অপরীক্ষিত কারক
ভেবে-চিন্তে যদি না কোনো কাজ করে।
বোকা নাপিতের মতো স্বদোষেতে মরে।।
দক্ষিণ ভারতে পাটলিপুত্র নামে এক নগর ছিল। সেখানে মণিভদ্র নামে এক বণিক তা থাকত। কপালের ফেরে এক সময় তার অবস্থা পড়ে যায়। দারিদ্র্যের জ্বালা যে কি, সে হাড়ে-হাড়ে টের পায়। অপমানে-অবহেলায় সে মুষড়ে পড়ে। একদিন রাতে সে শুয়ে শুয়ে ভাবে— যার টাকা নেই তার চরিত্রের সাধুতা, ক্ষমা, ভদ্রতা, মাধুর্য, আভিজাত্য ইত্যাদি কোনো গুণেরই মূল্য নেই। টাকা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মসম্মান, গর্ব, জ্ঞান সবই লোপ পায়। অনবরত পরিবার প্রতিপালনের চিন্তায় তার বুদ্ধি লোপ পায়। ধনী আত্মীয়ের সামনে গেলেও তার চোখে পড়ে না। দারিদ্র্যের কারণে তাকে কুল-শীল-হীন ব্যক্তিরও তোষামোদ করতে হয়। কিন্তু যার টাকা আছে, তার খেদমতের অভাব হয়না। সে যা বলে, তা-ই সবাই মেনে নেয়। তার তারিফ করে। তাই দরিদ্রের এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরাই ভালো।
এরূপ ভাবতে ভাবতে মণিভদ্র এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে—এক নগ্ন সন্ন্যাসী তাকে বলছে: ওহে শ্রেষ্ঠী, তুমি হতাশ হোয়ো না। আমি তোমার পূর্বপুরুষের অর্জিত ধন পদ্মনিধি। কাল সকালে ঠিক এই রূপ ধরে আমি তোমার বাড়িতে আসব। তুমি আমার মাথায় লাঠি মেরো। তাহলে আমি তোমার বাড়িতে অক্ষয় হয়ে থাকবে। তোমার আর কোনো অভাব থাকবে না।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই মণিভদ্র ছটফট করতে লাগল। স্বপ্ন সত্যি হবে তো? তার দারিদ্র্য কাটবে তো? আবার ভাবছে—এ নিশ্চয়ই মিথ্যে। এ কখনো সত্যি হতে পারে না। সারাক্ষণ টাকা-টাকা করি তো, তাই এই উদ্ভট চিন্তা। কথায় বলে—
রোগগ্রস্ত শোকগ্রস্ত কামার্ত যে-জন।
চিন্তাগ্রস্ত করে সদা অসার চিন্তন।।
মণিভদ্র যখন এরূপ চিন্তা করছে, তখন নাপিত এসেছে ক্ষৌরকর্ম করতে। ঠিক তখনই স্বপ্নে দেখা সেই সন্ন্যাসী এসে হাজির। একেবারে যেমনটি দেখেছিল, ঠিক তেমনটি। মণিভদ্র তখন লাঠি বসিয়ে দিল তার মাথায়। অমনি সে সোনা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। মণিভদ্র সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বর্ণপিণ্ড নিয়ে গেল ঘরে।
এসব কাণ্ড নাপিতের সামনেই ঘটেছে। তাই মণিভদ্র তাকে উত্তম বকশিস দিয়ে বলল: ভাই, এ-কথা অন্য কান করো না। দরকার হয় তোমাকে আরো দেব।
নাপিত ‘আচ্ছা’ বলে বাড়ি গেল বটে, কিন্তু মন কি শান্ত হয়? চোখের সামনে দলা-দলা কাঁচা সোনা। চিরজীবনের দারিদ্র্য দূর! তাই ভাবতে লাগল: এই নগ্ন সন্ন্যাসীদের মাথায় ডাণ্ডা মারলেই বুঝি সোনা হয়ে যায়। তাহলে আমিও কাল সকালে একজনের মাথায় ডাণ্ডা মারব। আমাকে আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে কামাতে হবেনা।
এরূপ চিন্তা করতে করতে রাতটা কোনোরকমে কাটল। পরের দিন ভোরবেলা নাপিত একটা শালকাঠ জোগার করে দরজার আড়ালে রাখল। তারপর চলে গেল জৈনাশ্রমে। গিয়ে কাতর কণ্ঠে বলল: প্রভু! আজ আমার বাড়িতে একটু প্রসাদ নিতে হবে। বহু সাধনায় এ আয়োজন করেছি। অবহেলা করলে এ অধম জীবন ত্যাগ করবে। গুরু ক্ষেপে গিয়ে বললেন: তুমি কি আমায় ব্রাহ্মণ ভাবছ, যে বললেই চলে যাব? মহাবীরের শিষ্যরা নির্লোভ। তারা নিজের ইচ্ছায় বের হয়ে দৈবাৎ কারো বাড়ি গিয়ে সামান্য আহার করে। কারো কথায় চলে না। অতএব, তুমি যাও। সময় হলে একদিন উপস্থিত হব।
নাপিত করজোড়ে বলল: প্রভু! অনেক কষ্টে পুথিমোড়ার অনেক কাপড় সংগ্রহ করেছি। পুথি নকল করার ভালো দক্ষিণাও জমিয়েছি।
কাপড় আর টাকার কথা শুনে সন্ন্যাসীর মন গলে গেল। তিনি হাত উঁচিয়ে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন: তথাস্তু।
নাপিত তখন খুশিমনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল এবং শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে লাগল—
ঘর নাই জন নাই বেশে দিগম্বর।
লোভ তবু ছাড়ে না—আজব ব্যাপার।।
এরূপ বলতে বলতে নাপিত বাড়ি এল। কিন্তু মনটা ভীষণ ছটফট করছে। কখন সন্ন্যাসী আসবে। একবার ঘরে যায়। আবার বাইরে আসে। পথের দিকে উঁকি দেয়। সন্ন্যাসী এল কি-না। এভাবে ঘর-বার করছে। এক সময় দেখে সন্ন্যাসী বাইরের দরজায় হাজির। দৌড়ে গিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসে। তারপর দরজা বন্ধ করে সন্ন্যাসীর মাথায় বসিয়ে দেয় সেই শালকাঠ। মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরছে। সন্ন্যাসীর আর্ত চিৎকারে চারদিক থেকে সবাই ছুটে আসে। ততক্ষণে সন্ন্যাসী পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়। জনে-জনে ঘটনাটি পৌঁছে যায় রাজদরবারে। রাজার লোক এসে নাপিতকে ধরে নিয়ে যায়। বিচারক এ খুনের কারণ জানতে চাইলে সে মণিভদ্রের কথা বলে। রাজার লোক তাকেও ধরে নিয়ে যায়। মণিভদ্র সমস্ত ঘটনা খুলে বললে বিচারক তাকে মুক্তি দেন। কিন্তু নাপিতের শূলারোহণে মৃত্যু হয়। বিচারক তখন বলেন—
অগ্র-পশ্চাৎ না ভাবিয়া করিও না কিছু।
বিপদ রয়েছে সদা তব পিছু পিছু।।
আসল না জানিয়া ঐ ক্রোধে অচেতন।
পুত্রতুল্য বেঁজি মারে বোকা ব্রাহ্মণ॥
মণিভদ্র ঔৎসুক্যের সঙ্গে বলল: কি হয়েছিল ব্যাপারটা?
বিচারক: শোনো বলছি …
ব্রাহ্মণ ও বেঁজি
এক গাঁয়ে থাকতেন এক ব্রাহ্মণ। তাঁর স্ত্রী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেন। একই দিন পোষা বেঁজিটিও একটি সন্তান প্রসব করে। কিন্তু প্রসবের পরপরই মা-বেঁজিটি মারা যায়। সেই থেকে ব্রাহ্মণী আপন স্তন্যদানে শিশু বেঁজিটিকে নিজের ছেলের মতোই বড় করে তোলেন। কিন্তু মায়ের মন সদাই সন্তান-কাতর। সন্তানের অহেতুক অমঙ্গল চিন্তা সর্বদাই তার মনে বাসা বাঁধে। তাছাড়া সন্তান যেমনই হোক, মায়ের কাছে সে অমূল্যরতন। তাইতো শাস্ত্র বলছে—
উদ্ধত কুৎসিত মূর্খ মদ্যপ ও খল
এমন পুত্রও হয় হৃদয়-নন্দন।
লোকে বলে চন্দন না-কি সুশীতল
তার চেয়েও বড় পুত্র-গাত্র-পরশন।।
পিতা ভ্রাতা বন্ধু নহে কেহ তথা।
আপনার পুত্রধন প্রিয় হয় যথা।।
তাই ব্রাহ্মণী বেঁজিটিকে মনে-মনে অবিশ্বাস করতেন। কি জানি কখন তার পুত্রের ক্ষতি করে বসে।
একদিন ব্রাহ্মণী যাবেন নদীর ঘাটে জল আনতে। ব্রাহ্মণকে ডেকে বললেন: ছেলেটাকে দেখ, যেন বেঁজিটা কিছু না করে।
এই বলে তিনি নদীর ঘাটে চলে গেলেন। এমনি সময় জমিদার বাড়ি থেকে ডাক এল। জদিমার-গিন্নির ব্রতানুষ্ঠান। পৌরোহিত্য করতে হবে। লোভনীয় দক্ষিণা আছে। দেরি করলে অন্যের হাতে চলে যাবে।
কিন্তু ব্রাহ্মণীর এত দেরি হচ্ছে কেন? অন্যদিন তো হয় না। আজ কি হলো? সময়মতো না গেলে সুযোগটা যে হাতছাড়া হয়ে যাবে! ব্রাহ্মণ কেবলি ছটফট করছেন। তারপর এক সময় বেঁজিটাকে ছেলের পাহারায় রেখে তিনি চলে গেলেন জমিদার বাড়ি। ফিরে এলে বহির্দ্বারে তাঁর খড়মের শব্দ শুনে বেঁজিটা আনন্দে ছুটে গিয়ে তাঁর পায়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তার মুখে-নখে রক্ত দেখে ব্রাহ্মণ ভাবলেন—এ নিশ্চয়ই তাঁর ছেলেকে খেয়ে ফেলেছে। অন্য কিছু না ভেবে হাতের লাঠির আঘাতে বেঁজিটাকে মেরে ফেললেন। তারপর অন্দরে ঢুকে দেখেন অন্য দৃশ্য। ব্রাহ্মণী ছেলেকে কোলে নিয়ে স্তন্য দান করছেন। আর অদূরে একটা কেউটে দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়ে আছে। আসলে কেউটেটা ঘরে ঢুকে যখন শিশুটির দিকে যাচ্ছিল, তখন বেঁজি তাকে মেরে ফেলে। সাপের রক্তই তার মুখে-নখে লেগে ছিল। এই খুশির খবর দিতে গিয়েই অবিবেচক ব্রাহ্মণের হাতে তাকে প্রাণ দিতে হলো। এ ঘটনা শুনে ব্রাহ্মণী বুক চাপড়ে পুত্রশোকবৎ বিলাপ করতে লাগলেন। যাকে তিনি অবিশ্বাস করতেন, সেই বেঁজিই তার পুত্রকে রক্ষা করেছে। অথচ লোভী ব্রাহ্মণের অবিবেচনায় তাকেই প্রাণ দিতে হয়েছে। ব্রাহ্মণী তখন স্বামীর উদ্দেশে বলতে লাগলেন: লোভী কোথাকার! লোভের বশে তুমি আমার কথা শোনোনি। এখন পুত্রশোকের জ্বালায় পুড়ে মর। সাধে কি আর বলেছে—
লোভ ভালো কিন্তু অতিলোভ ভালো নয়।
অতিলোভে চারবন্ধুর একজনকে ছাড়তে হয়।।
ব্রাহ্মণ: তার মানে?
