দশ
পরদিন সকালে ইশতিয়াক আহমেদ ফারুকের বাড়ির গেস্ট রুমে ভাঙল রানার ঘুম। মনে পড়ল, রাত বারোটায় ফোনে জেনেছে, বেলফেগর ট্রাক মেরামত হবে রাত তিনটের দিকে। ভেবেছিল, তখন গ্যারাজে গিয়ে বুঝে নেবে ট্রাক। তবে রাত- বিরেতে বিদায় নেবে শুনে ফারুক অনুরোধ করল, রাতটা যেন তার বাড়িতেই কাটিয়ে যায় ও।
দুই বন্ধুর অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী ফারুক জানতেও চায়নি, রানা কোথায় উঠেছে বা কোথায় চলেছে। অতীতে ফিরে গিয়েছিল ওরা। মার্সেনারি জীবনের নানান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একের পর এক বিয়ারের ক্যান শেষ করেছে ফারুক, আর ওর সঙ্গে তাল দিতে গিয়ে গোটা সাতেক বিয়ার গিলে ফেলেছে রানা।
এখন চোখ মেলে বুঝল, হ্যাংওভারের ব্যথায় টিসটিস করছে কপাল। দৃষ্টি গিয়ে পড়ল একটু দূরে দেয়াল ঘেঁষা এক র্যাকের ওপর। ওটায় হেলান দিয়ে রাখা নানান আগ্নেয়াস্ত্র। ইরাক ছেড়ে ফ্রান্সে এলেও সুযোগ পেলে দুর্লভ অস্ত্র সংগ্রহ করে ফারুক। সেগুলোর ভেতর রয়েছে রোমানিয়ান একে-৪৭। ভাঁজ করা যায় স্টক। ঠিক জায়গায় তিরিশ বুলেটের বাঁকা স্টিলের ম্যাগাযিন। পুরনো অস্ত্র হলেও নিয়মিত তেল দেয়া হয় বলে চকচক করছে ইস্পাত। ওটার পাশেই FAMAS রাইফেল। গত ত্রিশ বছর ওটা ব্যবহার করছে ফ্রেঞ্চ আর্মি। পিস্তল গ্রিপের পেছনে রিসিভার। বেঁটে অটোমেটিক ওয়েপন হলেও ব্যারেল স্বাভাবিক রাইফেলের সমান। ম্যাগাযিনে পঁচিশটা বুলেট। তা ছাড়া, মাযলের সঙ্গে রয়েছে সাধারণ বেয়োনেট।
বিছানা ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে আড়মোড়া ভাঙল রানা। নিচে সরু গলি। ওদিকে আস্তরহীন ইঁটের দালান। ঘুরে দরজার দিকে এগোতেই পেল কড়া কফির সুবাস।
ঘুম ভেঙেছে ফারুকের। এবার এক কেতলি কালো কফি ও টোস্ট বিস্কুট নিয়ে বসবে সে।
করিডোরে বেরিয়ে এল রানা। ওদিকের ঘর পেরোতেই সামনে পড়ল প্রকাণ্ড কিচেন। টেবিলের পাশে আর্মচেয়ারে বসেছে ফারুক। ইরাকি হলেও গায়ের রঙ আলকাতরার মত। পরনে লাল টি-শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট। রানাকে ঘরে ঢুকতে দেখে হাসল সে। ‘কী? সব ঠিক, দোস্ত?’
তার পাশের চেয়ারে বসল রানা।
মগে কফি ঢেলে ওর সামনে রাখল ফারুক। ‘মুখ এত ব্যাজার কেন? প্রেমিকা খুন হয়েছে, না পালিয়ে গেছে? গতকাল কিছুই তো বললে না!’
কপাল টিপতে টিপতে কফির মগে চুমুক দিল রানা। ‘তুমিও তোমার ব্যাপারে কিছুই বলোনি। এক শ ক্যান বিয়ার গিললে আর বললে পুরনো দিনের কথা।
… ওদিকের ঘরে জি টু ফ্যামাস দেখলাম। ওটা কোত্থেকে পেলে?’
বজ্রের সাদা ঝিলিক তুলে বত্ৰিশ দাঁত দেখাল ফারুক। ‘পেয়েছি ফ্রেঞ্চ এক মার্সেনারি বন্ধুর কাছ থেকে। তা-ও কয়েক বছর আগের কথা।’
‘ভাল।’
‘কী ভাল?’
‘ভাল আছ।’
‘তা বলতে পারো। টাকার অভাব নেই।’
‘গতকাল বাড়ির সামনে কালো একটা হামার দেখলাম। ওটা তোমার?’
গাড়িটা এইচ ওয়ান হামার। ইউএস আর্মির এম৯৯৮ হামভির সিভিলিয়ান সংস্করণ। এইচএমএমওয়াইভি বা হাই- মোবিলিটি মাল্টিপারপাস হুইল্ড ভেহিকেল।
‘হ্যাঁ। ক’মাস আগে পোকার খেলে জিতে নিয়েছি। তবে ইনশিয়োরেন্স করাতে যে টাকা লাগবে, তাতে ভাবছি আপাতত অত টাকা নষ্ট করব না।’
চুপ করে থাকল রানা। কফিতে চুমুক দিচ্ছে ওরা। দ্বিতীয় মগ শেষ করে বলল রানা, ‘আমাকে পৌঁছে দেবে একটা গ্যারাজে?’
‘কীসের গ্যারাজ? গাড়ি নষ্ট হয়েছে তোমার?’
‘গেলেই দেখবে।’
বিশ মিনিট পর এইচ ওয়ান হামারে চেপে মেকানিকের গ্যারাজে গিয়ে উপস্থিত হলো ওরা।
রানা বেলফেগর ট্রাক নিয়ে শহরে এসেছে বুঝে হাঁ হয়ে গেল ফারুক। মাথা নাড়ল বারকয়েক। ‘দোস্ত! ভাল কোনও চাকরি নেই? বুড়ো হদ্দ কোনও চাষার হাজার বছর আগের ট্রাক চালাচ্ছ? কী হয়েছে তোমার? টাকার এত অভাব? না- না, আমি আমার অর্ধেক টাকা দিয়ে দেব। তাতে চলবে?’
মৃদু হাসল রানা। ‘টাকার সমস্যা নেই। পরে কখনও বলব কীভাবে পেলাম এই ট্রাক। লম্বা কাহিনী।’
সকাল আটটায় খুলে গেছে গ্যারাজ।
এখন বাজে সাড়ে আটটা
রানাকে দেখে হাঁফ ছাড়ল হেড মেকানিক। ‘বাঁচলাম! আমি তো ভেবেছি আমার ঘাড়ে ওটাকে ফেলে সটকে পড়েছেন!’
‘মেরামত হয়েছে?’ জানতে চাইল রানা।
‘কাজ শেষ ভোর চারটেয়। তারপর দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারিনি বাকি রাত- ভেবেছি: মজা করতে ওই ট্রাক চাপিয়ে দিয়েছেন আমার মাথায়!’
‘আমি বোধহয় অতটা খারাপ লোক নই,’ হাসল রানা।
ওর হাতে ট্রাকের চাবি গছিয়ে দিল মেকানিক। ‘ওই জিনিস নিয়ে ভুলেও ইউরোপ ঘুরতে বেরোবেন না। ভীষণ অসুস্থ টাইপের বুড়ি মহিলা।
‘বেলফেগর মহিলা প্রথম শুনলাম,’ বিড়বিড় করল ফারুক।
‘এবার রওনা দেব,’ তাকে বলল রানা। ‘একটু তাড়া আছে। আবার দেখা হবে পরে।’
‘কবে?’ মাথা নাড়ল ফারুক। ‘রাতে আড্ডাই দিতে পারলাম না। এমন কী বলিনি কীভাবে লাখ বিশেক ডলার পেলাম।’
‘যে-কোনও দিন হাজির হয়ে যাব। তখন শুনব সব।’
‘প্রমিয?’
‘যাও, প্রমিয।’
একবার মাথা দুলিয়ে হামভিতে চাপল ফারুক। গর্জে উঠল গাড়ির শক্তিশালী ইঞ্জিন। একরাশ ধুলো ছিটকে বাড়ির পথে চলল প্রাক্তন মার্সেনারি। মানিব্যাগ বের করে মেরামতির বিল মিটিয়ে দিল রানা। গিয়ে উঠল বেলফেগরের ক্যাবে। চাবির কান মুচড়ে দিতেই ঘড়-ঘড় শব্দে জেগে উঠল পুরনো ইঞ্জিন। রানার মনে হলো না, কোথাও সমস্যা আছে। একবার দেখল ঘড়ি: পৌনে নয়টা।
বেশিক্ষণ লাগবে না সন্ন্যাসীদের মঠে পৌঁছে যেতে। তবে স্বাভাবিক গতির চেয়ে কম বেগে যেতে হবে ওকে। রক্তে প্রচুর অ্যালকোহল। খাড়া পাহাড়ি পথে অসতর্ক হলে সোজা গিয়ে পড়বে হাজার ফুট নিচের খাদে।
শহর পেছনে ফেলে ক্রমেই ওপরে উঠেছে সরু পথ।
কিছুক্ষণ পর বহু নিচে পাইনের সবুজ অরণ্য দেখল রানা।
জানালা দিয়ে হু-হু করে ঢুকছে তাজা হাওয়া। তাতে কমল ওর মাথাব্যথা।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর সন্ন্যাসীদের মঠের পরিচিত পাথুরে প্রাচীর দেখল রানা। কেন যেন কু ডাকল ওর মন।
এমনিতে বন্ধ থাকে মঠের প্রধান গেট। ওটা এখন হাট করে খোলা। রানা ভাবল, হয়তো ওর জন্যেই চওড়া দরজা খুলে রেখেছে সাধুরা। পরক্ষণে চিন্তা এল: যারা সবসময় দূরে রাখে দুশ্চিন্তা, আজ কেন খামোকা ভাববে? হয়তো প্রার্থনায় বসেছে তারা? না, তা-ও মনে হচ্ছে না! নিশ্চয়ই ঘটেছে খারাপ কিছু!
