এক
সময়টা আজ থেকে বহু বছর আগের- সেই তেরো শত আটচল্লিশ সাল। কুসংস্কারের গভীর কূপে তলিয়ে গেছে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স তথা গোটা ইউরোপের ধর্মবিশ্বাসী, অশিক্ষিত, গরীব মানুষ।
সফেদ তুষারে ছাওয়া বিশাল পর্বতের কাঁধে সন্ন্যাসীদের আস্তানা শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভো, তারই কাছে ছোট্ট এক গ্রামের প্রান্তে জড় হয়েছে একদল ভীত- সন্ত্রস্ত মানুষ। তুমুল শিলা-বৃষ্টির মধ্যে হতবাক হয়ে দেখছে ভলকে ওঠা কালো-ধূসর ধোঁয়া।
চারবার চিতার আগুন নিভে যাওয়ার পর, শেষপর্যন্ত জ্বলে উঠেছে নরকের লকলকে কমলা শিখা। ছড়িয়ে পড়ছে স্তূপীকৃত ভেজা খড়ের ভেতর। আগেই খড়ের মাঝে মাটিতে গেঁথে দেয়া হয়েছে কাঠের এক খুঁটি। এতই ঘন ধোঁয়া, ওই খুঁটিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা লোকটাকে ঠিকভাবে দেখতে পাচ্ছে না গ্রামবাসীরা। অবশ্য পরিষ্কার শুনছে বন্দির প্রাণপণ করুণ প্রতিবাদ। ঝটকা দিয়ে হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে চাইছে লোকটা।
তাতে লাভ নেই। দড়ির বদলে আছে লোহার শিকল। ঝন্-ঝন্ আওয়াজ হচ্ছে। ওটা দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে পুরু কাঠের খুঁটিতে। পবিত্র আগুনে তার পাপ ভরা নোংরা আত্মাকে পরিষ্কার করতে গিয়ে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেয়নি গির্জা কর্তৃপক্ষ।
বন্দি মধ্যবয়সী, অস্থিচর্মসার এক লোক। ঝুল ঝাড়ার লাঠির মতই সরু। স্থানীয়রা তাকে চেনে কানা এখিক সাবাতিয়েখ বলে। বাম চোখ নষ্ট, ওই গর্তের ওপর কালো ঠুলি। আজ থেকে ক’দিন আগে শেষ নভেম্বরে গ্রামে এসেছে সে। পরনে সাধুর জোব্বা ও মাথায় হুডি। এসেই সবার প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছে: সে একজন ফ্র্যান্সিসকান যাজক, চলেছে সুদূর জেরুজালেমে তীর্থযাত্রায়। সেই সময়ে মুসলিম সেনাবাহিনীর দখলে ওই শহর রয়ে গেলেও আবারও ঘাঁটি গাড়তে শুরু করেছে খ্রিস্ট ধর্মানুসারীরা। স্বদেশী ও ফ্র্যান্সিসকান বিশপ খজাখ গুয়েখিখের সঙ্গে যোগ দেবে এখিক সাবাতিয়েখ। প্রতাপশালী মামলুক শাসকদের কাছ থেকে কেনা হবে প্রাচীন শহরের একাংশ। তার মধ্যে থাকবে যিয়ন পর্বতের পবিত্র সেনাকল। সেখানে চালু করা হবে সাধুদের মঠ।
কিন্তু দীর্ঘ যাত্রার শুরুটা ভাল হয়নি সাবাতিয়েখের। বারগাণ্ডি থেকে রওনা দিয়ে আশি মাইল যেতে না যেতেই একদল লুটেরা কেড়ে নিল সব টাকা-পয়সা। মারধর খেয়ে আহতও হলো সাধু। এরপর থেকে রাতের আশ্রয় ও খাবারের জন্যে ভাল মানুষের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেল সে। প্রতিদিন খাবার জোটে না, তার ওপর জেঁকে বসেছে নভেম্বরের হাড় কাঁপানো কনকনে শীত। সেইসঙ্গে শুরু হলো দিনরাত অবিরাম ঝুপ-ঝুপ বৃষ্টি। এই কঠিন পরিবেশে তার দেহে ভর করল অসুখ, ভীষণ জ্বর। ভালভাবে তীর্থযাত্রার আগেই মরতে বসল সে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল পাহাড়ি রাস্তার ধারে নালার ভেতর। কিন্তু কপাল ভাল, এক মাইল দূরে পাহাড়ের ওপরের এক গ্রাম থেকে আসা কয়েকজন কিশোর দেখল তাকে। জ্বরগ্রস্ত লোকটার পরনে সাধুর নোংরা জোব্বা দেখে দৌড়ে গিয়ে গ্রামে খবর দিল তারা। একদল লোক ওয়্যাগন এনে নালা থেকে তুলে সাবাতিয়েখকে নিয়ে গেল নিজেদের গ্রামে। একপাল মুরগির সঙ্গে সাবাতিয়েখের ঠাঁই হলো খালি এক আস্তাবলে।
পরের সপ্তাহে ছেড়ে গেল জ্বর। গায়ের জোর ফিরে পেল সাবাতিয়েখ। এবার যাত্রা করতে হবে, কিন্তু উত্তর থেকে আসছে হিমঠাণ্ডা হাওয়া। ভীষণ শীতের ভেতর রওনা না হয়ে বসন্তের জন্যে অপেক্ষা করতে চাইল সে। কয়েক মাস আশ্রয় দিতে আপত্তি করল না গ্রামবাসী। বাড়তি একটা পেট চালাতে হবে, তবে এ-ও ঠিক, কঠিন শীতে একজোড়া হাতের সাহায্য পাওয়াও কম কথা নয়। সুস্থ হয়েছে সাবাতিয়েখ। প্রথমেই রাস্তা থেকে পরিষ্কার করল জমে থাকা তুষার। তারপর নামল গ্রাম ঘিরে রাখা ঝড় ঠেকিয়ে দেয়ার ভাঙা দেয়াল মেরামতে। এরপর দায়িত্ব নিল শুয়োরের পাল আগলে রাখার। নিজের সব কাজ সুচারুভাবে শেষ করার পর গ্রামবাসীদেরকে জড় করে দিতে লাগল আবেগপূর্ণ ধর্মোপদেশ। প্রায় প্রতিদিনই চলল এসব। ফলে সাবাতিয়েখ রয়ে যাওয়ায় যারা খুব অখুশি ছিল, তাদের বেশি দিন লাগল না খেপে উঠতে।
গ্রামে সবার হাঁড়ির খবর সবাই জানলেও সাবাতিয়েখের মনের খবর তাদের অজানা। সে ঈশ্বরের লোক হলেও খুব অচেনা, তাই গভীর সন্দেহে ভুগছে অতিসঙ্কীর্ণ চিত্তের মানুষগুলো। তার ওপর মাঝে মাঝে খুব বিদঘুটে আচরণ করছে সাধু।
সাবাতিয়েখ সুস্থ হওয়ার প্রথম মাসেই গ্রামবাসীর ভেতর শুরু হলো কানাঘুষো। প্রথমদিকে ওই গুজব থাকল মৃদু। কিন্তু ক’দিনে তা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে- সাধুর ওপর ভর করেছে স্বয়ং শয়তান!
অনেকে বলল, প্রার্থনার সময় আপত্তিকর মন্তব্য করে সাধু। কত বড় সাহস, কুৎসা রটায়: সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে গির্জা! যা খুশি বলে মহান পোপের বিরুদ্ধে!
এ থেকে সবাই বুঝল, অপবিত্র মনের সাধু আসলে ঈশ্বরের লোক হতে পারে না। তারচেয়েও ভয়ের ব্যাপার, হঠাৎ করেই যখন-তখন শরীরে ভয়ানক খিঁচুনি নিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে সে।
একবার শুয়োরগুলোকে খাবার দেয়ার ফাঁকে ধর্মোপদেশ প্রচারের সময় হঠাৎই বাজপড়া মানুষের মত মাটিতে পড়ল সাবাতিয়েখ। ছটফট করতে লাগল জবাই করা মুরগির মত। খুন হওয়ার সময়ে এমন করে মানুষ। ভীষণ ভয় পেল গ্রামবাসী। ভয়ঙ্কর বিকৃত হলো সাধুর মুখ। ঠোঁটের কশ বেয়ে নামল লালা। উল্টে গেল অবশিষ্ট চোখটা। মণির জায়গায় থাকল শুধু সাদা অংশ। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কী যেন বকল সে। নিশ্চয়ই ইবলিশের শিখিয়ে দেয়া বিদঘুটে কোনও ভাষা, বোঝা যায় না তার কিছুই!
