অপশক্তি – ২৫

পঁচিশ

‘কোথায় নিচ্ছ আমাকে?’ জানতে চাইল মেয়েটা।

‘এখনও জানি না,’ বলল রানা। জরুরি আরও কিছু বিষয়ে জবাব দেবে, সিলভিয়া। নাকি নামটা অ্যালাইস বেলাইত? এখনও সময় আছে আসল নাম বলার।’

‘আগেই বলেছি, সিলভিয়া রথচাইল্ড নই, অ্যালাইস বেলাইত। তবে ডাকতে পারো এলিস বা বেলা বলে।’

‘তোমার বন্ধু ব্যানওয়ার্টের ব্যাপারে বলো। ওটা কি তার আসল নাম?’

মাথা দোলাল এলিস বেলা। ‘পুলিশের ফাইল অনুযায়ী তার নাম ওটাই। বাজে রেকর্ড। খুন, ধর্ষণ ও ডাকাতির জন্যে খোঁজা হচ্ছে তাকে।’

‘তার মানে ডিজিএসআই-এর গল্প আঁকড়ে রাখতে চাও?’

‘অবশ্যই। মিথ্যা তো বলছি না।’

‘ঠিক আছে, এবার ব্যানওয়ার্টের রেকর্ড সম্পর্কে কিছু বলো,’ বলল রানা। আগে মিলিটারিতে ছিল? অভিজ্ঞতা আছে বোমা বসানোয়?’

‘না, সাধারণ অপরাধী,’ বলল এলিস বেলা। ‘খুব নীচ

মনের লোক। রবার্তো মোরাণ্ডি বা মার্কো মেযাসালমার মতই নিষ্ঠুর ইউরোপিয়ান টেরোরিস্ট। ক’বছর আগে যোগ দেয় ডেইটার গিসেলের দলে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা: বেশ কয়েকটা কিডন্যাপিঙের সঙ্গে জড়িত সে। জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে। নিজের দলের লোকদের সম্পর্কে চোখ বুজে থাকে ডেইটার গিসেল। তবে দরকার হলে দেরি করে না খাটিয়ে নিতে।’

‘কী ধরনের কাজ দেয়?’

‘বিশাল কোনও পরিকল্পনা আছে তার।’

‘গ্র্যাণ্ড স্কেলে চুরি বা ডাকাতির প্ল্যান?’ জানতে চাইল রানা।

‘আরও বড় কিছু। তবে দলের ওপরমহলে ঢুকতে পারিনি। কাজেই জানি না তেমন কিছু।’

একেবারে কিছুই জানো না?’

‘সর্বক্ষণ মুখ সামলে রাখে ওরা।’

‘অর্থাৎ, প্রায় ব্যর্থ হয়েছে তোমার অ্যাসাইনমেণ্ট,’ বলল রানা।

তিক্ত হাসল মেয়েটা। ‘তা হয়তো বলা যায় না। কোনও ধরনের ব্যাকআপ বা কন্ট্যাক্ট ছাড়াই তাদের দলে ছিলাম পুরো এক শ’ চব্বিশ দিন। কাজটা সহজ ছিল না। ব্যাপারটা ছিল প্রেশার কুকারে বাস করার মত। প্রতিদিন মনে হতো, এই বুঝি গাড়িতে তুলে নিয়ে যাবে নির্জন কোথাও। বাধ্য করবে নিজের কবর খুঁড়তে। তারপর কাজ শেষে মগজে গেঁথে দেবে বুলেট। পুরো দু’মাস পর হার্ভার্ট জানাল সে ব্রিটিশ সিক্রেট এজেন্ট।’

‘মস্তবড় ঝুঁকি নিয়েছিল,’ বলল রানা।

‘জানত আমি কে,’ বলল এলিস বেলা। ‘এমন কী জানা ছিল আমার নাম। ভুলটা আমারই ডিপার্টমেন্টের কোনও গাধার। হার্ভার্ট ভেবেছিল, একই দলে দু’জন মিলে কাজ করলে সহজ হবে ইনফরমেশন জোগাড় করা। প্রথমে তাকে বিশ্বাস করিনি। ভাবতে থাকি, যেভাবেই হোক আমার সম্পর্কে সব জেনে গেছে ওরা। ঠিক করি, প্রথম সুযোগেই আস্তানা ছেড়ে পালিয়ে যাব। কিন্তু এল না তেমন সুযোগ। পেরোল একটা সপ্তাহ। বিপদ হলো না। তখন হার্ভার্টকে বিশ্বাস করলাম। এরপর থেকে সুযোগ বুঝে যোগাযোগ করেছি। তবে ভীষণ সতর্ক থাকতে হয়েছে আমাদের দু’জনকে।’

‘দেখা যাচ্ছে যথেষ্ট সতর্ক ছিল না হার্ভার্ট,’ বলল রানা।

ঠোঁটে ঠোঁট চাপল মেয়েটা। ‘কী করে ওকে চিনল ডেইটার, জানা নেই। হয়তো সন্দেহ করেছে হামলার সময়। হার্ভার্ট হয়তো সরাসরি বলেছে, খুন করবে না কাউকে। অথবা, আগেই ডেইটার জেনেছে ও আসলে কে। তাই নিয়েছে খুনিদের টিমে। যাতে খুন করতে পারে।’

‘তোমাকে কেন এসবে জড়াল এজেন্সি?’ জানতে চাইল রানা। ‘এমন নয় যে ডেইটারের ওয়েবসাইটে অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম ছিল, আর সেটা পূরণ করতেই পেয়ে গেলে চাকরি।’

‘ওর চারপাশে আছে নানান ধরনের ফ্যানাটিক আর বদ্ধ উন্মাদ। এজেন্সি তৈরি করে সিলভিয়া রথচাইল্ড নামের এক চরিত্র। সে ইকো টেরোরিযম ও অ্যানিমেল রাইট্স বিষয়ে এক্সপার্ট। কয়েক মাস আগে বোমা ফাটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে এক প্রো-ভিভিসেকশনিস্টের গাড়ি। এ ছাড়া, আগুন দিয়েছে কয়েকটি ফাস্ট ফুডের রেস্টুরেন্ট ও এনিমেল ফার ফার্মে। দরজা ভেঙে ঢুকেছিল এক এনিমেল রিসার্চ ল্যাবে। আগুন ধরিয়ে দেয় ওখানে। এ ধরনের আরও কিছু অভিযোগ আছে তার নামে। ডিজিএসআই সুযোগ বুঝে জোসেফ ক্লার্ক নামের এক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার। হঠাৎ করেই সাক্ষাৎ হয় দু’জনের। ক্লার্ক ছিল পরিবেশবাদী এক ব্যাঙ্ক ডাকাত। কী কাজে যেন তাকে ডেকেছিল ডেইটার গিসেল। তখন জুটে যাই আমি। প্রথমবারের মত পরিচয় হয় গিসেলের সঙ্গে। অবাক হলাম তার চমৎকার আচরণে। বিনীত মানুষ। নানা ব্যাপারে একগাদা প্রশ্ন করল আমাকে। কী ধরনের অভিজ্ঞতা আছে, আমার ফিলোসফি কী, কীভাবে দেখি এই পৃথিবী, কীভাবে ওটাকে বদলে দিতে চাই— এসব। প্রতিটি প্রশ্নের জবাব ভেবেচিন্তে দিয়েছি। কথা শেষ হওয়ার পর বলল, আমি ইচ্ছে করলে যোগ দিতে পারি বিশেষ একটা সংগঠনে। তারা ভাবছে একদম বদলে দেবে এই পৃথিবী। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, সেটা কী করে সম্ভব হবে? জবাবে শুধু হাসল। এরপর তার দলের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বলা চলে, বোঝার আগেই আমি হয়ে গেলাম তাদের একজন। এরপর থেকে কোথায় আছি, সেটাও জানে না ডিজিএসআই।’

‘তাদের রেইডার থেকে হারিয়ে গেলে? খোঁজ নিল না তারা?’

‘নিশ্চয়ই খুঁজেছে। নিজে যোগাযোগ করতে পারিনি। সুযোগ ছিল না শরীরে জিপিএস চিপ লুকিয়ে রাখার। ফোন ট্র্যাকিং দূরের কথা। দলের কাউকে পুরনো ফোন রাখতে দেয় না ডেইটার গিসেল। নিজেই সরবরাহ করে দামি সেট। আগেই দেয়া থাকে নম্বর। ভাবতেও পারবে না, আজ কত কষ্ট করে বেরিয়ে এসেছি আস্তানা থেকে। যে-কোনও সময়ে ধরা পড়তাম। সেক্ষেত্রে হয়তো মরতে হতো।’

পকেট থেকে ফোন বের করে এলিস বেলার দিকে বাড়িয়ে দিল রানা। ‘হার্ভার্টের ফোন। প্রতিটি নম্বরে কল করেছি। জবাব দিয়েছ শুধু তুমি।’

‘প্রতিটি নম্বর দলের সদস্যদের।

‘সেক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সহজেই ট্রেস করতে পারবে।’

‘ট্রেস করেই বা কী হবে? গোস্ট নম্বর। কোনও কন্ট্যাক্ট, রেজিস্ট্রেশন বা নাম নেই। নগদ টাকায় বেআইনিভাবে কেনা। যখন-তখন ইচ্ছে হলেই দলের অন্যদের ফোন নম্বর পাল্টে দেয় ডেইটার গিসেল।’

দু’জনের মাঝে সেন্টার কন্সোলে ফোন রাখল রানা। বুড়ো আঙুল তাক করল কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে। ‘ওখানে চিরকাল থাকবে না ব্যানওয়ার্টের লাশ। কারও না কারও কুকুর খুঁজে বের করবে ওটা। লাশ পেল, অথচ তুমি নেই, ভেস্তে যাবে তোমার কাভার। সন্দেহ করবে দলের সবাই। দলের সদস্য খুনের দায়ে তোমাকে খুঁজতে শুরু করবে গিসেল।’

কাঁধ ঝাঁকাল মেয়েটা। কবজির টেপের কারণে কষ্ট হচ্ছে নড়তে। ‘এখন আর ভেবে লাভ হবে না। হারিয়ে যাব পর্দার আড়ালে। একটা কথা মাথায় রেখো, ওরা আমার দলের কেউ নয়।’

‘তুমি আলাদা তা ধরে নেয়ার কোনও কারণ আছে?’ বলল রানা। ‘কথা ছিল তুমি আসবে একা। বদলে আনলে প্রিন্স চার্মিং ব্যানওয়ার্টকে। দু’জন মিলে খুঁজলে আমাকে। হাতে পিস্তল। সুযোগ পেলে খুন করতে, বা ধরে নিয়ে যেতে তোমাদের আস্তানায়। সুতরাং, তোমাকে বিশ্বাস করার একটা কারণও খুঁজে পাচ্ছি না।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা। ‘এবার ভেবে দেখো আমার দিক থেকে। ফোন দিয়ে বোকা বানিয়ে দিলে। অন্তর থেকে বিশ্বাস করতে চেয়েছি বেঁচে আছে হার্ভার্ট। উত্তেজিত ছিলাম। যথেষ্ট সতর্ক নই। সবার চোখ এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যখন বাড়ি ছেড়ে বেরোব, পড়ে গেলাম ব্যানওয়ার্টের সামনে। সে জানতে চাইল, এত রাতে কোথায় চলেছি। কী জবাব দেব, বলো তো? আমাকে সন্দেহ করবে, তা হতে দিতে পারি না। কাজেই জানালাম ফোন করেছে হার্ভার্ট। ব্যানওয়ার্ট ধরে নিল, আমাকে ফাঁদে ফেলেছে কেউ। সঙ্গে অস্ত্র নিল। আমিও নিলাম। মনে ভীষণ ভয়, ডেইটার গিসেলের কাছে রিপোর্ট করবে লোকটা। তবে সেটা আর করল না। বোধহয় নিজেই ঝামেলা চুকিয়ে দিয়ে চেয়েছে প্রশংসা পেতে। আমাকে বলল, আমি যেন ড্রাইভ করি ওর পিকআপ।’

‘শুনে মনে হচ্ছে সুখের নীড়ে লিভ টুগেদার করতে, খোঁচা দিল রানা।

ঝট্ করে ঘুরে তাকাল মেয়েটা। ‘বাজে কথা বলবে না!’ চোখ ফেরাল রাস্তায়। ‘ওটা সুখের নীড় নয়। ওখানে দলের ক’জনকে রাখে গিসেল। জায়গাটা মেসের মত।’

‘নিজে তোমাদের সঙ্গে থাকে না গিসেল?’

‘অনিয়মিতভাবে আসে যায়। কখনও থাকে কয়েক ঘণ্টা, মিটিং করে। তারপর ফেরে গোপন কোথাও। কেউ জানে না জায়গাটা কোথায়।’

‘পিকনিক স্পটে আসতে তোমাদের দু’জনের লেগেছে তিন ঘণ্টারও বেশি। তো আজ কোথা থেকে এলে?’

