনিট পর মোটেলের একুশ নম্বর রুমের দরজা বন্ধ করল রানা। ওরা আছে পেছনের ব্লকে। কয়েক পা গিয়ে দরজা খুললেই পার্কিং এরিয়া। টয়োটা থেকে অস্ত্রের ভারী হোল্ডঅল এনেছে বেলা। নিজের ব্যাগটা বয়েছে হতক্লান্ত রানা।

ওদের ঘরটা মাঝারি। দরকারি আসবাবপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। দুটো পুরনো খাটিয়া, একটা ওয়ার্ডোব, চলনসই বাথরুম, ঘরের কোণে ঘাড় বাঁকা এক ল্যাম্প, পলকা এক টেবিলের ওপর ফোন ও দেয়ালে দুটো কমদামি তৈলচিত্র।

‘একেবারেই সাধারণ, চলবে তো তোমার?’ মৃদু হেসে বলল বেলা।

‘সমস্যা নেই,’ বলল রানা। চলে গেল বামের বেডের কাছে। ওদিকে জানালা। জুতো না খুলেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। শক্ত, এবড়োখেবড়ো ম্যাট্রেসটাকে মনে হলো পালকের মত নরম। চোখ বুজে বড় করে দম নিল রানা, দ্বিতীয়বার শ্বাস নিতেই ঘুরতে ঘুরতে নেমে গেল বৃত্তাকার কালো এক গহ্বরে! কোনও চিন্তা বা স্বপ্নের অনুমতি নেই ওখানে প্রবেশের!

উত্তর দিকে পাঁচ শ’ কিলোমিটার দূরে লে বাউরগেট এয়ারপোর্টে লিয়ার জেট থেকে নামল কমিশনার অ্যাল মার্লো। তার জন্যে অপেক্ষা করছে কালো সিত্রোঁ সেডানের কনভয়। প্যারিসের রাস্তায় নিজে ড্রাইভ করল মার্লো। পড়ে গেছে দুশ্চিন্তায়। লিয়নে জরুরি কাজ ফেলে সরকারি ক’জন আমলার সঙ্গে দেখা করতে হচ্ছে বলে বিরক্ত। মেজাজ আরও খারাপ, কারণ গত কয়েক ঘণ্টায় হাতে পায়নি ভাল কফি ভরা মগ। মহাবিরক্ত অন্য কারণেও। উঁচু পর্যায়ের গোপন ওই মিটিং করা যেত যে-কোনও বোর্ডরুমে। তার মনে হচ্ছে, বিলাসিতার দিক থেকে রাজা জর্জ ফাইভকে হারাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এসব রাজনীতিকরা। অথচ হাতে সময় নেই, যে-কোনও মুহূর্তে মাথায় পড়বে বাজ।

গ্র্যাণ্ড হোটেলের আধুনিক ও সুসজ্জিত লবিতে পা দিতেই অ্যাল মার্লোর দিকে এল কালো সুট পরা ক’জন লোক। কানে রেডিয়ো পিস। কোটের ভেতর অস্ত্র। কমিশনারকে পথ দেখিয়ে চতুর্থতলায় প্রেসিডেনশিয়াল সুইটে নিল তারা। ভেতরে পা রেখেই মার্লো বুঝল, তার শঙ্কাই ঠিক। টেবিলে রুপার প্লেটে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে দেশের সেরা খাবার। বন্যা বইছে শ্যাম্পেইন ও ওয়াইনের। লাঞ্চের সময় না হলেও পেটপুজোয় ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আমলারা। তার চেয়েও খারাপ কথা, আশপাশে কোথাও নেই এক ফোঁটা ভাল কফি!

রাজকীয় কামরায় ক্ষমতাশালী কয়েকজন আমলাকে দেখল মার্লো। তাঁদের মধ্যে আছেন ডিজিএসআই-এর সেন্ট্রাল ডিরেক্টর ও টেরোরিযম ডিভিশন রয়েছে এমন কয়েকটি এজেন্সির চিফ। লণ্ডন থেকে এসেছেন এমআই ফাইভ-এর লিয়েইযোঁ অফিসার। ডেইটার গিসেলের কেস নিয়ে দু’পক্ষের মাঝে যোগাযোগ রাখছেন তিনি। এসেছেন এফআইএস বা সুইস ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের চিফ। এ ছাড়া উপস্থিত হয়েছেন ফ্রেঞ্চ ইন্টেরিয়র মিনিস্টার। লুই পনেরো সেটির বেশিরভাগ জুড়ে থেবড়ে বসে আছেন তিনি। একটু পর পর চুমুক দিচ্ছেন শ্যাম্পেইনের গ্লাসে। কমিশনার মার্লো পৌঁছুতেই তার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলেন সবাই। ভদ্রতা বজায় রেখে খাবার বা ড্রিঙ্ক এড়িয়ে গেল সে। দেরি না করে যেতে চাইল মূল বিষয়ে।

এখন প্রধান সমস্যা: বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মাসুদ রানা। ওই লোক হঠাৎ করেই জড়িয়ে গেছে অতি গোপনীয় ডেইটার গিসেল অপারেশনে। ঘরের গুরুত্বপূর্ণ সবাই এরই ভেতর পড়েছেন রানার মিলিটারি রেকর্ড ও এসপিয়োনাজ কৃতিত্বের ওপর তৈরি সংক্ষিপ্ত ফাইল। প্রত্যেকে জানেন, ওই লোক পুলিশে ফোন করে বলেছে, কী ঘটেছে শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখয়ে দে পেলভোতে। সুতরাং প্রথম সুযোগ পেয়েই সরাসরি কাজের কথায় এল কমিশনার অ্যাল মার্লো।

‘আজ সকালে যা ঘটল, তা থেকেই শুরু করা যাক। ভোরের দিকে এক খামার থেকে ফোন করা হয় ব্রায়ানকন জণ্ডামির কাছে। খামার মালিক জানায়, চুরি হয়েছে তার পিকআপ ট্রাক। ওই এলাকা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরেই আমাদের পাইলট খুঁজে পায় এক এইচওয়ান হামার। পুলিশ এখন খুঁজছে ওই টয়োটা পিকআপ। হামারের মালিকের নাম ইশতিয়াক আহমেদ ফারুক। যুবক আপাতত কোথাও চাকরি করছে না। বাস করে ব্রায়ানকন শহরে। পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে, একটু আগে জেনেছে, চুরি হয়েছে তার গাড়ি। দেরি না করে নালিশ করত পুলিশে।

‘আপনার কি মনে হয় সত্যি বলছে সে?’ জানতে চাইলেন টেরোরিযম চিফ।

‘তার বিরুদ্ধে কোনও ধরনের প্রমাণ আমাদের হাতে নেই,’ বলল মার্লো। ‘ওদিকে সেই মঠের কয়েক কিলোমিটার দূরে সার্চ টিম পেয়েছে দুটো ভেহিকেল। একটা নিসান এসইউভি। ফাইল করা হয়েছে চেসিস ও ইঞ্জিনের নম্বর। লাইসেন্স প্লেট ছিল অ্যাক্সিডেন্টে নষ্ট হওয়া একটা গাড়ির। নিসানের ভেতরের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে জানা গেছে, ওটা ব্যবহার করেছে এজেণ্ট বেলাইত এবং এক লোক। ওই লোকের নাম কার্ল ব্যানওয়ার্ট। ধারণা করা হচ্ছে, সে গিসেলের দলে ছিল। একটু দূরে ঝোপে পাওয়া গেছে তার লাশ। খুব কাছ থেকে খুন করা হয়েছে হাই-ভেলোসিটি রাইফেল ব্যবহার করে। ক্যালিবার কী ছিল, আর অস্ত্রটা কী, সেসব নিয়ে কাজ করছি আমরা।’

নিম্নপদস্থ এক অফিসার বলল, ‘আন্দাজ করতে পারি, ট্রিগার টিপে দিয়েছে মাসুদ রানা।’ তাকে চিনল না মার্লো।

‘এই কেসে সব না জেনে মন্তব্য করা ঠিক হবে না,’ বলল কমিশনার। ‘তবে, হ্যাঁ, পরিস্থিতি দেখে তেমনই মনে হচ্ছে। ওই দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাসুদ রানা। রাজি করায় ওখানে দেখা করতে। এরপর গুলি করে কার্ল ব্যানওয়ার্টকে। বন্দি হয় আমাদের এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইত। মাসুদ রানা ধরে নেয় সে ডেইটার গিসেলের দলের সদস্যা। গত ক’মাস আমরাও চেয়েছি ওই দলের সবাই মেয়েটাকে বিশ্বাস করুক।’

‘কিন্তু এখন ব্যাকফায়ার করছে সব,’ মন্তব্য করলেন মিনিস্টার অভ দ্য ইন্টেরিয়র।

‘তবে মাসুদ রানা এখন জানে মেয়েটা কে,’ বললেন ডিজিএসআই চিফ। ‘ধরে নিচ্ছি, ওর ওপর ভয়ানক নির্যাতন করেছে কুকুরটা। এত সহজে মুখ খুলবে না আমার এজেন্ট। হয়তো খুনই হয়ে গেছে মেয়েটা।’

‘নির্যাতন বা খুন মাসুদ রানার স্টাইল নয়,’ বলল অ্যাল মার্লো। ঘরে উঠেছে গুঞ্জন। সবাই ভাবছে কী বীভৎসভাবে খুন হয়েছে এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইত। সবাই চুপ করবে সেজন্যে অপেক্ষা করল কমিশনার। আবারও সবার মনোযোগ পাওয়ার পর বলল, ‘অন্য ভেহিকেল ছিল পুরনো আমলের এক সিত্রোঁ ট্রাক। পুড়ে গেছে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওটা ছিল শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভোর বাহন। ফরেনসিক এক্যামিনেশন থেকে জানা গেছে, ওটার টুল লকারে ছিল এক লোক। এখনও এক্সপার্টরা জানতে চেষ্টা করছে সে আসলে কে। তবে আমার মনে হচ্ছে, ওই লোক ছিল আমাদের দ্বিতীয় এজেন্ট পল হার্ভার্ট ওরফে রন হাওয়ার্ড।’

‘তাকে খুন করেছে মাসুদ রানা,’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বললেন এমআই ফাইভ লিয়েইযোঁ অফিসার। তৃতীয়বারের মত নিলেন শ্যাম্পেইনের গ্লাস।

‘মাসুদ রানা বলেছে, সে তাকে খুন করেনি।’

সবার চোখ স্থির হলো কমিশনারের ওপর। একই সময়ে জানতে চাইলেন কয়েকজন, ‘আপনি বিশ্বাস করেন তাকে?’