এরপর দ্রুতগতি পেল গুজব।
গ্রামবাসী বুঝল, সত্যিই শয়তানের কবলে পড়েছে অভিশপ্ত সাধু। আগেও তারা শুনেছে, এমন দুর্ভাগ্য হয় কারও কারও, তবে এবার নিজ চোখে সবাই দেখছে সব।
শয়তানের খপ্পরে না গেলে এমন হয় মানুষের?
তৃতীয়বারের মত জনসাধারণের মাঝে সাবাতিয়েখ মূর্ছা গেলে তা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিল গ্রামবাসীরা। ডাকা হলো মোড়লদের জরুরি বৈঠক। ওই সভায় স্থির হলো, গ্রামের মাঝে এত অশুভ লোককে রাখা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও আপাতত আবহাওয়া মন্দ, তবুও বাধ্য হয়েই যেতে হবে শহরে। সব খুলে বলতে হবে চার্চ কর্তৃপক্ষের কাছে। এ কাজ করবে গ্রামবাসীদের মধ্যে সেরা ঘোড়সওয়ার কাঠমিস্ত্রি উইলি। ওদিকে গ্রামের বাইরে পাথরের এক আস্তাবলে বন্দি করে রাখা হবে কানা এখিক সাবাতিয়েখকে। আশা করা যায় দিন-রাত পাহারা দিলে হয়তো ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে না গ্রামবাসীদের।
সাবাতিয়েখকে বন্দি করার পর পেরোল দুশ্চিন্তা ভরা ক’টা দিন। এরপর গ্রামে ফিরল কাঠমিস্ত্রি। পেছনে এল বিশপের পাঠিয়ে দেয়া ছোট একটা দল। তারা গ্রামে এসেই ছোট্ট গির্জার ভেতর ডাকল সভা। বন্দিশালা থেকে ধরে আনা হলো শেকলে বাঁধা সাবাতিয়েখকে। বিশপের দূতের পায়ের কাছে উপুড় করে শুইয়ে দেয়া হলো তাকে। তার বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ আছে, সবই শুনল চুপচাপ। জানে, প্রতিবাদ করেও লাভ হবে না।
কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিল: সত্যিই শয়তানের কব্জার ভেতর চলে গেছে এ!
এমন সময়ে হঠাৎ সবার সামনেই আবার মূর্ছা গেল সাবাতিয়েখ। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কী যেন বলতে লাগল। সেইসঙ্গে ভীষণ ঝটকা মারছে তার শরীর। সবাই বুঝে গেল, ঠিকই বলেছে বিশপের দূত- ওই অশুভ সাধুর আত্মাটাকে দখল করে নিয়েছে স্বয়ং শয়তান!
শয়তানের আসর হওয়া মানুষের শরীরটা পুড়িয়ে দিলে আর কিছুই করতে পারে না অশুভ শক্তি। এখন তারই ভালর জন্য সাবাতিয়েখকে পুড়িয়ে মারাই একমাত্র উপায়। তাতে আবারও পবিত্র হবে তার আত্মা।
রায় দেয়া হয়ে গেছে, সেটা কার্যকর হচ্ছে এখন; অলস ঢেউয়ের মত কমলা আগুনের শিখা চাটতে শুরু করেছে এখিক সাবাতিয়েখের পায়ের পাতা। উত্তরদিকের পাহাড় থেকে আসা শীতল হাওয়া সরিয়ে দিল চিতার ধূসর ধোঁয়া। পুড়ছে সাবাতিয়েখের পা। ভীষণ যন্ত্রণায় করুণ আর্তচিৎকার জুড়েছে সে। দেখতে না দেখতে ঊরুর কাছে উঠে এল লকলকে আগুন। জায়গায় জায়গায় পুড়ল জোব্বা। গ্রামবাসীরা দেখল, সাধুর গায়ে বড় বড় ফোস্কা, কালো হয়ে যাচ্ছে চামড়া-মাংস।
‘আমি অভিশাপ দিচ্ছি!’ গনগনে আগুনের ভেতর থেকে চেঁচাল সাবাতিয়েখ, ‘নিরপরাধ একজন মানুষকে খুন করছ! আজ থেকে তোমরা অভিশপ্ত! তোমাদের ঠাঁই হবে নরকে!
একটু দূরে উঁচু চেয়ারে বসে আছে গির্জা কর্তৃপক্ষের দূত। পাশেই সৈনিকদল। আরও কিছুটা দূরে গ্রামবাসীরা। সাবাতিয়েখের প্রতিটা কথা শুনছে তারা।
সাধুর অভিশাপ শুনে ভীষণ ভয়ে পিছিয়ে গেল গ্রামবাসীরা। তাদের ধারণা: ওই কণ্ঠ আসলে শয়তানের। মায়েদের জোব্বার ভেতর মুখ লুকিয়ে চোখ বুজল বাচ্চারা। কান ঢাকল মহিলারা। শুনবে না অশুভ আত্মার হুঙ্কার!
সাবাতিয়েখের বুকের কাছে উঠল আগুন। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করে চেঁচাল সাধু: ‘সবই দেখছেন ঈশ্বর! ঈশ্বর, দেখুন কী মহাপাপ করছে এরা! শোনো, এলাকাবাসী, আমার অভিশাপ থেকে কেউ রেহাই পাবে না- না তোমরা, না তোমাদের সন্তানরা! নরকে পুড়বে হাজার বছর ধরে!’
বিশপের দূতের দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকাল এক সৈনিক। ধনুকের ছিলায় আটকে নিল তীর। অনুমতি পেলেই তীর গেঁথে দেবে জ্বলন্ত সাধুর বুকে। তা-ও ভাল, কারণ ভয়ঙ্কর আত্মার হুঙ্কার শুনে বুক কাঁপছে সবচেয়ে সাহসী মানুষেরও।
কিন্তু মাথা নাড়ল বিশপের দূত।
পবিত্র হতে হবে সাবাতিয়েখের দেহ। উপায় নেই দয়া দেখাবার। আগুনে পুড়ে মরতে হবে পাষণ্ড সাধুকে।
আগুনে পুড়তে গিয়ে যেন চিরকাল নিচ্ছে সাবাতিয়েখ। গ্রামবাসীদের মনে হলো বারবার তাদের দিকে ঝুঁকে এল তার জ্বলন্ত শরীর। চিড়বিড় শব্দে পুড়ছে মানুষের চর্বি। হাড় থেকে খসে এল চাকা চাকা পোড়া কালো মাংস। তবে একটু পর থামল অশুভ লোকটার চিৎকার। কালচে শেকলের ভেতর খুঁটির সঙ্গে ঝুলে থাকল শিথিল দেহ। দপ্ করে জ্বলে উঠল সাবাতিয়েখের জোব্বার ওপরের অংশ। শিখা পুড়িয়ে দিল মাথার চুল। দাউ-দাউ আগুনে এখন প্রায় দেখাই যাচ্ছে না তাকে। পুড়ল মুখ। তবে গ্রামবাসীর দিকে ঘৃণা নিয়ে চেয়ে রইল তার একমাত্র চোখটা।
আরও বহুক্ষণ পর ছাই হলো মানুষটার কঙ্কাল। খসে পড়ল লেলিহান আগুনের ভেতর। খুঁটির সঙ্গে রয়ে গেল ভারী শেকল। কিন্তু এখিক সাবাতিয়েখের চিৎকার ঘুরপাক খেতে থাকল গ্রামবাসীদের মগজের গভীরে।
অশুভ সাধু বলেছে, আজ থেকে চিরকালের জন্যে তারা অভিশপ্ত। বাস করবে নরকে। রক্ষা নেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের।
এরপর মাত্র ক’মাসের মধ্যে ফলল সাবাতিয়েখের কথা। শুরু হলো সাধুর ভয়ানক অভিশাপ!