ব্রাহ্মণী: মানে এই …
চারবন্ধু
এক গাঁয়ে থাকত চার যুবক—তাম্রসিদ্ধি, রৌপ্যসিদ্ধি, সুবর্ণসিদ্ধি ও চক্রধর। তারা চার বন্ধু। সবার মধ্যেই অন্তরঙ্গ ভাব। প্রথম তিনজনের বিদ্যে কম, বুদ্ধি বেশি। শেষের জনের বিদ্যে বেশি, বুদ্ধি কম। তবে চারজনেরই অর্থাভাব। তাই একদিন তারা মিলিত হয়ে বলাবলি করছে: ধিক্ এই দারিদ্র্যকে! অর্থ না থাকলে আত্মীয় আত্মীয় নয়। বন্ধু বন্ধু নয়। স্ত্রী স্ত্রী নয়। পুত্র পুত্র নয়। সমাজে কেউ দাম দেয় না। অর্থ থাকলে মানুষ এক রকম। না থাকলে অন্য রকম। অর্থহীন জীবনের সার্থকতা কি? তাই অর্থ চাই। এর জন্য প্রয়োজ। হলে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, এমন কি দেশ ছেড়েও চলে যেতে হবে। এটা শাস্ত্রের কথা।
এরূপ সিদ্ধান্ত করে একদিন তারা অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিল। যেতে যেতে তারা পৌঁছল অবন্তীতে। সেখানে সিপ্রার জলে স্নান করল। তারপর মহাকালের মন্দিরে প্রণাম করে বেরিয়ে আসছে। এমন সময় দেখে এক যোগী। নাম ভৈরবানন্দ। তাঁকে যথাবিধি সম্মান দেখিয়ে গেল তাঁর মঠে। যোগী তাদের উদ্দেশ্য জানতে চাইলে তারা বলল: আমরা সিদ্ধিযাত্রী। আমাদের সিদ্ধি হলো ধনলাভ। এ অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না। হে যোগীবর’ পণ্ডিতেরা বলেন দৈববলে হয়তো আকাশ থেকে জল পাওয়া যায়, কিন্তু পৌরুষবলে মাটি খুঁড়লেও জল মেলে। পৌরুষবলে সমুদ্র মন্থন করেই নারায়ণ লক্ষ্মী লাভ করেছিলেন। আবার বছরে চারটি মাস অলসভাবে জলে শুয়ে থাকেন বলেই বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী হন চঞ্চলা। কাজেই পৌরুষ এবং শ্রম এ দুটির সমন্বয় ঘটলে সিদ্ধিলাভ অসম্ভব নয়। আমরা এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই বের হয়েছি। এবার আপনি আমাদের পথের নিশানা বলুন, যাতে আমরা সফল হতে পারি।
যোগী তাদের কথা শুনে মুগ্ধ হলেন। তিনি যোগবলে চারটি সিদ্ধিবর্তিকা তৈরি করে চারজনের হাতে দিয়ে বললেন: তোমরা হিমালয়ের দিকে রওনা হও। যেখানে এ বর্তিকা পড়ে যাবে, সেখানেই মাটি খুঁড়লে ধন পাবে। তা নিয়ে ফিরে এস।
চারবন্ধু হাতে বর্তিকা নিয়ে চলতে লাগল। একদিনের পথ যেতেই একজনের হাত থেকে বর্তিকা পড়ে গেল। সে মাটি খুঁড়ে দেখল শুধু তামা আর তামা। বন্ধুদের বলল : চল, আমরা যত পারি তামা নিয়ে ফিরে যাই।
বন্ধুরা বলল: বোকা কোথাকার! সারা জীবন তামা বেচলেও দারিদ্র্য ঘুচবে না। চল, সামনে যাই।
সে বলল: তোরা যা। আমি তামা নিয়ে ফিরে যাব। মঠে তোদের জন্য অপেক্ষা করব। এই বলে সে ব্যাগভর্তি তামা নিয়ে ফিরে এল। আর বাকি তিনজন এগিয়ে চলল। কিছুদূর যাওয়ার পর দ্বিতীয়জনের বর্তিকা পড়ে গেল। সে মাটি খুঁড়ে পেল অনন্ত রূপার ভাণ্ডার। যত পারে সে রূপা নিয়ে ফিরে এল মঠে। কিন্তু বাকি দুজন এগিয়ে চলল। কিছুদূর যাওয়ার পর তৃতীয়জনের বর্তিকা পড়ে গেল। সে মাটি খুঁড়ে পেল সোনার ভাণ্ডার। তখন সে চতুর্থজনকে বলল: বন্ধু, আর গিয়ে কাজ নেই। চল, যত পারি সোনা নিয়ে ফিরে যাই। তাতেই আমাদের সারাজীবন চলে যাবে।
চতুর্থজন বলল: আরে বুদ্ধ! প্রথমে তামা, তারপর রূপা, তারপর সোনা। নিশ্চয়ই সামনে হীরা আছে। এক টুকরা হীরার দাম দশ বস্তা সোনার চেয়েও বেশি। এর একটা পেলেও সাতপুরুষ চলে যাবে। আর সোনার যে ওজন! ও বইবি কি করে? কাজেই চল আমরা এগিয়ে যাই।
তৃতীয়জন বলল: আমার হীরায় কাজ নেই। তুই গেলে যা। তোর জন্য মঠে অপেক্ষা করব।
এই বলে সে ব্যাগভর্তি সোনা নিয়ে সে ফিরে এল। চতুর্থজন বর্তিকাহাতে এগিয়ে চলল।
কিছুদূর গিয়ে সে একটা ভয়ঙ্কর জায়গায় উপস্থিত হলো। সূর্যের তাপে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পাগলের মতো সে ছটফট করতে লাগল। হঠাৎ দেখল—একটা লোকের গা বেয়ে রক্ত ঝরছে। মাথার ওপর একটা চক্র ঘুরছে। দৌড়ে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল: ভাই, তোমার এ-দশা কেন?
অমনি চক্রটা তার মাথায় এসে ঘুরতে লাগল। সে ভয় ও বিস্ময়ের সঙ্গে বলল: ভাই! এ কি হলো? চক্রটা আমার মাথায় এল কেন?
লোকটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল: তা জানিনে। তবে আমার মাথায়ও এমনিভাবেই এসেছিল।
যুবক কম্পিত কণ্ঠে বলল: বড্ড লাগছে! এটা কবে নামবে, ভাই?
লোকটি: তোমার মতো এরকম আর কেউ বর্তিকাহাতে এখানে এলে এবং তোমার সঙ্গে কথা বললে তবেই চক্র নেমে তার মাথায় যাবে।
যুবক: তুমি কতদিন এভাবে ছিলে?
লোকটি: এখন ভারতবর্ষের রাজা কে?
যুবক: বৎসরাজ।
লোকটি: রাম যখন রাজা ছিলেন তখন দারিদ্র্যপীড়িত হয়ে সিদ্ধবর্তিকা হাতে নিয়ে আমি এখানে এসেছিলাম। তোমার মতোই আরেকজনকে এ অবস্থায় দেখে আমি ঘটনা জানতে চেয়েছিলাম। অমনি আমারও এই দশা হয়েছিল।
যুবক: এ অবস্থায় তুমি অন্ন-জল কোথায় পেতে?
লোকটি: দেখ, এখানে যে আসে, তার আর অন্ন-জলের প্রয়োজন হয় না। কারণ, ধনপতি কুবের তাঁর ধন রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এজন্য কেউ এখানে আসে না। আর এসে পড়লেও তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা বোধ থাকে না। শুধুই কষ্ট ভোগ করা। আমি এখন মুক্ত। অনুমতি কর, আমি বাড়ি ফিরে যাই।
এই বলে লোকটি চলে গেল। আর চক্রধর দিনের পর দিন সেই যক্ষপুরীতে পড়ে রইল।
এদিকে দীর্ঘদিন হয়ে যায়। বন্ধু ফিরে না আসায় অন্য তিনজন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। একদিন তারা বন্ধুর খোঁজে সেই পথে অগ্রসর হলো। সেই যক্ষপুরীতে পৌঁছে তাকে ঐ অবস্থায় দেখে সুবর্ণসিদ্ধি জিজ্ঞেস করল: এ কি করে হলো?
