অপত্য
কালিদাসের অভিজ্ঞান-শকুন্তল নাটকে একেপ্রায় শেষ দৃশ্য। দুর্বাসার শাপে লুপ্তস্মৃতি দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে হারিয়ে ফেলেছেন বটে কিন্তু মৎস্য-গর্ভ থেকে তাঁর স্বনামাঙ্কিত, অঙ্গুরীয়টি উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই তিনি ‘হা শকুন্তলা! কোথা শকুন্তলা!’ করে বিরহাতুর দিন কাটাচ্ছিলেন। রাজসভায় প্রত্যাখাত শকুন্তলা মহর্ষি মারীচের আশ্রমে সুখপ্রসবা হয়েছেন। জন্ম দিয়েছেন এমন এক পুত্রের, যাঁর নামে এই উপমহাদেশ ভারত নামে বিখ্যাত হবে এবং সেই ভারতে বসবাসকারী মানুষেরা ভারতীয় বলে চিহ্নিত হবে বলে বিষ্ণুপুরাণ জানিয়েছে—বর্ষং তদ ভারতং নাম ভারতী যত্র সন্ততিঃ। এই বিখ্যাত ভরতের জননীর সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল বিরহাতুর দুষ্যন্তের—তিনি স্বর্গ থেকে ফিরছিলেন—পথে মারীচ মহর্ষির আশ্রমে প্রবেশ করেছিলেন তাঁকে প্রণাম জানিয়ে যাবার জন্য।
মারীচের আশ্রমেই পুনর্মিলন হয়ে গেল দুষ্যন্ত-শকুন্তলার। হর্ষোৎফুল্ল দুষ্যন্ত যখন বিদায় নিচ্ছেন আশ্রম থেকে, তাঁকে তখন ব্রহ্মপুত্র প্রজাপতি মারীচ আশীর্বাদ উচ্চারণ করে বললেন—আজ বড়ো সৌভাগ্যের দিন। তোমার এই স্ত্রী সাধ্বী শকুন্তলা, এই রকম সমৃদ্ধিমান তোমার অপত্য আর তুমি নিজে—দিষ্ট্যা শকুন্তলা সাধ্বী সদপত্যম ইদং ভবান—উপমার নিদর্শনায় এই তিনের সমাগমে যেন শ্রদ্ধা, বিত্ত এবং শাস্ত্রবিধি একত্র সঙ্গত হল। এখানে শকুন্তলা শ্রদ্ধা এবং দুষ্যন্তকে বিধি বলা হল কেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তর্ক বোধহয় এটাই যে এই স্বামী-স্ত্রীর পুত্রকে বলা হল ‘সদ অপত্যং’ এবং তার তুলনা হল স্বামী-স্ত্রীর নবলব্ধ এক বিরাট সম্পত্তি হিসেবে—সরলভাষায় পুত্র সম্পদ।
অপত্য-কথাটার তাৎপর্য কিন্তু পুত্রের সম্পত্তি-ভাবনার মধ্যেই শুধু আবদ্ধ নয়, বরঞ্চ তার চেয়েও অনেক বড়ো এক পারলৌকিক মুক্তির নিশ্বাস আছে এই অপত্য শব্দের মধ্যে এবং এটা প্রথম জানিয়েছিলেন মহামতি যাস্ক—খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৈদিক শব্দরাশির একটি কোষগ্রন্থ লিখে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। যাস্ক পুত্র-শব্দের অন্তত পনেরোটি প্রতিশব্দ বা পর্যায় শব্দের কথা বলেছেন যেগুলি বেদে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সমস্তগুলি একত্রিত করার পর যাস্ক কিন্তু অপত্য শব্দটিকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়ে বলেছেন—এগুলি হল অপত্যের পর্যায়বাচক শব্দ—ইতি অপত্য নামানি পঞ্চদশ। এতগুলি পুত্রনামের মধ্যে অপত্য শব্দটাকেই কেন তিনি এত প্রাধান্য দিচ্ছেন, সেটা বোঝানোর জন্য তিনি এই শব্দটির ধাতুমূল ধরে বিচার করে বলেছেন—কেন অপত্য বলছি এই শব্দটাকে—অপত্যং কস্মাৎ? কেননা পিতার কাছে আসার পর এ নিজেও আবার পৃথকভাবে আরও বিস্তার লাভ করে আরও ব্যাপ্ত হয়—পিতৃ সকাশাদ এতৎ পৃথগিব ততং ভবতি।