দুই
উত্তর কোরিয়ার এক পাহাড়ি অরণ্য।
দু’হাজার পনেরো সালের মার্চের দুই তারিখ।
বিশাল দালানে ঢুকেই ডেইটার গিসেল বুঝেছে, এখানে পা রেখে মস্তবড় ভুল করেছে তারা।
অথচ প্রতিটি তথ্য ছিল নির্ভুল। তথ্যদাতার কথা অনুযায়ী উত্তর কোরিয়ার এই ফ্যাসিলিটিতেই আছে সে জিনিস। প্রায় চলে এসেছিল হাতের মুঠোয়। তথ্য এবং যন্ত্রপাতি জোগাড় করতে ব্যয় হয়েছে লাখ লাখ ডলার। গত পুরো একবছর লেগেছে পরিকল্পনা আঁটতে। প্রতিদিন বারো ঘণ্টা থেকে ষোলো ঘণ্টা মানসিক ও শারীরিক শ্রম দিয়েছে তারা। কখনও আরও বেশি সময়। খুঁটিয়ে দেখেছে প্রতিটি দিক। অ্যানালাইয করেছে সিকিউরিটি সিস্টেম এবং ঝুঁকির পরিমাণ। জানত, দুর্ভেদ্য ফ্যাসিলিটি থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া হবে খুবই কঠিন।
সত্যি, কোনও লাভ হলো না এত পরিকল্পনা করে!
মিশনের শুরুতেই বাধল গণ্ডগোল। শত্রুপক্ষ জেনে গেল ওরা ঢুকেছে ফ্যাসিলিটির ভেতর। একটু আগেও ছিল দশজন। এখন নয়জন। ফেলে এসেছে জরুরি ইকুইপমেন্ট। হাতে অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই নেই।
পেছনে উজ্জ্বল নিয়ন বাতির সাদা করিডোরে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে তিনজন লোক। রক্তের স্রোতে ভেসে গেছে মেঝে। ওই তিনজনের দু’জন উত্তর কোরিয়ান সিকিউরিটি পারসোনেল বা সৈনিক। অন্যজন ডেইটার গিসেলের দলের লোক- বিশ্বস্ত এক অস্ট্রেলিয়ান। নাম জ্যাক লরেন্স। তারা শেষ দরজা পেরিয়ে জিনিসটা হাতের মুঠোয় পাবে, এমনসময় এল কোরিয়ান লোকদু’জন। চমকে গিয়েছিল দুই পক্ষ। এখন আর জ্যাক লরেন্সের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই গিসেলের কাছে। তাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত এ নরক থেকে বেরিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে গিসেল। না, প্রাণ থাকতে আত্মসমর্পণ করবে না তারা। তেলাপোকা ভরা উত্তর কোরিয়ার নোংরা বন্দিশালায় বাকি জীবন পার করার চেয়ে গুলি করে নিজের মাথার খুপরি উড়িয়ে দেয়াও ভাল।
জোট বেঁধে ছুটছে গিসেলের দলের সবাই। নিজেদের বুটের ধুপ-ধাপ শব্দ ছাপিয়ে শুনছে ফ্যাসিলিটির চারপাশে অ্যালার্মের তীক্ষ্ণ সাইরেন। হোলস্টার থেকে পিস্তল নিয়ে ডেইটারের পাশেই ছুটছে তার প্রেমিকা ডেইযি বাট্স্। উত্তেজনায় হিংস্র জানোয়ারের মত বেরিয়ে পড়েছে ঝকঝকে দাঁত। শক্ত হাতে উযি সাবমেশিন গান ধরেছে হেলমুট হাইনরাইনার। সে-ই খুন করেছে দুই কোরিয়ানকে। দলের পেছনে কানাডিয়ান লোক স্টিফেন রোথ। সামনেই প্যাট্রিক ওয়াইস্। প্রচণ্ড মানসিক চাপে যে-কোনও সময়ে হাল ছেড়ে দেবে সে।
সামনে দু’দিকে গেছে করিডোর। ওখানে পৌঁছে জানতে চাইল পাওলো গুয়েডিনেটি, ‘কোন্ দিক দিয়ে ঢুকেছি?’
‘ওদিক দিয়ে,’ বামের করিডোর দেখাল ডেইটার গিসেল। প্রেমিকা ডেইযির হাত ধরে ছুটে চলল সে। তার মনে হচ্ছে আগের চেয়েও জোরে বাজছে সাইরেন। একটা দরজা পেরিয়ে করিডোরে বাঁক নিল ওরা।
খুলে গেল একটু দূরের এক দরজা। আটকে দেয়া হয়েছে পালাবার পথ। করিডোরে এখন চারজন সিকিউরিটির লোক। পরনে খাকি রঙের প্যারামিলিটারি ইউনিফর্ম। হাতে চিনের তৈরি অ্যাসল্ট, রাইফেল। কোরিয়ান ভাষায় ধমকে উঠল তারা। ওই ভাষা অচেনা হলেও ডেইটার গিসেল বুঝল কী বলা হয়েছে তাদেরকে।
হাত থেকে অস্ত্র ফেলো!
সারেণ্ডার করো, নইলে গুলি খেয়ে মরবে!
মাত্র দু’সেকেণ্ডের জন্যে থমকে গেল দুই পক্ষ। সবার আগে গুলি করল হেলমুট হাইনরাইনার। কোমরের কাছ থেকে সামনের করিডোরে পাঠাল একরাশ নাইন মিলিমিটার বুলেট। গ্লক পিস্তল থেকে পর পর পাঁচবার গুলি ছুঁড়ল ডেইযি বাট্স্। হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল চার গার্ড। হেকলার অ্যাণ্ড কক সাবমেশিন গান থেকে শেষজনের বুকে গুলি করেছে ডেইটার। আগেও মানুষ খুন করেছে বলে মনে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই তার।
‘চলো!’ সাইরেনের ওপর দিয়ে চেঁচাল ডেইযি। চোখে হিংস্রতা ও ভয়। শিরার ভেতর টগবগ করছে অ্যাড্রেনালিনের স্রোত। লাশগুলো টপকে ছুটল সে। পেছনে অন্যরা।
প্রেমিকার যোগ্যতা দেখে গর্ব হলো ডেইটারের। কয়েক সপ্তাহ আগে ঠিক করেছে, এই মিশন গুবলেট হলে নিজের জীবন নেয়ার আগে খুন করবে ডেইযিকে। চিরবুনো মেয়েটির বন্দি হয়ে কষ্ট পাওয়ার কোনও দরকার নেই।
প্রাণপণে ছুটছে ওরা। সাইরেনের কর্কশ আওয়াজ ও বুটের ধুপ-ধাপ ছাড়া চারপাশে আর কোনও শব্দ নেই। একেকটা দরজা পার হওয়ার সময় ডেইটারের মনে হচ্ছে, এই বুঝি দড়াম করে খুলবে কবাট, হুড়মুড় করে করিডোরে ঢুকবে একদল গার্ড। তবে এ ফ্যাসিলিটিতে ঢুকতে গিয়ে যেমন বাধা পাবে ভেবেছে, সে ধরনের কিছুই হয়নি। দেশে যতই কড়া স্বৈরশাসক থাকুক, অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু হয়ে গেছে উত্তর কোরিয়া। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাসিলিটি পাহারা দিতে গিয়েও বাজেট কমাতে হয়েছে তাদেরকে। তা ছাড়া, কারও তো জানার কথা নয় পাহাড়ি জঙ্গলে আছে এই স্থাপনা। স্বাভাবিকের চেয়ে কম গার্ড রেখেই সন্তুষ্ট থেকেছে কর্তৃপক্ষ। হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে ফ্যাসিলিটির বাকি ক’জন গার্ড। এড়াতে চাইছে লড়াই। বুঝে গেছে, সংখ্যায় বেশি হামলাকারীরা। আবার এ-ও হতে পারে, ফ্যাসিলিটিতে হয়তো আর কোনও গার্ডই নেই!