‘বিশ্বাস করি, আর যা-ই হোক, মাসুদ রানা মিথ্যাবাদী নয়।’

‘হয়তো ভয়ানক বর্বর ওই মাসুদ রানা,’ বলল সুট পরা এক সরকারি অফিসার। ‘কারণ ছাড়াই দ্বিধা নেই খুন করতে।’ মৃদু মাথা নাড়ল অ্যাল মার্লো। ‘তার ক্ষতি না করলে পিঁপড়েও তার হাত থেকে নিরাপদ।’

‘আপনি আগেও তার সঙ্গে কাজ করেছেন,’ বললেন ইন্টেরিয়র মিনিস্টার। দেখছেন হাতের রিপোর্ট। ‘বছরখানেক আগে জড়িয়ে যায় এক কিডন্যাপিং কেসে। জানতে পারিনি বিস্তারিত। তবে আমার এখনকার প্রশ্ন: আসলে তাকে কতটুকু চেনেন আপনি, কমিশনার?’

‘যতটুকু চিনেছি, সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষতি করবে না সে। তবে, আমরা যার ভেতর পড়েছি, তাতে তাকে বলা যায় বিদ্যুৎবাহী তার। একটু দূরেই এক টন বিস্ফোরক। যে-কোনও সময়ে ঘটবে বিপর্যয়।

‘আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা, ‘ বললেন মিনিস্টার। ‘এসবে কীভাবে জড়িয়ে গেল সে?’

‘আমার পক্ষে সব জানা সম্ভব হয়নি,’ বলল অ্যাল মার্লো, ‘আমার পাঠিয়ে দেয়া ফোনের সংক্ষিপ্ত ট্র্যান্সস্ক্রিপ্ট দেখেছেন আপনারা। মাসুদ রানার মুখের কথা থেকে ধরে নিতে পারি, গত কয়েক দিন আগেও সে বাস করত ওই মঠে। কিন্তু ডেইটার গিসেলের দলের লোক মেরে ফেলল সাধুদেরকে মানুষগুলোকে বন্ধু মনে করত রানা। ফলে খেপে গেল সে। এখন ঠিক করেছে, প্রাণ থাকতে বাঁচতে দেবে না ওই দলের অপরাধীদেরকে। বলতে পারেন, একা নেমেছে লড়াইয়ে। এখন আর কিছুতেই সরানো যাবে না ওকে যুদ্ধের পথ থেকে। তার রেকর্ড দেখেছেন আপনারা। বর্তমানে পৃথিবীর বুকে তার চেয়ে বিপজ্জনক আর কেউ নেই। আরও খারাপ দিক, মাসুদ রানা জানেও না পা রেখেছে কীসের ভেতর। বিশেষ করে ডেইটার গিসেল সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। রানার কারণে বাধ্য হলে সময়ের আগেই ভয়ানক কিছু ঘটাবে গিসেল। জেন্টলমেন, আশা করি বুঝতে পেরেছেন, ক্ষতির ঝুঁকি কী পরিমাণ।’

মাথা দোলালেন মিনিস্টার। ‘এক পাগলের বিরুদ্ধে লেগেছে আরেক পাগল। ফলে ঘটতে পারে যে-কোনও বিপর্যয়।’ তিনটে ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির চিফদের দিকে ঘুরে তাকালেন তিনি। ‘আপনাদের কী মনে হয়, এখন কী করবে ডেইটার গিসেল? আপনারা তো এখনও জানেন না সে কোথায় আছে।’

ঢোক গিললেন ডিজিএসআই-এর ডিরেক্টর ও টেরোরিযম ডিভিশনে রয়েছেন এমন দু’জন চিফ।

ডিজিএসআই চিফ বললেন, ‘জী, কথা ঠিক। এখনও জানা যায়নি কোথায় ঘাঁটি গেড়েছে সে।’

অন্যদের ওপর চোখ বোলালেন মিনিস্টার। দৃষ্টি স্থির হলো সুইস এজেন্সি চিফের ওপর। ‘আপনারা কী ভাবছেন?’

‘নানাধরনের চেষ্টার পরেও জানা যায়নি সে কোথায়।’ মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক। ‘তার কোনও ঠিকানা, এমন কী ফোন বা ইমেইল নেই। কোথা থেকে যেন বেরিয়ে আবারও সেঁধিয়ে যায় কোথাও। গ্রেফতারের সুযোগই থাকে না।’

‘কিন্তু তাকে ঠিকই খুঁজে নেবে মাসুদ রানা,’ বলল কমিশনার মার্লো। ‘এ ব্যাপারে আপনাদেরকে নিশ্চয়তা দিতে পারি। আর আমাদের কাজ হবে সঠিক সময়ে তাকে বাধা দিয়ে ডেইটার গিসেলকে হাতের মুঠোয় নেয়া।’

লুই পনেরো সেটিতে নড়ে উঠলেন মন্ত্রী। টেবিলে ঠকাস্ করে রাখলেন শ্যাম্পেইনের গ্লাস। ‘তা হলে বসে আছেন কেন?’

ভালই বলেছেন, ভাবল মার্লো। তার চোখ গিয়ে পড়ল উচ্ছিষ্ট ভরা সব প্লেটের ওপর।

‘আমি চাই দেশ জুড়ে শুরু হোক ক্যাম্পেইন,’ পাশের দুই এইডের উদ্দেশে বললেন মন্ত্রী। ব্যস্ত হয়ে নোট নিচ্ছে দুই যুবক। ‘এতে দেরি করা চলবে না। দৈনিক পত্রিকায় পাঠাতে হবে মাসুদ রানা আর জিম্মি মেয়েটার ছবি। নিউয করুক সব ধরনের সাংবাদিকরা। ওই বেচারী মেয়ে এখনও বেঁচে থাকলে, তাকে যেন উদ্ধার করা হয়, সে-কাজে নেমে পড়ক ফ্রান্সের প্রতিটি মানুষ। শাস্তি পেতে হবে বাংলাদেশি ম্যানিয়াক মাসুদ রানাকে।’ পুরু বুড়ো আঙুল তুলে কমিশনার অ্যাল মার্লোকে দেখালেন মোটা মন্ত্রী, মুখে চওড়া হাসি। ‘এদিকে, কমিশনার, দরকারি সব কাজ করবেন আপনি। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, ইচ্ছে হলে যা খুশি করতে পারবেন। আপাতত আপনার হাতে তুলে দিলাম আর্মড্ রেসপন্স টিম। দরকারে একটা একটা করে গাড়ি সার্চ করবে তারা। খোঁজ নেবে গ্রামাঞ্চলে। মাসুদ রানা যে ধরনের ট্রেনিং পেয়েছে, গোপনে কোথাও লুকিয়ে পড়বে সে। পরে স্থির করবে কীভাবে হাতের মুঠোয় পাবে গিসেলকে। আর সে সুযোগটা নেব আমরা। ধরব সত্যিকারের হারামজাদাটাকে।’

‘রানা কিন্তু সাধারণ অপরাধী নয়,’ বলল মার্লো। ‘সে বাংলাদেশের একজন বিশ্বস্ত এজেন্ট। তার ট্রেনিং দুর্দান্ত। অত্যন্ত সতর্ক লোক। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের চিফ অ্যাডমিরাল মারভিন লংফেলো একাধিকবার এর সাহায্য নিয়ে নির্মূল করেছেন এমআইসিক্সের ভেতর ঢুকে পড়া বেশ ক’জন বিশ্বাসঘাতককে। ওর পেছনে যদি লাগতে যাই, হালকা একটা ব্যাগ নিয়ে হারিয়ে যাবে ও দুর্গম কোনও জায়গায়। যেখানে খুঁজতেও যাবে না কেউ। শত্রুর যানবাহন কেড়ে নিয়ে তাদেরই কমিউনিকেশন ব্যবহার করে উধাও হবে নতুন কোথাও। মাসুদ রানা যে শুধু কমাণ্ডো, তা নয়, ট্রেইণ্ড গেরিলা। আমরা যখন ভাবব তাকে বাগে পেয়ে গেছি, আসলে তখনই ও সরে যাবে বহু দূরে। আসলে সাধারণ কোনওভাবেই তাকে বাগে পাওয়া কঠিন।’

বিস্মিত চোখে কমিশনারের দিকে চেয়ে রইল সবাই। গুঞ্জন উঠেছে ঘরে।

‘আপনি আসলে কী বলতে চাইছেন?’ জানতে চাইলেন ইন্টেরিয়র মিনিস্টার। ‘তাকে ধরা যাবে না, সেটা হয় কীভাবে?

‘সত্যিই কাজটা প্রায় অসম্ভব,’ বললেন ডিজিএসআই চিফ। ‘ধারণা করা হয় বাঙালি ওই এজেণ্ট সত্যিই দুনিয়ার সেরা।’

‘হ্যাঁ, ধরা যাবে,’ বলল মার্লো। ‘তবে সেজন্যে আগে জানতে হবে কী ভাবছে সে।’

‘আশা করি ঈশ্বর আপনাকে বলে দেবেন ওর মগজে কী আছে,’ বললেন মিনিস্টার, ‘পারবেন এত কঠিন কাজ করতে?’