মঠের কাছে পৌঁছে গলা শুকিয়ে গেল রানার। গেট খোলে বাইরের দিকে। কিন্তু দু’পাল্লা ঝুলছে এখন ভেতর দিকে!
ফেটে গেছে পুরু কাঠের তক্তা। পাথরের মজবুত পিলার ভেঙে ছিঁড়ে এসেছে লোহার একটা কব্জা।
ট্রাক থামিয়ে ভাঙা গেটের দিকে তাকাল রানা। বুঝে গেছে, ও যখন ছিল না, ঘটেছে এখানে অস্বাভাবিক কিছু।
শত শত বছর প্রাকৃতিক অত্যাচার সয়েছে ওক কাঠের গেট। পুরো আট ইঞ্চি পুরু। বেঁধে নেয়া হয়েছিল লোহার পাত দিয়ে। পাথরের চেয়ে কম শক্ত ছিল না। পেছনে কব্জির সমান পুরু হ্যাস্পবোল্ট। ওটা ভেঙে দরজা উল্টো দিকে ঠেলে এগোতে গিয়ে লেগেছে প্রচণ্ড শক্তি। ভারী আর্মার্ড কার বা যুদ্ধের ট্যাঙ্কের মত কিছু দ্রুত বেগে গিয়ে ভেঙে দিয়েছে গেট।
বেলফেগর ট্রাক নিয়ে প্রশস্ত উঠানে থামল রানা।
হতবাক হয়ে গেছে সামনের দৃশ্য দেখে।
এগারো
ডানা হুড়িয়ে বসে লাশের গায়ে ঠোকর দিচ্ছে সাদা এক কাক। ট্রাকটাকে এগোতে দেখে উড়ে গেল জঙ্গলের দিকে। মৃতের পরনে সাধুর জোব্বা। বুকে ছোপ-ছোপ খয়েরি দাগ। পড়ে গিয়েছিল মুখ থুবড়ে। শুকাচ্ছে চারপাশের রক্ত। দু’হাতে খামচে ধরেছিল মাটি। এক পা ভাঁজ করা। বোধহয় সরতে চেয়েছিল ক্রল করে। কিন্তু শরীরে শক্তি ছিল না।
কীসের পিণ্ড রেধে গেছে রানার গলায়। ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ করে ক্যাব থেকে নেমে পড়ল উঠানে। মনে অযৌক্তিক চিন্তা। সাধু হয়তো মারা গেছে হার্ট অ্যাটাকে বা ব্রেইন স্ট্রোকে। লাশের দিকে ছুটে গেলেও কয়েক ফুট আগেই থামতে হলো ওকে। উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে আরও লাশ। নাড়িভুঁড়ি সাপের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে গেল রানার পেটে।
এরা সবাই ওর পরিচিত সাধু!
অন্তত সাতজনকে দেখছে রানা। অষ্টমজন হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে গুদামের ছায়ায়। নবমজন উঠতে চেয়েছে নিচু দেয়ালে। ঝুলছে ওখানেই। চারপাশে থকথকে রক্ত! উঠানে বয়ে গেছে লাল আঠালো নদী। সূর্যের তাপে হয়ে উঠছে খয়েরি। লাশের ওপর বসে গেছে একপাল মাছি। আরেক দল উড়ছে ভনভন শব্দে।
কাছের লাশের দিকে এগোতেই কী যেন পড়ল রানার বুটের নিচে। ওটা শক্ত হলেও পাথর নয়। ঝুঁকে জিনিসটা তুলল রানা। মরাটে রঙের তামার তৈরি খোসা। গায়ে খোদাই করা: WIN 9mm LUGER.
শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভো আশ্রমে এ জিনিস একেবারেই অচেনা হলেও ভাল করেই চেনে রানা।
স্ট্যাণ্ডার্ড নাইন-মিলিমিটার অ্যামিউনিশন। তৈরির জন্যে ইউটা রাজ্যের মর্গান ব্রাউনিং আর্মসকে অনুমতি দিয়েছে উইনচেস্টার রিপিটিং আর্মস কোম্পানি। অনেকে ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত খুদে এ বুলেট। হাই-প্রেশার, হাই- ভেলোসিটি। উনিশ শ’ দুই সালে আবিষ্কারের পর থেকেই ব্যবহার করেছে প্রায় প্রতিটি সেনাবাহিনী। কমব্যাট পিস্তল ও সাবমেশিন গানের গুলি হিসেবে জনপ্রিয়। সাবসনিক বলে ভেঙে দেয় না সাউণ্ড ব্যারিয়ার। আওয়াজ প্রচণ্ড নয়। তার ওপর সাইলেন্সার থাকলে শব্দটা হবে মৃদু কাশির মত। আইনি সংস্থার কান এড়াতে প্রচুর গোলাগুলির সময় এ অ্যামিউনিশন ব্যবহার করে ক্রিমিনালরা।
কিন্তু এই জিনিস কেন সন্ন্যাসীদের মঠে?
আজ কেন হঠাৎ লাশ হলো এতগুলো নিরীহ মানুষ?
কারও সাতে-পাঁচে থাকত না সাধুরা।
খোসার কালো মুখটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকল রানা। করডাইটের কটু গন্ধ বলছে ফায়ার করা হয়েছে সম্প্রতি। উঠানের নানাদিকে ছড়িয়ে আছে বুলেটের খোসা। সূর্যের আলোয় চকচক করছে হলদে গা।
গুলির খোসা ফেলে চারপাশ দেখল রানা।
এটা দু’একজনের কুকীর্তি নয়। ওরা এসেছিল দল বেঁধে। জানার উপায় নেই তারা কারা বা কয়জন ছিল। তবে অন্তত ছয়জন বা আটজন হামলা করেছে এখানে।
কিন্তু কী কারণে একদল সাধুকে খুন করবে কেউ?
মনের মাঝে কোনও জবাব পেল না রানা। বসল লাশের পাশে। শুকাতে শুরু করেছে খয়েরি রক্তে মাখা মাথার চুল। জোব্বা ভেদ করে শোল্ডার ব্লেডে বিধেছে বুলেট। ওই ক্ষত ঠুকরে মাংস খাচ্ছিল কাক। ক’পা হেঁটে পড়ে গেছে সাধু। মাটিতে রক্তের চিহ্ন। তখনও ক্রল করেছে কয়েক ফুট। এরপর কাছে এসে মাথায় গুলি করেছে খুনি।
দু’কাঁধ ধরে সাধুর লাশ চিত করল রানা। ত্বক শীতল। পাল্স্ দেখা অনর্থক। এরই ভেতর রিগর মর্টিসে কাঠের তক্তার মত শক্ত হয়ে উঠেছে দেহ। সাধুর কপাল ফুটো করেছে বুলেট। ওখানে যে গর্ত, তার ভেতর ঢোকানো যাবে আস্ত একটা গল্ফ বল। ভয়ানক বিকৃত হয়েছে সাধুর চেহারা। তবুও তাকে চিনল রানা। বুড়ো সাধু ফ্রায়ার রুডলফ। দু’জন মিলে মেরামত করেছিল কয়েকটা আসবাবপত্র। হাসিখুশি মানুষটাকে পছন্দ করত রানা। অন্যরাও ছিল ওর প্রিয়। আহত, অসুস্থ অবস্থায় ও আশ্রয় পেয়েছিল এই আশ্রমে। সবার আচরণ ছিল সহানুভূতিপূর্ণ।
উঠে আরেকটা লাশের সামনে থামল রানা। এরপর গেল আরেকটার পাশে। চতুর্থ ও পঞ্চম লাশও অন্যগুলোর মতই। গুলি করে মারা হয়েছে প্রত্যেককে। আড়ষ্ট হয়ে উঠেছে শীতল দেহ। ব্যবহার করা হয়েছে নাইন মিলিমিটারের হলোপয়েন্ট বুলেট। ছোট ফুটো তৈরি করে ঢুকেছে দেহে, বেরোবার সময় মস্ত বড় গর্ত। সবাইকে গুলি করা হয়েছে অন্তত দু’বার। একবার বুকে, আরেকবার মাথায়। আর্মিতে এই একই শিক্ষা দেয়া হয়। প্রথমে গুলি করো বুকে বা পেটে, তারপর টার্গেট পড়ে গেলে খতম করো মাথায় গুলি করে। তাতে বাঁচার উপায় থাকে না কারও।
রানা বুঝে গেল, খুনিরা ব্যবহার করেছে পিস্তল।
উঠানে লাশের মিছিল ফেলে দালানে ঢুকল রানা। নানাদিকে আছে মৃতদেহ। গির্জার বাইরে কয়েকজন। বেঁচে নেই কেউ। যেদিকে পা বাড়াচ্ছে রানা, দেখছে লাশ। বাগানের নিচু দেয়ালে হুমড়ি খেয়ে আছেন ফ্রায়ার রোবি। সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। এখনও গোড়ালিতে সাদা ব্যাণ্ডেজ। দেয়ালে থকথক করছে রক্ত। উড়ে গেছে তাঁর মাথার একাংশ। একটু দূরেই দুই যমজ ভাই ফ্রাঁসোয়া ও মার্ক। সেলার থেকে বিয়ার তোলার সময় রানার পাশে হাত লাগিয়েছিল ওরা। বাগানের পাশে বয়স্ক এক সাধু। প্রথমে গুলি করেছে পেটে, তারপর গলায়। বোধহয় বিরক্তি বোধ করছিল খুনি, তাই মাথার বদলে গুলি করেছে কণ্ঠনালীতে।
ধীরে হাঁটছে রানা। কষ্ট হচ্ছে বাস্তবতা মেনে নিতে। বারবার মন বলছে, ও আসলে আছে ঘুমের ভেতর। একবার জেগে গেলেই দেখবে এসব আসলে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।
একই কথা ঘুরছে ওর মনে।
কারা করল এই নৃশংস কাজ?