আগেই কি পিছিয়ে গেলাম, ভাবছে ডেইটার। কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই করিডোরের প্রধান দরজার কাছে পৌঁছে গেল তারা। দৌড়ে বেরিয়ে এল ঘন সবুজ জঙ্গলের মাঝের ফাঁকা উঠানে। বাইরের পরিবেশ গরম কোনও ভেজা চাদরের মত। কানে বেশি করে বাজল সাইরেনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। শব্দ বিকৃত হয়েছে ভবনের গায়ে বাড়ি খেয়ে। ধূসর কংক্রিটের ফ্যাসিলিটি। সামনেই জেলখানার উঠানের মত বিশাল প্রাঙ্গণ। চারদিকে পনেরো ফুট উঁচু স্টিলের খুঁটির গায়ে তারকাঁটার বেড়া। মাথার ওপর কয়েল করা রেযার ওয়াইয়ার। অন্য ভবনের চেয়ে বহু গুণ বড় চারকোনা প্ৰধান দালানটি। কোনও জানালা নেই। বিশাল বাঙ্কারের মত। চারপাশে ছোট সব গুদাম ঘর ও যন্ত্রপাতি রাখার ছাউনি। গায়ে মিলিটারির সবুজ রঙ। প্রধান দালানের আশি গজ দূরে মেইন গেট থেকে ফ্যাসিলিটির ভেতর কয়েক দিকে গেছে রাস্তা। চারপাশের গভীর অরণ্য কেটে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপনা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী এর কোনও অস্তিত্ব নেই। এই ফ্যাসিলিটির ব্যাপারে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করলেও তাদের স্যাটেলাইটের ছবিতে অস্বাভাবিক কিছুই পায়নি পশ্চিমা ইন্টেলিজেন্স। উত্তর কোরিয়া জুড়ে রয়েছে এমন শত শত · স্থাপনা, একটা থেকে আরেকটা আলাদা করা অসম্ভব।
চতুর পশ্চিমা গুপ্তচরদের চেয়েও ধূর্ত ডেইটার। প্রতিটি দিক খুঁটিয়ে দেখেছে সে। এই ফ্যাসিলিটির ভেতর কী আছে সেটা কেউ জানলে, সে ডেইটার গিসেল। লক্ষ লক্ষ ডলার ব্যয় তো করেইছে, সঙ্গে দিয়েছে প্রচণ্ড মানসিক খাটুনি।
মেইন গেট এড়িয়ে কম্পাউণ্ডের এক শ’ গজ দূরে পুবের পেরিমিটার ফেন্স কেটেছে তারা। ওখানে রয়েছে থোকা থোকা ঝোপ। আশপাশে নেই গুদাম বা যন্ত্রপাতি রাখার ছাউনি। একটু দূরেই পাহাড়ি জঙ্গল। ওদিকে ফাঁকা এক জায়গায় অপেক্ষা করছে দুটো হেলিকপ্টার। দরকারি জিনিসটা পেলে ওগুলোতে উঠে বেশিক্ষণ লাগত না সাগরে পৌঁছে যেতে। সাগরে আছে মোটর লঞ্চ। ওদেরকে নেবে পুবে জাপানের নিরাপদ এলাকায়। এরপর টোকিওতে চার্টার করা জেট বিমানে উঠে পৌঁছত ইউরোপে। ব্যস, খতম মূল মিশন।
এরপর দ্বিতীয় পর্যায়। এবং সেজন্যে বহু বছর অপেক্ষা করেছে ডেইটার গিসেল।
‘আশপাশে কেউ নেই,’ চারদিক দেখল হাইনরাইনার। তার কথাই ঠিক। ফাঁকা পড়ে আছে কম্পাউণ্ড। দূরে সারি দিয়ে রাখা কয়েকটা কোরিয়ান পিপল্স্ আর্মির সবুজ জিপ।
‘মনে হয় ওরা শেষ,’ বলল ডেইযি। ‘এখন আর ফ্যাসিলিটি পাহারা দিচ্ছে না কেউ। ফিরে গিয়ে জিনিসটা নিয়ে আসা উচিত। দেরি করলে ভুল হবে।’
চুপ থাকল ডেইটার। দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মত। একদিকে কাত হয়েছে মাথা।
‘ডেইযি ঠিকই বলেছে,’ বলল গুয়োডিনেটি। ‘হাতে সময় আছে। শেষ করতে পারব কাজ।’
‘ওটার জন্যেই এসেছি,’ বলল ডেইযি। ‘ভুলে গেলে? এ-ই.. শেষ সুযোগ। একবার ফিরে গেলে পরে আফসোস হবে।’
নীরব থাকল ডেইটার।
‘আমার মনে হয় ঠিকই বলেছে এরা,’ বলল হেলমুট হাইনরাইনার, ‘না শুনলে বাড়ি ফিরতে হবে খালি হাতে।’
‘খামোকা জীবন দেয়নি লরেন্স,’ বলল গুয়েডিনেটি। ‘কাজ শেষ করার মত সময় হাতে নেই,’ বলল ডেইটার। ‘পরে আবার চেষ্টা করব।’
‘সেজন্যে অপেক্ষা করতে হবে কত দিন?’ বলল ডেইযি। ‘মাসের পর মাস? নাকি বছরের পর বছর?’
‘অপেক্ষা করতে হবে সঠিক সময়ের জন্যে,’ কাঁধ ঝাঁকাল ডেইটার।
‘আমি আর অপেক্ষা করতে চাই না,’ জেদি সুরে বলল ডেইযি।
দলের অন্যদের চেয়ে অধীর ডেইটার। কিন্তু জিনিসটা পাওয়া এখন অসম্ভব। মাথা নাড়ল সে। ‘শুনছ?’
করিডোর থেকে বেরিয়েই শব্দটা পেয়েছে সে। সাইরেন ছাপিয়ে দ্রুত বাড়ছে আওয়াজ। ঘড়-ঘড় করে আসছে ভারী যানবাহন। কে জানে, কয়টা। তবে একটু পর কম্পাউণ্ড ভরে যাবে সৈনিকে। আবারও ফ্যাসিলিটিতে ঢোকা এখন একদম অনুচিত।
ভারী ইঞ্জিনের গর্জন শুনল ডেইযি। ‘সর্বনাশ!’
জঙ্গলের মাঝের রাস্তায় দেখা দিল ছয়টা রাশান গ্যায ভদনিক ট্রুপার ক্যারিয়ার। মেইন গেটের দিকে এল সগর্জনে। প্রতিটি যানে আছে নয়জন সৈনিক ও অফিসার। গতি না কমিয়ে গেটের ওপর হামলে পড়ল সামনের গাড়িটা। গ্যালভানাইড্ তার ছিঁড়ে ঢুকল কম্পাউণ্ডে। পেছনে কনভয়ের অন্যগুলো। চারপাশে ছড়িয়ে গিয়ে ব্রেক কষে থামল গাড়িগুলো। হ্যাচ খুলে নামতে লাগল সৈনিকরা। সংখ্যায় অন্তত পঞ্চাশজন। প্রত্যেকে সশস্ত্র। বিপক্ষে মাত্র নয়জন শত্রু।
‘মরুক হারামজাদারা,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল হেলমুট হাইনরাইনার। উযি সাবমেশিন গানে ভরল নতুন ম্যাগাযিন। পিস্তল ওপরে তুলল, ডেইযি। পরস্পরের দিকে তাকাল জেয়ান মাখমাইট ও রজার ওয়েরিন। একইসঙ্গে চোখ ফেরাল প্যাট্রিক ওয়াইভসের দিকে।
কম্পাউণ্ড ভরে গেল ছোট ক্যালিবারের গুলির আওয়াজে। এক পা-ও পেছাল না হেলমুট হাইনরাইনার। বাম ও ডানে এক পশলা করে গুলি পাঠাল সৈনিকদের উদ্দেশে। পরক্ষণে থরথর করে কেঁপে উঠে পড়ে গেল সে। হাত থেকে খসে গেছে উযি। পেছনের দেয়ালে ছিটকে লেগেছে এক ঝলক তাজা রক্ত। কুঁজো হয়ে দলের আহত সদস্যের দিকে ছুটল ডেইটার। রাইফেলের গুলিতে ছিঁড়ে গেছে হাইনরাইনারের গালের একপাশ। দু’হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে আড়ালে সরতে চাইল গিসেল। তাকে সাহায্য করল রজার ওয়েরিন। ওদিকে নাগাড়ে গুলি করছে ডেইযি। মাটিতে পড়ে গেল ক’জন সৈনিক। এদিকে এগিয়ে আসছে রাশান গ্যায ভদনিক ট্রুপার ক্যারিয়ার। ওগুলো থেকে চালু হলো ভারী মেশিন গান। বাতাস ছিঁড়েখুঁড়ে গেল ১৪.৫ এমএম বুলেটের গর্জনে। জিপগাড়ির সারির মাঝে এবং দুই দালানের মধ্যে ঢুকল শক্তিশালী গুলি। নানাদিকে ছিটকে উঠছে কংক্রিটের টুকরো।
ডেইটার গিসেলের ধারণাই ঠিক, ওরা মূল ফ্যাসিলিটিতে রয়ে গেলে কয়েক মিনিটে খুন হতো!