চক্রধর সব খুলে বলল। তখন সুবর্ণসিদ্ধি তাকে ভর্ৎসনা করে বলল: তোকে এত বারণ করলাম, শুনলি না। এজন্যই শাস্ত্র বলে—
বিদ্যা ভালো বুদ্ধি ভালো, তারপরেও
বুদ্ধি বিদ্যার সেরা।
বুদ্ধি বিনে বিদ্বান মরে—যেমন মরল
সিংহ-কারকেরা॥
চক্রধর: কিরকম?
সুবর্ণসিদ্ধি: এরকম…
চারবন্ধু ও মৃতসঞ্জীবনী
এক গাঁয়ে থাকত চার যুবক। প্রত্যেকের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব। এক্কেবারে হরিহর আত্মা। প্রথম তিনজন বিদ্বান। বুদ্ধিতে কাঁচা। চতুর্থজন বিদ্যায় অশ্বডিম্ব। বুদ্ধিতে চাণক্য। একদিন তারা পরামর্শ করল: বিদ্যা যদি কাজে না-ই লাগল, তবে তাতে কাজ কি? সিদ্ধান্ত হলো—পুবদেশে যাবে বিদ্যা খাটিয়ে অর্থোপার্জনের জন্য। দিন-ক্ষণ দেখে তারা যাত্রা করল। কিছুদূর গিয়ে প্রথমজন বলল: দেখো, বিদেশে বিদ্যা না থাকলে ভাত জোটেনা। কথায় বলে—স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে। সুবুদ্ধির তো বিদ্যে নেই। তাই ও বাড়ি ফিরে যাক।
দ্বিতীয়: তা-ই ঠিক। আমরা বিদ্যা খরচ করে টাকা রোজগার করব, আর ও তার ভাগ নেবে। এ হয় না। ভাই সুবুদ্ধি! তুই বরং বাড়ি ফিরে যা।
তৃতীয়জন অনুকম্পার সঙ্গে বলল: আহা! ওভাবে বলছ কেন? আমরা ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলেছি। বড় হয়েছি। এখন এতদূরে এসে ওকে বিদায় দেব? আমাদের বিদ্যা আছে, ওর বুদ্ধি আছে। চারজনের বিদ্যা আর বুদ্ধি মিলিয়ে যা আয় করব, চারজনে ভাগ করে নেব। দেখো—
এটা মোর ওটা ওর—এইভাবে যে ভাবে
ছোট মন তার।
উদার-চরিত যে—গোটা বিশ্ব তাঁর কাছে
নিজ পরিবার।।
কাজেই, ও আমাদের সঙ্গেই চলুক।
এবারে আর কেউ অমত করেনা। চারজনেই প্রফুল্ল মনে পথ চলতে থাকে।
একদিন তারা গভীর বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখে এক বিশাল জন্তুর হাড়গোড় পড়ে আছে। তা দেখে প্রথমজন বলল: শেখা-বিদ্যার পরখ না হলে তার ধার বোঝা যায়না। কাজেই বিদ্যাবলে আমরা একে বাঁচিয়ে তুলব।
দ্বিতীয় ও তৃতীয়জন সানন্দে সায় দিল। প্রথমজন হাড়গুলো জোড়া দিল। দ্বিতীয়জন মন্ত্রবলে রক্ত, মাংস ও চামড়া জুড়ে দিল। তৃতীয়জন মহানন্দে প্রাণ দিতে যাবে, এমন সময় চতুর্থ সুবুদ্ধি বলল: দাঁড়াও, দাঁড়াও! এ তো দেখছি একটা সিংহ হতে যাচ্ছে! প্ৰাণ পেলে এ তো সবাইকে খেয়ে ফেলবে! তাই আগে ভাব, প্রাণ দেবে কি-না! কিন্তু তৃতীয়জনের আর তর সইছিল না। অর্জিত বিদ্যার ফল চাক্ষুষ দেখার আনন্দে ভাববার আর সময় কোথায়? তাই সে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। তখন সুবুদ্ধি বলল: প্রাণ যদি দেবেই তবে একটু দাঁড়াও। আমি আগে গাছে উঠে নেই।
এই বলে সুবুদ্ধি গাছে উঠে গেল। আর প্রাণ পেয়ে সিংহটা তিনজনকেই খেয়ে ফেলল। কাজেই বুদ্ধিহীন বিদ্যার কোনো মূল্য নেই। তাই শাস্ত্র বলছে—
বিচারহীন শাস্ত্রপাশ, পায় কেবল উপহাস।
চক্রধর সাগ্রহে জানতে চাইল: কি রকম?
সুবর্ণসিদ্ধি: শোনো, বলছি …
চার মূর্খপণ্ডিত
এক নগরে ছিল চার ব্রাহ্মণ যুবক। পরস্পর বন্ধু। বাল্যকালেই তাদের মনে হয়েছিল, বিদ্যে শিখতে হলে বিদেশ যেতে হবে। তাই যৌবনে তারা ঠিক করল কান্যকুব্জে যাবে। একদিন চলেও গেল। সেখানে এক বিদ্যামঠে থেকে পড়াশোনা শুরু করল। একে একে বারোটি বছর কেটে গেল। তারা এখন সর্ববিদ্যায় দিগ্গজ। একদিন বলাবলি করছিল: আমাদের বিদ্যার্জন তো শেষ। এবার গুরুদেবের কাছে বিদায় নিয়ে চলো দেশে ফিরে যাই।
এ-কথায় কারো দ্বিমত নেই। তাই গুরুদেবের অনুমতি নিয়ে তারা দেশের উদ্দেশে রওনা দিল। সঙ্গে সমস্ত পুথি-পত্তর। কিছুদূর যেতেই দেখে দুটি পথ দুদিকে চলে গেছে। তারা বিপদে পড়ে গেল। কোন পথে যাবে? অগত্যা তারা দুই রাস্তার সংযোগস্থলে বসে পড়ল।
ঠিক সেই সময় ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল একদল শবযাত্রী। দাহ করতে। তখন চারজনের একজন পুথি দেখে বলল: মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা—মহাজন (মহৎ ব্যক্তি) যে—পথে যান, সেটাই উত্তম পথ। তাই মহাজনের (অপর অর্থ অনেক লোক) পথ ধরেই আমরা চলো যাই।
চার পণ্ডিত তা-ই করল। শবযাত্রীদের পেছনে পেছনে শ্মশানে গিয়ে উপস্থিত হলো। সেখানে দেখতে পেল একটি গাধা। তখন দ্বিতীয় পণ্ডিত পুথি খুলে একটি চাণক্য-বচন উদ্ধৃত করে বলল: আনন্দে, বিপদে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে যাকে কাছে পাওয়া যায়, সে-ই পরম বন্ধু। তাহলে এ-ও তো আমাদের বন্ধু। এর যত্ন নেয়া উচিত।
তখন চারজনে মিলে গাধাটার যত্ন নিতে শুরু করল। কেউ গলায় হাত বুলিয়ে দিল। কেউ পা ধুইয়ে দিল। ইত্যাদি।
হঠাৎ কিছু দূরে দেখে একটা উট। সেদিকে তাকিয়ে তারা বলল: ওটা কি? তৃতীয়জন অমনি পুথি খুলে বলল: ধর্মের গতি ত্বরিত। উট দ্রুত চলে। তাই এ ধর্ম বৈ আর কিছু নয়।
তখন চতুর্থজন পুথি খুলে বলল: ধর্মের উদ্দেশে প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করা পুণ্যের কাজ।
এ শাস্ত্রবাক্য শুনে সকলে মিলে গাধাটাকে উটের গলায় বেঁধে দিল। ঠিক এমনি সময় গাধার মালিক ধোপা এসে উপস্থিত। সে ভাবল, এরা বুঝি তার গাধাটাকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। অমনি। কাপড়কাচা লাঠি নিয়ে দৌড়ে এল। তা দেখে পণ্ডিতরা দ্রুত পালিয়ে গেল।
যেতে-যেতে পথে পড়ল একটা নদী। তীব্র স্রোত। পার হবে কি করে? হঠাৎ দেখে একটা পলাশ তা ভেসে আসছে। তখন এক পণ্ডিত শাস্ত্র দেখে বলল: যে-পত্র ভেসে আসবে সে আমাদের পার করবে। পত্র শব্দের একটি অর্থ নৌকা। কিন্তু পণ্ডিত তা না জেনে পাতা মনে করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে তলিয়ে যেতে দেখে দ্বিতীয়জন তার চুলের মুঠি ধরে বলল—
সব যখন যেতে বসে প্রাজ্ঞ তখন
যেটুকু পায় সেটুকুই ধরে।
সমূলে বিনাশ কি কেউ চোখে দেখে
নীরবে আর সহ্য করে।।
এই বলে ক্যাচাং করে তার মুণ্ডটা কেটে নিয়ে এল। এরপর তারা তিনজন হাটতে—হাটতে এক গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলো। গ্রামের লোকেরা তাদের নিমন্ত্রণ করে পৃথক পৃথক বাড়িতে রাখল। একজনকে খেতে দিল ঘি-চিনি মেশানো সেমাই। সে পুথি দেখে বলল, দীর্ঘসূত্রবৎ খাবার দোষণীয়। তাই সে খাবার থেকে উঠে গেল।
দ্বিতীয়জনকে খেতে দিল মণ্ডা জাতীয় সুমিষ্ট খাবার। সে পুথি খুলে দেখল মিষ্টি স্বাস্থ্যহানীর কারণ। মিষ্টি খেলে কুকুরের লোম উঠে যায়। তাই সে খাবার থেকে উঠে গেল।
তৃতীয়জনকে খেতে দিল চাল ও মাষকলাইয়ের তৈরি বটিকা। এর গায়ে অনেক ছিদ্র থাকে। পণ্ডিত পুথি বের করে দেখে ছিদ্রযুক্ত খাবার খেলে বিপদ বাড়ে। তাই তার আর খাওয়া হলোনা। এভাবে তিন পণ্ডিতেরই না খেয়ে গলা কয়ে কাঠ। অভুক্ত অবস্থায়ই তারা লোক হাসিয়ে বিদায় নিল ।
সুবর্ণসিদ্ধি এবার চক্রধরকে বলল: তুমিও এই পণ্ডিতদের মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন। আমার মানা সত্ত্বেও তুমি থামলে না। তাই তো এই দশা হলো। তাই বলছিলুম কেবল শাস্ত্রপাশ করলেই হয়না, বুদ্ধি-বিবেচনাও থাকা দরকার।
চক্রধর এর প্রতিবাদ করে বলল: তা নয়, বন্ধু; দৈবের মারে অনেক বুদ্ধিমানও মরে, আবার মূর্খেরাও এক বাড়িতে সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকে। রাখে কেষ্ট মারে কে? মারে কেষ্ট রাখে কে? তাই তো লোকে বলে—
শতবুদ্ধি ঐ যে মাথায় সহস্রবুদ্ধি ঝোলে।
একবুদ্ধি খেলছে দেখো টলটলে জলে।।
সুবর্ণসিদ্ধি: বলো তো ব্যাপারটা কি?