‘সুইট্যারল্যাণ্ড। ছোট শহর লোসান থেকে। ওখানে আছে গিসেলের সেফ হাউস। সে ওটার মালিক না ভাড়াটে, জানি না। এটা জেনেছি, যখন-তখন অন্য কোথাও চলে যায়। টাকার অভাব নেই। যে কাজেই ব্যস্ত থাকুক, সেজন্যে লাখ লাখ ডলার খরচ করতে দ্বিধা নেই তার। ভীষণ সন্দেহপ্রবণ। এমন কী কাছের সহযোগীদেরকেও বিশ্বাস করে না। তাকে ঘিরে রাখে এ টিম। সেটাতে আছে সে নিজে ডেইযি বাট্স্ আর বাছাই করা অল্প ক’জন। এরপর আছে বি টিম। ওটার সদস্যরা ঘনিষ্ঠ হলেও, মাঝে থাকে একটা দূরত্ব। তারপর আছে সি টিম। ওটাকে বলতে পারো বৃত্তের বাইরের অংশ। চার মাসে আমি সি টিম থেকে বি টিম পর্যন্ত পৌঁছুতে পারিনি। বি টিমে ছিল পল হার্ভার্ট। আমার চেয়ে বেশি দাম পেত। বি টিমের সদস্য বলেই হামলাকারী টিমে সুযোগ পেয়েছিল। ব্যানওয়ার্টও বি টিমের। আমার কাজ ছিল লজিস্টিক্স নিয়ে কাজ করা।

‘একটু খুলে বলো।’

‘রসদ সরবরাহ দেয়া ছিল আমার মত ক’জনের কাজ, বলল এলিস বেলা। লোসান থেকে এসেছি কনভয় নিয়ে। তিন গাড়িতে সব মিলে বারোজন। সবাই জড় হয় ফ্রাঙ্কো- সুইস সীমান্তে। ভেহিকেলগুলো ডেইটার গিসেলের। কালো রঙের রেঞ্জ রোভার। প্রতিটার ভেতর ছিল সাতটা করে সিট। একটা রেঞ্জ রোভার ড্রাইভ করেছি আমি। ঠিক জায়গায় যাওয়ার পর আমরা দেখলাম, আগেই ওখানে হাজির হয়েছে আরেক লোক। তার নাম পোল ল্যাণ্ডেনবার্জার। সে এনেছে আর্টিকুলেটেড ভলভো রিগ। কোথা থেকে এসেছিল জানি না। ওটার ভেতর ছিল একটা অ্যাটাক ভেহিকেল। বিয়ারক্যাট। আর্মার্ড ট্রাক। হেভিলি আর্মড্ ড্রাগ লর্ডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ‘যেগুলো ব্যবহার করে সোয়্যাট টিম। ওটার সামনের দিকে ছিল বিশেষ র‍্যাম। ভেঙে দিতে পারবে শক্তপোক্ত যে-কোনও দরজা।

‘ওটা কী তা ভাল করেই জানি,’ তিক্ত মনে বলল রানা। ‘আমরা জড় হওয়ার কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টারে করে এল ডেইটার গিসেল ও ডেইযি বাট্স্। জানি না কোথা থেকে।’

‘সব মিলে পনেরোজন,’ গুনে নিয়ে বলল রানা।

‘কাজে নামল জেন্স রোভার্স ও মাইকেল ব্রেসলিন। বিশেষ রেঞ্চ দিয়ে খুলে নিল হেলিকপ্টারের পাখা। এরপর ট্রেইলারের ভেতর তোলা হলো যান্ত্রিক পাখিটাকে। লরি নিয়ে আগের জায়গায় রয়ে গেল ল্যাণ্ডেনবার্জার। আমাদের কনভয়ের সঙ্গে যোগ দিল বিয়ারক্যাট ভেহিকেল। ওটা চালাচ্ছিল ডেইটার। আমরা চললাম ফ্রান্স সীমান্তের দিকে ফাঁকা ছিল পাহাড়ি সব রাস্তা। পুলিশের ঝামেলা হলো না। হার্ভার্ট বা আমি জানতাম না এরপর কী হবে। তবে এটা বুঝে গিয়েছিলাম, বড় ধরনের কিছু করবে তারা। বহু মাস ধরে সেজন্যে পরিকল্পনা করেছে ডেইটার। অনেকক্ষণ চলার পর পাহাড়ি রাস্তা থেকে নেমে দ্বিতীয় এক গন্তব্যে পৌছুলাম আমরা। ওখানে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ক্যাম্প করা হলো। বোধহয় নিজেদের ভেতর আলাপ করল এ টিমের সবাই। বিয়ারক্যাটের ধারে-কাছে ভিড়তে দেয়া হলো না সি টিমের কাউকে। বোধহয় ওয়েপন্স চেক করে নেয়ার পর শেষবারের মত তাদেরকে ব্রিফ করছিল ডেইটার।’

‘তারপর হামলা হলো ভোর সাড়ে চারটেয়, তাই না?’ জানতে চাইল রানা।

অবাক চোখে ওকে দেখল এলিস। ‘তুমি জানলে কী করে?’

‘ফরেনসিক পয়েন্টারের মাধ্যমে,’ বলল রানা, ‘এ ছাড়া ব্যবহার করতে হয়েছে যুক্তি। পাগল না হলে ওই সময়ে হামলা করবে বুদ্ধিমান যে-কোনও ট্যাকটিশিয়ান। দিনে হামলা করলে বিপদ হতো। সাধুদের কেউ না কেউ থাকত পাহাড়ে বা গবাদি পশুর মাঠে। এত বড় ঝুঁকি নেয়নি ডেইটার। একই জায়গায় সবাইকে পেল সে। ঘর ঘুরে ঘুরে খুন করতে হলো না। ভোরে প্রার্থনার জন্যে জড় হওয়ায় গির্জা ও উঠানেই ছিল বেশিরভাগ সাধু।’

‘খুব গম্ভীর ছিল ডেইটারের দলের সবাই,’ বলল বেলা। ‘টানটান পরিবেশ। তারপর চারটের একটু আগে বিয়ারক্যাট থেকে নামল চারজন অ্যাসল্ট ক্রু।’

‘নাম কী তাদের?’ জানতে চাইল রানা।

‘দলে সবমিলে আটজন। ডেইটার আর ডেইযি তো ছিলই, তাদের সঙ্গে যোগ দেয় হেলমুট হাইনরাইনার, পাওলো গুয়েডিনেটি আর এ টিমের দু’জন। এ ছাড়া কার্ল ব্যানওয়ার্ট… যাকে… সরিয়ে দিয়েছ। আরও ছিল মাইকেল ব্রেসলিন, জেন্স রোভার্স ও ব্রিটিশ এজেন্ট পল হার্ভার্ট।’

মনের খাতায় নামগুলো টুকে নিল রানা। ‘বাকি থাকলে তোমরা ছয়জন।’

মৃদু মাথা দোলাল মেয়েটা। ‘আমি, আমার জন্যে প্রেমকাতর স্টিভ র‍্যাঙলার আর খ্যাপাটে লোক রুপার্ট ওয়েনহেইম। এ ছাড়া ছিল বুনযি ম্যাককুলাক। চোখে ভারী চশমা। লড়াকু বলে মনে হয়নি। হয়তো বইয়ের পোকা। তাকে কেন দলে নেয়া হয়েছে, জানি না। দলে আরও ছিল আর্নেস্ট ব্রি আর ডাচম্যান ভ্যান রোবেন। অন্যরা কখন ফিরবে সেজন্যে বসে থাকা ছাড়া কোনও কাজ ছিল না আমাদের।’

‘তারপর ফিরল তারা চারঘণ্টা পর?’ বলল রানা।

বিস্ময় নিয়ে আবার একে দেখল মেয়েটা। ‘এ হিসাবও কি ফরেনসিক পয়েন্টার থেকে পেয়েছ?’

‘তিনটে কারণে জেনেছি তারা মনাস্ট্রিতে ছিল কয়েক ঘণ্টা,’ বলল রানা। ‘প্রথমত, যখন সাধুদের লাশ পাই, সেগুলো ছিল শীতল। কিন্তু দেখলাম হার্ভার্টের লাশ তখনও বেশ উষ্ণ। এ থেকে বুঝলাম, পরে খুন হয়েছে সে। দ্বিতীয়ত, মঠের নিচে প্রথম যে বোমা সেট করা হয়, আর পরে যে বোমা ফাটানো হয়েছে, দুটোর ভেতর ছিল কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান। শেষের বোমার কারণে আরেকটু হলে উড়ে যেতাম। সেট করা হয়েছিল আমি ওখানে যাওয়ার মাত্র একঘণ্টা আগে। তৃতীয়ত, ভারী জিনিস বয়ে নেয়ার জন্যে যথেষ্ট সময় নিতে হয় তাদেরকে।’

ঘাড় কাত করে ওকে দেখল মেয়েটা। অন্ধকারে চকচক করছে চোখ। ‘কী ভারী জিনিস?’ রানার কাছে জানতে চাইল।

‘আমার মতই তুমিও জানো ওগুলো কী,’ বলল রানা। ‘মনাস্ট্রির নিচে ছিল গুপ্তধন। হয়তো শত শত সোনার বার। কে জানে, টনকে টন। আর কোনও কারণে ওখানে হামলা করবে কেন?’

‘সোনার কথা কিছুই শুনিনি,’ বলল এলিস বেলা।

ছাব্বিশ

রাতের আঁধার চিরে তীর বেগে চলেছে হামার জিপ। ক্যাবের ভেতর গুড়গুড় শব্দ তুলছে হেভি-ডিউটি চাকা। এলিস বেলার কথা শুনে রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল রানা। বিস্মিত বোধ করছে। ‘কী বললে?’

‘প্রথমবারের মত শুনলাম সোনার বার-এর কথা,’ বলল মেয়েটা।

‘তা হলে অন্য কী কারণে ওখানে হামলা করে থাকতে পারে?’

‘তা জানি না।’

‘জানো না মানে? তুমি তো ওই দলেই ছিলে।’

‘বৃত্তের বাইরের দিকে ছিলাম।’

‘তোমার না দায়িত্ব ছিল ভেতরের খবর বের করা?’

‘আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তাতে তেমন কাজ হয়নি। বুঝতেই পারছ, নতুন সদস্য আমি, আমাকে বিশ্বাস করেনি ওরা।’

বিরক্তি বোধ করছে রানা। ‘নিশ্চয়ই এমন কিছু শুনেছ বা দেখেছ, যেটা কাজে আসবে?’

‘শুধু দেখেছি ক’টা সাদা কন্টেইনার,’ বলল এলিস বেলা।

‘কন্টেইনার?’

‘রেইড করে ফেরার পর অন্তত বিশ মিনিট বিয়ারক্যাটের দরজা খোলেনি তারা। তারপর বেরিয়ে এল ডেইটার গিসেল। চেহারায় ছিল ভয় ও দুশ্চিন্তার ছাপ। আগে কখনও তাকে ওরকম উত্তেজিত দেখিনি। ট্যাকটিকাল ড্রেস পাল্টে নিল। গা থেকে আসছিল করডাইটের কটু গন্ধ। শুটিং রেঞ্জ থেকে বেরোলে যেমন হয়। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে দেখতে পেয়েছি বিয়ারক্যাটের ভেতরের অংশ। ডিমের মত ছিল সাদা কন্টেইনার। দু’পাশে ছিল হ্যাণ্ডেল। ওটা ব্রিফকেস আর মিলিটারি অ্যামো ক্যানের মাঝামাঝি জিনিস। বোধহয় চকচকে প্লাস্টিক বা ফাইবারগ্লাস দিয়ে তৈরি। সবমিলিয়ে ছয়টা বা আটটা হবে। লোডিং বে-তে সাজিয়ে রাখা ছিল। বুঝতে পারিনি কীসের ওগুলো। হয়তো সত্যিই ভেতরে রয়েছে সোনা। কেউ একটা কথাও বলেনি ওগুলোর ব্যাপারে। শুধু শুনলাম, জরুরি কাজের জন্যে পেছনে রেখে আসা হয়েছে হার্ভার্টকে। সাহস হয়নি যে কিছু জিজ্ঞেস করব।’

চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে রানা।

‘আমার দায়িত্ব ছিল অপারেশনের পর সবার জিনিসপত্র পুড়িয়ে দেয়া, বলল এলিস বেলা। ‘সব ছিল বড় সব প্লাস্টিকের ব্যাগে। বোধহয় তাদের পোশাক। ভারী ও নরম লেগেছে হাতে। খস খস আওয়াজ তুলছিল। ওজন দেখে মনে হয়েছে, ব্যাগে ওদের বুটও রয়েছে। ক্যাম্প থেকে একটু দূরেই ছিল পাথুরে জমিতে বড় এক গর্ত। ব্যাগগুলো নিয়ে গিয়ে ওটার ভেতর ফেলে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিই।’

ব্যাগ নয়, ডিমের মত জিনিসগুলোর ভেতর কী, সেটাই ভাবছে রানা। ‘তুমি শিয়োর, কন্টেইনারের ভেতর কী, সেটা নিয়ে একবারও আলাপ করেনি ওরা?’

‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর। হার্ভার্টের সঙ্গে পরে যোগাযোগ করতে পারিনি। নইলে হয়তো কিছু জানতাম। একটু আগে জানলাম, বাকি জীবন অপেক্ষা করলেও কিছুই বলতে পারবে না সে। ডেইটার গিসেলের বেশ কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। ভাব করত অন্ধের মত অনুসরণ করে দলনেতাকে। অবশ্য অন্যরাও তাই করে। সবাই পীরের মত মানে তাকে। লোকটা ঘোরের ভেতর নিয়ে গেছে ওদেরকে।’

‘ঠিক আছে। হামলা থেকে ফেরার পর কী হলো?’