‘হাত লাগাও!’ চেঁচাল ডেইটার। সরাতে চাইছে রক্তাক্ত হাইনরাইনারকে। দলনেতাকে সাহায্য করল
করল প্যাট্রিক ওয়াইড্স ও ভিকি অন্যাথ। গোলাগুলি উপেক্ষা করে দুই দালানের মাঝে সরিয়ে নিল আহত সঙ্গীকে। সামনে রয়ে গিয়ে তাদেরকে কাভার দিল অন্যরা।
শত শত গুলি ছুঁড়ছে সৈনিকরা। দলের অন্যরা কাভার নিতে চাইলেও পেছনে রয়ে গেছে ডেইযি। খালি হয়েছে হাতের পিস্তল। কাঁধে গুলি খেল অ্যান্টন লিওকুইস্ট। তাকে জড়িয়ে ধরে আড়ালে নিল স্টিফেন রোথ। ওরা ক’জন অক্ষত অবস্থায় বেড়ার ছেঁড়া অংশ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে, বুঝতে পারছে না ডেইটার গিসেল। ঝোপঝাড়ের আড়াল নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলল তারা। শক্ত হাতে ভারী হাইনরাইনারকে ধরে পিছিয়ে চলেছে ডেইটার। রক্তে ভেজা শরীরে পিছলে যাচ্ছে হাত। সে ভাবছে, কপাল মন্দ হলে এরই ভেতর দুই হেলিকপ্টারের কাছে পৌঁছে গেছে আরেকদল সৈনিক।
আর ষাট সেকেণ্ড পর ফিরতি পথে যাওয়ার কথা যান্ত্রিক দুই ফড়িঙের। এরই ভেতর গুলির আওয়াজ পেয়েছে পাইলটরা। গতি তুলছে টারবাইনে। প্রথম সুযোগে উঠবে আকাশে। কয়েক সেকেণ্ড পর ডেইটার দেখল, মাটি ছেড়ে কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠেছে হেলিকপ্টারদুটো। ওগুলোর বাতাসের দাপটে শুয়ে পড়েছে ঝোপঝাড়। পরের আধমিনিটে ডেইটারের দলের জীবিত সবাই উঠে পড়ল হেলিকপ্টারে। ডানের যান্ত্রিক ঘাস ফড়িঙে চেপে বসল ডেইটার, ডেইযি, অন্যাথ, গুয়েডিনেটি এবং আহত হাইনরাইনার। বামের হেলিকপ্টারে স্টিফেন রোথ, জেয়ান মাখমাইট ও রজার ওয়েরিন।
কম্পাউণ্ড ত্যাগ করে গাছের মাঝ দিয়ে ছুটে আসছে সৈনিকরা। গাঢ় সবুজ জঙ্গলের ছায়ায় ঝলসে উঠছে মাযলের কমলা আগুন। কয়েকটা গুলি ফাটল ধরাল ডেইটারের হেলিকপ্টারের পার্সপেক্স স্ক্রিনে।
‘ওঠো!’ পাইলটের উদ্দেশে চিৎকার করল ডেইটার, ‘সরে যাও এখান থেকে!’
আকাশে উঠছে হেলিকপ্টার। হঠাৎ দেখা গেল জঙ্গল ভেদ করে বেরিয়ে আসছে সবুজ রঙের এক আর্মার্ড প্লেটেড ভিটিটি-৩২৩ পার্সোনেল ক্যারিয়ার। ওটার ভীষণ চাপে মড়- মড় করে ভেঙে পড়ছে সামনের সব গাছ। দুই এয়ারক্রাফটের দিকে ঘুরছে জোড়া মেশিন গানের নল। সেদিকে খেয়াল নেই ডেইটারের। চোখ ছানাবড়া হয়েছে টারেটে রাখা লঞ্চারে র্যাক ভরা রকেট দেখে। ট্র্যাক করা হচ্ছে দুই হেলিকপ্টারকে!
‘জলদি!’ রোটরের গর্জন ছাপিয়ে চেঁচাল ডেইটার, ‘ওপরে ওঠো!’
একই সময়ে আগুনের কমলা লেজ পেছনে নিয়ে ছিটকে উঠল দুটো রকেট। গাছের মাথা ছুঁয়ে গিয়ে লাগল দ্বিতীয় হেলিকপ্টারের পেটে। দেখা দিল প্রচণ্ড সাদা ঝিলিক। পরক্ষণে চারদিকে ছিটকে গেল আগুনের মস্তবড় ফুটবল।
পোড়া হেলিকপ্টারের জঞ্জাল ঝরঝর করে নামতে দেখে হাঁ হয়ে গেছে ডেইটার গিসেল। যান্ত্রিক ফড়িঙের জ্বলন্ত ফ্রেম খসে পড়ল পার্সোনেল ক্যারিয়ারের ওপর। দ্বিতীয় বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিল পুরো জঙ্গল। নিচে আর কিছু দেখল না ডেইটার, নাক তুলে লেজ দাবিয়ে ঘুরল হেলিকপ্টার, সোজা চলল সাগরের উদ্দেশে।
দ্রুত পিছিয়ে পড়ছে সবুজ জঙ্গল। চুপ করে থাকল সবাই। রক্তাক্ত ক্ষতের যন্ত্রণায় ছটফট করছে হাইনরাইনার। তাকে চেপে ধরেছে গুয়েডিনেটি ও অন্যাথ। ফার্স্ট-এইড কিট থেকে মরফিন নিয়ে বন্ধুর হাতে ইঞ্জেক্ট করল গুয়েডিনেটি। নিজের চিন্তায় তলিয়ে গেছে ডেইযি। মুখ ভিজে গেছে অন্যের রক্তের ছিটা লেগে।
কতটা ক্ষতি হলো, তার হিসেব কষছে ডেইটার গিসেল। স্থির করেছে, এখানেই এর শেষ নয়। আবারও ফিরবে সে। তখন ঠিকই পাবে যা চায়। আজ বা কাল, গোটা দুনিয়ার মানুষ জানবে কী করেছে সে।
এটা তার মহান নিয়তি।
তিন
ফ্রেঞ্চ এউটেস-আল্পস।
উঁচু পাহাড়ি খাদে পড়ে থাকা ওই যুবক বেঁচে আছে, না লাশ জানা নেই কারও। এখন কী করবে স্থির করতে গিয়ে অনেক সময় নিয়েছে সাধুরা।
প্রথমে যুবককে দেখেছে উনিশ বছর বয়সী জন পিয়েরে। ছুটে গিয়ে খবর দিয়েছে মঠের প্রধান সাধুকে। বলেছে, ওদিকে গিয়েছিল কমবয়সী এক শ্যামোয়ার সঙ্গে খাতির জমাতে। তখনই দেখেছে ওই মৃতদেহ।
ট্রেইল থেকে দূরে খাদের ভেতর পাথরখণ্ডের মধ্যে ক্যাম্প করেছিল লোকটা। সবুজ ছোট তাঁবু। পাশেই লাশ। তৈরি করেছিল ছোট কিন্তু গভীর এক চুলা। চিমনি আছে ওটার। ছড়িয়ে যেত না ধোঁয়া। লোকটা বোধহয় ওখানে লুকিয়ে ছিল পুলিশের ভয়ে।
লাশের কাছে যাওয়ার সাহস হয়নি জন পিয়েরের। ওখানে অপেক্ষা করেছে আধঘণ্টা। তারপর বুঝল, একেবারেই নড়ছে না লোকটা। তখনই টের পেল, মারা গেছে সে।
বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর জন পিয়েরের সঙ্গে ক’জন যুবক ও মধ্যবয়স্ক সাধুকে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রধান সাধু। মাঝ দুপুরে যুবকের ক্যাম্পে পৌঁছেছে তারা। তবে অবাক কাণ্ড, লাশ ছিঁড়ে খেতে শুরু করেনি নেকড়ে বা শকুন।
একটু পর বোঝা গেল কেন আশপাশে নেই মাংসাশী প্ৰাণী।
মৃত নয় লোকটা। ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত। জ্ঞান নেই। কাঁধে ও বাহুতে বুলেটের জখম। জনপদ থেকে এত দূরে কেন এসেছিল, তা বোঝা যাচ্ছে না। পোশাক দেখে মনে হয় না ভবঘুরে বা ফকির। শিকারিও নয়। তাঁবুর ভেতর বা আশপাশে কোনও অস্ত্র নেই।
যুবকের পকেটে পরিচয়পত্র মিলল না। সঙ্গে এনেছে সবুজ রঙের একটা ক্যানভাস হ্যাভারস্যাক। ওটার ভেতর মিলল একটা ছুরি ও প্রচুর পরিমাণ ইউরোর বড় বড় নোট।
দক্ষ হাতে তৈরি করা চুলাটা বিস্মিত করেছে সাধুদেরকে। পাথর ও মাটির তৈরি চিমনি বলে দিচ্ছে, পাহাড়ে অন্তত এক সপ্তাহ ধরে বাস করছে লোকটা। চুলার একপাশে চেরাই করা কাঠ। সাধুরা বুঝল, এই লোক সাধারণ কেউ নয়। সে জানে কীভাবে বৈরী প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। আগে হয়তো ছিল আর্মিতে। পরনে জিন্সের প্যান্ট, চামড়ার জ্যাকেট, পায়ে বুট। উস্কোখুস্কো কালো চুলগুলো পরিপাটি করে ছাঁটা।
সাধুদের কাছে মোবাইল ফোন নেই যে, এসএএমইউ ইমার্জেন্সি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্স সার্ভিসের সাহায্য নেবে। অবশ্য মঠের নিয়ম হচ্ছে বিপদগ্রস্তকে সাধ্যমত সাহায্য করা। মুসাফিরদের সহায়তা করলে খুশি হন স্রষ্টা। কাজেই সাধুরা স্থির করল, যুবককে নেবে তাদের মঠে। প্রথমে সুস্থ করতে হবে রোগীকে, তারপর সে কোথায় যাবে বা কী করবে, সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়।
তাঁবু গুটিয়ে ব্যাগ গোছাল সাধুরা। একটা স্ট্রেচারমত বানিয়ে কয়েকজন মিলে তুলে নিল অচেতন যুবককে। আঁকাবাঁকা, বিপজ্জনক ট্রেইল বেয়ে নামতে লাগল শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভো মঠের দিকে। তারা কেউ জানল না, সঙ্গে করে নিয়ে চলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক গুপ্তচরকে।
.