চক্রধর: আচ্ছা, শোনো …
শতবুদ্ধি সহস্রবুদ্ধি ও একবুদ্ধি
এক জলাশয়ে থাকত দুটি মাছ। শতবুদ্ধি ও সহস্রবুদ্ধি। পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেখানে একবুদ্ধি নামে একটি ব্যাঙও থাকত।
একদিন শতবুদ্ধি ও সহস্রবুদ্ধির সঙ্গে একবুদ্ধির বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সেই থেকে তিনজন জলের কিনারে এসে রোজ অড্ডা দিত। কত গল্পগুজব করত। মহানন্দে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার যার-যার ঘরে ফিরে যেত।
একদিন বিকেল বেলা তারা বসে গল্প করছে। এমন সময় দুজন জেলে মাছ ধরে পথ ধরে ফিরছিল। সূর্য তখন পাটে বসেছে। তারা বলাবলি করছিল: এই ঝিলটায় বেশ মাছ আছে। কাল সকালে এসে ধরে নিয়ে যাব।
জেলেদের কথা শুনে মাছেদের মুখ গেল শুকিয়ে। তখন ব্যাঙ বলল: জেলেদের কথা তো শুনলে। এখন কি করবে? পালাবে? না-কি এখানেই থাকবে? জলদি সিদ্ধান্ত নাও। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সহস্রবুদ্ধি হেসে বলল: বন্ধু, এত সহজেই ভয় পেলে কি চলে? কেবল কথা শুনেই বাপ-পিতামো’র এই আবাস ছেড়ে চলে যাব? তা হয়না। দেখ, শকুনের ইচ্ছায় যদি গরু মরত, তাহলে পৃথবীতে আর গরু থাকত না। দেখো না, ওদের হয়তো আসাই হবে না। আর এলেও বুদ্ধির জোরে আমি তোমায় বাঁচাব। জলে কতরকম চলতে জানি। তার ফলে নিজেকেও বাঁচাব।
একথা শুনে শতবুদ্ধি সহস্রবুদ্ধির প্রশংসা করে বলল: তুমি ঠিকই বলেছ। তোমার নামের সার্থকতা আছে। সাধে কি আর বলছে—
বুদ্ধিমানের বুদ্ধির কাছে সবই হয় ধ্বংস।
চাণক্যের বুদ্ধিবলে হত নন্দবংশ।।
দেখো, সুরক্ষিত দুর্গে যেখানে বায়ু, এমনকি সূর্যকিরণও প্রবেশ করতে পারেনা, বুদ্ধিমানের বুদ্ধি সেখানে অনায়াসে ঢুকতে পারে। অতএব শুধু কথা শুনে জন্মভূমি ত্যাগ করা চলে না। জন্মভূমি যতই খারাপ হোক, অপ্সরাপূর্ণ স্বর্গের চেয়েও সেখানে সুখ বেশি। কাজেই, বন্ধু, তোমায় কোথাও যেতে হবেনা। আমরা তোমায় রক্ষা করব।
কিন্তু ব্যাঙ বলল: তা যতই বলো ভাই, তোমাদের মতো আমার অত বুদ্ধি নেই। আমার একটিমাত্রই বুদ্ধি। সে বলছে— পালাও। সুতরাং আমি আমার বৌকে নিয়ে আজই অন্য জলাশয়ে চলে যাব।
এই বলে ব্যাঙ কিয়দ্দূরের এক জলাশয়ে চলে গেল।
এদিকে পরের দিন সকাল বেলা জেলেরা জাল দিয়ে ঐ ঝিলের সমস্ত মাছ, কাকড়া, ব্যাঙ ধরে নিয়ে গেল। শতবুদ্ধি ও সহস্রবুদ্ধি অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা পেল না। পরিবারসহ ধরা পড়ল। জেলেরা তাদের নিয়ে দূরের সেই টলটলে ঝিলের পাড় দিয়ে যাচ্ছিল। অনেক ভারী হওয়ায় শতবুদ্ধিকে মাথায় এবং সহস্রবুদ্ধিকে ঝোলায় করে নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে একবুদ্ধি ব্যাঙ তার স্ত্রীকে বলছিল—
শতবুদ্ধি ঐ যে মাথায় সহস্রবুদ্ধি ঝোলে।
একবুদ্ধি খেলছি আমি টলটলে জলে।।
তাই শুধু বুদ্ধির ওপর নির্ভর করলেই চলে না। বিদ্যারও দরকার আছে।
সুবর্ণসিদ্ধি: তা তো বুঝলুম। কিন্তু বন্ধুর কথাও তো শোনা উচিত। আমি বারণ করা সত্ত্বেও তুমি অতিলোভে আর বিদ্যার অহঙ্কারে সামনে এগোলে। তাই তো পণ্ডিতরা বলেন—
বন্ধুর কথা শোনে না যে মরণ তাহার ঠেকায় কে।
নিষেধ সত্ত্বেও মরল গাধা আপন মনে গান গেয়ে।।
চক্রধর: সে আবার কি?
সুবর্ণসিদ্ধি: শোনো তাহলে …।
গাধার গান
এক ধোপার ছিল এক গাধা। নাম উদ্ধত। যেমন স্বভাব, তেমন নাম। সারাদিন মোট বইত। রাত্রিবেলা ইচ্ছেমতো চরে বেড়াত। ভোরবেলা কেউ দেখার আগে ফিরে আসত। ধোপাও তাকে বেঁধে ফেলত।
এক রাতে ঘুরতে ঘুরতে এক শেয়ালের সঙ্গে দেখা। দুদিনেই ভাব হয়ে গেল। গভীর। সেই থেকে রোজ কাঁকুর ক্ষেতে ঢুকে দুজনে ইচ্ছেমতো কাকুর খেত। তারপর যে যার বাড়ি চলে যেত।
একদিন জোছনা রাতে গাধার মনে খুব রং ধরেছে। সে শেয়ালকে বলল: ভাগনে, দেখো, চাঁদটা কি গোল! দুধের মতো আলো ছড়াচ্ছে! আমার না গান গাইতে ইচ্ছে করছে! তা কোন রাগে গাই, বলতো?
শেয়াল নিরুৎসাহভরে বলল: মামা, শুধু-শুধু কেন বিপদ ডেকে আনছ? আমরা চুরি করে কাঁকুর খাচ্ছি। তুমি জাননা—চোর আর অবৈধ প্রেমিককে সব সময় ঘাপটি মেরে থাকতে হয়? শাস্ত্রও তো বলেছে: ঘুমকাতুরে আর কাশিরোগী চুরি ছাড়বে, আর রোগী যদি বাঁচতে চায় তাহলে হ্যাংলাপনা ছাড়বে। তাছাড়া তোমার যা গানের গলা! তার চেয়ে ফাটা বাঁশও ভালো। কাজেই পাহারাদারদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে মরণ ডেকে এনো না। তার চেয়ে পেট ভরে কাঁকুর খাও।
গাধা একটু চটে গিয়ে বলল: গানের তুমি বোঝ কি? জংলা কোথাকার! এই জোছনা রাতে কার না গান গাইতে ইচ্ছে করে? তুমি শোনো, আমি গাই—
শরতের এই জোছনা-বানে ভেসে গেছে আঁধার কোথা।
বঁধু আমার নেই কো কাছে—তাইতো বুকে বাজে ব্যথা।।
শেয়াল হাসি চেপে বলল: মামা, এতো গান নয়, শুধু চেঁচানো। গাধা রেগে বলল: কি! আমি গান জানিনা? তবে শোনো—গানের সপ্ত স্বর, তিন গ্ৰাম, একুশ মূর্ছনা, উনপঞ্চাশ তান, তিন বিরাম স্থান, ছত্রিশ রাগ, ছয় আস্য, নয় রস, চল্লিশ ভাব এবং একশ পঁচাশি বিভাগ। সঙ্গীতের চেয়ে প্রিয়তর আর কিছু আছে? দেবতারাও এর ভক্ত। আর তুমি কি-না সেই সঙ্গীতকে অবমাননা করছ?
শেয়াল তখন হার মেনে বলল: মামা, তাহলে এক কাজ করি। আমি বেড়ার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখি পাহারাদার আসছে কি-না। তুমি ইচ্ছেমতো গাও।
গাধা তখন মনের সুখে গান ধরল। তার হ্যাকো হ্যাকো শব্দ শুনে পাহারাদার ছুটে এসে বেদম পেটাল। মাইরের চোটে গাধা বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। পাহারাদার ভাবল—মরে গেছে। তাই সে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পড়ে গাধা হুঁশ পেয়ে বেড়া ভেঙ্গে দিল দৌড়। দূর থেকে শেয়াল বলল: এ-জাতের স্বভাবই এই। নিজেও বোঝেনা, বোঝালেও বোঝেনা। তাইতো মার খায়, আবার মুহূর্তে সব ভুলে যায়। সুবর্ণসিদ্ধি এবার চক্রধরের উদ্দেশে বলল: তুমিও আমার কথা না শুনে কি বিপদটাই না ঘটালে। সাধে কি আর পণ্ডিতেরা বলেছেন—
নিজেও বোঝেনা বোঝালেও বোঝেনা
এমন যে-জন হয়।
তাঁতি মন্থরকের মতো আপনার দোষে
মরণ তার নিশ্চয়।।
চক্রধর: কি রকম?