কেন? কেন খুন হলো এই নিরীহ মানুষগুলো?
রানা ডাক্তার না হলেও দেখেছে অনেক মৃত্যু। জানে, কেউ মরলে প্রতি ঘণ্টায় লাশের তাপমাত্রা কমবে ১.৫ ডিগ্রি করে। পরিবেশ শীতল হলে আরও দ্রুত কমে দেহের তাপ। বছরের এ সময়ে অ্যালপাইনের চমৎকার পরিবেশে তাপমাত্রা গড়ে আঠারো ডিগ্রি সেলসিয়াস। তারচেয়ে প্রায় বিশ ডিগ্রি উষ্ণ থাকে মানুষের দেহ। তার মানে, পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লাশ শীতল হতে সময় নেবে অন্তত তেরো ঘণ্টা। অবশ্য ভোরের শীতে দ্রুত হ্রাস পাবে দেহের তাপ। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যেত সাধুরা মারা গেছে দশ ঘণ্টা আগে। থার্মোমিটার নেই যে তাপ মেপে দেখবে রানা, কিন্তু এটা বুঝে গেছে এসব দেহ এখনও পরিবেশের চেয়ে উষ্ণ। এ থেকে এটাও বুঝতে পারছে, হামলা হয়েছে আন্দাজ পাঁচ ঘণ্টা আগে। এরপর ধীরে ধীরে লাশে ছড়িয়ে গেছে রিগর মর্টিস
হাতঘড়ি দেখল রানা। সময় এখন সকাল সাড়ে নয়টা। ওর ভুল না হলে সাধুদেরকে খুন করেছে ভোর সাড়ে চারটার দিকে। এমনিতে সেসময় নিজেদের শেষ প্রার্থনার পর গির্জা ছেড়ে যার যার কুঠরিতে ফেরে তারা। দুই-এক ঘণ্টা বিশ্রাম বা ঘুমের পর শুরু হয় পরদিনের কার্যক্রম।
গতরাতে কেন ফিরলাম না, ভাবনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে রানার মনে। চারটায় মেরামত হয়েছিল ট্রাক। ফিরলে হয়তো নিষ্ঠুর লোকগুলোকে বাধা দিতে পারত ও।
কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই!
পরবর্তী বিশ মিনিট এক এক করে সাধুদের কুঠরি ঘুরে দেখল রানা। বেশিরভাগ কক্ষ খালি। অন্যগুলোর ভেতর লাশ। বেঁচে নেই মঠের কেউ!
নবিস সাধুদের প্রধান ও মঠের প্রধান সাধুর ঘরে তাঁদেরকে পেল না রানা। গিয়ে ঢুকল গির্জায়। দরজার কাছেই আছেন মাথা-ন্যাড়া এক সাধু। সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে নেমে জমাট বেঁধেছে রক্ত। তাঁকে পরিষ্কার চিনল রানা।
নব্য সাধুদের নেতা ফ্রায়ার জিলেস। ডানহাত তুলে ঠেকাতে চেয়েছেন গুলি। ফুটো হয়েছে হাতের তালু। ওই একই বুলেট বাম ভুরুর উপরের হাড় ভেদ করে ঢুকেছে মগজে। উড়ে গেছে মাথার খুলি। তিনি যে বেঁচে নেই তা বুঝতে দ্বিতীয়বার তাকাতে হলো না রানাকে।
কিন্তু সাধুর কপালে প্রায় জমাট বাঁধা রক্তে কী যেন!
দু’সেকেণ্ড পর ঝুঁকে জিনিসটা নিল রানা। ওটা দৈর্ঘ্যে একইঞ্চি। আকৃতি বুলেটের খোসার মতই। গায়ের রঙ হলদেটে। তবে তামার তৈরি নয়, নরম। ওজনে খুব অস্বাভাবিক হালকা।
সিগারেটের ফিল্টার।
আগেও ওই ব্র্যাণ্ডের সিগারেট দেখেছে রানা।
রাশান।
ফিল্টারের গায়ে এমব্লেযন করা রাশার যারের রাজকীয় ঈগলের ছবি। টিপে নেভানো হয়েছে আগুন। বেরিয়ে এসেছে সামান্য তামাক। তাতে মেখে আছে রক্ত। তিক্ত চেহারায় জিনিসটা দূরে ছুঁড়ল রানা। মৃত সাধুর কপালে বৃত্তাকার পোড়া দাগ।
মানুষকে গুলি করে খুন করা, আর লাশের গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে নেভানো অন্য কথা।
রানা বুঝে গেল, ওই দলের লোকগুলো সত্যিকারের হারামি।
রক্ত এড়িয়ে এগোল রানা। বিশাল ঘরে আগরবাতি ও মৃত্যুর শীতল গন্ধ। শত শত বছর আগের দক্ষ রাজমিস্ত্রির তৈরি মোজাইকে গড়িয়ে গেছে প্রচুর রক্ত।
গির্জার ভেতর তেরোটা লাশ। প্রার্থনায় বসেছিল সবাই। মারাও গেছে একই সময়ে। এসব মৃতদেহের ভেতর রয়েছেন প্রধান সাধু অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড। খুব শান্ত চেহারা, যেন ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে তাঁর পাশে বসে থাকল রানা। মনে পড়ছে দাবা খেলার সময়গুলো। মানুষটার ঠোঁটে থাকত মিষ্টি হাসি। অন্যদের মতই রানার প্রতিও ছিল তাঁর অঢেল স্নেহ।
‘কথা দিলাম, ওদেরকে খুঁজে বের করব, ফাদার, ‘ বিড়বিড় করল রানা।
অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড বেঁচে থাকলে মৃদু হেসে বলতেন, ‘ভেনজেন্স ইয মাইন, সেথ দ্য লর্ড। কাজেই মানুষের উচিত নয় প্রতিশোধ নেয়া।’ বা হয়তো যোগ করতেন, ‘যিশু বলেছেন, যারা তোমার ওপর অত্যাচার করেছে, তাদের জন্যে হৃদয়ে রেখো ভালবাসা। প্রার্থনা কোরো তাদের জন্যে। সেক্ষেত্রে হয়তো দয়া পাবে স্রষ্টার কাছ থেকে।’
আনমনে মাথা নাড়ল রানা।
এ ধরনের পশুদেরকে ক্ষমা করার সাধ্য ওর নেই।
উঠে গির্জা থেকে বেরোল রানা। রক্তাক্ত সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে এল উঠানে। গিয়ে ঢুকল প্রধান দালানে। এখানেই রয়েছে সাধারণ সাধুদের ঘর। বাইরের দিকের পাথুরে মেঝেতে পেল আরও তিনটে লাশ।
তাদের দু’জন ওর পরিচিত সাধু।
তবে অন্যজন একেবারেই অচেনা।
এ লোক সাধুদের কেউ নয়। পরনে কালো কমব্যাট ট্রাউজার, পায়ে কালো হাই-লেগ মিলিটারি বুট, গায়ে কালো মাল্টি-পকেট ট্যাকটিকাল ভেস্ট, ইউটিলিটি বেল্ট, মুখে কালো স্কি মাস্ক, হাতে শুটারদের গ্লাভ্স্। মৃতের সঙ্গে ছিল সেমি অটোমেটিক পিস্তল। রয়ে গেছে খালি হোলস্টার। অস্ত্র নিয়ে গেছে দলের কেউ। সে-লোক দু’বার গুলি করেছে এর মাথায়। বুলেট নাইন মিলিমিটারের। একটু দূরেই গুলির খোসা। লাশের চোখ খোলা। স্কি মাস্কের ওদিক থেকে চেয়ে আছে সে ঘোলা দৃষ্টি মেলে।
লাশের ঘাড়ে তিন আঙুল রেখে তাপমাত্রা মাপল রানা। টান দিয়ে খুলল স্কি মাস্ক। লোকটার বয়স হবে ত্রিশ বা বত্রিশ। শ্বেতাঙ্গ। মাথার চুল কালো। সুপুরুষ না হলেও অসুন্দর নয়। তাকে দ্বিতীয়বার খেয়াল করবে না কেউ। অবশ্য, রানার কথা আলাদা। বাকি জীবন মনে রাখবে এর মুখ। তাকে খুন করেনি সাধুরা। আরও একটা কারণে বিষয়টি আরও জটিল লাগল রানার। সাধুদের মৃতদেহের চেয়ে একটু উষ্ণ লোকটার দেহ। তাকে খুন করা হয়েছে আরও পরে। টান দিয়ে লাশের ডানহাতের গ্লাভ খুলল রানা। ফেলল মৃতদেহের পাশে। হাত ও কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিতেই বুঝল, লাশে এখনও শুরু হয়নি রিগর মর্টিস। মুখ বেয়ে বুকের ভেস্ট ভাসিয়ে দিয়েছে রক্ত। তা এখনও জমাট বাঁধতে শুরু করেনি। তাকে খুন করা হয়েছে বড়জোর দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগে। সময়টা আরও কমও হতে পারে।
এ থেকে দুটো ব্যাপার বুঝল রানা।
প্রথমত, হয়তো মঠে লড়াই করে সশস্ত্র দুটো দল। তবে মারা পড়েনি অন্য দলের কেউ। মাঝ থেকে খুন হয়েছে সাধুরা। আবার এ-ও হতে পারে, নিজ দলের গুলিতেই খুন হয়েছে লোকটা। যদিও তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আসলে কেন হত্যা করা হলো সাধুদেরকে, সেটা এখনও রহস্যজনক।
দ্বিতীয়ত, বেশিক্ষণ হয়নি চলে গেছে খুনিরা। এক থেকে দেড় ঘণ্টা আগে উপস্থিত হলে তাদের সঙ্গে দেখা হতো রানার। এটা ঠিক, সাধুদের ওপর হামলা হয়েছে ভোর সাড়ে চারটের দিকে। এ থেকে বেরোয় আরও একটা তথ্য। সবাইকে খুনের পর অন্তত তিন থেকে চারঘণ্টা মঠে ছিল খুনির দল।
এ সময়ে কী করছিল তারা?