চুপ থাকল মার্লো। নীরবতা নেমেছে ঘরে। একটু পর বলল সে, ‘ঠিক আছে, জেন্টলমেন, তা হলে এবার আলাপ করি কী ধরনের কাজে নামছি আমরা।’

একত্রিশ

ঘুমের ঘন কালো, গভীর কূপ থেকে উঠেই বাজেভাবে আঁকা রঙচটা ছবিটা দেখল রানা। ঘরের অন্যদিকে চলেছে কে যেন। চোখ পিটপিট করে আবারও তাকাল ও। পুরোপুরি জেগে উঠতেই বুঝল, ওকে গ্রেফতার করতে আসেনি কমিশনার অ্যাল মার্লো। দরজার কাছে নেই হ্যাণ্ডকাফ হাতে ইন্টারপোলের সশস্ত্র অফিসার। ওই মেয়ে ওর পরিচিত এলিস বেলা। ঘরের ওদিকের জানালার কাছে গেল মেয়েটা। বাইরে কড়া রোদ। একটু আগে স্নান করেছে বলে তরতাজা গোলাপের মত দেখাচ্ছে বেলাকে। ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঢেকেছে স্তন ও ঊরু। সূর্যের আলোয় ঝিলিক দিল পেলব পায়ের পাতায় জলবিন্দু। শরীর শুকিয়ে নিতে আবারও বাথরুমে ঢুকল মেয়েটা।

পাশের বেডে পোশাকের ওপর ওর গ্লক পিস্তলটা দেখল রানা। ওদিকে ঘুরেও দেখেনি এলিস বেলা।

আমাকে বিশ্বাস করতে পারো, বলেছিল মেয়েটা।

হাই তুলে কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল রানা। ঘুরিয়ে পা রাখল মেঝেতে। সোজা হয়ে বসে আবারও তুলল হাই। ডানহাতে ডলছে গাল। চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি।

দুপুর সোয়া একটা।

যা ভেবেছিল, ঘুমিয়ে নিয়েছে তার চেয়েও বেশি।

কয়েক মুহূর্ত পর আবারও ঘরে ঢুকল বেলা। চুলে পেঁচিয়ে নিয়েছে ছোট একটা তোয়ালে।

‘আগেই ডাকতে,’ বলল রানা।

‘মায়া লেগেছে। ঘুমাচ্ছিলে ঠিক বাচ্চা ছেলের মত। কী অসহায় আর নিষ্পাপ।

লজ্জা পেয়ে বলল রানা, ‘ও। আমি তো বাচ্চাই!’

‘তা ছাড়া, বিপদের সময় ঝিমাতে শুরু করলে বিপদ হবে। সামনে জরুরি কাজ।’

টেবিলে বৈদ্যুতিক কেতলি ও কমদামি কফির ক’টা স্যাচেল দেখল রানা। ঘুম তাড়াতে কাজে লাগবে কফি। জানতে চাইল ও, ‘তুমি ঘুমাতে পেরেছ?’

কাঁধ ঝাঁকাল বেলা। ঝুঁকে একপাশে সরাল পিস্তল। তুলে নিল পোশাক। ‘সামান্য। পরে একবার ঘুরে এলাম বাইরে থেকে। রাস্তার একটু দূরেই একটা মোড়।’

‘কাজটা ঠিক হয়েছে?’ বলল রানা। ‘আগে কখনও শুনিনি চোরাই গাড়ি নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে জিম্মি।

‘রাগ কোরো না। রিসেপশনিস্টকে বলেছি, নষ্ট হয়েছে আমার মোবাইল ফোনের ব্যাটারি। মেয়েটা ভাল। ডেকে দিল ট্যাক্সি। নগদ টাকা খরচ করে তোমার জন্যে কিনেছি কিছু জিনিসপত্র। তুমি তো দেখছি সত্যিকারের টাকার কুমির।’

‘স্পয়েল অভ ওঅর, টেবিলে রাখা কেতলির দিকে চলল রানা।

‘জানতে চাই না,’ বলল এলিস, ‘তবে কাজে লেগেছে টাকা। মনে হলো ঘুম থেকে উঠে খিদে লাগবে তোমার। সেজন্যে কিছু খাবার এনেছি।’ মেঝেতে প্লাস্টিকের ব্যাগ দেখাল ও। ‘কয়েকটা জিন্সের প্যান্ট আর কয়েকটা শার্টও আছে। আমার আন্দাজ ঠিক কি না, কে জানে!’

‘ধন্যবাদ,’ বলে কেতলির ঢাকনি খুলে পানির পরিমাণ দেখল রানা। যথেষ্ট। চালু করে দিল কেতলি। চোখের কোণে কালো প্লাস্টিকের জিনিসটা দেখে বলল, ‘এটা কেন?’

.

টেবিলের কিনারায় রয়েছে ছোট একটা ল্যাপটপ কমপিউটার। ওটার কেবল গুঁজে আছে ল্যাণ্ড লাইনের ফোন সকেটে।

মাথা থেকে তোয়ালে খুলল বেলা। মুখের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ চুল। মেয়েটার সুন্দর মুখটা দেখাল সূর্যমুখী ফুলের মত। আপেলের নির্যাস দিয়ে তৈরি শ্যাম্পুর ঘ্রাণ পেল রানা। ‘আমাদের শত্রুদের কাছেও এই জিনিস। আধুনিকতার সঙ্গে তাল না মিলিয়ে উপায় নেই।’

ফোঁস-ফোঁস করা কেতলির ঢাকনি খুলল রানা। তিনটে স্যাচেল ছিঁড়ে কফি ফেলল কাপের ভেতর। কেতলির ফুটন্ত পানি যোগ দিতেই ফেনা তুলল কাদাটে ইন্সট্যান্ট কফি।

‘অন্য কথা ভাবছি,’ বলল বেলা। ‘ভূত বা প্রেতাত্মা নিয়ে কথা বলেছিলেন সাধু। ওই মঠে কিছু পেয়েছে ডেইটার গিসেল। কাজেই আমাদেরও জানতে হবে, ওটা আসলে কী। যখন ঘুমিয়ে ছিলে, সাধারণ কিছু কিওঅর্ড ব্যবহার করে ইন্টারনেটে সার্চ করেছি মঠ, গণকবর ও কানা সাধুর ব্যাপারে।’

বাজে কফিতে চুমুক দিল রানা। কুঁচকে গেল ভুরু।

‘কাজ হয়েছে তাতে,’ বলল বেলা। ‘জানলাম ফ্র্যাঙ্কো জেন পিয়েরের নাম। জানতে চাও সে আসলে কে?’

তিক্ত মুখে কফিতে আরেক চুমুক দিল রানা। ‘বলো সে কে।’

এক নামকরা ক্রনিকলার। চোদ্দ শতাব্দীর। সে আমলে নানা এলাকায় গিয়ে অদ্ভুত কিছু দেখলে সেসব লিখে রাখতেন। সেসময়ে লেখাপড়া জানত না বেশিরভাগ মানুষ। আর তাই ওই সময়ের ক্রনিকলের ওপর ভর করে ইতিহাস বর্ণনা করেন আজকালকার ইতিহাসবিদরা। মেডিইভেল আমলে ফ্র্যাঙ্কো জেন পিয়েরে লিখে গেছেন কানা সাধু এখিক সাবাতিয়েখের জীবনে ঘটে যাওয়া এক নিষ্ঠুর কাহিনী।’ মৃদু হাসল এলিস বেলা। ‘জানতে চাও আসলে কী হয়েছিল?’

‘জানতে না চাইলেও ছাড়বে না,’ আরেক চুমুক কফি নিল রানা।

‘সেসময়ে জেরুজালেমে যাওয়ার জন্যে ফ্রান্সের এক গ্রাম থেকে রওনা হন কানা এখিক সাবাতিয়েখ। কিন্তু গন্তব্যে আর পৌঁছুতে পারেননি।’

ভুরু কুঁচকে বেলাকে দেখল রানা। ‘তার মানে, তুমি এখন ইতিহাসবেত্তা।’

মিষ্টি হাসল মেয়েটা। ‘সরবনে ক্লাসের সেরা ছাত্রী ছিলাম। আইন পড়তে শুরু করার আগে প্রথম ডিগ্রি নিয়েছি ইতিহাসে। ঠিকই বলেছিলেন ফ্র্যাঙ্কো জেন পিয়েরে। সেসময়ে নেপলসের রাজা ও রানিকে সেনাকল কিনে নেয়ার জন্যে রাজি করান ফ্র্যান্সিসকান বিশপ খজাখ গুয়েখিখ। তুমি জানো, রানা, কোন্ ঘরে শেষবারের মত সাপার খান যিশু?’