‘আলাদা হয়ে গেল কনভয়ের ভেহিকেলগুলো। দুই রেঞ্জ রোভারে চেপে বসলাম আমরা নয়জন। গাড়ি চলল লোসানের দিকে। আমার দায়িত্ব ছিল ড্রাইভ করা। যখন টের পেলাম যে আমাদের সঙ্গে হার্ভার্ট নেই, পড়ে গেলাম দুশ্চিন্তার ভেতর। কিন্তু কাউকে যে কিছু জিজ্ঞেস করব, সে উপায় নেই। আমার পাশের সিটেই ছিল হেলমুট হাইনরাইনার। বাধ্য হয়ে নিজেকে শান্ত রাখলাম। সে বদমেজাজি লোক। দেখলে মনে হয় পাকা খুনি। তৃতীয় রেঞ্জ রোভার নিয়ে চলে গেল মাইকেল ব্রেসলিন ও জেন্স রোভার্স। বিয়ারক্যাটে চেপেছে ডেইটার গিসেল ও ডেইযি বাট্স্। বোধহয় গেল রন্দেভু পয়েন্টে। ওদিকেই থাকার কথা ভলভো ট্রেইলার। বোধহয় ওটা থেকে হেলিকপ্টার নিয়ে নতুন করে রোটর লাগাবে মাইকেল ব্রেসলিন ও জেন্স রোভার্স। আর্টিকুলেটেড ট্রাকে ঢুকে পড়বে বিয়ারক্যাট। এরপর রেঞ্জ রোভার ও ট্রাক যাবে লোসানের দিকে। ওদিকে যেখান থেকে এসেছে, হেলিকপ্টারে চেপে ওখানে উড়ে যাবে ডেইটার ও ডেইযি।’

‘তাদের সঙ্গে থাকবে সাদা কন্টেইনার। ‘

‘আমারও তা-ই ধারণা।’

‘মাইকেল ব্রেসলিন ও জেন্স রোভার্স কি এক্সএয়ার ফোর্স?’

‘ব্রেসলিন আমেরিকান এয়ার ফোর্সে ছিল। তখন হয়তো এয়ারো মেকানিক্স শিখেছে। জেন্স রোভার্সের ব্যাপারে কিছু শুনিনি।’

‘একটু খুলে বলো হেলমুট হাইনরাইনার সম্পর্কে।’

‘আগে ছিল মার্সেনারি। পরে যোগ দেয় ডেইটার গিসেলের দলে। শুনেছি ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর খুনি।’

রানা ধারণা করল, দলের বোমা বিশেষজ্ঞ বোধহয় ওই লোকই। ‘কাজে কেমন?’

‘শুধু জানি সে খুনি। পারতপক্ষে কথা বলে না। মুখ বিকৃত হয়ে গেছে বুলেটের আঘাতে।’

‘সিগারেট খায়?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমি কখনও দেখিনি। হঠাৎ এ কথা বললে যে?’

‘ডেইটার গিসেল স্মোক করে?’

‘না। সেফ হাউসে কাউকে ধূমপান করতে দেয় না।’

‘তার মানে তাকে কখনও রাশান সিগারেট সবরেইনি ধরাতে দেখোনি।’

মাথা নাড়ল এলিস বেলা। ‘কখনও না।’

‘ঠিক আছে।’ বেশ কিছুক্ষণ নীরবে ড্রাইভ করল রানা। মনে গেঁথে নিচ্ছে প্রতিটি তথ্য। তবে পাচ্ছে না পরিষ্কার কোনও চিত্র। একটু পর বলল, ‘একটা কথা বুঝতে পারছি না। ডিজিএসআই কেন খোঁজ নিচ্ছে ডেইটার গিসেলের ব্যাপারে? তাদের কাজ তো মহাসাগরের বড় মাছ, মানে টেরোরিস্ট বা আন্তর্জাতিক অপরাধীদের চক্র গ্রেফতার করা। এমন কী মার্সেইর ড্রাগ সিণ্ডিকেটের ব্যাপারেও তাদের মাথা- ব্যথা নেই। ছোট ধরনের সব কাজ ছেড়ে দিয়েছে সাধারণ পুলিশের হাতে। তা হলে কী কারণে ডেইটার গিসেলের ব্যাপারে আগ্রহী হলো তারা?’

‘ডেইটার গিসেল নিজেও বড় মাছ,’ বলল মেয়েটা।

‘খুলে বলো কীভাবে এত বড় হলো।’

‘যতটুকু জেনেছি, তাতে সন্তুষ্ট করতে পারব না তোমাকে।’

‘সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।’

দ্বিধায় পড়ল এলিস বেলা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘শুরু করার আগে একটা কথা বলতে চাই। যাকে পেটের খবর জানাব, তার ব্যাপারে আগে জানতে চাই।’

‘আগেই বলেছি, আমি কে,’ বলল রানা। ‘সাধারণ একজন মানুষ। তবে অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াবার বাজে অভ্যেস আছে। সন্ন্যাসীদের মঠে বেশ কয়েক দিনের জন্যে আমি ছিলাম একজন অতিথি।’

‘সাধারণ অতিথি নও, সেটা বুঝেছি। কবে থেকে সাধারণ মানুষকে আশ্রমে আশ্রয় দিচ্ছে সাধুরা?’

‘অসুস্থ ছিলাম বলে সাহায্য করেছে।’

‘তুমি যে সাধারণ যিশু-ভক্ত নও, সেটা তো বুঝবে যে কেউ। তুমি চিনলে কী করে এদোমন্দ দে লা হৌকে?’

চুপ থাকল রানা। এলিস বেলা আপাতত ওর বন্দি, তবে মুখ কোথাও বন্ধক দিয়ে আসেনি। ওর কাছ থেকে নতুন তথ্য পেতে হলে আগে দিতে হবে দু’চারটা তথ্য। কয়েক মুহূর্ত পর বলল রানা, ‘একবার দেখা হয়েছিল এদোমন্দ দে লা হৌর সঙ্গে।’

‘সাধারণ সাক্ষাৎ মনে হচ্ছে না। তার ব্যাপারে অনেক কিছু জানো। যেটা স্বাভাবিক নয়।’

‘একইসঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলাম দু’জনে,’ বলল রানা। ‘বেশ কয়েক বছর আগের কথা।’

‘কী ধরনের ট্রেনিং?’

‘আজকে রাতে যা হলো, সেই ধরনেরই,’ বলল রানা। তিক্ত হাসল মেয়েটা। ‘তার মানে কমাণ্ডো ট্রেনিং। তা হলে কি ধরে নেব তুমি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ?’ কী যেন ভাবতে লাগল সে। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল। ‘না। তুমি পুলিশ নও। আগে ছিলে সেনাবাহিনীতে। ‘

‘মিলিটারি গাড়ি দেখে বোধহয় ভুল ভাবছ। এটা ধার নিয়েছি এক বন্ধুর কাছ থেকে।’

‘গাড়ি নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি তোমার কথা। তোমাকে সাধারণ সৈনিক বলে মনে হয় না। আগে বোধহয় ছিলে বড় কোনও মিলিটারি পদে।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘মিথ্যা বলে লাভ হবে না,’ বলল এলিস বেলা। ‘সত্যিকারের লড়াকু মানুষের গা থেকে মিলিটারির গন্ধ যায় না। যেভাবে হাঁটো, নড়াচড়া করো, বা যেভাবে কথা বলো, সবই বলে দিচ্ছে তুমি ছিলে কোনও সেনাবাহিনীতে। তোমার ইংরেজি উচ্চারণ নিখুঁত। আরেকটু হলে ধরে নিতাম ব্রিটিশ আর্মির লোক। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি ছিলে উপমহাদেশের কোনও দেশের সেনাবাহিনীতে। আমি কি ভুল বললাম?’

চুপচাপ ড্রাইভ করছে রানা। চোখ রাস্তার ওপর।

‘ছিলে অন্তত মেজর,’ বলল মেয়েটা। ‘চৌকশ অফিসার। যাকে হিংসে করত অন্যরা।’

‘না জেনে কিছু ধরে নেয়া ঠিক নয়, বলল রানা।

‘আমার কথাগুলো প্রশংসা হিসেবে ধরে নিতে পারো।’

‘অথবা অপমান হিসেবে,’ বিড়বিড় করল রানা।

‘কোন্ দেশের সেনাবাহিনীতে ছিলে? স্পেশাল ফোর্সে, এটা বাজি ধরতে পারি।’

‘তোমার ধারণা ভুলও হতে পারে।’

‘মোটেও না। রাতে হামলা করলে, আর তখনই সব বুঝে গেলাম। আমার ধারণা ছিল, আমি ভালভাবে ট্রেইণ্ড। কিন্তু পরে দেখলাম, তোমার তুলনায় আমি একেবারে শিশু। জানতাম না উপমহাদেশীয় সেনাবাহিনী কাউকে এত ভাল ট্রেনিং দেয়। আর তাই সন্দেহ হচ্ছে, তুমি প্রশিক্ষণ নিয়েছ ব্রিটিশ, জার্মান বা ফ্রেঞ্চ আর্মি থেকে। তবে বাজি ধরলে বলব, স্যাণ্ডহার্স্ট মিলিটারি অ্যাকাডেমির ক্যাডেট তুমি।’

মৃদু মাথা নাড়ল রানা। ‘তোমার নাম যা-ই হোক, এলিস বেলা, তুমি কিন্তু নিজ স্বার্থরক্ষার তুলনায় একটু বেশি বুদ্ধিমতী।’

‘হয়তো,’ অন্ধকারে হাসল মেয়েটা।

‘প্রসঙ্গ পাল্টাও, নইলে ছুঁড়ে ফেলে দেব গাড়ি থেকে, ‘ মৃদু হুমকি দিল রানা।

‘তা হলে আগে কেটে নিতে হবে হাত-পায়ের টেপ,’ বলল এলিস বেলা।

‘আরও সহজ পথ আছে,’ দূরে তাকাল রানা। ‘মুখ আটকে দেব আরেক টুকরো টেপ দিয়ে।’

কিছু বলতে গিয়েও থামল এলিস বেলা। গোঁ-গোঁ আওয়াজে সেন্টার কন্সোলে কাঁপছে মোবাইল ফোন। ঝট করে পরস্পরের দিকে তাকাল রানা ও বেলা।

‘ধরবে ফোন?’ জানতে চাইল মেয়েটা।

আরও দু’বার রিং হওয়ার পর ফোনটা তুলে রিপ্লাই বাটনে চাপ দিয়ে কানে ঠেকাল রানা। ওদিক থেকে আগে কথা বলুক, সেজন্যে অপেক্ষা করছে। অ্যাক্সেলারেটর থেকে সরিয়ে নিল পা। ক্যাবের ভেতর কমে গেল ইঞ্জিনের গর্জন।

‘আরেক একাকী নেকড়ের কাছে জানতে চাই: খবর কী?’ পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনল রানা। ‘হ্যালো, মাসুদ রানা!

পাশে বসা মেয়েটি একটু চমকে উঠল। দু’জনের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে পরিষ্কার।

সাতাশ

‘বহু দিন দেখা নেই, পুরনো বন্ধু,’ আন্তরিক স্বরে বলল কমিশনার অ্যাল মার্লো। ‘আমি ভেবেছি হারিয়েই গেছে পৃথিবীর বুক থেকে।’

‘জগতের সেই সৌভাগ্য এখনও হয়নি,’ বলল রানা। ‘আগের মতই কাজ করছ গভীর রাত পর্যন্ত?’

‘লোভী লোক, উন্নতি চাই চাকরিতে,’ হাসল মার্লো।

প্রতিদিন কাজের প্রচণ্ড চাপ নেয় মানুষটা। ইন্টারপোলের হেডকোয়ার্টারে টপ ফ্লোরে তার ডেস্কের ছবি ভাসল রানার মনে। ভদ্রলোকের চেয়ারের পেছনে ঝুলছে দামি সুট জ্যাকেট। গলায় ঢিলা টাই। ডানহাতের কাছে ধূমায়িত কালো, কড়া কফির মগ। এতই ঘন তরল যে, চামচ ডোবানোও কঠিন।

‘প্রথমে ভেবেছি ধাঁধার মত কিছু দিয়েছ ফ্যাক্স মেশিনে, ‘ বলল মার্লো। ‘পরে দেখি তার ভেতর কোনও শিল্প নেই। তখন ভাবতে শুরু করলাম কোথায় আছ তুমি।’

‘এই এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি,’ বলল রানা।

‘তা বুঝতে পেরেছি। আগের মতই জড়িয়ে গেছ কোনও ঝামেলায়।’

‘তা বলতে পার।’

‘জানতাম। তোমার জন্যে দুশ্চিন্তা হয়, রানা।’

‘শুনে ভাল লাগল,’ বলল রানা। টের পেয়েছে, সৎ মানুষটার কণ্ঠে সত্যিই দুশ্চিন্তার ছাপ।

‘ভাবছিলাম, এবার আবার কী ধরনের বিপদে ফেলবে আমাকে।’

‘বড় কিছু নয়।’

‘কথাটা বিশ্বাস করলাম না। তুমি একাই তো আস্ত এক আর্মি। চারপাশে থাকে ভাঙা গাড়ি আর লাশের মিছিল।’

‘একটু বাড়িয়ে বলছ।’

‘ভালই ছিলাম, জরুরি কাজ ছিল না। তারপর হঠাৎই এল তোমার পাঠানো কাগজ।’

‘হাতের ছাপ পরীক্ষা করেছ?’