এর উপযুক্ত জবাব নেই রানার কাছে।
কী খুঁজছিল খুনিরা?
কেন এত সময় নিল রওনা হতে?
পাশে বসে লাশের বাম গ্লাভ খুলল রানা। মৃতের আঙুলে নেই নিকোটিনের দাগ। অর্থাৎ, নব্য সাধুদের নেতা ফ্রায়ার জিলেসকে খুন করেনি এ। হাত নামিয়ে রেখে তার পোশাক সার্চ করল রানা। ‘যা ভেবেছে, পেল না কোনও আইডি। অবশ্য পকেটে রয়েছে মোবাইল ফোন। ওটা নিজের পকেটে রাখল রানা। পরে সময় নিয়ে ঘেঁটে দেখবে। মনোযোগ দিল লাশের বাম কাঁধে কালো, ছোট হ্যাভারস্যাকের দিকে। ওটার চেইন বন্ধ। ব্যাগটা ছুটিয়ে নিয়ে দেখল, ওটার ওজন অস্বাভাবিক বেশি। হয়তো ভেতরে রয়েছে স্পেয়ার আর্মামেন্ট, এক্সট্রা ম্যাগাযিন ও বাক্স ভরা অ্যামিউনিশন।
চেইন খুলে ভেতরে চোখ বুলিয়ে কুঁচকে গেল রানার ভুরু।
গুলির বাক্স বা বাড়তি অস্ত্রের জন্যে ওজন বাড়েনি ব্যাগের।
ভেতরে রয়েছে একইরকম দুটো জিনিস।
শীতল। মসৃণ। ভীষণ ভারী।
জিনিসদুটো তুলে নিল রানা।
সূর্যের কাঁচা সোনালি আলোয় চকচক করছে সোনার বার!
বারো
খুব বিস্মিত হয়েছে রানা।
প্রতিটি বার দৈর্ঘ্যে বারো ইঞ্চি। চওড়ায় চার ইঞ্চি। উচ্চতা তিন ইঞ্চি। নিরেট ধাতুর হলেও খুব মসৃণ। একেকটার ওজন ছয় থেকে আট কিলোগ্রাম। খুবই দামি। এ ছাড়াও, হয়তো রয়েছে ঐতিহাসিক মূল্য।
শেষবার বছরখানেক আগে নাযিদের গোপন এক আস্তানায় এই জিনিস দেখেছে রানা। ওগুলোর গায়ে ছিল জার্মান ইমপেরিয়াল ঈগল ও স্বস্তিকার ছাপ। এই দুই সোনার বারও আকারে একইরকম। হয়তো তৈরি হয়েছে উনিশ শ’ তেত্রিশ সাল থেকে উনিশ শ’ পঁয়তাল্লিশ সালের ভেতর।
হাঁটুর ওপর একটা সোনার বার রেখে অন্যটা মেঝেতে নামাল রানা। পকেট থেকে নিল ট্রাকের চাবি। ওটা দিয়ে আঁচড় কাটল হাঁটুর ওপরের বার-এ। সোনার চেয়ে ঢের শক্ত ইস্পাত। পাতের বুকে তৈরি হলো এক মিলিমিটার গভীর বিশ্রী দাগ। সোনার নিচে গাঢ় ধূসর রঙ থাকবে ভেবেছিল রানা। মানুষ ঠকাতে একই ওজনের সীসার বার তৈরি করে প্রতারকরা। ওই পাতের চারপাশে থাকে সোনাপানি করা প্রলেপ।
দ্বিতীয় বার পরখ করে রানা বুঝে গেল, এগুলো সত্যিকারের জিনিস। বর্তমান বাজারে সোনার দাম কত জানা নেই ওর। তবে একেকটা বিক্রি হবে প্রায় সোয়া দুই লাখ ইউরোতে। বারদুটোর গায়ে কোনও চিহ্ন নেই। জানারও উপায় নেই কারা তৈরি করেছে এগুলো।
প্রথমে সাধুদেরকে খুন, তারপর সোনার বার ফেলে যাওয়া- বিষয়দুটো হয়ে উঠেছে খুবই রহস্যজনক।
লাশের কোলে সোনার বার রেখে তার ওপর ব্যাগ চাপিয়ে দিল রানা। আপাতত থাকুক। আশপাশে কেউ নেই যে সরিয়ে নেবে। উঠে দাঁড়িয়ে নিচে যাওয়ার প্যাসেজের কাছে গিয়ে থামল ও। খেয়াল করেছে, প্যাসেজের মুখে রক্তের বেশকিছু ফোঁটা রয়েছে। কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ল, দু’দিকের দেয়ালে রক্তাক্ত হাতের ছাপ।
প্যাসেজের মুখে ছিল নাইন মিলিমিটারের বুলেটের খালি খোসা। ওখান থেকেই শুরু রক্তের ফোঁটা। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই চারপাশ হয়ে এল অন্ধকার। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে টর্চ জ্বেলে নিল রানা। সিঁড়ি শেষ হওয়ার পর ক্রমে ঢালু হয়ে নিচে গেছে প্যাসেজের মেঝে। রক্তের চিহ্ন গেছে পঞ্চাশ গজ দূরের এক দরজার ওদিকে। কবাটে রক্তাক্ত হাতের তালুর ছাপ। টলতে টলতে গেছে আহত লোকটা। মাঝে মাঝে দেয়ালে ও মেঝেতে রক্ত।
লাল চিহ্ন অনুসরণ করছে রানা। ওর ধারণা, সামনে পাবে মৃত কোনও সাধুকে। অথবা, হয়তো এখনও বেঁচে আছে মানুষটা। সেক্ষেত্রে তার কাছ থেকে হয়তো জানা যাবে, কী হয়েছিল মঠে। তবে হাতে বেশি সময় নেই, প্রচুর রক্ত হারিয়ে শেষ হয়ে এসেছে মানুষটার জীবনী শক্তি।
দরজা পেরিয়ে রানা দেখল, সোজা সামনে গেছে প্যাসেজ। ওদিকেই রয়েছে বিয়ারের সেলার। বদ্ধ প্যাসেজের নিচ থেকে আসছে ছাতাপড়া বাসি গন্ধ। আগের চেয়ে বেশি রক্ত ঝরেছে মেঝেতে। অথবা, এতই আহত যে এগোবার গতি কমে গেছে মানুষটার।
মঠের নিচে করিডোরের জটিল গোলকধাঁধায় পৌঁছে গেল রানা। এখন পাথুরে দেয়ালে একটু পর পর রক্তাক্ত হাতের তালুর চিহ্ন। হাঁটার গতি বাড়াল রানা। পাহাড়ের যত গভীরে চলেছে, ক্রমে জোরালো হচ্ছে ওর পদশব্দের প্রতিধ্বনি। খেয়াল করল, দুর্বল হচ্ছে মোবাইল ফোনের টর্চের রশ্মি ডানে ও বামে হলদেটে আলো ফেলে এগিয়ে চলল রানা। করিডোর আঁধার থাকলে হোঁচট খেয়ে খোঁড়া হতো। কী যেন পড়ে আছে সামনের প্যাসেজে। পা দিয়ে ঠেলতে গিয়ে দেখল ওটা খুব ভারী। ঝুঁকে রানা দেখল, প্যাসেজের মাঝে আরেকটা সোনার বার। ওটা তুলে নিল ও। অন্যদুটোর মতই ওজনদার। মসৃণ। গায়ে কোনও চিহ্ন নেই।
সোনার বার মেঝেতে রেখে আবারও এগোল রানা। ঢালু হয়েছে প্যাসেজ। তবে কিছুক্ষণ পর সমতল হলো মেঝে। ওর মনে পড়ল, আগেও এসেছে এখানে। তখন ছিল না রক্তের চিহ্ন। এখন ধুলোয় অসংখ্য কমব্যাট বুটের ছাপ। এগুলো সাধুদের তৈরি নয়। বারবার এসে আবারও ফিরে গেছে কিছু লোক।
গতি বাড়িয়ে হেঁটে চলল রানা। দু’দিকের দেয়ালে একটু পর পর দেখছে হাতের তালুর রক্তাক্ত ছাপ। মেঝেতে আগের চেয়ে বেশি রক্ত। বামে বাঁক নিল অন্ধকার করিডোর, তারপর ডানে। ছুঁচোর তৈরি সুড়ঙ্গের মত করিডোর ঢুকেছে পাহাড়ের বুকে। হাঁটার গতি আরও বাড়াল রানা। অনেক বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছে। সামান্য দূরেই মানুষের তৈরি সেই গোপন কক্ষ। ওদিকেই গেছে রক্তের চিহ্ন। কমব্যাট বুট পরা লোকগুলোও গেছে ওখানেই।
সামনে দু’দিকে গেছে করিডোর। একদল গেছে সরাসরি গোপন কক্ষের দিকে। বামের করিডোরের মেঝেতে রক্তের চিহ্ন। ওদিকে কিছুটা যেতেই শুরু হলো অপেক্ষাকৃত সরু প্যাসেজ। দু’দিন আগে এখানে এসেছিল, মনে পড়ল রানার। নিচু হয়েছে ছাত। আরও কয়েক গজ যেতেই রক্তের চিহ্নের শেষে পৌঁছে গেল ও। ভেবেছিল দেখবে মৃত কোনও সাধুকে। অথবা সেই লোক খুনে দলের কেউ।
কিন্তু ভুল প্রমাণিত হলো রানার ধারণা।
অপ্রশস্ত প্যাসেজের মেঝেতে রক্তের অগভীর এক পুকুর। রানার টর্চের আলো গিয়ে পড়ল পুরনো বস্তার মত কিছুর ওপর। পাথরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ওটা।
সামান্য নড়ল স্তূপটা
দ্রুত এগোল রানা। চট্ করে বুঝে গেল ওখানে কে। নিচু গলায় ডাকল ও, ‘জন?’