সুবর্ণসিদ্ধি: শোনো…
তাঁতি মন্থরক
এক গায়ে থাকত এক তাঁতি। নাম মন্থরক। কাজের গতি মন্থর তো। তাই এ নাম। একদিন কাপড় বুনতে গিয়ে তার তাঁত গেল ভেঙ্গে। সে কুড়ুল নিয়ে বের হলো কাঠের সন্ধানে। হাটতে হাটতে একেবারে সমুদ্রের ধারে চলে গেল। সেখানে দেখে এক বিশাল সিসু গাছ। ভাবে, এটা কাটলে অনেক কাঠ পাওয়া যাবে। এই ভেবে সে যেই কুডুল উঁচালো, অমনি এক যক্ষ বলে উঠল: ভাই, শোনো! যুগ-যুগ ধরে আমি এ-গাছে আছি। সমুদ্রের ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা হাওয়ায় আমার গা জুড়িয়ে যায়। তুমি এটার বদলে অন্য কোনোটা নাও।
যক্ষের অনুরোধ শুনে তাঁতির মন গলে গেল। সে অন্য গাছের সন্ধানে যেতে লাগলে যক্ষ বলল: ভাই, আমি তোমার ব্যবহারে তুষ্ট হয়েছি। তুমি যে-কোনো একটা বর চাও।
তাঁতি খুশি হয়ে বলল: ঠিক আছে। আমি বাড়ি গিয়ে বন্ধু আর বৌকে জিজ্ঞেস করে আসি। তারপর তোমাকে বলব।
যক্ষ: বেশ, তাই হোক।
তাঁতি তখন আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। গাঁয়ে ঢোকার মুখে দেখা হলো বন্ধু নাপিতের সঙ্গে। তাকে সে যক্ষের ঘটনা বলে জিজ্ঞেস করল: বন্ধু, বলো তো কি চাওয়া উচিত?
নাপিত: আর কি? রাজ্য। তুমি হবে রাজা, আমি হবো মন্ত্রী। দুজনে মিলে ইহলোকেও সুখ ভোগ করব। পরলোকেও করব। শাস্ত্রে আছে না ন্যায়পরায়ণ রাজা ইহলোকে সৎকর্ম করে যে পুণ্য অর্জন করে, তার বলে স্বর্গে গিয়ে সে দেবতার পাশে বসে। তাঁতি: তা ঠিক। কিন্তু গিন্নিকেও একটু জিজ্ঞেস করা দরকার।
নাপিত মুখ বাঁকা করে বলল: এর মধ্যে আবার মেয়েলোক কেন, ভাই? ওদের কি কোনো বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে? ভাত-কাপড় আর গয়না-টয়না পেলেই ওরা খুশি। রাজ্যের ওরা কি বুঝবে? বুদ্ধিমানেরা কখনো মেয়েলোকের সঙ্গে এসব মন্ত্রণা করেনা। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য বলেছেন না—যে-বাড়িতে নারী, জুয়াড়ি কিংবা বালক হুকুম চালায়, সে-বাড়ি উচ্ছন্নে যায়। পুরুষ ততক্ষণই গুরুজনকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, যতক্ষণ সে একান্তে নারীর
কথা না শোনে। নারী কেবল আত্মসুখই চিন্তা করে। তার কাছে স্বামী-সন্তানও কিছু নয়।
তাঁতি এ-কথার প্রতিবাদ করে বলল: ভাই, অমন কথা বলো না। আমার স্ত্রী স্বামী-অন্ত প্রাণ। তাকে না বলে আমি কিছুই করিনা। কাজেই তাকে একটু জিজ্ঞেস করে আসি।
এই বলে সে বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে সব খুলে বলল। এ-ও বলল যে, নাপিত বন্ধু তাকে রাজ্য চাইতে বলেছে।
,
নাপিতের কথা শুনে স্ত্রী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল: রাখো তোমার নাপিত! ওদের আবার বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে না-কি? না-কি ওদের বিশ্বাস করা যায়? সারাক্ষণ গলার ওপর ছুরি চালায়। সুযোগ পেলে গলা কাটতে ওদের বাঁধে? শাস্ত্রে আছে না— নীচব্যক্তি, নাপিত, বালক, ভিক্ষু, বৈতালিক ও চারণ—এদের সঙ্গে বুদ্ধিমানেরা কখনো মন্ত্রণা করেনা, কারণ তা ফাঁস হয়ে যায়। তাছাড়া রাজ্য চালানো কি চাট্টিখানি কথা? একটার পর একটা ঝঞ্ঝাট লেগেই থাকে। পণ্ডিতেরা বলেন: রাজার অভিষেকের সময় কলসিগুলো শুধু গঙ্গাজলই ঢালেনা, সে-সঙ্গে নানারকম বিপদও ঢালে। আর রাজ্যের কারণে আপন ভাইও শত্রু হয়ে যায়। ইতিহাসে এমন ঘটনা বহু আছে। কাজেই ওতে আমাদের কাজ নেই।
তাঁতি এবার একটু অধৈর্য হয়ে বলল: তা তো বুঝলুম। কিন্তু কি চাইব তা বলো না। বিলম্বে কার্য নষ্ট।
স্ত্রী এবার শান্তভাবে বলল: দেখ, তুমি রোজ একটা করে কাপড় বোনো। তাতে আমাদের চলে যায়। এখন তুমি নিজের জন্য আরেক জোড়া হাত ও একটা মাথা চাও। তাহলে রোজ দুটো কাপড় বুনতে পারবে। সামনে একটা পেছনে একটা। একটার দাম দিয়ে খরচ চলবে। অন্যটার দামে অন্য কাজ করব। তাহলে স্বজাতের সকলে আমাদের মান্য করবে। আমাদের সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটবে। ইহকাল-পরকাল দুইই রক্ষা পাবে।
তাঁতি শুনে মহাখুশি। সে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল: বাঃ! প্রিয়ে, বাঃ! চমৎকার বলেছ! একেই বলে পতিব্রতা! আমি এক্ষুণি চললাম।
এই বলে তাঁতি যক্ষের কাছে গিয়ে বলল: আমার আর কিছু চাইনে, শুধু একটা মাথা ও একজোড়া হাত দাও।
যক্ষ ‘তথাস্তু’ বলতেই তাঁতির পেছন দিকে একটি মাথা ও একজোড়া হাত গজালো। তখন সে দ্বিমস্তক ও চতুর্ভুজ। এ অবস্থায় সে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরছে। গ্রামের লোকজন দেখে ভাবল রাক্ষস। তাই পাথর ছুঁড়ে এবং লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাকে মেরে ফেলল।
মন্থরকের এই করুণ কাহিনী শুনে চক্রধর অনুতাপ করে বলল: ঠিকই বলেছ, ভাই! আশার ছলনে পড়ে আমার আজ এই দশা! যথার্থই বলা হয়েছে—
মত্ত থেকে অসম্ভব ঐ আকাশ-কুসুম কল্পনায়।
ঘট ভাঙিয়া ছাতু পড়ে বিপ্রবরের সারা গায়।।
সুবর্ণসিদ্ধি: কি সে ঘটনা?
চক্রধর: শোনো….
ব্রাহ্মণ ও ছাতুর ঘট
এক গাঁয়ে থাকত এক ব্রাহ্মণ। সে ছিল স্বভাবকৃপণ। লোকে তার আসল নাম ভুলে ডাকত কিপটা বাওন বলে।
ব্রাহ্মণ রোজ ছাতু ভিক্ষে করত। খেয়ে-দেয়ে যা বাঁচত, তা একটা মাটির ঘটে ভরে শিকেয় ঝুলিয়ে রাখত। রাতের বেলা লাঠিহাতে তার নিচে শুয়ে থাকত, যাতে কেউ না নিতে পারে। এভাবে একদিন ঘটটা ছাতুতে ভরে গেল।
একদিন রাতে শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে: ঘটটা তো ছাতুতে ভরে গেছে। এখন যদি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাহলে বিক্রি করে একশ টাকা পাব। তা দিয়ে দুটি ছাগল কিনব। ছ-মাস অন্তর বাচ্চা দিলে ছাগলের এক পাল হবে। সেগুলো বিক্রি করে দুটি গাই কিনব। গাই দিয়ে দুটি মোষী কিনব। মোষী দিয়ে দুটি ঘুড়ী কিনব। তারা বাচ্চা দিলে একপাল ঘোড়া হবে। সেগুলো বিক্রি করে অনেক সোনা পাব। তা দিয়ে মস্ত বড় এক প্রাসাদ তৈরি করব। তখন কোনো এক ব্রাহ্মণ বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে তার মেয়ে বিয়ে দেবে। তার থেকে আমার এক ছেলে হবে। ছেলের নাম রাখব দেবশর্মা।
দেবশর্মা যখন হামাগুড়ি দিতে শিখবে, তখন আমি ঘোড়াশালের পেছনে বসে বই পড়তে থাকব। মায়ের কোল থেকে নেমে দেবশর্মা ঘোড়ার পায়ের কাছ দিয়ে আমার দিকে আসতে থাকবে। আমি তখন রেগেমেগে ব্রাহ্মণীকে বলব, ছেলেটাকে ধরো না। ব্রাহ্মণী তখন ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকবে। আমার কথা শুনবে না। আমি তখন লাঠি দিয়ে এভাবে তাকে মারব।
এই বলে ব্রাহ্মণ লাঠি উঁচিয়ে মারল এক বাড়ি। লাগল গিয়ে ছাতুর ঘটে। অমনি তা ভেঙে সমস্ত ছাতু ছড়িয়ে পড়ল তার গায়ে। তার সমস্ত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। চক্রধর ব্রাহ্মণের এই কাহিনী বলে চুপ হয়ে গেলে সুবর্ণসিদ্ধি বলল: ঠিকই বলেছ, ভাই। লোভ এভাবেই মানুষকে সর্বনাশের পথে টেনে নিয়ে যায়। তাইতো লোকে বলে—
লোভে পড়ে কাজ করে না ভাবিয়া ফল।
চন্দ্ররাজের মতো দশা তার হয় অবিকল।।
চক্রধর: কি হয়েছিল, চন্দ্ররাজের?