‘জীবনে যে দু’একটা বই পড়িনি, তা নয়,’ বলল রানা। ‘সেনাকল সম্পর্কে জানি।’

‘বিশপ চেয়েছিলেন পবিত্র শহরের আশপাশে খ্রিস্টধর্মীদের জন্যে একটা এলাকা। যদিও সেসময়ে ওই শহর ছিল মিশরীয় মামলুক সুলতানদের অধীনে। তবে তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক ছিল পশ্চিমা খ্রিস্টানদের।’

অপেক্ষা করছে রানা।

‘এ থেকে প্রমাণ হয় সঠিক ছিল ফ্র্যাঙ্কো জেন পিয়েরের ক্রনিকল,’ বলল বেলা, ‘আগেই বলেছি, ফ্রান্স ত্যাগ করতে পারেননি কানা সাধু এখিক সাবাতিয়েখ। অসুস্থ হয়ে পড়েন এক গ্রামের কাছে। পরে ধরে নেয়া হয় তিনি চলে গেছেন অশুভ শক্তির মুঠোর ভেতর। ক্রনিকল অনুযায়ী, যখন-তখন মাটিতে পড়ে যেতেন সাবাতিয়েখ। হাত-পা ছুঁড়তেন পাগলের মত। মুখ থেকে বেরোত অদ্ভুত এক ভাষা। আসলে মূর্ছা বা মৃগী রোগে আক্রান্ত হতেন বলে তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারে চার্চ কর্তৃপক্ষ। সেসময়ে চলত ডাইনী শিকার। শত শত রোগীকে এভাবে পুড়িয়ে মেরেছে মানুষ। সাবাতিয়েখের মূল অপরাধ, তিনি কথা বলেন পোপ ও চার্চের বিরুদ্ধে। তেরো শ’ তেতাল্লিশ সালে রোমের পোপ ক্লেমেন্ট ছয় ছিলেন বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে টু শব্দ করলেও রক্ষা ছিল না তার। বড় পদের ধর্মব্যবসায়ীরা নিজ স্বার্থে সম্পূর্ণ সমর্থন দিত পোপকে। ক্রনিকল অনুযায়ী, একটা

একটা খুঁটিতে সাবাতিয়েখকে বেঁধে আগুনে পোড়াতে থাকে চার্চ কর্তৃপক্ষ। তাদের সঙ্গে ছিল গ্রামবাসীরা। করুণ চিৎকার করতে থাকেন সাবাতিয়েখ। আর সেসময়ে দিতে থাকেন একের পর এক অভিশাপ।’

চট্ করে যোগাযোগটা বুঝল রানা। ‘অভিশাপের কথা বলেছিল ডেইটার গিসেল।’

মাথা দোলাল বেলা। ‘পাগলের মত বারবার করে বলত ওই অভিশাপের কথা। আগুনে পুড়তে পুড়তে চেঁচিয়ে বলেছিলেন সাবাতিয়েখ, ‘আমি অভিশাপ দিচ্ছি! নিরপরাধ মানুষকে খুন করছ! আজ থেকে তোমরা অভিশপ্ত! তোমাদের ঠাঁই হবে নরকে! সবই দেখছেন ঈশ্বর! মহাপাপ! মহাপাপ করলে! অভিশপ্ত হলে! রেহাই পাবে না তোমাদের সন্তানরা! নরকে পুড়বে তোমরা হাজার বছর ধরে!’’

বিস্বাদ কফিতে চুমুক দিতে দিতে শুনছে রানা। ভাবছে, এরপর কী বলবে মেয়েটা?

‘ইউরোপে মেডিইভেল সময়ে চারপাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত কুসংস্কার,’ বলল বেলা। ‘মুসলিম জগৎ যখন এগিয়ে চলেছে বিজ্ঞান ও অঙ্কে ভর করে, সেই একই সময়ে কাদার ভেতর তলিয়ে আছে পশ্চিমা সব দেশ। ঝড়-বৃষ্টি বা বন্যার পর সাধুরা বলত, তোমাদের ওপর খেপে গেছেন ঈশ্বর, তখন ভীষণ ভয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত সবাই।’ তিক্ত হাসল বেলা। ‘একেবারে ঠিক সময়ে অভিশাপ দিয়েছিলেন সাবাতিয়েখ। সময়টা তখন তেরো শ’ আটচল্লিশ সাল।’

‘ওই সালে কী হয়েছিল?’ জানতে চাইল রানা।

‘প্রথমবারের মত ফ্রান্সে শুরু হয় কালো মৃত্যু বা ব্ল্যাক ডেথের প্রকোপ,’ বলল বেলা। ‘মাত্র কিছু দিনের ভেতর সাফ হয়ে গেল দেশের অর্ধেক মানুষ। তখনও গ্রামবাসীর কানে বাজছে সাবাতিয়েখের কথা। সময়টা এমন যে গাছের শুকনো পাতার মত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে একের পর এক মানুষ। দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না দূরের পাহাড়ি গ্রামের মানুষের। জানা ছিল না কারও, গোটা দেশ জুড়ে চলছে কী ধরনের বিপর্যয়। সবার মনে হলো, সাবাতিয়েখকে অন্যায়ভাবে পুড়িয়ে মেরেছে বলেই এখন সেই অভিশাপে মরছে তারা। কিন্তু যা করার তো করেই ফেলেছে, কাজেই এখন আর রক্ষা নেই। স্থানীয় বেশকিছু গ্রামের একজন মানুষও বাঁচল না। তাদের ভেতর ছিল সাবাতিয়েখকে অভিযুক্ত করা মানুষগুলোও। মেডিইভেল আমলের সেই সময়ের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন ক্রনিকলার ফ্র্যাঙ্কো জেন পিয়েরে। স্তূপ হয়ে গিয়েছিল মানুষের লাশ। বারবার স্রষ্টার কাছে ক্ষমা চেয়েছে জীবিতরা। সেসময়ে মৃত ও প্রায় মৃত সবাইকে পাহাড়ি ওই মঠের নিচের ঘরে আটকে দেয়াল তুলে দেয়ার নির্দেশ দেন বিশপ। রানা, নিশ্চয়ই বুঝেছ কোন্ মঠের কথা বলছি?’

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

‘শুধু মৃত নয়, অসুস্থদেরকেও আটকে ফেলল একটা ঘরের ভেতর,’ বলল এলিস। ‘শত শত লাশের সঙ্গে বন্দি তারা। হাত-পায়ে আটকে দেয়া হলো শেকল। মাঝে দেয়াল তুলে দেয়ায় জীবন্ত কবর হলো তাদের। খাবার ও পানির অভাবে খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেল মানুষগুলো।

তিক্ত হয়ে গেছে রানার মন।

ক্ষুৎ-পিপাসার যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে ঘুটঘুটে আঁধারে পড়ে থাকল সবাই। পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে মানুষের লাশ। নরমাংস পৈয়ে চারপাশে হুটোপুটি করছে একদল ইঁদুর। ভীষণ গুঙিয়ে চলেছে অসুস্থরা। জীবিতরা জানে, আর কখনও বেরোতে পারবে না ওই ঘর থেকে। কেউ নেই যে রক্ষা করবে তাদেরকে।

‘ক্রনিকলে লেখা হয়েছে এলোইসের নাম,’ বলল এলিস। ‘তিনি ছিলেন নার্স। অসুস্থদেরকে সুস্থ করার জন্যে প্রাণপণ লড়েন। কিন্তু সেই অপরাধেই কি না জানি না, ওই ঘরে জীবন্ত কবর দেয়া হয় তাঁকেও। অনেকে বলে, আজও পাহাড়ি গুহামুখের ওদিক থেকে ভেসে আসে এলোইসের করুণ আর্তনাদ ও আহাজারি।’

প্রধান সাধুর কথা ভাবল রানা। প্রতিটি এলাকায় রয়েছে অতীতের গোপন বহু কিছু। যেগুলো ভুলে যাওয়াই ভাল। পাতাল ঘরের প্রসঙ্গে কথা তোলায় মঠের ওই লজ্জাজনক ইতিহাসের কথাই এড়াতে চেয়েছিলেন তিনি।

তবে ওদের কাছে নেই প্রতিটা জবাব। বহু প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলোর কোনও উত্তর নেই।

‘মাত্র এক সকালে যথেষ্ট রিসার্চ হয়েছে, তাই না?’ বলল বেলা।

‘শুরুটা ভাল,’ বলল রানা, ‘তবে কোনও দিকেই বেশি এগোতে পারোনি। আমাদের এখনও জানা নেই কোথায় আছে ডেইটার গিসেল।’

‘আমি একমত নই,’ বলল বেলা। ‘এসবের সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেছে ডেইটার গিসেল, ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আমরা তো এটা জানি, অভিশাপের কথা বারবার বলত সে।’

‘কিন্তু এটা জানি না, কেন বলত,’ বলল রানা। ‘তা ছাড়া, এত শত বছর পর হঠাৎ করেই কেন মঠে হামলা করল সে? কী সম্পর্ক এসবের সঙ্গে সোনার বারের? ক্রনিকলে ওই ব্যাপারে কিছু আছে?’

‘না, কিছুই নেই,’ স্বীকার করল বেলা।

‘হামলা আর সোনার পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘কী কারণে শত শত বছর আগে মানুষকে মঠের সোনা রাখার ট্রেয়ার ভল্টে আটকে দিয়েছিল চার্চ কর্তৃপক্ষ?’

কাঁধ ঝাঁকাল বেলা। ‘তারা হয়তো জানত না ওখানে গুপ্তধন আছে।’

‘সেক্ষেত্রে তো ডেইটার গিসেলেরও জানার কথা নয়। কানা সাধু সাবাতিয়েখের কাহিনী আর ফ্র্যাঙ্কো জেন পিয়েরের ক্রনিকলে সোনার বার সম্পর্কে কিছুই নেই কেন?’

‘হয়তো ক্রনিকলের আরও অংশ ছিল, পরে হারিয়ে গেছে,’ বলল বেলা।

‘তুমি তো বলেছ, পুরোটাই পড়ে দেখেছ।’

‘অনলাইনে যা পেয়েছি, সেটুকুই,’ বলল মেয়েটা। ‘বাকিটা হয়তো এখনও ডিজিটালাইয করা হয়নি। ফ্রান্সের ইতিহাস দীর্ঘ। এ বিষয়ে এখনও কাজ করছে ন্যাশনাল আর্কাইভ। আরও বেশ ক’বছর লাগবে আসল ইতিহাস কমপিউটারে তুলতে। শত শত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের শেলফ ভরা প্রাচীন সব ডকুমেণ্ট। কিছু জানতে চাইলে নিজে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে।’

রানা বুঝে গেল কী আশা করছে মেয়েটা। মুখে বলল, ‘ভাবছ ঘুরে আসবে প্যারিস থেকে?’