‘হ্যাঁ, কঠিন ছিল না। তবে, প্রিয় বন্ধু, এবার আমার জানতে হবে, কোথা থেকে পেয়েছ ওই ছাপ।’

মিষ্টি কথা শেষ, সিরিয়াস হয়েছে মার্লো। জরুরি কোনও কারণে চিন্তিত। ‘ছাপটা পেয়েছি অচেনা একজনের কাছ থেকে,’ বলল রানা। ‘ডিটেইলসে এখুনি যাব না। তোমার কথায় এরই ভেতর মনে হচ্ছে, আঙুলের ছাপের মালিককে চিনেছ। তা হলে সে কে?’

‘সে কি বেঁচে আছে?’ জানতে চাইল মার্লো।

‘না।’

সেক্ষেত্রে বড় ধরনের বিপদে জড়িয়ে গেছ, রানা,’ বলল মার্লো।

‘লাশটা পেয়েছি গতকাল সকালে,’ বলল রানা। ‘বুঝতেই পারছ আমি তার খুনি নই।’

‘শুনে খুশি হলাম। বলতে পার লাশটা কোথায়?’

‘কোথাও নেই।’

‘মানে?’

‘পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছে। এবার আসল কথায় এসো, মার্লো। তুমি কি জান সে কে, বা কী করত?’

‘জানি সে কে বা কী তার নাম,’ বলল মার্লো। ‘অনেক খুঁজতে হয়েছে। প্রথমে গেছি ইন্টারপোলের ক্রিমিনাল ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে। কমপিউটার জানিয়ে দিল সে ওই দেশের নয়। বাড়াতে হলো সার্চ এরিয়া। যেহেতু অথোরাই ইউযার, ঘাঁটলাম ইউরোপের প্রতিটি পুলিশ ডেটাবেস। ক্রিমিনাল হিসেবে সেখানেও নেই সে। তখন ডুব দিলাম আরও গভীরে। তুমি তো বলছ মারা গেছে সে। সেক্ষেত্রে পুকুরে ইঁট মারলে যেমন ঢেউ ওঠে, তেমনই হবে আটলান্টিকের জলে। সাহায্য চাইলে সব খুলে বলো, রানা। বাদ দেবে না কিছু।’

দ্বিধায় পড়ল রানা। অ্যাল মার্লোকে খুলে বলা ঝুঁকিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে উঠবে এলিস বেলার কথা। মার্লো নীতিবান পুলিশ অফিসার। আপাতত তাকে তথ্য না দেয়াই হয়তো ভাল। এদিকে জরুরি তথ্য চাইলে উপায় নেই তার সাহায্য না নিয়ে।

ব্রেক কষে রাস্তার পাশে থামল রানা। কাত হয়ে দেখল এলিস বেলাকে। সতর্ক চোখে ওকে দেখছে মেয়েটা।

‘বেশি কিছু চাইনি তোমার কাছে,’ ফোনে বলল রানা। ‘মাত্র একটা নাম।’

‘ব্যাপারটা আরও জটিল,’ বলল মার্লো, ‘যার আঙুলের ছাপ পাঠালে, তার নাম রন হাওয়ার্ড। ইন্টেলিজেন্স অপারেটর। আমাদের না। যৌথ অপারেশনে কাজ করছিল ফ্রেঞ্চ এজেন্টদের সঙ্গে। যে বিষয়ে ব্যস্ত ছিল, সে বিষয়ে কিছু বলব না। এমন কী তোমার মত প্রিয় বন্ধুকেও নয়।’

এবার সিদ্ধান্ত নিল রানা। দেখাবে নিজের হাতের তাস। সহজ সুরে বলল ও, ‘জানি; ওটা ছিল জয়েন্ট অপারেশন। জড়িত ছিল ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স ও ডিজিএসআই। তারা চোখ রেখেছে ডেইটার গিসেল নামের এক সুইস লোকের ওপর।’

খুক করে কেশে উঠল মার্লো। চমকে গেছে রানার কথা শুনে। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘হায়, যিশু! তোমার তো এসব জানার কথা নয়!’

‘জানতেও চাইনি, তবে জানতে হয়েছে,’ বলল রানা। ‘পরে জড়িয়ে যেতে হয়েছে বাধ্য হয়ে।’

‘যত দ্রুত সম্ভব ঝামেলা থেকে সরে যাও, রানা। নইলে পড়বে মস্তবড় বিপদে। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কত গভীর কাদায় পা দিয়েছ।’

‘কাদায় ডুবে গেছি গলা পর্যন্ত।’

নীরব থাকল ফোনের ওদিক। অন্তত একমিনিট পর টেবিলে আরেকটা তাস ফেলল মার্লো। ‘প্রথমে মিথ্যা বলেছি, রানা। জানি তুমি কোথায় আছ। সত্যি হচ্ছে: তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখছি। তোমার ফোনে রয়ে গেছে ট্র্যাকার।’

‘জানতাম, এমনই কিছু থাকবে।’

দেয়ালে বিশাল ডিজিটাল ম্যাপে দেখছি ফ্রান্সের মানচিত্র। তার বুকে লাল চিহ্নের মত টিপটিপ করছ তুমি। গতকাল যে হত্যাকাণ্ড ঘটল শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভো মঠে, তার খুব কাছেই আছ। এটা তোমার জন্যে .মোটেই স্বাস্থ্যকর বলে মনে হচ্ছে না। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ব, যদি জানা যায় ওই ঘটনার সঙ্গে কোনওভাবে জড়িয়ে গেছ তুমি।’

‘গতকাল আমিই ফোন করেছি পুলিশে,’ বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে সোজা চলে এসো আমার অফিসে। মুখোমুখি বসে আলাপ করা যাক।

‘আপাতত তা সম্ভব নয়, মার্লো। জড়িয়ে গেছি জরুরি কাজে। আগে জানব আরও কিছু জানে কি না এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইত।’

আবছা আলোয় চোখ বড় বড় করে ওকে দেখছে মেয়েটা।

ফোনের ওপ্রান্তে সাড়া নেই। পুরো একমিনিট পর বলল কমিশনার মার্লো, ‘তুমি কি বললে, রানা?’

‘যা বলেছি, ভাল করেই শুনেছ, মার্লো। আরও পরিষ্কার করে বললে, নিজের ইচ্ছেয় আমার সঙ্গে ঘুরছে না সে।’

রানা ভাল করে জানে, আরও বেশি জড়িয়ে গেছে বিশাল জালে। এবার পরের চাল দেবে মার্লো।

‘মেয়েটা এখন কোথায়?’ হুমকির সুরে জানতে চাইল ইন্টারপোল কমিশনার।

‘আমার পাশেই,’ বলল রানা। ‘বিপদ হয়নি ওর। তবে মনে হয় না তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে।’

‘তোমাকে সাবধান করছি, রানা, তুমি কিন্তু আইনের

পথে বাধা হয়ে উঠছ। জান না এরই ভেতর কত গভীর কূপে তলিয়ে গেছ।’

‘আইন তুমি মেনে চলো, মার্লো,’ বলল রানা, ‘তবে আমি পা দিচ্ছি না ইন্টেলিজেন্সের গোবরে। শুধু জানতে চাই, কারা খুন করল আমার বন্ধুদেরকে। তোমরা অপরাধীদেরকে শাস্তি দিতে না পারলে সে দায়িত্ব নেব আমি।’

‘তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি, রানা,’ বলল মার্লো। ‘প্রথম সুযোগেই হাতে তুলে নেবে আইন। তবে তা হলে এবার কিন্তু পড়বে বিরাট বিপদে।’

‘জরুরি তথ্য না দিতে পারলে, পুরনো বন্ধুর জন্যে অন্তত এটুকু করো, বাধা হয়ে উঠো না আমার চলার পথে।’

‘তুমি ভাল করেই জান, আইনের বাইরে যাব না আমি। এবার তোমাকে ধরে আনতে পাঠাতে হবে পুলিশ ফোর্স।’

‘জানতাম কী বলবে। সেক্ষেত্রে ধরে নাও, আপাতত জিম্মি করা হয়েছে এজেন্ট অ্যালাইস বেলাইতকে।’

‘এত বড় বিপদে নিজেকে ঠেলে দিয়ো না, রানা। পালাতে পারবে না কোথাও। শেষে মরবে গুলি খেয়ে।’

‘তা হলে মরবে তুমিও,’ মনে মনে বলল রানা।

আলাপ করে লাভ নেই। ফোন রেখে দিল রানা। হামার গাড়ির ক্যাবে বদ্ধ পরিবেশ। গুড়গুড় আওয়াজ তুলছে ইঞ্জিন। এলিস বেলা নড়ে ওঠায় চড়-চড় করছে টানটান টেপ। বিস্মিত চোখে রানাকে দেখছে মেয়েটা। ক’মুহূর্ত পর বলল, ‘ভালই! আগে জানতাম না, জেনেবুঝে মৃত্যু ডেকে আনে কেউ!’

‘মনে হয় না মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছি,’ বলল রানা। ‘আগে যা বলেছ তা ঠিক, সেটা জেনে নিলাম কমিশনারের কাছ থেকে। সেজন্যে বড় কোনও ঝুঁকিও নিতে হয়নি।’

ও, তা হলে এটা ছোট ঝুঁকি? আমার তো মনে হচ্ছে তুমি আসলে বদ্ধ উন্মাদ!’

জবাব দিল না রানা। ভাবছে, নিশ্চয়ই এরই ভেতর হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছে অ্যাল মার্লোর অফিসে। ফোনের পর ফোন যাচ্ছে নানান অফিসে। এবার জড় হবে ট্রপস্। তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হবে রন হাওয়ার্ডের ফোনের খোঁজে। এমন কী দুর্গম অ্যালপাইন পর্বত এলাকায় দ্রুত হাজির হয়ে যাবে পুলিশ বাহিনী। দরকার হলে দিনের পর দিন ধাওয়া করবে ওকে। তবে তাদের চেয়েও দ্রুত কাজে নামবে আরেকদল পুলিশ। তারা আসবে আকাশপথে। ফ্রান্সের চারপাশে ছড়িয়ে আছে জণ্ডারমিরি ন্যাশনাল এয়ারবোর্ন ডিভিশন। তাদের হেলিকপ্টারের অভাব নেই। যেহেতু পর্বত থেকে মাঝে মাঝে উদ্ধার করতে হয় ক্লাইমার ও স্কিয়ারদেরকে, ব্রায়ানকন শহরের কাছেই থাকবে তাদের হেলিবেস।

পঞ্চাশের দশকে যুদ্ধের সময় ইন্দোচায়নায় ছিল জিএন চপার স্কোয়াড্রন। সেসব পাইলটের উত্তরপুরুষরা খারাপ করছে না। একবার আকাশে ওঠার মাত্র কয়েক মিনিটে পৌঁছুবে টার্গেটে। এদিকে পুলিশের মাধ্যমে একের পর এক রোডব্লক করবে কমিশনার অ্যাল মার্লো। পরিস্থিতি সুবিধার লাগছে না রানার। প্রতি ঘণ্টায় আঁকাবাঁকা, সরু সব পাহাড়ি রাস্তায় যে-কোনও দিকে ও যেতে পারবে বড়জোর চল্লিশ কিলোমিটার। অথচ, চারপাশ থেকে ওকে ঘিরে ফেলবে শত শত সশস্ত্র পুলিশ অফিসার। উপায় নেই কোথাও যাওয়ার। তার চেয়েও খারাপ কথা, হয়তো এরই মধ্যে আকাশে উঠেছে জণ্ডামিরি কপ্টার।

সংক্ষেপে বললে, সময় হয়েছে লেজ তুলে ভেগে যাওয়ার!

আটাশ

কাগজের জন্যে গ্লাভবক্স খুলে ঘাঁটতে শুরু করেছে রানা।

‘কী করছ?’ জানতে চাইল এলিস বেলা।

ইশতিয়াক হামার জিপের ইনণ্ড্যুরেন্স না করালেও সংগ্রহ করেছে ফর্ম। ওটার পেছন অংশে মার্কার কলমে ফোনের ভেতরের নম্বরগুলো লিখতে শুরু করল রানা। পুরনো পদ্ধতি কখনও কখনও বেশি কাজের। কেউ ট্র্যাক বা ট্রেস করতে পারবে না কাগজ। লেখা শেষে ওটা পকেটে রাখল রানা। মাত্র এক সেকেণ্ডে ভেবে নিল, এবার কী করবে। ওই ফোন ভার্চুয়াল টার্গেটের মত। রেখে দেয়া যাবে না নিজের কাছে। নষ্ট করলে বন্ধ হবে সিগনাল। এদিকে চালু থাকলে পুলিশ জানবে ওটা কোথায় আছে। তাতে ওর কোনও সমস্যা নেই। হামার থেকে নেমে দীর্ঘ ঘাসের জমিতে চলে গেল রানা। ঘন দেখে এক ঝোপে গুঁজে দিল অন করা মোবাইল ফোন। নীরবে যেন পুলিশ বাহিনীকে ডাকছে: ‘এই যে, এখানে! আমি এখানে!’