সুবর্ণসিদ্ধি: শোনো তাহলে…
চন্দ্ররাজ ও বানরদল
এক নগরে ছিল এক রাজা। নাম চন্দ্র। তার বাড়িতে ছিল একদল বানর। বানরদের সঙ্গে রাজপুত্ররা খেলা করত। নানা রকম ভালো ভালো খাবার দিত। তারাও রাজপুত্রদের নানা রকম খেলা দেখাত।
বানরদের মধ্যে একজন ছিল বয়স্ক। দলপতি। বিশাল পণ্ডিত। দেবগুরু বৃহস্পতি, দৈত্যগুরু শুক্র, মহাপণ্ডিত চাণক্য—সকলের মতামত সে জানত এবং অন্যদেরও শেখাত।
রাজবাড়িতে একদল ভেড়ার পালও ছিল। তার মধ্যে একটা ছিল ভীষণ দুষ্টু ও পেটুক। প্রায়ই রান্নাঘরে ঢুকে পড়ত এবং এটা-ওটা মুখে দিত। আর রাঁধুনিরা হাতের কাছে যা পেত তা-ই ছুঁড়ে মারত।
এসব দেখে দলপতি একদিন বানরদের ডেকে বলল: এই ভেড়ার বাচ্চাটা একদিন বিপদ ঘটাবে। তাতে আমরাও মারা যাব। তার আগে চল আমরা সরে পড়ি।
বানররা বলল: কি বিপদ হবে?
দলপতি: ধর, রাঁধুনিরা একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে চুলা থেকে আধপোড়া এক কাঠ ওর দিকে ছুঁড়ে মারল। ওর গায়ে তো পশম। তাতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠবে। ও দৌড়ে বেরিয়ে আসবে। সামনেই পড়বে ঘোড়াশাল। সেখানে আছে খড়ের গাদা। তাতে আগুন ধরবে। ঘোড়াগুলো পুড়বে। ঘোড়ার পোড়া ঘা সারাতে লাগে বানরের চর্বি। রাজা তখন আমাদের চর্বি দিয়ে ঘোড়ার ঘা সারাবে। ফলে আমাদের বংশ ধ্বংস হবে। দলপতির কথা শুনে যুবক বানরেরা হো হো করে হেসে উঠল। তারা বলল: বুড়োর ভিমরতি ধরেছে। কথায় বলে বয়স বাড়লে বুদ্ধি কমে। তখন বুড়ো আর গুড়ো সমান হয়। রাজপুত্রদের দেয়া এই সুখাদ্য ফেলে বনের ওই তেতো ফল খেতে কে যাবে? দলপতি তখন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল: ওরে মূর্খের দল! তোরা এ সুখের পরিণাম জানলি না। কিন্তু আমি নিজের চোখে এই বংশধ্বংস দেখতে পারব না। শাস্ত্রে আছে—নিজের বাড়িতে শত্রুর আক্রমণ, বন্ধুর বিপদ, বংশধ্বংস কিংবা দেশের পতন যাকে দেখতে হয়না, সে-ই ধন্য। কাজেই আমি চললাম।
এই বলে দলপতি মনের দুঃখে বনে চলে গেল।
এদিকে সত্যই একদিন সেই বিপদ ঘটল। রাজা তখন বৈদ্যের কথামতো বানরের চর্বি দিয়ে ঘোড়াগুলোর চিকিৎসা করাল। এই দুঃসংবাদ একদিন দলপতির কানে গেল। বংশধ্বংসের শোকে তার আহার-নিদ্রা টুটে গেল। সে সারা বনময় ঘুরে ঘুরে ভাবতে লাগল—এই পাপিষ্ঠ রাজার নৃশংসতার প্রতিশোধ নেয়া যায় কিভাবে। কারণ—
শত্রুহাতে কুলের ধ্বংস সহ্য করে যে-বা।
পুরুষ বলে মানে তারে এ জগতে কে-বা।।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে এক সরোবরের কাছে এসে উপস্থিত হলো। টলটলে জল। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখে সে থমকে গেল। লক্ষ্য করে দেখল—মানুষের পা একমুখী। কেবল সরোবরের দিকেই গেছে। ফিরে আসছে না। এতে তার সন্দেহ হলো। সে বুঝতে পারল—সরোবরের জলে নিশ্চয়ই এমন কেউ আছে, যে যারাই জলে নামে তাদেরই খেয়ে ফেলে।
কিন্তু তেষ্টায় তার ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তাই একটা পদ্মের ডাটা তুলে তা দিয়ে সে জল পান করল।
ঠিক এমনি সময় জলের ভেতর থেকে উঠে এল এক রাক্ষস। তার গলায় এক রত্নহার, যার ছটায় সূর্যও যেন ম্লান হয়ে যায়। সে বলল: তোমার বুদ্ধি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তুমি আমার কাছে কি চাও, বলো?
দলপতি: যদি সত্যি বলে থাক, তাহলে তোমার গলার হারটা আমায় দাও। কথা দিচ্ছি—তোমায় আমি অনেক খাবার এনে দেব।
রাক্ষস: তোমায় বিশ্বাস করা যায়। এই নাও হার।
দলপতি হার গলায় দিয়ে রাজবাড়িতে গেল। হারের ছটায় সারা বাড়ি ঝলমল করে উঠল। কথাটা একে একে রাজার কানে গেল। তার নির্দেশে দলপতিকে ভেতরে নেয়া হলো। রাজা দেখে তো অবাক! কোথায় পেলে এ হার? —রাজা জানতে চাইল। রানির তো মূর্ছা যাওয়ার পালা।
দলপতি তখন ক্রূর হাসি হেসে বলল: মহারাজ চাইলে এমন হার সবাই একটা করে পেতে পারেন।
রাজা: কিভাবে?
দলপতি: বনের মধ্যে কুবেরের তৈরি এক জলাশয় আছে। রবিবার সূর্য যখন আধখানা উঠবে, সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে যে-ই জলে ডুব দেবে, সে-ই গলায় হার নিয়ে উঠে আসবে। একথা শুনে রাজা দলপতির হাত চেপে ধরে বলল: কালই রবিবার। তুমি আমাদের নিয়ে চল না!
দলপতি অন্তরে তৃপ্তির হাসি হেসে বলল: ঠিক আছে, মহারাজ। আমি তাহলে আজ আসি। কাল আবার আসব।
রাজা তার হাত চেপে ধরে বলল: তুমি কোথাও যাবে না। তুমি আজ আমাদের অতিথি।
এই বলে রাজা দলপতির থাকার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করল। সমস্ত রকম রাজভোগ তার জন্য পাঠাল। কিন্তু স্বজন হারানোর শোক এবং প্রতিহিংসার আগুন তখন তার অন্তরে দাউ-দাউ করে জ্বলছে। তাই সে তার কিছুই স্পর্শ করল না।
পরের দিন যথাসময়ে রাজা তার পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেই সরোবরে গিয়ে উপস্থিত হলো। দলপতির কথামতো সকলে জলে নেমে ডুব দিল। দলপতি রাজাকে বলল: মহারাজ, আপনি আমার সঙ্গে আসুন। আমি যেখানে ডুব দিয়েছিলাম, আপনাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।
এ-কথার পরে রাজা দলপতির পেছনে পেছনে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কৈ, কেউ তো উঠে আসছে না! রাজা জানতে চায়।
দলপতি তখন বিজয়ের হাসি হেসে বলল: আরে মূর্খ! ওরা আর উঠবে না। ওদের রাক্ষসে খেয়েছে। বিনা কারণে তুই আমার বংশ ধ্বংস করেছিস। আমি তার প্রতিশোধ নিলাম। স্বজন হারানোর শোক কি, এবার তা বুঝে দেখ।
এ-কথা শুনে রাজা শোকে অভিভূত হয়ে টলতে টলতে বাড়ির দিকে রওনা দিল। এমন সময় রাক্ষসটা জল থেকে বেরিয়ে এসে দলপতির উদ্দেশে বলল: বলিহারি তোমার বুদ্ধি! নাল দিয়ে জল খেলে। সবংশে শত্রু নিধন করলে। আমাকে বন্ধু করলে। অদৃষ্টপূর্ব এ মণিহার পেলে। ধন্য তুমি।
এই বলে সুবর্ণসিদ্ধি চক্রধরকে বলল: তুমিও এই রাজার মতো অতিলোভে পড়ে আজ এই বিপদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ। এবার আমায় বিদায় দাও, বন্ধু। আমি বাড়ি যাই।
চক্রধর তখন করুণ কণ্ঠে বলল: চাণক্য বলেছেন—বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায় বিপদে। আর এ অবস্থায় তুমি আমায় একলা ফেলে যাবে?
সুবর্ণসিদ্ধি: কথাটা ঠিকই বলেছ, ভাই। কিন্তু সেটা সম্ভব ব্যাপারটা যখন মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে। কিন্তু এ তো এখন দৈবের হাতে। তাছাড়া তোমার মুখটা এখন সেই লেজকামড়ানো বানরের মতো দেখাচ্ছে। কাজেই আমার পালানোই ভালো।
চক্রধর: কোন বানর? কি হয়েছিল তার?
সুবর্ণসিদ্ধি: শোনো, বলছি …।
রাজকন্যা রাক্ষস ও বানর
এক নগরে ছিল এক রাজা। নাম ভদ্রসেন। তার ছিল এক কন্যা। রত্নবতী। অপরূপ সুন্দরী। এক রাক্ষস তার প্রেমে পড়েছে। তাকে চুরি করার জন্য রোজ রাতে সে আসে। কিন্তু কোনোভাবেই সফল হয় না।
একদিন সন্দেবেলা রাজকন্যার প্রাসাদের বাইরে সে ঘাপটি মেরে আছে। রাজকন্যা তখন দাসীর সঙ্গে কথা বলছিল। এক পর্যায়ে রাজকন্যা তার সখীর উদ্দেশে বলল: আজ এলে ওকে বেঁধে রাখব।
এ-কথা শুনে রাক্ষস ভাবল: নিশ্চয়ই আমার মতো আর কেউ রাজকন্যাকে চুরি করতে আসে। আজ দেখব, কে আসে।
এই বলে রাক্ষসটা আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ার রূপ ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ বাদে এক চোর এল চুরি করতে। সে আস্তাবলে গিয়ে দেখে-শুনে রাক্ষসটাকেই পছন্দ করল। দ্রুত তার পিঠে চড়ে লাগাম পরিয়ে শপাং শপাং বেত মারতে লাগল।
রাক্ষস বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে। স্বরূপ প্রকাশ পেলে ধরা পড়ে যাবে। এদিকে বেতের ঘা। তাই সে ছুটতে লাগল। ছুটছে তো ছুটছেই।
অনেকটা দূর গিয়ে চোর ঘোড়াটাকে থামাতে চাইল। কিন্তু রাক্ষস ভাবল: এ তো যে—সে চোর নয়। আমি রাক্ষস। আমাকে পর্যন্ত ভয় পায় না!