অপত্য-শব্দের এই অর্থটিই পঞ্চম-ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দের এই মহামান্য কোষকারকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফ্রয়েড সাহেবের পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে—যিনি ‘রিপ্রোডাকশন’ এবং ‘সাসটেনান্স’কে পৌরুষেয় যৌনতার অন্তর্গত মূল বলে জানিয়েছেন। মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকার যে ইচ্ছেটা আছে, সেটা জীবিতাবধি নয়, মরণের পরেও তাঁর মনে হয় যেন এই সুন্দরী পৃথিবীতে তিনি থেকে যাবেন অন্য কোনো রূপে অন্য কোনো নামে। এই অতীপ্সিত নাম-রূপের মূর্ত চেহারাই হল অপত্য বা পুত্র-কন্যা। লক্ষণীয়, সংস্কৃতের অনেক শব্দই তার ধাতুমূলে একটা সমাজতাত্ত্বিক ভাবনা তুলে ধরে যেখানে অপত্য-শব্দের তাৎপর্য আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সংস্কৃতে ‘জায়া’ শব্দের অর্থভাষা এটাই যে, একজন পুরুষ পিতা যেহেতু জায়ার মাধ্যমে পুনর্বার জন্মায়, তাই স্ত্রীকে বা পত্নীকে জায়া বলা হয়—জায়ায়াস্তদ্ধি জায়াত্বং যদস্যাং জায়তে পুনঃ।
আমাদের বক্তব্য—যাঁর মাধ্যমে পুরুষ আবার জন্মাচ্ছে—এখানে জন্মের মাধ্যমের চেয়েও পুরুষের আরও এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পর্যন্ত বেঁচে থাকার তাৎপর্য নিয়েই অপত্য-শব্দের সার্থকতা তৈরি হয়—অপত্যের মাধ্যমে পিতা আরও বিস্তার লাভ করেন—ততং ভবতি। নিজেকে বিস্তারিত উত্তরাধিকারের মধ্যে স্থাপন করার কথাটা মানুষ যদি সাধারণভাবে না বোঝে, তাই মানুষকে খানিক আধ্যাত্মিক ভয় দেখিয়ে যাস্ক আবার বলেছেন—নানেন পততীতি বা—অর্থাৎ যে জন্মালে পুরুষ-পিতার আর পতন হয় না, নরকে পতন হয় না, সেইজন্যই তার নাম অপত্য। এই বিকল্প ভাষ্য ঘুরিয়ে একই কথা জোর দিয়ে বলছে অপত্য-লাভের ভাবনা তোমাকে করতেই হবে, তা নইলে নরকে গতি হবে তোমার। তার মানে, তুমি এক আছ, বহু হও এবং বংশের পরম্পরা তৈরি করো।