দ্রুত এসে হামারের ক্যাবে উঠল রানা। একের পর এক প্রশ্ন শুরু করেছে এলিস বেলা। একটা কথাও না বলে গাড়ি নিয়ে রওনা হলো রানা। ক্রমেই বাড়ছে হামারের গতি। সাপের মত এঁকেবেঁকে গেছে পাহাড়ি রাস্তা। চুলের কাঁটার মত বাঁক নেয়ার সময়েও কমছে না গাড়ির বেগ। কিচকিচ আওয়াজে পিছলে যাচ্ছে চাকার পুরু রাবার। উজ্জ্বল আলোয় দেখা যাচ্ছে দু’পাশ থেকে যেন ঘিরে ধরেছে সবুজ সুড়ঙ্গ। একটু পর পর রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রাখছে রানা। ভাবছে, পেছনের অন্ধকার চিরে যে-কোনও সময়ে হাজির হবে পুলিশের গাড়ির নীল বাতি।

একটু পর শুরু হলো চড়াই। সোজা গেছে রাস্তা দু’মাইল। এত ওপরের জমিতে জন্ম নেয়নি জঙ্গল। চারদিক থেকে চেপে এল উঁচু পাহাড়। বহু নিচে গাছে ভরা উপত্যকা। আকাশে ঝিকঝিক করছে লক্ষ-কোটি নক্ষত্র। আবছা আলো ফেলেছে চারপাশে।

কিছুটা গিয়ে ব্রেক কষে থামল রানা। নেমে পড়ল হামার থেকে। বিস্মিত চোখে ওকে দেখছে এলিস বেলা।

গাড়ির সামনের বনেটে চড়ে ওখান থেকে সমতল ছাতে উঠল রানা। এত ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে তিন শ’ ষাট ডিগ্রি। কোথাও নেই কোনও নড়াচড়া। নেই অগ্রসরমাণ গাড়ির সাইরেন বা হেলিকপ্টারের রোটরের শব্দ। পশ্চিমে আঁধার বুনো এলাকা। তারার আলোয় উত্তর ও দক্ষিণে চকচকে ফিতার মত কালো, নির্জন রাস্তা। পুবে পথের ব্যারিয়ারের ওদিকে পাথুরে ঢালু জমিতে জন্মেছে কাঁটা ঝোপ ও পাইন গাছের সারি। তিন শ’ গজ নিচে পৌনে একমাইল দূরে একঝাড় গাছের নিচে বেশ কয়েকটা দালান। বড় উঠানের পেছনে গোলাবাড়ি। ওটার জানালায় কোনও আলো নেই। বোধহয় গভীর রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই।

লাফিয়ে ছাত থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার সিট খুলল রানা। ‘অন্তত বলবে তো, কী হয়েছে!’ রাগী গলায় জানতে চাইল এলিস বেলা।

জবাব না দিয়ে পকেট থেকে ব্যানওয়ার্টের সুইচব্লেড ছুরি নিল রানা। খুলল ফলা। সাবধানে কাটতে লাগল মেয়েটার ডান কবজি ও গোড়ালির টেপ। কাজ শেষ করে চলে গেল ড্রাইভারের খোলা দরজায়। ভেতরে ঝুঁকে একই কায়দায় কেটে দিল এলিস বেলার বাম হাতের টেপ। তাতে স্বস্তির শ্বাস ফেলল মেয়েটা। রক্ত চলাচল ঠিক করতে ডলতে লাগল কবজি।

‘বেরিয়ে এসো,’ বলল রানা। ‘নিচের খামারে যাব।’

গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার কিনারা লক্ষ্য করে পা বাড়াল এলিস বেলা। ওদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাহাড়।

‘দাঁড়াও।’ বাধা দিল রানা। ‘আগে হাতদুটো রাখো গাড়ির উইঙের ওপর।

‘তুমি মানুষকে জিম্মি করতে ভালবাসো, তাই না?’ বিড়বিড় করল মেয়েটা। ফিরে এসে হাত রাখল হামারের উইঙে।

পেছনে থেমে ওর দু’কবজি টেপ দিয়ে আটকে দিল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘আওয়াজ করবে না। একটুও চালাকি নয়… মটকে দেব ঘাড়টা।’

‘আগে অবিশ্বাস করেছ বলে হুমকি দিয়েছ। ওটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন বিশ্বাস করার পরেও হুমকি কেন?’

‘তুমি তো জানো, জিম্মির জীবন, খুব কঠিন,’ বলল রানা। টেপের রোল থেকে কেটে নিল পাঁচ ইঞ্চি চওড়া একটা অংশ। এলিস বেলা কিছু বোঝার আগেই চট্ করে আটকে দিল ওর মুখে। ‘নড়বে না।’ হামার থেকে দরকারি সব বের করতে লাগল রানা। বাম কাঁধে ঝুলিয়ে নিল ব্যাগ। ডান কাঁধে তুলল অস্ত্র ও গুলি ভরা হোল্ডঅল। নানান পকেটে গেল এলিস ও ব্যানওয়ার্টের দুই পিস্তল ও ড্রাগ ডিলার ড্যামিকোর বেরেটা। ভারী অস্ত্র, সোনার বার ও লিওন সিমনের কাছ থেকে জব্দ করা টাকার ওজনে প্রায় জন্মের কুঁজো হয়ে গেল ও। মনে পড়ল ব্রেকোন ব্রেকোন্স-এ পেনি মাউণ্টেনের ট্রেনিঙের কথা। এমনই ভারী ওজন পিঠে নিয়ে ছুটে যেতে হতো নির্ধারিত পাহাড়ি পথে। ওই কোর্স চালু হওয়ার পর আজ পর্যন্ত ক্লান্তি ও হৃত্যন্ত্র বিকল হয়ে মারা গেছে বারোজনের বেশি ক্যাডেট। এখন অবশ্য ঢালু জমি বেয়ে নামতে হবে। তবে এতেও কমবে না ওর খাটুনি।

‘চলো,’ রাস্তার ওদিকে ঢালু পাহাড় দেখাল রানা।

পরিত্যক্ত হামার পেছনে রেখে ব্যারিয়ার টপকে গেল ওরা। আঁধার ঢালে সতর্ক পায়ে নামছে এলিস। আগে চলেছে রানা। মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছে বন্দিনীকে। মন খারাপ হামার জিপ হারিয়ে। তবে বেশিক্ষণ লাগল না শোক ভুলতে। সহজে .কিছু পেলে সেটা হারাবার কষ্টও কম।

চারপাশে ফস্কা পাথর। ভূমিধসের মত নেমেছে আলগা মাটি। বিপজ্জনক ঢালু জমি। সমতলে পৌছুতে পুরো বিশ মিনিট লাগল ওদের। সামনে গাছের সারি। আধ একর তৃণভূমির ওদিকে তক্তা দিয়ে তৈরি বেড়া। ওখান থেকেই শুরু হয়েছে খামার। বেড়া টপকে গেল রানা ও এলিস। চুপচাপ হাঁটছে গোলাবাড়ি লক্ষ্য করে। বেশকিছু গাছ ঘিরে রেখেছে বাড়িটাকে। রানার মনে পড়ল ওর আর্মি জীবন। হাঁটতে হাঁটতে দেখছে চারপাশ। সতর্ক হয়ে উঠেছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়। প্রতিটি শব্দ ও গন্ধ পাচ্ছে আলাদাভাবে। রাতের আঁধার চিরে দূর থেকে এল রোটরের আওয়াজ। ব্যগ্র হয়ে টার্গেটের দিকে ছুটছে পাইলট। কিছুক্ষণ পর ঝোপঝাড় হাতড়ে পাবে পরিত্যক্ত ফোন।

মৃদু হাসল রানা।

খুব নাখোশ হবে অ্যাল মার্লো 1

ওপরের রাস্তা থেকে নিচের খামার দেখতে চমৎকার। কিন্তু কাছে যেতেই টের পেল চারদিকে অবহেলার ছাপ। উঠানে জংধরা যন্ত্রপাতি। বহু বছর রঙ করা হয়নি পাথরের বাড়ি। ফ্যাকাসে লাল টাইলসের একদিকে চৌকো চিমনি। বাড়ির ভেতর থেকে আসছে কুকুরের গর্জন। তবে মনে হলো না ঘুম ভাঙল কারও। সব জানালা অন্ধকার। বাড়ির সামনের দেয়ালের কাছেই বড়সড় সব্জী বাগান। আরেক দিকের দেয়ালের কাছে জড় করা হয়েছে কয়েকটা ভাঙাচোরা ট্র্যাক্টর ও গাড়ি। সেগুলো থেকে একটু দূরে মার খাওয়া চেহারার এক টয়োটা হিলাক্স ক্রু-ক্যাব পিকআপ। লোড বেড-এ ডিজেলের ক্যান ও তারপুলিন। গাড়ির চাকায় হাওয়া আছে। কানা হয়নি হেডলাইট। কাজে আসতে পারে গাড়িটা। এলিস বেলাকে দেয়ালের ছায়ায় থাকতে ইশারা করে নিজে গিয়ে জেরি ক্যানের গায়ে চাপড় দিল রানা। ভেতর থেকে এল ছলছল আওয়াজ। সরে এসে সাবধানে টয়োটা পিকআপের ড্রাইভিং দরজা খুলল রানা। ইগনিশনে ঝুলছে চাবি। সাধারণ গ্রাম্য পরিবেশের সুবিধা একেই বলে, কেউ ভাবতে যায়নি রাতে হাজির হবে পুরনো গাড়ি-চোর।

পিকআপের আড়াল নিয়ে বাড়িটা দেখল রানা।

কেউ নেই।

ব্যাগ নামাতেই টের পেল চাপ কমে গেল কাঁধ থেকে। ব্যাগ থেকে বের করল লিওন সিমনের কাছ থেকে পাওয়া এক তোড়া ইউরোর নোট। হিসেব কষে ওখান থেকে সরিয়ে নিল আড়াই হাজার ইউরো। এত পুরনো গাড়ির জন্যে এর চেয়ে বেশি দিলে চাষা ভাববে রাতে এসেছিল স্বর্গের দূত অথবা নিরেট নির্বোধ। মনে মনে বলল রানা, ‘না জানিয়ে যে লেনদেন করলাম, আশা করি সেজন্যে পুলিশের কাছে যাবে না তুমি, ভাতিজা!’

দেয়ালের ওপর টাকাগুলো রেখে একটা পাথর দিয়ে ওগুলো আধচাপা দিল রানা। সকালে গাড়ির মালিকের চোখ পড়বে ওখানে। সাবধানে ক্যাবের পেছনের দরজা খুলল ও। ভেতরে তুলল নিজের ব্যাগ ও হোল্ডঅল। ফুটওয়েলে পেল শুকনো কাদা ভরা রাবারের ওয়েলিংটন বুট। এ ছাড়া রয়েছে তুবড়ে যাওয়া প্রাচীন একটা ক্যাপ। পেছন সিটে মুচড়ে যাওয়া বয়লার সুট। ওটাতে মেখে আছে শত শত মুরগির পায়খানা। দরজা বন্ধ করে হাতের ইশারায় এলিস বেলাকে ডাকল রানা। ছায়া থেকে সে বেরোতেই কাঁধ ধরে তাকে গাড়ির সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে তুলল রানা। নিজেও চেপে বসল ড্রাইভিং সিটে। বড় করে একবার দম নিয়ে মুচড়ে দিল চাবির কান। খ্যাক খ্যাক শব্দে চালু হলো ডিজেল ইঞ্জিন। রাতের নীরবতায় চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল সেই আওয়াজ। দেরি না করে গিয়ার ফেলে রওনা হয়ে গেল রানা। গোলাবাড়িতে জ্বলল না কোনও বাতি। গভীর ঘুমে বিভোর সবাই।

খামারের ছাউনি ও বার্ন পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে গেছে ব্যক্তিগত পথ। সামনে চওড়া খোলা গেটের ওদিকে রাস্তা। চোখ ঘুরিয়ে রানাকে দেখল এলিস, মুখে টেপ। খেপে গেছে ভীষণ। কী যেন বলছে বিড়বিড় করে। বোধহয় দুর্গন্ধ ভরা নোংরা, প্রাচীন বুট ও মুরগির পায়খানাময় সুটের কারণেই এত আপত্তি।

একটা মোড়ে বাঁক নিয়ে হাইওয়েতে পৌঁছল রানা। ঝোড়ো বেগে পরের পাঁচ মাইল পেরোল। রাস্তায় মোমবাতির মত আবছা আলো ফেলেছে টয়োটার ত্যাড়া হেডলাইট। হামারের উজ্জ্বল আলোর কথা ভেবে দুঃখের হাসি হাসল রানা। ভীষণ ধুঁকছে পিকআপের পুরনো ইঞ্জিন। দুলছে লচকে যাওয়া সাসপেনশন। রাস্তায় পিছলে যাচ্ছে নেড়া চাকা। আরও কিছুক্ষণ চলার পর এলিস বেলাকে পাত্তা না দিয়ে গাড়ি থামাল রানা। নেমে পড়ল ক্যাব থেকে। দেরি হলো না জ্যাকেট খুলতে। গায়ে চড়িয়ে নিল বয়লার সুট। কাছ থেকে ভয়াবহ ওটার দুর্গন্ধ। তবে এরচেয়েও মারাত্মক জিনিস জীবনে দেখেছে রানা। নিজের বুট খুলে পরল রাবারের ভেজা ওয়েলিংটন বুট। কাজটা শেষ হতেই খুলল প্যাসেঞ্জার দরজা। টান দিয়ে চড়চড় করে তুলে নিল এলিসের মুখের টেপ। মুখে মিষ্টি-মধুর হাসি।

‘এসবের মানেটা কী!’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল মেয়েটা।

‘কারও চোখে পড়বে না, এমন গাড়ি চাই,’ বলল রানা।

‘গ্রাম্য এলাকায় সবার চোখে পড়ত হামার।

‘গাড়ির কথা বলিনি, স্টুপিড! মুখের টেপের কথা বলেছি! বিরক্ত হয়ে গেছি বন্দির মত আচরণ পেয়ে!’