কাত হয়ে বসেছে জন পিয়েরে, আহত। ফ্যাকাসে সাদা মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কিছু চুল মিশে গেছে ঘন ভুরুতে।
ছেলেটা কেন এখানে, বুঝে গেল রানা। ছোট বা বড় যে- কোনও প্রাণী ভয় পেলে বা আহত হলে ফেরে তার আস্তানায়। জন পিয়েরেও চেয়েছে গোপন ডেরায় লুকিয়ে পড়তে। তবে এবার সাধুদের চোখ এড়াতে নয়, খুনিদের হাত থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছে এখানে।
মোবাইল ফোনের টর্চের আলোয় জনের জোব্বা দেখল রানা। রক্তে চুপচুপে ভেজা পুরু কাপড়। গুলি বিঁধেছে পেটে। ওখানে গুলি লাগলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়ে মরতে হয়।
একটু নড়ে উঠল জন পিয়েরে। খুলে গেল দুই চোখ। বুজে ফেলল পাতা। কয়েক মুহূর্ত পর আবারও খুলল। দৃষ্টি ঝাপসা। দেখছে না কিছুই। চোখের সাদা অংশ রক্তের মত লাল। কাছেই কেউ, টের পেয়েছে ছেলেটা। মাথা সরিয়ে দেখতে চাইল। কিন্তু সে শক্তি নেই ওর। প্রায় ফিসফিস করল, ‘রানা? আপনি?’
‘হ্যাঁ, আমি রানা, জন। আমি তোমার পাশেই আছি।’
ছেলেটার ঠোঁটে ফুটল মৃদু হাসি। পরক্ষণে ঝুলে গেল নিচের ঠোঁট। এত শক্তি নেই যে মুখ বুজে রাখবে।
‘জানতাম, আসবেন,’ কাঁপা শ্বাস ফেলল জন। হাত বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। ওর আঙুল ভেজা তাজা রক্তে।
ওর কতটা ব্যথা হচ্ছে বুঝে গলা শুকিয়ে গেল রানার। নরম সুরে বলল, ‘একটু অপেক্ষা করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ পরিষ্কার জানে, ডাহা মিথ্যা বলছে ও। আর বেশিক্ষণ নেই, মৃত্যু ছিনিয়ে নেবে ছেলেটার প্রাণ। এতক্ষণ বেঁচে থাকাই বিস্ময়কর। সহ্য করছে তীব্র যন্ত্রণা। কোথাও সরিয়ে নেয়া যাবে না ওকে। কেউ বাঁচাতে পারবে না কোনওভাবেই। হাসপাতালের একফুট দূরে থাকলেও কোনও লাভ হতো না।
ভীষণ ভয় ওর মনে। প্রাণপণে ঠেকাতে চাইছে নিশ্চিত মৃত্যু। তাতে আরও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে জীবনী শক্তি। রক্তাক্ত হাতে রানীর হাত ধরল জন পিয়েরে। নড়তে গিয়ে পেয়েছে প্রচণ্ড ব্যথা। বিকৃত হয়ে গেল মুখ। কয়েক মুহূর্ত পর ফুঁপিয়ে উঠে ফিসফিস করল।
কথাটা বুঝতে পারল না রানা।
মিঠে কী হয়েছিল, জন?’ নিচু গলায় জানতে চাইল, রানা। তিক্ত হয়ে গেছে ওর মন। একদল পশুর হামলায় মারা পড়ছে তাজা একটা প্রাণ!
মণি উল্টে গেল জনের। তিরতির করে নড়ছে চোখের পাতা। কাত হয়ে ঝুলে গেল মাথা।
রানার মনে হলো, দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে তরুণ সাধু।
কিন্তু আবার চোখ মেলল জন। বিড়বিড় করল, ‘এসেছিল… ভোরের আগে… আমি ছিলাম…. হারিয়ে গেল কণ্ঠস্বর।
‘কারা ওরা? কারা এ কাজ করেছে, জন?’,
কথা বলতে গিয়ে শেষ শক্তিটুকুও ব্যয় করে ফেলেছে তরুণ সাধু। হাঁপিয়ে চলেছে হাপরের মত। রানার হাত ধরে রাখতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছে হাতটা। বিন্দু বিন্দু ঘামে নতুন করে ভরে গেছে ফ্যাকাসে সাদা মুখ। দুই পাতা মেলতেই বিস্ফারিত হলো চোখ। দৃষ্টিতে ভীষণ ভয়। রানার হাতে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের আলো দেখে বিড়বিড় করল, ‘রানা, দেখেছি… শয়তান দেখেছি আমি…
জন পিয়েরের দিকে তাকাল রানা। প্রলাপ বকছে বেচারা। এক এক করে মারা পড়ছে মগজের প্রতিটি কোষ। শেষ র্যাম নিউরোকেমিক্যাল ইমপাস্ চলছে এখন, একে একে মারা যাচ্ছে নার্ভের প্রান্তগুলো। চারপাশ থেকে বেচারাকে ঘিরে ধরছে নিকষ কালো অন্ধকার। মৃত্যুর আগে অনেকে প্রলাপ বকে। চোখে দেখে অদ্ভুত সব দৃশ্য। ‘ঠিক আছে, জন, বুঝতে পেরেছি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।
কিন্তু আরও কিছু বলতে চাইছে জন। জোরে আঁকড়ে ধরল রানার হাত। ‘না… শয়তান না… ভূত! দেখেছি… ওদেরকে… ওরা ছিল সাদা ভূত…
আরও কিছু বলবে বলে বড় করে দম নিল জন। আস্তে করে কাত হয়ে পড়ল মেঝেতে। একবার সোজা করল মেরুদণ্ড, তারপর শিথিল হয়ে গেল চিরতরে।
তরুণের নিষ্প্রাণ চোখদুটো বুজিয়ে দিল রানা। মেঝেতে নামিয়ে রাখল ঘর্মাক্ত হাতটা। নীরবে ফিরল প্রধান করিডোরে। ডানের প্যাসেজে পদচিহ্ন। কমব্যাট বুটের ছাপ অনুসরণ করল রানা। ওই দলে আছে অন্যদের চেয়ে ছোট পায়ের কেউ। বড় পদক্ষেপে হেঁটেছে। ওপরের দালানে পড়ে থাকা খুনির লাশের কথা মনে পড়ল রানার। এরা নেমেছে মঠের নিচে। কিন্তু সেটা কেন করেছে? লোকটার ব্যাগে ছিল সোনার বার। একটু আগে ওরকম আরেকটা দেখেছে রানা। আরেকটু হলে ওটাতে হোঁচট খেয়ে মেঝেতে পড়ত। সেক্ষেত্রে কি ধরে নেবে, আশ্রমের নিচে ছিল গুপ্তধন? আর সেজন্যেই খুন করা হয়েছে সাধুদেরকে?
সবাইকে খুনের পর বহুক্ষণ এখানে থেকেছে তারা। হয়তো মঠে ছিল প্রচুর পরিমাণে গুপ্তধন। এখান থেকে সোনার বার ওপরে তুলতে গিয়েই ব্যয় হয়েছে ওই সময়। সোনা এতই বেশি ছিল, একটা-দুটো পড়ে গেলেও কুড়িয়ে নিতে গিয়ে সময় নষ্ট করেনি তারা।
ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই বেধেছিল তর্ক। ফলে খুন হয়েছে দালানের ওই খুনি। চোর-ডাকাতদের ভেতর প্রায়ই দেখা যায় এমন।
আরও কয়েক কদম হেঁটে মানুষের তৈরি প্রকাণ্ড কক্ষের কাছে পৌঁছুল রানা। গতবার ভালভাবে দেখা হয়নি চারপাশ। তবে এটা মনে আছে, তখন এই দেয়ালে এত অসংখ্য চিড় ছিল না। এখন জায়গায় জায়গায় বুড়ো আঙুল গুঁজতে পারবে ও। ফাটল ধরেছে সুড়ঙ্গের ছাতেও। মেঝেতে আগের চেয়ে অনেক বেশি ধুলো। এখানে-ওখানে ছোট-বড় সব পাথরের টুকরো। মনে হচ্ছে, যে-কোনও সময়ে ধসে পড়বে ছাত। প্রধান সাধুর কথা মনে পড়ল রানার। সামনের ওই ঘরেই করোটি পেয়েছিল ও। তবে এ বিষয়ে একটা কথাও বলেননি তিনি।
প্রকাণ্ড কক্ষে ঢুকল রানা। একই জায়গায় পড়ে আছে ফাটা খুলি। অর্ধেক ডুবে গেছে নতুন ধুলোয়। পাশে আরেকটা সোনার বার। চকচক করছে মোবাইল ফোনের টর্চের হলদে আলোয়। দ্বিতীয়বার ওদিকে ঘুরেও দেখল না রানা। মনোযোগ সরে গেছে অন্যদিকে।
বিশাল ঘরের মাঝে যে দেয়াল ছিল, শক্তিশালী বিস্ফোরণে তার বুকে তৈরি হয়েছে বড় একটা গর্ত!