আমরা বেশ বুঝতে পারি যে, নরক কিংবা পতনের কথাটা বাড়াবাড়ি, কিন্তু নিজেকে বিস্তারিত করে পরম্পরা রক্ষার যে তাগিদ, সেটা বৈদিককালেই ঋষি-মুনিরা বুঝেছিলেন বলেই দেবতার কাছে তাঁরা অপত্যলাভের প্রার্থনা করেছেন বারবার। অবশ্য অপত্য-লাভের জন্য বৈদিক আর্যজনজাতির আকূতি আমরা বুঝি—একটি পশুপালক জাতি দূর থেকে এসে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। পঞ্চনদীর তীরে পৌঁছোতেই অনেক যুদ্ধবিগ্রহ করতে হয়েছিল তাঁদের। তারপর সেখান থেকে আবার সরস্বতী-দৃষদবতী নদীর মধ্যস্থানে আসা, তারপর আবার গঙ্গার স্রোতধৌত অঞ্চলগুলি দিয়ে পুব দিকে যাত্রা—এ যাত্রায় যুদ্ধবিগ্রহ অনেক ছিল—ফলত প্রয়োজন ছিল পুরুষের প্রয়োজন ছিল বীর পুত্রের ঋগবৈদিক ভাষায় অপত্যের—যথা রয়িং সর্ববীরং নশামহা/অপত্যসাচং শ্রুত্যং দিবে দিবে।
পরম্পরাক্রমে বিস্তারিত হওয়ার জন্য অপত্য-শব্দের ব্যাখ্যায় যে ধাতুটি যাস্ক ব্যবহার করেছেন, সেটি হল ‘তন’ ধাতু, যার অর্থই হল বিস্তার করা, বিস্তারিত হওয়া—তনু বিস্তারে। এই ধাতু থেকে অপত্য শব্দ, তেমনই একই ধাতু থেকে সন্তান এবং সন্ততি—সম্যকভাবে যা বিস্তারিত হয়—এখানেও কিন্তু সেই একই ভাবনা—এই ভাবনা বেদ থেকে মহাভারতের কালে কীভাবে নেমে এসেছে, তার সামান্য একটা উদাহরণ দিই। মহাভারতে মহারাজ শান্তনু ঔরসে গঙ্গার গর্ভে জন্ম হয়েছিল দেবব্রতের—ভবিষ্যতে ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে যিনি ভীষ্ম নামে পরিচিত হবেন।
দেবব্রত যখন ভীষ্ম হননি, তখন মহারাজ শান্তনু ধীবরকন্যা সত্যবতীর রূপে মুগ্ধ হলেন এবং তাঁকে বিবাহ করতে চাইলেন। অবধারিত সেই শর্ত এল—দেবব্রতের রাজা হওয়া চলবে না, বিবাহ করাও চলবে না। অর্থাৎ দেবব্রতের বংশপরম্পরা স্তব্ধ করে দেবার ব্যবস্থা হয়ে গেল। পিতা শান্তনু এই শর্ত শুনে পিছিয়ে এলেন বটে, কিন্তু সেটার মধ্যে এক কপট-নাটকের প্রস্তাবনা লুকিয়ে ছিল। তাই দেবব্রত যখন পিতাকে খানিক আনমনা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন—কী হয়েছে তাঁর—তখন কথায় কথায় বেরিয়ে এল সত্যবতীর কথা এবং সেই সত্যের কথা। তাই বলে দেবব্রতের জন্য তিনি যে অশেষ মায়ায় সত্যবতীর কথা ভুলে যাচ্ছেন তা নয়, বরঞ্চ তিনি কুমার দেবব্রতকে অপত্যের তত্ত্ব বোঝালেন খানিক। দেবব্রতের মতো এক উপযুক্ত পুত্র থাকতেও শান্তনু তাঁকেই বললেন—বৎস! তোমার জন্যই তো আমার এত দুশ্চিন্তা। মানুষের জীবন কোথায়, কী যে হয়। তার মধ্যে সারা দিন-রাত তো তুমি যুদ্ধ-যুদ্ধ করে পাগল হচ্ছ। তুমি তো আমার একটাই মাত্র ছেলে। তাই ভয় হয়। কোনোভাবে তোমার কিছু হয়ে গেলে এই বংশ এখানেই শেষ—কথঞ্চিৎ তত্র গাঙ্গেয় বিপত্তৌ নাস্তি নঃ কুলম।’