‘তাতে অসুবিধে কী?’ প্রশ্ন তুলল বেলা।

‘এদিকে ডেইটার গিসেল আছে সুইট্যারল্যাণ্ডে, বলল রানা।

‘আর্কাইভে হয়তো পাব জরুরি কিছু। তাতে বেরিয়ে আসবে আসলে কী করতে চলেছে সে।’

‘অথবা ওটা কানা গলি,’ বলল রানা। কী যেন ভাবছে বেলা। ‘কী ভাবছ?’ জানতে চাইল ও।

‘একটা নম্বর,’ ল্যাপটপের সামনে থামল মেয়েটা। ডালা তুলতেই জেগে গেল স্ক্রিন। কি-বোর্ডে কয়েকটা টোকা দিল বেলা। ‘ফ্রেঞ্চ মিনিস্ট্রি অভ কালচার ওয়েবসাইট। প্যারিসে ম্যারাইসের ন্যাশনাল আর্কাইভ সেন্টারের ঠিকানা। এই যে।’ টেবিল থেকে ফোনের রিসিভার নিয়ে বাইরের কোড দিল ও। এখন স্ক্রিনে যে নম্বর দেখছে, ওটা ডায়াল করল ফোনে।

গোসল করতে গেলাম,’ পরিষ্কার কাপড়ের ব্যাগ তুলে নিয়ে বাথরুমের উদ্দেশে চলল রানা। ওদিকে কার সঙ্গে যেন আলাপ শুরু করল এলিস বেলা। বাথরুমে ঢুকে কবাট আটকে নিল রানা। বেলা শাওয়ার নিয়েছে বলে টাইল্স্ ও আয়নায় বিন্দু বিন্দু জলকণা। বাসি পোশাক মেঝেতে ফেলে শাওয়ারের নিচে দাঁড়াল ও। উষ্ণ জলে ভিজতে ভিজতে দেখল ওর শরীরের নানা কাটাছেঁড়া ও ছেঁচে যাওয়া জায়গা। এখনও ফুলে আছে জায়গায় জায়গায়। সবচেয়ে বেশি করুণ হাল ওর দুই হাতের। তালুতে গেঁথে আছে কর্কশ বালি ও কাঁকর। দশ মিনিট গরম পানিতে ভেজার পর টের পেল, বিদায় নিয়েছে প্রায় সব ক্লান্তি।

শাওয়ার শেষে ব্যাগ খুলে দেখল বেলার আনা নতুন পোশাক। ওগুলোর ভেতর রয়েছে নতুন একটা ডিসপোযিবল রেযর ও এক ক্যান শেভিং ফোম। আঙুল দিয়ে আয়নার জলবিন্দু সরিয়ে নিজেকে দেখল রানা। কোথাও কোথাও সামান্য পুড়ে গেছে মাথার চুল। চোখের নিচে কালো দাগ। তবে নতুন করে সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতেই বিদায় নিল গ্রিসের শেষ চিহ্ন। ফোম ব্যবহার করে সাবধানে দাড়ি-গোঁফ কাটল রানা। মনে হলো, দেখতে অতটা খারাপ নয় ও। চমৎকারভাবে ফিট হলো নতুন পোশাক। রুচি আছে মেয়েটার।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে রানা দেখল, নতুন পোশাক পরে বেডে বসে আছে এলিস বেলা। কাঁধে লুটিয়ে পড়েছে ঘন চুল। ‘আরে, এ কে!’ হাসল মেয়েটা। ‘তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না! আরেকটু হলেই প্রেমে পড়ে যেতাম!’

‘বেশিক্ষণ ফোনালাপ হলো বলে মনে হচ্ছে না,’ মন্তব্য করল রানা।

‘তা ঠিক,’ বলল বেলা, ‘ক্রেডেনশিয়াল জানিয়ে কথা বলেছি আর্কাইভের কিউরেটরের সঙ্গে। আমার অনুরোধে ফ্র্যাঙ্কো জেন পিয়েরের ক্রনিকল ঘেঁটে দেখতে রাজি নন তিনি।’

‘কেন?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেলা। ‘বললেন, ওটা দেখা অসম্ভব।’

‘বেশি পুরনো?’ জানতে চাইল রানা। ‘খসে পড়বে পাতা? নাকি ক্ষতি হবে পরিবেশের কারণে?’

‘চুরি হয়েছে গত বছর এপ্রিলে,’ বলল বেলা। ‘দুই গার্ডের হাত-পা বেঁধে আর্কাইভে ঢুকেছে মুখোশ পরা ক’জন ডাকাত। ঘেঁটে দেখেছে আর্কাইভের ওই অংশ। পরে জানা গেল, আর কিছু না নিলেও সরিয়ে ফেলেছে ক্রনিকল। পুলিশের কাছে সূত্র নেই বলে কাউকে সন্দেহ করতে পারেনি তারা।’

আমাদের মতই ওটার ওপর চোখ পড়েছিল কারও,’ বলল রানা।

‘ডেইটার গিসেল,’ বলল বেলা। ‘সে ছাড়া আর কেউ নয়। আগেই বলেছি, বড় কোনও গোলমাল আছে এসবে। ওই লোকের প্ল্যানে গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভূমিকা আছে ক্রনিকলের। তবে সেটা আসলে কী, সেটা আমরা এখনও জানি না।’

‘ক্রনিকলের ভূমিকা থাকলেও আটকে গেছি কানা গলিতে,’ বলল রানা। ‘জরুরি তথ্য নেই, যেটা ধরে এগোব। এবার চলো, বেরিয়ে যাই মোটেল ছেড়ে। সরাসরি যাব লোসানের সেই সেফ হাউসে।’

‘চোরাই গাড়ি নিয়ে সুইট্যারল্যাণ্ডে?’ জানতে চাইল বেলা। ‘ঠিক হবে না। তবে তোমার কাছে যে টাকা আছে, তাতে কিনে নিতে পারবে নতুন গাড়ি।

মাথা নাড়ল রানা। ‘আইনি পথে পাব না কাগজপত্র। গাড়ি বিক্রি করবে না কোনও ডিলার। ওদিকে বেআইনিভাবে যারা বিক্রি করবে, টাকা নিলেও ভাল জিনিস দেবে না তারা।’

‘শেষে মোটর-ওয়েতে আটকা পড়ব বাজে কোনও জায়গায়,’ সায় দিল বেলা। ‘সবার চোখ পড়বে আমাদের ওপর।’

‘তা-ই ধারণা করছি,’ বলল রানা।

‘তা হলে কী করবে ভাবছ?’

‘একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিডন্যাপার ও জিম্মি, তা ভাববে না কেউ,’ বলল রানা। ‘মনে করবে গাড়ি বা ভ্যানের পেছনে জিম্মিকে আটকে রাতের আঁধারে গোপনে ঘুরে বেড়াব।

‘তা ভেবে নেয়াই স্বাভাবিক,’ বলল বেলা। বুঝে গেছে কোন দিকে যাচ্ছে রানার চিন্তার ধারা।

‘সাধারণ দম্পতির মত ঘুরব,’ বলল রানা। ‘ব্রায়ানকন থেকে কাছে গ্রেনোবল শহর। ওটার রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে যাব লোসানে। তাতে লাগবে মাত্র কয়েক ঘণ্টা।’

‘ট্যাকটিকালি তা ভুল,’ বলল বৈলা, ‘ঝুঁকি বেশি। মিষ্টি হাসল সে। ‘সত্যিই, এ ধরনের ভুল করবে কেউ?’

মাথা দোলাল রানা। ‘ডিজিএসআই এজেণ্ট এলিস বেলা আর বিসিআই এজেন্ট মাসুদ রানা আসলে হয়তো হদ্দ বোকা!’

আজ দ্বিতীয়বারের মত মোটেল রিসেপশনিস্টের কাছে সাহায্য চাইল এলিস বেলা। টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে স্থানীয় ট্যাক্সি সার্ভিসে যোগাযোগ করল মেয়েটা।

ক্যাবের জন্যে অপেক্ষায় থাকল বেলা। সেসময়ে মোটেল থেকে সামান্য দূরে নিয়ে একগাদা গার্বেজ বিনের পেছনে টয়োটা পিকআপ রাখল রানা।

সাত মিনিট পর মোটেলে হাজির হলো হাসিখুশি এক. ট্যাক্সি ড্রাইভার। গাড়ির পেছনে তুলে দিল যাত্রীদের ব্যাগ ও হোল্ডঅল। ওগুলোর ভেতরে কী আছে জানলে আত্মা উড়ে যেত তার। ঘরের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বিল মিটিয়ে দিল রানা। ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হলো ওরা গ্রেনোবল শহরের উদ্দেশে।

পাঁচ মিনিট ফালতু এক কমেডি শো দেখে চ্যানেল বদলে নিল মোটেল রিসেপশনিস্ট। নতুন চ্যানেলে চলছে রোমান্টিক সিনেমা। পরস্পরকে জাপ্টে ধরে চুমু দিচ্ছে নায়ক-নায়িকা। তবে দু’জনই স্বর্গত হয়েছে অন্তত দশ বছর আগে। বাটন টিপতেই শুরু হলো জাপানিয কার্টুন। যুদ্ধে নেমেছে দুই দল দানব। আরেক ক্লিক দিতেই এল দুধের বিজ্ঞাপন। চোঁ-চোঁ করে দুই গ্লাস দুধ সাঁটিয়ে দিল শতখানেক দাঁত বের করে হাস্যরত এক ছোকরা। আবারও রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপতেই এল সংবাদ চ্যানেল। ভীষণ গম্ভীর মুখে সবাইকে সতর্ক করছেন এক পুলিশ অফিসার। দেখানো হলো অপরাধীর ছবি।

দূর!