তেরো
গতটা দৈর্ঘ্যে অন্তত ষোলো ফুট। উচ্চতায় পাঁচ ফুট। বিধ্বস্ত দেয়ালের দু’দিকে ইঁট ও আস্তরের হাজারো টুকরো। করিডোরের ছাত ও দেয়ালে কীভাবে ফাটল ধরল, বুঝে গেছে রানা। ব্যবহার করা হয়েছে শেপড্ চার্জ বা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। ঠিক জায়গায় বসিয়ে দূর থেকে ফাটিয়ে দিয়েছে বোমা। চাইলেই পাওয়া যায় না এই দুর্লভ জিনিস। যে লোক ছাত ও দেয়ালে বসিয়েছে বোমা, তাকে বলতে হবে সত্যিকারের শিল্পী। চার্জ বসানোর সময় সামান্য ভুল হলেও সবার মাথায় নামত আস্ত পাহাড়। এখনও বাতাসে বিস্ফোরিত করডাইটের হালকা গন্ধ রয়ে গেছে।
মেঝেতে বুটের দাগ। গর্তের ওপাশে গেছে কয়েকজন। ওদিকেই ছিল প্রয়োজনীয় কিছু। সেটা বোধহয় প্রচুর পরিমাণের সোনার বার। সেজন্যে সাধুদেরকে খুন করতেও দ্বিধা করেনি এরা।
ইঁট, পাথর ও ধুলোবালি মাড়িয়ে গর্তের ওদিকের অন্ধকারে পা রাখল রানা। প্রথমেই নাকে এল ভয়ঙ্কর বাজে দুর্গন্ধ। হয়তো হাজার বছর ধরেই আছে। কখনও পচা লাশ থেকে আসে এমন কুবাস।
আরেকটু হলে বমি করত রানা। শার্টের ওপরের অংশ তুলে ঢাকল নাক, ও মুখ। তাতে লাভ হলো না। আরও কয়েক পা গিয়ে চারপাশে আলো ফেলল ও।
এমনিতেই অনুজ্জ্বল টর্চের আলো, তার ওপর কক্ষটা বিশাল- কোনওদিকেই কোনও দেয়াল চোখে পড়ল না রানার। ঢালু হয়ে নেমেছে পাথুরে রুক্ষ মেঝে। আরও কয়েক ফুট এগোল ও। বুঝেছে, শত্রুপক্ষের ছিল হেড-টর্চ বা ছয় ব্যাটারির ম্যাগলাইট ও এলইডি বাল্ব। প্রায় দিনের আলো পেয়েছে তারা।
ফুরিয়ে এসেছে ফোনের ব্যাটারি। দূরে যাচ্ছে না হলদেটে আলো। বড়জোর দশ মিনিট পর চারপাশ থেকে ওকে চেপে ধরবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অবশ্য দৃষ্টিশক্তি খুব একটা কাজে না এলেও অন্যান্য ইন্দ্রিয় ঠিকই আছে ওর।
দূর থেকে এল ওর পায়ের প্রতিধ্বনি। এ ছাড়া আছে অন্য আওয়াজ। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে গোপনে হুটোপুটি করছে কী যেন!
টর্চ ওপরে তুলে কয়েক পা এগোতেই কীসের ভেতর যেন ভচ্ করে ডুবল রানার ডান পায়ের বুট। জিনিসটা পচা ফলের স্তূপের মত নরম ও থকথকে। নিচে আলো তাক করল রানা। আঠালো জিনিসটা থেকে এল ভয়ঙ্কর বদবু। মুখে শার্ট চেপেও নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল ও। পায়ের নিচে ওটা রোমশ কোনও জন্তুর পচে যাওয়া লাশ। অর্ধেকটা খেয়ে নিয়েছে অন্য কোনও প্রাণী। রানা বুঝে গেল, এখানে এত বাজে গন্ধ কীসের বা চারপাশে কাদের এত হুটোপুটির আওয়াজ।
এ ঘরে আছে হাজার হাজার ইঁদুর। নানাদিকে ছড়িয়ে আছে তারা। এক ছায়া থেকে আরেক ছায়ায় লুকিয়ে পড়ছে কালচে সব অবয়ব। রানাকে দেখে ভীত হয়ে উঠেছে ওগুলো। ঘরের চারপাশে তাদেরই মৃতদেহ ও হাড়। কয়েক গজ দূরের মেঝেতে ওর জীবনে দেখা সবচেয়ে বড় ইঁদুরের লাশ দেখল রানা। লেজের ডগা থেকে নাক পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে ওটা হবে পুরো দুই ফুট। বিদঘুটে আকৃতির বিকৃত দেহ। চোখ বলতে কিছুই নেই। শত শত বছর অন্ধকারে থেকে হারিয়ে গেছে দৃষ্টিশক্তি।
ইঁদুর জাতীয় জন্তু অপছন্দ করে রানা। তবে ওগুলোর অদ্ভুত ক্ষমতার প্রশংসা না করে উপায় নেই। প্রকৃতির বুকে টিকে থাকার যে প্রতিযোগিতা, তাতে ইঁদুরের চেয়ে অনেক পেছনে রয়েছে মানবজাতি। ইঁদুর এমন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়, যেটা অন্য প্রাণীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কুকুর ছুঁয়েও দেখবে না যে পচা খাবার বা বিষাক্ত পানি, সেসব খেয়ে এবং তৃষ্ণা মিটিয়ে দিব্যি বেঁচে থাকবে ইঁদুর। প্রয়োজনে খুন করে খেয়ে নেবে দলের দুর্বল সদস্যকে। রানা বুঝে গেছে, এভাবেই পাতাল ঘরে নিজেদের লাশ খেয়ে হাজার বছর ধরে টিকে আছে এরা। জেনেটিক এ কারণেই বিকৃত হয়েছে দেহ। হয়তো একদিন ঝাড়ে বংশে শেষ হবে, তবে তার আগে পার করবে হাজার হাজার প্রজন্ম। ঘরের মেঝেতে যে ধুলো, তাতে যেটুকু আর্দ্রতা আছে তাই দিয়ে মিটিয়ে নিচ্ছে পানির তৃষ্ণা। পাহাড়ের সুড়ঙ্গের ফাটল দিয়ে আসা সামান্য অক্সিজেনেই চলছে শ্বাস। শত শত বছর এ ঘরে জন্মেছে লাখ লাখ ইঁদুর, বড় হয়েছে মৃত ইঁদুরের মাংস খেয়ে, তারপর জন্ম দিয়েছে বেশুমার। নিজেরাও মরেছে অকাতরে। চারপাশে ঘটছে মানব সভ্যতার বিকাশ, কেউ জানত না পাহাড়ের নিচে গোপন ঘরে আছে অদ্ভুত আকৃতির হাজার হাজার ইঁদুর।
পচা, থকথকে মাংস থেকে বুট টেনে নিল রানা। এগোতে লাগল ঘরের গভীরে। ক্রমে আরও ম্লান হচ্ছে মোবাইল ফোনের টর্চের হলদেটে আলো।
আরও কয়েক ফুট যাওয়ার পর থমকে গেল রানা। মৃদু আভায় যে দৃশ্য, সেটা ওর মনে হচ্ছে খুব অস্বাভাবিক।
গোপন কক্ষের মেঝেতে সারি সারি মানুষের কঙ্কাল। আবার কোথাও বা হাড়ের উঁচু স্তূপ। মেঝের ধুলোয় লুটিয়ে আছে শত শত মানুষের পাঁজর, হাত, পা, মেরুদণ্ডের হাড় ও করোটি!
আস্ত নেই বেশিরভাগ কঙ্কাল। খুলে গেছে হাড়ের মাঝের বন্ধন, বা কামড়ে খাওয়ার সময় সরিয়ে দিয়েছে ইঁদুরের পাল। মানুষগুলো বোধহয় এ ঘরে আটকা পড়েছিল বহু বছর আগে। এখন আর হাড় থেকে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম পাবে না ইঁদুরগুলো।
জানার উপায় নেই এখানে মরেছে কতজন মানুষ।
আরও ক’পা সামনে বেড়ে হাড়ের কবরস্তানে আলো ফেলল রানা। পেলভিক হাড়ের বিস্তার দেখে বুঝতে পারছে, নারী-পুরুষ দু’জাতের কঙ্কালই আছে এখানে। বাদ পড়েনি বাচ্চাদের হাড়গোড়ও। আরও গভীর মনোযোগে চারপাশ দেখল রানা। একটা বিষয় বুঝে গলা শুকিয়ে গেল ওর। মেঝেতে গজাল গেঁথে চেইন দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছিল বহু মানুষকে। জং ধরে ক্ষয়ে গেছে হাত-পায়ের লোহার শিকল ও গজাল। পুরুষ, নারী ও শিশু— মধ্যযুগীয় জাহাজের ক্রীত- দাসের মতই বন্দি ছিল তারা এই ঘরে।
মৃতদেহকে শেকল দিয়ে বাঁধে না কেউ!