শান্তনু খুব ‘নেইভলি’ কুমার দেবব্রতের কাছে সত্যবতীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করছেন। একদিকে দেখাচ্ছেন যেন তাঁর এই ছেলের মতো ছেলে হয় না, অন্যদিকে তিনি তাঁর ভোগবাসনার কথাটাও অতিসূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে দিচ্ছেন বংশপরম্পরা রক্ষার মহান দায়িত্বের সঙ্গে। শান্তনু বললেন—বাছা! একথার মধ্যে এতটুকু ভুলও নেই যে, তুমি আমার একশো ছেলের বাড়া এক ছেলে, তুমি একাই একশো—শতাদপি বরঃ সুতঃ—আর সেইজন্যই আমি শুধু শুধু আর বিয়ে করতে চাই না। শুধু চাই, এই বংশের পরম্পরা-বিস্তার যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য তুমি শুধু সুস্থ থাকো। লোকে কী বলে জানো? লোকে বলে—এক ছেলে থাকাও যা, অপত্যহীনতাও তাই—অনপত্যঞ্চ একপুত্রত্বমিত্যাহুর্ধর্মবাদিনঃ। অর্থাৎ এক ছেলে থাকাও যা, কোনো ছেলে না থাকাও তাই। সত্যি কথা বলতে কী—আমাদের ধর্মকর্ম, অগ্নিহোত্র, বেদ-বেদাঙ্গের জ্ঞান এবং অখিন্ন-ছেদশূন্য একটা বংশপরম্পরা—এইসব কিছুই অপত্যলাভের মতো একটা বিশাল ঘটনার ধারেকাছেও যায় না—সর্বান্যেতানি অপত্যস্য কলাং নার্হতি ষোড়শীম। অর্থাৎ অপত্যলাভকে যদি ষোলো আনা বলি, তাহলে তার তুলনায় অন্য সব কিছু এক আনা। সেকালের উপমায় চাঁদের ষোলো কলা হল অপত্য বা সন্তান, আর অন্য সবকিছু চাঁদের এককলা।
আমরা অপত্য-লাভের প্রসঙ্গে মহারাজ শান্তনুর প্রসঙ্গ টেনে আনলাম এইজন্য যে, এইখানেই অপত্য-শব্দের মুখ্য তাৎপর্যটুকু একেবারে তৎকালীন সমাজ-মানসের প্রতিবিম্বভাবে ধরা পড়েছে। লক্ষণীয়, অনেকে অপত্য-শব্দটাকে স্নেহের সঙ্গে যুক্ত করে অপত্যস্নেহের ব্যাপারটাকে পুত্রস্নেহের চেয়েও অধিক গুরুতর এবং ঘনতর কোনো স্নেহপদার্থ বলে মনে করেন। তাঁদের জানাই, পুত্র স্নেহের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অপত্যস্নেহ শব্দটা অজ্ঞাত সংস্কৃত শব্দের একটা অধিক্ষেপ ভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাঁরা ভাবেন অনুষ্ণ বর্ণের প্রয়োগে অপত্য-শব্দের মধ্যে বুঝি স্নেহের মাত্রাতিরিক্ত রসমাধুর্য নিহিত আছে। বস্তুত কিন্তু তা মোটেই নয়, অপত্যের মধ্যে সন্তান-স্নেহের সাধারণ বাৎসল্য ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত কিছু নেই এবং মাত্রাতিরিক্ত যেটা আছে, সেটা ওই বংশধারা অক্ষত রাখার প্রাচীন চেষ্টা।
তবে এরই মধ্যে অপত্য-শব্দের ভাষ্যে একটা সুখের খবরও দেওয়া যায় এবং সে সুখটা এই যে, অপত্য বলতে শুধু পুত্রই বোঝায় না, কন্যাও বোঝায়। অর্থাৎ প্রাচীনকালে বংশপরম্পরা বিস্তারিত করার যে দুর্ভাবনা ছিল, সেটা যে কন্যা-সন্তানের মাধ্যমেও সম্ভব, সেই তাৎপর্যটা কিন্তু অপত্যশব্দের একটা বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ একটা বিশেষ বংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখা নয়, নিজেকে বহুলভাবে