বিশ
দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হলেও তাতে বেশ অভ্যস্ত রানা। চুপ করে বসে আছে গাড়ির ভেতর। কেউ ভাবতেও পারবে না প্রায় নিথর এই যুবক মুহূর্তে হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। চোখ রেখেছে বাড়ির দরজার ওপর। একটু আগে নেমেছে রাতের আঁধার। কিছুক্ষণের মধ্যেই নীল হুডি পরা এক কিশোর এসে থেমেছে দরজার কাছে। পরনে ফ্যাকাসে নীল জিন্স, পায়ে সাদা ট্রেইনার কেস্। ছেলেটার বয়স বড়জোর পনেরো। কার জন্যে যেন অপেক্ষা করছে।
ক’মিনিট পেরোবার পর বাড়ির সামনে থামল তুবড়ে যাওয়া এক বিএমডাব্লিউ গাড়ি। ওটা থেকে নামল অপেক্ষাকৃত লম্বা তিন তরুণ। তারা ছেলেটার চেয়ে বয়সে বছর চারেক বড়। পরনে একই ধরনের পোশাক।
এরা সবাই একই দলের।
ছেলেটাকে বাইরে রেখে বাড়ির ভেতর হারিয়ে গেল তিন তরুণ।
এরই ভেতর রানা বুঝেছে, ওরা ওই বাড়ির কেউ নয়। তবে হাঁটাচলা দেখলে যে কেউ ভাববে, চারপাশের সবকিছুর মালিক তারাই।
এ ধরনের ছেলেরা হয় অত্যন্ত নির্মম ও বেপরোয়া। আর এদের কারণেই এত সফলভাবে চলে ড্রাগসের ব্যবসা। প্রতিটি ধাপে থাকে একজন করে বস। তার কথা মেনে চলে নিচের কর্মীরা। চোখ রাখা হয় নিচের সবার ওপর। দলের প্রথম ধাপের কর্মীর কাজ ড্রাগ বিক্রির আস্তানার সদর দরজার দিকে চোখ রাখা। বিপদ দেখলেই ওপরের ধাপের তরুণকে ফোন করে সে। সেই বিপদ হতে পারে এলাকায় পুলিশের রেইড, বা বিপক্ষ দলের হামলা। অন্য দলের আক্রমণ হলে চট্ করে ভেগে যায় না এলাকা দখলকারী দলটি। গোলাগুলি শুরু হলে বেশিরভাগ সময় লড়াই শেষ হয় রক্তারক্তির মাধ্যমে। তবে পুলিশের রেইড হলে নজরদার ছেলেটা খবর জানিয়ে দিলেই দেরি না করে পালিয়ে যায় বাড়ির ভেতরের ড্রাগ বিক্রেতা। এরা দ্বিতীয় স্তরের কর্মী। তাদের মাধ্যমেই হুড়মুড় করে ড্রাগ লর্ডদের হাতে পৌঁছায় টাকা। কপাল ভাল হলে প্রতিদিন প্রতিটি বিক্রেতার কাছ থেকে আসে বারো থেকে পনেরো হাজার ইউরো। গাঁজা থেকে শুরু করে সব ধরনের ড্রাগ বিক্রি করে বলে খুব সতর্ক থাকে বিক্রেতারা। বিপদ আসছে শুনলেই ড্রাগ নিয়ে পালিয়ে যায় বাড়ি ছেড়ে।
আজকের রাতের পরিবেশ গুমোট। আকাশে একটা তারা নেই। বাতাসে কেমন তার পোড়া একটা গন্ধ। বোধহয় বেশিক্ষণ লাগবে না বজ্রপাত সহ ঝড়বৃষ্টি শুরু হতে। বাড়ির সামনে রাস্তার ল্যাম্প পোস্ট থেকে আলো পড়েছে ডিলারের বিএমডাব্লিউ গাড়ির ওপর। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে জগতের সব রঙ। রানার সামনের দৃশ্যটা যেন ক্যামেরায় তোলা উনিশ শতাব্দীর লালচে হয়ে যাওয়া পুরনো ছবি।
তিলতিল করে পেরিয়ে চলেছে সময়। এখন বাজে রাত দশটা। আর বেশিক্ষণ লাগবে না, হাজির হবে খদ্দেররা। আপাতত রাস্তা প্রায় ফাঁকা। হামারের দরজা খুলে নেমে পড়ল রানা। গাছ ও ঝোপঝাড়ের ছায়ার মাঝ দিয়ে চলল বাড়ির দিকে। জ্যাকেটের নিচে ধরে রেখেছে রাইফেল। অনায়াসেই লুকিয়ে রাখা যায় সাবমেশিন গানের মত। ডান বগলের কাছে ওটার বাঁট। কোমরের কাছে ঝুলছে বেঁটে-মোটা নল। চট্ করে কেউ বুঝবে না, ওটা ফুল বোর অ্যাসল্ট রাইফেল- বুলপাপ। দ্বিতীয়বার ওদিকে চোখ গেলে শত্রু বুঝবে, এখন প্রথম কাজ হওয়া উচিত প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু দ্বিতীয়বার দেখার কোনও সুযোগই পেল না এই বাড়ির সামনের নজরদার। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে তার ঘাড়ের কাছে পৌঁছে গেছে রানা।
ছেলেটা কিছু বোঝার আগেই জ্যাকেট থেকে FAMAS রাইফেল বের করে তার মুখের দিকে তাক করল ও। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় কাছ থেকে ছেলেটাকে দেখে মনে হলো, তার বয়স হবে ষোলো। ওপরের ঠোঁটে পাতলা গোঁফ। কিশোর বয়সী হলেও শিখছে সে দ্রুত। নিজের নাক বরাবর রাইফেলের নল আর কঠোর চেহারার এক লোককে দেখে বিস্ফারিত হলো তার দু’চোখ।
একহাতে রাইফেল ধরেছে রানা। অন্যহাত বাড়িয়ে দিয়েছে কিশোরের দিকে। নিচু গলায় বলল, ‘তোমার ফোনটা।’
সরু হয়ে গেল ছেলেটার দুই চোখ। প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে রাখল রানার বাড়ানো তালুর ওপর।
ফুলে আছে ছেলেটার প্যান্টের ব্যাক পকেট। ওটার দিকে ইশারা করল রানা। ‘এবার ওটাও দাও।’
নব্য গ্যাংস্টার হওয়ার জন্যে শিখছে নানান চাতুরি। একতিল নড়ল না ছেলেটা। তবে ওই লোকটার চোখ ভীষণ কঠোর। বাড়ানো হাতটা ফিরিয়ে এনে রাইফেলের সামনের কালো পলিমারের গ্রিপ চেপে ধরল রানা, চট্ করে পিস্তল গ্রিপ থেকে ডানহাত চলে গেল রিসিভারের ওপর। খটর খট আওয়াজে চেম্বারে ঢুকল ইশতিয়াকের ৫.৫৬×৫৪ এমএম ন্যাটো বল অ্যামিউনিশন। ওই শব্দে গলা শুকিয়ে যাবে যে কারও। এবার আর ছেলেটার সময় লাগল না পকেট থেকে মোবাইল বের করে রানার দিকে বাড়িয়ে দিতে।
ওটা নিয়ে সহজ সুরে বলল রানা, ‘ফিরে যাও মায়ের কোলে। আর কখনও এখানে এসো না।’
বাড়িটার দিকে দ্বিতীয়বার না চেয়ে ছুটল কিশোর ছেলেটা। বুঝে গেছে, আজই শেষ হতে যাচ্ছিল ওর জীবন। আবারও জ্যাকেটের ভেতর রাইফেল রাখল রানা। একবার দেখল ডানে ও বামে। আশপাশে কেউ নেই। বোধহয় এরই ভেতর প্রথম খদ্দেরের জন্যে অপেক্ষা করছে ড্রাগ ডিলার। তবে আজকে বিস্মিত হতে হবে তাকে। বাতির নিচ দিয়ে হেঁটে গিয়ে ময়লা কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল রানা। সামনেই ফয়ে। বাতাসে ভাসছে প্রস্রাবের দুর্গন্ধ। কয়েক গজ দূরে ধাতব রেইলিং দেয়া ওপরে ওঠার সিঁড়ি। নোংরা সব মন্তব্য লেখা দেয়ালে, কখনও রঙ করা হয়নি। প্রস্রাব ও বিয়ারের দাগে ভরা সিঁড়ির ধাপ নেড়া কংক্রিটের তৈরি। মেঝেতে শুকনো বমি ও রক্ত। এ বাড়িতে পরিষ্কার কর্মীর ঠাঁই নেই। ওপর থেকে আসছে ধুপধুপ শব্দে রক মিউযিকের গর্জন। সেটাকে দমিয়ে দেয়ার জন্যে চিৎকার করে কাঁদছে এক বাচ্চা ছেলে। তাকেও ছাপিয়ে উঠেছে এক মহিলার তর্জন-গর্জন।
রানা যেমন ভেবেছে, সেভাবেই প্রথমতলার সিঁড়ির ল্যাণ্ডিঙে দাঁড়িয়ে আছে সেই তিন তরুণ ডিলার। পায়ের কাছে পেটমোটা এক স্পোর্ট ব্যাগ। ওটার ভেতরের জিনিস বিক্রি হলে হয়তো সে টাকায় কেনা যাবে ব্র্যাণ্ড নিউ কোন ও মার্সিডিয গাড়ি। বামের তরুণের চোখ দেখে রানা বুঝল, নিজেও সে ড্রাগ অ্যাডিক্ট। ডানের তরুণ অতিরিক্ত মোটা। বিপদ হলে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। মাঝের জনকে মনে হলো সতর্ক। দলের নেতা সে-ই। তার দিকে চোখ রেখে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা। ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে তাদের পাশ কাটিয়ে চলেছে ওপরতলায়। কিন্তু তিন ধাপ উঠেই ঘুরে তিন ডিলারের দিকে রাইফেল তাক করল রানা। ও নিজে আছে ওপরের ধাপে। এদিক দিয়ে পালাতে পারবে না তিন তরুণ। নিচতলা দিয়েও পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া, এরা ভাববে একা আসেনি এই লোক। সামনের দরজা পাহারা দিচ্ছে দলের অন্যরা।
সতর্ক তরুণের দিকে রাইফেল তাক করল রানা। ঝামেলা এলে তা আসবে এর কাছ থেকেই। তবে এদের মত ছোট ডিলারের কাছে সাধারণত আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না। এদের দৌড় সুইচ-নাইফ পর্যন্ত। ড্রাগস্ দলের ওপরের ধাপ থেকে শুরু পিস্তলের চল। নিজেদের প্রতিটি কুকীর্তির জন্যে তৃতীয় স্তরের যুবকের কাছে জবাবদিহি করে ডিলার। সে যুবকের পদ অনেকটা ম্যানেজারের মত। দলে নতুন সদস্য নেয়া, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা, এবং বেশি বাড়াবাড়ি করলে খুন করা তার দায়িত্ব। নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ম্যানেজার। কয়েকটি বাড়ির তিন থেকে চারজন ডিলারের মাধ্যমে বিক্রি করে ড্রাগ্স্। ওই তিন বা চার বাড়ি পাহারায় থাকে দশ থেকে বারোজন কিশোর। প্রতিটি বাড়ি থেকে যে টাকা সংগ্রহ করে ম্যানেজার, সব পৌঁছে দেয় মাঝ স্তরের এক নেতার কাছে। মধ্যবয়স্ক সেই লোক সিনিয়র ম্যানেজার। কতগুলো বাড়ি নিয়ন্ত্রণ করবে, তা নির্ভর করে তার বয়স, সাহস ও চাতুরির ওপর। ওই স্তর থেকেই শুরু ওপরে ওঠার মইয়ের প্রথম ধাপ। এই এলাকার ম্যানেজারকে চেনে রানা। এখানে এসেছে তার কাছ থেকে জরুরি তথ্য পাওয়ার আশায়। তবে নিচের সবাইকে ঘাবড়ে না দিলে দেখা দেবে না ম্যানেজার। নিচের সবার ওপর চোখ রাখছে সে। দলের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু করলে শাস্তি দেবে। উৎসাহিত করবে বিশ্বস্ত হতে। কেউ বেইমানি করলে তার নির্দেশেই খুন হবে সেই তরুণ।
নিষ্কম্প হাতে রাইফেল ধরে জানতে চাইল রানা, ‘এখনও এ এলাকা ড্যামিকো কর্মিনির?’ বদ্ধ জায়গায় হাই-ভেলোসিটি ৫.৫৬ ন্যাটো বুলেট যে বিকট আওয়াজ করবে, তাতে উপস্থিত সবার কানের পর্দা ফাটবে। ছিন্নভিন্ন হবে মাঝের তরুণের মগজ। অবশ্য রানা চাইছে না গুলি করে নিজের কানের বারোটা বাজাতে।
বড় বড় চোখ করে ওকে দেখছে বামদিকের ড্রাগ আসক্ত তরুণ। মোটা ছেলেটা যেন ভারী শরীরের খরগোশ, রাতের আঁধারে শিকারির টর্চের আলোয় চমকে গেছে। ভ্রু কুঁচকে ফেলেছে মাঝের সতর্ক তরুণ। এটা অন্য দলের স্বাভাবিক হামলা বলে মনে হচ্ছে না তার। আস্তে করে মাথা দোলাল সে।
‘শুনি কার হয়ে কাজ করে ড্যামিকো কর্সিনি,’ বলল রানা। খদ্দের বা ভাড়াটিয়ারা হাজির হওয়ার আগেই নিজের কাজ শেষ করে বিদায় নিতে চাইছে ও।
‘তাঁর নাম লিওন,’ বলল মাঝের তরুণ।
‘লিওন কে?’
‘লিওন সিমন।’
‘তাই?’
‘সবাই ভীষণ ভয় পায় তাকে। মুচড়ে যাওয়া বিকৃত শরীর।’
‘ঠিক আছে,’ বলল রানা। ‘এবার ড্যামিকোকে ফোন দাও। ওকে বলবে আমি এখানে এসেছি। ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। যেন চলে আসে। যদি পাঁচ মিনিটের ভেতর পৌঁছে যায়, কোনও ঝামেলা হবে না। তবে দেরি হলে গুলি করে মারব তোমাদের তিনজনকে। তারপর ব্যাগের মালপত্র নিয়ে চলে যাব। তার আগে আগুন দেব এ বাড়িতে। রেহাই পাবে না তোমাদের অন্য বাড়িগুলোও। এরপর আমার কাজ শেষ হলে লিওন সিমনকে জানিয়ে দেব, ওর সঙ্গে বেইমানি করেছে ড্যামিকো।’
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে বাটন টিপতে লাগল মাঝের তরুণ। চোখ সরায়নি রানার ওপর থেকে। ‘কী নাম বলব আপনার?’
‘আমার বর্ণনা দাও, চিনে নেবে,’ বলল রানা।
ওদিক থেকে ফোন কল রিসিভ হতেই বলল তরুণ, ‘বস্, এক লোক এসে আপনাকে খুঁজছে।’ কথা শুনছে সে। ‘হ্যাঁ, এখানে এসেছে। বলছে আপনাকে ভাল করেই চেনে।’ কী ধরনের হুমকি দেয়া হয়েছে, গড়গড় করে বলল ডিলার। ওদিক থেকে শুনছে ড্যামিকো কর্সিনির কথা। রানার ওপর থেকে চোখ সরছে না তিন তরুণের। ‘হ্যাঁ, মিথ্যা বলছে বলে মনে হচ্ছে না। আমাদের খুন করার পর বাড়ি তো পুড়িয়ে দেবেই, নিয়ে যাবে সব মাল। আর তারপর পুড়িয়ে দেবে অন্য বাড়িগুলোও।’ চুপ করে কী যেন শুনছে তরুণ। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘গায়ের রঙ বাদামি। ইউরোপিয়ান না। কথা বলে শুদ্ধ ভাষায়। চোখদুটোর মণি কালো ছুরির মত। বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। কুচকুচে কালো চুল। লম্বায় প্রায় ছয় ফুট। গায়ে চামড়ার জ্যাকেট। বিরাট এক চুতিয়া রাইফেল, বস্! আপনার বোধহয় কথা শুনে চলাই ভাল।
ওদিক থেকে কোনও জবাব এল না। ভাবছে ড্যামিকো কর্সিনি। কয়েক মুহূর্ত পর কী যেন বলল। মাথা দোলাল ডিলার। ফোন রেখে জানাল, ‘রওনা হয়ে গেছে বস্।’
রাইফেল নামিয়ে জ্যাকেটের ভেতর রাখল রানা। ঠিক আছে, চুপচাপ বসো মেঝেতে।’
শুকনো বমি ও রক্তের ভেতর বসল তিন তরুণ। নীরব সবাই। দরকার হলে মুহূর্তে রাইফেল বের করবে রানা। একটু পর নিচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সরু এক সাদা লোক। নাকে বড় একটা দুল। এসেছে ড্রাগ কিনতে। তিন ডিলার ও রানাকে দেখে হঠাৎ তার মনে হলো, কোথাও কোনও গোলমাল আছে। ঘুরেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। ওপরতলায় এখনও গর্জন ছাড়ছে সেই মহিলা। বেসুরো কেঁদে চলেছে বাচ্চা ছেলেটা। ধুপ-ধাপ বিটে বাজছে মিউষিক।
দশটা সাতান্ন মিনিটে বাড়ির বাইরে থেকে এল কড়া ব্রেকের আওয়াজ। ধুম করে বন্ধ হলো গাড়ির দরজা। বাড়ির কাঁচের দরজা খুলে প্রায় দৌড়ে ঢুকল এক যুবক। বয়স পঁয়ত্রিশ মত। ড্যামিকো কর্সিনি। দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। পরনে ফুল তোলা শার্ট ও জিন্স প্যান্ট। টাক পড়তে শুরু করেছে মাথায়। পনি টেইল নেমেছে পিঠের কাছে। গতবার যখন অস্ত্রের মুখে তাকে রেখেছিল রানা, তার চেয়েও রুক্ষ হয়েছে ড্যামিকোর চেহারা।
রানাকে দেখে বিস্ফারিত হলো তার চোখ। একবার মাথা নাড়ল। ‘হায়, যিশু! একেবারে চুতিয়া হয়ে গেলাম! আবারও সেই তুমি? আর আমি ভেবেছি বাকি জীবনেও আর দেখা হবে না!’
‘জীবন অনেক বড়, ড্যামিকো,’ বলল রানা। মেঝেতে বসে থাকা তিন তরুণকে পাশ কাটাল ও।
‘আবার কী চাই?’ বারকয়েক মাথা নাড়ল ড্যামিকো 1
‘আমি তোমাকে চাই, ড্যামিকো,’ বলল রানা। সিঁড়ি থেকে নিচে নেমে জ্যাকেটের ভেতর থেকে রাইফেল বের করল ও। মোটা নল দিয়ে মাঝারি একটা বাড়ি দিল ম্যানেজারের মাথার পাশে। উল্টে গেল লোকটার দুই চোখ। অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল সে। কাণ্ড দেখে হাঁ হয়ে গেছে তিন ডিলার। সাহস নেই যে কিছু করবে। ঝুঁকে ড্যামিকোর শার্টের কলার চেপে ধরল রানা। অজ্ঞান লোকটাকে ছেঁচড়ে নিয়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে গেল বাইরে। রাস্তায় না থেমে ভারী বোঝা টেনে চলে গেল ছায়ায় রাখা হামারের পাশে। আকাশে জমেছে ঘন কালো মেঘ। তার বুকে ঝিলিক দিচ্ছে সাদা তলোয়ারের মত রুপালি বিদ্যুৎ। বাতাসে পোড়া প্লাস্টিকের মত গন্ধ। আজকের ঝড়টা বোধহয় তীব্র হবে।
রিপার চাবি ব্যবহার করে হামারের দরজা খুলল রানা। প্যাসেঞ্জার সিটের একপাশে রাখল ফ্যামাস রাইফেল। ড্যামিকো কর্সিনিকে সার্চ করল। পেল ফোন ও নিকেল প্লেটের বেরেটা সেমি অটোমেটিক। পিস্তলটা ছিল কোমরের পেছনে হোলস্টারে। ওটা নিজের বেল্টে গুঁজল রানা। বেলফেগর ট্রাকের লাশের চেয়ে বেশি যত্ন পেল না ড্যামিকো, তাকে তুলে ভারী বস্তার মত প্যাসেঞ্জার সিটের সামনে মেঝেতে ফেলল রানা। চেপে বসল ড্রাইভিং সিটে। ইঞ্জিন চালু করে চাকার গা রি-রি করা আওয়াজ তুলে রওনা হলো। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে তুলল তুমুল গতি।
ঝড়ের বেগে তিন কিলোমিটার গিয়ে ব্রেক কষে থামল রানা। হামারের ড্যাশবোর্ডে জমা পড়েছে চারটে মোবাইল ফোন। একটা পেয়েছে খুনির লাশ থেকে, দুটো নজরদার ছেলেটার, আর শেষেরটা ড্যামিকোর। কিশোর ছেলেটার দুই ফোন রাস্তায় ফেলল রানা। হাতে নিল ড্যামিকোর ফোনটা। ওটার ভেতর রয়েছে মাত্র একটা নম্বর। রানা বুঝে গেছে, ওটা কার। ডায়াল করতেই শুনল ওদিকে বাজছে রিং টোন। কয়েক সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে এল পাথরের মত কণ্ঠ: ‘কী ব্যাপার; ড্যামিকো?’
মৃদু হাসল রানা। ওই পাথুরে কণ্ঠ ওর চেনা। নরম সুরে জানতে চাইল ও, ‘কেমন আছ, সিমন?’
একুশ
অত্যন্ত জটিল মন ও বিকৃত দেহের লোক লিওন সিমন। তরুণ বয়সে তাকে নয়বার গুলি করে ফেলে দেয়া হয় উঁচু সেতু থেকে নিচের নদীতে। রক্তাক্ত দেহে তলিয়ে যায় পানির নিচে। কিন্তু তিন মাস পর আবারও তাকে দেখা গেল মার্সেই শহরে। খুন হয়ে গেল বিপক্ষ দলের তিন খুনি। তাতেই আণ্ডারওঅর্ল্ডে ছড়িয়ে পড়ল তার সুখ্যাতি। মেরুদণ্ডে গুলি লেগেছিল বলে বাঁকা হয়ে গেছে দেহ। ঠিকভাবে ফেলতে পারে না একটা পা।
অপরাধ জগতে আলাদা এক কদর আছে তার। ক্রাইম বস হিসেবে মস্ত বড়লোক হতে পারেনি সে। তবে অন্য অনেকের চেয়ে ভাল করেছে বেআইনি ব্যবসা করে। বেশ কয়েকটা বার ও ক্লাবের মালিক। অন্যান্য সব ব্যবসার পাশাপাশি বিক্রি করে তথ্য। বিসিআই-এর নতুন এজেন্ট লিমা আশরাফকে কিডন্যাপ করেছিল ব্রিটিশ কিডন্যাপাররা, আর এ বিষয়ে খোঁজ নেয়ার জন্যেই সিমনকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল রানা। বেশি মারধর করেনি। তাতে সম্মান আরও বেড়েছে লোকটার। কিডন্যাপারদের কপাল ছিল খুব মন্দ। আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি সব কটা লাশ।
‘আমি তো ভেবেছিলাম মারা গেছ,’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে রানাকে বলল লিওন সিমন। কণ্ঠস্বরে বিরক্তি।
‘কপাল ভাল ছিল না,’ বলল রানা।
তো আবারও এসেছ মার্সেইতে?’
‘তা-ই তো মনে হয়,’ বলল রানা। ‘ব্যক্তিগত কাজে তোমার সাহায্য চাই। বলে দাও কোথায় দেখা করব।’
‘আমি খুব ব্যস্ত মানুষ, মাসুদ রানা। কী চাও আমার কাছে?’
‘আগের মতই, তথ্য। যাতে ঠিক দিকে যেতে পারি।’
‘কিন্তু তোমার সঙ্গে কার কী হয়েছে, তার কিছুই জানি না।’
‘তুমি তো মার্সেইর সবাইকে চেনো, সিমন। এ শহরের প্রতিটি খারাপ খবর তোমার কাছে পৌঁছায়। আমি যে বিষয়ে জানতে চাইব, সেটা তোমার জানা থাকার কথা।’
‘শুনি বহু কিছুই। তবে এখন আর তথ্য বিক্রি করি না।’ ক’মুহূর্ত পর বলল সিমন, ‘আগের চেয়ে অনেক বড় মাছ ধরি। তা ছাড়া, তোমার সঙ্গে আমার কোনও খাতির নেই।’
‘মাত্র পাঁচটা মিনিট নেব, বলল রানা। ‘কিছু না জেনে থাকলে আর বিরক্ত করব না।’
‘শুনে খুব খুশি হলাম। আমি কত পাব?’
‘খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে আরও কিছু দিন। এটা বড় প্রাপ্তি।’
‘এজন্যেই তো তোমাকে পছন্দ করি না, মাসুদ রানা! না, আমি তোমাকে একটুও ভালবাসি না।’
‘তা ছাড়া, ফেরত দেব ড্যামিকো কর্সিনিকে,’ বলল রানা।
নীরব হয়ে গেল লাইন। মিনিটখানেক পর বলল সিমন, ‘কী কারণে তোমার মনে হলো, ওই কুকুরের বাচ্চাটাকে ‘আমি চাই?’
‘ভান কোরো না সিমন,’ বলল রানা, ‘ভাল করেই জানি তোমরা বিছানার পার্টনার। যদিও জানি না দু’জনের ভেতর কার রুচি বেশি খারাপ।
‘পাঁচ মিনিট দেব।’
‘তাতেই চলবে।’
‘মারধর করবে না তো?’
‘তুমি বাড়াবাড়ি না করলে কিছুই করব না,’ বলল রানা।
‘এখন আছি ক্লাব প্যারাডাইসে। রু দু ভ্যালন মণ্টেবেলোয় ওটা। চেনো?’
হাতঘড়ি দেখল রানা। রাত এগারোটা পনেরো মিনিট। ‘ত্রিশ মিনিট পর দেখা হবে,’ জানিয়ে দিল রানা।
রু দু ভ্যালন মন্টেবেলোয় পৌঁছল রানা রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে। ক্লাবের সদস্যদের গাড়ি থেকে এক শ’ গজ দূরে রাখল হামার। গালে কয়েকটা চড় দিতেই চটকা ভাঙল ড্যামিকোর। তাকে হাতের ইশারা করে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে গাড়ি থেকে নামল রানা। ওর নির্দেশে সামনে হাঁটতে লাগল লোকটা। খুব অখুশি।
এরই ভেতর রাস্তা ভরে গেছে নাইট ক্লাবারদের গাড়ির ভিড়ে। একদিকের ফুটপাথে খদ্দের খুঁজছে পতিতারা। আলোয় ঝলমলে কয়েকটা দোকান পাশ কাটিয়ে ক্লাবের দিকে চলল রানা ও ড্যামিকো। সামনের বাঁকের কাছে থেমেছে এক লোক। তার মোটর সাইকেলটা হার্লে ডেভিডসন। তবে খুলে ফেলেছে সাইলেন্সার। ফলে যে জোরালো ভ্যাট-ভ্যাট আওয়াজ হচ্ছে, যে কেউ ভাববে পৃথিবীর সবচেয়ে মোটা লোকটা ঘুম থেকে উঠেই শুরু করেছে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ। কারও খেয়াল নেই কালো আকাশ ভারী করেছে নিজের মুখ। গুড়গুড় করে উঠল মেঘ। যে-কোনও সময়ে বড় বড় ফোঁটায় শুরু হবে বৃষ্টি।
ক্লাব প্যারাডাইসের ভেতরে হৈ-চৈ ও মিউযিকের হুঙ্কার। মঞ্চে যে যার খুঁটি জড়িয়ে ধরে নেচে চলেছে উলঙ্গ কয়েকটা মেয়ে। বাতাসে ঘাম, বিয়ার ও মদের বাজে গন্ধ। ড্যামিকোকে ঠেলে ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগোল রানা। কারও খেয়াল নেই ওদের দিকে।
বারের একপাশে লাল বৈদ্যুতিক সাইনবোর্ডে লেখা: প্রাইভেট।
ড্যামিকোকে নিয়ে ওদিকে এগোল রানা। বারের পাশ দিয়ে ঢুকল খাটো করিডোরে। একপাশে মজবুত কাঠের দরজার সামনে বিশাল আকারের এক লোক। মোষের কাঁধের মত চওড়া কাঁধ। ন্যাড়া মাথা। থুতনিতে চারকোনা দাড়ি। পরনে তিন সাইয ছোট টি-শার্ট। দরজার সামনে যেন আস্ত পাহাড়। রানার চেয়ে অন্তত দেড় ফুট উঁচু। রানা বুঝল, হয় এ বারের বাউন্সার, নইলে সিমনের বডিগার্ড। কড়া চোখে ওকে দেখল দানব। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল প্রাইভেট লেখা বৈদ্যুতিক বোর্ড।
বরফের মত ঠাণ্ডা হাসল রানা। ড্যামিকোকে দেখিয়ে হৈ- চৈয়ের ওপর দিয়ে বলল, ‘একে পৌঁছে দেব সিমনের কাছে। আমার জন্যে অপেক্ষা করছে সে।’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কী যেন ভাবতে লাগল দানব। কয়েক সেকেণ্ড পর সরে গেল দরজার সামনে থেকে। ড্যামিকোকে ঠেলে ওদিকে ঢুকল রানা। আরেকটা ছোট প্যাসেজে তিনটে দরজা। মুখোমুখি দুটো, অন্যটা একটু দূরে। শেষ দরজা একটু চওড়া। ড্যামিকোর বাইসেপ ধরে এগোল রানা। দরজায় নক না করেই ঢুকল ভেতরে। নিচু গলায় বলল, ‘সব ভালই গুছিয়ে নিয়েছ, সিমন।’
ঘর চৌকো ও প্রায় অন্ধকার। ডেস্কে জ্বলছে কম ওয়াটের ল্যাম্প। রানার মনে হলো চারদেয়াল থরথর করে কাঁপছে ক্লাবের মিউযিকের ধাক্কায়। ছাতে কুয়াশার মত জমেছে সিগারের ঘন ধূসর ধোঁয়া। লিওন সিমন বাস করে কার্বন মনোক্সাইডের দুনিয়ায়। সে ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই। দরজার দিকে মুখ করে ডেস্কের পেছনে আয়েস করে বসেছে চামড়ার বিশাল চেয়ারে। পেছনের দেয়ালে কালো এক বড় সিন্দুক। খোলা ওটার ডালা। ভেতরে থরে ধরে টাকা দেখল রানা। চুটিয়ে ব্যবসা করছে লোকটা।
একদম বদলাওনি, মাসুদ রানা, বলল সিমন। হাসিটা তার লোভী কুমিরের মত। যেন এইমাত্র নদীর তীরে পেয়েছে শিশু ওয়াইল্ডাবিস্ট। পার্চমেন্টের মত খসখসে ত্বক। চোখে গোল ছোট চশমা। পড়ে গেছে মাথার বেশিরভাগ চুল। পরনে সিল্কের আর্মানি সুট। তবে ঠিকভাবে ফিট হয়নি। সিমন বসে থাকলেও মুচড়ে আছে মেরুদণ্ড।
পেছনে দরজা বন্ধ করল রানা। ‘খুশি হতাম তোমার ব্যাপারে একই কথা বলতে পারলে। আবারও পড়ে গিয়েছিলে উঁচু সেতু থেকে?’
‘আগের মতই দেখছি কৌতুকপ্রবণ,’ বলল সিমন। সিগারে টান দিয়ে সেঁধিয়ে গেল চেয়ারের আরও গভীরে।
‘এই যে তোমার লাভার বয়,’ ঘরের কোণে আরেকটা চেয়ার দেখে ওটার ওপর ড্যামিকোকে ঠেলে ফেলল রানা।
‘বাড়িতে ঢুকেই…’ শুরু করেছিল ড্যামিকো।
হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিল সিমন। চেহারা আবারও হয়েছে কুমিরের মত। ‘তুমি কি জানো যে তুমি আসলে একটা নির্বোধ, ড্যামিকো?’
‘আমার কী করার ছিল? বলেছে, তার সঙ্গে দেখা না করলে বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেবে!’
‘দাম আছে আমার কথার,’ বলল রানা।
‘বেশি তেড়িবেড়ি করলে বুঝবে এ এলাকা কার।’ সিগারে আরেকটা টান দিল লিওন সিমন।
‘যে কাজে এসেছি, সে বিষয়ে মুখটা খোলো, বলল রানা।
‘কী জানতে চাও?’
ডেস্কের সামনে থামল রানা। অফিসের অন্য আসবাবপত্রের মতই কালো ওটা। ওপরে সবুজ চামড়া মোড়া। ডেস্কের মাঝে নিজের ব্যাগ নামাল রানা। ভারী আওয়াজ হলো ওটার ভেতর থেকে।
কান খাড়া করেছে সিমন। ‘আমি অস্ত্রের ব্যবসা করি না।
‘ব্যাগে অন্যকিছু,’ বলল রানা। টান দিয়ে খুলল ব্যাগের চেইন। ভেতর থেকে নিল সোনার বার। ল্যাম্পের আলোয় চকচক করছে ওটা। ধপ করে ফেলল টেবিলের ওপর। চটে গেল টেবিলের কাঠের বার্নিশ।
তাতে বিরক্ত নয় লিওন সিমন। সোনার বারের ওপর থেকে সরাল না চোখ। ‘ওটা কি সত্যিকারের?
‘আরও অনেক আছে,’ বলল রানা, ‘অন্তত ছিল। আর সেজন্যেই এসেছি তোমার কাছে। জানতে চাই গত বারো ঘণ্টার ভেতর সোনার চালান শহরে এনেছে কে। তুমি তো একেবারে নিচ থেকে শুরু করে সবাইকে চেনো। আমার দরকার আসল লোকটার নাম আর ঠিকানা।’
‘সোনার চালান কত বড়?’ সোনালি পাতের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছে না সিমন।
‘অনেক বড়। কাজটা বোধহয় করেছে রাশানরা।’ সিমনের চেহারায় ভর করল হতাশা। ‘সত্যিই হাতে নিয়েছে ক’টা বড় কাজ। কিন্তু তোমার কেন মনে হলো, তারা সোনার চালান নিয়ে নাড়াচাড়া করছে?’
‘সোনা নিয়ে যাওয়ার সময় একটা জিনিস ফেলে গেছে। ওই লোক কালো সবরেইনি সিগারেট খায়।’
সোনার বার থেকে চোখ সরিয়ে রানাকে দেখল সিমন। আলোয় ঝিলিক দিল চশমা। অনিক্স অ্যাশট্রেতে টিপে নেভাল সিগার। ‘একবার ভেবেছ, রাশানরা যদি গুপ্তধন পেয়ে থাকে, সবার মুখ বুজিয়ে দেবে। বাঁচবে না কেউ। হয়তো সবার আগে মরবে তুমি।’
‘অথবা মরবে তারা,’ বলল রানা। ‘এরই ভেতর আমার বেশ ক’জন বন্ধুকে খুন করেছে ওরা। রাশানরা শুরু করলেও আশা করি খেলাটা শেষ করতে পারব আমি।’
‘রাশানদের ধারে-কাছে গেলে খুন হবে, রানা। তার আগে তক্তায় বেঁধে যিশুর মত ঝুলিয়ে নেবে। তারপর কেটে নেবে অণ্ডকোষ। ভুলে যেয়ো না ওরা ভয়ঙ্কর দানব।’
‘কত বড় দানব, সেটা জানতে চাই,’ বলল রানা।
‘কী নাম তোমার মৃত বন্ধুদের?’
‘তাদের নাম পাবে না অ্যাড্রেস বুকে, সিমন। তোমার মত মানুষের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না।’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আবারও সোনার বার দেখল সিমন। সরু দুই হাতে তুলল ওটা। বুঝতে চাইছে ওজন। চোখে ফুটে উঠল প্রশংসা ও লোভ।
‘বেশি ভালবেসে ফেলতে যেয়ো না, বলল রানা।
‘জানি না তোমাকে কী ধরনের সাহায্য করতে পারব,’ বলল লিওন সিমন।
‘সব খবরই তো তোমার কাছে আসে।’
সোনার বার টেবিলে রেখে তীক্ষ্ণ চোখে রানাকে দেখল সিমন। চোখে-মুখে কুমিরের হাসি। ‘কথা ঠিক, নজর রাখি সব ধরনের ব্যবসার দিকে। এবার বলো: আমি যদি সাহায্য করি, বদলে কী পাব? রাশানরা কিন্তু খুব বিপজ্জনক মানুষ।’
‘আগেই বলেছি, কাজে এলে হেঁটে চলে বেড়াতে পারবে। তরল খাবারও খেতে হবে না।’
‘তুমি খুব বাজে লোক, সেটা কি জানো, মাসুদ রানা?’
‘আমি যে কতটা খারাপ, সেটা তুমি কল্পনাও …
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল সিমন। ‘ঠিক আছে। খোঁজ নেব চারপাশে। সেজন্যে লাগবে আটচল্লিশ ঘণ্টা।’ চুপ হয়ে গেল সে। হাত বোলাল সোনার বারের ওপর। ওটা যেন আদর- কাতর বেড়াল। ‘এটা রেখে যাও। দরকারে কয়েকজনকে দেখাব।’
মাথা নাড়ল রানা। ‘আমি এতই বোকা? চোখদুটো সরাও ওটার ওপর থেকে।’
‘আমরা তো ব্যবসা করতে বসেছি, তাই না?’ বলল সিমন। ‘তুমি চাও ইনফরমেশন। আর আমি চাই সোনার বার।’
‘বাড়াবাড়ি করলে বিপদে পড়বে,’ বলল রানা।
সোনার বারে সরু চার আঙুল বোলাল সিমন। ‘টেবিলে এ জিনিস এলে, ধরতে হবে ওটা ওখানেই থাকবে। ভাবছ, আমার আস্তানায় ঢুকে যা খুশি অর্ডার দেবে? তুমি বেশি চালাক, নাকি? নিজেকে কী মনে করো তুমি, মাসুদ রানা?’,
কঠোর চোখে তাকে দেখল রানা। দৃষ্টি দিয়ে বুঝিয়ে দিল, তুমি আছ মস্ত বিপদে! ধৈর্য ফুরিয়ে গেছে ওর, অতিরিক্ত মোলায়েম সুরে জানতে চাইল, ‘দেরি না করে তথ্যটা দেবে, সিমন? নইলে কিন্তু ভীষণ ভুগতে হবে।’
‘এই যে ইনফরমেশন,’ বলল সিমন। ‘এবার মরবে তুমি, মাসুদ রানা!’ টেবিল চাপড়ে গলা ফাটাল সে, ‘অ্যাডালার্ড! শার্লট!’
ঝটকা খেয়ে খুলে গেল অফিসের দরজা। ধুম করে পাশের দেয়ালে লাগল কবাট। ব্যাটারিং র্যামের মত ভেতরে ঢুকল বিশাল আকারের এক লোক। পরনে তিন সাইয ছোট টি-শার্ট। বারের সেই বাউন্সার! পেছনে আরেকজন। তার চেহারা সামনের জনের মতই। হয়তো আপন ছোট ভাই। বড় ভাইয়ের চেয়ে দৈর্ঘ্যে একইঞ্চি কম হলেও চওড়ায় অন্তত একফুট বেশি। ক্ষত-বিক্ষত মুখটা যেন এবড়োখেবড়ো পাকা আতা ফল। মাথার চুল কেটেছে তীরের মত। দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে মাথা হেঁট করেছে দুই ভাই। মাথার ওপরের অংশ হারিয়ে গেছে সিগারের ধূসর ধোঁয়ার ভেতর। দু’জনের সম্মিলিত ওজন রানার কমপক্ষে চারগুণ বেশি। বসের নির্দেশের জন্যে বোধহয় অপেক্ষা করছিল দরজার বাইরে। রানার মনে হলো, আগে থেকেই তারা তৈরি।
‘খুন কর হারামজাদাটাকে!’ হাতের ইশারায় রানাকে দেখাল লিওন সিমন।
ভয়ানক চেহারা করেছে দুই ভাই। পকেট থেকে হ্যাঁচকা টানে সরু এক স্টিলের চেইন বের করল অ্যাডালার্ড। দুই হাতে চেইন পেঁচিয়ে নিতেই ওটা হয়ে গেল ফাঁসের মত। তার ছোট ভাই এনেছে করাত দিয়ে কাটা ডাবল ব্যারেলের শটগান। বাঁট ছেঁটে ফেলেছে বলে ওটা হয়েছে আঠারো ইঞ্চি পিস্তলের মত। স্রেফ উজবুক না হলে বদ্ধ ঘরে ওই জিনিস ব্যবহার করবে না কেউ। একবার ট্রিগার টিপলে ছড়িয়ে পড়বে শতখানেক পেলেট।
রানার মনে হলো, প্রথমেই উচিত শটগানের হাত থেকে বাঁচা। তবে ওর সামনে হাজির হয়েছে অ্যাডালার্ড। দুই হাতে শক্ত করে পেঁচিয়ে নিয়েছে চেইন। ওটা দিয়ে কচ করে কেটে নেবে রানার গলা। তার মতলব বুঝে গলা শুকিয়ে গেছে রানার। এখন আগের কাজ চেইন থেকে নিরাপদ থাকা। পরে ভাববে শটগানের কথা!
কারাতে স্টাইলে দু’পা ফাঁক করেই পরক্ষণে ডানপায়ে ভর দিল রানা। মুষ্টিযোদ্ধার মত মুঠো করেছে দু’হাত। অ্যাডালার্ডের মুখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ল ডানহাতি ঘুষি। তাতে চট্ করে মাথা সরাল দানব। তবে রানার উদ্দেশ্য মনোযোগ সরিয়ে নেয়া। ওর মুঠোর দিকে চোখ দানবের। বাউন্সারদের খেয়াল থাকে না সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হাত নয়। বাঁদরের মত দু’বার লাফিয়ে উঠেই সাঁই করে কোমর ঘুরিয়ে অ্যাডালার্ডের অণ্ডকোষে প্রচণ্ড এক লাথি বসাল রানা। বেসবল ব্যাটের মতই থ্যাপ্ করে নরম থলিতে লেগেছে পায়ের ডগা। রানা বুঝে গেল, কুপোকাত না হয়ে উপায় নেই দানবের। ঝুলে গেছে নিচের চোয়াল। শুয়োরের মত কুঁতকুঁতে চোখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ। হাত থেকে পড়ে গেছে চেইন। ধপ্ করে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসল লোকটা।
লড়াই হয়েছে সবমিলে দুই সেকেণ্ড!
কেউ চুল ধরবে ভেবেই বাউন্সারদের মত নেড়া হয়েছে অ্যাডালার্ড। রানা ভাবল, যার এতই বুদ্ধি, সে কীভাবে রাখে ছাগলা দাড়ি? ওটার জন্যে আরও ভয়ঙ্কর দেখাবে তাকে, সেটাই বোধহয় উদ্দেশ্য! কিন্তু ওটা ভাল একটা হ্যাণ্ডেল। বামহাতে অ্যাডালার্ডের দাড়ি চেপে ধরে গায়ের জোরে তার মুখ মেঝের দিকে নামাল রানা। একই সময়ে দ্রুত উঠল ওর ডান হাঁটু। শক্ত হাড়ে মাংস মোড়া হাড়ের সংঘর্ষে বিদঘুটে শব্দে ফাটল দানবের দু’ঠোঁট ও নাক। পিচকিরির মত ছিটকে বেরোল রক্ত। দাড়ি ছেড়ে দিতেই ঠাস্ করে মেঝেতে পড়ল লোকটা। তার ঘাড়ে ও মাথায় উঠে দাঁড়াল রানা। আপাতত উঠতে পারবে না দানব।
এরই ভেতর পেরিয়ে গেছে চার সেকেণ্ড।
একজন বাতিল, বাকি রইল দ্বিতীয়জন।
রাগে লাল হয়েছে ছোট ভাই। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে শটগান তুলল সে। তখনই মনে পড়ল, রানার পেছনেই ওদের বস। গুলি করলে বাঁচবে না সে। দ্বিধায় পড়ল ছোট দানব। তারপর একপাশে সরে গুলি করবে ভেবে নড়ে উঠল। কিন্তু রানার তুলনায় ওর গতি অনেক শ্লথ। এমন কী লিওন সিমনও তার চেয়ে দ্রুত। লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে বিদ্যুতের বেগে ডেস্ক ঘুরে খোলা দরজার দিকে উড়ে চলল সে। তাকে বাধা দিত রানা, কিন্তু আগে সামনে থেকে সরাতে হবে ছোট ভাইয়ের শটগান। এবার সরাসরি গুলি করবে সে! কোমরের পেছনে গেল রানার হাত, ঝটকা দিয়ে নিল ড্যামিকোর নাইন মিলিমিটারের বেরেটা। ছোট দানব শটগান তাক করার আগেই সেফটি অফ করল ও। পিস্তলের নল ঘুরিয়েই বলতে গেল: শটগান না ফেললে গুলি করব!
কিন্তু একই সময়ে সুযোগটা দেখতে পেয়েছে ড্যামিকো। ঘরের কোণে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে এসে রানার পিস্তলের নল চেপে ধরতে চাইল সে। ফলে হাত ঘুরিয়ে তার মুখে পিস্তলের নল নামাল রানা। হুড়মুড় করে ছোট ভাইয়ের ওপর পড়ল সমকামী। কিন্তু ওই একই সময়ে ট্রিগার টিপে দিয়েছে ছোট দানব। বদ্ধ অফিসে গুলির আওয়াজটা হলো বোমার মত। ছররা গুলি চেঁছে নিল ডেস্কের ওপরের অংশ। ছিঁড়েখুঁড়ে গেল চামড়ার চেয়ার। একটু আগে ওখানে ছিল লিওন সিমন। আগুনের হলকা গেছে রানার বুকের পাশ দিয়ে। কানের কাছে বিকট আওয়াজ। বারো গেজের বন্দুকের শোল্ডার স্টক নেই বলে মারাত্মক রিকয়েল ওটার। হনুমানের মত দানব ও সামলাতে পারেনি বন্দুক। নল উঠে গেছে ছাতের দিকে।
দ্বিতীবারের মত টার্গেটের দিকে নল নামাবার আগেই একপাশ থেকে লাথি মারল রানা। মেঝে ছাড়ল দানবের পুরু দুই পা। বাকি কাজ করল মাধ্যাকর্ষণ। বড় ভাইয়ের চেয়েও দ্রুত মেঝেতে ঠাঁই নিল সে। তবে ওঠার আগেই কানের পেছনে এসে লাগল রানার মাপা লাথি। ঘাড় ছিঁড়ে মাথাটা ওদিকের দেয়ালে গিয়ে পড়ক তা চায়নি। একবার ফুঁপিয়ে উঠে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ঘুমিয়ে পড়ল ছোট দানব।
পেছাতে শুরু করেছে ড্যামিকো। হাতদুটো তুলেছে বুকের সামনে। নীরবে যেন বলছে: মাফ করে দেন! ভুল হয়ে গেছে!
সমকামী ড্রাগ্স্ ডিলারের দিকে ঘুরেও তাকাল না রানা। অফিস ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেছে সিমন। ছোট দানবকে টপকে দরজা পেরিয়ে প্যাসেজে এল রানা। খেয়াল করল, বন্ধ হচ্ছে একটা দরজা। ওদিকে আস্তরহীন দেয়াল। নাইট ক্লাবের পেছনে গলি। একযিটের কাছে পৌঁছুল ও। আশপাশে নেই লিওন সিমন। পঙ্গু হলেও চড়ুই পাখির মতই দ্রুত। বোঝার উপায় নেই কোন্ দিকে গেছে। তিক্ত হয়ে গেল রানার মন। কেন যেন মনে হচ্ছে, ‘চাইলেও ওকে সাহায্য করতে পারবে না লিওন সিমন।
‘পিয়োর শুয়োর,’ বিড়বিড় করল রানা।
আবারও ফিরল অফিসে। হাঁটুতে ভর করে বসে আছে ড্যামিকো কর্সিনি। মাথার ওপর দু’হাত। কাঁপা গলায় বলল, ‘মাফ! মাফ! মাফ চাই!’
অ্যাডালার্ড ও শার্লটের অচেতন দেহ টপকে থামল রানা। ড্যামিকোর মাথা লক্ষ্য করে তাক করল বেরেটার নল। বারো গেজের বন্দুকের গুলিতেও যখন আসেনি কেউ, তো ক্লাবের মিউযিকের নিচে চাপা পড়বে নাইন মিলিমিটারের গুলির আওয়াজ।
‘স্যর, মাফ করে দেন!’ বিড়বিড় করল ড্যামিকো।
ট্রিগারে চেপে বসেছে রানার আঙুল। ভাবল, অসহায় সাধুদের লাশের কথা। মনে পড়ল কীভাবে কষ্ট পেয়ে মরেছে জন পিয়েরে।
মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা ড্যামিকোকে দেখল রানা। হাজার হাজার অপরাধের সঙ্গে জড়িত এ লোক। তবে সাধু নিধনে এর কোনও হাত নেই।
রানার মনে পড়ল প্রধান সাধুর কথা: ‘ভেনজেন্স ইয মাইন, সেথ দ্য লর্ড। কাজেই মানুষের উচিত নয় প্রতিশোধ নেয়া।’
রানা বুলেট খরচ করলে শুধরে যাবে না মার্সেইর সমাজ।
ওই লড়াই আসলে ওর নয়।
এক পা বেড়ে ঠাস্ আওয়াজে ড্যামিকোর মাথার ওপর পিস্তলের নল নামাল রানা। অচেতন হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা। বেল্টে পিস্তল গুঁজল রানা। ডেস্ক থেকে নিল সোনার বার। ওটার একদিক ব্যবহার করে ছেঁচে দিল তিন অজ্ঞান ইবলিশের ছয় হাতের বুড়ো আঙুল ছাড়া অন্যান্য আঙুল। লোক হিসেবে খুব সুবিধার নয় লিওন সিমন। রানা শহর ছেড়েছে শুনলেই ফিরবে নিজ আস্তানায়। তখন দেখবে কমেছে বাহুবল। আপাতত কয়েক মাসের জন্যে পঙ্গু তার দলের তিনজন।
জরুরি কাজ শেষ করতে গিয়ে একটু হাঁফিয়ে গেছে রানা। ব্যাগে গুঁজল সোনার বার। বেশ কিছু দিনের ভেতর সত্যিকারের লড়াইয়ে অংশ নেয়নি। শিরায় টগবগ করছে অ্যাড্রেনালিন। টের পেল, বড় দানোর ভাঙা নাকের রক্তে ভিজে গেছে প্যান্টের ডান হাঁটু। কষে লাথি মেরে এখন টনটন করছে বুটের ভেতর বুড়ো আঙুলটা। আর কোনও ক্ষতি না হলেও, লাভও হয়নি এখানে এসে। নষ্ট হয়েছে পুরোটা সময়। বিরক্ত নিজের ওপর।
ডেস্কের পেছনে গেল রানা। পালিয়ে যাওয়ার সময় সিন্দুকের কবাট খুলে চলে গেছে সিমন। ভেতরে থরে থরে টাকা। দরজা আরও খুলল রানা। ভেতরে এক শ’ ইউরোর পুরনো সব নোটের বাণ্ডিল। একেকটায় পঞ্চাশটা নোট। তার মানে, পাঁচ হাজার ইউরো। দশ সারিতে সব মিলিয়ে চল্লিশটা বাণ্ডিল। দামে প্রায় সোনার বারের সমান। গম্ভীর চেহারায় সিন্দুক থেকে বাণ্ডিলগুলো নিয়ে নিজের ব্যাগে ভরল রানা। সময় নষ্ট হয়েছে প্যারাডাইস ক্লাবে এসে। সেজন্যে যুদ্ধে হেরে টাকাগুলো দিচ্ছে লিওন সিমন।
আগের পথ ব্যবহার করে ভিড় এড়িয়ে ক্লাব থেকে বেরোতে চাইল রানা। পিঠে ঝুলছে ভারী ব্যাগ। ওটার দিকে খেয়াল দিল না কেউ। কয়েক মিনিট পর পা রাখল ক্লাবের বাইরে। বড় করে দম নিল। আর তখনই নোনা গন্ধ নিয়ে বইতে লাগল দমকা হাওয়া। নানাদিকে ছুটছে কালো মেঘ। ভেতরে ঝিলিক দিচ্ছে নীলচে বিদ্যুৎ। যে-কোনও সময়ে শুরু হবে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি।
হামারের দিকে এগোতেই রানার কপালে ঠাস্ ঠাস্ আওয়াজে পড়ল প্রথম দু’ফোঁটা বৃষ্টি। হাঁটার গতি বাড়াল ও। কালো মেঘ থেকে এল আরও কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি। পরক্ষণে ঝরঝর করে নামল জলধারা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ভিজে গেল রানা। মুহূর্তে পিছলা হয়েছে ফুটপাথ। চকচক করছে নিয়ন আলোয়। আর কোনও তাড়া নেই ওর। জানে না এরপর কী করবে বা কোথায় যাবে। হামারের দিকে যেতে যেতে টের পেল, পকেটে থরথর করে কাঁপছে মোবাইল ফোনটা।
বাইশ
ফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে রানা ভাবল, লিওন সিমন বোধহয় কল করেছে ড্যামিকোকে। জানতে চায় প্যারাডাইস ক্লাবে ফিরতে পারবে কি না। কিন্তু ড্যামিকোর ফোন বাজছে না। ওটা মঠের খুনির মোবাইল ফোন! রিপ্লাই বাটন টিপে কানে ঠেকাল রানা। চারপাশে ঝরঝর ঝরছে তুমুল বৃষ্টি। ধরে নিল যোগাযোগ করেছে ইন্টারপোলের কমিশনার অ্যাল মার্লো। রাত বাজে এখন প্রায় বারোটা। তবে কাজ থাকলে অফিস থেকে বেরোয় না সে। এ কারণেই ডিভোর্স হয়ে গেছে স্ত্রীর সঙ্গে।
কিন্তু কল করেনি অ্যাল মার্লো।
ওদিকে নারীকণ্ঠ। উচ্চারণ ফ্রেঞ্চ। তবে ইংরেজি শিখেছে আমেরিকান সিনেমা দেখে। বিচলিত ও খুশি। নিচু গলায় বলল, ‘হার্ভার্ট? সিলভিয়া। ঠিক আছ? যিশু, বুঝবে না তুমি ফোন দিলে কতটা ভয় পেয়েছি! হার্ভার্ট? কথা বলো!’
দ্বিধায় পড়ল রানা। এই মেয়ে খুনির পরিচিত। নম্বরগুলোর একটা তার। এবার কী করবে, ভাবছে রানা। হয়তো মেয়েটা বুঝতে চাইছে মোবাইল ফোনটা এখন কার কাছে। অথবা, সে জানেও না মারা গেছে তার পরিচিত লোকটা। হয়তো প্রেমিকা বা স্ত্রী। তবে সেক্ষেত্রে এত নার্ভাস কেন মেয়েটা?
এবার জবাবে কিছু বলতে হবে। হার্ভার্ট বংশের পরিচয় বা ডাকনামও হয়। ওই লোক অন্তত ফ্রেঞ্চ নয়। বোধহয় ব্রিটিশ বা আমেরিকান। মুখে হাত চেপে কর্কশ গলায় বলল রানা, ‘হ্যাঁ, আমি।’ বুঝতে পারছে, সামান্য ভুলেই সতর্ক হবে মেয়েটা।
ওদিকে নীরবতা।
শ্বাস আটকে ফেলল রানা।
আরও কয়েক সেকেণ্ড পর মেয়েটা বলল, ‘তুমি কোথায়? কী হয়েছে ওখানে? ওরা তো বলল ক্রসফায়ারে গুলি লেগেছে তোমার গায়ে। আরও বলেছে, ওটা দুর্ঘটনা।’
রানা বুঝল, এই কল স্ত্রী বা প্রেমিকার নয়। এই মেয়ে শত্রুপক্ষের কেউ। নিভু নিভু মোমবাতির মত রানার মনে জ্বলছে সামান্য আশা। মেয়েটার কাছ থেকে হয়তো পাবে জরুরি তথ্য। আরও সতর্কভাবে মাউথ পিস চেপে ধরে একটু দূর থেকে কর্কশ স্বরে বলল রানা, ‘আমি আহত, সিলভিয়া।’
‘কেমন যেন শোনাচ্ছে তোমার গলা।’
‘কারণ আমি আহত,’ প্রায় বিড়বিড় করল রানা। ‘বেরিয়ে এসেছি মঠ থেকে। কিন্তু সাহায্য দরকার।’
‘তুমি কোথায় আছ?’
ঝড়ের বেগে ভাবছে রানা। মেয়েটা বোধহয় বিশ্বাস করেছে, ও আসলে হার্ভার্ট। বড়শিতে আটকে গেছে মাছ। এবার ডাঙায় তুলতে হবে খুব সাবধানে।
মনের চোখে রানা দেখল, আহত এক লোক। পালিয়ে বাঁচতে চাইছে সে। মরিয়া হয়ে উঠেছে সাহায্য পাওয়ার জন্যে। ওর নিজ জীবনে অন্তত কয়েকবার এমন হয়েছে।
কয়েক ঘণ্টার ভেতর কতটা দূরে সরতে পারবে লোকটা?
তার চাই নিরাপদ আশ্রয়।
রানার মনে পড়ল, জঙ্গলের সেই ক্যাম্প সাইট।
ওখান থেকেই প্রথমবারের মত ফোন করেছিল ও।
আগুনে পোড়া এক ট্রাক ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে।
পাঁজরে গুলি খেয়েছে এমন এক লোকের অভিনয় করল রানা। কাঁপা গলায় কাশতে শুরু করে বলল, ‘এখানে… একটা পিকনিক স্পট… জঙ্গলের ভেতর। পাহাড়ের কাছে। সন্ন্যাসীদের মঠ থেকে বড়জোর পনেরো মিনিট। দক্ষিণ- পুবে। একটা গাড়ি… সাহায্য চাই। এখনও রক্ত পড়ছে ক্ষত থেকে।’
রানা নিজে ভাল করেই জানে, ফুটো ভরা ওর এই কাহিনী। রক্তাক্ত এক লোক ট্যাকটিকাল ড্রেস পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পৌঁচেছে জঙ্গলের পিকনিক স্পটে। অথচ তার তো বোঝারই কথা নয় কোন্ দিকে চলেছে!
কিন্তু কাঁচা মিথ্যা না বলে উপায়ও নেই ওর। কেন যেন মনে হচ্ছে, কথাগুলো বিশ্বাস করেছে মেয়েটা।
‘মঠের দক্ষিণ-পুবে পনেরো মিনিট?’ উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইল সিলভিয়া। ‘ভুল বকছ না তো? ওখানেই আছ তো?’
‘হ্যাঁ,’ বেদম কেশে উঠল রানা। ‘বাজেভাবে আহত।’
‘ঠিক আছে, আসছি। টিকে থাকো! হায়, যিশু! বহু দূরে যেতে হবে। আমাকে দাও দুটো ঘণ্টা। না, তিন ঘণ্টা। যত দ্রুত সম্ভব পৌছুব। রাত তিনটের ভেতর খুঁজে নেব তোমাকে। শুনতে পেয়েছ আমার কথা?’
‘দেরি কোরো না,’ ককিয়ে উঠল রানা, ‘আমি হয়তো বেশিক্ষণ নেই…’
বৃষ্টির ভেতর ওকে পাশ কাটাল কমবয়সী দুই ছেলে- মেয়ে। অবাক চোখে রানাকে দেখেছে মেয়েটা।
‘একটু অপেক্ষা করো,’ ফোনে বলল সিলভিয়া, ‘মাত্র তিন ঘণ্টা। পৌঁছে যাব তারই ভেতর।’ কল কেটে দিল মেয়েটা।
পকেটে ফোন রেখে হাঁটার গতি বাড়াল রানা।
ওই ফোনের কারণে বিস্মিত।
কিছুই না জেনে রাশানদের পেছনে ছুটছিল।
অথচ সিলভিয়া বা হার্ভার্ট নামটা ব্রিটিশ বা আমেরিকান।
এখন মনে হচ্ছে রাশান সিগারেট বা সিমনের পেছনে ছুটে ভুলই করেছে। অনুচিত ছিল মার্সেইতে পা রাখা।
এবার মাত্র তিন ঘণ্টা পাবে মঠের কাছে ওই পিকনিক স্পটে পৌঁছাতে। মেয়েটা হাজির হওয়ার আগেই তৈরি থাকতে হবে ওর। ব্রায়ানকন শহর থেকে এখানে আসতে লেগেছে পুরো তিন ঘণ্টা। অথচ, এবার যেতে হবে আরও বেশি দূরে।
পিকনিক স্পটে পৌঁছুতে পারবে রানা, তবে সেজন্যে গাড়ি চালাতে হবে বদ্ধ উন্মাদের মত।
একা আসবে না ওই মেয়ে, বুঝে গেছে রানা। বলেছে, ক্রসফায়ারে আহত হয়েছে হার্ভার্ট।
এসব ফালতু কথা।
যাতে তাকে বিশ্বাস করে রানা।
আসলে ফেলতে চাইছে ফাঁদে। সাহায্য করবে না। সঙ্গে আনবে দলের ক’জনকে। তারা মগজে গেঁথে দেবে বুলেট।
তবে এই ঝুঁকি নিতে মনে কোনও দ্বিধা নেই রানার।
নিজ দলের লোক হার্ভার্টকে শেষ করতে চাইলে, আপত্তি তুলত না রানা। নিজে প্রথম সুযোগে তাদেরকে পাঠাত নরকে।
হঠাৎ পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয়ায় বেশ বিস্মিত রানা। একটু আগেও ভাবছিল, সামনে নেই খোলা কোনও পথ। হামার জিপের দিকে হাঁটতে লাগল ও। ক’মুহূর্ত পর দ্রুত হলো ওর গতি। তর সইছে না। ভেজা ফুটপাতে ঝেড়ে দৌড় দিল গাড়ির দিকে। মুখ বেয়ে ঝরঝর করে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। হামারের পাশে পৌঁছে দেরি করল নাঁ দরজা খুলতে। ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলল প্যাসেঞ্জার সিটে। নিজে উঠল স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে। ইঞ্জিন চালু হতেই বডির সঙ্গে চেপে ধরল অ্যাক্সেলারেটর। ভেজা রাস্তায় পিছলে গেল চার চাকা। ছিটকে এগোল গাড়ি। পরক্ষণে চরকির মত ঘুরল ব্রায়ানকন শহরের দিকে। হাতে মাত্র তিন ঘণ্টার চেয়েও কম সময়, তারই ভেতর পৌছুতে হবে সেই পিকনিক স্পটে।
সাধ্যমত গতি তুলে জ্যামে ভরা মার্সেই শহর ত্যাগ করল রানা। খোলা হাইওয়েতে তুলল ঝড়ের বেগ। খুশি হামারের হেডলাইটের উজ্জ্বল আলোর সাহায্য পেয়ে। সামনে থেকে আসা গাড়ির ড্রাইভাররা আঁৎকে উঠছে হামারের স্পিড দেখে। আপত্তি তুলছে হর্ন বাজিয়ে। কিছুই পাত্তা দিচ্ছে না রানা। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছুতে হবে ঠিক সময়ে। সাঁই-সাঁই চলছে ওয়াইপার। ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে জ্বলছে জ্বলজ্বলে আলো। যেন রানা আছে কোনও ফাইটার বিমানের ককপিটে। চলেছে ঘণ্টায় দেড় শ’ কিলোমিটার বেগে। কিছুক্ষণ পর গতি উঠল এক শ’ সত্তর কিলোমিটারে। সামনে কালো ফিতার মত পড়ে আছে নির্জন রাস্তা।
ভীষণ ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে রানার দেহ। সারাদিন অতিরিক্ত পরিশ্রম করেছে। আজ রাতেও হয়তো বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পাবে না। দীর্ঘ যাত্রায় জেগে থাকতে সাহায্য করবে মিউযিক। ইশতিয়াকের সিডি কালেকশন ঘাঁটল রানা। মার্ভিন গেয়ে, স্টিভি ওয়াণ্ডার ও জ্যাকসন ফাইভ ছাড়া ভাল কিছুই নেই। বাধ্য হয়ে একটা একটা করে রেডিয়ো স্টেশন ধরতে লাগল রানা। একটু পর পেল হুয়ান-লেস-পিন্স-এর সামার জ্যায ফেস্টিভেল লেট নাইট কনসার্ট। পাগলাটে মিউযিক ভাল না লাগলেও ভলিউম বাড়িয়ে দিল রানা। ক্যাবের ভেতর ধুপধুপ করছে ড্রামের আওয়াজ। করুণ আর্তনাদ ছাড়ছে স্যাক্সোফোন। আঁধার পথে সেঁটে রয়েছে রানার চোখ। হিসাব কষে দেখেছে, কত বেগে গেলে ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারবে গন্তব্যে।
তুমুল বেগে ব্রায়ানকন শহরে পৌঁছল রাত আড়াইটার সময়। পরের পনেরো মিনিটে হাজির হলো জঙ্গলের মাঝে পিকনিক স্পটের কাছে। আগেই থেমেছে বৃষ্টি। পাহাড় চূড়ার মাথার ওপর আকাশে ঝিলমিল করছে আকাশগঙ্গা। পিকনিক স্পটের দিকে যেতে যেতে হেডলাইট ও ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। সতর্ক চোখ প্রায়ান্ধকার পথে। পোড়া বেলফেগর ট্রাক ছাড়া পিকনিক স্পট ফাঁকা। এখনও বোধহয় পৌঁছায়নি মেয়েটা। জঙ্গলের মাঝে বৃত্তাকার জায়গাটায় ঢুকে পড়ল রানা। থামল গাছের সীমানার কাছে ঘন এক ঝোপের ভেতর। আশপাশে ফার্নের ঝোপঝাড়। ওখানে লুকিয়ে অনায়াসে চোখ রাখতে পারবে কাঁচা মাটির পথে। হামার থেকে নেমে মোটা এক গাছের পেছনে গিয়ে বসল রানা। কোলে ফ্যামাস রাইফেল। বৃষ্টি ভেজা মাটি থেকে এল সোঁদা গন্ধ। চারপাশে গুঞ্জন তুলছে হাজার হাজার পোকা। একবার হাতঘড়ি দেখল ও। বিশ্রাম করতে বুজল চোখ। মাত্র কয়েক মিনিটে তলিয়ে গেল আধোঘুমে। যদিও সতর্ক প্রতিটি ইন্দ্ৰিয়।
একহাত রাইফেলের পিস্তল গ্রিপে, তর্জনী আলতোভাবে স্পর্শ করেছে ট্রিগার।
তিলতিল করে এল রাত তিনটে।
এল না কেউ।
পার হলো সাড়ে তিনটে।
দেখা দিল না কেউ।
নানা আওয়াজ তুলছে পতঙ্গের দল। অন্ধকার জঙ্গল থেকে এল একাকী পেঁচার হাহাকার। ক্রমে যেন বাড়ছে পোকামাকড়ের গুঞ্জন।
পঁচিশ মিনিট পর বাজবে ভোর চারটে।
চোখ মেলে চারপাশ দেখল রানা। ভাবছে, সত্যিই আসবে কেউ?
আরও পাঁচ মিনিট পর জঙ্গুলে পথে পড়ল গাড়ির হেডলাইটের আলো। চাপা গর্জন ছাড়ছে শক্তিশালী ইঞ্জিন। মৃদু ক্যাঁচকোঁচ শব্দ সাসপেনশনের। ভারী চাকার নিচে মটমট করে ভাঙল শুকনো ডাল। উঠে ঘন ফার্নের গভীরে সেঁধিয়ে গেল রানা। মাথার ওপর দিয়ে গাছগুলোয় পড়ল হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো। সরে গিয়ে স্থির হলো টয়লেট, পোড়া বেলফেগর ও প্রায় কয়লা হয়ে যাওয়া পিকনিক টেবিলের ওপর। রশ্মির ছটা দেখে রানা ধারণা করল, ওটা বড় আকারের কালচে রঙের কোনও এসইউভি। ফাঁকা জায়গায় এসে থামল গাড়ি। বাতি নিভিয়ে বন্ধ করা হলো ইঞ্জিন ‘ক্র্যাচ্’ আওয়াজ তুলল হ্যাণ্ডব্রেক। খুলে গেল দরজা। বৃত্তাকার জমির নানাদিকে গেল টর্চের আলো।
যা ভেবেছি, মনে মনে বলল রানা। একা আসেনি মেয়েটা।
তেইশ
যে দু’জন নেমেছে এসইউভি থেকে, বৃত্তাকার এলাকা ঘুরে দেখতে গিয়ে বিপরীত দিকে চলল তারা। লম্বা ছায়ামূর্তি আসছে রানাকে লক্ষ্য করে। আকারে ছোট ছায়ামূর্তি চলেছে বামে। রানার ভুল না হলে তারা দু’জনই সশস্ত্র। খুঁজছে মঠের ওই খুনিকে। ফাঁকা জায়গার কিনারায় পড়ছে টর্চের কাঁপা, জোরালো আলো। রানা যেখানে রয়েছে, ওটাকে ঘড়ির ছয়টা ধরলে মেয়েটা আছে দশটার কাছে। লোকটার অবস্থান দুটোর ওপর।
নিথর হয়ে জঙ্গলে বসে আছে রানা। প্রায় পড়ছে না শ্বাস। কমে গেছে হৃৎস্পন্দন। মিশে আছে বুনো পরিবেশের সঙ্গে। কমাণ্ডো ট্রেইনিঙে ওকে শেখানো হয়েছে, টার্গেট চলতে শুরু করলে সেই সুযোগে কীভাবে পৌছুতে হবে শত্রুর তিন ফুটের ভেতর। আর তারপর নিজেই ও হয়ে উঠবে আক্রমণকারী। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে খেপা সিংহের হিংস্রতা নিয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর।
আজকে তেমনই এক রাত।
বৃত্তাকার জায়গার কিনারায় গিয়ে পড়ছে মেয়েটার হাতের টর্চের আলো। একবার দেখল পোড়া বেলফেগর ট্রাক। বোধহয় ভাবছে, কোথা থেকে এল ওটা। এর সঙ্গে কী সম্পর্ক দলের আহত লোকটার? পারবে তো তাকে শেষ করতে, নাকি নিজেই হবে খুন?
হঠাৎ থমকে গেল মেয়েটা। ঘড়ির কাঁটার মত করে গাছের কিনারা ঘেঁষে ফিরছে লোকটা। বারবার আলো ফেলছে দু’পাশে। যেন পরখ করবে জঙ্গলের প্রতিটি পাতা ও ডাল। ঘড়ির ডায়ালের পাঁচ সংখ্যার কাছে পৌঁছুল সে। কয়েক গজ দূরে ফার্নের আড়ালে বসে লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ শুনছে রানা। নাকে এল ঘামের গন্ধ। তার ডানহাতে বাক্সের মত কালো একটা পিস্তল
প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে বসেছে রানা। ওর মাথার তিন ফুট ওপরে গাছের কাণ্ডে পড়ল টর্চের কাঁপা আলো। তখনই ব্যস্ত হয়ে উঠল রানা। অন্ধকার থেকে ছিটকে বেরোল চিতার বেগে। যেন বিশাল বাদুড়ের ছায়া। পরক্ষণে লোকটাকে চোক হোল্ডে ধরল ও। তার বামহাত থেকে পড়ে কয়েক ফুট দূরে গড়িয়ে গেল টর্চ। আলো স্থির হয়েছে বড় এক পাথরের ওপর। লোকটার কবজি মুচড়ে পিস্তল কেড়ে নিয়ে মাটিতে ফেলল রানা। পরক্ষণে এক ঝটকায় তাকে ঘুরিয়ে নিজের সামনে রাখল বর্মের মত। খুলির পাশে ঠেকাল ফ্যামাস রাইফেলের মোটা মাল। রাতের আঁধার চিরে চাপা শোনাল ওর কণ্ঠ: ‘হাত থেকে অস্ত্র ফেলো!’
থমকে গেছে মেয়েটা। হাতের টর্চের আলো তাক হলো মাটিতে। হাত থেকে কালো কী যেন পড়ল ধুপ আওয়াজে।
‘আলো স্থির করো নিজের ওপর,’ বলল রানা। ‘হাত নাড়বে না, নইলে গুলি খেয়ে মরবে তোমার সঙ্গী।’
ক’মুহূর্ত দ্বিধা করে নিজের ওপর টর্চ তাক করল মেয়েটা। চোখ পিটপিট করছে উজ্জ্বল আলোয়। আঁধার মঞ্চে স্পট লাইটে দাঁড়িয়ে থাকা অভিনেত্রী যেন, ভুলে গেছে পরের ডায়ালগ কী হবে। চোক হোল্ডে ধরা পড়া লোকটা চেষ্টা করছে শ্বাস নিতে। তার গলার ওপর চাপ কমাল রানা। ঠেলল কয়েক ফুট দূরে। বৃত্তাকার জায়গার দিকে সরে গেছে সে। পেছন থেকে তার মাথার ওপর রাইফেলের বাঁট নামাল রানা। স্টিল ও প্লাস্টিকে লেগে ভোঁতা আওয়াজ তুলল হাড়। আবছা ঘোঁত করেই হুড়মুড় করে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল সে। একটু দূরেই পোড়া ট্রাক।
মাটি থেকে পিস্তল তুলল রানা। ওজন ও আকৃতি থেকে বুঝল, অস্ত্রটা গ্লক ১৯। মাঝারি আকারের নাইন মিলিমিটার সেমি অটোমেটিক। বুলেটে ভরা ম্যাগাযিন। দামি ও পেশাদারী জিনিস। পয়সাওয়ালা অপরাধীরাই কেনে। বেল্টে পিস্তলটা গুঁজে মেয়েটার দিকে রাইফেলের মায়ল তাক করে এগোল ও। আলোকিত গাছের মত চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। চোখ কুঁচকে দেখতে চাইছে ওদিকে কী ঘটল। বিন্দুমাত্র মিথ্যা বলেনি রানা, মেয়েটা সামান্য চালাকি করলেও গুলি করবে।
কাছে পৌঁছে তাকে ভাল করে দেখল। যুবতীর বয়স বড়জোর পঁচিশ। বেশি লম্বা নয়। অ্যাথলেটিক শরীর দৌড়বিদের মত। কালো ক্যাপে গুঁজে রেখেছে বাদামি চুল। পরনে ফ্যাকাসে জিন্স প্যান্ট ও শার্ট। তার ওপর চাপিয়ে নিয়েছে হাইওয়ে-স্টাইলের কালো পুরনো এক চামড়ার জ্যাকেট।
তার হাত থেকে থাবা দিয়ে টর্চ নিল রানা। জিনিসটা পোক্ত অ্যালিউমিনিয়ামের। ভেতরে চারটে বড় সেল ব্যাটারি। যেমন কাজে আসবে ফ্ল্যাশলাইট হিসেবে, তেমনি ব্যবহার করতে পারবে মুগুরের মত। মেয়েটার মুখে আলো ফেলে বুকে রাইফেলের মাযল তাক করল রানা। এত কম রেঞ্জে লাগলে পিঠ ভেদ করে মুঠো সমান গর্ত তৈরি করবে গুলি। মেয়েটা নিজেও তা জানে। ডানদিকে সরল রানা। রাইফেলের নল দিয়ে ঠেলে অজ্ঞান লোকটার দিকে নিয়ে চলল তাকে।
‘তোমার সঙ্গীর পাশে থামবে।’
আড়ষ্ট পায়ে চলেছে মেয়েটা। অন্ধকারে ‘ নড়ল তার সঙ্গী। গুঙিয়ে উঠে একহাতে চেপে ধরল মাথা। একটু পিছিয়ে মেয়েটার পিস্তল তুলে নিল রানা। ওটা দামি এবং ভাল অস্ত্র। গ্লক ২৬। একই ক্যালিবারের। ছোট হাতের জন্যে তৈরি। গোপনে রাখতে এর তুলনা নেই। পিস্তলটা সুন্দরভাবে এঁটে গেল রানার হিপ পকেটে।
লোকটার দুই গজের ভেতর মেয়েটা পৌছুতেই নির্দেশ দিল রানা, ‘থেমে ঘুরে দাঁড়াও। দুটো হাতই যেন পরিষ্কার দেখতে পাই।’
থমকে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল মেয়েটা। কোমরের কাছে ঝুলছে দুই হাত। সামনের দিকে দুই তালু। যেন বলতে চাইছে, ‘হচ্ছেটা কী?’ চাইছে টর্চের আলো থেকে চোখ আড়াল করতে। তবে বোকা নয় সে। ভাল করেই জানে, হঠাৎ নড়লে হয়তো মরতে হবে গুলি খেয়ে। উত্তেজনার ছাপ চেহারায়। বারকয়েক তাকাল পতিত সঙ্গীর দিকে। উঠে হাঁটুর ওপর ভর করে বসেছে লোকটা।
‘এবার জানা যাক তোমরা কারা,’ বলল রানা। ‘তুমি তো সিলভিয়া, ঠিক?’
কড়া আলোয় ভুরু কুঁচকে মাথা দোলাল মেয়েটা। ‘আর কোনও নাম আছে?’
দ্বিধা করল যুবতী। ‘পুরো নাম সিলভিয়া রথচাইল্ড।’ ফোনে যেমন শুনেছে রানা, তেমনই মেয়েটার উচ্চারণ। ইংরেজ নাম বললেও তাকে মনে হচ্ছে ফ্রেঞ্চ।
‘আর এই লোক?’ জানতে চাইল রানা। টর্চের আলো ফেলল লোকটার ওপর। হাঁটুর ওপর ভর করে বসেছে সে। শ্বাস নিচ্ছে ফোঁস ফোঁস করে। মাথার চুল সোনালি। ত্রিকোণ চেহারা। রানা আঁচ করল, এই লোক স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান। অবশ্য ডাচ বা জার্মানও হতে পারে।
‘ওর নাম ব্যানওয়ার্ট,’ বলল যুবতী। ‘কার্ল ব্যানওয়ার্ট।’
‘সিলভিয়া, আমি যখন তোমার সঙ্গীকে সার্চ করব, আলো ফেলবে ওর ওপর,’ বলল রানা। ‘আশা করি ভুল হবে না। নইলে পড়বে মহাবিপদে।’
মৃদু মাথা দোলাল মেয়েটা।
তার হাতে ভারী টর্চ ধরিয়ে দিয়ে নিচু গলায় বলল রানা, ‘কার্ল, যথেষ্ট জোরে বাড়ি দেয়া হয়নি, উঠে দাঁড়াও।’
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে। টলছে মাতালের মত। রানা ও তার ওপর আলো ফেলল মেয়েটা। দ্রুত হাতে লোকটাকে সার্চ করল রানা। টর্চের উজ্জ্বল আলোয় ওর মনে হলো, ভীষণ রেগে আছে সে। একটা সুইচব্লেড ছুরি ও এক রোল ডাক্ট টেপ ছাড়া তার কাছে এমন কিছু নেই, যা আগ্রহ তৈরি করবে রানার মনে। এ ছাড়া আছে কয়েকটা ইউরোর নোট ও কয়েন। ছুরি ও টেপ সরিয়ে নিল রানা। ‘এবার তোমার পালা, কার্ল। আলো তাক করবে সিলভিয়ার ওপর। ভুলেও চালাকি করবে না।’
লোকটার হাতে টর্চ দিল মেয়েটা।
প্রচণ্ড রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে কার্ল। তবে ঠিকভাবেই ধরেছে আলো। মেয়েটাকে সার্চ করতে গিয়ে পারফিউমের মৃদু সুবাস পেল রানা। কাজটা দ্রুত শেষ করে টর্চ কেড়ে নিল কার্লের হাত থেকে। পিছিয়ে গেল এক পা। আলো ফেলে দেখল তাদের দু’জনকে। একহাতে কোমরের কাছে ধরেছে রাইফেল। মাযল তাক করা দু’জনের ঠিক মাঝে।
‘এবার মুখ খোলো,’ বলল রানা।
‘হার্ভার্ট কোথায়?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
ডানহাতের ভাঁজে টর্চ রাখল রানা। রাইফেলের মাযল না সরিয়ে বামহাতে প্যান্ট থেকে নিল ফোন। ওটা অন করে বের করল খুনির লাশের ছবি। ট্রাক পুড়িয়ে দেয়ার আগে তুলেছে। মেয়েটাকে ছবি দেখিয়ে জানতে চাইল, ‘চেনা চেনা লাগছে?’
ভুরু কুঁচকে গেল মেয়েটার। চোখে ঝড়ের মেঘ। আলো ভেদ করে দেখতে চাইল রানাকে। চাপা স্বরে বলল, ‘তুমি ওকে খুন করেছ।’
‘না, পেয়েছি মরা অবস্থায়,’ ফোন আগের জায়গায় রাখল রানা। ‘কয়েকটা নাইন মিলিমিটার বুলেটের আঘাতে ফুটো হয়ে গিয়েছিল। যে ধরনের লোক, হয়তো উপযুক্ত শাস্তিই পেয়েছে। তবে দোষ না করেও খুন হয়েছে আমার বন্ধুরা। আর সেজন্যে দায় নিতে হবে কাউকে না কাউকে। হয়তো তোমাদেরকে দিয়েই শুরু করব শোধবোধের কাজ।’
চোখ সরু করে ভুরু কুঁচকে ফেলেছে মেয়েটা। দেখতে চাইছে রানার চেহারা। ‘তুমি তা হলে মনাস্ট্রিতে ছিলে?’
‘থাকা উচিত ছিল,’ বলল রানা। ‘ওখানে ছিলাম গত বেশ ক’টা দিন। তোমরা যা খুশি না করলে হয়তো থাকতাম আরও।’
‘তুমি তো সন্ন্যাসী নও,’ বলল মেয়েটা।
‘চেহারা দেখেই সবাইকে বুঝে ফেল?’
‘কে তুমি?’
‘সব পরিকল্পনায় থাকে খুঁত,’ বলল রানা, ‘আমি তোমাদের সেই খুঁত। যার কথা ভাবতেও পারোনি। আর সেজন্যেই হয়তো পাবে চরম শাস্তি। আমি মৃত সাধু হলে খুশি হতে তোমরা।’
‘ভুল ভাবছ,’ বলল মেয়েটা, ‘সব খুলে বললে তখন বুঝবে।’
‘সেটাই করবে তোমরা, খুলে বলবে সব,’ বলল রানা। ‘গোপন করবে না একটা কথাও। নইলে মরবে গুলি খেয়ে। আশপাশে কেউ নেই। চিৎকার করে সাহায্য চাইলেও আসবে না কেউ। পরিবেশ এমনই ছিল সন্ন্যাসীদের মঠে। তবে এবার অস্ত্রের নল তোমাদের দিকে। ভাবতে গিয়ে নিশ্চয়ই ভাল লাগছে না, যে-কোনও সময়ে খুন হবে?’
‘আমাকে সব খুলে বলতে দাও,’ বলল সিলভিয়া রথচাইল্ড।
‘আমি চাই প্রথমে কথা শুরু করুক ব্যানওয়ার্ট,’ বলল রানা। ‘এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি গুণ্ডাটা।
ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে ব্যানওয়ার্ট। আড়ষ্ট হয়েছে হাত-পায়ের পেশি। রানা দেখছে, দড়ির মত ফুলে গেছে তার ঘাড়ের রগ।
‘নিজেকে খুব শক্ত ভাবো, তাই না, ব্যানওয়ার্ট?’ বলল রানা। ‘ধরে নিলাম তুমি উপযুক্ত লোক। তা হলে বলো, খুন করেছ ক’জন সাধুকে?’
কখনও কখনও বহু কিছু বলে নীরব সময়। গতকাল ভোরে কী করেছে, সেটা ভাবতে গিয়ে হাসি ফুটল লোকটার মুখে। চোখে উপভোগের দৃষ্টি।
রাইফেলের মাযল সামান্য সরিয়ে তাকে গুলি করল রানা।
বিকট আওয়াজে ছিঁড়েখুঁড়ে গেল জঙ্গলের আঁধার পরিবেশ। ভীষণ ভয়ে গাছ থেকে উড়াল দিল পাখিরা। ব্যানওয়ার্টের ঠিক বুকে গুলি করেছে রানা। হৃৎপিণ্ড ভেদ করে ফুসফুস ঝাঁঝরা করেছে হাই-ভেলোসিটির গুলি। যেন ছুটন্ত রেলগাড়ির ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে ছিটকে পড়ল লাশ। মারা গেছে মাটিতে পড়ার আগেই।
মেয়েটার দিকে মাযল তাক করল রানা।
ভীষণ ভয়ে চমকে গেছে মেয়েটা। বিস্ফারিত হলো দু’চোখ। মুখ ও ঘাড়ের পাশে ছলাৎ করে লেগেছে ব্যানওয়ার্টের রক্ত।
‘বেশিক্ষণ সময় নষ্ট করব না,’ বলল রানা, ‘হয় কথার জবাব দেবে, নইলে শুয়ে থাকবে বন্ধুর পাশে। আমি চলে গেলে ইঁদুর আর ছুঁচো খেয়ে সাফ করবে তোমাদের লাশ।’
মৃত সঙ্গীর দিকে তাকাল সিলভিয়া রথচাইল্ড। চট্ করে বুঝে গেছে, মিথ্যা বলছে না এশিয়ান এই লোক।
রানার মনে হলো না জীবনে প্রথমবারের মত লাশ দেখেছে মেয়েটা। মুহূর্তের জন্যে চেহারায় ফুটে উঠেছিল তৃপ্তির ছাপ।
‘যা বলার বলো, সিলভিয়া,’ বলল রানা।
‘তুমি পুড়িয়ে দিয়েছ ট্রাক?’ বেলফেগরটা দেখাল মেয়েটা।
‘তোমার বন্ধুর চেয়ে তুমি চালাক,’ বলল রানা। ‘এবার বলো, ‘কারা খুন করেছে সাধুদেরকে।
‘ব্যানওয়ার্ট আমার বন্ধু ছিল না,’ বলল মেয়েটা। ‘আবর্জনার মতই নোংরা এক লোক। ওকে গুলি করেছ বলে ধন্যবাদ। নিজেই বহুবার ভেবেছি ওই কাজটা করব।’
রাইফেলের মাयলের ওপর দিয়ে তাকে দেখল রানা। ‘ভেবেছ যা খুশি বলবে আর তাই বিশ্বাস করব?’
কাঁধ ঝাঁকাল সিলভিয়া রথচাইল্ড। ‘তা ভাবছি না। হয়তো গুলিই করবে। কারণ এখন যা বলব, বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে তোমার। তবে মনে রেখো, আমাকে খুন করলে পড়বে মহাবিপদে।’
‘সবসময়েই থাকি বিপদে, এটা নতুন কিছু নয়,’ বলল রানা, ‘হারাবার কিছুই নেই তোমার। কাজেই বলো যা বলার।’
আবারও কাঁধ ঝাঁকাল মেয়েটা। ‘ঠিক আছে। উপায় থাকলে অফিশিয়াল আইডি দেখাতাম। আপাতত সে উপায় নেই। আমার নাম সিলভিয়া রথচাইল্ড নয়। আমি ডিজিএসআই-এর আণ্ডারকাভার এজেন্ট। আসল নাম অ্যালাইস বেলাইত। অফিসের সহকর্মীরা কেউ কেউ ডাকে এলিস বেলা বলে।’
চব্বিশ
ডিখেকশন জেনাখেলে দে লা সিকিউখিতে ইন্তেখিয়েখের সংক্ষেপিত নাম: ডিজিএসআই। কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, কাউন্টার-টেরোরিযম ও সার্ভেইলেন্সের কাজ করে ওই ফ্রেঞ্চ এজেন্সি। শত্রুভাবাপন্ন দেশ বা অশুভ কোনও পক্ষ দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করলে এজেন্টদের দায়িত্ব তা রুখে দেয়া। বাংলাদেশে একই দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বা বিসিআই। কঠোর মিলিটারি ট্রেনিং নেয়া দেশ সেরা ক’জন যুবক ও যুবতী প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লড়ছে দেশের বাইরের অশুভ সব পক্ষের বিরুদ্ধে। ওদের দায়িত্ব আরও বেশি, কারণ বিদেশে গিয়েও ঠেকাতে হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব ষড়যন্ত্র। দুর্ধর্ষ ওই এজেন্টদেরই একজন মাসুদ রানা। এ মুহূর্তে ভাবছে, হয়তো সত্যি বলছে মেয়েটা। এ কারণেই মুখে-ঘাড়ে রক্ত লাগলেও ঘাবড়ে যায়নি। অবশ্য বেশকিছু প্রশ্ন জন্মেছে রানার মনে।
‘জানতাম, বিশ্বাস করবে না তুমি,’ বলল এলিস বেলা। ‘বিশ্বাস করব কি না তা পরে ভাবব,’ বলল রানা, ‘আগে জানতে চাই বেশ কয়েকটা বিষয়ে।’
‘আগেই বলেছি, যে মিশনে আছি, সঙ্গে রাখতে পারিনি এজেন্সির আইডি। গত চার মাস হলো সিলভিয়া রথচাইল্ড নাম নিয়ে ঢুকে পড়েছি গিসেলের সংগঠনে। তবে বেশি দূর এগোতে পারিনি তদন্তে।’
‘গিসেল কে?’ জানতে চাইল রানা।
‘ডেইটার গিসেল। ওই সংগঠনের চিফ।’
‘অপরাধী কোনও সংগঠন?’
‘তা বলতে পারো। নিজেদের বলে পারাটি। শব্দটা এসেছে ল্যাটিন থেকে।’
‘জানি,’ বলল রানা। ‘পারাটি মানে প্রস্তুত হওয়া মানুষ। কিন্তু কী কারণে প্রস্তুত হতে চাইছে তারা?’
কাঁধ ঝাঁকাল এলিস বেলা। ‘ভাল প্রশ্ন। তবে এর কোনও জবাব আমার কাছে নেই।’
রহস্যের কুয়াশা ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পর জানতে চাইল রানা, ‘ঠিক আছে, বলো তো নেউলি-সার- সেইনে তোমাদের এজেন্সির হেডকোয়ার্টারের বাড়িটা কী রঙের?’
‘যা-তা বললেই হলো?’ মাথা নাড়ল এলিস বেলা। ‘আমাদের হেডকোয়ার্টার লেভোলোইসে-পেরেট-এ।’
‘কয়টা ডিপার্টমেন্ট আছে তোমাদের এজেন্সিতে?’
‘আটটা,’ খুব গম্ভীর কণ্ঠে বলল মেয়েটা, ‘ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজি, জেনারেল অ্যাডমিন, ভায়োলেন্ট সাবভারশন, ইকোনমিক, টেরোরিযম, সাপোর্ট, কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স আর ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স।’
তোমাদের আছে এক সিনিয়র এজেন্ট। আকারে বিশাল। উচ্চতা হবে ছয় ফুট আট ইঞ্চি। গালে ক্ষতের দাগ। গোঁফ ঝোপের মত। তার নাম কী?’
‘এদোমন্দ দে লা হৌ,’ দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিল এলিস বেলা। ‘অবসর নিয়েছে কয়েক বছর আগে।’
‘হাতের ডানে বা বামে উলকি?’
‘বাম বাহুর ওপরের দিকে।’
‘ওটার ভেতর কীসের ছবি?’
‘জলপরীর, বলল মেয়েটা। ‘তার বউয়ের নাম কী?’
‘বিয়েই তো করেনি! যে মেয়েকে ভালবাসত, সে বিয়ে করেছিল আরেক লোককে।’
অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে এলিস বেলাকে দেখল রানা। ওর মনে হলো না কোনও কিছু গোপন করছে মেয়েটা। অথবা, এ ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়বে ভেবে ভাল করেই ট্রেনিং দেয়া হয়েছে তাকে। ওর নিজের অনুচিত হবে চট্ করে তাকে বিশ্বাস করা। রাইফেলের নল নিচু করে ক্লিক আওয়াজে সেফটি অন করল রানা।
‘তুমি নিজে আসলে কে?’ বলল মেয়েটা। ‘আমার এজেন্সি সম্পর্কে এত কিছু জানার কথা নয় তোমার। তা ছাড়া, সঙ্গে দেখছি মিলিটারি ইত্য রাইফেল। ওটাও থাকার কথা নয় তোমার কাছে।’
‘আগেই বলেছি, আমি সাধু নই,’ বলল রানা। ‘ভুলে গেছ, জবাব দেবে তুমি, আমি নই। হার্ভার্ট কে ছিল?’
‘পল হার্ভার্ট, মানে যার লাশের ছবি তুলেছ?’
‘তার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন ছিলে। সেটা কেন?’
‘হার্ভার্ট আমাদেরই একজন,’ ক’মুহূর্ত পর বলল মেয়েটা।
‘সে তো ফ্রেঞ্চ ছিল না।’
‘ইংরেজ,’ বলল এলিস বেলা। ‘তুমি নিজে কোন্ দেশের মানুষ? গায়ের রঙ দেখে মনে হচ্ছে উপমহাদেশীয়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান না বাংলাদেশের?’
‘হার্ভার্ট সম্পর্কে বলতে থাকো।’
‘তার আসল নাম জানি না। শুধু এটা জানি, চাকরি করত ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সে। কাজটা ছিল জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন।’
‘মিথ্যা বলছ। খুনিদের একজন ছিল সে।’
‘কাউকে খুন করেনি, প্রতিবাদের সুরে বলল এলিস বেলা। ‘এতে কোনও দ্বিধা রেখো না মনে। বাধ্য হয়ে তাদের সঙ্গে মিশে থাকতে হয়েছে তাকে। এখন অন্যদের সঙ্গে পাওয়া যাবে তার লাশ। তাকে শনাক্ত করা হলে এ কারণে বেশ জটিলতায় পড়বে আমার এজেন্সি।’
‘আমি হলে দুশ্চিন্তা করতাম না, বলল রানা, ‘কারণ, আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে সে। কোথাও পাওয়া যাবে না তাকে।’
‘আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে? কোথায় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে?’
‘এখানেই,’ পোড়া কালো ট্রাক দেখাল রানা। ‘একটা হাড়ও পাবে না।’
ট্রাকের দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা। চোখে ঝড়ের মেঘ। ‘হায়, যিশু! তুমি আসলে কে?’
‘এমন কেউ, যে পছন্দ করত ওই নিরীহ সাধুদেরকে। যার মনে খুনিদের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কিছু নেই।’ আপাদমস্তক মেয়েটাকে দেখল রানা। ‘তোমার হাইট কত?’
‘এক শত বাহাত্তর সেন্টিমিটার,’ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছে এলিস বেলা।
তার পায়ে টর্চের আলো ফেলল রানা। মেয়েটার পরনে হাই-লেগ কমব্যাট বুট। আকারে বেশ ছোট। ‘জুতোর সাইয কত?’
ভুরু কুঁচকে বলল মেয়েটা, ‘ছত্রিশ। পায়ের মাপ দিয়ে কী বুঝতে চাইছ?’
‘মনাস্ট্রিতে খুনিদের পায়ে ছিল তোমার মতই কমব্যাট বুট। সেগুলোর ভেতর ছিল ছোট সাইযের পায়ের ছাপ। ওটার মালিক হয় টিনএজার, নইলে ছোট পায়ের কোনও মেয়ে।’ সন্দেহ নিয়ে মেয়েটার পায়ের দিকে আবারও তাকাল রানা।
‘ছাপগুলো আমার নয়। তুমি দেখেছ ডেইযির পায়ের চিহ্ন।’
‘ডেইযি কে?’
‘ডেইযি বাস্। ডেইটার গিসেলের প্রেমিকা। দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেত্রী। সর্বক্ষণ থাকে গিসেলের সঙ্গে। প্রেমিকের মতই একই পরিমাণ বিপজ্জনক সে।’
এলিস বেলার চোখে তাকাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝে গেল, দৃষ্টিতে একফোঁটা মিথ্যার ছাপ নেই। অথবা, হয়তো বড় অভিনেত্রী সে।
‘তোমার কাছ থেকে জেনে নেব কিছু বিষয়ে,’ বলল রানা। ‘তবে জিজ্ঞাসাবাদ এখানে করব না।’
মেয়েটাকে রাইফেলের নলের ইশারায় ঝোপঝাড় দেখাল রানা। জঙ্গলে ঢুকতেই পায়ের নিচে মটমট করে ভাঙল শুকনো সব ডাল। হামার গাড়ির কাছে থামল ওরা। নতুন করে গুলির আওয়াজ না পেয়ে যে যার নীড়ে ফিরেছে পাখিরা। উত্তেজিত কণ্ঠে ডাকছে অন্ধকারে। মেয়েটাকে গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটের দিকে নিল রানা। বুকে অস্ত্র তাক করে টান দিয়ে খুলল দরজা। ‘ওঠো।’
উঁচু কার্নিশে পা রেখে গাড়িতে উঠল মেয়েটা। একপাশে হামারের গায়ে ঠেস দিয়ে রাইফেল রাখল রানা, সুইচব্লেড ও টেপ বের করল পকেট থেকে। ক্লিক আওয়াজে খুলল ছুরি। চাঁদের আলোয় ঝিক করে উঠল রুপালি ফলা। টেপের রোল থেকে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বেশ কয়েকটা অংশ কাটল রানা। সিটের টিউবের মত ফ্রেমে টেপ দিয়ে আটকে দিল মেয়েটার ডানহাত। টেপের দ্বিতীয় অংশ কাজে এল দুই গোড়ালি জড় করে আটকে দেয়ায়। তৃতীয় টুকরো বন্দি করল তার গোড়ালি ও ডান কবজি। পিছিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করল রানা। রাইফেল হাতে থামল ড্রাইভিং সাইডে। দরজা খুলে রাইফেল রাখল সিটের পেছনে। নিজে উঠে এল ক্যাবে। টেপের চতুর্থ টুকরো ব্যবহার করে সিটের সঙ্গে আটকে দিল মেয়েটার বাম কবজি।
নিজ কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আবারও হামার থেকে নামল রানা। দরজাদুটো লক করে গেল ব্যানওয়ার্টের লাশের পাশে। দুই কবজি ধরে টেনে নিয়ে রাখল ঘন এক ঝোপের কাছে। ফিরল এসইউভির সামনে। পিকনিক স্পটে ঢোকার প্রবেশপথ জুড়ে বসে আছে ওটা। গাড়িটা নিসান হার্ডটপ পিকআপ, ট্রাক। রঙ কালো হলেও গায়ে রাস্তার হলদেটে ধুলো। একপাশে বড় অক্ষরে লেখা: আউট’ল। ইগনিশনে রয়েছে চাবি। স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে উঠল রানা। গাড়ির ভেতরে নতুন-নতুন একটা গন্ধ। গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে জরুরি কিছু নেই। ইঞ্জিন চালু করে হেডলাইট জ্বেলে পিকনিক স্পটের আরেকদিকে চলল রানা। গাড়ি রাখল ব্যানওয়ার্টের লাশের সামনে। তারপর বারকয়েক আগু-পিছু করে অফ রোড চাকা দিয়ে প্রায় চেপ্টা করল লাশ। কাজটা নিখুঁত হলো না। তবে সময় নেই যে তাকে কবর দেবে।
গাড়িটা ওখানে রেখে হেঁটে গিয়ে হামারে উঠল রানা। পাশের সিটে গম্ভীর চেহারায় বসে আছে ওর বন্দি। চালু করতেই গর্জে উঠল হামারের ইঞ্জিন। বাতি জ্বেলে দেয়ায় উজ্জ্বল হেডলাইটের আলো ছড়িয়ে গেল ঝোপের চারপাশে। কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল রানা, তারপর প্যান্টের পকেট থেকে নিয়ে কোলের ওপর রাখল মেয়েটার ছোটখাটো ক পিস্তল।
‘এত টেপ ব্যবহার করলে গরিলাও পালাতে পারবে না,’ রানার কোলে পিস্তলটা দেখছে এলিস বেলা। ‘নাম যা-ই হোক তোমার, তুমি ঝুঁকি নেয়ার লোক নও।’
‘এজন্যেই এখনও মরিনি,’ বলল বিসিআই এজেন্ট, ‘নামটা রানা।’ গিয়ার ফেলল ও। এবড়োখেবড়ো জমিতে দুলতে দুলতে চলেছে হামার। অর্ধবৃত্তের মত এক জায়গা পেরিয়ে আবার উঠল পিকনিক স্পটে। পাশ কাটাল পোড়া বেলফেগর ট্রাক। জঙ্গুলে পথ সোজা গেছে হাইওয়ের দিকে। কালো পিচঢালা রাস্তায় পৌঁছে মুহূর্তের জন্যে দ্বিধায় পড়ল রানা। ডানে যাবে, না বামে? ডানের পথ ওকে নেবে সন্ন্যাসীদের মঠে। বামে পড়বে পুরনো ওই গ্রাম্য ফিলিং স্টেশন। বামে বাঁক নিল রানা। হামার যেন নির্জন রাস্তায় শক্তিশালী বাতিঘর। হেডলাইটের সাদা আলোয় পিছিয়ে পড়ছে গাছের সবুজ সুড়ঙ্গ।