আরেক ক্লিকে আবারও চ্যানেল পাল্টাল রিসেপশনিস্ট।

ক্যালিফোর্নিয়ার বে সিটিতে শত্রুর পেছনে ছুটে চলেছে নায়ক। ওদিকে চেয়ে হঠাৎ ভুরু কুঁচকে গেল মেয়েটার। ফিরল আগের নিউয চ্যানেলে। ফুরিয়ে এসেছে সংবাদ। দেখাচ্ছে অপরাধীর ছবি। আরও কুঁচকে গেল রিসেপশনিস্টের ভুরু। বিস্ফারিত হলো দু’চোখ। বিড়বিড় করে বলল সে, ‘হায়, ঈশ্বর!’

ওদের মোটেলের একুশ নম্বর ঘরের সেই দু’জনের ছবি দেখাচ্ছে টিভিতে!

বত্রিশ

গ্রেনোবল শহরের রেলস্টেশনে পৌঁছে ড্রাগলর্ডের কাছ থেকে জব্দ করা টাকা দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে দরাজ-দিল বকশিস দিল রানা। ব্যাগ ও হোল্ডঅল নিয়ে গেল প্ল্যাটফর্মে। খোঁজ নিয়ে জানল, আজ সুইট্যারল্যাণ্ডের দিকে যাবে মাত্র একটা ট্রেন। সেটা রওনা হবে বিকেল পৌনে চারটেয়। তবে জেনেভা থেকে পুরো ষাট কিলোমিটার আগেই থামবে অন্য স্টেশনে। লেক জেনেভার তীরে সুইস আল্পসের গা ঘেঁষে লোসান শহরে পৌছুতে হলে উঠতে হবে বাসে। কাউন্টার থেকে নগদ টাকায় দুটো টিকেট কাটল রানা।

বেশিক্ষণ লাগল না, কু-ঝিকঝিক করতে করতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল ট্রেন। এয়ারব্রেকের জোরালো ফোঁস-ফাঁস শব্দে থামল রানা ও বেলার পাশে। রেলগাড়ির সামনের চতুর্থ ক্যারিজে ওদের সিট। জানালার ধারে পেল মুখোমুখি দুই সিট। ভারী হোল্ডঅল পায়ের পেছনে রাখল রানা। মাথার ওপরের র‍্যাকে ঠাঁই পেল ব্যাগ। ট্রেনে উঠছে যাত্রী। বেশিরভাগই টুরিস্ট। ভারী ব্যাগ-ব্যাগেজ বয়ে লালচে চেহারায় খুঁজছে যে যার সিট। র‍্যাকে তুলে দিচ্ছে লাগেজ। তর্ক চলছে সিট কোটা, আর জানালার পাশে বসবে কে। একবার সিটে বসলেই ইলেকট্রনিক গ্যাজেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠছে সবাই।

প্ল্যাটফর্মে এক গার্ডকে হনহন করে আসতে দেখল রানা। বেজে উঠল পুরনো আমলের হুইসল। বন্ধ হলো ট্রেনের অটোমেটিক ডোর। পায়ের নিচে দুলে উঠল মেঝে। শক্তি বাড়ছে ইঞ্জিনের। ঠং-ঠং শব্দে লাগছে কাপলিং। কয়েক মুহূর্ত পর স্টেশন ফেলে এগোল রেলগাড়ি।

টেবিলে কনুই রেখে জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে আছে বেলা। ফুলের মত মুখটা ঘিরে খোলা চুলের ফ্রেম। বাইরে ঝলমল করছে রোদ। ঝিকঝিক করছে শুভ্র তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়া। পেছনে পড়ল গ্রেনোবল শহর। নিয়মিত হলো চাকার ঝকঝক আওয়াজ। অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে না চেয়ে মনের সাগরে ডুব দিল রানা। ভাবছে, কী হতে চলেছে সামনে?

‘রেইড দেয়ার আগে তোমরা জড় হও পনেরোজন,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘গাড়িতে বারোজন, সঙ্গে ডেইটার ও তার প্রেমিকা। আর্টিকুলেটেড লরিতে ছিল ড্রাইভার। এ-ই তো?’

মৃদু মাথা দোলাল বেলা।

‘বাদ দিলাম হার্ভার্ট ও ব্যানওয়ার্টকে,’ বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে তোমাকে বাদ দিলে তারা বারোজন।’

‘ডেইটার ও ডেইযি ছাড়াও রয়েছে বিশ্বস্ত দশজন,’ বলল এলিস। ‘এ ছাড়া, নানাদিকে আছে দলের আরও অনেকে। টাকার অভাব নেই ডেইটারের। লোক জোগাড় করা তার জন্যে বড় সমস্যা নয়।’ রানাকে দেখল মেয়েটা। ‘অস্ত্রেরও অভাব নেই। খুব বিপজ্জনক হবে ওদের আখড়ায় রেইড দেয়া। তুমি ভাবছ ঝুঁকিটা নেবে না?’

‘নিজেকে নিয়ে ভাবছি না,’ বলল রানা। মনে হচ্ছে এসবে তোমার জড়িয়ে না যাওয়াই ভাল।’

‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’ আবারও বরফমোড়া চূড়া দেখল বেলা।

এত ঝুঁকি না নিলেও পারো। নেমে যেতে পারো পরের স্টপে। সোজা ফিরবে ডিজিএসআই অফিসে। ইন্টারপোলকে জানিয়ে দেবে, পালিয়ে গেছি আমি।’

‘একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না মার্লো,’ মৃদু হাসল এলিস। সিরিয়াস হলো মুখ। ‘আগেই তো এসব নিয়ে কথা বলেছি। নতুন কিছু বলার নেই।’

‘হ্যাঁ, আলাপ করেছি,’ বলল রানা। ‘তবে বিপদের মাত্রা বুঝতে পেরেছ কি না, সেটা জানি না।’

ভুরু নাচাল বেলা। ‘বলতে চাইছ, মারা পড়তে পারি যে- কোনওজন।’

‘লড়তে হবে অন্তত বারোজনের বিরুদ্ধে। আমাদের সুস্থ থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। হয়তো বাঁচব না। এসব ভেবেই বলছি, সময় আছে। পথ এখনও খোলা। মস্তবড় বিপদে জড়িয়ে যাওয়ার আগেই সরিয়ে নিতে পারো নিজেকে। ফিরবে নিজের কাজে। বাড়িতে হয়তো অপেক্ষা করছে আত্মীয়স্বজন বা প্রেমিক।’

‘অনেক দিন আগেই মন থেকে উবে গেছে প্রেমিকের জন্যে ভালবাসা,’ বলল বেলা। ‘ওর মত পশু আর দেখিনি। আর আত্মীয়রা জানে কী ধরনের কাজ করি। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে না কেউ।’

‘বেশ,’ মৃদু হাসল রানা।

‘তোমার হাসিটা মিষ্টি,’ বলল বেলা। ‘সারাক্ষণ মুখ গম্ভীর না রেখে মাঝে মাঝে হাসলেও তো পারো।’

‘ডেইটার গিসেল পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে অন্তর থেকে হাসব,’ বলল রানা।

‘তারপর ফিরবে বাংলাদেশে, তাই না? বিসিআই-এর নতুন কোনও বিপজ্জনক মিশনে জড়িয়ে পড়বে। …একটা কথা বলব? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমাকে চিনি হাজারো বছর ধরে।’

চুপ থাকল রানা।

নীরবতা নামল দু’জনের মাঝে।

দুলতে দুলতে চলেছে ট্রেন।

গলা শুকিয়ে গেছে রানার। পকেট থেকে নিল প্রধান সাধুর দেয়া সেই টনিক। এখনও রয়ে গেছে এক আউন্স মত পানীয়। ক্যাপ খুলে গলায় ঢালল কয়েক ফোঁটা তেতো পানি। মন ফিরে গেছে সাধুদের মঠে।

‘বোতলে কী?’ জানতে চাইল বেলা।

‘প্রধান সাধু দিয়েছিলেন। এটা নাকি সুস্থ রাখে।’

‘জিনিসটা কী?’

‘পানি। খেতে ভাল নয়।’

‘দাও তো একটু।’ রানার হাত থেকে ছোট্ট বোতল নিয়ে ক্যাপ খুলে শুঁকল বেলা। ছোট্ট চুমুক দিল। কুঁচকে গেল গাল। ‘পানির ভেতর বোধহয় কোনও ধাতু আছে।’

‘আমাকে বলেছিলেন হার্বাল দিয়ে তৈরি,’ বলল রানা। শিশি ফেরত পেয়ে পকেটে রেখে দিল।

আবারও নামল দু’জনের মাঝে নীরবতা।

খটখট-ঝিকঝিক আওয়াজে চলেছে ট্রেন। সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে যাচ্ছে ফসলের সোনালি মাঠ ও একটা-দুটো গ্রাম।

আধঘণ্টা পর সিট ছেড়ে বুফে কারের দিকে চলল রানা। ওটা ট্রেনের সামনের দিকে। ট্র্যাকের পাশে সাইন দেখে বুঝল, পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর পৌঁছুবে সুইস সীমান্তে। দুলন্ত মেঝেতে তাল সামলে দু’পাশের সিট ধরে এগিয়ে চলল ও।

তিন বগি পরে বুফে কার। ডানদিকে ধাতব দীর্ঘ কাউন্টার। পেছনে ছোট্ট কিচেন। বামদিকের জানালার কাছে ছোট কয়েকটা স্টুল। ব্রিটিশ রেলওয়ের মত বাটপারি করতে বসেনি ফ্রেঞ্চ রেলওয়ে। সত্যিকারের ভাল এবং সুস্বাদু খাবার সার্ভ করে তারা। কফি বা ওয়াইন চমৎকার। দুটো চিয বার্গার ও কফির অর্ডার দিল রানা। টাকা দিয়ে খাবার ও পানীয় নেয়ার সময় খেয়াল করল, হঠাৎ করেই নাটকীয়ভাবে কমে আসছে ট্রেনের গতি। কাউন্টার ধরে নিজেকে সামলে নিল রানা। একই কাজ করেছে বুফে অ্যাটেণ্ড্যান্ট। ‘আস্তে, দোস্ত! তাক থেকে পড়বে সব,’ বিড়বিড় করল সে।

‘সামনে কি কোনও স্টেশন?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল অ্যাটেণ্ড্যান্ট। ‘না, লাইনে বোধহয় সমস্যা। মাসখানেক আগে এভাবে আটকে দিয়েছিল একপাল গরু। অথবা মেইনটেন্যান্সের কাজ।’

খুচরো পয়সা নিয়ে ট্রে হাতে ফিরতি পথ ধরল রানা। নাকে এল দামি কফির সুবাস। আরও কমেছে ট্রেনের গতি। কয়েক সেকেণ্ড পর একটা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল।

‘অবাক কাণ্ড তো!’ মন্তব্য করল অ্যাটেণ্ড্যান্ট।

ঘাড় কাত করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। বাঁকা এক ট্র্যাকে থেমেছে ট্রেন। দেখা গেল পেছনের দীর্ঘ লেজ। আশপাশে নেই কোনও স্টেশন। রেলওয়ের ট্র্যাক পেরিয়ে নুড়িপাথরের সরু এক রাস্তা। ওটার সামনে নিচু এক ব্যারিয়ারের ওদিকে দুটো গাড়ি।

রানার মগজে বেজে উঠল সতর্ক ঘণ্টি। বুঝে গেল, আয়েস করে কফি পানের সুযোগ নেই এখন!