জড়িয়ে দেওয়াটা যে কন্যাসন্তানের মাধ্যমেই সম্ভব সেই শুভ চিন্তাটাও অপত্য ভাবনার একটা অঙ্গ। সম্ভবত সেই কারণেই অপত্য শব্দটি সংস্কৃতে পুংলিঙ্গও নয়, স্ত্রীলিঙ্গও নয়, এটি ক্লীবলিঙ্গ শব্দ। ছোটবেলায় পাণিনি ব্যাকরণের তদ্ধিত প্রত্যয় শেখার সময় ‘দাশরথি’ কিংবা ‘আর্জুনি’ পদটি ভেঙে বলার সময় বলতে হত—’দশরথস্য অপত্যং পুমান’ অর্থাৎ দশরথের পুরুষ সন্তান হল দাশরথি; অর্জুনের পুরুষ সন্তান হল আর্জুনি। এই যে আলাদা করে পুমান বা পুরুষ অপত্যের কথা বলে তদ্ধিত প্রত্যয় যুক্ত করতে হচ্ছে তাতেই পরিষ্কার বুঝি যে, বংশপরম্পরা বহনের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকও অপত্য-শব্দের অর্ধেক তাৎপর্য বহন করে। একথা সবচেয়ে ভালো বোঝা যাবে মহাভারতের একটি ঘটনায়।
মহাভারতের বিখ্যাত একটি উপাখ্যান হল সাবিত্রী-সত্যবানের উপাখ্যান। এখানে সাবিত্রীর বাবা মদ্রদেশের রাজা অশ্বপতি তাঁর কন্যাজন্মের আগে পুত্রলাভের উদ্দেশেই তপস্যা আরম্ভ করেছিলেন। যৌবন অতীত হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো পুত্র না হওয়ায় অশ্বপতি গায়ত্রীস্বরূপা সাবিত্রী দেবীর আরাধনা-তপস্যা আরম্ভ করলেন। এইভাবে আঠেরো বছর কেটে গেল। রাজার এক লক্ষ হোম করার সংকল্প এবং অপার কৃচ্ছ্রসাধনের পর অগ্নিহোত্র হোমের কুণ্ড থেকেই আবির্ভূতা হলেন দেবী সাবিত্রী। রাজা অশ্বপতিকে তিনি বর চাইতে বললেন তুষ্টির প্রতিদান দিয়ে। অশ্বপতি পরিষ্কার জানালেন—আমি বংশপরম্পরাবাহী অপত্য-লাভের বাসনায় এতকাল ধরে তপস্যা করেছি, আমাকে বহু বহু পুত্রলাভের বর দিন, যে পুত্রেরা আবার এই কুলের কথা ভাববে—
অপত্যার্থঃ সমারম্ভঃ কৃতো ধর্মেপ্সয়া ময়া।
পুত্রো মে বহবো দেবি ভবেয়ুঃ কুলভাবনা।।
এখানে অশ্বপতি প্রথমে বংশকর অপত্যের কথা বলেছেন, তারপর অপত্যকে বিশেষিত করে বহু পুত্রলাভের বর চেয়েছেন। কিন্তু বরদা সাবিত্রী স্ত্রী বলেই বোধহয় তাঁর ভাবনার মধ্যে স্ত্রীলোকের হৃদয়যন্ত্রণার অনুভব ছিল। তিনি রাজাকে বললেন—আমি জানতাম, তুমি পুত্রলাভের জন্যই এই তপস্যা করেছো। কিন্তু তুমি আমার কথা শোনো। আমার বরে খুব ব্যক্তিত্বময়ী একটি কন্যা লাভ করবে তুমি—কন্যা তেজস্বিনী সৌম্য ক্ষিপ্রমেব ভবিষ্যতি। ভগবান ব্রহ্মার নির্দেশে আমি এই বর দিয়েছি এবং এরপরে তুমি আর একটি কথাও বলবে না। অর্থাৎ এখানে কোনো তর্ক চলবে না—আমি পুত্র চেয়েছি, কেন পুত্র পেলাম না—এসব তর্ক চলবে না এখানে।