এই ভেবে সে আরো জোরে ছুটতে লাগল।
এদিকে চোর ভাবল: লাগাম মানেনা—এ আবার কেমন ঘোড়া? এ তো ঘোড়া নয়! নিশ্চয় রাক্ষস-টাক্কস হবে!
এই ভেবে সে লাফিয়ে পড়ার চিন্তা করল। এমনি সময় রাক্ষসটা একটা বটগাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। অমনি চোর একটা ডাল ধরে ঝুলে রইল। সেই ডালে ছিল এক বানর। রাক্ষসের বন্ধু। সে রাক্ষসটাকে ডেকে বলল: বন্ধু, তুমি ভয়ে পালাচ্ছ কেন? এ-তো মানুষ। তোমার খাদ্য।
এ-কথা শুনে রাক্ষস এক-পা দু-পা করে এগোতে লাগল। চোর তখন বিপদ বুঝে বানরের লেজটা মুখে পুরে চিবোতে লাগল। বানর ভাবল: একি! এতো মানুষ নয়! এ—যে রাক্ষসেরও বাপ! বানরের লেজ ধরে খাওয়া শুরু করেছে! সর্বনাশ!
ভয়ে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। তা দেখে রাক্ষস পালিয়ে গেল। লেজের বেদনায় বানরের মুখ কুচকে গেল।
সুবর্ণসিদ্ধি এবার চক্রধরের উদ্দেশে বলল: তাই বলছিলুম, মাথায় চক্র ঘোরার বেদনায় তোমারও মুখের চেহারা হয়েছে ওই বানরের মতো। কাজেই, এবার বিদায় দাও, বন্ধু, আমি যাই।
চক্রধর ম্লান হাসি হেসে বলল: তুমি যা-ই বলো, ভাই! দৈবই হচ্ছে মানুষের ভালো—মন্দের মূল কারণ। তাইতো দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য বলেছেন: ত্রিকূট পর্বত ছিল যার দুর্গ, সাগর ছিল যার পরিখা, স্বয়ং কুবের ছিলেন যার ধনদাতা, শতশত নিশাচর ছিল যার যোদ্ধা, দেবতারা ছিলেন যার আজ্ঞাবহ—সেই লঙ্কেশ্বর রাবণকেও মরতে হয়েছিল। আবার ত্রিস্তনী রাজকন্যা, এক কানা, আরেক কুঁজো—দৈববলে তারাও সুস্থ হয়ে যায়। সুবর্ণসিদ্ধি: কি রকম?
চক্রধর: শোনো বলছি …
রাজকন্যা অন্ধ ও কুঁজো
উত্তর ভারতে মধুপুর নামে এক নগর ছিল। সেখানকার রাজা ছিলেন মধুসেন। একবার তাঁর ত্রিস্তনী এক কন্যা জন্মাল। তা দেখে রাজার তো মুখ শুকিয়ে গেল। এ যে কুলক্ষণ! তাই তিনি কঞ্চুকীকে আদেশ দিলেন একে দূরের কোনো বনে ফেলে দিয়ে আসতে, যাতে কেউ জানতে না পায়।
কিন্তু বৃদ্ধ কঞ্চুকী বললেন: মহারাজ! ত্রিস্তনী কন্যা অলুক্ষুণে বটে। কিন্তু তবুও ব্রাহ্মণদের ডেকে একটু জিজ্ঞেস করলে হয় না, এক্ষেত্রে করণীয় কি? কারণ কন্যা বিসর্জনে আবার ইহকাল-পরকাল উভয়ই নষ্ট না হয়। কথায় বলে: প্রশ্ন করলে অনেক অজানা কথা জানা যায়। আর যে প্রশ্নোত্তর শুনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, তারই দিনদিন শ্রীবৃদ্ধি হয়। তাই তো রাক্ষসের হাতে ধরা পড়েও ব্রাহ্মণ বেঁচে গিয়েছিলেন। রাজা বললেন: কিভাবে?
কঞ্চুকী: শুনুন তাহলে…
রাক্ষস ও ব্রাহ্মণ
এক বনে থাকত এক রাক্ষস। নাম চণ্ডকর্মা। একদিন বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে এক ব্রাহ্মণকে ধরে ফেলল। তার কাঁধে চড়ে সে বলল: আমাকে ঐ পুকুর পাড়ে নিয়ে চলো তো দেখি।
ব্রাহ্মণ কি আর করবে? ভয়ে ভয়ে তাকে নিয়ে চলল পুকুর পানে। যেতে যেতে দেখে, রাক্ষসের পা-দুটো ভীষণ নরম। যেন পদ্মের ডাঁটা। তাই সে রাক্ষসকে জিজ্ঞেস করল: তোমার পা-দুটো এমন নরম হলো কি করে?
রাক্ষস বলল: আমার একটা ব্রত আছে। আমি ভিজে পায়ে মাটিতে পা দেই না।
এ-কথা শুনে ব্রাহ্মণ মুক্তির উপায় চিন্তা করতে করতে পুকুর পাড়ে গিয়ে পৌঁছল। ব্রাহ্মণের কাঁধে চড়েই রাক্ষস জলে নেমে স্নান করল। তারপর গিয়ে একটা আসনে বসল। ব্রাহ্মণকে বলল: আমার পুজো শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি ঐ গাছের নিচে গিয়ে বস। ডাক দিলেই চলে আসবে। পালানোর চেষ্টা করোনা আবার।
ব্রাহ্মণ ভাবল: পুজো সেরেই ও আমাকে খেয়ে ফেলবে নিশ্চয়। তাই এই ফাঁকে দৌড়ে পালাই। ব্রতভঙ্গের ভয়ে ও নিশ্চয়ই ভিজে পায়ে আমার পেছনে দৌড়বে না।
এই ভেবে ব্রাহ্মণ দৌড়ে পালালো। রাক্ষসটা সত্যিই ব্রতভঙ্গের ভয়ে তার পেছন পেছন ছুটল না।
তাই বলছিলুম, মহারাজ! ব্রাহ্মণদের ডেকে একবার জিজ্ঞেস করুন।
কঞ্চুকীর কথা শুনে রাজা ব্রাহ্মণদের ডেকে বললেন: আমার একটি ত্রিস্তনী কন্যা হয়েছে। বলুন তো একে নিয়ে আমার কি করা উচিত?
ব্রাহ্মণেরা বললেন: মহারাজ! কন্যা সন্তানের অঙ্গ যদি কম-বেশি হয়, তবে তার চরিত্র নষ্ট হয়। এ থেকে পিতার জীবন নাশের সম্ভাবনা দেখা দেয়। কাজেই আপনি ওর মুখ দেখবেন না। ওকে যদি কেউ বিয়ে করে, তাহলে তার হাতে সঁপে দিয়ে নির্বাসনে পাঠান। এতে ইহকাল পরকাল উভয়ই রক্ষা পাবে।
ব্রাহ্মণদের পরামর্শে রাজা ঘোষণা দিলেন: যে এই ত্রিস্তনী রাজকন্যাকে বিয়ে করবে, তাকে এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেয়া হবে। তবে তাকে সস্ত্রীক নির্বাসন যেতে হবে!