‘ভুলে গেলে তুমি একজন সরকারি এজেণ্ট? আর আজ রাতে আমি একজন পলাতক অপরাধী। বুঝতেই পারছ, আমাদের দু’জনের সম্পর্ক হচ্ছে সাপ আর নেউলের মত।’

‘একবারও তোমার মাথায় ঢুকছে না, বাধা দিলে আগেই তা দিতাম? চাইলে গ্রেফতার করতে পারতাম তোমাকে।’

‘সত্যিই এসব ভাবিনি,’ বলল রানা। মাথায় চাপিয়ে নিল তুবড়ে যাওয়া ক্যাপ। কুঁজো হয়ে হাত ভরল ট্রাকের কাদা ভরা সিলের নিচে। হাতড়ে দেখছে সাসপেনশন। কয়েক মুহূর্ত পর সোজা হয়ে দেখল হাতে লেগেছে ধুলো ভরা কালো গ্রিস। সামান্য মেখে নিল মুখে। বাকি অংশ মুছল বয়লার সুটে।

‘দারুণ লাগছে দেখতে,’ টিটকারির সুরে বলল মেয়েটা।

লোড বেড থেকে তারপুলিন নিল রানা। ‘সামনেই থাকবে পুলিশের রোডব্লক। এখন তোমাকে সবিনয়ে অনুরোধ জানাব ফুটওয়েলে শুয়ে পড়তে। বেশিক্ষণের জন্যে নয়। তবে, নালিশ বন্ধ না হলে বা আওয়াজ করলে বাধ্য হয়ে আবারও মুখে আটকে দেব টেপ।’

‘ভাবছ পুলিশদেরকে বোকা বানিয়ে ব্লকেড পেরোবে? ওরা কিন্তু প্রশিক্ষিত অফিসার, গাধা নয়!’

‘ওরা গাধা না হলে বাধ্য হয়েই গুলি করতে হবে।’

‘তুমি বদ্ধ উন্মাদ!’

‘মুখে টেপ লাগাব?’

মাথা নাড়ল এলিস বেলা। ‘আমি একটা কথাও বলব না।’

‘সত্যিই লক্ষ্মী মেয়ে!’ লিভার টেনে প্যাসেঞ্জার সিট পুরো পেছনে নিল রানা। বেলাকে সাহায্য করল ফুটওয়েলে শুয়ে পড়তে। ওর ওপর বিছিয়ে দিল তারপুলিন। দরজা বন্ধ করে আবারও ড্রাইভিং সিটে উঠল রানা। স্টিয়ারিং ও ধুলো ভরা ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের মাঝে আছে পুরনো এক ব্রায়ার পাইপ। ভেতরে আছে খানিক তামাক। যদিও ওটাকে ঘোড়ার শুকনো নাদা বলেই মনে হলো ওর। দু’ঠোঁটের মাঝে পাইপ গুঁজে লাইটার দিয়ে জ্বেলে নিল তামাক। গলাটা ভীষণভাবে জ্বলে উঠতেই কাশল খকখক করে।

‘ভয়ানক বাজে কিছু পুড়ছে!’ তারপুলিনের নিচ থেকে নালিশের সুরে বলল এলিস।

‘কথা এখন বন্ধ।’ রওনা হয়ে গেল রানা। রাবারের ধাবড়া বুটের জন্যে ঠিকভাবে চাপ দিতে পারছে না গ্যাস পেডাল ও ক্লাচে। পুরনো গাড়ি নিয়ে খটর-মটর আওয়াজে আরও এক কিলোমিটার পেরোল রানা। তারপর তীক্ষ্ণ বাঁক নিতেই বিশ গজ দূরে দেখল রাস্তা জুড়ে অপেক্ষা করছে পুলিশের দুই রেনও মেগান গাড়ি। জ্বলজ্বল করছে হেডলাইট। ঝোপঝাড়ে নীলচে আলো পড়েছে ছাতের লাইট বার থেকে। পিকআপ ট্রাক দেখে টর্চ হাতে কয়েক পা এগোল দু’জন পুলিশ অফিসার। ইউটিলিটি বেল্টের হোলস্টারে রয়ে গেছে পিস্তল। দুই পুলিশের একজনের বুকে আড়াআড়িভাবে ঝুলছে পুরনো আমলের ম্যাট-৪৯ সাবমেশিন গান। হাত তুলে টয়োটা পিকআপ থামাতে বলছে অন্যজন।

কিছুটা দূরে থাকতেই থেমে গেল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর ওর জানালার পাশে পৌঁছে গেল এক অফিসার। অন্যজনের হাতে সাবমেশিন গান। ভয়ানক কুঁচকে রেখেছে ভুরু। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, গাড়ি ভরা ক্রিমিনালের সঙ্গে গোলাগুলির সুযোগ পেলে সে খুশি হত। অন্যজনের বয়স বেশি। বস্তার মত পেট তার, নেমে এসেছে নিচের দিকে। জানালার কাঁচ নামাল রানা। ভক করে গাড়ি থেকে বেরোল বিশ্রী তামাকের ভয়াবহ ধোঁয়া। টর্চের আলোয় গাড়ির ভেতরের অংশ দেখল অফিসার। রশ্মি পড়ল তারপুলিনের ওপর। ওটার নিচে লুকিয়ে আছে এলিস বেলা। আবার আলো ঘুরে এসে পড়ল রানার মুখে। ধাঁধিয়ে দিল ওর চোখ। এবার আলো গেল পেছনে রাখা ব্যাগের ওপর। ওটার ভেতরে রয়েছে সোনার বার ও নগদ টাকা। পাশের হোল্ডঅলে রয়েছে মিলিটারি রাইফেল ও প্রচুর গুলি। স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে রানা, ঠোঁটে ধূমায়িত পাইপ। ডানহাত কোলে। দরকারে এক সেকেণ্ডে কোমর থেকে গ্লুক ২৬ নিয়ে উড়িয়ে দেবে পুলিশের মুখ।

‘এত রাতে কোথায় চলেছ, মোসিউ?’ জানতে চাইল বয়স্ক অফিসার।

কাঁধ ঝাঁকাল রানা। স্থানীয় সুরে বলল, ‘আমার মালকিনের তাড়া খেয়ে বেরোতেই হলো।’

‘তাড়া খেলে কেন?’

‘খুঁজে এনে দিতে হবে মিস্টার ম্যাক্সিমিলিয়ানকে।’

‘কে এই ম্যাক্সিমিলিয়ান?’

‘মালকিনের জানের জান, পরানের বন্ধু,’ বলল রানা, ‘আবারও ভেগে গেছে কুত্তার বাচ্চাটা। মাথা খারাপ হয়েছে দূরের খামারের কুত্তীটার প্রেমে। আপনারা তো দেখেননি বোধহয় ওটাকে?’

‘না, কোনও কুকুর দেখিনি,’ বিরক্ত হয়ে বলল অফিসার। ‘কী ধরনের কুকুর?

‘নেকড়ে কুকুর,’ বলল রানা। তাচ্ছিল্য করে জার্মান শেফার্ড কুকুরকে ওই নামে ডাকে ফ্রেঞ্চরা। ‘শুয়োরের বাচ্চার শরীরটা বিরাট। মাথায় মগজের বদলে আছে গোবর। আর চরিত্রের ব্যাপারটা তো বুঝতেই পারছেন। আমার মালকিনের উচিত ওই বিশ্বপ্রেমিকটার মাথায় গুলি করে শেষ করে দেয়া। ক’দিন পর পর নালিশ আসছে ওই খামার থেকে।’

আরও কয়েক সেকেণ্ড রানার মুখে আলো ফেলল অফিসার। দেখা হয়ে গেল নোংরা বয়লার সুট, পুরনো ক্যাপ ও মুখের গ্রিস। ভকভক করে ধোঁয়া উঠছে পাইপের বোউল থেকে। অফিসারদের কাছে দেয়া হয়েছে ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা চৌকশ চেহারার এক যুবকের ছবি। তার সঙ্গে মোটেই মিল নেই খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা এই লোকের। খামারের মজুর, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

এত রাতে আপনারা কী খোঁজেন?’ জানতে চাইল রানা। ‘চোর-বাটপার না খুনি?’ আরেক টান দিল পাইপে। গাড়ি থেকে ভক করে বেরিয়ে টর্চের আলোয় পাক খেতে লাগল কড়া তামাকের ধোঁয়া। রাস্তায় থুতু ফেলে জানালা থেকে পেছাল অফিসার। পাইপের বাজে ধোঁয়া বা বয়লার সুটে মুরগির বিষ্ঠার দুর্গন্ধে মহাবিরক্ত সে।

‘আর যাকেই খুঁজি, তোমাকে না,’ বলল অফিসার, ‘যাও তো, বাপু! পথ ছাড়ো!’ সাবমেশিন গানধারী অফিসারের দিকে হাতের ইশারা করল সে। ক’পা সরে গেল কমবয়সী অফিসার। চোখে-মুখে তীব্র হতাশা। ভাবছে, পরের গাড়িতে হয়তো থাকবে মাসুদ রানা। আর তখনই খেলা দেখিয়ে দেবে সে। জানালার কাঁচ তুলে খড়খড়-মড়মড় আওয়াজে পিকআপ নিয়ে রওনা হলো রানা। আয়নায় দেখল, নিজেদের গাড়ির দিকে চলেছে দুই পুলিশ অফিসার। পরের বাঁক পেরোতেই তাদেরকে আর দেখা গেল না। ড্যাশবোর্ডে পাইপ রেখে বলল, ‘এবার উঠে আসতে পারো।’

বিশ্রী ফড়ফড় আওয়াজ তুলে তারপুলিন সরিয়ে সিটে উঠল বেলা। কৌতূহলী চোখে তাকাল রানার দিকে। ‘ম্যাক্সিমিলিয়ান?’

কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

মাথা নেড়ে বলল মেয়েটা, ‘ঠিক আছে, আগের কথা ফিরিয়ে নিলাম! আসলেই পুলিশের লোকদুটো নিরেট গাধা।’

‘সত্যিকারের ভাল জিম্মির মত অভিনয়ের জন্যে তোমাকেও ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘ভাল লাগছে যে গুলি করতে হয়নি তোমাকে।’

‘ইউ আর ওয়েলকাম। তো, এবার কী করবে?’

পাহাড়ে দেখা দিয়েছে ধূসর ভোরের প্রথম আলো।

‘খিদেয় খুন হয়ে যাচ্ছি,’ জানাল রানা।

ঊনত্রিশ

সারারাত গাড়ি চালিয়ে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ট্রাক-ড্রাইভারদের কাছে খাবার বিক্রি করে ফ্রাঁসোয়া রেস্তোরাঁ। ওটা খোলা হয় ভোরে। রাস্তার ধারে লম্বাটে, নিচু দালান। সামনে আর্টিকুলেটেড ট্রাক রাখার বিশাল পার্কিং এরিয়া। তবে আজ ভিড় নেই রেস্তোরাঁয়। একটু আগে আকাশে মুখ তুলেছে সোনালি সূর্য। জানিয়ে দিচ্ছে, আজকের দিনটি হবে উষ্ণ।

আগেই খামার-মালিকের বেশভূষা ছেড়ে নিজের পোশাক পরেছে রানা। ময়লা কাপড়চোপড় রেখেছে পিকআপের লোড বেড-এ। খসখসে এক কাপড় দিয়ে মুখ থেকে মুছে নিয়েছে গ্রিস। এখন রিট কর্তৃপক্ষ তাদের হোটেলে ঢুকতে না দিলেও ওই রেস্তোরাঁর টেবিল দখল করতে বাধা দেবে না কেউ।

ঘুমের অভাবে ফাঁকা রানার মাথা। মনে নেই শেষবার কবে খেয়েছে পেট পুরে। টয়োটা পিকআপ থেকে নেমে রেস্তোরাঁর দিকে পা বাড়িয়ে এলিস বেলাকে বলল ও, ‘আগের নিয়ম নিশ্চয়ই মনে আছে? ভঙ্গি করবে তুমি বন্দিনী নও। মাথায় রেখো, আমার পকেটে লোডেড পিস্তল।’

ফ্রাঁসোয়া রেস্তোরাঁর টেবিল-চেয়ার অপরিষ্কার। তাতে কী, রানার এখন চাই খাবার। কয়েকটা টেবিলে বসে খাচ্ছে ক’জন ট্রাক ড্রাইভার। তাদেরকে পাশ কাটাবার সময় গরুর ভাজা মাংস ও টোস্টেড পাউরুটির সুবাস নাকে এল ওর। টের পেল, জিভে জমে গেছে জল। বেলাকে নিয়ে ঘরের পেছনে নির্জন এক টেবিল দখল করল রানা। মুখোমুখি দুই নরম ভিনাইল বেঞ্চে বসল ওরা। ব্যাগ পাশে নামিয়ে রেখেছে রানা। বামহাত ঝুলছে কোমরের কাছে। দরকারে ঝট্ করে বের করবে গ্লক পিস্তল। একবার মেয়েটাকে দেখে নিয়ে জানালা দিয়ে চোখ বোলাল উঠানে। একটু দূরে টয়োটা পিকআপ ট্রাক। রাস্তা থেকে কেউ এলে আগেই দেখবে।

মিনিটখানেক পর ওদের সামনে এসে থামল বিরক্ত চেহারার এক ওয়েটার। দু’জনের জন্যে পাউরুটি টোস্ট, গরুর ভাজা মাংস, মাশরুম ও কফির অর্ডার দিল রানা। এলিস বেলা নিজের জন্যে বাড়তি চাইল ফলের জুস। ওয়েটার বিদায় নিতেই ব্যাগ খুলে ভেতর থেকে সোনার বার নিয়ে টেবিলের ওপর রাখল রানা। ওটার ওজনে সামান্য দেবে গেল পাতলা কাঠের পাটাতন। নিচু গলায় বলল ও, ‘গুপ্তধন ছিল, এই যে প্ৰমাণ।’

সোনার বার দেখে সামান্য বিস্ফারিত হলো এলিস বেলার চোখ। ‘তার মানে ঠাট্টা করছিলে না।’

‘আরও দুটো ছিল তোমাদের পল হার্ভার্টের কাছে।’

‘কিন্তু ওর কাছে থাকবে কেন?’