দশ দিন আগে জ্বর ছেড়েছে মাসুদ রানার। আজও ভোরের আগেই ভাঙল ঘুম। নিথর হয়ে শুয়ে থাকল সরু বিছানায়, সম্পূর্ণ সতর্ক। মনে পড়ল ইতালিতে শেষ ক’টা দিনের কথা।
ডার্ক মেডিউসা* পর্ব শেষ হওয়ার পর ইতালিতে নির্জন এক হোটেলে উঠেছিল রানা ও নোরা। দারুণ কেটেছে সময়।
কিন্তু পঞ্চম দিন এল বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের ফোন। তিনি বললেন: আত্মহত্যার আগে অস্থায়ী ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স চিফ জ্যারেট ঘনিষ্ঠ ক’জন স্যাঙাতকে বলেছে- তোমাদের উচিত পৃথিবী থেকে মাসুদ ‘রানাকে সরিয়ে দেয়া। নইলে তোমাদেরকেও ছাড়বে না সে। সেক্ষেত্রে খুন হবে, বাধ্য হবে আত্মহত্যা করতে, অথবা বহু বছরের জন্যে পচে মরবে জেলে। সুতরাং, নিজ স্বার্থেই তাকে খুন করা উচিত তোমাদের।
মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান আরও জানান: ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস চিফ মার্ভিন লংফেলো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই তিনি জোর দাবি জানাবেন, যেন রানার পেছনে লেলিয়ে দেয়া মৃত্যুদূত ব্রিটিশ এজেন্টদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। তবে আপাতত ওর উচিত আত্মগোপন করা।
সেদিনই নোরাকে আমেরিকাগামী বিমানে তুলে দিয়ে হোটেলে ফিরতেই লবির তিনদিক থেকে এল রানার ওপর হামলা। গোলাগুলির সময় খুন হলো চারজন ব্রিটিশ এজেন্ট। অন্য দু’জনকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ফ্রান্সের পাহাড়ি এলাকায় চলে এল হতক্লান্ত, আহত রানা।
আল্পসের ছোট এক শহর থেকে সংগ্রহ করল সামান্য রসদ ও ছোট একটা তাঁবু। ওই শহরেই রয়েছে ইরাকি যোদ্ধা, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইশতিয়াক আহমেদ ফারুক। তবে তার সঙ্গে দেখা করেনি রানা। মন সায় দেয়নি তাকে বিপদে জড়িয়ে নিতে।
পাহাড়ি ক্যাম্পে সাত দিন ছিল রানা। কিন্তু আরও বাড়ল জ্বরের প্রকোপ। হিসাব থাকল না দিন-রাতের। আবার যখন জ্ঞান ফিরল, দেখল ও আছে খ্রিস্টান সাধুদের এই আস্তানা শ্যাতোস দে লা সান্তে ভিখযে দে পেলভো মঠে।
এরপর ছোট এই ঘরে সাধুদের চিকিৎসায় দ্রুত সেরে উঠতে লাগল ও। কোনও অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়াই শুকিয়ে গেল বুলেটের ক্ষত। রানা জিজ্ঞেস করেনি কী ধরনের লতাগুল্ম ছেঁচে ওর জখমে লাগাচ্ছে তারা। প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি কথা বলে না সাধুরা। তবে তাদের সহৃদয় আচরণ দেখে রানা বুঝেছে, ওকে সেবা দিতে গিয়ে বিন্দুমাত্র বিরক্ত নয় তারা।
গত ক’দিন যান্ত্রিক সভ্যতার বিকট আওয়াজ বা মানুষের হৈ-হুল্লোড় থেকে বহু দূরে রানা। প্রশান্ত হয়ে উঠেছে মন। ভোরে শুনতে পায় পাখির মিষ্টি কূজন। আবার সন্ধের দিকে। খুব নিয়ম মেনে চলে শ্যাতোস দে লা সান্তের সাধুরা। ঠিক সময়ে বসে প্রার্থনায়। তবে একবারও তাদের সঙ্গে যোগ দিতে রানাকে আমন্ত্রণ জানায়নি তারা।
দেয়ালের কাছে ওয়ারড্রোবের ওপর রাখা বালিঘড়ি দেখল রানা। পৌনে একঘণ্টা পর ভোর হলে আবারও প্রার্থনায় বসবে সাধুরা।
সরু, শক্ত বিছানা ছেড়ে পাথুরে শীতল মেঝেতে উপুড় হয়ে শুলো রানা। শুরু হলো বুকডন। প্রথমে বিশবার, এরপর চার দফায় কয়েক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে আরও আশিবার। ব্যথা থেকে বুঝতে পারছে, পুড়ছে ট্রাইসেপ ও ডেল্টয়েড পেশির ল্যাকটিক অ্যাসিড। বুকডন শেষ করে বিশ্রাম না নিয়েই দু’পায়ের আঙুলগুলো বাধিয়ে নিল কাঠের বাঙ্কের নিচে। প্রতিবারে বিশবার করে পাঁচ দফায় দিল মোট এক শ’টা সিট আপ। আড়ষ্ট হয়েছে পেটের পেশি। উঠে চলে গেল ছোট বেডরুমের দরজার পাথুরে লিন্টেলের সামনে। হাজার বছর ধরে আছে ওটা। বোধহয় ঠেকিয়েও দেবে অ্যাব্রাম্স যুদ্ধের ট্যাঙ্কের হামলা। রানার ওজন নেয়া ওটার জন্যে কিছুই নয়। লাফ দিয়ে তাকের মত জায়গাটার কিনারা দু’হাতে ধরল রানা। দু’পা ঝুলছে শূন্যে। ভাঁজ করে নিল হাঁটু। হাতের জোরে চিবুক তুলল লিন্টেলের কাছে। কয়েক সেকেণ্ড পর নামিয়ে নিল শরীর। আবারও চিবুক নিল লিন্টেল বরাবর। পাঁচ দফায় এক শ’বার চিন আপ করার পর আস্তে করে নেমে পড়ল মেঝেতে। তরতাজা বোধ করছে।
ভোরের আগেই ওই তিন ব্যায়াম সেরে নিল আরও ছয় দফা। এটা রানার কাছে সাধনার মত। শারীরিকভাবে ফিট না হলে যে-কোনও সময়ে আসবে মৃত্যু।
মিনিট পাঁচেক বিশ্রামের পর ঢুকল ছোট্ট বাথরুমে। বেসিনে পাহাড়ি ঝর্নার শীতল জল। পরের দশ মিনিটে মুখ- হাত ধুয়ে ফিরল ঘরে। গায়ে সাধুর জোব্বা চড়িয়ে নিয়ে পেটের কাছে বাঁধল ফিতা। পায়ে বুটের বদলে হালকা চপ্পল। চুপচাপ বসে থাকল বিছানার কিনারায়।
একটু পর দিগন্তে মুখ তুলল কমলা সূর্য। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল সোনালি আলো। সময় হয়েছে বাইরে যাওয়ার। যে-কোনও সময়ে ঢং-ঢং শব্দে বাজবে ঘণ্টি। দীর্ঘ করিডোরে বেরোবে জোব্বা পরিহিত সাধুরা। নীরবে গিয়ে ঢুকবে গির্জায়। কেউ তরুণ, পিঠ টানটান, আবার কেউ বৃদ্ধ। হাতে লাঠি বা ক্রাচ। কুঁজো হয়েছেন বয়সের ভারে। গাল ভরা দাড়ি পৌচেছে নাভির কাছে। বহু বছর দুনিয়া থেকে দূরে। কারও কারও মনেও নেই শেষ কবে গেছেন কোনও শহরে বা গ্রামে আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে।
গত ক’দিন রানা ভেবেছে, এখন যে-কোনও সময়ে সাধুরা বলবে: আপনি তো সুস্থ, এবার বিদায় নিন।
সেক্ষেত্রে চলে যেতে হবে এই নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে।
কিন্তু এ বিষয়ে টু শব্দটি করেনি কর্তৃপক্ষের কেউ।
এদিকে কীভাবে ফাঁদ পেতে ধরতে হয় বনমুরগি, কীভাবে ঝর্না থেকে পাওয়া যায় পাহাড়ি মাছ, বা পাহাড়ে কোথায় ক্যাম্প করলে বিপদের ঝুঁকি কম— রানার কাছ থেকে এমন অনেক কিছু শিখতে পেরে মহাখুশি তরুণ সাধুরা। ওর নেতৃত্বে মুগ্ধ তারা। কয়েকজন বলেও ফেলেছে, ‘থাকুন না আরও কিছু দিন? আপনার কাছ থেকে শিখতে চাই আরও অনেক কিছু।