তেত্রিশ

ট্রেনের দিকে নাক তাক করে আছে দুই গাড়ি। প্রথমটা কালো সিত্রোঁ সি ফাইভ সেডান। পরেরটা নীল সুবারু ইমপ্রেযা ডাব্লিউআরএক্স এসটিআই। হাই-পারফর্মিং মডেল। প্রচণ্ড বেগে যাওয়ার সময় পথের সঙ্গে সেঁটে রাখে পেছনের উইং। ধুলোয় ধূসরিত দুই গাড়ির দরজা খুলে এইমাত্র নেমেছে ছয়জন লোক। রানার মনে হলো, তাদের কপালে বড় হরফে লেখা রয়েছে: আমরা পুলিশ!

সাধারণ পোশাকের গোয়েন্দা। ব্যবহার করছে হাই-স্পিড ইন্টারসেপ্টর সুবারু। একই সুবিধা আছে সিত্রোঁ গাড়িতে। লোকগুলোর পরনে জিন্সের প্যান্ট ও হালকা সামার জ্যাকেট। অস্ত্র আছে বলে ফুলে গেছে বুকের একপাশ। সবার চেহারা গম্ভীর। সিগারেট টানতে, আলাপ করতে বা পথের পাশে প্রস্রাব করতে নামেনি। সরাসরি এল ট্রেনের দিকে। রেলগাড়ি থেকে নেমেছে টিটি। এগিয়ে গেল তাদের দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর তাকে নিজেদের ব্যাজ দেখাল সাদা পোশাকের ছয় পুলিশ। শুরু হলো আলাপ। মাঝে মাঝে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে ট্রেন।

রানা বুঝে গেল, জরুরি ভিত্তিতে রেডিয়ো করে থামতে বলা হয়েছে ট্রেনটাকে। কারণটা ভাল করেই জানে ও। কাউন্টারে ট্রে রেখে ফিরে চলল নিজের সিটের দিকে। আরও বাড়ল হাঁটার গতি। বসে থেকে চারপাশে তাকাচ্ছে যাত্রীরা। . বুঝতে চাইছে হঠাৎ কেন থামল ট্রেন। জানালা দিয়ে রানা দেখল, তিন দলে ভাগ হলো পুলিশের লোকগুলো। একদল চলেছে ট্রেনের মাঝের দিকে। দ্বিতীয় দল ছুটে গেল পেছন দিকে। তৃতীয় দল আসছে সামনের অংশ সার্চ করতে। ফিসফিস আওয়াজে খুলল ট্রেনের প্রতিটি দরজা। তৃতীয় বগি পেরিয়ে ওদের বগিতে পা রাখল রানা। এইমাত্র পেছনের বগিতে উঠেছে পুলিশের তৃতীয় দলের দু’জন। সামনে থেকে সার্চ করতে করতে আসবে তারা। ওদিকে পেছন ও মাঝের বগি তল্লাসী করবে অন্য চারজন। চট্ করে সরে যেতে না পারলে আটকা পড়বে রানা ও এলিস বেলা।

‘নামতে হবে,’ নিজেদের সিটের কাছে পৌঁছে বলল রানা। এরই ভেতর উঠে দাঁড়িয়েছে বেলা। বুঝে গেছে অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে। ‘সঙ্গী জুটে গেছে।’ সিটের ওপরের র‍্যাক ও নিচ থেকে ব্যাগ ও হোল্ডঅল নিয়ে কাঁধে তুলল রানা।

‘জানল কী করে….’ বিড়বিড় করল বেলা।

‘ওটা নিয়ে পরে ভাবব,’ বলল রানা। ভাবছে এবার কী করবে। ট্রেন থেকে নামার পর কী? সামনে দুই পুলিশ। পেছনে চারজন। এগিয়ে যাওয়াই ভাল। ভারী দুই ব্যাগ নিয়ে বুফে কারের দিকে চলল রানা। দুই বগির মাঝে কানেকটিং ডোর। খুলে গেছে একপাশে বামে বেরোবার দরজা। একই সময়ে একটু দূরের বগিতে দুই পুলিশকে দেখল রানা। তৃতীয় বগির মাঝে পৌঁছে গেছে তারা। কয়েক গজ পেরোলেই কাঁচের কানেকটিং ডোর। রানার চোখে চোখ পড়তেই তিক্ত হলো লোক দু’জনের চেহারা। চিনেছে ভাল করেই। ঝট করে রেডিয়ো বের করল সামনের লোকটা। গতি বেড়েছে হাঁটার। সতর্ক হয়ে উঠেছে আশপাশের যাত্রীরা। যেন বুঝতে পেরেছে, যে-কোনও সময়ে শুরু হবে গোলাগুলি।

ট্রেন থেকে বেরোবার দরজার দিকে বেলাকে ঠেলল রানা। সমতল প্ল্যাটফর্মে খোলে দরজা, তবে এখন ওটা মাটি থেকে আড়াই ফুট ওপরে। লাফিয়ে পাথুরে জমিতে নামল বেলা। ব্যাগদুটো ওর পাশে ফেলল রানা। নিজেও নেমে এল নিচে। ব্যাগ ও হোল্ডঅল তুলে নিয়ে ট্রেনের পাশ দিয়ে ছুট দিল সামনের দিকে। কিন্তু কোথাও লুকাতে পারবে না। আটকা পড়েছে ওরা খোলা জায়গায়। পায়ের নিচে পাথরের এবড়োখেবড়ো সব খণ্ড। ব্যারিয়ারের ওপারে অন্তত একহাজার গজ চারণভূমি। তার মাঝ দিয়ে গেছে রাস্তা। জায়গাটা পেরোলে জমি উঠেছে পাইনের সবুজ জঙ্গলে। বহু দূরে পাহাড়।

না, কাভার নেয়ার মত কোনও জায়গা নেই।

ওদের পেছনে ট্রেন থেকে নামল দুই পুলিশ। উড়ে আসছে রানাকে ধরতে। সামনের জন মুখের কাছে তুলল রেডিয়ো সেট। কয়েক সেকেণ্ড পর ত্রিশ গজ পেছনে ট্রেনের দরজায় দেখা দিল দলের আরও দু’জন। অস্ত্র হাতে লাফিয়ে নামল। ছুটে গেল কালো সিত্রোর দিকে। মাত্র কয়েক মুহূর্ত পর চেপে বসল গাড়িতে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। ট্রেনকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে এল সিত্রোঁ। একই সময়ে ট্রেনের পেছনের বগি থেকে নেমেছে তৃতীয় দলের দুই পুলিশ। ছুটে গিয়ে উঠল নীল সুবারুতে। ঘড়ঘড়ে আওয়াজে চালু হলো গাড়ির ইঞ্জিন। চরকির মত ঘুরল চার চাকা। ছুটন্ত দুই পুলিশকে পাশ কাটাল কালো সিত্রোঁ। কয়েক সেকেণ্ড পর কড়া ব্রেক কষে আড়াআড়িভাবে আটকে দিল পথ। গাড়িটা আছে রানা ও বেলার মাত্র কয়েক গজ দূরে ব্যারিয়ারের ওদিকে।

থমকে গেল রানা। বুঝে গেছে, পালাতে পারবে না। তার ওপর বইছে ভারী ব্যাগ ও হোল্ডঅল। পেছনে ছুটে আসছে দুই পুলিশ। ঘুরে পেছনে তাকাল রানা। ব্যাগ ও হোল্ডঅল নামিয়ে টান দিয়ে খুলল অস্ত্রের ব্যাগের চেইন। বের করে নিল ফ্যামাস রাইফেল। চাপা স্বরে বেলাকে বলল, ‘পেছনে থাকো। ভঙ্গি করবে তুমি আসলে জিম্মি।’

‘রানা, কাউকে গুলি কোরো না,’ জরুরি সুরে বলল বেলা। ‘তুমি তো আর অপরাধী নও।’

বেলাকে দেখল রানা। জবাব দেয়ার সময় নেই। তিন গুলির সিলেকটর সুইচ টিপল। খুলে গেল সিত্রোঁ গাড়ির সামনের দুই দরজা। অস্ত্র হাতে বেরোল দুই পুলিশ। ছুটে এসে থামল পনেরো গজ দূরে। দু’পা বাঁকা করেছে ক্লাসিক কমব্যাট শুটিং ভঙ্গিতে। উঁচু করল পিস্তল। হয়তো অভিজ্ঞতা আছে মুখোমুখি গান ফাইটের। আবার তা না-ও হতে পারে। তবে তাদেরকে দেখে কাঁচা মনে হলো না রানার। ট্রিগারের ওপর আঙুল। মাঘলের ওপর দিয়ে চেয়ে আছে ওর বুকের দিকে।