এটা কবরস্তান নয়, ভয়ঙ্কর ইতিহাস আছে এ জায়গার। শত বছর আগে একদল লোক আরেকদল পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে টেনে হিঁচড়ে এনে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল এই ঘরে। জ্যান্ত ছিল সবাই। তাদেরকে বন্দি করে ঘরের মাঝে তুলে দেয়া হয় দেয়াল। মানুষগুলোর কাছে না ছিল খাবার, না ছিল পানি। চারপাশে নেই আলো। ফুরিয়ে আসছে বুক ভরে নেয়ার মত বাতাস। তবুও কয়েক দিন বেঁচেছে তারা। হয়তো ইঁদুরের মতই খেয়েছে স্বজাতির মাংস। তারপর মরতেই হয়েছে তাদেরকে।
মুহূর্তের জন্যে রানার মনে হলো, শুনতে পাচ্ছে বহুকাল আগের অসহায় মানুষগুলোর করুণ আর্তনাদ ও আহাজারি।
তারপর একসময় ফুরিয়ে গেছে তাদের প্রাণশক্তি। একে একে লুটিয়ে পড়েছে মৃত্যুর কোলে!
রানার মনে পড়ল প্রধান সাধু অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ডের কথা: ‘অতীতে ভয়াবহ পাপে জড়িত ছিল চার্চ। স্রষ্টার নামে নিরীহ মানুষের ওপর করেছে অকথ্য নির্যাতন।’
মঠের নিচে এই ঘরে কী ঘটেছে, হয়তো জানতেন তিনি। অথবা জানত অন্য কেউ। ঘরে শুধু কঙ্কাল ছিল, তা বোধহয় নয়। সোনা পাওয়া গেছে এখান থেকেই।
ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে রানার কাছে। কিছুই যেন যৌক্তিক নয়। অন্ধকারে শত শত মানুষের হাড়ের মাঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল রানা। আরও ম্লান হলো টর্চের আলো। রশ্মি এখন টিমটিমে লালচে। চারপাশ থেকে ঘনিয়ে আসছে কালো কুয়াশার মত আঁধার। চোখ সইয়ে নিতে চাইল ও। আর তখনই চোখের কোণে দেখল মৃদু নড়াচড়া। না, ওটা কারও দেহ নয়। টিপটিপ করছে একটা আলোর বিন্দু।
একসারি সংখ্যা থেকেই আসছে আবছা ওই লাল আভা।
অন্ধকারে আছে অচেনা এক প্যানেল।
জিনিসটা প্রাচীন আমলের নয়।
বেশিক্ষণ হয়নি ওটা রেখে গেছে কেউ।
দ্রুত কাউন্ট ডাউন করছে প্যানেল।
এক সেকেণ্ডের দশ ভাগের এক ভাগ দেখাচ্ছে ওখানে।
তিলতিল করে পেরিয়ে চলেছে মুহূর্তগুলো।
এখন কি ফুরিয়ে এসেছে সময়?
দ্রুত এগিয়ে ডিজিটাল রিডআউটে চোখ রাখল রানা।
০০:০০:১৬:০৭…
মাত্র এক সেকেণ্ডে রানা জেনে গেল ওটা কী।
কমছে সংখ্যা!
এখন প্যানেলে লেখা: 00:00:15:07…
সময় নেই হাতে!
ঘুরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাড় মাড়িয়ে দৌড় দিল ও।
ভচ-ভচ শব্দে পচা ইঁদুরের দেহে দেবে যাচ্ছে জুতো।
ঘর ছেড়ে বেরোতে উড়ে চলেছে রানা।
আগে কখনও এত জোরে দৌড়াতে হয়নি ওকে।
মাত্র পনেরো সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হলো বোমাটা!
চোদ্দ
ডেটোনেশন হতেই চারপাশে ছিটকে গেল শক ওয়েভের প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাস। মুহূর্তে বাষ্পায়িত হলো বিশাল কক্ষের ওদিকটা। জীবিত বা মৃত রইল না আর কেউ।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে হাজার বছরের ছাত ভেঙে হুড়মুড় করে নামল পাহাড়ের লাখ লাখ টন পাথর। কোনও কোনও পাথর খণ্ড আকারে আস্ত গাড়ির চেয়েও বড়। যেন হাঁ করে ঘরের ওদিকটা গিলে নিল মস্ত কোনও দানব। বুজে গেল পাহাড়ের নিচের নানাদিকের সুড়ঙ্গপথ।
বোমা ফাটার মাত্র দু’সেকেণ্ড আগে দেয়ালের এদিকে পা রেখেছে রানা। তবে ওকে বাঁচাল তীব্র শক ওয়েভ। আবার একই সময়ে চাইল শেষ করতে। খামচে তুলে ছুঁড়ে দিল ঘরের বাইরের করিডোরে। রকেটের বেগে করিডোরের দেয়ালে গিয়ে লাগল রানার দেহ। ওখান থেকে ঠাস্ করে পড়ল মেঝেতে। মুখ কুঁচকে গেল পাঁজরের ব্যথায়। ফুসফুসে এক তিল বাতাস নেই!
সুড়ঙ্গের ওপরের দিক দিয়ে বয়ে গেল ড্রাগনের নিঃশ্বাসের মত আগুনের লাল হলকা। রানার মনে হলো পুড়ে যাচ্ছে ওর দেহ। আর বাঁচবে না। কিন্তু এক সেকেণ্ড পর ধসে পড়ল প্রকাণ্ড ঘরের পুরো ছাত। ওদিকে রয়ে গেল গনগনে আগুন ও বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া। ফলে হঠাৎ করেই নামল করিডোরে ভীষণ নৈঃশব্দ্য।
সুড়ঙ্গের বাতাসে ভাসছে ঘন ধুলো ও ধোঁয়া। ছেঁকা খাওয়া, প্রায়-অন্ধ, হতভম্ব রানা ভাবছে, বোধহয় মরেই গেছি!
তবে দু’সেকেণ্ড পর ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। বুঝে গেছে, যে-কোনও সময়ে ধসে পড়বে করিডোরের ছাত। জরুরি এখন বেরিয়ে যাওয়া। নতুন করে দৌড় শুরু করল রানা। দু’চোখ থেকে দরদর করে ঝরছে অশ্রু। ফুসফুসে ঢুকছে ছোট বালি কণা। সেই সঙ্গে বেদম কাশি। ছুটতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাচ্ছে রুক্ষ পাথুরে দেয়ালে। ছিলে গেল কাঁধ ও বাহুর ত্বক। অন্ধকারে উন্মাদের মত ছুটছে রানা। ছাত থেকে ঠুস-ঠাস্ শব্দে মাথায় পড়ছে পাথরের টুকরো ও ধুলোবালি। জমি এখনও কাঁপছে, না নিজেই টলে যাচ্ছে, নিশ্চিত নয় রানা। দৌড়ে চলেছে অন্ধকারে। তবে মনে নেই বিন্দুমাত্র ভয়। ভাল করেই জানে, যা হওয়ার তা-ই হবে। ঠেকাতে পারবে না কিছুই। হাত-পা কাজ করছে চালু ইঞ্জিনের পিস্টনের মত। ভীষণ লাফ দিচ্ছে হৃৎপিণ্ড। মনে হচ্ছে, যে-কোনও সময়ে বুক ফাটিয়ে বেরিয়ে আসবে ওটা। মাথার ওপর নেমে এল না করিডোরের ছাত। বারকয়েক ডানে ও বামে বাঁক নেয়ার পর পায়ে লাগল ভীষণ শক্ত কিছু। হোঁচট খেয়ে পড়ল রানা। ভারী সেই সোনার বার। দু’হাতে ভর দিয়ে আবারও উঠল ও। ছুটে চলল দূরে সামান্য আলোর আভাস দেখে। ওই যে, ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি!
ঝড়ের বেগে একের পর এক ধাপ বেয়ে উঠল রানা। প্রথমবারের মত টের পেল, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বাতাস।
ওপরে দিনের আলো।
সিঁড়ি ফুরাতেই ছুটে বেরোতে চাইল দরজা দিয়ে। কিন্তু চৌকাঠে কাঁধ লেগে কাত হয়ে পড়ল রানা। তাতে কী, পৌঁছে গেছে দালানের একতলার মেঝেতে। শ্বাস নিচ্ছে ফোঁস ফোঁস করে। শুয়ে থাকল মিনিটখানেক। ভাবছে, কপাল ভাল যে বেরোতে পেরেছে মৃত্যুপুরী থেকে। জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে মাথার চুল। আগুনের তাপে প্রায় ঝলসে গেছে বাম গালের ত্বক। ছড়ে যাওয়া দু’হাতে খুদে সব কাটাচিহ্ন। হাতের তালুতে গেঁথেছে পাথরের ধারাল কণা। ব্যথায় টনটন করছে সারাশরীর। উঠে পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল রানা। সতর্ক হাতে ধুলোবালি সরাল চোখ থেকে। মুখে ঢুকেছে একগাদা বালি। খক খক করে কেশে পরিষ্কার করতে চাইল গলা। এরই ভেতর বুঝেছে, কী করে গেছে ডাকাতরা। শেপড় চার্জ ফাটিয়ে ঢুকেছে গোপন ঘরে। যেজন্যে এসেছে, ́তা সরিয়ে আবারও পেতেছে আরেক বোমা। এটা বহু গুণ শক্তিশালী। বিস্ফোরণের সময় সেট করে বেরিয়ে গেছে। চেয়েছে গোপন থাকুক নিচের ওই ঘর।
কিন্তু কী কারণে কাজটা করল তারা?