একই কথা বলেছেন দু’জন বুড়ো সাধু। রানার কারণে নতুন এক উদ্যম ফিরে পেয়েছে তরুণরা, অই তাঁরা খুশি।
অবশ্য অনাহূত অতিথির মত রয়ে যেতে রাজি নয় রানা। ওদিকে টাকা সাধলে হয়তো চরম অপমানিত বোধ করবেন সাধুরা। তাই ক’দিন হলো নিজে থেকেই মঠের দৈনন্দিন কিছু কাজ সেরে রাখছে ও। আশ্রমের গোয়ালের গরু ও খামারের ছাগলের খাবার ও পানি দেয়ার পর সংগ্রহ করে দুধ। তার খানিকটা নিজেরা খান সাধুরা, বাকিটা দিয়ে তৈরি করেন পনির ও মাখন। হেনহাউসের মুরগির ডিম কুড়িয়ে রানা দিয়ে আসে কিচেনের মোটা সাধুর হাতে। চেরাই করে চুলার জন্যে জ্বালানি কাঠ। এ ছাড়া, মেরামত করে আশ্রমের পুরনো ভাঙা সব আসবাবপত্র। কিছু সময় কাটায় একপাল বিড়ালের সঙ্গে। সেগুলোর ভয়ে এদিকে পা বাড়ায় না ছোট কোনও জন্তু। বিড়ালের খাবার দেয়ার পর চারপাশ ঘুরতে বেরোয় রানা। কখনও সঙ্গে থাকে একদল তরুণ সাধু। তাদের ভেতর রয়েছে জন পিয়েরে। তার সঙ্গে খাতির হয়েছে ওর। ছেলেটার বয়স বড়জোর আঠারো বা উনিশ। সুযোগ পেলেই চলে আসে গল্প করতে। এত সরল ছেলে আগে কখনও দেখেনি রানা। মুখে সর্বক্ষণ মিষ্টি হাসি। রানা বুঝেছে, জনের মানসিক বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দ। খুব বুদ্ধিমান না হলেও আশ্রমের জন্যে জান দিতেও দ্বিধা নেই ওর। আর সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় বলেই ওকে বিশেষ স্নেহ করে সবাই।
জন পিয়েরে ভাল প্রশিক্ষকও। রানাকে দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে দুধ দুইয়ে নিলে খেপে না গরু বা ছাগল। ছেলেটাকে একবার দমফাটানো হাসি হাসতে দেখেছে রানা। সেসময় মহা ফিচেল এক মুরগিকে খোঁয়াড়ে ভরতে চাইছিল ও। কিন্তু কিছুতেই ধরা দেবে না সুন্দরী। তাকে তাড়া করতে গিয়ে পা পিছলে মাটিতে পড়েছিল রানা। হাসতে হাসতে নিজেও মাটিতে গড়াতে থাকে জন পিয়েরে। আর ওর খিলখিল হাসি দেখে নিজেও না হেসে পারেনি রানা।
সময় পেলে পর্বতের উঁচু চূড়ার দিকে চলে যায় ও। মনটা বলে, এ আশ্রম যেন সভ্যতা থেকে বহু যোজন দূরে। অথচ মাত্র ক’মাইল গেলেই ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু শহর ব্রায়ানকন। আত্মগোপনের সময় ওখান থেকে রসদ নিয়েছে রানা। শহরের জনসংখ্যা মাত্র এগারো হাজার। তাতে কী, গত ক’দিনে ওর মনে হচ্ছে, ওই শহর আসলে অন্য গ্যালাক্সির শেষ প্রান্তের কোনও গ্রহ। ওখানে আছে রাজনীতি, চাতুরী, ঠকবাজি, দুঃখ, বঞ্চনা।
আশ্রমে নেই মনোমালিন্যের বালাই। সবাই ব্যস্ত যে যার প্রার্থনায়। তবে রানা জানে, নিশ্চিন্ত এই জীবন ওর জন্য নয়। এরই ভেতর খচ খচ করছে মন। গভীর রাতে স্বপ্নে দেখছে বাংলাদেশের নানান মায়াময় সবুজ দৃশ্য। চোখে ভাসছে প্রিয় কিছু মুখ। ঠিক করেছে, আর ক’দিন পর শহরে গিয়ে ফোন দেবে বিসিআই অফিসে। জেনে নেবে, ব্রিটিশ এজেন্টরা পিছু ছাড়ল কি না।
আজকের দিনটাও শুরু হলো বরাবরের মত।
গির্জায় গিয়ে প্রার্থনায় বসল সাধুরা।
সেসময়ে গবাদি পশুগুলোকে খাবার দিল রানা।
সাতটার সময় এল নাস্তা।
আটটায় আবারও প্রার্থনার জন্যে জড় হলো সাধুরা।
বাগানের জরুরি সব কাজ এগিয়ে রাখল রানা।
দিনে-রাতে মোট তিনবার খাবার খায় সাধুরা। অতি সাধারণ কিন্তু পুষ্টিকর সে খাবার। ঠিক সময়ে রানার দরজার তলা দিয়ে চলে আসে সেই ট্রে।
দুপুরে ঘণ্টি বাজতেই কাঠের ট্রলিতে করে যার যার ঘরে লাঞ্চ পৌঁছে দিল এক সাধু। সব্জীর তরকারী, সঙ্গে ডিম বা মাছের ডিশ। সবার দরজার তলা দিয়ে পাঠানো হয় ট্রে। অনেকটা জেলখানার মতই। তবে কারও ঘরের দরজায় তালা বা ছিটকিনি নেই। মাঝে মাঝে দুপুরে জোটে অতি সামান্য পরিমাণে ওয়াইন বা বিয়ার।
নানান কাজে বিকেল পেরোবার পর সন্ধ্যায় এল হালকা সাপার। সাতটা বাজতেই প্রার্থনায় বসল সাধুরা। একঘণ্টা পর শুয়ে পড়ার কথা, তবে ওই সময় শোয় না কার্থাসিয়ান সাধুরা। যে-যার ঘরে গিয়ে প্রার্থনায় বসে। সাড়ে এগারোটায় আবার বাজে ঘণ্টি। গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করে সাধুরা। সেটা শেষ হয় গভীর রাতে। এরপর বিছানায় যায় সবাই। তবে দুই বা তিনঘণ্টা ঘুমাবার পর নতুন করে শুরু হয় আরেকটি দিনের প্রার্থনা-কার্যক্রম। শত শত বছর ধরে এভাবেই চলছে এদের জীবন।
আশ্রমে রেডিয়ো, টিভি বা মোবাইল ফোন নেই। ধর্মীয় বই ছাড়া অন্য বইকে ভাল চোখে দেখা হয় না। কমপিউটার বা ইন্টারনেট কী, দেখেনি কেউ। এগারো শতকে কার্খাসিয়ান রীতি চালু হওয়ার পর থেকেই আজও মেনে চলেছে এরা সেই নিয়ম। সাধুদের ধারণা: সর্বক্ষণ স্থির হয়ে আছে যিশুর ক্রুশ, আর গোটা পৃথিবী ঘুরছে ওটাকে ঘিরে। যারা আশ্রমে বাস করে, তাদের মন থেকে ঝেঁটিয়ে দূর করা হয় দুনিয়ার সব মোহ।
মাসুদ রানার মনে মোহ বা লোভ আছে কি না, তা জানতে আজ গভীর রাতে ডেকে পাঠালেন প্রধান সাধু।
আগে কখনও তাঁকে দেখেনি রানা। মধ্যবয়স্ক এক সাধুর সঙ্গে প্রধান সন্ন্যাসীর কক্ষের দিকে পা বাড়াল ও। ভাবছে: এবার বোধহয় বিদায় নিতে বলবে এখান থেকে।
চার
প্রধান সাধুর ঘর অন্যদের ঘরের মতই, সাদামাটা। মানুষটির নাম অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড। বয়স নব্বুইয়ের বেশি। লোলচর্ম মুখে দীর্ঘ, পাকা দাড়ি। ধবধবে সাদা ফোলা চুলের জন্যে তাঁকে দেখাচ্ছে পুরুষ সিংহের মত।
প্রথমেই তাঁর চোখে চোখ পড়ল রানার। হাসি ও খুশিতে চিকচিক করছে দুই চোখ। দৃষ্টি থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে আশ্চর্য
পবিত্র আলো। রানা মুখোমুখি চেয়ারে বসতেই নরম ফ্রেঞ্চ ভাষায় বললেন সাধু, ‘আপনি একবারের জন্যেও আমাদের প্রার্থনায় যোগ দেননি। তবে কি আপনি নাস্তিক?’