রাজা অশ্বপতি শীঘ্রই স্ত্রী মালবীর গর্ভে একটি কন্যা লাভ করলেন এবং তিনি তার নামও রাখলেন সাবিত্রী। সাবিত্রী-সত্যবানের কাহিনির মধ্যে আমরা ঢুকছি না। আমরা শুধু বলতে চাই অপত্য শব্দের মধ্যে পুত্রের অনুষঙ্গ যতখানি কন্যার ঠিক ততখানি। তা না হলে দ্রৌপদীর মতো মহাভারত-সার এক রমণী দুষ্টজনের সামনে এই সগর্ব উচ্চারণ করতেন না যে, ‘ওরে শোন! আমি মহারাজ দ্রুপদের কন্যা-অপত্য। লোকে আমাকে কৃষ্ণা বলে ডাকে; আমি পাঁচজন পুরুষকে স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছি, তাদের কথা তুই শুনেছিস নিশ্চয়—অপত্যস্মি দ্রুপদস্য রাজ্ঞঃ/কৃষ্ণেতি মাং শৈব্য বিদুর্মনুষ্যাঃ।
দ্রৌপদী-কৃষ্ণা নিজেকে দ্রুপদরাজার অপত্য বলে যে গর্বোক্তি করেছেন, তাতে অপত্য-অর্থের মধ্যে পুত্রের মতো স্ত্রীলোকেরও পরিসর আছে, এটাই প্রমাণ হয়। তবে অপত্য শব্দের মুখ্য তাৎপর্যে পরম্পরাবাহী বংশরক্ষার যে তাৎপর্য, সেটা সবথেকে ভালোভাবে প্রমাণ করেছেন প্রজাপতি দক্ষ। সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় ব্রহ্মা তাঁর মানসপুত্রদের প্রজা সৃষ্টি করতে বলেছিলেন। প্রজা মানে কিন্তু পুত্র-কন্যা—প্রজায়তে যতঃ, অর্থাৎ যাদের থেকে পুনরায় প্রজনন সম্ভব হয়, তাদেরই প্রজা বলা যায়। প্রজা মানে—সাধারণ অর্থে পুরুষ-নারী। কিন্তু সৃষ্টির প্রথম পর্বে ব্রহ্মা তাঁর পুত্রদের প্রজা সৃষ্টি করতে বললে, তাঁরা অনেক পুত্র উৎপাদন করে প্রজাপতি বলে বিখ্যাত হলেন। এখানেই টিপ্পনীটা দরকার যে, যাঁরা বিয়ের ‘কার্ডে’ ওপরে একবার ‘প্রজাপতয়ে নমঃ’ লিখে ওপরে একখানি প্রজাপতির রঙিন ছবি সরবরাহ করেন। তাঁরা একেবারেই জানেন না যে, বৈবাহিক প্রজননধর্মিতা স্মরণ করেই কিন্তু সৃষ্টিকালের আদি পিতাদের সাধারণ উপাধি বৈবাহিক পত্রে লেখা হয় ‘প্রজাপতয়ে নমঃ’। তা নইলে পতঙ্গ প্রজাপতির কোনো মর্মার্থ নেই বিবাহের কোনো প্রসঙ্গে—এটি কোনো চিত্রকরের মূর্খের প্রতি কৌতুক।
ঠিক এই প্রজননী ভূমিকায় অপত্য-শব্দের তাৎপর্যটুকু স্ত্রীলোকের প্রাধান্যে গ্রহণ করেছিলেন প্রজনন-দক্ষ দক্ষ-প্রজাপতি। তিনি ব্রহ্মার পুত্রদের মতো পুত্র উৎপাদন না করে ষাটটি কন্যার জন্ম দিলেন বীরিণীর গর্ভে। সেই কন্যাদের দশটিকে তিনি বিয়ে দিলেন ধর্মের সঙ্গে; তেরোটি কন্যা দিলেন কশ্যপ প্রজাপতির হাতে, সাতাশটি মেয়ে তুলে দিলেন চন্দ্রের হাতে, চারটি অরিষ্টনেমিকে, দুটি বহুপুত্রকে, দুটি কৃশাশ্বকে এবং দুটি অঙ্গিরাকে। এবার এদের গর্ভে যেসব পুত্র-কন্যা জন্মাল, তাতে দেবতা, অসুর এবং মানুষে এই সমস্ত জগৎ ভরে গেল—দেবাসুর-মনুষ্যাদি তাভ্য সর্বমভূজ জগৎ। তাই বলি, অপত্য শব্দের বংশবিস্তারিকা শক্তিটুকু মেয়েদের মধ্যেই বেশি আছে—এই তত্ত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বুঝেছিলেন বলেই প্রজাপতি দক্ষের নাম দক্ষ।