‘তা জানা নেই, তবে মনে হয়েছে নিজের জন্যে রেখেছিল।’

‘আমার তা মনে হয় না।’

‘ওই জিনিস আরও দুটো দেখেছি। কিন্তু ব্যস্ত ছিলাম বলে সংগ্রহ করতে পারিনি।’

‘তার মানে, ওখানে ছিল সোনার অসংখ্য বার,’ বিড়বিড় করল এলিস বেলা। চোখ সরাতে পারছে না সোনার বার থেকে।

‘আমারও তা-ই ধারণা,’ বলল রানা। ‘ওগুলো তুলে এনে রেইড ভেহিকেলে রাখতে গিয়ে সময় লেগেছে কয়েক ঘণ্টা।’

ভুরু কুঁচকে ফেলল বেলা। ‘এ কারণেই অস্বস্তি বোধ করছি। প্যাসেঞ্জার বা ইকুইপমেন্টের জন্যে ওই ভেহিকেলে জায়গা খুব কম। সোনার বার ওখানে থাকলে ঠিকই চোখে পড়ত আমার।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘তা ছাড়া, গিসেল মাত্র একটা গাড়িতে তুলবে কেন?’ আনমনে বলল এলিস। ‘কয়েকটা গাড়িতে তুলে দেয়া ছিল বেশি যুক্তিসঙ্গত।’

‘বহু কিছুই এই ঘটনায় যৌক্তিক নয়,’ বলল রানা। ‘দ্বিতীয় বোমা রাখল কেন?’

‘যাতে গর্ত বুজে দিতে পারে? মুছে গেছে সব ধরনের চিহ্ন।’

‘তা হলে লাশগুলোকে ওই ঘরে রেখে বোমা ফাটাত। কী কারণে খোলা জায়গায় রাখবে নিজেদের লোকের লাশ?’

‘জানি না,’ বিড়বিড় করল বেলা।

‘তা ছাড়া, সব সরিয়ে নিয়ে থাকলে টাইম বোমা সেট করবে কেন? ওখানে তো লুকাবার মত আর কিছু নেই।

‘হয়তো ডাইভার্শন। একঘণ্টা পর বোমা ফাটলে সরে যেতে পারবে বহু দূরে। আর এর ভেতর কেউ এসে পড়লে মরবে। অথবা, হয়তো ডিভাইসটা নিখুঁত ছিল না।’

‘অনেক হয়তো তোমার কথায়, ওয়েটার ট্রে নিয়ে আসছে দেখে ব্যাগে সোনার বার রাখল রানা। টেবিলে টে নামিয়ে বিদায় নিল ওয়েটার। যে যার খাবারের প্লেট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল রানা ও এলিস। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দিচ্ছে রানা। মেয়েটা তার ফলের জুসে। দু’জনই চিন্তিত।

‘তা ছাড়া, এরা জানল কী করে মঠে গুপ্তধন আছে?’ পেটে খাবার পড়তেই রানার মনে হচ্ছে শক্তি ফিরছে শরীরে। এখন চাই অন্তত বারো ঘণ্টার দীর্ঘ একটা ঘুম।

‘ডেইটার কিছু জানতে চাইলে, সেজন্যে লাখ ডলার ব্যয় করতেও দ্বিধা করে না,’ বলল বেলা। ‘আগেই বলেছি, লোকটা বদ্ধ উন্মাদ। একবার মাথায় কিছু ঢুকলে সেটা বেরোয় না মগজ থেকে। তাকে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারের রোগী মনে হয়েছে আমার। অথচ, মনে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। একবার কিছু ঠিক করলে দিন-রাত বকবক করে ওই বিষয়ে। উৎসাহের শেষ থাকে না। কয়েকবার শুনেছি তার মনোলগ। কয়েক সপ্তাহ আগে এক রাতে লোসানে এল। সঙ্গে ছিল ডেইযি বাট্স্ আর আরও ক’জন। লিভিং রুমে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কী যেন বলল গিসেল। মনে হলো, তার যা ইচ্ছে বলবে, কেউ শুনুক বা না-শুনুক কিছু এসে যায় না। বারবার বলল এক গোপন ঘরের কথা। ওটা আছে পাহাড়ে নিরেট পাথরের নিচে। অথচ, একবারও বলল না জায়গাটা কোথায়। বলেছিল, ওখানে আছে রহস্যময় অনেক কিছু।’

‘রহস্যময় অনেক কিছু?’

মাথা দোলাল এলিস বেলা। ‘হ্যাঁ, প্রাচীন রহস্য। কয়েক শতাব্দী আগে মানুষ ভুলে গেছে ওই গোপন বিষয়টি। কিন্তু সত্যিকারের তথ্যটা রয়ে গেছে ডেইটার গিসেলের কাছে। আর সেজন্যেই নাকি ইতিহাস গড়বে সে। হাজার বছর পরেও তার কথা মনে করবে মানুষ। পূজা করবে তাকে। বকবক করতে করতে কান পচিয়ে দিয়েছিল সে।’

‘অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ডও গোপন বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন,’ বিড়বিড় করল রানা।

‘অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড কে?’

‘মঠের প্রধান সাধু,’ বলল রানা, ‘বলেন, আশ্রমের অতীত ভাবতে গেলে মন ছোট হয় তাঁর।’ মঠের নিচের পাতাল ঘরের কথা খুলে বলল ও। ওই ঘর নিয়ে আলাপ করতে রাজি হননি সাধু। ‘যখন আগ্রহ দেখালাম, শামুকের মত আটকে ফেললেন মুখ। পরে চলে গেলেন অন্য প্রসঙ্গে।’

‘হয়তো জানতেন বসে আছেন সোনার পাহাড়ের ওপর, বলল বেলা। ‘গোটা ফ্রান্স জুড়ে ছড়িয়ে আছে শত শত প্রাচীন গুপ্তধন। খুঁড়ে তুলতে পারলেই বড়লোক হবে যে কেউ। আর সেজন্যে পুরনো সব তথ্য সংগ্রহ করছে ফটকাবাজরা। গুপ্তধনের জন্যে কাউকে খুন করা নতুন কিছু নয়। কে জানত, দুর্গম এক আশ্রমের ওপর চোখ পড়েছে গিসেলের। হয়তো ভেবেছিল গুপ্তধনের কথা জেনে যাবে মিডিয়া। সঙ্গে সঙ্গে ওখানে হাজির হবে টিভি ক্রু, সাংবাদিক ও শত শত মানুষ। তাই প্রথম সুযোগে ওখানে ছান দিয়েছে সে।’

পাউরুটি ও মাশরুম চিবুতে শুরু করে বেলার কথাগুলো ভাবছে রানা। খাবার গেলার পর কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে না গুপ্তধনের কথা বলেছেন সাধু। বলেছিলেন প্রাচীন ভূত ও প্রেতাত্মার কথা। বলেন, ভুলে যাওয়া উচিত সেই ভয়াবহ অতীত। সেটা এতই লজ্জাজনক ও বীভৎস, মুখে উচ্চারণ করা যায় না। তাঁর কথা শোনার আগে ওই পাতাল ঘরে অন্য কিছু দেখেছি। সেটা সোনার বার নয়।’

ফলের জুসে শেষ চুমুক দিয়ে জানতে চাইল বেলা, ‘অন্য জিনিসটা কী?’

‘পুরনো হাড়গোড়,’ বলল রানা, ‘মানুষের। স্তূপ করা। অন্তত কয়েক শ’ কঙ্কাল। নারী-পুরুষ তো আছেই, বাদ নেই শিশুরাও।’

‘গণকবর?’

‘গণকবর নয়,’ বলল রানা। ‘আরও খারাপ কিছু। মেঝেতে আটকানো লোহার শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল মানুষগুলোকে। কেউ আটকে রাখে না লাশ। মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করা হয় নিচের ঘরে। মুখের সামনে তুলে দেয়া হয় মোটা দেয়াল। তাদের কাছে ছিল না খাবার বা পানি। ধীরে ধীরে মারা পড়ে মানুষগুলো। শত শত বছর আগের কথা সেটা।’

‘মঠের নিচে এ ধরনের কাজ করবে কে?’

‘সেসময়ের গির্জা কর্তৃপক্ষ,’ বলল রানা, ‘তখন ইউরোপে আর কারও এত ক্ষমতা ছিল না। এ ব্যাপারে সবই জানতেন অলিভিয়ের গুয়েরিন। আর সেজন্যেই মুখ খুলতে রাজি হননি।’

‘ভয়ঙ্কর মৃত্যু!’

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

ফাকা চোখে টেবিলের দিকে তাকাল এলিস বেলা। একটু কুঁচকে গেল ভুরু। ভাবছে কী যেন।

‘কী ভাবছ?’ জানতে চাইল রানা।

‘একটা কথা, শুনতে তোমার অবাক লাগতে পারে, তবুও বলছি: কোনও ধরনের অভিশাপের কথা বলেছিলেন অলিভিয়ের গুয়েরিন?’

‘অভিশাপ?’ মেয়েটার চোখে তাকাল রানা।

মৃদু মাথা দোলাল বেলা। ‘বিস্তারিত জানতে চেয়ো না, কারণ, জানি না। তবে সে রাতে মন দিয়ে শুনেছি ডেইটারের প্রতিটি কথা। একপর্যায়ে বলল, সেই অভিশাপ দিয়েছে কানা এক লোক।’

‘কানা লোকের অভিশাপ?’ অবাক হয়েছে রানা।

‘ইতিহাস থেকে বলেছে। সে ছিল যাজক বা সাধু। কিছুতেই মনে করতে পারছি না, তবে কানা কী যেন তার নাম।

চুপচাপ কফিতে চুমুক দিল রানা। অপেক্ষা করছে নতুন তথ্যের জন্যে।

ভুরু কুঁচকে ভাবছে বেলা। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘এখিক… কী যেন! …হ্যাঁ, দাঁড়াও! কানা সাধু এখিক সাবাতিয়েখ!’

কানা সাধু শুনে রানার মনে পড়ল বাঁকাচোরা মেরুদণ্ডের বাটপার লিওন সিমনের কথা। মৃদু মাথা নাড়ল ও। ‘আমি অভিশাপ বিশ্বাস করি না।’

‘কিন্তু রহস্যময় কিছু ঘটেছিল,’ আনমনে বলল বেলা। ‘ওই মঠের সঙ্গে জড়িত। আর সেটা বের করতে পারলে আমরা জেনে যাব কীভাবে সোনার খোঁজ পেল ডেইটার গিসেল।’

‘লোকটা সম্পর্কে আর কিছু জানো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল বেলা। ‘আগেই বলেছি, আমার মিশন অসফল ছিল। অফিস থেকে প্রথমে যে তথ্য দেয়া হয়, তারপর চার মাস তাদের সঙ্গে কাটিয়েও জোগাড় করতে পারিনি নতুন কোনও ইনফরমেশন।’

‘কী তথ্য দিয়েছিল অফিস?’ জানতে চাইল রানা।

‘তেমন কিছু নয়,’ বলল এলিস, ‘গিসেল সুইস নাগরিক। বয়স বেয়াল্লিশ। ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। টাকার কুমির। তার পরিবার জুতো কিনতেও ব্যয় করত লাখ-লাখ ডলার। তার জন্যে রেখে গেছে কোটি কোটি ইউরো। পেশায় ডেন্টিস্ট সে। কিছু দিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেছে জেনেভায়। ডাক্তার হিসেবেও তার নামে কোনও খারাপ রেকর্ড নেই।’

‘আর কিছু?’ বলল রানা।

‘সুইস প্রাইভেট লাইসেন্স পাওয়া সার্টিফায়েড পাইলট, বলল এলিস বেলা, ‘দৈর্ঘ্যে ছয় ফুট। ওজন এক শ’ ষাট পাউণ্ড। পাকতে শুরু করেছে মাথার চুল। ধূসর চোখ। কোথাও কোনও বাড়িঘর নেই বলে ঠিকানা নেই। আর এই কারণেই তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে বেশ কয়েকটি সরকারি এজেন্সি। জানা গেছে, বিরাট কী যেন করছে সে।’

‘সেটা কী?’ জানতে চাইল রানা। ‘কোনও আন্দাজ…

‘আমার জানা নেই। আণ্ডারওঅর্ল্ড থেকে খবর পাওয়া গেছে, বন্ধু-বান্ধবীদের উপকারের জন্যে কী কাজে যেন নেমেছে। সেটা ভাল কিছু হতে পারে না। সাধুদেরকে হত্যার চেয়েও আরও অনেক খারাপ কিছু করবে সে।’

‘তার মানে কী করবে, তা জানে না কেউ,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘তা হলে কি ধরে নেব মঠে খুন করেছে সোনার জন্যে? আর সেগুলো বিক্রি করে’ চালু করবে বড় কোনও প্রজেক্ট?’