‘আগে বলার সুযোগ হয়নি, আমি জন্মেছি মুসলিম পরিবারে,’ বলল রানা।
মাথা দোলালেন গুয়েরিন। ‘তাতে কী। যে জাতি যেভাবে ডাকুক, স্রষ্টা তো আর তাতে বদলে যান না।’ সাধু পাল্টে নিলেন প্রসঙ্গ। ‘ভাই প্যাট্রিকের কাছে শুনেছি, আপনি আগে ছিলেন মিলিটারিতে।’
‘জী।’
‘কত বছর চাকরি করেছেন?’
‘বেশ কয়েক বছর।’
সেসময়ে কি কাউকে খুন করেছেন?’
চুপ করে থাকল রানা।
‘আপনার চোখে কষ্টের ছাপ, রানা। আপনি কি মানব- হত্যার জন্যে অনুতপ্ত?’
কিছুক্ষণ ভাবার পর বলল রানা, ‘আমার তা মনে হয় না, ফাদার। কখনও নিরপরাধ কারও ক্ষতি করিনি।’
‘কিন্তু যদি একদিন নির্দেশ পান স্রষ্টার তরফ থেকে? তখন কী করবেন, রানা?’
মৃদু হাসল রানা। ‘সেটা যৌক্তিক কি না বুঝে নেব। অনেক সময় স্রষ্টার আদেশ ধরে নিয়ে চরম অন্যায় করে মানুষ অন্যের ওপর।’
মাথা দোলালেন প্রধান সাধু। ‘বর্তমানের খবর জানি না। তবে অতীতে এভাবে একে অপরের ওপর নির্যাতন করেছে মানবজাতি। যেমন বলতে পারি এগারো শতকের কথা। সেসময়েই তৈরি এই মঠ। চলছিল প্রথম ক্রুসেড। জেরুজালেম দখল করে নিরীহ হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করেছিল খ্রিস্টান সেনাবাহিনী। তা ধর্মবিশ্বাসের জন্যে নয়, খুন করেছে পাশবিক আনন্দে।’
বৃদ্ধের চোখে চেয়ে রইল রানা।
‘অতীতে ভয়াবহ পাপে জড়িত ছিল চার্চ,’ মাথা দোলালেন প্রধান সাধু, ‘স্রষ্টার নামে অকথ্য নির্যাতন করেছে নিরীহ মানুষের ওপর।’ তাঁর ঠোঁটে দুঃখের হাসি। ‘বুঝতে পারছি, এ ধরনের কথা শুনে আপনি অবাক হচ্ছেন।’
নীরবে বসে আছে রানা।
‘আমার ধারণা, বাধ্য হয়ে যাদেরকে খুন করেছেন, সুযোগ পেলে আপনাকেই খুন করত তারা। তা ছাড়া, খুন করেও আপনি তলিয়ে যাননি মানসিক পাপের গভীর জলাশয়ে। এ থেকে বুঝেছি, এমন কোনও অপরাধ করেননি, যেটার জন্যে আপনাকে শাস্তি দেবেন প্রভু।’
‘ফাদার,’ বলল রানা, ‘ভাল-মন্দ তো একেকজনের কাছে একেকরকম।’
‘তা ঠিক,’ একটু থেমে সাধু জানতে চাইলেন, ‘আপনি এখন সুস্থ। এবার কী করবেন ভাবছেন? …আচ্ছা, আপনি আবার পলাতক অপরাধী নন তো?’
‘না,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘অপেক্ষা করছি আমার দেশের কর্তৃপক্ষের নির্দেশের জন্যে। ডাক এলেই ফিরব।’
‘এখানে থাকতে চান আরও কিছু দিন?’
‘যদি আপনাদের অসুবিধে না হয়।’
যুবকের স্পষ্ট বক্তব্য ভাল লেগেছে সাধুর। নরম সুরে বললেন, ‘আমাদের সমস্যা নেই। যত দিন ইচ্ছে থাকুন।’ জোব্বার পকেট থেকে ছোট এক বোতল বের করলেন তিনি। ‘এটা নিন। যে ক’দিন আছেন, প্রতিদিন খাবেন এক চুমুক করে। তাতে অসুখ-বিসুখ দূরে থাকবে।’
বোতলটা নিল রানা। ‘ভেতরে কী, ফাদার?’
‘টনিক। নিজেই তৈরি করেছি। পাহাড়ি পানির সঙ্গে কয়েকটা সাধারণ লতার রস। এর ভেতর অ্যালকোহল নেই। ক্ষতি হবে না। আমি নিজেই বহু বছর ধরে ব্যবহার করছি।’
ছিপি খুলে বোতল নাকের কাছে নিল রানা। গন্ধ নেই তরলে। জিভে স্পর্শ করাতেই টের পেল মৃদু তেতো স্বাদ।
‘প্রতিদিন এক চুমুক খেলে ধারে-কাছে আসবে না রোগ-বালাই।’
‘ধন্যবাদ, ফাদার।’
‘গিয়ে শুয়ে পড়ুন। একটু পর প্রার্থনায় বসব আমরা।’ চেয়ার ছেড়ে দরজার দিকে যাওয়ার সময় ছায়া ভরা একটা টেবিলের ওপর দাবার বোর্ড দেখল রানা।
ওর দৃষ্টি খেয়াল করেছেন সাধু। মৃদু হাসলেন। ‘মন পরিষ্কার করতে ভাল কাজে আসে দাবা।’
রানার মনে পড়ল পিয়েরের একটা কথা। কিছু দিন আগে মারা গেছেন অতিবৃদ্ধ এক সাধু। তিনি নিয়মিত দাবা খেলতেন প্রধান সাধুর সঙ্গে। আশ্রমের আর কেউ খেলতে জানে না বলে বাধ্য হয়ে একা একাই আজকাল দাবা খেলেন অলিভিয়ের গুয়েরিন অভ গ্যাসপার্ড।
‘চার বা পাঁচ চালে জিতবে সাদা,’ বোর্ডের দিকে চেয়ে বলল রানা।
‘আপনি দাবাখেলা জানেন? গুড!’ হাসলেন প্রধান সাধু। ‘হাতে সময় পেলেই চলে আসবেন। হয়ে যাবে দু’একটা দান।’
মৃদু মাথা দুলিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলল রানা।