‘খবরদার! হাত থেকে অস্ত্র ফেলো!’ চিৎকার করে উঠল, বামের পুলিশ।

কর্কশ শব্দে সিত্রোর পেছনে থামল সুবারু। গাড়ি থেকে নেমে দরজার পেছনে রয়ে গেল পঞ্চম ও ষষ্ঠ অফিসার। অস্ত্র তাক করল রানার বুকে।

কাভার নেই এমন একজনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ছয়জন।

রানার বুক-পিঠের দিকে চেয়ে আছে ছয়টা পিস্তল।

পালাবার পথ নেই।

কিন্তু বন্দি হলেও চলবে না। আহত করতে পারবে না কাউকে।

চৌত্রিশ

রানার প্রতিটি সেকেণ্ড এখন ভাগ হয়েছে হাজার টুকরোয়। হিসাব কষছে। বুঝতে চাইছে পরিস্থিতি। অ্যানালাইয করছে। মন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। নেই বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা বা ভয়।

উত্তেজনার চোরা স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছে ছয় অফিসার। চোখ বিস্ফারিত। ফ্যাকাসে মুখ। সম্ভবত জীবনে প্রথম নেমেছে মানুষ শিকারে।

রানা বুঝল, এখনই সময় কাজে নামার। কয়েক ডিগ্রি বামে সরল ফ্যামাস রাইফেলের মাযল। প্রথম ও দ্বিতীয় পুলিশের পায়ের কাছে বিধল তিনটে গুলি। ভীষণ ভয়ে কাভারের জন্যে পেছাল তারা। ডানেরজন হাঁটু গেড়ে বসল মাটিতে, পরক্ষণে গড়িয়ে গেল ট্রেনের নিচে। অন্যজন নুড়িপাথরের ভেতর চেপে ধরল মুখ।

না থেমে ডানে সরেছে ফ্যামাস রাইফেলের মাযল। ট্রিগার স্পর্শ করতেই বেরোল তিনটে গুলি। বিস্ফোরিত হলো সিত্রোঁর উইণ্ডশিল্ড ও আয়না। ছুটে গাড়ির পেছনে আশ্রয় নিল তৃতীয় ও চতুর্থ পুলিশ। মুহূর্তে সিলেক্টর সুইচ অটোমেটিকে নিল রানা। তর্জনী চেপে বসল ট্রিগারে। বিকট শব্দে ছিটকে বেরোল তামার জ্যাকেট পরা একরাশ বুলেট। পাতলা কাগজের মত ছিঁড়ল সিত্রোঁর ধাতব দেহ। চারদিকে ছিটকে গেল উইণ্ডশিল্ডের টুকরো, প্লাস্টিকের রেডিয়েটর গ্রিল ও ভাঙা হেডলাইট। পেছনের বাম চাকা ফুটো হতেই ঠিশ্ করে ডাক ছাড়ল গাড়িটা। পরক্ষণে বসে পড়ল ডানদিক।

খালি হওয়ায় লক হলো ফ্যামাস রাইফেলের বোল্ট। খোলা ব্রিচ থেকে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। গাড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়েছে দুই পুলিশ, এতই ভীত যে গুলি ছুঁড়ছে না। রাইফেল থেকে পঁচিশ রাউণ্ডের শূন্য ম্যাগাযিন ফেলে হোল্ডঅল থেকে আরেকটা ম্যাগাযিন লোড করতে রানার লাগল বড়জোর আড়াই সেকেণ্ড। তালু দিয়ে ঠিক জায়গায় বসাল বোল্ট। তাতে লাগল এক সেকেণ্ড। সিত্রোর বামদিক ও পেছনে বিধল আরেক পশলা গুলি। মাটি খুবলে নিতে শুরু করে বুলেটের সারি গেল পঞ্চম ও ষষ্ঠ পুলিশের দিকে। আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়েছে তাদের। বুঝে গেছে, এবার মরবে নির্ঘাত। সরে গেল সুবারুর আড়াল থেকে।

‘অস্ত্র মাটিতে,’ গম্ভীর কণ্ঠে নির্দেশ দিল রানা।

মাত্র আধ-সেকেণ্ডে কাটল দুই পুলিশের মনের দ্বিধা। প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ থামতেই ছয়টা পিস্তল মাটিতে পড়ার শব্দটা ভোঁতা ঠেকল রানার কানে। বামে-ডানে নব্বুই ডিগ্রি মাঘল ঘোরাচ্ছে ও। ‘বেরিয়ে এসো সবাই। যেন চোখের সামনে দেখতে পাই।’

হামাগুড়ি দিয়ে ট্রেনের তলা থেকে বেরোল এক অফিসার। পাথরে মুখ থুবড়ে থাকা লোকটা হাঁটু গেড়ে বসল। সিত্রোর পেছন থেকে এল দুই অফিসার, হাতদুটো মাথার ওপর। ভীত চোখে দেখছে রানাকে। যে দু’জন সরে গিয়েছিল সুবারু থেকে, আবারও ফিরল রাস্তার দিকে।

বিস্ফারিত চোখে রানাকে দেখছে এলিস। ভাবছে, আগে দেখিনি বাঙালি গুপ্তচরের এই ভয়ঙ্কর রূপ!

প্রচণ্ড গোলাগুলি দেখে হৈ-চৈ করছে ট্রেনের যাত্রীরা।

ছয় অফিসারকে ট্রেনের পাশে দাঁড় করাল রানা। রাইফেল তাক করে রেখে কুড়িয়ে নিল ছয় পিস্তল। পাঁচটা ভোঁতা চেহারার গ্লক হলেও অন্যটা ওয়ালথার পিপিকে। জীবনের প্রথম ট্রেনিঙের সময় পছন্দ হয়েছিল অস্ত্রটা। পিস্তলগুলো চলে গেল রানার ব্যাগের ভেতর। পুলিশ অফিসারদেরকে বলল ও, ফোন ও রেডিয়ো রাখো পায়ের কাছে। এরপর প্যান্ট খুলে হাঁটু গেড়ে বসো।’

খেপে গেলেও তর্ক জুড়ল না ছয় অফিসার। মাটিতে নামাল রেডিয়ো ও ফোন। এরপর বেল্ট খুলে খসিয়ে দিল প্যান্ট। দেখা গেল রঙিন বক্সার শর্টস্। গোড়ালির কাছে ঢলঢল করছে প্যান্ট। তিক্ত মুখে একে একে হাঁটু মুড়ে বসল পাথুরে মাটিতে। রাগান্বিত, অপমানিত।

বেলার দিকে রাইফেলের মাযল ঘোরাল রানা। জিম্মিকে এভাবেই হুমকি দেয়া হয়। কড়া গলায় বলল, ‘সব তোলো আমার ব্যাগের ভেতর।’

মাথা দুলিয়ে কাজে নামল এলিস। মাটি থেকে তুলে ব্যাগে ভরল অফিসারদের মোবাইল ফোন ও রেডিয়ো।

‘এবার ওঠো গাড়িতে, ‘বেলাকে নীল সুবারু দেখাল রানা।

তড়িঘড়ি গিয়ে গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে উঠল মেয়েটা। পুলিশ অফিসারদের দিকে রাইফেলের নল রেখে হোল্ডঅল ও ব্যাগ তুলল রানা। পিছিয়ে গিয়ে গাড়ির রিয়ার সিটে রাখল সব। ওটার ওপর চাপিয়ে দিল রাইফেল। বেল্ট থেকে টান দিয়ে বের করল ড্যামিকো কর্সিনির বেরেটা। ছয় পুলিশের দিকে মাযল তাক করে চলে গেল গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দিকে। সামনেই গুলিতে চুরমার সিত্রোঁ, যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ট্যাঙ্ক। ধুলোয় ধূসরিত সুবারু সম্পূর্ণ অক্ষত। এটাই চেয়েছে রানা। বেলার পাশের সিটে চেপে দরজা বন্ধ করল ও। জানালা দিয়ে টা-টা দেখিয়ে মুচড়ে দিল ইগনিশনের চাবি। কর্কশ আওয়াজে স্টার্ট হলো শক্তিশালী ইঞ্জিন। কালো সিত্রোঁকে পাশ কাটিয়ে অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে দিল রানা। চরকির মত বনবন করে ঘুরল চার চাকা। মাটিতে তৈরি হলো গর্ত। গর্জন ছেড়ে ছিটকে এগোল সুবারু। সিটে সেঁটে গেল ওদের পিঠ। পাশে রেল ট্র্যাক রেখে ছুটে চলেছে দ্রুতগামী গাড়ি। মাত্র একমিনিট পর বাঁক নিয়ে বহু দূরে সরে এল।

দারুণ গাড়ি এই পুলিশ ইন্টারসেপ্টর। খুবই ভাল সাসপেনশন। সাড়া দিচ্ছে ইঙ্গিত পেলেই। হালকা স্পর্শে সরছে স্টিয়ারিং। জোরে বাঁক নিলেও চাকা সেঁটে আছে রাস্তায়। গাড়িটা কাউকে পাশ কাটালে সে চমকে যাবে আবছা নীল ঝিলিক দেখে। গাড়ির ভেতর ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলছে টার্বো চার্জড ইঞ্জিন।

কিন্তু ইঞ্জিনের গর্জনের চেয়েও বেশি জোরে ধুপধুপ আওয়াজ তুলছে মাথার ওপরে হেলিকপ্টারের রোটর!

জানালা দিয়ে ওপরে তাকাল রানা। একটু আগেও চারপাশ ছিল নির্জন। এখন আকাশ থেকে নেমে আসছে যান্ত্রিক ফড়িঙ। ফিউযেলাজে বড় অক্ষরে লেখা: জামিরি।

‘ধুৎ!’ বিড়বিড় করল এলিস বেলা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *