পনেরো
সুইট্যারল্যাণ্ড। প্লেক্সিগ্লাসের জানালা দিয়ে চেয়ে আছে ডেইযি বাস্। উত্তর দিকে উড়ে চলেছে বেল ৪২৯ হেলিকপ্টার। দিগন্তে মিশে গেছে ছবির মত সুন্দর সবুজ ঘাসজমি। চারদিকে খুদে সব বিন্দু। এত ওপর থেকে বোঝার উপায় নেই মাঠে চরছে গরুর পাল। কানে রেডিয়ো হেডসেট আছে বলে রোটরের বিকট গর্জনে বিরক্ত নয় ডেইযি। তাকাল পাইলটের সিটে বসা প্রেমিকের দিকে। ওর মুখে হাসি, চোখে খুশির ঝিলিক।
সত্যিই হিরো ওর প্রেমিক। বরাবরের মতই চোখে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। উত্তর কোরিয়ার সেই ব্যর্থতার পর আজ সফল হয়েছে সে। ডেইটার গিসেলের মত নিজেও আছে ডেইয়ি ফূর্তিতে। যদিও তা প্রকাশ করবে না কারও কাছে। হেলিকপ্টারের রোটরের মতই ধুব-ধুব শব্দ তুলছে অস্থির হৃৎপিণ্ড।
এবার শুরু হবে ওদের মিশনের দ্বিতীয় পর্যায়।
কাত হয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের মাঝে রাখা বড়সড় ডিম- আকৃতির কন্টেইনার দেখল ডেইযি। প্রতিটি ডিম স্ট্র্যাপে বাঁধা। সকালের সূর্যের আলোয় চকচক করছে প্লাস্টিকের শক্ত খোল। ভেতরের জিনিসের জন্যে জীবন দিয়েছে দলের ক’জন। তবে শেষ পর্যন্ত এ-জিনিস হাতের মুঠোয় পেয়েছে ওরা।
এবার একদম বদলে যাবে ওদের জীবন।
একটু পর আঁকাবাঁকা নীল এক নদী পেরোল হেলিকপ্টার।
ওই নদী এক শত একর জমির অর্গানিক এক ডেইরি ফার্মের পশ্চিম সীমানা। ডেইটার গিসেল নিজের এয়ারস্পেস বলে মনে করে এই এলাকা। তার ঠোঁটে ফুটল মৃদু হাসি। অন্যান্য অনেক রিয়েল এস্টেটের মত এটাও কিনে নিয়েছে বিশাল এক কোম্পানি। ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিজ নামে রাখে না সে। সবচেয়ে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করেছে এখানে। অথচ এ খামার নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা-ব্যথা নেই তার। বারো বছর আগে দশ একর নিজের জন্য রেখে বাকি সব জমি লিয দিয়েছে সে এক পরিশ্রমী দম্পতিকে। লোক-লস্কর নিয়ে ভালই চালাচ্ছে ওরা, প্রতি বছর মুনাফা করছে ওই ডেইরি ফার্ম। মুনাফার সামান্য অংশ যাচ্ছে ডেইটারের পকেটে। জমির মালিককে হের ক্রুগারম্যান হিসেবে চেনে খামারমালিক ল্যারি ও ন্যান্সি। তারা খুশি, মোটেও বিরক্ত করেন না জমিদার। মাত্র একবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁদের। সেটা লিয়ের দলিলে সই দেয়ার সময়।
হের ক্রুগারম্যানকে এড়িয়ে চলে তারা। সন্তুষ্ট নিজেদের নব্বই একর জমি ও বিশাল খামারের দেখভাল নিয়ে। মালিক নিজের জন্য রাখা দশ একর জমি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে নিয়ে অসংখ্য গাছ লাগিয়ে দুর্ভেদ্য জঙ্গল বানিয়ে ফেলেছেন। তারই মাঝখানে বিঘা দুয়েক জমিতে তাঁর বাগানবাড়ি ও হেলিকপ্টারের হ্যাঙার। ওখানে তাঁর কিছু শৌখিন গাড়িও আছে। মাঝে মাঝে গিন্নিকে নিয়ে দামি গাড়িতে চড়ে বেড়াতে বের হন জমিদার।
বিশাল বড়লোক।
ল্যারি ও ন্যান্সির সঙ্গে স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দেননি তিনি।
তাতে কী, একটু পাগলাটে হলেও ক্ষতি তো করছেন না কারও!
তা ছাড়া, গুজব ছড়াবার মানুষ নয় ল্যারি ও ন্যান্সি। দিনের বেশিরভাগ ব্যয় করে গরুগুলোর পেছনে।
আকাশপথে খামারবাড়ি পেরোল কপ্টার। পেছনে পড়ল সবুজ খেত ও ঘাসজমি। লাল ট্র্যাক্টর নিয়ে নিচু জমিতে ব্যস্ত ল্যারির ফোরম্যান। ওপর থেকে যন্ত্রটাকে লাগল ছোট্ট খেলনার মত। মাত্র ক’মুহূর্তে পাইন জঙ্গলের ওপর পৌঁছে গেল ডেইটার ও ডেইযি। গোল করে জঙ্গল কেটে মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে হ্যাঙারটা। চারদিকে কংক্রিটের কলামে রয়েছে তারকাঁটার উঁচু বেড়া। হ্যাঙার থেকে বেরোবার বা ফেরার ব্যক্তিগত সড়কের মাঝেও ইস্পাতের জালের উঁচু গেট। কপ্টার স্থির হতেই ল্যাণ্ডিং-বাটন টিপল গিসেল। নামছে যান্ত্রিক ফড়িঙ। আড়াল হলো একটু দূরের ফসলের মাঠ। কংক্রিটের মেঝে স্পর্শ করল কপ্টারের চাকা। গাড়ির মত চলে হ্যাঙারের স্টিলের শাটারের সামনে থামল যান্ত্রিক ফড়িঙ।
ছোট এক রিমোট কন্ট্রোল স্টিলের শাটারের দিকে তাক করল ডেইযি। যন্ত্রটার বুকে আছে দশ ডিজিটের কিপ্যাড। নিচে আরও দুই বাটন। ম্যানিকিউর করা নখ দিয়ে সবুজ বাটনে চাপ দিতেই ওপরে উঠতে লাগল শাটার। গতি হ্রাস পাওয়ায় হুফ-হুফ-হুফ আওয়াজ তুলছে রোটর। শাটার খুলে যাওয়ায় হ্যাঙারের বুকে তৈরি হয়েছে প্রবেশপথ। হেলিকপ্টার নিয়ে হ্যাঙারে ঢুকল ডেইটার। ডেইযি আবারও রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপতেই ওদের পেছনে বন্ধ হলো শাটার।
হ্যাঙারের ভেতর স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠেছে উজ্জ্বল সাদা বাতি। চকচক করছে লাল মেঝে। চারদিকের দেয়াল ধবধবে সাদা। হ্যাঙারের চারভাগের একভাগ জুড়ে রয়েছে ভলভো আর্টিকুলেটেড লরি। ওটা নিয়েই ইতালি ও ফ্রান্সের সীমান্তের কাছে গিয়েছিল পোল ল্যাণ্ডে বার্জার। ডেইটারের ক’জন বিশ্বস্ত অনুচরের একজন সে। তাই জানে, কীভাবে ঢুকতে হয় হ্যাঙারে। ডেইটারের নির্দেশে লরির ট্রেইলার থেকে লেনকো বিয়ারক্যাট বের করে একপাশে রেখে গেছে সে। এ ছাড়া, হ্যাঙারে রয়েছে ডেইটারের আরও ক’টি শৌখিন যানবাহন। সেগুলোর ভেতর রয়েছে ছয় সিলিণ্ডারের ক্লাসিক বেনেলি মোটর সাইকেল, হোণ্ডা গোল্ড উইং আসপেনকেইড, হার্লে ও চকচকে নিচু বডির পাগানি যোণ্ডা সুপারকার। শেষেরটা দেখলে মনে হবে ওটা গাড়ি নয়, কার্বন-ফাইবার দিয়ে তৈরি স্পেস ফাইটার। ট্যাক্সিইং করে সাদা রঙ করা জায়গায় বেল কপ্টার রাখল ডেইটার। রোটরের ঘূর্ণন থামবে, সেজন্যে অপেক্ষা করছে।
প্রথমে হেলিকপ্টার থেকে নামল ডেইটার। একটা একটা করে সাদা ডিম্বাকৃতির কণ্টেইনারগুলো তার হাতে ধরিয়ে দিল ডেইযি। সতর্কতার সঙ্গে ইলেকট্রিক গল্ফ বাগিতে ওগুলো সাজিয়ে রাখল ডেইটার।
সব মিলে আটটা কন্টেইনার।
আপাতত কাজ শেষ। গলফ বাগিতে চেপে বসল ডেইটার ও ডেইযি। ডেইটার প্যাডেল স্পর্শ করতেই চকচকে মেঝেতে নিঃশব্দে ছুটল খুদে গাড়ি।
কেউ হ্যাঙারের জানালা দিয়ে উঁকি দিলে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হতো তার চোখ। যাচ্ছে কোথায় এরা! গলফ কার্ট কোথায় নেবে কার্গো?
হ্যাঙারে নেই গুদামের জন্যে জায়গা বা কোনও ঘর। বিশাল চৌকো এলাকা। অনেকটা গ্যারাজের মত।
কয়েক মুহূর্ত পর আবারও সেই ছোট্ট রিমোট কন্ট্রোল বের করল ডেইষি। এবার টিপল ছয় ডিজিটের কমবিনেশন কোড। দাবিয়ে দিল লাল বাটন। কিছুই ঘটল না তাতে।
তবে কয়েক সেকেণ্ড পর মেঝেতে দেখা দিল চুলের মত সরু একটা চিড়। গোপন হাইড্রলিক গিয়ারের কল্যাণে বড় হতে লাগল ফাটল। মেঝেতে তৈরি হলো দশ ফুট বর্গাকার এক দরজা। বাড়িতে পৌঁছে গেছে ডেইটার গিসেল। হাসিমুখে প্রেমিকাকে দেখল।
‘হ্যাঁ, পেরেছি, চাপা স্বরে বলল ডেইযি। আবেগ প্রকাশের মানুষ নয় সে। তবে মন চাইছে মাথার উপর দু’হাত তুলে নাচতে, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠতে।
‘জানতাম পারব,’ বলল ডেইটার। নীরবে গলফ কার্ট নিয়ে ঢালু র্যাম্প বেয়ে নেমে গেল গোপন ফ্যাসিলিটির ভেতর। তার দলের ক’জন ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানে না এই জায়গার কথা। যারা জানত, যারা বানিয়েছে, তারা কেউ বেঁচে নেই আর।
ষোলো
সন্ন্যাসীদের মঠ ও নিজের মাঝে দূরত্ব তৈরির জন্যে পুরো পনেরো মিনিট উদ্দেশ্যহীনভাবে দক্ষিণ-পুবে চলল রানা। পর্বত পেঁচিয়ে দূরে চলে গেছে অচেনা পথ। কিছুক্ষণ পর খাড়া হয়ে নেমে এল নিচে। দু’পাশে গভীর পাইন জঙ্গল। বড়সড় পাতার গাছগুলো তৈরি করেছে সবুজ সুড়ঙ্গ। পনেরো মিনিটের ভেতর ওদিক থেকে এসেছে মাত্র একটি গাড়ি। কাঁচা সোনার মত ঝলমল করছে সূর্য। মন খারাপ, নইলে আজকের দিনটা রানার মনে হতো স্বর্গীয়।
ডানে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সরু পথ দেখে ওদিকেই বাঁক নিল রানা। এবড়োখেবড়ো মাটিতে দুলতে দুলতে চলল বেলফেগর। পঞ্চাশ গজ দূরে জঙ্গল পরিষ্কার করে বনবিভাগ তৈরি করেছে ত্রিশ গজ বৃত্তাকার ফাঁকা জায়গা। শেওলা ধরা মাটিতে অজস্র শুকনো পাতা। বৃত্তের মাঝে কাঠের বড় এক পিকনিক টেবিল। একটু দূরেই কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ছোট টয়লেট। জায়গাটা ক্লান্ত টুরিস্টদের বিশ্রামের জন্যে। তবে জঙ্গলের বেশি ভেতরে বলে এখানে আসে খুব কম লোকই।
বরাবরের মতই ফাঁকা পিকনিক স্পট।
এতে খুশি রানা। ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ করল, কিন্তু নামল না ক্যাব থেকে। কমেছে কানের ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ। শুনছে নানান পাখির কূজন। গাছের পাতায় ফিসফিস করছে হালকা হাওয়া। এ ছাড়া আছে হাজার পোকার গুঞ্জন। গাছের পাতার মাঝ দিয়ে নেমে উইওস্ক্রিনের ওপর আঁকিবুকি কাটছে সোনালি রোদ।
চুপ করে বসে চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিল রানা। প্রথমবারের মত শিথিল হলো ওর শক্ত চোয়াল। হাত সরাল স্টিয়ারিং হুইল থেকে। প্রতি মিনিটে পঁয়তাল্লিশবার চলছে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। একটু আগেও ছিল বিমর্ষ ও ক্রোধান্বিত। এখন ওই দুই অনুভূতির সঙ্গে যোগ হয়েছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও কঠোর সঙ্কল্প। বরফের মত শীতল ওর মন। বিড়বিড় করল, ‘দেখা হবে। একটু অপেক্ষা করো।’
বের করে মৃত খুনির ফোন দেখল রানা। ওটা কমদামি হলেও আছে ক্যামেরা। স্ক্রল করে কল রেকর্ড ও মেনু ঘাঁটল ও। ফোন করা হয়নি কোথাও। কলও আসেনি। অথবা সব রেকর্ড মুছে দিয়েছে লোকটা।
মেইন মেনু খুলে ছবির ফোল্ডারে ইমেজ পেল না রানা। ক্যালেণ্ডারও ফাঁকা।
এবার গেল সিলেক্টেড কন্ট্যাক্ট-এ।
পেল দশটা নম্বরের সংক্ষিপ্ত লিস্ট। তবে কারও নাম নেই।
এসব নম্বরে কল দিয়ে কয়েক মিনিট ব্যয় করল রানা। প্রতিবার ওদিক থেকে এল জেনেরিক অ্যান্সারফোন রেকর্ডিং।
‘বুঝলাম,’ পকেটে ফোন রাখল রানা। ক্যাব থেকে নেমে আড়মোড়া ভাঙল। গিয়ে ঢুকল টয়লেটে। ওয়াশরুম বাজে ও নোংরা। ফিটিংস্ হিসেবে রয়েছে পুরনো এক বেসিন ও ফাটা আয়না। জায়গায় নেই সাবান বা তোয়ালে। পানি কনকনে ঠাণ্ডা। ফাটা আয়নায় তাকিয়ে ভয়ঙ্কর এক বদ্ধ উন্মাদকে দেখতে পেল রানা। চুল ভরা সাদা ধুলোবালি। কঠোর চোখ লালচে। কাদাটে মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। যুদ্ধের ময়দানে এই হাল হয় সৈনিকদের। পরের প্রায় দশ মিনিট নিজেকে সাধ্যমত সাফ-সুতরো করল রানা। তাতেও ওর মনে হলো না সভ্য জগতের কারও সঙ্গে মিশতে পারবে। এমন কী বন্ধু সোহেল পর্যন্ত পিট্টি দেবে বেশি কাছে গেলে।
ফিরল বেলফেগরের ক্যাবে। ইঞ্জিন চালু করে গিয়ার ফেলে কয়েকবার কসরতের পর ঘুরিয়ে নিল ট্রাক। জঙ্গল ছেড়ে আবারও উঠল রাস্তায়। চলেছে ব্রায়ানকন শহর থেকে আরও দূরে। গাছের ছাউনির মাঝখান দিয়ে সুড়ঙ্গের মত এঁকেবেঁকে গেছে পিচঢালা পথ। মাঝে মাঝে পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে তুষার ছাওয়া পর্বতশৃঙ্গ ও নীল আকাশ।
পনেরো মিনিট চলার পর ডানে ফিলিং স্টেশন দেখল রানা। ওটার পঞ্চাশ গজ আগেই ব্রেক কষে গতি কমাল। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে দেখল জায়গাটা। ফিলিং স্টেশন বলতে কাঠের পুরনো, জীর্ণ ও নিচু একটা ঘর। রাস্তা থেকে ওটা পঞ্চাশ গজ ডাইনে। একপাশে টিনের গোলাবাড়ি। আগে ব্যবহার হতো ফসল রাখার জন্যে। তবে এখন ছাউনি হয়েছে গুদামঘর। এককোণে উঁচু করে রাখা জ্বালানী কাঠ, উল্টোদিকে বিউটেইন ভরা সারি সারি সিলিণ্ডার। দোকানের সামনে কংক্রিটের মেঝেতে দুটো পুরনো আমলের পাম্প। একটা গ্যাসোলিনের, অন্যটা ডিজেলের। দোকানের একটু দূরে বহু পুরনো পেজো ৫০৫ পিকআপ ট্রাক। পেছনের অংশ হলদে জং-এ ভরা। কোথাও গুঁতো খেয়ে ত্যাড়া হয়েছে হেডলাইট। আশপাশে আর কোনও গাড়ি নেই। মাথায় ব্রেটন ক্যাপ পরে গুদামঘরের দিকে চলেছে এক বৃদ্ধ। সে-ই বোধহয় ফিলিং স্টেশন ও পিকআপের মালিক।
এক শ গজ যাওয়ার পর ইণ্ডিকেটর জ্বেলে রাস্তার পাশে থামল রানা। ইঞ্জিন বন্ধ না করে নেমে পড়ল ক্যাব থেকে। হেঁটে চলেছে ফিলিং স্টেশনের দিকে। ভালভাবে দেখবে চারপাশ। একটু পর বুঝে গেল, ওর ধারণাই ঠিক। ওখানে পাবে দরকারি সবকিছু। বড় কথা, ওখানে নেই কোনও সিকিউরিটি ক্যামেরা। আবার গিয়ে ট্রাকের ক্যাবে উঠল রানা। ব্যাক গিয়ার ফেলে ফিরল এক শ’ গজ দূরের ফিলিং স্টেশনে। ট্রাক নিয়ে গিয়ে রাখল পাম্পের সামনে।
বেলফেগর ট্রাকের ডিজেলের অভাব নেই, তবে কাজে লাগবে দাহ্য জিনিস। খদ্দের পেয়ে গুদামঘর থেকে বেরিয়ে এল কুঁজো বৃদ্ধ। খুশি মনে বলল, ‘বোঁযো, মোসিউ।’
ফ্রান্সে এখনও ভদ্র এই সম্বোধন ত্যাগ করেননি বয়স্করা।
বৃদ্ধের কাছ থেকে পাঁচ লিটার পেট্রলের প্লাস্টিকের চারটে ক্যান, স্থানীয় এলাকার ম্যাপ ও এক বাক্স ম্যাচ কিনল রানা। ক্যান ভরে যাওয়ার পর নিজেই ওগুলো তুলে দিল ট্রাকের পেছনে। ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানিয়ে সোজা চলল পিকনিক স্পটের দিকে।
পনেরো মিনিট পর আবারও পৌঁছুল জঙ্গলের ভেতরের সেই বৃত্তাকার জায়গায়। চারপাশ আছে আগের মতই। ঠিক মাঝে টেবিলের পাশে ট্রাক রাখল রানা। ইঞ্জিন বন্ধ করে
সোনা ভরা ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নেমে এল ক্যাব থেকে। জঙ্গলের কিনারায় এক গাছের পাশে নামিয়ে রাখল ব্যাগ। ফিরে এল ট্রাকের কাছে। ওটার লোহার আড়া থেকে খুলল তারপুলিন। ওটা একপাশে ফেলে খুলল টুল লকার। দু’হাতে শার্টের কলার ও কবজির আস্তিন ধরে তুলে আনতে চাইল লাশ।
গহ্বর থেকে ওটা বের করতে ব্যয় হলো মিনিটখানেক। ফ্ল্যাটবেড পাটাতনে শুয়ে রইল লাশ। বিদঘুটেভাবে বাঁকা হয়ে রয়েছে ভাঙা দুই হাঁটু। সবজে-ধূসর রঙ ধরেছে মৃতদেহ। আড়ষ্ট হয়ে উঠছে রিগর মর্টিসে। পকেট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে লাশের গোটা কয়েক ছবি তুলল রানা।
স্ক্রিনে দেখল ছবি। দেখার মত পোর্ট্রেট নয়। তবে এতেই কাজ হবে। সন্তুষ্ট হয়ে ফোন রেখে লাশ টপকে টুলবক্সের দিকে ঝুঁকল রানা। বের করে নিল বোল্ট ক্রপার। ভাল করেই জানে, টুলবক্সের অন্য কিছুই কাজে আসবে না।
‘এক ফোঁটাও ব্যথা পাবে না,’ লাশের উদ্দেশে বলল রানা।
আপত্তিকর কাজটা শেষ হলে মৃতদেহের বুকে রাখল বোল্ট ক্রপার। এক এক করে খুলল পেট্রলের চার প্লাস্টিকের ক্যানের মুখ। প্রতিটি ক্যানের পেট্রল ঢালল ফ্ল্যাটবেড, লাশ ও কাঠের টেবিলের ওপর। সতর্ক থাকল, যেন গায়ে না পড়ে পেট্রল। ভিজে চুপচুপে হলো ক্যাব। রোদের আলোয় বাষ্পের মত উবে যাচ্ছে পেট্রল। খালি ক্যান রাখল আগের জায়গায়। ট্রাক থেকে নেমে পকেট থেকে নিল ম্যাচের বাক্স। একটা কাঠি জ্বেলে ছুঁড়ে দিল ট্রাকের ফ্ল্যাটবেডের ওপর।
আগুনের স্পর্শে জোরালো হাউফ শব্দে জ্বলে উঠল বিশ লিটারের ইউরোসুপার ৯৮। দূর থেকে রানার মনে হলো নাক পুড়িয়ে দেবে গনগনে নীল শিখা। মুহূর্তে ট্রাক ও পিকনিক টেবিল গ্রাস করল আগুন। লাফ দিয়ে আকাশে উঠল লেলিহান শিখা। বাতাসে ভর করে জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ল কালো ধোঁয়া। কিছুক্ষণ ওদিকে চেয়ে রইল রানা, তারপর ব্যাগ কাঁধে তুলে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ফিরে চলল রাস্তার দিকে।
সতেরো
ডেইটার গিসেলের সুইস ফ্যাসিলিটির ভেতর রয়েছে সাবওয়ে টানেলের মত দীর্ঘ সব করিডোর। চকচকে সাদা টাইল্স্ বসানো দু’পাশের দেয়াল। ছাতে উজ্জ্বল নিয়ন বাতি। রাবারের কম্পাউণ্ড দিয়ে তৈরি মেঝে, ফলে হড়কে যাচ্ছে না ডেইটার ও ডেইযির গলফ কার্টের চাকা। হ্যাঙার ত্যাগের পর ঢালু করিডোর নেমেছে এক শ’ গজ দূরের আরেক পাতাল করিডোরে। চারপাশের রিইনফোর্সড কংক্রিটের ওপরে রয়েছে ফসলের মাঠ ও জঙ্গল। ডেইটারের সাধ্য ছিল না সুইট্যারল্যাণ্ডের গ্রাম্য এলাকায় তৈরি করবে এত প্রকাণ্ড পাতাল ফ্যাসিলিটি। আসলে এই স্থাপনা তৈরি করেন বিলিয়নেয়ার লো টর্দু। শিপিং ব্যবসা করে হাজার হাজার কোটি ডলারের মালিক হন তিনি। উনিশ শ’ সাতাত্তর সালের দিকে ভাবতে থাকেন, যে-কোনও সময় ইউরোপ জুড়ে শুরু হবে পারমাণবিক যুদ্ধ। তখন তাঁর পঞ্চাশ বছর বয়স। উনিশ শ’ বিরাশি সালে শেষ হয় তাঁর স্বপ্নের বিশাল বাঙ্কার। ভেবেছিলেন যুদ্ধ বেধে গেলে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের নিয়ে লুকিয়ে পড়বেন মাটির নিচে ফ্যাসিলিটির ভেতর।
কিন্তু প্রকাণ্ড এ পাতাল স্থাপনা তৈরিতে যে টাকা খরচ হলো, তাতেই শেষে লাল বাতি জ্বলল তাঁর ব্যবসার।
ভীষণ হতাশা ও মনোকষ্ট নিয়ে বেঁচে রইলেন আরও আটাশ বছর। নিঃস্ব হয়ে গেলেন ঋণের দায়ে। এদিকে ভেঙে পড়েছে শরীর। বুঝে গেলেন, তিনি বেশি দিন নেই। তা হলে কী হবে তাঁর স্বপ্নের সেই ফ্যাসিলিটির?
আসলে একজনের ক্ষতি আরেকজনের লাভ। দু’হাজার দশ সালে লো টর্ভুর সঙ্গে পরিচয় হলো ডেইটার গিসেলের। সে দেরি করল না সুযোগটা নিতে। কিনে নিল এক শ’ একরের অর্গানিক ফসলের মাঠ। তার আসল চাহিদা ছিল ওটার নিচের এই ফ্যাসিলিটি, যেটা টিকে থাকরে পারমাণবিক বোমা পড়লেও।
সব নিখুঁত করতে খেপে উঠেছিলেন টর্দু। এমন সব হাই- লেভেল স্পেসিফিকেশন যোগ করেন, যেগুলোর কথা জীবনে শোনেনি সাধারণ মানুষ। এই পাতাল স্থাপনা আসলে বিশাল এক দুর্গ। মাত্র আধ মাইল দূরে এক মেগাটন পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হলেও কিছুই হবে না এটার। অর্থাৎ, হিরোশিমার ওপর যে বোমা ফেলা হয়েছিল, তার সত্তরগুণ শক্তিশালী বোমার আঘাত ঠেকিয়ে দেবে এই ফ্যাসিলিটি অবশ্য জায়গাটা কিনে নেয়ার সময় নিউক্লিয়ার যুদ্ধের কথা ভাবেনি ডেইটার গিসেল। তার ছিল অন্য উদ্দেশ্য।
কী নেই এই ফ্যাসিলিটির ভেতর!
একাধিক রিসেপশন রুম, আশিজনের স্লিপিং কোয়ার্টার, কমাণ্ড পোস্ট, আর্মারি, জিমনেশিয়াম, অপারেশন থিয়েটার, মেডিকেল ল্যাব। লো টর্দু ভেবেছিলেন বদ্ধ জায়গায় থাকতে গিয়ে মানসিক ও দৈহিক সমস্যায় পড়তে পারে কেউ, তাই রয়েছে ছোট একটা হাসপাতালও। বাদ পড়েনি কোটি টাকার দামি ওয়াইনের সেলার। গুদামে রয়েছে বিশাল খাবারের মজুদ। এ ছাড়া, রয়েছে পানি ও ফিউয়েলের বিশাল মওজুদ। জেনারেটর, হিটিং সিস্টেম, ওঅটার পিউরিফিকেশন ও এয়ার ফিল্টারেশন সিস্টেম। উনিশ শ’ বিরাশি সালে প্রতিটি জিনিস ছিল অত্যাধুনিক। এখনও ওগুলোর চেয়ে ভাল কিছু আবিষ্কার করা যায়নি। বেচারা যতদিন পারেন ধরে রেখেছিলেন স্বপ্নটাকে, প্রাণে ধরে বেচতে পারেননি।
এককথায় বলা যায়, আত্মগোপনেচ্ছুক যে-কারও জন্যেই এই বাঙ্কার সত্যিকারের স্বর্গ। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে এমন জায়গাই খুঁজছিল ডেইটার গিসেল। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল গোপনীয়তা। এক শ’ একরের জমি ও বাঙ্কার কিনে নেয়ার দু’রাত পর আগুন ধরল জেনেভার আর্কিটেক্ট অফিসে। পুড়ে ছাই হলো টর্ভুর ফ্যাসিলিটির সমস্ত প্ল্যান। যে চিফ ইঞ্জিনিয়ার দেখভাল করেছেন ফ্যাসিলিটির প্রজেক্ট, ক’দিন পর উঁচু এক সেতু থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করলেন তিনি। যদিও কেউ দেখেনি তাঁকে নদীতে ঝাঁপ দিতে। একই বছর পাহাড়ি এক রাস্তায় পোর্শে গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেলেন লো টর্দু। যাঁরা তৈরি করেছিলেন আর যাঁরা জানতেন এই ফ্যাসিলিটির কথা, একে একে মারা গেলেন সবাই। কারও জানা থাকল না গ্রামাঞ্চলে এক শ’ একরের অর্গানিক খামারের নিচে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য পাতাল ফ্যাসিলিটি।
কিছু দিনের ভেতর যারম্যাটের শ্যালে ও লোসানের পেন্টহাউস বিক্রি করে এই ফ্যাসিলিটিতে এসে উঠল ডেইটার গিসেল। সুইস সরকারি নথি অনুযায়ী, সে এমন এক গৃহহীন যুবক, যে সুইট্যারল্যাণ্ডের সবচেয়ে বড়লোক।
এরপর পেরিয়ে গেছে নয় বছরেরও বেশি। পাহাড়ি ঢালে সবুজ ঘাসের মাঠে চরছে অসংখ্য গরু। বাইরের কেউ জানে না মাটির নিচে রয়েছে রিইনফোর্সড্ কংক্রিটের বিশাল এক বাঙ্কার।
এ মুহূর্তে গুদামের দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে ডেইটার ও ডেইযির গলফ কার্ট। ওই গুদাম ওয়্যারহাউসের মতই প্রকাণ্ড। গত নয় বছরে চুপ করে বসে থাকেনি ডেইটার। প্রচুর টাকা খরচ করে কিনেছে দরকারি সব রসদ। আধুনিক করেছে যন্ত্রপাতিগুলো। বিপর্যয়ের সময় কীভাবে টিকে থাকতে হবে, তা শিখে এসেছে মন্টানা ও কলোরাডোর বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। শুধু যে প্রস্তুতি নিয়েছে, তা নয়, ধীরে ধীরে তৈরি করেছে জটিল এক পরিকল্পনা।
স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যে করেনি এসব।
বাঙ্কারের গুদামে এখন রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস। দেড় শ’ ফুটের আর্মারিতে রয়েছে তিন স্তরের উঁচু র্যাক। প্রতিটিতে রয়েছে অনেক ভেবেচিন্তে কেনা আধুনিক সব অস্ত্র। ডেইটারের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তখন ব্যক্তিগত মাঝারি এক সেনাবাহিনী তৈরিতে কাজে লাগবে ওগুলো। বাদ নেই কোনও ক্যালিবারের মারণাস্ত্র ও অ্যামিউনিশন। ইউরোপের সবচেয়ে বড় গোপন ব্যক্তিগত অস্ত্রের মজুদ রয়েছে ডেইটারের। সেজন্যে মনে মনে ধন্যবাদ দেয় তার প্রিয় বন্ধু ভিকি অন্যাথকে। ভবিষ্যতে সে-ই হবে দলের ডেপুটি চিফ। কিন্তু এটা খুব দুঃখের কথা, পচে গেছে ইউরোপের বিচার ব্যবস্থা, ফলে দুর্নীতিপরায়ণ একদল সরকারি অফিসার তাকে আটকে রেখেছে জেলখানায়। তারা একবারও ভাবেনি ভিকি অন্যাথ সাধারণ কোনও অপরাধী নয়।
গলফ কার্টে চেপে যাওয়ার সময় ডেইটারের মনের কথাই যেন বলল ডেইযি, ‘আহা, বেচারা অন্যাথ! কে জানে কেমন আছে! ভাবলে মন ছোট হয় যে সে এখন জেলখানায়!
‘আর ক’টা দিন, তারপরই আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে,’ বলল ডেইটার। ‘সেজন্যে বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।’
আরও দেড় শ’ গজ যাওয়ার পর নীরবে থামল গলফ কার্ট। ‘তারা পৌঁছে গেছে ঠিক জায়গায়। এখানেই রয়েছে ফাঁকা একটা ঘর। ওটা যেন হাস্যরত সুন্দরীর ওপরের পাটি দাঁতের মত— দেখা যাচ্ছে মাঝে দুটো দাঁত নেই!
তবে আজ থেকে আর তেমন লাগবে না।
ঘরের পেছনের দেয়ালে প্রকাণ্ড সিন্দুক। পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত ফায়ার টর্চ ব্যবহার করেও ড্রিল করা যাবে না ওটার পুরু স্টিল। ওই জিনিস ভাঙতে হলে চাই যুদ্ধের ট্যাঙ্কের গোলার আঘাত। নইলে খুলবে না কব্জা, তালা বা পুরু ডালা।
গলফ কার্ট থেকে নেমে সিন্দুকের সামনে থামল ডেইটার ও ডেইযি। সিন্দুকের কমবিনেশন কোড ‘জানে একমাত্র ডেইটার। কোড দেয়ায় নীরবে খুলল স্টিলের দরজা। ভেতর অংশ ইলেকট্রনিকালি তাপ নিয়ন্ত্রিত। পাশাপাশি চারটে খাড়া তাক কোট রাখার লকারের মত।
সাবধানে গলফ কার্ট থেকে নিয়ে সাদা একটা ডিম ওপরের তাকে রাখল ডেইটার। তার হাতে আরেকটা ডিম ধরিয়ে দিল ডেইয়ি। প্রথম ডিমের পাশে ওটা রাখল ডেইটার। একে একে আটটা ডিম গেল সিন্দুকের পেটে। কাজটা শেষ করে পরস্পরের দিকে তাকাল ডেইটার ও ডেইযি। মুখে সন্তুষ্টির হাসি।
সিন্দুক বন্ধ করে নিজেদের কোয়ার্টারে ফিরল ওরা। ফ্রিয থেকে সেরা শ্যাম্পেইন নিয়ে দুটো গ্লাসে ঢালল ডেইটার। একটা গ্লাস দিল প্রেমিকার হাতে। আজকের এ সাফল্যের জন্যে অনেক দিন অপেক্ষা করেছে ওরা।
‘সুন্দর হোক ভবিষ্যৎ,’ বলল ডেইটার। ‘আগামী কয়েক দিনে বদলে যাবে গোটা পৃথিবী। আমরা হব আদম ও হাওয়ার মত।’
‘তা হলে শুরু হচ্ছে আত্মত্যাগী সাধুর অভিশাপ, গ্লাসটা উঁচু করল ডেইযি।
‘হ্যাঁ, তাই,’ মাথা দোলাল ডেইটার। ‘স্বর্গে বসে হাসছে এখন সাধু এখিক সাবাতিয়েখ।’
পরস্পরের গ্লাসে টোকা দিল দু’জন।
টুং করে উঠল দামি স্ফটিক।
আগামী কয়েক দিন পর পাল্টে যাবে এই পৃথিবী। খুশি মনে শ্যাম্পেইনে চুমুক দিল ডেইটার।
‘আমার গর্ব হচ্ছে তোমাকে পেয়েছি,’ হাসল ডেইযি।
মৃদু হাসল ডেইটার। ‘নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছি লিস্ট। জানতে চাও?’
চকচক করে উঠল ডেইযির চোখ।
পকেট থেকে লিস্ট বের করল ডেইটার। টেবিলে নামিয়ে রাখল মদের গ্লাস। তালিকার ভেত্র অনেক কাটাকুটি। ‘সব মিলে আটটা। এগুলো হচ্ছে শুরু।’
‘শোনাও তো কোনগুলো?’ গলা দিয়ে বিড়ালের মত গরগর আওয়াজ বেরোল ডেইযির।
গত কয়েক বছর এ তালিকা নিয়ে কাজ করেছে দু’জন। তবে আগে কখনও সাফল্যের কথা ভাবার সুযোগ আসেনি। লটারিতে যারা মোটা অঙ্কের টাকা জিতে যায়, সবসময় সেরা গাড়ি কিনতে গিয়ে তারা দ্বিধায় পড়ে। বিরাট বড়লোকের ছেলে বলে কখনও টাকার অভাব হয়নি ডেইটারের। তার চাহিদা সব সময়েই ছিল অন্য ধরনের।
‘এই যে,’ বলল ডেইটার, ‘বার্লিন, ব্রাসেল্স্, লণ্ডন, মাদ্রিদ, প্যারিস, রোম আর ভিয়েনা।’
অভিমানে ঠোঁট বাঁকা করল ডেইযি। ‘তুমি তো বললে মাত্র সাতটা শহরের কথা।’
‘আপাতত এ-ই। প্রাগকে বাদ দিয়েছি।’ লিস্ট থেকে চোখ তুলে তাকাল ডেইটার। ‘তোমার কোনও আপত্তি আছে?’
‘তা তো আছেই,’ বলল ডেইযি। ‘এই পৃথিবী কিন্তু আরও অনেক বড়। চিন, জাপান, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর অস্ট্রেলিয়াকে বাদ দেয়া ঠিক নয়। আর আমেরিকা?’
‘একবার কাজ শুরু হলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে,’ বলল ডেইটার। ‘জিনিসটা তো এমনই। বাতাসে ভেসে পৌঁছে যাবে প্রতিটা মহাদেশে।’
‘ডার্লিং, কথা ঠিক। তবে আমাদের উচিত ওদেরকে সাহায্য করা। সেটাই কি ভাল নয়?’
ভুরু কুঁচকে তালিকা দেখল ডেইটার। ‘ঠিকই বলেছ। আমাদের দশজনকে পাঠিয়ে দেব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা আর আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল শহরে। এ ছাড়া থাকছে ইউরোপ।
আরেক চুমুক শ্যাম্পেইন নিল ডেইযি। ‘গুড! চারপাশে ছড়িয়ে দিতে হবে। যাতে দ্রুত কাজ করে।
চকচক করছে প্রেমিকার চোখ। আগে কখনও তাকে এত সুন্দরী মনে হয়নি ডেইটারের। মুচকি হাসল সে। ‘তুমি কিন্তু নেশা ধরিয়ে দিচ্ছ। তোমার মত প্রেমিকা না থাকলে বেঁচে কী লাভ!’
পরস্পরের চোখে চেয়ে হাসল ওরা। তারপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ল বিছানায়।
আঠারো
বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর সামনে থেকে গাড়ি আসতে দেখে ডানহাতের বুড়ো আঙুল ওপরে তুলল রানা। ব্রেকের ক্যাচক্যাচ আওয়াজে ওর পাশেই থামল রেনও ৫। ভেতরে রয়েছেন বয়স্কা দুই বোন। ধর্ষিতা হওয়ার ভয় নেই, ভাবছেন কিডন্যাপও হবেন না। ঝাপসা চোখে দেখলেন হিচ হাইকারের কাঁধে মিলিটারি হ্যাভারস্যাক। ধুলোয় ভরা ম্লান মুখ। গা থেকে আসছে পেট্রল ও ধোঁয়ার মৃদু গন্ধ। তবে ছেলেটার হাসি সত্যি আন্তরিক। কে বলবে একটু আগে লাশ পুড়িয়ে এসেছে! দুই বোনের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না এলেও রানা পেছন সিটে উঠতেই বত্রিশ দাঁত খিঁচিয়ে ওকে ভয় দেখাতে চাইল সাদা এক পুডল কুকুর।
বারকয়েক হোঁচট খেয়ে রওনা হলো গাড়ি। দুই বোনের জীবনের বিশাল কাহিনী চুপচাপ শুনতে লাগল রানা। তবে মাইল দশেক যাওয়ার পর নেমে পড়ল এক গ্রামের কাছে। ওখানেই বাড়ি দুই বোনের। বিদায় নেয়ার আগে রানাকে মধুর হাসি উপহার দিলেন তাঁরা। বাস স্টপের খোঁজে চলল রানা। ওর ম্যাপ অনুযায়ী এখনও ষোলো মাইল দূরে ব্রায়ানকন শহর। সেখানেই যেতে হবে ওকে।
দশ মিনিট পর বাস স্টপে পৌঁছল রানা। জানল, বাস কখন আসবে তার ঠিক নেই। রোদের ভেতর একটা বেঞ্চে বসে থাকল ও, পায়ের কাছে ব্যাগ। কপাল ভাল, আধঘণ্টার মধ্যেই এল রুপালি এক অটোকারস্ রিস্যাল্প কোচ।
ক’জন যাত্রী নেমে যেতেই বাসে উঠল রানা। ঠাঁই হলো পেছনের সিটে। চোখ বুজে বসে থাকল ও। আবার যখন চোখ খুলল, বাস পৌঁছে গেছে ব্রায়ানকন শহরে।
প্রধান বাস স্টেশন ব্যস্ত জায়গা। নানাদিক থেকে আসছে ও ছেড়ে যাচ্ছে বাস। গ্রেনোবল, অ্যাভিগনন থেকে শুরু করে উত্তরের প্যারিস, দক্ষিণ-পুবের ইতালি বা উত্তর-পুবের সুইট্যারল্যাণ্ডে যেতে হলে এটাই প্রধান জংশন। যাত্রীদের মাঝ দিয়ে পথ করে নিয়ে শহরের কেন্দ্রের দিকে চলল রানা। সোনার বার বইতে গিয়ে টনটন করছে কাঁধ। খিদেও লেগেছে খুব। কিন্তু আপাতত সময় নেই রেস্তোরাঁয় যাওয়ার।
একটু পর পৌছুল ফাঁকা এক স্টেশনারি দোকানে। ভেতরে রয়েছে কাগজপত্র, কমপিউটার, প্রিন্ট কার্ট্রিজ, ফটোকপিয়ার মেশিন ও ডেস্কে এক তরুণী ক্লার্ক। মিষ্টি হাসে মেয়েটা। লুটিয়ে পড়েছে কাঁধে বাদামি চুল। হাতে রোমান্টিক উপন্যাস। নিজের সেরা হাসি দিল রানা। দেখলে যে-কেউ বলবে, এ লোক কখনও কোনও অপরাধে জড়াতে পারে না।
তাক থেকে নিল পাতলা সাদা কাগজ, কালো মার্কার পেন, স্ট্যাম্প ও কালির প্যাড। মেয়েটার কাছে জানতে চাইল, ব্যবহার করতে পারবে ওঅর্ক স্টেশন?
জবাবে মৃদু মাথা দুলিয়ে হাসল মেয়েটা। দেখিয়ে দিল কীভাবে চালু করতে হবে ফটোকপিয়ার ও ফ্যাক্স মেশিন।
তরুণীর দিকে পিঠ রেখে উঁচু টেবিলের সামনে থামল রানা। মেঝেতে রাখল ভারী ব্যাগ। ওটা কাঁধ থেকে নামাতে পেরে খুশি। চারকোনা খয়েরি প্লাস্টিকের কপিয়ারের ওপরে বৃত্তাকার অংশে কাঁচের স্ক্যানার স্ক্রিন। শরীর দিয়ে ওটাকে আড়াল করল রানা। পকেট থেকে নিল কাগজে মোড়ানো সসেজ আকৃতির পাঁচটা জিনিস। টেবিলে পাশাপাশি রাখল ওগুলো। ওর কাজে লাগবে ইঙ্কপ্যাড। চৌকো ঢাকনি খুলে প্যাডে তর্জনীর চাপ দিল ও। আঙুলে উঠে এসেছে কালো কালি। এবার খুলল অফিস পেপারের সিল। একটা কাগজ নিয়ে রাখল অন্যান্য জিনিসের পাশে। পকেট থেকে বের করল মৃত খুনির ফোন। মেনু থেকে নিল নম্বর। চট্ করে দেখে নিল পেছনে। কাউন্টারের ওদিকে গভীর মনোযোগে উপন্যাসে মগ্ন তরুণী।
কাগজ দিয়ে মোড়া প্রথম সসেজটা বের করল রানা।
কাটা আঙুলটা ফ্যাকাসে ও রক্তহীন। যেটুকু রক্ত ছিল, সব শুষে নিয়েছে কাগজ। বামহাতের তর্জনীটার শেষ কড়ায় ভালভাবে কালি লাগাল রানা, তারপর ছাপ ফেলল কাগজের বুকে। দেখল ভালভাবেই পড়েছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট। প্রথমটার কাজ শেষ। একে একে বাকি চারটে আঙুলের ছাপ কাগজে নিল রানা। কাগজে মুড়িয়ে নিল সব। অফিশিয়াল কাগজের বুকে ধরা পড়েছে বামহাতের পাঁচ আঙুলের ছাপ। এমন ছাপ নিতে পারলে খুশি হবে জেলখানার ডিউটি অফিসার। ওই এক হাতের ছাপই যথেষ্ট। কালি শুকাবার জন্যে অপেক্ষা করল রানা। খেয়াল করল বই থেকে মুখ তুলে ওকে দেখছে তরুণী। জবাবে দুর্দান্ত আকর্ষণীয় এক হাসি দিল রানা। আবার ঘুরল কাগজের দিকে। মার্কার পেনের খাপ খুলে কাগজে লিখল: একাকী নেকড়ে, এম.আর.নাইন বলছে: হ্যালো!
এবার নিচে লিখে দিল ফোনের নম্বর ও অন্য নম্বরগুলো।
শুকিয়ে গেছে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ছাপ। স্ক্যানারে ঠিক জায়গায় কাগজটা রাখল রানা। ঢাকনি বন্ধ করে প্যান্টের পকেট থেকে নিল মানিব্যাগ। বের করল ইন্টারপোলের কমিশনার অ্যাল মার্লোর কার্ড। বছরখানেক আগে সে ছিল প্যারিসের সাধারণ ইন্সপেক্টর। তবে বেশকিছু কেস সমাধা করে নিজ যোগ্যতায় উঠে গেছে বহু ওপরের পদে। আপাতত আছে লিয়নে ইন্টারপোলের হেডকোয়ার্টারে। নায়কের মত চেহারা। দক্ষ, চতুর ও যোগ্য। অথচ, ছিল তার বৈবাহিক জটিলতা। দুঃখ করে রানাকে বলেছিল, ‘আমিও তোমার মতই একাকী নেকড়ে।
কমিশনার মার্লোর মনে থাকার কথা সেই আলাপচারিতা। কোনও পুলিশ অফিসারের সাহায্য নেবে ভাবার পর থেকেই রানা ঠিক করেছে, কার কাছে চাইবে জরুরি তথ্য। কার্ডের নিচে রয়েছে অ্যাল মার্লোর ফ্যাক্স নম্বর। ওই নম্বর মেশিনে তুলে দিয়ে সবুজ বাটন টিপল রানা। গুঞ্জন ছাড়ল ফ্যাক্স মেশিন। ডিজিটাল রিডআউটে দেখল রিসিপেন্টের উদ্দেশে রওনা হয়েছে ফ্যাক্স। স্ক্যানারের ঢাকনি তুলে কাগজটা নিয়ে ভাঁজ করে মানিব্যাগে রাখল রানা। ব্যাগ তুলে ওটার ভেতর পুরল বাড়তি কাগজ, পাঁচ আঙুল, মার্কার পেন ও ইঙ্কপ্যাড। ফ্যাক্স ব্যবহারের জন্য মেয়েটাকে বুঝিয়ে দিল প্রাপ্য টাকা। একটা হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে এল রোদে। একটু দূরেই রাস্তায় ওয়েস্ট বিন। ওটার ভেতর আঙুলগুলো ফেলে দিল।
মাসের পর মাস বাইরের কেউ যায় না মঠে। নির্জন পাহাড়ে বুনো সব জন্তু খেয়ে নেবে সাধুদের লাশ। রানার উচিত পুলিশে ফোন করে জানিয়ে দেয়া, ওখানে কী ঘটেছে। তবে খুনির ফোন ব্যবহার করে কল করা হবে মস্তবড় ভুল।
কয়েক ব্লক যেতেই রাস্তার কোণে পাবলিক ফোন বুথ পেল রানা। এ জিনিসই খুঁজছিল। কেউ নেই আশপাশে। এখনও এ শহরের পাবলিক ফোন বুথে কর্তৃপক্ষ বসায়নি সিসিটিভি ক্যামেরা। বাক্সের মত ছোট ঘরে ঢুকে ১৭ নম্বর ডায়াল করল রানা। ওদিক থেকে এক পুলিশ অফিসার কল রিসিভ করতেই বিকৃত কণ্ঠে বলল: ‘খুন হয়ে গেছে শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভোর সাধুরা।’
ক্রেডলে রিসিভার রেখে বেরিয়ে এল রানা। হনহন করে হেঁটে চলল শহরের আরেকদিক লক্ষ্য করে। ভাল করেই জানে, একটু পর পাহাড়ি পথে মঠের দিকে রওনা হবে একের পর এক ইমার্জেন্সি ভেহিকেল। সাধু হত্যার তথ্য ঠিক, তা জানলেই একদল পুলিশ ছুটে যাবে ওই টেলিফোন বুথে।
আরও কিছুক্ষণ পর ফাঁকা এক রেস্তোরাঁ দেখে পেছনের টেবিলে গিয়ে বসল রানা। ওয়েইটার আসতেই অর্ডার দিল। পাঁচ মিনিট পর হাজির হলো দুটো প্রকাণ্ড স্যাণ্ডউইচ ও এক গ্লাস লাল ওয়াইন। স্যাণ্ডউইচে কামড় দিয়ে রানা টের পেল, আসলে কতটা ক্ষুধার্ত ও। খাবার শেষ করে আবারও বের করল মোবাইল ফোন। ইন্টারনেটে গিয়ে দেখল এ মুহূর্তে সোনার দর কত করে। তারপর আবারও একবার দেখল কন্ট্যাক্ট লিস্ট। একে একে নম্বরগুলোতে দশবার করে কল দিল। ফলাফল আগের মতই, রিসিভ করল না কেউ। কাউকে কোনও মেসেজ দিল না রানা।
যোগাযোগ করেনি ফরাসী কমিশনার অ্যাল মার্লো।
তাতে হতাশ নয় রানা। ওর ধারণা, সব প্রমাণ মিলিয়ে দেখার পর ঠিক সময়ে কল দেবে সে।
ফোন রেখে রানা ভাবতে লাগল, কে আসলে সন্ন্যাসীর মঠের বিস্ফোরণ এক্সপার্ট। বেশ ক’জন মার্সেনারির নাম মনে পড়ল। নিজেদের কাজে দক্ষ তারা। প্রচুর টাকার বিনিময়ে যে-কোনও সীমান্ত পার করে পৌঁছে দেবে বেআইনি বোমা বা অস্ত্র।
বিশেষ করে দু’জনের কথা মনে পড়ল রানার। ফোন দিলে খুশি হবে ওরা। তবে তাতে কাজ হবে বলে মনে হয় না। বেআইনি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে সাধারণ জীবনে ফিরে গেছে ওরা।
বেশকিছু ইণ্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার করা হয় বোমা।
গার্ডার উড়িয়ে দিতে, বড় গাছ ফেলতে, বা খনি খুঁড়তে, বরফ ভাঙতে, গভীর গর্ত তৈরিতে আইন মেনেই করা হয় এসব কাজ। তবে প্রচুর টাকা পেলে গোপনে বোমা বিক্রি করতে পারে যে-কেউ।
এক কথায়, সপ্তাহের পর সপ্তাহ খোঁজ নিলেও হয়তো জানা যাবে না মঠের নিচে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে কে।
সে কে, তা জানতে গেলে প্রথমেই ঠিক জায়গায় ছড়াতে হবে প্রচুর টাকা। সেটা আপাতত বড় বিষয় নয়। নগদ যে টাকা আছে ওর কাছে, তাতে না কুলালে তুলতে পারবে ব্যাঙ্ক থেকে যত খুশি ডলার। অবশ্য এতেও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বর্তমান ফরাসী মার্সেনারিদের ভেতর এমন কেউ নেই, যে কিনা অন্তর থেকে সাহায্য করবে ওকে।
অবশ্য ব্রায়ানকন শহরেই আছে ওর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু। প্রয়োজনে ওর জন্যে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করবে না সে। এবার ঠিক করেছে সহায়তা নেবে তার কাছ থেকে।
খাবারের বিল মিটিয়ে কাঁধে ভারী ব্যাগ তুলে রেস্তোরাঁ থেকে বেরোল রানা। চলেছে পরিচিত এলাকার দিকে। আধঘণ্টা পর থামল দোতলা এক সাদা বাড়ির সামনে। পাশেই এবড়োখেবড়ো ইঁটের তৈরি সরু গলি। বাড়ির দরজায় কলিং বেলে চাপ দিতেই ভেতর থেকে কী যেন বলে উঠল কেউ।
রানা তৃতীয়বার বেল বাজাতেই খুলে গেল দরজা।
‘কে? ওহ্! আরেহ্, দোস্ত!’ রানাকে দেখে এক কান থেকে আরেক কানে গেল ইশতিয়াক আহমেদ ফারুকের হাসি। ‘কই, এসো!’ রানা ভেতরে পা রাখতেই পেছনে দরজা বন্ধ করে দিল সে। হাতের ইশারায় দেখাল কিচেনের দরজা। ‘আজকেও নষ্ট হলো কৃষক শালার ট্রাক?’
‘না। এবার এসেছি অন্য কাজে।’
‘চলো, কফি খেতে খেতে শুনি।’
কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে টেবিলের পাশের মেঝেতে রাখল রানা। পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসল দুই বন্ধু। একটা মগে কুচকুচে কালো কফি ঢেলে রানার সামনে দিল ইশতিয়াক। নিজেও নিল এক মগ। বলছিলে কী যেন কাজে এসেছ? জড়িয়ে গেছ কোনও ঝামেলায়?’
‘না,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘তবে তোমার কাছ থেকে নেব বেশকিছু জিনিস।’
সাদা মুলো বের করে বিশাল এক হাসি দিল ইশতিয়াক। ‘তোমাকে না দেয়ার মত কিছুই নেই, দোস্ত! ভুলব না, আমার জীবনে এসেছিলে স্বর্গের দূত হয়ে। নইলে বসনিয়ায় খুন হতাম সার্ব সোলজারদের হাতে। আহত, শরীরে এক তিল শক্তি নেই। আর ওই ছয় পিশাচ কয়েন দিয়ে টস্ করছিল, কে আগে গুলি করবে আমার বুকে। ভাবলে গলা শুকিয়ে যায়, খালি হাতে ছয় সৈনিককে খতম করে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিলে বহু দূরের হাসপাতালে। দোস্ত, বলে ফেলো, কী লাগবে।’
‘চাই তিনটে বিষয়ে সাহায্য,’ বলল রানা।
‘শুধু তিন বিষয় কেন, তুমি চাইলে দেব আমার সবই।’
‘প্রথমে চাই ছোট এক বিষয়ে সহায়তা। দ্বিতীয়টা তার চেয়ে একটু বড়। আর তৃতীয়টা বিশাল।’ কফিতে চুমুক দিল রানা।
‘তুমি বললে জান দিয়ে দেব, দোস্ত্।’ অভিমানের ছাপ পড়ল ইশতিয়াকের মুখে। তুমি তো জানো, বেইমান নই!’
‘প্রথম কথা, আমি একঘণ্টা ধরে গোসল করতে চাই।’
‘খুবই উচিত,’ মাথা দোলাল কুচকুচে কালো দানব। ‘গা থেকে কেমন পেট্রল আর ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছি। …এবার দ্বিতীয় যে জিনিস লাগবে, সেটা বলো।’
‘তোমার কাছ থেকে নেব একটা FAMAS রাইফেল আর একটা কালাশনিকভ। সঙ্গে চাই প্রচুর পরিমাণে গুলি।’
‘তাতে কোনও সমস্যা নেই। তৃতীয় জিনিসটা কী?’
‘ধার দেবে তোমার হামার। কত দিনের জন্যে নিচ্ছি, সেটা বলতে পারব না। হয়তো শেষে ফেরতই পাবে না।’
চোখ বড় বড় করে রানাকে দেখল ইশতিয়াক। খপ করে করে ধরল বন্ধুর ডানহাত। ‘গুরু, ওস্তাদ আমার! তুমি কি সত্যিই পীর-আউলিয়া হয়ে গেলে?’
হাতটা ছুটিয়ে নিয়ে শুরু করেছিল রানা, ‘আমি…’
ওকে থামিয়ে দিল ইরাকি যোদ্ধা, ‘ওই হারামি হামারের জ্বালায় জীবন আমার যায় যায়! ওটার জন্যেই তো যত ঝামেলা! আর তুমি একেবারে চেপে ধরেছ সমস্যার গোড়া।’
‘গোড়া? একটু খুলে বলো তো,’ কৌতূহলী হলো রানা।
‘গত ক’দিন আগে প্রিসিলি… তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি… আমার প্রেমিকা… ভোরে ওকে নিয়ে ঘুরতে গেলাম হামারে চেপে। ভেবেছি মুগ্ধ হবে। শহরের মাঝ থেকে ঘুরিয়ে আনলাম দেড় শ’ কিলোমিটার বেগে। তাতেই আমার লেজ, চেপে ধরল প্রিসিলি। এত বিপজ্জনক গাড়ি ঠিকই একদিন খুন করবে আমাকে। ততদিনে হয়তো ওর চারটে ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে! তখন কী হবে? এটাই হচ্ছে ওর আর আমার সমস্যা। গত ক’দিন ধরে ফোন রিসিভ করে না। বান্ধবীকে দিয়ে বলিয়ে দিয়েছে, ওকে সংসারে পেতে চাইলে বিক্রি করতে হবে হামার। এরপর থেকে ছিলাম ভীষণ দ্বিধার ভেতর। তবে একটু আগে তুমি যখন বললে ওটা নেবে, তখন মনে হলো, এটাই চান স্বর্গের মালিক। প্রিসিলিকে বলব ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়েছি ওটাকে। ক’দিনের ভেতর বিয়ে করব। আর তারপর পটাপট নেব একটার পর একটা বাচ্চা। ধরে নাও আমার হামার হয়ে গেছে তোমার।’
মাথা নাড়ল রানা। ‘বদলে কিছু নিতে হবে তোমার।’
‘পুরো একটা ডলার ছাড়ো, ব্যস, ঝামেলা খতম!’
টান দিয়ে ব্যাগ তুলে টেবিলে রাখল রানা। ওটা থেকে বের করল সোনার বার। ‘যা নেব, সেসবের জন্যে এটা রাখবে।’
সোনার ভারী পাত হাতে তুলল ইশতিয়াক। ওজনের কারণে পুরো একইঞ্চি নেমেছে পেশিবহুল বাহু। এপাশ- ওপাশ ঘুরিয়ে দেখল জিনিসটা। বিস্ফারিত হয়েছে চোখ। ‘নকল?’
‘আসল। চব্বিশ ক্যারেটের। ওজন সাড়ে সাত কেজি। প্রতি কেজির দাম ত্রিশ হাজার ইউরোর একটু বেশি। তবে হলমার্ক নেই বলে দাম একটু কম পাবে।’
‘ব্যাপার কী, দোস্ত? শেষে ব্যাঙ্ক ডাকাতি শুরু করলে?’
‘না, তা করিনি।’
‘এত সাহস নেই যে জিজ্ঞেস করব কোথা থেকে পেলে।’
‘এ ব্যাপারে জানতে না চাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।’
‘সোনার এই টুকরো দিয়ে আমি কী করব?’
‘রেখে দেবে। দরকার হলে তখন বিক্রি করবে।’
‘ফেঁসে যাব না?’
‘ভিনসেন্ট গুগলের সঙ্গে কথা বললে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেবে সে।’
‘সে তো বহু টাকার ব্যাপার।’
‘হামার জিপ, দুই রাইফেল আর অ্যামিউনিশনের বদলে। আর তোফা গোসল পুরো ফাও।’
‘আমি তো এমনিতেই ওগুলো দিচ্ছি, রানা!’
‘তো ধরে নাও তোমার চার ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ হিসেবে ওটা উপহার।’ চেইন আটকে আবারও মেঝেতে ব্যাগ রাখল রানা। ‘আরেকটা কথা, হামার নিয়ে আমি কোনও বিপদে জড়িয়ে গেলে, তোমার কাছে আসবে পুলিশ। তাদেরকে বলে দেবে, চুরি হয়ে গেছে গাড়িটা। পুলিশে জানাতে যাচ্ছিলে। মুখ সামলে কথা বললে কোনওভাবেই তোমাকে ফাঁসাতে পারবে না।’
মাথা দোলাল ইশতিয়াক। ‘তোমার কয় বাক্স গুলি লাগবে, রানা? আপাতত আছে একেকটা রাইফেলের জন্যে দশ বাক্স করে গুলি।’
‘তাতেই চলবে।’
‘তো গোসল করে এসো। দু’জন মিলে গুছিয়ে ফেলব রাইফেল আর গুলির বাক্স। উঠে গিয়ে দরজার পাশের বড় পেরেক থেকে কী যেন নিল ইশতিয়াক। ফিরে এসে চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর রাখল হামারের চাবি। ‘তুমি আজই রওনা না হলে পরিচয় করিয়ে দেব প্রিসিলির সঙ্গে।
মাথা নাড়ল রানা। ‘এবার আর সময় করে উঠতে পারব না।’
প্রিয় বন্ধু গেস্টরুমে ঢুকতেই বিড়বিড় করল ইরাকি যোদ্ধা, ‘বুঝেছি, তোমাকে পাব না আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে!’
উনিশ
মনের চোখে একটা মানচিত্র এঁকে নিয়েছে মাসুদ রানা।
ব্রায়ানকন শহর থেকে চারঘণ্টা দক্ষিণে গেলে পৌঁছুবে নিস শহরে। আগে ওটা নিয়ন্ত্রণ করত সিসিলিয়ান ক্রাইম বসেরা। আজকাল তাদের হটিয়ে সাহসী একদল লুঠেরা চালায় শহরের ড্রাগ র্যাকেট ও পতিতালয়। ওখান থেকেই খোঁজ নেয়া যেতে পারে কে বোমা বসিয়েছে সাধুদের মঠে।
অথবা যেতে হবে ব্রায়ানকন থেকে আড়াই শত কিলোমিটার দূরে মার্সেই শহরে। হামার জিপে করে ওখানে পৌঁছুতে লাগবে বড়জোর তিনঘণ্টা। খারাপ শহর হিসেবে নিসকে দশে সাত দেবে রানা। তার এক ধাপ ওপরে রয়েছে মার্সেই। সংগঠিত অপরাধী ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ প্রশাসনের শহর ওটা। বরাবরের মতই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছে গলাকাটা কর্সিকান, তুর্কি, মাগরেবি, পিয়েনোয়া, সেনেগালিয, মানউশ ও ইয়েনিশ জিপসি অপরাধীরা। জুয়া, অস্ত্র, কিডন্যাপিং, টাকার বিনিময়ে খুন, জালিয়াতি, কারও ব্যবসা বা বাড়িতে আগুন দেয়া- এসব নিয়েই আছে ওরা। ড্রাগ ব্যবসা দখলের জন্যে সর্বক্ষণ চলছে খুনোখুনি ও দলাদলি। তবে ইদানীং নতুন একদল ক্রাইম বস চেপে বসেছে অন্যদের ঘাড়ে। তারা যেন হায়েনার পালে সিংহ।
আর সে কারণেই বহু গুণ বেড়েছে অপরাধের মাত্রা। পূর্ব ইউরোপ থেকে হুড়মুড় করে অস্ত্রের চালান আনছে রাশান মাফিয়ারা। অনেকেরই রয়েছে মিলিটারি ট্রেইনিং। তাদের কাছে মানুষের মূল্য পিঁপড়ের চেয়েও কম। একে একে খুন হচ্ছে মিলিউ দলগুলোর ক্রাইম বসরা।
রানার মনোমানচিত্রে রয়েছে আড়াই লাখ বর্গমাইলের এক এলাকা। তার ভেতর এক শত ছিয়ানব্বুই হাজার বর্গমাইলের একটা এলাকা বেছে নিয়েছে ও। এরই ভেতর কোথাও রয়েছে মিলিটারি ট্রেইনিংপ্রাপ্ত একদল খুনি। তারাই খুন করেছে শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভোর নিরীহ সাধুদেরকে। খুনিদের ভেতরে রয়েছে এক লোক, যে কিনা রাশান সিগারেটে অভ্যস্ত। মৃত সাধুর কপালে টিপে আগুন নিভিয়ে নিয়েছিল সে।
মার্সেইর আণ্ডারওঅর্ল্ড রাশান ক্রাইম বসেরা দখল করে নিয়েছে বলেই ওই শহরটা বেছে নিয়েছে রানা। এ মুহূর্তে দক্ষিণ-পশ্চিম মোটর-ওয়ে ধরে ঝোড়ো বেগে মার্সেইর দিকে চলেছে ওর কালো এইচওয়ান হামার। জানালা দিয়ে হু-হু করে আসছে বিকেলের শীতল হাওয়া। পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে দুই লাখ ইউরো দামের সোনার বার নিয়ে রানার ব্যাগটা। পেছনের বুটে একটা হোল্ডঅলে রয়েছে দুটো অটোমেটিক রাইফেল ও কয়েক শ’ রাউণ্ড গুলি। যে কাজে নেমেছে রানা, তাতে খুব জরুরি ছিল হামার গাড়িটা। ওটা ওকে নেবে দুর্গম যে-কোনও এলাকায়। প্রয়োজনে কাজ করবে মোবাইল ক্যাম্প হিসেবে। বলা চলে মিলিটারি অরিজিনের সিভিলিয়ান ব্যাটল ওয়্যাগন ওটা। গোঁ-গোঁ আওয়াজ তুলছে শক্তিশালী ইঞ্জিন।
বিকেলের তপ্ত পরিবেশ শীতল হয়নি, এমন সময়ে মার্সেই শহরে পৌঁছুল রানা। দূর থেকে শহরটা দারুণ আকর্ষণীয়। পেছন দিকে ঝোপঝাড়ে ভরা উঁচু, পাথুরে জমি। অবশ্য কাছ থেকে দেখলে সহজেই চোখে পড়ে, ক্ষয়ে যাচ্ছে নগরসভ্যতা। শহরের মূল কেন্দ্র এড়িয়ে শহরতলীর দিকে চলল রানা। আগেও ওদিকে গেছে বিসিআই-এর বিপজ্জনক মিশনে। জায়গাটা উত্তরদিকের ডিসট্রিক্ট। চারপাশে সস্তা মালসামান দিয়ে তৈরি করা পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট। বহু আগেই ভেঙে ফেলার কথা, তবে গেরাজ্জি করেনি শহর কর্তৃপক্ষ। শহরের ওদিকে চলে না সাধারণ আইন, সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধীরা তৈরি করে নিয়েছে নিজেদের নিয়ম।
এখন লা ক্যাস্টেলেইন নামের ডিসট্রিক্টের দিকে চলেছে রানা। মজুরদের জন্যে তাড়াহুড়ো করে সত্তর দশকে তৈরি করা হয়েছিল অপ্রশস্ত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। তখনও সবাই জানত, কাজ না পেলে ওখানে থাকবে না মজুররা। তারপর এল অর্থনৈতিক মন্দা। বন্ধ হতে লাগল একের পর এক ফ্যাক্টরি। তখন বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়াল হাজার হাজার মজুর। ঠাঁই পেল সরকারি জেলখানায়। নানান ধরনের অপরাধীতে ভরে গেল মার্সেইর ওদিকের এলাকা।
আগের মতই আছে জায়গাটা। মেক্সিকান বসতির ফ্যাকাসে জীর্ণ রাস্তায় এগিয়ে চলেছে রানার হামার। দেখলে যে কেউ বলবে, এটা তিন সালের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইরাকী এলাকা। চারপাশে ধুলোবালি ও ভাঙা বাড়িঘর। এখানে- ওখানে আগুনে পোড়া গাড়ি। প্রতিটি দেয়ালে বাজে ছবি ও তার চেয়েও বাজে মন্তব্য। লোহা বা কাঠের বার দিয়ে বন্ধ প্রতিটি বাড়ির নিচতলার জানালা। দেখলে মনে হবে ওগুলো জেলখানা। পরিত্যক্ত দালানের মাঝে হলদে হয়েছে সবুজ ঘাসের চাপড়া। দশ বা পনেরো বছর আগে যেসব বাড়ি নির্মাণ করতে গিয়েও কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে, সব পড়ে আছে আধ-খাপচা অবস্থায়। চারদিকে ধুলোয় ভরা ঝোপঝাড়। দিনেও শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। রাস্তার পাশে সাদা, ধূসর বা রুপালি রঙের পুরনো সব গাড়ি। ওগুলো দেখলে যে কেউ ভাববে, চারপাশ থেকে হারিয়ে গেছে রঙ। আসলে আশা নেই কারও মনে। পথে পথে ঘুরছে শার্টহীন কিশোর ও তরুণদের দল। মারামারি বা ঝগড়া চলছে নিজেদের ভেতর। পাশ দিয়ে গাড়ি গেলেই ছুঁড়ে দিচ্ছে ইঁট-পাটকেল।
তবে হামার জিপের দিকে এল না ইঁট। ছেলেদের চোখে- মুখে সতর্কতার ছাপ দেখছে রানা। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ব্রায়ানকন শহরে ইশতিয়াকের অতিরিক্ত বড় গাড়িটাকে আপদ মনে হলেও, মার্সেইর নোংরা ও বিপজ্জনক রাস্তায় অন্যকিছু প্রকাশ করে ওটা। ভয়ঙ্কর হিংস্র চেহারা হামারের। তার ওপর কালো টিন্টেড জানালা যেন ছেলেদেরকে বলছে: ওই কাঁচের ওপাশে বসে আছে যে-লোক, সে সত্যিই অনেক বিপজ্জনক!
তেড়িবেড়ি করলে খুন হবে ওরা। কারণ যারা এ ধরনের গাড়ি মার্সেইর এসব এলাকায় চালায়, সাধারণত তারাই নিয়ন্ত্রণ করে এই এলাকা। টাকা সংগ্রহ করে, জানিয়ে দেয় কে বাঁচবে আর কে মরবে। কাজেই হামারের দিকে পাথর ছুঁড়লে পালিয়ে যেতে হবে দেরি না করে। নইলে গাড়ি থেকে নেমেই অন্তত বিশটা গুলি করে ছেলেটাকে খুন করবে মালিক। তাতেই শেষ হবে না সব। খুন হবে ওর বন্ধু, পরিবার ও পরিচিত সবাই। কাজেই এ ধরনের গাড়ি দেখলে সম্মান না দেখিয়ে উপায় নেই মার্সেইর ছেলেদের। এদেরকে দেখে খারাপ লাগছে রানার। কিছুদিনের ভেতর সহজে টাকা উপার্জন করতে গিয়ে ড্রাগ বিক্রি ও পাচারের অপরাধে জেলে যাবে এরা। যারা রয়ে যাবে বাইরে, তাদের কপালও মন্দ। যে-কোনও দিন পিঠে গুলি বা ছুরির গভীর ক্ষত নিয়ে চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়বে ড্রেনের পাশে। মার্সেই শহরে মানুষের গড় আয়ু বড় কম।
আরেকটা পোড়া গাড়ি পাশ কাটিয়ে ভাবল রানা: দুই দলের গোলাগুলি শুরু হলে বিপক্ষ দলকে খুনের পর নিয়ম এখন লাশ সহ গাড়িতে আগুন দেয়া। এরা ওটাকে বলে ‘শিককাবাব’ তৈরি করা। আগ্নেয়াস্ত্রের অভাব নেই চারপাশে। সবার সুদূর স্মৃতিতে আজও রয়ে গেছে, একসময় এদিকে ছিল পুলিশ ও আদালতের আইন-শৃঙ্খলা।
আগেরবার যখন এসেছে রানা, তার চেয়েও চারদিকের অবস্থা বহু গুণ খারাপ দেখতে পাচ্ছে। চোরাবালির মত হতাশা ছাড়া কিছুই নেই মানুষের মনে। ভালভাবে বাঁচার উপায় নেই। আবার প্রথম থেকে গড়তে হবে সব। অথচ, উদ্যোগ নেয়ার মত বড় নেতা নেই। ক্ষয়ে যাচ্ছে মানব- সভ্যতা। যারা করেছে শহরের এ হাল, তাদের হাত থেকে শান্তিপ্রিয় মানুষকে বাঁচাতে হলে, একমাত্র উপায় শিকড় থেকে নরপশুগুলোকে ঝাড়েনংশে উপড়ে ফেলা। কে জানে, ভবিষ্যতে হয়তো ‘বন্দুক-যুদ্ধে’ নামবে ফ্রেঞ্চ সরকার।
কিছুক্ষণ পর পরিচিত এলাকায় পৌছুল রানা। রাস্তার পাশে এক গাছের ছায়ায় রাখল হামার। বন্ধ করল ইঞ্জিন। একটু দূরে পুরনো এক পাঁচতলা বাড়ি। চারদিকে আবর্জনা ও ঝোপঝাড়। সিটে চুপ করে বসে থাকল রানা। টিন্টেড কাঁচের ওদিক থেকে চোখ রেখেছে বাড়ির সদর দরজার ওপর। রাতের আঁধার নামার পর সঠিক সময়ে কাজে নামবে, সেজন্যে অপেক্ষা করছে ও।