আনমনে মাথা নাড়ল রানা।
আপাতত এর কোনও জবাব নেই ওর কাছে।
পুরো পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নিল রানা। তাতে স্বাভাবিক হলো না অস্থির হৃৎপিণ্ড। পরের পাঁচ মিনিট পরীক্ষা করে বুঝল, বড় ধরনের কোনও জখম হয়নি ওর শরীরে।
নিচের করিডোরগুলো থেকে এখনও বেরোচ্ছে ধোঁয়া উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ল রানা। চলল দালানের প্রধান দরজার দিকে। ভীষণ ঘুরছে মাথা। অবশ লাগছে শরীর। বমি হলে ভাল লাগত। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজে কানে সর্বক্ষণ ভোঁ-ভোঁ শব্দ। মনের চোখে দেখছে জন পিয়েরে, প্রধান সাধু অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড… সবার মৃত মুখের ছবি!
নিজেকে দোষ দিচ্ছে রানা। উচিত ছিল ঠিক সময়ে মঠে পৌঁছে যাওয়া। তাতে হয়তো ঠেকাতে পারত এই পাইকারি হত্যাকাণ্ড। নিরীহ মানুষগুলো ছিল ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাদের জন্যে কিছুই করতে পারেনি ও।
এখনও পারবে না কিছু করতে। কোদাল দিয়ে সবাইকে কবর দিতে হলে লাগবে পুরো একমাস। অবশ্য খবর দিলে যা করার নিজেরাই করবে পুলিশবাহিনী। তাদেরকেই ডাকবে ঠিক করল রানা। তবে তার আগে উধাও হবে এখান থেকে। ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে না পুলিশের লোক। তারা যে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করবে, তা ভাবছে না রানা। তাই নিজেই জেনে নেবে কেন হত্যা করা হলো মানুষগুলোকে। খুঁজে বের করবে খুনিদের। আর তখন ওর হাত থেকে মুক্তি পাবে না তারা।
সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিজের ঘরে ফিরল রানা। আগে হোক বা পরে, মঠে এসে তদন্ত করবে পুলিশবাহিনী। তাদেরকে জানতে দেয়া যাবে না এখানে ছিল ও। নইলে ওর ঘাড়েই সমস্ত দোষ চাপিয়ে দেবে তারা। এ ঘরেই রয়েছে ওর ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নেয়ার পর যেখানে যেখানে থাকতে পারে ওর হাতের ছাপ, রুক্ষ একটা ন্যাকড়া দিয়ে সেসব জায়গা ঘষল ও। কাঁধে ঝুলিয়ে নিল ব্যাগ। গত বেশ ক’দিন ছিল এখানে। শেষবারের মত দেখল ছোট্ট ঘরটা, তারপর বেরিয়ে এল বাইরে। আবারও ঢুকল সাধুদের দালানে। আগের মতই পড়ে আছে খুনিদের সেই সঙ্গী। কোলের ওপর সোনার দুই বার। ও-দুটো তুলে নিজের ব্যাগে পুরল রানা। ছিলে যাওয়া কাঁধে চেপে বসেছে বাড়তি ওজন। অস্বস্তি নিয়ে প্রশস্ত উঠানে এল রানা। চারপাশে সাধুদের রক্তাক্ত লাশ। আবারও ফিরেছে সেই সাদা কাক। চঞ্চু দিয়ে খুঁচিয়ে তুলছে মৃতের মাংস। রানার ইচ্ছে হলো পাথর মেরে ওটাকে খুন করে। পরক্ষণে ভাবল, আর সবার মতই বাঁচার সমান অধিকার আছে ওই ক্ষুধার্ত কাকের।
ট্রাকের ক্যাবে উঠল রানা। প্যাসেঞ্জার সিটে রাখল ভারী ব্যাগ। চালু করল ইঞ্জিন। আগের চেয়ে কম আওয়াজ তুলছে যন্ত্রটা। একমুহূর্ত পর রানা বুঝল, বিস্ফোরণের জন্যে আপাতত তালা লেগে গেছে ওর কানে। ফার্স্ট গিয়ার দিয়ে উঠানের আরও ভেতরে চলল রানা। তারপর থেমে ব্যাক গিয়ার দিয়ে বিশাল হুইল এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে কসরৎ করে ঠিক দিকে নিল ট্রাকের নাক। এখন গেটের দিকে মুখ করে আছে ওটা। আবারও পিছিয়ে যেতে লাগল রানা। ট্র্যান্সমিশনের হুঁই-হুঁই আওয়াজে ট্রাক পিছিয়ে চলেছে সাধুদের দালানের দিকে। মৃত সাধুদের লাশ যাতে চ্যাপ্টা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখল রানা। দালানের কাছে থেমে গিয়ার নিউট্রাল করে নেমে পড়ল ক্যাব থেকে। আবার গেল মৃত খুনির পাশে। লাশের শার্টের কলার চেপে ধরে টেনে নিল ট্রাকের দিকে। বিড়বিড় করে বলল, ‘ভেবেছ রেখে যাব?’
ভারী নয় সে। সাধুদের প্রায় জমাট রক্তের মাঝ দিয়ে লাশ টেনে ট্রাকের কাছে নিতে লাগল মাত্র দু’মিনিট। কলার ছাড়তেই ধুপ্ করে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল মৃত খুনি। ট্রাকের পেছনে পাঁজরের মত যে লোহার আড়া, তা থেকে তারপুলিন নামিয়ে একপাশে রাখল রানা। ফিরল খুনির লাশের পাশে। বুটের ডগা দিয়ে চিত করল দেহটা। দু’হাত ধরে টেনে উঁচু করল লাশ, ঠেস দিয়ে রসাল ট্রাকের চাকার গায়ে। কোমর পেঁচিয়ে ধরে তুলল লাশটা। ছেঁচড়ে এল দু’পা। মাতালের মত টলতে টলতে ট্রাকের পেছনে লাশ নিল রানা। গায়ের জোরে ঠেলল ওপরে। তারপুলিনের পাশে কাত হয়ে পড়ল লাশের ওপরের অংশ। এবার দু’গোড়ালি ধরে ট্রাকের ওপর পাদুটো তুলল রানা। নিজেও উঠল সমতল পাটাতনে। ক্যাবের টুল লকারটা দৈর্ঘ্যে চার ফুট। চওড়ায় দু’ফুট। আরেকবার দেখল খুনির লাশ। বিশালদেহী নয়। ক্র্যাচ-ক্র আওয়াজে লকারের ঢাকনি খুলল রানা। বক্স থেকে তুলে নিল জং ধরা স্প্যানার ভরা রিমুভেবল কম্পার্টমেন্ট। ফেলল ট্রাকের পাশের উঠানে। টুল লকার এখন প্রায় খালি। রয়ে গেছে শুধু বোল্ট ক্রপার ও পুরনো দড়ি। টুলবক্সের ভেতরের জায়গা খালি থাকবে না বেশিক্ষণ।
সঙ্গে রক্তাক্ত লাশ নেবে ভেবেছে রানা। তবে রাখবে না ক্যাবে। প্যাসেঞ্জার সিটে মৃতদেহ দেখলে খুব নাখোশ হবে পুলিশের লোক। লাশটা টুলবক্সে গুঁজে দেয়াই ভাল।
কাজে নামল রানা। টেনেহিঁচড়ে, মুচড়ে বক্সে ভরতে চাইল লাশ। কাত করে রাখল ওটার কাঁধ। বামহাত দেহের নিচে। ডানহাত বুকের ওপর। উঁচু হয়ে রয়ে গেল মাথা, যেন বাইরে উঁকি দিতে চায়। ক’বার মাড়িয়ে টুলবক্সের আরও গভীরে লাশ ঠুসতে চাইল রানা। আকারে বড় না হলেও বামন নয় লোকটা। নানাভাবে চেষ্টা করেও পাদুটো ভরা গেল না টুলবক্সের ভেতর। বাধ্য হয়ে অন্য পথ ধরল রানা। জোরালো কয়েক লাথিতে ভাঙল লাশের দুই হাঁটু। এবার ঠিকভাবে বাক্সে এঁটে গেল পা।
জ্ঞানীরা বলেন, মৃতের প্রতি দেখানো চাই উপযুক্ত সম্মান। রানারও ভাল লাগেনি লাশের পা ভাঙতে। খুবই খুশি হতো জীবিত অবস্থায় লোকটার হাঁটু চুরমার করে দেয়ার সুযোগ পেলে।
খুনির লাশ এখন টুলবক্সে, ধুম্ শব্দে ডালা বন্ধ করল রানা। ট্রাকের পেছনে পাঁজরের মত লোহার আড়ায় ঝুলিয়ে নিল তারপুলিনের ঢাকনি। লাফিয়ে নামল ট্রাকের পাটাতন থেকে। গিয়ে উঠল ক্যাবে। প্রতি মুহূর্তে হাঁফিয়ে চলেছে পুরনো ডিজেল ইঞ্জিন। গিয়ার দিতেই দুলতে দুলতে গেটের দিকে চলল ট্রাক।
উঠানের দিকে ঘুরেও তাকাল না রানা। গেট পেরিয়ে ডানে বাঁক নিয়ে উঠল রাস্তায়। ট্রাক চলেছে ব্রায়ানকন শহরের উল্টো দিকে। প্রিয় বন্ধুদের লাশ রেখে যাচ্ছে রানা। স্থির করেনি এবার কী করবে। তবে এটা বুঝেছে, যারা খুন করল দয়ালু মানুষগুলোকে, তাদেরকে হাতের নাগালে পেতেই হবে ওর। বিন্দুমাত্র দয়া দেখাবে না ও ওদের প্রাণ নেয়ার সময়।
ওরা চায় রক্ত। রানাও তা-ই করবে, ঝরাতে শুরু করবে ওদের রক্ত।