কিন্তু বহুদিন হয়ে গেল। কেউ এগিয়ে এল না। রাজকন্যা দিনে দিনে যৌবনে পা দিল। অতি গোপনে তাকে রাজার কাছ থেকে দূরে রাখা হচ্ছে।
ওই রাজ্যে ছিল এক অন্ধ, আর এক কুঁজো। কুঁজো লাঠিভর দিয়ে অন্ধকে পথ দেখায়, আর দুজনে ভিক্ষে করে। এভাবে তাদের জীবন চলে।
একদিন তারা পরামর্শ করল। অন্ধ বলল: আমাদের তো কিছুই নেই। নির্বাসন আর স্ববাসন আমাদের কাছে সমান কথা। আর আমাদের তো কেউ মেয়েও দেবে না। কাজেই এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে ত্রিস্তনী রাজকন্যাকে বিয়ে করে নির্বাসনে যাওয়ায় ক্ষতি কি? এতে যদি আমাদের মৃত্যুও হয় তা-ও ভালো। আমাদের জন্য তো কান্না করার কেউ নেই।
কুঁজো এ-কথায় সায় দিয়ে বলল: ঠিকই বলেছ, ভাই। দারিদ্র্যের এই কষ্ট আর সহ্য এসব তখনই হয়না। দেখ— লজ্জা, ঘৃণা, ভয়, স্নেহ, মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা–সম্ভব, যখন পেটে ভাত পড়ে। আমরা যে বেঁচে আছি, একে কি বাঁচা বলে? এর চেয়ে কুকুর-বিড়ালও ভালো আছে। তাছাড়া আমাদের তো হারানোর কিছু নেই। কাজেই তুমি এগিয়ে যাও।
কুঁজোর কথায় সাহস করে অন্ধ রাজার লোকদের গিয়ে বলল, সে রাজি। রাজার লোকেরা তাকে নিয়ে গেল রাজার কাছে। রাজা দেখে বললেন—
হোক না কানা কালা কুঠে কিংবা হরিজন।
বিয়ে করে টাকা নিয়ে যাবে নির্বাসন।।
তারপর রাজার আদেশে রক্ষীরা নদীর পাড়ে গিয়ে অন্ধের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে দিল। সেই সঙ্গে লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে মাঝিদের বলল ভিন্ন কোনো রাজ্যে এ তিনজনকে পৌঁছে দিতে। মাঝিরা তা-ই করল। কয়েকদিন নৌকো বেয়ে ভিন্ন এক রাজ্যে গিয়ে তাদের নামিয়ে দিল। তারা সেখানে ঘর তুলে তিনজন সুখেই বাস করতে লাগল।
এক পর্যায়ে কুঁজো আর রাজকন্যার মধ্যে গোপন সম্পর্ক গড়ে উঠল। কারণ চোখের ভালোবাসা আগে, মনের ভালোবাসা তার পরে। তাই দিন যত গড়াতে লাগল, রাজকন্যা এবং কুঁজোর সম্পর্ক তত গভীর হতে লাগল।
একদিন রাজকন্যা বলল, বিষ প্রয়োগে অন্ধটাকে মেরে ফেললে তাদের ভালোবাসার পথ নিষ্কণ্টক হয়। এ-কথা শুনে কুঁজো উৎফুল্ল হয়ে উপায় খুঁজতে লাগল। একদিন বনের মধ্যে হাটতে হাটতে একটা মরা কেউটে পেল। কুঁজো সেটা বাড়ি এনে রাজকন্যাকে বলল জলে সেদ্ধ করে অন্ধটাকে খাওয়াতে। তাহলে বিষক্রিয়ায় সে মারা যাবে।
রাজকন্যা তা-ই করল। কেউটেটাকে টুকরো টুকরো করে হাঁড়িতে সেদ্ধ বসিয়ে অন্ধকে বলল: ওগো, তুমি তো মাছ খেতে পছন্দ করো। তাই তোমার জন্য মাছ রান্না হচ্ছে। তুমি একটু চামচ দিয়ে নাড়াও। ততক্ষণে আমি স্নানটা সেরে আসি।
এই বলে সে চলে গেল কুঁজোর ঘরে। সেখানে গিয়ে রঙ্গরসে মত্ত হলো।
এদিকে অন্ধ চামচ দিয়ে হাঁড়ির মধ্যে নাড়তে লাগল। আর সাপের বিষাক্ত ধোঁয়ায় তার চোখের কালো পর্দা আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগল। সে আবছা আবছা দেখতে লাগল। এক পর্যায়ে তার চোখ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে গেল। সে পেছনে এক পলক তাকিয়ে দেখে তার স্ত্রী কুঁজোর সঙ্গে রঙ্গরসে ঢলে পড়ছে। তা দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেল। কিন্তু সে আগের মতোই অন্ধের ভান করে হাতড়াতে হাতড়াতে কাছে গিয়ে কুঁজোর দুই পা ধরে দিল টান। মাথার ওপর দিয়ে বনবন করে ঘুরিয়ে এমনভাবে ছেড়ে দিল যে, বজ্রের মতো পড়ল গিয়ে রাজকন্যার বুকে। তাতে তার অতিরিক্ত স্তনটা বুকের মধ্যে ঢুকে গেল। আর বোঁ-বোঁ শব্দে ঘূর্ণনের ফলে কুঁজো গেল সোজা হয়ে। এভাবে তিন বিকলাঙ্গই স্বভাবিক জীবন লাভ করল।
চক্রধরের এসব কথা শুনে সুবর্ণসিদ্ধি বলল: ভাই, তুমি ঠিকই বলেছ। দৈব অনুকূল হলে সবই ভালো হয়। কিন্তু সজ্জনের কথাও মেনে চলা উচিত। তা যে না করে, তার অবস্থা হয় সেই দুমুখো ভারও পাখির মতো
চক্রধর: কিরকম?
সুবর্ণসিদ্ধি: শোনো তাহলে…
দুমুখো ভারও
সমুদ্রের ধারে থাকত এক ভারও পাখি। তার দুই মাথা ও দুই মুখ। সমুদ্রের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসা নানারকম ফল সে খেত। এভাবে সুখেই তার দিন কাটছিল।
একদিন সে এক অদ্ভুত ফল পেল। কি তার স্বাদ! কি তার মিষ্ট গন্ধ! আঃ! তার মনে হলো—এ নিশ্চয় স্বর্গের পারিজাত কিংবা হরিচন্দন বৃক্ষের ফল। অমৃত এর কাছে কিছুই না। সে দারুণ তৃপ্তিভরে ফলটা খাচ্ছে।
তখন অন্য মুখ বলছে: ভাই, আমাকে একটু দাওনা! খেয়ে জীবনটা সার্থক করি।
প্রথম মুখ বলল: দেখ, আমাদের মুখ দুটি বটে, কিন্তু উদরতো একটিই। কাজেই আমি খেলেও যে-কথা, তুমি খেলেও সে-কথা। খিদা দুজনেরই মিটবে। সুতরাং আলাদা খেয়ে আর কি লাভ?
দ্বিতীয়: মুখের স্বাদ বলতেও তো একটা কথা আছে।
প্রথম: আরে সে তো ক্ষণস্থায়ী। গলার ওপাশে গেলে তিতা-মিঠা, টক-ঝাল সবই এক। তার চেয়ে কিছুটা ভারণ্ডীকে দিলে সে খুশি হবে।
এই বলে সে বাকি অংশ ভারণ্ডীকে দিল। ভারণ্ডী তো ফল খেয়ে মহাখুশি। সে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল প্ৰথম মুখকে।
এ-সব দেখে দ্বিতীয় মুখ তো মহা খাপ্পা! একেতো সেই অমৃত ফলের স্বাদ না পাওয়া। দ্বিতীয়ত প্রথম মুখকে ভারণ্ডীর এই আদর। তাই সে মনে মনে অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার সংকল্প করল।
অন্য একদিন ভারও পাখিটি সমুদ্রের তীরে চরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দ্বিতীয় মুখ একটা বিষফল দেখতে পেল। সে সেটা মুখে নিয়ে প্রথমকে বলল: এই দেখ, সেদিনকার অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছি।
প্রথম চিৎকার করে বলে উঠল: আরে মূর্খ! কি করছিস? ওতো বিষফল! খেলে দুজনেরই মৃত্যু হবে!
দ্বিতীয়: তা হোক। আমি অপমানের প্রতিশোধ নিতে চাই।
এই বলে সে বিষফলটা খেয়ে ফেলল। আর বিষক্রিয়ায় দুজনেরই মৃত্যু হলো। সুবর্ণসিদ্ধি চক্রধরের উদ্দেশে বলল: তাই বলছিলুম, সজ্জনের পরামর্শ যারা না শোনে, তাদের এভাবেই মৃত্যু হয়।
চক্রধর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল: ঠিকই বলেছ, ভাই। তাহলে তুমি এবার বাড়ি যাও। তবে একা যেওনা। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেও। পণ্ডিতেরা বলেন—সুস্বাদু জিনিস একা খেতে নেই। সবাই ঘুমুলে একা জাগতে নেই। একা-একা পথে যেতে নেই। আর একা-একা অর্থলাভেরও চিন্তা করতে নেই। তাই তো শাস্ত্র বলছে—
পথের সাথী তুচ্ছ হলেও সঙ্গে নিতে হয়।
সঙ্গে কাঁকড়া ছিল বলে বিপ্ৰ বেঁচে যায়।।
সুবর্ণসিদ্ধি: কি সে ঘটনা?
চক্রধর: শোনো, বলছি …
ব্রহ্মদত্ত কাঁকড়া ও সাপ
এক গাঁয়ে থাকত এক ব্রাহ্মণ। নাম ব্রহ্মদত্ত। একদিন এক জরুরি প্রয়োজনে তাকে ভিন গাঁয়ে যেতে হবে। মা বললেন: একা যাসনে। সঙ্গে কাউকে নিয়ে যা।
ব্রহ্মদত্ত: ভয় কি, মা? এ-পথে কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই। কাজ পড়েছে। তাই যেতে হবে।
মা দেখলেন, ব্রহ্মদত্ত যাবেই। তাই পাশের পুকুর থেকে একটা কাঁকড়া ধরে এনে বললেন: যাবেই যখন, সঙ্গে এই কাঁকড়াটা নিয়ে যা। কাজে লাগবে।
মার কথা শুনে ব্রহ্মদত্ত কাঁকড়াটাকে কপূরের থলিতে পুরে রওনা দিল।
খাঁ-খাঁ রোদে চারিদিক যেন পুড়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মদত্ত খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই পথিমধ্যে এক গাছের নিচে বসে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
গাছের কোটরে ছিল এক গোখরো সাপ। কর্পূরের গন্ধ সাপের খুব প্রিয়। তাই সাপটা কোটর থেকে বেরিয়ে এসে যেই থলিটা ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকেছে, অমনি কাঁকড়া তার গলা কামড়ে ধরে মেরে ফেলল। ব্রহ্মদত্ত ঘুম থেকে উঠে মৃত সাপটাকে দেখে বুঝতে পারে যে, কাঁকড়াই সাপটাকে মেরেছে। সে তখন খুশি হয়ে বলল: ভাগ্যিস মা কাঁকড়াটাকে সঙ্গে দিয়েছিলেন। নইলে সর্পাঘাতে আজ আমার নির্ঘাত মৃত্যু হতো। মা ঠিকই বলেছেন, একা কোথাও যেতে নেই। ছোট হোক বড়ো হোক, সঙ্গী একজন থাকা প্রয়োজন। তাই তো শাস্ত্রও বলেছে―
মন্ত্রে তীর্থে গুরু-ব্রাহ্মণে
দৈবজ্ঞে ওষুধে ভগবানে।
বিশ্বাস আছে যার যেমন
ফল পায় সে তার তেমন।।
এই বলে ব্রহ্মদত্ত যেখানে যাচ্ছিল, সেখানে চলে গেল। চক্রধর সুবর্ণসিদ্ধির উদ্দেশে বলল: তাই বলছিলুম—তুচ্ছ হলেও পথের সাথী কেউ একজন থাকা প্রয়োজন। সুবর্ণসিদ্ধিও এ-কথা স্বীকার করে চক্রধরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল।
সমাপ্ত