‘আমিও এই একই কথা ভেবেছি,’ বলল বেলা।

‘আর কোনও তথ্য?’

‘না; নেই। আরও কিছু জানতে হলে যোগাযোগ করতে হবে ডিজিএসআই-এ।’

‘আমি তো ভেবেছি স্বয়ং ডিজিএসআই-এর কাছ থেকেই তথ্য পাচ্ছি,’ ঠাট্টার সুরে বলল রানা।

করুণ চোখে ওকে দেখল মেয়েটা। ‘ঠাট্টা করতেই পারো, আমার কিছু বলার নেই।’

নিজেকে সামলে নিল রানা, ‘নতুন কিছু জানলে কাজে নেমে পড়ত না তারা?’

‘হয়তো। এটাও হতে পারে, সুপিরিয়ররা আমাকে সব তথ্য দেননি। আমি সাধারণ এজেন্ট। নিচের পর্যায়ের। কিছু হলেও দেশের ক্ষতি নেই। তাই হয়তো বিশ্বাস করেনি আমাকে। পাইনি জরুরি ইনফর্মেশন। ডেইটার বা তার দলের কেউ সন্দেহ করলে নির্যাতন করত। তবুও কিছুই জানত না। পরে বিরক্ত হয়ে দূরে কোথাও নিয়ে মেরে ফেলত। তখন নতুন কৌশল নিয়ে এগোত এজেন্সি। তাদের কেউ ঢুকত ওই সংগঠনে। আমি ছিলাম এক্সপেণ্ডেল। এটা ভাবলে মন ছোট হয়ে যায় আমার। অবশ্য, যোগ দেয়ার সময় শপথ করেই চাকরি নিয়েছি।’

কফি শেষে হেলান দিয়ে বসল রানা। ‘তার মানে, কিছুই জানা নেই আমাদের।’

‘সরি। তুমি হয়তো ভেবেছিলে জরুরি কিছু তথ্য দিতে পারব।’

‘আপাতত এক জায়গায় আটকে গেছি, তবে চিরকালের জন্যে নয়,’ বলল রানা।

‘বুঝি, প্রিয় মানুষগুলোকে মেরে ফেলেছে বলে খুব কষ্ট পেয়েছ। আমারও ভাল লাগছে না সাহায্য করতে না পেরে।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘এবার কী করবে ভাবছ?’ জানতে চাইল এলিস।

‘খুঁজে নেব ডেইটার গিসেলকে,’ বলল রানা। ‘বাদ পড়বে না তার দলের কেউ। চুকিয়ে দেব তাদের হিসাব।’

‘অনেক নিরাপদ কোথাও থাকে সে।’

‘তবুও একজন লোক কমে গেছে তার।’

‘আরও অনেকেই আছে। তারা ব্যানওয়ার্টের চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর।

‘এক এক করে সবার সঙ্গেই দেখা হবে,’ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল রানার মুখ। ‘বাদ পড়বে না ডেইটার গিসেলও।’

কৌতূহলী চোখে ওকে দেখল এলিস বেলা। ‘তুমি কি জেম্‌স্‌ বণ্ডের মত অতটা দক্ষ?’

‘আগেও এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েছি। এখনও মরিনি।’

‘তুমি আর্মিতে ছিলে, ঠিক বলেছি, তাই না?’

‘এ ছাড়া সামান্য ট্রেনিং নিয়েছি কারও কারও কাছ থেকে।’

‘অন্তত কর্নেল বা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলে?’

‘না।’

‘মনে হয় পরে বোধহয় যোগ দাও সিক্রেট সার্ভিসে।’ কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখল বেলা। ‘কোন্ দেশের মানুষ তুমি?’

‘মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়, আর নীচ শোষকদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে যে দেশ।’

‘বাংলাদেশ!’ বিড়বিড় করল বেলা। পরক্ষণে বিস্মিত চোখে দেখল ওকে। ‘তা… র মা… নে বি… সি… আই? তুমিই সেই মা…মা… মাসুদ রানা?’

চুপ করে থাকল রানা।

‘হাজারটা গল্প শুনেছি তোমার ব্যাপারে,’ ঢোক গিলে বলল বেলা। ‘ভেবেছি, আমিও একদিন হব তোমার মত বিখ্যাত দেশপ্রেমিক এজেন্ট!’

‘আমার চেয়ে অনেক বড় বড় সব এজেণ্ট ছিল অতীতে, এখনও আছে,’ সহজ সুরে বলল রানা, ‘ভবিষ্যতেও থাকবে।’

মাথা নাড়ল বেলা। ‘বিশ্বাস করি না! তার চেয়েও বড় কথা, আমি ভীষণ হিংসে করি তোমাকে! শুনেছি, আমার দেশের কর্তৃপক্ষের মত করে তোমাদেরকে নাকে দড়ি পরিয়ে ঘোরান না তোমাদের বস্ মেজর জেনারেল (অব.) খান।’

‘তাই শুনেছ?’ বসের প্রশংসা শুনে খুশি হয়েছে রানা। ‘হ্যাঁ, আমাদের ওপরওয়ালারা মনে করে নিরীহ মানুষ খুন হলে কিছুই এসে যায় না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য খেলায় জিতে যাওয়া। আমি এখন গিসেলকে গ্রেফতার করতে চাইলে, আমার পরিচয় ফাঁস হয়েছে বলে সরিয়ে দেবে এই কেস থেকে। সুযোগ পাব না টু শব্দ করার। নতুন করে লোকটাকে মুঠোয় পাওয়ার জন্যে ফন্দি আঁটবে এজেন্সি। আমরা তো ভাবতেও পারি না, কোনও এজেন্টের বিপদে তোমাদের মত দল বেঁধে বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ব। বিসিআই-এ এটা সম্ভব হয়েছে শুধু তোমাদের বসের কারণে। বুঝলে, রানা, তোমরা কাজ করো তাঁর তৈরি করে দেয়া সত্যিকারের স্বর্গের মত অফিসে!’

একটু হিংসে ও অঢেল প্রশংসা এলিস বেলার চোখে। কেন যেন মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেলল রানা। জানতে চাইল, ‘এবার কী করবে ভাবছ?’

‘ভাবছি, তোমার জিম্মি হিসেবে কিছু সুবিধে পাব,’ বলল এলিস। ‘যেমন ধরো, দু’পায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে ফিরতে হবে না অফিসে। অন্তত এখনই নয়। অন্যদের তুলনায় থাকব এক পা আগে। কাজও করতে পারব খোলা মনে। বাধা দেবে কে?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘জোট বাঁধতে চাও? সেক্ষেত্রে বলব, রাজি নই। একটু পরেই আলাদা হয়ে যাবে আমাদের পথ।’

‘তার মানে মুক্ত করে দেবে আমাকে?’

‘ওই যে ওদিকে দরজা, বাধা দিচ্ছি না,’ বলল রানা। ‘একঘণ্টা পর কমিশনার অ্যাল মার্লোর মতই তুমিও আর খোঁজ পাবে না আমার।’

‘কর্তৃপক্ষকে কী বলব?’

‘ভাল কোনও কাহিনী তৈরি করে সবাইকে জানাবে, মৃত্যুর ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে যাও মাসুদ রানার হাত থেকে। সবাই বলবে, তাই তো, সত্যিই তুমি হিরোইন!’,

‘আরেকবার ভেবে দেখো,’ বলল এলিস। ‘আমি কিন্তু অনেক কাজে আসব।’

আবারও মাথা নাড়ল রানা। ‘সাধারণত আমি কাজ করি একা। তোমাকে সঙ্গে নিলে গতি কমিয়ে দেবে তুমি।’

‘নিজেও জানো তা ভুল,’ বলল এলিস, ‘একাকী কেউ সবসময় সহজ শিকার। বিশেষ করে তোমার ক্ষেত্রে। এই মুখের ছবি যাবে খবরের কাগজের অফিসে। সন্ধ্যার আগেই বেরোবে পেপারের নতুন সংস্করণ। প্রচারিত হবে টিভি চ্যানেলে তোমার মুখের ছবি। আগামী কয়েক ঘণ্টায় চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে লাখ লাখ পোস্টার। সাধারণ মানুষ ভয় পাবে তোমাকে। যেখানেই যাবে, চট্ করে চিনবে। পালাতে পারবে না কোথাও। কিন্তু একসঙ্গে কোনও দম্পতিকে দেখলে সন্দেহ করবে না কেউ। ভাববে, স্বামী-স্ত্রী চলেছে নিজেদের কাজে।’

‘তুমি নিজেই বলেছ, উপযুক্ত ট্রেনিং নেই তোমার।’

‘আমি চট্ করে শিখতে জানি। তা ছাড়া, অবাক করে দিতে পারব তোমাকে।’

‘অনর্থক বিস্মিত হব কেন,’ মস্ত হাই তুলল রানা। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। একগাদা ক্যাফেইনও কাজ করেনি। ওর মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়বে এখানেই।

‘তোমার এখন বিশ্রাম দরকার,’ বলল এলিস। ‘ক্লান্তিতে খুন হয়ে যাচ্ছ।’

‘তা ঠিক,’ বলল রানা, ‘নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাই। সেজন্যে একা থাকা খুব জরুরি। নইলে ঘুম থেকে জেগে দেখব, আমার মুখের দিকে তাক করে রেখেছ পিস্তলের মাল।’

‘তুমি ভয় পাচ্ছ, সুযোগ পেলেই তোমাকে গ্রেফতার করব?’

‘কথাটা যে মাথায় আসেনি, তা বলব না।

মিষ্টি হাসল এলিস বেলা। ‘সত্যি বলতে, রানা, ইচ্ছে করলে বেশ ক’বার তোমাকে গ্রেফতার করতে পারতাম। যেমন, প্রথম সুযোগ ছিল হামার থেকে নামার পর। ওই যে সিট থেকে নামাতে গিয়ে টেপ কাটলে? তারপর আবারও দুই কবজিতে আটকে দিলে টেপ? বা যখন ছিলাম তারপুলিনে নিচে! অথবা এখানে এই রেস্তোরাঁয় আসার পর। এমন কী এখনও গ্রেফতার করতে পারি চাইলে।’

‘কী করে?’ ভুরু নাচাল গম্ভীর রানা।

‘জানি, তোমার প্রায় সব অস্ত্র গাড়িতে। যদিও জ্যাকেটের পকেটে গুক, তাতে কী, তুমি অতিরিক্ত ক্লান্ত। চট্ করে দেখাতে পারবে না প্রতিক্রিয়া। আসলে সে সময়ই পাবে না। তার আগেই বের করব আমার অস্ত্র।’

‘তোমার সঙ্গে তো অস্ত্রই নেই,’ বলল রানা। ‘কাঁটা চামচ হাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে? উপড়ে নেবে আমার চোখ?’

মধুর হাসি দিল এলিস বেলা। ‘ব্রিটিশ আর্মির বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং নিয়েছ, তারা শিখিয়ে দেয়নি সুন্দরী মেয়ের গোপনাঙ্গের কাছে থাকতে পারে আরও কোনও অস্ত্র? অথবা তুমি এতই ভদ্রলোক, হাতড়ে দেখলে না আমার আণ্ডারওয়্যার।’ টেবিলের তলা থেকে হাত বের করল মেয়েটা। মুঠোয় পলিমার ও স্টিলের তৈরি ছোট একটা কালো অটোমেটিক পিস্তল!

চট্ করে আবারও টেবিলের নিচে চলে গেল ওটা।

‘তোমাকে হ্যালো বলল আমার মাইক্রো কেল-টেক,’ হাসল এলিস, ‘সাতটা .৩৮ ক্যালিবারের গুলি। রেস্তোরাঁয় ঢোকার আগে থেকেই যে-কোনও সময়ে খুন করতে পারতাম তোমাকে। আইন আমার পক্ষে। সরকারি এজেন্টকে কিডন্যাপ করা যা-তা কথা নয়। নিজেকে রক্ষার সম্পূর্ণ অধিকার আছে আমার।’

রানার জ্যাকেটের পকেটে পিস্তল থাকলেই বা কী? বিরস চোখে এলিস বেলাকে দেখল বিসিআই এজেন্ট।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *